টেলিপোর্টেশন
লেখক: সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“টেলিফোন ইয়েস, টেলিগ্রাফ ইয়েস, টেলিস্কোপ ইয়েস, টেলিপ্রিন্টার ইয়েস, এমনকী টেলিপ্যাথিও ইয়েস—বাট টেলিপোর্টেশন? নো স্যার।”
দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলাম। ব্রেকফাস্ট সেরে দুজনে হোটেলের সবুজ ঘাসের লনে বসে আড্ডা মারছিলাম। দুজনে মানে, আমি আর অনন্ত। আমরা স্কুলের বন্ধু। অনন্ত ক্লাশের ফার্স্ট বয় ছিল। অঙ্কে দারুণ মাথা। ওর পদবীটা অদ্ভুত, মহাকাল—শোনা যায় না বড়ো একটা। মারাঠিদের মধ্যে এরকম পদবী শোনা যায়—যদিও খুব কম। অনন্ত বলত, ওর পূর্বপুরুষ হয়তো বর্গিদের সঙ্গে এ দেশে এসেছিল কিন্তু আর ফিরে যায়নি, বর্ধমানেই রয়ে গেছে। এখন তো ওরা পুরোদস্তুর বাঙালি। ক্লাশে আমরা ওর পদবীটা একটু পালটে মাকাল বলে ডাকতাম। তাতে অবশ্য ও কিছু মনে করত না। স্কুলের পর ও কানপুর আইআইটিতে ফিজিক্স নিয়ে পড়তে চলে গেল। এমএসসি পাশ করে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভারসিটি, বার্কলে থেকে এমএস আর স্ট্যানফোর্ড ইউনিভারসিটি থেকে থিয়োরেটিক্যাল ফিজিক্সে পিএইচডি করে। বিষয় ছিল কোয়ান্টাম অপটিকস। এর পর পোস্ট ডক করে বছর সাত-আটেক বিদেশে কাটিয়ে মুম্বাইতে টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে জয়েন করে।
অনন্তের সঙ্গে বরাবরই আমার যোগাযোগ ছিল। এখন দুজনেই অবসর নিয়েছি। থাকিও বলতে গেলে কাছে পিঠে। ও থাকে মুম্বাইয়ের পাওয়াইতে আর আমি থাকি ঠানে—পঁচিশ কিলোমিটার দূরত্বে। তাই প্রায়ই আড্ডাবাজি হয়। পেশাগতভাবে দুজনেই পদার্থবিদ ছিলাম বলে অনেক সময়ে আলোচনাটা আধুনিক বিজ্ঞান, নয়তো কল্পবিজ্ঞান নিয়ে হয়। স্কুলে থাকতেই আমরা কল্পবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হই, অদ্রীশ বর্ধনের সম্পাদনায় ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকা পড়ে। পালা করে চাঁদা তুলে আমি, অনন্ত আর আরও দুজন বন্ধু প্রায়ই কিনে পড়তাম। স্কুল ছাড়ার পর নিয়মিত সায়েন্স ফিকশন পড়ায় পড়ল ভাঁটা। ফিকশন বাদ দিয়ে সায়েন্সটা শুধু রয়ে গেল পেশাগত কারণে। গবেষণামূলক কাজের জন্য পড়তে হতো বিস্তর আর সেই পড়ার বাইরে যেটুকু অবসর, পড়া শুরু করি বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের লেখা পপুলার সায়েন্সের বই ও জার্নাল বিশেষত সায়েন্টিফিক আমেরিকান ও ফিজিক্স টুডে যা আমার ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরিতে আসত। কার্ল সাগান, ফ্রেড হয়েল, স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, লিও লেডারম্যান, জর্জ গ্যামো, স্টিফেন হকিং, রিচার্ড ফাইনম্যান, পল ডেভিস, মিশিও কাকু—এঁদের লেখা বইগুলোই বেশি পড়া হত।
স্কুল ছাড়ার পর থেকে অনন্তের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হলেও বরাবরই ছিল। আমি ঠানেতে চলে আসার পর এখন আবার বন্ধনটা দৃঢ় হল। হয় ওর ফ্ল্যাটে, নয় আমার ফ্ল্যাটে প্রায়ই আড্ডা বসে। অনন্তের কল্পবিজ্ঞানের অনেক বই ছিল বিশেষ করে অ্যাসিমভ, ক্লার্ক, হাইনলাইন, অ্যাডামস ও আরও অনেকের। ফলে নতুন করে আবার কল্পবিজ্ঞান পড়া শুরু হল। ইন্টারনেটের কল্যাণে বেশ কিছু পুরোনো কল্পবিজ্ঞানের পিডিএফ বা ই-বুকের সন্ধান পাওয়া গেল। সে সব নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হত।
অনন্তই একদিন বলল, “চল না, ক-দিনের জন্য কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসি।”
আমি, “বেশ তো, কোথায় যাবি বল।”
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল পরের সপ্তাহের বুধবার মহাবালেশ্বরের কাছে পঞ্চগনি যাওয়া হবে। অনন্তের চেনা এক মারাঠি ভদ্রলোকের ওখানে স্ট্রবেরির ফার্ম আছে আর একটা ছোটোখাটো হোটেলও আছে। নাইট ভলভো বাসে সকাল প্রায় সাতটায় পঞ্চগনির রোটারি বাস স্টপে পৌঁছে দেখি হোটেল থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। মিনিট পাঁচ-সাত লাগল হোটেলে পৌঁছতে। পঞ্চগনি থেকে যে রাস্তাটা মহাবালেশ্বরের দিকে গেছে, তার খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকে রাস্তা নেমে এঁকেবেঁকে ইউ-টার্ন নিয়ে রুইঘরের দিকের রাস্তা কিছুটা গিয়ে ডান দিকে ঢালু রাস্তা নেমে হোটেলে এসে শেষ হয়েছে। মেইন গেট দিয়ে ঢুকেই লবি আর রিসেপশন। এই ফ্লোরটা তিনতলা। দরজার পাশ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে। একতলা আর দোতলা মালিকের নিজস্ব। তিনতলায় গোটা আষ্টেক ঘর। আমরা দুজনে একটা বড়ো ঘর নিলাম। দেয়াল জোড়া ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর কাচ দিয়ে পাহাড়, লেক আর ভ্যালি দেখা যাচ্ছে—যেন ক্যালেন্ডারের ছবি। ব্যালকনি থেকে পুরো ভ্যালিটা দেখা যায়। রাস্তাঘাট, সবুজ মাঠ, দূরে দূরে বাড়ি ঘর। একটাতো বড়ো হোটেল বোঝাই যাচ্ছে। হোটেলের প্রাঙ্গনেও অনেক গাছ, একদিকে বাগানঘেরা লন। হোটেলের জমি যেখানে শেষ হচ্ছে, তার পরেই পাহাড়ি ঢাল নেমে গেছে অনেক নীচে ভ্যালিতে।
ক্ল্যাসিক্যাল টেলিপোর্টেশন
আমরা ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে লনে এসে দুটো বেতের গার্ডেন চেয়ারে বসেছি। হোটেলের বয় নন্দু দু-কাপ কফি আর ফুলকপির ছোটো ছোটো পকোড়া দু-প্লেট সামনের বেতের গোল টেবিলের ওপর রেখে গেল। আমাদের আলোচনাটা চলছিল টেলিপোর্টেশন নিয়ে। দুটো পকোড়া মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে কফিতে চুমুক দিয়ে অনন্তকে বললাম,
“দ্যাখ টেলিপোর্টেশন বিষয়টা যতটুকু জেনেছি কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়তে গিয়ে। আমরা অনেক সময়ে বলে থাকি, ‘আজকের কল্পবিজ্ঞান—আগামীর বিজ্ঞান’। কথাটা পুরোপুরি সত্য না হলেও আংশিক সত্য তো বটেই। তোর কী মনে হয় গল্পগুলোতে যে ধরনের টেলিপোর্টেশনের বর্ণনা পাই, তা আগামী দিনের বাস্তব বিজ্ঞান বলে প্রতিষ্ঠা পাবে? আমার তো তা মনে হয় না। তুই কী বলিস? আমি এই টেলিপোর্টেশনের ফিকশন তো কিছু কিছু জেনেছি এবারে সায়েন্সটা জানতে চাই। সেই পিএনপিসির মতন—‘ইকোয়েশন তো একটা পাওয়া গেল, কিন্তু এর পেছনে ফিজিক্সটা কী’?”
“পিএনপিসি মানে… পরনিন্দা পরচর্চ্চা? … ওঃ হো সরি সরি সেই পিএনপিসি—স্কুলে আমাদের ফিজিক্স পড়াত। পুরো নামটা কী ছিল যেন?”
“প্রলয় নাথ পাল চৌধুরী। ওর আরেকটা নাম ছিল ঝোড়ো।”
“হ্যাঁ কী স্পিডে পড়াত। তারপরেই একটা অঙ্ক দিয়ে দশ মিনিট বসে থাকত। তা আমাকে আগে বল, তুই টেলিপোর্টেশন বলতে কী পড়েছিস, কী বুঝেছিস?”
