সৌরসংঘাত
লেখক: অনুষ্টুপ শেঠ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ঈশিকারি গ্রামটা রাতারাতি পালটে গেল।
এরকম যে হবে, তা অবশ্য অনেকদিন ধরেই গাঁওবুড়ো আকিরা বলে আসছিল। সে নাকি স্বপ্ন দেখেছিল এমন এক দিনের। সে নাকি মাঝে মাঝেই ফিরে দেখে সে স্বপ্ন।
কী স্বপ্ন? শুধোলে তার শুকনো হাড়সর্বস্ব দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। ঝোল্লা জামার হাতা নাচতে থাকে, কারণ হাত নেড়ে নেড়ে কোন এক অমঙ্গলকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে বুড়ো।
তারপর গলাখাঁকারির শব্দ শোনা যায়। কথাটা শুনে শুনে কান পচে যাওয়া লোকেরা বোঝে, এবার সে মুখ খুলবে।
“দেখি কী, গ্রামের উপর এক অদ্ভুত ছায়া নেমে এসেছে। মেঘের ছায়া না, ঘন কালো আঁধার ছায়া… আকাশে আর সূর্য দেখা যায় না। সূর্য নেই, রোদ নেই, আলো নেই। দিনের পর দিন কেটে যায় সেই ছায়ার নীচে—আর চাষবাস হয় না, ফুল ফোটে না, ফল ফলে না। মাঠে চরে খাওয়ার মতো ঘাস নেই বলে সব পোষা প্রাণীরা যায় মরে। ফসল নেই, মুর্গা নেই, কেটে খাওয়ার মতো পশু বেঁচে নেই। মানুষ তবু মরে না… ধুঁকতে ধুঁকতে তারা হাঁটে, বোবা মানুষের দল…
আর আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ায় সেই দৈত্য ইগল, ডানায় সূর্য আড়াল করে। তার ছুড়ে ফেলে দেওয়া এঁটোকাঁটা খুঁটে খায় মানুষ, জরাজীর্ণ শরীরে তাদের শক্তি নেই, চোখে জ্যোতি নেই… মাথায় চিন্তা করার ক্ষমতা নেই। শুধু আছে খিদের তাড়না, আর ধুঁকে ধুঁকে খাবার খোঁজার অভ্যাস…”
বসে বসে রূপকথা শোনার সময় আর এযুগে কার আছে বলো! একে দুইয়ে লোকে উঠে যেত এই একঘেয়ে বর্ণনার আসর থেকে।
আরে বাবা, এটা হল ২০৯৭ সাল। স্ট্যাটিসটিক্স বলে, মানুষ সারাদিনে গড়ে মাত্র ১৩ মিনিট সময় পায় গল্পগুজব করার জন্য। সেই মহামূল্যবান সময় এইসব বাজে ভাট শুনে কাটানো যায় নাকি!
সূর্যের আলো গেছে আটকে! বলি গাঁজাখুরি গল্প বানানোর আর জায়গা পেলে না! ২০৮১ সালেই তো অর-কো-১১ প্রোজেক্ট পুরোদমে চালু হয়ে গেছে। সূর্যের আলো জায়গায় জায়গায় প্যানেলে ধরে তা থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা তো মান্ধাতার আমলের টেকনোলজি—এই অর-কো প্রোজেক্ট ধাপে ধাপে সে শক্তি সঞ্চয় করে তোলা, আর দরকারমতো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। শেষ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা দেশের সমস্ত শক্তির চাহিদা সম্মিলিতভাবে জোগান দেওয়ার মতো ক্ষমতা হয়ে গেছে এই ভাঁড়ারগুলোর। এখনও কাজ চলছে সে প্রোজেক্টে, সে নাকি ভবিষ্যতের জন্য রসদ বানিয়ে রাখার।
সূর্যের তেজ কমতে কমতে একদিন তো নেই হয়ে আসবে—সেই সেদিনের প্রস্তুতি নাকি এসব।
তারপর যদি কেউ বলে সে স্বপ্নে দেখল সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে বলে সবাই মরে যাচ্ছে… লোকে হাসবে না!
আর, ইগল জিনিসটাই বা চিড়িয়াঘর – না, চিড়িয়াখানা নয়, দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য নয়, বিজ্ঞানের প্রয়োজনে তাদের যেখানে অতি সন্তর্পণে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে সেই ইউনিটের কথা হচ্ছে – ছাড়া কোথায় দেখা যায়? অধিকাংশ প্রজাতিই তো বহুকাল বহির্বিশ্বে লুপ্ত, ইগলও তার ব্যতিক্রম নয়।
‘ছাড় তো! বুড়োর ভীমরতি ধরেছে!”
ইসামু বলে। আর এক মিনিট ১১ সেকেন্ডের মধ্যে তাকে কন্টেন্ট ক্রিয়েশন ইউনিটে ফিরে গিয়ে ট্যাবের সামনে বসে পড়তে হবে। মিজুকি বেবি কেয়ারে আছে, তাই ওর এতটাও কড়াকড়ি নেই। তবে লাঞ্চ টাইমের শেষ হতে তারও দেরি নেই বেশি।
হাসলে মিজুকিকে ভারী সুন্দর লাগে। লালচে গাল আর গোল চিবুক মেয়েটার। কপালের ঝুরো চুল সরিয়ে সে বলে, “বলিস বটে, কিন্তু সুযোগ পেলে শুনতেও তো ছাড়িস না!”
জবাব না দিয়ে দৌড়য় ইসামু। দেরি হয়ে গেছে।
তা ছাড়া জবাব দিতই বা কী! বলতে তো পারত না, আজকাল স্বপ্নে সেও রোজ দেখছে এক পাখির ডানায় সব আলো চাপা পড়ে যাওয়ার…? ঘামঝরা গায়ে, বুকে পাথর নিয়ে উঠে বসছে অন্ধকার ঘরে, একা?
বলতে কি পারত, যে আকিরার চেয়ে অনেক গ্রেড উপরের বুদ্ধি থাকার ফলে সে যতটা পড়াশুনোর সুযোগ পেয়েছে, আর কাজের সুবাদে যা যা বিচ্ছিন্ন সূত্র জানতে পেরেছে… তা জোড়া লাগিয়ে সে আঁচ করতে পারছে স্বপ্নটা কেন আসছে?
পাগল নাকি!
