বাতাসে বিনাশ বার্তা
লেখক: প্রদীপ্ত সাহা
শিল্পী: রনিন
টেবিলের ওপর সাজান সিদ্ধ ভাতের তৈরি সাদা, শাঙ্কব পাহাড়ের সারি; কলা পাতায় উৎসর্গ করা চাল, পাখির ডিম, বিভিন্ন ফলমূল, ছত্রাক। আজ রিনচেনদের বাড়িতে পুজো, লেপচা ভাষায় ‘রাম ফাট্’। প্রাচীন মুন ধর্মবিধি মেনে উপাসক সিমিক বংথিং এবং উপাসিকা রেণু মুন সামান্য ‘চি’ পান করে পুজোয় বসেছেন। সকাল থেকেই কুয়াশার ধুসর পর্দায় মুখ ঢেকেছে গ্রামের রাস্তাঘাট। রিনচেনদের বাড়ি থেকে বৌদ্ধ স্তূপটি দেখা যাচ্ছে না আজ। তিব্বতি মন্ত্র লেখা স্তব নিশানের সারি উড়ছে না অন্য দিনের মতো। বিরূপ প্রকৃতি উপেক্ষা করেও কিন্তু রিনচেনদের বাড়ির বাইরের উঠোনে জমে উঠেছে মেলা ভিড়। ওর আবো রংকুপ আর আমু পেমা দাঁড়িয়ে আছেন বেদির কাছেই। রংকুপ পরেছেন ডোরাকাটা দাম্প্রা, তার মাথায় বেতের টুপি। পেমা দেবীর পরনে রঙিন দাম্দেম্। মাসখানেক হল রিনচেনের শরীর গতিক ভালো যাচ্ছে না। তাই এবারের রাম ফাট বাড়িতেই হচ্ছে।
ছোট ছোট বাঁশের প্রদীপের আলোয়, ধুনোর ধোঁয়ায় আর রেনু মুনের একাগ্র প্রার্থনায় দেবতারা যে তুষ্ট হয়েই থাকবেন তা নিয়ে প্রায় কেউই দ্বিমত পোষণ করল না। পুজো যখন শেষের দিকে, কুয়াশার পরত ভেদ করে হঠাৎই তখন শোনা গেল সাইরেনের কানফাটা আওয়াজ। একটা লালবাতি সরকারি গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে বাইরে।
‘ড. চ্যাটার্জি না?’ একটু বিস্মিত হয়েই বাইরে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করলেন রংকুপ। নামটা শুনে স্ত্রী পেমা আর কন্যা সুমিনাও ঘুরে তাকাল দরজার দিকে।
‘কিন্তু উনি হঠাৎ এভাবে এখানে? সঙ্গে সাধারণ পোষাকে ইন্সপেক্টর যাদভও এসেছেন!’
ওঁদের আসতে দেখে ওরা সবাই বেশ অবাক। সুমিনা একবার তার ভাই রিনচেনের দিকে তাকাল। গতকাল সে ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে গেছিল, সে কথা আর বাড়িতে জানান হয়নি। ড. সন্দীপ চ্যাটার্জি বড় নিউরোসার্জন, শিলিগুড়িতে ওঁর হাসপাতাল। জানালেন রিনচেনর চিকিৎসা উনি শুরু করেছেন। রংকুপ আর সুমিনা ডাক্তারবাবুকে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
‘গত মাস থেকেই দেখছি ওর আচার ব্যবহার কেমন বদলে গেছে। আসলে আমিই নিয়ে যেতাম আপনার কাছে। যাক ভালোই হয়েছে দিদির সঙ্গে গেছে। ঠিক কী হয়েছে ওর ডাক্তারবাবু?’
‘ওর একটু অদ্ভুত ধরনের হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। লক্ষণ দেখে আমি প্রথমটা ভেবে ছিলাম হয়তো এটা স্কিটজোঅ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার হতে পারে। কিন্তু তোমার পরিবারে এই রোগ কারোর নেই। তাই আমার মনে সংশয় ছিল। এই রোগ হঠাৎ করে কারোর হওয়াটা একটু অস্বাভাবিক।’
‘স্কিটজোফ্রেনিয়া তো খুব খারাপ অসুখ ডাক্তারবাবু?’ রংকুপের মুখে ফুটে উঠল সংশয় আর দুশ্চিন্তার ছাপ।
‘সে তো বটেই। তবে আমার মনে হয় আপনার ছেলের এই হ্যালুসিনেশন আসলে কোনও মানসিক অসুখ নয়। ও নেশা করে কি না জিজ্ঞেস করেছিলাম গতকাল, আর ও সত্যি বলছে কি না যাচাই করে দেখার জন্য দিয়ে ছিলাম রক্ত পরীক্ষা করাতে। এই দেখুন আমার হাতে ওর ব্লাড রিপোর্ট। এই রিপোর্ট বলছে আপনার ছেলের রক্তে বিরল একধরনের হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ পাওয়া গেছে। আমি নিশ্চিত যে ও নেশা করছে আজকাল। আর এমন কিছু নেশা করছে যা এই তল্লাটে পাওয়াই যায় না। পাহাড়ে নেশার উপদ্রব বেড়েছে। আমি চিন্তিত যে হয়তো ও কোনও খারাপ সঙ্গতে পড়েছে।’
‘বলেন কী ডাক্তারবাবু!’ রংকুপ আকাশ থেকে পড়লেন।
‘সেরকম হলে আমরা বাড়িতে বুঝতে পারতাম। কিন্তু আমরা তো একবারেই কিছু জানি না। হ্যাঁ, মাসখানেক আগে ও একবার জ্বরে পড়েছিল। তখন কীসব যেন ভুল বকত।’
‘ওর নিউমোনিয়া হয়েছিল। সেই প্রেসক্রিপশন আমি দেখেছি। তবে আপনার ভাবনার কিছু নেই, পুলিশের হাতে ওকে দেওয়া হবে না। আমি ওকে এখন শিলিগুড়িতে আমার হাসপাতালে রাখব। সেখানেই ওর চিকিৎসা হবে। আর তার সঙ্গে জানা দরকার সে কী নেশা করে? কোথা থেকেই বা সেসব পায়? তারপর হয়তো রিহ্যাব সেন্টারে ওকে নিয়ে যাওয়া হবে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তাই সঙ্গে পুলিশ আনতেই হল।’
‘কিন্তু ডাক্তারবাবু।’
‘কোনও কিন্তুর অবকাশ নেই রংকুপবাবু।’ উদ্বিগ্ন রংকুপকে রুঢ়ভাবেই জবাব দিলেন ড.চ্যাটার্জি।
তারপর ওঁরা যেমনভাবে হঠাৎই এসেছিলেন ধূমকেতুর মতো, তেমনই তড়িঘড়ি করে চলে গেলেন। বাড়ির উঠোনে মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল রিনচেনকে নিয়ে। গ্রামবাসীদের ঠিক কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না রংকুপ। সেদিনের উৎসব শেষ হল বেসুরো ঝমঝমে বৃষ্টিতে।
এই আকস্মিক ঘটনার অভিঘাতে পরিবারের প্রতিটি মানুষের জীবন অনেকটাই বদলে গেল। অনূর্ধ্ব সতেরো জাতীয় দলে রিনচেনের খেলার কথা। ছেলের ফুটবল খেলা নিয়ে গ্রামে রংকুপের সম্মান নেহাত কম নয়। সেবার যখন শিলিগুড়ির বড় ক্লাবের বিরুদ্ধে নামচু ক্লাব জিতল বাবা হিসেবে রংকুপের গর্ব কম হয়নি। গোলটা রিনচেনই করেছিল, তাও বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই। খেলা তখন ৪-৪। বড়জোর আর মাত্র দশ মিনিট বাকি শেষ হতে। সবাই ভাবছে খেলাটা ড্র হবে। হঠাৎ একটা পাস পেয়ে রিনচেন তরতরিয়ে এগিয়ে গেল বল নিয়ে। ওদের মিড ফিল্ডাররা তখন খানিকটা অপ্রস্তুত। সবাই তখন অন্যদিকে। সেই সুযোগে বল নিয়ে সে ঢুকে পড়ল ওদের পেনাল্টি এরিয়ায়। সেখানে তখন শুধু একজন ডিফেন্ডার রয়েছে। তাকে এক মুহূর্তে ডজ্ করে অসাধারণ দক্ষতায় কোনাকুনি শট্ নিল ও। কীপারের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে নিখুঁত ‘বেকহ্যামীয় গতিসূত্র’ মেনে বল গন্তব্যে ঢুকে গেল। তারপর মাঠে সে কি উচ্ছ্বাস ওকে নিয়ে। তখন থেকেই ওকে ‘শুটিং স্টার’ বলে সবাই ডাকতে শুরু করেছিল।
ঘটনার পর থেকে সজ্জন, মিতভাষী রংকুপ প্রতিবেশীদের যতটা সম্ভব এড়িয়েই চলতে শুরু করলেন। যেন এক বিরাট অন্যায় করে ফেলেছেন। পেমা দেবীর দিকে তো তাকানই যায় না। সারাদিন কাজ নিয়েই মিছেই ব্যস্ত থাকেন। আর রিনচেনের কথা উঠলেই মুখে তার একরাশ অন্ধকার নেমে আসে। গ্রামের মানুষজনের রিনচেনকে ঘিরে বড় আশা ছিল। মেরংসি গ্রামের মোড়ে মোড়ে ওকে নিয়ে আলোচনা থামতেই চায় না।
***
এর ঠিক সপ্তাহখানেক আগে, বিকেলে ক্লাবে ফুটবল খেলতে গিয়ে ফড়িং বুঝল খেলায় রিনচেনের একেবারেই মন নেই। রিনচেনের সঙ্গে ফড়িংও নামচু ক্লাবেই ফুটবল খেলে।
‘আরিং রে সু গো? তোর কী হয়েছে বলতো রিনচেন? বার বার ফাউল করছিলি। এভাবে খেললে তো রেড কার্ড দেখবি। আর এত খারাপ স্কিল তোর আগে কখন দেখিনি। সব কিছুতেই কেমন গা ছাড়া ভাব। ব্যাপার কী শুনি?’ খেলার শেষে ড্রেসিং রুমে এসে একটু বিরক্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করল ফড়িং।
‘ও কিছু না রে। গো আক ইয়েত দো।’ অন্য দিকে তাকিয়ে রিনচেন প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইল।
‘না বললেই হল? কিছু তো নিশ্চয়ই হয়েছে। আমাকে বলবি না সেটা বল। আর ভাই তুই স্টার প্লেয়ার আমাকে সব বলবিই বা কেন?’
