কৃষ্ণা নদীর ওপারে
লেখক: মূল রচনা: রবার্ট ই হাওয়ার্ড অনুবাদ: সায়ক দত্তচৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
কুঠার হারাল কোনান
আদিম, গহীন অরণ্য ভেদ করে যাওয়া কুণ্ঠিত বনপথটি এতটাই জমাট নিঝুম যে অজিন নির্মিত পাদুকার খসখস ধ্বনিও যেন মূর্তিমান শান্তি ভঙ্গকারী হয়ে উঠছিল। অন্তত পথিকের কর্ণদ্বয় সেই মৃদু শব্দেই সচকিত হয়ে উঠছিল বারবার। যদিও তার সেই পদচারণা ছিল নিয়ন্ত্রিত ও চর্চিত। বজ্র নদীর সীমা পার করার দুঃসাহস যারা করে তাদের এই অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে যেতেই হয়।
পথিকের উচ্চতা মাঝারি। শিরস্ত্রাণ তার মুখাবয়বকে আচ্ছাদিত করেনি। কৃষ্ণাভ বিশৃঙ্খল ঘন কেশরাশিও দৃশ্যমান। তার সাজপোশাক এই দেশে বহুল প্রচলিত। উর্ধ্বাঙ্গে কর্কশ টিউনিক। চামড়ার কটিবন্ধ। নিম্নাঙ্গে চামড়ার, ছোটো, আঁটসাঁট, অর্ধপদাবৃত পায়জামা। পায়ে বেশ কিছুটা উঁচু অবধি আচ্ছাদিত মৃগত্বকের পাদুকা। তার একটির থেকে উঁকি দিচ্ছে ছুরির কারুকার্যময় হাতল। চওড়া কটিবন্ধটি থেকে ঝুলছে একটি নাতিদীর্ঘ ভারী তরোয়াল ও একটি হরিণের চামড়ার থলি। বৃহৎ চক্ষুদুটির দৃষ্টি সতর্ক। তা প্রতি মুহূর্তে চারপাশের গাঢ় সবুজ প্রাচীরকে পরিমাপ করে বোঝার চেষ্টা করছে সেটির আড়ালে কোনো বিপদ লুক্কায়িত আছে কিনা। সে দীর্ঘাকৃতি নয়, কিন্তু যথেষ্ট সবল। টিউনিকের খাটো হাতা পার করে যে বাহুদ্বয় দেখা যাচ্ছে তা বেশ শক্তিশালী পেশিবহুল।
সে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছিল। গৃহবাসীদের শেষ কুটিরটিও কয়েক মাইল পিছনে ফেলে এসেছে সে। যতই এগোচ্ছে ততই এই প্রাগৈতিহাসিক, গা ছমছমে, ঘন সবুজ সমুদ্রের মতো বনভূমির, রহস্যময় ভয়ানক বিপদ যেন তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হচ্ছিল।
যতটা তার নিজের মনে হচ্ছিল ততটা আওয়াজ অবশ্য সে করছিল না। তবে সে নিশ্চিত জানে, এই অস্ফুট আওয়াজই কালচে পান্না বর্ণের ষড়যন্ত্রী আঁধারে লুকিয়ে থাকা বহু হিংস্র শ্রবণযন্ত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য জোগান দিতে যথেষ্ট। তাই সে অত্যন্ত সাবধানী। তাই তার চোখ আর কান খুব সজাগ। বিশেষত কান। কারণ দৃষ্টিকে যতই সজাগ রাখার চেষ্টা করা হোক, তার পক্ষে ঘন লতা, গুল্ম, বৃক্ষরাজি ভেদ করে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া অসম্ভব।
কিন্তু কোনো দৃশ্য বা শব্দ নয়, হঠাৎ এক সহজাত প্রবৃত্তিই তাকে সাবধান করল। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার হাত পৌঁছাল তরোয়ালের হাতলে। পথের মাঝে সে যেন প্রস্তরিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অসচেতনভাবেই শ্বাসরুদ্ধ। কীসের শব্দ শুনল সে? অথবা আদৌ কোনো শব্দ শুনল কি? নিস্তব্ধতা তো তেমনই আছে। তেমনই নিশ্ছিদ্র। কোনো পাখির অস্ফুট ডাক বা কাঠবিড়ালির নখরশব্দ তো পৌঁছায়নি তার কানে। তারপর তার দৃষ্টি পড়ল কয়েক গজ দূরে, এই তন্বী বনপথের ধারে একটি ঘন ঝোপের ওপর। বাতাস তো নেই। তবে একটি ডাল কেঁপে উঠল কেন? তার রোম খাড়া হয়ে উঠল। সে ক্ষণকাল অনিশ্চিত দোলাচলে স্থির হয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল, সামনে বা পিছনে, যেদিকেই সে যাক, উদ্যত মৃত্যু তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে মুহূর্তমাত্র সময় নেবে না।
এমন সময় ভয়ংকরভাবে দুলে উঠল সেই ঝোপ। প্রবল আঘাতের ফলে কড়কড় করে কঠিন কিছু একটা কাটার শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। সঙ্গে সঙ্গেই ঝোপের আড়াল থেকে নিক্ষিপ্ত একটি তির বিদ্যুৎ গতিতে হারিয়ে গেল বনপথ পার করে জঙ্গলের অন্ধকারে। তা দেখে তৎক্ষণাৎ পথিক এক লাফে একটি বনস্পতির আড়ালে আশ্রয় নিল। তরোয়ালটা শক্ত মুঠিতে ধরে বিরাট কাণ্ডের আড়াল থেকে সে উঁকি দিয়ে দেখল, ঝোপটা দু-ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, আর তার পিছন থেকে অলস পায়ে বনপথে এসে দাঁড়াচ্ছে একটি সবল, শালপ্রাংশু মানবদেহ।
পথিক ভয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে চেয়ে রইল। আগন্তুকের পায়ে পা ঢাকা জুতা। খুবই খাটো নিম্নাঙ্গ আচ্ছাদনী তার পরনে, জানু অবধিও নামেনি তা। সেটি চামড়ার পরিবর্তে সম্ভবত রেশম নির্মিত। উর্ধ্বাঙ্গে টিউনিকের পরিবর্তে সে পরিধান করেছে একটি হাতা হীন স্কন্ধ ও বক্ষকে আড়াল করা ধাতব বর্ম। সেটি থেকে ঝুলছে বহু সূক্ষ্ম শৃঙ্খল নির্মিত জালিকা। তার শিরস্ত্রাণটি সবচেয়ে আশ্চর্যজনক। তাতে কোনো চূড়া নেই, বরং দুটি শৃঙ্গ বের হয়ে রয়েছে। এ শিরস্ত্রাণ কোনো সভ্য মানুষের হাতে নির্মিত নয়। যেমন তার নীচে যে মুখাবয়ব দেখা যাচ্ছে তাও কোনো সভ্য মানবের হতে পারে না। তামাটে, রোদে পোড়া, ক্ষত চিহ্নে কলঙ্কিত। চোখদুটি নীলাভ, ধোঁয়াটে। যেন কোনো গগনচুম্বী পর্বতচূড়ার শীতলতা জমা হয়েছে তাতে। সেই দুটি আঁখি এই অরণ্যের মতোই আদিমতায় ভরা। মানুষটির ডান হাতে একটি চওড়া ফলার তরবারি। সেটি রক্তে রঞ্জিত।
“বেরিয়ে এসো হে।” পথিকের অপরিচিত এক উচ্চারণ ভঙ্গিমায় ডাক দিল সে। “এই একটা কুত্তাই ছিল। এবার বেরিয়ে এস।”
ডাক শুনে পথিক দ্বিধাগ্রস্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে এল। সন্তর্পণে বোঝার চেষ্টা করল পরিস্থিতি। সামনে থেকে যোদ্ধার দেহাবয়ব দেখে তার মন একই সঙ্গে শ্রদ্ধা আর ভয়ে ভরে গেল। আগন্তুক বৃষস্কন্ধ, কবাটবক্ষ। তার দুই হাত, যার একটিতে ধরা তরবারি থেকে তখনও রক্ত ঝরছে; রোদে পোড়া, শক্তিশালী পেশির কারুকার্য খচিত। তার কালো প্যান্থারের মতো দ্রুত, নমনীয়, স্বচ্ছন্দ চলাফেরা প্রমাণ করছে যে সভ্য দেশে তো নয়ই, এমনকী যে সীমারেখায় সভ্যতা ও বর্বরতা মিশে যায়, সেখানেও সে জন্মগ্রহণ করেনি।
ঝোপের কাছে আবার ফিরে গিয়ে সেটিকে ফাঁক করল যোদ্ধা। ভীত পায়ে তার পিছন পিছন গিয়ে সেটিতে উঁকি দিল পথিক। একটি মানবদেহ পড়ে আছে। খর্ব, কৃষ্ণকায়, পেশিবহুল। পরনের একটি লেংটি ছাড়া বাকি দেহ অনাবৃত। গলায় মানুষের দাঁতের মালা। হাতে তামার বালা। কোমরে একটি খাটো তরবারি। এক হাতে তখনও ধরা রয়েছে একটি কালচে হিলহিলে ধনুক। মাথায় কালো চুল। মাথা সম্পর্কে এইটুকুই বুঝতে পারল পথিক, কারণ সেটি রক্তে আর ঘিলুতে মাখামাখি। প্রচণ্ড আঘাতে তালু থেকে চোয়াল অবধি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে মাথাটি।
“হে ভগবান! এ যে দেখছি একটা পিক্ট!” আঁতকে উঠল পথিক।
জ্বলন্ত নীল নয়নদুটি তার দিকে ফিরল।
“অবাক হলে?”
“তা তো কিছুটা বটেই। শুধু ভেলিট্রিয়ামেই নয়, অরণ্যপ্রান্তের শেষ বসতির কুটিরগুলোতেও ওরা বলেছিল এই শয়তানেরা সীমান্তে উঁকি মারলেও এত ভিতরে ঢোকে না।”
“ভুল বলেছিল। তুমি কৃষ্ণা নদী থেকে মাত্র চার মাইল পুবে আছো।” আগন্তুক মন্দ্রস্বরে বলল। “ভেলিট্রিয়ামের এক মাইলের মধ্যেও এদের দেখা গেছে। বজ্র নদী ও টাস্কেলান দুর্গের মাঝে কোনো বসতি স্থাপনকারীই নিরাপদ নয়। আজ সকালে আমি দুর্গের তিন মাইল দক্ষিণে এই কুত্তাটার চলার রাস্তা খুঁজে পাই। সেটাকে অনুসরণ করতে করতে আমি এখানে পৌঁছই। যখন ওকে দেখলাম, ও তখন তোমাকে তাক করে তির ছোড়ার জন্য প্রস্তুত। আর একটু দেরি হলেই তুমি নরকে পৌঁছে যেতে। বেচারার নিশানার আমি দফা রফা করে দিয়েছি।”
পথিক বিস্ফারিত চোখে দীর্ঘকায় মানুষটির দিকে চেয়ে ছিল। এই মানুষটি এক শয়তান পিক্টের গমনপথ অনুসরণ করে এসে কোনো সন্দেহ সৃষ্টি না করে তাকে হত্যা করেছে, এ যে কত বড়ো অসম্ভব কীর্তি তা ভেবেই সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। যে কোনো অরণ্যচারীর পক্ষে এটা স্বপ্নের অতীত সক্ষমতা। এমনকী এই কোনাজোহারাতেও।
“তুমি দুর্গের সৈন্যদলের একজন?” সে জিজ্ঞেস করল।
“সৈন্য বলতে যা বোঝায়, আমি ঠিক তা নই। আমি দুর্গ থেকে একজন সেনানায়কের বেতন ও খাবারদাবার নিলেও, বেশির ভাগ সময় জঙ্গলেই কাটাই। ভ্যালানাস জানে আমাকে দুর্গে আটকে রাখার চেয়ে নদীতটে, জঙ্গলে ঘুরতে দিলে তার লাভ বেশি।”
যোদ্ধা অবলীলায় মৃতদেহটিকে পা দিয়ে ঝোপের আরও ঘন অংশে ঠেলে দিল, তারপর চলতে শুরু করল বনপথ ধরে। পথিক তার পিছু নিল।
“আমি ব্যালথাস।” সে নিজে থেকেই বলল। “কাল রাতে আমি ভেলিট্রিয়ামে ছিলাম। আমি এখনও ঠিক করতে পারিনি যে এখানে বসতি স্থাপনের কাজে লাগব, নাকি দুর্গে কোনো কাজ নেবো।”
“বজ্র নদীর কাছে সবচেয়ে ভালো জায়গাগুলো বিলি বাঁটা হয়ে গেছে।” হন্তারক সামান্য বিরক্তি নিয়ে বলল। “করোটি খাঁড়ি, মানে যেটা তুমি পার হয়ে এসেছ, আর দুর্গের মাঝামাঝি ছিল জায়গাগুলো। তবে ওগুলো বিপজ্জনকভাবে কৃষ্ণা নদীর কাছাকাছি। পিক্টগুলো মাঝে মধ্যেই নদী পার হয়ে এসে চুরি ডাকাতি এমনকী খুনও করে। কোনো না কোনো দিন হয়তো ওরা দলবেঁধে এসে বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণ করে কোনাজোহারা থেকে ঝেঁটিয়ে দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। এই বাইরে থেকে এসে উপনিবেশ স্থাপন করার চিন্তাটাই পাগলামি। অন্যায়ও বটে। বসোনিয়ার সীমানায় প্রচুর ভালো জমি পড়ে আছে। অ্যাকুইলোনিয়রা যদি তাদের ব্যারনদের বিশাল বিশাল জমিদারির কিছুটা ভাগ করত, যেখানে তাদের ফুর্তির জন্য হরিণ শিকার হয় সেখানে গম চাষ করত, তবে সীমানা পার করে পিক্টদের তাড়িয়ে তাদের জমি দখল করার কোনো দরকার হত না।”
“কোনাজোহারার একজন রাজকর্মচারীর মুখে এমন কথা কিন্তু খুবই অদ্ভুত।” ব্যালথাস অবাক হল।
“মোটেই না। আমি একজন পেশাদার যোদ্ধা। যে সর্বোচ্চ দাম দেয়, আমার তরোয়াল তার হয়েই কথা বলে। কিন্তু উচিত কথা বলা থেকে আমায় কেউ আটকাতে পারে না। তোমরা হাইবোরিয়রা নিজেদের রাজত্ব যতদূর বিস্তার করা উচিত, করেছ। তবু তোমাদের আশ মেটেনি। সীমানা ছাড়িয়ে, গ্রাম পুড়িয়ে, বেশ কিছু গোষ্ঠীকে কৃষ্ণা নদীর ওপারে পাঠিয়ে থেমেছ। তবে আমার ধারণা তোমাদের পশ্চিম সীমানা তোমরা আর বাড়াতে পারবে না। এমনকী তোমরা যা দখল করেছ তাও ধরে রাখতে পারবে না। তোমাদের মূর্খ রাজা জানেই না এখানকার প্রকৃত অবস্থা কী। সে তো এখানে নতুন করে কোনো সৈন্যই পাঠাচ্ছে না। নদীর ওপার থেকে যদি কোনো সম্মিলিত আক্রমণ আসে তবে এখানের উপনিবেশের ক্ষমতা নেই তাকে প্রতিরোধ করার।”
“কিন্তু পিক্টেরা তো ছোটো ছোটো গোষ্ঠীতে বিভক্ত।” ব্যালথাস গোঁয়ার্তুমি করে বলল, “ওরা কোনোদিন এক হবে না। একটা গোষ্ঠীকে মেরে তাড়ানোর ক্ষমতা আমাদের আছে।”
“হ্যাঁ, তিন-চারটে গোষ্ঠীকেও।” হন্তারক স্বীকার করল। “কিন্তু একদিন আসবে যখন একজনের নেতৃত্বে তিরিশ-চল্লিশটা গোষ্ঠী সংগবদ্ধ হবে। যেমন কয়েক বছর আগে সিমেরিয়রা হয়েছিল গান্ডারম্যানদের বিরুদ্ধে; যখন তারা উত্তরে সাম্রাজ্য বিস্তার করার চেষ্টা করেছিল। ওরা সিমেরিয়ার দক্ষিণ সীমানা পার করে ঢুকেছিল, কিছু গোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিল, ভেনারিয়াম নামের একটা দুর্গ শহরও বানিয়েছিল। তার পরের গল্প তো তোমরা জানো।”
“জানি তো।” ব্যালথাস চোখ পিটপিট করে জবাব দিল। সেই রক্তেভেজা দিনটির স্মৃতি পররাজ্য দখল করে উপনিবেশ স্থাপনকারীদের হৃদয়ে বরাবরের জন্য এক কৃষ্ণ ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি করে গেছে। “আমার কাকা সেই হামলার দিনে ভেনারিয়ামে ছিলেন। উনি ছিলেন এক ভাড়াটে সৈনিক। সামান্য যে কয়েকজন সেদিন বাঁচতে পেরেছিল, তার মধ্যে একজন ছিলেন উনি। বহুবার সে কাহিনি শুনেছি ওঁর মুখ থেকে। সেদিন আচমকা পাহাড় থেকে নেমে বন্যার জলের মতো হিংস্র বর্বর সিমেরিয়রা ঢুকে পড়েছিল। কেউ তাদের আটকাতে পারেনি। তারপর শুরু হয়েছিল হত্যালীলা। পুরুষ, নারী, শিশু কাউকে ছাড়েনি ওরা। ভেনারিয়াম সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল। গান্ডারম্যানরা সেই যে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হল, আর কোনোদিন সিমেরিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের সাহস করেনি। কিন্তু তুমি এমনভাবে কথাটা তুললে যেন সেদিন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে।”
“ছিলাম তো।” গম্ভীর স্বরে যোদ্ধা বলল। “আক্রমণকারীদের মধ্যে একজন ছিলাম আমি। তখনও আমি পনেরোটা বরফের ঋতুও ঠিকমতো দেখিনি। তবু তখনই আমার নাম একাধিক গ্রামপ্রধান নির্বাচিত করেছিল।”
ব্যালথাস নিজের অজ্ঞাতেই দু-পা পিছিয়ে গিয়ে ভয়মিশ্রিত চোখে চাইল। তার পাশে নির্লিপ্ত আননে শান্ত পদক্ষেপে যে মানুষটি চলেছে সে কিশোর বেলাতেই ভেনারিয়ামের কঠিন প্রাচীর চুরমার করে এক রক্তলোলুপ পিশাচের মতো পথঘাটে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল!
“তাহলে তুমি একজন বর্বর!” কথাগুলো যেন নিজে নিজেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
মানুষটি কিন্তু এতে কিছু মনে করল না। নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে সায় দিল সে। বলল, “আমি কোনান। সিমেরিয়।”
“আমি তোমার কথা শুনেছি।” নতুন করে উৎসাহ দেখা গেল ব্যালথাসের চোখে মুখে। এইজন্যেই পিক্টটি শিকারে পরিণত হয়েছে। এই সিমেরিয়রা পিক্টদের মতোই হিংস্র ও বর্বর, কিন্তু অনেক বেশি বুদ্ধিমান। বোঝা যাচ্ছে কোনান বেশ কিছুদিন সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে। কিন্তু তার ফলে সে কোমল, শ্লথ হয়নি। তার আদিম জন্মগত ক্ষমতাগুলির কোনোটাই হারায়নি সে। বনপথ ধরে কোনানের অনায়াস নিঃশব্দ মার্জারের মতো চলন দেখে তার উদ্বেগ মুগ্ধতায় বদলে গেল। আশ্চর্যজনকভাবে তার তৈলজ্জ্বল ধাতব বর্ম পর্যন্ত একটুও শব্দ উৎপন্ন করছে না। সে বুঝল কোনান অরণ্যের লতাগুল্মের ঘন প্রাচীর ভেদ করে একজন নিরাবরণ পিক্টের মতোই নিঃশব্দে সঞ্চরণে সক্ষম।
“তুমি নিশ্চয়ই গান্ডারম্যান নও?” প্রশ্নের বদলে একে বিবৃতিই বলা চলে।
“না।” ব্যালথাস মাথা ঝাঁকাল। “আমি ট্যরানের লোক।”
“আমি ট্যরানের বেশ কিছু ভালো বুনো শিকারিকে দেখেছি। তোমাদের মতো অ্যাকুইলোনিয়ার সীমান্তে থাকা বনবাসীদের বসোনিয়রা প্রায় একশো বছর ধরে থাকতে দিচ্ছে। ফলে তোমরা নরম সরম হয়ে পড়েছ। তোমাদের আরও পোক্ত হতে হবে।”
কথাটা সত্যি। অ্যাকুইলোনিয়ার সীমান্ত ছুঁয়ে থাকা প্রদেশগুলোতে প্রায় দূর্ভেদ্য প্রাকারে ঘেরা বিভিন্ন গ্রামে যে দুর্ধর্ষ তিরন্দাজরা থাকত, তারা বহু বছর ধরে অনায়াসে হিংস্র বন্যদের ঠেকিয়ে রেখেছিল। এখন তাদের উপনিবেশ স্থাপনকারী হিসেবে বজ্র নদী পার করে বাসের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ভাবা হচ্ছে দূর্দান্ত শিকারী যোদ্ধা বলে, বন্যদের নিজভূমেই তারা তাদের আধিপত্য স্থাপন করতে পারবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে এমন যোদ্ধার দেখা পাওয়া ভার। যারা আসছে তাদের মধ্যে বাসস্থান স্থাপনকারী বেশি, বনচর বীর মৃগয়াজীবী কম।
সূর্য এখনও অস্তমিত হয়নি। কিন্তু তা হারিয়ে গেছে বনস্পতির দীর্ঘ প্রাকারের পিছনে। দীর্ঘতর হচ্ছে ছায়া। মনখারাপ করা অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে আরও কাছে।
সেই ছায়াঘন পথে হাঁটতে হাঁটতে কোনান নির্বিকারভাবে বলল, “দুর্গে পৌঁছানোর আগেই রাত হয়ে যাবে দেখছি।” তারপর অকস্মাৎ থমকে গিয়ে বলে উঠল, “শুনতে পাচ্ছ?”
মুহূর্তের মধ্যে সে বদলে গিয়েছিল এক সতর্ক, সন্দেহপ্রবণ বনচারীতে। হাত তরবারির হাতলে রেখে, সামান্য ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল সাবধানতা ও হিংস্রতার প্রতিমূর্তি হয়ে। বিপদ এলে সঙ্গে সঙ্গে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করতে প্রস্তুত।
এবার আর্তনাদটা এত জোরে হল যে ব্যালথাসও শুনতে পেল তা। কিছু দূরে কেউ একজন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় অথবা তীব্র ভয়ে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল। তৎক্ষণাৎ কোনান যেন প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই দৌড়তে শুরু করল সেই শব্দ লক্ষ্য করে। তার পিছু নিল ব্যালথাস। কিন্তু কোনান ছুটছিল এক শ্বাপদের মতো। তার সঙ্গে বেদম হয়ে পড়া ব্যালথাসের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে গালি বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। ট্যরানে দৌড়বিদ হিসেবে তার সুনাম আছে। কিন্তু কোনান তাকে অবলীলায় পিছনে, আরও পিছনে ফেলছিল। এমন সময় আরেকটা চিৎকার শোনা গেল। এক রোমহর্ষক বীভৎস হুঙ্কার। এমন গর্জন বোধহয় নিরয়বাসী দানবের পক্ষেই করা সম্ভব। মনুষ্য দৃষ্টির অগোচর কোনো কলুষিত আঁধারে মানবতার পতনে বোধহয় তারা এমন উল্লাসধ্বনি করে ওঠে।
শব্দটা ব্যালথাসের মেরুদণ্ডে হিমশীতল স্রোতের সৃষ্টি করেছিল। একইসঙ্গে ঘর্মাক্ত হয়েছিল তার শরীর। রুদ্ধ হয়েছিল তার পদচারণ। কিন্তু কোনানের মধ্যে এই হুঙ্কারের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তীব্র বেগে সে বনপথের বাঁক পার হয়ে সেই শব্দের উৎসের উদ্দেশে অদৃশ্য হয়ে গেল। সংবিৎ ফিরলে যে মুহূর্তে ব্যালথাস বুঝল সে এই ভয়ানক বনভূমে একা হয়ে পড়েছে, তৎক্ষণাৎ প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করল।
বাঁকটা পার হতেই কোনানের সঙ্গে প্রায় সংঘর্ষ হচ্ছিল তার। সিমেরিয়টি মুক্ত তরবারি হাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার সম্মুখে সামান্য দূরে পথিমধ্যে পড়ে আছে একটি মানবদেহ। কিন্তু কোনানের দৃষ্টি সেদিকে নয়। তার জ্বলন্ত দৃষ্টি ভেদ করতে চাইছে বনপথের দু-দিকের ঘন উদ্ভিদের আড়াল।
ব্যালথাস ভয়ার্তকণ্ঠে ভগবানের নাম নিল। সম্মুখে যে মানবদেহ পড়ে আছে তা স্থূল ও খর্বাকার। তার বুটজুতা জোড়া সুবর্ণখচিত। এই উষ্ণ আবহাওয়াতেও যে টিউনিক সে পরিধান করেছে তা দুর্মূল্য বন্য নকুলের রোম দ্বারা নির্মিত। নিঃসন্দেহে এক অত্যন্ত ধনকুবের ব্যবসায়ী। তার রক্তহীন, বৃহৎ, স্থূল মুখাবয়ব থেকে দুটি বিস্ফারিত নয়ন যেন অন্তহীন আতংকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসতে চাইছে। এক কর্ণের তলদেশ থেকে অপর কর্ণের তলদেশ পর্যন্ত অত্যন্ত ধারালো কিছুর আঘাত তার মস্তককে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে প্রায়। কটিদেশে কোশবদ্ধ তরবারি নির্দেশ করছে যে, সে যুদ্ধের কোনো অবকাশই পায়নি।
“পিক্টের কাজ?” অন্ধকার বনানীর দিকে সভয়ে দৃষ্টিপাত করে ব্যালথাস ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল।
নেতিবাচক শির সঞ্চালন করল কোনান। সে দৃষ্টি ফেরাল মৃতদেহের দিকে। তারপর মৃদুস্বরে বলল, “বনের পিশাচ। ক্রমের দিব্যি, এই নিয়ে পাঁচ নম্বর হল।”
“মানে?”
“তুমি জ়োগার স্যাগ নামের কোনো পিক্ট জাদুকরের নাম শুনেছ?”
ব্যালথাস খুব অস্বস্তি নিয়ে মাথা নাড়ল।
“ও গ্বাওয়েলাতে থাকে। কৃষ্ণা নদী পার করলেই সেই গ্রাম। তিন মাস আগে এই পথ ধরেই দুর্গের উদ্দেশে মালপত্র সমেত একটা খচ্চরের দল যাচ্ছিল। ও কোনো উপায়ে সেগুলোর রক্ষকদের ঘুম পাড়িয়ে সেখান থেকে দু-তিনটে খচ্চর নিয়ে পালায়। ওই মালপত্রগুলো এর ছিল।” মৃতদেহটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল সে। “টিবেরিয়াস। ভেলিট্রিয়ামের এক ধনী ব্যবসায়ী। ওই খচ্চরগুলোতে অনেক মদের কলসীও ছিল। বজ্জাত জ়োগারটা লোভে পড়ে নদী পার হওয়ার আগেই মদ গিলে গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিল। সোরাকটাস নামের একজন শিকারি ওর চলার পথ খুঁজে বের করে। সে টিবেরিয়াস আর তিনজন রক্ষীকে নিয়ে যখন ওকে খুঁজে পায় জ়োগার তখন গাছের নীচে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। ওরা ওকে ধরে একটা খাঁচায় বন্দি করে রাখে। এর চেয়ে বড়ো অপমান একজন পিক্টের জীবনে আর হয় না। দু-একদিন পর সুযোগ পেয়ে সে একজন রক্ষীকে খুন করে পালায়। সে এই খবরও ছড়িয়ে দেয়, টিবেরিয়াসের সঙ্গে যে চারজন তাকে বন্দি করেছিল তাদের এমনভাবে হত্যা করে প্রতিশোধ নেবে যা অ্যাকুইলোনিয়া কোনোদিন দেখেনি।
“যাইহোক, সোরাকটাস আর অন্য সৈন্যরা এর মধ্যেই খুন হয়ে গেছে। সোরাকটাস নদীর ধারে আর বাকি সৈন্যরা দুর্গের আশপাশেই ছায়ার আঁধারে। তাদের প্রত্যেকের ধড় পাওয়া গেলেও, মুণ্ড পাওয়া যায়নি। আমি নিশ্চিত সেগুলো জ়োগার স্যাগের আরাধ্য পৈশাচিক দেবতার পূজার বেদীর শোভা বাড়াচ্ছে। একমাত্র টিবেরিয়াসের মাথাটাই এখনও উধাও হয়ে যায়নি দেখছি।”
“কী করে বুঝলে খুনগুলো পিক্টেরাই করেনি?” ব্যালথাস সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করল।
কোনান বণিকের মৃতদেহটির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল।
“তোমার কী ধারণা গলার ওই ক্ষতটা কোনো ধারাল অস্ত্র করেছে? ওই ক্ষত কেবল নখের পক্ষেই করা সম্ভব। ভালো করে দেখলে বুঝতে পারবে গলার মাংসটা কাটা হয়নি, ছেঁড়া হয়েছে।”
“হতে পারে কোনো প্যান্থার…।” ব্যালথাসের স্বরে তখনও অবিশ্বাস।
কোনান অধৈর্য হয়ে মাথা নাড়ল।
“ট্যরানের অধিবাসী হয়েও প্যান্থারের নখের দাগ চেনো না? না, এটা প্রতিশোধ পূরণ করার জন্য জ়োগার স্যাগের ডেকে আনা বনের পিশাচ। টিবেরিয়াস একটা গাধা। সন্ধে নামার সময় কেউ একা ভেলিট্রিয়ামের দিকে রওনা দেয়? তবে এটা ঠিক, যে ক-জন মারা গেছে, প্রত্যেককেই যেন মৃত্যুর আগে পাগলামিতে ধরেছিল। রাস্তায় চিহ্ন দেখে বোঝা যাচ্ছে, টিবেরিয়াস একটা খচ্চরে করে রওনা দিয়েছিল। হয়তো কোনো ব্যাবসার কাজে। দানবটা পিছনের ঝোপ থেকে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেখ ওটার ডালপালাগুলো কেমন দুমড়ে মুচড়ে গেছে।
প্রথম চিৎকারটা টিবেরিয়াসই করেছিল যখন ও নরকে ব্যাবসা করতে গেল। ওর খচ্চরটা ছুটে পালায়। খেয়াল করো, এখনও ওটার ছোটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এসে পড়েছিলাম বলে দানোটা ওর মুণ্ডু ছিঁড়ে নিতে পারেনি।”
“আমরা না, তুমি এসে পড়েছিলে বলে।” ব্যালথাস শুধরে দিল। “কিন্তু এ কেমন দানো, যে একজন সশস্ত্র মানুষকে দেখেই পালালো? পিক্টেরা এমন কোনো ছুরি ব্যবহার করছে না তো, যার আঘাতে নখের মতো ক্ষতচিহ্ন হয়? তুমি দানোটাকে দেখেছ?”
“না, দেখিনি।” কোনান স্বীকার করল। “কিন্তু শুনেছি জাদুকরেরা যে পিশাচ পাঠায় তারা শুধুমাত্র তাদের শিকারকেই দেখা দেয়। আরেকটু আগে এলে বুঝতাম কথাটা সত্যি কিনা। আমি যখন এসেছিলাম কেবল ওই ঝোপটা নড়ছিল। তবে তুমি যদি আরও প্রমাণ চাও, মাটিতে তাকাও।”
টিবেরিয়াসের রক্তে পথ ভিজে গিয়েছিল। সেখানে পা পড়েছিল আততায়ীর। অন্ধকার অরণ্যে মিলিয়ে যাওয়ার আগে যে কটি রক্ত লাল পদচিহ্ন রেখে গিয়েছিল সে, সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আতংকের শীতল স্রোত বয়ে গেল ব্যালথাসের হৃদয়ে। বীভৎস অদ্ভুত সে চরণ চিহ্ন। মাত্র চারটি অঙ্গুলির ছাপ পড়েছে মাটিতে। তিনটি অগ্রে একটি পশ্চাতে। প্রতিটি অঙ্গুলি থেকে নির্গত শানিত বক্র নখর পথে দাগ রেখে গেছে। এমন চিহ্ন কোনো চেনা পশুর হতে পারে না। এ যেন পক্ষী ও সরীসৃপের মাঝামাঝি কোনো বিচিত্র জীবের সৃষ্টি। সে অতি সাবধানে স্পর্শ না করে আঙুলের সাহায্যে সেটির দৈর্ঘ্য মাপার চেষ্টা করল। দুই বিতস্তির অধিক হবে। সেটির বিশালত্ব অনুভব করে শিউরে উঠল সে।
“কী এটা? আমি কোনো বন্যপ্রাণীকে এমন পথরেখা ছাড়তে দেখিনি?” ভয়ার্ত কণ্ঠে, ফিসফিসিয়ে সে জিজ্ঞেস করল।
“জলাভূমির পিশাচ।” কোনান গম্ভীর গলায় জবাব দিল। “লোকে বলে, কৃষ্ণা নদীর ওপারের জলাভূমিতে ওরা বাদুড়ের মতো ছেয়ে আছে। ওদের চিৎকার নরকে আটকে পড়া আত্মার কথা মনে করিয়ে দেয়। গ্রীষ্মে যখন ওদিক থেকে বাতাস বয়, নিশুতি রাতে ওদের আর্তনাদ শোনা যায়।”
“এবার আমরা কী করব?” ঘন নীল আঁধারের দিকে ভয়াভিভূত দৃষ্টিপাত করে ব্যালথাস বলল। মৃতের ত্রাসে ছাওয়া মুখমণ্ডল তাকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, হয়তো এই মুহূর্তে এক জঘন্য, পৈশাচিক দানব অন্ধকারে লালানিঃসারী তীক্ষ্ণ দন্তধারী মুখ ব্যাদিত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যতই সরানোর চেষ্টা করুক, আতংক এক কৃষ্ণ আচ্ছাদনের মতো তাকে ঢেকে ফেলছিল।
“পিশাচকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই।” কোনান তার কোমরবন্ধে ঝোলানো একটি ছোটো কুঠার হাতে নিয়ে বলল। “সোরাকটাসের মৃতদেহ দেখার পর আমি ওর পথ অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলাম। দশ-বারো পা এগোনোর পর সেটা হারিয়ে গেল৷ কে জানে, হয়তো পিশাচটা ডানা মেলে উড়ে গিয়েছিল। মাটি ফুঁড়ে নরকেও নেমে যেতে পারে। খচ্চরটার পিছনে ছুটেও লাভ নেই। ওটা নিজে থেকেই হয় দুর্গে নয়তো কোনো বসতির কুটিরে ঠিক পৌঁছে যাবে।”
কথা বলতে বলতেই কোনান পথিপার্শ্বস্থ দুটি দশ-বারো ফুট দীর্ঘ শিশুবৃক্ষ কেটে তার শাখা-প্রশাখা ছেঁটে ফেলেছিল। এবার সে সাপের মতো পড়ে থাকা একটি দৃঢ় লতাকে নির্বাচিত করল। লতাটি কেটে একটি দণ্ডের অন্তিম প্রান্ত থেকে ফুটখানেক দূরে বাঁধল সে। তারপর সেটিকে দুটি দণ্ডের সঙ্গে রজ্জুর মতো জালকাকারে জড়িয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি লম্বাটে ডুলি তৈরি করে ফেলল। এরপর সে টিবেরিয়াসের চর্মনির্মিত কোমরবন্ধের সাহায্যে ডুলির অগ্রপ্রান্তে একটি শক্তিশালী ফাঁস বানাল।
“আমি পিশাচটাকে টিবেরিয়াসের মাথাটা নিয়ে যেতে দেব না।” সে রাগে গরগর করে বলল। “লোভী, মোটা লোকটাকে আমি পছন্দ করতাম না। তবু ওর মৃতদেহটাকে আমি দুর্গে নিয়ে যাবো। মাইল তিনেক বইতে হবে। একজন সাদা মানুষের মৃতদেহের এই হাল হতে দেওয়া ঠিক হবে না।”
পিক্টদের অনেক গোষ্ঠীর ত্বকের বর্ণও অবশ্য শ্বেতই ছিল। তবে তা বেশ কিছুটা মলিন। এছাড়া নোংরায় ঢাকা থাকার কারণে তাদের দেহবর্ণ সবসময় বোঝা যেত না। ফলে লোকজন তাদের সাদা মানুষ হিসেবে কখনও উল্লেখ করত না।
কোনান হতভাগ্য বণিকের দেহটাকে নির্বিকারভাবে ডুলিতে রাখল। সে সামনের অংশে টিবেরিয়াসের কোমর বন্ধনির সাহায্যে বানানো ফাঁসটি আর ব্যালথাস পিছনের দণ্ডাংশদুটি ধরল, তারপর যত দ্রুত সম্ভব পা চালিয়ে রওনা দিল দুর্গের উদ্দেশে। কোনান সামনের অংশটি একহাতে অবলীলায় বহন করছিল। তার অন্য হাতে ছিল উন্মুক্ত তরবারি। এত ভার বহন করা সত্ত্বেও তার চলায় কোনো শব্দ উৎপন্ন হচ্ছিল না।
গাঢ়তর হচ্ছিল তমসা। ঘন নীল অন্ধকার যেন গিলে খেতে চাইছিল তাদের। পর্নরাজিকে আবৃত করা অন্ধকার কুয়াশার আড়ালে যে রহস্য জালিকা বিস্তার করছিল তা কোন অবর্ণনীয় আতংক লুকিয়ে রেখেছে কে জানে!
এক মাইল পার করেছে তারা। ব্যালথাসের হাত দুটিতে মৃদু ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এমন সময় নীল থেকে ঘন কৃষ্ণনীলে পরিণত হওয়া তমিস্রা ভেদ করে এক সুতীব্র চিৎকার ভেসে এল।
কোনান সচকিত হয়ে থমকে দাঁড়াল। ব্যালথাস থরথর করে কেঁপে হাত থেকে ডুলির দণ্ড ফেলে দিচ্ছিল প্রায়।
“হে মিত্রা! এ তো মেয়ের গলার আওয়াজ।” সে কম্পিত কণ্ঠে বলল।
“কোনো বসতি স্থাপনকারীর বৌ বোধহয় একা জঙ্গলে বেরিয়েছিল।” নিজের প্রান্তের ডুলির অংশটা মাটিতে নামাতে নামাতে কোনান বলল। “হয়তো হারানো গরু খুঁজতে। এখানে দাঁড়াও…।”
কথাটা বলেই সে হিংস্র শিকারী নেকড়ের মতো ঝাঁপ দিল পত্রাবৃত অরণ্যে। ভীত ব্যালথাসের রক্ত যেন জমে যাচ্ছিল।
“এই মৃতদেহের সঙ্গে, পিশাচ ভরতি জঙ্গলের মাঝে?” সে কাঁদো কাঁদো স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “আমিও আসছি।” তারপর কোনানের পিছন পিছন দৌড় লাগাল। কোনান একবার পিছন ফিরে দেখল, কিন্তু কিছু বলল না। তবে তার তুলনামূলক ধীরগতির সঙ্গীটির জন্য গতিবেগও কমাল না। তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে প্রাণান্ত হচ্ছিল ব্যালথাসের। কোনান যেন এক দ্রুতগামী অশরীরী, যাকে ধরা অসম্ভব। এমন সময় তারা এক বনমধ্যস্থ ছোট্ট মাঠে পৌঁছাল। মাঠের প্রান্তে কোনান গুঁড়ি মেরে স্থির হয়ে গেল। ব্যালথাসও।
“থামলাম কেন আমরা?” ব্যালথাস এক হাতে তলোয়ার ধরে অপর হাতে চোখের ওপর ঝরে পড়া ঘাম মুছতে মুছতে বলল।
“চিৎকারটা! চিৎকারটা এখান থেকেই আসার কথা। যে কোন শব্দ কোথা থেকে হয়েছে তা আমি নির্ভুল ভাবে ধরতে পারি।” কোনান কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে জবাব দিল। “কিন্তু এখানে তো দেখছি…”
এমন সময় সেই আর্তনাদ আবার শোনা গেল। যে পথ তারা ফেলে এসেছিল, তার মাঝেই। এক ভয়ার্ত, আক্রান্ত নারীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর। তারপর সেই সেই কাতর চিৎকার হঠাৎ বদলে গেল এক পৈশাচিক খলখল হাসিতে। অগ্নিময় রৌরবের কোন দানবীয় আত্মা যেন মুক্তিলাভ করে বিদ্রুপ করে উঠল তাদের।
“হে মিত্রা, এ কী….” ব্যালথাসের মুখমন্ডল ভষ্মের মতো পান্ডুর হয়ে গিয়েছিল।
তীব্র কণ্ঠে দিব্যি গেলে লাফিয়ে উঠল কোনান। তারপর পিছন ফিরে জ্যা মুক্ত শরের মতো দৌড়তে শুরু করল। তার পিছনে মরিয়া ব্যালথাস। গুল্ম, বৃক্ষের শাখাপ্রশাখার ঝাপট খেতে খেতে দ্রুত বেগে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই সে লৌহ মূর্তির মতো স্থির হয়ে থাকা কোনানের সঙ্গে ধাক্কা খেল। সেই ধাক্কায় ব্যালথাস চাপা কাতর আর্তনাদ করে উঠলেও কোনানের কোনো বিকার হল না। সে হিসহিস করে তাকে কোনো শব্দ না করতে নির্দেশ দিল। তার বৃষস্কন্ধের উপর দিয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিল ব্যালথাস।
যা দেখল তাতে সেও বরফমূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বনপথে কিছু একটা নড়ছে। কিন্তু কী ওটা? সেটা হাঁটছেও না, উড়ছেও না, বরং যেন সরীসৃপের মতো পিছলে যাচ্ছে পথের ওপর দিয়ে। ওটা তো নাগ নয়। ওটার দেহাবয়ব কেমন অদ্ভুতভাবে অপরিস্ফুট। সেটা থেকে কেমন একটা আশ্চর্যজনক নারকীয় নীলচে আভা বেরিয়ে আসছে। তবু যতটুকু বোঝা যাচ্ছে ভয়ংকর মূর্তিটি না স্থূল, না শীর্ণকায়। মস্তকটি মাটি থেকে এক মানুষের চেয়ে বেশিই উচ্চতায় উঠে রয়েছে। ওই নীলাভ আলো ছাড়া সেটির সবকিছুই কেমন ধোঁয়াময় মনে হচ্ছে। যেন সেটি একটি নীলচে-সবুজ অগ্নিশিখা, আপন স্বার্থ পূরণের জন্য এই অরণ্যে আবির্ভূত হয়েছে।
ক্রুদ্ধ চাপা স্বরে ভগবানের দিব্যি গেলে কোনান তার খর্বাকার ধারাল কুঠারটি ছুড়ে মারল। কিন্তু তাতে সেই অপার্থিব পিশাচের ভ্রুক্ষেপমাত্র দেখা গেল না। কুঠার হারিয়ে গেল জঙ্গলের অন্ধকারে। আর সেই ভয়ানক আকৃতি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে, যেমন করে একটি দীর্ঘ ছায়া ভাসতে ভাসতে নিশীথের আঁধারে মিলিয়ে যায়, অরণ্য তমসায় উধাও হয়ে গেল। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে সেই বন্য পরিবেশ যেন শ্বাসরুদ্ধ, স্থির হয়ে রইল।
মুহূর্তেক পরে কোনান চমক ভেঙে মাতঙ্গের মতো পাতার দেওয়াল ভেদ করে পৌঁছাল যেখানে টিবেরিয়াসের মৃতদেহ শায়িত আছে। ব্যালথাস সেখানে পৌঁছে দেখল, সে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দেহ মুণ্ডহীন।
“জানোয়ারটা বেড়ালের মতো চেঁচিয়ে আমাদের ধোঁকা দিয়ে গেল।” রাগে দীর্ঘ তরোয়ালটা ঘোরাতে ঘোরাতে কোনান গরগর করে উঠল। “আমার বোঝা উচিত ছিল। এখন জ়োগারের পুজোর বেদিতে পাঁচটা মুণ্ডু থাকবে।”
“কিন্তু কী এটা? মেয়েদের মতো আর্তনাদ করে, প্রেতের মতো হাসে, সাপের মতো পিছলে যায়, গা থেকে অমন নীল আভা বের হয়—কী, কী এটা?”
“জলার পিশাচ।” কোনান নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে করতে বলল। “চলো, মৃতদেহের বাকি অংশটাই বয়ে নিয়ে যাই। মন্দের ভালো, ওজন কিছুটা কমল।”
এক আত্মমগ্ন দার্শনিকের মতো সে ডুলি তুলে নিঃশব্দে হাঁটতে শুরু করল।
গ্বাওয়েলার মায়াবী
টাস্কেলান দুর্গ কৃষ্ণা নদীর বাম কূলে অবস্থিত। নদীর জল সেটির বৃক্ষকাণ্ডে নির্মিত শক্তিশালী বহিঃপ্রাচীরের পাদদেশ ধুয়ে দিয়ে যায়। ভিতরের সব ভবনগুলি কাষ্ঠনির্মিত। এমনকী কেন্দ্রে অবস্থিত সবচেয়ে সুরক্ষিত ভবনটিও। সেখানেই থাকেন দুর্গপ্রধান। সেটি উচ্চতর ভূমিতে অবস্থিত বলে পাশের মজুদখানা পার করে দেখা যায় বিষণ্ণ নদীটিকে। নদীর অপর পাড়ে বিশাল, গভীর জঙ্গল। মহারণ্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। তার পাদদেশে, নদীতট ঢেকে রাখে শ্যামল মসের গালিচা। প্রাচীরের উপর অংশে নির্মিত নজরপথে দাঁড়িয়ে দিনে রাতে সেদিকে সতর্ক লক্ষ রাখে প্রহরীর দল। অরণ্যের সেই ঘন সবুজ আবরণ ভেদ করে কখনও সখনও দেখা মেলে দু-একটি ছায়ামূর্তির। কিন্তু দুর্গের সকলেই জানে তাদের ওপরেও নজর রাখা হচ্ছে নিরন্তর। আদিমতম ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে হিংস্র, ক্ষুধার্ত, ক্ষমাহীন চোখের সারি। অশিক্ষিত চোখে মনে হতেই পারে সেই অরণ্যপ্রান্ত প্রাণহীন, পরিত্যক্ত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই অন্ধকার পরদার আড়ালে লুকিয়ে আছে বন্য প্রাণীর দল। কেবলমাত্র পশু, পক্ষী বা সরীসৃপ নয়; হিংস্রতম জীব, মানুষও।
দুর্গটির সঙ্গে সঙ্গেই সভ্যতার শাসন সমাপ্ত হয়। এটি দোর্দণ্ডপ্রতাপ হাইবোরিয় জাতিটির জয়যাত্রার পশ্চিমতম নিদর্শন। নদীর অপর পারে আদিমতা আজও রাজত্ব করে। তমসাবৃত কান্তারে দেখা মেলে পর্ণকুটিরের, যার উঠানে বর্শার শীর্ষে গাঁথা মানব করোটিগুলি দন্ত বিকশিত করে হাসতে থাকে; মৃত্তিকানির্মিত প্রাচীরের আড়ালে বাজতে থাকে দামামা, জ্বলতে থাকে আগুন, শানিত ভল্ল হাতে নৃত্যরত ছায়ামানুষেরা ঘৃণায় ভরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে নদীর অপর পাড়ের দুর্গের দিকে। তারা জটাজুটধারী। তাদের চোখ সাপের মতো। কৃষ্ণা নদীর ওপারে, আজ যেখানে টাস্কেলান দুর্গ দাঁড়িয়ে আছে, একসময় সেখানেই তাদের বসতি ছিল। এখন যেখানে সোনালি চুলের মানুষদের ঘরদোর আর চাষ আবাদ, একসময় সেটা ছিল তাদের বিচরণভূমি। অতীতে, অশান্ত বজ্র নদীর তীরে, নবীন, অনভিজ্ঞ ভেলিট্রিয়াম শহরই ছিল বসোনিয় রাজত্বের সীমানা। তারপর একদিন বণিকেরা আসতে শুরু করল। তাদের পিছন পিছন মিত্রার নাম উচ্চারণ করতে করতে, বাহু প্রসারিত করে, নগ্ন পদে, আসতে লাগল ধর্মপ্রচারকেরা। তাদের অধিকাংশকেই হত্যা করা হল। তাই এরপরে এল সৈন্যদল। তাদের সঙ্গে এল কুঠার হাতে পুরুষ আর গো-শকটে করে নারী ও শিশুর সারি। বজ্র নদীর পশ্চিম পাড় থেকে কৃষ্ণা নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত, যা ছিল আদিবাসীদের মাতৃভূমি, দখল করল তারা। বনচরদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে, হত্যালীলা চালিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হল কৃষ্ণা নদীর অপর পাড়ে। কিন্তু কৃষ্ণকায় মানুষেরা কখনও ভুলল না যে কোনাজোহারা একসময় তাদেরই ছিল।
টাস্কেলান দুর্গের পূর্ব দ্বারের প্রধান দ্বারপাল খুবই মুশকিলে পড়ে গেল। দরজার ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে তার দুটি কুতকুতে চোখ দেখা যাচ্ছিল। তার হাতের মশালের আলো বাহিরের পথকে যেন আরও ছায়াময়, অবোধ্য করে তুলেছিল। দ্বারের বাইরের অঞ্চলকে আলোকিত করার পরিবর্তে তা বরং বেশি প্রতিফলিত হচ্ছিল তার উজ্জ্বল শিরস্ত্রাণে। মধ্যরাত্রি না হলেও সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কয়েক দণ্ড। এমন সময় কেউ দুর্গে ঢুকতে চাইলে তাকে অনুমতি দেওয়া উচিত কার্য হবে কিনা সেটি যথেষ্ট বিতর্কের বিষয়।
“দরজা খোল বলছি।” কোনান রাগে চেঁচিয়ে উঠল। “অন্ধ হয়ে গেছ নাকি? আমাকে চিনতে পারছ না?”
তার মুখে বেশ কয়েকটি বাছা বাছা গালি এসে গিয়েছিল। কিন্তু সৈনিকের শৃঙখলা রক্ষার কারণে সে সেগুলি আর উচ্চারণ করল না।
দ্বারের ভারী পাল্লা পিছে হঠল। কোনান ও তার সঙ্গী প্রবেশ করল কেল্লায়। ব্যালথাস দেখল সেই দ্বারের দু-ধারে দুটি নাতিউচ্চ মিনার। তার গায়ে অসংখ্য ছিদ্র। তিরন্দাজদের শর নিক্ষেপের ব্যবস্থাপনা। তারা দুজনে যে বোঝা বহন করে এনেছিল তা দেখে অন্যান্য দৌবারিক ও রক্ষীরা আতংকিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। দরজা বন্ধ করতে না করতে তারা ঠেলাঠেলি করে একে অপরের পিছন থেকে সেটিকে আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করছিল।
“জম্মে মুণ্ডুহীন মরা দেখনি মনে হচ্ছে, অ্যাঁ?” কোনান খেঁকিয়ে উঠল।
মশালের আলোতেই দেখা গেল রক্ষীদের মুখ ধূসর হয়ে গিয়েছে।
“ওটা টিবেরিয়াস। ওর লোমের টিউনিক দেখেই চিনেছি।” একজন রক্ষী বলে উঠল। “ভ্যালেরিয়াসের থেকে আমি পাঁচ লুনা পাবো। হতভাগাটা যখনই মরা মাছের মতো চোখ নিয়ে, কারো বারণ না শুনে, খচ্চরে চড়ে বেরিয়ে গেল, তখনই আমি ওর সঙ্গে বাজি ধরেছিলাম, এবার ওর মুণ্ডুহীন মৃতদেহটা পাওয়া যাবে। ওকে নিশিতে ডেকেছিল।”
কোনান রাগে গজগজ করে উঠল। বোঝা নামিয়ে রাখতে ব্যালথাসকে সাহায্য করল সে। তারপর তাকে নিয়ে রওনা দিল দুর্গপ্রধানের সঙ্গে দেখা করার জন্য।
যুবক অ্যাকুইলোনিয়টি প্রথমবার এই দুর্গে প্রবেশ করল। তাই সে চলতে চলতে অবাক চোখে দেখতে লাগল সৈন্যদের স্কন্ধাবার, অশ্বশালা, বণিকদের সার দেওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিপনি, কাষ্ঠনির্মিত সুউচ্চ দুর্গের বিভিন্ন অংশ, অন্যান্য ভবনসমূহ, এবং দুর্গের অভ্যন্তরে প্রশস্ত চতুর্ভুজাকৃতি প্রাঙ্গনটিকে। সেই প্রাঙ্গনে প্রতিদিন সকালে সৈন্যদের কুচকাওয়াজ হয়, আর সন্ধ্যায় দুর্গবাসীরা মশালের আলোয় বিশ্রম্ভালাপে মগ্ন থাকে। দেখা গেল কোনানেরা যে বস্তুটি বহন করে এনেছে তার সংবাদ সেখানে পৌঁছে গেছে। উপস্থিত সকলেই সেটিকে দর্শনের অভিলাষে দ্রুতপদে পূর্ব দেউড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। দীর্ঘকায় অ্যাকুইলোনিয় ভল্লধারী ও সংবাদবাহকদের সঙ্গে পা মিলিয়েছে খর্বাকার বলিষ্ঠ বসোনিয় তিরন্দাজেরা। এর ফলে চত্ত্বরকুট্টিমে মশালের আলো ও দীর্ঘ ছায়ার বিচিত্র কাটাকুটি সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।
ব্যালথাস বিশেষ আশ্চর্য হল না যখন দুর্গপ্রধান স্বয়ং তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। বুদ্ধিমানেরা অভিজাত শ্রেণির অহংকার মূল সাম্রাজ্যের সীমার মধ্যেই ফেলে আসেন। ভ্যালানাস অল্পবয়েসি। তার নাক মুখ ধারাল, চোখ বুদ্ধিদীপ্ত। দায়িত্ব, পরিশ্রম এবং অল্পদিনের অভিজ্ঞতাই তার অবয়বে সংযত গাম্ভীর্যের ছাপ ফেলেছে।
“শুনলাম তুমি ভোর হওয়ার আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলে।” তিনি কোনানকে বললেন। “আমি তো ভয়ই পাচ্ছিলাম এবার পিক্টেরা তোমাকে বন্দি করেছে ভেবে।”
“ওরা যখন আমার মুণ্ডুটাকে বর্শায় গাঁথবে তখন গোটা নদীর আশপাশ সেটা টের পাবে।” কোনানের গলায় বিদ্রুপের সুর শোনা গেল। “ভেলিট্রিয়াম অবধি পিক্ট মেয়েদের হাহাকার শোনা যাবে তাদের মৃত পুরুষদের জন্য। আমি একটা একলা চরের পিছনে ধাওয়া করেছিলাম। গোটা রাত আমি শুতে পারিনি। ওদের দামামাগুলো কথা বলছিল।”
“ওগুলো তো প্রতি রাতেই বাজে।” দুর্গপ্রধান বললেন। তারপর কোনানের দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখে আশংকার ছায়া ঘনাল। অভিজ্ঞতা তাঁকে এক বর্বরের জন্মগত অনুমান ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে।
“কালকের বাজনা অন্যরকম ছিল।” কোনান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল। “জ়োগার স্যাগ পালানোর পর থেকে প্রতিদিনের বাজনা ধীরে ধীরে পালটেছে।”
“আমাদের হয় ওকে উপহার দিয়ে ফেরত পাঠানো উচিত ছিল, নয়তো ফাঁসি দেওয়া উচিত ছিল।” দুর্গপ্রধান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। “তুমি তাই বলেছিলে। কিন্তু…”
“কিন্তু তোমাদের মতো সভ্য হাইবোরিয়দের পক্ষে বহির্বাসীদের নিয়মকানুন মেনে নেওয়া খুব কঠিন।” কোনান বলল। “যাকগে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। যদ্দিন জ়োগার বেঁচে আছে তদ্দিন ও বন্দিদশার খাঁচাটার কথা মনে রাখবে। ফলে এখন শান্তি স্থাপনের চেষ্টা বৃথা। আমি একটা পিক্টের পিছু নিয়েছিলাম। বজ্জাতটা ভেবেছিল এখানের কয়েকটা লোককে চাঁদমারি বানাতে পারবে। ওকে খতম করার সময় আমার এর সঙ্গে দেখা হয়। এ ব্যালথাস। ভালো ছেলে। ট্যরান থেকে এসেছে যদি আমাদের উপনিবেশের কোনো কাজে লাগতে পারে।”
ভ্যালানাস যুবকটির শক্তিশালী চেহারা আর অকপট মুখচ্ছবির দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে চাইলেন।
“স্বাগতম মহাশয়। আমি আশা করব আরও বেশি করে আপনাদের মতো তরুণ রক্ত এখানে আসবেন। এখানের বন্য জীবনে আমাদের আরও মানুষের প্রয়োজন। আমাদের বহু সৈনিক আর বসবাসকারী সুদূর পুব থেকে এসেছে। ওরা ঠিকমতো না জানে চাষবাস, না জানে শিকারের কাজ।”
“পছন্দের লোক ভেলিট্রিয়ামের এপারে এখন পাওয়া খুব কঠিন।” গজগজ করল কোনান। “শহর ছেড়ে কেউ আসতেই চায় না। আরেকটা কথা, আমরা টিবেরিয়াসকে পথের মাঝে মৃত অবস্থায় পেয়েছি।” মূল প্রসঙ্গে ফিরতে চাইল সে।
“আমি জানতামই না উনি দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। পাগল হয়ে গিয়েছিলেন নাকি?” বিমর্ষ মুখে ভ্যালানাস বললেন।
“হ্যাঁ, হয়েছিল। অন্য চারজনের মতোই।” কোনান গম্ভীর মুখে বলল। “যখন ওদের সময় ঘনিয়েছিল, ওরা সব ছেড়ে মৃত্যুর মুখে গিয়ে পড়েছিল। যেমন খরগোশ ছুটে গিয়ে অজগরের মুখে পড়ে। জঙ্গলের গভীর থেকে কিছু একটা ওদের ডেকেছিল। লোকে বুঝতে না পেরে বলে নিশির ডাক। সে ডাক কেবল হতভাগ্যরাই শুনতে পায়। জ়োগার স্যাগ এমন কোনো জাদুর সাহায্য নিয়েছে যা আটকানোর ক্ষমতা অ্যাকুলোনিয় সভ্যতার নেই।”
ভ্যালানাস কোনো প্রতিবাদ করলেন না। কম্পিত হস্তে ললাটের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “রক্ষীরা জানে?”
“পুব দেউড়িতে মৃতদেহটা রেখে এসেছি আমরা।”
“উচিত হয়নি। তোমরা মৃতদেহটা বনেই লুকিয়ে রাখতে পারতে। সৈন্যেরা এর মধ্যেই যথেষ্ট ভয় পেয়ে আছে।”
“কোনো না কোনো উপায়ে ওরা এটা জানতে পারতই। আমরা যদি ওটাকে না এনে জঙ্গলে ফেলে আসতাম, তবে সোরাকটাসের মৃতদেহ যেমন ফিরেছিল তেমনই টিবেরিয়াসেরটাও আসত। কাল সকালেই দেখা যেত সেটা দুর্গের দরজার বাইরে বাঁধা রয়েছে।”
ভ্যালানাস শিউরে উঠলেন। ঘুরে, একটি গবাক্ষ দিয়ে উদাসী দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন নক্ষত্রপূর্ণ আকাশের নীচে প্রবাহিত ঝিলমিলে কাজলকালো নদীর দিকে। নদীর অপর পাড়ে তমসাবৃত অরণ্য এক আবলুস বর্ণের প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বহুদূর থেকে ভেসে আসা এক প্যান্থারের হুংকার রাত্রির নিস্তব্ধতা চিরে দিল। অন্ধকার যেন বাইরের রক্ষীদের কথপোকথনের শব্দ, অস্ত্রের ধাতব আওয়াজ শুষে নিয়ে, মশালের আলোকে স্তিমিত করে থাবা বাড়াচ্ছিল সর্বত্র। প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণবর্ণ বৃক্ষের শাখাপ্রশাখার ফাঁকে ফিসফিসিয়ে বয়ে গেল অচেনা বাতাস। ঢেউ তুলল নদীর কালো জলে। তার ডানায় ভর করে ভেসে এল এক অদ্ভুত বায়ুর কম্পন। শিকারী চিতার থাবার মতোই নিঃশব্দে।
“মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ভ্যালানাস। তিনি যেন নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলছিলেন। “অরণ্যের আড়ালে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে তা আমরা কেন, কেউই বলতে পারে না। গুজব শুনি সেখানে নাকি অনেক বিশাল বিশাল জলাভূমি আর নদী রয়েছে। এই গহন অরণ্য নাকি সীমাহীন সমভূমি আর পর্বতশ্রেণী পার করে পশ্চিম সাগরের উপকূলে গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু বনের মাঝে, নদীর উপত্যকায় কোন ভয়াল আতংকরা বাস করে তা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। কোনো সভ্য মানুষ এই জঙ্গলের গভীরে গিয়ে বেঁচে ফিরতে পারেনি। আমরা যতই সভ্য হই না কেন, আমাদের জ্ঞান ওই কৃষ্ণা নদীর তির অবধি গিয়েই থেমে যায়। কে জানে সভ্যতার আলোর বাইরে কোন পার্থিব বা অপার্থিব সত্তা বাস করে?
“কেউ সঠিক জানে না ওই বর্বর জঙ্গলে কোন দেবতা পূজিত হন, কিম্বা কোন শয়তান সেখানের জলাভূমির পাঁক থেকে উঠে আসে। কে বলতে পারে ওই আঁধার ছাওয়া দেশের সব অধিবাসীরা আদৌ ইহজগতের কিনা? জ়োগার স্যাগকে দেখে তো পুবের শহরের জাদুকরেরা নাক সিঁটকোবে। বলবে একটা গরীব বুনো ফকির ছাড়া সে কেউ নয়। সেই কিনা তার আদিম জাদু দিয়ে আমাদের পাঁচজনকে পাগল বানিয়ে খুন করে ফেলল! আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সেও আসলে মানুষ, নাকি অন্য কিছু?”
“আমি যদি ওকে কখনও কুঠার ছুড়ে মারার নাগালের মধ্যে পাই, ওই প্রশ্নের জবাব ঠিক বের করে ফেলব।” কোনান বলল। ইতিমধ্যে সে নিজে একটা আসবপাত্র হাতে তুলে নিয়ে আরেকটা বাড়িয়ে ধরেছে ব্যালথাসের দিকে। ব্যালথাস দুর্গপ্রধানের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে ইতস্তত করে সেটা নিল।
ভ্যালানাস এবার কোনানের দিকে ফিরে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দৃষ্টিপাত করলেন।
“যে সৈন্যরা ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না তারা ভয়ে মরছে।” তিনি বললেন। “অথচ দেখ, তুমি রাক্ষস, খোক্কস, ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানো সবকিছু বিশ্বাস করো, কিন্তু ভয় পাচ্ছ না। কীভাবে?”
“দৈত্য দানোর সঙ্গে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে ধারাল ইস্পাত বধ করতে পারে না এমন কিছু এই পৃথিবীতে নেই।” কোনান বলল। “আমি পিশাচটার দিকে কুঠার ছুড়ে মারলাম, অথচ ওটার কিছুই হল না। হতেই পারে আমি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলাম। কিম্বা গাছের ডালে লেগে ওটা অন্য কোথাও ছিটকে গেছে। আমি বনের মধ্যে পিশাচ খুঁজতে বের হবো না। কিন্তু সেরকম কিছু যদি আমার পথে এসে দাঁড়ায়, আমি তাকে ছেড়ে কথা বলব না।”
ভ্যালানাস এবার স্থির দৃষ্টিতে কোনানের চোখের দিকে চাইলেন। বললেন, “কোনান, তুমি যা ভাবছ তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু তোমার ওপর নির্ভর করছে। তুমি জানো এই বন্য প্রদেশের দূর্বলতা কী, কীভাবে এখানের সবাই এই দুর্গের উপর নির্ভর করে আছে। আমার ধারণা যারা এই সীমান্ত রক্ষা করছে, তারা অসফল হলে ঝড়ের চেয়েও দ্রুতগতিতে শত্রুরা এখানের সব সাধারণ মানুষকে তো হত্যা করবেই, এমনকী তারা ভেলিট্রিয়ামের ওপরেও আছড়ে পড়বে। এই কথাটাই মহারাজ আর তার পারিষদবর্গ বুঝতে চাইছেন না। তাঁরা এই অঞ্চলের পিছনে আর কোনো অর্থব্যয় করতে রাজি নন। এমনকী কোনাজোহারা জয় করার পর অধিকাংশ সৈন্যদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
“এর মধ্যে ওই শয়তান জ়োগার স্যাগ আমাদের জলের উৎসটা বিষাক্ত করে দেওয়ার ফলে সেই জল খেয়ে চল্লিশজন সৈনিক মারা গেছে। অসুস্থ বহু। এর সঙ্গে যোগ করো সাপে কাটা, বন্য জন্তুর আক্রমণের ফলে মৃত মানুষদের। এই সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়ছে। গুজব ছড়াচ্ছে ওই ডাকিনীবিদ্যাধারীটাই এসব বুনো জন্তুদের নিয়ন্ত্রণ করছে।
“আমার হাতে এখন মাত্র তিনশো ভল্লধারী, চারশো বসোনিয় ধনুর্ধর আর পঞ্চাশ জন ধুরন্ধর শিকারী অরণ্যযোদ্ধা আছে। প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তোমার মতো এই শিকারীরা হয়তো খুবই কার্যকরী, কিন্তু তাদের পক্ষেও এই বিপজ্জনক বন্য প্রদেশের দেখভাল করা অসম্ভব। ফলে ভয় জড়িয়ে ধরছে সবাইকে। এর সঙ্গে শয়তান জাদুকরটা যে কালো প্লেগ ছড়ানোর ভয় দেখিয়েছিল, তার দুঃস্বপ্নে কাঁপছে সবাই। তার হুমকি যদি সবাই ফলবেই ভেবে নেয়, এই প্লেগের ভয়ে সবাই পালাতে শুরু করে, তবে দুর্গরক্ষা হবে কী করে?
“তাই কোনাজোহারাকে বাঁচাতে জ়োগার স্যাগকে মারতে হবে কোনান। যাবে তুমি তাকে মারতে? একমাত্র তুমিই অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি অজানা প্রদেশে ঘুরেছ। তোমার পক্ষেই নদী পার করে গ্বাওয়েলাতে গিয়ে তাকে বন্দি করা বা মারা সম্ভব। গেলে দেরি করা যাবে না। সম্ভব হলে আজ রাতেই রওনা দেওয়া ভালো। আমি জানি আমি অপ্রকৃতিস্থর মতো কথা বলছি, তবু যদি যাও, যত খুশি সৈন্য তুমি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো। তোমার পক্ষেই আমাদের পরিত্রাতা হওয়া সম্ভব।”
“গাদাগুচ্ছের সৈন্য নিয়ে যাওয়ার চেয়ে জনা দশ-বারো বাছাই করা লোক নিয়ে যাওয়া ভালো।” কোনান খানিক ভেবে বলল। “পাঁচশো সৈন্য নিয়ে গিয়ে গ্বাওয়েলা আক্রমণ করে সফল হওয়া অসম্ভব। বরং দশ-বারো জন মিলে চুপিসারে গিয়ে কাজ হাসিল করা যেতে পারে। আমি আমার পছন্দের লোকেদের বেছে নিতে চাই।”
“আমায় নিয়ে চলো।” ব্যালথাস বলে উঠল। “আমি ট্যরানে বহু বছর ধরে হরিণ শিকার করছি।”
“আচ্ছা, সে দেখা যাবে। ভ্যালানাস, আমি এখন অরণ্যযোদ্ধাদের খাওয়ার ঘরে যাবো। সেখানেই আমি সঙ্গী বেছে নেব। আজ রাতের অন্ধকারেই রওনা দেব। তুমি কৃষ্ণার ঘাটে একটা নৌকার ব্যবস্থা করো। আমরা সেটা করেই ওপারে গিয়ে গ্বাওয়েলাতে পৌঁছানোর চেষ্টা করব। যদি বেঁচে থাকি, কাল দিনের আলো মেলানোর আগেই ফিরে আসব।”
নিশাচরের দল
মেহগিনি বর্ণের দুই বন্য প্রাচীরের মাঝে অস্পষ্ট নদীটি প্রবহমানা। পূর্ব তীরের ছায়ার মধ্যে দিয়ে কুম্ভীরের মতো দীর্ঘ নৌকাটি নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল। সারসের ঠোঁট যেমন নিঃশব্দে জলে ডুব দেয়, সেটির দাঁড়গুলিও তেমনই শব্দ না করে জলে পড়ছিল। ব্যালথাসের সামনে উপবিষ্ট শক্তিশালী মানুষগুলির চওড়া কাঁধও এই অন্ধকারে আবছা লাগছিল। সে জানত নৌকার একেবারে সম্মুখে বসে থাকা মানুষটিও তারই মতো কয়েক ফুট দূরে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কোনান বন্য প্রবৃত্তি আর নদীটির সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান কাজে লাগিয়ে অঙ্গুলি সংকেতে এগোনোর নির্দেশ দিচ্ছিল।
কেউ বাক্যালাপ করছিল না। ব্যালথাস দুর্গ থেকে বেরিয়ে নদীতীরে অপেক্ষারত ক্যানোটিতে ওঠার আগেই তার সঙ্গীদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। এরা সভ্য ও অসভ্য জগতের সীমারেখায় বেড়ে ওঠা এক নতুন প্রজাতি, যারা জীবনের প্রয়োজনে দক্ষ শিকারীতে পরিণত হয়েছে। অ্যাকুলোনিয়ার পশ্চিম প্রান্তের অধিবাসীদের সঙ্গে এদের অনেক মিল। তারা একই রকম পোশাক পরে। পুরুষ মৃগত্বকের জুতা, চামড়ার লেঙ্গুটি জাতীয় খাটো নিম্নাঙ্গের পোশাক, অজিন নির্মিত উর্ধ্বাঙ্গ আবরণী। কোমরে চওড়া কটিবন্ধ। সেটি থেকে ঝুলছে একাধিক কুঠার ও খাটো তলোয়ার। তারা প্রত্যেকে মেদহীন, বলিষ্ঠ, স্বল্পভাষী, ক্ষতচিহ্ন রেখাঙ্কিত, কঠিন চক্ষু বিশিষ্ট।
তাদের কিছুটা বন্য বলা চলে। কিন্তু তবু তাদের আর কোনানের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ। তারা সভ্যতার পুত্র, যাদের বন্য জীবনে অভ্যস্ত হতে হয়েছে। কিন্তু কোনানের ধমনীতে বইছে হাজার প্রজন্মের বন্য, বর্বর রক্ত। তারা নিঃশব্দচারণ ও বন্যপ্রাণীর ধূর্ততা আয়ত্ত করেছে। কোনানের সেগুলি সহজাত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার পরিশীলিত ক্ষিপ্র অঙ্গসঞ্চালন। তারা যদি নেকড়ে হয়, সে হিংস্র ব্যাঘ্র।
ব্যালথাসের মনে তার সহযোদ্ধাদের এবং তার নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জাগরিত হয়েছিল। সে তাদের সঙ্গী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে বলে মনে মনে গর্ব অনুভব করছিল। তার ব্যবহৃত দাঁড়টিও তাদেরগুলির মতো কোনো শব্দ করছিল না। অন্তত এ ক্ষেত্রে সে তাদের সমকক্ষ হতে পেরেছে। যদিও সে জানে ট্যরানে পাওয়া শিকারের শিক্ষা নিয়ে সে কখনোই সর্বক্ষেত্রে এই সভ্যতাপ্রান্তে বিচরণকারী শিকারীদের সমকক্ষ হতে পারবে না।
দুর্গ থেকে কিছু দূরেই নদীটি একটি তীব্র বাঁক নিয়েছে। সেটি পার হতেই শেষ চৌকির আলোগুলো হারিয়ে গেল। কিন্তু তার পরেও ক্যানোটি অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যে ভেসে আসা কাঠের গুঁড়ি বা অন্যান্য অপ্রত্যাশিত বাধায় ধাক্কা না খেয়ে আরও মাইলখানেক পার করল।
তাদের নেতার কাছ থেকে নিঃশব্দ নির্দেশ পেয়ে অরণ্যযোদ্ধারা নদীর অপর পাড়ে তরী ভেড়ানোর জন্য সেটির মুখ ঘোরালো। তীরভূমিস্থ বৃক্ষরাজির ছায়ার আড়াল থেকে সুরক্ষাহীন নদীবক্ষে বের হলেই হৃদয়ে ত্রাসের সঞ্চার হয়। তবে ব্যালথাস জানত, আগে থেকে খবর পেয়ে খুব খেয়াল না করলে, নক্ষত্রপুঞ্জের ম্লান আলোয় তাদের এই নৌকাটিকে কেউ দেখতেই পাবে না। অপর পাড়ে পৌঁছানোর পর একটি বিশাল বৃক্ষের নীচে নৌকা ভেড়াল তারা। ব্যালথাস হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে সেটির একটি শাখাকে ধরে নৌকা স্থির রাখল। কেউ কোনো কথা বলল না। দুর্গ থেকে বের হওয়ার আগেই প্রতিটি পদক্ষেপ নির্দিষ্ট করে রাখা ছিল। কালো চিতার মতো নৌকা থেকে নেমে কোনান জঙ্গলের আঁধারে হারিয়ে গেল। তার মতোই নিঃশব্দে, সন্তর্পনে তাকে অনুসরণ করল বাকি নয় জন। ব্যালথাস অবাক বিস্ময়ে শাখাটিকে জড়িয়ে ধরে, পায়ের সাহায্যে দাঁড়গুলিকে স্থির রেখে দেখল কী করে দশটি মানুষ কোনো শব্দ না করে এমন গহন জঙ্গলে মিলিয়ে যেতে পারে!
এবার তাকে অপেক্ষা করতে হবে। উত্তর-পশ্চিমে, এক মাইলের মধ্যেই জ়োগার স্যাগের কাঠের প্রাকার ঘেরা গ্রাম অবস্থিত। তার সঙ্গে নৌকার পশ্চাদভাগে আরেকজন দাঁড়ি বসে ছিল। কোনো কথা উচ্চারিত হল না। তারা জানত যে, যদি ঊষার প্রথম আলোকস্পর্শের আগে কোনানরা ফিরে না আসে, সঙ্গে সঙ্গে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে প্রাণপণে দাঁড় বেয়ে দুর্গের ঘাটে পৌঁছাতে হবে। খবর দিতে হবে যে আদিম অরণ্য আবার তার আক্রমণকারীদের গ্রাস করে নিয়েছে।
নৈঃশব্দ্য গলা টিপে ধরতে আসছিল। জমাট আঁধার আর ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালার ওপার থেকে কোনো শব্দ আসছিল না। দামামার আওয়াজও থেমে গিয়েছিল ঘণ্টা খানেক আগেই। ঘন আঁধার চিরে দেখার চেষ্টায় সে চোখ পিটপিট করছিল বারবার। তিমির রাত্রি ও অভিশপ্ত নদীর গন্ধ তাকে বিষণ্ণ করে তুলছিল। মনে হল কাছেই কোথাও একটা বড়ো মাছ ঘাই মারল। এত কাছে যে ক্যানোটি দুলে উঠল। তারপর সেটির পিছন অংশটি ধীরে ধীরে নদীর পাড় থেকে সরে যেতে লাগল। নিশ্চয়ই হালের কাছে বসে থাকা লোকটি নদীতীরের গাছের শাখাটি তার মতো ধরে নেই। ব্যালথাস মাথা ঘুরিয়ে তাকে সাবধান করার জন্য চাপা হিসহিসে শব্দ করে উঠল। মাথা ঘুরিয়ে সে দেখল তার সঙ্গী নৌকার পিছনে জমাট অন্ধকারের মতো বসে আছে।
সাবধানবাণীতে কোনো ফল হল না। লোকটি কোনো জবাবও দিল না। অবাক হল ব্যালথাস। ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? গুঁড়ি মেরে সঙ্গীর কাছে পৌঁছে তার কাঁধের ওপর হাত রাখল সে। সঙ্গে সঙ্গেই তার সঙ্গী একতাল নরম কাদামাটির মতো ল্যাতপেতিয়ে কাত হয়ে নৌকা থেকে পড়ে যাচ্ছিল। তাকে কোনোক্রমে ধরে পতন রোধ করল ব্যালথাস, তারপর শুইয়ে দিল ক্যানোর ওপর। তার হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে ধকধক করছিল যেন সেটা ফেটে বেরিয়ে আসবে। সে কাঁপা কাঁপা আঙুলে সঙ্গীর গলায় হাত রাখল। এক যুবকোচিত প্রবল আত্মনিয়ন্ত্রণই তার মুখ থেকে ভয়ার্ত চিৎকারটা বেরতে দিল না। তার আঙুল একটা রক্তাক্ত ক্ষতস্থান স্পর্শ করেছে। সেখান থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। অঙ্গুলিস্পর্শে সে বুঝতে পারল তার সঙ্গীর কণ্ঠদেশের ক্ষত কতটা সুগভীর ও সুদীর্ঘ।
সেই ভয়াবহ আতঙ্কের মুহূর্তে ব্যালথাস এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসতে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জমাট আঁধার থেকে একটা শক্তিশালী হাত বেরিয়ে এসে তার গলাটা এমনভাবে জড়িয়ে ধরল যে তার মুখ দিয়ে কোনো আর্তনাদ বের হতে পারল না। ধস্তাধস্তিতে ক্যানোটা ভয়ংকরভাবে দোল খেতে লাগল। ব্যালথাসের মনে নেই কোন প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সে জুতো থেকে তার ছুরিটা বের করে এনেছিল। অন্ধকারে পাগলের মতো সেটা দিয়ে পিছনের দিকে এলোপাথাড়ি আঘাত করার চেষ্টা করছিল সে। সৌভাগ্যক্রমে একটা আঘাতে ছুরিটা কোথাও আমূল গেঁথে গেল। তৎক্ষণাৎ তার কানের কাছে বীভৎস পৈশাচিক চিৎকার করে উঠল কেউ, আর সেই হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। কিন্তু এতে তার চারপাশের আঁধার যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। তুমুল পাশব কোলাহলে ভরে গেল চারদিক, আর কাজল কালো অন্ধকার অসংখ্য হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। অনেকগুলো মানবদেহ ব্যালথাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ফলে ক্যানোটা উলটে গেল। সেটার সঙ্গে তলিয়ে যাওয়ার আগেই ব্যালথাসের মাথায় সজোরে আঘাত করল কেউ। প্রবল আঘাতে তার চোখের সামনে যেন নরকের আগুন জ্বলে উঠল। তারপর সব অন্ধকার। সে আঁধারে নক্ষত্রের মিটমিটে আলোও দেখা যায় না।
জ়োগার স্যাগের জন্তু
জ্ঞান ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিশিখার প্রখরতা ব্যালথাসের চোখ আবার ঝলসে দিল। পিটপিট করতে করতে মাথা ঝাঁকাল সে। সে ঔজ্জ্বল্য তার চোখকে পীড়া দিচ্ছিল। নানারকম বিমিশ্রিত শব্দ তার চেতনাকে বিভ্রান্ত করছিল। ধীরে ধীরে সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই শব্দ বাড়তে লাগল। মুখ তুলে এক বেকুবের মতো সে বোঝার চেষ্টা করল চারদিকে কী হচ্ছে। কিছু দূরে দাউদাউ করে জ্বলন্ত আগুনকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিদের ওপর নজর পড়ল তার।
তারপর স্মৃতি ও বোধশক্তি অতি দ্রুত তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে এক মুক্ত প্রাঙ্গনে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে বৃত্তাকারে ঘিরে রয়েছে একদল বীভৎস দর্শন, হিংস্র মানুষ। কিছুটা দূরে তাদের ঘিরে আরেকটি বৃত্ত। সে বৃত্ত লেলিহান অগ্নিশিখার। সেই পাবককে পরিচর্যা করছে কৃষ্ণাঙ্গী নগ্ন নারীর দল। তার ওপারে দেখা যাচ্ছে কুটিরের সারি। তৃণ, কর্দম, কাষ্ঠনির্মিত নেহাতই অসংস্কৃত পর্ণকুটিরগুলো জড়ামড়ি করে রয়েছে। সেটি পার করে দেখা যাচ্ছে বৃক্ষকাণ্ড নির্মিত প্রাকার।
কিন্তু এসব কিছুই ব্যালথাসের দৃষ্টি সেভাবে আকর্ষিত করল না। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল তার দিকে জ্বলন্ত চক্ষে তাকিয়ে থাকা পুরুষগুলোর দিকে। প্রশস্ত বক্ষ ও স্কন্ধ, ক্ষীণ কটি বিশিষ্ট খর্বাকার মানুষগুলির পরনে কেবলমাত্র পশুচর্মের লেঙ্গুটি। অগ্নিপ্রভা তাদের স্ফুরিত পেশি ও শক্তিশালী দেহাবয়ব থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে। তাদের মুখ ছায়াবৃত কিন্তু চোখ থেকে শিকারী বাঘের হিংস্রতা ঝরে পড়ছে। তাদের জটাজুট পিছন দিকে টেনে তামার তার দিয়ে বাঁধা। তাদের হাতে ধরা রয়েছে তরবারি ও কুঠার। কারো কারো ক্ষতস্থানে অপটু হাতে পটি বাঁধা হয়েছে। অনেকের শরীরে এখানে সেখানে রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে রয়েছে। যুদ্ধ হয়েছিল। কিছুক্ষণ আগেই। খুব নির্মম, হিংস্র যুদ্ধ।
তার নজর এবার বন্য অবরুদ্ধকারীদের থেকে খানিক দূরে গিয়ে পড়ল। সে যা দেখল তাতে তার মুখ দিয়ে এক ভয়ার্ত আর্তনাদ বেরিয়ে আসছিল। কোনোক্রমে নিজেকে সামলালো সে। তার থেকে কয়েক ফুট দূরে একটা ছোটোখাটো পিরামিড। রক্তাক্ত মানুষের মাথার। তাদের বেশির ভাগের চোখই কাজল কালো আকাশের দিকে অভিব্যক্তিহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কয়েকটা তার দিকে ফেরানো মাথাকে সে অস্পষ্টভাবে চিনতে পারল। কোনানকে জঙ্গলের মধ্যে অনুসরণ করেছিল যারা, এ মুণ্ড তাদের। সে ঠিক বুঝতে পারল না ওই স্তূপের মধ্যে সিমেরিয়টির মাথাও আছে কিনা। তার মনে হল ওখানে দশ-এগারোটা রক্তাক্ত মুণ্ড তো আছেই। সে অসুস্থ বোধ করতে লাগল। একইসঙ্গে তার কান্না পাচ্ছিল আর গা গুলিয়ে উঠেছিল। এমন সময় মাটিতে শোয়ানো বেশ কয়েকটা পিক্টের মৃতদেহের দিকে নজর গেল তার। আধ ডজনের বেশিই হবে। তার সঙ্গীরা বিদায় নেওয়ার আগে ভালো মতো বেগ দিয়ে গেছে। সে মনে মনে উল্লসিত হল।
সেই বিকট, বীভৎস দৃশ্য থেকে চোখ ফেরালে সে দেখল পাশেই আরেকটি কালো রঙের কাঠের থামে একজন মানুষকে তার মতো বেঁধে রাখা হয়েছে। চামড়ার নিম্নাঙ্গ আবরণী ছাড়া তার শরীরে আর কোন পোশাক নেই। সর্বাঙ্গে আঘাতের দাগ। মুখের কশ বেয়ে নেমে আসছে রক্তধারা। কোনোক্রমে মাথা তুলে জিব দিয়ে ঠোঁটের রক্ত চাটতে চাটতে লোকটি বিড়বিড় করে উঠল। পামরদের চিৎকার কোনোক্রমে পার করে কথাগুলো ব্যালথাসের কানে প্রবেশ করল।
“তাহলে তোমাকেও ধরেছে।”
“জলের নীচ থেকে হঠাৎ ভেসে উঠে নৌকার আরেকজনের গলা কেটে দিল।” রাগ ঝরে পড়ছিল ব্যালথাসের গলায়। “আক্রমণ করার আগে কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। কী করে এমন নিঃশব্দে কেউ চলাফেরা করতে পারে?”
“ওগুলো মানুষ নয়, নরকের শয়তান।” কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল শিকারীর। “মাঝনদীতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা নিশ্চয়ই আমাদের দেখতে পেয়েছিল। আমরা ফাঁদে পা দিয়েছি। জঙ্গলে ঢোকার পর কিছু বোঝার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে তির এসে পড়ল আমাদের ওপর। প্রথম আক্রমণেই আমাদের অনেকে মারা পড়ল। আমরা তিন-চার জন জঙ্গল ফুঁড়ে ওদের মুখোমুখি হতে পেরেছিলাম। কিন্তু ওরা দলে অনেক ভারী ছিল। কোনান হয়তো পালাতে পেরেছে। আমি ওর মাথা দেখতে পাইনি। আমাদেরও মেরে ফেললেই ভালো ছিল। তবে কোনানকে আমি দোষ দিই না। সাধারণত আমাদের গ্রামটাতে নির্বিঘ্নেই পৌঁছানোর কথা। যেখানে আমরা নেমেছি, সেখানে ওরা নদীর ধারে সবসময়ের জন্য চর রাখে না। আমরা নিশ্চয়ই দক্ষিণ থেকে আসা একটা বড়ো দলের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম। কিছু একটা গভীর ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। অনেক পিক্ট জড়ো হয়েছে এখানে। এরা সবাই গ্বাওয়েলাতে থাকে না। পশ্চিমের বহু গোষ্ঠীর অসভ্য এসে জুটেছে। নদীর উত্তর দক্ষিণ সব জায়গা থেকে।”
ব্যালথাস হিংস্র আকৃতিগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করল। পিক্টদের সম্বন্ধে সে বিশেষ কিছুই জানে না, তবে সে বুঝেছিল, যত অরণ্যবাসী তাদের ঘিরে রেখেছে, তাদের সকলের পক্ষে এই গ্রামে থাকা অসম্ভব। তারপর সে খেয়াল করল তাদের মুখে এবং বুকে যে সব রঙিন উল্কি দেখা যাচ্ছে তার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে।
“কিছু একটা নারকীয় কাণ্ড ঘটতে চলেছে।” উদ্বেগপূর্ণ কণ্ঠে বনচারী শিকারীটি বলল। “এরা এখানে জড়ো হয়েছে জ়োগার স্যাগের জাদুর বীভৎসতা দেখতে। আমাদের মৃতদেহ নিয়ে ও নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু করবে। জানি আমাদের মতো বনচারীদের মৃত্যু বিছানায় শুয়ে হয় না, কিন্তু এখানে মরার চেয়ে অন্যদের সঙ্গে মরে গেলেই ভালো হত।”
পিক্টদের নেকড়ের মতো সমবেত চিৎকার, উত্তেজনায় তীব্রতর হয়ে উঠল। তাদের ছন্দবদ্ধ দোলন, ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি দেখে ব্যালথাস বুঝল, গুরুত্বপূর্ণ কেউ আসছে। মাথা ঘুরিয়ে সে ছোটো কুটিরগুলোর তুলনায় বেশ বড়োসড়ো একটা বাড়ি দেখতে পেল। তার চাল থেকে চারদিকে ঝুলছে অনেকগুলি নরকরোটি। আর সেটার প্রধান দরজার সামনে উন্মাদের মতো নেচে চলেছে এক বিচিত্র মূর্তি।
“জ়োগার!” ফিসফিসিয়ে বলে উঠল শিকারী। তার রক্তাক্ত মুখাবয়ব নেকড়ের মতো হিংস্র হয়ে উঠল। সে অবচেতনেই টান মেরে তার দড়ির বাঁধন ছেঁড়ার চেষ্টা করল বার বার। ব্যালথাস বন্য ওঝাটির দিকে নজর দিল। মাঝারি উচ্চতার শীর্ণকায় একটি মানুষ। সে পুরোটাই প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে উটপাখির পালকে সজ্জিত একটি চামড়া ও তামার তার দিয়ে তৈরি পোশাকে। সেই পালকের রাশির মধ্যে থেকে উঁকি মারছে একটি মুখ। কী অসহ্যকর জঘন্য, কী বিদ্বেষে পূর্ণ সেই মুখ! পালকগুলো ব্যালথাসকে আশ্চর্য করেছিল, কারণ সে জানত সেগুলোর উৎসস্থল সুদূর দক্ষিণে, অর্ধেক পৃথিবী পার করে। কী করে পালকগুলো পেল এই বন্যটি? সেই ওঝা যত লাফাচ্ছিল, দোমড়াচ্ছিল মোচড়াচ্ছিল নিজের দেহকে, সেগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ছটফট করছিল, অশুভ মর্মরধ্বনি সৃষ্টি করছিল।
সেই বিচিত্র পোশাকে লাফাতে লাফাতে, উদ্ভট অঙ্গভঙ্গী করতে করতে জাদুকরটি পৌঁছাল মানব বৃত্তের মধ্যে। নীরব, অসহায় বন্দিদের দিকে হিংস্র, জিঘাংসাপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে সে পাক খেতে লাগল। স্বাভাবিক সময়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এ এক পাগলামি মনে হতে পারে, কিন্তু সেই উড়তে থাকা পালকের মাঝ থেকে যে শয়তানী ভরা মুখ উঁকি মারছিল, তা বার বার মনে করাচ্ছিল এমন পাপাত্মার পক্ষে যে কোন নারকীয় কাণ্ড করা খুবই সম্ভব।
হঠাৎ সে থমকে গেল। পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল একেবারে। উড়ন্ত পালকগুলো ঝিমিয়ে পড়ল। চারদিকের উল্লাসধ্বনি, কানফাটানো হুঙ্কার স্তব্ধ হয়ে অন্ধকার, প্রাণহীন নীরবতা নেমে এল। জ়োগার স্যাগ খাড়া দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছিল সে যেন তার দৈর্ঘ্য, আয়তন বৃদ্ধি করছে। ব্যালথাসের মনে হল সে যেন বিশাল হতে হতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে বহু ওপর থেকে ভস্মকারী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ব্যালথাস জানত এই জাদুকর তার চেয়েও খর্বাকার। সে বুঝল এ সবই মায়া, ইন্দ্রজালের প্রভাব। সে মাথা ঝাঁকিয়ে এই দৃষ্টিবিভ্রম থেকে মুক্ত হতে চাইল। ওঝাটা এবার বিড়বিড় করতে শুরু করল। কোনো অবোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ সে করছিল তার খসখসে কর্কশ উচ্চারণ ভঙ্গিতে তা বোঝা যাচ্ছিল না, শুধু মনে হচ্ছিল অনেক শঙ্খচূড় হিসহিসে শব্দ তুলেছে। হঠাৎ সে মুখ ঘুরিয়ে তেড়ে গেল খুঁটিতে বাঁধা আহত শিকারিটির দিকে। তার হিংস্র চোখ জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো ধকধক করছে। সাহসী শিকারীটি বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে তার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিল।
এক অভিশপ্ত প্রেতের মতো পাষণ্ডটি তীক্ষ্ণ চিৎকার করে পিছনের দিকে ডিগবাজি খেয়ে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ঘিরে থাকা বন্যযোদ্ধারা এমন এক সুতীব্র হুঙ্কার দিয়ে উঠল যে আকাশের নক্ষত্রেরা পর্যন্ত যেন কেঁপে উঠল তা শুনে। তারা তেড়ে গেল শিকারীর দিকে, কিন্তু বন্য জাদুকরটি মেরে ধরে তাদের আটকালো। সঙ্গে সঙ্গে রুক্ষস্বরে তাদের কিছু একটা আদেশ করল সে। তা শুনে কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে গ্রামের প্রধান দ্বার হাট করে খুলে দিল, আর তারপর দৌড়েই ফিরে এল মানববৃত্তে। কিন্তু তখন সে বৃত্ত দ্বিখণ্ডিত হয়ে দুটি সারিতে পরিণত হচ্ছে বামে ও দক্ষিণে। ব্যালথাস দেখল, সেই জীর্ণ কুটিরগুলি থেকে উঁকি দিচ্ছে ভীত নারী ও শিশুদের মুখাবয়ব। বন্যরা এমনভাবে সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছিল যাতে প্রধান দ্বার থেকে প্রবেশের জন্য একটি প্রশস্ত পথের সৃষ্টি হয়। উন্মুক্ত দ্বারের ওপাশে অন্ধকার অরণ্য যেন প্রেতের মতো গিলে খাচ্ছিল গ্রামের বিবর্ণ আলো-কে। সেই আঁধার থেকে কী কেউ আসবে? কে সে? কী সে?
জ়োগার স্যাগ সেই আঁধার বনানীর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এক নিঃশব্দ টানটান চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। তখনই, একেবারে হঠাৎ করেই জ়োগারের কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এল এক অপার্থিব চিৎকার। সে যেন কাউকে ডাকছে। এক অমানুষিক কণ্ঠস্বরে সে যেন আহ্বান জানাচ্ছে জঙ্গলের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা কোনো আদিম ভয়ংকরকে। সেই কণ্ঠস্বর কাঁপতে কাঁপতে মিলিয়ে যাচ্ছিল নিকশ কালো রাত্রে।
সেই আহ্বানের প্রত্যুত্তর এল এক ভয়ানক গর্জনের মাধ্যমে। গহীন অরণ্যের অতি গভীর থেকে সাড়া দিল কেউ। ব্যালথাস কেঁপে উঠল। সে জানত এই গর্জন কোনো মানবকণ্ঠ সৃষ্টি করতে পারে না। ভ্যালানাসের সাবধানবাণী তার মনে পড়ল। জ়োগার নিজের ইচ্ছেমতো বন্য পশুদের চালিত করতে পারে। তার পাশের শিকারীটির রক্তমাখা মুখাবয়বও যেন পাংশু হল কিছুটা। সে জিব বের করে অবচেতনেই তার রক্তাক্ত ঠোঁট চাটল।
গোটা গ্রাম নিস্তব্ধ। জ়োগারও স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। তার অলৌকিক পালকগুলো থিরথির করে কাঁপছিল। অকস্মাৎ দেখা গেল প্রধান দ্বার আর শূণ্য নেই।
সঙ্গে সঙ্গেই সারা গ্রামে এক চাপা ভয়ের আর্তরব ছড়িয়ে পড়ল। দ্বারের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যে পুরুষের দল, তারা পিছিয়ে গেল বেশ কিছুটা। ভয়ার্ত মুখে চাপাচাপি, ঠেলাঠেলি করে তারা কুটিরের দিকে সরে গেল যতটা সম্ভব। মেরুদণ্ড দিয়ে নেমে যাওয়া এক হিমেল স্রোত ব্যালথাসকে জমিয়ে দিচ্ছিল। উন্মুক্ত দরজায় যে দাঁড়িয়েছে তাকে দানব বললেও কম বলা হবে। সে যেন দুঃস্বপ্ন থেকে উঠে আসা এক নিদারুণ আতঙ্ক। তার অদ্ভুত আবছা দেহবর্ণ মিশমিশে কৃষ্ণ অন্ধকারে এমন মিশে যাচ্ছিল যে তাকে ঠিকমতো ঠাহর করা যাচ্ছিল না। সে যেন অবাস্তব কিছু। কিন্তু তার মুখ থেকে বেরিয়ে থাকা অতিদীর্ঘ ধারাল দাঁতগুলির মধ্যে অবাস্তবতার লেশমাত্র ছিল না। মশালের হলদে আলো তীব্রভাবে প্রতিফলিত হচ্ছিল সেগুলি থেকে। কোনো পশুর কি দুয়ের অধিক শ্বদন্ত সম্ভব? মাথা কিছুটা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই মহাশ্বাপদ। ঝলসে উঠছিল তার শানিত নখরগুলি। মাংশল স্থূল থাবার ওপর ভর দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক এক প্রেতের মতো সে নিঃশব্দে এগিয়ে এল। এ সেই প্রাচীন, বিক্ষুব্ধ, প্রতি মুহূর্তে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত সময় জয় করে আসা এক কৃপাণদন্তী ব্যাঘ্র। বাঘটার তরোয়ালের মতো বাঁকানো বিরাট শ্বদন্তগুলো থেকে অবিরাম লালা ঝরে পড়ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কোনো হাইবোরীয় শিকারী এদের মুখোমুখি হয়নি। এদের ঘিরে জন্ম নেওয়া অসংখ্য কিংবদন্তি এদের এক অতিলৌকিক প্রাণীতে পরিণত করেছিল। তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল এদের প্রেতের মতো দেহবর্ণ ও পিশাচতূল্য হিংস্রতার বর্ণনা।
এই মহাকায় ব্যাঘ্রটি সাধারণ শার্দূলদের চেয়ে বহুগুণে বড়ো। তবু তার চলন কী সাবলীল! ছন্দময় চলনে সে যেন ভেসে আসতে লাগল ব্যালথাসদের দিকে। সেটির মস্তক এত বড়ো ও অগ্রপদগুলি এত পেশিবহুল যে তার ফলে দেহের সম্মুখভাগকে অসংগতভাবে বিশাল লাগছিল। অবশ্য এটাও বোঝা যাচ্ছিল তার পিছনের পদদ্বয় সিংহের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। তার শানিত দন্তপূর্ণ মুখগহ্বর ও করোটির আকৃতি তাকে আরও হিংস্র দর্শন করে তুলেছে। দেখেই বোঝা যায় ওই করোটিতে যে মস্তিষ্ক বিদ্যমান তার আকার অতি ক্ষুদ্র। সে মস্তিষ্কে ধ্বংসেচ্ছা ছাড়া আর কোনো অনুভূতি জন্মগ্রহণ করে না। বিবর্তনের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের এক ভয়ানক উদাহরণ এই মহাব্যাঘ্র।
এই বিকটাকার জন্তুকে তাহলে জ়োগারের জাদু এখানে ডেকে এনেছে! ব্যালথাস তার শক্তিকে আর সন্দেহ করার অবস্থায় ছিল না। কেবলমাত্র কালো জাদুই এই মস্তিষ্কহীন ভয়ানক পশুকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। মৃদু গুঞ্জনের মতো তার চেতনার অন্তরাল থেকে এক অতি প্রাচীন আদি দেবতার নাম ভেসে উঠল। সেই দেবতা, যাঁর পদতলে মানব এবং পশু উভয়েই মাথা নত করত। সেই নিবিড় তমিস্রাচ্ছন্ন সময়ে যাঁর নামোচ্চারণে ত্রাসে শিহরিত হত সকলে। এবং এখনও হয়। জ়োগারের জ্বলন্ত দৃষ্টি এবার তার মনে আরও গভীর শঙ্কার সৃষ্টি করছিল।
দানবটা শিথিল শান্ত পদক্ষেপে কর্তিত, রক্তাক্ত মুণ্ডের স্তূপটা পার হয়ে গেল। একবারের জন্যেও ভ্রুক্ষেপ করল না সেদিকে। জীবিত প্রাণী ছাড়া অন্য কিছুতে তার উৎসাহ নেই। সে সংহারক, মৃতদেহভোজী নয়। তার উচ্ছিষ্টে বহু মাংসাশী প্রতিপালিত হয়। তার সবুজ অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে ক্ষুধা ঝরে পড়ছিল। সে ক্ষুধা কেবলমাত্র উদরপূর্তির জন্য নয়। সে ক্ষুধা হত্যার, শিকারের। বন্য ওঝাটি কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তার অঙ্গুলি ব্যালথাসের সঙ্গী শিকারিটির দিকে নির্দেশিত।
সেই মহাকায় শার্দূল এবার গুঁড়ি মেরে বসল। তখনই ব্যালথাসের মনে পড়ে গেল এদের নিয়ে প্রচারিত এক জনশ্রুতির কথা। কীভাবে এক সুবিশাল হস্তিপৃষ্ঠে এক লাফে উঠে তার করোটিতে দাঁত বসিয়েছিল এক কৃপাণদন্তী। সুদীর্ঘ দন্তের এক আঘাতেই ভূপতিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল হস্তিটি। কিন্তু সেই দন্ত এমনভাবে প্রোথিত হয়েছিল করোটিতে যে তা আর বের করা যায়নি। শিকারের সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিল শিকারী। অনাহারে। জাদুকরটি এবার তীক্ষ্ম কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল আর ভূবন কাঁপানো গর্জনের সঙ্গে লাফ দিল মহাব্যাঘ্র।
ব্যালথাস দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি কোনো পশু ধ্বংসের প্রতিমূর্তি হয়ে এভাবে লাফাতে পারে। তার লৌহসম দেহ, তীক্ষ্ম নখর ও দন্ত থেকে জিঘাংসা ঝরে পড়ছিল। সেটা উড়ে গিয়ে শিকারীর বক্ষে আছড়ে পড়ল। সেই আঘাতে মড়মড় করে উঠল মোটা কাঠের স্তম্ভটি, তারপর গোড়া থেকে মট করে ভেঙে পড়ল। কয়েক মুহূর্তেই সেই কৃপাণদন্তী তার শিকারের মৃতদেহটা অবলীলায় স্তম্ভ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে সেটার কিছু অংশ মুখ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় আর কিছুটা মাটিতে ঘসটাতে ঘসটাতে টেনে নিয়ে চলল। সেই মৃতদেহ ততক্ষণে একতাল রক্তমাংসের পিণ্ডে পরিণত হয়েছে। আতংকিত ব্যালথাস সেদিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল। চোখের পাতা ফেলার ক্ষমতাও আর তার নেই।
কৃপানদন্তীটির ঝাঁপিয়ে পড়ার ফলে কেবলমাত্র কাষ্ঠ স্তম্ভটিই ভেঙে পড়েনি, প্রবল কামড়ের ফলে ও ছিঁড়বার সময় শিকারীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তার মস্তক মূল দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল একধারে, অন্ত্র এবং বিভিন্ন দেহাংশ ছিটকে পড়েছিল এধার ওধার। গুঁড়িয়ে গিয়েছিল কঙ্কাল। ব্যালথাসের ব্যাঘ্র, ভাল্লুক ইত্যাদি নানা বন্য হিংস্র পশুদের আক্রমণে মৃত মানুষের দেহ দেখার অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু নিমেষে একটি মনুষ্যদেহকে এভাবে মাংসপিণ্ডে পরিণত হতে সে কখনও দেখেনি। সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়েছিল সে। তার বমি পাচ্ছিল।
কৃপানদন্তী অরণ্যের গভীর তমিস্রায় মিলিয়ে গেল। দূর থেকে রাত্রির নিঃস্তব্ধতা চিরে চাবুকের মতো একবার আছড়ে পড়ল তার বক্ষে কম্পন সৃষ্টিকারী গর্জন। তারপর আবার সব চুপচাপ। পিক্টেরা তখনও আতংকিত হয়ে কুটিরগুলির কাছে ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে। জ়োগার তাকিয়ে রয়েছে এক কৃষ্ণ গহ্বরের মতো মুখ ব্যাদানকারী প্রধান দ্বারের দিকে।
ভীত ব্যালথাসের শরীর স্বেদে স্নান করছিল। ওই কৃষ্ণ গহ্বর থেকে এবার কোন আতংক আবির্ভূত হবে তার দেহকে দূষিত মাংসপিণ্ডে পরিণত করতে? নিয়ন্ত্রণহীন আতংক তাকে বার বার বাঁধন ছেঁড়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাতে বাধ্য করল। মশালের হলদে রশ্মির সীমার বাইরের অন্ধকার অরণ্য যেন গলা টিপে ধরতে আসছিল। মশালের আগুনও যেন দাউদাউ করে নরকাগ্নির মতোই জ্বলছিল। সে টের পেল পিক্টেরা এবার তার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রয়েছে। শত শত আঁখির অগ্নিময় ঘৃণায় ভরা দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করতে লাগল। সে দৃষ্টিতে মানবতার চিহ্নমাত্র নেই। সেই বন্যেরা যেন আর মানুষ নেই, অন্ধকার মহারণ্যের একদল রক্তলোলুপ পিশাচে পরিণত হয়েছে। পালকের পোশাক পরিহিত মায়াবী এখন তাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
জ়োগার রাত্রির অন্ধকার চিরে তীক্ষ্ম চিৎকারে আবার ডাক পাঠাল। কিন্তু এই চিৎকার একেবারে অন্যরকম। এই আহ্বানে এক নারকীয় শিসধ্বনী যুক্ত হয়েছিল। কোনো দৈত্যাকার রাজসর্প যদি প্রচণ্ড জোরে হিস হিস করে উঠতে পারত তবে হয়তো এমনটা শুনতে লাগত।
এবার কিন্তু কোনো জবাব এল না। বরফের মতো জমাট বাঁধা নিস্তব্ধতার মাঝে ব্যালথাস কেবল নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। কিছুক্ষণ শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার পর দ্বারের বাইরে খসখস করে একটা শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। অতিকায় কিছু যেন নিজের দেহকে ঘসটে ঘসটে টেনে নিয়ে আসছে। তার পর দ্বার জুড়ে সেটি এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে প্রবল আতংকে ব্যালথাসের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল।
এ ভয়ংকরের কথা কেবল পৌরাণিক উপাখ্যানেই পাওয়া যায়। ব্যালথাসও কেবল গল্প শুনেছে এর। ঘোড়ার চেয়ে বড়ো মাথাটা দেখেই সে সেই অশুভ প্রাগৈতিহাসিক সর্পটিকে সনাক্ত করতে পেরেছিল। সেটির দেহ প্রকাণ্ড শায়িত বৃক্ষকাণ্ডের মতো মোটা, শল্কিত, চকচকে। দুই খণ্ডে চেরা জিবটি অজানা কোনো উদগ্র লালসায় বারবার মুখ থেকে বেরোচ্ছে আর ঢুকছে। আর সেটির শ্বদন্তগুলি! কী বিশাল! মশালের আলোয় বাঁকানো তলোয়ারের মতো লাগছে সেই দুটিকে। মাটি থেকে মাথা তুলল দানব। এখন সেটির মস্তকটি অন্তত দুই মানুষ উচ্চতায় অবস্থিত।
ব্যালথাসের মনে আর কোনো অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল না। অনিবার্য পরিণতির শঙ্কায় সে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো হয়ে গিয়েছিল। প্রাচীন উপকথায় একে প্রেতসর্প নামে অভিহিত করা হত। নিশুতি রাত্রে শিকারে বেরোত এরা। এক একবারে পুরো পরিবারকে গলাধঃকরণ করার ক্ষমতা ছিল এদের। এরা অজগরের মতো শিকারকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপে বিনাশ করতে পারে। কিন্তু এরা অজগরের মতো নির্বিষ নয়। এদের কামড় প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক। এদের বিষ মৃত্যুর আগে শিকারকে পাগল করে দেয়। মনে করা হত এরা অবলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ভ্যালানাসই ঠিক বলেছিল। এই অন্তহীন কান্তারে কোন বিভীষিকা লুকিয়ে রয়েছে তা সভ্য মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
সেই মহানাগ এবার এগিয়ে আসতে লাগল। তার মস্তক একই উচ্চতায় রেখে, শরীর বাঁকিয়ে মৃত্যুর মতো নিঃশব্দে এগোচ্ছিল সে। তার দৃষ্টি ন্যস্ত ছিল তার শিকারের চোখের ওপর। সে যেন ব্যালথাসকে সম্মোহিত করে ফেলছিল। যুবকটি তার শরীরের দোলন, লোলুপ দৃষ্টি থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না। চিন্তা করার শক্তি হারিয়েছিল সে। তার কাঁদবার ক্ষমতাও ছিল না।
তখনই কুটিরগুলোর অন্ধকার ছায়া থেকে মশালের আলোয় ঝলসে উঠে, বিদ্যুচ্চমকের মতো কিছু একটা উড়ে এল। আছড়ে পড়ল বিশাল চোয়ালের নীচে স্তম্ভের মতো মোটা গলায়। মুহূর্তে থরথর করে কেঁপে উঠল মহানাগের শরীর। আধো জাগরণে যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ব্যালথাস দেখল একটা দীর্ঘ বর্শা এসে গেঁথে গেছে সাপটির গলায়। এত জোরে যে সেটির ইস্পাতের অগ্রভাগ গলা ফুঁড়ে একদিকে বেরিয়ে গেছে। অপর দিকে দেখা যাচ্ছে বর্শার পিছনের প্রান্ত।
মুহূর্তে দক্ষযজ্ঞ বেধে গেল। সেই মহাসর্প গড়িয়ে, দুমড়ে, মুচড়ে, কুণ্ডলি পাকিয়ে, লেজ আছড়িয়ে ভয়ানক কাণ্ড শুরু করল। বর্শাটি তার মেরুদণ্ড ভেদ করেনি, কিন্তু গলার পেশিকে এমনভাবে বিদ্ধ করেছিল যে তার মাথা ঘোরানোর সামর্থ ছিল না। ছটফট করতে করতে সে গিয়ে পড়ল কুটির ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বন্যদের দলের ওপর। তার বিশাল দেহে চাপা পড়েই কয়েকজন প্রাণ হারাল। এর সঙ্গে তার মুখ থেকে আগুনের মতো বের হতে লাগল তরল হলাহল। সেটা যার গায়েই পড়ছিল সেই যন্ত্রণায় পাগলের মতো চিৎকার করছিল। এই অবস্থাতেই দানবটা কয়েকজনকে সামনে পেয়ে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। তার লেজের ঝাপটে জীর্ণ কুটিরগুলো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছিল। চারিদিকের আর্তনাদ, কান্না, হাহাকার, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল গোটা গ্রাম। এইসময় প্রবল অস্থিরতায় সাপটা গিয়ে পড়ল জ্বলন্ত আগুনের ওপর। ফলে যন্ত্রণায়, রাগে অন্ধ হয়ে সে আরও সংহারক মূর্তি ধারণ করল। পিক্টেরা বাঁচার জন্য উন্মাদের মতো ছোটাছুটি শুরু করল। পালাতে গিয়ে তারাও আগুনের ওপর পড়ছিল। কয়েকজনের গায়ে দাউদাউ করে আগুন লেগে গেল। এলোমেলো ছোটার ফলে পদদলিত হল বহু। গ্বাওয়েলাতে সে রাতে পাতাল থেকে নরক উঠে এসেছিল।
হঠাৎই তার কবজির কাছে কারো একটা স্পর্শ অনুভব করল ব্যালথাস। তারপর যেন কোন জাদুমন্ত্রে তার হাতের দড়ি খুলে গেল আর খুঁটির পিছন থেকে একটা শক্তিশালী হাত তাকে টেনে নিল। আচ্ছন্ন অবস্থাতেই সে কোনানকে দেখতে পেল। তার বর্মে রক্তের দাগ। তার ডান হাতে ধরা তরবারি থেকে রক্ত ঝরছে। সেই আলোছায়াতে তাকে বিরাট, অবাস্তব মনে হচ্ছিল।
“তাড়াতাড়ি করো। ওরা স্বাভাবিক হওয়ার আগেই পালাতে হবে।” বাম হাতে প্রবলভাবে ব্যালথাসের বাহু আকর্ষণ করে সে বলল।
ব্যালথাস টের পেল তার হাতে সে একটা কুঠার গুঁজে দিচ্ছে। জ়োগার স্যাগ উধাও হয়ে গিয়েছিল। যতক্ষণ না যুবকটির আচ্ছন্নতা কাটে কোনান তাকে টেনে নিয়ে চলল। যখন সে দেখল তার সঙ্গী দৌড়াতে সক্ষম, সে একছুটে নর করোটি ঝোলানো বড়ো বাড়িটায় প্রবেশ করল। ব্যালথাসও তাকে অনুসরণ করল। ভিতরে ঢুকতেই তারা ভয়ানক পূজাবেদিটিকে দেখতে পেল। বাইরের আলোয় স্বল্পালোকিত। পাঁচটি মুণ্ড তার সামনে সাজানো। তার মধ্যে নব্যতমটি তখনও কিছুটা চেনার মতো অবস্থায় রয়েছে। সে মুণ্ড ব্যবসায়ী টিবেরিয়াসের। তার পিছনের সিংহাসনে এক বিরাট কৃষ্ণবর্ণ মনুষ্য সদৃশ অবয়ব উপবিষ্ট। স্বল্পালোকে তাকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ব্যালথাসের হৃৎকম্প উপস্থিত হল যখন সেটি আসন ছেড়ে উঠে তাদের দিকে হাত বাড়াল। শৃঙ্খলের ঝনৎকার শোনা গেল। যাই হোক না কেন, ওটা বন্দি। কিন্তু তাতেও সেটা বিপজ্জনকভাবে তাদের কাছে এগিয়ে এল।
যেন প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই তরোয়াল চালাল কোনান। ফিনকি ছুটল রক্তের। একটা কানফাটানো জান্তব আর্তনাদ। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ব্যালথাসকে হেঁচকা টান দিয়ে সে আধো অন্ধকারে ছুটে চলল বেদীর পিছনদিকে কুটিরের অপর প্রান্তে। অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে মৃতদেহের মতো নরম নরম কী সব যেন মাড়িয়ে চলল তারা।
পিছনের একটা দরজা দিয়ে ছিটকে বেরোল তারা। প্রায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার সেখানে। সেই নারকীয় কাণ্ডের পরেও পিক্টদের কেউই এদিকে পালিয়ে আসেনি। কিন্তু তাদের সামনেই এখন গ্রাম সীমার উঁচু প্রাকার।
কোনান থমকে দাঁড়াল। তারপর ব্যালথাসকে শিশুর মতো কোলে তুলে নিয়ে অবলীলায় দু-হাতে মাথার ওপর তুলে ধরল। যেন তার কোনো ওজনই নেই। প্রাকারের ওপর অতিকষ্টে চড়ে বসল ব্যালথাস। মোটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো প্রাচীরের ছুঁচালো উপরের প্রান্ত তাকে আহত করছিল। তবুও কোনোক্রমে সেখানে বসে ঝুঁকে পড়ে কোনানকে উপরে উঠতে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল সে।
ঠিক তখনই জ়োগারের কুটিরের পিছনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরোল একজন পিক্ট। অত অন্ধকারেও তাদের চিনতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল তার। কোনান তাকে দেখামাত্র কোমরে ঝোলানো একটা খাটো কুঠার হাতে তুলে নিয়েছিল। প্রায় তৎক্ষণাৎই সেটি ছুড়ে মেরেছিল বুনোটিকে লক্ষ করে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। বিজাতীয় ভাষায় চিৎকার করে উঠেছিল পিক্টটি। তারপরই সেটা বদলে গেল তার মরণ আর্তনাদে। কোনানের ছোড়া কুঠার তার মাথা দু ফাঁক করে দিয়েছে।
তার চিৎকার আর আর্তনাদ শুনে গ্রামের ভিতরে নতুন করে হই-হট্টগোল শুরু হল। একসঙ্গে বহু পায়ের আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। তারা সকলে এদিকেই ছুটে আসছে। কোনান বাঘের মতো উপরের দিকে লাফ দিল। এত জোরে যে ব্যালথাসের বাড়ানো হাতের বদলে কাঁধের কাছাকাছি বাহুর একটা অংশ ধরে ঝুলে পড়ল সে। তারপর দোল খেয়ে দেওয়ালের ওপর চড়ে বসল। যন্ত্রণায় চাপা আর্তনাদ করে উঠল ব্যালথাস। তবে সেই যন্ত্রণা উপেক্ষা করে তৎক্ষণাৎ সে কোনানের সঙ্গে লাফিয়ে পড়ল প্রাচীরের অপর পারে। পলাতকদের সামনে এখন অন্ধকারাবৃত আদিম অরণ্য।
ঝেব্বাল স্যাগের সন্তানেরা
“কোন দিকে যাবো এখন?” বিমূঢ় ব্যালথাস জিজ্ঞেস করল।
“নদীর দিকে নয়।” কোনান সাবধানী স্বরে বলল। “নদী আর গ্রামের মাঝের জঙ্গল এখন পিক্ট যোদ্ধায় ছেয়ে আছে। আমাদের সেদিকে যেতে হবে, যে দিকের কথা ওরা কল্পনাও করতে পারবে না। পশ্চিমে চলো।”
ওরা ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করল। ব্যালথাস পাতার ফাঁক দিয়ে একবার পিছনে ফিরে তাকাল। বৃক্ষকাণ্ডে নির্মিত প্রাচীরের উপরে বেশ কয়েকটা কৃষ্ণবর্ণের মস্তক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে পিক্টেরা কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারা প্রাচীরের কাছে পৌঁছানোর পূর্বেই পলাতকরা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কোনানের দ্বারা নিহত যোদ্ধাটিকে দেখে তারা ভেবেছিল যে তাদের গ্রামকে আবার কোনো সৈন্যবাহিনী আক্রমণ করেছে। কিন্তু শেষমেশ কাউকে দেখতে না পেয়ে তারা হতচকিত হয়ে পড়েছিল।
ব্যালথাস বুঝল এখনও তাদের পলায়ন অনাবিষ্কৃতই রয়েছে। গ্রামের ভিতর থেকে ভেসে আসা জ়োগার স্যাগের উচ্চৈঃস্বরে নির্দেশ এবং অন্যান্য চিৎকার শুনে সে আন্দাজ করল পিক্ট যোদ্ধারা এখনও সেই মহাসর্পকে আক্রমণ করতে ব্যস্ত আছে। সেই দানব আর বন্য ওঝাটির নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই চিৎকারের ধরন বদলে গেল। রাগত হতাশ স্বর রাতের বাতাস পরিপূর্ণ করছিল।
একটা তেতো হাসি ফুটে উঠল কোনানের মুখে। এক অতি ক্ষীণ সুঁড়িপথে বহু বনস্পতির অন্তর দিয়ে সে ব্যালথাসকে নিয়ে চলেছিল আরও পশ্চিমে। সে সেই অন্ধকার পথে বৃক্ষকাণ্ড, শাখাপ্রশাখা, পত্রাদি এড়িয়ে এমনভাবে ছুটে চলেছিল যেন সেটি এক আলোকিত রাজপথ। তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে ব্যালথাসের প্রাণান্ত হচ্ছিল। বার বার সে ধাক্কা খাচ্ছিল বৃক্ষকাণ্ডে; পত্র, প্রশাখার ঝাপট লাগছিল তার চোখে মুখে। হোঁচট খেতে খেতে সে কোনানকে অনুসরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।
“ওরা এবার আমাদের তাড়া করবে।” কোনান বলল। “জ়োগার স্যাগ এতক্ষণে খেয়াল করেছে ওই স্তূপে আমার মাথাটা নেই। কুত্তা একটা। আমার কাছে আরেকটা বর্শা থাকলে সেটা ছুড়ে সাপটার আগে ওকে গাঁথতাম। আমার পিছন পিছন এসো। গ্রাম থেকে বহু পথ বেরিয়েছে। তার মধ্যে যেগুলো নদীর দিকে গেছে, ওরা আগে সেগুলো ধরে ছুটবে। নদীর পারে কয়েক মাইল জুড়ে পাহারা বসাবে। আমরা এই সরু পথটা ধরেই যতদূর সম্ভব যাবো। ঘন জঙ্গলে ঢুকলে গতি কমবে। এখন যত জোরে সম্ভব দৌড়ও।”
“ওরা বড্ড তাড়াতাড়ি ভয়টা কাটিয়ে উঠল।” ব্যালথাস ছুটতে ছুটতে, হাঁফাতে হাঁফাতে বলল।
“ওরা বহু বছর আগে থেকেই ভয়কে জয় করতে শিখেছে।” কোনানের কণ্ঠে যেন কিছুটা বিরক্তির সুর শোনা গেল।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ বাক্যালাপ হল না। পলাতকেরা পথ অতিক্রম করতে তাদের যাবতীয় শক্তি ব্যয় করছিল। তারা গহীন থেকে গহীনতর অরণ্যে প্রবেশ করছিল। প্রতি পদক্ষেপে তাদের সভ্য জগৎ থেকে দূরত্ব বাড়ছিল। ব্যালথাসের ভয় লাগছিল। কিন্তু কোনানের সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করার মতো মানসিক জোর তার ছিল না।
খানিক পর কোনান নিজেই বলে উঠল। “আমরা পশ্চিমে অনেকটা যাওয়ার পর ঘুরে একটা ধনুকের মতো বাঁকা পথে নদীর ধারে যাওয়ার চেষ্টা করব। গ্বাওয়েলার কয়েক মাইলের মধ্যে যত গ্রাম আছে সব ক-টার মানুষই ওই গ্রামে গিয়ে জড়ো হয়েছে৷ আমরা ওদের এড়িয়ে ঘুরপথে নদীতে পৌঁছব। দিনের আলো ফুটলে ওরা অবশ্য বুঝবে আমরা এই রাস্তা ধরেছি। কিন্তু আমরা জঙ্গলে ঢুকে পড়লে কোন দিকে গেছি সেটা বুঝতে ওদের অসুবিধা হবে।”
তারা দৌড়চ্ছিল। গ্রামের চিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না। ব্যালথাসের শরীরের নানা স্থানের ব্যথা তাকে কাতর করছিল। তবু সে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল যতটা সম্ভব দ্রুতগামী হওয়ার। এমন সময় কোনান থমকে দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে তাকাল।
চাঁদ উঠেছিল। মাথার উপর জড়ামড়ি করে থাকা শাখা প্রশাখাকে ভিজিয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল জ্যোৎস্না। নাম না জানা লতা পাতার জালে চাঁদ যেন আটকে পড়েছিল। বন অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ।
“আমরা কি এবার জঙ্গলে ঢুকব?” ফিসফিস করল ব্যালথাস।
“তোমার কুঠারটা দাও।” হিসহিস করল কোনান। “আমাদের পিছনে কিছু একটা আসছে।”
“তাহলে তো আমাদের বনে লুকোনো উচিত।”
মাথা নাড়ল কোনান। তারপর সঙ্গীকে টেনে নিয়ে দ্রুত পাশের জঙ্গলে প্রবেশ করল।
চাঁদ আরও উপরে উঠেছিল। তার আলোয় শীর্ণ বনপথটিকে কেমন রহস্যময় লাগছিল।
“সব ক-টা পিক্ট এলে ওদের সঙ্গে লড়ে আমরা জিততে পারব না।” ব্যালথাস ফিসফিস করল।
“কোনো মানুষের পক্ষে আমাদের পালানোর পথ এত দ্রুত খুঁজে বের করে এত কাছে আসা সম্ভব নয়।” কোনান চাপা স্বরে বলল। “এটা অন্য কিছু। শব্দ কোরো না।”
চারদিকের নিঃস্তব্ধতার মাঝে ব্যালথাস নিজের হৃৎপিণ্ডের ধকধক শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। এত জোরে, যে তার মনে হচ্ছিল এক মাইল দূর থেকে সেটা শোনা যাবে। তারপর অকস্মাৎ সেই স্বল্পালোকিত পথে তাদের অনুসরণকারীকে দেখা গেল। ব্যালথাস আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠেছিল প্রায়। তার মনে হয়েছিল এ সেই কৃপান দন্তী ব্যাঘ্র। কিন্ত তারপরই একটু খেয়াল করতে সে বুঝতে পারল এটি আকারে কিছুটা ছোটো। একটা চিতাবাঘ। পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে গন্ধ শুঁকে তারা কোনদিকে গেছে, বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু বেচারার ভাগ্য খারাপ। বায়ু তার দিক থেকে ব্যালথাসেদের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে সে কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জন্তুটি এবার মাথা নীচু করে তাদের পদচিহ্নগুলো শুঁকে এগিয়ে আসতে লাগল। তারপর তাকাল সেই দিকে, যে গুল্মের আড়ালে তারা লুকিয়ে ছিল। তার চোখ প্রায়ান্ধকারে উল্কার মতো জ্বলে উঠল। ব্যালথাস আসন্ন সংগ্রামের কথা চিন্তা করে একটু কেঁপে উঠল যেন।
তখনই কোনান বিদ্যুৎ গতিতে তার কুঠার ছুড়ে মারল। তার স্কন্ধের এবং বাহুর সম্পূর্ণ শক্তি যুক্ত হয়েছিল সেই ক্ষেপনে। কুঠারটি একটি রূপালি বিদ্যুতের মতো গিয়ে আঘাত করল চিতাবাঘটির মাথায়। সে কোনো শব্দ করার সু্যোগ পেল না। পূর্ণবয়স্ক পশুটির দেহ সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
কোনান লঘু পদে মৃতদেহটির কাছে গিয়ে গেঁথে থাকা কুঠারটি খুলে নিয়ে সেটিকে একটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল। ব্যালথাস মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। কোনান সেদিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে বলল, “চলো, যাওয়া যাক। যত দ্রুত সম্ভব।”
তারপর সে অরণ্যের মধ্য দিয়ে দক্ষিণের পথ ধরল। চলতে চলতেই বলল, “জন্তুটার পিছন পিছন এবার যোদ্ধারা আসবে। যেই একটু সম্বিত ফিরেছে, জ়োগার আমাদের পিছনে ওটাকে লেলিয়ে দিয়েছিল। ওটা নিশ্চয়ই আমাদের পিছনে পিছনে আসার আগে গোটা গ্রামে একবার পাক খেয়েছে। তারপর তিরের মতো ছুটে এসেছে আমাদের দিকে। যোদ্ধাগুলো ওর মতো অত তাড়াতাড়ি দৌড়তে পারেনি। ফলে পিছিয়ে পড়েছে। ওরা ওর ডাক শোনার চেষ্টা করবে; আর শুনতে পাবে না যদিও। তবে ও কোনদিকে যেতে পারে তার একটা আন্দাজ তো ওদের আছেই। ফলে এখানে ঠিকই পৌঁছবে। তারপর রক্ত দেখে মৃতদেহটা খুঁজে বের করবে। ততক্ষণে আমরা বেশ কিছুটা এগিয়ে যাবো। সাবধানে এসো।”
সে স্বচ্ছন্দে শাখা, প্রাশাখা, ঝুলন্ত লতাগুলোকে এড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। কোনো বৃক্ষকাণ্ড স্পর্শ করছিল না। প্রতি পদক্ষেপে সে তার গমনচিহ্ন নষ্ট করতে করতে এগোচ্ছিল। ব্যালথাস তাকে দেখে শিখছিল। কিন্তু তার পক্ষে সে কাজ যথেষ্ট কঠিন।
তারা মাইলখানেক পথ পার হয়ে এসেছে। তাদের পিছনে কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। ব্যালথাস আর থাকতে না পেরে বলে উঠল, “জ়োগার কি চিতাবাঘের বাচ্চা ধরে তাদের কুকুরের মতো অনুসরণ করার তালিম দেয়?”
কোনান মাথা ঝাঁকাল। “ওটা একটা জংলি চিতা।” সে বলল।
“কিন্তু, ও যদি বুনো পশুদের আদেশ দিতেই পারে, সব ক-টাকে আমাদের মারার জন্য পাঠালো না কেন? বন তো চিতাবাঘে ভরতি। একটাকে পাঠিয়ে কী লাভ?” ব্যালথাস বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল।
কোনান এ প্রশ্নের জবাব সঙ্গে সঙ্গে দিল না। কিছুক্ষণ পর যখন সে কথা বলল, তার কণ্ঠে এক সংযমী সুর,
“কারণ ও সবাইকে আদেশ করতে পারে না। কেবলমাত্র তাদেরকেই পারে, যারা ঝেব্বাল স্যাগকে মনে রেখেছে।”
“ঝেব্বাল স্যাগ?” ব্যালথাস সেই আদিম দেবের নামটা খুব ইতস্তত করেই উচ্চারণ করল। সারাজীবনে সে এই নাম তিন-চার বারের বেশি উচ্চারিত হতে শোনেনি। তার সামনে যারা এই নাম নিয়েছে, তারা ভয়ার্ত চক্ষে এই দেবতা সম্পর্কে আর কোনো কথা বলতে চায়নি।
“একসময় সব জীবিত প্রাণী তাঁকে পুজো করত; বহু বহু বছর আগে, যখন মানুষ আর পশুরা একই ভাষায় কথা বলত। তারপর মানুষেরা তাঁকে ভুলে গেল। বেশির ভাগ পশুও। কিন্তু কয়েকজন মনে রাখল তাঁকে। যারা মনে রাখতে পারল, তারা মানুষ বা পশু যাই হোক না কেন, এখনও নিজেদের মধ্যে সেই ভাষায় কথা বলতে পারে।” কোনান গম্ভীর স্বরে বলে চলেছিল। ব্যালথাস চুপ করে ছিল। সে দেখেছে সেই মায়াবী জ়োগারের ডাকে বন্য জন্তুরা কীভাবে সাড়া দেয়। এই নিবিড় অরণ্য তাকে অতীন্দ্রিয়ে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে।
“সভ্য মানুষেরা একথা শুনে হাসে। কিন্তু কীভাবে জ়োগার বন থেকে বাঘ আর সাপেদের ডেকে আনতে পারে, তার কোনো ব্যাখ্যা ওরা দিতে পারবে না। এ ঘটনা শুনলে ওরা সেটা বিশ্বাসই করবে না। ওরা অমনই। অর্ধজ্ঞানী। যার ব্যাখ্যা ওদের কাছে নেই, তাকে মিথ্যে বলে দাগিয়ে দেয়।”
সাধারণ অ্যাকুইলোনীয়দের চেয়ে ট্যরানবাসীরা অরণ্যের অনেক নিকটবর্তী স্থানে বাস করে। নানা প্রবাদ, লোককথা, সংস্কার ছড়ানো তাদের মাঝে। পূর্বপুরুষানুক্রমে তারা প্রকৃতিকে ভালোবেসেছে, ভয় পেয়েছে, পুজো করেছে। তথাকথিত সভ্যতার আলোতে প্রাচীন বিশ্বাসকে ধূলিস্যাৎ হতে দেয়নি। তাই ব্যালথাস এই দেবতার নাম সভয়ে উচ্চারিত হতে শুনেছে কয়েকবার। সে কোনানের সব কথাই বিশ্বাস করছিল।
“আমি শুনেছি এই বনের কোথাও একটা ঝেব্বেল স্যাগের প্রগৈতিহাসিক পূজাবেদী আছে। কোথায় আছে জানি না।” কোনান বলল। “তবে আমি দেখছি এখানকার পশুরা অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি করে তাঁকে মনে রেখেছে।” চলতে চলতে তারা অরণ্যের মাঝে এমন এক স্থানে এসে দাঁড়িয়েছিল যেখানে বৃক্ষের ঘনত্ব কম। তাদের তলদেশ বেশ পরিষ্কার। কোনান চারপাশ দেখে সেখানে দাঁড়াল।
“তাহলে এবার অন্যরা আসবে?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল ব্যালথাস।
“তারা নিশ্চয়ই রওনা দিয়েছে।” কোনান কেমন নির্বিকার হয়ে জবাব দিল। “জ়োগার নিশ্চিতভাবেই একটা মাত্র চিতার ওপর আমাদের অনুসরণ করার ভার ছেড়ে দেয়নি।”
“তাহলে আমরা কী করব?” ব্যালথাসের কণ্ঠে অস্বাচ্ছন্দ। সে তার কুঠারটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে উপরে, অন্ধকার বৃক্ষশাখের দিকে, আর চারপাশে চাইল। তার মনে হচ্ছিল যে কোনো মুহূর্তে তার ওপর অনেক ধারাল দাঁত আর নখ ঝাঁপিয়ে পড়বে।
“অপেক্ষা।” কোনানের কণ্ঠে ভয়ের লেশমাত্র নেই।
এরপর সে উবু হয়ে বসে মাটিতে এক বিচিত্র নকশা আঁকতে লাগল। কৌতূহলী ব্যালথাস তার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে সেটা দেখার চেষ্টা করল। কে জানে কেন, চিহ্নটা দেখে তার সর্বাঙ্গের রোম হর্ষিত হচ্ছিল। তাদের চারদিকের অরণ্যে খশখশ শব্দ শোনা গেল। বনস্পতিদের পত্র, প্রশাখা দুলিয়ে কেঁদে কেঁদে অশরীরীর মতো বয়ে গেল অদ্ভুত বাতাস। ব্যালথাসের শরীরে সে বাতাসের বিন্দুমাত্র স্পর্শ লাগল না। কোনান একবার ভাবলেশহীন মুখে চারিদিকে চাইল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ চিত্তে চিহ্নটার দিকে তাকিয়ে রইল।
“কীসের ছবি এটা?” ব্যালথাস ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল। তার কাছে সেটা অতি জটিল ও দুর্বোধ্য। সে ভেবেছিল শিল্পকলা সম্বন্ধে অজ্ঞতার ফলেই এই প্রাচীন নকশাটিকে সে চিনতে পারছে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সভ্য জগতের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হলেও এ অভিজ্ঞানের অর্থ তার পক্ষে বোঝা সম্ভব হত না।
“আমি এটাকে একটা গুহায় দেখেছিলাম। হাজার হাজার বছর ধরে সে গুহায় কোনো মানুষের পা পড়েনি।” কোনান বিড়বিড় করল। “সেটা ছিল সুদূর ভিলায়েত সাগরের তীরে এক জনমানবহীন পাহাড়ি অঞ্চল। এরপর একদিন এক অচেনা নদীর তীরে এক কালোজাদু জানা মায়াবীকে আমি এই ছবিটা আঁকতে দেখি। তার কাছে আমি এর অর্থ জানতে চাই। সে আমায় পুরোটা খুলে না বললেও জানায় এই চিহ্ন ঝেব্বাল স্যাগের। তার উপাসক পশু ও মানুষদের কাছে এ অতি পবিত্র। এবার দেখা যাক।”
তারা পাথরের মতো নিরেট নিস্তব্ধতার মাঝে, এক ঝোপের অন্তরালে, অরণ্যের লতা, গুল্ম, পত্রাদির দিকে তাকিয়ে দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। পূর্বে, বহু দূরে কোথায় যেন মৃদু শব্দে ডঙ্কা বাজছিল। উত্তর আর পশ্চিম থেকে দামামার শব্দে জবাব আসছিল তার। ব্যালথাসের কাঁপুনি লাগছিল। তার মনে হচ্ছিল ওই ডঙ্কার বার্তা এক অশুভ, রক্তস্নাত দৃশ্যের আগাম পটভূমিকা রচনা করছে। ও শব্দের উৎস বহু দূরে, তাদের মাঝে এক গহীন অরণ্য বাধা রচনা করেছে, এইসব ভেবে সে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল।
এইসময় সে বিস্ফারিত চোখে দেখল, কয়েক গজ দূরের একটা ঝোপের আড়াল থেকে রাজকীয় পদক্ষেপে একটা বিরাট প্যান্থার বেরিয়ে আসছে। চাঁদের রূপালি আলো তার তৈলমসৃণ ত্বক থেকে পিছলে যাচ্ছে। সামান্য নড়লেই সেই ত্বকের নীচের সবল, সুগঠিত পেশিগুলো পরিস্ফুট হয়ে উঠছে।
মাথা নীচু করে, মাটি শুঁকতে শুঁকতে সেটি তাদের দিকে এগিয়ে এল। তারপর একেবারে স্থির হয়ে গেল। তার নাক প্রায় সেই চিহ্নটিকে স্পর্শ করেছে। এক দীর্ঘ সময় সে চলৎশক্তি রহিত হয়ে রইল, তারপর ভূমিষ্ট হয়ে তার মাথাটি সেই চিহ্নের সামনে ঠেকাল। ব্যালথাসের মনে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছিল। প্যান্থারটিকে আর ততটা ভয়ানক লাগছিল না, অথচ এই রোমহষর্ক দৃশ্য দেখে তার ভয়ও লাগছিল।
এবার প্যান্থারটি সসম্ভ্রমে দেহ সংকুচিত করে, উদর প্রায় মাটিতে ঘসটিয়ে পিছু হটল। বেশ কিছুটা এভাবে যাওয়ার পর সে যখন ফাঁকা জায়গাটা ছেড়ে জঙ্গলের কাছাকাছি এসেছে, উঠে দাঁড়িয়ে, ঘুরে, এক কৃষ্ণ বিদ্যুৎ চমকের মতো অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ব্যালথাস কাঁপা কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছে কোনানের দিকে তাকাল।
কোনানের জ্বলন্ত চোখগুলিতে যেন আগুন ধরে গিয়েছিল। এ আগুন সেই বর্বর চোখেই জ্বলতে পারে যা কোনোদিন কোনো মেকি সভ্যতার প্রলেপ আচ্ছাদিত করতে পারেনি। সেই মুহূর্তে তার রক্তে এক আদিম বন্যতা মাতন জাগিয়েছিল। স্পষ্টতই সে তার সঙ্গীর কথা বিস্মৃত হয়েছিল। এ এক অচেনা কোনান। তার আগুনে দৃষ্টিতে ব্যালথাস, যখন জগতে সদ্য প্রাণের উন্মেষ ঘটছে, সেই বিস্মৃত অতি প্রাচীন কালের নামহীন স্মৃতির জাগরণ, ছায়ার আভাস দেখতে পেল। আলো ঝলমলে সভ্যতা সেগুলিকে বার বার কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা যে কত বড়ো সত্য সেটা সে হৃদয়ঙ্গম করছিল।
তারপর সেই আগুন আবার নিয়ন্ত্রিত হল। শান্ত চোখে উঠে দাঁড়িয়ে কোনান বলল,
“চলো। বন্য পশুরা আর আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু আমরা যেভাবে দৌড়েছি তাতে যোদ্ধারা আমাদের খুঁজে পাবে। তবে এটাও ঠিক আমরা যে দক্ষিণে গেছি সেটা ওরা চট করে বুঝবে না। আর পশুরা গন্ধ শুঁকে আমাদের খুঁজতে সাহায্য করবে না বলে সেই কাজ আরও কঠিন হবে। অবশ্য এমনিতেই দক্ষিণে প্রচুর যোদ্ধা থাকবে জঙ্গলে। কাজেই আমরা আঁধার ঘনালে পথ চলব। নদীর দিকেও রাতের আঁধারেই যেতে হবে। অকারণে লড়তে গিয়ে মারা পড়লে ভ্যালানাসকে সাবধান করা যাবে না।”
“ভ্যালানাসকে সাবধান করবে?”
“অবশ্যই। নদীর তীরের জঙ্গলে পিক্টেরা থিকথিক করছে। তাই ওরা আমাদের ধরে ফেলেছিল। জ়োগার ওদের যুদ্ধের জন্য তৈরি করছে। এবার কোনো সাধারণ আক্রমণ হবে না। এর মধ্যেই পনেরো কুড়িটা গোষ্ঠীর যোদ্ধারা জড়ো হয়েছে। আরও আসছে। আমি আড়াল থেকে শুনেছি ওদের কথাবার্তা। জ়োগার ওর জাদুর সাহায্যে ওদের মধ্যে লড়াই করার নেশা জাগিয়ে তুলেছে। এখন বেশির ভাগ পিক্টই তাদের সর্দারদের চেয়েও ওর কথা বেশি শুনছে। ওর পরিকল্পনা টাস্কেলান দুর্গ আক্রমণ করা। কবে তা আমি জানি না। তবে যত শিগগির সম্ভব করবে। নয়তো বিভিন্ন গোষ্ঠীর পিক্টেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করে আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে।
“আমাদের কাজ হবে নদী পার করে সব বসতিস্থাপনকারীদের সাবধান করা। হয় তাদের দুর্গে, নয়তো ভেলিট্রিয়ামে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অবশ্য ওদের যা কথাবার্তা শুনেছি তাতে মনে হয়েছে ওদের দুর্গের সঙ্গে ভেলিট্রিয়াম আক্রমণ করারও ইচ্ছা রয়েছে।”
কথা বলতে বলতেই কোনান তার সঙ্গীকে নিয়ে আরও দূর্ভেদ্য অরণ্যে প্রবেশ করছিল। একসময় তারা এক উন্মুক্ত স্থানে পৌঁছাল। সেখানে গোটা অঞ্চলটাই পাথুরে। কিছু ছোটো গুল্ম ছাড়া আর কিছু জন্মায়নি। অঞ্চলটি দক্ষিণে বিস্তৃত। কোনান খুশি হল।
“পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটলে আমরা কোনদিকে গেছি ব্যাটারা কিছুতেই বুঝতে পারবে না।” সে বলল।
“তুমি বাঁচলে কী করে?” ব্যালথাস এতক্ষণে প্রশ্নটা করতে পারল।
কোনান নিজের শৃঙ্গবিশিষ্ট শিরস্ত্রাণ আর সূক্ষ্ম শৃঙ্খলনির্মিত বর্ম দেখিয়ে মৃদু হাসল। বলল,
“যদি এখানকার মানুষেরা এগুলো পরার অভ্যেস করত তবে বুনোগুলোর বর্শার ডগায় অনেক কম মাথা দেখতে পাওয়া যেত। অবশ্য তার আগে এই বর্ম পরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শব্দ না করে চলাফেরা করাটা শিখতে হবে।
“পিক্টগুলো আমাদের নদী পার করতে দেখতে পেয়েছিল। ওরা আগে থেকেই জঙ্গলের মধ্যে আমাদের জন্য লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল। আর একজন পিক্ট যখন নড়াচড়া না করে পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে তখন বনের শিকারি পশুরাও তাদের খেয়াল না করে চলে যায়। আমরা সাবধানেই এগোচ্ছিলাম। তখনই ওরা রাস্তার দু-পাশ থেকে তির ছুড়তে শুরু করে। অন্ধকারে প্রথমে নিশানা ঠিক রাখতে না পারা বজ্জাতগুলো নিজেদের দু-একটাকেও গেঁথে ফেলেছিল। আমরা তাদের চেঁচানি শুনতে পেয়েছি।” মৃদু হাসি ফুটে উঠল কোনানের মুখে।
“প্রথম তিরের ঝাঁকটা আসার আগে ধনুকের শব্দ শুনে আমি আমার সঙ্গীদের মাটিতে শুয়ে পড়তে বলে চেঁচিয়েছিলাম। কিন্তু ওদের বেশির ভাগই বড্ড ধীর। ফলে অতর্কিত আক্রমণটায় আমাদেরই ক্ষতি হল বেশি। প্রথম ধাক্কাটার পরই আমরা জঙ্গলের মাঝে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু ওরা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল।
“আমাদের বেশির ভাগ মারা পড়লে আমরা শেষ দু-তিনজন পালাতে থাকি। অনেকগুলো রং-মাখা নোংরা কুত্তা আমাকে তাড়া করেছিল, কিন্তু দৌড়ে ধরতে পারেনি। আমি লুকিয়ে নদীর তীরে পৌঁছাই। দেখি সেখানে পিক্টেরা পাহারা বসিয়েছে। ভেবেছিলাম ওদের এড়িয়ে নদীতে সাঁতার দেব। সেই সময়েই গ্রাম থেকে দামামার শব্দ ভেসে আসে। বুঝলাম আমাদের দু-একজনকে ওরা জীবন্ত অবস্থায় গ্রামে ধরে নিয়ে গেছে।
“আমি গ্রামের দিকে যাই। বড়ো বাড়িটার পিছন দিকে টপকানোর জন্য পাঁচিলটায় চড়লে দেখি সবাই জ়োগারের জাদু দেখতে ব্যস্ত। সেখানে একটা পাহারাদার ছিল বটে, কিন্তু সে-ও সেদিকেই তাকিয়ে। আমি নিঃশব্দে নেমে তার পিছনে গিয়ে ঘাড় মটকে দি। তারপর তার বর্শাটা তুলে ছুড়ে মারি। তোমার কাছে যে কুঠারটা আছে, সেটাও ওর ছিল।”
“কিন্তু জ়োগার স্যাগের পুজোর বেদীতে ওটা কী ছিল? ওটাও তো তোমার হাতে মরল বলে মনে হল।” সেই কদর্য, ভয়াল দৃশ্যের কথা মনে পড়ায় ব্যালথাসের দেহ শিহরিত হল।
“জ়োগার যাদের পুজো করে তুষ্ট করতে চায়, তাদের মধ্যে একজন। তবে ঝেব্বাল স্যাগকে ভুলে গিয়েছিল বলে সেটাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়েছিল। আসলে ওটা একটা পুরুষ গরিলা। পিক্টেরা মনে করে চাঁদে যে গাল্লাহ্ নামের গরিলা দেবতা বাস করেন, এরা তাঁর প্রতিভূ।
“আলো ফুটছে। একটা সুবিধাজনক জায়গা বেছে লুকিয়ে পড়তে হবে। দেখতে হবে পিক্টেরা আমাদের রাস্তায় কতদূর এল। তারপর অন্ধকার হলে আমরা নদীর দিকে যাবো।”
গোটা অঞ্চলটাই প্রস্তরপূর্ণ তরঙ্গায়িত হলেও তার এক পার্শ্বে একটি নাতিউচ্চ পর্বত ছিল। তার শীর্ষদেশ ছিল বৃক্ষ ও গুল্ম দ্বারা আবৃত। তার সানুদেশেই বেশ কিছু বিক্ষিপ্ত প্রস্তরখণ্ড এক প্রাচীরের মতো অবরোধ সৃষ্টি করেছিল। সেগুলির পিছনে আশ্রয় নিল কোনান ও ব্যালথাস। এই উচ্চ ভূমি থেকে নীচের প্রায় চার-পাঁচ মাইল প্রশস্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর সহজেই নজর রাখা সম্ভব। অথচ নীচে থেকে তাদের দেখা প্রায় অসম্ভব। কোনো পিক্টের পক্ষে আর দৃষ্টির অগোচরে থেকে তাদের আক্রমণ করা সম্ভব নয়, এই ভেবে ব্যালথাস কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু পশুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় তার তখনও যায়নি। এমনকী ঝেব্বাল স্যাগের অভিজ্ঞানের শক্তি দেখার পরও। কোনান অবশ্য সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিল। সভ্যতাসৃষ্ট অবিশ্বাস তার মনকে কলুষিত করেনি।
ভোর হচ্ছিল। মনখারাপ করা সকালের আলো মৃতদেহ ঢাকার সাদা চাদরের মতো বিছিয়ে পড়ছিল পর্বত, অরণ্যের উপর। আকাশের রং রক্তাভ থেকে ধীরে ধীরে নীলে পরিণত হল। এমনিতে চারিদিক নিস্তব্ধ। কেবল কোথাও একটা নিঃসঙ্গ পাখি একটানা থেমে থেমে ডেকে চলেছিল। ব্যালথাসের খিদে পাচ্ছিল। এমন ক্ষুধার উদ্রেক হওয়া অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। তারা এর মধ্যে কেবলমাত্র একটি পাহাড়ি ক্ষীণ স্রোতস্বিনীর জল পান করেছিল। দামামার শব্দ আর শোনা যাচ্ছিল না। ক্ষুধা ও রাতের দুঃস্বপ্নের থেকে চিন্তা ঘোরানোর জন্য ব্যালথাস বলে উঠল,
“জ়োগারের পোশাক দেখলাম উটপাখির পালকে বানানো। আমি ওগুলো দেখেছিলাম কেবলমাত্র পুবের, বহুদূর থেকে আসা নাইটদের টুপিতে। ও ওগুলো কোথা থেকে পেতে পারে? এই জঙ্গলে তো উটপাখি নেই। না কি আছে?”
“নেই। পালকগুলো কুশ থেকে আনা।” কোনান বলল। “এখান থেকে অনেক দূরে, পশ্চিমে গেলে সমুদ্রে পৌঁছান যায়। জিঙ্গারা থেকে কখনও সখনও ব্যবসায়ীদের জাহাজ আসে অস্ত্র, মদ, পোশাকের বদলে তামা, সোনা, পশুর চামড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওরাই মাঝে মাঝে উটপাখির পালক নিয়ে আসে। ওরা সেগুলো পায় স্টাইজিয়া থেকে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা আবার সেটা পায় আরও দক্ষিণে অবস্থিত কুশের কালো মানুষদের থেকে। পিক্ট ওঝাগুলো এই পালকের জন্য চড়া দাম দেয়। কিন্তু পিক্টদের সঙ্গে ব্যাবসা করা খুবই বিপজ্জনক। ওরা মাঝে মাঝে আক্রমণ করে গোটা জাহাজটাই দখল করতে চায়। উপকূল অঞ্চলটাও খুব একটা সুবিধার নয়। এ সবই আমি জেনেছিলাম জিঙ্গারার দক্ষিণে বারাচান দ্বীপপুঞ্জে যখন জলদস্যুদের দলে ছিলাম, তখন।”
ব্যালথাস অভিভূত দৃষ্টিতে কোনানের দিকে চেয়ে ছিল।
“আমি জানতাম তুমি কেবল সেনাবাহিনীতে কাটাওনি। তুমি বহু দূর দূর দেশে ঘুরেছ, তাই না?”
“হ্যাঁ। আমার জাতির যে কোনো লোকের চেয়ে আমি অনেক বেশি ঘুরেছি। আমি হাইবোরিয়া, স্টাইজিয়া, শেম আর অ্যাকুলোনিয়ার বিশাল, চোখধাঁধানো শহরগুলো দেখেছি। আমি কুশেরও দক্ষিণে যে সব অন্ধকার দেশ আছে, সেখানে গেছি। ভিলায়েত সাগরের পুবেও গেছি। আমি কখনও গরীব ভবঘুরে ছিলাম, কখনও সেনাপ্রধান। আমি রক্ষীবাহিনীর প্রধান হয়েছি আবার জলদস্যুও। খালি রাজাটাই এখনও হতে পারিনি। মরার আগে একবার সেটা হওয়ার চেষ্টা করে দেখতে হবে।” কোনান মুচকি হাসল। তারপর শরীর টান টান করে পাথরের ওপর শুয়ে পড়ল। “আমি জীবনটা ভালোই কাটাচ্ছি। আমার পায়ের তলায় সর্ষে আছে। কে জানে এই সীমান্তে আমার মন কতদিন টিকবে, এক মাস না এক বছর। তবে যেখানেই থাকি, ভালোই থাকব।”
ব্যালথাস বসে বসে নীচের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল, যে কোনো মুহূর্তে সে পিক্টদের রঙিন চিত্রবিচিত্র অবয়বগুলোকে অরণ্য থেকে দৌড়ে বেরোতে দেখবে। প্রহরের পর প্রহর অতিক্রান্ত হল। কেউ এল না। ব্যালথাস সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে পিক্টেরা তাদের পলায়নের পথ খুঁজে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে অপেক্ষা করে করে কোনান কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিল।
“আমাদের পিছনে তো ওদের আসার কথা ছিল। যদি আমাদের পিছু নেওয়া ওরা ছেড়ে দেয় তবে নিশ্চয়ই ওরা আরও বড়ো মতলব ভাঁজছে। মনে হচ্ছে ওরা দলে দলে জড়ো হচ্ছে নদী পার করে দুর্গ আক্রমণ করবে বলে।”
“আমাদের পালানোর পথ খুঁজে না পেলে ওরা কি আর এত দক্ষিণে আসবে?”
“ওরা আমাদের চলার রাস্তাটা খুঁজে নাও পেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থায় ওরা দল বেঁধে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত। তেমন হলে এতক্ষণে কোনো না কোনো দলকে নীচের ফাঁকা জায়গাটায় দেখতেই পেতাম। নাঃ, ওরা নিশ্চিত নদী পার করার কথা ভাবছে। আমাদেরও নদীর দিকেই যাওয়া উচিত।”
সুতরাং তারা রওনা দিল। সেই উন্মুক্ত প্রস্তরাকীর্ণ প্রান্তর পার হওয়ার সময় ক্ষণে ক্ষণে ব্যালথাসের মনে হচ্ছিল উপর বা নীচের অরণ্যে অপেক্ষারত পিক্টেরা তাদের আক্রমণ করবে। যে কোনো মুহূর্তে অসংখ্য শানিত শায়ক উড়ে আসবে তাদের দিকে। কোনান কিন্তু নিরুদ্বিগ্ন ছিল। সে নিশ্চিত তাদের নিকটে চতুর্দিকে কোনো শত্রু নেই। সিমেরিয়টিই সঠিক প্রমাণিত হল।
“আমরা গ্রামের দক্ষিণ দিকে আরও মাইলখানেক নীচে চলে এসেছি। আমরা এবার সোজা নদীর তীরে যাবো। জানি না ওরা দক্ষিণে কতদূর অবধি ছড়িয়ে আছে। সতর্ক হয়ে যেতে হবে।” কোনান বলল।
এত দ্রুত পূর্বে নদীর দিকে যাওয়াটা ব্যালথাসের বেপরোয়া কাজ বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু কোনানের ধারণা প্রায় সব শত্রুই গ্বাওয়েলাতে সমবেত হয়েছে। এমনকী তারা হয়তো এর মধ্যে নদী পার করেছে। যদিও দিবালোকে নদী পার করা বিপজ্জনক, তবুও।
“ওদের দেখলেই শিকারীরা সাবধান হয়ে যাবে। তাই ওদের একটা অংশ দু-ভাগ হয়ে বেশ কিছুটা উত্তরে আর দক্ষিণে নদী পার করবে যাতে দুর্গের রক্ষীদের নজরে না পড়ে। এরপর বাকি অংশ সরাসরি নদী পার করে আক্রমণ চালিয়ে দুর্গের দেওয়াল ভাঙার চেষ্টা করবে। সেদিকে দুর্গের সৈন্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়লে আগে পার হওয়া দল দুটি দু-দিক থেকে আক্রমণ চালাবে। এটা ওরা আগেও করেছে। সেবারে দুর্গের সৈন্যরা তাদের কচুকাটা করে ছেড়েছিল। কিন্তু এবারে ওদের সংখ্যা অনেক বেশি।” কোনান বলল।
তারা একবারের জন্যেও না থেমে দৌড়চ্ছিল। ব্যালথাস গাছে কয়েকটা কাঠবিড়াল দেখতে পেল। একটু সময় পেলেই সে ক্ষুধার নিরসন করতে পারত। কিন্তু তার সঙ্গী অক্লান্ত। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই ছায়াচ্ছন্ন বনভূমি তাকে ক্রমশ বিষণ্ণ করছিল। হঠাৎই তার ট্যরানের রৌদ্রস্নাত সমভূমি আর উদ্যানের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল তাদের খড়ে ছাওয়া আনন্দময় গৃহের কথা, যার বাতায়নগুলি সূর্যালোকে হীরার মতো ঝলমল করত। স্বাস্থ্যবান গবাদি পশুর দল চরে বেড়াত বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে। সেখানকার হাসিখুশি রাখাল আর পরিশ্রমী কৃষকের দলের জন্য তার হৃদয় ব্যাকুল হচ্ছিল।
পাশে সঙ্গী থাকা সত্ত্বেও তার একাকী লাগছিল। সে এখানে আগন্তুক হলেও কোনান প্রকৃতপক্ষে এই বন্য পরিবেশেরই অংশ। সিমেরিয়টি জগতের বড়ো বড়ো শহরগুলিতে ভ্রমণ করতে পারে, সেখানের অভিজাতদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, এমনকী তার স্বপ্ন অনুযায়ী একদিন হয়তো কোনো রাজ্যের রাজাও হতে পারে, কিন্তু সভ্যতার ক্ষমতা নেই তাকে পরিবর্তন করার। সে চিরকাল বন্য, বর্বর হয়েই থাকবে। সে কেবল জীবনের অপরিহার্য মৌলিক বিষয়গুলোকেই গুরুত্ব দেয়। সম্পর্কের উষ্ণতা, আবেগের সূক্ষ্ম বহিঃপ্রকাশ, ছোটো ছোটো আনন্দ আর ভালো লাগা যা সভ্যতাকে আলোকিত করে, সুরভিত করে, তার কোনো মূল্যই কোনানের কাছে নেই। একটা নেকড়েকে যতই শিকারী কুকুরদের সঙ্গে রাখা হোক, সে শেষপর্যন্ত নেকড়েই থাকে। রক্তপাত, হিংস্রতা, বর্বরতা কোনানের জীবনের স্বাভাবিক অংশ। সে কখনোই সভ্য মানুষের ছোটোখাটো, আপাত তুচ্ছ ভালোবাসার বিষয়গুলোকে কদর করতে পারবে না।
নদীতীরে পৌঁছতে পৌঁছতে ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছিল। যখন তারা অরণ্যের মুখোশ সরিয়ে উপত্যকায় উঁকি দিল তখন সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। নদীখাতের উপর ও নীচের বহুদূর অবধি দেখতে পাচ্ছিল তারা। নদীতট পরিত্যক্ত। প্রবাহিনী কলঙ্কহীনা। অপর পারেও কাউকে দেখা গেল না।
“আমরা গ্বাওয়েলার প্রায় ছয় মাইল দক্ষিণে এসে পড়েছি। এবার আমাদের নদী পার করার চেষ্টা করতে হবে। জানি না এর মধ্যে ওরা নদী পার করেছে কিনা। যে কোনো পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে ওরা লুকিয়ে থাকতেই পারে। কিন্তু ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই একটা ধনুকের টংকারের শব্দ শোনা গেল। কোনান ব্যালথাসকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে নিজেও মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গড়িয়ে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মাথার ওপর দিয়ে সাপের মতো হিস হিস করতে করতে উড়ে গেল একটা তির। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে কোনান এক ক্রুদ্ধ হিংস্র শ্বাপদের মতো উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গিয়ে লাফিয়ে পড়ল একটা বড়োসড় ঝোপের ভিতর। ব্যালথাস তার তরবারির ইস্পাতের ঝলকানি দেখতে পেল আর শুনতে পেল কারো একটা মরণ আর্তনাদ। গোটা ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। সম্বিৎ ফিরতেই সে কোনানের দিকে দৌড়ে গেল।
ঝোপটা পার হতেই সে দেখল একটা পিক্ট মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে, আর জঙ্গল ভেদ করে তাদের দিকে ছুটে আসছে আরও জনা ছয়েক যোদ্ধা। তাদের হাতে কুঠার, তরোয়াল আর লম্বা ছোরা। তারা ধনুক ফেলে দিয়েছিল, কারণ কোনান বিপজ্জনকভাবে তাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। এত নিকটে ধনুক ব্যবহার অসুবিধাজনক। এদের মুখে শ্বেত আলপনা, নগ্ন দেহে নানা রঙের আঁকিবুঁকি। এই বিশেষ গোষ্ঠীকে ব্যালথাস আগে কখনও দেখেনি।
তাদের একজন ব্যালথাসের দিকে কুঠার ছুড়ে মেরে ছুরি উঁচিয়ে তেড়ে এল। ব্যালথাস নীচু হয়ে কুঠারটা এড়াল তারপর ছুরির আঘাত থেকে বাঁচতে আক্রমণকারীর কবজিটা ধরে ফেলল। টান মেরে শত্রুকে মাটিতে ফেলতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে নিজেও পড়ে গেল সে। মাটিতে গড়াতে গড়াতে দুজনেই দুজনকে আঘাত হানার চেষ্টা করছিল। পিক্টটি খুবই শক্তিশালী। তার দেহ যেন লোহা দিয়ে গড়া।
ব্যালথাস এক হাতে বুনো লোকটার কব্জিটা ধরে রেখে অন্য হাতে নিজের কুঠার বের করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু প্রবল ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। পিক্টটা প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করে নিজের ছুরি ধরা হাতটা ছাড়াতে আর ব্যালথাসের হাত যাতে তার কুঠারে পৌঁছাতে না পারে সেই চেষ্টা করছিল। এর সঙ্গে হাঁটু দিয়ে প্রবল আঘাত হানছিল তার পেটে। লড়াইয়ের মধ্যে একসময় তার মুক্ত হাতে ছুরিটা নিতে গেল সে। সুযোগ পেয়ে তৎক্ষণাৎ ব্যালথাস তার কুঠার বের করতে পারল আর সেটা বসিয়ে দিল আক্রমণকারীর মাথায়।
লাফিয়ে দাঁড়িয়ে ব্যালথাস তার সঙ্গীর দিকে চাইল। সে ভেবেছিল কোনান বহু আক্রমণকারীর বিপক্ষে লড়তে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেখানে অন্য কাহিনি রচিত হচ্ছিল। সে বিস্ময়াভিভূত চোখে কোনানের দানবীয় শক্তির বিস্ফোরণ দেখল। এর মধ্যেই দুটি পিক্টের মৃতদেহ তার পায়ের সামনে লোটাচ্ছে। তার চওড়া তরবারির প্রচণ্ড আঘাতে আরেকজনের দেহ সম্পূর্ণ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। তারপর সে মার্জারের ক্ষিপ্রতায় একটা নিক্ষিপ্ত কুঠারের আঘাত এড়িয়ে লাফিয়ে গেল আরেক আক্রমণকারীর কাছে। বন্য যোদ্ধাটি নীচু হয়ে মাটি থেকে একটা অস্ত্র তোলার চেষ্টা করছিল। সে সেই সুযোগ আর পেল না। কোনানের তরবারি তার দেহ এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলল।
তাই দেখে তাকে আক্রমণ করার জন্য দু-দিক থেকে দুটি পিক্ট একসঙ্গে ছুটে এল। এবারে ব্যালথাসের উড়ন্ত কুঠার নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাত হেনে তাদের সংখ্যা এক করে দিল। কোনানের তরবারিটি তার আগের আক্রমণকারীর দেহে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে সেটিকে সে টেনে বের করতে পারছিল না। তাই এবারে সে তার আগ্রাসী শত্রুর ওপর খালি হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক হাতে ছুরি আরেক হাতে কুঠার নিয়ে পিক্টটি আক্রমণ শানিয়েছিল। কিন্তু কোনানের লৌহ বর্ম ছুরির আঘাত প্রতিহত করল। পিক্টটি একই সঙ্গে অন্য হাতের কুঠারটা তার মাথা লক্ষ করে চালিয়েছিল। মুহূর্তে কোনান আক্রমণকারীর কবজি ধরে ফেলে সেটাকে দুমড়ে দিল। মড় মড় করে হাড় ভাঙার শব্দ শোনা গেল। বন্যটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। কুঠার খসে গেল তার হাত থেকে। তারপরই কোনান দু-হাতে তার শত্রুকে শূন্যে তুলে ফেলে এক আছাড় মারল। এত জোরে যে পিক্টটির শরীর মাটিতে ধাক্কা খেয়ে যেন কিছুটা লাফিয়ে উঠল। এরপর আবার মাটিতে পরে খানিক ধড়ফড় করে স্থির হয়ে গেল।
“চলো, যাওয়া যাক।” মৃতদেহ থেকে তরবারিটা গায়ের জোরে টেনে বার করে খাপে রেখে, পড়ে থাকা একটা কুঠার তুলে নিয়ে কোনান বলল। “একটা ধনুক আর কয়েকটা তির তুলে নাও। জলদি চলো। পায়ের ওপরেই ভরসা করতে হবে। এরা এত চেঁচিয়েছে যে অন্যরা এল বলে। আমরা এখানে সাঁতরে নদী পার করতে গেলে তির ছুড়ে আমাদের ঝাঁঝরা করে দেবে।”
রক্তরঞ্জিত রণক্ষেত্র
কোনান ঘন বনমধ্যস্ত পথ না বেছে নদীর নিকটে থাকা পছন্দ করেছিল। বড়োজোর একশো গজ দূর দিয়ে নদীর সমান্তরালে দৌড়াচ্ছিল তারা। ব্যালথাস তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখ দেখে বুঝেছিল, সুযোগ পেলেই সে পিক্ট আক্রমণের সংবাদ দুর্গে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। সামান্য পরেই ব্যালথাস পিছন থেকে চিৎকারের শব্দ শুনতে পেল। বোঝা গেল পিক্টেরা বনে সহযোদ্ধাদের মৃতদেহগুলো আবিষ্কার করেছে। চিৎকারের আওয়াজ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাদের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য আরও যোদ্ধারা সমবেত হচ্ছিল। যেভাবে তারা দৌড়াতে বাধ্য হচ্ছিল, তাতে তাদের পথ অনুসরণ করা মোটেই কঠিন কাজ নয়।
কোনান গতিবেগ বাড়াল। ব্যালথাস দাঁতে দাঁত চেপে তার সঙ্গে তাল রাখার চেষ্টা করছিল। তার হৃৎপিণ্ড বিস্ফারিত হওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছিল সে। মনে হচ্ছিল বহু মাস তার আহার জোটেনি। রক্তস্রোত তার কর্ণপটহে এত জোরে আঘাত করছিল যে তার শ্রবণক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর তার মনে হল, সেজন্যেই সে তাদের অনুসরণকারীদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে না।
কোনান থামল। বেদম ব্যালথাস একটি বৃক্ষকাণ্ডে হেলান দিয়ে হাঁফাচ্ছিল।
“ওরা হাল ছেড়ে দিয়েছে।” রক্তচক্ষু কোনান বলল।
“পি-ছু নি-চ্ছে না?” দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে অতিকষ্টে ব্যালথাস বলল।
কোনান মাথা ঝাঁকাল।
“এত কম দূরত্বের দৌড়ে প্রতি পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা চেঁচাতে থাকে। না, ওরা ফিরে গেছে। একটু আগে অবধিও ওদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি অন্য একটা ডাকও শুনতে পেয়েছি। সেটা শোনার পরই ওরা ফিরে গেছে। এটা আমাদের জন্যে ভালো হলেও বসতির পক্ষে খারাপ। যে লোকগুলোর মুখোমুখি আমরা পড়ে গিয়েছিলাম তারা নদীর নীচের দিকের অঞ্চল থেকে আসছিল। ওরা গ্বাওয়েলাতে জড়ো হচ্ছে। যত এগোচ্ছি, আমরা দুর্গ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। যে করে হোক নদী পার করার একটা উপায় বের করতে হবে।”
অরণ্য ভেদ করে তারা আবার পুবের দিকে ছুটতে শুরু করল। কাঁধে, বুকে সেই পিক্টের কামড়ের আঘাতগুলো ব্যালথাসের শরীরে নতুন করে যন্ত্রণা সৃষ্টি করছিল। সে জঙ্গল সরিয়ে উন্মুক্ত নদীতীরে উপস্থিত হতে যাবে, এমন সময় এক ঝটকায় কোনান তাকে আবার পাতার আড়ালে টেনে নিল। তখন সে খেয়াল করল শান্ত নদীতে নৌকা বাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটা ক্যানো। তার একমাত্র আরোহী স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় বাইছে। আরোহীটি এক শক্তিশালী পিক্ট। তার মাথায় সাদা সারসের পালকের মুকুট, দেহে পালকের পোশাক।
“গ্বাওয়েলার লোক।” কোনান ফিসফিস করে বলল। “জ়োগারের দূত। তাই মাথায় সাদা পালক। নদীর নীচের দিকে গ্রামগুলোতে গিয়েছিল শান্তিপ্রস্তাব দিতে। এখন ফিরছে সবার সঙ্গে যোগ দিয়ে রক্তবন্যা বওয়াতে।”
সেই একাকী নৌচালক তাদের লুকোনোর স্থানের একেবারে কাছে এসে পড়েছিল। তখনই প্রবলভাবে চমকে ব্যালথাস এক লাফে ঝোপ থেকে নদীতীরে বেরিয়ে এল। কারণ হঠাৎ তার কানের একেবারে কাছে একজন পিক্ট প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিল। লাফিয়ে বেরিয়ে আসার পর সে বুঝল আসলে কোনানই পিক্টদের কর্কশ ভাষায় চিৎকারটা করেছিল। সেটা শুনে নৌচালক পশ্চিম তীরের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, তারপর ঝুঁকে পড়ে দ্রুত দাঁড় বেয়ে আসতে লাগল পাড়ের দিকে। কিচ্ছু না বুঝে ব্যালথাস হতবাক হয়ে পিছনে তাকাল। পাতার ফাঁক দিয়ে সে দেখল কোনান ঝোপের আড়ালে থেকে তার ফেলে আসা ধনুকে শরসন্ধান করছে।
পিক্টটি তীরের একবারে নিকটে এসে চিৎকার করে কিছু বলল। এবার তার জবাব এল ধনুকের টংকারে। একটা কালো সাপের মতো হিলহিলে তির উড়ে এসে পালকের পোশাক ভেদ করে তার বুকে ডুবে গেল। একটা আর্তচিৎকার করে পিক্ট যোদ্ধাটি অগভীর জলের মধ্যে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কোনান ঝোপের আড়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে নদীতে ঝাঁপিয়ে, ভেসে যাওয়া ক্যানোটাকে ধরে পাড়ে টেনে আনতে লাগল। ব্যালথাস আচ্ছন্নের মতো তার পিছন পিছন এসে নৌকাতে চড়ে বসল।
কোনানও ক্যানোতে চড়ে বসে সবল হাতে দাঁড় বাইতে শুরু করেছিল। ব্যালথাস তার দিকে শ্রদ্ধা মিশ্রিত চোখে চেয়ে ছিল। সে যেন এক লৌহ মানব। ক্লান্তি শব্দটা তার অভিধানে নেই।
“তখন কী বলে চেঁচালে তুমি?” সে কোনানকে জিজ্ঞেস করল।
“বলেছিলাম ‘একজন সাদা ফেরারি বন্দি তোমার দিকে তির ছোড়ার চেষ্টা করছে। দ্রুত পাড়ে নৌকা ভিড়িয়ে তাকে ধরতে সাহায্য করো।’ ”
“এটা কী উচিত কাজ হল?” ব্যালথাস প্রতিবাদ জানাল। “ও ভেবেছিল একজন বন্ধু ওকে ডাকছে। এ তো ছলনার সাহায্য নেওয়া।”
“ওর নৌকোটা আমাদের দরকার ছিল।” দাঁড় বাইতে বাইতে রাগত স্বরে কোনান বলল। “কোনটা ভালো? আমাদের জ্যান্ত চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া, ওপারে যাদের জীবন আমাদের ওপরে নির্ভর করে আছে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা, নাকি একজন পিক্টকে ধোঁকা দেওয়া?”
ব্যালথাস চুপ করে এই দ্বন্দের সমাধান কী হতে পারে তা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল,
“দুর্গ থেকে কতদূরে আছি আমরা?”
কোনান একশো গজ মতো দূরের একটি খাঁড়ির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল। সেটি পুব থেকে প্রবাহিত হয়ে নদীতে মিশেছে।
“দক্ষিণের খাঁড়ি।” সে বলল। “ওটা কোনাজোহারার দক্ষিণ সীমা। দুর্গ ওটা থেকে দশ মাইল দূরে। ওটার দক্ষিণে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু জলাভূমি আর বাদাবন। কাজেই ও দিক থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দুর্গের উত্তরে ন মাইল দূরে উত্তরের খাঁড়ি। তার ওপারেও শুধু জলাভূমি। তাই আক্রমণটা কেবল পশ্চিম দিক থেকে, কৃষ্ণা নদী পার করেই আসতে পারে। কোনাজোহরা যেন একটা উনিশ মাইল চওড়া বর্শার ফলা, পিক্টদের বুনো রাজত্বের বুকে গেঁথে রয়েছে।”
কোনান খাঁড়ির গা ঘেঁষে পূর্ব পারে তরী ভেড়াল।
“এখানে নামবো কেন? নদী বেয়ে তো আরও কিছুটা এগোতে পারতাম।” ব্যালথাস বলল।
“স্রোতের উলটোদিকে উঠতে সময় বেশি লাগত। দৌড়ে অনেক তাড়াতাড়ি যাবো। এছাড়া গ্বাওয়েলা দুর্গের কিছুটা দক্ষিণে অবস্থিত। ওরা হয়তো এখন নদী পার করছে। ওদিকে গেলে আবার ওদের সামনে পড়ে যাব।”
সন্ধ্যা ঘনাচ্ছিল। পূর্ব পাড় জলপাই রঙের অন্ধকারে ঢাকা পড়ছিল ক্রমশ। কোনান অবিরাম ছুটে চলেছিল উত্তরের দিকে। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে পা ব্যথা করছিল ব্যালথাসের।
“ভ্যালানাস চেয়েছিল নদীর সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ খাঁড়ির সংযোগস্থলগুলোতে দুর্গ বানানো হোক। তাতে গোটা অঞ্চলটায় নজর রাখা যেত। কিন্তু মন্ত্রীরা ওর কথাতে পাত্তা দিল না।” দৌড়তে দৌড়তে রাগে গজগজ করল কোনান। “ভুঁড়িওলা গাধার দল। ওদের থাইয়ের ওপর বসে আদুল গায়ের মেয়েরা মুখের সামনে বরফ ঠান্ডা মদ বাড়িয়ে ধরে, আর ওরা তাতে চুমুক দিতে দিতে সিদ্ধান্ত নেয়। আমি এই জাতটাকে খুব ভালো করে চিনি। ওরা ওদের প্রাসাদের বাইরে কোনো কিছুকেই গুরুত্ব দেয় না। কুটনীতি! নরকে যাক ওদের কুটনীতি। ওরা কীভাবে দেশ জয় করা উচিত তা নিয়ে বড়ো বড়ো বাতেলা মারবে আর ভ্যালানাসের মতো যোদ্ধারা তাদের কথা মেনে চলতে বাধ্য হবে। ওরা আর উপনিবেশটা বাড়ানোর দিকেও নজর দেবে না, সেটার সুরক্ষার ব্যবস্থাও ঠিকমতো করবে না। ওরা বোধহয় বসে আছে কবে বুনোরা বন্যার জলের মতো ঢুকে গোটা বসতিকে ছারখার করে দেবে সেটা দেখার জন্য।”
এক সপ্তাহ আগেও ব্যালথাস এমন একটা আশংকাকে হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু এখন সে কোনো জবাব দিল না। সীমানার ওপারে সে মানুষের অবর্ণনীয় হিংস্রতা দেখে এসেছে। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে সে ওই কৃষ্ণবর্ণ মৃত্যুর মতো শান্ত প্রবাহিণীকে দেখে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠল। পাড়ের প্রাচীন বৃক্ষের শাখাপ্রশাখা প্রেতের মতো হাত বাড়িয়েছে নদীর দিকে। ব্যালথাসের মনে হল এতক্ষণে নিশ্চয়ই পিক্টেরা নদী পার করছে। কোন বৃক্ষশাখে তারা আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছে তা কে জানে। দ্রুত অন্ধকার গাঢ়তর হচ্ছিল।
হঠাৎ তাদের সামনে একটা সন্দেহজনক আওয়াজ তাদের থমকে দিল। ব্যালথাস এতটাই চমকেছিল যে তার হৃৎপিণ্ড যেন গলার কাছে এসে আটকে গেল। কোনানের তরবারি কোশমুক্ত হয়ে সেই স্বল্প আলোতেই ঝলসে উঠল। সেটা আবার কোশবদ্ধ হল যখন তারা দেখল, একটি বড়োসড়ো, রুক্ষ চেহারার, ক্ষতচিহ্ন রেখাঙ্কিত সারমেয়, তাদের সামনে এসে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
“আরে, এ তো স্ল্যাশার!” কোনান বলল। “ওর মালিক দুর্গ থেকে অনেকটা দক্ষিণে বাড়ি বানিয়েছিল। একদিন পিক্টেরা ওর বাড়ি আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দেয়। লোকটাকে খুন করে। কুকুরটাকে আমরা অজ্ঞান অবস্থায় পাই। তিনটে পিক্টকে মেরে ফেলতে পেরেছিল ও। চোট আঘাতে তখন ওর অবস্থাও মর মর। আমরা ওকে দুর্গে নিয়ে সেবা শুশ্রূষা করে বাঁচিয়ে তুলি। সেরে উঠে ও যেন আরও হিংস্র হয়ে যায়। ওকে বনে ছেড়ে দিতে হয়। কিরে স্ল্যাশার, এখনও মালিকের খুনিদের শিকার করে বেড়াচ্ছিস?” কোনানের কণ্ঠস্বরে স্নেহ ঝরে পড়ল। স্ল্যাশার কী বুঝল কে জানে, তার মাথাটা একটু দুলল, বন্য আগুন ঝিকিয়ে উঠল তার সবুজ দুটি চোখে। কুকুরটা একবারের জন্যেও ডাকছিল না। সে নিঃশব্দে কোনানদের অনুসরণ করতে লাগল।
“ওকে আসতে দাও।” কোনান বলল, “আমাদের আগেই ও শয়তানের গন্ধ পাবে।”
ব্যালথাস মৃদু হেসে আদর করার জন্য কুকুরটার মাথায় হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটি দু-পা পিছিয়ে গিয়ে তার দ্রংষ্টা বের করল। সামান্য গরগর শব্দ শোনা গেল তার গলায়। লেজটির দোলনে সংশয় আর অনিশ্চয়তা প্রকাশ পাচ্ছিল। কুকুরটি যেন বিশ্বাস আর বন্ধুত্বের অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিল। খারাপ লাগল ব্যালথাসের। নিজের বাড়ির মোটাসোটা, আদুরে, বিশ্বাসী পোষা কুকুরগুলোর কথা মনে পড়ে গেল তার। এই হিংস্র সংগ্রামমুখর প্রদেশ সব প্রাণীর সুস্থ বোধগুলো যেন কেড়ে নিচ্ছে।
স্ল্যাশার এগিয়ে গেল। কোনানও তাকে বাধা না দিয়ে অনুসরণ করল। দিবার শেষ আলোটুকুকেও সবুজ অন্ধকার শুষে নিচ্ছিল। মাইল খানেক পার করল তারা। স্ল্যাশারের মতো তারাও নিঃশব্দে পথ চলছিল। এমন সময় কুকুরটি থমকে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে কী যেন শুনতে লাগল। তারাও দুজনে দাঁড়িয়ে একটু চেষ্টা করতেই শুনতে পেল সেই রণহুংকার। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে বলে তা মৃদু কিন্তু সুস্পষ্ট।
“ওরা দুর্গ আক্রমণ করেছে। আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। জলদি।” পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল কোনান।
দৌড়ের গতি বাড়াল সে। কোনো সাবধানতা অবলম্বন না করে অতর্কিত আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সে স্ল্যাশারের ঘ্রাণশক্তির ওপর নির্ভর করে দৌড়চ্ছিল। এক টানটান উত্তেজনার বন্যা ব্যালথাসেরও ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যন্ত্রণা সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। যত তারা এগোচ্ছিল, চিৎকারের শব্দ তত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বন্যদের সেই হিংস্র গর্জন ছাপিয়ে ভেসে আসছিল সৈন্যদের রণহুংকার। যখন ব্যালথাস ভাবছিল এবারে তারা অসভ্য, নিষ্ঠুর শত্রুদের মুখোমুখি হতে চলেছে, কোনান নদীপাড় ছেড়ে একটা অর্ধবৃত্তাকার পথ ধরল। সেই পথ ধরে তারা পৌঁছল টিলার মতো এক উচ্চ স্থানে। সেখান থেকে দুর্গটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।
দুর্গপ্রাকারের ওপরে নজরপথে বহু মশালের ছোটাছুটি দেখা গেল। উচ্চ স্তম্ভগুলিতেও জ্বলে উঠেছিল মশাল। এতে দুর্গের বাইরের উন্মুক্ত স্থানে আলোছায়ার আঁকিবুঁকি সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে দেখা গেল অসংখ্য নগ্ন, রঙিন উল্কি রঞ্জিত অবয়বকে। কৃষ্ণা নদী ক্যানোর ঝাঁকে পরিপূর্ণ। পিক্টেরা দুর্গকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।
নদী এবং চারপাশের জঙ্গল থেকে বৃষ্টির মতো তির উড়ে গিয়ে পড়ছিল দুর্গের ওপর। একসময় নেকড়ের মতো সমবেত চিৎকার করে অরণ্য থেকে সশস্ত্র পিক্টের এক বিরাট দল ছুটে গেল পূর্ব দেউড়ির দিকে। তারা লক্ষ্যের এক দেড়শো গজের মধ্যে পৌঁছান মাত্র সুরক্ষা স্তম্ভগুলো থেকে বহু ধনুর সমবেত টংকারধ্বনি শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে শরবৃষ্টি অনেক বন্য সৈন্যকে ধরাশায়ী করল। অবিন্যস্ত যোদ্ধারা আবার ছুটে পালিয়ে বনের আড়ালে আশ্রয় নিল। কেল্লার সৈন্যরা উল্লাসে চিৎকার করে উঠল।
নদীর দিক থেকে ক্যানোতে করে দুর্গ প্রাকারের ওপর হামলা চালিয়েছিল পিক্টেরা। তাদের ছোড়া তির ও পাথরে দুর্গের ভিতরেও বহু সৈন্য হতাহত হচ্ছিল। একসময় দুর্গ থেকে পাথর ছোড়া যন্ত্রগুলো তাদের ক্ষেপনাস্ত্রের সাহায্যে আধ ডজন ক্যানোকে একসঙ্গে ডুবিয়ে দিল। সেগুলোর সওয়ারীরা সঙ্গে সঙ্গে নিহত হল। আবার উল্লাসধ্বনি ভেসে এল দুর্গের ভিতর থেকে। কিন্তু সে শব্দ দুর্গের চারদিক ঘিরে রাখা দুর্দান্ত বন্যদের সমবেত হিংস্র গর্জনে চাপা পড়ে গেল।
“আমরা কি অবরোধ ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করব?” উৎসাহী ব্যালথাস জিজ্ঞেস করল।
গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল কোনান। বুকের কাছে দু-হাত ভাঁজ করে, ঘাড় কাত করে সে একমনে দৃশ্যটা দেখে চলেছিল। তারপর দুঃখ জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“দুর্গ রক্ষা করা যাবে না। পিক্টগুলো এত ক্ষেপে উঠেছে যে যতক্ষণ না সব ক-টা মরছে ওরা যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়বে না। আর এবারে এত এসেছে যে কেল্লার রক্ষীদের পক্ষে ওদের শেষ করা সম্ভব নয়। আমরা যদি কোনোক্রমে ঢুকেও পড়তে পারি, ভ্যালানাসের সঙ্গে আমরাও মারা পড়ব।”
“তাহলে নিজেদের প্রাণ বাঁচানো ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই?”
“আছে। আমাদের বসতির বাসিন্দাদের বাঁচাতে হবে। একটা জিনিস খেয়াল করেছ, পিক্টেরা অগ্নিবাণ ছুড়ছে না। ওরা এখনি কেল্লায় আগুন লাগাতে চাইছে না। কারণ আগুন লাগলে তার আভা বহুদূর অবধি দেখা যাবে। তাতে পুবের বসতির লোকেরা সাবধান হয়ে যাবে। ওদের পরিকল্পনা হল আগে দুর্গ ধ্বংস করে তারপর পুবে আক্রমণ চালানো। ওরা বজ্র নদী পার করে ভেলিট্রিয়ামেও আক্রমণ চালাতে পারে। নিদেনপক্ষে কৃষ্ণা আর বজ্র নদীর মাঝে সব ক-টা সভ্য মানুষকে খতম করার চেষ্টা তো ওরা করবেই।
“আমরা কেল্লায় সময়মতো সাবধান হওয়ার খবরটা পৌঁছে দিতে পারলাম না। অবশ্য পৌঁছে দিলেও কোনো লাভ হত না। দূর্গে লোকসংখ্যা কম, সেটা ঠিকমতো দেখাশোনাও করা হয় না। আর কয়েকবার আক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়লেই দেওয়ালটা ভেঙে পড়বে। কিন্তু আমরা ওদের আক্রমণের বৃত্তের বাইরে আছি। আমরা উপনিবেশের সবাইকে সাবধান করে তাদের ভেলিট্রিয়ামে পৌঁছে দিতে পারি। চলো।”
তারা একটা দীর্ঘ বিকল্প বক্র পথে অগ্রসর হল। যেতে যেতে তারা আক্রমণ এবং পিছু হটার সময়ে উৎপন্ন নান্দীরোলের ঢেউয়ের মতো ওঠাপড়া শুনতে পাচ্ছিল। কেল্লার সৈন্যরা গড় রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল, কিন্তু তাতে হিংস্র শত্রুর উৎসাহে কোনো ভাঁটা পড়ছিল না। তারা সংখ্যায় বিপুল। তাদের গর্জনে নিশ্চিত বিজয়ের সুর শোনা যাচ্ছিল। অনতিবিলম্বে ব্যালথাসরা পুবের রাস্তা ধরল।
“দৌড় শুরু করো।” কোনান বলল।
দাঁতে দাঁত চাপল ব্যালথাস। ভেলিট্রিয়াম এখান থেকে উনিশ মাইল দূরে। করোটি খাঁড়ির দূরত্ব পাক্কা পাঁচ মাইল। সেখান থেকেই বসতি শুরু। তার মনে হল সে যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দৌড়ে আর লড়াই করে চলেছে। কিন্তু তার স্নায়ুর মধ্যে দিয়ে যে প্রবল উত্তেজনার স্রোত বয়ে চলেছিল তাই তাকে এমন হারকিউলিশ সদৃশ সামর্থের অধিকারী করে তুলেছিল।
স্ল্যাশার তাদের সামনে মাটি শুঁকতে শুঁকতে ছুটে চলেছিল। প্রথম সাবধানতার সংকেত তারা তার কাছ থেকেই পেল।
“সামনে পিক্ট।” কোনান হিসহিস করে উঠল। তারপর ঝুঁকে পড়ে পথের মাঝের পদচিহ্নগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করল। “কতজন বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে একটা ছোটো দল। কেল্লার পতন অবধি অপেক্ষা করতে পারেনি। তার আগেই বেরিয়ে পড়েছে ঘুমন্ত বাসিন্দাদের খুন করার জন্য। চলো।”
একটু অগ্রসর হতেই তারা অরণ্যের ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা দেখতে পেল, আর শুনতে পেল কর্কশ গলায় বন্য, হিংস্র সংগীত। পথ বেঁকে গিয়েছিল। তারা পথ ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সাবধানে অগ্রসর হল আলো লক্ষ করে। সামান্য এগোতেই তারা এক জঘন্য দৃশ্য দেখতে পেল। আসবাবপত্রে পূর্ণ একটি গো-শকট দাউদাউ করে জ্বলছে। তার পাশেই দুটি বৃষ নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। তাদের ছিন্ন গ্রীবা থেকে বেরিয়ে আসা রক্তধারা মাটি ভিজিয়ে দিচ্ছে। তার পাশেই একটি পুরুষ ও একটি নারীর বিবস্ত্র বিকৃত মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। তাদের ঘিরে রক্তমাখা কুঠার হাতে একদল পিক্ট উল্লাসে নৃত্য করছে। তাদের একজন আবার শরীরে নারীর রক্তমাখা পোশাকটি জড়িয়ে নিয়েছে।
শরীরের সব রক্ত যেন ব্যালথাসের চোখে এসে জমা হয়েছিল। দাঁতে দাঁত ঘষে সে হাতে ধনুক নিয়ে তাতে শর যোজনা করল। তার লক্ষ্য ছিল মেয়েদের পোশাক জড়ানো আগুনের পাশে উন্মাদের মতো নাচতে থাকা কালচে শরীরটা। কান পর্যন্ত জ্যা টেনে সমস্ত ঘৃণা মাখিয়ে তিরটাকে ছাড়ল সে। সেটা পিক্টটার হৃৎপিণ্ড এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল। মরণ আর্তনাদ করে সে তৎক্ষণাৎ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর দুটো মানুষ আর একটি সারমেয় বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল হতচকিত উত্তরজীবী বুনোগুলোর ওপর।
ব্যালথাস তার তলোয়ার এত জোরে চালালো যে একটা পিক্টের ধড় থেকে মুণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সেই পতনরত মৃতদেহের উপর দিয়ে লাফিয়ে সে অন্য দুটো বুনোর দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু সে পৌঁছতে পৌঁছতে কোনান তাদের একজনকে হত্যা করে ফেলেছিল। ব্যালথাস দ্বিতীয়টির দিকে তার কুঠার তুলতে না তুলতে কোনানের দীর্ঘ তরবারি তার বক্ষ বিদীর্ণ করল। হাহাকার করে লুটিয়ে পড়ল সেই শয়তান।
শেষ পিক্টটির দিকে ঘুরে ব্যালথাস দেখল যে সে মাটিতে পড়ে আছে। তার বুকের ওপর দু-পা রেখে রক্তঝরা মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্ল্যাশার। সে কামড়ে তার টুঁটি ছিঁড়ে নিয়েছে।
পথের মাঝে হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা দেখে ব্যালথাস যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। পিক্টদের আক্রমণে নিহত নারী পুরুষ দুটির বয়স খুবই কম। মেয়েটিকে তো বালিকাই বলা চলে। যে কোনো কারণেই হোক না কেন তার আননটি অবিকৃতই ছিল। ভীতি, অত্যাচারের যন্ত্রণা, মৃত্যুর সব চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও সেটি সুন্দর। কিন্তু তার শরীর জুড়ে অজস্র অস্ত্রের আঘাত। ব্যালথাসের অশ্রু ক্রোধের আগুনে বাষ্পীভূত হচ্ছিল। এক অসহনীয় দুঃখবোধ ও ক্লান্তি তাকে গ্রাস করছিল। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার ইচ্ছে হচ্ছিল তার।
“এই কমবয়েসি বরবউ দেখছি দুর্গে যাবে বলে একলাই বেরিয়ে পড়েছিল।” কোনান ভাবলেশহীন মুখে তরবারির রক্ত মুছতে মুছতে বলল। “পথে পিক্টগুলোর সঙ্গে ওদের দেখা হয়ে যায়। হয়তো ছেলেটা সৈন্যদলে নাম লেখাত। হয়তোবা নেহাতই ঘর বাঁধত। যাইহোক, আমরা সময়মতো ব্যবস্থা না নিতে পারলে বজ্র নদীর এপারের ছেলে, মেয়ে, বাচ্চা, বুড়ো সব্বার একই হাল হবে। চলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের ভেলিট্রিয়ামে পৌঁছে দিতে হবে।”
সিমেরিয়টির পিছনে দৌড়তে দৌড়তে ব্যালথাসের হাঁটু কাঁপছিল। কিন্তু কোনান ক্লান্তিহীন। ব্যালথাস ও এই বর্বরটির মধ্যে এক অব্যক্ত সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল। সম্মুখের রাস্তায় তেমন কোনো বিপদের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছিল না। দূর্গ থেকে ভেসে আসা লড়াইয়ের আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছিল। ব্যালথাসের অবশ্য ধারণা ছিল যে রক্ষীরা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই দিব্যি গেলে কোনান থমকে দাঁড়াল।
মূল সড়ক ছেড়ে একটা সরু পথ উত্তরের দিকে চলে গেছে। দেখে বোঝা যায় রাস্তাটায় বিশেষ লোকচলাচল করে না। পথের মাঝে ছোটো ছোটো চারাগাছ জন্মেছিল। কিন্তু সেগুলো আপাতত পদদলিত। আবছায়াতে এসব ব্যালথাস বিশেষ দেখতে পাচ্ছিল না। কোনানের নির্দেশে তাকে ছুঁয়ে বুঝতে হচ্ছিল। সিমেরিয়টি যেন মার্জার চক্ষু বিশিষ্ট। অন্ধকারে সব কিছু দেখতে পায়। সে তাকে এটাও দেখালো যে পথে গো-শকট যাওয়ার গভীর চিহ্ন পড়েছে।
“বসতির লোকেরা নুন বানাতে নোনতা মাটির খোঁজে গেছে।” গজগজ করল কোনান। “জলার ধারে কোথাও একটা ওরা তাঁবু খাটাবে। জলা এখান থেকে অন্তত ন-মাইল দূরে তো হবেই। ওদের পেলে পিক্টেরা একেবারে কচুকাটা করে ফেলবে। শোনো, তুমি মূল রাস্তা ধরে গিয়ে বসতির লোকেদের সাবধান করো। আমি বাকিদের খোঁজে জলার দিকে যাচ্ছি। আমাদের জন্যে অপেক্ষা কোরো না। সবাইকে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ভেলিট্রিয়ামের দিকে রওনা দিও। আমরা জঙ্গলের পথে পৌঁছে যাবো।”
কথাগুলো বলেই কোনান সেই অন্ধকারাবৃত সরু পথ ধরে দ্রুতপদে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ সেদিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ব্যালথাস মূল সড়ক ধরে রওনা দিল। কুকুরটি তার সঙ্গেই ছিল। সেটিও নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করল।
কয়েক পা এগোতেই ব্যালথাস পিছন থেকে একটা ভয়ংকর চাপা গর্জন শুনতে পেল। ঝটিতি ঘুরে দাঁড়াতেই সে দেখতে পেল এক নীলাভ সবুজ আলোর প্রভা কোনান যে পথে গিয়েছিল, সে পথে অদৃশ্য হয়ে গেল। স্ল্যাশারে কণ্ঠের গভীর থেকে একটা ঘড়ঘড়ে ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। তার রোম খাড়া, সবুজ চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছিল। ব্যালথাসের মনে পড়ল এই স্থানের নিকটেই টিবেরিয়াসের মুণ্ড ছিন্ন করেছিল ভয়ানক জলার পিশাচ। দানবটা কোনানকে অনুসরণ করছে? সে একটু ইতস্তত করল। তার কি কোনানের কাছে গিয়ে তাকে সাবধান বা সাহায্য করা উচিত? কিন্তু সে সিমেরিয়টির সক্ষমতা ও শৌর্যের যে পরিচয় পেয়েছে তাতে তার অন্য কারো সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এ ছাড়া নিরীহ বসতিস্থাপনকারীরা এক রক্তাক্ত ঘুর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হতে চলেছে। তাদের বাঁচাতে সেখানে তার নিজের উপস্থিতি বেশি প্রয়োজনীয়। নীলাভ আভার পিশাচের ভয়াবহতার চেয়ে পথে পড়ে থাকা যুবক যুবতীর রক্তস্নাত দেহ দুটির ভয়াবহতার স্মৃতি তাকে বেশি নাড়া দিল। সে ছুটতে শুরু করল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে করোটি খাঁড়ি পার করে প্রথম খামার বাড়িটার সামনে দাঁড়াল। বাড়িটা দীর্ঘাকার, কুঠারে কাটা কাঠ দ্বারা নির্মিত। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ব্যালথাসকে প্রবলভাবে দরজা ধাক্কাতে শোনা গেল। ভিতর থেকে একটা ঘুমজড়ানো কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
“এক্ষুনি উঠুন। পিক্টেরা নদী পার করে আক্রমণ করতে আসছে।” সে চাপা গলায় বলে উঠল।
কথাগুলো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। ভিতর থেকে একটা আর্তনাদ শোনা গেল আর সঙ্গে সঙ্গেই সশব্দে দরজাটা খুলে সেখানে এসে দাঁড়াল এক বিস্রস্ত বেশের মহিলা। তার এলোমেলো চুল এসে পড়েছে খোলা কাঁধের ওপর। তার একহাতে একটি মোমবাতি, অপর হাতে কুঠার। তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখ ভয়ে বিস্ফারিত।
“ভিতরে আসুন।” সে অনুনয়ের সুরে বলল, “আমরা ঘরের ভিতরে থেকে ওদের ঠেকিয়ে রাখব।”
“না, আমাদের এক্ষুনি ভেলিট্রিয়ামের দিকে রওনা দিতে হবে। দুর্গটাকে পর্যন্ত রক্ষা করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। এতক্ষণে বোধহয় সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে। পোশাক বদলানোর সময় নেই। ছেলে, মেয়ে যারা যারা আছে সবাইকে নিয়ে এখনি বেরিয়ে পড়ুন।”
“কিন্তু ওদের বাবা তো অন্যদের সঙ্গে নুন আনতে গেছে।” মহিলা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। তার পিছন থেকে তিনটি ছোটো ছোটো বাচ্চা গোল গোল চোখে উঁকি দিচ্ছিল।
“কোনান ওদের সাবধান করতে গেছে। ওরা অন্য রাস্তায় ফিরবে। আমাদের যত দ্রুত সম্ভব বাকি বাড়িগুলোতে খবর দিতে হবে।”
ব্যালথাসের কথা শুনে মহিলা স্বস্তি পেল।
“মিত্রার জয় হোক। সিমেরিয়টি গেছে মানে আর কোনো চিন্তা নেই। একজনও যদি ওদের বাঁচাতে পারে, তাহলে কোনানই পারবে।” সে চেঁচিয়ে উঠল। ঝড়ের গতিতে সে সবচেয়ে ছোটো বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে বাকি দুটোকে ঠেলে, বাইরে বের করে আনল। ব্যালথাস তার হাত থেকে মোমবাতিটা নিয়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে রগড়ে সেটাকে নিভিয়ে ফেলল। তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে শোনার চেষ্টা করল কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা। সন্দেহজনক তেমন কিছু শুনতে না পেয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের ঘোড়া আছে?”
“আস্তাবলে। তাড়াতাড়ি চলুন।”
অশ্বশালার দরজা খোলার সময় মহিলার হাত এত ঠকঠক করে কাঁপছিল যে অহেতুক দেরি হচ্ছিল। ব্যালথাস তাকে সরিয়ে নিজেই ঘোড়াটাকে বের করে আনল, তারপর বাচ্চাগুলোকে বসালো সেটার ওপর। সামনে বসা বড়োটাকে বলল শক্ত করে ঘোড়ার কেশর ধরে রাখতে। বাকি দুটোকে বলল তাদের সামনের জনকে জড়িয়ে ধরতে। তারা ভয়ে ভয়ে গোটা পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কান্নাকাটি করল না। মহিলাটি ঘোড়ার লাগাম হাতে নিতে তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তার অপর হাতে তখনও কুঠার ধরা। ব্যালথাস জানত প্রয়োজন হলে সন্তানদের বাঁচাতে সে এক মেয়ে প্যান্থারের মতোই লড়াই করতে প্রস্তুত।
ব্যালথাস পিছনে পিছনে হাঁটছিল। কেল্লা থেকে ভেসে আসা আর কোনো শব্দ পাচ্ছিল না সে। এতক্ষণে তার মনে হচ্ছিল দুর্গের পতন হয়েছে। মন খারাপ হয়ে ছিল তার। সে বুঝেছিল রক্তলোলুপ, খুনের নেশায় মত্ত নোংরা বুনোগুলো জঙ্গলে আর ভেলিট্রিয়ামের রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো তারা এদিকে ছুটে আসছে।
কিছুদূর হাঁটতেই আরেকটা কুটির দেখতে পেল তারা। মহিলা তাদের চিৎকার করে ডাকতে উদ্যত হয়েছিল। ব্যালথাস তাকে থামাল, তারপর দ্রুতপায়ে গিয়ে কুটিরের দরজা ধাক্কাল। ভিতর থেকে একটা মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল। ব্যালথাস তাকে তার আসার কারণ জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই ভিতর থেকে আতংকিত বাসিন্দারা বেরিয়ে এল। এক বৃদ্ধা, দুটি যুবতী, চারটে বাচ্চা। তাদের বাড়ির পুরুষেরাও বিপদের আশংকা না করে একদিন আগে নুন আনতে গেছে। ব্যালথাসের কাছ থেকে সব শুনে যুবতী দুটির একটি ভয়ে জ্ঞান হারাল। অপরটি স্নায়ুরোগের রুগীর মতো আচরণ করতে শুরু করল। কিন্তু জীবন যুদ্ধে অভিজ্ঞ সেই বৃদ্ধাটি কঠোর হয়ে দ্রুত তাদের স্বাভাবিক করলেন। তারপর বাড়ির পিছনের আস্তাবল থেকে দুটি ঘোড়া বের করে তাতে শিশুদের চাপাতে ব্যালথাসকে সাহায্য করলেন তিনি। ব্যালথাস তাঁকে অশ্বারোহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল; কিন্তু তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে, রাজি না হয়ে একটি যুবতীকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘোড়াটায় চাপালেন।
“ও পোয়াতি।” সিংহীর মতো গরগর করলেন প্রবীণা। “আমি হাঁটতে পারব। দরকারে লড়তেও পারব।”
তারা হাঁটতে শুরু করার পর একজন যুবতী বলল, “আজ সন্ধেবেলা এক কমবয়েসি দম্পতি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা বললাম, আঁধার ঘনাচ্ছে, তোমরা আজ রাতটা আমাদের বাড়িতেই কাটিয়ে যাও। ওরা রাজি হল না। বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুর্গে পৌঁছতে চায়। ওদের কোন খবর…।”
“ওদের সঙ্গে পিক্টগুলোর দেখা হয়েছিল।” কঠিন মুখে ব্যালথাস বলল। কথাটা শুনে যুবতীটি আতংকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
সবে কুটিরটা তাদের চোখের আড়াল হয়েছে, এমন সময় বেশ কিছুটা দূর থেকে একটা তীব্র, তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল।
“নেকড়ে।” একটি মেয়ে বলল।
“মুখে আর গায়ে রঙ মাখা।” পাথরের মতো মুখ করে ব্যালথাস বলল। “আপনারা এগিয়ে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্যদের খবর দিন। আমি খানিকটা পিছনে থাকব পাহারা দেওয়ার জন্য।”
কোনো কথা না বলে একটা ঘোড়ার লাগাম ধরে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা গোটা দলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারা যখন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল, ব্যালথাস দেখল বাচ্চাগুলো ঘাড় ঘুরিয়ে নির্নিমেষ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মুখগুলো দেখে মনে হল যেন অনেকগুলো মিষ্টি কিন্তু ভীতু চাঁদ নেমে এসেছে মাটিতে। তার ট্যরানের কথা, বাড়ির কথা, পরিবারের কথা মনে পড়ল। এক হতাশা, দুঃখ, মনখারাপ, ব্যাধির মতো তাকে চেপে ধরল। সে আর পারছিল না। অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়ছিল পথের উপর। তখনই তার হাত স্ল্যাশারের চওড়া গ্রীবার ওপর এলিয়ে পড়ল। সে মুখের ওপর তার ভিজে জিবের স্পর্শ পেল।
কিছুক্ষণ পর সে কোনক্রমে তার ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে দাঁড় করাল আর স্ল্যাশারের দিকে চেয়ে একটা ক্লিষ্ট হাসি হেসে বলল,
“চলো বন্ধু, আমাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি।”
সামান্য পরেই গাছপালার আড়াল থেকে আগুনের লাল হলকা দেখতে পাওয়া গেল। পিক্টেরা নিকটতম শেষ কুটিরটাতে অগ্নিসংযোগ করেছে। এত কষ্টেও হাসি পেল তার। জ়োগার স্যাগ ক্ষেপে লাল হয়ে যাবে যদি সে জানতে পারে তার অতি উৎসাহী অনুচররা কী কাণ্ড করেছে। এই আগুন দূরবর্তী বসতি স্থাপনকারীদের সাবধান করে দেবে। কিন্তু তার পরেই দুশ্চিন্তা তার মনকে ভারী করে দিল। পায়ে হাঁটার ফলে আর ঘোড়াগুলোতে অত্যধিক সওয়ার থাকার জন্য মহিলারা খুব ধীরে চলেছে। দ্রুতগামী পিক্টগুলো এক মাইল এগোলেই তাদের ধরে ফেলবে, যদি না…।
পথের ধারে বেশ কয়েকটা গাছের গুঁড়ি স্তূপাকার হয়ে পড়ে ছিল। সে তার পিছনে আশ্রয় নিল। কুটিরের আগুন পথের পশ্চিম প্রান্তকে আলোকিত করেছিল। ফলে বুনোগুলো যখন সে পথে এল ব্যালথাস তাদের কৃষ্ণবর্ণ চেহারাগুলো পরিষ্কার দেখতে পেল।
ধনুকের জ্যা-টাকে যতটা সম্ভব টেনে সে প্রথম তির ছুড়ল। একটা কালো শরীর একতাল কাদার মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আর বাকিরা সঙ্গে সঙ্গে দু-পাশের ঝোপে, জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। তারপর এক দীর্ঘ নিস্তব্ধতা। মুহূর্তগুলোকে অনন্ত মনে হচ্ছিল। তার পাশে স্ল্যাশারের চাপা গর্জন শুনে ব্যালথাস বুঝতে পারছিল সে আক্রমণের জন্য অধৈর্য হয়ে পড়েছে। হাতের স্পর্শে তাকে শান্ত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছিল সে। এমন সময় সে দেখতে পেল একটি ঝোপের আড়াল দিয়ে একজন পিক্ট বেশ কিছুটা তার লুকোনোর স্থানের দিকে এগিয়ে এসেছে। ব্যালথাসের ধনুকে আবার টংকার ধ্বনি হল। এবার তিরটা গিয়ে বিধল বর্বরটার জঙ্ঘায়। একটা চাপা আর্তনাদ করে সে ঝোপের পিছনে বসে পড়ল। স্ল্যাশারকে আর আটকে রাখা গেল না। এক লাফে গুঁড়িগুলো পার হয়ে সে ঝোপটার পিছনে হারিয়ে গেল। ভয়ানকভাবে নড়ে উঠল ঝোপটা। একটা মরণ আর্তনাদ শোনা গেল। একটু পরেই স্ল্যাশার নিঃশব্দে ফিরে এসে আবার তার পাশে দাঁড়াল। তার দাঁত, মুখ রক্তে রাঙা।
পথে বা ঝোপের আড়ালে আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। নিস্তব্ধতাটাকে অসহ্য লাগছিল। ব্যালথাস ভয় পাচ্ছিল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তার লুকোনোর জায়গাটা পার করে শত্রুরা হয়তো তাকে ঘিরে ফেলছে। এমন সময় কিছুটা দূরে তার বাম দিকে অরণ্যের আড়ালে একটা খসখস শব্দ শোনা গেল। ব্যালথাস শব্দটা লক্ষ করে অন্ধের মতো শরক্ষেপণ করল। কিন্তু তার মন আক্ষেপে ভরে গেল যখন সে শব্দ শুনে বুঝল সেটা একটা বৃক্ষের কাণ্ডে গিয়ে বিঁধেছে। স্ল্যাশার কিন্তু আর অপেক্ষা করল না। শব্দের উৎসস্থলের দিকে তিরের মতোই উড়ে গেল সে। ব্যালথাস শুনতে পেল সেখান থেকে লড়াইয়ের শব্দ ভেসে আসছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এক বীভৎস ঘড়ঘড়ে আওয়াজ শোনা গেল। একটু পরে একটা ভূতের মতো নিঃশব্দে স্ল্যাশার ফিরে এসে ব্যালথাসের বাহুতে রক্তমাখা মাথা ঘসতে লাগল। তার কাঁধে একটা দীর্ঘ গভীর ক্ষত।
পিক্টেরা বোধহয় এতক্ষণে বুঝেছিল অরণ্যের আড়াল দিয়ে হানা দেওয়াটা খুব একটা ফলপ্রসু হচ্ছে না। এক প্রেতের মতো শ্বাপদের নিঃশব্দ ত্বরিতগতির আক্রমণ তাদের লোকসংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে কেবল। এছাড়া বৃক্ষকাণ্ডের স্তূপের পিছনে একটিমাত্র যোদ্ধা লড়াইটা চালাচ্ছে। তাই তারা নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করল। বনভূমি কাঁপিয়ে বীভৎস হুংকার দিয়ে তারা একসঙ্গে ছুটে এল ব্যালথাসের দিকে। ব্যালথাস নিজেও কোনোদিন ভাবেনি এমন পরিস্থিতিতে তার স্নায়ু এত শান্ত থাকতে পারে। যোদ্ধারা ছুটে আসতে আসতে নির্ভুল লক্ষ্যে শরক্ষেপণ করে তাদের তিনজনকে ভূপাতিত করল সে। বাকি দুজনের একজন তাই দেখে সামান্য ইতঃস্তত করে থমকে গিয়েছিল। তারপরেই সে ঝাঁপিয়ে বনের আড়ালে আশ্রয় নিল। অবশিষ্ট লোকটি কিন্তু প্রবল গর্জন করতে করতে ব্যালথাসের একেবারে কাছে এসে পড়ল। তার চোখ ক্ষুধার্ত পশুর মতো জ্বলছে, মাথার ওপর তুলে ধরা কুঠার সেই সামান্য আলোতেও ঝলকে উঠেছে। ব্যালথাস বাঁচার জন্য লাফিয়ে উঠে পিছনে সরতে গেল। তখনই পা পিছলে গেল তার। সে ভারসাম্য হারাল বটে, কিন্তু সেজন্যেই তার প্রাণ রক্ষা পেল। সবেগে চালানো কুঠারটি তার মাথার বেশ কিছুটা চুল চেঁচে নিয়ে চলে গেল। পিক্টটা এত জোরে কুঠার চালিয়েছিল যে সামলাতে না পেরে সে নিজেও কাঠের গুঁড়িগুলোর ওপর আছড়ে পড়ল। সে আর উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল না। স্ল্যাশার তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে শেষ করে দিল।
তারপর আবার অসহ্য নিস্তব্ধ চাপা উত্তেজনায় পূর্ণ অপেক্ষার প্রহর। ব্যালথাস ভাবছিল পলাতক লোকটিই কি দলের শেষ ব্যক্তি। এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে দলটা বিশেষ বড়ো নয়। হয় এরা দুর্গের যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে অতি উৎসাহে বসতি আক্রমণ করতে বেরিয়ে পড়েছিল, নয়তো মূল দলটা যুদ্ধজয় করে রওনা দেওয়ার আগে এরা আশপাশের অবস্থা খতিয়ে দেখতে বেরিয়েছিল। সান্ত্বনার বিষয় এই যে, যত সময় কাটছিল মহিলা ও শিশুদের দলটা ততই ভেলিট্রিয়ামের নিরাপদ আশ্রয়ের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল।
এরপর হঠাৎই একঝাঁক তির উড়ে এল তার আত্মগোপনের আশ্রয় লক্ষ্য করে। এর সঙ্গে শোনা গেল বহু মানুষের রক্তলোলুপ চিৎকার। হয় শেষ শত্রুটি অন্যদের ডেকে এনেছে, নয়তো আরেকটি দল নিজেই এসে যোগ দিয়েছে তার সঙ্গে। জ্বলতে থাকা কুটিরের আলো স্তিমিত হয়ে এলেও দেখা যাচ্ছিল তাদের। ব্যালথাসের ধনুক তারের বাজনার মতো বেজে উঠল। দু-তিনজন প্রাণহীন হয়ে লুটিয়ে পড়তেই পিক্টেরা জঙ্গলে আশ্রয় নিল। তাদের গর্জন থেমে গেল। কিন্তু তারা নিঃশব্দে অতি দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল ব্যালথাসের দিকে। অনতিবিলম্বে বহু যোদ্ধার পদশব্দ তাকে ঘিরে ফেলল।
ব্যালথাস প্রবল আবেগে স্ল্যাশারকে আদর করতে করতে বলল, “চলো বন্ধু, ওদের নরকের রাস্তা দেখাই।” এক হাতে কুঠার আরেক হাতে তলোয়ার নিয়ে লাফিয়ে উঠল সে। তারপর একটা অন্ধকার মানুষদের বন্যা ধেয়ে এল আর দুই অসমসাহসী যোদ্ধা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রাণঘাতী কুঠার, শানিত খঞ্জর ও তীক্ষ্ণ দন্তের ঘুর্ণিঝড়ের মধ্যে।
অগ্নিপিশাচ
ভেলিট্রিয়ামের রাস্তা ছেড়ে কোনান যখন উত্তরের রাস্তা ধরল, তখন সে ভেবেছিল তাকে অন্তত নয় মাইল দৌড়তে হবে। কিন্তু চার মাইল অতিক্রম করতে না করতেই সে বেশ কিছু মানুষের গলা শুনতে পেল। যেভাবে শব্দ করতে করতে তারা আসছিল, সে বুঝল আর যেই হোক ওরা পিক্ট হতে পারে না। সে চেঁচিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
“কে তুমি?” এক কর্কশ কণ্ঠস্বর তাকে সংপ্রশ্ন করল। “আর এক পা এগোলে তির মেরে তোমাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলব।”
“ছাড়ো তো। এই আঁধারে, জঙ্গলের মধ্যে তোমরা একটা হাতির গায়েও তির লাগাতে পারবে না।” কোনান অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল। “আমি কোনান। পিক্টেরা নদী পার করেছে।”
“আমরাও তাই সন্দেহ করেছিলাম।” এবারে দলপতিটি এগিয়ে এল। সে দীর্ঘকায়, শক্তপোক্ত, কঠিন মুখের মানুষ। তার হাতে ধনুক। “আমাদের শিকারী দলের কয়েকজন একটা অ্যান্টিলোপকে তাড়া করতে করতে কৃষ্ণা নদীর পাড় অবধি চলে গিয়েছিল। সেখানেই ওরা পিক্টদের চেঁচামেচি শুনতে পায়। ওরা ছুটে এসে খবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নুন, গাড়ি সব ছেড়ে ঘরের পথে রওনা দি। বলদগুলোকেও ছেড়ে দি যাতে সেগুলো নিজের মতো পালাতে পারে। আমরা জানতাম পিক্টেরা কেল্লা আক্রমণ করলে, কয়েকটা দল নিশ্চয়ই বসতির দিকে আসবে আমাদের ঘরবাড়ি লুট করার জন্য।”
“চিন্তা কোরো না। তোমাদের পরিবারের সবাই নিরাপদে আছে।” কোনান বলল। “আমার সঙ্গী ওদের আগেভাগে খবর দিয়ে ভেলিট্রিয়ামে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। এখন আমরা যদি বড়ো রাস্তা দিয়ে যাই, তবে শত্রুদের মুখোমুখি পড়ে যাবো। কাজেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ পুবের দিকে যেতে হবে। ওখানে পৌঁছেই সবার সঙ্গে দেখা হবে। তোমরা এগোও। আমি পিছনে চারদিকে নজর রাখতে রাখতে যাচ্ছি।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা দলটা দক্ষিণ পূর্বের দিকে দ্রুতবেগে চলতে শুরু করল। কোনান তাদের পিছনে এমন একটা দূরত্ব রেখে হাঁটছিল, যাতে বিপদে পড়ে তারা ডাক দিলে সে শুনতে পায়। তবে পথ চলতে চলতে এমনিতেই তারা এত শব্দ উৎপন্ন করছিল যে, ভারী বিরক্ত লাগছিল তার। একদিক দিয়ে সিমেরিয় ও পিক্টদের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। তারা বনের মধ্যে লতাপাতার ফাঁক দিয়ে বাতাসের নিঃশব্দ বয়ে যাওয়ার মতোই চলতে সক্ষম।
বনের মধ্যে এক ছোটোখাটো তৃণক্ষেত্র পার করে আবার সবে অরণ্যে প্রবেশ করেছে, এমন সময় কোনানের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সাবধান করল। তার মনে হল কেউ তাকে অনুসরণ করছে। সতর্ক হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে সে শুনল অভিবাসীদের দলের শব্দ ক্রমে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এরপর চারদিকে এক প্রাণহীন নীরবতা নেমে এল। এমন সময় তার মনে হল পিছনের ফেলে আসা পথ থেকে কেউ তাকে অতি ক্ষীণ স্বরে নাম ধরে ডাকছে।
“কোনান, কোনান। একটু দাঁড়াও কোনান।”
“ব্যালথাস!” সে চমকে ঘুরে দাঁড়াল।
“কোনান। আমার জন্যে অপেক্ষা করো।” এবার গলাটা আরও পরিষ্কার শোনা গেল।
“ব্যালথাস! তুমি এখানে কী করছ?” বলতে বলতে কোনান জঙ্গল ছেড়ে তৃণভূমির প্রান্তে এসে দাঁড়াল।
“ক্রম!” যা দেখল তাতে ভগবানের নাম নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে। তার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। তৃণভূমির অপর প্রান্তে অরণ্য থেকে যে বেরিয়ে আসছে সে ব্যালথাস নয়, এক রহস্যময় সবুজ লেলিহান অগ্নিশিখা। সেটা প্রেতের মতো ভেসে ভেসে সেই বনমধ্যস্ত মাঠ পার হয়ে তার সামনে এসে থামল।
কোনান তার থেকে কয়েক ফুট দূরের সেই নৃত্যরত ডাকিনি আগুনের দিকে তাকিয়ে তার আড়ালে কোন অবয়ব লুকিয়ে আছে তা বোঝার চেষ্টা করছিল। সেই স্পন্দিত অনলের ভিতর নিঃসন্দেহে এক নিরেট অন্তঃসার বর্তমান। নীলাভ সবুজ অগ্নিশিখা কেবল সেই শয়তানি সত্তার পরিধান মাত্র। কিন্তু কোনান চেষ্টা করেও সেটার প্রকৃত আকৃতি স্পষ্ট বুঝতে পারছিল না। তারপর তাকে সচকিত করে সেই অদ্ভুত অনল কথা বলে উঠল।
“কসাইয়ের জন্য অপেক্ষারত, ভাগ্যহত মেষের মতো স্তব্ধ হয়ে কেন দাঁড়িয়ে আছ কোনান?”
কণ্ঠস্বরটা মানুষের মতো হলেও তার ধ্বনিতরঙ্গের বৈশিষ্ট্য মনুষ্য স্বরযন্ত্রের দ্বারা উৎপন্ন শব্দের থেকে আলাদা।
“আমি ভেড়া?” কোনানের ক্রোধ তাকে বিপদের কথা ভুলিয়ে দিল। “তোর কি ধারণা আমি একটা জলার পিশাচকে দেখে ভয়ে জমে গেছি? একজন বন্ধু ডেকেছিল বলে আমি দাঁড়িয়ে আছি।”
“তুমি যাদের রক্ষা করার চেষ্টা করছ তারা আমার ভ্রাতার শিকার। আমি তাদের রক্তে ভ্রাতার ছুরিকাকে রঞ্জিত হওয়ার পথে অন্তরায় হব না। কিন্তু তুমি আমার। ওহে মূর্খ, তুমি সুদূর সিমেরিয়া থেকে নিয়তির অঙ্গুলিহেলনে এই কোনাজোহারার অরণ্যে এসেছ নিজের সর্বনাশের মুখোমুখি হতে।”
“তোর সঙ্গে তো আমার আগেও দেখা হয়েছিল। তখন আমায় মারার চেষ্টা করিসনি কেন?”
“আমার ভ্রাতা কোনো মনুষ্যকরোটিকে কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত করে তাতে তোমার নাম লিখে গাল্লাহ্-র পূজাবেদির সম্মুখে নিরন্তর প্রজ্জ্বলিত অগ্নির মাঝে নিক্ষেপ করেনি। সে সদা তমসাবৃত উচ্চভূমির বাসিন্দা কোনো কৃষ্ণবর্ণ অতৃপ্ত আত্মার কানেও তোমার নামোচ্চারণ করেনি। কিন্তু এক নিশাচর বাদুড়, মৃতের পাহাড় পার করে উড়ে গিয়ে রাত্রির চার ভ্রাতা যে নিলয়ে নিদ্রিত, তার সামনে আনত এক শ্বেত ব্যাঘ্রচর্মে রক্ত দিয়ে তোমার ছবি এঁকেছে। এরা সেই আদিম দেবতা যাদের কেশ রাশিতে অযুত নক্ষত্র প্রজ্বলিত, যাদের পদযুগলের কাছে কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে থাকে প্রকাণ্ড সর্পের দল।”
“কেন আঁধারের দেবতারা আমার মরণ চান?” গরগর করে জিজ্ঞেস করল কোনান।
সেই অগ্নিকুণ্ড থেকে শিখার মতো একটি হাত বেরিয়ে এল। সেটা হাত, না পা, না অন্য কোনো অঙ্গ, বোঝা গেল না ঠিক। সেই উপাঙ্গ মাটির ওপর একটা আলপনা আঁকল। আগুনের মতো জ্বলতে লাগল চিহ্নটা। আগুন নিভল, কিন্তু তার আগেই কোনান সেটাকে চিনতে পারল।
“তুমি সেই অভিজ্ঞান অঙ্কনের সাহস দেখিয়েছ, যাতে কেবল ঝেব্বাল স্যাগের উপাসকের অধিকার। মৃতদের আবাসভূমি কৃষ্ণ পর্বতে বজ্র নির্ঘোষ হয়েছে, কেঁপে উঠেছে গাল্লাহ্-র পূজাবেদি। যে দূত রাত্রির চার ভ্রাতার কাছে খবর দিয়েছিল, সেই এসে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে গেছে তোমার নাম। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। তোমার করোটি আমার ভ্রাতার গৃহের শোভা বৃদ্ধি করবে। তোমার মাংসে উদর পূর্তি করবে তীক্ষ্ণ চঞ্চু, কৃষ্ণ পক্ষ বিশিষ্ট ‘ঝীল’-এর সন্তানেরা।”
“তোর এই ভ্রাতাটা কে বলতো?” কোনান চেঁচিয়ে উঠল।
“জ়োগার স্যাগ। সে মাঝে মাঝেই ঝেব্বাল স্যাগের পবিত্র উপবনে তীর্থ করতে যায়। এক বন্য নারী একবার ঝেব্বাল স্যাগের কুঞ্জে রাত কাটিয়েছিলেন। তাঁর পুত্রই হল জ়োগার স্যাগ। আমিও ঝেব্বাল স্যাগ ও বহু দূর দেশের এক অগ্নিসত্তার সন্তান। জ়োগার স্যাগ আমাকে সেই কুয়াশাচ্ছন্ন দেশ থেকে ডেকে এনেছে। তার নিজের রক্ত দিয়ে, ইন্দ্রজাল ও মন্ত্রের সাহায্যে এই গ্রহের উপযোগী সত্তা হিসেবে নির্মাণ করেছে আমায়। অদৃশ্য সূতার বন্ধনে আমরা এক হয়ে গেছি। তার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। সে আঘাত পেলে আমিও আহত হই। আমার দেহে ক্ষত সৃষ্টি হলে লাগলে সে রক্তাক্ত হয়। অনেক কথা হল। খুব শীঘ্রই তোমার প্রেতাত্মা আঁধার জগতের প্রেতেদের সঙ্গে কথা বলবে। তারাই তোমায় শোনাবে সেই আদিমতম দেবতাদের গাথা যারা অসীম রসাতলে নিদ্রিত থাকেন, আর কখনও সখনও কোনো কল্পান্তে জাগ্রত হন।”
“তাই নাকি?” নিজের কোমরে ঝোলানো কুঠারটা হাতে নিয়ে কোনান বলল। “পাখির মতো পা তোর, আগুনের মতো জ্বলে ভয় দেখাতে চাস। আবার এখন মানুষের মতো কথা বলছিস। তুই যাই হোস না কেন, আমি একবার তোর আসল চেহারাটা দেখতে পাই, তারপর….।”
“তুমি অবশ্যই তা দেখতে পাবে।” সেই বিচিত্র কণ্ঠে উচ্চারিত হল। “আর আমাকে জানার জ্ঞান নিয়ে তুমি জাহান্নামে যাবে।”
সেই নারকীয় সবুজ আগুন দপদপ করছিল। প্রচণ্ডভাবে জ্বলে উঠছিল, আবার স্তিমিত হচ্ছিল। তারপর তার মধ্যে দিয়ে একটা মুখাবয়ব পরিস্ফুট হতে লাগল। প্রথমে কোনানের মনে হয়েছিল তা জ়োগার স্যাগের। সে-ই হয়তো এই অগ্নিময় পোশাক পরে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার পক্ষে তো এতটা দীঘল হওয়া সম্ভব নয়। এর উচ্চতা তো তার চেয়েও বেশি। কোনান আগেই জ়োগারের মধ্যে বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছিল। তার চক্ষুদ্বয় অস্বাভাবিক রকমের তীর্যক, তার কর্ণদ্বয় উপর দিকে সূচালো, তার ওষ্ঠ নেকড়ের ওষ্ঠের মতো কৃশ। এ সকল বৈশিষ্টই যেন ওই মুখাবয়বে অতিরঞ্জিত হয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তীর্যক চক্ষুদ্বয়ে জ্বলন্ত অঙ্গারের দৃষ্টি।
তারপর সে আলোর আবরণ ভেদ করে সেই দানবের প্রকৃত দেহাবয়ব দেখার চেষ্টা করল। সেটার কোমর থেকে উর্ধাঙ্গ অনেকটা মানুষের মতো। অথচ তা শল্কাবৃত। দুটি হাতে দীর্ঘ তীক্ষ্ম নখর। এদিকে তার নিম্নাঙ্গে আবার সারসের মতো গ্রন্থিযুক্ত অথচ শক্তিশালী দুটি পা। তাতে শিকারী পক্ষীর মতোই শানিত বক্র নখরযুক্ত অঙ্গুলি। সেই বিচিত্র দেহ জুড়ে নীলাভ সবুজ আলো ছুটে বেড়াচ্ছে। সে যেন তাকে আলোকিত কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেল।
কোনান যত তাকে দেখছিল, তার উচ্চতা যেন ততই বাড়ছিল। দানবটা তাকে সম্মোহনী শক্তিতে স্থির করে রেখেছিল। এমন সময় হঠাৎ তার দীর্ঘ বাহু বাড়িয়ে কোনানকে আক্রমণ করল সে। চেষ্টা করল কোনানের গ্রীবা ছিন্ন করার। তীক্ষ্ম চিৎকার দিয়ে তার মায়াজাল ছিন্ন করে সিমেরিয়টি লাফিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ গতিতে কুঠার চালাল সেটার মাথা লক্ষ করে। আশ্চর্যজনক দ্রুত গতিতে অবলীলায় সেই আক্রমণ এড়াল দানবটা। তারপর তার দেহাগ্নির হিসহিসে শব্দসহ ঝাঁপিয়ে পড়ল কোনানের ওপর।
কিন্তু সে যখন অন্য শিকারের ওপর ঝাঁপিয়েছিল, ভয় তার অন্যতম সহায়ক অস্ত্র ছিল। কোনান ভয়হীন। সে জানত যে কোনো সত্তা, তা সে যত ভয়ংকরই হোক না কেন, যদি জাগতিক অস্থি চর্ম দ্বারা নির্মিত দেহ বিশিষ্ট হয়, তবে তাকে জাগতিক অস্ত্রের দ্বারা বধ করা সম্ভব।
প্রবল লড়াইয়ের সময় একবার দানবটার শক্তিশালী উপাঙ্গের ঝাপটে কোনানের শিরস্ত্রাণ খসে পড়ল। কিন্তু সে উল্লাসে ফেটে পড়ল যখন দেখল তার তরবারি সেই শয়তানের উদরে ক্ষত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে তৎক্ষণাৎ এক সংহারক প্রহার থেকে বাঁচার জন্য সে পিছু হঠতে বাধ্য হল। কিন্তু তাও সেই দানবের তীক্ষ্ণ নখরপ্রান্ত তার বুকে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়ে গেল। তার লৌহ বর্ম এমনভাবে চিরে গেল যেন তা কাপড়ে তৈরি। তবু আবার সে ক্ষুধার্ত শার্দূলের মতো শয়তানটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার তরবারি পাগল শিল্পীর মতো সেই দানবের বুকে, পেটে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিচ্ছিল। একসময় দানবটা কোনানকে জড়িয়ে ধরল। সে টের পাচ্ছিল দুটি হাত তাকে জড়িয়ে পিশে ফেলার চেষ্টা করছে, নখের সাহায্যে তার বর্মের পিঠের দিকের অংশ ছিন্ন ভিন্ন করছে তার দেহের নাগাল পাওয়ার জন্য। সেই নীলচে-সবুজ আগুন তার শরীরকে লেহন করছিল। কিন্তু তা উষ্ণতা বিহীন। সে অদ্ভুত আগুন তুষারের চেয়েও শীতল। কোনান বুঝেছিল দানবটা দূর্বল হয়ে পড়লেও তার হাতে বেশি সময় নেই। বিদ্যুৎ গতিতে সে তার গ্রীবা লক্ষ করে তলোয়ার চালাল।
ধীরে ধীরে মাটিতে ঢলে পড়ল সেই বিচিত্র দানবের দেহ। দেখা গেল তার মস্তক কেবল এক সূক্ষ্ম সূতার মতো মাংসখণ্ড দিয়ে ধড়ের সঙ্গে সংযুক্ত। তার দেহ পরিবৃতকারী অগ্নি রক্তবর্ণ ধারণ করে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। তার অভ্যন্তরের দেহাবয়বকে আর দেখা যাচ্ছিল না। এক মাংসপোড়া গন্ধ কোনানের নাক জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। সে চোখের ওপর থেকে ঘাম আর রক্ত মুছে বনের মধ্য দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। তার সর্বাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। সে দক্ষিণের দিকে মাইল খানেক দৌড়ানোর পর এক জ্বলন্ত খামারবাড়ির আগুনের আভা দেখতে পেল। মূল সড়কের আরও পিছনে রনোন্মত্ত জনতার গর্জন তাকে আরও জোরে দৌড়নোর অনুপ্রেরণা দিল।
কোনাজোহারা নিশ্চিহ্ন
জান কবুল লড়াই হয়েছিল বজ্র নদীর পাড়ে। সমরাগ্নি লেলিহান শিখায় ছড়িয়ে পড়েছিল ভেলিট্রিয়াম নগরীর সীমানায়। কুঠার আর মশালের স্তূপ জড়ো হয়েছিল নগরী প্রাকারের পাদদেশে, নদীর আশপাশে। গায়ে আলপনা আঁকা শত্রুরা পিছু হটার আগেই ছাই হয়ে গিয়েছিল উপনিবেশের বেশির ভাগ বসতি কুটির।
তারপর পরিব্যপ্ত হয়েছিল শ্বশানের শান্তি। এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। লোকেরা ছোটো ছোটো দলে জড়ো হচ্ছিল এখানে ওখানে। কিন্তু তারা কথা বলছিল ফিসফিসিয়ে। যেন জোরে শব্দ হলেই এই কষ্টার্জিত শান্তি কাচের মতো চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়বে। পানশালায় রক্তমাখা পটিবাঁধা মানুষের দল নিঃশব্দে আসব পান করছিল।
তেমনই এক আসবাগারে কোনানকে দেখা গেল। সে তার বিশাল পানপাত্রে আনমনা হয়ে চুমুক দিচ্ছিল। এমন সময় সেখানে প্রবেশ করল এক অভিজ্ঞ শিকারী যোদ্ধা। তার মাথায় পটি বাঁধা, এক হাত রজ্জু ও কাপড়ের সাহায্যে গলা থেকে ঝোলানো। স্পষ্টত সেটির অস্থি বিচূর্ণ হয়েছে। সে টাস্কেলান দুর্গের যুদ্ধের এক ভাগ্যবান উত্তরজীবী। সে এসে কোনানের সামনে বসল।
“তুমি তো সৈন্য নিয়ে কেল্লার ধ্বংসস্তূপ দেখতে গিয়েছিলে?” সে জিজ্ঞেস করল।
কোনান নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
“আমি যেতে পারিনি।” দুঃখিত মুখে বলল যোদ্ধা। “ওখানে আর লড়াই হচ্ছিল?”
“পিক্টগুলো কৃষ্ণা নদীর ওপারে ফিরে গিয়েছিল।” কোনান বলল। “কিছু একটা কারণে ওরা আত্মবিশ্বাস হারিয়েছিল। শয়তানই জানে কেন ওরা অমন করল।”
নিজের ভাঙা হাতের দিকে চেয়ে মৃগয়াজীবীটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, “শুনলাম সৎকার করার জন্য ওখানে নাকি কোনো মৃতদেহই পাওয়া যায়নি? পিক্টেরা সব দেহগুলোকে পুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল?”
কোনান মাথা নাড়ল। “চারদিকে শুধু ছাই পড়ে ছিল। পিক্টেরা নদী পার করার আগে নিজেদের আর ভ্যালানাসের যোদ্ধাদের মৃতদেহে আগুন লাগিয়ে দেয়। দুর্গেও আগুন লাগায়।”
“ভ্যালানাস একেবারে শেষের দিকে মারা যান। দেওয়াল ভেঙে শত্রুরা ঢোকার পরে সবার সঙ্গে উনিও মুখোমুখি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ওরা ওঁকে জীবন্ত বন্দি করতে চেয়েছিল। কিন্তু উনি ওদের বাধ্য করেন তাঁকে হত্যা করতে। আমাদের দশ জনকে আহত অবস্থায় বন্দি করেছিল। আমাদের আর লড়ার ক্ষমতা ছিল না। আমাদের নয় জনকে বলি দেওয়ার পর আমার পালা এসেছিল। তখনই জ়োগার স্যাগ মরল আর আমি পালানোর সুযোগ পেলাম।” যোদ্ধাটি বলল।
“জ়োগার স্যাগ মরে গেছে?” কোনান আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওই জন্যেই তো বুনোগুলো ভেলিট্রিয়ামে তেমন জোরদার আক্রমণ চালাতে পারল না। খুবই আজব ব্যাপার। লড়াইতে ওকে কেউ আঘাত করেনি। একটা জ্বলন্ত আগুনের কুণ্ডের পাশে হাতে একটা কুঠার নিয়ে শয়তানটা নাচছিল। সেটা দিয়েই আমার ন-জন বন্ধুকে খুন করেছিল ও। আমার দিকেও ও একটা জন্তুর মতো চেঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল। তারপর হঠাৎ আর্তনাদ করে, কুঠার ফেলে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে শুরু করল। আমি কোনো মানুষকে অমন জানোয়ারের মতো চেঁচাতে শুনিনি। কেল্লার মানুষদের পুড়িয়ে মারবে বলে আগুনের কুণ্ডটা জ্বালিয়েছিল ও। আছাড়ি পিছাড়ি খেতে খেতে আমার আর সেটার মাঝখানে এসে ধড়ফড় করে স্থির হয়ে গেল। ওর মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছিল। পিক্টগুলো ছুটে এসে পরীক্ষা করে চেঁচাতে লাগল যে ও নাকি মরে গেছে। সেই সময় প্রচণ্ড গণ্ডগোলের মাঝে আমি সুযোগ পেয়ে পালালাম।
“পালানোর আগে আগুনের আলোয় ওকে আমি দেখেছিলাম। ওর বুকে, পেটে, গলায় গভীর ক্ষতের মতো লাল দাগ হয়ে গিয়েছিল। মাথাটা এমনভাবে বেঁকে পড়ে ছিল যেন শরীর থেকে সেটা প্রায় ছিঁড়ে গেছে। ওর এমন দশা হল কেন কে জানে?”
কোনান কোনো জবাব দিল না। অরণ্যযোদ্ধাটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেই আবার বলতে শুরু করল, “ও জাদুর সাহায্যে বেঁচে ছিল আর জাদুর ফলেই মরল। ওর মৃত্যুর রহস্য পিক্টদের সাহস শুষে নিয়েছিল। ওটা দেখার পর নতুন করে আর কেউ ভেলিট্রিয়ামের দিকে হানা দিতে যায়নি। ওখান থেকে ওরা কৃষ্ণা নদী পার করে পিছিয়ে যায়। যারা বজ্র নদীর ধারে যুদ্ধ করেছিল, তারা সবাই জ়োগার মরবার আগেই রওনা দিয়েছিল। সংখ্যা তত বেশি না থাকায় শহরের খুব একটা ক্ষতি করার ক্ষমতা ওদের ছিল না।
“আমি লুকিয়ে ওদের প্রধান দলটার পিছন পিছন যাচ্ছিলাম। আমি জানতাম আমায় কেউ অনুসরণ করছে না। তুমি পুরুষ উপনিবেশীদের বেশ কিছুটা আগেই শহরে পৌঁছে দিয়েছিলে ঠিকই, কিন্তু মেয়ে আর বাচ্চাদের দলটা ওই রংমাখা আক্রমণকারীরা পৌঁছানোর একটু আগেই শহরে ঢোকে। তরুণ ব্যালথাস আর স্ল্যাশার না থাকলে শয়তানগুলো পথেই ওদের সবাইকে খুন করত।
“যেখানে ব্যালথাস আর স্ল্যাশার প্রচণ্ড লড়াই করে শত্রুদের আটকে রেখেছিল, সেই জায়গাটা আমি দেখেছি। ওরা পিক্টদের মৃতদেহের স্তূপের মাঝে পড়ে ছিল। আমি দেখেছি সাতটা মৃতদেহ ওদের চারপাশে পড়ে আছে। তাদের দেহে তরবারি, কুঠার কিম্বা স্ল্যাশারের দাঁতের দাগ। এছাড়া পথের পাশেও বেশ কয়েকটা তির বেঁধা মৃতদেহ পড়ে ছিল। ওঃ ভগবান, কী লড়াইটাই না ওরা লড়েছিল।”
“ও একজন সত্যিকারের পুরুষ মানুষ ছিল। আমি ওর স্মৃতির উদ্দেশে পান করছি। কুকুরটির স্মৃতির উদ্দেশেও।” কোনান জলদগম্ভীর স্বরে বলল। “আমি প্রতিজ্ঞা করছি, ব্যালথাসের জীবনের মূল্য হিসেবে দশটি পিক্টের মুণ্ড মাটিতে লুটোবে, আর স্ল্যাশারের জন্য সাতটা। ও যে কোনো মানুষের চেয়ে অনেক বড়ো যোদ্ধা ছিল।” রক্তলাল চোখে সে পানীয়টা একবারে গলাদ্ধকরণ করে এত জোরে পানপাত্রটা আছড়াল যে সেটা দুমড়ে গেল।
তার আগুনঝরা নীল চোখের দিকে তাকিয়ে শিকারী যোদ্ধাটি বুঝল, এই প্রতিজ্ঞা নিশ্চিতভাবেই রক্ষিত হবে।
“ওরা আর দুর্গটা বানাবে না?” সে জিজ্ঞেস করল।
“না। অ্যাকুইলোনিয়ার কাছে কোনাজোহারা হারিয়ে গেছে। সীমানা পিছিয়ে এসেছে অনেকটা। এখন বজ্র নদীই সাম্রাজ্যের নতুন সীমানা।” কোনান গম্ভীর স্বরে বলল।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল যোদ্ধা। তারপর তাকাল কুঠারের বাঁট আর তলোয়ারের হাতল ধরার ফলে সৃষ্ট কোনানের রেখাঙ্কিত, কঠিন চর্ম বিশিষ্ট করতলের দিকে। বর্বরটি এক নতুন আসব ভৃঙ্গারের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। সে মনে মনে অরণ্য যোদ্ধাদের সঙ্গে তাকে তুলনা করতে শুরু করল। তুলনা করল এই যুদ্ধে ছেড়ে আসা নদীতীরে যারা মারা পড়ল তাদের সঙ্গে। সে বুঝল কোনান তাদের থেকে কতটা আলাদা।
“মানব প্রজাতি স্বভাবগতভাবেই বন্য।” সিমেরিয়টির দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিপাত করে সীমান্ত বাসীটি নিজের মনে বলে উঠল, “সভ্যতা তো ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এক অস্বাভাবিক অবস্থা মাত্র। সময় নদীতে স্বল্পস্থায়ী ঢেউয়ের মতো হঠাৎই তার আবির্ভাব ঘটে। সেজন্যেই বোধ হয় আদি অকৃত্রিম বর্বরতা বারবার শেষপর্যন্ত জয়ী হয়।”
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রবার্ট ই হাওয়ার্ড, সায়ক দত্তচৌধুরী