***
ঘোষণাটা একেবারে আচমকা এসেছিল। কেউ, মানে বলতে গেলে প্রায় কেউই প্রস্তুত ছিল না এমন কিছুর জন্য। এমনকী ইসামুর মতো যারা নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ভাবতে বাধ্য হচ্ছিল যে কিছু একটা হতে চলেছে, তারাও এইরকম মাপের কিছু ভাবতে পারেনি।
সকাল থেকে সব চ্যানেলে, সব পাবলিক অ্যাড্রস সিস্টেমে বার বার বলা হচ্ছিল, সন্ধ্যা আটটায় দেশপ্রধান খুব জরুরি একটা ঘোষণা করবেন, সবাই যেন শোনে। হ্যান্ড ডিভাইসে অ্যালার্ট এসেছিল সন্ধ্যা আটটার কিছু আগে। তারপর আটটায় চেনা জলদগম্ভীর কাটা কাটা উচ্চারণ ভেসে এসেছিল—
“দেশ বিপন্ন।”
সব বাড়িতেই সেন্ট্রাল চ্যানেলে ফুটে উঠেছিল প্রৌঢ় হিনাকা ইতোর সৌম্য চেহারা। মানুষকে কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়েই তিনি বলে গেছিলেন, “আমাদের ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম খুব শক্তিশালী হওয়ায় আজ আমরা এক মহা বিপদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। নাহলে অতীতের সেই অন্ধকার দিন আর একবার ফিরে আসত , আমাদের প্রিয় দেশ ধ্বংস হয়ে যেত পারমাণবিক বিস্ফোরণের ধাক্কায়।”
প্রবল গুঞ্জন উঠেছিল ঘরে ঘরে। কী করে সম্ভব… এ তো বহুকাল নিষিদ্ধ এক বিষয়। শেষ যুদ্ধের ফলাফলে আফ্রিকা প্রায় মুছে যাওয়ার পর স্বেচ্ছায় এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে সব ক-টি দেশ!
“পৃথিবীর বুকে এক সময়ে যে মারাত্মক অসুখ ছিল, টেররিজম, ২০৭০ নাগাদ যা সর্বাংশে নির্মূল করা গেছে ভাবা হয়েছিল—তা আবার সদ্য মাথা চাড়া দিয়েছে ইউরোপে। ভারত, বার্মা, রাশিয়া তার ছোবল টের পাচ্ছে, আপনারা জানেন। বিশেষ খবরে জানা গেছে, তাদের পাখির চোখ এখন জাপানের দিকে। সৌরশক্তিকে আয়ত্তে আনার যে কৌশল আমরা আয়ত্ত করেছি, তার দিকে নজর এখন তাদের। সেজন্য, নিষিদ্ধতম বস্তু ব্যবহার করতেও তাদের দ্বিধা নেই।”
মগ্ন হয়ে শুনছিল ইসামু। হ্যাঁ, জনগণের কাছে সব কিছু না পৌঁছলেও, তারা জানে বইকি এই নব্য টেররিস্টদের কাণ্ডকারখানা। এরা যে কিছুতেই পিছপা হবে না, সেটা সত্যি।
“এইবার আমরা বলতে গেলে এক চুলের জন্য বেঁচে গেছি। সময়মতো কিছু লোককে ধরে ফেলা না গেলে ও কিছু জায়গায় আমাদের লোক না পৌঁছলে, আমি অন্তত আপনাদের সামনে আজ দাঁড়িয়ে থাকতাম না! সেই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যেত অগণিত সাধারণ মানুষ, কত বাবা-মা-সন্তান!”
মিজুকি শিউরে উঠে চুল আঁচড়ানো বন্ধ করে ফেলে এ কথায়।
“এ জিনিস একবার হয়েছে যখন, আবার হবে। বার বার হবে। তাই উচ্চস্তরে বহু পরমর্শ করে আমরা একটা পদক্ষেপ নিচ্ছি বাধ্য হয়েই। আগামী সাত দিনের পর থেকে সমস্ত এনার্জি সোর্স অচল হয়ে যাবে। এই সাত দিনে সর্বত্র নতুন টোকেনোমিটার লাগিয়ে দেওয়া হবে। প্রয়োজনীয় টোকেন না দিলে সে সোর্স আর চালু হবে না।”
“এইভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। এতকাল আপনারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করতেন, তার বিল আসত, তা মেটাতেন। তাই তো? এবার থেকে বিদ্যুতের টোকেন আপনি আগে ইয়েন দিয়ে কিনবেন, তারপর ব্যবহার করবেন। হরেদরে ব্যাপারটা আপনাদের জন্য একই রইল।”
“কিন্তু… এই টেররিস্টরা যেমন করেছিল, তেমন বহিরাগত কেউ আর নিজের মতো একটা বড়ো বৈদ্যুতিন সামগ্রী ভরা সেট আপ তৈরি করতে পারবে না! কারণ, এই টোকেন হাটবাজারে বিক্রি হবে না—এটা সরকারের তরফ থেকেই শুধু বিক্রি করা হবে, প্রতিটি মানুষের গ্রেড, কাজের ধরণ ও প্রয়োজন অনুযায়ী। সেসমস্ত আগামীকালের মধ্যে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে। সেইমতো যে যার টোকেন কিনে নেবেন সরকারি কিয়স্কগুলি থেকে। মনে রাখবেন, আপনাদের নিরাপত্তার জন্য সরকার দায়বদ্ধ!”
প্রাথমিকভাবে, আর সবার মতোই ইসামু উত্তেজিত হয়েছিল। মুগ্ধ হয়ে ভেবেছিল, সত্যিই তো, এ একেবারে অকাট্য বুদ্ধি! বিদ্যুৎ বাদ দিলে, আজকের দিনে কীভাবে কোনো বড়ো অপারেশন চালানো সম্ভব? এ তো একেবারে টেররিজমের গোড়ায় কোপ মারা!
মিজাকি তার সহকর্মীদের সঙ্গে প্রশংসায় মেতেছিল হিনাকো ইতোর। তাদের গর্ব হচ্ছিল এমন এক দেশে তারা বাস করে বলে—মানুষের জন্য কত ভাবে এই সরকার!
গাঁওবুড়ো অবশ্য ভিনসুর গাইছিল, তবে কিনা ওকে আর কে তত পাত্তা দেয়!
কিন্তু সাত দিনটা যেতে না যেতে লোকের মুগ্ধতা কেমন তলানিতে এসে ঠেকল। সাত দিনে সারা দেশের সবার ব্যবস্থা করা যায়নি, যাবেও না জানা কথা—তাই সেটা পিছিয়ে এক মাস করা হয়েছিল। এই একটা মাস ধরে সাধারণ মানুষ ঘরে বাইরে সর্বত্র নাজেহাল হয়ে যেতে লাগল। কাকে কত টোকেন দেওয়া হবে তা নিয়ে মতবিরোধ, লিস্ট অনুযায়ী যত দেওয়া হচ্ছে তা যথেষ্ট না হওয়া, টোকেন সংগ্রহ করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়ে রুজিরোজগার নষ্ট হওয়া, এবং পাছে সময়মতো যথেষ্ট টোকেন না পাওয়া যায় সেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা—মানুষের নরকভোগ হয়ে গেল যাকে বলে!
