সাদা জাহাজ
লেখক: এইচ পি লাভক্র্যাফট, বাংলা অনুবাদ: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী: রনিন
আমি বেসিল এলটন। আমি নর্থ পয়েন্টের বাতিঘরের বাতিওয়ালা। আমার আগে আমার বাবা, আমার ঠাকুর্দা সকলেই এইখানে বাতিওয়ালা ছিলেন। পাড় থেকে অনেকটা ভেতরে পিছল পাথরের বুকে ধূসর বাতিঘরটা একলা দাঁড়িয়ে থাকে। পাথরগুলো জোয়ার এলে জলে ডুবে যায়। ভাটার সময় নজরে পড়ে। বাতিঘরের পেছনে ছড়িয়ে থাকা সমুদ্রের বুকে সাত সাগরের তিন মাস্তুলের পালতোলা জাহাজরা ভেসে যায়। ঠাকুর্দার আমলে তারা ছিল অগুনতি। বাবার আমলে সে সংখ্যা কমে আসা শুরু হয়েছিল। আমার আমলে দিনান্তে হাতেগোনা একটি বা দুটি তেমন জাহাজ চোখে পড়ে। সারাদিন সেই বাতিঘরে বসে বসে আমার বড় একা ঠেকে তাই। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় এত বড় গ্রহটায় বুঝি আমিই একলা একজন অবশিষ্ট আছি।
বেনেদের ওই সাদা পালের জাহাজগুলো বহুদূর থেকে ভেসে আসত। তারা আসত পুবের সমুদ্র থেকে। সেখানে সূর্য উষ্ণ আলো ছড়ায়। সেখানে চিত্রবিচিত্র মন্দির আর বর্ণোজ্জ্বল বাগিচাগুলির থেকে মিঠে সুবাস ভেসে আসে বাতাসে। মাঝে মাঝে সেইসব জাহাজের বুড়ো ক্যাপ্টেনরা আমার ঠাকুর্দার সঙ্গে দেখা করতে এসে সেইসব দেশের গল্প শুনিয়ে যেত। ঠাকুর্দা সেইসব গল্প বলে গিয়েছিলেন আমার বাবাকে। হেমন্তের লম্বা বিকেলগুলোয় যখন পুব দিগন্ত থেকে গর্জন করে ভূতুড়ে হাওয়া ছুটে আসত সমুদ্র বেয়ে, সেই সময় বাবা বসে বসে আমায় সেই গল্প শোনাতেন। সে ছাড়াও, যখন আমার বয়েস কম ছিল, যখন আমার দুনিয়াটা নানান আশ্চর্য স্বপ্নে ভরপুর ছিল, সেই সময় অনেক বইপত্রেও আমি সেইসব দেশের বহু গল্প পড়েছি।
তবে ক্যাপ্টেনদের গল্প, কিংবা বইয়ের গল্পগাথার চেয়েও রোমাঞ্চকর হল সমুদ্রের গোপন গল্পরা। সমুদ্র নীরব থাকে না। নীল, ধূসর, সফেদ, কালো, মসৃণ, দোদুল্যমান, ছুটন্ত পাহাড়ের মতো ঢেউ… অনেক গল্পই আছে তার ভাঁড়ারে। সারাটা জীবন ধরে আমি সেই গল্পদের শুনে চলেছি। সে গল্পদের সবকিছু আমি জানি। শুরুতে তারা আমায় ছোট ছোট গল্প শোনাত। শান্ত কোনও সাগরবেলা কিংবা কাছাকাছি দাঁড়ানো সব ছোটখাটো বন্দরের গল্প সে সব। কিন্তু বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র আমার আরও কাছের বন্ধু হয়ে গেল। তখন সে আমায় তার গোপন সব গল্পদের খুলে বলত। দেশকালের অনেক গভীরে ছড়িয়ে থাকা দূরদূরান্তের আশ্চর্য সব কাহিনি। কখনও কখনও গোধূলিবেলায় দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কুয়াশার আবরণ সরে গিয়ে আমায় তার পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্যদের দেখতে দিত। কখনও বা রাত্রির গভীরে সমুদ্রের গভীর জল স্বচ্ছ, উজ্জ্বল হয়ে উঠে আমায় দেখতে দিত তার গভীরে লুকিয়ে থাকা হাজারো রহস্যের ছবি। সে ছবি শুধু এখনকার নয়। মাঝেমাঝেই তাতে দেখতে পেয়েছি অতীত দিনের ছবি, কখনও বা যে দিনগুলো এখনও আসেনি তারই ইতিহাস। কারণ, সমুদ্রেরা পাহাড়দের চেয়েও প্রাচীন। তাদের বুকে সময়ের স্রোতে বুনে থাকা অতীত কিংবা অনাগত স্মৃতি আর স্বপ্নরা ধরা থাকে।
পূর্ণিমার রাতে দক্ষিণ সমুদ্র থেকে একটা সাদা জাহাজ ভেসে আসত কখনও কখনও। সমুদ্রের বুক বেয়ে নিঃশব্দে যেন উড়ে আসত সে। তখন সমুদ্র ঝোড়ো হোক কী শান্ত, আকাশে ঝড় উঠুক বা না উঠুক তার গতি একই রকম মসৃণ আর শান্ত হত। আর সব আবহাওয়াতেই একরকমভাবে ফুলে থাকত তার সাদা পাল। তার দুপাশে দাঁড়ের দল একই ছন্দে ওঠাপড়া করত।
তেমনই এক পূর্ণিমার রাতে একবার আমি তার ডেকের ওপরে একজন মানুষকে দেখেছিলাম। তাঁর মুখে সফেদ দাড়ি, তাঁর পরনে ঢিলে আলখাল্লা। আমায় তিনি হাত নেড়ে ডেকেছিলেন। নিমন্ত্রণ করেছিলেন যেন তাঁর সঙ্গে সমুদ্রের পথে যাওয়ার জন্য। তারপর থেকে বহুবার আমি পূর্ণিমার চাঁদের নীচে সমুদ্রের বুকে তাঁকে দেখেছি। প্রতিবারই তিনি সেই একইভাবে আমায় ডাক দিয়েছেন হাত নেড়ে। নিঃশব্দে।
তারপর, যেদিন আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম, সেদিন পূর্ণিমার চাঁদ ভারী উজ্জ্বল ছিল। তখনই বাতিঘর থেকে জাহাজ অবধি ছড়িয়ে গেল চাঁদের আলোর একটা সেতু। আমি সেই সেতু বেয়ে অশান্ত সাগর পেরিয়ে জাহাজের ডেকে গিয়ে পা রাখলাম। মানুষটা আমায় ভারী মিঠে ভাষায় অভ্যর্থনা জানালেন। সে ভাষা আগে কখনও শুনিনি, অথচ টের পেলাম আমি তার অর্থ বুঝি। তারপর তাঁর সঙ্গে সেই জাহাজের বুকে আমি ভেসে গেলাম দক্ষিণ সমুদ্র বেয়ে। আমায় ঘিরে রইল পূর্ণচাঁদের সোনালি আভা, আমায় ঘিরে রইল জাহাজের দাঁড়িদের গলার নরম মিঠে গানের সুর।
তারপর যখন সকাল এল তার গোলাপি আভা নিয়ে, তখন দূরে দেখা দিল সবুজ তীরভূমি। উজ্জ্বল। অজানা। দিগন্তের গায়ে, যেন সমুদ্রের জল ফুঁড়েই দেখা দিল রাজকীয় সব বাগান, তার মধ্যে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকে ঝলমলে সাদা ছাদ আর বিচিত্র গড়নের মন্দির। পাড়ের দিকে জাহাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে আমায় সেই বৃদ্ধ মানুষটা বললেন, ও হল ‘জার’-এর উপকূল। মানুষের সমস্ত সৌন্দর্যের স্বপ্ন আর ভাবনাদের বাস সেখানে। ওখান থেকেই তারা মানুষের মনে এসে উঁকি দেয়, তারপর মিলিয়ে যায়।