ফড়িঙের গলায় অভিযোগের সুর। রিনচেন বুঝল এবার আর না বললেই নয়। ব্যাপারটা রাগ অভিমানের পর্যায় চলে গেলে ফড়িং আবার কথা বন্ধ করে দেয়। হাতে মোবাইল ফোনটা নাড়াচাড়া করতে করতে মিনমিনে গলায় সে বলল, ‘কি জানিস, আমার এই ফোনটায় কেমন যেন অদ্ভুত সব ছবি আমি দেখছি।’
‘মানে? কীরকম ছবি?’
‘খুব ডিস্টারবিং ছবিগুলো, এই আমাদের ক্লাবেরই।’
‘কই দেখি দে তোর ফোনটা।’
রিনচেন ফোনটা দিতে না চাইলেও ফড়িং জোর করেই নিল। তারপর সব ছবিগুলি দেখল একে একে। ছবিগুলি গতবার শিলিগুড়ির দেশবন্ধু ক্লাবের বিরুদ্ধে ম্যাচ জিতে রিনচেন নিজেই তুলেছিল। গ্রামে ফিরেও চলছিল বিজয় উৎসব। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবকে হারিয়ে ওদের আনন্দ আর ধরে না। সেইদিন ক্লাবের সামনে তাদের পুরো দলের একটা গ্রুপ ফোটো, আর ক্লাব ঘরের ভিতরে কয়েকটি ছবি রিনচেন তুলেছিল। কিন্তু এখন সে বলেছে যে প্রায় দিনই নাকি সন্ধেয় ছবিগুলি সব আপনা আপনিই বদলে যায়। ক্লাবের সামনে কেউই আর সারি বেঁধে বসে নেই, ভেঙে পড়েছে ক্লাব ঘরটির একাংশ, সামনে থই থই করছে জল, খেলার মাঠে নেমেছে ধ্বস। আর সেই ধ্বসে চাপা পড়ে আছে অনেকে। ভেঙে পড়েছে ক্লাব ঘরের ছাদ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইট কাঠ পাথরের রাবিশ। তবে ফড়িং কিন্তু রিনচেনর কথামতো তেমন কিছুই দেখতে পেল না।
‘কই, এগুলো তো ঠিকই আছে দেখছি রে। এই তো সবাই বসে আছে।’
‘তুই দেখতে পেলি না? ঠিক করে দেখ আরেকবার ভাই। আমি এখনও স্পষ্টই দেখছি সব কিছু।’ রিনচেন বিশ্বাসই করতেই পারছে না যে একই ছবি ওরা দুজনে দুরকম দেখছে।
‘আমার কী হয়েছে বলত ভাই? শুধু আমিই কেন এসব দেখছি?’ রিনচেনের গলায় হতাশা, আশঙ্কা আর ভয় মিলে মিশে একাকার। উত্তরে ঠিক কী বলবে ফড়িং ভেবে পেল না।
‘তুই হয়তো অন্য কোনও ছবির কথা ভাবছিস।’ তারপর রিনচেনের কপালে হাত রাখতেই সে বুঝল ওর গায়ে হালকা জ্বর ভাব। থার্মোমিটারে মাপলে হয়তো নিরানব্বইও পেরবে না।
‘তুই এসব নিয়ে এখন বেশি ভাবিস না। তোর শরীর এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। আজকে খেলতে এলিই বা কেন? কিছুদিন আরও বাড়িতে রেস্ট নে, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তারপর একটু থেমে, কী যেন ভেবে বলল, ‘তবে আমি কি ভাবছিলাম জানিস? হয়তো তুই যে ছবিগুলো দেখছিস হতে পারে অন্য কেউ পাঠিয়েছে তোকে।’
‘অন্য কেউ? কিন্তু কেন?’
‘হয়তো তোকে সে সাবধান করতে চায়। ধর যদি এগুলি ভবিষ্যৎ থেকে পাঠান ছবি হয়?’
‘ভবিষ্যতের ছবি? তাও আমারই ফোনের ক্যামেরায় তোলা? তুই ঠিক কী বলতে চাইছিস বলত? ভুতুড়ে গল্প নাকি টাইম মেশিন?’ চোখ কপালে তুলে, কথাগুলো একটু বিরক্তি নিয়েই বলল রিনচেন।
‘আরে না রে। টাইম মেশিন নয়। আমার ধারণা হয়তো কেউ তোকে পাঠাচ্ছে এই ছবিগুলো। তবে এগুলো সত্যই ভবিষ্যতের কি না সেটা নিশ্চিত হতে হলে ছবির তারিখটা তুই কী দেখছিস আমার জানা দরকার? বুঝলি?’
রিনচেন অনেক চেষ্টা করেও তারিখ বুঝতে পারল না। ছবির মেটাডেটায় তারিখ আর সময় লেখা অক্ষরগুলি কেমন যেন ঝাপসা। রিনচেন কী যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখনই ওদের ডাক পড়ল। ভেতরে যেতে হবে। সবাই সেখানে জড় হয়েছে প্রোজেক্টরে খেলা দেখার জন্য।
‘চল এখন যেতে হবে। পরে দেখিস আবার।’
অনুশীলনের ভিডিয়ো ফুটেজ ওরা সবাই ক্লাবে বসেই রোজ দেখে। নিজেদের খেলা দেখলে ভালোমন্দ দিকগুলি সহজেই ধরা পড়ে। বড় পর্দায় শুরু হল ছবির অভিক্ষেপণ। সবাই যখন মন দিয়ে দেখেছে ভিডিয়ো ফুটেজ, ফড়িং লক্ষ করল রিনচেন কেমন যেন উসখুস করছে, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। হাত ধরে নাড়া দিতে সে সম্বিত ফিরে পেল।
‘কীরে কী হল?’
রিনচেন কোনও উত্তর দিল না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াল। দেখা দেখি ফড়িং ওর পিছু নিল।
‘কিরে তুই বেরিয়ে এলি এভাবে?’