নতুন ব্যবস্থা পুরোদমে চালু হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল, আগের মতো জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে গেছে। টোকেন জিনিসটা সরকার দিয়েছে একেবারে গুণেগেঁথে, তাদের মতে একজন মানুষের যতটা বিদ্যুৎ লাগা উচিত ততটুকুই। কিন্তু সে হিসাবে মানুষের বেহিসাবী অবসর কাটানো, ছুটির দিনের বিনোদন, শখের রান্নার জন্য পুরোনো রেসিপি অনুযায়ী সময় নিয়ে গ্রিল ওভেন জ্বালানো—এসব কিছুই ধরা নেই। ধরা নেই অসুখ বিসুখের সময়ের বাড়তি নেবুলাইজার চালানো বা জল গরম করার কথা। অসুস্থ বুড়োবুড়িদের জন্য এতকাল বাড়িতে ব্যবহার করা লাইফ সাপোর্ট ডিভাইসগুলোর কথাও কে জানে কী করে সরকার বেমালুম ভুলে গেছে।
অন্য জ্বালানি তো বহু যুগ হয়ে গেল শেষ। বিদ্যুৎ, বিশেষ করে সৌরবিদ্যুৎটুকুই এখন একমাত্র ইন্ধন মানুষ প্রজাতির। সেইখানেই এবার রেশনিং শুরু করতে বাধ্য হল সবাই। যথাসম্ভব আলো না জ্বেলে, এসি না চালিয়ে, হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার না করে… যা যা যন্ত্রের সাহায্য না নিয়ে গতরে খেটে করা যায়, তা সে বালতি করে একতলা থেকে জল তুলে আনাই হোক কী পাইপে করে বাগানে জল দেওয়াই হোক—আজ নাহোক পঞ্চাশ বছর পরে সবাই আবার নতুন করে করতে শুরু করল। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি হত, “মান্ধাতার আমলে ফিরে গেলাম যে হে! এভাবে আর কিছুদিন চললেই ভাল্লুকের চামড়া কোমরে জড়িয়ে লগুড় নিয়ে হরিণ শিকারে বেরোতে হবে!”
প্রথম প্রথম সবাই ভেবেছিল এইসব হিসাবের গণ্ডগোল সাময়িক মাত্র, কেরানিদের ভুলত্রুটি। তেড়ে কমপ্লেন লিখেও পাঠিয়েছিল লোকে—অবশ্যই চিঠি লেখা ও পাঠানোর জন্য যেটুকু সময় ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে হচ্ছে তা হুঁশ রেখে, কারণ সেগুলো চার্জ করতেও তো আবার বিদ্যুৎ খরচা করতে হবে!
কিন্তু ছ-মাস কেটে যাওয়ার পর বোঝা গেল, এই হিসাব পালটানোর কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই।
মানুষজনের অসুবিধা? সে নিয়ে ভাবারও সময় সম্ভবত নেই আর। বস্তুত, আরও দু-মাস এভাবে চলার পর রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার চ্যানেলে আবার রাত আটটায় আবির্ভাব হল হিনাকো ইতো-র। একই রকম ধীরস্থিরভাবে তিনি জানালেন, গোপন ইনটেল জুড়ে ক্রমাগত বহিঃশত্রুর আক্রমণের খবর আছড়ে পড়ছে, তাই সূর্যশক্তির টোকেনে আরও র্যাশনিং করা প্রয়োজন।
“আমাদের প্রতিরক্ষা কাঠামো আরও মজবুত করতে হবে… সেখানে আরও অনেক বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে আমাদের। আমি জানি আপনারা আমার পাশে আছেন, কারণ এই সমস্ত কিছুই আমাদের, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য…”
ইসামু আর মিজাকি একসঙ্গে বসে কথাগুলো শুনছিল সেদিন। গ্রামের আরও অনেকেই ছিল ওদের সঙ্গে, গ্রামের একমাত্র সরাইখানাটায়। ঘরে ঘরে কমিউনিকেটর ইউনিট চালানোর বিলাসিতা কে করতে পারে এখন আর…
ভাষণ শেষ হবার আগেই ক্ষুব্ধ গুঞ্জনে ভরে উঠল ছোটো, নীচু ঘরটা। সরাইটাতে এমনিতেই অল্প আলো জ্বলে মুড তৈরি করতে, এখন বিদ্যুৎ বাঁচাতে তার মধ্যেও কিছু কিছু আলো নেভানো। মিজাকির মুখের আধখানা অন্ধকারে ডুবে ছিল। কিছু একটা বলল সে, বিড়বিড় করে। ইসামু শুনতে পেল না, তাই ঝুঁকে পড়ল একটু ওর দিকে।
“কী বলছ?”
সব ছাপিয়ে সেই সময়েই পাঁড় মাতাল ইশিদা-র গলা ভেসে এল, “বিশ্বাস করি না কিচ্ছু… কিচ্ছু বিশ্বাস করি না… সব ধান্দা এদের… সব… আহ্!!”
একটা জোরে আওয়াজ। কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। একটা গ্লাস ভাঙল মনে হয়।
সব কেমন এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল তারপর। আলোগুলো কেউ নিভিয়ে দিল এক এক করে। ইসামু মিজাকির হাত চেপে ধরেছিল। অন্ধকারে ধাক্কা খেতে খেতে ওরা বেরিয়ে এল পাশের দরজা দিয়ে। পিছনে ভাঙচুরের শব্দ তখনও ধেয়ে আসছে। হাত ধরাধরি করেই ছুটে নামল ফুটপাথ বেয়ে…
চেনা গ্রাম আজকাল কত অচেনা লাগে। নিষ্প্রদীপ, নিঃশব্দ…
যে মোড় থেকে ওদের বাড়ির রাস্তা আলাদা হয়ে যায়, সেইখানে দু-পলক দাঁড়িয়েছিল ওরা। মেঘছেঁড়া আলো আসছিল আধখাওয়া চাঁদের শরীর থেকে। মিজাকির ঠোঁটের নরম উষ্ণতা যেন সেই জ্যোৎস্নায় জমে দানা দানা হয়ে গেছিল।
মেয়েটা কেন কেঁদেছিল কে জানে। ইসামুর বদলির অর্ডার আসতে তো আরও তিন দিন দেরি, সে নিজেও জানত না এমন কিছু হতে চলেছে।
***
সারারাত ধরে নাইট ডিউটি সেরে সকাল দশটায় আকিহাবারার রাস্তা দিয়ে শ্রান্ত পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছিল ইসামু। যদি ওই ছোটো কিউবিক বাঙ্কবেডগুলোকে ঘর বলা যায়। যদি এই শরীর টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে নিজেকে কোনোরকমে ইউনিফর্মের প্যাঁচ থেকে মুক্ত করে বিছানায় ছুড়ে ফেলে দেওয়াটাকে ‘ফেরা’ বলা যায়।
আজকাল কী যে কাজ করে তাও বোঝে না ও। হুকুমের পর হুকুম তামিল, যা নিয়ে কাজ তার বেশির ভাগই এত ধাঁধায় ভরা, এত সাঙ্কেতিক বাক্য দিয়ে তৈরি, সেসব সত্যি কিনা ভাবা বহুকাল বন্ধ করে দিয়েছে সে। আগে কনটেন্ট বানাত, নিজের ইচ্ছায় সাজাত, আরও ভালো কী করে করা যায় তা নিয়ে ভেবে হদ্দ হয়ে যেত।
এখন শুধু হুকুম তামিল করে।
কারণ …
কারণ কি একটা?