তার কথা শুনে ফের একবার সেই বাগানগুলির দিকে চোখ ফেলে আমি বুঝলাম, সত্যি কথাই বলেছে সে। কারণ, কখনও কখনও গোধূলিবেলায় সমুদের বুকে দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কুয়াশার আবরণ সরে গিয়ে আমি তার পেছনে লুকিয়ে থাকা যে রহস্যদের দেখেছি, কখনও বা রাত্রির গভীরে সমুদ্রের গভীর জল স্বচ্ছ, উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার গভীরে লুকিয়ে থাকা যে হাজারো রহস্যের ছবি আমায় দেখিয়েছে তার অনেক কিছুই রয়েছে সেইসব বাগানে। তারা ছাড়াও কল্পনার আরও যে অসংখ্য বিচিত্র রূপ ছড়িয়ে ছিল সেখানে, তাদের সঙ্গে আমার চেনাজানাও নেই। যে কবিরা অভাবের তাড়নায় প্রাণ দিয়েছে… তারা তাদের যে আশ্চর্য কল্পনাগুলোকে লিখে রেখে যেতে পারেনি আমাদের জন্য, সেইসব কল্পনারাও সেইখানে জীবন্ত ছিল।
তবে এই সবই আমরা দেখেছিলাম জাহাজের বুক থেকে। ‘জার’-এর মাটিতে পা দিইনি আমরা। কারণ সে ভূমিতে একবার পা ছোঁয়ালে নাকি আর কখনও নিজের দেশে ফিরে আসা যায় না।
সেখান থেকে পাল উড়িয়ে ফের সমুদ্র বেয়ে চলল সাদা জাহাজ। খানিক বাদে দিগন্তে জেগে উঠল অন্য এক শহরের আকাশছোঁয়া মিনারের দল। বৃদ্ধ সেদিকে দেখিয়ে আমায় বললেন, “ওই হল সহস্র বিস্ময়ের নগরী থালারিওন। মানুষ চিরকাল যেসব রহস্যের তল খুঁজে পায়নি, ওই শহরের বুকে সেই সব রহস্যের বাস। শুনে আমি সেই শহরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর জাহাজ তার আরও খানিক কাছে এলে দেখলাম, এত বিশাল শহর আমি আগে কখনও দেখিনি। তার মন্দিরের আকাশ পেরনো চূড়াদের নীচ থেকে দেখা যায় না। সেইসব অতিকায় মন্দিরদের ছাড়িয়ে অনেক পেছনে, একেবারে দিগন্তের কাছে, ধূসর দেয়ালের সার। তাদের ওপর দিয়ে ক্বচিৎ দু-একটি বাড়ির ছাদ চোখে পড়ে। তাদের গড়ন বুকে কাঁপুনি ধরায়। অথচ তাদের গায়ে মনভোলানো সব নকশা আর ভাস্কর্যের সার।
আশ্চর্য অথচ ভয়ধরানো এই শহরটার বুকে একবার পা দেওয়ার জন্য বড় উতলা হয়ে উঠেছিলাম আমি। তার বিরাট গুহার মতো দরজাটা আমাকে চুম্বকের মতো টানছিল। জেনেছিলাম সে-দরজার নাম আকারিয়েল। বৃদ্ধকে আমি বারবার অনুরোধ করেছিলাম, একটিবার আমায় তার কাছে পাথরের জেটিতে নামিয়ে দিতে। জবাবে তিনি শান্তভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “থালারিওন শহরে অনেক যাত্রীই নেমেছে। কিন্তু তাদের একজনও সেখান থেকে ফিরে আসেনি। ওর বুকে যারা ঘুরে বেড়ায় তারা দানব। তারা আর মানুষ নেই। ওর শাসক এইডলন লাঠিকে যারা দেখেছে তারা কেউই বেঁচে থাকেনি। ও-শহরের পথঘাট তাদের ছড়ানো হাড়ে সাদা হয়ে থাকে।”
