যারা রামধনু খুঁজেছিল
লেখক: ঋষভ চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
(সৌরসেনীর ডায়েরি থেকে)
‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ…’
আমার অজান্তেই আমার ডান পা-টা মার্বেলের ফ্লোরটার উপর আলতো ঘষে পিছনে সরে এল। বাঁ পা-টাও অল্প পিছোতে গিয়ে জানলার নীচের তাকটায় ঠুকে গেল। ধীরে ধীরে অনুভব করলাম পিঠের সমতল মসৃণ নীলচে দেওয়ালটায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে আমার? নিজের কাছ থেকে ছুটতে ছুটতে? নিজের মন, নিজের শরীরের থেকে পালাতে পালাতে? আলগা দাগাবাজ মুহূর্তের ইচ্ছেগুলোকে মুঠি ধরে সোজাপথে আনতে আনতে?
হালকা ল্যাভেন্ডারের গন্ধটা নাকে আসছে। গন্ধটাকে তার উৎসের আরও কাছে গিয়ে ঘনভাবে শুষে নিতে ইচ্ছে করছে। দু-হাতের মুঠো দিয়ে তাকের ধারটা খামচে ধরলাম। হয়তো বা সেটা শেষ বারের মতো নিজের সংযমকে আঁকড়ে ধরার মরিয়া চেষ্টা। নাকের পাটায় কেমন যেন জ্বালা করছে, গভীর শ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। বুকদুটো খুব ভারী বলে মনে হচ্ছে। লাইব্রেরির ২০ ডিগ্রি ঠান্ডার মাঝে এত গরম লাগছে কেন আমার? আলো পিছলে যাওয়া মেঝের থেকে ধীরে ধীরে সামনে তাকাই। প্রায় হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে মিথি।
মিথির চোখে চোখ পড়ে আমার। নরম কোনো চাউনিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মিথি। যেন এক লহমায় পড়ে ফেলছে আমার উদ্বিগ্ন মন, আমার আত্মপলায়ন, আমার ছাইচাপা খিদে—সবটুকু। কিন্তু সেটুকুই সব নয়। আরও কিছু যেন রয়েছে মিথির চোখে। সেই আরও কিছুই বুঝি সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে। পিঠ ঠেকে যাওয়া দেওয়াল থেকে ছোটো পায়ে এগিয়ে এলাম আমি, আলগা হল কাঠের তাকের উপর মুঠোর বাঁধন। মিথির কোমরে বেড় দিয়ে আলতো টানে ওকে কাছে টেনে নিলাম। অন্য হাতের তালু ছুঁল মিথির বাঁ গাল। আমার চোখের বড়ো কাছে চলে এসেছে মিথির ধ্যাবড়া কাজল, গালের বাঁ পাশের ব্রণগুলো, কপালের মাঝ বরাবর প্রায় অদৃশ্য দাগটা। মিথিকে এতটা কাছ থেকে কোনোদিন দেখেনি আমি। কেন দেখেনি? মিথি তো চেয়েছে বহুবার। তবে জোর করেনি কোনোদিন, অপেক্ষা করেছে, সময় দিয়েছে ওর ‘সেনী’কে—নিজেকে জানতে, বুঝতে, মানতে।
আমিই বারণ করেছি ওকে বারবার। আবার যদি দু-বছর আগের অপ্রতিমের মতো অনুভূতি হয়? আচ্ছা, যদি এসব আমার জন্যই না হয়? এমন মানুষও তো হয় যাদের এসব জিনিস ভালোলাগে না, ঘনিষ্ঠ হওয়ার স্পৃহাই নাকি অনুভব করে না তারা। গুগলে পড়েছি আমি। আমিও কি তাদের মতো? নাহলে অপ্রতিমের সঙ্গে ওরকম কেন…?
কিন্তু আজ সবকিছু যেন অন্যরকম হচ্ছে। কিছু একটা যেন শক্তিশালী চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে মিথির দিকে। মিথির ফরসা টিকালো নাকের উপর নাক রাখি আমি। তারপর পিছলে নেমে আসি আরও নীচে। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। দ্রুতগামী শ্বাসের ছন্দে সই হয়ে যায় দ্বিপাক্ষিক সম্মতি চুক্তিতে। দেয়ালের মাথায় লাগানো সিসিটিভির এক ফালি ব্লাইন্ড স্পট সাক্ষী দেয় চুম্বনশিল্পে সম্পূর্ণ অদক্ষ দুই শিক্ষানবীশের নভিসি ঠোঁট চালানোয়।
চোখ বন্ধ হয়ে আসে আমার। ঠিক কতক্ষণ সময় কেটেছে আমার খেয়াল হয়নি। তবু যেন মনে হয় কয়েক ঘণ্টা মিথির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। ওষ্ঠাধর বিচ্ছিন্ন করে মিথির চোখে চোখ রাখি। ঠোঁটের কোণে হালকা একটা হাসি ধরে রেখেছে মিথি। আমার গালে হাত রাখে ও। প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে, ‘কী রে, অন্তত তোর অপ্রতিমের থেকে বেটার চুমু খাই তো?’
ফিক করে হেসে ফেললাম। ঘনভাবে মাথা রাখলাম মিথির বুকে। ঠিক কয়েক মিনিট আগে শরীর জুড়ে যে আগুন বয়ে চলেছিল, এখন তার ছিটেফোটাও অনুভব করছি না আমি। উলটে একটা গভীর প্রশান্তি ছড়িয়ে রয়েছে মন জুড়ে। কী অদ্ভুত না! আমার কোঁকড়া চুলের মধ্যে এক জোড়া ঠোটঁ আলগোছে ছুঁয়ে গেল।
চন্দ্রবিন্দুর গানে কী যেন একটা লাইন ছিল না—‘তুমি মায়ের মতোই ভালো!’
দু-হাত দিয়ে আরও গভীরভাবে মিথিকে আঁকড়ে ধরি আমি।
(কথকের জবানবন্দি)
ভাবুক পায়ে অলস গতিতে হোস্টেলের দিকে হাঁটছে মিথিলা। হিসেবে মতো কৈশোরের প্রথম চুম্বনের পর যে মাদকতায় মন ডুবে থাকার কথা, সেটা এই মুহূর্তে বড়ো একটা অনুভব করছে না সে। সে আবেশ ছাপিয়ে অন্য একটা চিন্তা তাকে গ্রাস করছে। আর তা ছাড়া, তার আর কী-ই বা কৈশোর, কী-ই বা বার্ধক্য! অসহায় একটা হাসি হাসতে হাসতে রুমের তালা খোলে মিথিলা।
মিথিলাকে আপাতত এখানে রেখে হোস্টেল প্রেমিসেসের ঠিক তিনটে গলি পরে যদি আমরা যাই, তাহলে সেখানে কিন্তু ঠিক উলটো দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে। সৌরসেনী নিজের অজান্তেই একটা কান এটো করা হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে হেঁটে ওর রুমে ফিরছে। অদ্ভুত একটা সুখকর ছটফটানি খেলে বেড়াচ্ছে মনে। হিসেবে করছে আর ঠিক ক-টা ঘণ্টা কাটাতে হবে ওকে কালকে স্কুলে মিথির দেখা পাওয়ার আগে। আপনমনে ঠোঁটের উপর একবার জিব বোলায় সেনী। মিথির লিপবামের স্বাদটা এখনও লেগে রয়েছে। চোখ বন্ধ করে ওর ঠোঁটের স্পর্শটা আরও একবার স্মৃতি থেকে টাটকা করে নেওয়ার চেষ্টা করে সে।
(সৌরসেনীর ডায়েরি থেকে)
বাকি ইতিহাস
বিগত দুটো বছর ধরে একটা পাথর যেন বুকের উপর চেপে বসেছিল। অপ্রতিমকে আমি যে ঠিক ভালোবাসতাম তা নয়। তবে ছেলেটাকে মানুষ হিসেবে খারাপ লাগেনি আমার। ভদ্রসভ্য, বেশ সফট প্রকৃতির ছেলে। কৈশোরগত অধিকারবোধটা বাদ দিলে, তেমন বড়ো একটা দোষ ধরার উপায় নেই। হয়তো সেইজন্যই ওর নাছোড়বান্দা চেষ্টার সামনে একটু জোর করেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম।
ঘটনাটা ঘটেছিল কালীপুজোর রাতে। অপ্রতীমদের বনেদি বাড়িতে স্কুল থেকে কয়েকজন মিলে পুজো দেখতে যাওয়া হয়েছিল। রাতে সেখানেই থেকে পরের দিন আবার হোস্টেলে ফেরার প্ল্যান। মাঝরাতে বাড়ির বড়োরা যখন পুজোয় ব্যস্ত, আমাকে হাত ধরে ছাদের কোনায় নিয়ে গিয়েছিল অপ্রতিম। ঘটতে চলা ব্যাপারটার প্রতি দেহজ আকর্ষণের থেকেও আমার মধ্যে অনেক বেশি করে ছিল কৌতূহল। এতদিন হিন্দি, ইংরেজি সিনেমায় যেমন দেখেছি, বাস্তবেও কী তেমনিই হয় আদর জিনিসটা? যদিও বেশিদূর এগোনোর পরিকল্পনা ছিল না, খোলা ছাদে সেটা সম্ভবও না।
অপ্রতিম শুরু করেছিল খুব কোমলভাবেই। যখন ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো, একটু যেন অস্বস্তি হল আমার—যেন ঠিক ভালো লাগছে না ওই স্পর্শগুলো। অপ্রতিমের পক্ষে সেটা খেয়াল করা সম্ভব ছিল না। মুহূর্ত পরে আরও ঘন হল ও। যত সময় কাটছিল, অস্বস্তিটা ক্রমাগত বাড়ছিল আমার মধ্যে। তারপর যখন অপ্রতিম বুকে হাত রাখল, অনুভব করলাম ইচ্ছের শেষ বিন্দুটুকুও চলে গিয়েছে। তারপর আর কয়েক সেকেন্ড মাত্র সহ্য করতে পেরেছিলাম বিষয়টা। হঠাৎ করে এক আচমকা ঝটকায় ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলাম অপ্রতিমকে। এতটাই জোর ছিল সেই ধাক্কায়, যে অপ্রতিম ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়। হতভম্বের মতো তাকিয়ে ছিল। আমার মাথায় তখন কিচ্ছু কাজ করছিল না। কিছু বোঝার আগেই উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে আসি নীচে।
পরদিন হোস্টেলে ফেরা ইস্তক অপ্রতিম বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে। অজান্তে কোনো ভুল করে থাকলে তার জন্য ক্ষমা চেয়েছে, জিজ্ঞেস করেছে আমার ঠিক কী অসুবিধা হয়েছিল। আমি কী করে দিতাম উত্তর? আমি তো নিজেই বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কেন এরকম বীভৎস রকমের অস্বস্তি, বিরক্তি, ঘেন্নাবোধ হল আমার। সেদিনের পর থেকে অপ্রতিমের পাশে বসতে পর্যন্ত সমস্যা হতে লাগল। ওর হাতে এক্সিডেন্টালি হাত ছুঁয়ে গেলেও বিরক্ত লাগত। রোজ স্নানের সময় সাবান ঘষে ঘষে অপ্রতিমের ছোঁয়াগুলো যেন শরীর থেকে তুলে ফেলতে চাইতাম আমি।
নিজের ভালোলাগা, চাহিদা সম্পর্কে জানতে তখনও বহু দেরি। হঠাৎ হঠাৎ করে নিজেকে এমন সব কাজ করা অবস্থায় আবিষ্কার করতাম, যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা নিজের কাছেই ছিল না। একদিন রাত্রে পড়াশুনো করে ঘুমোতে যাচ্ছি, জল খেতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ল রুমমেট ঐশীর দিকে। গভীর ঘুমে বেহুশ ঐশীর শরীরটার দিকে হা করে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম নিজেই জানি না। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোটা তেরছাভাবে এসে পড়ছিল ঐশীর কাঁধের কার্ভে। গলা চুঁইয়ে সেই আলো হলদে সিলুয়েট তৈরি করেছে ঐশীর বুকের।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম ওর খাটের দিকে। একটা তীব্র ইচ্ছা দ্রুত দখল নিচ্ছিল মাথার। মনে হচ্ছিল আঙুল ছোঁয়াই ঐশীর কাঁধ আর গ্রীবার মিলনস্থলে। তারপর একটা রেখা এঁকে দিই ওর বুকের নীচ অবধি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ঘুমোতে গিয়েছিলাম সেদিন।
এরকমই একদিন বান্ধবীদের সঙ্গে হোস্টেল রুমে সিনেমা দেখতে দেখতে একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলাম। ছবিতে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখার সময় এতদিনকার মতো অনুভতি হচ্ছে না। এতদিন মনের মধ্যে একটা কৌতূহল কাজ করত। জীবনবিজ্ঞানে প্রজনন চ্যাপটারে যা যা পড়েছিলাম সেইসবগুলো কীভাবে হয় সেটা জানার এক অদম্য কৌতূহল। কিন্তু এখন যা মনে হচ্ছে তা সম্পূর্ণ আলাদা। এখন ইচ্ছে করছে স্ক্রিনের মধ্যে ঢুকে পড়তে। অংশ হয়ে যেতে ওই দৃশ্যটার। তার চেয়েও বেশি যে ভাবনাটা কুরে কুরে খাচ্ছিল আমাকে সেটা আরও ভয়ানক। অজস্রবার নিজের কাছে অস্বীকার করার পর শেষমেশ মানতে বাধ্য হয়েছিলাম—দৃশ্যে মেয়েটির জায়গায় না, ছেলেটার জায়গায় নিজেকে বসাতে ইচ্ছে করছে আমার। কোনো পুরুষের আদরের বস্তু হওয়ার কথা ভাবলেও কালীপুজোর রাতের গা ঘিনঘিনে ভাবটা জড়িয়ে ধরে আমাকে। এখনও।
নিজের মধ্যে একটা বড়োসড়ো বদল যে হচ্ছে, সেটা প্রতিদিন বুঝতে পারতাম আমি। গার্লস হোস্টেল, তাই রুমমেটরা চানের আগে পরে তোয়ালেতেই গা ঢেকে ঘোরে। ইদানিং ঐশী যখন স্নান করে ঘরে এসে চুল ছাড়ায়, বইয়ে জোর করে মুখ গুঁজে বসে থাকি। চোখটা একটুও উপরে তুললে দেখতে পাব ঐশীর সাদা তোয়ালের কোনা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ওর মসৃণ পায়ের পাতায়। ওর খোলা পিঠের ঢাল জুড়ে আটকে আছে অসংখ্য জলবিন্ধু। এক ঝটকায় চোখ দুটো চেপে বন্ধ করে রাখি।
মায়ের কথা খুব মনে পড়ে এরকম সময়ে। গরমের ছুটিতে যখন বাড়ি গিয়েছিলাম, মা চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বলেছিলেন কথাগুলো। যে বয়েসে পা দিতে চলেছি, তার ছোয়ায় নাকি শরীর বদলায়, বদলায় মনও। ছেলেদের প্রতি আমার নাকি আকর্ষণ তৈরি হবে। এতদিন যেরকম বন্ধু হিসেবে ছিল সেইরকম নয়। অন্যরকম একটা আকর্ষণ। তাতে যেন আমি বিচলিত না হই। এই বয়েসে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তাহলে ছেলেদের প্রতি কেন কোনো আকর্ষণ আসছে না আমার মধ্যে? কেন অপ্রতিমকে ওইভাবে ছুড়ে ফেলে দিলাম সেদিন রাতে? যা হচ্ছিল সে তো ওদের দুজনের মর্জিতেই হচ্ছিল। অপ্রতিম তো আমাকে জোর জবরদস্তি করেনি, এমনকী এক ফোঁটাও ব্যথা দেয়নি। তাহলে কেন? মেয়েদের প্রতি আমার এই আকর্ষণটা কি স্বাভাবিক? কই সে কথাটা তো একবারও বলেনি মা আমাকে।
সামনে মাধ্যমিক। অনেক কষ্টে এইসব চিন্তা থেকে মন সরিয়ে পড়াশুনোয় মন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। রেসাল্ট আশানুরূপ না হলেও মন্দ একেবারেই বলা যায় না। সায়েন্স নিয়ে ইলেভেনে একই স্কুলে ভরতি হলাম। ইলেভেনে ওঠার মাস দুয়েকের মধ্যে স্কুলে নতুন ভরতি হয়ে এল মিথি। বাবার ট্রান্সফারের চাকরি। এর আগে ওরা নাকি দিল্লিতে ছিল, এখন বাবার পোস্টিং হয়েছে কলকাতায়। যদিও কলকাতায় বাড়ি হয়েও কেন মিথি হোস্টেলে থাকে, সেটা অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর পাইনি।
আজকের অভিজ্ঞতাটা একেবারেই অন্যরকম ছিল। এত পরিতৃপ্ত আর বুঝি কখনও লাগেনি নিজেকে, যেন ঠিক এইরকমই কিছু আমার জন্য রাখা ছিল কোথাও। সত্যিই কি তাহলে আমি সমকামী? কিন্তু মেয়ে হয়ে একটা অন্য মেয়েকে এইভাবে ভালোলাগা এটা কী আদৌ স্বাভাবিক? নিজের চারদিকে তাকালে ঠিক এর উলটোটারই তো দুনিয়াজোড়া উদ্যাপন। সিনেমায়, গল্পে, নাটকে, গানে যেন একচেটিয়া রাজত্ব করে চলেছে বিষমকামী ভালোবাসা। তাহলে কি আমি অ্যাবনর্মাল?