“বেশ যদি টেলিপোর্টেশনের সংজ্ঞা জানতে চাস তো আমার মতে—কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে কোনো পথ দিয়ে শারীরিকভাবে না নিয়ে, কোনোপ্রকার অশরীরী পরিবর্তন করে, খুব দ্রুত বলতে গেলে তাৎক্ষণিক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহন করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তিকে টেলিপোর্টেশন বলে। টেলিপোর্টেশনের কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আছে কি না জানা নেই তবে দূরদর্শন, দূরভাষের মতন একে দূরপরিবহন বলা যেতেই পারে, যেহেতু গ্রিক ভাষায় টেলি মানে দূরবর্তী। এখন কোনো নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হলেই আবার অনেকে আমাদের পুরাণে বা বিভিন্ন দেশের মাইথোলজিতে এই সব প্রযুক্তি খোঁজার চেষ্টা করে। আমি সে পথেই যাচ্ছি না।
আমি যতদূর দেখেছি মনে হয় এই টেলিপোর্টেশন বিষয় নিয়ে, ‘দা ম্যান উইদাউট এ বডি’ শিরোনামের, ২৫ মার্চ, ১৮৭৭ সালে নিউ ইয়র্কের ‘দি সান’ পত্রিকায়, প্রথম একটা কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখেন আমেরিকান সাংবাদিক ও লেখক, এডোয়ার্ড পেজ মিচেল। এই গল্পে জনৈক বিজ্ঞানী প্রফেসর ডাম্মফ ‘টেলিপম্প’ নামক এক যন্ত্রের উদ্ভাবন করেন। টেলিফোন যেমন তারের মাধ্যমে কথা অর্থাৎ শব্দ প্রেরণ করে, টেলিগ্রাফ যেমন সাংকেতিক শব্দের সাহায্যে কোনো বার্তা পাঠায়, তেমনি এই শক্তিশালী টেলিপম্প যন্ত্র কোনো জড় বা চেতন সত্ত্বাকে তারের মাধ্যমে এক স্থান হতে অন্য স্থানে প্রেরণ করতে সক্ষম।
প্রফেসর ডাম্মফের ধারণা অনুসারে পদার্থ সকল অণু দিয়ে ও অণুগুলো পরমাণু দিয়ে গঠিত। পরমাণু সত্ত্বার একক। পরমাণুদের সংখ্যা ও বিন্যাসের বিভিন্নতায় বিভিন্ন প্রকার অণুর সৃষ্টি। যেহেতু কোনো মৌলিক পদার্থের সব পরমাণু একই রকম, কোনো অণুতে তাদের বিন্যাসও একই ক্রমে হবে আর কোনো বস্তুতে অণুদের বিন্যাসও মূল বস্তুর অনুরূপই হবে। অতএব কোনো পদার্থের উপাদানগুলিকে পারমাণবিক স্তরে বিচ্ছিন্ন করে ইলেকট্রিসিটির সাহায্যে তারের মাধ্যমে প্রেরক পোর্ট থেকে গ্রাহক পোর্টে পাঠানো যেতে পারে, যেখানে সেই পরমাণুদের দিয়ে মূল পদার্থের এক অনুলিপি তৈরি করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ এটা ডিসইন্টিগ্রেশন-রিইন্টিগ্রেশন পদ্ধতিতে, বা বাংলা করলে বিচ্ছিন্নকরণ ও একীকরণ পদ্ধতিতে ম্যাটার ট্রান্সমিশন বা পদার্থের পরিবহন।”
অনন্ত বলল, “এখানে কিন্তু মিচেল টেলিপম্প কথাটা ব্যবহার করেছেন, টেলিপোর্ট বা টেলিপোর্টেশন নয়।”
“হ্যাঁ, কারণ মিচেলের কল্পবিজ্ঞানের যে প্রথম গল্প ট্যাকিপম্প—যা নীতিগতভাবে এমন একটি যন্ত্র যার গতি অসীম। গ্রিক ভাষায় ট্যাকো মানে গতি আর পেম্পো মানে পাঠানো। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেলিপম্প কথাটা মিচেল উদ্ভাবন করেছেন। আরেকটা জিনিস লক্ষ কর। এখানে ডিসইন্টিগ্রেশন পারমাণবিক স্তরে, উপপারমাণবিক স্তরে নয়, কারণ তখনও পর্যন্ত ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন দিয়ে পরমাণুর গঠনের তত্ত্ব আবিষ্কার হয়নি।
এর পরের ঘটনা মজার। প্রফেসর ডাম্মফ কোয়ার্টজ, স্টার্চ, জল, পোস্টেজ স্ট্যাম্প ইত্যাদি কিছু অজৈব পদার্থ একটি পাঁচ মাইল কয়েলের মধ্য দিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে পাঠাতে সফল হয়ে, যন্ত্রের শক্তি বাড়িয়ে একটি জোরালো কারেন্টের সাহায্যে বেড়ালকেও পাঠাতে সমর্থ হলেন। এবার তিনি ভাবলেন যে তা হলে তো তাঁর বোস্টন শহর থেকে লন্ডনে আটলান্টিক মহাসাগরের তলা দিয়ে পাতা টেলিগ্রাফের কেবল দিয়ে মানুষও পাঠানো সম্ভব। পরীক্ষার জন্য তাঁর অফিস থেকে বাড়ি অবধি তার টেনে, ব্যাটারির শক্তি আরও বাড়িয়ে নিজেকে পাঠাতে আরম্ভ করলেন। দেখতে দেখতে তাঁর শরীর ডিসইন্টিগ্রেট করে অদৃশ্য হয়ে গেল আর তিনি চেতনা হারিয়ে ফেললেন। আবার যখন চেতনা ফিরে এল তখন তাঁর শরীর ধীরে ধীরে গঠিত হচ্ছে। মাথা হয়ে গলা ঘাড় হওয়ার পরই ব্যাটারির চার্জ শেষ। ব্যাটারিতে ফ্রেস সালফিউরিক অ্যাসিড ঢালতে ভুলে গিয়েছিলেন। তার ফলম ফলৌ ফলাঃ প্রফেসর চিরকাল ধড়হীন সচেতন মস্তক হয়ে এক মিউজিয়ামে কাচের বাক্সে রয়ে গেলেন। কাহিনিটি প্রফেসরের মস্তক কাহিনির কথককে বলছেন।
১৯২৯ সালে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, তাঁর সৃষ্ট চরিত্র, অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী প্রফেসর জর্জ চ্যালেঞ্জারকে নিয়ে ‘দি ডিসিন্টিগ্রেশন মেশিন’ গল্পটি লেখেন, যেখানে থিয়োডোর নেমোর নামক জনৈক ল্যাটাভিয়ার ভদ্রলোক এক অনন্যসাধারণ যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন বলে দাবি করেন, যা তার প্রভাব বলয়ের মধ্যে থাকা যে কোনো বস্তুকে তার আণবিক বা পারমাণবিক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, আবার পুনরায় বিপরীত প্রক্রিয়ায় পূর্ব বস্তুতে একত্রিত করতে সক্ষম। জনৈক সাংবাদিক প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে নিয়ে, সেই দাবির সত্যতা যাচাই করার জন্য যন্ত্র দেখতে গেলেন। যন্ত্রটির নাম ‘নেমরের ডিসইন্টিগ্রেটর’। এই কাহিনিতে যন্ত্রের অবশ্য একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। একটা ঘরে সিলিং থেকে ঝুলন্ত অসংখ্য তামার তার, পেডাস্টালের ওপর একটা বড়ো ম্যাগনেট, বিশাল আকারের কাচের প্রিসম, দস্তার প্ল্যাটফর্মের ওপর একটা চেয়ার যার ওপরে একটা চকচকে তামার টুপি ঝোলান আছে। পাশে নম্বর দেওয়া ছোটো ছোটো গর্ত করা র্যাচেট আর রাবার জড়ানো হাতল আছে। গল্পে সফলতার সঙ্গে টেলিপোর্টেশন হওয়ার পর, প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের ফাঁদে পা দিয়ে নেমর তার যন্ত্র পরীক্ষা করার জন্য যেই চেয়ারে বসেছেন, প্রফেসর হাতল ঘুরিয়ে তাকে ডিসইন্টিগ্রেট করে দিয়েছেন, তাকে ধ্বংস করার জন্য, কারণ সে টাকার লোভে তার এই যন্ত্র রাশিয়ার কাছে বেচে দিতে চাইছিল, যাতে ব্রিটেনের সমূহ ক্ষতি হতে পারত।
এর আগে অবশ্য ১৮৯৭ সালে ফ্রেড জেনের লেখা ‘টু ভেনাস ইন ফাইভ সেকেন্ডস’ নামে একটি সায়েন্স ফ্যান্টাসি প্রকাশিত হয় যেখানে টেলিপোর্টেশন বা ওই জাতীয় কোনো কথা ব্যবহার করা হয়নি, তবে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে পৃথিবী থেকে শুক্র গ্রহে যাওয়া আসার কথা বলা হয়েছে। চার্লস হোয় ফোর্ট ছিলেন আঠারো-ঊনিশ শতকের আমেরিকার জনৈক লেখক, যাঁর বিশেষত্ব ছিল অস্বাভাবিক বিষয় বা ঘটনা নিয়ে লেখা। তাঁর লেখা কল্পবিজ্ঞানের অনেক লেখককে প্রভাবিত করেছে। তিনি তাঁর ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘লো’ নামক বইতে উল্লেখ করেছেন, যে প্রকৃতিতে এক ধরনের পরিবহন বল আছে, যাকে তিনি টেলিপোর্টেশন আখ্যা দিয়েছেন। যদিও তিনি এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেননি, শুধু মানুষ, প্রাণী বা বস্তুর এক স্থান থেকে অদৃশ্য হয়ে অন্য জায়গায় পুনরায় আবির্ভূত হওয়ার অসংখ্য সংবাদ এবং উপাখ্যানে এই টেলিপোর্টেশনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ কথা দাবি করা হয়ে থাকে ফোর্টই নাকি প্রথম এই টেলিপোর্টেশন নামটির উপস্থাপনা করেন। যদিও তা সম্পূর্ণ ভুল।
ব্রিটিশ কল্পবিজ্ঞান লেখক স্যার আর্থার ক্লার্ক ১৯৩৭ সালে তাঁর প্রথম কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি ‘ট্র্যাভেল বাই ওয়্যার’ লেখেন। এখানেও সেই ডিসইন্টিগ্রেশন-রিইন্টিগ্রেশন—তবে সেটা ডেল্টা রে স্ক্যানার ব্যবহার করে ও রেডিয়ো ট্র্যান্সপোর্টার দিয়ে টেলিপোর্ট করা হয়েছে আর আণবিক অথবা ইলেকট্রনের স্তর ছেড়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্তুপিণ্ড নিয়ে টেলিপোর্টেশন করা হয়েছে। এই পদ্ধতির বাণিজ্যিক ব্যবহার আর তড়িৎবাহী তার দিয়ে পরিবহনের ফলে বিবিধ বৈদ্যুতিক ত্রুটির জন্য বস্তু বা ব্যক্তির রূপগত পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথাও মজা করে গল্পে বলা আছে। কিন্তু যেটা আমার কাছে বেশি ইন্টারেস্টিং তা হল, রেডিয়ো ট্র্যান্সপোর্টার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার সময়ে একটি গিনিপিগ ট্র্যান্সপোর্ট করার পর মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অটোপ্সির পর দেখা গেল সেটি ভয় পেয়ে শকে মারা গেছে। তাই পরের একটা গিনিপিগকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে সাফল্যের সঙ্গে পাঠানো গেল।”