‘সেই একই সমস্যা রে। তোরা যা দেখছিলি আমি তা দেখিনি। আমি দেখলাম খুব বৃষ্টি হচ্ছে, ধ্বস নামছে ক্লাবের মাঠে। যেমনটা দেখেছিলাম সেই ছবিগুলোতে। দেখলাম সেই ধ্বসে সব কিছু ভেঙে হয়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। অনেককে ধ্বসে চাপা পড়ে আছে। তুই, সেরিং, ডিঙ্গো, কোচ স্যার সব্বাই। আর দেখতে দেখতে মনে হল আমিও যেন চলে গেছি ওই ধ্বংসের মাঝে। মনে হল আমিও ভিজে গেছি বৃষ্টিতে। শুনতে পেলাম বৃষ্টির শব্দ, গাছ পড়ার আওয়াজ, সঙ্গে মানুষের আর্তনাদ।’
‘হুম, ভারী অদ্ভুত!’ ফড়িংকে একটু অন্যমনস্ক শোনাল।
‘আরেকটা ব্যাপার, আমি যে ভিডিয়ো ফুটেজ আর ছবিগুলো দেখছিলাম কিছুক্ষণ আগে সেগুলো কম রেজলুশনের, আর খানিকটা যেন কার্টুন ছবির মতো। এরকম ছবি ক্যামেরায় কখনই ওঠে না।’
‘হ্যাঁ আর তার মানে হল তুই যা দেখছিস কখনই সেসব ক্যামেরায় তোলা হতে পারে না। হলে অবশ্য আমরাও তা দেখতে পেতাম।’
‘যদি ধরেই নি যে আমার মোবাইলেই কোনও বিশেষ ক্যামেরা আছে বা কোনও অ্যাপ আছে যা শুধু আমাকেই ভবিষ্যৎ দেখায়, তাহলে প্রশ্ন আসে ক্লাবে দেখা ভিডিয়োগুলোতেও একই রকম দৃশ্য কেন দেখলাম? সেগুলো তো আর আমার মোবাইলে তোলা নয়।’
‘তুই ঠিকই বলছিস। আচ্ছা শোন, আমরা আরেকবার ওই ভিডিয়ো ক্লিপিং দেখব ক্লাবে ঢুকে। তাই এখনই বাড়ি চলে যাস না।’
তারপর সবাই চলে গেলে ওরা আরেকবার ভিডিয়ো দেখতে শুরু করল। ভিডিয়োর মেটাডেটা দেখিয়ে ফড়িং বার বার রিনচেনকে জিজ্ঞেস করল যে সে এবার কোনও তারিখ সে দেখতে পাচ্ছে কি না। তারিখ দেখতে পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে সত্যই সেটা ভবিষ্যতের ফুটেজ কি না। আবার যদি সত্যই সেটা কোনও দুর্যোগের পূর্বাভাষ হয় তবে কবে তা হতে চলেছে সেটাও বোঝা যাবে। কিন্তু রিনচেন অনেক চেষ্টা করেও তারিখ দেখতে পেল না। তবে সে দ্বিতীয় বার ভিডিয়ো দেখতে গিয়ে লক্ষ করল আগেরবার সে যা যা দেখেছিল এবার যেন সবকিছুই একটু বদলে গেছে। ক্লাব ঘরের বাইরে বড় পাইন গাছটা পড়ে যেতে দেখেছিল আগের বার। এবার সেটা ঠিকই আছে। আগেরবার রিনচেন যাদের যেখানে যেখানে চাপা পড়ে থাকতে দেখেছিল এবার কিন্তু তাদেরকে ঠিক সেখানে সেখানে দেখা গেল না। সবাই যেন জায়গা বদল করেছে। ক্লাব ঘরটা আগের বার ভেঙেছিল উত্তর দিক দিয়ে। এবার ভেঙেছে দক্ষিণ দিক দিয়ে। এসব দেখে ওর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হল ও সে যা কিছু দেখছে সেসব ওর মস্তিষ্কেরই খেয়াল। ওরা ঠিক করল কাউকে না কাউকে সবকিছু জানাতে হবে। বিষয়টা শুধু যে রিনচেনকে নিয়ে তা নয়। তবে সন্ধে গড়িয়ে এল।
ফড়িং বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়াতেই রিনচেন বলল, ‘আচ্ছা শোন, তোকে আরও কিছু বলার ছিল।’
‘বলে ফেল চটপট।’
কিন্তু তখনই বেজে উঠল ফড়িঙের মোবাইল, বাড়ি থেকে ফোন করেছে মা। বার বার ‘আসছি আসছি’ শুনে রিনচেন বুঝল সময় ফুরিয়েছে।
‘আজকে যে আমাকে ফিরতে হবে। তোর গল্প আরেকদিন শুনব।’
সময়ের অভাবে সেদিন আর ওদের কথা হল না। ঠিক হল গ্রামের কাউকে বলতেই হবে সব কথা। কিন্তু ঠিক কাকে এসব বলা যায় ভেবে না পেয়ে সেদিন সন্ধেয় বাড়ি ফিরে দিদিকেই রিনচেন বলল তার কথা। আর তাতে যা ফল হওয়ার ছিল তাই ঠিক হল। আর দেরি না করে রিনচেনকে নিয়ে সুমিনা গেল ড. চ্যাটার্জির হাসপাতালে।
***
মহানন্দার ধার ঘেঁষে তৈরি ড. চ্যাটার্জির “বেঙ্গল সেন্টার ফর নিউরো সাইন্সেস” এ ভরতি হওয়া থেকে রোজই রিনচেনেকে যেতে হত কোনও না কোনও পরীক্ষাগারে। মানব মস্তিষ্কের আকারে গড়া বারোতলা ইমারতটিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন লেগো ব্রিক্স জুড়ে জুড়ে বানান। মেডুলা অংশে সামনের দরজা, ঢুকেই একদিকে রিসেপশন, তার পিছনের সেরিবেলামে এমারজেন্সি বিভাগ। রিসেপশনের সামনের দালানে দাঁড়ালে দেখা যায় উপরের তলাগুলি, একটি বারান্দা একতলা থেকে শুরু করে সর্পিল আকারে উঠে গেছে উপরের দিকে। ওকে এই বারান্দা দিয়ে যখন তেতলার ঘর থেকে নামান হত, ওকে ঘিরে জিজ্ঞাসু মানুষের উৎসাহ উপচে পড়ত। ওর কেসটা যে ড্রাগস নিয়ে সেটা কীভাবে যেন প্রচার হয়ে গেছিল। বড় বড় মেশিনে তোলা হত মস্তিকের সাদাকালো, রঙিন সব ছবি। কখনও বা মাথায় লাগান হত অসংখ্য তারের হেলমেট। অনেকে এসে জড়ো হত ছবি দেখতে। ছবি দেখিয়ে ড. চ্যাটার্জি তার ছাত্রদের কত কী-ই না বোঝাতেন। রিনচেন ওদের কথা সব না বুঝলেও এটা আন্দাজ করেছিল যে এত পরীক্ষানিরীক্ষা সত্বেও ওদের অনেক কিছুই অজানা। জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে রংমিত তামসাংও মন দিয়ে শুনত ড. চ্যাটার্জির বক্তব্য। তখন থেকেই সে ও শুধুমাত্র আগ্রহের বশেই জড়িয়ে পড়ল এই কেস এ।
যাদভজি প্রায়ই আসতেন জিজ্ঞাসাবাদ করতে। কখন একা, কখনও বা সঙ্গী নিয়ে। হাসপাতালেই মাটির নিচের একটি অল্প ব্যবহৃত অফিস ঘরে চলত জিজ্ঞাসাবাদ। তবে এত করেও ওরা বিশেষ কিছু উদ্ধার হল না। একদিন উনি ড. চ্যাটার্জিকে বললেন, ‘ইয়ে লেডকা কছু বলছে না। ছোরা বহুত চালাক আছে। সিকিমি ড্রাইভার লোগ ভি একে চেনে না। হামাদের টিম গ্যাংটক গেছিল জানচ্ পরতাল করতে। সেখানেও কছু হাতে আসেনি। হোসাকতা হ্যায় কি ইয়ে মামলা ড্রাগস কা নেহি ভি হো। ইয়াফির কাহি কুছ আউর গড়বড় হ্যায়, জো হামে পাতা নেহি।’
শুনে ড. চ্যাটার্জির কপালে ভাঁজ পড়ল, কারণ উনিও তত দিনে বুঝে গেছিলেন রিনচেনের রক্তে পাওয়া মাদকটি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। একদিনের মধ্যেই শরীরের থেকে মাদক দ্রব্য বের হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই পনেরো দিনে বহু বার রক্ত পরীক্ষা উনি করিয়েছেন। প্রতিবারই পাওয়া গেছে সেই মাদক। কিন্তু ঠিক কীভাবে রয়ে গেছে মাদক সেটা অবশ্য ওঁর কাছে স্পষ্ট নয়।
রোজের মতোই সেদিন বিকেলে সুমিনা কলেজের পর দেখা করতে এল হাসপাতালে। এই বিপদের দিনে একমাত্র সেই রিনচেনকে বিশ্বাস করেছে শর্তহীনভাবে। ড. চ্যাটার্জি তখন যাদভজিকে বিদায় জানিয়ে অফিসে বসে আছেন। দেখা করতে গেলে উনি রিনচেনের সব রিপোর্ট সুমিনাকে দেখালেন, তারপর স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ‘তোমার ভাইয়ের কেস বেশ অদ্ভুত। ওর পলিসেন্সরি হ্যালুসিনেশন যে মাদকটি থেকে হচ্ছে সেটি এখনও রয়েছে ওর রক্তে। মস্তিষ্কের দর্শন কেন্দ্র, শ্রবণ কেন্দ্র, ঘ্রাণ কেন্দ্র এখনও অতিমাত্রায় সক্রিয়। তবে এলাকার কোনও মাদক চক্রের সঙ্গে ওর যোগসাজশ যে নেই সেটা অনেকটাই স্পষ্ট।’
‘আমি জানতাম ডাক্তারবাবু। কখনওই নেশা ভাং করার ছেলে ও নয়। তাহলে কি আমরা ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি ডাক্তারবাবু?’ উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুমিনার মুখ।
‘আমি এখনই সে ব্যাপারে এখনই কিছু বলতে পারছি না। ওকে আরও দেখা দরকার। তা ছাড়াও যাদভজি এখনও ওকে পুরো ক্লিয়ারেন্স দেননি।’
সুমিনা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। তারপর কথাবার্তা শেষ হলে ভাইকে দেখতে গেল তেতলার ঘরে। ঘরে রিনচেন একা খাটে বসে মন দিয়ে কী যেন করছে। পশ্চিমের জানলার পরদা সরানো, ঘরে ঢুকছে বিকেলের নরম আলো। নিঃশব্দে একটু কাছে যেতেই সুমিনা দেখল রিনচেন আঁকছে। তার সামনে রাখা বেড টেবিল, রং পেন্সিলগুলি আশপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। সুমিনার একটু অদ্ভুত লাগল। তার ভাই আঁকতে বসেছে? হাতের কাজে, আঁকায় রিনচেনের কোনওদিনই মতি নেই। স্কুলের বেশির ভাগ আঁকাজোখার কাজ সুমিনাই করে দিয়েছে এতদিন। সে আরও একটু কাছে যেতে রিনচেনের হুঁশ হল। ঘুরে তাকাতেই দিদিকে দেখতে পেল।
‘আরে দিদি তুই, কখন এলি?’
‘এই তো এইমাত্র। তুই মন দিয়ে কাজ করছিস দেখে শব্দ করিনি। কী আঁকছিস এত মন দিয়ে?’
‘ও কিছু না।’ সুমিনা খাতাটা তুলে নিয়ে দেখতে শুরু করল। একই দৃশ্য খাতায় বার বার আঁকা। প্রথম পাতা থেকে শেষ অবধি শুধু একটি সরোবর, বিরাট একটা গাছ, সামনে ফুটেছে অজস্র ফুল। আর দূরে পাহাড়ের গায়ে ঘন বন। রিনচেন কবে বাড়িতে আঁকতে বসেছিল অনেক চেষ্টা করেও সুমিনা মনে করতে পারল না।
কথার ফাঁকে সুমিনা জানাল ড. চ্যাটার্জির সঙ্গে হওয়া তার কথাবার্তা। উনি রিনচেনকে এখনও নির্দোষ মানতে নারাজ। ওদিকে বাড়িতে তাকে নিয়ে মা বাবার চিন্তার শেষ নেই। প্রতিবেশীদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত রংকুপ রাগ করে ঠিকই করে নিয়েছেন ছেলেকে দেখতে আসবেন না হাসপাতালে। কথাগুলো বলতে বলতে চিক চিক করে উঠল সুমিনার চোখের কোণ। দিদিকে দুর্বল দেখে রিনচেন আশ্বাস দেয় ‘তুই বেশি মন খারাপ করিস না দিদি, মনে রাখিস একটা ভুল বোঝাবুঝি কখনওই বেশিদিন স্থায়ী হতে পারে না।’ তার গলায় অদ্ভুত আত্মপ্রত্যয়।
সেদিন কথা বলতে বলতে কখন যে ভিজিটিং আওয়ারস শেষ হয়ে গেছিল খেয়ালই করেনি ওরা। নার্স এসে জানাল সময় শেষ। সুমিনা বাড়িমুখো হল। সঙ্গে রিনচেনও নিচে নামল। হাসপাতালে এসেও রোজ বিকেলে জগিং না করলে ওর চলে না।
ড. চ্যাটার্জি বেশ বুঝতে পারছিলেন ওঁর কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, কিন্তু কীভাবে এই মাদক রিনচেনের রক্তে ঢুকল আর কেনই বা রয়ে গেল তার কিনারা করতে না পেরে ক্রমশই আরও অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। বিভিন্ন ডাক্তারি লাইব্রেরি ঘেঁটে দেখছিলেন সেই অদ্ভুত মাদকটির উল্লেখ কোথাও আছে কি না? কিন্তু রাসায়নিকটির কোথাওই কোনও উল্লেখ উনি পেলেন না। শুধু হাসপাতালের উপর নির্ভর না করে কলকাতার বিভিন্ন পরীক্ষাগারেও নমুনাগুলি পাঠাতে থাকলেন ড. চ্যাটার্জি। যে কোনও নতুন তথ্য এই রহস্য কিনারায় সাহায্য করবে। বেশ কয়েকজন নামকরা চিকিৎসকের সঙ্গেও সমানে চালিয়ে গেলেন কথাবার্তা, বিনিময় হল অগণিত ইমেইল। ডাক্তারবাবুর টেবিল ক্যালেন্ডারের তারিখগুলি একে একে উলটে যেতে থাকল, অসংখ্য পরীক্ষানিরীক্ষার রিপোর্ট জমা হতে হতে টেবিলে রাখা রিনচেনের কেস ফাইলটিও ক্রমশ বেশ মোটা হয়ে উঠল।
***
মাঝে একদিন রংমিত লক্ষ করল বিকেলে জগিং করার পর পরই রিনচেনের হ্যালুশিনেশন বেড়ে যায়। পরীক্ষা করে দেখা গেল রক্তে মাদকটিও পরিমাণে আগের থেকে বেড়ে গেছে। ড. চ্যাটার্জিকে এই নতুন তথ্য শোনাতে তিনি কয়েক মুহূর্ত দাড়ি চুলকে কী যেন ভাবলেন। তারপর স্মিত হাসি হেসে বললেন, ‘গুড জব রংমিত, দারুণ অবজারভেশন তোমার। এখন বেশ বুঝতে পারছি যে ওর শরীরে কোথাও নিশ্চয়ই সঞ্চিত হয়ে আছে ওই পদার্থ, হতে পারে হয়তো ফ্যাটের সঙ্গে। লাইপোফিলিক পদার্থ অনেক সময়ই ফ্যাটের সঙ্গে শরীরে সঞ্চিত থাকে। জগিং এর সময় অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন পড়লে সঞ্চিত ফ্যাট ব্যবহার হচ্ছে, তখন মাদকটি মুক্তি পেয়ে রক্তে মিশে যাচ্ছে রক্তে। তা থেকেই সন্ধেয় ওর হালকা জ্বর আসে আর হ্যালুসিনেশন হয়।’
‘আপনি হয়তো ঠিকই অনুমান করেছেন স্যার। আমারও তাই মনে হয়।’
ড. চ্যাটার্জি ড্রয়ার থেকে রিনচেনের ফাইলটা বার করলেন, দুটো রিপোর্ট বের করে রাখলেন টেবিলে। ‘তোমাকেও একটা নতুন তথ্য আমার বলার আছে। তুমি কি ওর ব্লাড কালচার দেখেছ রংমিত? আমি কলকাতায় সাম্পেল পাঠিয়ে ছিলাম গত সপ্তায়, তার রিপোর্ট এসেছে। বলছে রক্তে ছত্রাকের বীজাণু রয়েছে।’
‘তাইনাকি? ভেরি স্ট্রেঞ্জ। ওর কি কোনও ফাঙ্গাল ইনফেকশন ছিল? এটা কোনও ফাঙ্গাসের স্পোর?’
‘এখানে আসার মাসখানেক আগে রিনচেনের জ্বর হয়েছিল। তখন ডাক্তার ভেবেছিল ওর নিউমোনিয়া হয়েছে। আসলে ওর যেটা হয়েছিল তা হল ওই ছত্রাকের বীজাণুর প্রভাবেই ফুসফুসের একটা ইনফেকশন। ওর ফুসফুসে ছোট্ট একটা দাগ এখনও আছে। ওখানেই রয়ে গেছে বীজাণু। আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম বীজাণুগুলি কোন ছত্রাকের? আকার অবয়ব আমার অচেনা ঠেকায় আমি সেগুলিকে আলাদা করে তাদেরও ডিএনএ পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছিলাম কলকাতায়। সেখান থেকেও এক বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট এসেছে। ওরা বলছে এই ফাঙ্গাল স্পোরগুলিতে যে ডিএনএ পাওয়া গেছে সেগুলো সবই ‘জাঙ্ক’ ডিএনএ। বংশগতির জন্য প্রয়োজনীয় জীন এতে নেই। তাই সেই ফাঙ্গাস অচেনাই থেকে গেছে।’
ড. চ্যাটার্জির কথাগুলো বেশ অদ্ভুত লাগল রংমিতের। দীর্ঘ ডিএনএ অণু জুড়ে জিনগুলি একটার পর সাজান থাকে, পর পর অবস্থিত দুটি জিনের মধ্যেকার অংশ প্রোটিন তৈরির কাজে লাগে না। এগুলিকেই মজা করে ‘জাঙ্ক ডিএনএ’ বলেন বিজ্ঞানীরা। এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছুই ছিল না, কিন্তু রিপোর্টে ওরা বলছে বীজাণুগুলির থেকে পাওয়া সমস্ত ডিএনএ-ই ফাঁকা। রিপোর্টটি তুলে বার বার খুঁটিয়ে পড়ল রংমিত।
‘সে কি? ডিএনএ আছে আর তাতে একটিও জিন নেই? ভারী অদ্ভুত!’
কিন্তু প্রোটিন তৈরি না করলে এই জিনহীন ডিএনএ কাজটাই বা ঠিক কী হতে পারে সে ব্যাপারে ওদের কারোরই কোনও ধারণা তখন ছিল না। আর সেই অমীমাংসিত বিষয়গুলি নিয়ে ওদের দিনগুলো বেশ অস্বস্তিতেই কাটছিল। রিনচেনকে অন্য কোনও বড় হাসপাতালে পাঠান যায় কি না ভেবে দেখছিলেন ডাক্তারবাবু।
***
দিন যায়, রাত কাটে। কিন্তু রিনচেনের অবস্থার কোনও পরিবর্তনই হয় না। ওর হ্যালুসিনেশনের বিবরণ বার বার শুনতে শুনতে একদিন ড. চ্যাটার্জির মনে একটা অনুমান দানা বাঁধে। রংমিতকে কথার ফাঁকে বলেন তাঁর ভাবনা।
‘কি জান রংমিত, রিনচেন বার বারই বলেছে যে দৃশ্য ও দেখে সেগুলি প্রতিবারই একটু একটু করে বদলে যায়। এটা শুনে আমার মনে হয়েছে ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে তার এক একটি সম্ভবনা বা সিনারিও ওর চোখের সামনে ফুটে ওঠে। আসলে ওর হ্যালুসিনেশন একটা সিমুলেশন ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকটা কম্পিউটার সিমুলেশনের মতোই।’
‘ইন্টেরেস্টিং। কিন্তু এর কোন প্রমাণ কি আপনি পেয়েছেন?’
‘প্রমাণ বলা যায় না বটে তবে সিমুলেশনের একটি বৈশিষ্ট্য তার কথাতেই পাই। ও বলেছে যে ওর দেখা ছবিগুলি ঠিক ক্যামেরায় তোলা বাস্তব জগতের ছবির মতো নয়। সেগুলি কার্টুন ছবির মতো দেখতে, আর কম রেসলুশনের। এটা শুনে মনে হয় ও যেন ওর মস্তিষ্ক বাস্তবের এমন এক প্রতিচ্ছবি বানাচ্ছে যা থেকে অনেক কম মেমরি ব্যবহার করে একটা “লো পাওয়ার” সিমুলেশন করা যায়।’
‘কিন্তু মানব মস্তিষ্ক কি পারে এসব করতে? যতদূর জানি এই ধরনের সিমুলেশন করতে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার দরকার পড়ে।’
‘খুবই সংগত প্রশ্ন। আমার মনে হয় ওর মস্তিষ্ক ওই মাদকের প্রভাবেই সিমুলেশন করার ক্ষমতা পেয়েছে। রিপোর্টে বলছে স্নায়ুতন্ত্রের রাসায়নিক বার্তাবাহক নিউরোট্রান্সমিটারগুলি অদ্ভুত রকম ভাবে বেড়ে যায় ওর রক্তে। কী এত চলছে ওর মধ্যে?
এটাও মনে রেখ রংমিত, মানব মস্তিষ্কের ক্ষমতাও কম্পিউটারের থেকে কম কিছু নয়। হ্যাঁ, ওর হয়তো লিমিটেশন কিছু আছে, সেজন্যই পুরো সিমুলেশনটা ওর মস্তিষ্ক ‘লো রেজোল্যুশন’ এ করছে যাতে “মেমরি ওভার ফ্লো” না হয়।’
‘কিন্তু সিমুলেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ডাটা সে কথা থেকে পেল?’
‘ডাটা এসেছে কথা থেকে জানতে চাও? তবে শোন, এই ডাটা জুগিয়েছে ওই বীজানুগুলি।’
‘স্পোরগুলি?! কিন্তু তা কী করে সম্ভব?’ রিনচেন আকাশ থেকে পড়ল।
‘মনে আছে কলকাতা থেকে বীজাণুর ডিএনএ সিকুয়েন্সিং করে ওরা বলেছিল বীজাণুগুলির সবই ডিএনএ-ই “জাঙ্ক” ডিএনএ। এমন ডিএনএ এর কাজই কি যা প্রোটিন সংশ্লেষ করতে পারে না? তবে ডিএনএ অনুতে বেস পেয়ারগুলোর সজ্জা যে খুব এলোমেলো বা র্যানডম নয় তা পরিষ্কার। মেপে দেখলাম ওই সিকুয়েন্সের বেসিয়ান এন্ট্রপির মান বেশ কম, যা একেবারেই সাধারণ ডিএনএ সুলভ নয়। আমার অনুমান এই ডিএনএ আসলে তথ্য বহনকারী ডিএনএ। ডিএনএ ও যে হার্ড ডিস্কের মতোও ডাটা ধরে রাখতে পারে তা তোমার অজানা নয় নিশ্চয়ই।’
‘কিন্তু প্রফেসর আমাদের স্নায়ুতন্ত্র উদ্ভিদের বার্তা কি বুঝতে পারবে? আমরা ওরা একেবারেই আলাদা। ওদের কোনও স্নায়ুতন্ত্রই নেই আসলে।’
‘না রংমিত না। এখানেই তুমি ভুল করছ। আমরা ওদের থেকে আলাদা হলেও দু-দলের মধ্যে মিলও কম কিছু নয়। ভুলে যেও না প্রাণীদেহে পাওয়া কিছু নিউরোট্রান্সমিটার উদ্ভিদদেহেও পাওয়া যায়। সেই কবেই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু দেখিয়েছেন উদ্ভিদের স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া।’
‘ঠিক আছে, সে সব না হয় বুঝলাম। কিন্তু সেই ডিএনএ তে কি ধরনের ডাটা আছে সেসব কি বোঝা গেল?’
‘না তা অবশ্য যায়নি। চেষ্টা করেছিলাম ‘এ-টি’ কে এক আর ‘জি-সি’কে শূন্য ধরে এগোবার। কিন্তু পারিনি। প্রকৃতির দুর্বোধ্য ভাষা বোঝা! সে বড় কঠিন কাজ।’
‘কিন্তু স্যার আপনি যেন অনেক কিছুই এখানে অনুমান করে নিচ্ছেন। কোনওভাবে কি প্রমাণ করা যায় না যে রিনচেনর মস্তিষ্ক সত্যই সিমুলেশন করছে?’
‘একটা উপায় আছে বটে।’
‘কী সেই উপায় স্যার? তাড়াতাড়ি বলুন।’ উপায় আছে শুনে রংমিতের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল।
‘রিনচেনকে এমন কিছু বোঝাতে হবে যাতে সিমুলেশনের প্রাথমিক অবস্থাটাই যাবে বদলে। সিমুলেশন বিশারদরা বলেন যদি কোনও সিমুলেশনের প্রাথমিক অবস্থা বদলান যায়, তবে তার ফলাফলও বদলে যাবে। যেমন ধর যদি ওকে বোঝান যায় যে ও যাদেরকে দেখছে তারা সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে তাহলে আর ওর সাবকন্সাস তাদের কে সিমুলেশনে ধরবেই না। তখন যদি রিনচেন ওদেরকে আর দেখতে না পায় তাহলে বুঝবে ও সত্যিই হয়তো ও যা দেখেছে সেটা একটা সিমুলেশন।’
‘বাহ এটা বেশ ভালো আইডিয়া। কিন্তু কীকরে যে ওকে আমরা বিশ্বাস করাব?’
‘দেখি কী বলা যায়। এমন কিছু বলতে হবে যা বেশ বিশ্বাসযোগ্য।’
পরিকল্পনা মাফিক সেদিন দুপুরেই ডাক্তারবাবু রিনচেনকে বোঝালেন ওদের ক্লাবের সবাইকে গোয়া যেতে হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে। তাই টানা কয়েকমাস ক্লাবে কেউই থাকবে না। ওর দিদিও ওকে একই কথা বলল। ফল মিলতেও বেশি দেরি হল না। বিকেলের শরীরচর্চার পর যখন রিনচেন বিশ্রাম নিতে এল ড. চ্যাটার্জি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভালো করে দেখ রিনচেন তুমি কাকে কাকে দেখছ ছবিগুলোতে?’
‘ক্লাবঘর আগের মতোই ভেঙে পড়েছে। কিন্তু ধ্বসে চাপা পড়ে থাকতে কাউকেই দেখছি না।’
ঠিক এটাই আশা করেছিলেন ড.চ্যাটার্জি। পরীক্ষার ফলাফল দেখে ওরা নিশ্চিত যে রিনচেনের অবচেতন মন ওকে ভবিষ্যৎই সিমুলেট করে দেখাচ্ছে।
***
ওদিকে ফড়িং ভয়ে ভয়ে দিন গোনে, ওর ধারণা কেউ নিশ্চয়ই রিনচেনকে আগামী বিপদ সম্পর্কে সচেতন করতে চাইছে। ও প্রতিদিনই রিনচেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার বিভিন্ন ফন্দি আঁটে। কিন্তু সেসব আর সফল হয় না। একদিন বাড়িতে রিনচেনের কথা জিজ্ঞেস করে মিছে মিছেই বাবার কাছে বকুনি খেল বেচারা। ওর নাম্বারে ফোন ও লাগে না। ওদের বাড়ি যাওয়াও এখন বারণ। আগে ওদের বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকত। নিয়মিত মেয়েরা দুপুরে জড়ো হত কাপড় বুনতে। সন্ধেয় নাচগান হত মাঝে মাঝে। এখন সবই বন্ধ। তারপর একদিন ভেবে চিন্তে রিনচেনের সঙ্গে দেখা করার একটা উপায় বার করল ফড়িং। ওদের বাড়ির সামনে দিয়েই সুমিনা শিলিগুড়ি যায়। সাত সকালে যখন সুমিনা সবে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, প্রতিবেশীদের বক্র দৃষ্টি উপেক্ষা করে ফড়িং এসে তার পথ আটকাল।
‘ক্মের সুমিনা আন্। হাও কায়েত দো?’
‘ক্মের। আমি ভালো রে। তুই কেমন আছিস? আকু আর আনুর খবর ভালো তো?’
‘আমরা সবাই ভালো আছি। রিনচেনের সঙ্গে কথা হয় না অনেকদিন। আজকে আমাকে নিয়ে চল হাসপাতালে।’ হাত দুটো কচলাতে কচলাতে কথাগুলো দ্রুত বলে ফেলল রংমিত। সুমিনা আপত্তি করল না। ফড়িঙকে দেখলে ভাই যে কতটা খুশি হবে সেটা ওর অজানা নয়। সুমিনা ওকে ভাল করে বুঝিয়ে দিল যদি প্রশ্ন ওঠে গোয়ার ট্রেনিং ছেড়ে ও কেন গ্রামেই এখনও রয়েছে তার একটা জুতসই উত্তর যেন সে তৈরি রাখে।
সকাল ন-টা নাগাত ওরা হাসপাতালে পৌঁছল। একমাস পর দুই বন্ধুর দেখা, চোখে চোখ পড়তেই রিনচেনের মুখে ফুটে উঠল অকৃত্রিম হাসি।
‘আরে ফড়িং তুই?’
‘চলেই এলাম রে। কত দিন দেখিনি তোকে।’
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তারা একে অপরকে আলিঙ্গন করল। মনে অনেক কথা জমেছে দুজনেরই। এই একমাস কার কেমন কেটেছে, গ্রামের খবর, ক্লাবের খবর সব কিছুই রিনচেন জানল খুঁটিয়ে। তারপর ফড়িঙের মনে পড়ল সেদিন সন্ধের রিনচেন কী যেন বলতে চেয়েছিল।
‘আচ্ছা তুই সেদিন কী যেন আমাকে বলবি বলেছিলি? সেই যেদিন আমাদের শেষ দেখা হল।’
সেদিনের কথা উঠতেই রিনচেন কেমন যেন গুটিয়ে গেল। অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল ও। তারপর নীচু গলায় বলল, ‘আমি জঙ্গলে গেছিলাম।’
‘কি মুস্কিল ওখানে তো যাওয়া বারণ আছে সবার। তুই গেলি কেন হঠাৎ?’
কথাটা শুনে ফড়িঙ প্রায় লাফিয়ে উঠল। তারপর অভিযোগের সুরে বলল, ‘আমাকেও নিয়ে গেলি না।’ ভাব এমন যেন তাকে নিয়ে না যাওয়াটাই বেশি বড় ভুল হয়েছে রিনচেনের।
‘কি জানিস ভাই। ওই জায়গাটা বার বারই আমাকে টানে। আগেও গেছি ওখানে অনেকবার। কিন্তু এবার গিয়ে একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। ওখানে একটি জলাশয় আছে জানিস। আর তার ধারে রয়েছে একটা বিরাট ওক গাছ। আমি গেলেই ওই গাছের নিচে গিয়ে বসে থাকি। এবার গিয়ে দেখলাম কতরকমের ফুল ফুটেছে ওখানে। খেলাম ছোট ছোট স্ট্রবেরি। ওখানে একটু ঘোরা ঘুরি করার পর গাছের নিচে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। তখনই একটা অদ্ভুত গন্ধ পেলাম। একটা মিস্টি গন্ধ, কিন্তু সেটা কোনও চেনা ফুলের বা ফলের গন্ধ নয়। সেই গন্ধে কেমন যেন ঘোর লাগে। কিছুক্ষণ পর মাথাটা ঝিম ঝিম করতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গেই আশপাশের জগৎ গাঢ় রঙিন হয়ে উঠল। সেই গাছ, সরোবর, দূরের পাহাড় সব কিছুই আপনাআপনিই কাঁপতে শুরু করল। গনগনে আঁচের ওপরে উত্তপ্ত বাতাসের মধ্যে দিয়ে দেখলে জগৎ যেভাবে কাঁপে অনেকটা সেরকম। এমন মায়াময় জগৎ আমি আগে দেখিনি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনেই নেই। স্বপ্নে দেখলাম ওই গাছটা কী যেন আমাকে বলতে চাইছে। কিন্তু সেটা ঠিক কী তা বুঝলাম না। ’
‘এত বড় একটা কথা আজকে বলছিস আমাকে, এতদিন পর।’ ফড়িং বেশ চেঁচিয়েই বলল কথাগুলো।
‘আমি আগেও ভেবেছিলাম তোকে কথাটা বলব। কিন্তু সব কিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল…’
ড. চ্যাটার্জি তখন রাউন্ডে এসেছিলেন। ওঁকেও জানান হল রিনচেনের অভিজ্ঞতার গল্প।
‘সে কি? কই আমাকে তো সে এতদিন এসব কিছুই বলেনি।’
সব শুনে উনি ঠিক করলেন তিনি সেদিনই যাবেন সেই জঙ্গলে, সবাইকে নিয়ে। জানা দরকার শেখানে কি এমন আছে যা রিনচেনকে অসুস্থ করেছে। তখনই ড্রাইভার লক্ষণ থাপাকে ফোন করলেন তৈরি হওয়ার জন্য। ঘড়িতে এখন সাড়ে ন-টা, দেরি করে আর লাভ নেই।
***
গ্রামে তখন মেঘের আড়াল সরিয়ে সোনালি রোদ এসে পড়েছে শান্ত, সবুজ পাহাড়ের গায়। আকাশ আজ পরিষ্কার, ঝিরঝিরে হওয়ায় বৌদ্ধ স্তব নিশানগুলি উড়ছে প্রাণ খুলে। তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিয়েছেন উত্তরে। নিচে গভীর খাতে বয়ে চলেছে রঙ্গীত নদী। তার উচ্ছল স্রোতে আজ সদ্যজাতের সতেজতা।
গ্রামের উপরের সাল, সেগুন, দেবদারুর ঘন জঙ্গল, মধ্যে মধ্যে মাথা উঁচু করে জেগে আছে পাইনের চূড়াগুলি। বিভিন্ন অর্কিড, ফার্ন ও অন্যান্য লতানে গাছের অলংকারে সেজেছে গাছের গুঁড়ি আর ডালপালা। সেই আঁকাবাঁকা, খাড়াই পথের রেখা বেয়ে শুরু হল চড়াই। সরু পথে দুজন মানুষও পাশাপাশি চলতে পারে না। পথের রেখা এতটাই অস্পষ্ট যে রিনচেন আগে গিয়ে দিকনির্দেশ না করলে ওদের কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিল না সে পথ চেনার। একটু উপরের উঠে ওরা পেল রডোডেনড্রন বন। তার লাল ফুলের শোভা সুন্দরী অর্কিডগুলিকেও হার মানায়। উঠতে উঠতে এক জায়গায় পাহাড়ের ঢাল যেখানে শেষ হয়েছে ঘন বনও সেখানেই থেমে গেছে। তারপর উঁচুনীচু ঘাস জমি। ড. চ্যাটার্জি লক্ষ করলেন সেখানকার কয়েকটি বড় বড় গাছের গুঁড়ি হেলে গেছে। কপালে ভাঁজ পড়ল ওঁর। বললেন, ‘এই গাছগুলি দেখ তোমরা। এগুলির গুঁড়ি এভাবে হেলে যাওয়ার কারণ আছে। যে জমিতে এরা দাঁড়িয়ে তা হয়তো ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। তাতেই গাছেরা ভারসাম্য হারাচ্ছে। গাছেরা জমির এই সরণ সহজেই বুঝতে পারে, আর সময় থাকতে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু এই গুঁড়িগুলি যেভাবে কাত হয়ে আছে তাতে মনে হয় বেশ দ্রুতই জমি সরে যাচ্ছে। এই লক্ষণ একেবারেই ভালো নয়’
ফড়িং জিজ্ঞেস করল, ‘কেন ডাক্তারবাবু? কী হতে পারে এর ফলে?’
‘খুব তাড়াতাড়ি এভাবে মাটি সরে গেলে ধ্বসও নামতে পারে।’
ফড়িং আর রিনচেন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
জঙ্গল পেরিয়ে উপরে উঠতেই ঘাস জমিতে ওরা দেখল রংবেরঙের নানান বনফুল ফুটেছে, ফলেছে ছোট ছোট ফল, কোথাও কোথাও মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে রয়েছে পাথর। ফুলের সেই কার্পেটের মধ্যে দিয়ে, একটি অস্পষ্ট পথের রেখা ধরে আরও কিছুক্ষণ চলার পর ওরা এসে দাঁড়াল একটি জলাশয়ের ধারে। চলতে চলতে রিনচেন বলে চলল তার আগের বারের অভিজ্ঞতা। কোন পথে সে এসেছিল, কী কী দেখেছিল, কোথায় সে বিশ্রাম নিয়ে ছিল প্রভৃতি। ড. চ্যাটার্জি সমস্ত রকম খুঁটিনাটি লিখে নিলেন ওঁর নোট বইতে। জলাশয়ের একদিকে রয়েছে একটি সুবিশাল ওক গাছ। এই জায়গাটিকেই রিনচেন বার বার আঁকে ওর খাতায়। গাছগুলির চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে শেওলা ঢাকা বড় বড় পাথরের চাঙড়। মাটিতে পড়ে ওই গাছেরই কতগুলি পুরোনো ডাল, তার ভিজে কাঠের গায়ে ফুটেছে সাদা-রঙ্গিন অনেক ধরনের ছত্রাক। ড. চ্যাটার্জি রিনচেনের থেকে বিষদে জানতে চাইলেন কোন গাছের স্ট্রবেরি সে খেয়ে ছিল, ঠিক কোথায় সে সেই অদ্ভুত গন্ধ পেয়েছিল ইত্যাদি। খুঁজে খুঁজে উনি অনেক কিছুই নিয়ে নিলেন নিজের সংগ্রহে। তবে সেদিন কিন্তু ওরা কেউই কোনও গন্ধ পেল না। ড. চ্যাটার্জি আরও লক্ষ করলেন সরোবরের অন্য পাড়ে খাড়া পাহাড়ের গায়ে দেখা যাচ্ছে জলের দাগ। বুঝতে অসুবিধে হয় না ওই দাগ অবধিই আগে জল ছিল।
এতটা এসে সবারই বেশ ক্লান্ত লাগছিল। ওরা সবাই মিলে সেই ওক গাছের নিচে বসল বিশ্রাম করতে। কিছুক্ষণ কাটতেই বোঝা গেল জায়গাটিতে কেমন যেন গা ছমছমে, অস্বস্তিকর ভাব। সবারই অল্প অল্প মাথা ঘুরছে, শরীর আনচান করছে। কথাবার্তা তখন কমই হচ্ছিল, হঠাৎই রিনচেন কানে এল ক্ষীণ শব্দ।
‘ডাক্তারবাবু! আমি কী যেন শুনতে পাচ্ছি।’
‘কী শুনছ তুমি রিনচেন?’
‘মড় মড় শব্দ। কিন্তু খুব ধীরে। ঠিক বলতে পারব না কীসের এই শব্দ।’
ড. চ্যাটার্জি কী যেন ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঠিক কোনদিক থেকে এই শব্দ আসছে বুঝতে পারছ কি? একবার মাটিতে কান পেতে শোন তো ঠিক এই শব্দটিই কি না?’
রিনচেন তাই করল।
‘হ্যাঁ ডাক্তারবাবু। আমি মাটিতে কান পাতলেই শব্দ আরও স্পষ্ট হচ্ছে।’
‘ভেরি ইন্টারেস্টিং ইনডিড।’
ড. চ্যাটার্জির ধারণা রিনচেনের শোনা সেই শব্দ ইনফ্রাসাউন্ড হতে পারে। সবাইকার মনে যে গা ছমছমে, অস্বস্তিকর যে ভাবটা সেটা ইনফ্রাসাউন্ডের প্রভাবেই হওয়াটা বিচিত্র নয়। অনেক ক্ষেত্রে এই ধরনের শব্দ মাটির নিচে ফাটল ধরার সময় বের হয়। একথা ঠিক যে ওই শব্দের কম্পাঙ্ক এতটাই কম হয় যে কোনও মানুষের পক্ষেই তা শোনা সম্ভব নয়। কিন্তু রিনচেনের মস্তিষ্ক এখন ভীষণ সক্রিয়। অদ্ভুত অনেক কিছুই সে অনুভব করছে যা বাকিরা পারে না।
ড. চ্যাটার্জির ইচ্ছে ছিল ওখানে আরও কিছুক্ষণ কাটানোর, কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। দুপুর গড়িয়েছে, সূর্য ঢেকে গেছে মেঘে। পাহাড়ি আবহাওয়া এবার খারাপ হতে চলেছে।
‘আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা ঠিক নয়। চল এবার ফেরা যাক।’
ফেরার পথে জঙ্গলে দেখা গেল এক জায়গায় পাথরের গায় ফাটল তৈরি হয়েছে। আর সেই দিয়ে চুইয়ে পড়ছে কয়েকটি ছোট ছোট জল ধারা। রিনচেনকে জিজ্ঞেস করাতে সে জানাল আগেরবার এসে এগুলি দেখেনি। এগুলি তৈরি হয়েছে এই দু-একমাসের মধ্যেই। পাহাড়ে অনেক সময়ই বর্ষায় এরকম হয় তাই এতে আশ্চর্য হওয়ার তেমন কিছুই ছিল না। তবে সরবরের জল কমে গেছে দেখে ড. চ্যাটার্জির সন্দেহ হল হয়তো সেই জল মাটির ভিতরের ফাটল দিয়ে এসে এখানে এসে মুক্তি পেয়েছে। তেমনটা হলে অবশ্য চিন্তার কারণ আছে। হয়তো জলের চাপে ফাটল তৈরি হয়েছে। ফাটল তৈরি হওয়ার শব্দই হয়তো রিনচেন শুনেছে।
শিলিগুড়ি ফেরার সময় লক্ষণ থাপা দেখল পথে সারাক্ষণই তিনি অন্যমনস্ক। খাতা খুলে বার বার পড়ছেন সকাল থেকে নেওয়া নোট। সারাদিনের ঘটনা তাকে যথেষ্টই বিচলিত করেছে। সরবরের জল যদি পাথরের ফাটল দিয়ে চাপে বেরতে থাকে তাহলে এই ফাটল ক্রমশ বাড়তে থাকবে আর একসময় নামবে ধ্বস। বড় বড় বাঁধ অনেক সময় এভাবে ভাঙে।
***
পরদিন সকাল সকাল ডাক্তারবাবু হাসপাতালে জেতেই রংমিত ঘরে এসে হাজির। চোখেমুখে উৎসুক ভাব, মনে অনেক প্রশ্ন। তখন ড. চ্যাটার্জির একটি মাইক্রোস্কোপের নিচে কী যেন খুব মন দিয়ে দেখছেন। আশপাশে ছড়িয়ে রয়েছে গতকালের সংগৃহীত নমুনাগুলি।
‘গুড মর্নিং স্যার। কাল তো আপনি বেশ ভালোই অ্যাডভেঞ্চার করে এলেন। কেমন লাগল রিনচেনদের গ্রাম?’ তাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি, তাই গলায় খানিকটা অভিযোগ নিয়েই যেন কথাগুলো বলল রংমিত। ডাক্তারবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, ‘অ্যাডভেঞ্চার করতে আমি যাইনি রংমিত। গেছিলাম সেই জায়গাটা দেখতে যেটা রিনচেন বার বার খাতায় আঁকে। গেছিলাম দেখতে সেখানে কী এমন আছে যা রিনচেনকে অসুস্থ করেছে।’
‘তা কী দেখলেন?’
ড. চ্যাটার্জির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দেখলাম প্রলয়ের পূর্বাভাস। যা দেখলাম তাতে মনে হল রিনচেন এতদিন ধরে আমাকে যা বলতে চাইছে, হয়তো কোনওদিন তা সত্যি হতে চলেছে। ওখানকার মাটি, বিভিন্ন গাছগাছালি ইত্যাদি সংগ্রহ করে এনেছিলাম। সেসবই দেখছি এখন। রিনচেনের রক্তে পাওয়া স্পোরগুলো রয়েছে এখানে।’
সেই রহস্যময় ডিএনএযুক্ত বীজাণু ওখানকার মাটিতেই পাওয়া গেছে শুনে রংমিত খুশি হল। ‘যাক স্পোরগুলো পাওয়া গেছে ভালোই হল। কিন্তু সেটা কোন ফাঙ্গাসের সেটা কি বোঝা গেল?’
‘মাটিতে মাইকরিজা জাতীয় ফাঙ্গাসই বেশি পেয়েছি ওখানে। তা ছাড়াও আরও কয়েক প্রজাতির ফাঙ্গাস সেখানে রয়েছে। এই স্পোর যে কারোরই হতে পারে।’
‘আচ্ছা স্যার, আমি এখন ও বুঝতে পারলাম না রিনচেন কীভাবে পেল এই পূর্বাভাস?’
‘ওই জায়গার গাছ যে মাটির সরণ বুঝেছে সেটা আমি দেখেছি। গাছের মূল সহজেই বুঝে নেয় এই সরণ। বিজ্ঞানীরা বলেন জঙ্গলে গাছেদেরও নাকি আলাদা সমাজ আছে। বনের প্রতিটি গাছকে মাইকরিজা ছত্রাকের সুবিস্তৃত মাইসেলিয়াম জালের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। অনেকটা যেন ইন্টারনেটের মতোই। পরিবেশবিদেরা নাম রেখেছেন “উড ওয়াইড ওয়েব”। এর সাহায্যেই তারা বিভিন্ন খাদ্যবস্তু, তথ্য আদানপ্রদান করে, এমনকী বিপদ বুঝলে প্রতিবেশী গাছেদেরও তা জানায়। আমি নিশ্চিত যে এ ক্ষেত্রেও তেমনই কিছু হয়েছে। ওই গাছ আর তাদের বন্ধু ছত্রাক গোষ্ঠীই মাটির নিচে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন পরিবর্তন বুঝেছে আর রিনচেনকে তা জানিয়েছে তাদের তৈরি সেই অদ্ভুত বীজাণু আর মাদকের সাহায্যে। রিনচেন যে মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিল তাতেই ছিল ওর রক্তে পাওয়া হ্যালুসিনোজেনিক মাদক আর ছত্রাকের বীজাণু। মাদক তার মস্তিষ্ককে সিমুলেশনের ক্ষমতা দিয়েছে, বুঝতে শিখিয়েছে সেই বীজাণুর বার্তা। গাছেরা মাটির নিচ থেকে সেসব উপাদান সংগ্রহ করে জাইলেম কলা দিয়ে তুলে এনেছে পাতায়, আর তারপর পরিবেশে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায়।
‘বুঝলাম। কিন্তু স্যার আপনারা যেদিন ওখানে গেলেন আপনারা কেন পেলে না এই গন্ধ? এমনতো নয় যে তখন ট্রান্সপিরেশন বন্ধ হয়ে গেছিল।’
‘প্রস্বেদন বন্ধ না হলেও তার হার কিন্তু সময় সময় বদলায়। যে কোনও কারণেই হোক তখন সেটা কম হচ্ছিল। হয়তো মাটির নিচে থেকে উপাদানগুলির জোগান কমে গেছিল।’
একটু থামলেন ড. চ্যাটার্জি। দু-ঢোক জল খেলেন। তারপর জানলার দিকে তাকিয়ে কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘তবে কি জান রংমিত? সমস্যা একটাই। রিনচেন এটা বলতে পারে না যে এই বিপর্যয় ঠিক কবে হতে চলেছে। আজও হতে পারে আবার অনেক পরেও কোনও দিনও হতে পারে। তাই শুধু ওর কথায় মানুষজনকে সরে যেতে বলাটা অমূলক হবে। তবে সবাইকে সাবধান যে করতে হবে সে কথা ঠিক।’
কথা বলতে বলতে ওরা খেয়ালই করেননি রেডিয়োতে খবর পড়া শুরু হয়ে গেছে। ড. চ্যাটার্জির রোজ অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর খবর শোনা অভ্যাস, তড়িঘড়ি করে যখন অনলাইনে পডকাস্ট চালালেন তখন সাড়ে সাতটার খবর শেষের দিকে।
‘…আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকে বিশেষ সতর্ক বার্তায় জানান হয়েছে বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত নিম্নচাপ এক বিরাট ঘূর্ণাবর্তের আকার ধারণ করেছে। এরই প্রভাবে আগামীদিনে উপকূলবর্তী এলাকায় ঘণ্টায় ১৫০ কিমি বেগে ঝড় ওর সঙ্গে প্রবল বৃষ্টির সম্ভাবনা। মনে করা হচ্ছে এর প্রভাবে শুধু গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গেই নয়, উত্তর বঙ্গেও আগামী পাঁচ-সাত দিন টানা বৃষ্টি হবে’
ডাক্তারবাবু চিন্তায় পড়লেন। নিম্নচাপের এক টানা বৃষ্টি আবার পাহাড়ে নানা সমস্যা ডেকে আনে।
***
শুরু হল আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন। সংবর্ত মেঘের আড়ালে পাকাপাকিভাবেই আশ্রয় নিলেন সূর্যদেব। বৃষ্টি প্রথমটা থেমে থেমে হলেও শেষে এমন হল যে কখন শুরু হচ্ছে আর কখন শেষ সেটা আর আলাদা করে বোঝা যেত না। কখন কখন জানলা দিয়ে শঙ্কিত দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখতেন ড.চ্যাটার্জি। ভাবতেন বন্ধুমহলে কাউকে কাউকে জানাবেন তাঁর কথা, কিন্তু ঠিক কীভাবে যে বলা যায়? কে-ই বা বিশ্বাস করবে তার কথা?
ঠিক একদিন পর মেরংসি গ্রাম সম্পূর্ণভাবে ঢেকে গেল পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসা ঘন কুয়াশায়। অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ সে কুয়াশায়। ঠিক যেমনটা রিনচেন পেয়েছিল। গুমোট আবহাওয়ায় ভারী সেই কুয়াশা গ্রাম থেকে সরতেই চায় না। বেশ কয়েকজন অধিবাসী অসুস্থ হয়ে পড়ল। অদ্ভুত লক্ষণ নিয়ে তারা ভরতি হল শিলিগুড়ি জেনেরাল হসপিটালে। ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষগুলির চোখের সামনে মাঝে মাঝেই ফুটে উঠছে বিক্ষিপ্ত বিনাশ দৃশ্য। ড. চ্যাটার্জি খবর পেয়ে রংমিত কে নিয়ে ছুটে গেলেন সেখানে। একসঙ্গে আট-দশজনের একই রোগ। এক রোগী জানাল, ‘কাল অবধি ভালোই ছিলাম ডাক্তারবাবু। আজকে সকালে গ্রামে কুয়াশা নামার পর থেকেই শুরু হয়েছে কাশি। কাশতে গিয়ে দেখছি ভয়ংকর সব দৃশ্য। মাত্র কয়েক সেকেন্ডর জন্য। তারপর আবার মিলিয়ে যাচ্ছে সেসব। মনে সারাক্ষণ উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা। কী যে হল আমার?’ দৃশ্যের বর্ণনা শুনেই ডাক্তারবাবু বুঝলেন এর সঙ্গে রিনচেন হ্যালুসিনেশনের মিল আছে। যদিও এরা কেউই ফোনে বা অন্য কোনও ছবিতে এসব দেখছে না। আর এদের হ্যালুসিনেশনে রিনচেনের মতো বিস্তারিতও নয়। কয়েকজনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে ওরা দুজনে ফিরে এল। দেখা গেল ওদের রক্তেও রয়েছে সেই ছত্রাকের বীজানু রয়েছে যা রিনচেনের রক্তে আগেই পাওয়া গেছে।
‘কী বুঝছেন স্যার?’
‘কুয়াশার সঙ্গে নেমেছে সেই বীজাণু নেমে এসেছে বন থেকে। বুঝতে পারছ রংমিত? গাছেরা প্রস্বেদন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মরিয়া হয়ে এবার ওরা সাবধানবাণী ‘সম্প্রচার’ করছে এইভাবে। ধ্বস এবার নামল বলে।’
‘কী করা যায় এখন?’
কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিলেন ড. চ্যাটার্জি। তখনই দরজায় টোকা পড়ল। বাইরে রিনচেনের দাঁড়িয়ে।
‘ভিতরে আসতে পারি ডাক্তারবাবু?’
‘এস এস রিনচেন, ভেতরে এস। বল কী হয়েছে? কোনও জরুরি দরকার?’
‘হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু। কিন্তু ঠিক কোথা থেকে যে শুরু করি? আসলে আমি আপনাকে এতদিন বলে এসেছি যে আমি ছবি আর ভিডিয়োগুলিতে কখনই তারিখ দেখতে পাই না।’
‘হ্যাঁ, সে কথা আমার ভালোই মনে আছে।’
‘এবার কিন্তু স্পষ্টই তারিখ দেখলাম ছবিগুলিতে। দেখলাম ২০ মে ২০৩০।’
‘সে কি! সে তো আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। তুমি ঠিক দেখেছ তো?’
‘হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু। আমি ঠিকই দেখেছি। আমার ধারণা ওটাই বিপর্যয়ের দিন।’
এসব শুনে উনি ব্যস্তভাবে পায়চারি শুরু করে দিলেন। বুঝলেন এতদিন যে রিনচেন তারিখ দেখতে পেত না, তার কারণ ধ্বস নামার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেলেও তার মূল কারণ বা ট্রিগার, এই অতিবৃষ্টি এখন শুরু হতে চলেছে তাই এখন সময় নির্ধারণ করাও সম্ভব হয়েছে।
ড. চ্যাটার্জি স্থির করলেন ওঁর করণীয়। দেখা করলেন বন্ধু বরুন রায়ের সঙ্গে। উনি একজন পদস্থ আমলা। এই মুহূর্তে সব কিছু বুঝিয়ে বলতে গেলে বিপরীত ফল হতে পারে। শুধু আবহাওয়ার অবস্থা উল্লেখ করে শুধু বললেন মেরংসি গ্রাম খালি করতে হবে। উনি নিজে দেখেছেন গ্রামের উপরের দিকে মাটি আলগা হয়ে গেছে, জমিতে ফাটল ধরেছে। বৃষ্টিতে ধ্বস নামার সম্ভাবনা প্রবল। তাতেই কাজ হল। গ্রামে এল বড় বড় ট্রাক, বাস, দমকল। নামল সামরিক বাহিনী। গ্রামের মানুষজনকে স্থানান্তরিত করা হল অন্যত্র। সেদিনই মাত্র দু-দিনের টানা বৃষ্টির পর গভীর রাতে ধ্বস নামল। সেবার অনেক মানুষের প্রাণ রক্ষা করা গেলেও গ্রামটিকে বাঁচান যায়নি। উপরের জঙ্গলও অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছিল।
পরদিন সকালে খবর পেয়ে উনি আরও একবার গেলেন গ্রামে। অকুস্থলে তখন বৃষ্টি ধরে এসেছে। দূর থেকে দেখলেন উপরের জঙ্গল আর গ্রামের বুক চিরে নেমেছে ধ্বস। নদীর স্রোতের মতোই মাটি আর পাথরের ধারা উপড়ে নিয়েছে বড় বড় গাছ, গ্রামের ঘরবাড়ি। প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ছবির মতো সুন্দর বসতিটি। ধ্বংসাবশেষ জমা হয়েছে নদীখাতে।
তখন সবে শুরু হচ্ছে উদ্ধার কাজ। সঙ্গের মিলিটারি গার্ডদের নিষেধ উপেক্ষা করেও উনি কাছে গিয়ে সরজমিনে ঘুরে দেখলেন অবশিষ্ট বাড়িগুলি। ক্লাবঘরটি এমনভাবে মুছে গেছে পাহাড়ের বুক থেকে যেন সেটি কোনওদিন ছিলই না ওখানে। রিনচেনদের বাড়িটির অবস্থাও তথৈবচ। শুধু কীভাবে যেন বহু পুরোনো বৌদ্ধস্তূপটি এত কিছু সয়েও দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে ড চ্যাটার্জি হাতে তুলে নিলেন মাটি চাপা পড়া একটি পতাকা। যত্ন করে রেখে দিলেন বুক পকেটে। ওপরে জঙ্গলের দিকে তাকালেন আরেকবার। মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করলেন তাদেরকে রক্ষা করতে না পারার জন্য। ক্ষমাও চাইলেন মূক বনস্পতিকুলের কাছে।
ঘটনার পর রিনচেনের হ্যালুসিনেশন আর হয়নি, রক্তে পাওয়া মাদকটি আর বীজাণুগুলিও রহস্যজনকভাবেই শরীর থেকে বেরিয়ে গেছিল। তাও কখনও কখনও ড. চ্যাটার্জি তাকে ডেকে পাঠাতেন চেক আপ করতে। মাঝে মাঝেই খুলে দেখতেন ডাক্তারি রিপোর্টগুলি। অনেক প্রশ্নের না পাওয়া উত্তর তিনি খুঁজতেন। চেষ্টা করতেন পড়তে সেই ডিএনএ সিকুয়েন্সের অবোধ্য বার্তা। রিনচেনের আঁকার খাতাটিও রাখতেন হাতের কাছেই। ওর আঁকাগুলি দেখে বোঝা যায় সে সরোবরের প্রকৃতিকে কতটা ভালোবেসেছিল। কেউ কেউ বলেন অনেক ধরনের উদ্ভিদই নাকি শব্দ শুনতে পায়। সরবরের পাশের উদ্ভিদকুল আর মাটির নিচের ছত্রাকের জগৎ কি বুঝত রিনচেনের উপস্থিতি? তারা কি চিনত তার পায়ের শব্দ? ওরাও কি রিনচেনকে ভালোবেসেছিল?
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, প্রদীপ্ত সাহা, রনিন