দণ্ডবায়স
লেখক: মূল রচনা: এডগার অ্যালান পো অনুবাদ: মৌমিতা চন্দ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মূল কবিতা: The Raven
একদা এক নিশীথ রাতে শ্রান্ত করুণ মন
ঘুরে ঘুরে মরছে শুধু প্রাচীন কথার কোণ,
শরীর আমার লুটিয়ে পড়ে, এল কি চোখ ঢুলে?
কিন্তু কে ওই নাড়ছে কড়া, কে এল পথ ভুলে?
স্পষ্ট আমার স্মরণেতে, সে এক শীতের রাত
নিবন্ত সব অঙ্গারেরা ধরছে আঁধার হাত
বৃথাই আমি করছি আশা, দুখবিহীন এক উষা
পুরাণ পুথির পাতায় পাতায় পাইনি যে তার দিশা,
হারিয়ে-যাওয়া লেনোর আমার, দেবদুর্লভ নারী
ভুলেছে তার নাম সকলে, দিতে সময় পাড়ি।
রেশম-বোনা পর্দা কাঁপে, বেগনিরঙা মায়া,
অন্তরে মোর রূপ ধরেছে অদ্ভুত ভয়-ছায়া
চলছে তবু হৃদ্যন্ত্র, একলা তারই জোরে
ফিশফিশিয়ে বলি তবু, “কে এল এই দোরে?”
হঠাৎ করেই নিজের মাঝে শক্তি ফিরে পাই—
অক্ষমতা সবিনয়ে স্বীকার করি তাই—
“ঘুমিয়ে ছিলাম, দুঃখিত, তাই আসতে হল দেরি—
কী নিঃশব্দ এই আগমন, নইলে কি ভুল করি?”
বলতে বলতে দরজা খুলে, দরজার ওই পার—
আঁধার—খালি আঁধার শুধু, কিচ্ছুটি নেই আর!
সেই আঁধারে দাঁড়িয়ে আমি, মনের মাঝে ভয়,
সংশয় আর সন্দেহ, আর স্বপ্ন দেখাও রয়,
স্বপ্ন, সে যা নশ্বর জীব কেউ দেখেনি আগে
অটুট ওই নৈঃশব্দ্য, নিস্তব্ধ জাগে
শব্দ সে যা একমাত্র, ভাঙল সকল ডোর
আমার কণ্ঠে, ‘লেনোর’ আর প্রতিধ্বনি জোর।
ফিরছি ঘরে, অন্তরেতে জ্বলছে দাবানল
আবার যে কেউ নাড়ছে কড়া, বলছে, “ফিরে চল।”
নিশ্চিত ওই রাতের বাতাস বাজাচ্ছে ঝুমঝুমি
জানলার ওই খড়খড়িতে আলতো করে চুমি
হৃদয় আমার, শান্ত হ তুই, দেখছি উঁকি মেরে
নিশ্চয়ই এক ঝোড়ো বাতাস বইছে এমন করে।
খুলেই দিলাম জানলা-কপাট, শব্দ যা হয় হোক
দণ্ডবায়স ঢুকল ঘরে, উদাত্ত তার চোখ।
রাজার মতো ভঙ্গি যে তার, নোয়ায়নি তো মাথা
উড়াল দিয়ে বসল শুধু প্যালাসমূর্তি যেথা
সেই প্যালাসের মূর্তি, যা তো দোরের মাথার চূড়া,
দণ্ডবায়স বসল তাতে, বন্ধ করে ওড়া।
আঁধাররঙা দণ্ডবায়স, গম্ভীর এক প্রাণী
ব্যথার মাঝেও আনছে টেনে আমার হাসিখানি—
“তুমি তো নও হীন কাপুরুষ, উন্নত ওই শির,
কী নাম তুমি ধারণ করো, পাতাললোকের বীর?”
জবাব দিতে নাড়াল ঠোঁট দণ্ডবায়স তার,
বলল শুধু একটি কথা, “কক্ষনো না আর।”
অবাক আমি শুনেছিলাম পাখির স্পষ্টবাক
উত্তরে তার অর্থ কিছু থাক অথবা না-থাক—
এই দুনিয়ায় আছে কি কেউ আমার আগে-পরে—
পাখির সঙ্গে বলছে কথা এমনই এক ঘরে?
হোক সে পশু, কিংবা পাখি, অন্য জানোয়ার,
বলেছে কি কখনও কেউ, “কক্ষনো না আর”?
একাই বসে দণ্ডবায়স, নেই তো কোনো দ্বিধা,
একটিমাত্র বাক্যে ঢালে আপন প্রাণের সুধা
বলছে না আর কোনো কিছুই, কাঁপছে না তার পাখা
সংশয়েরই মাঝে এ যে বন্দি হয়ে থাকা—
“আসবে উষা, তুমিও যাবে, রইবে না কেউ আর”—
দণ্ডবায়স বলল শুধু, “কক্ষনো না আর!”