কাজেই সে-শহরেও আর নামা হল না আমার। শহরকে পাশ কাটিয়ে সাদা জাহাজ দক্ষিণমুখো উড়ে চলা একটা পাখির পিছু নিয়ে ভেসে চলল। আকাশের গভীর থেকে উদয় হওয়া সেই পাখির পালক ছিল আকাশের মতোই নীল।
অবশেষে বেশ কয়েকদিন সাগর বেয়ে চলবার পর আমরা এসে হাজির হলাম ভারী সুন্দর একটা দেশের পাশে। তার সাগরবেলায় কত না রঙিন ফুলের বাহার। উজ্জ্বল সূর্যের নীচে যতদূর চোখ চলে বাগিচার পর বাগিচার সার চলেছে তার বুকে। সেইসব বাগিচার আড়াল থেকে মাঝেমাঝেই ভেসে আসছিল কোনও না দেখা কণ্ঠের আশ্চর্য সুর, কোনও অদেখা যন্ত্রের মিঠে টুংটাং। আর ওরই মধ্যে মধ্যে কারা যেন হেসে উঠছিল বারবার। ভারী মধুর ঝরঝরে তার শব্দ।
আমার পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ কোনও কথা বলছিল না। লিলিফুলের ঝার দিয়ে সাজানো সমুদ্রতটের দিকে জাহাজটা যখন এগিয়ে চলেছে সে-সময়টা শুধু একদৃষ্টে আমার দিকে দেখে যাচ্ছিল সে। তারপর হঠাৎ পাড়ের সেই ফুল ছাওয়া মাঠগুলোর দিক থেকে বয়ে আসা বাতাস একটা গন্ধ বয়ে আনল আমার নাকে। আমি শিউরে উঠলাম। ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছিল গন্ধটা। মহামারী আক্রান্ত শহর, তার বুকে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহদের, তার খোলা কবরগুলোয় পড়ে থাকা গলিত শবের গন্ধ! প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মুখ ঘোরাল আমাদের জাহাজ। ফুলে ওঠা পালের ধাক্কায় তটভূমি ছেড়ে যখন সমুদ্রের গভীরে ফিরে যাচ্ছি তখন বুড়ো আমায় বলল, “এ হল জুরার তটভূমি। অপূর্ণ সুখের দেশ।’’
তারপর ফের একবার সেই স্বর্গপাখির পিছু পিছু ভেসে চললাম আমরা। সুগন্ধ বাতাসের ঘায়ে ফুলে ফুলে ওঠা সমুদ্রের বুক বেয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কেবল ভেসে চলা। পূর্ণিমার রাতে জাহাজের দাঁড়িরা গান গাইত। সে গানের সুর ভারী মিষ্টি। অবশেষে তেমনই এক চাঁদনি রাতে আমরা সোনা-নীল এর বন্দরে নোঙর ফেললাম এসে। সে বন্দরে ঢোকবার মুখে, সমুদ্র থেকে মাথা জাগানো দুটো ফটিকের স্তম্ভের মাথা জুড়ে গিয়ে যেন এক বিরাট দরজা বানিয়েছে। এ হল সুখস্বপ্নের দেশ। চাঁদের আলোয় তৈরি একটা সোনালি সেতু বেয়ে আমরা তার অপরূপ উপকূলে এসে নামলাম।
সোনা-নীল দেশে স্থান-কাল এসব কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই। দুঃখ নেই, মৃত্যু নেই। সেই সুখস্বপ্নের দেশে আমি কত না যুগ কাটিয়ে দিলাম। সে দেশের অরণ্য ঘন সবুজ, ফুলেরা উজ্জ্বল, সুগন্ধ মাখা, তার ঘন নীল নদীদের চলার ছন্দে সুর জাগে। তার ফোয়ারারা শীতল, স্বচ্ছ, তার মন্দির, দুর্গ শহরেরা রাজকীয়। সে দেশের কোনও সীমা নেই। দিগন্তবিস্তৃত রূপের বন্যার ওপারে সুন্দরতর দিগন্তেরা জেগে থাকে সেই দেশে। তার বাসিন্দারা চিরসুন্দর, চিরসুখী। আমি সেই সুখী মানুষদের মধ্যে বড় আনন্দে ঘুরে বেড়াতাম। দিনের বেলা কোনও টিলার মাথায় উঠে অনিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকতাম চারপাশে ছড়ানো আনন্দের ভুবনের দিকে— ঘন সবুজের মধ্যে থেকে উঁকি দেয় শান্ত মন্দিরদের চূড়া। ফুলের পাড় দেওয়া সফেদ রাস্তারা সেই মন্দিরদের দিকে এগিয়ে যায়। তার সবুজ উপত্যকাদের বুকে ইতিউতি উঁকি দেয় শান্ত জনপদ। তার নিঃসীম দিগন্তে অতিকায় শহরদের সোনালি রোদ পড়ে ঝিকমিক করে। কখনও বা চাঁদঝরা রাতে পাহাড়ের মাথায় উঠে আমি ঝিলমিলে সমুদ্র আর স্ফটিকের সেই দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দরজা পেরিয়ে শান্ত বন্দর। সেখানে নোঙর ফেলে স্থির হয়ে আছে আমার সফেদ জাহাজ।
এমনি করে অগুনতি বছর সেই দেশে কাটাবার পর, এক পূর্ণিমার রাত্রে হঠাৎ সেই স্বর্গপাখি ফের দেখা দিল আকাশে। ডানার ইশারায় আমায় যেন ডাক দিল সে। অমনি, বহুকাল পরে, একটা ভুলে যাওয়া অস্থিরতা ফের পেয়ে বসল আমাকে। দাড়িওয়ালা বৃদ্ধকে ডেকে আমি বললাম, আর আমার মন টিকছে না সেখানে। এইবার আমাকে যেতে হবে। যেতে হবে সুদূর কাথুরিয়া-র সন্ধানে। আজ অবধি কোনও মানুষ তাকে দেখেনি। কিন্তু সকলেই বলে পশ্চিম সমুদ্রে জেগে থাকা আগুন-পাথরের স্তম্ভদের পেরিয়ে গিয়ে কোথাও সে-দেশের দেখা মিলবে। লোকে বলে সে হল আশার দেশ। তুমি যা হতে চাও তার আদর্শ রূপটি জীবন্ত হয়ে থাকে সেই দেশে। শুনে বৃদ্ধ আমায় সাবধান করলেন, “যে সাগর পেরিয়ে কাথুরিয়া যেতে হয় সে-সাগর আমাদের অজানা। সোনা-নীলে দুঃখ নেই, মৃত্যু নেই, বেদনা নেই সে আমরা জানি। কিন্তু পশ্চিমে আগুন-পাথরের স্তম্ভদের পেছনের সমুদ্রে কী অপেক্ষা করে আছে তার সঠিক খবর কেউ জানে না।” কিন্তু আমি তাঁর সাবধানবাণীতে কান দিলাম না। পরের পূর্ণিমায় ফের আমি সফেদ জাহাজে চেপে বসলাম।
আগে আগে ভেসে চলে স্বর্গপাখি। পেছন পেছন সমুদ্রে ভেসে যায় সফেদ জাহাজ। তার লক্ষ্য পশ্চিম সমুদ্রের আগুন-পাথরের স্তম্ভের দল। দাঁড়িদের গলায় তখন জেগে উঠেছে নতুন গান। সে গান আগেকার গানদের মতো নরম, মধুর নেই আর। তবে সে-গানের দিকে আমার আর মন ছিল না। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আমি তখন কাথুরিয়ার স্বপ্নে বিভোর। না জানি সে দেশ কত সুন্দর। না জানি সে-দেশে কত না সুখ আমার অপেক্ষায় আছে! সেই স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি নিজের মনেই বলতাম “কাথুরিয়া ঈশ্বরের দেশ। সে-দেশে কত না সোনার শহর! তাকে ঘিরে থাকে চন্দন আর সুগন্ধী কামোরিনের বন। সে-বনের গাছে গাছে গান গেয়ে যায় কত না পাখি!” মাঝেমাঝেই বৃদ্ধ আমাকে বলত, “ফিরে চলো সোনা-নীল-এর দেশে। সে দেশ আমরা চিনি। কাথুরিয়াকে কেউ চেনে না। কেউ কখনও পা দেয়নি সে দেশে।” আর আমি তখন তার কথার জবাব না দিয়ে এমনভাবেই কাথুরিয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম।
এইভাবে ত্রিশ দিন সমুদ্র বেয়ে চলবার পর, একত্রিশ দিনের মাথায় দিগন্তে দেখা দিল পশ্চিম সমুদ্রের আগুন-পাথরের স্তম্ভের দল। তাদের ঘিরে গভীর কুয়াশার ঘোমটা। সেই আবরণ পেরিয়ে তার পেছনের সমুদ্রে দৃষ্টি চলে না। তাদের আকাশছোঁয়া চূড়ারাও হারিয়ে গেছে বহু উঁচুতে সেই কুয়াশার আড়ালে। এইখানে এসে বৃদ্ধ ফের আমায় বললেন, “ফিরে চলো।” আমি তাঁর কথায় কান দিলাম না। কারণ কুয়াশামোড়া সেই স্তম্ভগুলির পেছন থেকে আমার কানে তখন ভেসে আসছে হালকা সুরের শব্দ। কেউ যেন গান গাইছে ওখানে। বেজে চলেছে বাঁশি। মধুর থেকেও মধুরতর সেই সুর যেন আমারই নাম ধরে ডাকছিল। দূরদেশ থেকে চাঁদের আলোয় সাগর বেয়ে আসা এই আমার স্তুতি যেন বেজে উঠছিল সেই গানে।
তারপর, সেই সুরকে অনুসরণ করে সফেদ জাহাজ ভেসে গেল আগুন-পাথরের স্তম্ভদের পেরিয়ে তার পেছনের কুয়াশাঘেরা সমুদ্রের বুকে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল গানের সুর। উধাও হল আকাশজোড়া কুয়াশা। দেখতে পেলাম সেই সমুদ্রের বুকে আমার স্বপ্নের শহরের কোনও চিহ্ন নেই। আছে শুধু দ্রুত ধেয়ে যাওয়া রাক্ষুসে, অতল জলরাশি। তার বুকে অসহায় একটুকরো পালকের মতো ভেসে যায় সফেদ জাহাজ।
খানিক দূর যেতেই হঠাৎ আমাদের কানে এল দূরাগত কোনও জলপ্রপাতের গুম গুম শব্দ। আর তারপর দিগন্ত জুড়ে দেখা দিল এক সুবিশাল জলপ্রপাত। পৃথিবীর সব সমুদ্র সেইখানে এসে কোনও অতল অনস্তিত্বের বুকে ঝাঁপ দেয়। আমার পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধের দু’চোখ তখন জলে ভরে উঠেছে। আমার দিকে ফিরে ভাঙা ভাঙা গলায় তিনি বললেন, “স্বেচ্ছায় সোনা-নীল ছেড়ে এসেছি আমরা। আর কোনওদিন তার বুকে আমাদের পা পড়বে না। মানুষের চাইতে ঈশ্বর অনেক শক্তিমান। তাঁর কাছে হেরে গেছি আমরা…”
সফেদ জাহাজ তখন জলপ্রপাতের একেবারে কিনারায় এসে পৌঁছেছে। তার অতল গহ্বরের দিকে একনজর তাকিয়েই আমি চোখ বুঁজে ফেললাম। আমাদের সামনে জলপ্রপাতের গহ্বরের মাথায় ভাসতে থাকা সেই স্বর্গপাখিকে আমি আর দেখতে চাই না!