অনন্ত এতক্ষণ কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মন দিয়ে আমার কথা শুনছিল। হেসে বলল, “স্টিফেন কিংএর ১৯৮১ সালে লেখা ‘দ্য জন্ট’ গল্পটার মূল আইডিয়াটা স্বভাবতই মনে হয় ক্লার্কের গল্পটা থেকে নিয়েছে। এখানে জন্ট আর টেলিপোর্টেশন কথা দুটো সমার্থক। জন্ট কথাটা কিং নিয়েছে ১৯৫৬ সালে আমেরিকান লেখক আলফ্রেড বেস্টারের ‘দ্য স্টারস মাই ডেস্টিনেশন নভেল’ থেকে। কিং এর গল্পেও জনৈক বিজ্ঞানী ভিক্টর ক্যারুন টেলিপোর্ট পদ্ধতি আবিষ্কার করে সচেতন প্রাণী হিসেবে কতকগুলো সাদা ইঁদুর টেলিপোর্ট বা জন্ট করতে গিয়ে দেখলেন যে রিসিভিং পোর্টালে ইঁদুরগুলি মৃত নয়তো কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় এসে মারা যাচ্ছে। পরে ছয়জন বন্দিকে অজ্ঞানে আর ফোগিয়া নামের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এক খুনীকে সজ্ঞানে টেলিপোর্ট করলে একমাত্র ফোগিয়া উন্মাদ অবস্থায় হৃদরোগে মারা যায়। গল্পের বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যায় বলা হল শরীর তাৎক্ষণিকভাবে টেলিপোর্ট করা গেলেও তা সচেতন মন তাকে অতি দীর্ঘকাল বা লক্ষ লক্ষ বছর ভাবে। শূন্য স্থানে এই অতি দীর্ঘকালের একাকিত্ব মনকে অপ্রকৃতিস্থ করে তোলে যার ফল মৃত্যু।
“এই মন ও চেতনার টেলিপোর্টেশন নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব,” আমি বললাম, “তার আগে আমি তোকে একটা ১৮৭৮ সালের তথ্য দেব। নেটে রেফারেন্স, ক্রস রেফারেন্স ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়েছি। এটা লেখা গল্প ঠিক নয়—বরং একটা খবরের কাগজের মাঝের পাতার কলামে বাহান্ন লাইনের রিপোর্ট। ‘ট্রোভ’ নামের অস্ট্রেলিয়ার এক রিসার্চ পোর্টাল অনুযায়ী মেলবোর্নের ডেইলি টেলিগ্রাফ আর ২৩ অক্টোবর ১৮৭৮ সালের ‘দ্য হাওয়াইয়ান গেজেট’ পত্রিকায় এই রিপোর্টটা পাওয়া যায়। সেখানে বলছে যে ভারতবর্ষের একটা জার্নালে এক নতুন আবিষ্কারের রিপোর্ট বেরিয়েছে যার সত্যতা সন্দেহজনক। আমি খুঁজে বের করলাম যে এই রিপোর্ট সম্ভবত ১৮৭৮ সালে মার্চের ৫ তারিখে বম্বে থেকে প্রকাশিত দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে বেরিয়েছিল। কিন্তু রিপোর্টারের কোনো নাম নেই। রিপোর্ট বলছে:
টেলিপোর্ট একটি যন্ত্র যা দিয়ে কোনো মানুষকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুসমষ্টিতে পরিণত করে, কোনো তারের মধ্য দিয়ে পাঠিয়ে, অপরপ্রান্ত থেকে নিরাপদে অক্ষত অবস্থায় পরমাণুগুলির সংযোজনে মানুষটিকে আবার তৈরি করা যায়। যন্ত্রটি একটি শক্তিশালী ব্যাটারি, একটি বড়ো ধাতব ডিস্ক, ঘণ্টার আকারের কাচের ঘর এবং একটি তারের সঙ্গে যুক্ত বড়ো লোহার ফানেল দিয়ে গঠিত। একটা কুকুরকে হাড় চিবান অবস্থায় ডিস্কের ওপর বসিয়ে শক্তিশালী কারেন্ট চার্জ করার দেখা গেল, কুকুরটি অদৃশ্য হয়ে তারের আরেক প্রান্তে এসে বসে হাড় চিবোচ্ছে। এর পর পেড্রো নামের একটি গোয়ানিস ছেলেকে কাচের ঘরে ধাতব ডিস্কে বসিয়ে ডিস্কের নীচে আবার শক্তিশালী কারেন্ট দেওয়া হল। ছেলেটা মজা পেয়ে মুচকি হাসছিল। এবারও আগের মতন প্রতিফল দেখা গেল। কাচের ঘর বাষ্পীভূত মানুষে ভরে গেল যতক্ষণ না তা সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। ছেলেটার হাসিটাও যেন একটা পাতলা বাষ্পের পর্দা—আমাদের মনে হল ছেলেটা মিলিয়ে গেলেও হাসিটা মিলিয়ে যায়নি। পনেরো সেকেন্ড পরে ছেলেটিকে তারের অপর প্রান্তে পাওয়া গেল। এবারে ছেলেটিকে আর কুকুরকে একসঙ্গে পাঠানো হল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। পরিবহনের সময়ে ছেলেটির আর কুকুরের পরমাণুগুলি মিলেমিশে গিয়ে দুটো ভয়াবহ অপ্রাকৃত প্রাণীর উদ্ভব ঘটল। পত্রিকার মতে এই টেলিপোর্ট পদ্ধতিতে সমুদ্রের তলার কেবল দিয়ে ভারতবর্ষ থেকে ইংল্যান্ডে মানুষ কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে। দ্যাখ এই রিপোর্টেই কিন্তু প্রথম টেলিপোর্ট কথাটা পাওয়া যাচ্ছে।”
খবরের কাগজের ছবিটা ইন্টারনেট ঘেঁটে বার করেছিলাম। আমার মোবাইলের থেকে সেটা অনন্তকে দেখালাম। অনন্ত বলল, “ভারতবর্ষের এক খবরের কাগজে বেরিয়েছে—তারপর সে খবর উল্লেখ করেছে অস্ট্রেলিয়া আর হাওয়াইএর কাগজ। অল্প কিছু লোক পড়েছে, বেমালুম ভুলে গেছে। অথচ তার ঊনআশী বছর পরে, একই ধরনের গল্প যেখানে পেড্রোর জায়গায় সায়েন্টিস্ট আন্দ্রে ডেলাম্ব্রে আর কুকুরের জায়গায় মাছি বসিয়ে, শুধু একটু নুন, মিষ্টি, মশলা দিয়ে মুখরোচক করে, ফরাসি-ব্রিটিশ গুপ্তচর-কাম-জার্নালিস্ট জর্জ্জ লাঙ্গেলান ১৯৫৭ সালে আমেরিকার প্লেবয় ম্যাগাজিনে, ‘দ্য ফ্লাই’ গল্পটা লিখে সে বছরে সেরা কল্পবিজ্ঞানের তালিকায় নাম তুলে ফেলল। ১৯৫৮ সালে সে বই সিনেমাও হয়ে গেল। আমার তো এই দুটো গল্পের মিল কখনই কাকতালীয় বলে মনে হয় না।”
“আমিও সহমত। হ্যাঁ, লোকে অন্যের গল্পের থেকে আইডিয়া নিয়ে গল্প লিখতেই পারে তবে তাতে যদি নিজেও কোনো নতুন আইডিয়া যোগ করে তা হলে সেটা নিশ্চয়ই মেনে নেওয়া যায়। আমার তো মনে হয় এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য ডিস-ইন্টিগ্রেশন মেশিন’ আর আর্থার ক্লার্কের ‘ট্র্যাভেল বাই ওয়্যার’ গল্পগুলোতে এডোয়ার্ড পেজ মিচেলের ‘দ্য ম্যান উইদাউট আ বডি’ গল্পের স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে যা লেখা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে।”
“শুধু তাই নয়,” অনন্ত বলল, “এডোয়ার্ড মিচেল কল্পবিজ্ঞান জঁরের আদি যুগের অগ্রদূত। ওয়েলসের অনেক আগেই তিনি অদৃশ্য মানুষ, টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে গল্প লিখেছেন। এ ছাড়াও আলোর গতির থেকেও দ্রুতগতির ভ্রমণ, চিন্তাশীল কম্পিউটার, টেলিপোর্টেশন, উচ্চতর মিউট্যান্ট এসব বিষয় নিয়েও গল্প লিখে গেছেন।”
আমি, “হ্যাঁ, আমি ওঁর কিছু গল্প পড়েছি। একটা কথা ঠিক, লেখকরা তাঁদের লেখার উপকরণ জোগাড় করেন তাঁদের পড়া বই, জার্নাল, নিউসপেপার আর এখন ইন্টারনেট থেকে আর সমাজ-সংসারের নানান ঘটনা, চরিত্র ও অভিজ্ঞতা থেকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় লেখকের কল্পনার রং আর রচনাশৈলী। যার যত বেশি পড়াশোনা, যত বেশি অভিজ্ঞতা আর কল্পনার শক্তি তাঁর ভালো লেখার সুযোগও তত বেশি। আমার প্রশ্ন হল মিচেল প্রথম তাঁর টেলিপোর্টেশন নিয়ে গল্পের আইডিয়া কোথা থেকে পেলেন?”
অনন্ত, “মনে তো হয় ম্যাজিক।”
“আমারও সেটাই ধারণা”, আমি বললাম, “ঊনবিংশ শতাব্দীতে ওই সময়ে আলেক্সান্ডার হেরমান, জন ম্যাস্কিলিন, হ্যারি হুডিনি, ডেভিড কপারফিল্ড, হাওয়ার্ড থারস্টন সব বিখ্যাত ম্যাজিসিয়ানরা স্টেজে নানা জিনিস, এমনকী মানুষ অদৃশ্য করে দেওয়া আবার তাকে ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ কতকটা টেলিপোর্টেশনের মতন ম্যাজিক দেখাত। তবে তারা সেটা করত নানান কৌশলে যেমন ট্র্যাপডোর, আয়না, যমজ ভাই বা বোন বা ডপ্লগেঞ্জার দিয়ে, নানা কথা বলে দর্শকদের ভুলিয়ে রেখে কাজ সারত। কল্পবিজ্ঞানগুলোতে যে পদ্ধতিগুলো বলা হয়েছে অবশ্যই তা নয়।”
অনন্ত, “এই ম্যাজিকের টেলিপোর্টেশন নিয়ে একটা নভেল আছে ব্রিটিশ লেখক ক্রিস্টোফার প্রিস্টের ‘দা প্রেস্টিজ’—ঊনবিংশ শতাব্দীর দুই বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ানের পারস্পরিক পেশাগত হিংসা ও প্রতিদ্বন্দিতার কাহিনি, একে অপরের দর্শকের সামনে হেয় করার ও বিশেষত একটা মানুষ টেলিপোর্টের কৌশলগত পদ্ধতি কে কীভাবে করছে, যা তাদের ট্রেড সিক্রেট, সেটা জানার প্রচেষ্টা। এটা ক্রিস্টোফার নোলান সিনেমাও করেছে ২০০৬ এ।”
“হ্যাঁ আমি বইটাও পড়েছি, সিনেমাটাও দেখেছি,” আমি বললাম, “তা হলে মিচেল থেকে শুরু করে সায়েন্স ফিকশনের গল্পগুলোতে এ যাবত টেলিপোর্টেশনের যে সব পদ্ধতিগুলো বলা হয়েছে সেগুলো দেখা যাক।