সুতীক্ষ্ণ এই উত্তরেতে ভাঙল নীরবতা
সংশয়ী এই আমি, ভাবি, কতকালের কথা,
সুনিশ্চিত, মনিব যে এর নিঠুর কোনো কেউ,
তার হতাশা, অক্ষমতা তুলত তুফান ঢেউ,
শিখেছে ওই একটি বুলি সকল কিছুর সার,
আওড়ে চলে বারবার তাই, “কক্ষনো না আর।”
রহস্যময় দণ্ডবায়স, লাগছে যেন নেশা,
রেশম-মোড়া আসনখানা দোরের কাছে ঘেঁষা—
সেই আসনে বসছি আমি, ভাবনার নেই পার,
কী ভেবে ও বলছে শুধু, “কক্ষনো না আর”?
ভাবছি মনে কতই কিছু, প্রকাশ অপ্রতুল,
আগুনচোখো পাখির নজর বিঁধছে যেন শূল—
বসেই আছি নিশ্চুপে তাই, হেলিয়ে দিয়ে মাথা,
বেগনিরঙা রেশম গদি, নরম আলোয় মাখা,
হায়, যদি সে থাকত ঘরে, এই আসনের ধার—
কিন্তু সে আর ঘটবে না তো, কক্ষনো না আর!
বাতাস হয়ে উঠছে ভারী, গন্ধধূপের তায়,
দেবদূতেরা আসছে বুঝি, শব্দ তাদের পায়,
দুঃখী আমি, ঈশ্বর হে, পাঠাও তোমার দূত,
বিস্মরণের মধুর সুধা আস্বাদে প্রস্তুত।
এই সুধা কী করবে আমায় লেনোর-স্মৃতির পার—
দণ্ডবায়স বলল শুধু, “কক্ষনো না আর!”
পাখি রে তুই কেমন প্রাণী, কোত্থেকে তুই এলি,
আলোর পথে, নাকি ধরে অন্ধকারের গলি?
নাকি প্রবল ঝড়ের ঠ্যালায়, আসলি ভেসে তুই
কোনখানে তোর বাসা পাখি, কোনখানে তোর ভুঁই?
সেই ভূমে কি বসছে শুধুই নিষ্করুণের মেলা,
অন্ধকারের শক্তিরা সব করছে সেথায় খেলা?
আসলি ভেসে সেখান থেকে এই দুনিয়ার পার,
বল রে পাখি, এই তো সময়, পারছি না যে আর।
যন্ত্রণাহর সেই ওষধি, দেবে কি কেউ ধার?
দণ্ডবায়স বলল শুধু, “কক্ষনো না আর!”
পাখি রে তুই কেমন প্রাণী, কোত্থেকে তুই এলি,
আলোর পথে, নাকি ধরে অন্ধকারের গলি?
ঈশ্বরেরই দিব্যি তোকে, সত্যি করে বল,
দুঃখভরা এ মন আমার, করিসনে তো ছল
উজ্জ্বলা সে, লেনোর আমার, দেবদুর্লভ নারী,
স্বর্গের সেই উদ্যানেতে একলা দিলে পাড়ি,
আত্মা কি মোর পাবে তাকে, ছোঁবে কি হাত তার—
দণ্ডবায়স বলল শুধু, “কক্ষনো না আর!”
“চলে যা তুই, পাখি, নাকি জমাট অন্ধকার—”
আর্তনাদে উঠছে বেজে আমার ভিতর-বার
“সওয়ার হ তুই ঝড়ের আবার, যা ফিরে তুই ঘর,
রাতের কালো জমাট-বাঁধা মরণ সাগর চর,
ঝরাসনে তুই পালক কোনো, রাখতে প্রমাণ আজ,
রেখে যা তুই একলা আমায়, ছাড় মর্মর তাজ!
ছেড়ে যা তুই এ দ্বার আমার, আসিসনে তো আর—”
দণ্ডবায়স বলল শুধু, “কক্ষনো না আর!”
বসেই থাকে দণ্ডবায়স, নিঝুম নিথর চুপ,
পায়ের নীচে প্যালাসেরই মূর্তি-প্রতিরূপ
স্বপ্নালু তার চোখের তারায় আঁধাররঙা খেলা,
বাতির আলো চুইয়ে পড়ে, ছায়াকে দেয় ঠ্যালা,
আত্মা আমার সেই ছায়াতে ঘুরছে বারংবার,
মুক্তি সুদূরপরাহত, কক্ষনো না আর!
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মৌমিতা চন্দ