সংঘর্ষ। অন্ধকার। আর তারই মধ্যে সংখ্যাতীত আর্তনাদের শব্দ ভেসে যায়। তাদের মধ্যে অনেক কণ্ঠস্বর মানুষের নয়! দুলতে দুলতে নেমে যাই আমি… গভীর থেকে আরও গভীরে…
অবশেষে একসময় টের পেলাম, ভেজা, পিচ্ছিল একখণ্ড পাথর মাথা জাগিয়েছে আমার শরীরের নীচে। ঠিক তখন পুবদিগন্ত থেকে ধেয়ে এল সুতীব্র ঝড়। তারপর হঠাৎ একটা ভয়ানক ধাক্কার শব্দে চোখ মেললাম আমি। চেয়ে দেখি, আমার বাতিঘরের ঠিক যেখান থেকে সফেদ জাহাজে সওয়ার হয়েছিলাম আমি বহুকাল আগে, ঠিক সেইখানটাতেই ফের এসে পৌঁছেছি। অনেক নীচে, অন্ধকার, উত্তাল সমুদ্রের বুকে নিষ্ঠুর ডুবোপাথরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন একটা জাহাজ ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল। চমকে মাথা উঁচিয়ে আমি দেখলাম, আমার বাতিঘরের আলো নিভে গেছে। আমার ঠাকুর্দা এই বাতিঘরের দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই প্রথমবার তার আলো নিভল।
সেদিন গভীর রাতে যখন আমি বাতিঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম, দেখি সেখানে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের গায়ে, যেদিনটা আমি এখান থেকে রওনা হয়েছিলাম, সেই দিনটাই দেখাচ্ছে এখনও। তার সময় থেমে আছে আমার যাত্রার মুহূর্তে। পরদিন সকালবেলা বাতিঘর থেকে নেমে ডুবোপাথরগুলোর দিকে চোখ ফেলে আমি দেখেছিলাম, সেখানে কোনও জাহাজ নেই। শুধু আশ্চর্য নীল রঙের একটা পাখির মৃতদেহ পড়ে আছে মাথা জাগিয়ে ওঠা পাথরদের বুকে। আর আছে একটা লম্বা কাঠের পাটাতন। তার দুধসাদা রং, ঢেউয়ের মুকুট কিংবা পাহাড়চূড়াদের তুষারকিরীটের চাইতেও সফেদ।
সেইদিন থেকে সমুদ্র আমায় আর তার কোনও গোপন কথা বলেনি। সেইদিন থেকে… এতগুলো বছর কেটে গেল আমার এইখানে… কত না পূর্ণিমায় চাঁদের আলোয় ভেসে গেল ওই সমুদ্র… কিন্তু আর কোনও সফেদ জাহাজ দক্ষিণ থেকে ভেসে এল না আমার কাছে।
মূল গল্প: দ্য হোয়াইট শিপ
লেখক: এইচ পি লাভক্র্যাফট
প্রথম প্রকাশ: দ্য ইউনাইটেড অ্যামেচার (ভলিউম ১৯ #২), নভেম্বর ১৯১৯
Tags: এইচ পি লাভক্র্যাফট, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি গল্প, রনিন, হরর গল্প
অসাধারণ অনুবাদ।মনেহল যেন একজন সুসাহিত্যিকের মুল রচনা পড়ছি।রসোত্তীর্ণ অনুবাদ। লেখকের প্রতি আন্তরিক শুভেচছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
কী অসাধারণ কাব্যিক অনুবাদ… মনেই হল না এটা ভাষান্তর। ঠিক যেন স্বয়ং লাভক্র্যাফট বাংলায় লিখেছেন। সেই একই আবেদন।