“প্রথম শুরু হয়েছিল কোনো তার বা কেবলের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রিসিটির সাহায্যে পদার্থকে আনবিক-পারমাণবিক স্তরে বিচ্ছিন্ন করে, প্রেরক পোর্টাল থেকে গ্রাহক পোর্টালে পরিবহন করে আবার আগের মতন একীকরণ করা, যেমনটা মিচেলের, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টে আর ওয়েলসের গল্পে আছে। কোনো বিশাল ভারী মেশিন যদি কারখানার এক জায়গা থেকে নিয়ে অন্য কোথাও নতুন করে বসাতে হয়, তবে মেশিনের সব পার্টস খুলে সে জায়গায় নিয়ে গিয়ে আবার নতুন করে পার্টসগুলো আগের মতন লাগিয়ে মেশিন চালু করতে হয়। নিশ্চয়ই এই আইডিয়া থেকে মিচেলের গল্পে ডিসইন্টিগ্রেশন-রিইন্টিগ্রেশন তত্ত্বের উদ্ভব যা পরবর্তীকালে প্রায় সব টেলিপোর্টেশন নিয়ে কল্পবিজ্ঞানের গল্পে দেখা যায়।
১৯০৫ সালে প্রকাশিত অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ অনুসারে পদার্থের ভর আর শক্তি একই সত্ত্বার ভিন্ন রূপ ও পারস্পরিক রূপান্তর ঘটে থাকে। ১৯৩০এর দশকে আইনস্টাইনের এই তত্ত্ব পরীক্ষিত সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হল। এবারে বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানেরও উন্নতি ঘটল। টেলিপোর্টেশনের দ্বিতীয় পদ্ধতিতে, বস্তুর পদার্থগুলিকে শক্তিতে রূপান্তর করে, সে শক্তিকে প্রেরক পোর্টাল থেকে গ্রাহক পোর্টালে পাঠিয়ে, শক্তি থেকে আবার পদার্থে রূপান্তরিত করে, বস্তুর পুনর্নিমাণ করা হল। এ ক্ষেত্রে কোনো তার বা কেবলের প্রয়োজন হল না। ফলে বহুদূরে এমনকী গ্রহান্তরেও টেলিপোর্ট করা গেল। আর্থার ক্লার্কের ‘ট্র্যাভেল বাই ওয়্যার’ গল্পে প্রথমে পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করে এনকোড করে, রেডিয়ো ওয়েভ দিয়ে গন্তব্যস্থলে পাঠিয়ে আবার ডিকোড করে শক্তিকে মূল পদার্থে পরিণত করা হয়। পরে অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তারের মধ্য দিয়ে বড়ো বড়ো শহরে টেলিপোর্ট করা শুরু হয় যেহেতু তারের মধ্য দিয়ে পাঠানোতে সুরক্ষা বেশি। গল্পের বর্ণনাকারী বিজ্ঞানী নিজে যখন নিউ ইয়র্কে গেলেন তখন কিন্তু প্লেনেই গেলেন—টেলিপোর্টিংএ ভরসা করেননি।”
“ক্লার্কের গল্পের শেষের এই চুটকিটা আমার খুব মজা লেগেছিল,” অনন্ত বলল।
“আমারও,” আমি বললাম, “‘জর্জ লাঙ্গেলান তাঁর ‘দ্য ফ্লাই’ গল্পে টেলিপোর্টেশন পদ্ধতি নিয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সিনেমাটাতে এই টেলিপোর্টেশন পদ্ধতি দেখান হয় যেখানে একটি কাচের বড়ো বাক্সে একটা গিনিপিগ রেখে বিজ্ঞানী মেশিন চালু করেন। বাক্স প্রথম নীল আলোয় ভরে উঠল আর তার পরেই এক তীব্র সাদা আলো ঝলসে ওঠার পর দেখা গেল গিনিপিগ অদৃশ্য আর খানিক দূরে আরেকটা কাচের বাক্সে গিনিপিগটা বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। এরপর ১৯৬৬ সালে আমেরিকান প্রযোজক জিন রডেনবেরি তাঁর বিখ্যাত স্টার ট্রেক টিভি সিরিয়েলে ব্যাপকভাবে এই টেলিপোর্টেশনের ব্যবহার করেন, ট্র্যান্সপোর্টার নামক এক যন্ত্রের সাহায্যে, স্টারশিপের মহাকাশচারী সদস্যদের বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে যাতায়াতের জন্য। এখানে পদার্থ থেকে শক্তি আর শক্তি থেকে পদার্থ এই পদ্ধতি ব্যাবহৃত হয়। এক ট্র্যান্সপোর্টারে অদৃশ্য হওয়া আর গন্তব্যস্থলের ট্র্যান্সপোর্টারে আবির্ভূত হওয়া কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। এর ফলে ব্যয়বহুল আর সময়সাপেক্ষ স্পেশাল এফেক্টগুলো যা স্পেসশিপগুলোর কোনো গ্রহে ল্যান্ডিং ও টেক অফ করা বা দুই স্পেসক্র্যাফটের ডকিং করার জন্য প্রয়োজন হত তার আর দরকার হল না। প্রযোজকের টিভি সিরিয়ালগুলোর তৈরি করার খরচ অনেক কমে গেল। স্টার ট্রেকের জনপ্রিয়তা টেলিপোর্টেশনের ওপর সিনেমা করতে আর কল্পবিজ্ঞানের বই লিখতে অনেককেই উৎসাহিত করল।
টেলিপোর্টেশনের তৃতীয় পদ্ধতিতে, কোনো যন্ত্রের সাহায্যে বস্তুর সকল পদার্থের আনবিক গঠনের সকল তথ্য সংগ্রহ করে সেই তথ্যকে সংকেতে পরিণত করা হয়, যা বস্তুর সঠিক আনবিক গঠন বর্ণনা করে। সে সকল সংকেত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গাকারে পাঠানো হয়। গ্রাহক পোর্টালে আরেকটি যন্ত্র দিয়ে সেই তথ্য অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ পদার্থ থেকে বস্তুটিকে আবার আগের মতন নির্মাণ করা হয়। ঠিক যেমন নক্সা দেখে একটা বাড়িকে বানানো যায়। এখানে অবশ্য মূল বস্তুটি তথ্য সংগ্রহের সময় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিংবা রয়ে যেতে পারে। আর মূল বস্তুটির একটি অনুলিপি তৈরি হয় আরেক জায়গায়, অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক ফ্যাক্স বলা যায়। ১৯৬০ সালে আলগিস বুড্রাইসের ‘রোগ মুন’, ১৯৯৫ সালে লেখা জেমস প্যাট্রিক কেলির ‘থিঙ্ক লাইক এ ডাইনোসর’ গল্পদুটিতে এই পদ্ধতিতে টেলিপোর্টেশন করা হয়েছে।”
অনন্ত বলল, “এই দুই গল্পেই কিন্তু মূল ব্যক্তিটি মৃত। তথ্য সংগ্রহের সময়ে আনবিক-পারমাণবিক স্তরে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করায় ব্যক্তিটির দেহ বা ব্রেন ধ্বংস হয়ে যায়। সামগ্রিক তথ্যের ব্লু-প্রিন্ট থেকে যেমন গ্রাহক পোর্টালে অনুলিপি তৈরি হচ্ছে তেমনই প্রেরক পোর্টালেও অনুরূপ অনুলিপি তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু মূল ব্যক্তি আর তার অনুলিপিদের মধ্যে মন, বুদ্ধি, স্মৃতি, চেতনা কি একই থাকবে? আর তড়িৎচুম্বকীয় শক্তির গতিই সর্বোচ্চ গতি। ধরা যাক পৃথিবী থেকে একটা মানুষকে দশ আলোকবর্ষ দূরে কোনো তারার গ্রহে পাঠানো হচ্ছে। তা হলে এই দশ বছর ধরে মৃত থেকে লোকটা আবার আগের মতন বেঁচে উঠবে? যদি পৃথিবীতে লোকটা মরে না গিয়ে বেঁচেও থাকে, তবে দূর গ্রহে যে লোকটা নতুন করে তৈরি হল, তখন তাহলে একই লোকের দু-দুটো সত্ত্বা—একই মন, একই বুদ্ধি, একই চেতনা? তা কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে? এই টেলিট্র্যান্সপোর্টেশন প্যারাডক্স বা ডুপ্লিকেটিং পারাডক্স নিয়ে ব্রিটিশ দার্শনিক ডেরেক পারফিট বিস্তর আলোচনা করেছেন তাঁর ‘রিসনস অ্যান্ড পারসনস’ বইতে।”
আমি বললাম, “এই সমস্যার কথা কল্পবিজ্ঞানের লেখকরা নিশ্চয়ই ভেবেছেন। তাই সবসময়ে একটি করে অনুলিপি রেখেছেন। ‘দ্য প্রেস্টিজ’ গল্পেও জাদুকর রুপার্ট অ্যাঞ্জিয়ার প্রতিবার টেসলার মেশিন দিয়ে টেলিপোর্টেশনের ম্যাজিক দেখানোর পর তার অনুলিপিকে মেরে ফেলতেন। অবশ্য মূল রুপার্ট আগেই মারা গেছেন, প্রথমবার টেলিপোর্টেশনের সময়ে। ‘থিঙ্ক লাইক আ ডাইনোসর গল্পেও, যাকে টেলিপোর্ট করা হত তাকে মেরে ফেলা হত, ‘টু ব্যালান্স দ্য ইকোয়েশন’।
আরেকটা মজাদার ব্যাপার আছে। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে গল্পের টেলিপোর্টেশনের মাধ্যমের উন্নতি। প্রথম দিকে ছিল পদার্থের পরিবহন ইলেকট্রিক তারের মধ্য দিয়ে। তাতে আর কতটুকু যাওয়া যায়? যতখানি তার, ততখানি দৌড়। যখন পদার্থ থেকে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে বা পদার্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে রেডিয়ো তরঙ্গে পাঠানো হল তখন অবধারিতভাবে মাধ্যম হল স্পেস বা মহাশূন্য। তাতে অবশ্য যতদূরই যাওয়া যাক না, গতির সীমাবদ্ধতা সর্ব্বোচ্চ ওই আলোর বা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের গতি। যদি এখান থেকে নিকটতম তারা আলফা সেন্টাউরির গ্রহে যেতে হয় তাতেও চার বছর লাগবে। গন্তব্যস্থল যত আলোকবর্ষ দূরে, টেলিপোর্টেশন করলেও তত বছরই লাগবে যেতে। তা হলে আর তাৎক্ষণিক পরিবহন কোথায় হল? যতই গল্পে থাক। ১৯৯৪ সালে ‘স্টার গেট’ সিনেমাটা ছিল এক প্রাচীন টেলিপোর্টেশন যন্ত্রের সাহায্যে ওয়র্মহোল সৃষ্টি করে তার মধ্য দিয়ে মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে এক গ্রহে অভিযানের কাহিনি। পরে এর অনেক টিভি সিরিয়াল হয়। সেখানেও এই ওয়র্মহোল ডিভাইস টেলিপোর্টেশনের মাধ্যম। এখানে আর ওই ডিসইন্টিগ্রেশন–রিইন্টিগ্রেশনের গল্প নেই। সোজা ওয়র্মহোলের মধ্য দিয়ে প্রেরক থেকে গ্রাহক পোর্টালে চোখের পলকে পাঠিয়ে দাও, তা সে যত আলোকবর্ষ দূরেই হোক না কেন। আচ্ছা এই ওয়র্মহোলের তত্ত্বটা যেন কী ছিল?”