অ্যাপার্টমেন্টের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছে গেছিল ইসামু। দরজায় চাবি ঘোরানোর আগে অভ্যাশবশতই ক্লান্ত চোখদুটো তুলে মাথার উপরে চাইল সে।
এই তো, একটা কারণ চোখের সামনে। এমন ধূসর, ধাতব পাতে পুরোপুরি ঢেকে যাওয়া আকাশ দেখামাত্র মনের মধ্যে গাঢ় দমবন্ধ ভাব পাকাপাকি বাসা বাঁধে না কি!
টোকিওতে বদলির অর্ডারটা আসার পর সাত বছরের বেশি সময় কেটে গেছে। যদিও মাঝে মাঝে মনে হয় এত কম না, এত কম হতেই পারে না… অন্তত এক যুগ হয়ে গেছে ঈশিকারি গ্রামে ও পা রাখেনি।
কাঠের মন্দিরটার সামনের চাতালে সারি সারি বসে আছে বাচ্চারা। ইসামুর মা ওর হাত ধরে একপাশে বসিয়ে দিয়ে গেল। ছোট্ট ইসামু আড়চোখে দেখছে অন্যদের, বোর হয়ে যাচ্ছে, ভাবছে উঠে পালাবে কিনা… এমন সময়ে বুড়ো পুরোহিতের হাতে ধরা যন্ত্র থেকে ‘হারাঈ’এর শান্তিজল ছড়িয়ে পড়ল ওর মাথায়… সব বাচ্চার মাথায় জল ছিটোচ্ছে পুরোহিত, মুখে বিড়বিড় করছে শান্তির মন্ত্র…
তারপর ঘণ্টা বাজছে দূরে কোথাও…
ঘণ্টা না। দূরে সাইরেন বাজতে শুরু হয়েছে। আবার কোথাও কিছু হল বুঝি!
শ্বাস টেনে বাড়িতে ঢুকে যায় ইসামু। মাথার উপরে ধাতব পাতে মোড়া কৃত্রিম আকাশে মৃদু মৃদু আলো ঝলকাচ্ছে। সঞ্চিত সৌর এনার্জি কোথাও বিস্ফোরণে ঢালা হবে, তার সঙ্কেত। যে যেখানে আছে, আড়ালে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত এইসব, সাইরেন, এই ঝলক…
যত কড়া হাতে সৌর এনার্জি কনট্রোল করা হচ্ছিল, দেশের সাধারণ মানুষ তত কৃচ্ছসাধনে তলিয়ে যেতে যেতেও বুক বেঁধেছিল… তারা কষ্ট করে বাঁচবে, কিন্তু বাঁচবে। তাদের নিরাপত্তার জন্য, তাদের ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার জন্যই তারা কষ্ট করবে।
কিন্তু হিসেব কোথায় গুলিয়ে গেল কে জানে। আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ… সারা দেশ জুড়ে যেন মৃত্যুলীলার তাণ্ডব শুরু হল। ইসামুর আর হিসাবই নেই সে কতবার অপ্রস্তুত অবস্থায় সাইরেন শুনে পালিয়েছে, লুকিয়েছে।
কতবার কত চেনা মুখের মৃত্যুর খবর এসেছে তার কানে।
একটা দেশ, একটা ছোটো কিন্তু আত্মসম্মানবোধে টইটম্বুর, পরিশ্রমী, স্বনির্ভর দেশ চোখের সামনে কেমন বিধ্বস্ত হয়ে গেল!
নিজস্ব পরিবারপ্রথা লোপ করা হল ৩০০২ সালে। ততদিনে দেশের মানচিত্র পালটে গেছে। এক একটা শহর হয়ে গেছে শুধুই কবরস্থান।
মানুষদের নিয়ে আসা হল অল্প কিছু বাছাই অঞ্চলে। তাদের জন্য সারি সারি গগনচুম্বী অ্যাপার্টমেন্টকে কিউবিক বাঙ্কবেড ইউনিটে পালটে ফেলা হল ঝড়ের গতিতে।
বহুকাল আগে ক্যাপসুল বেড ছিল টোকিওতে। শহরের লজ্জা ছিল সে সব, সন্তর্পণে বহিরাগত ট্যুরিস্টদের থেকে লুকিয়ে রাখা হত সেসবের কথা। মহার্ঘ শহরে যার একটা ফালি ঘরও ভাড়া নেওয়ার সামর্থ্য নেই সেই হতভাগ্য দিন-আনি-দিন-খাইয়ের দল সেখানে রাতটুকু কাটাতে যেত।
কিউবিক বাঙ্কবেড তার চেয়ে সামান্যই বড়ো এক একটা ব্যবস্থা।
টোকিওর এই আকিহাবারা একদা ছিল ইলেকট্রনিক্স জন্ত্রপাতির স্বর্গ। কত রাত অবধি আলোয় আলো হয়ে থাকত, গমগম করত। মাটির তলা দিয়ে একাধিক স্তরে মেট্রো ছুটে যেত বিভিন্ন লাইনে।
সব কবেই বন্ধ হয়ে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। থাকার মধ্যে আছে খালি এই থাকার জায়গা সার সার, আর কিছু বড়ো বড়ো ডোমের নীচে অফিস – যেখানে কাজ করতে যায় এই সব থাকার জায়গার বাসিন্দারা – পিঁপড়ের ঢিপি থেকে সার সার পিঁপড়ে বেরোনোর মতো।
আর সবার উপরে সেই ধাতব আচ্ছাদন।
শেষ বড়ো রক্তক্ষয়ী আক্রমণের রসদ সরাসরি ইঞ্চি ইঞ্চি মাপের অজস্র সোলার প্যানেল লাগিয়ে বানিয়ে নেওয়া বিদ্যুৎ ব্যবহার করে হয়েছিল নাকি… তাই সরকার আকাশ এমন করে ঢেকে নিয়েছে যাতে তাদের নিজস্ব ইউনিট ছাড়া কেউ সূর্যের আলো না পায় আর…
“কী হচ্ছে ভাবতে পারবি না… আকাশ ঢেকে দিচ্ছে পাতের পর পাতে…সে কত, উফ!”
তখনো নিজস্ব ফোন বলে কিছু থাকত। তখনো সপ্তাহে একবার দাদাকে ফোন করে গ্রামের খবর নিত ইসামু। ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দাইকি চেঁচিয়ে উঠেছিল, “আকিরা দেখেছিল, বল? অমন দেখেছিল না?”
বহুকাল বাদে আকিরার নাম শুনেছিল ইসামু। জানতে চেয়েছিল সে বুড়োর কী খবর।
“সে তো কবেই পটল তুলেছে রে! হিসাব করে চলতে পারত না, মাসের মাঝে সব চার্জ শেষ করে আর জল গরম করতে পারেনি… ঠান্ডা জলে হাত মুখ ধুয়ে, ঠান্ডা ঠান্ডা খাবার খেয়ে, কম্বল গরম করতে না পেরে লাগল নিউমোনিয়া… ব্যস!”
“যাঃ! খারাপ হল।”
“হুঁ। বুড়ো বেঁচে থাকলে তোর কথা শুনে বেজায় হাঁকডাক করত। স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে বলে কথা!”
তারপর অন্য অনেক কথা ঝড়ের গতিতে সেরে নিয়ে ওরা ফোন রেখে দিয়েছিল। দুজনের মনের মধ্যে পাক খেয়ে বেড়ানো কথাটা কেউই আর মুখ ফুটে উচ্চারণ করেনি।
তারপর? একে একে বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যা কমল। আকিরার মতো যারা ধুঁকে ধুঁকে মরে যেত না, তারা উধাও হয়ে যেত আচমকাই। সরকার জানাত, নাশকতামূলক অন্তর্ঘাতের বলি হয়েছে “অমুক”।
তারপর একদিন পরিবার প্রথা লোপ পেল, সবাইকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আলাদা আলাদা কাজে, আলাদা আলাদা জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হল, নেহাত শিশুরা হয়ে গেল রাষ্ট্রের সম্পত্তি—যোদ্ধা হবার ট্রেনিং নিতে তারাও চলে গেল সব শিশুনিবাসে। ঘরবাড়ি সব হয় ভেঙে বহুতল কিউবিক বাঙ্কবেড হল, নয় পড়ে রইল পরিত্যক্ত। নিজস্ব ফোন—নিজস্ব সব কিছুই লোপ পেল। নিজস্ব পছন্দ, প্রয়োজন আর অভ্যাসগুলোও অনভ্যাসে কবে যেন মুছে গেল জীবন থেকে।
দাদা, বউদি, বাবা-মা, ভাইপোটা… কে কোথায় গেছিল আর জানতেও পারেনি ইসামু। এমনই ছিল নিয়ম।
মিজাকির খোঁজও দিতে পারেনি কেউ আর…
ইসামু মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখত, গ্রামে তাদের বাড়িটার ফিকে গোলাপি দেওয়ালে শ্যাওলা আর ছত্রাকে ভরে গেছে। আগাছা আর কাঁটাঝোপ বেড়ে বেড়ে ঢেকে ফেলেছে ছোট্ট একফালি বাগানটাকে। বারান্দায় রাখা বেঞ্চিটা ভেঙে পড়েছে…
ঘুমের মধ্যেও ও বুঝতে পারত স্বপ্নটা ভুল। পরিত্যক্ত গ্রামে জলের সাপ্লাইও বহুকাল বন্ধ। আগাছাও গছাবে না আর ওখানকার জমিতে। এটা বুঝতে পারার পর ওর স্বপ্নটা পালটে যেত। কোথা থেকে রাশি রাশি বালি এসে ঢেকে দিত ওদের ঘরদোর, উঠোন। জ্বালাপোড়া ধরা একটা সূর্য উঠত আকাশে, আর ফুল ফুল ফ্রক পরা মিজাকি সেই উঠোনের বালিতে খালিপায়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলত, “দেখো কত রোদ? কত্ত সৌরশক্তি জমাতে পারি আমরা দেখো!”
ঘুম ভাঙার পর দাদাকে না বলতে পারা কথাটা প্রত্যেক বার মনে হত ইসামুর।
‘আকিরার স্বপ্নের বাকিটাও কি সত্য হবে তবে? এই কি তবে আমাদের শেষের শুরু?!’
***
“আরে! সবাই দেখো!”
ইসামু ওর ফ্লোরের বাকিদের মতো নিজের কাজের টেবিলে মুখ গুঁজে পড়ে ছিল। ফুজির চিৎকারে ওদের সবার মাথাই ফ্লোরের কমিউনিকেটর স্ক্রিনের দিকে ঘুরে গেল।
ফ্লোরের মাঝামাঝি উজ্জ্বল গোলকটা ধীরে ধীরে ঘুরছিল। তার স্ক্রিনে ফুটে উঠছিল সদ্য ঘটে যাওয়া নাশকতার ছবি। একটা রক্ষী জেট মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রাস্তার উপর। পিছনের অংশটা নেই।
খবরে নামটা ফুটে ওঠার আগেই ওরা বুঝে গেছিল কারা করেছে।
“মানুষের দল”।
এই অদ্ভুত একটা নামে কারা যে এই ভুলভাল কাণ্ডগুলো সমানে চালাচ্ছে, কে জানে! এই যে একের পর এক এরকম রক্ষীজেটের উপর আক্রমণ আসছে—সেটাই বা সাধারণ মানুষে কী করে করতে পারে? এখন… কিচ্ছু তো নেই মানুষের নিজের বলে। তাহলে?
না, এরা আসলে নিশ্চয় কোনো বহিঃশত্রু! কোনোভাবে দেশের মধ্যে এরা এখনও টিকে রয়েছে… আর এইসব চালিয়ে যাচ্ছে।
মানুষ কেন দেশের সম্পত্তি ধ্বংস করবে, বলো? যখন এমনিতেই সব কিছুর এত টানাটানি… ইসামুর বিশ্বাস হয় না এ কাজ দেশের মানুষই করছে। মিথ্যা বলে। নিশ্চয় মিথ্যা প্রচার ওটা।
সেইটা বলতে গিয়ে দেখে ফুজির চোখ কেমন পাথরের মতো স্থির।
আর…
চকচক করছে কী? জল?
খবর পালটে গেছে ওদিকে। ইসামু আবার নিজের টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ল।
***
ফুজিকে প্রশ্নটা না করে পারছিল না ইসামু। তবে, ভাবেনি তার উত্তর এমন বিস্ফোরক হবে।
বিশ্বাস হচ্ছিল না, যে আঠেরো বছরের ছেলেটা তার পাশে দাঁড়িয়ে এক বছরের উপর সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে, সে আসলে…
সে আসলে…
ওই ‘মানুষের দল’-এর সদস্য! না সদস্য কিনা ও তখন জানত না। শুধু জানত ছেলেটা মানুষের দলের খবর বলে যা যা বলছে তা ওর কল্পনাতেও আসেনি এর আগে।
একবারে বিশ্বাস করেওনি। ফুজিও মুখ খোলেনি মোটেই এক দিনে। লেগে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে ইসামু জেনেছে অনেক কিছু …
না জানলেই ভালো হত হয়তো।
এই যে একরকম জানত—দেশের সুরক্ষার জন্য এত কিছু ব্যবস্থা, এত কড়াকড়ি… সরকার সমানে লড়ে যাচ্ছে কিছু নাশকতাবাদীর বিরুদ্ধে যারা ওদের ভালো থাকায় ছাই বেড়ে দিতে চায়…
না! না! এটাই ঠিক। ফুজি যা বলছে সব ভুল… ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে নিশ্চয়। নইলে বলে, সরকার সব মিথ্যা বলছে! নইলে বলে, সরকারের লোকেরা বেজায় আমোদ ফুর্তি করে সুখের জীবন কাটাচ্ছে… আর এইভাবে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে তাদের শ্রম বিনামূল্যে আদায় করে নিচ্ছে…
নইলে বলে, লড়াইটা আসলে এই ভয়ানক খারাপ লোকগুলোর বিরুদ্ধে যারা সরকারে চেপে বসে আছে, এখানে বহিঃশত্রু কেউ নেই। বলেছিল, সিকিউরিটির ফাঁক গলে কীভাবে একটা ভিডিয়ো বার হয়ে এসেছিল। সে ভিডিয়োর ব্যবস্থা নাকি করে দিয়েছিল একটা মেয়ে যাকে এরা মেরে ফেলেছে। মেরে ফেলবে জেনেই সে ব্যবস্থা করে গেছিল যাতে মানুষ জানতে পারে এদের আসল স্বরূপ।
“মানুষের দল” নাকি, আদতেই, শুধুমাত্র মানুষেরই দল। এসব জানার পর, যে ক-জন সাহস করে এগিয়ে আসতে পেরেছে, তাদের দল।
ইসামু মানতে চায়নি। মানতে পারেনি। ফুজিকে মিথ্যুক বলেছিল। ধরিয়ে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছিল। মরিয়া হয়ে ফুজি ওর হাত চেপে ধরেছিল।
“না, প্লিজ! তুমি বিশ্বাস করো… আমি প্রমাণ দেখাচ্ছি তোমায়। প্লিজ।”
দুজনে কী করে ওইটুকু ইউরিনালের খোপে ঢুকেছিল বলা মুশকিল। তবে সর্বত্র চোখ পেতে রাখা ক্যামেরাকে ফাঁকি দিতে এটা লোকে করেই থাকে। যে কারণেই হোক, এটা নিয়ে ক্যামেরায় চোখ পাতা সিস্টেম কিছু মনে করে না।
ম্যাজিকের মতো ফুজি জিনিসটা বার করেছিল। আদ্যিকালের একটা ফোন। কীভাবে জোগাড় করেছে, কীভাবে চার্জ দেয়—কে জানে!
সেই ফোনেই ভিডিয়োটা দেখিয়েছিল সে। ছেঁড়া ছেঁড়া একটা ইয়ারফোন লাগিয়ে বাড়িয়ে ধরেছিল।
ইসামু দেখেছিল—প্রাসাদের মতো ঘর একটা। আলোয় আলোয় ছয়লাপ। বাজনা বাজছে। সামনে লাল রেশমি গদিতে অনেকগুলো লোক বসে। পুরুষ… মহিলা…
মুখগুলো চেনা।
সরকারের একদম উপরের তলার লোক এরা।
সবার সামনে খাবার প্লেট। গ্লাসে পানীয়।
পুরাকালের ছবি দেখছে মনে হচ্ছিল ইসামুর। এই বৈভব তো ও জীবনে কখনও কোথাও দেখেনি। খালি ইতিহাসে পড়েছে বহু বহু অতীতে সম্রাটের দরবারে এমন ঠাটঠমক হত।
বাজনা সুর পালটাল, দ্রুত হল। সামনের এরিনায় পাশ থেকে এসে ঢুকল কয়েকজন নর্তকী। তাদের পরনে উত্তেজক সব পোশাক। বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা লাস্যময়ী নাচতে থাকল আগুনের শিখার মতো।
ফুজি কিছুটা এগিয়ে দিল ভিডিয়োটা। ইসামু বিরক্ত হল। মেয়েগুলোকে দেখতে ভালো লাগছিল তার। বহুদিনের উপোসী শরীর গরম হয়ে উঠছিল।
ফুজি পাশ থেকে বিড়বিড় করে বলল, “এবার দেখো। এবারটা।”
কানের মধ্যে একটা ভীষণ চেনা স্বর বলে উঠেছিল, “নিয়ে আয়।”
দুজন লোক আরেকটা মেয়েকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে এসেছিল। এ মেয়েটার পরনেও নর্তকীর পোশাক। মেয়েটা কাঁদছিল।
বহিরাগত কেউ না। এদেশেরই মেয়ে।
কানে আবার বেজে উঠেছিল সেই স্নিগ্ধ সৌম্য কাটাকাটা উচ্চারণ, শুধু তার সঙ্গে জুড়ে গেছিল অশ্লীল একটা হাসি।
“শুরু কর।”
মেয়েটার শরীর থেকে জবরদস্তি এক একটা পোশাকের অংশ ছিঁড়ে নিচ্ছিল লোকদুটো। তারপর মেয়েটাকেও ছিঁড়ে ফেলতে লাগল যেন। আকুলিবিকুলি ছটফট করছিল সে…
ইসামুর চোখ সরছিল না। গলার কাছটা ওঠানামা করছিল।
মেয়েটা সহ্য করছে কী করে? চোখ ঠেলে উঠছে, গলার শিরা ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে। মুখে থাবার মতো চেপে আছে একটা হাত—তবু চিৎকারে যেন কান ফেটে যাচ্ছে ইসামুর… এসব কী দেখাচ্ছে ফুজি তাকে… না…
“ঢের হয়েছে।”
আবার কানে বেজে উঠেছিল হিনাকো ইতোর গলা। লোক দুজনের একজন মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে টানল। মুখটা উপরে উঠল—দৃষ্টি সোজা ইসামুর দিকে।
ইসামু সম্মোহিতের মতো দেখল একটা ছুরি ধরা হাত সামনে দিয়ে চলে গেল। গলা থেকে গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল মেয়েটার।
চুলের মুঠি ছেড়ে দেওয়ামাত্র মুখটা ঝুঁকে পড়ল সামনে।
অব্যক্ত একটা আওয়াজ করে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নিল ইসামু। ফোনটা জোর করে ফুজিকে ধরিয়ে দিল সে।
“আরও আছে। ওরা তারপরেও…”
“শুনতে চাই না। জানতে চাই না।”
ধাক্কা দিয়ে ফুজিকে প্রায় ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ইসামু। টলতে টলতে এসে দাঁড়িয়েছিল বেসিনের ধারে। বমি করেছিল।
ফুজি এসে ওর কাঁধে হাত রেখেছিল একবার। তারপর সনির্বন্ধ চোখে চেয়ে বলেছিল, “বলে দেবে না তো কাউকে?”
ইসামু জবাব দেয়নি।
না, ও বলেনি কাউকে। কিন্তু পরদিন থেকে ফুজি উধাও হয়ে গেল।
হয়তো নিজেই গা ঢাকা দিয়েছিল, ওকে এত কিছু বলে ফেলার ভয়ে। জানে না ইসামু। তবে তারও দু-দিন পর খবরে জানা গেছিল নাশকতার শিকার হয়েছে ফুজি তেনগান নামের এক যুবক—যদিও যুবক ঠিক বলা যায় না মাত্র আঠেরো বছরে, যায় কি!
ফুজি বেঁচে থাকলে আর ওর সঙ্গে আর একটিবার দেখা হলে একটা জিনিস জিজ্ঞাসা করত ইসামু। পুরো ঘটনাটা চলার সময়ে বাকি মেয়েগুলো নির্বিকারভাবে নেচে যাচ্ছিল পাশে।
“পারল কী করে?!”
কথাটা যতবার ভেবেছে গা গুলিয়ে পাকস্থলী অবধি উঠে আসতে চেয়েছে ইসামুর।
***
“নাম্বার পি১৬ – সুনাদা!! ইসামু সুনাদা!”
অ্যানাউন্সমেন্টটা আচমকাই ভেসে এসেছিল ফ্লোরে। ইসামু আঁতকে উঠেছিল, কিছুটা অসাব্যস্ত ভাবে মুখ তুলে শুনেছিল তাকে জরুরি ভিত্তিতে সুপারভাইজারের কাছে যেতে বলা হচ্ছে। ফ্লোরের সবাই অবাক চোখে চেয়ে ছিল তার দিকে। ইসামু কারো চোখে চোখ রাখেনি, সোজা হেঁটে বেরিয়ে গেছিল।
যখন সুপারভাইজারের কেবিন থেকে ছাড়া পেল সে, তখন তারিখ পালটে গেছে। তার শিফটের পালা শেষ। ইউনিট থেকে লগ আউট করে দিয়ে এই শিফটের লোক সেখানে কাজে বসে গেছে। ইসামু কাউকে কিছু না বলে ধীরপায়ে ঘরে ফিরে এল।
খাওয়া হয়নি আজ। কিন্তু খিদেও পাচ্ছিল না।
মাথার ডানদিকটা দপদপ করছে এখনও। সুপারভাইজারের কেবিন থেকে বেরিয়ে জলের ঝাপটা দিয়েছিল, এখন ঘরে ঢুকেই ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে ফোলা অংশটা ঢেকে পট্টি বেঁধেছে। ব্যথাটা কমেছে, কিন্তু যায়নি।
ফুজির মৃত্যুর খবরের পর থেকেই আজকের দিনের অপেক্ষায় ছিল ইসামু। শেষ দিনে তাকেই তো ঘনিষ্ঠভাবে দেখা গেছে ফুজির সঙ্গে।
তবে ও সত্যিই জানত না ও নিজে এতখানি শক্তি রাখে। এত কিছু সহ্য করেও সে ওদের বিশ্বাস করাতে পেরেছে শেষ অবধি যে ও কিছুই জানে না, ফুজি যা বলেছে তা কিছুই ও বিশ্বাস করে না, সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
না, ভিডিয়ো দেখাতে চেয়েছিল ফুজি একটা। সে দেখতে রাজি হয়নি। ধাক্কাধাক্কিটা তা থেকেই হয়েছিল।
কীসের ভিডিয়ো? কে জানে কী!
রিপোর্ট করেনি ওকে বিশ্বাস করেনি বলেই তো। অমন কোনো দল নেই, ও জানে।
হ্যাঁ, তবু করা উচিত ছিল। মেনে নিচ্ছে। হুজুর দয়া করুন, আর এমন ভুল হবে না তার।
দোহাই হুজুর…
বুটগুলো কী শক্ত হয়!
নিঃশব্দ কান্নার দমকে ইসামুর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। বসে বসেই কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে এক সময়ে।
***
অঘোরে ঘুমোচ্ছিল ইসামু। আওয়াজটা বহু দূর থেকে কানে যেন ছুঁচের মতো বিঁধে যেতে লাগল। সাইরেন?
না। আরও বড়ো কিছু। পুরো কিউবিকলটা থরথর করে কাঁপছে। কী হচ্ছে, ভূমিকম্প নাকি?
ইসামু কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে বেরোল করিডরে। গোটা বাড়িটাই কাঁপছে এখন। আর কারো ঘুম ভাঙছে না কেন? এত ভয়ংকর আওয়াজই বা কীসের?
ওর বিস্ফারিত চোখের সামনে মুহুর্তের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ ছুটে গেল যেন।
সামনের কাচের প্যানেলের গা বেয়ে তার মিলিয়ে যাওয়া শিখাটা এক ঝলক চোখে পড়ল তার।
ট্রেন?
ম্যাগ-ট্রেন? যা ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করে একদা অট্টালিকাগুলোর গা বেয়ে চলাফেরা করত?
সে তো কবেই বন্ধ হয়ে গেছিল। মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজন ফুরোনো মাত্র।
কে চালাচ্ছে ও ট্রেন?
ওর প্রশ্নের জবাবেই যেন অ্যানাউন্সমেন্ট সিস্টেম গর্জে উঠল, “সাবধান! সাবধান! বিল্ডিং-এ অ্যাটাক হয়েছে ‘মানুষের দল’ নামে নাশকতাবাদীদের। যারা এখনও বেরিয়ে যাননি এক্ষুনি বেরিয়ে যান!”
ওঃ! এইজন্য আর কারো দেখা নেই। সবাই নিশ্চয় আগের অ্যানাউন্সমেন্ট শুনেই মুক্তিগোলকে ভিড় জমিয়েছে গিয়ে। ওর ঘুম ভেঙেছে দেরি করে।
সারা মেঝে সামুদ্রিক ঝড়ে পড়া জাহাজের মতো কাঁপছিল। অ্যানাউন্সমেন্টটা তখনো চলছিল, মৃগী রোগীর মতো আওয়াজটা ভাঙা ভাঙা গলায় বলছিল, “লাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল কল! লাস্ট অ্যা-হ্যা-ন্ড ফাইইনাল কল…”
কী হচ্ছে, আর ওকে কী করতে হবে—এটা ঠিক করতে বেশি সময় লাগল না।
ইসামু দৌড়ল। তবে মুক্তিগোলকের দিকে নয়। ছাতের দিকে। ট্রেনটা নীচের দিকে পাক খাচ্ছে ও দেখেছে কাচ দিয়ে তাকিয়ে – নীচ থেকে পাক খেয়ে খেয়ে খেয়ে গতি বাড়িয়ে নিয়ে উঠে আসবে আবার।
ওটার আগেই ওকে ছাতে পৌঁছতে হবে।
***
হাপরের মতো বুকটা ওঠাপড়া করছিল ইসামুর। এত করেও আগে পৌঁছতে পারেনি ও। খুলতে পারেনি ছাতের দরজাও। অগত্যা কাচের গায়ে নাক ঠেকিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করছিল, কী হচ্ছে।
ট্রেনটা চরম গতিতে উঠে এসেছিল একটু আগেই। কিন্তু এখন অদ্ভুতভাবে সেটা থেমে গিয়েছে বিল্ডিং-এর কানা বেয়ে একটু মাথা তুলে। দুলছে অল্প অল্প।
জানলাটা খুলতে পারলে, কার্নিস বেয়ে বেয়ে ট্রেনের ইঞ্জিনের কাছে পৌঁছনো যাবে কি? নীচে না তাকালে পারবে মনে হয়।
জানলার কাচটা তখনই চৌচির হয়ে গেল। গুলি চলছে কোথাও থেকে।
***
চকিতে নীচু হয়েছিল ইসামু। আর গুলি এল না দেখে আস্তে করে উঁকি দিল আবার।
রক্ষীবিমানটা দেখা গেল এবার। চক্কর কেটে আসছে ট্রেনের দিকে। আবার এক ঝাঁক গুলি ছুটল… স্পষ্ট দেখতে পেল ইসামু ট্রেনের ইঞ্জিনের একদিকের কাচও ভেঙে পড়ল।
টেনে হিঁচড়ে নিজেকে জানলার ভাঙা কাচের মধ্যে দিয়ে বার করে আনল ইসামু। অনেক কিছু না পারা দিয়ে জীবন কেটে গেছে এতকাল। এইটা এবার পারতেই হবে ওকে। দাঁতে দাঁত চেপে কার্নিস বেয়ে বেয়ে পৌঁছে গেল ট্রেনের ইঞ্জিনের পাশে।
লোকটার মুখ রক্তে মাখামাখি হয়ে ছিল। তবু চোখ তুলে ইসামুকে দেখল বুড়ো মানুষটা, ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘প্লিজ…’
ইসামু নিজেকে ওইটুকু জানলা দিয়ে গলাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। রক্ষীবিমানের আওয়াজ জোরালো হচ্ছে ক্রমে…
লোকটা হাত বাড়িয়ে দরজাটা খুলে দিল ভিতর থেকে।
ইসামু ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর পাশে চলে এল।
“কনট্রোল…?”
“এটা। পুরোনো মডেল। পারবে?”
জবাব না দিয়ে ওর হাত থেকে প্যানেলটা ছিনিয়ে নিল ইসামু। পারবে ও। এককালে চালিয়েছে। ট্রেনিং-এর পার্ট ছিল ওর। ভুলে গেছে কি?
না। ভোলেনি।
ইঞ্জিন জেগে উঠল। তারপর এক ঝটকায় লাফিয়ে এগিয়ে গেল, ছাতটা বেড় দিয়ে এগোতে শুরু করল। গতি বাড়ছে এবার।
লোকটা খুব অল্প কয়েকটা শব্দে বলার চেষ্টা করল, কী করতে চাইছিল সে।
না বললেও হয়তো বুঝে নিত ইসামু। ফুজি উধাও হয়ে যাওয়ার পর, চুপিচুপি কাজের অছিলায় যত তথ্য ঘেঁটেছে সে, তাতে জানা হয়ে গেছিল ওদের এই বিল্ডিং-এর ছাত থেকে পাশের অর-কো-হাউস, মানে সৌরশক্তি কনট্রোল ইউনিটের ছাতের দূরত্ব খুব কম। সূর্যের গড়নেই বানানো সে বিল্ডিং, ছাত থেকে ছড়িয়ে থাকা সূর্যকিরণের মতো পিলারগুলোর একটা ঠিক ওদের বাড়ির দিকে ঝুঁকে রয়েছে।
আর ফুজি তো বলেই ছিল কেন মানুষের দল বার বার রক্ষীবিমান দখল করে, কী উদ্দেশ্যে।
মেগা ট্রেন ওদের বিল্ডিং-কে পাক খেয়ে উঠে আসছে দেখেই দুই আর দুইয়ে চার করে নিয়েছিল ইসামু।
তবে, এ ট্রেন… এখন তো আর নেমে পাক খেয়ে এসে গতি বাড়ানোরও সময় নেই… এই ছাতের চারদিকে ঘুরেই যা করার করতে হবে…
“হয়ে যাবে।”
লোকটার গলা একদম ঘড়ঘড়ে হয়ে গেছে। না তাকিয়েও শব্দ শুনে বুঝে নিল ইসামু, হেঁচকি উঠছে ওর এবার।
ট্রেনটা ঝাঁকুনি খেল একটা। পিছনদিকে লাগল মনে হয়ে গুলিগুলো এবার… এতটা গতিতে তাক করে ঠিক নিশানায় লাগানো মুশকিল… কিন্তু আর দেরি করা যাবে না… যা হয়েছে এটা কি যথেষ্ট? ভেবে লাভ নেই… এখনই… নইলে আর হবে না… এখনই করতে হবে যা করার…
অর-কো হাউসের বাড়িয়ে দেওয়া স্তম্ভটার দিকে মরিয়া লাফ দিল ইসামুর ম্যাগ-ট্রেন। ম্যাগনেটিক লাইন ও বাড়িতেও আছে, ও জানে। এই শূন্যপথটুকু পেরোতে পারলেই…
সেই কয়েক মুহূর্ত আর কিচ্ছু মাথায় ছিল না ইসামুর।
খালি ফোনের স্ক্রিন জুড়ে মিজাকির ওর দিকে অমন চেয়ে থাকা।
আর ছুরি ধরা হাত একটা…
দূরত্বটা পুরো পেরোনোর আগে থেমে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে লোহার পাতটাকে আঁকড়ে ধরে নিল ট্রেনের নীচের ম্যাগনেট। এক মুহূর্তের জন্য দেখতে লাগল যেন এক অতিকায় শুঁয়োপোকা গাছের এক ডালে মুখ আর এক ডালে লেজের ভাগ রেখে শূন্যে ঝুলে আছে।
তারপর দু-হাতে কনট্রোল প্যানেলটাকে প্রায় পিষে দিল ইসামু। তীব্র আওয়াজ তুলে লাইন ধরে ঘুরপাক খাওয়া শুরু করল মেগা ট্রেন। গতি বাড়তে লাগল, বাড়তে লাগল…
যতক্ষণ না ছাতের ঠিক মাঝখানে থাকা উত্তল উপরিভাগ ভেঙে চুরমার করে দিয়ে সেটা ঢুকে যেতে পারে মূল সৌরশক্তি স্টোরেজের ঠিক হৃৎপিণ্ডে…
বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ, আগুন, কান ফাটানো আওয়াজ… এসব কিছুই ইসামু টের পায়নি আর। ওর এটাও জানা হয় না যে এই আক্রমণের ফলে সমস্ত সঞ্চিত সৌরশক্তি হারিয়ে ফেলে সরকার বাধ্য হবে আবার আকাশের আড়াল খুলে দিতে, সেই সুযোগে মানুষের দল—তারা দিন দিন আরও বেড়ে উঠেছিল কোন মন্ত্রবলে—নিজস্ব মিনিয়েচার সোলার প্যানেল জোগাড় করে নেটওয়ার্ক তৈরি করে নিতে পারবে। ওর জানা হয় না মিজাকিকে খুন করার ভিডিয়ো দাবানলের মতো ছড়িয়ে যাবে সেই নেটওয়ার্ক বেয়ে, জানা হয় না একসময়ে দেশের প্রায় সব মানুষই এই মানুষের দলে এসে দাঁড়াবে—হিনাকো ইতো ও তার দলবলের পালানো ছাড়া গতি থাকবে না।
এসব কিচ্ছুই সেই মুহূর্তে ভাবেনি ইসামু।
সে স্বপ্ন দেখছিল খালি। সেই বিশাল ডানাওলা ইগলের স্বপ্ন। দেখছিল, এখন সে নিজেই তার সওয়ার… ডানা মেলে সোজা উপরে উড়ছে ইগল…
হু হু করে তারা ছুটে চলেছে সূর্যের দিকে…
তার পিছনে বসে, পিঠ জড়িয়ে ধরে ঝরনার মতো সুরে হাসছে মিজাকি…
Tags: অনুষ্টুপ শেঠ, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা