কুরুক্ষেত্র হাইওয়ে
লেখক: সিদ্ধার্থ ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
তিন বসন্ত সতেরো দিন পরে এবার বুঝি প্রতীক্ষার অবসান। শেফালি নদীর কোলে পলাশপুর গ্রাম ছেড়ে পালানোর কাহিনি বহুদিন হল স্বেচ্ছায় মনের কোণে নির্বাসিত করেছে রীতা। অকারণে নিজেকে অস্থির করতে চায় না বলে। মশালের দাউদাউ রক্ত যখন হিংস্র ছুটে বেড়াচ্ছিল তাদের গ্রামের কিনারায় রীতার হাসির উচ্ছ্বাসে ঘুম ভেঙে ককিয়ে উঠেছিল শহর-সড়কের দু-ধারে ধোঁয়াটে জটাওলা গাছের যত পাখি, আর রাতজাগাদের ডানা গুটিয়ে এসেছিল অজানা আতঙ্কে। সন্ধানী মশালের মতো পাখিরাও বুঝতে পারেনি গ্রামের ভিটে ছেড়ে কোনো আহাম্মক শহরের দিকে পা বাড়াতে পারে। সূর্য মন্দিরের শতায়ু পুরোহিত শুধু স্মরণ করতে পেরেছিলেন এ-গ্রামের একমাত্র বাসিন্দার মুখ যিনি শহরের প্রলোভনে ধর্মত্যাগী হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য তিনি আর ফিরে আসেননি। যে যায় সে কখনো আর ফিরে আসে না। ভূর্জপত্রের পুথির ত্রয়োবিংশতি আপ্তবাক্য দুর্লঙ্ঘ প্রমাণিত করেছে জনপদের এ যাবৎকালের ইতিহাস।
কিন্তু শহরের প্রলোভনে ধর্মত্যাগী হয়নি রীতা। ধমত্যাগ আগেই করেছিল এবং সেই দায়ে সূর্যমন্দিরের পূর্বে নরকজলায় জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ার নিদান মেনে নেয়নি। শহরের চেয়েও বড়ো প্রলোভন তার জীবনের প্রথম পুরুষের স্পর্শ। দুরুদুরু অভিসারকে ছায়ার রাজ্যের লুকোচুরি পার করে সূর্যের কিরণে বিস্তৃত করতে চেয়েছিল। ভিন্ন গোষ্ঠী, ভিন্ন জাতি, ভিন্ন ধর্মের অয়নের সাহচর্যের আকাঙ্ক্ষা শহরে যন্ত্রকলের বাঁশি, ধোঁয়া, কালি ও ছুটন্ত চাকার রুদ্ধশ্বাস জটিলতার ভুবনকেও বরণীয় করে তুলেছিল।
তিন বসন্ত সতেরো দিনের পূর্বে কয়েকটি মোহময় দিন গন্ধক আর অম্লরসের বাষ্পসিক্ত শহুরে হাওয়ায় ভাসিয়ে রেখেছিল তাদের ছাতকোঠা। পায়ের নীচে অট্টালিকার বাকি ছাব্বিশ তলা শিকড়সমেত লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপর কখন যেন বেরসিক ক্ষুধা তার তাগিদ নিয়ে ফিরে এল। তখন জানলার ওপরে বেগুনি আকাশে শহরের বিলুপ্ত রাত্রি জড়িয়ে আছে। একটা লোহার খাঁচা নামিয়ে আনল তাঁদের পৌঁছে দিল পথে।
অয়নের যাবতীয় সঞ্চয় তিন মোড়ক পাঁউরুটি হয়ে ফুরিয়ে গেল। ফসল তোলার দিন শেষ হওয়া মাত্র সব সঞ্চয় যে খুইয়ে বসে গ্রামের জীবনে তার নিশ্চিত অনাহার। কিন্তু রাত জয় করে ঋতু বিলোপ করে টগবগ করে ফুটছে শহর। তার ইন্ধন জোগাবার জন্য হাত-পায়ের প্রয়োজন কখনোই ফুরায় না। বেঁচে থাকার চাহিদা পূর্ণ হওয়ার স্বাদ বাসি হওয়ার আগেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল অফুরন্ত দিন। উপলব্ধি নিরন্ধ্র হয়ে জানিয়ে দিল তারা বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে, আরও বহুদিন। বহু, বহু, দিন বাঁচতে হবে। দিনগুলো আর আগের মতো অস্ফুট নিশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে উধাও হয়ে যাবে না, হারিয়ে যাবে না। হারিয়ে যাবে অন্য কিছু।
তিন বসন্ত সতেরো দিন পূর্বে যন্ত্রের ঘর্ষণে পোড়া তেল মাখা তুষারপাতের মধ্যে গাড়ি-আড্ডার চোরাবাজারে নাম মাত্র দরে অয়ন বেচে দিল তার শীতবস্ত্র। সংগ্রহ হল পাথেয়। যাত্রীবাহকের কামরায় চির হেমন্তের আবহাওয়া তুষারমৃত্যু রোধ করল। বহু দূরের একটি দিন, যেখানে উজ্জ্বল উষ্ণ বাতাস বইছে আর পেশিবহুল দুটি হাতের ভারী সমাদর—সেইখানেই নামবে অয়ন। ভাগ্যান্বেষীর লক্ষ্য এর চেয়ে সুনির্দিষ্ট হয় না।
আজ তিন বসন্ত সতেরো দিন পরে প্রথম চিঠি পেয়েছে রীতা। চলে এসো আর ঠিকানা। অয়নের ঠিকানা। আস্তানা। একার। নিজস্ব।
অপরাজেয় কেশবন্ধ নির্মাতার সংস্থায় রীতা তিনটি বিশ্বযুদ্ধের সতেরোটি বাহিনীর জন্য একান্ন রঙের দশ কোটি তেত্রিশ লক্ষ সাতাশ হাজার তিনশো একুশ মাইল দীর্ঘ কৃত্রিম বস্ত্র বয়ন করে গ্রাসাচ্ছাদনের প্রয়োজন মিটিয়েছে। তিয়াত্তর প্রদেশের দুশো বিরানব্বই প্রান্তরে (পূর্ব ঘাঁটিতে) পৌঁছাবার জন্য আসন সংগ্রহের সম্বল নেই তার।
আন্তরপ্রাদেশিক ভূ-পরিবহন ঘাঁটিতে পৌঁছে অয়নের মতোই শীতবস্ত্রের বিনিময়ে রীতা ভেবেছিল সমস্যার নিরসন করবে। তিন উৎসাহী খরিদ্দারও জুটেছে একে একে। প্রথম ব্যক্তি পরীক্ষার ছলে বস্ত্রের খাপ থেকে শুকনো খাদ্যের কৌটোটি ইন্দ্রজাল করেছে। দ্বিতীয় ব্যক্তি ভালো মূল্য দিতে রাজি হয়েছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে রীতা আবিষ্কার করে যে খরিদ্দারের নিজস্ব যন্ত্রালয়ে মূদ্রিত আয়তাকার প্রতিশ্রুতিপত্ৰগুলি দ্বিতীয় কেউ মান্য করবে না। তৃতীয় খরিদ্দার কৌতূহল প্রকাশ করার পর রীতার হাতে মাত্র শেষ দুই ভেঁপু সময় ছিল। রীতার উৎকণ্ঠা বাড়ে আর মন্থরতর হতে থাকে খরিদ্দারের প্রশ্ন-পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের প্রক্রিয়া। রীতা বলে, নিতে হয় এখুনি নিন। গাড়ি ছেড়ে দিলে আমার আর কিছুই বিক্রির কোনো প্রয়োজন পড়বে না।
খরিদ্দার রীতার গন্তব্য জানতে চায়। তার পর স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে বৈদ্যুতিক সংবাদ ভাণ্ডার উজ্জীবিত করে নিবেদন করে, অপেক্ষাকৃত মন্থরগতি আরও একটি শকটেও রীতা আজ তিয়াত্তর প্রদেশে পাড়ি দিতে পারে। মধ্যাহ্ন সূর্য পনেরো কাহন হেলে পড়ার আগে রীতা পৌঁছে যাবে। ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের এই দ্বাদশচক্র-যানে মাশুলও জাতীয় পরিবহনের তুলনায় লোভনীয়। ন্যূন মূল্যে শীতবস্ত্র বেচে রীতা তিনশো বাহাত্তর সংখ্যক যাত্রীর আসন অধিকার করল।
আহত অসুস্থ দানবের গর্জনে গর্জনে প্রতিবাদ ছড়িয়ে এগিয়ে চলেছে চক্রযান। বায়ুনিরোধের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার প্রতিকার করতে রুদ্ধ জানলা এখন দৃষ্টিও নিরোধ করে নিশ্চিন্ত। চোখের তারায় কোনো দৃশ্য ছুটছে না, তাই গর্জন আর কম্পন বাদে অগ্রসর হওয়ার কোনো বোধও জন্মায় না। চোখ বুজে ঠেস দিয়ে বসে আছে রীতা। রামধনু পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলেছে সে অন্ধকারের সওয়ারি হয়ে। আনন্দের পিছনে দাঁড়িয়ে অনিশ্চয়তা, ছড়িয়ে পড়ছে বিবশ ছায়া।
মধ্যাহ্ন সূর্যের কুড়ি কাহন প্রণিপাত থেকে অপেক্ষা করবে অয়ন। কিন্তু কতক্ষণ অপেক্ষা করবে অয়ন আর কতক্ষণে পৌঁছাবে রীতা।
ঘাসের সমুদ্রে গোড়ালি ডুবিয়ে দাঁড়াল রীতা। শুধু তাকে নামবার জন্যই মূল সড়ক ত্যাগ করে কাঁকর-বিছানো সরু ঘুরপথ ধরেছিল চক্রযান। ভেবে গর্ব হচ্ছে রীতার। দূরত্ব শকটের আকৃতিকে ক্রমশ খর্ব করছে। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে সবুজ সমুদ্র পেরিয়ে দিগন্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে পাল-নামানো মাস্তুরবিহীন প্রাচীন কোনো জলযান।
আকাশের দিক মুখ ফেরাল রীতা। সূর্য আশ্বাস দিল চোখ ঝলসে দিয়ে। পিছন ফিরল রীতা। তার স্বচ্ছ চোখের তারায় ঘন নীল স্ফটিক পর্বতমালার অগুন্তি শিখরকে পিছনে রেখে সবুজ ঢেউয়ের উপত্যকা কাঁপছে ঘাসের ডগায় ডগায়।
সমুদ্রে ঝাঁপ দিল রীতা। উচ্ছ্বাস বার বার ছুড়ে দেয় তাকে, লোফালুফি চলে দেহের সঙ্গে মনের। উথালপাথাল ভাসা আর ভোবা। আনন্দে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শেষে উঠে দাঁড়ায়। মনে পড়ে যাত্রা এখনও শেষ হয়নি।
ময়ূরের মতো গর্বিত ঝুঁটি ফুলিয়ে শিকারি বাঘের মতো ধীরে সন্তর্পণে পা ফ্যালে রীতা কিন্তু ছুটে চলে হরিণ। লাল আর সবুজের ডোরাকাটা একটা আবছা ঝুলন্ত হিজিবিজি স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তিয়াত্তর প্রদেশের দুশো বিরানব্বই (পশ্চিম) প্রান্তরের অতিথিদের সম্বর্ধিত করছে জোনাকি-শিখার ফলক। সমস্ত সময় যেখানে থমকে যাবে তার বড়ো কাছে এখন রীতা।
এক জোড়া সোনার কাঠিতে গাঁথা ওই ফলকের নীচে একা দাঁড়িয়ে রীতা আবার সাক্ষী মানল সূর্যকে। নিশ্চয় অয়নের আসার সময় হয়নি।
একটা ক্ষীণ শব্দ আগেই শুনেছিল। এবার শুনছে অনুনাসিক প্লুতস্বরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের কান্নার রোল। শব্দের পায়ে পায়ে উঠেছে দামাল হাওয়া। বেসামাল কেশের গুচ্ছ নিশান হয়ে দিক নির্ণয় করছে বাতাসের। ভালো করে চোখের পাতা খোলাও দুষ্কর।
ক্ষান্তিবিহীন শব্দকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাওয়া। হাওয়াকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শব্দ। চুল উড়ছে দক্ষিণ থেকে বামে। পিছিয়ে দাঁড়াল রীতা। দৃষ্টি সংহত করল। তার সামনে দিয়ে বাতাসের খরস্রোত নখ ঘাসের আস্তরণ আঁচড়ে নির্মূল করে প্রবাহিত। নিখুঁত দুই সমান্তরাল বিশিষ্ট মসৃণ উজ্জ্বল ধূসর সড়ককে ছড়িয়ে দিয়েছে আদিগন্ত। পিছনে নীল স্ফটিক পাহাড় থেকে সবুজের ঢল সড়কের এপারের কিনারায় এসে থমকে গেছে। আর ওপারের কিনারা থেকে আরও সবুজের আরও সমুদ্রের সুদূরে প্রান্তে জেগে আছে সোনালি পাহাড়।
সোনালি পাহাড় পিছনে ফেলে প্রদীপের শিখার মাথায় একটা ধোঁয়া যেন থরথর করে এদিকেই এগিয়ে আসছে। লক্ষ হৃৎস্পন্দন অন্তর তার আকৃতি স্পষ্টতর হওয়ার লক্ষণ ধরা পড়ছে। দশ বার মৃত্যুর পর আবার প্রাণ ফিরে পেয়ে রীতা অবিনশ্বর হল।
অয়ন। অয়ন আসছে দ্বিচক্রযানে। রীতা গুঞ্জন করে, চন্দ্রিমা! চন্দ্রিমা! সবচেয়ে সুলভ উত্তাপ-চালিত যন্ত্ৰবাহন। শহরে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জন্য চক্র দুটি অসমান ডিম্বাকৃতি। লাফিয়ে লাফিয়ে গড়িয়ে আসছে চন্দ্রিমা।
রীতা দুই হাত তুলে ডাকে, ‘অয়ন! আমি এখানে!’
‘এখানে—এখানে—এখানে, এখানে এখানে এখানে—’
দু-হাজার মাইল দূরে উড়ে যায় শব্দ হাওয়ার টানে। কিন্তু অয়ন তাকে দেখতে পেয়েছে।
‘চন্দ্রিমা’ শুইয়ে রেখে অয়ন ক্লান্ত পায়ে সড়কের ওপারে এসে দাঁড়ায়। তার ম্লান চোখের দুটি হাওয়ার পর্দা পেরিয়ে রীতার উচ্ছ্বাস নিভিয়ে দেয়।
অয়নের দৃষ্টির অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকায় রীতা। তার সারা পোশাকে ঘাসের সবুজ প্রাণের ছোপ কিন্তু দুই পা আজানু কালিমালিপ্ত। সড়কের প্রান্তে রীতার পায়ের তলায় ঘাসের এখানে কাজল পরা। অয়নের দিকে মুখ তোলে রীতা। তার নির্বাক ভাষা অনায়াসে পাঠ করে রীতা।
সড়কের দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকায় রীতা। শব্দ আর হাওয়া জমাট বেঁধে গেছে এখন আর ছুটছে শুধু চক্রযান। বিশ প্রস্থ সম্মেলক সড়ক দিয়ে শব্দকে পরিত্যাগ করে হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে চলেছে পাশাপাশি কুড়িটি করে সাজোঁয়া গাড়ির অফুরন্ত সরীসৃপ। গতি তাদের ইস্পাতের খোলেও স্বচ্ছতা এসেছে। চক্রারোহী ইস্পাতের স্বচ্ছ চলন্ত প্রাচীরের এপারে রীতা ওপারে অয়ন।
আবার তাকাল রীতা। আরেক ঝলক উপলব্ধি। কুরুক্ষেত্রের হাইওয়ের দু-ধারে দাঁড়িয়ে তারা। ঠিক স্থানেই পৌঁছে দিয়েছে রীতাকে শুধু পুব পারের স্থানে পশ্চিমে। এই সড়ক লঙ্ঘন করতে হলে হয় কুরুক্ষেত্র ঘুরে আসতে হবে নয়তো আবার ফিরে যেতে হবে শহরে। অথবা অপেক্ষা করতে হবে যুদ্ধশান্তির। তিরিশ শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধ আজ সন্ধ্যার আগে থামবে কি?
শীতল হওয়ায় শিউরে ওঠে রীতা। কুঁকড়ে যায় শরীর। আর অয়নের দৃষ্টির থেকে হতাশা মুছে দেয় দুর্ভাবনা। আকাশে তাকিয়ে সূর্যগণনা করে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। সূর্যাস্তের দুই ঘণ্টার মধ্যে কাচের হিমকফিনে বন্দি হবে রীতা। গলার কাছে শীতবস্ত্রের পশুর লোমগুলো অয়নকে উত্তেজিত করে।
রীতা আর দাঁড়াতে পারছে না। সড়কের ওপরেই গতি আছে, মুক্তি আছে, অয়ন ও উষ্ণতা কিন্তু চলমান শব্দ-বাতাসের প্রাচীরে যেন হঠাৎ চিড় ধরে। রীতা এক-পা এগিয়ে আসে। স্রোতে ভাঁটা পড়েছে যেন…
আতঙ্কে চিৎকার করে অয়ন, না না! দাঁড়াও দাঁড়াও!
এবার তিন হাজার মাইল দূরে উড়ে যায় শব্দ। ইস্পাতের রথের নতুন শ্রেণি পথে নেমেছে। আরও দ্রুত শব্দকে পরাস্ত করেছে, তারা তাই বিভ্রান্ত। মরীচিকা।
সড়কের কিনারায় উন্মত্ত ঝটিকার গায়ে হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ে রীতা। সুদীর্ঘ এক ক্ষণকাল লড়াই চলে রীতার সঙ্গে। হাতে পায়ে নখে খিমচে ধরে মাটি। হাওয়া তবু টেনে নিয়ে নামাতে চায় তাকে সড়কে।
তিন হাত দূরে বুকে হেঁটে সরে এসেছে রীতা। যন্ত্রের কুটিল নিশ্বাসের হল্কায় পোড়া কালো ঘাসে মুখ গুঁজে হাঁপাচ্ছে।
শুয়েই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে রীতা। ‘চন্দ্রিমা’কে দাঁড় করাচ্ছে অয়ন। ফিরে যাচ্ছে?—হ্যাঁ, তুমি ফিরে যাও অয়ন, ফিরেই যাও।
অয়ন পায়ের ধাক্কা দিয়ে চন্দ্রিমাকে তপ্ত উজ্জীবিত করছে।
আর শীত করছে না রীতার। ক্লান্তির সঙ্গে আর লড়াই নেই। এখন বিশ্রাম। দু-হাতে মুঠো করে কালো ঘাস ছিঁড়ে নেয় রীতা। সড়কে অঞ্জলি। তিন হাজার মাইল দূরের কপট দেবতার পায়ে।
অয়ন চন্দ্রিমাকে ঠেলে সড়কের দিকে এগিয়ে আসছে কেন? আরোহণ করছে না কেন?
ক্লান্ত চোখে প্রশ্নও বুঝি ভালো ফোটে না।
বিনা সোয়ারির চন্দ্রিমাকে অয়ন এক ঝটকায় ঠেলে দিল, ছুড়ে দিল রক্তলোলুপ হিংস্র ইস্পাতের স্রোতে।
প্রথম আঘাতেই তিন পাহাড় উঁচুতে ছিট্কে গিয়ে ছত্রখান হয়ে গেল চন্দ্রিমা। আত্মতুষ্ট গতির নিরবচ্ছিন্ন শব্দধারায় ভেসে গেল না প্রতিবোধ। অতিম্লান কণ্ঠ কিন্তু স্পট স্বতন্ত্র উচ্চারণ, সৃষ্টিছাড়া বেমানানের স্পর্ধা।
রীতা চকিতে উঠে দাঁড়াল। সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে চন্দ্রিমার বিস্ফোরিত উদয় কুরুক্ষেত্রের হাইওয়ের উপর বর্ষণ করছে তিন লিটার পিচ্ছিল কালো রক্ত।
পথের ঘর্ষণকে পিছুটান জ্ঞানে উপেক্ষা করে গতির সাধনায় মত্ত যত ইস্পাতের রথ এবার পূর্ণ মুক্তি পেয়ে আচমকা আকাশে এলোমেলো উড়ে গেল।
প্রলয়ংকর সংঘর্ষের আগুন আর আর্তনাদ এবারও শব্দের চেয়ে দ্রুত বেগে আবার ছড়িয়ে পড়ল হাইওয়ের শুরু থেকে শেষ অবধি।
মনোলোভা আতসবাজির প্রদর্শনী হাইওয়ে ভোমরার প্রাণ হরণ করে নিল।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বিধস্ত সরবরাহের ভস্ম জঞ্জালের ধিকিধিকি আগুন পায়ে মাড়িয়ে তিন বসন্ত সতেরো দিন পরে হাইওয়ের ঠিক মধ্যিখানে তারা পরস্পরকে লাজুক দ্বিধা ভরে স্পর্শ করল!
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক একাদশ বার্ষিকী, সেপ্টেম্বর ১৯৮৮
এটি সিদ্ধার্থ ঘোষ রচনাসংগ্রহ তৃতীয় খণ্ডে গ্রন্থিত।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সিদ্ধার্থ ঘোষ