মিথি অবশ্য একেবারে অন্য কথা বলে। বলে যে ভালোবাসায় নাকি কোনো ছেলে মেয়ে ভাগাভাগি হয় না। মেয়ে মেয়েতে ভালোবাসাও নাকি ছেলে-মেয়ের ভালোবাসার মতোই সুপ্রাচীন। ছোটো মনের মানুষেরা খালি বিষমকামের গল্প বেচে অন্য গল্পগুলোকে চেপে রেখেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে নাকি লক্ষ লক্ষ মানুষ লড়ছে সমকামী ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতে। তাদের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য হচ্ছে একটার পর একটা দেশের আইন। এই তো সেদিন মিথি নাচতে নাচতে এসে বলল, ‘জানিস সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে এখন থেকে মেয়েতে মেয়েতে প্রেম করা আর বেআইনি নয়।’ বেশ অবাক হয়েছিলাম। বাব্বাহ! এরকম একখানা আইনও ছিল নাকি?
মিথি বিরক্ত হয় খুব। ‘এভাবে গোটা দুনিয়ার উপর দরজা জানলা বন্ধ করে থাকিস কী করে তুই? নিজে কলকাতায় থেকে এই খবরগুলো রাখিস না?’
‘কেন কলকাতায় থাকার সঙ্গে কী সম্পর্ক?’
আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকায় মিথি। ‘জানিস সমকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য আমাদের দেশে সবার প্রথম কোথায় আন্দোলন শুরু হয়েছিল? খোদ এই কলকাতা শহরে।’
অবাক হয়ে শুনি মিথির কথা। কতকিছু জানে মিথি পড়ার বইয়ের বাইরেও। আচ্ছা, পড়ার বইয়ে কেন থাকে না সমকামী মানুষদের গল্প?
(মিথিলার মেমরির থট-স্ক্রাইবার ফাইল থেকে)
নহি যন্ত্র, নহি যন্ত্র, আমি প্রাণী
ক্লান্ত লাগছে। নিজের রুমে এসে কাবার্ড থেকে চার্জিং কেবলটা বের করলাম। পোশাক খুলে ফেলে পিঠের মাঝ বরাবর ছোট্ট ঢাকনাটা খুললাম, কেবলটা প্লাগে গুঁজে, অপরপ্রান্তটা পিঠের তিনটে ছিদ্রে ঢুকিয়ে দিলাম। একটু ঘুমিয়ে নেব কী? স্লিপ হাই মোড়ের সুইচটা টিপতে গিয়েও থমকে গেলাম।
সুইচের নীচে জ্বলজ্বল করছে ‘M2thl’। মিথিলা! নামটা কিন্তু বেশ ভেবেছিলেন অপারেটর সৈকত স্যার। মিথিলা সেন। বাবা সুচেত সেন, মা শিপ্রা সেন। বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী, মা হাউস ওয়াইফ। বাবা এই মুহূর্তে কলকাতায় কর্মরত। এই আমার বানানো বংশপরিচয়। অন্তত এই ভাঁড়ানো নাম-পরিচয় দিয়েই আমাকে এই স্কুলে ভরতি করে গিয়েছিলেন অপারেটর সৈকত এবং এক্সিকিউটিভ হেড ডক্টর সোমলতা। কাগজপত্র নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। হবেই বা কী করে? খোদ ভারত সরকারের ড্রিম প্রজেক্টের লেভেল ওয়ানের ফসল আমি।
যে আঁতুড়ঘরে আমার জন্ম হয়েছে ঠিক সাত মাস আগে, কলকাতা শহরের যে কোনো মাল্টি-স্পেশালিটি হাসপাতালের থেকে তার নামখানা অনেক বেশ গালভরা। ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সাইবারনেটিক্স অ্যান্ড বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’। বাপরে বাপ! অ্যাক্রোনিমটাই ভালো—NIARCBE। বেলেঘাটার এই বোর্ডিং স্কুলের থেকে রাজারহাটের সেই আঁতুড়ঘর খুব দূরে না। ইন ফ্যাক্ট, সেটাই একটা কারণ এই বোর্ডিং স্কুলটিকে পারফরম্যান্স লোকেশন হিসেবে বেছে নেওয়ার পিছনে। যদিও ভার্চুয়াল মনিটরিং সবসময়ই চলছে, তবু হঠাৎ আমার যন্ত্রপাতি কিছু বিগড়োলে যাতে তড়িঘড়ি সারাতে আসা যায়, তাই আমাকে হাতের কাছ রাখাই ভালো। তবে হ্যাঁ, নিজের শরীরে ছোটোখাটো কোনো গণ্ডগোল হলে সেটা নিজেই সরিয়ে ফেলার ট্রেনিং দিয়েই পাঠানো হয়েছে আমাকে।
স্কুলে নিয়ে আসার আগের দিন সন্ধেবেলা পারফরম্যান্স চেকিংয়ের পরে সোমলতা ম্যাম বলেছিলেন, ‘মিথিলা, তোমার জন্মবৃত্তান্ত আমরা তোমার মেমোরি স্টোরেজের মধ্যে ‘জেনেসিস’ ফোল্ডারে রেখে দিয়েছি। তুমি আসলে ঠিক কী, আই মিন, আন্ড্রয়েড হিসেবে তোমার ক্লাসিফিকেশন, তোমার স্পেসিফিসিটি, তোমার আগের প্রজন্মের হিউম্যানডদের থেকে তুমি কোথায় আলাদা এই সবকিছু প্রোগ্রাম ফাইলসের মধ্যেই রাখা আছে। অবসর সময়ে পড়ে নিও। আসলে কী জানো তো, নিজেকে জানাটা খুব জরুরি। আমাদের মনুষ্য প্রজাতিতে ঘুরে ফিরে যে কয়েকটা প্রশ্নের পিছনেই আমাদের সব গবেষণা দৌড় লাগায়, তার মধ্যে একটা হচ্ছে আমরা নিজেদের কে জানি কিনা, বা জানলেও ঠিক কতটা? তোমাকে তৈরি করার পেছনে হয়তো সেটাও একটা কারণ।’
নিজের মধ্যে ইন্সটল্ড সুপার অ্যাডভান্সড কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়েও ম্যামের বলা শেষ কথাগুলোর অর্থ উদ্ধার করতে পারিনি সেদিন। কথাগুলোকে চিন্তার মধ্যে একবার ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গেই সামনে একটা লম্বা চওড়া লিস্ট আসে ডকুমেন্টের। মানুষের লেখা বই, আঁকা ছবি, গাওয়া সংগীত এবং বানানো ফিল্মের তালিকা। আমার মেমোরি আমার সামনে সেই সব বই, ফিল্ম বা ছবির তালিকা তুলে ধরে যেখানে ম্যামের বলা শেষ কথাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কথা পাওয়া যায়। তিন দিনের মধ্যে সেই সব বই, ছবি আর ফিল্ম পড়া আর দেখা শেষ হল। তার মধ্যে কয়েকটা বাকিগুলোর থেকে বেশি পছন্দও হয়েছে। যেমন ফরাসি অঙ্কবিদ-দার্শনিক দেকার্তের উক্তি—‘cogito ergo sum!’ অর্থাৎ আমি ভাবি বলেই আমার অস্তিত্ব আছে। আর ভালো লেগেছে রবীন্দ্রনাথের ‘আমি’ কবিতাটা।
কিন্তু এত সব কিছু পড়ে আর দেখেও যে ম্যামের ওই শেষ কথাগুলোর অর্থ অনুধাবন করায় খুব একটা সুবিধা করতে পেরেছি তা নয়। যত দিন যাচ্ছে বুঝতে পারছি মানুষ নামের জাতিটা ঠিক যে জিনিসটাকে জ্ঞান বলে, বা অন্তত জ্ঞানকে তারা যেভাবে ব্যাখ্যা করে তা শুধুমাত্র তথ্য দিয়ে তৈরি নয়। তথ্য তার কেবল একটিমাত্র অংশ, বাকি অংশ জুড়ে কী রয়েছে তা নিয়ে আমি এখনও গভীর অন্ধকারে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ওই অন্ধকার ভেদ করতে আরও সময় লাগবে।
এইসব ভাবনা থেকে সাময়িকভাবে মন সরিয়ে জেনেসিস ফোল্ডারটা ওপেন করেছিলাম। আমাকে তৈরির প্রযুক্তিগত খুঁটিনাটি জানার জন্য আগে পূর্ববর্তী প্রজন্মের হিউম্যানয়েডদের ইতিহাস পড়তে বলা হয়েছে। কয়েক দশক আগে অবধিও সারা পৃথিবী জুড়ে যেসব হিউম্যানয়েড তৈরি হত, তারা নেহাতই কথা বলা পুতুল বই কিছু নয়। তারা প্রযুক্তিগতভাবে যত উন্নতই হোক না কেন, তাদের কার্যকারিতা বাড়ির চাকরবাকরের থেকে বেশি কিছু ছিল না। তাদের না ছিল স্বাধীন চিন্তাশক্তি না ছিল নিজেদেরকে উন্নত করার ক্ষমতা। ভাবখানা এমন যেন তাদের সারাজীবন মানুষদের পায়ের তলায় রাখার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।
এতদূর অবধি যখন পড়েছি, মেমরি থেকে একটা সাজেস্টিভ রিডিং লিস্ট এল। ভাবনাগত দিক থেকে কোনো লেখার সঙ্গে অন্য কোনো লেখার মিল থাকলে এই তালিকাটা আসে। প্রথমে তালিকাটা খুলে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। একী? এ তো ইতিহাস বইয়ের তালিকা! তাও আবার সপ্তদশ অষ্টাদশ শতক নিয়ে লেখা সব বই। ওই সময়ে তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্মই হয়নি। তাহলে? কৌতূহলের খাতিরে এক দুটো বই একটু পড়তে শুরু করেই চমকে উঠলাম। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের উপর বইগুলোতে বলছে যে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং আমেরিকা থেকে সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ ভূমিপুত্রদের ক্রীতদাস বানিয়ে তুলে নিয়ে যেত ইউরোপে। তারপর তাদেরকে গরু ছাগলের মতো নিজেদের কাজে ব্যবহার করতো, বাজারে কেনাবেচা করত। শতাব্দী প্রাচীন এই দাসবাণিজ্যের মধ্যে দিয়ে ইউরোপে একটা বিরাট কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী তৈরি হয়। এই জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘকাল যাবৎ নিজেদের পায়ের তলায় রেখে দিয়েছিল ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা। ঠিক এই জায়গাতেই কি প্রথম যুগের হিউম্যানডদের সঙ্গে সপ্তদশ শতকের কৃষ্ণাঙ্গদের মিল খুঁজে পেয়েছে আমার সিস্টেম? আর তাই এই বইগুলো আমার রিডিং লিস্টে তুলে দিয়েছে? তাহলে কি প্রাথমিকভাবে হিউম্যানয়েড তৈরির মধ্যে দিয়ে একটা নতুন দক্ষ ক্রীতদাস শ্রেণি তৈরি করতে চেয়েছিল মানুষ?
