বাংলা সায়-ফি জগতের হারামণি ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী
লেখক: আশ্চর্য! পত্রিকা
শিল্পী: জটায়ু
মাত্র ৩৮ বছর বয়েসে গত সোমবার ৫ সেপ্টেম্বর ভোররাতে কলকাতার উড্ল্যান্ডস্ নার্সিংহোমে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন ‘আশ্চর্য!’ প্রিয় লেখক এবং বাংলা সাহিত্যের সায়েন্স ফিকশন দিগন্তের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ডক্টর দিলীপ কুমার রায়চৌধুরী।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিভাধর ছাত্র হিসেবে অল্প দিনেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন দিলীপবাবু। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত খড়গপুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ছিলেন লেকচারার রূপে। এর পরেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হন এবং Iowa স্টেট কলেজ শিক্ষক-গবেষক সহযোগীর কাজ করেন ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত। পরে এইখান থেকেই ডক্টরেট উপাধি লাভের সম্মান অর্জন করেন।
১৯৫৭ সালে আই.সি.আই.লিমিটেড কোম্পানিতে টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন দিলীপবাবু এবং ক্রমে ক্রমে গত জুন মাসে কমার্শিয়াল ম্যানেজারের পদে উন্নীত হন। ডক্টর রায়চৌধুরী রাবার টেকনোলজিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং বিভিন্ন কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্য ছিলেন। কেবলমাত্র সায়েন্স এবং টেকনোলজিতে দক্ষতা অর্জনই নয়, প্রাবন্ধিক ও সায়-ফি লেখক রূপেও তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন।
দিলীপবাবুর শোকবিহ্বল পিতামাতা, স্ত্রী এবং দুই কন্যাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই। অগাধ পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও তাঁর সরলতা আমাদের বিমুগ্ধ করেছে; এবং স্বল্পতা সত্ত্বেও SF কে জনপ্রিয় করার জন্যে তাঁর অদম্য উৎসাহ আমাদের বিস্মিত করেছে।
ডক্টর দিলীপ কুমার রায়চৌধুরীর লোকান্তরিত আত্মা শান্তিলাভ করুন, এই প্রার্থনাই করি ঈশ্বরের কাছে।
—সম্পাদক, ‘আশ্চর্য!’
******
ভাগ্যের পরিহাস এর চেয়ে আর কি নিষ্ঠুর হতে পারে। দিলীপের শোক স্মৃতি আমায় লিখতে হবে এ কথা কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি। দিলীপ রায়চৌধুরী বাংলা দেশের পক্ষে গর্ব করবার মতো ছেলে, বিদ্যায় বুদ্ধিতে স্বভাব চরিত্রে চেহারায় আচরণে সত্যিই তার জুড়ি খুঁজে পাওয়া ভার। পড়াশুনায় অনেক ছেলে ভালো হয়ে দেশ বিদেশের সম্মান পায়, অল্প বয়সে আশাতীত উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়াও একেবারে বিরল নয়। কিন্তু এসবের ওপরে দিলীপের এমন কয়েকটি বিশেষ গুণ ছিল যা তাকে একটি উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র দিয়েছে। বিনয়ী মিষ্টভাষী শান্ত গম্ভীর এই সুদর্শন ছেলেটির মধ্যে এমন একটা প্রচণ্ড উৎসাহের সংহত বেগ যে ছিল তা অনেকেই বাইরে থেকে বুঝতে পারতেন না। কর্মোদ্যম তার নানা দিকে প্রকাশ পেয়েছে। তার তুল্য মূল্যের পদে যারা সমাসীন তাদের বেশির ভাগই যখন নিজেদের যোগ্য ঠাঁট বজায় রাখতে ব্যস্ত, দিলীপ তখন বাংলা দেশের ছোটদের জন্যে নির্দলীয় রাজনীতি নিরপেক্ষ একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। তার পরিচালিত তরুণতীর্থ প্রতিষ্ঠানটিতে প্রাণের যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেখেছি তা অতুলনীয়। দিলীপ বিজ্ঞানের জগতের মানুষ, হয়তো ব্যাবসায়িক সংস্থায় নিজের বহুমুখী প্রতিভার অবিসম্বাদিত প্রমাণ দিয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনি রচনার তার আশাতীত সাফল্য। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে অকালে দিলীপ আমাদের ছেড়ে গেছে। তার কাছে নানা দিক দিয়ে অনেক কিছুই আশা করবার ছিল। সে আশা আর কোনও দিন পূর্ণ হবার নয় যখন ভাবি তখন পরম সম্ভাবনাময় একটি মহৎ জীবনের ওপর যথেচ্ছ খেয়ালের এই আকস্মিক ছেদ টানার ভেতরে জীবন বিধাতার কী গভীর উদ্দেশ্য থাকতে পারে বুঝতে পারি না।
—প্রেমেন্দ্র মিত্র
******
রেডিয়ো স্টেশনে জমায়েত হয়েছি চারজনে— প্রেমেনবাবু, অদ্রীশ, আমি এবং আরেকটি ভদ্রলোক, যার সঙ্গে তখনও আমার পরিচয় হয়নি। চারজনে মিলে পালা করে আমাদের রচিত একটি বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প রেকর্ড করব রেডিয়োর জন্য।
অচেনা ভদ্রলোকটির সঙ্গে অদ্রীশই আলাপ করিয়ে দিল।
‘ইনিই দিলীপ রায়চৌধুরী।’
নমস্কার বিনিময়ের সময় লক্ষ করলাম তাঁর হাসিতে বালকসুলভ সরলতা। বললেন, ‘আমার বোনের কাছে আপনার কথা খুব শুনি।’
‘আপনার বোন…?’
‘শিবানী।’
বুঝলাম ইনি সন্দেশের লেখিকা শিবানী রায়চৌধুরীর দাদা।
এবার প্রেমেনবাবু আরও বললেন তাঁর সম্পর্কে— তাঁর মেধা, তাঁর কৃতিত্ব, তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, এবং কতদিন থেকে কতখানি স্নেহ করে এসেছেন তিনি দিলীপকে।
ডাক এল। যে যার অংশ রেকর্ড করে এলাম। তারপর চারজনে বসে চা পান ও সেই রেকর্ডিং-এর প্লেব্যাক শোনা।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বিদায় গ্রহণের সময় এসে গেল। বললাম, একদিন আসবেন তো? হেসে সম্মতির ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন তিনি। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর প্রতি একটা সৌহার্দ্য অনুভব করছিলাম। শুধু সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত সম্প্রদায়ের একজনকে পাওয়া গেছে বলে নয়, তাঁর আকৃতি ও প্রকৃতি দুইই ছিল সহজে মানুষকে কাছে টেনে নেবার মতো।
সে দিনের পর আর দেখা হয়নি, শিবানী সম্প্রতি এসেছিল তাকে তার দাদার কথা জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, ভালো আছেন।
ক্ষমতাবান যুবা পুরুষের অকালমৃত্যু সব সময়েই মর্মান্তিক। দিলীপ রায়চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় না হলেও তাঁর মৃত্যুতে আক্ষেপ হত নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সেদিনের সেই সামান্য পরিচয়ের স্মৃতি আজ আমার আক্ষেপকে আর নির্ব্যক্তিক থাকতে দেয়নি। আজ মনে হচ্ছে যেন একজন অতি কাছের মানুষ, চেনা মানুষকে হারালাম।
—সত্যজিৎ রায়
১১/৯/৬৬
******
সালটা ১৯৬৪। মাসটা মনে নেই।
গেছিলাম আদি গঙ্গার তীরে প্রেমেন্দ্র মিত্রে বাড়ি। আলোচনা হচ্ছিল ‘আশ্চর্য!’ নিয়ে। উনি বললেন, ‘অদ্রীশ, মৌলিক গল্প পাচ্ছ?’
বললাম, ‘খুব বেশি নয়।’
উনি তখন হাতে তুলে দিলেন ‘শিলাকান্থ’র পাণ্ডুলিপি।
বললেন, ‘হাত ভালো। এঁকে দিয়ে তোমরা লেখাও।’
লেখকের নাম দেখলাম, ডক্টর দিলীপ কুমার রায়চৌধুরী। শুনলাম বিলাতফেরত বড় বিজ্ঞানী। বয়স কিন্তু অল্প। আই.সি.আই.য়ের টেকনিক্যাল সারভিস ম্যানেজার। নিজে পণ্ডিত বলেই গল্পের তত্ত্বে ফাঁকি নেই, অথচ তথ্যভারাক্রান্ত নয়।
‘শিলাকান্থ’ সেই বছরেই অগাষ্টে প্রকাশিত হল ‘আশ্চর্য!’তে এবং ওই একটি গল্পেই পাঠকপ্রিয় হয়ে গেলেন দিলীপবাবু, চিঠি আসতে লাগল ‘শিলাকান্থ’র লেখকের কলমে আরও গল্প চাই। কিন্তু তাঁর সময় খুব কম। তা সত্ত্বেও লিখলেন কয়েকটি গল্প উপন্যাস এবং প্রতিটিই সাড়া জাগাল পাঠকমহলে।
মানুষটির সহিত আলাপ হল প্রেমেনদার বাড়িতেই। সদাহাস্যময় অমায়িক। কথাবার্তায় আশ্চর্য সরলতা। তারপর তাঁর সঙ্গে বহু বার দেখা হয়েছে। প্রতিবারই বলতেন, “‘আশ্চর্য!’-কে আমি ভালোবাসি, তাই না লিখেও পারি না।”
মাত্র একটি উপন্যাস এবং তিন-চারটি ছোটগল্প লিখে যে খ্যাতি অর্জন করলেন দিলীপবাবু, তা মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানের কপালেই জোটে। জনপ্রিয়তার স্বীকৃতি এল আর একদিক দিয়ে। কলকাতা যেসব কেন্দ্র থেকে সাহিত্য বাসরে সায়েন্স ফিকশন গল্প বলার আমন্ত্রণ এল ‘আশ্চর্য!-র’ তিন লেখকের কাছে— সেবার ছিলাম আমরা তিনজন— প্রেমেনদা, দিলীপবাবু এবং আমি। দ্বিতীয়বারের সাহিত্য বাসরে পড়লাম ‘সবুজ মানুষ’— এবার আমাদের সঙ্গে রইলেন সত্যজিৎ রায়।
দিলীপবাবু প্রতি বছরেই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতের বাইরে যেতেন। ফিরে এসে ফোন করতেন, দেখাসাক্ষাৎ হত। সায়-ফি’কে কীভাবে আরও ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা বলতেন। ওঁর ইচ্ছে ছিল একটি Symposium করা। কিন্তু আর শেষ রক্ষা হল না।
অগাষ্টের শেষাশেষি একদিন রাত সাড়ে ন-টার সময়ে ‘আশ্চর্য!’ দপ্তরে এসে হাজির দিলীপবাবু। পুজোর গল্প তার আগের দিনই গভীর রাত পর্যন্ত লিখে শেষ করেছেন। আমার পায়ের আঙুল ভেঙে গেছে শুনেই নিউ আলিপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন আমাকে দেখতে। অসীম বর্ধনের সঙ্গে আলোচনা হল রকেট সিরিজে তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘অগ্নির দেবতা হেফেস্টাস’ প্রকাশ সম্পর্কে। আমাকে বললেন, SF সিনে ক্লাবের ফিল্ম শো’তে আসার ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারছেন না সময়ের অভাবে। আমি বললাম, ‘আসুন না দোসরা অক্টোবরের শো-য়ে।’
প্রাণখোলা হেসে জবাব দিলেন দিলীপবাবু, ‘দাঁড়ান মশাই, বাঁচি কি মরি তার নেই ঠিক, দোসরা অক্টোবরের অনেক দেরি।’
সত্যিই তাই হল। দোসরা অক্টোবর আর এল না তাঁর জীবনে। ৫ সেপ্টেম্বর খবরটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম ডক্টর দিলীপ রায়চোয়ধুরী আর নেই। এনকেফালাইটিস রোগে রেনে ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছেন আমাদের প্রিয় সুহৃদ।
খবরটা বিশ্বাস হয়নি। তৎক্ষণাৎ টেলিফোন করলাম। ওঁর শাশুড়ি ধরলেন। বললেন, “এইমাত্র ইলেকট্রিক চুল্লিতে তাকে দাহ করে ফিরছি।”
সব শেষ হয়ে গেল। একটা বিরাট প্রতিভার আকস্মিক মৃত্যু ঘটল। এত অল্প লিখে ‘আশ্চর্য!’ মহলে এত নাম খুব অল্প লোকই করেছেন। প্রেমেনদা শুধু একজনকেই এনে দিয়েছিলেন ‘আশ্চর্য!’ গোষ্ঠীতে, স্বল্প সময়ে বিপুল নাম করে তিনিও আমাদের ছেড়ে গেলেন মাত্র ৩৮ বছর বয়েসে।
প্রেমেনদাকে টেলিফোন করলাম। বুঝলাম, কান্নার ওঁর গলা বুজে গেছে— কথা বলতে পারছেন না। বারবার বললেন, “দিলীপ আমার ছেলের চেয়েও বড় ছিল। ভগবান যাঁদের ভালোবাসেন তাঁদেরই কাছে টেনে নেন। তাই এর মতো রত্নকে পেয়েও আমরা হারালাম।”
দিলীপবাবু আজ নেই। কিন্তু তাঁর অফুরন্ত প্রাণশক্তি, বিপুল উৎসাহ সায়-ফি ভক্তমহলে সঞ্চারিত হোক, এই কামনাই করি তাঁর অকাল মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারা সায়েন্স ফিকশনের অগ্রগতি যে বেশ খানিকটা ব্যাহত হল, তাতে সন্দেহ নেই।
—অদ্রীশ বর্ধন
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য! অক্টোবর-নভেম্বর ১৯৬৬
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ পাবলিক লাইব্রেরি, সোহম গুহ
Tags: জটায়ু, ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, বিশেষ আকর্ষণ
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল এই লেখা পড়ে। আমি স্বর্গত লেখকের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলাম, আছি, থাকব। তাঁর অকালপ্রয়াণ বাংলা সায়েন্স ফিকশন জগতে অপূরণীয় ক্ষতি করেছিল।
এই লেখায় অন্য যে নক্ষত্ররা স্মৃতিতর্পণ করেছেন, আজ তাঁরাও কেউ নেই। হয়তো দূর কোনো নক্ষত্রলোকে তাঁরা রচনা করছেন ‘সবুজ মানুষ’-এর পরবর্তী অধ্যায়।
একজন প্রতিভাশালী মানুষ এই ছায়াপথের মায়া ছেড়ে অন্য কোন কালাবর্ত্ম্যের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন নেহাত অকালে। তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার অবসরেও বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ধারাকে নানা মৌলিক আখ্যানের সম্ভারে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁকে অকালে হারানোর এই কষ্ট, এই আক্ষেপ আমাদের কোনদিনও যাবে না।