দমের খেলা
লেখক: অলীক অনামিকা
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“হাওয়ার ঘরে দম আটকা পড়েছে…”
(ফকির লালন শাহ, লালনগীতিকা, পৃঃ ২৪৬)
“পদার্থও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়া থাকে—পদার্থ সম্বন্ধে পঞ্চত্ব কথা প্রয়োগ করা ভুল; কারণ রেডিয়ামের গুঁতা খাইয়া পদার্থ ত্রিত্বপ্রাপ্ত হয়, অর্থাৎ আলফা, বিটা ও গামা এই তিন ভূতে পরিণত হয়। এইরূপে পদার্থের অস্তিত্ব যখন লোপ হয় তখন অপদার্থ শূন্যে মিলিয়া যায়। কিন্তু যতদিন পার্থিব পদার্থ জীবিত থাকে ততদিন পৃথিবী ছাড়িয়া পলায়ন করিতে পারে না।” পলাতক তুফান (বৈজ্ঞানিক রহস্য, ১৯২১, জগদীশচন্দ্র বসু, অব্যক্ত)
১. ধুলার শহর: কোভিড ৩.০
৩০ নভেম্বর, ২১৯৯
সাত বছর পরে শীতের শুরুতে ঢাকার মাটিতে পা ফেলে অলীক দ্যাখে এই নগরী বড়োই ধূসর। চোখে দেখার আগে তার ফুসফুস ধুলা টের পায়। পকেটে রাখা সেন্সর রক্তচোখে বিপ বিপ করে জানায়:
Health 0%
Performance 20%
অলীক সঙ্গে সঙ্গে মাস্কের সামনের ফুটোর ঢাকনা খুলে তার দমযন্ত্রের সঙ্গে মাস্কটা জুড়ে দিয়ে যন্ত্রে ‘মুক্ত বায়ু’ ব্র্যান্ডের ছাপচিত্রের পাশে লেখা ‘শুদ্ধ বায়ু’ বোতামে চাপ দেয়।
বিশুদ্ধ অম্লজান ভরতি দমকা হাওয়ায় তার নাক-মুখ ভরে যায়। মস্তিষ্ক সতেজ হয়। প্রাণ ভরে বারবার শ্বাস নেয় সে।
হাতঘড়ি উলটে দ্যাখে, চামড়ার নীচে বসানো সেন্সর জানান দিচ্ছে:
Oxygen Saturation 98%
Pulse: 82 per minute
Blood Pressure: 125/85 mm Hg
যদিও পাঁচ মিনিট শুদ্ধ অম্লজান নেওয়ার পরে তাকে থামতে হয়। দমযন্ত্রে বড়ো বড়ো করে লেখা:
“অতিরিক্ত অম্লজানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে সাবধান!”
মাস্ক খুলে অলীক কালো চশমার ভেতর দিয়ে জানালার কাচে তার এক সময়ের প্রিয় শহরকে দ্যাখে। সুপার এক্সপ্রেস এয়ারওয়ে নামের আকাশপথে তার বায়ুযান খুব ধীর গতিতে চলছে। কারণ একটাই।
সতর্ক সংকেত:
Airway Traffic Congestion. Red Alert.
কতক্ষণে সে হোটেলে পৌঁছোবে, কে জানে?
একবার সাহস করে জানালা খুলে বাইরে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে।
পাশ দিয়ে হুউস করে চলে যায় চার-পাঁচটা বায়ুবাইক কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে। সবাই নাগরিক বায়ু চলাচল প্রশাসনকে গালিগালাজ করছে:
কেউ বলছে, “শুয়োরের বাচ্চা। এরা মানুষ না। লাখ লাখ টাকা বায়ুকর নিবে। এরা কোনো ধরনের সেবা নাগরিকদের দিবে না।”
আরেকজন পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলছে, “ভাই, আপনি কী কন? মানুষে কি চালায় নাকি? সব আ্যলগোরিদ্মে চলে। দ্যাখেন গিয়া, কনট্রোল রুমে এআই বইসা আছে।”
বাকিটা আর শুনতে পায় না অলীক।
অজস্র উন্নয়নধর্মী অবকাঠামোর কাজে মহানগরী ঢাকায় একুশ শতকের চেয়েও আজ অধিক শব্দসন্ত্রাস, ধুলার রাজত্ব। মুখে সাম্প্রতিক অতিমারির সময়কার তিন মাত্রার মুখোশ পরেও ক্ষতিকর বায়ুকণার আগ্রাসন ঠেকানো যাচ্ছে না।
বায়ুযানের চালক সহসা অনুযোগ করে, “ম্যাডাম, গাড়িতে ধুলা ঢুকে যাইতেসে। এক্সট্রা ক্লিনিং চার্জ দিতে হবে।”
অফিসের গাড়ি। কিন্তু চালক বেশ রূঢ়কণ্ঠে কথাগুলো বলে। অলীকের পছন্দ হয় না। সে কড়া কথা শোনা বা বলার ব্যাপারে অতি সংবেদনশীল। এর জন্য কর্মজীবনে তাকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে।
আর এমনি কপাল—সে বৃহত্তর জার্মানির মতো একটি রূঢ়ভাষী অঞ্চলে থাকে, যেখানে প্রায় প্রতিদিন চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ যন্ত্রমানুষের আক্রমণ থেকে অযান্ত্রিক মানুষদের, বিশেষত কালো ও বাদামি মানুষদের আত্মরক্ষা করে চলতে হয়।
বার্লিনের ট্যাক্সি ও বাসচালকদের মেজাজ কুখ্যাত। কালো বা বাদামি মানুষ গাড়িতে উঠলে তো কথাই নাই। পরিচয়পত্র চেক করতে বলবে, ইনটারকমে হাজিরা দিয়ে শপথবাক্য পাঠ করতে হবে, যার সারাংশ: “আমি গণতন্ত্র, যন্ত্রবান্ধব পরিবেশ এবং দৈহিক ও সামাজিক জনজীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাসী।”
বার্লিনের দৈনন্দিন জীবনে বর্ণবাদী অভিজ্ঞতার স্মৃতি মনে করে অলীক শান্ত হয়। সে তার অযান্ত্রিক বাংলাদেশি বায়ুযানচালককে কিছু একটা কঠিন কথা নরম সুরে বলতে গিয়েও থেমে যায়। খোলা জানালা বন্ধ করে সে চশমার স্ক্রিনে মেইল ফিড দেখতে থাকে।
বিপ বিপ বিপ…
আবার কী হল?
পকেটে রাখা শুদ্ধ বায়ু যন্ত্রটা বড়োজোর দুই ঘণ্টা কাজ করে। ঘনঘন ফিলটার বদলাতে হয়। অলীক বার্লিন থেকে পঞ্চাশটা ফিলটার নিয়ে এসেছে লুকিয়ে। কুড়ির বেশি ফিলটার সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক জলপথে চলাচলের নিয়ম নেই।
আকাশপথে আরও বেশি ফিলটার আনা যেত। কিন্তু টিকেটের দাম খুব বেড়ে গেছে শেষ অতিমারির পর থেকে। কারণ গত কয়েকটি অতিমারি পরপর আকাশপথেই সব চেয়ে বেশি অভিযাত্রীদের আক্রান্ত করেছে।
বার্লিনে এখনও অতিমারি চলছে।
ঢাকায় কোনো এক আশ্চর্য কারণে অতিমারি এসেও থেমে গেছে। খানিকটা একুশ শতকের অতিমারি, কোভিডের মতন তার হাবভাব। তাই কেউ কেউ বলতে আরম্ভ করেছেন: এই অতিমারির নাম কোভিড ৩.০।
কিন্তু সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেলেও কোভিড ৩.০-এর জয়যাত্রা ঢাকায় ঠেকাল কে বা কারা?