অনন্ত বলল, “আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সমীকরণের এক বিশেষ সমাধান থেকে এই ওয়র্মহোল বা আইনস্টাইন-রোসেন ব্রিজের উদ্ভব। ধর একটা লম্বা রাস্তা ক্রস করে তুই ওপারে যাবি কোনো দোকানে। কিন্তু ডিভাইডার থাকায় তোকে অন্তত এক কিলোমিটার গিয়ে রাস্তা ক্রস করে আবার এক কিলোমিটার পেছনে আসতে হবে। তার বদলে যদি ওই জায়গাতে কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল বা ওভারব্রিজ থাকে তাহলে কয়েক পা গেলেই দোকানে যেতে পারবি। ওয়র্মহোলও সে রকম শর্টকাট। এটা অবশ্য গাণিতিক ধারণা কিন্তু একে কল্পনা করতে পারি একটা সুড়ঙ্গের মতন যা মহাকাশের স্থানকালের বক্রতার ফলে বিস্তর দূরত্বের দুটি বিন্দুকে স্বল্পদূরত্বে সংযোগ করতে পারে।
কিন্তু আজ অবধি মহাকাশে এরকম কোনো ওয়র্মহোলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বছর কয়েক আগের একটা রিসার্চ পেপার বলছে ওয়র্মহোলের দুটো গোলাকার মুখ আর একটা সংযোগকারী গলা যা সোজাও হতে পারে আবার এত প্যাঁচানো হতে পারে যা আসল দূরত্বের থেকেও বেশি। এই ওয়র্মহোল যদিও সায়েন্স ফিকশনের গল্প-উপন্যাস ও সিনেমার দিগন্ত খুলে দিয়েছিল মহাকাশে আন্তর্নক্ষত্র ভ্রমণের, কিন্তু আসল কথা হল বাস্তবে তা অসম্ভব। কোনো ভরযুক্ত বস্তু এর ভেতর দিয়ে যাবার চেষ্টা করলেই এ সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে।
বিখ্যাত পদার্থবিদ ২০১৭ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কিপ থর্ন যিনি রিলেটিভিটি, ব্ল্যাক হোল, ওয়র্মহোল বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, বলেছেন, ‘দুঃখের কথা হল যে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলিই ওয়র্মহোলের ভেতর দিয়ে মানুষকে ভ্রমণ করতে দেয় না।’ তবে থর্ন এটাও দেখেছেন যে শক্তিশালী মহাকর্ষীয় বস্তু যেমন সূর্য কিংবা ব্ল্যাক হোল আলোর রশ্মিকে ভেতর দিয়ে বেঁকিয়ে দেয়, অর্থাৎ কনভেক্স লেন্সের মতন, কিন্তু বাইরের দিকে বাঁকাতে বা কনকেভ লেন্সের মতন ছড়িয়ে দিতে পারে না। একমাত্র বস্তুর ভর বা শক্তি নেগেটিভ হলে আলো বাইরের দিকে বাঁকতে পারে। তাই কোনো গোলাকৃতি ওয়র্মহোলের ভেতর দিয়ে কোনো কিছুকে আলোর গতিতে যেতে হলে তার ভেতরে নেগেটিভ শক্তি সম্পন্ন পদার্থ থাকতে হবে। এ জাতীয় পদার্থকে বলে এক্সোটিক ম্যাটার। অবশ্য থর্নের চিন্তার আগেই ১৯৭৫-এ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেনি গ্যানন তাঁর এক থিওরেমে এ বিষয় প্রমাণ করেছিলেন, যা থর্নের অজ্ঞাত ছিল। এখন ল্যাবরেটরিতে খুব ক্ষীণ হলেও বিজ্ঞানীরা নেগেটিভ শক্তির সন্ধান পেয়েছেন (ক্যাসিমির এফেক্ট) কিন্তু বহু চেষ্টা সত্ত্বেও প্রকৃতিতে এর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাই ওয়র্মহোলের ভেতর দিয়ে টেলিপোর্টেশন ফ্যান্টাসিই রয়ে গেল।”
“আবার মজার ব্যাপার কি জানিস?” আমি বললাম, “ক্রিস্টোফার নোলান ২০১৪-তে ইন্টারস্টেলার নামে যে সায়েন্স ফিকশনের সিনেমাটা করেছিলেন, এই কিপ থর্ন ছিলেন তার এক্সিকিউটভ প্রোডিউসার আর সায়েন্টিফিক কনসালট্যান্ট। ইনি এই ইন্টারস্টেলার সিনেমার গল্পের পেছনে যে বিজ্ঞান কাজ করছে, তার ওপরে একটা বই লিখেছেন, ‘দ্য সায়েন্স অব ইন্টারস্টেলার’। কিপ থর্ন এই সিনেমার সঙ্গে প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন। স্টিভেন স্পিলবার্গের পরিচালনা করার কথা ছিল। পরে নোলান ডিরেক্টার নিযুক্ত হন। গল্প ও স্ক্রিপ্ট লেখার সময়ে কিপ থর্ন দুটি বিষয়ে বিশেষ ভাবে নজর দিতে বলেছিলেন—
- সিনেমার কোনো বিষয় বা দৃশ্য যেন সুপ্রতিষ্ঠিত পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলি বা মহাবিশ্ব সম্বন্ধে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত তত্ত্বগুলি উল্লঙ্ঘন না করে।
- মহাবিশ্ব আর তার স্বল্প বোঝা ভৌত সূত্রগুলি নিয়ে যত সুদূরপ্রসারী জল্পনা করা হোক না, সেগুলি যেন প্রকৃত বিজ্ঞানসম্মত হয় আর সেই ধারণাগুলো যেন আর পাঁচজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের মতে সম্ভবপর বলে গৃহিত হয়।
পুরো সিনেমাটা যাতে বিজ্ঞানের দিক থেকে সম্পূর্ণ অবাস্তব বা অসম্ভব না হয় সেটার দিকে থর্নের নজর ছিল।
নোলান বলেছিলেন যে কিপ থর্ন সায়েন্স-পুলিশের ভূমিকা ছাড়াও লেখার ব্যাপারেও সাহায্য করেছেন। আসলে হলিউডের এই নোলান, স্পিলবার্গ, স্ট্যানলি কুব্রিকের মতন নামকরা ডিরেক্টাররা সিনেমা করার সময়ে বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন, পরামর্শ নেন যাতে তাঁদের করা সিনেমাটা ধ্রুপদী কল্পবিজ্ঞান হয়—উদ্ভট অবাস্তব ফ্যান্টাসি না হয়ে যায়।
আরেক ধরনের টেলিপোর্টেশনের কথা সায়েন্স ফিকশনে পাওয়া যায় যা করা হয় মানুষের মন আর ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগে অর্থাৎ যাকে সায়োনিক টেলিপোর্টেশন বা মানসিক টেলিপোর্টেশন বলা যায়, যেখানে মনের ইচ্ছেশক্তির সাহায্যে কোনো বস্তুকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানো যায় বা কোনো ব্যক্তি স্থানান্তরে নিমেষের মধ্যে চলে যেতে পারে। এখন এই মানসিক ক্ষমতা সম্পর্কিত বিষয়গুলি যেমন, মানসিক টেলিপোর্টেশন, সাইকোকাইনেসিস বা টেলিকাইনেসিস, টেলিপ্যাথি এগুলো নিয়ে বহুকাল ধরেই চর্চা হয়ে আসছে। বহু গল্প, উপন্যাস, সিনেমা এই বিষয়ে হয়ে গেছে। অনেক সিদ্ধাই যোগী বা বৌদ্ধ লামাদের এ ধরনের শক্তি ও ক্ষমতা সম্বন্ধে নানা কাহিনি শোনা যায়। তবে প্যারাসাইকোলজির বিষয়গুলি কখনই বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের আওতায় স্বীকার করা হয় না এবং কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা তথ্যপ্রমাণের অভাবে এদের নিয়ে আলোচনা করাটাও বৃথা। আলফ্রেড বেস্টারের ‘দ্য স্টারস মাই ডেস্টিনেশন’, স্টিভান গোল্ডের ‘জাম্পার’, রবার্ট হাইনলাইনের ‘টানেল ইন দ্য স্কাই’ বইগুলো মানসিক টেলিপোর্টেশনের ওপর ভিত্তি করে। আর একটা গল্পের কথা না বললেই নয়। আইজাক অ্যাসিমভের ‘ইটস সাচ আ বিউটিফুল ডে’ গল্পটা?”
অনন্ত, “দারুণ। সেখানে টেলিপোর্টেশনের কোনো পদ্ধতি বলা হয়নি। ডিস্ট্রিক্টের সব বাড়ি, স্কুল, অফিস, সর্বত্র একটা করে বিশেষ দরজা আছে যেখানে গন্তব্যস্থলের কো-অর্ডিনেট ডায়াল করে দরজার ভেতর দিয়ে সেখানে চলে যাওয়া যায়। মানুষ অতিরিক্ত বিজ্ঞান আর টেকনোলজি নির্ভর হয়ে পড়লে সুন্দর প্রকৃতিকে কী ভবে হারাবে সেটা অ্যাসিমভ দেখিয়েছেন। আচ্ছা, এবারে বল তো, ভূতের রাজার বরে, জুতো পায়ে দিয়ে, এ ওর হাতে তালি দিয়ে হুন্ডি, ঝুন্ডি, শুন্ডি বা হীরক রাজার দেশে গুপি বাঘার এক নিমেষে হুস্ করে চলে যাওয়াও তো টেলিপোর্টেশনই।”
আমি হেসে অনন্তর দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “ভালো বলেছিস, একশো ভাগ সহমত। নাগড়া জুতো আর হাততালির যুগলবন্দীতে কোনো ওয়র্মহোলের সৃষ্টি হচ্ছিল কি না কে বলতে পারে? যাক, এবারে আমাদের আলোচনা কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন নিয়ে যেটা কিছুটা তোর বিষয়। এটা কী ব্যাপার আমাকে বোঝা।”
ইতিমধ্যে নন্দু আরও দু-কাপ কফি রেখে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে অনন্ত বলল, “কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের কথা একটু পরে আসছি। তার আগে এই নন-কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন কতটা সম্ভব বা তাত্ত্বিক দিক থেকে সম্ভবপর হলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে আদৌ সম্ভব কি না সেটা বুঝতে হবে…”
“নন-কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন মানে তুই ক্ল্যাসিক্যাল টেলিপোর্টেশন বলছিস তো যা এই কল্পবিজ্ঞান গল্পগুলোতে পাই?”
অনন্ত, “আসলে ক্ল্যাসিক্যাল টেলিপোর্টেশন বলতে সাধারণত কোনো তথ্য বা ছবি বা কথা-গান, তার বা কেবল বা রেডিয়ো তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠানোকে বোঝানো হয়। যেমন, ইমেল, ফ্যাক্স বা টেলিভিশনে লাইভ প্রোগ্রাম যাকে সাদা বাংলায় বলি টেলি-যোগাযোগ। এ তো আমরা রোজই ব্যবহার করছি। তবে সায়েন্স ফিকশনে যে টেলিপোর্টেশন পাই তাকে অনেকে অবশ্য ক্ল্যাসিক্যাল টেলিপোর্টেশন বলেন। কিন্তু প্রথম দিকে সায়েন্স ফিকশনগুলোতে যে ইলেকট্রিক তারের মধ্য দিয়ে ম্যাটার ট্রান্সমিশন বা পদার্থের পরিবহনের কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবে অসম্ভব। ইলেকট্রিক তার বা কেবলের মধ্য দিয়ে একমাত্র ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক সিগন্যাল বা ইলেকট্রন ছাড়া আর কোনোরকম পদার্থ কণাই প্রবাহিত হতে পারে না। আর গ্রাহক পোর্টালে শুধু ইলেকট্রন দিয়ে তো আর বস্তু বা ব্যক্তির পুনর্গঠন হবে না।
আবার যদি পদার্থকে শক্তিতে পরিণত করে তার বা রেডিয়ো তরঙ্গের সাহায্যে পাঠানো হয় সেখানেও বিশাল ঝামেলা আছে। প্রথম কথা পদার্থকে বা ম্যাটারকে শক্তিতে পরিণত করতে হলে সমপরিমাণ অ্যান্টিম্যাটার লাগবে। প্রকৃতিতে অ্যান্টিম্যাটারের সংখ্যা অত্যন্ত নগন্য। ওই কসমিক রে থেকে কালেভদ্রে পোসিট্রন ও অ্যান্টিপ্রোটন ছিটেফোঁটা পৃথিবীতে আসে। কৃত্রিম উপায়ে পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটারে কিছু অ্যান্টিম্যাটার তৈরি হয়, তা বছরে কয়েক ন্যানোগ্রাম কারণ অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করতে বিপুল শক্তি ও অর্থের প্রয়োজন…”
আমি, “ধর, একটা সত্তর কিলোগ্রাম লোককে অ্যান্টিম্যাটার দিয়ে শক্তিতে পরিণত করতে কতটা শক্তি লাগতে পারে?”
অনন্ত ওর মোবাইলে ক্যালকুলেটারে খুট খুট করে কীসব লিখল। তার পর আমায় বলল, “এক গ্রাম অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করতে ৯ x ১০১৩ জুল শক্তির প্রয়োজন। সেই হিসেবে একজন সত্তর কিলোগ্রাম ওজনের লোকের অ্যান্টিম্যাটার তৈরির জন্য লাগবে ৬.৩ x ১০১৮ জুল শক্তি। এ যাবত সবচেয়ে শক্তিশালী যে পরীক্ষামূলক থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা ‘ত্সার বম্বা’ ফাটানো হয়েছে তার নির্গত শক্তি ২.০৯ x ১০১৭ জুল। অর্থাৎ এর থেকেও তিরিশ গুণ শক্তি লাগবে সত্তর কিলো অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করতে। এক গ্রাম অ্যান্টিপ্রোটন তৈরি করতে খরচ পড়ে ৬২.৫ ট্রিলিয়ন (১ ট্রিলিয়ন = ১ লক্ষ কোটি) ডলার। ১ মিলিগ্রাম পোসিট্রন তৈরিতে খরচ ২৫ বিলিয়ন ডলার।
এ ছাড়া অ্যান্টিম্যাটার স্টোর করাটা তৈরি করার থেকেও অনেক বেশি ঝামেলার। ম্যাটারের সংস্পর্শে এলেইতো শক্তিতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তার জন্য বিশেষভাবে তৈরি অক্টোপোল ম্যাগনেটিক বোতল তৈরি করেছেন যার নাম মিনিমাম ম্যাগনেটিক ফিল্ড ট্র্যাপ। একটি প্রকাশিত রিসার্চ রিপোর্ট বলছে যে বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতিতে আটতিরিশটা অ্যান্টিহাইড্রোজেন পরমাণুকে একশো বাহাত্তর মিলিসেকেন্ড স্টোর করতে পেরেছিলেন। সুতরাং একটা সত্তর কিলোগ্রাম লোককে শক্তিতে পরিণত করে টেলিপোর্টেশন করার কাজটা আপাতত কল্পবিজ্ঞানের লেখকগণ বা সিনেমাওয়ালাই না হয় করুক।”
আমি, “আর তৃতীয় পদ্ধতি যেখানে সমস্ত বস্তু বা দেহ স্ক্যান করে সকল তথ্য পাঠিয়ে লোকাল ম্যাটার দিয়ে বস্তু বা দেহকে পুনর্নিমাণ করা—সেটা কি সম্ভব?”
অনন্ত কফির শেষ চুমুক দিয়ে বলল, “সমস্যা আছে অনেক। তত্ত্ব যত রোমান্টিক হোক না কেন, বাস্তব বড়ো কঠিন ঠাঁই। আমি বেশ কিছুদিন আগে টেলিপোর্টেশন নিয়ে একটা গল্প পড়তে গিয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু ক্যালকুলেশন করি। একটা সত্তর কিলোগ্রাম ওজনের লোকের শরীরের পরমাণুর সংখ্যা মোটামুটি ৭ x ১০২৭। এর মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ হল হাইড্রোজেন, অক্সিজেন আর কার্বন। এখন এই বিপুল পরিমাণ পরমাণুর সঠিক ধরণ, সংখ্যা আর অবস্থান এর তথ্য, অনুগুলোর রাসায়নিক বন্ধন, ওরিয়েন্টেশন, কোয়ান্টাম অবস্থা এবং আনবিক স্তর যেমন ডিএনএ, প্রোটিন থেকে ম্যাক্রোস্কোপিক স্তরে অর্থাৎ দেহ অঙ্গ, টিস্যু ইত্যাদির জৈবিক কাঠামোর বিন্যাস—সব কিছুর তথ্য প্রয়োজনে মাপঝোক করে সংগ্রহ করে কম্পিউটারে স্টোর করতে হবে। এর জন্য দরকার হবে ৮৫৪ x ১০২৭ মেগাবাইট অর্থাৎ ৮.৩৪ x ১০২০ এক্সাবাইট মেমোরি। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার জাপানের ‘ফুগাকু’র মেমোরিতে স্টোর করে রাখার ক্ষমতা ১.২ এক্সাবাইট…”
আমি, “আচ্ছা এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে এল। কার্ল সাগান মানব সভ্যতা কতটা যেতে পারে তার একটা স্কেল বলেছিলেন, কারদাসেভ স্কেলের মতন। সাগানের শ্রেণিবিন্যাসে ইংরেজি হরফ A হচ্ছে ১০৬ বিট অর্থাৎ ১২৫ কিলোবাইট তথ্য। এরপর ক্রমান্বয়ে ১০-এর গুণে বাড়তে বাড়তে হরফ Z হল ১.২৫ × ১০৯ জেটাবাইট তথ্য। ১ জেটাবাইট মানে ১০২১ বাইট। ১৯৭৩ সালের হিসেবে পৃথিবীর তথ্যভাণ্ডার ছিল ১২৫০ গিগাবাইট আর সেখানে ২০১৩ সালের হিসেবে তা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৪ জেটাবাইট। International Data Corporation-এর এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২০২৫ সালে পৃথিবীর তথ্যভাণ্ডার গিয়ে দাঁড়াবে ১৬৩ জেটাবাইট। আর সেখানে টেলিপোর্টেশনে লাগছে ৮.৩৪ x ১০২০ এক্সাবাইট অর্থাৎ ৮.৩৪ x ১০১৭ জেটাবাইট। কার্ল সাগানের মতে এই মহাবিশ্বে কোনো সভ্যতাই এই Z লেভেলে পৌঁছতে পারেনি। তার মানে টেলিপোর্টেশনের জন্য মানব দেহের সকল তথ্য স্টোর করে রাখার ক্ষমতা মানুষের কোনোদিনই হবে না।”
অনন্ত বলল, “তাই তো দেখা যাচ্ছে বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণ করে। তা ছাড়াও আর একটা সমস্যা হচ্ছে প্রেরক পোর্টাল থেকে গ্রাহক পোর্টালে ডেটা পাঠানো। এই ২০২৪ সালে ওয়াইফাই দিয়ে সবথেকে বেশি ইন্টারনেট স্পিড হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ৩.৫৭ গিগাবিটস। ভবিষ্যতে স্পিড নিশ্চয়ই আরও বাড়বে। তবে এখন এই স্পিডে টেলিপোর্টেশনের একজন মানুষের দেহের সব ডেটা পাঠাতে গেলে সময় লাগবে ৫.৯৩ x ১০২২ বছর। সূর্যই তো আর বড়ো জোর পাঁচশো কোটি বছর থাকবে।
টেলিপোর্টেশনে ডেটা স্ক্যানিংএ আরেকটা বাধা হাইজেনবার্গ অনিশ্চয়তা নীতি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই নীতি অনুসারে একটি কণার অবস্থান এবং ভরবেগ উভয়ই একই সঙ্গে নির্ভুলভাবে জানা অসম্ভব। এই নীতি কখনোই আমাদের একটি দেহের সমস্ত কণার অবস্থা সঠিকভাবে পরিমাপ করতে দেবে না আর তার ফলে দেহের পারমাণবিক কনফিগারেশনের উপর ভিত্তি করে দেহের পুনর্গঠন তাত্ত্বিকভাবেই হোক আর বাস্তবেই হোক অসম্ভব।”
আমি হেসে বললাম, “কেন ‘হাইজেনবার্গ কম্পেনসেটার’?
অনন্তও হেসে বলল, “হ্যাঁ সেই। স্টার ট্রেক সিরিয়েলের টেলিপোর্ট করার যন্ত্র ট্রান্সপোর্টার সিস্টেমের একটা অংশ ছিল এই ‘হাইজেনবার্গ কম্পেনসেটার’ যা দিয়ে অনিশ্চয়তা দূর করে উপপারমাণবিক কণাগুলোর অবস্থান ও ভরবেগ দুটোই নিঁখুতভাবে মাপা যায়। এখন কীভাবে এটা কাজ করে এই প্রশ্ন ১৯৯৪ সালে টাইম ম্যাগাজিন ‘স্টার ট্রেকে’র আর্ট সুপারভাইসার মাইকেল ওকুডাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এগুলো ভালোই কাজ করে, ধন্যবাদ’।”
“কল্পবিজ্ঞানের গল্পে, সিনেমায় এরকম বেশ কিছু অদ্ভুত অবাস্তব যন্ত্রের দেখা পাওয়া যায় যাদের নামের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পরিভাষার যোগ থাকলেও বিজ্ঞানের সঙ্গে এদের কোনো যোগ নেই বা কোনোকালে যোগ হবার সম্ভাবনাও নেই। এবারে আমার একটা প্রশ্ন আছে”, আমি বললাম, “কল্পবিজ্ঞানের গল্প অনুযায়ী যে মানুষকে টেলিপোর্ট করা হচ্ছে তাকে একেবারে পারমাণবিক স্তরে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে তা সে পদার্থ বা শক্তি বা তথ্য পরিবহন, যে পদ্ধতিই হোক, সেক্ষেত্রে মানুষটির মৃত্যু অবধারিত, যে অবস্থা থেকে তাকে বাঁচানো আর সম্ভব নয়। এখন পদার্থ, বা শক্তি বা তথ্য পরিবহনের সর্বাধিক গতি যাই হোক গ্রাহক পোর্টালে পৌঁছতে যে সময় লাগবে ততক্ষণ সে মৃত। আবার সেখানে রিইন্টিগ্রেশনের পর সে আবার বেঁচে উঠে আগের মানুষ হয় কী করে? তা হলে তো যে কোনো মরা মানুষকেই বাঁচিয়ে তোলা যায়। কিন্তু তা তো হয় না। বেঁচে থাকা অবস্থায় তার যে মন, বুদ্ধি, স্মৃতি, অহং-বোধ বা চেতনা সব মিলিয়ে আমরা যাকে সূক্ষ্মদেহ বা আত্মা বলি যারা কোনোটাই পদার্থ নয়, সেগুলো কীভাবে টেলিপোর্ট করা হবে? একটা মানুষের দেহ গ্রাহক পোর্টালে এসে বেঁচে উঠবে কীভাবে?”
অনন্ত আমার দিকে কিছুক্ষণ একটু প্যাঁচার মতন চেয়ে থেকে বলল, “দেখ প্রশ্ন আছে ঠিকই কিন্তু উত্তর নেই অর্থাৎ উত্তর কারোরই জানা নেই। না বিজ্ঞানীদের, না কল্পবিজ্ঞানের লেখকদের। বর্তমান পৃথিবীর একদম প্রথম সারির তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, স্ট্রিং থিয়োরি, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি বিশেষজ্ঞ ও যাঁর এই টেলিপোর্টেশন, প্যারালেল ওয়ার্ল্ড, টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে অনেক পপুলার সায়েন্সের বই লেখা আছে সেই মিশিও কাকুকে এই ধরনের প্রশ্ন করা হলে তিনি তিনটি শব্দে এর উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আই ডোন্ট নো’। আর বিজ্ঞানীরা যদি কল্পবিজ্ঞানের গল্পের প্রতিটি বিষয়ে খুঁত ধরে, এটা হয় না, ওটা অবাস্তব বলে ঝামেলা করে তা হলে তো লেখকরা কোনোদিনই কল্পবিজ্ঞানের গল্প-উপন্যাস লিখে উঠতে পারবে না। তাঁরা যা লিখছে লিখতে দে—পাঠকের ভালো লাগলে নেবে, না লাগলে নেবে না। এইজন্যই অদ্রীশ বর্ধন বোধ হয় একটা কথা ঠিকই লিখেছেন তাঁর প্রফেসর নাটবল্টুচক্র গল্পসমগ্রের ভূমিকায়, “ভূতের গল্প যেমন ভূতেদের জন্যে নয়, ঠিক তেমনই কল্পবিজ্ঞানও বৈজ্ঞানিকদের জন্যে নয়…।
আমাদের বর্তমানের এমনকী অদূর ভবিষ্যতের বিজ্ঞান ও টেকনোলজির যে সীমাবদ্ধতা আর তার সঙ্গে প্রাণ ও চেতনা জাতীয় যে দার্শনিক প্রশ্নগুলো সেসব বিচার করে বিজ্ঞানীদের ধারণা যে ক্ল্যাসিক্যাল টেলিপোর্টেশন কখনোই সম্ভবপর নয়। ওটা কল্পবিজ্ঞানের গণ্ডিতেই চিরকাল থাকবে। বরং যেটাতে পরীক্ষালব্ধ ফল পাওয়া গেছে তা কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন। এখন প্রায় বেলা সাড়ে বারোটা বাজে। চল, স্নান করে খেয়ে দেয়ে ব্যালকনিতে বসে তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।”
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন
দুজনেই স্নান সেরে লাঞ্চ করে নিলাম। ওপরে বিশাল ছাদে হোটেলের খাবার জায়গা। টিনের চালের নীচে ফলস্ সিলিং। একদিকে বড়ো একটা বিলিয়ার্ড টেবিল, বলগুলো টেবিলের ওপর ছড়ান, কিউ স্টিকটা একদিকে রাখা। চৌকো মাপের ছ-টা টেবিল আর কাঠের চেয়ার সাজান। একদিকে কিচেন আর স্টোররুম। বাইরে বেসিন। টয়লেটও একটা রয়েছে। দু-একদিন আগে কোনো বাচ্চার জন্মদিনের পার্টি ছিল মনে হয়। এখনও এখানে ওখানে চুপসানো বেলুন, রঙিন ক্রেপ কাগজের ফিতে ঝুলছে। দুপুরে ভাত, মুসুরির ডাল, ফেঞ্চ ফ্রাই আর পাঠার মাংসের ঝোল। মন্দ নয় রান্না। ছোটো হোটেল—কী খাব আগে থেকে বলে রাখতে হয়, তাহলে ওরা ব্যবস্থা করতে পারে।
খেয়েদেয়ে আধাঘণ্টাটাক একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে দুজনেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল প্রায় পৌনে চারটে। ঘরে ইলেকট্রিক কেটলি ছিল। হোটেল থেকে দুটো কফি মগ দিয়েছিল। আমরা নেসকাফের বড়ো শিশি নিয়ে এসেছিলাম। কফি নিয়ে দুজনে ব্যালকনিতে এসে বসলাম। পাহাড়ের ওদিকটা বেশ মেঘলা। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ। কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, “এবারে তুই কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন নিয়ে বলবি। তবে সহজ করে বলবি, মাথার ওপর দিয়ে যেন না যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স শেষ পড়েছিলাম এমএসসিতে। সব ভুলে মেরে দিয়েছি।”
অনন্ত হেসে বলল “দ্যাখ সব থেকে কঠিন হচ্ছে কোয়ান্টাম ব্যাপারগুলো সহজ করে বলা। গত পঁচাত্তর বছরে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের মতন তুখোর বিজ্ঞানী যেখানে বলেছেন, ‘I can safely say that nobody understands quantum mechanics’ আমরা কোন ছাড়। যা হোক চেষ্টা করব। তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রারম্ভিক দিক বা কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন, শ্রোডিংগারের ওয়েভ মেকানিক্স এসব নিয়ে এখন আলোচনা করে লাভ নেই। দাঁড়া তোকে একটা কার্টুন দেখাই। একটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের লেকচারে পেয়েছিলাম।”
এই বলে অনন্ত ওর মোবাইলে রাখা একটা ছবি আমাকে দেখাল।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনে দুটো শব্দ—কোয়ান্টাম আর টেলিপোর্টেশন। আমরা সকালে ক্ল্যাসিক্যাল টেলিপোর্টেশন নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি, যা বর্তমান এমনকী আগামী অদূর কেন সুদূর ভবিষ্যতের বিজ্ঞান বা কারিগরির দিক থেকেও অসম্ভব বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। কিন্তু কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন তা নয়—এর তত্ত্বও যেমন সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেও সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন হল কিছু কোয়ান্টাম বস্তুর কোয়ান্টাম অবস্থা, কোনো পরিবর্তন ছাড়াই অন্য কোয়ান্টাম বস্তুতে স্থানান্তর করা।”
আমি যতটা সম্ভব ঘাড় পেছনে হেলিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম।
অনন্ত একটু থমকে বলল, “কী হল?”
“না, দেখছিলাম তোর শেষ কথাটা মাথার কত ওপর দিয়ে গেল।”
“আরে দাঁড়া না, আগে আমায় সবটা বলতে দে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে কোয়ান্টাম কথার অর্থ মিথস্ক্রিয়ায় জড়িত কোনো ভৌত সত্ত্বার সর্বনিম্ন পরিমাণ। যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, নিউট্রিনো, কোয়ার্ক, ফোটন বা আলোককণা, গ্লুওন, বোসন অর্থাৎ যারা কণা- ও তরঙ্গ- উভয়বিধ ধর্মই অনুসরণ করে। এই কোয়ান্টাম থেকেই এসেছে আরেকটি শব্দ কোয়ান্টাইজেশন যা একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো ভৌত রাশি বা পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তিত না হয়ে ধাপে ধাপে নির্দিষ্ট মানে পরিবর্তিত হয়। যেমন ইলেকট্রনের শক্তির কতকগুলো নির্দিষ্ট স্তর আছে যেগুলো সে নিতে পারে আর মাঝের বাকি যে স্তরগুলো থাকে তা নিতে পারে না। কিন্তু ক্ল্যসিক্যাল পদার্থবিদ্যায় ইলেকট্রনের সব স্তরের শক্তি নিতে পারে।
এবারে আরেকটি শব্দ হচ্ছে কোয়ান্টাম স্টেট বা অবস্থা যা একটি কোয়ান্টাম সিস্টেমের অর্থাৎ এক বা একাধিক কোয়ান্টাম কণার সব তথ্য যথা অবস্থান, গতি, শক্তি, ভরবেগ ইত্যাদি বর্ণনা করার জন্য প্রয়োজনীয় বিবরণ, যা পরিমাপের ফলাফলগুলোর সম্ভাব্যতা (প্রোব্যাবিলিটি) বর্ণনা করে। কোনো কণা বা সিস্টেমের পুরো কোয়ান্টাম স্টেটকে যার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তাকে বলে ওয়েভ ফাংশন যা একটি গাণিতিক ফাংশন। ওয়েভ ফাংশন সাধারণত ψ(x,t) দিয়ে প্রকাশ করা হয়, যেখানে x হল স্থান এবং t হল সময়।
ওয়েভ ফাংশন ψ(x,t) এর মান বর্গ (∣ψ(x,t)∣2) হল সম্ভাবনা ঘনত্ব বা প্রোব্যাবিলিটি ডেন্সিটি যা নির্দেশ করে যে কণা নির্দিষ্ট স্থান এবং সময়ে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকার সম্ভাবনা কত। ওয়েভ ফাংশনটি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে এবং এই পরিবর্তনটি শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ (Schrödinger’s equation) দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়।
কোয়ান্টাম স্টেট যখন একাধিক অবস্থার একত্রিত রূপে থাকে তখন তাকে বলে সুপারপোজিশন বা উপরিপাতন। যেমন একই ইলেকট্রন একই সময়ে দুটি ভিন্ন শক্তি স্তরে থাকতে পারে যতক্ষণ না তা পরিমাপ করা হয়। কোয়ান্টাম সিস্টেমের কণাগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকতে পারে, যা এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট বা বিজড়ন নামে পরিচিত। এতে একটি কণার অবস্থা অন্য কণার উপর নির্ভরশীল হয়, এমনকী তারা একে অপরের থেকে অনেক দূরে থাকলেও। যাকে বলে লং ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপ। যখনই দুটো বা ততোধিক কণা এন্ট্যাঙ্গলড হয়, তাদের কোয়ান্টাম স্টেট কখনও স্বাধীনভাবে আলাদা করে বর্ণনা করা যায় না। যত দূরেই কণারা থাকুক না কেন একটার অবস্থার পরিবর্তন অপরটির অবস্থাকে প্রভাবিত করে।
যেমন ধর, দুটো ফোটনকে এন্ট্যাঙ্গল করা হল আর তারা প্রারম্ভিক স্তরে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া করল যাতে পরবর্তীকালে তাদের কোয়ান্টাম অবস্থা শুধু একটি ওয়েভ ফাংশন দিয়ে বর্ণনা করা যায়। এবারে তারা যতদূরেই আলাদা হয়ে যাক না কেন, সে এক মিটারই হোক আর কয়েকশো আলোকবর্ষই হোক, তারা সেই একই ওয়েভ ফাংশন ভাগ করে নেবে। সুতরাং একটার পরিমাপ করলে অপরটারও অবস্থা জানা যাবে। যেমন ধর মুলুন্দ অঞ্চলের কোনো ফুডস্টল থেকে একটা বার্গার আর একটা চিকেন স্যান্ডুইচ অর্ডার করা হল। আলাদা করে দুটো বাক্সে প্যাক করে পাঠাবে, একটা ঠানেতে তোর কাছে আর একটা পাওয়াইতে আমার কাছে। এবার তোর কাছে যখন প্যাকেট এল তুই জানিস না এর ভেতরে কী আছে। খুলে দেখলি বার্গার—সঙ্গে সঙ্গেই তুই বুঝে গেলি যে আমার বাক্সে স্যান্ডুইচ আছে…”
আমি বললাম, “বুঝলাম। মানে সোর্স কোহেরেন্ট অর্থাৎ উৎস এক হওয়া চাই। ফিজিক্সের একটা উদাহরণ দে।”
অনন্ত, “এক্সাক্টলি। সোর্স কোহেরেন্ট হতে হবে। তুই জানিস যে স্পিন কোয়ান্টাম কণাগুলোর ভর, চার্জ ইত্যাদির মতন একটা বৈশিষ্ট্য যা কণা কী ভাবে অন্য কণা বা ক্ষেত্রের যেমন চৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাক্ট করবে তা নির্ধারণ করে। স্পিনের মান ইলেকট্রন ও প্রোটনের ১/২ (অর্ধেক) হয় আর আপ ডাউনও হয় যা ওপর দিকে ও নীচের দিকে তির চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়। ফোটনের স্পিন ১ আবার পাই-মেশন কণার স্পিন শূন্য (০)। এখন একটা পাই-মেশন ক্ষয়প্রাপ্ত হলে একটা ইলেকট্রন ও একটা পোজিট্রন উৎপন্ন হয়। সুতরাং তারা এন্ট্যাঙ্গলড কণা—একই উৎস থেকে আসছে। এবারে আলাদা হয়ে যত দূরেই চলে যাক না কেন, যে কোনো একটার স্পিন মাপলে অপর কণার স্পিন তৎক্ষণাৎ জেনে যাব।
আইনস্টাইন কখনোই কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মেনে নেননি। তিনি বিজ্ঞানের নিশ্চয়তাবাদের পক্ষেই সওয়াল করে এসেছেন, বিপুল সফলতা সত্ত্বেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তাবাদকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘God does not play a dice’। নানারকম থট-এক্সপেরিমেন্টের সাহায্যে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভুল ধরার চেষ্টা করেছেন, যদিও সফল হননি। তার মধ্যে একটি হল EPR Paradox যা নিয়ে আইনস্টাইন, বোরিস পোডলস্কি আর নাথান রোসেন ১৯৩৫ সালে ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যেটি কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেলমেনন্টেরই উদাহরণ, যেখানে তাঁরা বলেন যে কোনো কোয়ান্টাম সিস্টেমের স্থানিকভাবে বিচ্ছিন্ন অংশগুলি একে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এই এন্ট্যাঙ্গেলমেন্টকে তিনি বলেছিলেন, ‘Spooky action at a distance’। কারণ তাঁর মতে কোনো তথ্যই আলোর গতির চেয়ে দ্রুতগতি হতে পারে না। তা হলে বহুদূরবর্তী কণার অবস্থা কীভাবে জানা যাবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে কোনো কণা বা কোনো তথ্যের পরিবহন হচ্ছে না।
এই কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেলমেন্টই কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের মূল অস্ত্র। এই কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট না হলে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন আদৌ হত না। বিজড়িত কণাগুলি কোনো কণার কোয়ান্টাম অবস্থাকে এক অবস্থান থেকে অন্যস্থানে টেলিপোর্ট করার মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। এখন এই কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন কীভাবে হয়? আসল তত্ত্ব ও পদ্ধতি অনেক সূক্ষ্ম ও জটিল তবুও খুব সহজ করে বলার চেষ্টা করছি।
ধর A একটা ফোটন যাকে তুই টেলিপোর্ট করবি, কলকাতা থেকে বর্ধমানে। তা হলে প্রথমে তোকে একজোড়া এন্ট্যাঙ্গেলড ফোটন B আর C সৃষ্টি করতে হবে। একটা ফোটন B কলকাতাতে থাকল আর আর একটা ফোটন C-কে বর্ধমানে পাঠিয়ে দিলি। কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের লক্ষ্য বর্ধমানে ফোটন C-এর পরিচয় পরিবর্তন করে ফোটন A-এর সঠিক প্রতিরূপে পরিণত করা। এটা করার জন্য, আমাদের কোনোভাবে ফোটন A-র কোয়ান্টাম স্টেটের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য বের করতে হবে এবং সেই তথ্যগুলো বর্ধমানে পাঠাতে হবে, সে ইমেল করে বা টেলিফোনে বা ক্যুরিয়ারে যেভাবেই হোক অর্থাৎ ক্ল্যাসিক্যাল ট্রান্সমিশন, যাতে C এটিকে এক ধরনের ব্লু প্রিন্ট হিসাবে ব্যবহার করে নিজেকে A-তে পরিণত করতে পারে। তবে সমস্যাটি হল হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্রের জন্য আমরা A-কে স্ক্যান করে সব তথ্য সঠিকভাবে পাব না। সুতরাং পরিবর্তে, আমরা কলকাতাতে অন্য ফোটন B এর সঙ্গে ফোটন A-কে এনট্যাঙ্গল করব। এইভাবে, A-এর কিছু তথ্য B-এর সঙ্গে ভাগ হয়ে যাবে, এবং যেহেতু B বর্ধমানের C-এর সঙ্গে এনট্যাঙ্গল্ড আছে, তথ্যগুলো C-তে এসে যাবে আর আগে ক্ল্যাসিক্যাল ট্রান্সমিশনে আসা তথের ব্লু-প্রিন্ট অনুযায়ী, C নিজেকে A-এর একটা অনুলিপিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবে।
তবে একটি খেসারতিও দিতে হবে: মূল ফোটন A প্রক্রিয়াটিতে ধ্বংস হয়ে যাবে কারণ এটি তার সমস্ত তথ্য হারাবে আর এইভাবে তার পরিচয়ও হারাবে। B-এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। এর ফলে তুই দেখতে পাবি মূল ফোটন A এখানে কলকাতাতে অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং এক মুহূর্তের পরে বর্ধমানে আবার আবির্ভূত হয়েছে।
ছবিটা দেখ, তা হলেই বুঝবি।” বলে অনন্ত মোবাইলে ইন্টারনেট থেকে একটা ছবি আমাকে দেখতে দিল।
আমি ভালো করে দেখে নিয়ে বললাম, “বুঝলাম। কিন্তু এই A-ফোটন আর B-ফোটনকে এনট্যাঙ্গল করব কী করে?”
অনন্ত, “কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট করার নানারকম পদ্ধতি আছে। যেমন বিশেষ ধরনের কৃস্ট্যাল বিটা বেরিয়াম বোরেটের ভেতর দিয়ে লেসার বিম পাঠিয়ে বেশি শক্তির আলট্রাভায়োলেট ফোটনকে দুটো কম শক্তির ফোটনে রূপান্তরিত করা যায় যার মধ্যে একটা হরাইজন্টালি পোলারাইসড আরেকটা ভারটিক্যালি পোলারাইসড আর কিছু ফোটনের পোলারাইজেশন নির্দিষ্ট নয় কিন্তু তাদের আপেক্ষিক পোলারাইজেশন পরিপূরক অর্থাৎ তাদের পোলারাইজেশন একসঙ্গে নির্দিষ্ট করে মাপা যাবে না। এরা এনট্যাঙ্গলড ফোটন। এই পদ্ধতিতে অনেক এন্ট্যাঙ্গলড ফোটন জোড়া সহজেই সৃষ্টি করা যায়। পরমাণুকে এনট্যাঙ্গল করা বেশ কঠিন। জটিল র্যান্ডম লেসার অপারেশন করে হয়তো একটা জোড়া এনট্যাঙ্গলড পরমাণু পাওয়া গেল। অনুগুলিকে ভেঙে এন্ট্যাঙ্গলড ভগ্নাংশ সৃষ্টি করা যায় কিন্তু এসব পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।” এই বলে অনন্ত উঠে গিয়ে ঘরের থেকে একটা নোট প্যাড আর কলম নিয়ে এসে ছবি এঁকে দেখাল।
আমি, “তা, এই কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন কি পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়েছে?”
অনন্ত, “অবশ্যই। ১৯৯৭ সালে ভিয়েনার ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্টন ৎসাইলিঙ্গার ও তাঁর সহকর্মীরা ল্যাবরেটরিতে একটি ফোটনের কোয়ান্টাম অবস্থাকে এক মিটার দূরত্বে অবস্থিত আরেকটি ফোটনে টেলিপোর্ট করেছেন এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ও ক্ল্যাসিক্যাল ট্র্যান্সমিশন ব্যবহার করে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রোমের সাপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রান্সিস্কো ডি মার্টিনি ও তাঁর সহকর্মীরাও অনুরূপ সাফল্য লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির জেফরি কিম্বল ও তাঁর গ্রুপ একটি ফোটনের কোয়ান্টাম অবস্থাকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরে একটি সিজিয়াম পরমাণুতে টেলিপোর্ট করেছেন। ২০০৪-এ টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আকিরা ফুরুসাওয়া আলোক রশ্মিকে, যা ধারাবাহিক পরিবর্তিত কোয়ান্টাম অবস্থা, কয়েক মিটার দূরত্বে টেলিপোর্ট করতে সক্ষম হয়।
এরপর শুরু হল দূরত্ব বাড়ানো। এপ্রিল ২০১২ সালে একদল আন্তর্জাতিক গবেষকের দল অ্যান্টন ৎসাইলিঙ্গারের নেতৃত্বে ফোটন টেলিপোর্ট করেন ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের লা পালমা থেকে টেনেরিফ, একশো তেতাল্লিশ কিলোমিটার দূরত্বে। চিনের ইউনিভারসিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির জিয়ান উই পানের গ্রুপ সাতানব্বই কিলোমিটার দূরে ফোটন টেলিপোর্ট করেন। চিনের এই গ্রুপই ২০১৭ সালে ফোটন টেলিপোর্ট করেন পৃথিবী থেকে ১৪০০ কিলোমিটার দূরে এক স্যাটেলাইটে। ২০২০ সালে আমেরিকার ফার্মিল্যাবের বিজ্ঞানীরা চুয়াল্লিশ কিলোমিটার ফাইবার-অপটিক নেটওয়র্ক দিয়ে ৯০% এরও বেশি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ফোটনের কিউবিট টেলিপোর্ট করেন…”
আমি, “কিউবিট আবার কি?”
অনন্ত, “ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটেশনে যেমন বিট যার মান ০ অথবা ১, তেমনি কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনে কোয়ান্টামের কিউ-র সঙ্গে বিট শব্দ জুড়ে কিউবিট—ইনফরমেশনের বেসিক ইউনিট। একটি কিউবিট একই সঙ্গে ০ এবং ১ উভয়ের একটি সুপারপজিশনে থাকতে পারে, প্রতিটি অবস্থারই কিছু নির্দিষ্ট সম্ভাবনা নিয়ে।”
আমি, “আচ্ছা এই অ্যান্টন ৎসাইলিঙ্গারই না ২০২২ সালে ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন?”
অনন্ত, “হ্যাঁ, অ্যান্টন ৎসাইলিঙ্গার, অ্যালেন অ্যাসপেক্ট আর জন ক্লাউসার তিনজনেই ফোটন এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট নিয়ে পরীক্ষা আর কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সাইন্সের যুগান্তকারী কাজের জন্য নোবেল পুরষ্কার পান।”
আমি, “আচ্ছা কোনো অনুকে টেলিপোর্ট করা গেছে?”
অনন্ত, “না। কারণ অনুর কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের জন্য অনুতে মধ্যে থাকা ইলেকট্রন, প্রোটন সহ সমস্ত কণার কোয়ান্টাম অবস্থাগুলিকে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং এন্ট্যাঙ্গল করতে হবে আর এই জটিল কোয়ান্টাম তথ্য সঠিকভাবে পাঠাতে হবে। বর্তমানে আমাদের যা প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি জানা আছে তাতে কোনো অনু কোয়ান্টাম টেলিপোর্ট করা যাবে না। তবে আগামী ভবিষ্যতে হওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানীরা সুদূর ভবিষ্যতে জৈব ম্যাক্রো অনুগুলি যেমন ডিএনএ-র অংশ বা ছোটোখাটো প্রোটিন টেলিপোর্ট করতে পারবেন। এমনকী, আগামী একশো বছরে বিজ্ঞানীরা কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়াকে কোয়ান্টাম টেলিপোর্ট করার আশা রাখেন।”
আমি, “আর মানুষ?”
অনন্ত, “ওটা কল্পগল্পের লেখকেরা আর স্বপ্ন ব্যবসায়ীরা করবেন, বিজ্ঞানীদের দ্বারা সম্ভব হবে না, এই মহাবিশ্বের জীবদ্দশাতে তো নয়ই।”
আমি, “আমার শেষ প্রশ্ন, এইসব ফোটন এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট, কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন মানুষের কোনো উপকারে আসবে?”
অনন্ত, “এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট, কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন এদের প্রয়োগ প্রধানত কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন ও কোয়ান্টেম কমিউনিকেশনে। এখন আমাদের সামাজিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক জীবন কম্পিউটার, মোবাইল ও ইন্টারনেটের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ও যতদিন যাচ্ছে তত বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আমাদের ব্যক্তিগত সকল তথ্য, ব্যাঙ্ক, কোম্পানি ও অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার যাবতীয় তথ্য তাদের কম্পিউটারে আছে যা ইন্টারনেট থেকে পাওয়া যায়, যার সুরক্ষা এবং অনভিপ্রেতের হাতে পড়ে যাতে তার অপব্যবহার না হয়, সেটা দেখা অত্যন্ত জরুরি। অবশ্য কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের উন্নতির সঙ্গে তার তথ্য ও ডেটা সুরক্ষার উপায়ের অনেক উদ্ভাবন হয়েছে। তবুও এই হ্যাকাররা বা তথ্যচোরেরাও নিত্য নতুন উপায় উদ্ভাবন করছে সুরক্ষা কবচ ভেদ করার জন্য।
ঠিক এই জায়গাতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ও কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের ভূমিকা বিশেষত কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন ও কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনে। যেহেতু এন্ট্যাঙ্গল্ড কণাদের একটার অবস্থা অপর কণাকে তৎক্ষণাৎ প্রভাবিত করে, এই বিষয়টি কোনো ডেটা বা তথ্য কেউ নাগাল পাবার দেষ্টা করছে কি না, সনাক্তকরণে সাহায্য করবে। কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট কোয়ান্টাম কি (key) ডিস্ট্রিবিউশনের (QKD) মূল ভিত্তি যা দুটো পার্টির মধ্যে এনক্রিপশন কি (key) বিনিময় করে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহারে এই QKD যে স্তরের সুরক্ষা দেবে, কোনো হ্যাকারের সাধ্য হবে না তা ভাঙার।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার এখনকার কম্পিউটার থেকে অনেক বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন হবে। আগামি ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন কোয়ান্টাম কমপিউটারগুলোকে একত্র সংযুক্ত করে একটা অতি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক হিসাবে কাজ করাবে ও তারা যে স্তরে গণনা করতে পারবে যা ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটারের পক্ষে অসম্ভব।”
প্রায় ছ-টা বাজে। আলোচনার মাঝে আমরা অবশ্য আরেকবার কফি খেয়েছি—নন্দু দিয়ে গিয়েছিল। এখনও বাইরে আলো রয়েছে। দুজনে মহাবালেশ্বরের পথে একটা স্ট্রবেরি গার্ডেন দেখতে যাব। হোটেলই গাড়ি ঠিক করে দিয়েছে। ফেরার সময়ে মার্কেটের দিকে গিয়ে একবারে ডিনার করে ফিরব।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী