নক্ষত্রমাতা
লেখক: রবার্ট এফ ইয়ং, বাংলা অনুবাদ - নিবেদিতা হালদার গাঙ্গুলি
শিল্পী: রনিন
সেই রাতে তাঁর ছেলেই ছিল প্রথম নক্ষত্র।
সেই চৈত্র রাতে তিনি একটা হাত বুকে রেখে, একা, তাঁর বাড়ির বাগানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন— সামনের মাঠটা থেকে তাঁর ছেলে দক্ষিণের আকাশে উঠে গেল— উঁচু আরও উঁচুতে উঠতে উঠতে একেবারে আকাশের মাথায় পৌঁছে সে নামতে থাকল। নামতে নামতে শেষে উত্তর দিগন্তের কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেল— তাকে আর দেখা গেল না। আচ্ছা, সে কি এখন তাঁর কথা ভাবছে? এই বারান্দাওয়ালা বাড়ি, যেখানে সে জন্মেছে— তার ফাঁকা ঘরগুলোর কথা মনে করছে? এই মাঠের কথা মনে পড়ছে তার, যেখানে সে ছেলেবেলায় খেলেছে, কাজ করেছে? ছেলেটা যেন বড্ড তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল!
একটা ধাতব বায়ুনিরুদ্ধ যানের মধ্যে আর একটা ধাতব বায়ুনিরুদ্ধ ক্যাপসুলে বসে সে পৃথিবীকে ঘিরে পাক খেয়ে চলেছে… কী দরকার? কেন যে এরা নক্ষত্রদের একা ছাড়ে না? কেন যে তাদের ভগবানের কাছে ছেড়ে দেয় না?
***
তিনি একদম সকাল সকাল জেনারেলের দ্বিতীয় টেলিগ্রামটি পেলেন: ‘দ্বাদশ এক্সপ্লোরার মিশন শেষ করছে, হয়তো কালকেই আপনার ছেলে আপনার কাছে ফিরে আসবে’।
সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার। তিনি যথারীতি পোলট্রি থেকে ডিমগুলো নিয়ে কার্ডবোর্ডের বাক্সে সেগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে স্টেশন ওয়াগন চড়ে বেরিয়ে পড়লেন বাজারের দিকে। ক্রেতারা সবাই তাঁর ছেলেকে নিয়ে উৎসুক— নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে থাকল। যেমন, একজন জিজ্ঞেস করল, “মার্থা, টেরি কি সত্যি একা গেছে?”
আরেকজন জিজ্ঞাসা করল, “তোমার ভয় লাগছে না, মার্থা?”
আরেকজন তাঁকে আশ্বস্থ করে বলল, “ও ঠিক ফিরে আসবে, দেখো মার্থা।“
তিনি বুঝতেই পারছিলেন, যে তিনি রাতারাতি একজন ডিমবিক্রেতা থেকে একজন তারকার মা হয়ে উঠেছেন। কিন্তু, তিনি কখনই ভাবেননি যে টিভি থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে আসবে। একদিন হঠাৎই তাঁর বাড়ির সামনে গাড়ি আর ট্রাকের সারি এসে দাঁড়াল, সেগুলো থেকে টেকনিশিয়ানরা নেমে এসে বাড়ির সামনে নানা রকমের যন্ত্রপাতি লাগাতে শুরু করে দিল, তাঁকে জিজ্ঞাসা না করেই। তিনি আপত্তি করার সুযোগই পেলেন না। একজন ঝকঝকে স্মার্ট তরুণ এসে তাঁকে বললেন, “ম্যাডাম, আপনার ছেলের জন্য আমরা সবাই গর্বিত। দয়া করে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন!”