জনস্বাস্থ্যের এই বৈজ্ঞানিক রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যই অলীককে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় পাঠিয়েছে বার্লিনের রবার্ট কখ ইন্সটিটিউট।
একুশ শতক থেকেই বায়ুদূষণে ঢাকা শীর্ষস্থানীয় শহর।
অলীক যতবার ঢাকায় আসে, প্রত্যেকবার রাস্তায় বের হলে মনে হয়, নাকে মুখে কানে পেটে ফুসফুসে ধুলা ঢুকে জমে এক ইঞ্চি পুরু হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে প্রবাসী উতুপুতু ভাব নিয়ে তার পক্ষে তো ঘরে বসে থাকা চলে না। একটা জটিল কাজে এসেছে। কাউকে খুঁজতে এসেছে।
অলীক যাদের খুঁজছে, তারা কারা?
২. দমের খেলোয়াড়
“বায়ু স্থির না হইলে কিছুই স্থির হয় না। সুতরাং সিদ্ধিলাভও হয় না।”
(গোরক্ষনাথ, source)
কোভিড ৩.০. কেন ঢাকায় থেমে গেল, তার অনেকগুলো হাইপোথেসিস আছে।
কেউ কেউ বলেন, কোনো এক গুপ্তবিদ্যাচর্চার কারণে এটা সম্ভব। একদল মানুষ আছেন আমাদের দুনিয়ায়, যাঁরা হাওয়ার সাধনা করেন। দমের খেলায় পারদর্শী। তাঁরা গোপনে এই বিদ্যা সাধারণ জনগণকে শিখিয়েছেন।
বিগত হাজার বছরের আর্কাইভে তাঁদের বিভিন্ন নামে ডাকা হত। বিজ্ঞান নয়, তাঁদের জন্য চিহ্নিত জায়গা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক আর্কাইভে।
তাঁদের নাম ছিল:
যোগী
ভিক্ষু
সুফি
সাধক
বাউল
এই সময়ে আমাদের দেশে তাঁরা ‘দমের খেলোয়াড়’ নামে পরিচিত।
“এটা একটা আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট। গুপ্তবিজ্ঞান।”
স্ক্রিনের উপর ভেসে-আসা এআই অবতার মইদুলকাকার গলা নকল করে কথা বলতে থাকে।
“গুপ্তবিজ্ঞান কেন বলছেন কাকা? গুপ্তবিদ্যা বলেন।”
অলীক তার পার্সনাল এআই সহকর্মীকে কাকা বলেই ডাকে। একটা মানুষ-মানুষ ফিল আসে তার মধ্যে।
“আগে যা ছিল বিদ্যা, আজ তা-ই হয়েছে বিজ্ঞান।”
মইদুলকাকা বেঁচে থাকতে তাঁর সঙ্গে তর্কে কখনও পেরে ওঠেনি অলীক।
কাকার মৃত্যুর পর তাঁর এই কৃত্রিম অবতারের সঙ্গেও বিতর্কে জেতা মুশকিল।
অলীক হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে বলে, “কাকা, এই গুপ্তবিদ্যা সম্পর্কে তাহলে আরও কিছু বলুন। শুনি।”
মইদুলকাকা তাঁর শান্ত, স্থিতধী কণ্ঠে পড়তে শুরু করেন এক প্রাচীন গ্রন্থ থেকে:
“মন্-থীরিতে পবন্-থীর পবন্-থীরিতে বিন্দুথীর।
বিন্দুথীরিতে কন্দথীর বলে গোরক্ষদেব সকলথীর।।
(হঠপ্রদীপিকা-ধৃত গোরক্ষ-বাক্য)
অর্থাৎ, গোরক্ষদেব বলেন, মন স্থির হইলে বায়ু স্থির হয়, বায়ু স্থির হইলে বিন্দু স্থির হয়, বিন্দু স্থির হইলে কন্দ স্থির হয়, এবং তাহা হইলেই সকল স্থির হয়।”
…
খানিকটা শোনার পর অলীকের সব গুলিয়ে যেতে থাকে। তার মনে বিবিধ জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়।
সকল প্রশ্নের মধ্যে সব চেয়ে জরুরি প্রশ্ন: “বায়ুর সাধনা করে কি বায়ুদূষণের প্রতিক্রিয়া এড়ানো সম্ভব? বায়ুর সাধনায় কোভিড ৩.০-এর জীবাণু দমন হয়ে যাবে? এত সোজা?”
মইদুলকাকা ক্রমশ পড়ে যাচ্ছেন একের পর এক প্রাচীন গ্রন্থের ডিজিটাল পাতা। মাঝে মাঝে মোটা অক্ষরে উদ্ধৃতি দেয়ালের হলোগ্রামে ছুড়ে দিচ্ছেন। অলীক কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, টের পায়নি।
ঘুমের মধ্যে হঠাৎ দম নিতে খুব কষ্ট হতে শুরু করে। পাঁজরের গতি ক্ষীণ হয়।
অলীক ছোটো ছোটো শ্বাস নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর গভীর শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে তার মনে হয় যেন কেউ তার পাঁজরের দুইপাশ চেপে ধরেছে। একই সঙ্গে আরও কেউ যেন বুকের উপর একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে।
অলীক যত শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে, ততই চাপ বাড়ছে পাঁজরের দশদিকে। আর কিছু না করতে পেরে হাল ছেড়ে দেয় সে।
নিজের জন্ম-শহরে দম বন্ধ হয়েই মারা যাওয়া ছিল তার কপালে?
***
“হা আআআ হা… হাহ্!”
দম-বন্ধ-করা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে পাগলের মতো দম নিতে থাকে অলীক।
বাইরে গভীর রাত।
দূর থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসে দশদিক থেকে। দিনে পাঁচবার সৃষ্টিকর্তার কাছে নতজানু হওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রত্যেক পাড়ায় একটা সাইরেন বসানো হয়েছে।
সেই শব্দে কানে তালা লেগে যায়। শব্দ শাটারটা দ্রুত নামিয়ে দেয় অলীক। এই শহরে কোনো একদিনে বায়ুদূষণে না হোক, শব্দদূষণে মরে যাবে সে।
জোর করে কাউকে ধার্মিক বানাতে চাইলে তার ফল কী হতে পারে, সেটা ইতিহাসের ভয়াবহ ধর্মযুদ্ধগুলো প্রমাণ করে দিয়েছে। কোনো ধর্মের লোক এই সহিংসতা থেকে রক্ষা পায়নি।
জোর করে বিজ্ঞান প্রয়োগের ফলও ভালো হয় না।
২০২০ সালে যখন কোভিড ১.০ সারা পৃথিবীর ফুসফুস ধ্বংস করতে যাচ্ছিল, তখন খুব তাড়াহুড়ায় সৃষ্টি করা প্রতিরোধী টিকার কার্যকারিতা নিয়ে জনমানসের সংশয় ও আতঙ্ককে পুঁজি করে লাভবান হয়েছে শুধু দেশে দেশে চরমপন্থী দলগুলো। অতিমারিকে পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি আজও।
বিজ্ঞান আর ধর্ম এই দুই বিদ্যা মানবসভ্যতার আশীর্বাদ না অভিশাপ এই বিতর্কের মীমাংসা কবে হবে, কেউ কি জানে?
দম ফিরে পেয়ে অলীক জীবন ফিরে পায়।
মাথা ভরতি প্রশ্ন ঘুরতে শুরু করে আবার।
দৈনন্দিন বেশ কয়েকটা বায়ুব্যয়ামের অভ্যাস আছে তার। কিন্তু কী মনে করে সে মইদুলকাকার কথাগুলো replay করে কয়েকবার শোনে।
Replay শেষ করে বলে, “কাকা, বায়ুসাধনার পদ্ধতি নিয়ে কিছু পেলে বলেন তো। আমি একটা পরীক্ষা করতে চাই নিজের উপর।”
মইদুলকাকা এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার আরম্ভ করে: “গুরু-শিষ্য পরম্পরা ব্যতিরেকে এই সাধনা নিষ্ফল…”
অলীক প্রথম বাক্য শুনে হাই তুলে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। “এসব আমাকে দিয়ে হবে না, কাকা।”
বিড়বিড় করতে করতে আবারও গভীর ঘুমে প্রবেশ করে সে।
ঘুম যত গভীর হয়, স্বপ্নলোকের চাবি তত জোরে ঘুরতে থাকে।
দমের খেলোয়াড়েরা সেই চাবি নিয়ে খেলতে জানেন। এবারের চাবির নাম ‘অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি’।
টেলিপ্যাথি বা কঠিন বাংলায় ‘অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি’ বিষয়ে প্রাচীন বিজ্ঞান যা-ই বলে থাকুক, ২০২০ সালের কোভিড ১.০ উত্তর পৃথিবীতে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিভেদ বোঝার জন্য নতুন প্রজাতির নৃসমাজ ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়েছে গত দুই শতক ধরে।
অলীক টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করে না, কারণ ‘অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি’ প্রক্রিয়াটা তার কাছে স্পষ্ট না। অথচ ঢাকায় বা বার্লিনে বেশ কয়েকবার টেলিপ্যাথিক অভিজ্ঞতা তার মনে রাখার মতো।
কী এক অজ্ঞাত কারণে সে মইদুলকাকাকে এই একটা ব্যাপারে কখনও কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
একটা অস্বস্তি কাজ করে। যা সে নিজের শরীর-মন দিয়ে উপলব্ধি করেছে, তার চেয়ে বড়ো সত্য কি বিজ্ঞানের বইয়ের পাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে?
প্রতিবার অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি আসে সবার আগে অলীকের নাকে। একটা অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে। তীব্র গন্ধ, যেন জানালার পাশে কামিনী ফুল ফুটেছে শত শত।
কামিনী নাকি হাসনুহানা? ফুলের গাছের দেশি নাম সে তেমন ঠাহর করতে পারে না। নামের সঙ্গে যদি বা চোখে দেখা গাছের মিল পায়, ঘ্রাণের সঙ্গে নামের যোগ তার জন্য কঠিন।
মইদুলকাকার নিতান্ত প্রাথমিক ঘ্রাণশক্তি দিয়ে কামিনী আর হাসনুহানা ফুলের গন্ধের পার্থক্য করা সম্ভব না।
কিন্তু এই মুহূর্তে গন্ধটা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে আর তার মানে কেউ তার কথা ভাবছে, যোগাযোগ করতে চাইছে। গন্ধটা এত তীব্র হয়নি এর আগে। কেউ কি জেনেশুনে অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি চর্চা করছে? কে বা কারা?
***
অলীক নিজেকে বৈজ্ঞানিক হিসেবে পরিচয় না দিয়ে বলে রহস্যসন্ধানী তাত্ত্বিক, পরিবেশকর্মী ও কল্পকাহিনি লেখক।
দমের খেলোয়াড়দের কাউকে খুঁজে বের করে তাঁদের বায়ুসাধনায় বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধান হোক-না হোক, রোমাঞ্চকর কল্প উপন্যাস লেখা খুব সম্ভব।
যেসব ঘটনার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ থাকে না বর্তমানে, সেসব নিয়ে কল্পবিজ্ঞান লেখাই সমীচীন, গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ নয়।
এই মুহূর্তে অলীকের অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি বলছে, দমের খেলোয়াড়দের একজন তার আশপাশে ঘুরঘুর করছে। ঠিক তক্ষুনি বিপ বিপ বিপ।
মেসেজ পড়তে শুরু করলেন মইদুলকাকা:
“প্রিয় অলীক,
আমরা জানি, আপনি আমাদের খোঁজ করছেন। আপনার বুদ্ধিমত্তায় আমাদের আস্থা আছে। আপনার উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনার মন যত-না সন্ধানী, তার চেয়ে অনেক বেশি সংশয়ী।
সুতরাং আমাদের সঙ্গে দেখা করার আগে অন্তত একুশ দিন আপনাকে বায়ুসাধনা করতে হবে। নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যা।
আপনার ঠিকানায় আমরা বিস্তারিত জানিয়ে একটি হাতচিঠি পাঠাব। আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে আপনি সেই প্রশ্ন নিয়ে ভাববেন। সময় নিয়ে, মনোরোগ দিয়ে।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায়:
অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি।”
৩. দমের খেলা
‘হুশ দার দাম’
আঁকাবাঁকা হাতে বাংলায় লেখা এক লাইনের চিঠিটা হাতে পেয়ে অলীক অবাক হয়। কেউ কি তার সঙ্গে মশকরা করছে?
“Is it some kind of a practical joke?” অলীক প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় হাওয়ায়। সাধারণত তার যে-কোনো সরব মন্তব্যের প্রত্যুত্তর আসে।
কিন্তু মইদুলকাকাকে log off করে রেখেছে অলীক আজ সকাল থেকে। কী কারণে তার মনে হয়েছিল, এই চিঠি বিষয়ে কোথাও কোন ডিজিটাল রেকর্ড না-থাকাই ভালো।
কিন্তু এক লাইনের চিঠিটা পেয়ে এখন মনে হচ্ছে এতটা সতর্কতার কিছু নেই।
Log on করে সে মইদুলকাকাকে জিজ্ঞেস করে, “হুশ দার দাম মানে কী? কোন ভাষা?”
জবাবে মইদুলকাকার দীর্ঘ বক্তৃতা: “নকশবন্দি পথের ১১টি মূলনীতির সর্বপ্রথম নীতি ‘হুশ দার দাম’। সুফি আবদুল খালিক ঘুজদুওয়ানি (মৃত্যু ১২২০) আর সুফি বাহা আদ-দিন নকশবন্দ (মৃত্যু ১৩৮৯) এই গুপ্ত নিয়মগুলো তৈরি করেছেন তাঁদের শিষ্যদের আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য…”
এটুকু শুনে অলীকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে চেঁচিয়ে বলে, “কাকা থামেন তো! কী সব ভুজুংভাজুং দিচ্ছেন? আধ্যাত্মিক উন্নয়নের সঙ্গে দমের কী সম্পর্ক?”
মইদুলকাকা অলীকের অসহিষ্ণুতা গ্রাহ্য না করে বলতে থাকেন, “প্রত্যেকটি শ্বাস যখন ভিতর থেকে বের হয়, তাকে অবশ্যই সচেতনভাবে নিঃসৃত হতে হবে, যাতে করে কোনো কিছুতেই মন বিস্মৃতির দিকে না যায়। বাহা আদ-দিন নকশবন্দ বলেছেন, ‘আমাদের কাজের মূলভিত্তি আছে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে। একজন ব্যক্তি যত বেশি শ্বাসপ্রশ্বাস সম্পর্কে সচেতন, তার অন্তর্জীবন তত শক্তিশালী। প্রত্যেকের জন্য তার শ্বাসকে সুরক্ষিত করা আবশ্যক।’
“সাধক ও অন্বেষক যখন মুহূর্তের অনুশীলনে (অর্থাৎ নিশ্বাসের কথা মনে রাখায়) ব্যস্ত, তখন তিনি অতীতকে স্মরণ করেন না। ভবিষ্যতের চিন্তায় তাঁর মনোযোগ থাকে না। প্রতিটি নিশ্বাসের মেয়াদ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তিনি নিশ্বাসের দিকে মনোনিবেশ করেন।
“আত্মার উপস্থিতি নিশ্বাসে। ‘আত্মা একটি শ্বাসপ্রশ্বাসদেহ বলেই তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য।’ শ্বাসের সচেতনতা আমাদের আত্মা এবং অভ্যন্তরীণ দেহ, অভ্যন্তরীণ আত্ম সম্পর্কে সচেতন করে, যা মুহূর্তে মুহূর্তে সন্তরণশীল।
“সুফি পথে শ্বাসপ্রশ্বাসের সচেতনতা অনেক বড়ো নীতি। যারা এই পথে আছে, তারা শ্বাসপ্রশ্বাসে অচেতন হয়ে পড়াকে মহাপাপ বলে মনে করে।”
(Source)
অলীক মন দিয়ে শুনতে থাকে কথাগুলো। যদিও তার অজ্ঞেয়বাদী বিজ্ঞানতাত্ত্বিক মগজ খুব একটা সায় দেয় না। কিন্তু তার ফুসফুস কী এক অজ্ঞেয় কারণে খুশি হয়। বুক ভরে শ্বাস নেয় অলীক। সচেতনভাবে শ্বাস নেয়। যেন জীবনে এই প্রথম। যেন এর আগে কোনোদিন সে ঠিক করে শ্বাস নেয়নি।
হুশদারদাম হুশদারদাম হুশদারদাম।
দমের উপর হুশ রাখুন।
এই একটিমাত্র বাক্যের এতটাই ক্ষমতা?
***
অলীক পরপর একুশ দিন জেগে-থাকা প্রত্যেক মুহূর্তে দম সাধনা করে। অতীতের যাবতীয় শোক ভুলে যায় সে, ভবিষ্যতের আশঙ্কা তাকে ছুঁতে পারে না।
কুড়ি দিন কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় না। মইদুলকাকার সঙ্গেও না।
একুশ দিনের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সে দ্যাখে বাইরে আকাশ এখনও ধুলায় আচ্ছন্ন। কিন্তু তার ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, গোটা শরীর তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে।
হাতঘড়ি উলটে দ্যাখে, চামড়ার নীচে বসানো সেন্সর জানান দিচ্ছে:
Oxygen Saturation 100%
Pulse: 72 per minute
Blood Pressure: 120/8 mm Hg
অলীকের মাথা ও মন অলৌকিক শূন্যতায় ভরে থাকে। সেই শূন্যতায় কোনো দুঃখ নেই। সীমাহীন মুক্তির স্বাদ।
অলীকের মাথা নুয়ে আসে কৃতজ্ঞতায়: “আপনারা কে বা কারা জানি না। কিন্তু ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা নেই আমার। খুব ইচ্ছা করছে, আপনাদের পা জড়িয়ে ধরে সালাম করি।”
“পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার প্রয়োজন নেই। আপনার শুদ্ধ দম আমাদের কাছে পৌঁছেছে। খুব অল্প সময়ে আপনি দমের খেলার মূলনীতি শিখে গেছেন। আমাদের মনে হয়, আপনার নিয়ৎ ঠিক থাকলে আপনিও কোনো একদিন দমের দক্ষ খেলোয়াড় হতে পারবেন।” (অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতি)
ঘরে কেউ নেই, তবু অলীক চেঁচিয়ে বলে, “আপনারা কে? আমি কোথায় পাব আপনাদের?”
দশদিক থেকে ফিশফিশ করে কে বা কারা বলছেন, “আমরা মইদুলকাকা। এখনও চিনতে পারোনি?”
* “জয়ঢাক প্রকাশনের ‘অন্য বসন্তের উপাখ্যান’-এ প্রকাশিত।”
Tags: অলীক অনামিকা, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা