গুরনেক সিং – বাংলা কল্পবিজ্ঞানের আশ্চর্য দিশারী
লেখক: আশ্চর্য! পত্রিকা
শিল্পী: জটায়ু
‘আশ্চর্য!’ পত্রিকায় নতুন ধরনের গল্প রচনায় যে সব লেখক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে গুরনেক সিং অন্যতম। তাঁর জনপ্রিয়তা ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার গৌরব। তাঁর সম্পর্কে বিশদ বিবরণ জানতে চেয়ে প্রায়ই ‘আশ্চর্য!’ অফিসে চিঠি আসে, ফোন আসে— কত প্রশ্ন… ‘গুরনেক সিং কি ছদ্মনাম?’, ‘তিনি কি সত্যি অবাঙালি?’, ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঠকবর্গের এই স্বতঃস্ফূর্ত কৌতূহল আর আকুল আগ্রহ চরিতার্থ করার জন্যই তাঁর ফোটো আর পরিচয় সংগ্রহ করে এই সংখ্যায় ছেপে দেওয়া হল।
তাঁর একটি নতুন ভালো গল্পও এ সংখ্যায় প্রকাশিত হল। তাঁর একটি সম্পূর্ণ উপন্যাসও ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার পাতার যথা শীঘ্র সম্ভব প্রকাশের ইচ্ছা আছে।
পরের মুখে
কয়েক বছর আগে একদিন জাতীয় গ্রন্থাগারের ক্যান্টিনে চা পান করতে করতে এক অচেনা কণ্ঠের সুউচ্চ সরস পরিহাসে সচকিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে প্রথমে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলাম— একটু দূরে অন্য টেবিলে কয়েকজন বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে বসে আছেন রঙিন পাগড়ি পরা এক তরুণ পাঞ্জাবি। এইমাত্র তিনি কার প্রতি যেন পরিহাসটি করলেন। তাকে লাইব্রেরির কর্মী বলে দূর থেকে দেখেছি, আমিও লাইব্রেরির একজন নিয়মিত পাঠক। অবাঙালি অনেকেই বাংলা বলেন, কিন্তু এমন অনায়াস উচ্চারণে পরিষ্কার বাংলা একজন পাঞ্জাবির মুখে সত্যিই বড় ভালো লেগেছিল।
রবীন্দ্র–জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে এক সাংস্কৃতিক সভায় একবার উপস্থিত ছিলাম। সেখানে বাংলা সাহিত্যের একজন কৃতযশা অধ্যাপক প্রসঙ্গত ঘোষণা করলেন, “আপনারা শুনে আনন্দিত হবেন, আমার বন্ধু শ্রী গুরনেক সিং রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটি পাঞ্জাবি ভাষায় অনুবাদ করেছেন।”
রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’, যার মধ্যে বাঙালি মনের মাধুর্যরসের অনবদ্য সৃষ্টি কুমুদিনী— বাংলার সেই একান্ত মরমী চরিত্রের কি অনুবাদ করলেন পাঞ্জাবি লেখক? কিছুটা বোধহয় উদ্বিগ্ন ও কিছুটা কৌতুহলী হয়ে লেখকের সঙ্গে আলাপ করলাম, প্রশ্ন করলাম কুমুর মতো বাঙালি ঘরের বাঙালি ধাতের মেয়েকে আপনি কেমন করে বুঝলেন?… ক্রমশ পরিচয় ঘনিষ্ঠ হল। বুঝলাম তিনি কেবল বাংলা ভাষা বলতে না লিখতেই শেখেননি— বাংলার ভাব–সংস্কৃতিকেও তিনি রীতিমতো আত্মসাৎ করেছেন। আমার মনে হয় পাঞ্জাবির পাগড়ি পোশাক ছাড়া ভদ্রলোক যদি বেশান্তরে আত্মপ্রকাশ করেন, কোনও বিশেষজ্ঞ শ্রী সিং–কে শেষ পর্যন্ত বাঙালি বলেই ধারণা করবেন।
আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে যে, পাঞ্জাবে যাঁর জন্ম, পাঞ্জাবি পরিবার পরিজনদের সঙ্গে আবাল্য থেকেও কেবল বাংলা স্কুলে পড়ে বাঙালি বন্ধু আর বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে একজন অবাঙালি সত্যতর পরিচয়ে বাঙালি হয়ে গেলেন কীভাবে! শ্রী সিংয়ের জনৈক সাহিত্যরসিক পাঞ্জাবি বন্ধুকে সহাস্যে বলতে শুনেছি, “গুরনেক সিং একেবারে বাঙালি হয়ে গেছেন। উনি পাঞ্জাবের প্রচলিত দেশি ভাষাই জানেন না!”