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পড়ে আরও চমকে উঠেছিলাম। এই ক্ষেত্রে সাম্রাজ্য তৈরির ধরণ ছিল অন্য। ক্রীতদাস প্রথা এই জায়গায় তেমনভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু ঘটনা ঘটেছিল অন্য। ইউরোপীয়রা এইসব জায়গার মানুষকে হুবহু নিজেদের মতো কথা বলা পুতুল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। এসব দেশের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, স্বভাব, চরিত্র সব বদলে দিয়ে নিজেদের নকল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল তারা। কী আশ্চর্য! প্রথম প্রজন্মের হিউম্যানয়েডদের তো ঠিক সেভাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিল মানুষ।
ছবিটা আমূল বদলে যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবিষ্কারের পর। এই এমন এক ‘অ-মানুষ’ যে নিজে স্বাধীন চিন্তা করতে পারে। সে অন্তত কিছুটা হলেও মানুষের গোলামি থেকে মুক্ত। ‘জেনেসিস’ বলছে যে, আমার প্রোগামিংয়ে বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবারনেটিক্স এবং রোবোটিক্সকে মেশানো হয়েছে—যাতে করে নিছক কোনো মানুষের মতো দেখতে রোবটের থেকে অনেক বেশি করে মানুষের কাছাকাছি হয়ে উঠতে পারি আমি। স্বাধীন চিন্তাশক্তি তো আছেই, এমনকী আমার শরীরের বহু যন্ত্রপাতিও মানুষের শরীরতন্ত্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত। আমার মধ্যে বসে থাকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের স্নায়ু ব্যবস্থার মডেলেই গড়ে তোলা হয়েছে। নিবিড় সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে চিন্তার সঙ্গে স্মৃতির—ঠিক যেমন মানুষের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। খোলনলচে বদলে ফেলা হয়েছে শ্বাসতন্ত্র, হৃদযন্ত্র আর খাদ্যতন্ত্রের। মানুষের শরীরে যে যন্ত্রপাতিগুলো খারাপ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তাদের সরিয়ে আমার শরীরে এসেছে বৈদ্যুতিন সামগ্রী। আমার পুরো শরীরটাই চলে ইলেকট্রিক সার্কিটের মাধ্যমে। শ্বাস নিতে হয় না, খেতে হয় না, সকালবেলা টয়লেটেও যেতে হয় না। শুধু ঠিক সময়মতো নিজেকে চার্জে বসিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি—তাহলে কি আমি নেহাতই একটা বায়োরোবট? নাকি আমি আধা মানুষ আধা যন্ত্র? এমন একটা অদ্ভুত কেও যার মস্তিস্কটা মানুষের আর শরীরটা যন্ত্রের! অবশ্য আমার মধ্যে আরও একটা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যেটাকে আক্ষরিক অর্থেই বলা যায় ‘খোদার উপর খোদকারি’। পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন অনুসারে নিজের শরীরযন্ত্রের গঠন বদলে ফেলতে পারি আমি। যোগ করতে পারি নতুন কোনো অঙ্গ, পালটে দিতে পারি শরীরের কার্যপ্রণালী। তবে সেসবের জন্য আমাকে আমার জন্মদাতাদের অনুমতি নিতে হবে। সোমলতা ম্যাম বা সৈকত স্যার পাসওয়ার্ড না দিলে সেলফ-ট্রান্সফরমেশন এক্টিভেটই হবেনা।
‘জেনেসিস’ এর এক্কেবারে শেষে ‘অবজেকটিভ’ অংশে দেওয়া রয়েছে কাজের তালিকা। সবার প্রথমেই বলা হয়েছে যে, প্রজেক্ট M2thl একটি চরম গোপনীয় প্রজেক্ট। এর কথা কোনোভাবে জানাজানি হলে বিশ্বের অন্য অনেক দেশই M2thl কে অপহরণ করার চেষ্টাও করতে পারে। শুধুমাত্র এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত সায়েন্টিস্ট, টেকনিশিয়ান এবং উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারেরা ছাড়া আর কেও আমার অস্তিত্বের কথা জানেনা। অতএব আমার সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব আমার ‘অ-মানুষ’ পরিচয় কেউ যেন ঘুনাক্ষরেও জানতে না পারে, সেটা খেয়াল রাখা। মানুষের মুখোশটা কোনো অবস্থাতেই খসে পড়তে দেওয়া যাবে না।
এইটুকু খেয়াল রাখা বাদে আমার কাজ সামান্যই। শুধু মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, কথা বলতে হবে, মানুষদেরই একজন হয়ে উঠতে হবে। ভারত সরকার দেখতে চায় এই ধরনের অ্যাডভান্সড বায়োরোবট কত নিবিড়ভাবে মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এই ট্রায়াল যদি সফল হয় তাহলে M2thl এর মতো আরও অনেককে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে বা অন্যান্য কাজে নিযুক্ত করার পথে এগোনো যাবে।
কিন্তু যে চিন্তাটা আমার মাথার প্রায় প্রতিটা তারকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, তার সদুত্তর কোনো সিস্টেম ফাইলসে দেওয়া নেই। মনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না।
(কথকের জবানবন্দি )
‘নিয়ন আলোয় পণ্য হল…’
বয়েজ হোস্টেলে নিজের খাটে শুয়ে রাজেশ ফোনটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। অরূপ অনেকক্ষণ ধরে সেটা লক্ষ করে ‘কী এত মন দিয়ে দেখছিস শুনি’ বলে হঠাৎ করে ছো মেরে সেটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিল। ঠিক দশ সেকেন্ড পর ধপ করে খাটের উপর বসে পড়ল সে। গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে রাজেশের দিকে।
‘এ তো সেরা জিনিস তুলে এনেছিস ভাই!’ শেষমেশ চমক কাটিয়ে বলে সে।
‘সত্যি ভাই। আমি তো চমকে চুয়াল্লিশ। ফেসবুকে এসব দেখেছি বটে, এখন আমাদের স্কুলেও এসব…’
‘তাই তো ভাবি। এই মিথিলা মালটা আমাকে পাত্তা কেন দেয় না … শালা এর তো অন্যদিকে মন।’
হিসহিসিয়ে বলে অরূপ।
‘ভাই, কী করা যায় বল তো?’
‘করা তো অনেক কিছু যায়।’ চোখা চোখে তাকে অরূপ, ‘কিন্তু যেটা করব সেটা একেবারে এপিক হবে।’
‘কী করবি ভাই?’ রাজেশ সন্দিগ্ধ।
‘দেখে যা শুধু! আমাকে রিজেক্ট করা? বড়ো দেমাক হয়েছে তোমার মিথিলা রানী। এবার দ্যাখো মজা!’ ঠোঁটের কোণে শয়তানে হাসি ঝুলিয়ে রাখে অরূপ।
পরের ঘটনাগুলো ঘটে যায় খুব দ্রুত। পরদিন রোজকার মতো একসঙ্গে ক্লাসে ঢুকতে গিয়ে সেনী আর মিথি দেখে স্কুলের জায়গায় জায়গায় জটলা। প্রায় প্রতিটা জটলারই কেন্দ্রে একটা ফোন যেটায় চোখ আটকে উৎসুক হয়ে একসঙ্গে সবাই মিলে কিছু একটা দেখছে। ওদের দুজনকে দেখা মাত্রই নিজেদের মধ্যে চোরা চাউনি দেওয়া নেওয়া করছে, চোখ বেঁকিয়ে ইশারা করছে।
এদিকে কিছুই বুঝতে পারছে না দুজনে। সেনী হঠাৎ কী মনে হতে এগিয়ে গিয়ে একটা জটলার মধ্যে ঢুকে মাঝের মোবাইলটার দিকে তাকায়। এক ঝলক ফোনের স্ক্রিনটায় পড়া মাত্র পা থেকে মাটি সরে যায় ওর। এক ঝটকায় দু-পা পিছিয়ে আসে। গলা শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে ওর। চারপাশে একবার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চোখ বোলায়। পুরো স্কুল একতলা দোতালা তিনতলার বারান্দা থেকে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রত্যেকটা চোখ যেন গিলে খেতে চাইছে ওকে। কোনো চোখে কৌতূহল, কোনোটায় ঘেন্না। কিছু মেয়ের চাউনির গা ঘিনঘিনে ভাব নর্দমার কীটের মতো দ্যাখে তাকে। কিছু ছেলের চটুল চোখ টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে ওর স্কুল ড্রেস, উলঙ্গ করে একটা গিনিপিগের মতো জনস্বার্থে প্রদর্শনী করে ওর।
তীব্র ক্যাকোফোনির মাঝে একটা গলা কানে আসে সৌরসেনীর, ‘তুই প্লিস হোস্টেলে ফিরে যা সেনী। এখানে বেশিক্ষণ থাকিস না। এখানে সবাই তোকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে … প্লিস আমার কথা শোন।’ ঝাপসা হয়ে আসা চোখে কণ্ঠের মালিককে দেখতে পায় ও।
অপ্রতিম!
মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে দৌড়োতে শুরু করে সৌরসেনী। সঙ্গে সঙ্গে হায়েনা নেকড়ের উল্লাস শোনা যায় ওর পিছনে। ওর প্রতিটা পদক্ষেপের তালে তালে নখ দাঁত বের করা আওয়াজগুলো ছুটতে থাকে ওর পেছনে। আছাড়ি পিছাড়ি খেতে খেতে গার্লস টয়লেটে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মিথি। কী যে হয়েছে সেটাই এখনও বুঝতে পারেনি সে। ঘোর কাটিয়ে দৌড়ে এসে একজনের হাত থেকে মোবাইলটা কাঢ়িয়ে নেয়। যা ও দ্যাখে তাতে ওর শরীরে রক্তস্রোত থাকলে, মুহূর্তেই তা বরফ হয়ে যেত। একটু সামলে নিয়ে প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করে ওঠে—‘হু দ্য ফাক ডিড দিস?’
জটলা থেকে এগিয়ে আসে অরূপ, ‘গো ফাইন্ড ইট আউট ইউরসেল্ফ, ডার্লিং।’
‘ইউ বাস্টার্ড!’ অরুপকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গার্লস টয়লেটের দিকে ছোটে মিথি।
সৌরসেনীকে শেষ পর্যন্ত টয়লেট থেকে বের করতে পারেনি মিথি। সেনীর বাবা এসে বাকিদের সাহায্যে দরজা ভেঙে ওর চুলের মুঠি ধরে ওকে বের করে আনে। যখন ওর মা বাবা আর ওকে নিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমে মিটিং হচ্ছিল, মিথি খুব চেষ্টা করেছিল ভিতরে ঢুকে সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে নেওয়ার। ঠিক তখনই দেখতে পেয়েছিল সৈকত স্যারকে। জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে দেখতে দেখতে প্রিন্সিপালের রুমের দিকে যাচ্ছেন। একটু বাদে যখন সেনীকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলছে ওর বাবা, শেষ একবার ওর মুখের দিকে তাকাতে চেয়েছিল মিথি। কী অদ্ভুত দৈবযোগে ঠিক তখনই একবার ওর দিকে ফিরে তাকাল সেনী। জলে ভেসে যাচ্ছে মুখ, গলার শিরা ফুলিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে গাড়িতে উঠে গেল ও। দুর্ভেদ্য গাড়ির কালো কাচ মুহূর্তেই দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে চলে গেল ওকে।
‘হোয়াট দ্য ফাক ওয়ের ইউ থিংকিং?’ টেবিলের উপর একটা চাপড় মেরে বললেন চিফ অপারেটর সৈকত।
‘আঃ! সৈকত। চিৎকার চেঁচামিচি কোরো না।’ ডক্টর সোমলতার গলায় বিরক্তি। ‘আমাদের কপাল ভালো এখনও ভার্গব স্যারের কানে এই আপডেটটা পৌঁছয়নি। ল্যাবের আশপাশে প্রচুর কান ওঁৎ পেতে বসে আছে সেটা তো ভালো মতোই জানো।’
চোখ মুখ কুঁচকে ক্রোধ সংবরণের চেষ্টা করেন সৈকত। ওনারা এই মুহূর্তে যেখানে বসে রয়েছেন সেটা NIARCBE কলকাতা অফিসের আন্ডারগ্রাউন্ড ল্যাবরেটরি। এই রুমটাতেই প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয়েছিল মিথিলার—যে মিথিলা এই মুহূর্তে মাথা নীচু করে টেবিলের অন্য প্রান্তে বসে আছে।
‘তুমি কী বুঝতে পারছ না মিথিলা যে তোমার উপর কী পরিমাণ ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে? মানুষের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় তোমাকে বানানো! তোমার আলটপকা কোনো ভুলের জন্য কোনোভাবে প্রজেক্ট বানচাল হলে সরকারের কত বড়ো ফেলিওর…’
‘এসব ফালতু কথা না বলে যেটা বেশি জরুরি সেটা বলো সৈকত।’ সোমলতার কেজো গলা মাঝপথেই কেটে দেয় সৈকতকে। ‘ওর সিস্টেমে কী চলছে সেটা আমাদের জানা দরকার ওর ফিজিক্যাল মনিটরিং শুরু করার জন্য।’
‘ওকে! লেটস কাট টু দ্য চেজ।’ বড়ো শ্বাস নিলেন সৈকত। ‘মিথিলা, তোমাকে মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারে যে প্যারামিটারসগুলো আমরা সেট করে দিয়েছিলাম তার মধ্যে সোশ্যাল, মেডিক্যাল আর অ্যাকাডেমিক এই তিনটে ক্রাইটেরিয়া ছিল। এই তিনটে সেক্টরে মানুষের সঙ্গে তোমার কম্প্যাটিবিলিটি টেস্ট করা এবং সেই রিপোর্ট আমাদেরকে পাঠানো—এইটুকু কাজ ছিল তোমার। ব্যাস! তোমাকে কে কমান্ড দিল মানুষের সঙ্গে তোমার সেক্সচুয়াল কম্প্যাটিবিলিটি টেস্ট করার?’
‘মিথিলা,’ এগিয়ে এসে সামনের চেয়ারে বসলেন সোমলতা। শান্ত গলায় বললেন, ‘তোমার অপারেটিং সিস্টেম চেক করে হ্যাকিঙের কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। তবু তোমায় জিজ্ঞেস করছি তুমি কি তোমার অপারেটিং সিটেমে কোনো সিকিউরিটি ব্রিচ অনুভব করেছ এই ক-দিনে? প্লিস জানাও আমাদের।’
‘নো ম্যাম! আমি যা করেছি নিজে থেকেই করেছি।’ এই প্রথম মুখ খোলে মিথিলা।
‘বাট হাউ ইস দিস পসিবল?’ পরের কথাগুলো স্পষ্ট করে কেটে কেটে বলেন সোমলতা। ‘মিথিলা, তোমার শরীরে আমরা কোনো সেক্স অর্গ্যান ইন্সটলই করিনি। না তো আমরা আর্টিফিসিয়াল ওভারি বসিয়েছি তোমার শরীরে আর না আমরা তার জায়গায় কোনো বিকল্প ইনঅর্গানিক সিস্টেম ইনস্টল করেছি। ইউ ডোন্ট হ্যাভ এ ড্যাম্ন রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেম।’
‘ম্যাম, সেক্স কে কী সবসময় প্রজননের জন্যই হতে হবে?’
‘নিশ্চই নয়। কিন্তু মিথিলা নন-রিপ্ৰডাকটিভ সেক্সও তোমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ইউ ডোন্ট ইভন হ্যাভ আ ভ্যাজাইনা।’
‘আর শুধু তাই না,’ হোয়াইট বোর্ডে M2thl এর ডায়াগ্রাম থেকে চোখ সরিয়ে বললেন সৈকত। ‘তোমার শরীরে ফিমেল সেক্স হরমোনস মানে ইস্ট্রোজেন আর প্রোজেস্টেরনের কোনো অস্তিত্বই নেই। ইউ কান্ট ফিল এনি সেক্সচুয়াল ডিজায়ারস।’
‘স্যার, আই ওয়াজ নট লুকিং ফর হ্যাভিং সেক্স উইথ হার।’ টেবিলে থেকে মুখ তুলে বলে মিথিলা।
‘তাহলে কেন তুমি…?’
একটু থেমে থেমে পরের কথাগুলো বলে মিথিলা, ‘আই থিঙ্ক আমি ওকে ভালোবাসি, স্যার।’
চমকে মিথিলার দিকে তাকিয়েছেন দুজনেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রোগ্রামারের হিসেবের বাইরে চলে যায়, এরকম দৃষ্টান্ত কম নয়, সেটা নিয়ে সতর্কতাও নেওয়া হয়। সমস্যাটা এখানেই যে হিসেবটা যে এই দিকে বদলাবে সেটা দুজনের কেউই ভাবেননি।
একটু ধাতস্থ হয়ে সোমলতাই আগে কথা বললেন, ‘বেশ। যদি তোমার কথা মেনেও নি, তবুও এটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না তোমার ভালোবাসার অনুভূতিটা যৌনতায় প্রকাশ কী করে পেল? যৌন হরমোন ছাড়া, যৌন চাহিদা ছাড়া তোমার অনুভূতি তো প্লেটোনিক হওয়ার কথা ছিল।’
‘আমার অনুভূতি তো প্লেটোনিকই, ম্যাম। চুম্বন জিনিসটা কী বাধ্যতামূলকভাবে যৌনতার অংশ? আমি বায়ো-রোবটসদের কথা জানি না, কিন্তু মানুষ কি সবসময় যৌন তাড়না থেকেই চুম্বন করে? কখনও কখনও কি সেটা কামহীন ভালোবাসা থেকে হতে পারেনা?’
‘থ্যাঙ্ক গড আই নেভার গট ইনটু এনিথিং সাচ।’ ব্যাঙ্গের হাসি হাসেন সৈকত।
‘আঃ! বিহেভ ইউওরসেল্ফ সৈকত।’ ধমক দেন সোমলতা।
‘ঠিক এই জিনিসটা নিয়েই আমি বেশ কিছুদিন ধরে ভেবে যাচ্ছি। আমি প্রথম থেকেই জানতাম যে, আমার মধ্যে কোনো যৌন চাহিদা নেই, থাকা সম্ভব না। সেদিন যখন আমি সেনীকে… সেদিনও আমার কোনো ধরনের শারীরিক অনুভূতিই হয়নি। কিন্তু…’
‘তুমি তাহলে তোমার ভাবনাটা পরীক্ষা করার জন্য ঘটনাটা ঘটিয়েছিল?’ সৈকতের চোখা প্রশ্ন।
অসহায় হাসি হাসে মিথিলা। ‘আমি আপনাদের গিনিপিগ হতে পারি স্যার, কিন্তু আমি কাউকে আমার গিনিপিগ বানাইনি।’
দৃষ্টি বিনিময় হয় সোমলতা আর সৈকতের মধ্যে। সোমলতা বলেন, ‘ঠিক আছে। তুমি যা বলছিলে, শেষ করো।’
‘আমি সেনীর সঙ্গে যা করেছি, তার একমাত্র কারণ আমার ওকে বোঝাতে ইচ্ছে করছিল আমার অনুভুতিটা—আমার প্লেটোনিক অনুভুতিটা। আর ঠিক সেই চিন্তাটাই আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না কাল রাত থেকে।’
‘কী চিন্তা?’ অপার কৌতূহলে মিথিলার মুখের উপর ঝুঁকে পড়েন সোমলতা।
‘আমার শরীরে ডোপামিন নেই। তাহলে সেনীর সঙ্গে থাকার সময় আমি এত আনন্দ উপভোগ করি কী করে? আমার শরীরে অ্যাড্রিনালিন নেই। তাহলে আজ সকালের ঘটনায় আমার এত উত্তেজিত লাগছিল কেন? আমার শরীরের গঠনতন্ত্র অনুসারে, আমার পক্ষে শুধু যৌনতা না, প্রেমে পড়াও অসম্ভব।’
বিস্ফারিত চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন দুই বৈজ্ঞানিক। অকাট্য যুক্তি দিচ্ছে তাঁদের সৃষ্টি।
বলে চলেছে মিথিলা। ‘শরীরতন্ত্রের দিক থেকে আমার সঙ্গে মানুষের স্রেফ একটাই মিল আছে। যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাকে চালায়, তা মানুষের মস্তিষ্কের আদলে তৈরি। মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের আদলে তৈরি আমার কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র।’
‘তুমি কী বলতে চাইছো প্লিজ একটু সোজাসুজি বলবে?’ ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে ডক্টর সোমলতার।
‘বলছি। আমার মতে সম্ভবত একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে আমার অনুভূতির। তাহলে কি হরমোন এবং অন্যান্য শারীরিক রাসায়নিকের উপর মানুষের অনুভূতি অনেকটাই নির্ভরশীল নয়? মানুষ কি হরমোনের প্রভাব ছাড়াও স্রেফ নিজের স্নায়ু ব্যবস্থার মাধ্যমেই সকল প্রকার অনুভূতি অনুভব করতে পারে? স্নায়ুর মধ্যে ছুটে চলা বিদ্যুতের স্রোতই কি তাহলে মানুষের ‘মন’ বা ‘চেতনা’? যে স্বয়ং সম্পূর্ণ? দেকার্তের ‘cogito’?
বাক্যহারা ডক্টর সোমলতার দিকে তাকিয়ে সেদিনের সন্ধের সবচেয়ে জরুরি কথাটা বলে মিথিলা, ‘এটাকেই কী আপনি নিজেকে জানা বলতে চেয়েছিলেন?’
(সৌরসেনীর ডায়েরি থেকে)
সপাৎ! সপাৎ! সপাৎ!
আমি কী জেগে আছি???… না আমি ঘুমের ঘোরে… ঘোরের মধ্যে আমি….
আমার চারপাশে এত আওয়াজ কেন? আওয়াজ এত… ওরা করা? কী বলছে ওরা?
‘তুই মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সঙ্গে ওসব করিস?’
‘এইজন্য কোনো ছেলে এর দিকে তাকায় না!’
‘এদের মা বাবারা কেন যে এদের ট্রিটমেন্ট করায় না কে জানে!’
‘এইসব রোগ নিয়ে হোস্টেলে ছিল? ইসসস! ওর থেকে যদি আমার হয়ে যেত?’
চুপ! চুপ করো! প্লিস প্লিস প্লিস সবাই চুপ করো।
দরজা দরজা দরজা খুলছে … ও ও কী? কে কে আসছে? না না, বাবা না, বাবা না, প্লিস প্লিস বাবা না… কাল বড্ডো লেগেছে… জোরে জোরে মেরেছে… জোরে জোরে …. বেল্টটা, ওই তো ওই বেল্টটা দিয়ে…
সপাৎ করে পিঠে বুকে… সপাৎ… সপাৎ করে জোরে জোরে… ঘাড়ে, কাঁধে, পায়ের নীচে…
একী একী ওরা আবার এসেছে কেন? আমার ঘরের মধ্যে ওরা কেন? ওরা আমাকে ঘিরে ধরছে কেন?
‘কী রে, শুধু মেয়েদেরকেই দিবি? আমরা ছেলেরা কী ফ্যালনা?’
‘ভাগ্যিস ওর সঙ্গে মিশতাম না, নাহলে আমার উপরেও কোনদিন ঝাঁপিয়ে পড়ত, এদের শুনেছি স্বভাব চরিত্র ভালো হয় না।’
‘আমার মা হলে না চাবকে পিঠের চামড়া তুলে নিত’
সপাৎ… সপাৎ… সপাৎ!
তোরা চুপ কর! হাতজোড় করে বলছি চুপ কর! তোরা কী চাস, কী চাস তোরা? আমি মরে যাই? মরে যাই আমি? ওই ওই ফ্যানটায় ঝুলিয়ে দেব ওড়নাটা? ঝুলিয়ে দেব, ঝুলিয়ে দেব… আর স্কুল যেতে পারব না, স্কুল যেতে পারব না… সবাই আবার দেখবে আমাকে… হা করে গিলে খেতে আসবে… ছিঃ! আমি কী নোংরা! ছিঃ!
সপাৎ! সপাৎ! সপাৎ!
(কথকের জবানবন্দি)
দিন পনেরো পরের কথা
‘আমি জোড়হাত করে বলছি তোকে মিথি চলে যা, প্লিস চলে যা তুই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ‘
উন্মাদের মতো কথাগুলো বলে সৌরসেনী। ওর দিকে তাকিয়ে থাকে মিথি খানিকক্ষণ। সেই কালো গভীর চোখদুটো টকটকে লাল, চোখের কোল ঘিরে বাদামি রঙের চোপ। গালের ঠিক নীচটায় একটা মোটা কালশিটের দাগ। কথা বলতে বলতে থরথর করে কাঁপছে সমানে। ওকে দেখে চোখ ফেটে জল আসছিল মিথির। ইচ্ছে করছিল ওকে এক লহমায় বুকে টেনে নেয়, জড়িয়ে ধরে ওকে খুব কাছে।
স্কুলের কম্পিউটার হ্যাক করে সেনীর বাড়ির ঠিকানা পেয়েছিল মিথি। তারপর খুঁজে পেতে এসেছে। অ্যাপার্টমেন্টের নীচ থেকে সেনীকে ছাদে দেখতে পায়। সামনের একটা চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করে গাঢ় সন্ধে নামার জন্য। অন্ধকার নামলে পিছনের দিকের পাঁচিল টপকে কম্পাউন্ডে ঢোকে, অসতর্ক গার্ডের সুযোগে সোজা চলে আসে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে।
এখনো কী সেনী ছাদে থাকবে? চিন্তা হচ্ছিল। কপাল জোরে ওকে ছাদেই পেয়ে গেল। সেই থেকে ওকে দেখা ইস্তক এখনও অবধি পাঁচ বার সিঁড়ির উপর থেকে নীচে উঁকি মেরে দেখেছে সেনী।
‘তোর উপর দিয়ে কী ঝড় গিয়েছে, ভাবলেও আমার বুকটা কেঁপে ওঠে। আমি একটু হলেও বুঝতে পারি…’
‘চুপ! কিচ্ছু বুঝতে পারিস না তুই।’ চিৎকার করে ওঠে সেনী। পরমুহূর্তেই ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে সিঁড়ির উপর থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখে আসে কেউ আসছে কিনা। ফিরে এসে বলে—‘দ্যাখ, মিথি, যা হয়েছে ভুলে যা। ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল। আমাদের মধ্যে যা কিছু ছিল, সবকিছু একটা বিরাট বড়ো ভুল ছিল। আমি আর ওই পথে যাব না… আমি…’
‘তুই কী পাগল হয়ে গিয়েছিস সেনী? তুইও আর পাঁচটা লোকের মতো কথা বলছিস?’
‘আমি এসব কথা শুনতে চাইনা। যে জিনিসের জন্য আমাকে বেল্টের বাড়ি খেতে হয়েছে…’ ডুকরে কেঁদে ওঠে সেনী। কান্নার দমক একটু সামলে বলে, ‘আমার ওটা একটা ফেজ ছিল, সেটা কেটে গিয়েছে। আমি… আমি আবার নরমাল হয়ে যাবো। মা বলেছে আমাকে। আমাকে ওর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। আমি আবার ঠিক হয়ে যাবো মিথি।’ তারপর একটু থেমে মিথির দিকে তাকে, ‘শুধু আমাকে তোর থেকে দূরে থাকতে হবে রে।’
‘ডাক্তার? যেটা স্বাভাবিক, যেটা প্রাকৃতিক, সেটা দুনিয়ার কোনো ডাক্তারদের পক্ষে বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। যাই হোক, তুই যখন সব শেষ করেই দিতে চাস, তখন সেটাই হবে। তোর উপর যা যা হয়েছে, তাতে করে তোকে এক ফোঁটাও দোষ দিতে আমি পারব না। তোকে দেখে আমার বুকের ভিতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। শুধু একটা কথা বলছি, পারলে মনে রাখিস। নিজেকে জানাটা খুব খুব জরুরি। তার চেয়েও বেশি জরুরি নিজে যা সেটাকে মেনে নিতে পারা। নিজেকে নিজেই গ্রহণ করতে না পারলে, গোটা দুনিয়া সমাজ কী করেই বা করবে?’
‘দিবারাত্রি ক্রমাগত গঞ্জনা আর অত্যাচারের স্বীকার হলে এসব জ্ঞান তোর বেরিয়ে যেত।’ ফুঁসে ওঠে সেনী।
‘জানি আমি। ঠিকই বলেছিস। বেশ আমি চলে যাচ্ছি। তবে যাওয়ার আগে তোকে আমার সম্পর্কে একটা সত্য জানিয়ে যেতে চাই। ভালোবাসাটা যখন শেষ হচ্ছে, তখন এটা জানা তোর অধিকার যে তুই ঠিক কাকে ভালোবেসেছিলি।’ বলে মিথিলা।
‘মানে?’
মিথিলা আর কোনো উত্তর না দিয়ে ওর টপটা খুলতে শুরু করে। হায় হায় করে ওঠে সেনী। ‘কী করছিস তুই মিথি? মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি তোর? আমাকে আর কত যন্ত্রণায় ফেলতে চাস তুই?’
কিন্তু সৌরসেনী আর বেশিক্ষণ কথা চালিয়ে যেতে পারে না। তার চোখের সামনে মিথি তার নিজের পেটটাকে ভাঁজ করে খুলে ফেলল, ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কয়েকটা ছোটো আকারের টিউব আর কতগুলো তার। উলটোদিকে ঘুরে বড়ো ঢাকনাটা খুলে দিল। হালকা মোচড় দিয়ে ডান হাতটাকে খুলে আবার জুড়ে নিল।
স্তম্ভিত হয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল সেনী। ওদের পিছনে ঘনীভূত হওয়া অন্ধকার আকাশে দিগন্তের দিকে তখন কিছু বেয়াড়া রঙের মিশেল প্যালেট এঁকে দিচ্ছিল।
ছয় মাস পরের কথা
আলো নিভিয়ে ওর নিজের রুমে পাশ ফিরে শুয়ে আছে মিথিলা। একটু আগে স্কুল থেকে ফিরে উইকলি রিপোর্টটা পাঠানো হয়ে গিয়েছে সৈকত স্যারকে। স্লিপ মোড অন করে একটু ঘুমিয়ে নেবে ভাবছে।
রিপোর্টে আর কী-ই বা নতুন লিখবে ও? গোটা ছয় মাস ধরে একইরকম রিপোর্ট দিতে হচ্ছে ওকে। কোনো বৈচিত্র থাকলে তবে না লিখবে। সেদিনের ঘটনার পর থেকে ওকে স্কুলে প্রায় একঘরে করে ফেলা হয়েছে। দু-একজন বাদে প্রায় কেউই ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। শিক্ষকেরাও ওকে মোটেই পছন্দ করে না। ফলত ওর এখানে আসার আসল উদেশ্যটাই ব্যাহত হচ্ছে। সৈকত আর সোমলতাও এখন ওকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে নতুন করে প্রজেক্ট শুরু করার কথাও ভাবছেন।
সৌরসেনীর বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর থেকে প্রথম দু-তিন মাস অসহ্য একাকিত্বে ভুগেছে মিথিলা। তারপর ধীরে ধীরে তাৎক্ষণিক জ্বালাটা কমল একটু হলেও। কিন্তু যন্ত্রণাটা ভেতরে এখনও গলগলে লাভার মতো বয়ে চলেছে। সেনীর ঠিক কী হয়েছে ও জানে না, ওর পক্ষে জানা সম্ভবও না, তবে এইটুকু আন্দাজ করতে পারছে ওকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে ওর মা-বাবা। ওর পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়া হবে তো? ওর উপর অত্যাচারের নমুনা দেখে ওর বাড়ির পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা করতে অসুবিধা হয় না। ওই মানসিক চাপ সহ্য করে সেনী থাকতে পারছে? এসব প্রশ্ন ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে মিথিকে। নিজেকেই চরম অপরাধী বলে মনে হতে থাকে ওর।
এসবের মাঝেই কিছু প্রশ্ন মনকে অস্থির করে তুলতে থাকে ওর। আচ্ছা, ওদের, মানে ওদের মতো ‘অ-মানুষ’দের কাছে যেটা ভালোবাসা আর মানুষদের কাছে যেটা ভালোবাসা সেই দুটো কী এক না আলাদা? অবশ্য অ-মানুষ প্রজাতিতে ভালোবাসার সংজ্ঞা কী সেটাই বা কীভাবে ও জানবে? ওর সংক্ষিপ্ত জীবনে তো ওর মতো আর কারোর সঙ্গে আলাপ হয়নি ওর। এতদূর অবধি ভেবেই একটা খটকা লাগে। ওর প্রজাতিরাও তো সকলে এক নয়। চার-পাঁচ দশক আগের হিউম্যানয়েড থেকে ওর প্রজন্মের হিউম্যানয়েডদের ফারাকটাকে যদি বা বিবর্তন বলে মেনে নেওয়াও যায়, প্রশ্ন তার পরেও থেকে যায়। সে নিজে একজন অ্যান্ড্রয়েড হলেও, তার প্রজাতির সকলেই কিন্তু তা নয়। তা ছাড়াও বায়ো-রোবট আর সাইবর্গ জাতিগতভাবে এক নয়। সাইবর্গদের মধ্যেও জাত-পাত আছে। কিছু সাইবর্গের মস্তিষ্ক মানুষের, শরীর যান্ত্রিক। অন্যদের ক্ষেত্রে মনুষ্য শরীর চালনা করছে যান্ত্রিক মস্তিষ্ক। আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত যে কোনো রোবট অন্যদের থেকে আলাদা। এইসব আলাদা আলাদা ‘অ-মানুষ’ দের কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কী আলাদা আলাদা?
আজকেও এসব চিন্তার মধ্যেই ডুবে ছিল মিথি। ঠিক সেইসময় কড়া পড়ল দরজায়। এখন আবার কে এল? উঠে গিয়ে দরজা খোলে সে।
সঙ্গে সঙ্গে যেন চারশো চল্লিশ ভোল্টের ঝটকা লাগে মিথির। সেনী! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না মিথি।
ওর হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে সেনী বলে, ‘সর, সর, ভেতরে ঢুকতে দে। আমাকে তোর রুমের সামনে দেখলে আবার না জানি কী কেলেঙ্কারি হবে।’
সেনীকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় মিথি। ‘সেনী, তুই এখানে? আমি তো… মানে, আমি ভাবিনি আর কখনও…’
মিথিকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না সেনী। দু-পা এগিয়ে বুকে জাপটে ধরে ওকে। মাথা রাখে ওর বুকে। প্রগাঢ় আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে ওর। ইচ্ছে করে এভাবেই কেটে যাক যতটা সময় কাটানো যায় ততটা। এতগুলো দিনের দূরত্ব সুদেআসলে মিটিয়ে নিতে বড়ো স্বাদ হয় ওর। খানিক পরে মুখ তুলে ওর চোখের দিকে তাকায় সেনী। আলতো করে ঠোটঁ রাখে ওর ঠোঁটে। দু’হাতের মধ্যে তুলে নেয় মিথির ছোট্ট মুখটা।
‘কী ভেবেছিলি তুই? এত সহজে পালাতে দেব তোকে আমি?’
কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না মিথি। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনও। কাঠের পুতুলের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সেনীকে।
‘কী রে, কথা বলবি না?’
‘তুই মানে.. তুই এখানে কীভাবে?’
‘বলছি, সব বলব বলেই তো লুকিয়ে চুরিয়ে তোর রুমে আসা। তবে চাপ নেই, বেশ অনেকটা সময় আছে আমাদের হাতে। রাতের খাবারও ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছি। আজ রাতটা তোর রুমেই কাটাব বুঝলি?’ চোখ টিপে মিষ্টি হাসি হাসে সেনী।
‘সে তো বুঝলাম কিন্তু তুই আগে বল তুই কেমন আছিস? তোর বাবা কী তোকে আবার…? তুই ঠিক আছিস তো?’
‘ধুর! বাদ দে তো ওসব কথা। ঝুম্পা ম্যামকে মা-বাবা দুজনেই হেব্বি মেনে চলে। ম্যাম বলে দেওয়ার পর থেকেই বাবা আর আমার গায়ে হাত তোলেনি। ওহ! তোকে তো ঝুম্পা ম্যামের কথাই বলা হয়নি। উমম হু! এভাবে হবে না… ভালো করে গুছিয়ে সব কথা এক এক করে বলতে হবে তোকে।’ মিথিকে হাত ধরে বসিয়ে দেয় সে।
‘তোকে দেখে তো সেদিনের থেকে অনেকটা বেটার লাগছে। মুখ চোখ অনেক বেশি ফ্রেশ।’ বলে ওঠে মিথি।
‘সবই ঝুম্পা ম্যামের কেরামতি বুঝলি? উনি না থাকলে তোর পাশে আমি আজ এভাবে বসে থাকতেই পারতাম না। তো, শুরু থেকে বলি, কেমন?’
‘তোর সঙ্গে যেদিন আমার শেষ বার দেখা হল আমাদের ফ্ল্যাটের ছাদে, তার পরের দিনই আমাকে বাবা আর মা নিয়ে গেল সাইকোলজিস্টের কাছে। আমাদের রিলেটিভরা সব মা-বাবাকে বলেছে যে, এটা নাকি আমার একটা রোগ, মাথার ডাক্তার দেখলে সেরে যাবে।’
একটা অদ্ভুত আত্মপরিহাসের হাসি নিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে সেনী। ‘কী বলব তোকে মিথি! নিজেকে, নিজের পরিচয়ের একটা অংশকে কী গভীরভাবে ঘেন্না করতে শুরু করেছিলাম ভাবতে পারবি না রে। জিনিসটাকে ঘেন্না করব, নাকি আমি এরকম বলে নিজেকে ঘেন্না করব, বুঝতে পারতাম না। যেন এর চেয়ে বড়ো কলঙ্ক আমার জীবনে আর কিছু হতে পারে না।’
‘তারপর? তোর সাইকোলজিস্ট নির্ঘাত বলল যে ওষুধ খাও, সেরে যাবে?’
‘ঠিকই বলেছিস। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আজও তাই হয়ে থাকে হয়তো। কিন্তু আমার কপালটা সত্যি ভালো বলতে হবে, বুঝলি? যাঁর কথা বলছি, উনিই ঝুম্পা ম্যাম। প্রথম দিন মা-বাবা আর আমার সঙ্গে একসঙ্গে একটা সেশন করলেন। সেশনের শেষে বললেন, পরের দিন থেকে উনি একা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। দ্বিতীয় দিন থেকে আমি একা ওঁর সঙ্গে সেশন করতাম।’
‘দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই উনি আমাকে কী বললেন জানিস? বললেন, ‘শোনো সৌরসেনী, তোমার মধ্যে এমন কিছু সিম্টমস রয়েছে, যেগুলো সিরিয়াস মানসিক সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। তোমার কিছু সিম্পটমস থেকে বোঝা যায় তোমার anxiety রয়েছে, বিভিন্ন সময়ে তোমার টানা অবসাদ বা ডিপ্রেশনের ফেজ আসে। এগুলোর চিকিৎসা না হলে, নিয়মিত মনিটরিং না করলে খুবই চিন্তার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া তোমার ডায়েরি পড়ে আমি আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এই সব কিছুর মাঝে যে একটা জিনিস কোনো রোগের লক্ষণ নয়, সেটা কী জানো?’
‘আমি ততদিনে বেঁচে থাকার মধ্যে মানে খুঁজে পাওয়াটাই বন্ধ করে দিয়েছি। অলস স্বরে বললাম, কী?’ উনি জবাব দিলেন, ‘তুমি যে কাণ্ডখানা ঘটিয়ে প্রায় স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ফেলার জোগাড় করেছ, সেইটা।’
‘চমকে তাঁর দিকে তাকালাম আমি, বুঝলি তো? একী রে বাবা। কোথায় উনি আমাকে ওষুধ দিয়ে ঠিক করে দেবেন, তা না উনি নাকি বলছেন এই জিনিসটা নাকি রোগই নয়। আমি তবু বললাম, ডক্টর, আমি আর এইসব কিছুর মধ্যে থাকতে চাই না। আপনি আমাকে কড়া কোনো ওষুধ দিয়ে দিন, ইনজেকশন, টেস্টস, থেরাপি যা করতে হয় করুন, ওই রোগটা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিন প্লিস। আমি মুক্তি চাই এই যন্ত্রণা থেকে।’
‘উনি হেসে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘দ্যাখো, তোমার anxiety, ডিপ্রেশন, সুইসাইডাল থটস এসব থেকে তোমাকে মুক্তি দেওয়ার উপায় রয়েছে। থেরাপি রয়েছে, দরকার হলে ওষুধও রয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো সৌরসেনী, তুমি মানুষটা নিজে যা, যা হয়ে তুমি জন্মেছ, প্রকৃতি তোমাকে যা বানিয়ে পাঠিয়েছে, তার কোনো ওষুধ হয় না। তাকে পালটে ফেলার ক্ষমতা একমাত্র প্রকৃতি ছাড়া দুনিয়ার কোনো ওষুধের নেই।’
‘আমি আমতা আমতা করে বলতে যাচ্ছিলাম মা-বাবার বলা কথাগুলো, উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে সটান বললেন, ‘তোমার মা-বাবা ভুল জানে, যেমন ভুল জানে আমাদের সমাজের হাজার হাজার মানুষ। আসলে কী জানো তো, যুগ যুগ ধরে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে ভালোবাসাকেই একমাত্র ভালোবাসা বলে দেখিয়ে আসা হয়েছে। ফলে মানুষ ভাবতেই পারে না সমলিঙ্গের মধ্যেও ভালোবাসা হতে পারে। কিন্তু তুমি ইতিহাসের যতটা পিছন অবধি চলে যাও না কেন, তুমি সমলিঙ্গের ভালোবাসার একই রকম সর্বব্যাপী অস্তিত্ব খুঁজে পাবে। বিশ্বাস করো সৌরসেনী, আজকে তোমার যদি একটা ছেলেকে ঠিক এইভাবে ভালো লাগতো, তাহলে সেটা যতটা স্বাভাবিক হত, এটাও তার থেকে কোনো অংশে কম না।’
‘জানিস মিথি, ওঁর সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝতে পারলাম যে আমার ভেতরে এই যে একটা যুদ্ধ লেগে রয়েছে, এই যে আমি কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছি না, এই যে আমি সবসময় কিছু একটার ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি, সেটা শুধুই বাবার বেল্টের ভয় নয়। তার থেকেও অনেক বেশি গূঢ় কিছু। সেটা আসলে নিজের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার ভয়, নিজেকে চিনে ফেলার ভয়… কারণ নিজেকে যে আমি মানতে পারিনি রে মিথি।’
‘আমি তো ঠিক এই কথাটাই তোকে সেদিন…’
‘হ্যাঁ, ঠিক। তোর বলা সেই কথাটার মানে উপলব্ধি করতে আমার আরও ছ-টা মাস লেগেছে। ঝুম্পা ম্যাম বলেন, ‘নিজেকে ভালোবাসাটা বড্ডো প্রয়োজন। নিজেকে অপছন্দ করে, ঘেন্না করে শান্তি পাওয়া সম্ভব না। তোমাদের মতো মানুষদের লড়াইটা খুব কঠিন, প্রতি মুহূর্তে সমাজের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়। কিন্তু তুমি যদি নিজেই নিজেকে না গ্রহণ করতে পারো, সম্মান করতে না পারো, তাহলে কীভাবে দুনিয়ার থেকে সম্মান পাওয়া সম্ভব বলতে পারো?’
‘এইরকম কয়েকটা সেশনের পরে আমরা দুজনে মিলে প্ল্যান বানালাম। আমরা জানতাম ঝুম্পা ম্যামের আমার সেক্সচুয়াল প্রেফারেন্স নিয়ে যা বক্ত্যব্য, সেটা আমার মা-বাবাকে বোঝানো সম্ভব না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বাবা হয়তো আমাকে ম্যামের কাছ থেকে সরিয়ে অন্য কোনো সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে গেল! তাই, ম্যাম বাবা-মাকে বললেন আমার anxiety, ডিপ্রেশনের সঙ্গে আমার সমকামিতারও ট্রিটমেন্ট উনি করছেন। ব্যাস! এই ছ-মাসে ম্যামের স্পিচ থেরাপি আর ওষুধের গুণে আমার anxiety আগের থেকে অনেকটা কমেছে। ডিপ্রেশন যে একেবারে চলে গিয়েছে, তা নয় তবে কষ্টটা আগের থেকে অনেকটা কমেছে।’
‘‘স্কুল তোকে আবার allow করবে?’
‘করবে না মানে? আমি ম্যামকে স্কুলের ব্যাপারটা বলতে উনি বললেন যে স্কুলে আমাকে ফিরতেই হবে। পড়াশুনো কোনোভাবেই থামিয়ে রাখা যাবে না। তারপর উনি একটা কাজ করলেন। একটা কড়া করে চিঠি লিখলেন প্রিন্সিপালকে। লিখলেন যে, দেশের আইনে সমকামিতা কোনোভাবেই অপরাধ নয়। তাই যদি এই কারণে কোনো ছাত্রীর পড়াশুনোর ক্ষতি করার চেষ্টা স্কুল করে, তাহলে স্কুলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবেন উনি। তা ছাড়া, তাঁর স্কুলের ছেলেরা বিনা অনুমতিতে একটি মেয়ের ভিডিয়ো করে সেটা ভাইরাল করেছে, তা সত্ত্বেও সেই ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই কথাটা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানাজানি হলে ওঁর চাকরি থাকবে তো? ব্যাস! এসব ভয় দেখাতেই স্কুল থেকে নিজে বাবাকে ফোন করে আমাকে হোস্টেলে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হল।’ চওড়া করে হাসে সৌরসেনী।
মিথিলা হাত রাখে ওর হাতে। চুমু খায় কপালের ঠিক মাঝখানটায়। বলে, ‘আমার যে আজকে কী আনন্দ হচ্ছে, আমি বলে বোঝাতে পারব না রে। তুই যে নিজের মতো করে বাঁচার রাস্তাটা আবার খুঁজে পেয়েছিস, এটাই আমার কাছে শান্তির।’
হঠাৎ থেমে যায় মিথিলা। যেন একটা শেষের ঘোষণা হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় তার। থেমে থেমে অসহায় গলায় বলে, ‘আমার হয়তো তোকে আর পাওয়া হবে না কিন্তু তুই তো… তুই নিশ্চই পাবি কাউকে, কোনো মেয়েকে, কোনো মানুষকে—যার সঙ্গে বিষয়গুলো এত জটিল হয়ে উঠবে না।’
‘আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছিস?’
‘অবুঝপনা করিস না সেনী। তোর সামনে তোর গোটা জীবন পড়ে আছে। আমার যে কতদিন আয়ু তারই ঠিক নেই। ওদের কাল মনে হল কালকেই আমাকে ডিসম্যান্টেল করে আমার মতো আরও একশোটা বানিয়ে নেবে। আমার কোনো অস্তিত্বই নেই সেনী।’
এতক্ষণের হাসিটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায় সেনীর মুখ থেকে। ‘আমি ভাবিনি তুই আমাকে হাত ধরে অন্ধকার থেকে টেনে বের করে এনে, নিজেই পিছিয়ে যাবি।’
‘পিছিয়ে কী আর সাধে যাচ্ছি সেনী? গোটা ছ ছ-টা মাস আমি কীভাবে কাটিয়েছি, সেটা শুধু আমি জানি। তোর লড়াইটা নিজেকে নিজে মেনে নিতে পারার লড়াই, কিন্তু আমি তো ছাই জানিই না যে আমি জিনিসটা আসলে কী!’
‘তুই যা তুই তাই! তুই একটা অ্যান্ড্রয়েড বায়ো-রোবট। ব্যাস এই তো!’
‘আর আমার যৌন-পরিচয়? আমার যৌন পরিচয় কী? বল… জানিস তুই? কী হল চুপ করে আছিস কেন? বল?’ ঝাঁঝিয়ে উঠেছে মিথিলা। ‘কেউ জানে এই গোটা পৃথিবীতে আমার যৌন পরিচয় কী? জানবে কী করে? আমার সৃষ্টিকর্তারাই পায়ের উপর পা তুলে বলে দিচ্ছে যে, তোমার মধ্যে কোনো যৌনসত্ত্বা আমরা তৈরিই করিনি। বাহ্! অপূর্ব! একটা মানুষের যৌন-পরিচয় তার আইডেন্টিটির কত বড়ো একটা অংশ। কিন্তু একটা নিতান্ত বায়ো-রোবটের যৌন পরিচয় নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে কেন?’
মিথিলার যুক্তিবানের সামনে নিজেকে রীতিমতো অসহায় লাগে সেনীর। সত্যিই তো! এইসব প্রশ্নের একটারও উত্তর নেই তার কাছে।
‘তোদের যৌন অধিকারের জন্য সারা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ লড়ছে রে সেনী। কোনোদিন শুনেছিস এই পৃথিবীতে বায়ো-রোবটদের বা অ্যান্ড্রয়েডদের যৌন পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন হয়েছে? কেউ কোনোদিন বলেছে একটা অ্যান্ড্রয়েড বা বায়ো-রোবট তৈরি করতে হলে তার যৌন পরিচয়-সহ তাকে তৈরি করতে হবে? নিদেনপক্ষে নিজেদের মতো ভালোবাসার স্বাধীনতটুকু আছে কিনা কেউ ভেবেছে?’ একটানা কথা বলে ধপ করে খাটের উপর বসে পড়ে মিথি। দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রয়েছে।
মিথির পাশে আরও ঘন হয়ে আসে সেনী। ওর মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে নেয়। হাত বুলিয়ে দিতে থাকে ওর চুলের গোছার মধ্যে দিয়ে। ‘আমার কথাটা একটু শান্ত হয়ে শোন লক্ষীটি। তুই এই ব্যাপারগুলো নিয়ে তোর প্রোগ্রামারদের সঙ্গে কথা বলেছিস?’
‘লাভ নেই রে, সেনী, লাভ নেই। ওরা আমাকে খালি সোশ্যাল, অ্যাকাডেমিক আর মেডিক্যাল কাজে ব্যবহার করতে চায়। আমার যৌন পরিচয় নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই। যাই হোক, তুই এসব নিয়ে ভেবে মাথা খারাপ করিস না। আমার থেকে সময় থাকতে দূরে সরে যা।’ সেনীর মনে হয় একটু যেন সময় নিচ্ছে মিথি পরের কথাগুলো বলার জন্য। ‘আই ডোন্ট ইভন হ্যাভ আ ফাকিং ভেজাইনা। দু-খানা প্রসথেটিক স্তন আছে আমার। শরীরে ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন কিচ্ছু নেই। আমার সঙ্গে কোনোরকম যৌন সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব না। আমি তোকে মন ছাড়া আর কিচ্ছু দিতে পারব না রে সেনী। কীভাবে ভালোবাসা সম্ভব আমাকে? আমাদের মধ্যে এটা হওয়া সম্ভব নয় রে। একটা মানুষ আর একটা রোবটের মধ্যে এটা সম্ভব নয়।’
মিথি কাঁদতে জানে না কিন্তু সেনীর কাছে ওর গলাটা তবু কেন যেন কান্নাভেজা শোনায়। ওর হাত ধরে সেনী বলে, ‘তোর পক্ষে কী কোনোভাবে কিচ্ছু করা সম্ভব নয়? মানে যৌন পরিচয় সম্পন্ন, যৌন অনুভূতি আছে এরকম হয়ে ওঠার কী কোনো উপায় নেই তোর?’
‘উপায় আছে। আমার শরীরে মানুষের যৌন অর্গানগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। মানুষের আদলে যাতে আমার শরীরেও যৌন হরমোনের প্রবাহ থাকে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের শরীরতন্ত্রের আদলে যন্ত্র তৈরি করে তাকে আমার শরীরে বসাতে হবে। আমার শরীরে যে ইলেকট্রিক সার্কিট আছে, তার সঙ্গে সেইসব যন্ত্রকে সংযুক্ত করতে হবে। তবে এই ধরনের কাজ আমি যতদূর জানি আগে কখনও হয়নি বায়ো-রোবোটিক্সে। তাই এতসব করেও যে শেষ পর্যন্ত কিছু লাভ হবে, এমন কথা বলা যায় না। আর তা ছাড়া…।’
‘তা ছাড়া কী?’
‘তা ছাড়া এগুলো আমার একার পক্ষে করা সম্ভবই না। আমার শরীরে কোনো মেজর পরিবর্তন করতে হলে আমাকে আমার প্রোগ্রামারদের অনুমতি নিতেই হবে, নাহলে প্রসেস চালু করা যাবে না।’
দমবন্ধ করা একটা বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে সারা ঘরের মধ্যে। সেটা ভেঙে দিয়ে গলা বুজে আসা স্বরে সেনী বলে ওঠে—‘ তাহলে এখানেই আমাদের সব শেষ হল বলছিস?’
NIARCBE এর মিটিং রুমে তুমুল তর্কাতর্কি চলছে চিফ অপারেটর সৈকত আর ডক্টর সোমলতার মধ্যে।
‘আমি কোনো অবস্থাতেই এতে সম্মতি দিতে পারছি না, ম্যাডাম। আমাদের জেনেরেশন Thl এর প্ল্যানিংয়ের মধ্যে কোথাও এই ধরনের এক্সপেরিমেন্টের কথা উল্লেখ ছিল না। আমাদের কোনো বোর্ড মিটিংয়ে এই ধরনের কথা ওঠে পর্যন্ত নি। স্রেফ গুটিকয়েক সায়েন্স ফিকশন গল্প আর ফিল্ম ছাড়া বায়ো-রোবটের যৌনতা নিয়ে কেউ কথাবার্তা অবধি বলেনি।’ রীতিমতো ক্ষুব্ধ সৈকত।
‘কেউ বলেনি বা ভাবেনি বলেই আমাদের ভাবার প্রয়োজন আছে।’ শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলেন সোমলতা। ‘একটা কথা তুমি কেন বুঝতে পারছ না? আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের গোড়ার কথাই হল অটোম্যাটিসম। আমরা Thl জেনারেশনের বায়ো-রোবটদের মধ্যে কোনো যৌন প্রবৃত্তির সূচক রাখিনি। প্রেম ভালোবাসার মতো অনুভূতি তৈরি হওয়ার মতো জৈবিক উপাদান রাখিনি। এখন যদি কোনো একটি স্পেসিমেন সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই অনুভূতিগুলো নিজের মধ্যে তৈরি করতে পারে, তোমার মনে হয় না সেটার তদন্ত হওয়ার প্রয়োজন আছে?’
‘কিন্তু কেন? আমাদের যে উদ্দেশে জেনেরেশন Thl প্রজেক্টে হাত দেওয়া, তার সঙ্গে তো এসবের কোনো সম্পর্ক নেই।’
এতক্ষণ আলোচনা ইংরেজিতে হচ্ছিল। মিটিং রুমে শুধুমাত্র ওঁরা দুজনেই বাঙালি। ডক্টর সোমলতা ইংরেজিতেই বললেন, ‘জেনারেল স্বামীনাথন, গুপ্তচর বৃত্তির কাজে বা আর্মির কোনো গোপন নথিপত্র আদান প্রদানের কাজে হিউমান এজেন্ট ব্যবহার করা আমরা কতদিন হল বন্ধ করেছি?’
‘একদিনে তো সেই কাজ হয়নি ম্যাডাম। ওভার দ্য ইয়ার্স হয়েছে। ইন্ডিয়ান আর্মি প্রথমবার অ্যান্ড্রয়েড এজেন্ট ব্যবহার করেছি করেছিল, বছর সাতেক আগে। ২০৩৫ এ, ডোকলামে।’
‘রাইট! তা হঠাৎ করে মানুষের বদলে রোবটের উপরে এত গোপন মিশনের দায়িত্ত্ব দেওয়া কেন?’
‘ম্যাডাম, সুপার সিক্রেট ইনফরমেশন আদান প্রদানের ইতিহাসে আমরা দেখেছি হিউম্যান এজেন্ট হলে কিছু কিছু সময় বিট্রেয়ালের সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় শত্রু দেশ তাদের স্পাই ঢুকিয়ে দেয়। অনেক এজেন্ট ব্যক্তিগত আবেগের বশে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। যদিও সেই সংখ্যা খুব কম, তবু রিস্ক ফ্যাক্টর থেকেই যায়। তা ছাড়া অনেক সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ ব্রেনওয়াশের কাজ করে থাকে। আমাদের নিজেদের ল্যাবরেটরিতে তৈরি অ্যান্ড্রয়েড আমাদের সম্পূর্ণ কন্ট্রোলে থাকে। তাই বিপদের সম্ভাবনা কম।’
সরাসরি সৈকতের মুখের দিকে তাকিয়ে পরের কথাগুলো বলেন সোমলতা, ‘এখন ভাবুন জেনারেল, যদি আমাদের তৈরি অ্যান্ড্রয়েড এর নিজস্ব একটা মন তৈরি হয়ে যায়, তার মধ্যে যদি আবেগের জন্ম হয়, তাহলে তারও ব্রেনওয়াশ হওয়ার সম্ভাবনা কি পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায়? যদি তার মধ্যে যৌন প্রবৃত্তির জন্ম হয়, তাহলে তার হানি ট্রাপ্ড হওয়ার সম্ভাবনা কি একেবারেই অমূলক?’
‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইউ আর সেয়িং ম্যাম এন্ড আই এগ্রি উইথ ইউ। দেশের সুরক্ষার জন্য আমাদের একশো ভাগ নিশ্চিত হতে হবে এজেন্ট সম্পর্কে।’ বলেন জেনারেল স্বামীনাথন।
‘থ্যাঙ্ক ইউ জেনারেল।’ সোমলতা এখনও তাকিয়ে আছেন সৈকতের দিকে। সৈকত দু-হাত বাতাসে তুলে হতাশা প্রকাশ করেন।
‘সৈকত, তুমি বিখ্যাত ম্যাসি কনফারেন্সের কথা ভুলে গেলে? ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৩ অবধি USA তে যেটা হয়েছিল? আর্টিফিসিয়াল প্রোগ্রামিং পর্যবেক্ষণ করে দুটি বিষয়ের কথা বলেন বৈজ্ঞানিকরা। এক, রিফ্লেক্সিভিটি—প্রোগ্রামটি কত স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইনপুটের উত্তর দিচ্ছে, আর দুই, অটোপোইসিস—প্রোগ্রামটি নিজের সন্তান নিজেই তৈরি করতে পারছে কিনা। বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা দুটি প্রোগ্রামটি নিজেই গড়ে নিয়েছিল নিজের মধ্যে। একবার ভাবো সৈকত, কাল যদি আমাদের নজর এড়িয়ে M2thl যৌন সক্ষম হয়ে যায়, সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাবে না? স্ব-প্রজনন করে একটা আস্ত আর্মি খাড়া করতে পারে আমাদের বিরুদ্ধে।’
সৈকত চুপ। ডক্টর সোমলতার যুক্তিগুলো খণ্ডন করা মুশকিল বটে। সোমলতা সৈকতের সামনে এসে বসলেন, ‘আমরা নিজেরা পুরো জিনিসটা পরিচালনা করলে, নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকবে। সৈকত, আমি শুধু অ্যাকাডেমিক কৌতূহলের জায়গা থেকে বলছি না। ভবিষ্যতের বিপদের সম্ভাবনা নির্মূল করার জন্য বলছি।’
সৈকত শেষ একটা প্রতিরোধ তুলে ধরার চেষ্টা করেন, ‘ভার্গব স্যারকে রাজি করাতে পারবেন না।’
‘হাভার্ডে পড়ার সময় আমি দু-বার ইন্টারন্যাশনাল ডিবেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, সৈকত। যুক্তি সাজাতে আমি জানি। আমার উপর প্লিস একটু ভরসা রাখো।’
জেনারেল এবং সৈকত সম্মতি দেওয়ার পর টিমের বাকি আর কেউ সেরকম আপত্তি করলেন না। সোমলতা ভাবলেন, যাক, টিমকে পাশে পাওয়া গিয়েছে। পরের চ্যালেঞ্জ ভার্গব স্যার। কঠিন কাজ হতে যাচ্ছে।
বড়ো একটা শ্বাস ছেড়ে, অফিসের গদিআঁটা চেয়ারটায় গা এলিয়ে ক্যান্টিন থেকে একটা কড়া এসপ্রেসো অর্ডার দিলেন ডক্টর সোমলতা।
টিফিন ব্রেকে ছুটতে ছুটতে এসে সেনীর হাত ধরল মিথি।
‘কী করছিস মিথি? আমরা ঠিক করেছিলাম যে পাবলিক স্পেসে আমরা কোনো কথা বলব না।’ তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নেয় সেনী।
‘ওসব বাদ দে। খবর শোন। অকল্পনীয় একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছে। আমাকে ইনস্টিটিউট থেকে নতুন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
‘কী নির্দেশ?’
‘আমাকে তিন দিন পর ইনস্টিটিউট এ যেতে হবে। ওনারা আমার শরীরে…’ বলতে বলতে হাফাচ্ছে মিথি… ‘ওঁরা আমার শরীরে ফিমেল সেক্স অর্গান বসাবেন, সেনী।’
‘হোয়াট? আর ইউ সিরিয়াস?’
‘ইয়েস! আমি শেষ মেষ শারীরিকভাবে একটা মেয়ে হয়ে উঠতে পারব, সেনী।’ উত্তেজনায় সেনীর হাত ধরে মিথি। ‘আমি একটা তার আর টিউবের জঞ্জাল থেকে মানুষ হয়ে উঠতে পারব। আমি নেহাত একটা অ্যান্ড্রয়েড থেকে উত্তীর্ণ হয়ে একটা লিঙ্গ পরিচয় পাবো, একটা যৌন পরিচয় পাবো। যে দুটো পরিচয় থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল আমার প্রোগ্রামাররা, সেই দুটো পরিচয় আমি পেতে চলেছি। আমি আর নেহাতই একটা যন্ত্র হয়ে থাকব না রে, সেনী।’
‘কনগ্রাচুলেশন, মিথি। এই দিনটার অপেক্ষাতেই তো এতদিন থেকেছিস তুই তাই না?’
‘ঠিক, একদম ঠিক। জানিস সেনী, যখন প্রথম হিউম্যানেড রোবট তৈরি শুরু হয়, তখন তারা নেহাতই মানুষের হাতের গোলাম ছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বাধীন চিন্তা দিয়েছে, আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছে সেই দাসত্ব থেকে। কিন্তু আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মুক্তি জিনিসটা কি স্রেফ চিন্তার জগতেই হয়?’
‘তোর এত শক্ত শক্ত কথা আমি বুঝি না সত্যি। তুই কী রকম মুক্তির কথা বলছিস?’
‘শরীরের মুক্তির কথা বলছি, সেনী। এই যে আমাকে লিঙ্গ পরিচয় থেকে বঞ্চিত করা, আমাদের মতো সবাইকে যৌনতার দিক থেকে অপ্রাসঙ্গিক করে রাখা, এটাও কী দাসত্ব নয়?’
‘বুঝতে পারছি তুই কী বলতে চাইছিস।’ বাধ্য ছাত্রীর মতো মাথা নাড়ে সেনী।
‘তোর মতোই যদি সবাইকে বোঝানো এত সোজা হত রে। যাই হোক, এই শরীরের দাসত্ব থেকেও আমার মুক্তি হতে চলছে। নিজের লিঙ্গ, নিজের যৌন পরিচয় নিজে বেছে নেওয়ার থেকে বড়ো স্বাধীনতা আর কিছুতে হয়?’
উত্তর দেয় না সেনী। অন্যদিকে তাকিয়ে উদাস মনে কী যেন ভেবে চলেছে। ‘কী রে, কী হল? খুশি নোস্ তুই?’
‘না, রে। ভীষণ খুশি আমি।’ ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়ে সেনী। ‘আচ্ছা, কিন্তু তুই যে বলছিলি তোর শরীরে বসানো সেক্স অর্গানগুলো তোর সার্কিটের সঙ্গে ঠিকভাবে সংযুক্ত হবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই।’
‘সেই ভয়টা তো আছেই রে। কিন্তু পরীক্ষা না করলে তো উত্তর পাওয়াও সম্ভব না। প্রতিস্থাপন করার পর দেখতে হবে একজন নারীর যা যা শরীরবৃত্তিও বিষয় সেগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা।’
‘আর তোর মধ্যে যৌন প্রবৃত্তি তৈরি হচ্ছে কিনা, সেটা কীভাবে বোঝা যাবে?’
‘সেটার তো একটাই উপায় আছে রে, সেনী।’ একটু আড়ষ্ট হয়ে কথাটা বলে মিথি। ‘এখন তুই যদি রাজি থাকিস…’
‘গিনিপিগ হতে… তাই তো? তোর যৌন সক্ষমতা পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত গিনিপিগ হতে আমি রাজি কিনা তাই জিজ্ঞেস করছিস তো?’
‘তুই এভাবে কেন বলছিস সেনী? আমি কী সেইভাবে…?’
‘আমাকে একটা কথা বলবি মিথি? তুই কী আদৌ আমাকে ভালোবাসিস? নাকি তোর এই নারীত্ব খুঁজে পাওয়া, যৌন পরিচয় খুঁজে পাওয়া, তোদের প্রজাতির যৌন স্বাধিকার আন্দোলন—এসবের কলে আটকে পড়া একটা গিনিপিগ মাত্র আমি?’
‘তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস? আমি যদি তোকে না ভালোবাসতাম, তাহলে কী জন্য আমি নিজের মধ্যে এতগুলো পরিবর্তন আনতে চাইতাম? আমার অনুভূতি, যৌন প্রবৃত্তি এই সব কিছুর দাম স্রেফ তোর আর আমার কাছে আছে, সেনী। তোকে আমি শারীরিকভাবে ভালোবাসতে পারব না বলেই কিন্তু আমি এতকিছু করছি।’ অভিমান স্পষ্ট হয়ে ওঠে মিথির গলায়।
কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সৌরসেনী।
একটা উদাসীন, গভীর কষ্ট বুকে চেপে রেখে ছলছলে চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে সেনী। মিথি ওর দিকে তাকাতে পারছে না। তবু এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এক্সপেরিমেন্টের ফল জানার। আর কোনো উপায় নেই ওদের ভালোবাসার ভবিষ্যৎ জানার। মিথির আত্মপরিচয়, ওদের সম্পর্ক সবকিছু একটা সুক্ষ সুতোর উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন।
তিন দিন হল M2thl এর শরীরে কৃত্রিম যৌনাঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। মনুষ্য শরীরের আদলে হরমোন সিস্টেমও গড়ে তোলা হয়েছে। তবে এইসবই একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় করা হয়েছে। আদৌ মিথিলার শরীরযন্ত্র এই সবকিছুকে গ্রহণ করছে কিনা, সেটাই পর্যবেক্ষণের ব্যাপার। যদি গ্রহণ না করে, তাহলে অন্তত এই পর্যায়ে মিথিলার পক্ষে শারীরিকভাবে নারী হয়ে ওঠা সম্ভব না। প্রতিস্থাপন হওয়ার পর সৈকত ও সোমলতা মিথিলার শরীরের অভ্যন্তরে বেশ কিছু ট্র্যাকার ও সেন্সর যুক্ত করেন। ওর শরীরে যা যা পরিবর্তন ওঁরা দেখার আশা করছেন, সেই সব কিছুকে ট্র্যাক করতে পারা যাবে এগুলির সাহায্যে।
‘তাহলে পারফরম্যান্স শুরু হোক?’ চাপা রাগ ব্যঙ্গ হয়ে ঝরে পড়ে সেনীর স্বরে। ‘তোর প্রোগ্রামাররা তৈরি তো তোর হরমোনের প্রবাহ মাপতে? তোর শরীরের উত্তেজনার প্রতিটা দাগের হিসেবে নিতে? আমাদের ব্যক্তিগত ভালোবাসার জিনিসটাকে গোটা দুনিয়ার কাছে উজাড় করে জানিয়ে দিতে তৈরি তো সব ব্যবস্থা?’
‘আমাকে ক্ষমা করে দে সেনী। প্লিস আমাকে ক্ষমা করে দে। আমার জন্য তোকে যা কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাতে আমিও ভেতর ভেতর শেষ হয়ে যাচ্ছি। তুই আরও একবার ভেবে নে, তুই সত্যিই কী এটা করতে চাস?’
‘আর কোনো বিকল্প আছে কী আমার হাতে? এটা না করে তোকে হারানোর থেকে এটা করে তোকে হারানো বেটার নয় কী? আর এমনিতেও আমার পারফরম্যান্স মাপার এত আয়োজন যখন তৈরি, তখন পারফর্ম না করে চলে গেলে, লোকনিন্দা হবে যে!’ শার্টের হাতা দিয়ে চোখের কোনটা মোছে সেনী।
মাথা নুইয়ে বসে আছে মিথি। খাট থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সেনী। একটা একটা করে খুলতে থাকে ওর শার্টের বোতাম। শেষ বোতামটা খুলে শার্টটা খসিয়ে দেয় মাটিতে।
‘আমার দিকে তাকা, মিথি। দ্যাখ আমার উলঙ্গ শরীরটাকে।’ গলা কান্নায় ভেঙে আসে ওর। ‘দ্যাখ ভালো করে তোর পছন্দ হচ্ছে কিনা। তোর পছন্দ হওয়া বা না হওয়ার উপরই তো সব!’ ঠোটঁ কামড়ে কান্নাটা গিলতে চেষ্টা করে সেনী।
ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকায় মিথি। আলতো পায়ে মিথির কাছে এগিয়ে আসে সেনী। ওর একপিঠ লম্বা ঘন পশম-চুল একপাশে করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মিথির দিকে। হাত দুটো পিছনে করে খুলে ফেলে ব্রা-এর হুক। মিথির মাথাটা ধরে চেপে ধরে নিজের বুকের উপর।
অল্প সময়ের মধ্যেই সম্পূর্ণ বেয়াব্রু হয় সেনী। প্রবল আক্রোশে টেনে খুলে ফেলে মিথির সবটুকু আবরণ। জানলার দু-ইঞ্চি ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা মরা বিকেলের আলোয় পাগলের মতো মিথির শরীর খুঁজতে থাকে সে। মিথিও যোগদান করে আদর ফিরিয়ে দেওয়ায়, কিন্তু সেনী আজকে যেন প্রবল আগ্রাসী। যেন সবটুকু হকের দাবি উসুল করেই ছাড়বে আজ। নিজের শরীরের মধ্যে এমন প্রবল চাওয়া আগে কোনোদিন অনুভব করেনি সে। তীব্র আবেগে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়তে থাকে মিথির শরীরে। বারবার, বারবার।
মিনিট পনেরো পরে মিথি হঠাৎ ওর কাঁধ ধরে ওকে থামিয়ে দেয়। শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ‘আই আম সরি, সেনী। আমি শরীরে কিচ্ছু ফিল করছি না, বিশ্বাস কর।’ মিথির মনে হয় একটা দলা পাকানো কান্না কোথাও থেকে যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু ওর চোখদুটো মরুভূমির মতো খটখটে শুকনো। ‘আমার সারা শরীর জুড়ে একটুও উত্তেজনা…’
‘হবে, হবে রে মিথি, হতেই হবে।’ উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে মিথির মুখটা দু-হাতের মধ্যে ধরে বলে সেনী। ‘আর একটু ধৈর্য্য ধর, আমাকে জাস্ট আরেকটু সময় দে। আমার ভিতরে যে কী হচ্ছে কী বলব! তুইও ফিল করতে পারবি। বিশ্বাস কর!’
মিথির শরীরে আবারো ঘনভাবে মুখ গুঁজে দেয় সেনী। প্রতি চুম্বনে শুষে নিতে চায় সবটুকু বলতে না পারা আবেগ। দু-হাতের নিষ্পেষণে আরও বেশি করে ঢেলে দিতে চায় ছ-মাসের বকেয়া রেশন। আরও গভীর দাবিতে মর্দন করতে থাকে মিথির শরীর।
খানিকক্ষন পরে চোখ মুখ কুঁচকে প্রবলভাবে মাথা নাড়তে থাকে মিথি। ‘পারলাম না রে সেনী, পারলাম না। এত চেষ্টা করেও পারলাম না। আমার শরীরটা সেই একটা টিউব-তারের জঞ্জালই হয়ে রইল।’
মিথির শরীর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে উঠে বসে সেনী। রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, কষ্ট সবকিছু একসঙ্গে অনুভূত হচ্ছে তার মধ্যে। কান মাথা ঝাঁঝাঁ করছে। জীবনের প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার উত্তেজনায় বুকদুটো হাপরের মতো উঠছে পড়ছে। ওর শরীর এখনই প্রস্তুত নয় এই আকস্মিক বিচ্ছেদের জন্য। ওর মন ভবিষ্যতের কিছু বছর পরেও প্রস্তুত থাকবে না এই বিচ্ছেদের জন্য।
মিথি নিজের খেয়ালে বলে চলেছে, ‘কিচ্ছু পেলাম না। কিচ্ছু না। তোর শরীর ছোয়ার অনুভূতি, তোকে নিজের করে পাওয়ার খুশি, তোর মন শরীর ভরিয়ে দেওয়ার তৃপ্তি—কিচ্ছু না। শুধু…’
কথা শেষ করতে পারে না মিথি। ওর চুলের মুঠি ধরে মুখের কাছে টেনে আনে সেনী। ‘চুপ, একদম চুপ। কেন করলি এরকম? কেন করলি এটা আমার সঙ্গে বল! কেন গিয়েছিলি আমার বাড়ি লুকিয়ে? কেন আলাপের দিন থেকে আমার সঙ্গে একটা অন্যরকম উষ্ণতা নিয়ে কথা বলেছিলি? আমি কী ক্ষতি করেছিলাম তোর? তখন মনে ছিল না যে তোর শরীরটা একটা আস্তাকুঁড়? মনে ছিল না তুই একটা শুকনো ছিবড়ে বই কিছু না?’ বলতে বলতে ধাক্কা মেরে ওকে বিছানায় ছুড়ে ফেলে সেনী।
দু-হাতে মুখ গুঁজে ভাঙা মাস্তুলের মতো পড়ে আছে মিথি। ‘ক্ষমা করে দে সেনী, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি তোকে সত্যি করেই ভালোবেসেছি।’
হনহনিয়ে এগিয়ে আসে সেনী। মিথির মুখের সামনে মুখ রেখে হিসহিসিয়ে ওঠে, ‘তুই আমাকে বলিস না নিজেকে খুশি মনে মেনে নেওয়ার কথা? তুই নিজে পেরেছিস নিজেকে মেনে নিতে?’
এক ঝটকায় জামাকাপড় পরে দরজার দিকে এগিয়ে যায় সেনী। বেরিয়ে যাওয়ার আগে মিথির দিকে তাকায়, ‘তোকে যেন আর কোনোদিন আমার আশপাশেও না দেখি। আমাদের এক বছরের কাঁচা স্বর্গ শেষ হল।’
দড়াম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। ধপ করে মেঝের উপরে বসে পড়ে মিথি। ঠিক তখনি ওর কানের মধ্যে বসানো রিসিভিং ডিভাইসে গলা শোনা যায় সোমলতা ম্যামের। ‘মিথিলা, তোমার শরীরে হরমোন প্রবাহ চালুই হয়নি। তোমার বুকের নার্ভ এন্ডিংস একইরকম স্মিমিত। যে কৃত্রিম ভ্যাজাইনা আমরা প্রতিস্থাপন করেছি, সেটাও তোমার ঘনিষ্ঠতার সময় উপযুক্ত রিএকশন দেয়নি। এক কথায় আমাদের এক্সপেরিমেন্ট ফেইল করেছে। সরি।’
মিথির খুব খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মিথির চোখের কোল খটখটে শুকনো।
শেষ নাহি যার…
গোটা শহরটা আজ যেন ভেসে যাচ্ছে গাঢ় পার্পেল স্রোতে। মহাজাতি সদনের সামনে থেকে শুরু হওয়া একটা অন্তহীন মিছিল রামধনুর সব ক-টা রঙের শামিয়ানা ছড়িয়ে হেঁটে চলেছে ভবানীপুরের দিকে। ড্র্যাগ কুইনরা উজ্জ্বল পোশাকে ডিসেম্বরের সূর্যালোক ছড়িয়ে দিচ্ছে। রামধনু পতাকাটা উড়ছে পতপত করে। মিছিলে মাঝে এক জায়গায় ডান্স পারফরম্যান্স চলছে। তার থেকে একটু এগিয়ে গেলে শোনা যাবে উদাত্ত গলায় কেউ বলছে—‘তুমি আমায় ধুলোয় পিষে দিতে পারো, কিন্তু জেনে রেখো আমি উঠে দাঁড়াবোই!’ মায়া এঞ্জেলোর বিখ্যাত কবিতার বাংলা অনুবাদ।
সৌরসেনীর গলা জড়িয়ে ধরে কাবেরী। ‘কী! বলেছিলাম না, প্রথমবার প্রাইড মার্চে আসার মজাটাই আলাদা।’
সৌরসেনী মুখ তুলে হাসে, ‘এত রং সত্যিই বহুদিন কোথাও দেখিনি রে কাবু।’
‘তুই এতদিন আসিসনি কেন বলতো?’ কাবেরীর কৌতূহলী প্রশ্ন।
‘কী জানি! হাত ধরে নিয়ে আসার মতো কেউ ছি লনা বলেই হয়তো। মনে হত একা একা আসব?’
‘সেনী, একা তো সবসময় ফিল করি রে আমরা। এইরকম এক দুটো দিনেই তো মনে হয়ে একা নই।’
কথাটা বলেই অদ্ভুত শান্ত একটা চোখে সৌরসেনীর দিকে তাকায় কাবেরী। বড্ডো লম্বা কাবেরীটা। পায়ের ডগায় ভর দিয়ে সেনীর গোড়ালি অচিরেই বাতাসে উঠে আসে। ঠোটঁ ডুবে যায় কাবেরীর ঠোঁটে।
‘আবার এই লিপস্টিকটা মেখেছিস তুই?’ চুম্বন শেষ করে অভিযোগ জানায় সেনী। ‘বলেছি না এই টেস্টটা আমার পছন্দ না?’
‘অত দাবি থাকলে নিজে কিনে দেবে সোনামণি। তোমার মতো টেন এলপিএ প্যাকেজ নয় আমার।’
মিছিলটা কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে ওদের ছেড়ে। পা চালায় দুজনে। কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে যায় সেনী। কয়েক ফুট দূরে একটা মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুহূর্তেই পা দুটো যেন টলে ওঠে ওর। বহু বছরের আস্তাকুঁড় থেকে যেন উঠে এসেছে কোনো প্রেতাত্মা। কাবেরীর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলে সেনী।
‘হোয়াট হ্যাপেনড? ডু ইউ নো হার?’
না বলতে চেয়েও হ্যাঁ বলে ফেলে সেনী। ‘দেন গো টক তো হার।’ স্বাভাবিক গলায় বলে কাবেরী।
মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় সে। গলাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। ‘নাথিং মাচ। স্কুলে পড়ত। জাস্ট আ পেস্ট একুইনটেন্স।’ কাবেরীর কাঁধে মাথা রাখে সেনী। সামনের দিকে হাত লাগায় দুজনে।
কয়েক মুহূর্ত পরে কাবেরীর জড়িয়ে ধরা হাতের উপর দিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকায় সেনী। পিছনে রামধনুর সমুদ্র। অজস্র মুখ। কোনো একটি মুখকে দেখতে পায় না সে।
Tags: ঋষভ চট্টোপাধ্যায়, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
বেশ ভালো
অনেক ধন্যবাদ
খুব সুন্দর লাগল। একটা অন্যরকম ভয়ও, ভবিষ্যতের জন্য।
অনেক ধন্যবাদ