সম্পাদকীয়
লেখক: কল্পবিশ্ব
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
অভয়া বিচার পাননি এখনও। আমাদের সকলের সমবেত প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ এখনও রাজপথে রাজপথে অসহায়ের বোবা কান্নার মতো পাক খেয়ে খেয়ে মাথা কুটে মরছে। ধূসর আকাশ আর ভাঙা হৃদয় নিয়ে শরৎ এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়, তাকে বরণ করে নেবে কে? কত প্রশ্ন উঠছে দিকে দিকে। প্রতি বছর নারী শক্তির জয়গান গাই নিয়ম করে—তাহলে নারীদের উপর এত অত্যাচার আমাদের সমাজে হয় কেমন করে? ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। দেশের বিত্ত বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে বিত্তহীনদের দুর্দশা। সমাজ ও সভ্যতা বিজ্ঞানের হাত ধরে নতুন দিশার দিকে পা বাড়ালে অজ্ঞান, অধর্ম আর কুসংস্কার আমাদের টেনে ধরছে পিছনের দিকে। এ সবের থেকে কি মুক্তি নেই? এত অস্বস্তি আর বিপন্নতা নিয়ে আগে বোধহয় আর কোনো পুজো আসেনি। নাকি এসেছিল? প্রতিবারেই আসে হয়তো? শুধু বদলে যায় প্রেক্ষাপট? উত্তর নেই। তবে একটা আশ্বাস আছে। এমন জটিল ও কুটিল সামাজিক টানাপোড়েনের রেখাচিত্র বুঝতে গেলে কল্পবিজ্ঞান পড়তে হবে। পড়তে হবে কালজয়ী লেখক লেখিকাদের দৃষ্টিভঙ্গিও। তাঁরা পর্যবেক্ষক—আমাদের সামগ্রিক অবক্ষয় আর অবনমনের ইতিহাস তাঁদের কাহিনিতে বারবার উঠে এসেছে। বর্তমানের লেখকরা বলে দিয়েছেন আগামীর বিপদগুলির কথা। সে কথা শুনতে হবে, জানতে হবে—ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সাহিত্যই হাতে তুলে দেবে সমস্ত অশুভর সঙ্গে লড়াইয়ের সাহস এবং মেধা। তাই বিপন্ন মন্যুষত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রতিবারই সমস্ত প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা কল্পবিশ্বের শারদ সংখ্যা নিয়ে হাজির হই। নতুন এবং পুরোনো শব্দশিল্পীদের চেতনায় অনাগত ভবিষ্যতের মানচিত্র উৎসুক পাঠকের হাতে তুলে দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাই। এ আমাদের এক পবিত্র কর্তব্য, যে কর্তব্যে আমরা আজীবন ব্রতী ছিলাম, আছি এবং থাকব।
এবার আসি এ বছরের পুজোসংখ্যায় উপস্থিত লেখাগুলির বিষয়ে। নিঃসন্দেহে প্রতিবারের মতোই এবারেও আমাদের ওয়েবজিনে বিষয় বৈচিত্র অবাক করে দেওয়ার মতন। একাধারে যেমন আছে বাংলা ভাষায় রচিত উপন্যাস, বড়োগল্প, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ও লিমেরিক, পুস্তক আলোচনা, ঠিক তেমনি আছে ইংরেজি নভেলা এবং ছোটোগল্প এবং প্রবন্ধও। কল্পবিশ্বের ওয়েবজিনের জন্য এ বছর প্রথমবারের জন্য কলম ধরলেন প্রখ্যাত শিশু-কিশোর সাহিত্যিক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা নেই আমাদের। আমাদের কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী পাঠকদের জন্য তিনি লিখেছেন বিজ্ঞানাশ্রয়ী একটি অসাধারণ গল্প। লেখক, অনুবাদক এবং সাহিত্যিক অদ্রীশবাবু আজীবন আমাদের পাশে ছিলেন উৎসাহের প্রজ্জ্বলিত দীপ হয়ে, প্রতিবারের মতন এবারের সংখ্যাতেও তিনি আছেন একটি অনুবাদ গল্প নিয়ে। তাঁর সঙ্গে আছেন রণেন ঘোষ, নিরঞ্জন সিংহ এবং সিদ্ধার্থ ঘোষ। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না, এই প্রথম আমাদের ওয়েবজিনে ইরানের প্রথিতযশা লেখিকা জোহা কাজেমীর গল্প অনূদিত হয়ে প্রকাশ পেল আমাদের সকলের অত্যন্ত প্রিয় কবি ও লেখিকা যশোধরা রায়চৌধুরীর হাত ধরে। জোহার গল্প বিদেশের মাটিতে নারীদের অবস্থানকে বুঝতে আমাদের কাছে দূরবীনের কাজ করতে পারে অনায়াসে। স্বনামধন্য লেখকদের সঙ্গে এবারের সংখ্যায় নতুনদের উপস্থিতিও চমকে দেবার মতন। তাঁদের অনভিজ্ঞ কলমের দুরন্ত প্রাণশক্তি আশা করি অনেকের মন ও মগজে আলোড়ন তুলবে অচিরেই। সম্পাদকদের তরফ থেকে তাঁদের জন্য রইল অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। নবীনদের শব্দে প্রকাশের পথ উন্মুক্ত হোক আগামীর।
কল্পবিশ্বের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এবার বিখ্যাত চিনা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক রিভারফ্লো লেখা পাঠিয়েছেন। সাড়া দিয়েছেন আর্থার লিউ এবং শ্বেতা তানেজাও। আশা করি ভবিষ্যতেও তাঁরা এমনি করে আমাদের সাহিত্য যজ্ঞে উদ্দীপনার জ্বালানি জুগিয়ে যাবেন।
শারদ সংখ্যার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল তার প্রচ্ছদ। উজ্জ্বল ঘোষ অক্লান্ত পরিশ্রমে যে প্রচ্ছদটি এবার পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছেন তার জুড়ি মেলা ভার। তাঁকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা নেই। উজ্জ্বলের সঙ্গেই ধন্যবাদার্হ হলেন আমাদের সম্পাদকবাহিনীর নবতম সংযোজন রাকেশকুমার দাস এবং দেবরাজ মৌলিক। গল্প নির্বাচন থেকে পত্রিকার সামগ্রিক পরিচালনায় তাঁরা যেমন করে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় প্রতিবার জ্বলে উঠেছেন তাতে একটি ব্যাপার পরিষ্কার—কল্পবিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারে নতুন রক্তের অভাব কোনোদিন হবে না। আর ধন্যবাদ জানাই সহযোদ্ধা রনিন ও প্রমিত নন্দীকে। সবার শেষে, যে তিনজনের কথা না বললে ঘোরতর অপরাধ হবে কল্পবিশ্বের সেই তিন অভিভাবককে ধন্যবাদ জানবার পালা। দীপ ঘোষ, সন্তু বাগ ও সুপ্রিয় দাস—প্রতিটি সংখ্যায় তাঁদের অকল্পনীয় পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের যে পরিচয় আমরা পাই—তা তুলনাবিহীন।
অন্ধকারের শেষে আলোর ঠিকানা লেখা থাকে। শুধু পথটুকু খুঁজে নিতে হয়। সমাজের তমসাঘন বিপর্যয়ের দিনে শিল্প ও সাহিত্য একযোগে সেই পথের দিশা আমাদের হাতে তুলে দেবে এই আশা নিয়েই আসুন আমরা সবাই মাতৃশক্তিকে আবাহন করি। সকলের পুজো কাটুক আনন্দে। পৃথিবী ভরে উঠুক আলোকোজ্জ্বল এক নতুন ভোরের আলোয়।
ধন্যবাদান্তে,
কল্পবিশ্ব সম্পাদকমণ্ডলী
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সম্পাদকীয়