—জনৈক বন্ধু
নিজের মুখে
জন্ম যদিও পাঞ্জাবে, তবে ভালোভাবে জ্ঞান হবার আগেই বাংলা দেশে এসেছিলাম বাবা–মা–র সঙ্গে। তাই আমার ছোটবেলাকে ঘিরে যেসব মুখের আনাগোনা, তার সব ক–টাই প্রায় বাঙালি বন্ধুদের; আমার স্মৃতির প্রাঙ্গনে যে সব ঘটনার সমারোহ, তার সব ক–টির পৃষ্ঠভূমিই হল কলকাতা।
হাতেখড়িও হয়েছিল বাংলা ভাষাতেই। লেখাপড়া একডালিয়ার কর্পোরেশন স্কুলে, তারপর জগদ্বন্ধু ইন্সটিটিউশনে— সেখান থেকে বাংলা ভার্নাকুলার নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করলাম। আইএসসি–তেও বাংলা ছিল, বিএসসির পথে বাংলার সঙ্গে বিচ্ছেদ হল। তবে লেখা, পড়া আর বন্ধুদের মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে একটা সজীব যোগাযোগ রয়ে গেল।
আমার স্মৃতির মণিকোঠায় যে সব ঝলমলে ছবি আজও অম্লানভাবে বিরাজ করছে, তার একটি হল আমার পরম শ্রদ্ধেয় বাংলা অধ্যাপক হরিসাধনবাবুর। প্রধানত তাঁর সস্নেহ উৎসাহেই আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হই। অন্যান্য অধ্যাপকরাও আমার বাংলা শেখার ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। এঁদের সকলের স্নেহ, সাহচর্য ও সাহায্য না পেলে বাংলা হয়তো শিখতাম, কিন্তু বাংলায় নিজেকে প্রকাশ হয়তো করতে পারতাম না।
আমার জীবনের একটি সযত্নলালিত উচ্চাশা ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাশ করা। তাই জীবিকার প্রয়োজনে যখন সাহিত্য ছেড়ে বিজ্ঞানের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে হল, তখন যে ব্যথা পেয়েছিলাম, তার রেশ আজও মিলিয়ে যায়নি। পড়া ছেড়ে দেবার দশ বছর পরে এই সেদিন বাংলায় বি.এ দিয়ে বিজ্ঞানের পাঠক আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে বাংলায় এম.এ দেবার অধিকার অর্জন করে নিয়েছি। এবার আপনাদের আশীর্বাদ আর আমার গুরুবল!
লেখা শুরু করেছিলাম ক্লাস এইট থেকে। মনে আছে, প্রথম লেখা যখন যুগান্তরের পাততাড়িতে ছাপা হল তখন সে কি আনন্দ। নিজের নামটা যে ছাপার অক্ষরে দেখতে এত ভালো লাগে, সেটা সেই প্রথম আবিষ্কার করলাম। এরপর ক্রমে শিশুসাথী, শুকতারা, ভাইবোন, দ্বীপালী, অচলপত্র, যুগান্তর, আনন্দবাজার প্রভৃতি পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে। স্বর্গীয় কবি সুনির্মল বসু আমাকে লেখায় খুব উৎসাহিত করতেন। তাঁর চার লাইনের একটি অটোগ্রাফ আজও আমার কাছে আছে—
পাঞ্জাবি কিশোর তুমি তাই
বাংলায় বাঁধিয়াছ ঘর।
জয় তুমি করিয়াছ তাই
বাঙালির কিশোর অন্তর।
মাতৃভাষা পাঞ্জাবিতে আজ পর্যন্ত আমার প্রায় পঁচিশটি মৌলিক গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে কবিগুরুর ‘যোগাযোগ’ আর স্বামী বিবেকানন্দের দুটি জীবনীগ্রন্থের পাঞ্জাবি অনুবাদ।
হিন্দীতেও আমি লিখে থাকি— এ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রায় তিরিশটি গল্প বেরিয়েছে। হিন্দীতে প্রকাশিত কয়েকটি গল্প বাংলা (মানসী), ইংরেজি (ক্যারাভান), মারাঠী (লোকসত্ত) ও কান্নাডায় (কস্তুরী) ও অনূদিত হয়েছে।
বর্তমানে বাংলায় আমি দুটি পত্রিকার নিয়মিত লেখক— “আশ্চর্য!” ও “রোমাঞ্চ।” ছোটবেলা থেকেই ফ্যান্টাসি গল্পের প্রতি আমি বিশেষভাবে আকৃষ্ট। এইচ জি ওয়েলস, কন্যান ডয়াল, জুল ভের্ণ প্রমুখ দিকপালদের লেখার মধ্যে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলতাম। ক্লাস সেভেন–এইটে প্রেমেন্দ্র মিত্রের “পৃথিবী ছাড়িয়ে” ও “পিপীলিকা পুরাণ” পড়ে অসম্ভব ভালো লেগেছিল। বাংলায় এই জাতীয় লেখার খুবই অভাব ছিল; তাই যখন “আশ্চর্য!” বেরুল, তখন খুব ভালো লাগল। এতদিন ছিলাম নীরব পাঠক— আজ হয়েছি সক্রিয় লেখক। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানত “আশ্চর্য!”-র কর্ণধারদের সানন্দ সহযোগিতায় ও “আশ্চর্য!” পাঠকদের অকুণ্ঠ আশীর্বাদে— লেখকের যা সর্বশ্রেষ্ঠ পাথেয়।
কর্মজীবনে আমি জাতীয় গ্রন্থাগারের সেন্ট্রাল রেফারেন্স লাইব্রেরিতে নিযুক্ত; সাংসারিক জীবনে আমি ছোটখাটো একটি সত্যজিৎ রায়— ‘তিন কন্যা’র গৌরবান্বিত পিতা! সেতার, ফোটোগ্রাফি, বই পড়া আর দেশভ্রমণের সখ আছে।”
—গুরনেক সিং
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য! মে ১৯৬৭
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ পাবলিক লাইব্রেরি, সোহম গুহ
Tags: আশ্চর্য পত্রিকা, গুরনেক সিং, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
দারুণ লাগলো, যদিও আশ্চর্যের গ্রাহক ছিলাম প্রথম সংখ্যা থেকে৷ তবে এতো কিছু মনে ছিলো না। পুরোনো কথা ফিরিয়ে আনবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।