স্বাভাবিকভাবেই বেশির ভাগ প্রশ্ন টেরিকে নিয়ে করা হল। প্রশ্নকর্তা মনে হল যেন ভেবেই এসেছেন যে টেরিকে আর পাঁচটা আমেরিকান ছেলের মতোই দেখাবেন। তাই মার্থা যখনই জানালেন যে, টেরি বাকি সাধারণ ছেলের মতো নয়, সে অনেক রাত অবধি জেগে পড়াশোনা করত, বা সে খুব লাজুক, তাই তার বন্ধুবান্ধব বেশি হয়নি, এমনকি সে কোনওদিনও ফুটবল খেলেনি, প্রশ্নকর্তা তখনই কথা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। মনে হল না যে তিনি টেরির সম্পর্কে সত্যি কিছু জানতে চান, তিনি শুধু চান টেরিকে এক তারকা বানাতে।
কিছু প্রশ্ন মার্থাকেও করলেন প্রশ্নকর্তা। যেমন—
—টেরি কি আপনার একমাত্র সন্তান?
—হ্যাঁ।
—আপনার স্বামী?
—কোরিয়ার যুদ্ধে মারা গেছেন।
—এই যে নতুন আইনে আপনার মতো এক তারকার মাকে নানা রকম সুযোগসুবিধে দেওয়া হবে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে আপনার কী মতামত?
—ভালোই তো! তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহীদদের মায়েদের জন্যও যদি এমন আইন থাকত, তাহলে ভালো হত।
***
টিভির লোকদের সব গুছিয়েগাছিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে যেতে বিকেল হয়ে গেল। মার্থা হালকা একটু খেয়ে নিয়ে টেরির একটা পুরোনো জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে বাগানে গিয়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের অপেক্ষা করতে লাগলেন। জেনারেল তাঁর প্রথম টেলিগ্রামে জানিয়েছেন রাত ৯:০৫-এর আগে টেরির মহাকাশযানের আকাশে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। তাও তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রথম থেকে তারাদের ফুটে ওঠা দেখতে থাকলেন। একটি একটি করে তারারা কালো আকাশের গায়ে ফুটে উঠল, কোনওটি নীল, কোনওটি লাল, আবার কোনওটি হলুদ… সবুজ… কমলা…
মার্থার কোনওকালেই আকাশ দেখার বিশেষ শখ ছিল না, তিনি চিরকাল পৃথিবীকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। অল্পবয়সে যখন বিলের সঙ্গে প্রাকবিবাহ প্রেমপর্ব চলছিল, তখন কখনও কখনও দুজনে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রোমান্টিক হয়েছেন, বা উল্কাপাত দেখে মনে মনে কিছু প্রার্থনা করেছেন, কিন্তু রাতের পর রাত কালো আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা তারাদের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাননি। কিন্তু, আজ পরিস্থিতি ভিন্ন, আজ যে ওই তারাগুলি তাঁর বড় আপনার মনে হয়, তাদের বড় জীবন্ত মনে হয়!
চৈত্ররাতের ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে কখন যে ন’টা বেজে গেল! মার্থা হাতঘড়িতে দেখলেন ৯:০২ বাজে। কই তাঁর টেরি? তিনি দক্ষিণ আকাশের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলেন। ওই তো দেখা যায়— টেরি তার ঝকঝকে নভোযানে চড়ে দক্ষিণ আকাশ থেকে উঠতে উঠতে একদম আকাশের মাথায় পৌঁছে উত্তর আকাশ বরাবর নেমে এল, তারপর এক সময় দিগন্ত পেরিয়ে কালো পৃথিবীর আঁধারে হারিয়ে গেল। মার্থা আকুল উৎসাহে পুরোটা সময় ধরে হাত নেড়ে গেলেন। গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠল। টেরির যান আকাশ থেকে মিলিয়ে যাওয়ার পর হাত নামিয়ে একটা গভীর দীর্ঘঃশ্বাস ত্যাগ করলেন মার্থা, আর তাঁর সবটুকু স্নেহ-মমতা দিয়ে প্রার্থনা করলেন, তাঁর টেরি যেন তাঁর কাছে নিরাপদে ফিরে আসে।
***
পরদিন বুধবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে পড়লেন মার্থা। মুরগীদের খেতে দিয়ে, নিজে খেয়ে, মুরগীর ডিমগুলো কার্ডবোর্ডের বাক্সে ভরে নিয়ে আবার বাজারে গেলেন তিনি। আবার তাঁকে অজস্র প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল –
—মার্থা, তুমি যে কী করে শান্তিতে আছ, বুঝতেই পারছি না। ছেলেটার জন্য চিন্তা হয় না তোমার?
—হ্যাঁ, হয় তো!
—মার্থা, ওকে কবে ফিরিয়ে আনবে?
—এই তো আজকেই!
—ওহ! তোমার ছেলে তো এখন তারকা! নিশ্চয় এটা ভেবে তোমার ভালো লাগে মার্থা?
—তা লাগে বইকী!
ভালো কি আর লাগে না? কিন্তু তার সঙ্গে যে ভয়ও লাগে… হে ভগবান! টেরি তাঁর কাছে নিরাপদে ফিরে আসুক! এরপর অন্য কোনও মা’র ছেলে যাক নক্ষত্র হতে!
***
দুপুরে জেনারেলের তৃতীয় টেলিগ্রামটা এসে পৌঁছল— ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানানো হচ্ছে যে, একটি উল্কার ধাক্কায় স্যাটেলাইটের ক্ষতি হয়েছে। তাই ক্যাপসুলটিকে স্যাটেলাইট থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। আপনার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য অন্য এক ব্যবস্থা শীঘ্রই নেওয়া হবে’।
টেরিইইই…
মার্থার চোখের সামনে ফুটে উঠল একটা ম্যাপল গাছ, গাছের তলায় ছোট্ট টেরি খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলা করছে— সূর্যের আলোতে তার সোনালি চুল চকচক করছে, গাল দুটো গরম হাওয়ায় লাল হয়ে আছে…
টেরিইইই…
ওই তো নীল ডেনিম পরে টেরি আসছে, রোদে পোড়া ঘাসের ওপর লম্বা লম্বা পা ফেলে রোদে পোড়া রোগা রোগা দুটো হাত দুলিয়ে। আকাশটা কী নীল আর ঝকঝক করছে! শরতের বাতাসে ভেসে আসছে সিকাডা পোকার একটানা ডাক…
টেরিইইই…
“মা গো, টেক-অফের আগে আর চিঠি লিখতে পারব না। একদম চিন্তা করো না। এই এক্সপ্লোরার টুয়েলভটা যা বিশাল না! কোনও উল্কার ধাক্কায় এটার কিছুই হবে না, যদিও ধাক্কা খাওয়ার চান্স লাখে একটা!”
কেন যে এরা নক্ষত্রদের একা ছাড়ে না? কেন যে তাদের ভগবানের কাছে ছেড়ে দেয় না?
***
পশ্চিমের পাহাড়টার পিছনে লাল সূর্যটা ডুবে গেল। মার্থা রান্না করলেন বটে, কিন্তু কিছুতেই খেতে পারলেন না। সন্ধ্যা হতে তিনি টেরির জ্যাকেটটা পরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে আকাশটা কালো হতে থাকল আর তার গায়ে একটা একটা করে তারা ফুটতে থাকল। এক সময় দক্ষিণের আকাশে তাঁর চেনা তারাটাকে দেখা গেল, কিন্তু তিনি সেই তারার গতিপথ ভালো করে দেখতে পেলেন না, তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। আর ঠিক সেই সময়েই হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার চিড়ে, নুড়ি বিছানো রাস্তায় টায়ারের কর্কশ শব্দ তুলে একটা গাড়ি এসে থামল তাঁর বাড়ির সামনে।
মার্থা বাগানেই দাঁড়িয়ে রইলেন, “হে ভগবান, টেরি এসেছে কি?” মনে মনে বললেও তিনি জানেন সেই সম্ভাবনা প্রায় নেই! তাঁর পিছনে একজনের পদধ্বনি শোনা গেল। সেই ব্যক্তি তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে হালকা করে একটু কাশলেন। এইবার মার্থাকে পেছনে ফিরে সেই ব্যক্তির সম্মুখীন হতেই হল। তাঁর পরা ছাই রঙা উর্দিতে লাগানো তারকাগুলি তাঁকে চিনিয়ে দিল। তাঁর থমথমে মুখ ও তাঁর চোখের তলার কালি মার্থাকে বুঝিয়েই দিল তাঁর না বলা বক্তব্য। তাও তাঁকে বলতে হল—
—গুড ইভনিং ম্যাডাম! আমরা কিছুক্ষণ আগেই জানলাম সেই উল্কাটা স্যাটেলাইটের দেওয়াল ধ্বংস করে ক্যাপসুলের দেওয়ালও ফাটিয়ে দিয়েছে… আমাদের কিছু করার ছিল না ম্যাডাম… আপনি ঠিক আছেন তো?
—হ্যাঁ, ঠিক আছি।
—দুঃসংবাদটা দিতে আমাকেই আসতে হল… আমি আপনার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি ম্যাডাম!
—আমি ঠিক আছি।
—আমরা অবশ্যই আপ্রাণ চেষ্টা করব টেরির… ইয়ে মানে, ওর দেহাবশেষ নিয়ে আসতে… ওকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে কবর দেওয়া হবে।
—না!
—না?
মার্থা চোখ তুলে নক্ষত্রখচিত কালো আকাশের দিকে তাকালেন— কিছুক্ষণ আগে যে পথ দিয়ে টেরির নভোযানটা গেছে, সেই গতিপথের দিকে তিনি তাকালেন— এবার আর তাঁর চোখ ঝাপসা নেই, তাঁর স্পষ্ট দৃষ্টির সামনে জ্বলজ্বল করছে নীলচে সাদা রঙের লুব্ধক। তিনি আরও ওপরের দিকে চাইলেন— কালো আকাশের গায়ে কালপুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন আর্দ্রা, কৃত্তিকা, কার্তবীর্য ও বাণ নক্ষত্র চতুষ্টয়কে নিয়ে। আরও ওপরে দেখা যাচ্ছে বৃষ, মিথুন ও কর্কট রাশিকে এবং কৃত্তিকামণ্ডলীর সাত জন কৃত্তিকাকে। মার্থার মনে হল কালপুরুষ যেন একটি ফুলের গাছ আর আর্দ্রা, কৃত্তিকা, কার্তবীর্য ও বাণ নক্ষত্র চতুষ্টয় সেই গাছের চারটি ফুল। বৃষ ও মিথুন রাশি যেন কালো আকাশে ফুলশয্যা পেতেছে। গোলাকার কর্কট রাশি যেন একটি ফুলের মালা আর কৃত্তিকামণ্ডলী যেন ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা পুষ্পদল। সেই পুষ্পদ্যান থেকে উপবৃত্তাকার নক্ষত্রপথে পৌঁছে যাওয়া যায় মঙ্গল গ্রহের লাল গোলাপের বাগানে।
“না!” আবার বললেন মার্থা।
এতক্ষণ জেনারেলও চোখ তুলে আকাশের দিকে চেয়ে ছিলেন। এবার ধীরে ধীরে মাথা নামিয়ে বললেন, “আমি বুঝতে পেরেছি ম্যাডাম আপনি কী চাইছেন… তারাগুলোকে কী সুন্দর লাগছে না?”
“এর আগে এত সুন্দর কখনও লাগেনি।”
***
জেনারেল চলে যাওয়ার পর মার্থা আবার একবার চোখ তুলে নক্ষত্রোদ্যানের দিকে তাকালেন— নানা রঙের ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রপুষ্পের মাঝে যেখানে তাঁর ছেলে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। তারপর ধীর পদক্ষেপে তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে ফিরে এলেন।
মূল গল্প: স্টার মাদার (১৯৫৯)
লেখক: ১৩1
শীর্ষচিত্র: রনিন
Tags: অনুবাদ গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, নিবেদিতা হালদার গাঙ্গুলি, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, রনিন, রবার্ট এফ ইয়ং
বিজ্ঞানধর্মী গল্পের আবহ ছাপিয়েও মানবিক আখ্যান এই গল্পের সম্পদ!! অনুবাদেও সেই মেজাজ চমৎকার ফুটে উঠেছে।