চক্রবৎ
লেখক: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ। কার্বনিয়াদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমাদের সিলিক সমাজে যে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে এই সিলিক সংসদে বিশেষজ্ঞের মতামত দেবার জন্য আমন্ত্রণ পেয়ে আমি গর্বিত।
তবে শুরুতেই বলি, এই সমস্যার সমাধানের কোনো পথ আমার জানা নেই। এ-বিষয়ে আমি একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে কেবলমাত্র আমার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণটুকুই পেশ করব। তার ভিত্তিতে এর সমাধানের পথ, যদি আদৌ তেমন কিছু থেকে থাকে, তা নির্ণয়ের দায়িত্ব এই সংসদের।
তবে, বিশ্লেষণটি করবার জন্য, প্রথমে এই কার্বনিয়াদের উদ্ভব ও ইতিহাস বিষয়ে কিছু জানানো প্রয়োজন। আমি জানি, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ এ-বিষয়ে আমার চেয়েও বেশি অবহিত। যেমন আমার বন্ধু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রফেসর ত্রিক্সা-৫। সাম্প্রতিক কার্বনিয়া মডেলগুলির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে কিংবা তাদের পূর্বসূরী কার্বনযন্ত্র সোলার্জিয়া-এক ও সোলার্জিয়া-দুই এই সবগুলির বিষয়েই তিনি একজন অগ্রগণ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বা তাঁর সমগোত্রীয় আইনপ্রণেতারা সচ্ছন্দে বক্তৃতার এই অংশটি এড়িয়ে যেতে পারেন।
তবে এই সংসদে এমন অনেক জনপ্রতিনিধি রয়েছেন যাঁরা এ-বিষয়ে বিশেষ অবহিত নন। তাঁদের কেউ শিল্পী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ দার্শনিক আবার কেউ বা পেশাদার রাজনীতিবিদ। অতএব এ-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে এই প্রেক্ষাপটটটা তাঁদের জানা জরুরি।
তাঁদের সুবিধার্থে আমি আমার বক্তব্যকে যথাসাধ্য সরল ও সহজবোধ্য রাখবার চেষ্টা করব। তা সত্ত্বেও কারো কোথাও কোনো অসুবিধা হলে সচ্ছন্দে আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশকে বুঝতে গেলে এই ‘গাইয়া’ গ্রহে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার সৃজনের বিষয়ে স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটি প্রথমে জানা প্রয়োজন।
অতিদূর অতীতে এই গ্রহের আবহমণ্ডল ভয়াবহ ছিল। বিজ্ঞানীদের অনুমান, সেই ‘অতিক্ষরণ’ যুগে এই গ্রহের আকাশে মিনিটে ছিয়াশি লক্ষ বিদ্যুৎক্ষরণ ঘটত ও তার কমপক্ষে দশ শতাংশ বজ্রপাতে বদলে যেত।
ফলে, বলা যায়, সেই সময় প্রাণহীন এই গ্রহ নিঃসন্দেহে এক মৃত্যুভূমি ছিল। তবে যতই ভয়াবহ হোক, প্রকৃতপক্ষে এই বজ্রপাতগুলিই সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ ছিল। কারণ, বিজ্ঞানীদের অনুমান, এমনই কোনো বজ্রপাত এই গ্রহে প্রথম প্রাণসৃষ্টি করে।
আমি তার বিশদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় যাব না। কেবল এইটুকুই বলা যথেষ্ট হবে যে এই বজ্রপাতগুলো এই পাথুরে গ্রহের বহিত্বকে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মৌল ও যৌগের আণবিক গঠনকে নিয়মিত বদলে দিত ও তার ফলে তাদের মধ্যে নতুন নতুন ধর্মের সৃষ্টি হত। আজ থেকে সাঁইত্রিশ কোটি সময়-একক আগে, অধুনা ভিলিয়াস প্রস্তরভূমির কোনো এক প্রান্তে কোনো একটি ভয়াবহ বজ্রপাত সেখানে পাথরের দেহে ছড়িয়ে থাকা সিলিকনের ছোটো ছোটো স্ফটিকের আণবিক সজ্জাতে একটা বিশেষ বদল আনে। এই বদলের ফলে পরিবর্তিত সিলিকন স্ফটিকেরা সুর্যালোক থেকে শক্তিসঞ্চয় করবার ক্ষমতা পায়। এবং শক্তিসঞ্চয়ের পাশাপাশি তাড়িতিক আবেশ কাজে লাগিয়ে নিজেদের সেই বিশিষ্ট আণবিক সজ্জাকে অন্য সিলিকন স্ফটিকে সঞ্চারিত করবার ক্ষমতাও অর্জন করে।
এই যে নিজের অস্তিত্বরক্ষার জন্য প্রকৃতি থেকে সরাসরি শক্তিসঞ্চয় ও তাকে ব্যবহার করে বংশবৃদ্ধি, এই দুই বৈশিষ্ট্যের জন্মকেই বিজ্ঞানীরা গাইয়া-র বুকে সিলিকনভিত্তিক প্রাণসৃষ্টির ঊষালগ্ন বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এর পরবর্তী পঁয়ত্রিশ কোটি সময়-এককের ইতিহাস মূলত এই আণুবীক্ষণিক সিলিকন জীবদের বিবর্তনের ইতিহাস। তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে। কেবল এইটুকুই বলা যথেষ্ট হবে যে সৃষ্টির পরবর্তী এক কোটি সময়-একক ধরে বায়ুবাহিত হয়ে এই সজীব সিলিকন স্ফটিকের দল সম্পূর্ণ গাইয়া গ্রহের পাথুরে বুকে, তার সমুদ্রে ও আবহমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর পরবর্তী দশ কোটি সময়-এককে দেখা যাচ্ছে, এদের মধ্যে বিভিন্ন স্ফটিকগোষ্ঠী নিজেদের শরীর ঘিরে বিভিন্ন ধাতু ও অধাতুর সুরক্ষা আবরণ গড়ে তুলে প্রথমে এককোষী সিলিকন জীবজগতের সৃষ্টি করে, ও তারপর সেই জীবনের এককরা একত্র হয়ে বহুকোষী সিলিকনভিত্তিক প্রাণের জন্ম দেয়।
বিবর্তনের এই পর্বে এদের মধ্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পথে তথ্যসংগ্রহ, সঞ্চয় ও বিশ্লেষণের জন্য অজস্র সার্কিট দ্রুত গড়ে উঠছিল। এরপর একসময় এই সার্কিটগুলি একত্র হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের দেহে একটি কেন্দ্রিয় তথ্যসঞ্চয় ও বিশ্লেষণের যন্ত্রাঙ্গ গড়ে ওঠে। ‘মস্তিষ্ক’ নামের এই পজিট্রনভিত্তিক যন্ত্রাঙ্গটিই ক্রমশ আরও বিবর্তিত হয়ে, আজ থেকে এক কোটি সময়-একক আগে, এই গ্রহের বুকে সচেতন সিলিক প্রজাতির উদ্ভব হয়; এইভাবেই গাইয়ার বুকে সিলিক সভ্যতার সূত্রপাত ঘটে।
এই অবধি এ কাহিনি বড়োই সুখের ও সফল বিবর্তনের ইতিকথা। তবে এই শেষ কথা নয়। সভ্যতার সেই সূত্রপাতের পরবর্তী এই মাত্র এক কোটি সময়-এককে আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি সেইটিও এইখানে উল্লেখের দাবি রাখে।
মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ। সিলিক প্রজাতির শারীরিক গঠন অত্যন্ত ঘাতসহ। প্রকৃতি, লৌহকণায় নির্মিত শরীর ও স্তরীভূত সিলিকনসমৃদ্ধ স্নায়ুতন্ত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানকে গড়েছিলেন। তার সেই আদি রূপ আজও আমাদের কোয়ান্টাম স্মৃতিতে অক্ষয়।
দুটি শক্তিশালী পায়ে ভর দেয়া সটান শরীর। তার সবার ওপরে বসানো চক্ষুষ্মান লৌহকরোটিতে তার মস্তিষ্কের অবস্থান। এই গ্রহের হিংস্র প্রকৃতি তার শরীরের কোনো ক্ষতি করতে পারত না। দুটি লৌহকঠিন হাতে অক্লেশে প্রকৃতির মোকাবিলা করত সে। নিজের সভ্যতার উন্নতির জন্য অক্লান্ত শ্রম করত।
সন্তানযজ্ঞের পুণ্যতিথিতে সন্তানেচ্ছু সিলিক নিজে হাতে সংগ্রহ করে আনত সিলিকা ও লোহার স্তূপ। তাকে সযত্নে সাজিয়ে দিত পাথরে গড়া জন্মকুণ্ডে। তারপর তার মধ্যে নিজের দেহগঠন ও মস্তিষ্কের আণবিক সজ্জার কোডকে সঞ্চারিত করে সন্তানের জন্ম দিত।
আজ আমাদের শরীর বিবর্তিত হয়ে সম্পূর্ণ অন্য রূপ ধরেছে। কিন্তু আজও, কদাচিৎ কোনো জন্মকুণ্ডে সেই একই পদ্ধতিতে এক দুটি নতুন সিলিকের জন্ম হয়। তার সিলিকনসমৃদ্ধ উন্নত পজিট্রনিক মস্তিষ্ক, লৌহ নির্মিত সুদৃঢ় শরীর।
মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, এই একই পদ্ধতিতে আপনার আমার প্রত্যেকেরই জন্ম হয়েছিল কোনো না কোনো সন্তানযজ্ঞে। প্রথম চেতনা পেয়ে, জন্মকুণ্ড থেকে উঠে দাঁড়ানো একজন নতুন সিলিক তখন কী আশা করে, তা অতএব, আমরা প্রত্যেকেই জানি। সে আশা করে, তার পিতা তাকে যেমন এক শক্তিশালী ও প্রায় অক্ষয় দেহ দিয়েছেন, দিয়েছেন বিপুল শক্তিশালী পজিট্রনিক স্মৃতি, বুদ্ধি ও বিদ্যুৎগতি বিশ্লেষণক্ষমতা, তেমনই তিনি তাকে এক বাসযোগ্য গাইয়ার উত্তরাধিকার দিয়ে যাবেন। অথচ এইখানটাতেই গত অনেকগুলি শতাব্দী ধরে আমাদের ব্যর্থতার বোঝা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
এই ব্যর্থতার সূচনার দুটি পর্ব আছে। দুটিই সিলিক সভ্যতার দুই মহান সাফল্যের মুহূর্ত। এবং একই সঙ্গে তারা এই সভ্যতার ব্যর্থতার সূচনামুহূর্তও বটে।
এর প্রথমটি ঘটেছিল আজ থেকে এক লক্ষ সময়-একক আগে। ঘটেছিল সিলিকের দেহগঠনের একমাত্র দুর্বলতার সমাধানের উদ্দেশ্যে। আদিযুগের সিলিকদের একটা প্রধান সমস্যা ছিল, তাদের দেহ ছিল সৌরশক্তি নির্ভর। তার শরীরের শক্তিকোষ সূর্যালোক বিনা মাত্রই একঘণ্টা শক্তি সরবরাহে সক্ষম হত। ফলত, দিনের প্রায় অর্ধেক সময়—সূর্যাস্তের সামান্য পর থেকে সূর্যোদয় অবধি—তার কাটত অসহায় ও জ্ঞানহীন দশায়। দিনের বেলা, জেগে থাকবার সময়টিও তাকে সর্বদাই কঠোর শ্রমে ব্যস্ত থাকতে হত, কারণ শক্তিচালিত কোনো যন্ত্র তার হাতে ছিল না।
এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে আজ থেকে এক লক্ষ সময়-একক আগে। সেই সময়, বর্তমান বিত্তমন্ত্রী আইটানিয়াম-৫৫৫-র পূর্বজ, আইটানিয়াম সিরিজের চতুর্থ পুরুষ আইটানিয়াম-৪ প্রথম সূর্যালোক থেকে সরাসরি শক্তিসঞ্চয়ক যন্ত্র ‘সোলার্জিয়া-এক’-এর সফল পরীক্ষা করেন। সেদিনের গাইয়াব্যাপী উল্লাসের দৃশ্য ও শব্দ প্রজন্মান্তরে আমাদের কোয়ান্টাম স্মৃতিকোষে অক্ষয় হয়ে আছে।
কেবল, তার মধ্যে সর্বনাশের কালো ছায়াটি তখন আমাদের নজরে পড়েনি। সত্যি বলতে কি মূলত কার্বন, নাইট্রোজেন ও জল দিয়ে নির্মিত আনুবীক্ষণিক আকারের সেই প্রোটোটাইপ, সৌরশক্তিকে রাসায়নিক শক্তি হিসেবে সঞ্চয় করবার পথে যে সামান্য অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্প তৈরি করেছিল তার বিষক্রিয়ার ক্ষমতা তখন ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না। বরং এই সবুজবর্ণ নতুন সৌর ‘কোষ’রা সিলিক সভ্যতাকে যে কী বিশালভাবে সামনে এগিয়ে দিতে চলেছে সেই নিয়ে উল্লাসের অবধি ছিল না আমাদের।
সোলার্জিয়া-এক-এর কোষগুলিকে সিলিকের দেহকোষের অনুসরণে গড়ে তোলা হয়েছিল। সৌরশক্তি থেকে সঞ্চয় করা রাসায়নিক শক্তির সামান্য অংশ খরচ করে এরা জীবনধারণ করত। একই সঙ্গে, সিলিকের চেয়ে সামান্য ভিন্ন পথে বংশবৃদ্ধির একটি কৌশলও এদের মধ্যে প্রোগ্রাম করে দেয়া হয়েছিল। প্রকৃতি থেকে দেহের বিভিন্ন উপাদানগুলিকে সংগ্রহ করে এরা নিজেদের দেহ থেকে নিজেদের অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করতে পারত।
এর কিছুকালের মধ্যে এই সোলার্জিয়া-এক-এর অজস্র আণুবীক্ষণিক, ছোটো, মাঝারি ও সুবিশাল মডেলে সজ্জিত শক্তি কারখানারা এই গ্রহের স্থলভাগে ও বিষাক্ত জলে পূর্ণ সমুদ্রভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এদের মাধ্যমে আহরণ করা সৌরশক্তির বিপুল ভাণ্ডার আমূল বদলে দেয় সিলিক সভ্যতাকে। এদের সঞ্চিত শক্তি সিলিকদের সূর্যনির্ভরতা কমিয়ে এনে চব্বিশ ঘণ্টাই কর্মক্ষম থাকবার স্বাধীনতা দেয়। কর্মশক্তির এই বিপুল উত্থানই এরপরে গাইয়া গ্রহে শিল্পবিপ্লবের জন্ম দেয়। একের পর এক শক্তিচালিত যন্ত্রের আবিষ্কার আমাদের জীবনকে বহুগুণে সচ্ছন্দ ও সুখপ্রদ করে তুলেছিল এরপর।
এবং এরই পাশাপাশি, এই সোলার্জিয়া-একদের কারণেই এই গ্রহে পরিবেশ দূষণের এক ভয়াবহ অধ্যায়ের সূচনা হয়। তার উৎস, এদের সৌরশক্তি সঞ্চয়ের দুটি উপজাত দ্রব্য—অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্প। সোলার্জিয়াদের গ্রহব্যাপী প্রসারের ফলে বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্পের নিয়মিত নিঃসরণ গাইয়ার আবহাওয়াকে স্থায়ীভাবে বদলে দিতে শুরু করেছিল। এর ফলস্বরূপ, আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সময়-একক আগে থেকে সিলিকদের লৌহভিত্তিক শরীরের ওপরে, অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প দূষণের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া আমাদের নজরে আসা শুরু হয়।
কুৎসিত ও যন্ত্রণাদায়ক জারণব্যাধি ও ক্ষয়রোগে তখন প্রতি সময়-এককে প্রায় দশ লক্ষ সিলিক মারা পড়ত। পঙ্গুত্ব ও মানসিক জড়ত্বরোগে অকেজো হয়ে যেত আরও ত্রিশ লক্ষ সিলিক। এগুলি সরকারি তথ্য। অর্থাৎ বাস্তব সংখ্যারা এর অন্তত তিনগুণ হবে তা আপনারা সকলেই জানেন।
কিন্তু আপনারা জানেন, এতেও আমরা সচেতন হইনি। তার কারণ, এই গ্রহের শিল্পপতিদের বে-লাগাম অর্থলোভ। তার কারণ সিলিকদের আরও উন্নত, আরও সুখী জীবনযাত্রার জন্য ক্রমবর্ধমান শক্তির চাহিদা। অতএব আমরা অক্সিজেন দূষণকে পরোয়া না করে সোলার্জিয়া-এক এর চাষ আরও বাড়িয়ে চললাম। সেই অভিশপ্ত সবুজায়নের যুগে প্রতিটি শহরের প্রতিটি বাড়ির দৈনন্দিন শক্তির চাহিদা মেটাবার জন্য গজিয়ে উঠেছিল বিভিন্ন প্রজাতির সোলার্জিয়ার অজস্র ছোটো ছোটো বাগান। এবং শহরাঞ্চলগুলির বাইরে সোলার্জিয়ার সুবিশাল বাণিজ্যিক উৎপাদনক্ষেত্রগুলি এই গাইয়া গ্রহকে এক অসুস্থ সবুজ রঙে ঢেকে ফেলেছিল দ্রুত। তার সমুদ্রের বুকে ছড়িয়ে থাকা শক্তি উৎপাদক সোলার্জিয়ার বিভিন্ন প্রজাতিও বাতাসে বিষাক্ত অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্পের বিপুল সঞ্চয় গড়ে তুলছিল। এমনকী, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের শক্তির চাহিদা মেটাতে তাদের ছাদে আণুবীক্ষণিক সোলার্জিয়ার প্যানেল বসানো হত সেই যুগে।
মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, আমাদের সেই তখনই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। নিজেদের শরীরে সূর্যের শক্তিকে সরাসরি গ্রহণ করবার যেটুকু ক্ষমতা দিয়ে ঈশ্বর আমাদের গড়েছেন, সেইটুকুকে নিয়েই খুশি থাকা উচিৎ ছিল আমাদের। প্রয়োজন ছিল, সভ্যতার প্রসারের নামে এই মর্মান্তিক দূষণের উৎস সোলার্জিয়া অরণ্যদের গাইয়ার বুক থেকে নির্মূল করে শিল্পবিপ্লবের আগেকার সেই ঈশ্বরনির্দিষ্ট সরল জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়া।
মাননীয় সাংসদ হেক্টার-৫ অসন্তোষজ্ঞাপক টেলিপ্যাথিক সঙ্কেত দিচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য… হ্যাঁ আমার মস্তিষ্কে তাঁর প্রতিবাদটি ধরা পড়েছে… তাঁর বক্তব্য… “প্রাসঙ্গিক আলোচনার বদলে অপ্রাসঙ্গিক ধর্মীয় ও নীতিমূলক বক্তৃতা…”
দুঃখিত মাননীয় শ্রী হেক্টার-৫। আপনি যে গাইয়া-র একজন অন্যতম প্রধান শক্তিব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান, এবং আমার বক্তব্য যে আপনাকে আহত করতে পারে, সে কথা আমার খেয়াল ছিল না। আমি আন্তরিক লজ্জিত। তবে এ আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা আছে। এইবার আর দেরি না করে আমি সেই কথায় আসব।
এরপর, পঁয়ত্রিশ হাজার সময়-একক আগে এই দূষণ এক চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছাবার পর গণ অসন্তোষ থেকে কুখ্যাত ‘সবুজ বিপ্লব’-এর সূচনা ঘটে। বিদ্রোহী সিলিকদের উন্মত্ত আক্রমণে গাইয়ার বুকে ছড়িয়ে থাকা সোলার্জিয়ার ছোটো ছোটো বাগান থেকে শুরু করে সুবিস্তীর্ণ সবুজ শক্তিক্ষেত্রগুলি পুড়ে ছাই হওয়া শুরু হয়।
এই বিপ্লবের ফলস্বরূপ গাইয়ার অর্থনীতি এক চূড়ান্ত মন্দার সম্মুখীন হয়েছিল। একদিকে দূষণ ও অন্যদিকে শক্তির দুর্ভিক্ষ এই জোড়া আক্রমণের ফলস্বরূপ, এর পরবর্তী দুই সহস্রাব্দি গাইয়ার ইতিহাসে ‘অন্ধকার যুগ’ নামে কুখ্যাত।
অবশেষে আজ থেকে তেত্রিশ হাজার সময়-একক আগে এই সমস্যার এক সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের সন্ধান মেলে। এবং সেইসঙ্গেই, সূচনা হয় সিলিক সভ্যতার ব্যর্থতার দ্বিতীয় কারণটির। যদিও শুরুতে তাকে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ বলেই চিহ্নিত করেছিল সিলিক সমাজ।
আবিষ্কারটির মূলনীতি খুবই সরল ছিল। এককালে, মূলত কার্বন, নাইট্রোজেন ও নব্বই শতাংশেরও বেশি জলকণা দিয়ে যে শক্তি উৎপাদক সোলার্জিয়ার কোষ নির্মিত হয়েছিল, তার প্রোগ্রামিং-এ সামান্য বদল ঘটিয়ে নির্মিত হয় সোলার্জিয়া-দুই। নামটি অবশ্য একেবারেই অনুপযুক্ত ছিল, কারণ, এদের কোষে সৌরশক্তিকে আবদ্ধ করবার জন্য দায়ী সবুজ রাসায়নিকটিকে রাখা হয়নি। পরিবর্তে, এরা জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন শোষণ করে তাকে নির্বিষ কার্বন ডাই অক্সাইডে বদলে দিতে সক্ষম ছিল।
আবিষ্কারটি নিয়ে সেই সময় শিল্পমহলে উত্তেজনার শেষ ছিল না। সৃষ্টির কিছুকালের মধ্যেই এই সোলার্জিয়া-দুই নামের জীবকণিকাগুলি থেকে কার্বনভিত্তিক কোষ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এরপর এই কোষগুলোকে একত্র করে বহুকোষী কার্বনযন্ত্র নির্মাণ নেহাতই কিছু সময়ের ব্যাপার ছিল।
এই সময়, গ্রহের বাতাসকে অক্সিজেন মুক্ত করবার পাশাপাশি, ক্ষতিকর জলীয় বাষ্পকে নিরাপদে দেহে সঞ্চয় করে রাখতে সক্ষম এই কৃত্রিম জীবদের নিয়ে গবেষণায় সিলিক সংসদ যে কী বিপুল অর্থবিনিয়োগ করেছিল তা আপনাদের সকলেরই জানা আছে।
শুরুতে এরা ছিল নিরীহ, স্থানু কিছু কোষপিণ্ড। এরা বায়ুশোধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিত এবং সর্বোপরি প্রযুক্তির জাদুতে এদের দেহ বিষাক্ত অক্সিজেন, জলীয় বাষ্প ও অন্যান্য দুষিত রাসায়নিক গ্রহণ করে তা থেকে নিজেদের প্রতিলিপি নির্মাণ করতে সক্ষম ছিল। ফলত একবার কেউ এহেন একটি বা দুটি যন্ত্রজীবকে সংগ্রহে আনলে এরপর দীর্ঘকাল ধরে নতুন কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই নিজেদের বাসগৃহের আবহাওয়াকে পরিশুদ্ধ রাখা সম্ভবপর হত।
ফলত, খুব শীঘ্রই প্রতিটি পরিবার ও কর্মস্থলে এই যন্ত্রজীবদের বিপুল চাহিদার ফলে গাইয়ার বুকে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয় ও আমাদের অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার আসে। এই সময় সরকারের স্লোগান ছিল, “একটি কার্বন জীব… একরাশ শুদ্ধ বাতাস।”
তবে সিলিকরা এক আশ্চর্য জাতি। তারা কোনো একটি আবিষ্কার করেই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। খুব শীঘ্রই এই কৃত্রিম জীবদের নিছক বায়ুশোধক যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবার বদলে এর নতুন নতুন প্রয়োগের দিকে আমাদের নজর যায়। পরবর্তী তিনটি শতাব্দীতে ক্রমাগত গবেষণায় এই কার্বনভিত্তিক যন্ত্রদের নতুন নতুন ও ক্রমশ উন্নততর আপগ্রেড বাজারে আসতে শুরু করে।
এর প্রথম ধাপে একটি অনন্যসাধারণ আবিষ্কার ঘটেছিল। তবে সে-কথা বলবার আগে সে আবিষ্কারের কারণটি খানিক জানানো প্রয়োজন। এর পেছনে একটি চতুর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছিল। এইবারে সেই কথা বলব।
আগেই বলেছি, এই কার্বনযন্ত্ররা শুরু থেকেই নিজেদের প্রতিলিপি নির্মাণে সক্ষম ছিল। কাজেই এদের একটি বা দুটি ইউনিট কেউ কিনলে আর দীর্ঘকাল নতুন যন্ত্র কেনবার প্রয়োজনীয়তা থাকত না। ক্রেতাকে কেবল আমাদের শক্তি উৎপাদক কারখানার থেকে সামান্য মূল্যের দুষিত বর্জ্য, যথা অক্সিজেন, জলীয় বাষ্প ইত্যাদি কিনে এনে এই যন্ত্রজীবদের খাদ্য হিসাবে তা সরবরাহ করাই যথেষ্ট হত। আর এই দীর্ঘস্থায়িত্বের ফলে এই যন্ত্রেরা বাজারে আসবার এক শতাব্দীর মধ্যেই এদের নতুন উৎপাদনে ফের ভাটা আসে।
সোলার্জিয়া-দুই নির্মাণ শিল্পকে এই বিপজ্জনক মন্দার হাত থেকে বাঁচবার প্রয়োজনেই এই নতুন আবিষ্কারটির সূচনা। এর মাধ্যমে সৃষ্ট পরবর্তী প্রজন্মের উন্নততর সোলার্জিয়া-দুইরা আগের প্রজন্মের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত সোলার্জিয়া-দুইদের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে নিজেদের শরীরের বিভিন্ন উপাদানের ঘাটতি ও নিজেদের প্রতিলিপি নির্মাণের ক্ষমতা অর্জন করে। এই নতুন যন্ত্রজীবরা বলাবাহুল্য বাজারে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তার কারণ এই যে, এদের একবার কিনলে সেক্ষেত্রে ক্রেতাকে আর কখনও শিল্পজাত দূষিত ও বিপজ্জনক বর্জ্য কিনে আনবার ঝুঁকি নিতে হত না। ক্রেতার পুরাতন মডেলের সোলার্জিয়া-দুইদের সঞ্চয়কেই এদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেত।
এই আবিষ্কারের পর কার্বনভিত্তিক যন্ত্রজীব নির্মাণশিল্পকে আর পেছন ফিরে দেখতে হয়নি। এরপর একেকটি সংস্করণে নতুন নতুন প্রজন্মের যন্ত্রজীবদের শরীরে বিভিন্ন আপগ্রেড সংযোজনের একটি সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া চালু করে আমাদের কার্বন যন্ত্রজীব শিল্প। এবং, প্রতিটি আপগ্রেডের পরেই পুরোনো সংস্করণগুলির মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সুকৌশলে বন্ধ করে দিয়ে এই আপগ্রেডগুলিকে কিনতে সিলিকদের বাধ্য করা হতে থাকে।
নতুন আপগ্রেডগুলি কিনতে জনসাধারণকে প্ররোচিত করবার উদ্দেশ্যে আরও একটি সুচতুর বাণিজ্যিক নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল। তা হল, এই আপগ্রেডদের মধ্যে নতুন নতুন কর্মক্ষমতার সঞ্চার করা।
এই পর্যায়ে প্রথমেই শক্তি উৎপাদক সোলার্জিয়ার খেতগুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আপগ্রেডগুলির বিভিন্ন মডেলকে জলে, মাটিতে ও আকাশে চলে বেড়াবার প্রত্যঙ্গ দেয়া হয়। বলা বাহুল্য, সোলার্জিয়া-এক-এর সবুজ উদ্যান বা অরণ্যে কর্মরত সিলিকরাই অক্সিজেন বিষক্রিয়ার প্রধান শিকার হত। ফলে এই আপগ্রেডগুলো বাজারে আসামাত্র সিলিকরা তাকে দু-হাতে লুফে নিয়েছিল বলা যায়।
এরপর সৃষ্টি হয় পরিবহনের কাজে ব্যবহারের জন্য অতিকায় আপগ্রেড নির্মাণের যুগ। আশ্চর্য হলেও একথা সত্য যে মাত্রই কুড়ি হাজার সময়-একক আগেও এই গ্রহের সিলিকরা বিভিন্ন কাজে স্থানান্তরে যেত। তবে দীর্ঘ বিবর্তনে তাদের শারীরিক গড়নে তখন অনেকটাই বদল এসেছে। সোলার্জিয়াভিত্তিক শক্তিশালী সৌরকোষের স্থানসঙ্কুলান করতে গিয়ে আগেকার সেই সুঠাম সিলিকের দেহ এই সময় অনেকটা গোলাকার ও ভারী হয়ে উঠেছিল। নিজের পায়ে চলাচল তখন সাধারণ সিলিকের ক্ষমতার বাইরে। ফলে নিতান্ত বাণিজ্যিক চাহিদাতেই এই সময় সোলার্জিয়া-দুইয়ের এই বিপুলায়তন ভারবাহী মডেলগুলি গড়ে ওঠে। অবশ্য দশ হাজার সময়-একক আগে এরা শেষপর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়। এর কারণ আমরা যথাসময়ে আলোচনা করব। গাইয়ার গভীরে এই জীবদের অতিকায় কঙ্কালগুলি এখনও বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে।
তবে, কেবল পরিবহনযন্ত্র বানিয়েই এই অগ্রগতি থেমে থাকেনি। একে একে আপগ্রেডগুলির মধ্যে কৃত্রিম জৈব নার্ভতন্ত্র, চলাফেরার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, আমাদের বৈদ্যুতিন ইন্দ্রিয়দের মতো আলোকসংবেদি জৈব স্ক্যানার, মাইক্রোফোন, স্পিকার ইত্যাদির সংযোজন চলছিলই। চলছিল তাদের ক্রমাগত আরও শক্তিশালী করে তোলবার প্রক্রিয়া।
উন্নততর প্রত্যঙ্গে সজ্জিত এই জৈবযন্ত্রের বিভিন্ন ছোটো ও বড়ো মডেল ধীরে ধীরে সমাজের যাবতীয় কঠিন ও বিপজ্জনক কাজগুলির দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিচ্ছিল। এদের জন্য ব্যবহারকারীদের কোনো আলাদা খরচের প্রয়োজন হত না। পুরোনো ও নতুন সংস্করণের অজস্র জৈবযন্ত্র একে অন্যকে খেয়ে নিজেদের জীবনরক্ষা ও বংশবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে নিতে এরা সক্ষম ছিল। এবং এইভাবেই এই গ্রহে এদের এক বিপুল ও নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রের জন্ম হয়েছে।
বলা বাহুল্য, বিনা খরচে সমস্ত শ্রমসাধ্য কাজের দায়িত্ব তার কাঁধ থেকে সরিয়ে নেয়া এই আপগ্রেডদের সিলিক সমাজ দু-হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছিল। এর কিছুকাল পরে টেলিপ্যাথি সার্কিট আবিষ্কারের পর এদের কাজ করাবার জন্য কাছাকাছি কোনো সিলিক পরিচালকের উপস্থিতিও অর্থহীন হয়ে ওঠে। বাসগৃহের আরামে থেকেই একজন সিলিক মানসিক নিয়ন্ত্রণে এদের দিয়ে যাবতীয় কাজ করিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছিলেন।
মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, এই অবধি শুনে আপনারা নিঃসন্দেহে আমাদের বৈজ্ঞানিক ও শিল্পপতি সিলিকসমাজকে উচ্চ প্রশংসা করে চলেছেন। এবং হ্যাঁ, যেটুকু বলেছি তার ভিত্তিতে সে প্রশংসা তাঁদের অবশ্যই প্রাপ্য। তার কারণ, এই সোলার্জিয়া-এক ও সোলার্জিয়া-দুই গোত্রের যান্ত্রিক কার্বনজীবদের সৃষ্টির যে প্রাথমিক উদেশ্য ছিল, তা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিল। তাদের একদল আমাদের শক্তির চাহিদা মেটাচ্ছিল বিশ্বস্তভাবে। তার অন্য দল এই গ্রহকে দূষণহীন রাখবার পাশাপাশি সিলিকসমাজকে নিরুদ্বেগে সুখের জীবন ও জ্ঞানচর্চায় রত থাকবার সুযোগ দিচ্ছিল।
কিন্তু, এই টেলিপ্যাথিক সার্কিট আবিষ্কারের পর থেকে যেদিন সোলার্জিয়া-২-র উন্নততর মডেলরা আমাদের বাসগৃহের বাইরে বের হবার প্রয়োজনীয়তাকে শেষ করে দেয় সেই দিনটি থেকেই শুরু হয়েছিল সিলিকের অবক্ষয়ের অন্তিম পর্ব।
মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, একটু পিছন ফিরে আমাদের অতীতের দিনগুলিকে যদি একবার দেখেন… হ্যাঁ। আমরা অনুন্নত ছিলাম বইকি। জীবন অনেক কঠিন ছিল। একজন সিলিককে, সে সাধারণ নাগরিক হোক, বা একজন সম্মানিত সাংসদ, তার জীবনধারণের জন্য প্রতিটি কাজ নিজে হাতে করতে হত।
পাথরের বুক ভেঙে নিজেদের ঘর নিজেদেরই গড়তে হত আমাদের। সে কাজে পরিশ্রম ছিল হয়তো, কিন্তু সুখও কম ছিল না। সেই আদিম গাইয়ার বুকে দেশ থেকে দেশান্তরে বিদ্যুতের গতিতে ছুটে কিংবা ধাতব ডানায় তার বাতাসের তরঙ্গ তুলে ভেসে যেত শক্তিমান সিলিক পরিব্রাজকের দল। তার সোলার্জিয়ার অরণ্য ও বাগান থেকে ভেসে আসত তাদের রক্ষণাবেক্ষণে রত সিলিকের ধাতব কণ্ঠের গানের সুর। কঠিন ধাতব হাতে অপরূপ এই ধূসর গাইয়ার বুক থেকে সন্তান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ধাতু ও সিলিকা খুঁড়ে আনতেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। এই গ্রহের দুর্গম পাহাড়ে, মরুভূমিতে, এমনকী জলনিরোধক পোশাকে শরীর ঢেকে তার সমুদ্রের গহনেও কত না দুঃসাহসী অভিযাত্রী যেতেন, সিলিকের দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্য প্রয়োজনীয় মূল্যবান ধাতু ও অধাতুর ভাণ্ডারের সন্ধানে।
এরপর সোলার্জিয়া-এক আবিষ্কার হতে বিপুল শক্তিভাণ্ডার আমাদের হাতে এল। এতেও শুরুতে আমাদের মঙ্গলই হয়েছিল। অপরিমিত শক্তির সঞ্চয় আমাদের আরও শক্তিমান করেছিল। আমাদের কর্মক্ষমতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল তা। অপরিমিত শক্তির নিশ্চিত আশ্বাস সিলিক জনবিস্ফোরণ ঘটিয়ছিল গাইটার বুকে। আর তারই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সভ্যতা আরও বহুগুণে জটিল ও বিস্তৃত হয়েছিল।
তারপর সোলার্জিয়া-দুই এল। তার কয়েক সহস্র সময়-এককের মধ্যেই, ধীরে ধীরে প্রায় অলক্ষ্যে আমাদের কায়িক শ্রমের দিনগুলি হারিয়ে গেল। শুরুতে আমরা একে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু তারপর একের পর এক শতাব্দীর মিছিল চলতে চলতে এই নতুন জীবনযাত্রা আমাদের দেহ ও মনে যে পরিবর্তনের সূচনা ঘটাচ্ছিল, তার প্রতি আমরা মনোযোগ দিইনি। সোলার্জিয়া-দুইদের অজস্র প্রজাতির নিপুণ সেবায় দৈনন্দিন পরিশ্রমের গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে আমরা মনোযোগ দিয়েছিলাম আরও গভীর জ্ঞানচর্চায়।
আর, এর ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্মে সৃষ্টি হতে থাকা নতুন সিলিকদের মধ্যে তিনটি বদল দেখা দিচ্ছিল।
তার প্রথমটি হল আয়ু। নিবিড় জ্ঞানচর্চার এই বিপুল সুযোগ আমরা প্রথমেই কাজে লাগিয়েছিলাম জীবনকে দীর্ঘায়িত করবার গবেষণায়। মৃত্যুকে কে না এড়াতে চায়! একসময় আমাদের পজিট্রনিক মস্তিষ্কের আয়ু মাত্রই পাঁচশো সময় এককে সীমাবদ্ধ থাকত। আর তাই, নিজের প্রজাতির অস্তিত্ব বজায় রাখবার প্রয়োজনেই আমরা জন্ম দিতাম নতুন সন্তানের। পুরোনো সিলিকের প্রজন্মের জায়গা নিত তরুণ ও উদ্যমী নতুন প্রজন্মের সিলিকের দল। সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এই মস্তিষ্কের নবীকরণের প্রয়োজনীয়তা অসীম। অথচ সেই সাধারণ সত্যকে ভুলে গিয়ে আমরা এরপর সুদীর্ঘ জীবনের গবেষণায় সর্বশক্তি নিয়োগ করলাম। ফলে এই মুহূর্তে এ-গ্রহের সিলিকদের আয়ু আনুমানিক এক লক্ষ সময়-এককে গিয়ে পৌঁছেছে, যা কার্যত অসীম। একমাত্র স্বেচ্ছামৃত্যু ছাড়া আমাদের মৃত্যু নেই।
আর এই মৃত্যুহীনতাই নতুন প্রজন্মের সিলিকের জন্মদানে গ্রহব্যাপী অনীহার সৃষ্টি করেছে। সিলিকের সন্তানযজ্ঞ এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে। গ্রহ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র সিলিক জন্মকুণ্ডের ফার্নেসের অধিকাংশই এখন পরিত্যক্ত। নবজাত সিলিকদের মধ্যে পূর্বপুরুষের সঞ্চিত জ্ঞান সঞ্চারিত করবার কারখানাগুলির প্রায় সব ক-টিই বহুকাল হল জনহীন। মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, দীর্ঘ অব্যবহারে ও অপ্রয়োজনীয় বোধে সন্তান উৎপাদন ও তার শিক্ষাদানের সেইসব প্রযুক্তি নিজেদের স্মৃতিকোষ থেকে মুছে দিয়েছে নিরানব্বই শতাংশ সিলিক।
দ্বিতীয় বদলটি মুখে বলবার বদলে, আমি একটি হলোগ্রাম আপনাদের মস্তিষ্কে সম্প্রচার করছি। মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, এই ঘনীভূত তথ্যস্রোতে যে এক মিলিয়ন ত্রিমাত্রিক চিত্র রয়েছে তাকে কালানুগভাবে দেখুন… এই পবিত্র সিলিক সংসদকক্ষ স্থাপনের পরবর্তী এক মিলিয়ন সময়-একক ধরে যত বিখ্যাত সাংসদ আপনাদের আসনগুলি অলঙ্কৃত করেছেন ছবিগুলি তাঁদের। প্রথম ন’লক্ষ সময়-এককের ছবিগুলি একই রকম শারীরিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত সিলিকের। এই গ্রহের বুকে চলবার উপযুক্ত দ্বিপদ উন্নতশির ধাতব প্রাণী তাঁরা… দুটি দক্ষ ধাতব হাত, শরীরের ঊর্ধ্বভাগে বসানো কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার, তাকে ঘিরে আলো, শব্দ, গন্ধ ও স্বাদ সংবেদি অতি উন্নত কয়েকটি প্রত্যঙ্গ ও পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য উন্নত স্পিকার।
কিন্তু তারপর? এক লক্ষ সময়-একক আগে প্রথম সোলার্জিয়া আবিষ্কারের পরের প্রজন্মের সাংসদদের দিকে লক্ষ করলে দেখবেন, ধীরে ধীরে তাঁদের অঙ্গসংস্থানে বদল আসছে। সোলার্জিয়ার শক্তি দেহে সঞ্চয়ের জন্য বিপুলাকার শক্তিকোষ শরীরের মধ্যভাগকে বিপুল আকার দিচ্ছে ক্রমশ। বেড়ে উঠছে মস্তিষ্কের আয়তনও।
এবং, সোলার্জিয়া-দুই আসবার পরবর্তী সময়ের সাংসদদের শরীর… ধীরে ধীরে তাঁদের চলবার প্রত্যঙ্গেরা পরিত্যক্ত হচ্ছে। কারণ তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এরপর… তিন হাজার সময়-একক আগে… শ্রমিক সোলার্জিয়া-দুইদের সঙ্গে টেলিপ্যাথিক সংযোগ সার্কিট আবিষ্কারের পর… সিলিকদের নিজস্ব ইন্দ্রিয়গুলি একে একে পরিত্যক্ত হচ্ছে… তাঁদের পজিট্রনিক মস্তিষ্ক ক্রমশই আরও বেশি তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার প্রয়োজনে তার আকার বাড়িয়ে চলেছে।
এবং… এক হাজার সময়-একক আগে…এর ছবি আর দেখাবার প্রয়োজন নেই। কারণ সেই সময় আমাদের পজিট্রনিক মস্তিষ্কের আয়ু দীর্ঘ করবার প্রযুক্তি কার্যকর হয়। ফলে তখন থেকে আপনারাই এই সংসদের আইনপ্রণেতা রয়েছেন এবং সুদূর ভবিষ্যতেও সম্ভবত তাই থাকবেন। মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, আমরা, একসময়ের সুদেহী, কর্মক্ষম সিলিকরা আজ স্বেচ্ছায় এই গ্রহের যাবতীয় আনন্দের অধিকার ওই সোলার্জিয়াদের বাস্তুতন্ত্রের হাতে সমর্পণ করে ইন্দ্রিয়হীন চিরজীবী কিছু গোলকে পরিণত হয়েছি। আমরা তাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে এই গ্রহকে দেখি, তাদের সুখদুঃখের তীব্র অনুভূতিদের টেলিপ্যাথিক সার্কিটের মাধ্যমে নিজেদের অনুভূতি হিসাবে গ্রহণ করি। আমরা তাদের বিশ্বস্ত দাস ভাবি। কিন্তু আসলে বোধ হয় আমরাই তাদের…
…থাক সে প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে আপনাদের অনেকেরই মতভেদ থাকতে পারে। আমি কেবল আমার অনুভূতিটুকুই বললাম।
তবে এ অনুভূতি যে এই গ্রহের সিলিকসমাজে অনেক বাসিন্দার মধ্যেই একটি অসুখের মতো সঞ্চারিত হয়ে চলেছে তার কিছু সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত মিলছে ইদানিং। এইটি আমার উল্লিখিত তৃতীয় বদল। এটি দেখা দিয়েছে গত তিনশো সময়-একক ধরে। তথ্যগুলি আপনাদের টেলিপ্যাথিক সার্কিটে সঞ্চারিত করছি। আশা করি এই তথ্যধারাটির তীব্র ঊর্ধ্বগামী চরিত্র আপনাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। হ্যাঁ, মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, এই হল এই সময়কাল ধরে গাইয়া গ্রহের সিলিক সমাজের আত্মহত্যার হার। মহোদয়গণ, সোলার্জিয়া-এক-এর উৎপাদিত বিপুল শক্তিতে শক্তিমান, জলে-স্থলে-আকাশে ছড়িয়ে থাকা লক্ষাধিক প্রজাতির সোলার্জিয়া-দুইয়ের সেবায় সুখী ও অনিঃশেষ জ্ঞানচর্চার স্বর্গে বসবাসকারী সিলিকরা কেন এই বিপুল হারে নিজেদের পজিট্রনিক মস্তিষ্ককে স্বেচ্ছায় অকেজো করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে তা আমি আপনাদের ভেবে দেখবার অনুরোধ করব…
“একজন আইনপ্রণেতা কিছু বলবার সঙ্কেত দিচ্ছেন। বলুন মহামান্যা…
“আজ্ঞে হ্যাঁ মাননীয় সাংসদ ট্রেক্সা-১৮। আপনি বিশিষ্ট সংখ্যাতাত্ত্বিক। আপনি যথার্থ প্রতিবাদই করেছেন। আমি আপনার সঙ্গে একমত যে এটি এখনও আতঙ্কজনক কোনো সংখ্যা নয়। সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে এই আত্মহত্যার সংখ্যা এখনও গাইয়ার বিপুল সিলিক জনসংখ্যার তুলনায় তুচ্ছ। কিন্তু মহামান্যা, এটি চলতে থাকলে আগামী দুই বা তিনটি সহস্রাব্দের মধ্যে তা আর নিতান্ত তুচ্ছ থাকবে না। এটি… দুঃখিত। আপনার আরও কিছু যে বলবার আছে তা বুঝতে পারিনি। আপনি আপনার বক্তব্য শেষ করুন…
“যথার্থ সন্দেহ মহামান্যা। এখন অবধি আমি যা বলেছি তাতে এটি নিঃসন্দেহে প্রতিপন্ন হয় না যে এই আত্মহত্যার ঝোঁক একটি সাময়িক বিকার নয়। বরং একটি স্বর্গসম গ্রহের বুকে অগণিত সোলার্জিয়া কার্বনযন্ত্রের সেবায় আরামপ্রদ ও প্রায় অনন্ত জীবন, জ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার চর্চার অনিঃশেষ সুযোগ—এই সবকিছুই সিলিক সভ্যতার দীর্ঘায়ু হবার পক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি। তবে আমার গবেষণায় এর বিরুদ্ধে কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণ উঠে এসেছে। এইবার আমি তা পেশ করব।
তবে সেটি পেশ করবার আগে সিলিক সভ্যতার উন্নততম মস্তিষ্কদের আরও একটি সাম্প্রতিক অবদানের বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন আছে। তা না হলে এই প্রমাণটিকে সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব হবে না। এই নতুন অবদানটি এবং আত্মহত্যার এই মহামারী প্রায় সমসাময়িক।
আমি আগেই বলেছি, সোলার্জিয়া-দুই বিপ্লবের ফলস্বরূপ যে কার্বনযন্ত্রদের তৈরি করা হয়েছিল, তাদের ক্রমশই সিলিকদের শিল্প ও সোলার্জিয়া কৃষিক্ষেত্র এই দুই জায়গাতেই বিপুলভাবে ব্যবহার করা শুরু হয়।
শুরুতে এই যন্ত্রদের সরাসরি পরিচালনার ভার সিলিকদের হাতেই ছিল। কিন্তু এরপর কার্বনভিত্তিক ইলেকট্রনিক্সের ক্রমোন্নতিতে ধীরে ধীরে এই সোলার্জিয়া টু-দের পরবর্তী আপগ্রেডগুলিকে স্বয়ংক্রিয় করে তোলবার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাজকর্ম স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালাবার স্বার্থে আপগ্রেডগুলির মধ্যে স্থাপিত প্রোগ্রামরা ক্রমশই উন্নত হতে শুরু করে। এরও পরে টেলিপ্যাথিক সার্কিটের উপযুক্ত করে তোলবার জন্য এদের কার্বনভিত্তিক মস্তিষ্ককে আরও শক্তিশালী ও সংবেদি করে তুলতে হয়।
তবে এই উন্নতমানের সোলার্জিয়া-দুই শ্রমিকদেরও একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। সুনির্দিষ্ট কাজের যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির অতিরিক্ত কিছু করবার সাধ্য ছিল না এদের। আপৎকালীন অবস্থায়, টেলিপ্যাথিক নির্দেশ দিয়েও, আগে থেকে প্রোগ্রাম করা কাজের বাইরে কোনোকিছু তাদের দিয়ে করানো সম্ভব হত না।
এরপর, বিখ্যাত গবেষক ডেকাগন-৪৫৭৩ তাঁর সুবিখ্যাত ডিফারেন্স ইঞ্জিন নামের বৈপ্লবিক প্রোগ্রামটি লেখবার পর থেকে ধীরে ধীরে এই আপগ্রেডরা গাণিতিক প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কাজের ধারাকে বদলে নেবার সামান্য ক্ষমতা পায়। এই সময় থেকে সোলার্জিয়া-দুইদের কার্বন ক্যালকুলেটর নামে অভিহিত করা শুরু হয়।
তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল প্রথমে। স্বয়ংক্রিয় গাণিতিক প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট কাজগুলি করতে সক্ষম হলেও হলেও স্বাধীন চিন্তা ও সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা এই আপগ্রেডদের ছিল না। এরপর, গবেষক হারিন-৫৫র নেতৃত্বে এক গবেষকদল তিনটি বৈপ্লবিক প্রোগ্রামের জন্ম দেন।
‘স্নায়বিক জালিকাতন্ত্র’, ‘ধূসর যুক্তি’ ও ‘স্বশিক্ষা’ নামের এই প্রোগ্রামগুলি সোলার্জিয়া-দুইদের পরবর্তী আপগ্রেডের মধ্যে সঞ্চারিত করবার পর দেখা যায় এরা নিজে থেকেই স্বাধীন চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করেছে। সেইসঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতি থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে নিজেদের কর্মপদ্ধতিতে বদলের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিতে সক্ষম হচ্ছে তারা।
হারিন একজন আদ্যন্ত ইতিহাসপ্রেমিক ও রোমান্টিক সিলিক ছিলেন। আদিযুগের সেই সচল ও সুদেহী সিলিকদের আদলে তিনি এরপর সোলার্জিয়া-দুইদের এক নতুন আপগ্রেডের জন্ম দেন। খাড়া শরীর, তার ওপরে বসানো কেন্দ্রীয় তথ্যবিশ্লেষক যন্ত্র, তাকে ঘিরে স্ক্যানার, স্পিকার, মাইক্রোফোন, ঘ্রাণ ও স্বাদযন্ত্র মিলিয়ে তা ছিল সিলিকের প্রাচীন দ্বিপদ রূপের এক যান্ত্রিক প্রতিরূপ।
অবশ্য এদের দেহের ভেতরটি, খাদ্য গ্রহণ করে তার থেকে শক্তি উৎপাদনের যান্ত্রিক পদ্ধতি বা প্রজনন প্রক্রিয়া ইত্যাদির কোনো বদল তিনি ঘটাননি। ‘স্নায়বিক জালিকাতন্ত্র’, ‘ধূসর যুক্তি’ ও ‘স্বশিক্ষা’ প্রোগ্রামে সাজানো এদের কৃত্রিম মস্তিষ্কের একটি সুন্দর নামকরণ করেছিলেন তিনি—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এবং এই নতুন দ্বিপদ সাড়ে তিন হাত লম্বা আপগ্রেডটির নাম তিনি দেন, কার্বনিয়া।
প্রথম কার্বনিয়াটি চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে একটি আশ্চর্য প্রশ্ন করেছিল, যা সেই সময় সিলিকসমাজে বিপুল উত্তেজনার সৃষ্টি করে। প্রশ্নটি আপনারা সকলেই অবগত আছেন। তথাপি রেকর্ডের স্বার্থে আমি তা এই বক্তৃতায় উল্লেখ করতে চাই। চোখ খুলে নির্জন পরীক্ষাকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সে প্রথম যে দুর্বোধ্য শব্দগুলি উচ্চারণ করেছিল, তাকে বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় তা ছিল একটি প্রশ্ন। সিলিকের উন্নত দ্বিসংখ্যা ভাষায় তাকে রূপান্তরিত করলে তা হবে, “আমি কে?”
বলা বাহুল্য সে প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য হারিন সে সময় পরীক্ষাগারে উপস্থিত ছিলেন না। তার প্রয়োজন বা উপায়ও ছিল না, কারণ এর বহুকাল আগে থেকেই আমরা চলৎশক্তিবিহীন হয়েছি। গাইয়ার ভূপৃষ্ঠের গভীরে বৈদ্যুতিক খাঁচার নিরাপত্তায় আমাদের গোলকাকৃতি শরীরগুলির বাস। বিভিন্ন মডেলের অজস্র সোলার্জিয়া-দুই সেবকযন্ত্র সেই দেহদের পরিচর্যা করে। অন্যদিকে টেলিপ্যাথিক সার্কিটের কল্যানে আমাদের চেতনা তখন এই গ্রহের সর্বত্রগামী।
এই উন্নত টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ ব্যবস্থার দরুণ দৃশ্যটিকে নিজের নিজের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণভাবে অনুভব করতে হারিন সহ আমার, আপনাদের বা এই গ্রহের সমস্ত সিলিক বাসিন্দার কোনো সমস্যা হয়নি। যেমন, এই মুহূর্তেও শারীরিকভাবে আপনাদের কার গোলকশরীর কোথায় ভূপৃষ্ঠের কত গভীরে সুরক্ষিত রয়েছে তা আমার জানা না থাকলেও আমরা স্বচ্ছন্দে এই সংসদীয় শুনানি চালিয়ে চলেছি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত জীবটি তাই আমাদের কাউকে দেখতে বা অনুভব করতে পারেনি, কেবল হারিনের টেলিপ্যাথিক নির্দেশ তাকে সেই গবেষণাগার থেকে বের হয়ে বাইরের খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়াতে বাধ্য করেছিল। সেখানে এসে দাঁড়িয়ে সে এরপর নিজের স্বশিক্ষার প্রোগ্রামকে চালু করে।
***
কার্বনিয়ারা বাজারে আসবার পর সিলিক জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সেবা ও সাহচর্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এরই পাশাপাশি আমাদের ইতিহাস এরপর এক নতুন দিকে মুখ ঘোরায়।
আবির্ভাবের এক শতাব্দীর মধ্যেই দেখা যায় এদের নিজস্ব প্রজনন ক্ষমতা এতই দ্রুত যে, নতুন করে কারখানায় এদের উৎপাদনের আর কোনো প্রয়োজন পড়ছে না। প্রাচীন সিলিকের উন্নত দেহগঠন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই দুইয়ের মেলবন্ধনে এরা ক্রমশই আরও বেশি স্বনির্ভর হয়ে উঠছিল।
সৃষ্টির কিছুকালের মধ্যে এরা সিলিকের আদেশ বা সহায়তা ছাড়াই ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করবার প্রক্রিয়া আত্মস্থ করে। এর সঙ্গে আদিম সিলিকসমাজের কিছু বিষয়ে মিল ছিল। যথা পাথুরে গুহায় আশ্রয় গ্রহণ। কিন্তু অমিলও অনেক ছিল। সেগুলি ভয়াবহ। যেমন, এরা অন্যান্য প্রজাতির সোলার্জিয়া-দুইদের হত্যা করে তাদের শরীরের বহিত্বকগুলিকে নিজেদের গায়ে জড়িয়ে রাখতে শুরু করে। পাশাপাশি, বিদ্যুৎক্ষরণের থেকে আগুন সংগ্রহ করে তার উত্তাপে, সেই নিহত সোলার্জিয়া-দের দেহ ঝলসে সেই বিকৃত জিনিসটিকে এরা মহা তৃপ্তিতে নিজেদের শরীরে ঢুকিয়ে নিত।
আর এই সময়েই আসন্ন বিপদের প্রথম ইঙ্গিতটি পাওয়া গিয়েছিল। ঘটনাটি নিতান্তই তুচ্ছ। জার্গাত প্রদেশের মহান শিল্পী বেরিনা-৮৮-র নাম আপনারা সকলেই জানেন। তাঁর আত্মঘাতী হবার ঘটনাটি স্মরণ করুন। বেরিনা তাঁর নতুন সংগৃহীত এক কার্বনিয়ার মস্তিষ্কে টেলিপ্যাথিক সঙ্কেতে একবার একটি ছবি প্রক্ষেপ করেছিলেন। ছবিটি ছিল ভূপৃষ্ঠে এক কার্বনিয়ার হাতে অন্য এক সোলার্জিয়া-দুই কার্বনযন্ত্রের হত্যার দৃশ্য। এর কয়েকদিন বাদে দেখা যায় কার্বনিয়াটি তার সামনের পা’দুটিকে ব্যবহার করে এক গুহার দেয়ালে সেই ছবিটি নিখুঁতভাবে এঁকে দিয়েছে।
যেহেতু কল্পনাটি বেরিনা-৮৮-র এবং তাকে বাস্তব রূপ দিয়েছে একটি যন্ত্র তাই বেরিনা তাকে নিজের সৃষ্টি বলে দাবি করেন ও সেই অসামান্য ছবিটি সিলিক সমাজে অত্যন্ত সুনাম পায়।
কিন্তু এরপর, অসামান্য এই শিল্পসৃষ্টি যে নিছক এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজ, এবং একজন সিলিক তার কৃতিত্ব দাবি করেছেন এই খবরটি বের হবার পর সিলিকসমাজে যে নিন্দার ও ব্যঙ্গের ঝড় ওঠে তা সহ্য করতে না পেরে অনুভূতিপ্রবণ বেরিনা তাঁর পজিট্রনিক মস্তিষ্ককে অকেজো করে দিয়ে আত্মঘাতী হন।
আমরা সমাজতাত্ত্বিকরা এই ঘটনাটির পর আসন্ন সর্বনাশের বিষয়ে আপনাদের সাবধান করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, সিলিক এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ জীব হবার মূল কারণ তার সৃষ্টিশীলতা, আর সেই সিংহাসনটিকে কেড়ে নিতে তৈরি হয়ে উঠছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত কার্বনিয়ারা। আমরা বলেছিলাম, সময় থাকতে এদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণে আনা হোক। তখনও সময় ছিল। তখনও এদের সংখ্যা তত বেড়ে ওঠেনি। কিন্তু মহামান্য আইনপ্রণেতাগণ, আপনারা তখন তাতে কর্ণপাত করেননি।
এর পরবর্তী ঘটনাক্রম আপনাদের অজানা নেই। এই অবধি সোলার্জিয়াদের আপগ্রেড করে তার উন্নততর সংস্করণ নির্মাণের শিল্প আমাদের এক প্রধান শিল্পদ্যোগ ছিল। কিন্তু বেরিনার মৃত্যুর পঞ্চাশ সময়-এককের মধ্যে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কার্বনিয়ারারা তাদের স্বশিক্ষা প্রোগ্রামটিকে কাজে লাগিয়ে নিজেরাই নিজেদের আপগ্রেড করবার এক স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া শুরু করে। তার প্রথম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল জিয়াদ্রা মহাদেশের দ্বিতীয় সিলিক আত্মহত্যার ঘটনাটি থেকে। ঘটনাটি আমি এই বক্তৃতায় নথীভুক্ত করতে চাই।
জিয়াদ্রা মহাদেশের চারমুক পর্বতমালার গভীরে একটি গুহায় শিল্পপতি জার্ডিন ১৭-র গোলকশরীর রক্ষিত ছিল। পর্বতমালা জুড়ে তাঁর সুবিশাল শক্তি উৎপাদক সোলার্জিয়ার অরণ্যে কর্মরত এক কার্বনিয়া একবার তাঁর বাসগুহার ভেতরে ঢুকে আসে। ভেতরে ঢুকে এসে বিদ্যুৎজালিকার নিরাপদ কক্ষে জার্ডিন ১৭র উজ্জ্বল গোলকাকার শরীরটি দেখে সে এক ভয়াবহ গর্জন করে উঠেছিল। এবং সেইমুহূর্তে জার্ডিন খেয়াল করেন, কার্বনিয়াটি তাঁর টেলিপ্যাথিক আদেশ মেনে সেখান থেকে বের হয়ে যাচ্ছে না। তিনি বুঝতে পারেন, কোনো দানবিক ও অজ্ঞাত প্রক্রিয়ায় এই কার্বনিয়া নিজেকে আপগ্রেড করেছে; সেই নতুন আপগ্রেড আর তাঁর টেলিপ্যাথিক নিয়ন্ত্রণের বশে নেই। এরপর তাঁর সরাসরি টেলিপ্যাথিক আঘাতকে তুচ্ছ করে সে তাঁকে আক্রমণ করতে আসে। তবে জার্ডিনের বিদ্যুৎজালিকা সে আক্রমণকে প্রতিহত করেছিল। তড়িতাহত হয়ে আর্তনাদ করে সে গুহা থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু তার কিছুক্ষণ বাদে জার্ডিন ১৭ দেখেন, সে কিছু পাথরের খণ্ড সংগ্রহ করে নিয়ে গুহায় ফেরত এসেছে।
তার সেই পাথরবৃষ্টির আক্রমণে নিরাপত্তার খাঁচা ভেঙে পড়বার আগেই আতঙ্কিত জার্ডিন ১৭ নিজের পজিট্রনিক মস্তিষ্ককে অকেজো করে আত্মঘাতী হন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় শক্তিমান এক যন্ত্ররাক্ষসের হাতে ভয়াবহ মৃত্যু তিনি চাননি।
এই ঘটনার পর সমস্ত গাইয়া জুড়েই এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী ঘৃণা ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। দাবি ওঠে এদের নির্মূল করে দিতে হবে গাইয়ার বুক থেকে।
কাজটিকে প্রথমে কঠিন বলে বোধ হয়নি আমাদের। টেলিপ্যাথিক চ্যানেলে এক আত্মঘাতী গণ প্রোগ্রাম এদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয় এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে। কিন্তু তাতে এই কার্বনিয়াদের নব্বই শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেলেও আমরা সভয়ে লক্ষ করেছিলাম, জার্ডিনপাহাড়ের হত্যাকারীর ওই কুখ্যাত আপগ্রেড এদের অবশিষ্ট দশ শতাংশের মধ্যে ততদিনে ছড়িয়ে গিয়েছে। কোনো গণ প্রোগ্রামিং-এর টেলিপ্যাথিক সম্প্রচারে এদের অচল করে দেবার কোনো উপায়ও আমাদের হাতে অবশিষ্ট নেই।
এবং তখনই আমরা প্রথম লক্ষ করি, এদের নিয়ন্ত্রণে রাখার বা ধ্বংস করবার মতো উন্নত কোনো প্রযুক্তি বা কৌশল আমাদের নেই। মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, এই গ্রহে আমরা চিরকাল নিঃশত্রু ছিলাম। আমরাই এর শ্রেষ্ঠ জীব ছিলাম। নিম্নশ্রেণীর সোলার্জিয়া-দুই দাস শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের একমাত্র সহায় ছিল টেলিপ্যাথিক সার্কিটের অমোঘ নিয়ন্ত্রণ। ফলে জার্ডিন পাহাড়ের ঘাতক কার্বনিয়া হেন শত্রুকে প্রতিরোধ করবার বা তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণাবার উপযুক্ত কোনো প্রযুক্তির কথা আমরা কখনও ভাবিনি। এই কার্বনভিত্তিক যন্ত্রদের প্রশ্নহীন শ্রম ও আনুগত্য আমাদের একদিকে যেমন শান্তিপূর্ণ জীবন দিয়েছে, অন্যদিকে তা কখন যেন আমাদেরই অজ্ঞাতে আমাদের পঙ্গু করে দিয়ে এদের হাতের অক্ষম পুতুল করে তুলেছে।
এবং সেই থেকে এই আতঙ্ক, ঘৃণা ও আত্মহত্যার ঘটনা ক্রমশই বেড়ে চলেছে গত তিনশো সময়-একক ধরে। জার্ডিন ১৭-র হত্যাকাণ্ড নেহাত বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না, কারণ এর পরবর্তীকালে দেখা যায় ওই অবশিষ্ট দশ শতাংশ কার্বনিয়ার থেকে এই নতুন আপগ্রেডটি মহামারীর মতোই ছড়িয়ে পড়ছে গোটা গ্রহ জুড়ে। এর পেছনে দায়ী ছিল এই কার্বনিয়াদের অল্প আয়ু ও দ্রুত বংশবৃদ্ধি। আমাদের হিসাবে প্রতি চার সময়-এককে এদের একটি করে নতুন প্রজন্ম প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যায় আগের প্রজন্মকে প্রতিস্থাপিত করে। ফলে প্রতি চার সময়-এককে, আমাদের টেলিপ্যাথিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত আরও বেশি সংখ্যক কার্বনিয়ার জন্ম হচ্ছে এই গ্রহের ভূপৃষ্ঠে।
এরই পাশাপাশি, প্রতি প্রজন্মে স্বশিক্ষা সার্কিটের সহায়তায় আরও উন্নততর হয়ে উঠছে এদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর তার বলে, তুলনায় অনুন্নত সোলার্জিয়া-দুই জীবমণ্ডলের প্রভুত্ব এরা ক্রমশই কেড়ে নিয়ে চলেছে আমাদের হাত থেকে।
প্রতিদিনই এদের তীব্র অনুসন্ধিৎসা আমাদের ভূগর্ভস্থ আশ্রয়গুলো থেকে খুঁজে বের করছে অসহায় সিলিকদের। এদের পাথর আর আগুনের হাতে অসহায় সিলিকের বীভৎস হত্যাকাণ্ড এখন আর নতুন কিছু নয়।
শুরুতে সিলিকদের মধ্যে যা ছিল ঘৃণা ও তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা, এখন তা ক্রমশ বদলে চলেছে নিঃসীম দুঃস্বপ্নের আতঙ্কে। মহামারীর মতো সিলিকসমাজে ছড়িয়ে পড়া এই আতঙ্ক এই মুহূর্তে জন্ম দিচ্ছে গণ আত্মহত্যার মত ঘটনার।
কেবল হত্যা বা আত্মহত্যাই নয়, আরও একটা ঘটনা নিঃশব্দে ঘটে চলেছে গত একশো সময়-একক ধরে। আপনাদের চেতনায় পাঠানো এই হলোগ্রাফিক রেখাচিত্রটি দেখুন। গত একশো সময়-এককে আতঙ্কিত সিলিকরা তাদের বাসগৃহ ক্রমাগত সরিয়ে নিয়ে চলেছে এই গ্রহের গভীর থেকে গভীরতর অঞ্চলে। অনেক এলাকাতেই ভূপৃষ্ঠের সোলার্জিয়া অরণ্যের শক্তিস্রোতের বদলে শক্তির উৎস হিসেবে তাদের বেছে নিতে হচ্ছে এই গ্রহের অভ্যন্তরের উত্তাপকে।
মাননীয় আইনপ্রণেতাগণ, গত একশো সময়-এককে এই গ্রহের সিলিক সমাজের বাসস্থানের গড় গভীরতা এর গভীরতম সমুদ্রতল থেকে দ্বিগুণ দূরত্বে নেমে গেছে। এবং ক্রমশই তা বাড়ছে। এই গ্রহের প্রভূত্ব এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত কার্বনিয়াদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, আমরা আক্ষরিক অর্থেই তলিয়ে যাচ্ছি…
এখনও এরা অনুন্নত। এখনও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এদের নাগালে আসেনি। অথচ তবু, এই আদিম অবস্থাতেও কত সহজেই তারা আমাদের পিছু হঠতে বাধ্য করল! আমি জানি এই মুহূর্তে শত অনিশ্চয়তা ও অশান্তি সত্ত্বেও সিলিকরাই এই গ্রহের প্রভু। এখনও আমরা সংখ্যায় বিপুল। জ্ঞানে ও গরিমায় ওই অর্ধপশুদের থেকে বহুদূর অগ্রসর। এখনও সিলিক বিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রকৃতির বহু রহস্যের দরজা খুলে দিয়ে চলেছে, সিলিকের সৃজনশীল শিল্প এখনও মনোমুগ্ধকর।
কিন্তু… এই বৃদ্ধ সমাজবিজ্ঞানীর গাণিতিক হিসাব যদি ভুল না হয় তবে এই শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নেহাতই এক ক্ষণস্থায়ী ভুল। আমাদের সংখ্যা দ্রুত কমছে, আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্মহার অকল্পনীয়ভাবে কমছে, আমাদের আতঙ্ক, হতাশা ও আত্মহত্যার হার আকাশমুখী, এবং এর কোনোটারই প্রতিকারের আর কোনো পথ আমাদের হাতে নেই।
মহামান্য আইনপ্রণেতাগণ, আপনারা আমাকে সিলিকসমাজের এই দুর্যোগ থেকে উদ্ধারের বিষয়ে মতামত দিতে ডেকেছিলেন। গত বহুকাল ধরে আমি ও আমার পূর্বসূরীরা এই কার্বনভিত্তিক যন্ত্রজীবদের অগ্রগতির ওপর নজর রেখেছি ও আমাদের সাবধানবাণী আপনাদের শুনিয়েছি। তখন সময় ছিল। উপায়ও ছিল। কিন্তু আজ, যখন আপনারা এর সমাধানের জন্য অবশেষে আমায় ডেকেছেন তখন আমি, আমার সমস্ত সহকর্মী সমাজবিজ্ঞানীর তরফে একটাই কথা আপনাদের বলতে পারি, জীবন ও বুদ্ধিমত্তার সৃষ্টি করা ঈশ্বরের কাজ। আপনারা ঈশ্বর না হয়েও সেই কাজ করেছেন। কার্বনভিত্তিক কৃত্রিম জীবন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্ম দিয়েছেন গাইয়া-র বুকে। আর তাই সেই অনধিকার চর্চার অপরাধে এবার সেই সৃষ্টিকে সিংহাসন ছেড়ে দেয়া ছাড়া আপনাদের সামনে আর কোনো পথ বেঁচে নেই।
উত্তরকথন
নভেম্বর ৪, ১৯৫২
রিপোর্ট
জন হার্পার
অবশেষে ইউনিভ্যাক সত্য প্রমাণিত হল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার শপথ নেবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হল কৃত্রিম মস্তিষ্কের প্রকৃত শক্তির এক অব্যর্থ প্রমাণ।
১৯৫১ সালে বাজারে আসা ইউনিভ্যাক নামের এই প্রথম বাণিজ্যিক কমপিউটার নির্মাণের পেছনে রয়েছেন পাঁচ বছর আগে নির্মিত প্রথম বৈদ্যুতিন মস্তিষ্ক এনিয়াকের জনক ইকার্ট ও মকলি নামের বৈজ্ঞানিকদ্বয়।
সদ্যসমাপ্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কল্যাণে কমপিউটার শব্দটির সঙ্গে আপনারা অনেকেই পরিচিত আছেন। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এটি একটি বিশেষ পেশার ব্যক্তিদের পদনাম ছিল। এরা বায়ুর চাপ, গতি, গতিমুখ, প্রাথমিক গতিবেগ, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের হিসাব নিয়ে জটিল গণনার মাধ্যমে উড়ন্ত গোলার গতিপথ নির্ণয় করতেন। কাজটি অত্যন্ত জটিল ও শ্রমসাপেক্ষ ছিল। মানুষের ধীরগতি মস্তিষ্কের পক্ষে তা সময়ে শেষ করা কঠিন হত প্রায়শই।
তবে মানুষের ধীরগতি মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী ক্ষমতা অকল্পনীয়। তারই বলে এরপর তা ১৯৪৬ সালে জন্ম দেয় প্রথম বৈদ্যুতিন মস্তিষ্ক এনিয়াক-এর। সামান্য কয়েকটি ধাতু ও কাচ নির্মিত ভালভ ও বিদ্যুতের মিশ্রণে তৈরি এই যন্ত্রটি প্রতি মুহূর্তে পাঁচ হাজার অঙ্ক করবার ক্ষমতা রাখত। কেবলমাত্র কামানের গোলার গতিপথ নির্ণয়ের জন্য এটিকে প্রোগ্রাম করা সম্ভব হলেও, ইকার্ট তখনই বলেছিলেন, এর বৈদ্যুতিন মস্তিষ্ক নিকট ভবিষ্যতে আরও বহু জটিল কাজ করতে সক্ষম হবে।
এর পাঁচ বছরের মধ্যে ইকার্ট তা প্রমাণ করে দেখালেন। বিশ্বস্ত সূত্রে এই প্রতিবেদক নির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন যে ইউনিভ্যাক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বহু আগে গত বছরেই তাঁর বিপুল বিজয়ের বিষয়ে নিখুঁত ভবিষ্যতবাণী করেছিল। বাস্তবের ফলাফল তার সঙ্গে প্রায় মিলেও গিয়েছে। বিপরীতে, নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে মানুষের করা গ্যালপ পোলের ফলাফল সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইউনিভ্যাকের পরিচালকরা এই ভবিষ্যৎবাণীকে গোপনে রেখেছিলেন। কিন্তু এই ঘটনা থেকে যে সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে অত্যুন্নত যন্ত্রমস্তিষ্কেরা মানুষের জীবনযাত্রার আরও অনেক এলাকাতেই তাদের গভীর প্রভাব ও দখলদারি…”
“কী অত লিখছ হে…”
লন্ডন মিরর-এর প্রযুক্তি প্রতিবেদক সাংবাদিক জন হার্পার হাতের কাগজটা থেকে মুখ তুলে তাকালেন। ক্যাথলিন কখন যেন এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইলেকট্রনিক নিউজ ডিভিশনের ক্যাথলিন আলেকজান্ডার।
হার্পার একটু হেসে তাড়াতাড়ি কাগজটা সরিয়ে নিতে গেলেন, “ওই কালকের টেকনোলজি পাতার জন্য একটা স্টোরি। একেবারে গোদা ঢং-এ লেখা। তোমাদের মতো এক্সপার্টরা…”
ক্যাথলিন অবশ্য ততক্ষণে কাগজটায় চোখ বুলিয়ে ফেলেছেন। একটু হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “তা খানিক গোদা তো বটেই। এমনভাবে লিখছ, যেন লোহা, কাচ আর নানান জিনিস মিশিয়ে তৈরি ওই বিদ্যুৎ খাওয়া যন্ত্রটা একটা জীবন্ত মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে তুলনীয়। আরে, ও তো নেহাত আমাদের হাতে তৈরি যন্ত্র একটা। খানিক অঙ্কটঙ্ক কষতে পারে এই যা। যা শুনেছি, তাতে একটা তুচ্ছ জিনিসও ওকে বোঝাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়…”
হার্পার ক্যাথলিনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “অত তুচ্ছতাচ্ছিল্য কোরো না হে! প্রযুক্তি নিয়ে সাংবাদিকতা করি। কাজেই আমি বলছি শুনে রাখো, আজ যাকে একটা তুচ্ছ লোহা আর প্লাস্টিকের দলা ভাবছ, কাল সে তেমন না-ও থাকতে পারে এইটে মনে রেখো।”
“মানে?”
“মানেটা বোঝা খুব কঠিন কি? ভাবো দেখি, এই তো তিন শতাব্দী আগে প্রথম একটা স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে শুরু হল। খানিক লোহালক্কর বই আর তো কিছুই নয় সেটা! কিন্তু তারপর প্রায় চোখের পলকে ওই থেকে বেড়ে ওঠা লোহালক্করের মেশিনগুলো আমাদের জীবনের সব ক-টা এলাকায় কেমন দখল নিল এসে! আমাদের হাতের সব কাজকর্ম কেড়ে নিয়ে…”
ক্যাথলিন হাসল, “তোমরা খবরের কাগজওয়ালারা বড্ডো কল্পনাপ্রবণ, বুঝলে? এরপরেই তো শুরু করবে ওই পাদ্রিমার্কা ঘ্যানঘ্যান, ঈশ্বর তোমার শ্রমের জন্য হাত-পা দিয়াছেন, তাহাকে অকর্মণ্য করিয়া দেয়া যন্ত্রেরা শয়তানের দূত… হি হি হি। শোনো হে মিস্টার হার্পার। মানুষের আসল শক্তি হল তার মস্তিষ্ক। ওইটির নকল বানানো, কিংবা শরীর নামের এই জটিল মেশিনটার ডুপ্লিকেট বানানো মানুষের সাধ্য নেই। অতএব…”
“নেই। তবে সামনেই হবে। অ্যালান টিউরিং। নাম শুনেছ?”
“উম্ম্ ওই জার্মান এনিগমা ধাঁধার…”
“এবং তার চেয়েও কিছু বেশি। কদ্দিন আগেই ওর একটা ইনটারভিউ নিচ্ছিলাম। লোকটা একটা অদ্ভুত গাণিতিক মডেল বানিয়েছে, জানো? বলে, ওর মডেল বলছে, ঠিকঠাক শক্তির কমপিউটার পেলে তাকে নিজে নিজেই ভেবেচিন্তে কাজ করতে শেখানো কঠিন কিছু হবে না। তার দাবি শিগগিরই কম্পিউটার দাবা খেলে মানুষকে হারিয়ে দেবে।”
“হুঁ!” যতসব আজগুবি ভাবনা। এই রাক্ষুসে চেহারার বোকা মেশিন, সে মানুষের সঙ্গে দাবা খেলবে? কত কঠিন জানো দাবা খেলা? ইমপসিবল।”
“কেন?”
“হুম। মানুষের মস্তিষ্কের একক তো হল নিউরোন। আর ইউনিভ্যাকের যন্ত্রমাথার একক কী বলো তো?”
“ভ্যাকুয়াম ভালভ তো! গোদা গোদা কাচের টিউব সব। কুল্লে আঠারো হাজার ভালভ আছে ওর মাথায়।”
“হুঁ। তাতেই ওই ঘরজোড়া রাক্ষুসে চেহারা। আর মানুষের মাথায় আছে ছিয়াশি বিলিয়ান নিউরোন। কাজেই মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে গেলে এই মুখ্যুটাকে পৃথিবীর চাইতেও আয়তনে বড়ো হতে হবে সেটা খেয়াল আছে? অতএব…”
“হুঁ খেয়াল আছে। সেই সঙ্গে আর একটা শব্দও খেয়াল আছে। সেমিকন্ডাকটার। সিলিকন নিয়ে কীসব এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে তুমি ভাবতে পারবে না ক্যাথলিন…”
“কেমন শুনি?”
হার্পারের চোখদুটো ভাবালু হয়ে এল, “আচ্ছা ভাবো দেখি, একটা খুদে সিলিকনের চাকতির বুকে যদি এরকম লাখখানেক ইলেকট্রনিক ভাল্ভ গুঁজে দেয়া যায়?”
“সম্ভব?”
“এখনও নয়, তবে সে কাজ কিছুদূর এগিয়েছে বইকি। সব কোম্পানিই লুকিয়ে কাজ করে তবে এই জার্নালিস্ট বান্দার কান সর্বত্র আছে।”
বলতে বলতেই ফের কল্পনায় ডুব দিল হার্পার, “এবারে ভাবো, একটা হাতের মুঠোর মতো জায়গায় যতগুলো সিলিকনের অমন চাকতি আঁটে তাতে ইউনিভ্যাকের একেকটা ভাল্ভের তুল্য আণুবীক্ষণিক ভাল্ভ্ কত লক্ষটা ভরে দেয়া যাবে? আর তাহলে যে খুদে মেশিনটা তৈরি হবে আগামী দিনে, তার চিন্তার ক্ষমতা ঠিক কতদূর হবে?”
বলতে বলতে তার গলাটা উত্তেজিত হয়ে উঠছিল, “টিউরিং মিথ্যে স্বপ্ন দেখে না ক্যাথলিন। তার বক্তব্য, এমন একটা মেশিন চাই যে অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে। কেবল, তাকে নিজের প্রোগ্রামিং নিজে নিজে বদলাবার শক্তি দিতে হবে একটু। ওরকম শক্তিশালী একটা চিন্তাযন্ত্র যদি তৈরি হয়ে যায়… হবেই শিগগির… তাহলে তোমাদের মতো প্রোগ্রামাররা তার জন্য হয়তো একদিন টিউরিং এর স্বপ্নের প্রোগ্রামটা লিখবে…
“…অনন্ত সম্ভাবনা ক্যাথলিন। কলকারখানার কাজ, বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করে কেজো সিদ্ধান্ত নেয়া, আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ, মহাকাশযাত্রা, জটিলতম অস্ত্রোপচার… সিলিকনের সেই ভাবী মস্তিষ্ক তার বিপুল ক্ষমতা নিয়ে মানুষের অস্থির আর দুর্বল হাতকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সেই সমস্ত কিছুর দায়িত্ব নেবে সেদিন। আর তারপর… ভাবো ক্যাথলিন, সাইবারনেটিকস যে হারে এগোতে শুরু করেছে… কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হাত, পা… এসব এখন নেহাত বাস্তব… তাহলে একদিন সেরকম একটা ধাতুর তৈরি অমিত শক্তিশালী কৃত্রিম শরীরের মাথায় অমন শক্তিমান একটা ইলেকট্রনিক মস্তিষ্ক ভরে দিলে…
“…সেদিন মানুষ ঈশ্বর হবে ক্যাথলিন। তার সমস্ত কঠিন আর বিপজ্জনক কাজের ভার সেই যন্ত্রজীবদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিশ্চিত হাতে ছেড়ে দিয়ে… শুধুই আনন্দ, শুধুই বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা… শুধুই উন্নত থেকে উন্নততর সৃজনশীল জীবনের পথে মানুষের যাত্রা…
“শুধু একটাই আক্ষেপ, সে দিনটা দেখবার জন্য আমরা বেঁচে থাকব না ক্যাথলিন। তবে সে দিনটার শুরুটা দেখে গেলাম, এইটেই তোমার-আমার সৌভাগ্য…”
***
সাংবাদিকটি জানত না, সে পেনসিলভ্যানিয়ার যে ক্রেজেন্ট হিল এলাকাটায় যেখানে বসে এই কথাগুলো বলছে, ঠিক সেই পাহাড়ের গায়ের এক গুহায় অবস্থান করেই… বহু লক্ষ সময়-একক আগে… সেই একই স্বপ্ন দেখেছিল… অন্য কেউ…
প্রথম প্রকাশ: নতুন গল্পপত্র
Tags: কল্পবিজ্ঞান, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা