অযান্ত্রিক
লেখক: রনিন
শিল্পী: রনিন
অন্ধকার রাতে কেউ নেই পথে। মশালগুলো হাওয়ার সঙ্গে যুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই। আগুনের শিখাগুলো ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়ার দাপটে বিদ্রোহী চাষীদের মতন কাঁধ নুইঁয়ে অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কুকুরগুলো কোনও এক কোনে গলা মিলিয়ে কান্না জুড়েছে। একাকী পথে কাঁপতে কাঁপতে পথ চলেছে মাঝবয়েসী ইয়াসোনাস। বাপ-মা ভেবেছিল ছেলে বড় হয়ে বৈদ্য হবে, মানুষের প্রাণ বাঁচাবে। কিন্তু ছেলে বড় হয়ে বদমেজাজি কুস্তিগির হয়ে উঠেছে। সঙ্গে মাতলামি আর জুয়া খেলার গুনটা জুটেছে ফাউ-এর মতন। জন্মের নামটা তাই সে ভুলেই গেছে। এখন সকলের চোখে সে ‘মিনোস’-ষণ্ড। অনেকে অবশ্য ওর নামের আগে একটা ‘পা’ যোগ করে গোপনে হাসাহাসি করে থাকে। তবে ইয়াসোনাস তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাত না। কিন্তু আজ ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
ইতিমধ্যেই কাঁপতে কাঁপতে ইয়াসোনাস মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আজও তার আগুনে চোখ দুটো রক্তরাঙা, তবে আক্রোশে নয়। অশ্রুতে। হাত তার আজও মুষ্টিবদ্ধ, তবে লড়াই করার ইচ্ছেয় নয়। হৃদয়ের ভাঙচুরকে আটকাতে। সে মাথা উঁচু করে দেখল শ্বেত-মর্মরে মোড়া অভাবনীয় স্থাপত্যকে। সে নাস্তিক। ঈশ্বর তার উপহাসের পাত্র ছিলেন এতদিন। ভগবানের দেউল তার পরিহাসের বিষয় ছিল। সেখানে দলবেঁধে পুজোর অর্ঘ্য সাজিয়ে ভিড় করত যে মানুষগুলো তাদেরকে বিদ্রূপ করে মজা পেত সে। আজ সেই মানুষটা নিজেই মাথা নীচু করে ঈশ্বরের ঘরে এসেছে হৃদয় ভরা আকুতি নিয়ে। এসেছে হারের মুকুট দেবতার পায়ে উৎসর্গ করবে বলেই। সিঁড়িগুলো পেরিয়ে তাই সে চলেছে খালি পায়ে।
কিন্তু মন্দিরের দরজা তো বন্ধ! এবার তবে উপায়? ইয়াসোনাস একটা উদ্গত কান্নাকে গিলে নিয়ে গলায় ঝোলানো বস্ত্রখন্ডে চোখ মুছল। দরজার সামনে যে উঁচু ধাতুর পাত্রে কাঠ-কুটো জ্বালা ছিল সেখানে এখন শুধুই ছাই। লোকটা কাপড়ের কোঁচড় খুলে অল্প কিছু কাঠ আর ধুনো রাখল ওই পাত্রে। তারপর দেয়ালে জ্বলতে থাকা মশাল দিয়ে আগুন ধরাল জ্বালানিতে। অল্প সময়ের মধ্যেই জায়গাটা ভরে উঠল সুগন্ধি ধূমে। আহুতি। ঈশ্বর দর্শনের প্রাথমিক শর্ত। সেটুকু সমাপন করে সে অপেক্ষা করল।
ঘড়-ঘড়-ঘড়-
ইয়াসোনাস রুদ্ধবাক। যে দেবতাকে সে এতদিন সরব অপমানে বিদ্ধ করেছে আজ সেই তিনিই দরজা খুলে কাছে ডাকছেন তাকে? সে সুবিশাল দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে প্রবেশ করল গর্ভগৃহে। ভয় আর শ্রদ্ধায় অবশ হয়ে গিয়েছিল মাঝবয়েসী লোকটার অন্তর। কি উঁচু উঁচু খিলান। কি ব্যাপ্তি প্রতিটা কক্ষের! কি ভয়াল সৌন্দর্য প্রতিটা দেবমূর্তির! সে ঘরের শেষ প্রান্তে চোখ রাখল। ওই তো ‘তিনি’! জিউস! দেবতাদের দেবতা! পাঁচ-মানুষ উচ্চতা মূর্তিটার। চোখের মনি থেকে ঠিকরে পড়ছে ক্ষোভ আর আক্রোশের আগুন, হাতের মুঠোয় বন্দি বিদ্যুতের ফলকটা যেন এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে আগন্তুকের মাথায়, অভিশাপ হয়ে। ইয়াসোনাস মাথা নীচু করে এগিয়ে গেল। তার ক্ষুদ্র ছায়াখানা দেয়ালে দেয়ালে মশালের নিবু নিবু আলোয় কাঁপতে কাঁপতে এগোল তারই পা’য়ে পা মিলিয়ে। নীরব নিথর দেবমূর্তিগুলো চেয়ে রইল তারই গমনপথের দিকে নির্বাক দৃষ্টি মেলে। ওদিকে মন্দিরের ছাদ থেকে ভেসে এল বজ্রবিদ্যুতের ক্ষীণ নির্ঘোষ। ইয়াসোনাস থমকে দাঁড়াল।
“হে ঈশ্বর, সব হারিয়েছি। ঘর বাড়ি আত্মীয় পরিজন মান সম্মান— কিচ্ছুটি নেই আর। চেনাশোনা মানুষগুলো আমার মুখ দেখতে চায় না আর। যাদের বন্ধু বলে জানতাম, তারা আজ আমায় নিয়ে উপহাস করে। তুমি তো সবই জানো, প্ৰভু…”
গলাটা বুজে এল তার। কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। কান্নার আবেগে কাঁপছে শরীর। বিষণ্ণতার এমন ভার যে বলিষ্ঠ মানুষটা মেঝেতে বসে পড়ল।
“এতদিন তোমায় মানিনি, তোমাকে নিয়ে পরিহাস করেছি। আসলে আমি আজ পর্যন্ত কোনও ভালো কাজই করিনি। একটা মানুষের মুখেও এক ফোটা হাসি পর্যন্ত এনে দিতে পারিনি প্রভু…” হাতের তালুতে চোখ মুছে ইয়াসোনাস আবার তার প্রার্থনা জারি রাখল, “বৌ পালিয়েছে বন্ধুর হাত ধরে, মেয়েটা পালিয়েছে বৌয়ের হাত ধরে। পাওনাদার এসে কেড়ে নিয়েছে সমস্ত সম্বল। পথে ঘাটে বেরোলেই লোকে পাথর ছোঁড়ে আমায়। ‘পাগল ষাঁড়’ বলে অপমান করে। এরপর আর বেঁচে থেকে কি লাভ, প্রভু? তুমি একটিবার শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, শুধু একবার আমাকে জীবনের পথটুকু নিজের হাতে দেখিয়ে দাও। উত্তর দাও প্রভু, আমি কি তবে এই নগন্য জীবনটাকে পুরোনো পোশাকের মতন ঝেড়ে ফেলে আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করব? বলে দাও ভগবান, বলে দাও—”
ঈশ্বর নির্বাক। কেন? ইয়াসোনাস আগে শুনেছিল, এই মন্দির থেকে ভক্তকূল কোনও দিন ফেরেনি খালি হাতে। তাহলে গন্ডগোলটা কোথায়? নাকি তার পাপের ভারা এতটাই ভরতি যে ‘তিনি’ তাকে দেখেও দেখছেন না? শুনেও শুনছেন না তার আর্তি? তখনই ধাতুর চোঙাটা নজরে পড়ল তার। ‘দানপাত্র’। ঈশ্বরের মুখ খোলবার একমাত্র উপায়। ইয়াসোনাস কোঁচড় থেকে একটা মুদ্রা বার করল। মায়া জড়ানো চোখে দেখল সেটাকে। শেষ সম্বল। জুয়ায় সব হারাবার পর বিজয়ী লোকটা চরম হেলায় তার দিকে ছুড়ে দিয়েছিল এবড়খেবড় ধাতুর বলয়টা। অনুকম্পা অথবা অপমান। সেটুকুই আজ ইয়াসোনাসের জীবনের শেষ বাজি।
থনাট—
মুদ্রাটা চোঙার পেটে মিলিয়ে গেল শব্দ করে।
একটা গর্জন ভেসে এল তক্ষুনি। মন্দিরের ছাদ থেকে। জিউসের মুখটা যেখানে আধো-অন্ধকারে ঢাকা সেখান থেকে এল মেঘের ডাকের শব্দ। উত্তর-হ্যাঁ। ইয়াসোনাস উঠে দাঁড়াল। শরীরে তার শিহরণ। দেবতার দেবতা উত্তর দিয়েছেন। আজ আবার সবকিছুর শেষে নতুন জীবনের খোঁজে পথে নামতে হবে তাকে। শুরুর আগে সমাপ্তি ঘোষণা করতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে আলেক্সান্দ্রিয়ার আঁধার মোড়া রাজপথে হারিয়ে গেল ইয়াসোনাসের চেহারাটা।
তিন দিন পরেই মাঝ সমুদ্রে মেছুড়েদের জালে একগাদা সার্ডিন মাছের মধ্যে পাওয়া গেল অর্ধনগ্ন শক্তপোক্ত মানুষটার শরীর। চোখ খুবলে নিয়েছে মাছেরা, আঙুলগুলো নেই আর, কিন্তু লোকটার ঠোঁটের কোন লেগে থাকা অপার্থিব হাসিটা কেউ মুছে দিতে পারেনি। লোকটার মুখ দেখে জেলেরা মাথা নাড়াচ্ছিল। অমঙ্গলের সূচক। মৃতদেহ তাই নৌকায় তোলা বারণ। ওরা শরীরটাকে আবার ছুড়ে ফেলল সমুদ্রে।
ইয়াসোনাস নামের লোকটার গল্প এভাবেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য। তবে একটাই স্বান্ত্বনা। মরার আগে তার সঙ্গে অন্তত খোদ সৃষ্টিকর্তার দেখা হয়েছিল একবারের জন্য হলেও। যে উত্তরটা সে খুঁজেছিল সে উত্তরটা সঙ্গে নিয়েই সে নিজেকে সঁপেছিল অতল সমুদ্রে। কিন্তু একমাত্র ঈশ্বরই বোধহয় জানেন, যে স্বান্ত্বনা বুকে নিয়ে মাঝবয়সি লোকটা সম্মুদ্রের গর্ভে শান্তি খুঁজতে বেরিয়েছিল, তার পিছনে ঠিক কতটা মিথ্যার ছলনা লুকিয়ে ছিল।
দুই
দৃপ্ত সূর্য। কচি আঙ্গুরলতার ঝোপগুলোকে এলেমেলো করে দিয়ে ভিজে দামাল বাতাস চিরুনি চালিয়ে যাচ্ছে সবুজ গমের শীষগুলোর মাথায়। ছেলেমানুষের মতন আনন্দে দুলে দুলে উঠছে ওরা। নাচছে আঙুলের ডগায় শিহরণ জাগিয়ে। চোখ বন্ধ করে সমস্ত অনুভূতিগুলোকে প্রকৃতির হাতে নিলামে তুলে দিয়ে নবীন যুবক আবিষ্ট হয়ে পড়ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল নাগরিক সব পরিচয় মুছে ফেলে এই দ্বীপেরই একজন হয়ে যেতে। মনমত কোনও এক সুন্দরীর হাত ধরে রৌদ্রস্নাত এই ভূ-খণ্ডের কোনও এক কোনে একটা একচালার ঘর বেঁধে জীবন কাটিয়ে দিতে চাইছিল যুবকের মন। এ দেশে প্রকৃতি আছে, মাটির গন্ধ আছে, মাঠভরা ফসল আছে, সমুদ্র ঘেরা বালিয়াড়ি আছে, বালিয়াড়িতে মুখ গুঁজে থাকা শৈল-শ্রেণি আছে – ঘর বাঁধতে এর চাইতে ভালো জায়গা আর কোথায় আছে এমন?
“ওহে ছোকরা, তুমি উন্মাদ নাকি? একলা একলা অমন হাসছ যে বড়?”
প্রশ্ন শুনে যুবকের মুখের হাসি মুহূর্তে মুছে গেল। পরিবর্তে মুখে বিরক্তির ভাব প্রকট হল। মাথা ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তার নধর চেহারার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টি ফেলে সে মাথা নাড়াল।
“হতেই পারি। কামড়ে দেব দেখবেন?”
লোকটা হাসল।
“ধুস, পাগলরা বলে বলে কামড়ায় না—”
“আমি, অন্যরকম পাগল—”
“থাক, আমাকে পাগলামি দেখিয়ে কাজ নেই আর। আমি বৈদ্য নই যে তোমার রোগ সারাব। আচ্ছা, আমার ঘোড়াটাকে দেখেছ? আসলে মাঝপথে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ওই গমক্ষেতে যেতেই ঘোড়াটা পালাল।”
যুবক চটপট ক্ষেত ছেড়ে আলপথে উঠে দাঁড়াল। তারপর মাথা নাড়াল।
“না—”
“চালাক বটে—”
“মানে?”
“প্রাণীটাকে লুকিয়ে রেখেছ নিশ্চয়। আমি চলে গেলেই ওটায় চেপে দিব্যি লোপাট হবে। তাই তো?”
“কি জ্বালায় পড়লাম—”
“তোমার মতন সুদর্শন বিদেশি লোকেদের আমি একটুও পছন্দ করি না। তোমাদের মুখ দেখে কুমারীদের হয়তো মনে প্রেমের তুফান জাগবে, কিন্তু আমার কাছে তোমরা সবাই এক। হুহ—”
“দেখুন, আমি সত্যি জানি না আপনি কে। আমি এটাও জানি না যে আপনার ঘোড়াটা কোথায়। আমি নিজেই লাহোস গ্রামের পথ খুঁজে মরছি—”
“সেখানে তোমার কাজ কি?”
“আপনাকে বলতে যাব কেন?”
“আমি ওখান থেকেই আসছি কিনা—”
“আমি মজুর, শুনেছি ওখানে মন্দির তৈরি হচ্ছে—”
“এহ, ধর্মব্যবসায়ীদের সাহায্য করতে বিদেশ থেকে মজুর এনেছে ওঁরা—”
“আমি শ্রমিক, মোড়লের নিমন্ত্রণে কাজে যাচ্ছি। এই আর কি—”
“সোজা হাঁটবে। গমের খেত পেরিয়ে চুনাপাথরের পাহাড়, তারপরেই পড়বে দিঘিটা। ওখান থেকে সবুজ গাছে মোড়া যে গ্রামটা উত্তর দিকে মাথা তুলে আছে ওটাই লাহোস গ্রাম। তবে রাতের আগে ওখানে না পৌঁছলে কিন্তু কপালে দুঃখ আছে। দীঘির ধারে দস্যুদের ঘাঁটি। তাই সাবধান—”
“ধন্যবাদ, সুযোগ পেলে নিশ্চয় আপনার এই ঋণ—”
“শয়তানগুলোকে বলে দিও, ধর্মের ভয় দেখিয়ে মানুষকে বোকা বানানো যায় হয়তো, তবে পরলোকের শাস্তিটা এড়ানো যায় না।”
মোটাসোটা টাকমাথা লোকটা জ্ঞান দিয়েই সোজা হাঁটতে শুরু করেছে। লোকটা খারাপ নয়। কিন্তু ভদ্রলোকের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক এত খারাপ কেন? কি প্রয়োজন এত কিছু ভাবার? সে কর্মী মানুষ। মোহরের লোভে অনেকটা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে সে এসেছে বিদেশে। কাজ শেষ হলেই, পাখি ডানা মেলে উড়ে যাবে আবার স্বভূমে। সুতরাং মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর কোনও দরকার আছে কি?
সে লাহোস গ্রামের দিকে পা বাড়াল।
তিন
ফিলো দাড়িতে আঙুল বোলাতে বোলাতে ঝিমোচ্ছিল। তাঁর মাথায় অজস্র চিন্তা কিলবিল করছে। যেদিন থেকে মন্দির তৈরির কাজ শুরু হয়েছে সে দিন থেকে আহার-নিদ্রা দুই-ই গায়েব হয়েছে, মাথার চুল পাখির পালকের মতন ঝরে যাচ্ছে, শরীরের ওজন কমে যাচ্ছে। এপেলোর মূর্তিটা যে দিন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা পাবে, সে দিন হয়তো ফিলো এতটাই রুগ্ন হয়ে পড়বে যে লোকে তাকে আর দেখতেই পাবে না। ইশ, কোন কুক্ষনে যে মন্দির গড়ার কাজে সে সম্মতি দিয়েছিল!
“এই যে সর্পচক্ষু কুর্মাবতার—”
ফিলো তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হল আসলে। ওই কণ্ঠস্বর এই দ্বীপদেশের সব মানুষের কাছ থেকে ঠিক এরকমই সম্মান আর সম্ভ্রম দাবি করে কিনা।
“এই যে প্রভু—”
লোকটা এগিয়ে আসছে ক্রমাগত। তারই দিকে। ফিলো’র ঘুম ছুটে গেল।
“সিজার ওদিকে সব শ্রমিকদের কচুকাটা করছে আর তুমি কিনা এখানে বসে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ?” গমগমে গলাটা ফাঁকা ঘরে শব্দের ঢেউ তুলল।
“লোকটাকে নিয়ে আর পারছি না প্রভু! সব জায়গায় আমাদের ভুল ধরছে। কি সব হিসেবেনিকেশ করে আর মজুরদের খাটিয়ে মারে—”
“সিজার আলেক্সান্দ্রিয়ার স্থপতি। ওঁর কথা মেনে চলবে না তো কার কথা মতন চলবে শুনি? ওঁর হাতে জাদু আছে। সুতরাং সিজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে সোজা মাথা নেব তোমার। বুঝলে?”
“বুঝলাম, প্রভু। কিন্তু ওঁর এত দাবিদাওয়া—”
“কি দাবি করেছে শুনি? মন্দিরের মুখ পূব দিকে হবে, এই তো? সে তো করতেই হবে! তা না হলে উদীয়মান সূর্যের কিরণ কীভাবে মূর্তির মাথায় সবার আগে এসে পড়বে শুনি? ও বলেছে, মন্দির হবে সবচাইতে উঁচু পাহাড়ের ওপরে। তাতেই বা আপত্তি কিসের? পাহাড়ের ওপর মন্দির হলে তবেই না সেটা শত্রুর হাত থেকে নিরাপদ হবে দেবস্থানের সম্পদ। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা যাবে আকাশ, সমুদ্র আর দিগন্ত। এতেই বা তোমার আপত্তি কীসের?”
“আহা, অতগুলো শ্রমিককে দিয়ে ভারী ভারী স্তম্ভগুলো উঁচু পাথরের ওপরে বয়ে নিয়ে যাওয়া কি সোজা প্রভু? সেইজন্যই তো কাজে দেরি হচ্ছে—”
“হোক দেরি! মনে রেখো, আমরা মন্দির বানাচ্ছি, তোমার শৌচালয় নয়, ফিলো—”
“আহা, আমি কি সে কথা বললাম প্রভু—”
“আর মর্ফিয়াস যখন মন্দির বানিয়ে ইথাকার মানুষকে তাক লাগিয়ে দেবে তখন তাকিয়ে দেখবে গোটা গ্রিস—”
তাগড়াই চেহারার লোকটা যখনই গর্বিতভাবে আকাশের দিকে চেয়ে নিজের গরিমা প্রকাশ করে তখনই তৃতীয় পুরুষে কথা বলে ওঠেন। এটা তাঁর স্বভাব। লোকটা এমনই। গর্বিত, অহংকারী এবং কুচক্রী। তবে মর্ফিয়াস যে খুব শিগগিরই ইথাকার সিংহাসন দখল করে বসবেন, সে ব্যাপারে ফিলোর সন্দেহ নেই। সেই জন্যই এত লাথিঝাঁটা খেয়ে সে পড়ে আছে মর্ফিয়াসের চরণ বুকে আগলে।
“প্রভু, ওরাকল নিয়েও বিস্তর চিন্তা—”
“কিসের চিন্তা?”
“সিজার প্রার্থনাকক্ষ বানিয়ে পালিয়ে যাবে, কিন্তু নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের শেখানো কথা আউড়াবে এমন মেয়ে পাই কোথায়? সেটা তো আর ওই স্থপতি জোগাড় করে দেব না—”
“ইথাকায় আবার সুন্দরী মেয়ের অভাব!”
“ভাবছিলাম, বাসিলের মেয়েটাকে—”
“তোমার চোখ তাহলে ওইদিকে? এই বয়সে—”
“না, না প্রভু। দেবতার জন্যই তো—”
“তাহলে অসুবিধাই বা কোথায়? বাসিলকে কারাগারে পচিয়ে মারার পরিকল্পনা তো আমিই তৈরি করে দিলাম! তুমি ওর মেয়েটাকে ধরে আনতে পারবে না? ওটা তো তোমারই কাজ! এমনিতে কোনও কাজই তো পার না, এইটুকু জায়গা খুঁজে একটা কুমারী মেয়ে জোগাড় করতে পারবে না? তোমাকে দেখছি এবার—”
“একটা কেন প্রভু, হাজারে হাজারে জোগাড় করে দেব। আপনি চিন্তা করবেন না একদম—”
ফিলোর মুখের দিকে চেয়ে মর্ফিয়াস অট্টহাসি হাসলেন। পাথরের ঘরটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠল।
“মনে রেখ, সামনের পূর্ণিমায় ঈশ্বর প্রথমবার কথা বলবেন। ওই দিনেই নিকেশ হবে আমার প্রথম শত্রু। সে ব্যাপারে কোনও গাফিলতি না হয় যেন—”
“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন প্রভু—”
“তোমার গর্দানটা আমার চোখে বড় আকৰ্ষণীয় থেকেছে ফিলো, যে কোনও দিন ওটায়—”
“আহা, কি যে বলেন—”
মর্ফিয়াস আবার হাসতে হাসতে ঘর ছাড়লেন। ফিলো অজান্তেই নিজের ঘাড়ে হাত বোলাল। মুখটা শুকনো।
“এ তো দেখছি মোহর গুনতে সিংহের মুখে মাথা ঢুকিয়েছি। এবার প্রাণ বাঁচলে হয়—”
ফিলো দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সাবধান করল। তারপর ছুটল মন্দিরের দিকে। এখনও অনেক কাজ বাকি তার।
চার
মোটাসোটা টাকমাথা লোকটা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে তড়িঘড়ি পাথরের কাঠামোর দিকে পা চালাল। রোদ্দুরে পাহাড় ভেঙে আসতে যে তাঁর বেজায় কষ্ট হয়েছে সেটা তার মসৃন মাথায় জমা ঘামের বিন্দুর সংখ্যার আধিক্যে মালুম পাওয়া যায়। একটু দূরে যেতেই সারবাঁধা হাড়পাঁজরসর্বস্ব মজদুরদের বাহিনী চোখে পড়ল তার। নির্বাক নির্জীব শরীরগুলো পাথরের টুকরো টেনে নিয়ে যাচ্ছিল চড়াই বেয়ে। নাদুস নুদুস চেহারা নিয়ে ওদের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না লোকটা। তাতে আরও মেজাজ খাপ্পা হয়ে উঠছিল তার।
“এই, সিজার নামের হতভাগাটা কোথায়?” আগন্তুক একজন রুগ্ন শ্রমিকের কাছে উত্তর চাইল। সে উত্তর না দিয়ে এক মনে পাথরের গায়ে খোদাই চালিয়ে যাচ্ছিল অবশ্য। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন মজুর হাসল। কানের দিকে আঙুল দেখিয়ে মাথা নাড়াল। বোঝাল, নিজের হাতুড়ির শব্দেই মজুর ব্যাটা নিজের কানদুটোকে বিসর্জন দিয়ে ফেলেছে।
“তোর কান তো ঠিক আছে, তাহলে উত্তর দিলি না কেন হতচ্ছাড়া?” আগন্তুক হম্বিতম্বি শুরু করতেই লোকটা আঙুল তুলে মন্দিরের দিকে ইশারা করল। আগন্তুকের মনে সন্দেহ হল। লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ রে তুই কি আবার বোবা নাকি?” সে ইতিবাচক হাসল।
পাথরের ঢিবি পেরিয়ে ধুলোর মেঘ সরিয়ে মেদ-ভারী শরীরটাকে টেনে টেনে সে পথে উঠতে গিয়ে আগন্তুকের তখন নাকাল অবস্থা। সিজার যে আসলে কোথায় সেটাই কেউ বলতে পারছে না ঠিক করে। শুধু অসভ্য শ্রমিকদের নির্দেশিকা মেনে সে খালি চরকি পাক খেয়ে চলেছে অনবরত।
এমন সময় একজন ভদ্র লোকের সন্ধান মিলল। যুবকের মুখ খুব পরিচিত ঠেকল আগন্তুকের।
“এই যে ছোকরা, সিজার কোথায় বলতে পার?”
ছোকরা একটা স্তম্ভের ধারে দাঁড়িয়ে মুখে হাত দিয়ে গম্ভীরভাবে কিছু ভাবছিল। নীল চোখের মনি আবদ্ধ ছিল মর্মরগাত্রে। ঠোঁটদুটো নড়ছিল। আগন্তুকের মনে হল ছেলেটা গাণিতিক হিসেবে নিকেশ করছে এক মনে।
“বলি তুমিও কি বোবা-কালা নাকি? সিজার কোথায় বলতে পার?” প্রশ্নের শেষটা ধ্যানমগ্ন যুবকের একেবারে কানের কাছে এনে রীতিমতো চেঁচিয়েই করল আগন্তুক। লোকটা যেন বিরক্ত হল হঠাৎ। তারপর আঙুল তুলে দেখাল অনির্দিষ্ট কোনও এক দিকে। আগন্তুক সে দিকে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। ছেলেটার মুখের কাছে মুখ এনে খুঁটিয়ে দেখল।
“তুমি সেই ছোকরা না? আমায় চিনতে পারছো?”
ছেলেটা এবার মুন্ড ঘুরিয়ে আগন্তুকের বৃত্তাকার মুখে দৃষ্টি ফেলল। তারপরেই চমকে উঠল যেন।
“ওহ, বিশ্বাস করুন। আমার কোনও দোষ নেই—”
“কিসের দোষ রে ভাই!”
ছেলেটা নিজেকে সামলে নিল।
“কেমন আছেন ভদ্র? সেদিনের পর আর দেখা নেই—”
“যাক চিনতে পেরেছ দেখছি—”
“আহা, আপনাকে কি ভোলা সহজ নাকি? এরকম স্বাস্থ্যের প্রাচুর্য, এমন আলাপী হাসি, এমন পূর্ণচন্দ্রের মতন মুখাবয়ব— ভোলা সহজ নয় মশায়।”
উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল না। বরং আগন্তুকের চোখের দৃষ্টি খর হল। “আমার চেহারা নিয়ে মস্করা হচ্ছে?”
“বিশ্বাস করুন—”
“যাকগে, আগে বল সিজার কোথায়? আজ তার সঙ্গে আমার একটা হেস্তনেস্ত করেই তবে ছাড়ব—”
“কেন, কি হল বলুন তো হঠাৎ?”
“তোমাদের ওই স্থপতি একটা নরকের কীট! শয়তান! আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ছ’খানা বড় আর ষোলখানা ছোট স্তম্ভ বানাবার। আমার মিস্ত্রিরা দিনরাত এক করে যেই না সেগুলো বানিয়ে পাঠাল, তোমাদের ওই স্থপতি কিনা বলল ওগুলো চলবে না? আমার সমস্ত পাওয়ানাটাই নাকি সে আটকে দেবে! কতবড় সাহস!”
“আজ্ঞে, আপনিই কি সেই মহামান্য পাথর-ব্যবসায়ী বাসিল? গতকাল দেখলাম ‘উনি’ আপনার উদ্দেশ্যেই বেশ কিছু মিঠেকড়া কথা বলছিলেন—”
“কি বলছিল লোকটা?”
“আপনি নাকি নির্বোধ, আকাট এবং মূর্খ!”
“কি—”
“এপেলোর মন্দিরে আপনি নাকি মেয়েলি ফুল লতাপাতায় মোড়া ‘আয়নিক’ স্তম্ভ পাঠিয়েছেন। এদিকে এপেলো তো শক্তপোক্ত মজবুত সা-জোয়ান দেবতা, তাঁর মন্দিরে কি পৌরুষময় কাঠখোট্টা কিন্তু সুদৃঢ় ‘ডোরিক’ স্তম্ভের সজ্জা ছাড়া চলে? ওই কারণেই আপনাকে আরও কিছু—”
“কি আশ্চর্য! আমি তো প্রথমে ‘ডোরিক’ স্থাপত্যরীতি মেনেই কাজ করাচ্ছিলাম, পরে ওই শয়তানটা নিজেই তো চিরকুটে লিখে পাঠালে—”
“কে… সিজার?”
“নয় তো কে? হস্তাক্ষরটা পর্যন্ত আমার কাছে আছে, দেখবে?”
লোকটা কোমরে গোঁজা থলে থেকে একটুকরো তুলোট কাগজ বার করে ধরল। ছেলেটা কাগজ হাতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ।
“দেখলে? এবার তোমার কী বক্তব্য শুনি?”
“এটা সিজারের স্বাক্ষর নয়। কেউ নকল চিঠি পাঠিয়েছে আপনাকে—”
“মিথ্যে—”
“সত্যি, আমার চাইতে কে ভালো জানবে বলুন তো?”
“কেন, তুমি কি ওঁর পা টেপা চাকর?”
ছেলেটা ঢোঁক গিলল।
“ভাই, সিজার, মূর্তির পাদদেশে আলোর—”
কখন যেন একজন বৃদ্ধ শিল্পী চলে এসেছিলেন ছেলেটির পিছনে। কেউই খেয়াল করেনি। কিন্তু তার ডাকেই বাসিল নামের আগন্তুকের মুখ লাল হয়ে উঠল। যুবক লাজুক মুখে কাঁধ নাচাল। সে আগন্তুকের চোখে চোখ রাখতে পারছিল না।
“মিথ্যুক, বুজরুক, শয়তান—”
“বিশ্বাস করুন, কেউ আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করেছে। আমি কোনমতেই এমন চিঠি লিখতে পারি না। তবে আপনার বকেয়া যাতে মিটিয়ে দেওয়া হয় তার ব্যবস্থা আমি নিশ্চয় করব।” যুবকের মুখ দেখে মনে হল সে মিথ্যে বলছে না। বাসিল রাগে কাঁপতে কাঁপতে প্রস্থান করল।
সবকিছু তার মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে রীতিমতো। চমকের পর চমক। কিন্তু তাকে নকল চিঠিটা পাঠাল কে?
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ডাকটা কানে গেল তার। ঘোড়ার ডাক। একটু নজর ঘুরিয়ে পাশের পাইন গাছের বনে আবিষ্কার করা গেল সতেজ চারপেয়ে প্রাণীটাকে। মনের সুখে ছোলা চিবোচ্ছে সে। তার পোষ্য ঘোড়া। কিন্তু সে এখানে এল কোথা থেকে? তার চোখের মণিদুটো ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে।
“ওটা কার ঘোড়া বল দেখি?” একজন পাথর-বাহী শ্রমিককে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেই লোকটা আঙুল দিয়ে দেখাল সিঁড়িতে আলোচনায় ব্যস্ত যুবককে।
“তবে রে শয়তান—” লোকটা উত্তপ্ত কড়াইয়ে খৈয়ের মতন লাফাতে লাফাতে ছুটল যুবকের দিকে। আগন্তুকের যুযুধান চেহারা দেখে দিশেহারা সিজার প্রথমে সচকিত হয়ে উঠলেও মুহূর্তের মধ্যে বুঝল গন্ডগোলের কারণ। তারপর দুহাত তুলে নিরস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাগে টকটকে লাল হয়ে যাওয়া টাকমাথা ব্যবসায়ীকে।
ওদের দুজনের উত্তপ্ত আলাপচারিতাকে মাঝখানে রেখে শ্রমিকদের ব্যস্ত দল দু-দিক দিয়ে টেনে নিয়ে চলল ভারী ভারী প্রস্তরখন্ড। ওদের ঘামেভেজা শ্রান্তিকে মুছিয়ে দিতেই উত্তর দিকের জঙ্গল থেকে ক্ষণে ক্ষণে উঠল নির্মল বাতাসের ঢেউ। সকলের নীরব কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়েই একটু একটু করে তৈরি হতে লাগল এক নবীন দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত উচ্চাশার রঙে রাঙা এক অতুলনীয় দেবালয়।
পাঁচ
দীঘিটা পরিত্যক্ত। জল-তল প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। অথচ ওর মধ্যেই লাল শালুক ফুটছে দিব্যি। শালুক বনের মধ্যেই আবার ঘাসে ঘেরা জলাভূমিও মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও দ্বন্দ্ব নেই ওদের। কোনও এক অর্থবান এক কালে সাদা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ঘিরেছিল জায়গাটা। এখন সেগুলো ফুটি-ফাঁটা ফোকলা হাসি নিয়ে মুখ ব্যাদান করে চেয়ে আছে। অবশ্য ওই সিঁড়িগুলোর জন্যই পাশের নির্জন পথ থেকে দীঘিটা মুখ লুকিয়ে আত্মগোপন করে আছে বিগত যৌবনকে ঢেকে রাখবে বলে।
মেয়েটা লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল ওই সিঁড়িগুলো বেয়ে। সে উত্তেজিত। যাকে সে খুঁজছিল তাকে দৃষ্টি দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ব্যগ্র।
“এতক্ষণে তোমার সময় হল? আমি সেই কখন থেকে—”
শেষ ধাপে বসে থাকা যুবক মেয়েটির পায়ের শব্দ পেয়েই উঠে দাঁড়িয়েছিল। সে আকুল দৃষ্টি মেলে মেয়েটিকে অভিবাদন জানাল।
“চুপ কর! আমাদের আর দেখা করা সম্ভব নয়, জানো সে কথা?”
মেয়েটার মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে ছেলেটি কথা বলতে ভুলে গেল। গতিক সুবিধের নয়।
“কি বলছ? মন্দির প্রস্তুত, মাত্র চার-বেলার মধ্যেই অনুষ্ঠান করে মন্দির খুলে দেওয়া হবে জনসাধারণের জন্য। তারপরই তো আমাদের বিবাহের—”
“দুঃখিত হারমন, সে আর সম্ভব নয়। আমরা বিপন্ন। বাবাকে আজ বিকালে মর্ফিয়াসের সেনারা এসে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছে। এপেলোর সামনে নাকি তাঁর বিচার হবে। তিনি নাকি মন্দির বানাতে গিয়ে লোভের বশবর্তী হয়ে প্রচুর সোনার মোহর আত্মসাৎ করেছেন। ঈশ্বরের সঙ্গে নাকি বেইমানি করেছেন…”
মেয়েটা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। হারমন নামের ছেলেটি স্তব্ধবাক। অজস্র চিন্তাভাবনার স্রোতে সে হাবুডুবু খাচ্ছিল।
“তোমার বাবা, কি করেন তিনি? তাঁর প্রতি মর্ফিয়াসের আক্রোশের কারণই বা কি?”
“মাত্র এক সপ্তাহের পরিচয় আমাদের। তাতেই তোমায় হৃদয় দিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু হে ঈশ্বর, এ কেমন বিপদে ফেললে আমায়—”
“কতদিনের পরিচয় সেটা বড় কথা নয়, সম্পর্কটা ঠিক কতটা মজবুত, সেটাই আসল কথা দিমিত্রিয়া। কথা দিচ্ছি, তোমার বাবার কোনও বিপদ আমি বেঁচে থাকতে হতে দেব না—”
“মর্ফিয়াস আমার বাবার শত্রু, আগেও অনেকবার তাঁর নানা সিদ্ধান্তে বাবা নাক গলিয়েছিল। তাই সুযোগ পেয়েই লোকটা বাবাকে চেপে ধরেছে। ওই সিজার নামের স্থপতিই এ সর্বনাশের মূল কারণ। ওই লোকটাকে হাতে পেলে—”
মেয়েটা আবার ফুঁপিয়ে উঠল। হারমন দাঁতে ঠোঁট কামড়াল। ‘সিজার’ নামটা অনিচ্ছাকৃতভাবেই সমস্ত লোকের কাছে ত্রাসের কারণ হয়ে উঠছে। কি করা যায়!
“দিমিত্রিয়া, একটু শান্ত হয়ে বস। তোমার বাবার কাহিনিটা একটু গুছিয়ে বল দেখি—”
“বাবা শত্রু জেনেও তাঁর কাছে মন্দির বানাবার জন্য সাহায্য চেয়েছিল ওই শয়তান মর্ফিয়াস। লোভ দেখিয়েছিল। বাবা পাথরের ব্যবসায়ী। মোহরের ঝনঝনানি না শুনলে তাঁর নাকি রাতের ঘুম হয় না। তাই যেচে কাজে হাত দিয়েছিল। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। এমন সময় হঠাৎ প্রধান স্থপতির নির্দেশ এল, কতগুলো স্তম্ভ বানাতে হবে তাঁকে। বাবা যখন সেগুলো প্রস্তুত করে মন্দিরে পাঠালেন তখন জানা গেল ওই আহাম্মক স্থপতি নাকি অন্য রকমের স্তম্ভ বানাতে বলেছিলেন। বাবা তো আকাশ থেকে পড়লেন। তারপর ওই শয়তানটা আবার বাবাকে বলল যে, জাল চিঠি পাঠিয়ে কেউ তার সঙ্গে ঠাট্টা করেছে। অবশ্য তার জন্য ক্ষতিপূরণের টাকা পাবে বাবা। আজ বিকেলে মর্ফিয়াসের সেনারা এসে জানাল, ওই চিঠিটাও নাকি জাল! বাবা নাকি ওভাবেই আত্মসাৎ করতে চাইছিলেন মর্ফিয়াসের অর্থ! ভাবা যায়?” দিমিত্রিয়া হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
হারমন নামের ছেলেটা নির্বাক বসে ছিল। তার মেরুদণ্ড নুইঁয়ে পড়েছে। মুখের হাসিটা কেউ যেন শুষে নিয়েছে। গালগুলো রক্তশূন্য। সে স্খলিত গলায় প্রশ্ন করল, “তোমার বাবার নাম?”
মেয়েটা মুখ তুলল। সজল চোখে উত্তর দিল, “বাসিল—”
ছেলেটা পাথরের সিঁড়িতে ঘুসি ছুড়ল নিষ্ফল আক্রোশে।
“আমায় মাফ করবে দিমিত্রিয়া?” ছেলেটা ভাঙা গলায় প্রশ্ন করল। মেয়েটি অবাক হয়ে প্রেমিকের চোখে চোখ রাখল। তার চোখে দিশাহারা পাখির চাঞ্চল্য।
“গল্প শোনাবার মতন সময় হাতে নেই। তাই আমার কথা বিশ্বাস করে যা করতে বলছি সেগুলো একটার পর একটা করতে হবে। কথা দাও, যেমনটা বলব ঠিক তেমনটাই করবে?” ছেলেটার গলায় আবার আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। সে উঠে দাঁড়িয়েছে।
“এ সবের কি অর্থ—”
“অর্থ নয় দিমিত্রিয়া, অনর্থ। আমি করেছি। সর্বনাশ ডেকে এনেছি। সেই সর্বনাশের মুখে আগুন জ্বালতে হবে। তারপর তুমিই আমার বিচার কোরো, কেমন?” ছেলেটার মুখটা ভেঙেচুরে যাচ্ছিল।
দিমিত্রিয়ার মনে হাজার প্রশ্নের ঝড় উঠেছিল। কিন্তু তরুনের অপাপবিদ্ধ মুখটা এই মুহূর্তে তাকে মূক করে দিচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল নিজের আঁচলে ছেলেটার সমস্ত দুঃখ কষ্টকে মুছিয়ে দিতে। কিন্তু সময় কোথায়?
“কি করতে হবে, বল—”
ওদের গুনগুনানি কেউ শুনতে পেল না। অন্ধকার তার চাদরে মুড়ে ফেলল ওদের দুজনকে। দীঘির ওপারে চাঁদের লালচে রেখাটা উঁকি মারল লাজুকভাবে। রাত নামল।
ছয়
মর্ফিয়াসের পরনে শ্বেতশুভ্র ‘টিউনিক’। সেটাকে বেড় দিয়ে মখমলি পশমের ‘টোগা’ তাঁর কাঁধ ছুঁয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। লালচে সোনালি চুলে অলিভ পাতার মুকুট। পায়ে মহার্ঘ্য ভেড়ার লোমের ক্যালিগা। শরীরে বিনবিনে সুগন্ধ। এত কিছুর পরেও লোকটার মুখে যে সযত্নলালিত দম্ভ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার রেখাগুলো ছিল সেগুলোকে কিছুতেই লুকিয়ে রাখতে পারছিলেন না ভদ্রলোক। আসলে লুকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তাও ছিল না বিশেষ।
তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে জনতার সমুদ্র। কালো কালো মাথার সারি সর্বত্র। তারা নির্বাক, মূক। শুধু ওদের চোখগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল মন্দিরের প্রতিটা ধারাল কোনগুলোকে। যেন কেউ নিক্তি দিয়ে মেপে মেপে প্রতিটা পাথরের প্রান্তকে মিলিয়েছে অন্য প্রান্তের সঙ্গে। কোথাও এক চুল-ও বিন্যাসের হেরফের নেই। এত নিঁখুত দেবভূমি একমাত্র খোদ ঈশ্বরের হাতে সৃষ্টি পেতে পারে। দর্শনার্থীরা নীরব বিস্ময়ে ভাবছিল। ওদের মাথা নত হয়ে আসছিল শ্রদ্ধায়, সম্ভ্রমে।
“মহারাজ এখনও এসে পৌঁছলেন না তো?”
একজন স্যাঙাত ফিসফিস করে মর্ফিয়াসের কানে কানে কথাগুলো উচ্চারণ করল। চিন্তার ব্যাপারই বটে। লুসিয়াসকে নিমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছিল দূতের মাধ্যমে। মহারাজ নিজ হাতে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেবেন মন্দিরের দরজা, এমনটাও জানিয়েছিলেন চিঠির মারফত। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও তাঁর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না তো কিছুতেই? তবে কি এখনই মহারাজের মনে হিংসার গরল ছড়িয়ে পড়েছে? আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে সুচতুর ভাস্কর, স্থপতি এবং বিজ্ঞানী এনে তিনি যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সে খবর কি এখনই মহারাজের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দেখা দিল? মর্ফিয়াস মনে মনে হাসলেন। এই তো সবে শুরু!
“আমার প্রিয় সহানাগরিকবৃন্দ এবং ইথাকার তামাম জনসাধারণ, আপনাদের সম্মুখে মাথানত করে পেশ করছি আমার জীবন দিয়ে তৈরি ভগবান এপেলোর মহামন্দির। আসুন, আপনারাও মাথা নীচু করে ঈশ্বরের দর্শন করুন। আমার সঙ্গে চলুন মন্দিরের গর্ভগৃহে, যেখানে খোদ দেবাদিদেব তাঁর সিংহাসনে বিশ্রাম নিচ্ছেন এই মুহূর্তে।”
সাধারণ এবং অ-সাধারণের মধ্যে তখন তুমুল কৌতূহল। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে জমায়েতের ভিড়টা নতমস্তকে উঠে আসছিল মন্দিরের দিকে। সকলের চোখেমুখে তীব্র ভাবগম্ভীর আবেগের উথালি-পাথালি ঢেউ। চক্ষু সজল।
“ওই দেখুন, মন্দিরের চাতালে শোভা পাচ্ছে ঐশ্বরিক ফোয়ারা! এই ফোয়ারায় জলের স্রোত স্বয়ম্ভূ! স্বয়ং ভগবানের হাতে এর উৎপত্তি! এর জল কোনও দিন ফুরাবে না, কোনও দিন এর স্রোত থামবে না। জন্ম জন্মান্তর ধরে চলবে—”
মর্ফিয়াসের চোখ দুটো গোল হয়ে গেল ঠিক এই সময়। ফোয়ারা বন্ধ হয়ে গেছে। সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে ভীতিবিহ্বল গুঞ্জন।
“এ কি অনাচার—” কেউ কেউ ফিসফাস করতে শুরু করেছে এরই মধ্যে।
“উঁহু অনাচার নয়। ভূত, প্রেত বা ভগবানও নয়, ফোয়ারার প্রস্রবণ বন্ধ হয়ে যাবার কারণ হল, ‘বিজ্ঞান’। আসুন বুঝিয়ে বলি,” ভিড় ঠেলে একটি যুবক এগিয়ে এসেছে, সেই-ই হাত নেড়ে জনগণকে নিরস্ত করে ঘটনাটার ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল। মর্ফিয়াস বাকরুদ্ধ। ছেলেটিকে তিনি বিলক্ষণ চেনেন।
“আসলে, ঈশ্বর নন, এই ফোয়ারা চালায় ‘জলবাহী চাপ’। এই মর্মর-সাজের আড়ালে লুকিয়ে রাখা আছে তিনখানা পাত্র, যার মাত্র একটির খোলা অংশবিশেষ খালি চোখে দেখা যায়। এই তিন খানা পাত্র আর তিনখানি নল দিয়ে একই জলপ্রবাহকে বারংবার একই পথে বাহিত করে এই আশ্চর্য দৃশ্য আমরা দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করি। কেউ একে বলেন জাদু আবার কেউ বলেন, এ হল দৈব মহিমা। আমরা জানি, এর পিছনে থাকে পদার্থের নিজস্ব ধর্ম—”
ছেলেটা মহানন্দে নিজের জ্ঞান বিতরণ করে চলেছে। ভিড়ের কেউই কিছু বুঝতে পারছে না যদিও, তবু একটা জিনিস খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে তাদের কাছে, ও ফোয়ারা আসলে কারিগরের হাতসাফাই। তারা মনক্ষুন্ন হল খানিক।
“আহা, সিজার! রাত সংক্ষিপ্ত! চল আমরা এগোই—” মর্ফিয়াস কঠিন গলায় মধু মাখিয়ে সিজারের হাত ধরে টান মারলেন।
“এই দেখুন, গর্ভগৃহের দরজা। আমাদের এবং ঈশ্বরের মাঝখানে এখন শুধু এই সুউচ্চ কাঠের বাধা। এইটুকু পেরলেই আমাদের সামনে প্রকাশ পাবে দেবলোকের পথ। কিন্তু…” মর্ফিয়াস একটু বিরতি নিলেন। জমায়েতের উদ্বিগ্ন মুখগুলোকে মনযোগ দিয়ে দেখলেন। ওদের মুখে যে ভয় আর ভক্তির প্রাচুর্য দেখছেন তাতে মনে মনে উল্লসিত হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। মিটিমিটি হাসিতে মুখ ভরিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, “কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করতে গেলে যে তাঁকে সম্মান দেখতে হয়! তাঁর সামনে দাঁড়াতে গেলে যে অন্ধকারের কলুষ মুছে দিয়ে আলোর শিখায় উদ্ভাস হতে হয়। তাই আসুন, এই বেদিতে জ্বালাই পূতাগ্নি—”
তাঁর ইশারায় একজন দাস মশাল হাতে এসে উপস্থিত হল। মর্ফিয়াস আগুন জ্বালালেন বেদিতে জড় করা কাঠের স্তূপে। দাউ দাউ করে সাদা ধোঁয়ায় ভরে উঠল মন্দিরের অলিন্দখানা।
“ওই দেখুন, আপনাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন আমাদের ভগবান—”
সত্যিই তাই। ঘড়-ঘড় শব্দে অতিকায় পাল্লাদুটো একটুখানি সরে গেল। জনতা উল্লাসে হাততালি দিয়ে উঠল বটে কিন্তু সেই শব্দেই কিনা কে জানে পাল্লাদুটো আর নড়ল না। ওইটুকু ফোঁকর দিয়ে তো একজনও গলতে পারবে না গর্ভগৃহে? এবার উপায়?
“সিজার—” মর্ফিয়াস বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে উঠলেন। আর পড়িমরি করে আবার ভিড় ঠেলে সামনে চলে এল যুবক।
“উঁহু, দেবতার দোষ বা রোষ, কোনটাই এমন অঘটনের জন্য দায়ী নয়। আসলে ব্যাপার হল, আমরা যখনই ওই বেদিতে আগুন দিলাম, অমনি জায়গাটার উষ্ণতা বাড়ল। আর উষ্ণতা বাড়তেই বায়ুর আয়তন বাড়ল। আয়তন বাড়তেই বায়ুর নিজের চাপেই কোনও এক গোপন জায়গায় একটি পাত্রে তরল এসে জমা হল। তারপর জমা তরলের ভারে সেই পাত্র মাথা নীচু করে তরলের প্রবাহ ঢেলে দিল অন্য একটি পাত্রে, যেটি কিনা একটি পুলির সঙ্গে বাঁধা। ওই তরলের ভারে পুলিতে টান পড়তেই পুলির দড়িতে বাঁধা পাল্লা দুটো খুলে যাওয়ার কথা—”
“পাপ—”, “জাদু—”, “লোক ঠকানো বুজরুকি—” জনতা চিৎকার করে উঠল।
“আগে পুরোটা শুনুন মশাইয়েরা, দরজা খুললেই তো হল না। ওটাকে বন্ধও তো করতে হবে, তাই না? আসলে আগুন নিভে গেলেই বায়ুর আয়তন বেড়ে যাবে আবার—”
“সিজার—”
মর্ফিয়াসের চিৎকার মাঝপথে হাত তুলে বন্ধ করে ছেলেটা তড়িঘড়ি দরজার কাছে পৌঁছে গেল। দু’হাতে সবলে ঠেলা মেরে গর্ভগৃহে প্রবেশের পথটা উন্মুক্ত করে দিল। মুখে তার মুচকি হাসি। বিভ্রান্ত জনগণ এগিয়ে গেল। এগিয়ে এলেন মর্ফিয়াস-ও। তিনিও দিশেহারা। ভেবেছিলেন এ মন্দিরের সমস্ত নাটক নিজে হাতে পরিচালনা করবেন তিনি। দেবতা সিংহাসনে বসে থাকবেন আর তাঁর সামনে এসে দাঁড়ানো কুশীলবদের তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন নিজের আঙুলে বাঁধা সুতোর সাহায্যে। কিন্তু সে আর হচ্ছে কই? ওই সিজার নামের ছেলেটি তার হাত থেকে পুতুল নাচের সমস্ত উপকরণ কেড়ে নিয়েছে এক লহমায়। এখন তাই বড় বিপন্ন বোধ করছেন মর্ফিয়াস।
“এই যে পথ, এই পথে ভক্তের দল পূজার উপাচার নিয়ে হাজির হবে দেবতার সম্মুখে। এইবার সুধী পা ফেলুন সাবধানে। মনে রাখবেন, ঈশ্বর আর কয়েক পা দূরেই আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। আসুন-” মর্ফিয়াস আবার সক্রিয় হয়ে উঠলেন। লোকটা হার মানতে জানে না। হয়তো সে কারণেই এই দ্বীপের অজস্র বিত্তবানদের মধ্যে একমাত্র তিনিই সিংহাসনের দিকে পা বাড়াবার সাহস দেখিয়েছেন এর মধ্যেই। স্বপ্ন দেখতে সাহস তো চাই-ই, তাই না?
বর্গক্ষেত্রে সাজানো পাথরের টুকরোগুলোর ওপর পা ফেললেই একটা মেঘ ডাকার গমগমে শব্দ আসছে। যেন মাউন্ট অলিম্পাসের পথে হঠাৎ করে চলে এসেছে ইথাকার মানুষগুলো। মশালের আলো আর অনেকটা অন্ধকারে কেমন যেন এক ইন্দ্রজালের মায়া ছড়িয়ে পড়েছে মন্দিরের ক্রোড়ে। সকলেই সন্ত্রস্ত। সকলেই উদ্বিগ্ন।
হঠাৎ মেঘের ডাক থেমে গেল। মর্ফিয়াস ইতিউতি চাইলেন চারদিকে। এরকম তো হবার কথা নয়! মূর্তির যত কাছে পৌঁছবে মানুষ, ততই জোরদার হবে মেঘের ডাক। তেমনটাই তো বলেছিল সিজার!
ছেলেটার কথা ভাবতেই সে আবার হাজির। আগুয়ান জনতার পথ আগলে সে আবার বচন ঝাড়তে শুরু করেছে!
“সাবধান! ঈশ্বর ক্রূদ্ধ! তিনি রুষ্ট! তাই থেমে গেছে বজ্রের গর্জন-” ছেলেটার মুখেচোখে ত্রাসের ছাপ। দর্শকরা ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই অবশ্য ছেলেটা ফিক করে হাসল। “ধূর, আমি তো ঠাট্টা করছিলাম। আসলে কি হয়েছে জানেন তো, এই গম্বুজের ছাদে কয়েকটা ভারী লোহার গোলক নির্দিষ্ট খোপে সাজিয়ে রাখা আছে। এই বর্গাকার প্রস্তরখন্ডে পা ফেললেই, আপনার ভারে মেঝের সামান্য নিচেই কোনও এক জায়গায় একটি পুলিতে টান পড়বে, আর টান পড়লেই পুলির অন্যপ্রান্তে একটি করে গোলিকা ধাক্কা খাবে। ধাক্কা খেলেই সেটি গড়িয়ে যাবে এক ধার থেকে অন্য ধারে। আর তখনই মেঘ ডাকার শব্দ শোনা যাবে। এবার প্রশ্ন হল, অতটা উচ্চতায় ওইটুকু শব্দ হলে তাকেই বা মানুষ ‘গর্জন’ বলে মানবে কেন? সে জন্যই আমার মাথায় এল এক অভিনব চিন্তা। নিচের কক্ষটা তো অতিকায় এবং সম্পূর্ণ ফাঁপা! তাহলে ছাদে হওয়া ওই শব্দটাই তো দেয়ালে দেয়ালে তরঙ্গ হিসাবে ধাক্কা খেয়ে যখন দর্শকের কানে পৌঁছবে তখন তো তার প্রাবল্য বাড়বেই! ব্যাস, সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। এখন বোধহয় ওই পুলিগুলোর কোনও একটা তারে সামান্য অসুবিধা হয়েছে, তাই—”
“থাক, হয়েছে! তুমি এবার দূর হও আমার সুমুখ থেকে! সান্ত্রী, এক্ষুনি এই শয়তানটাকে বন্দি করো, কাল সকালেই দেবতার সামনে বিচার শেষ করে ওর গর্দান নেওয়া যাবে-” কয়েকজন রক্ষী অস্ত্র হাতে জাপ্টে ধরল সিজারকে। তাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল সকলের দৃষ্টিপথের আড়ালে।
মর্ফিয়াসের মুখে আবার আত্মবিশ্বাসী হাসি ফিরল।
“ভেবেছিলাম আলেক্সান্ড্রিয়ার বিখ্যাত স্থপতিকে এনে মন্দির সাজাব নিজের ইচ্ছেমতো। কিন্তু দেখুন দেখি, অর্থের কার্পণ্য না করলেও লোকটা কেমনভাবে আমায় ঠকাল? শুধু আমাকেই না মহোদয় এবং মহোদয়ারা, ও ঠকিয়েছে আমাদের সব্বাইকে। তবে একটাই স্বান্ত্বনা, মন্দিরের কারিগরিতে শঠতা মিশে থাকলেও, দেবতা আমাদের জাগ্রত। আসুন পরীক্ষা করে দেখা যাক এবার—”
মর্ফিয়াসের নির্দেশে রক্তলাল মসলিনের আবরণ উঠে গেল। আর প্রকাশ পেল অতিকায় মর্মর মূর্তিখানা।
এক ঢাল চুল। ঝরনার মতন নেমে এসেছে ঘাড় অবধি। উন্নত নাসা, ধনুকের মতন ভ্রূ-যুগল, একজোড়া মরমী চোখ। পেশিবহুল পৌরুষ অঙ্গসৌষ্ঠবে। একহাতে বীনা অথচ বাকি শরীরে সোনার বর্ম। স্বর্গীয় উচ্চতা থেকে মানুষটা চেয়ে আছেন দর্শকদের দিকে। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন কেমন মায়াময় হাসিতে মুখ উদ্ভাস করে।
দর্শকদের দৃষ্টি মাটি ছুঁল। একমাত্র মর্ফিয়াস মুগ্ধ হয়ে চেয়ে ছিলেন দেবতার মুখের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টি ফেলে। সত্যিই কি অপূর্ব সৃষ্টি! এপেলোর মধ্যে কি উচ্চাকাঙ্খী মানুষটা নিজের ছায়া খুঁজছিলেন? তিনি দ্রূত আগের অবস্থায় ফিরলেন।
“ঈশ্বর শুধুমাত্র আমাদের স্রষ্টাই নন, আমাদের সমস্ত কার্যকলাপের বিচারকও তিনি-ই। রাজার চাইতেও তাঁর শক্তি বেশি, দৃষ্টি প্রসারিত। তাঁরই ‘উপযুক্ত’ তত্বাবধানে এখানেই ভগবানের সামনে শুরু হবে অপরাধীর বিচারের প্রক্রিয়া। খোদ ‘তিনিই’ শোনাবেন অপরাধীর শাস্তি—”
ঘোষণা শেষ হবার আগেই মন্দিরে শোরগোল পড়ে গেল। মূর্তি জাগ্রত, তাই বলে সে মূর্তি নিজেই অপরাধীর বিচার করে ফেলবে? এমনটাও সম্ভব নাকি? অনেকে আবার শঙ্কিত হয়ে পড়ল। এ সবের পিছনে মর্ফিয়াসের কোনও চক্রান্ত নেই তো? কেউ কেউ আবার এমন প্রশ্নও তুললেন, এমন জাগ্রত দেবতা থাকলে দেশে রাজার প্রয়োজন কি?
মর্ফিয়াসের গলাটা হেঁকে উঠল।
“বন্দিকে হাজির করা হোক—”
চারটে মুশকো অস্ত্রধারী উদয় হল অন্ধকার চিরে। তাদের সঙ্গে উদয় হলেন পেটমোটা ব্যবসায়ী। বাসিল। তাঁর টাকমাথায় আজ আর সেই আগের চমক নেই, গালদুটো জৌলুস হারিয়েছে, চোখে সেই উদ্দীপনাটাও গরহাজির। গায়ে ধুলো ময়লা আর হাতে-পা’য়ে শেকল। মর্ফিয়াসকে দেখতে পেয়েই বাসিল গর্জে উঠলেন।
“শয়তান, তোমার চালাকি যে দিন—”
মর্ফিয়াস ঠোঁটে আঙুল চেপে বাসিলকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিলেন। তারপর মিটিমিটি হাসলেন। আঙুল নাচিয়ে দেবমূর্তির দিকে বাসিলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
“ভাই বাসিল, ঈশ্বর সব কিছু দেখছেন! এইবার না হয় নিজেকে একটু সম্বরণ কর? তোমার পাপী জিভটাকে এবার অন্তত শান্তি দাও একটু!”
বাসিল কাঁপছিলেন। অনেক কথা বলার আছে তাঁর। কিন্তু এতগুলো লোক রক্তপিপাসুর মত চেয়ে আছে তাঁর দিকে। অতিকায় চেহারা নিয়ে তার মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছেন মহামহিম এপোলো। এ অবস্থায় কি করণীয় তাঁর? তিনি আবার ঘামতে শুরু করেলন।
মর্ফিয়াস ছাদের দিকে মুখ তুলে সংক্ষিপ্ত তালি বাজালেন। কাজ হল। একজন শীর্ণকায় মধ্যবয়স্ক মানুষ এসে হাজির হলেন। তাঁর পরনে পুরোহিতের সাজ। লোকটা চোঙার মতন দেখতে একটা পাত্রের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তারপর চোখ বন্ধ করে হাতের মুঠোটা আলগা করলেন। একখানা সোনার মোহর পাত্রের গায়ে খোদাই করা গর্ত দিয়ে গড়িয়ে পড়ল চোঙার ভিতরে। আর সঙ্গে সঙ্গে আড়াল থেকে গর্জে উঠল মেঘমন্দ্র স্বর। সমবেত জনতা চমৎকৃত। এ কি আশ্চর্য লীলা!
স্বরটা মানুষের। সেটা পরিষ্কার। কিন্তু অত খুঁটিয়েই বা কে শোনে? তার ওপর যখন শব্দটা দেবমূর্তির কাছ থেকে আসছে তখন তাঁকে প্রশ্নই বা করবে কে? সকলেই তাই নতজানু। মর্ফিয়াস নন অবশ্যই।
তিনি তখন আসল কাজে হাত দিয়েছেন। বেশ উঁচু তারে কণ্ঠস্বরকে বেঁধে শুরু করেছেন তাঁর নতুন নাটক।
“হে আদিপুরুষ, আপনার সম্মুখে আমরা নগরবাসী দাঁড়িয়ে আছি অপার শ্রদ্ধা আর বিনম্র আকুতি নিয়ে। আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অকৃতজ্ঞ অমানুষ ব্যবসায়ী বাসিল-ও। সে লোভী, শৃগালের মতন ধূর্ত। এই মন্দির নির্মাণকালে সে স্থপতির সই জাল করে আমার কাছ থেকে অর্থ আদায় যেমন করেছে তেমনি মন্দির নির্মাণে দেখিয়েছে অসহ্য শঠতা। আমাদের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করে সে আমাদের ঠকিয়েছে, প্রভু। শুধু তাই নয়, তার নির্দেশেই সিজার নাম্নী এক খল যুবক আমাদের বোকা বানিয়ে এই মন্দিরকে তার কারিগরি বুদ্ধি দিয়ে কলুষিত করেছে। তাই আমি, এই মন্দিরের নির্মাতা এবং পৃষ্ঠপোষক হিসাবে আপনার কাছে নতজানু হয়ে বিচার চাইছি। আপনিই বলুন প্রভু, কি শাস্তি দেওয়া যায় এই দুই শয়তানকে? উত্তর দিন প্রভু-”
শেষের দিকটায় মর্ফিয়াসের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল। নিজের অভিনয়ে খুশি হয়ে লোকটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল বোধহয়। তাই কয়েক ফোঁটা চোখের জল-ও গড়িয়ে পড়ল তাঁর দু’চোখ বেয়ে।
“চুপ কর শয়তান!”
না, এটা বাসিলের গলা নয়। এ গলার স্বর আসছে দেবতার ঐশ্বরিক উচ্চতা থেকে। কি গম্ভীর! কি ভয়ানক! দেয়ালে দেয়ালে ওই সুরের তরঙ্গ ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরছে বিপদের শমন নিয়ে।
জনতা কয়েক পা পিছিয়ে গেল। মর্ফিয়াস হতবাক। এ কণ্ঠস্বর তো চেনেন না তিনি? তিনি ভয়ে ভয়ে ঢোঁক গিললেন। তবে কি সত্যিই দেবতা জাগরুক? নাকি এ-ও ওই সিজার নামের ছেলেটির কোনও জারিজুরি? যদি তা হয়ও তাহলে সেটাকে প্রমাণ করবেন কীভাবে?
“বিশ্বাস করুন প্রভু—”
মর্ফিয়াসের মরিয়া অনুনয়।
“মিথ্যে! তুই মিথ্যে কথা বলছিস! বাসিল নির্দোষ! সিজার নির্দোষ!”
মেঘনাদ হল আবার।
মর্ফিয়াস হাঁটুমুড়ে বসলেন। তিনি ভয় পেয়েছেন। যে নাটকটা তিনি নিজে হাতে পরিচালনা করবেন বলে ভেবেছিলেন এখন তিনি নিজেই সেই নাটকের বিয়োগান্ত নায়ক হয়ে উঠছেন ক্রমশ। মনে ভয়ের কম্পন জাগছে তাঁর।
“এক্ষুনি বাসিলকে মুক্তি দে। আর সমস্ত জনপদের সামনে নিজের ভুল কবুল কর! নইলে এক্ষুনি আমার অভিশাপে তুই নির্বংশ হবি, কুষ্ঠের ঘায়ে পঁচে পঁচে মরবি ইথাকার পথেঘাটে। সত্যি বল শয়তান, সত্যি বল। এখনও সময় আছে—”
মর্ফিয়াসের শক্ত শরীরটা কুঁকড়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন।
“না প্রভু, না-” হাত জোড় করে ক্ষমাভিক্ষা করলেন মর্ফিয়াস, তারপর উদ্গত কান্না চেপে বললেন, “হে ইথাকাবাসী, আমি পাপিষ্ঠ। আমার পরিকল্পনা আর অর্থেই এই মন্দিরের নির্মাণ। আসলে মানুষ ঠকিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করব ভেবেছিলাম। ঈশ্বরের মাহাত্ম্য দেখিয়ে সেই ঈশ্বরকেই শত্রুবিনাশের চাবি হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। মন্দিরের দানে ঘর ভরাতে চেয়েছিলাম। সিজারকে এনে দায়িত্ব দিয়েছিলাম এমন মায়াজাল তৈরি করতে যাতে মানুষের মনে ভগবানের ভয় আর ভক্তি জাগে। আমায় ক্ষমা করুন আপনারা—”
দর্শকদের একটা দল চোখ পাকিয়ে ছুটে গিয়েছিল লোকটাকে বন্দি করতে। কিন্তু আরেক দল দাঁড়িয়ে ছিল চোখ বড় বড় করে। মূর্তির পিছন থেকে কে বেরিয়ে আসছে ও?
মর্ফিয়াস চোখের জল মুছে তাকালেন। ঝাপসা দৃষ্টিপথে যে সুবেশ সুদৃঢ় পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন হাসিমুখে তাঁকে দেখেই মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন তিনি।
“লুসিয়াস, আমাদের প্রভু, আমি ভেবেছিলাম আপনি আজ আসবেন না—” কান্নার দমকে মর্ফিয়াসের কথা আটকে যাচ্ছিল। ইথাকার সম্রাট লুসিয়াস পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিলেন তাঁর দিকে। তাঁর পিছনে সিজার এবং বাসিল-কন্যা দিমিত্রিয়া। ওদের সঙ্গে রাজ-বাহিনী।
“মহন্ত, ভগবানের নাম নিয়ে আপনি যে ব্যাবসা করবেন বলে ভেবেছিলেন সেটাকে রুখতেই কিছুক্ষণের জন্য নিজেকেই ভগবান সাজতে হল। আশা করি অলিম্পাসের দেবতারা আমায় ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু আপনি যে ভয়াবহ নারকীয় চক্রান্ত করেছিলেন তার ক্ষমা হয় না। অন্তত আমার সভায় তো নয়-ই। তাই আপনাকে শাস্তি দেবার দায়িত্ব আমি ছেড়ে দিলাম ইথাকার সমস্ত মানুষদের হাতে, যাদের বুদ্ধি আর বিবেক নিয়ে আপনি খেলতে চেয়েছিলেন আজ—”
“কিন্তু আমার পরিকল্পনা, সে তো একমাত্র ফিলো—”
একজন প্রহরী রুগ্ন লোকটাকে টেনে নিয়ে এল। লুসিয়াস হাসলেন। “দিমিত্রিয়া ঘোড়ার চেপে ভাগ্যিস আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল। ওর কাছ থেকেই জানতে পারলাম তোমার কু-বুদ্ধির কথা। তারপর সিজারকে মুক্ত করতে গিয়ে জানতে পারলুম ফিলোর লুকিয়ে থাকার গোপন জায়গাটার কথা। তোমার মুখ থেকে সত্যি কথা ওগরাতে তাই ওর বদলে আমিই এপেলোর মুখে কথা যোগালাম শেষ পর্যন্ত-” লুসিয়াস এবার ফিরলেন বাসিলের দিকে। নিজের হাতে তাঁকে মুক্তি দিলেন। সিজারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘোষণা করলেন, “তোমার বুদ্ধিতেই এতবড় একটা সর্বনাশ থেকে মুক্তি পেল সবাই, তাই পুরস্কার হিসেবে তোমাকে দিলাম বাসিলের কন্যাকে বিবাহের অনুমতি। সেই সঙ্গে তোমার হবু শ্বশুরের অর্ধেক সম্পত্তিও তোমার নামে দান করলাম আমি। বাসিল, তোমার এতে আপত্তি নেই তো?”
“ই-ই-ই-ই-ক-” বাসিল হেঁচকি তুলল। পাত্রকে তাঁর যে পছন্দ নয় সেটা নিয়ে কারোর মনেই কোনও সংশয় রইল না। রাজা হাসলেন।
“বাসিলের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে বেজায় খুশি। যাই হোক, পুরস্কারের সঙ্গে সঙ্গে তিরস্কারের ঘোষণাটাও এই বেলা করে যাই, সিজার। যেহেতু তোমার জ্ঞান-বিদ্যে-বুদ্ধি সৎকাজে ব্যবহার না করে তুমি এতগুলো মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছ, তাই আজ থেকে ইথাকা থেকে তুমি নির্বাসিত। ভবিষ্যতে এখানে তোমার পায়ের চিহ্ন পড়লে—”
সিজার মাথা নত করে শাস্তি স্বীকার করে নিল। লুসিয়াস রাজকীয় গাম্ভীর্যে বিচার শেষ করে সপারিষদ মন্দির ছেড়ে চলে গেলেন।
মানুষ অপেক্ষা করছিল। মহারাজের নির্গমনের সঙ্গে সঙ্গে ওদের দলটা এগিয়ে গেল মর্ফিয়াস আর ফিলোর দিকে। যেমনভাবে নেকড়ের দল এগিয়ে যায় শিকারের দিকে। পায়ে পায়ে পিছিয়ে এল মর্ফিয়াস আর তার বশংবদ কর্মচারী ফিলো। তারপর একটা রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে জনতার ঢল ঝাঁপিয়ে পড়ল ওঁদের ওপর।
দুই পাপীর করুন পরিণতি দাঁড়িয়ে না দেখে দিমিত্রিয়ার হাত ধরে সিজার চলল দ্রূতবেগে। সঙ্গে বাসিল। দরজার কাছে এসে থামল ওরা।
“আপনার সম্পত্তিতে আমার দাবি নেই কোনও। আপনি মুক্ত—” সিজার হাতজোড় করে ঘোষণা করল।
“হুঁহ, ঘোড়াটার জন্য—” বাসিল ক্রোধ সম্বরণ করে হাতের তালুতে ঘুসি ছুড়লেন। সিজার হেসে ফেলল। মেয়ের জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন বাসিল। কিন্তু ঘোড়াটার দুঃখ এখনও তিনি ভোলেননি!
“আগেই বলেছি, ঘোড়াটা আমি চুরি করিনি। ও বেচারা পালাতে গিয়ে পথ হারিয়ে আমার কাছে এসে পড়েছিল। বিশ্বাস করুন—”
“যাও, বিশ্বাস করলাম। তবে দিমিত্রিয়া তোমায় ভালোবাসে, ওকে ঠকিও না যেন।” বাসিল ক্ষনিকের জন্য নরম হলেন যেন। তারপর হনহন করে বাড়ির পথ ধরলেন। দিমিত্রিয়া আর সিজার নীরবে চোখাচুখি করল। তারপর ওরা-ও হারিয়ে গেল অন্ধকারে।
সাত
ছলাৎ… ছলাৎ… ছলাৎ…
মাঝি দুটো দাঁড় টানছিল। রাতের অন্ধকারে কাঠের চ্যাপটা ডগায় ঢেউগুলো মুক্তো ছড়িয়ে ভেঙে পড়ছিল। সে দিকে চেয়ে থুতনিতে হাত দিয়ে বসেছিল দিমিত্রিয়া। ওর চোখদুটো সজল। ঠোঁটদুটো কাঁপছে। যে পুরুষকে মাত্র কয়েক দিনের পরিচয়ে হৃদয় দিয়ে বসেছিল সে-ই আসলে বিপদ হয়ে আছড়ে পড়েছিল তার সংসারে। বিদ্বান হয়েও মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে মর্ফিয়াসের হাতে তুলে দিয়েছিল অখন্ড শক্তির আধার। ভুল বুঝে সেই মানুষটাই আবার নিজের জীবন বিপন্ন করে মর্ফিয়াসকে কুপোকাত করার পরিকল্পনা এঁটেছে। কিন্তু যে মানুষটার এত বিদ্যা আর বুদ্ধি, সে কেন করবে এমন কাজ? যার হাতের জাদুতে ঈশ্বরের মহিমা ফুটে উঠতে পারে মানুষের চোখের সামনে, সে কেন এমন ভাবে মানুষের বোধবুদ্ধি নিয়ে ছেলেখেলা করবে? অথচ সেই মানুষটাকেই সে হৃদয় দিয়ে ফেলেছে। এখন তার হাত ধরেই সে পাড়ি দিয়েছে দূর দেশের উদ্দেশে। মনের মধ্যে কেমন একটা নাড়ি ছেঁড়া টান অনুভব করছিল মেয়েটা।
চুপ করে বসেছিল সিজার নামের যুবকও। ক্ষমা চাইবার সাহস নেই তার। শৈশবে শেখা সমস্ত বর্ণমালাগুলো কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে তার মস্তিষ্কে। নিজেকে মর্ফিয়াসের চাইতেও অনেক বেশি অপরাধী বলে মনে হচ্ছে তার। কত শহরের কত মন্দিরে আজও তার কারিগরিতে মানুষ চমৎকৃত হচ্ছে, ভুল বুঝছে, প্রতারিত হচ্ছে। সে পাপের শাস্তি কে-ই বা দেবে তাকে? নতুন আবিষ্কারের আনন্দে দেবতার মূর্তির আড়ালে সে নিজেই কত রাক্ষসের জন্ম দিয়েছে, তাদের বিনাশ সে করবে কীভাবে? দিমিত্রিয়ার নীরব ভর্ৎসনাটা তাই শাস্তি হিসাবে মাথা পেতে নিয়েছিল ছেলেটি। তবে, হাতের মুঠোয় মেয়েটির হাত ধরতে ভোলেনি সে। মনে হয়তো ভয় ছিল, ওই বন্ধনটুকু না থাকলে মনের মানুষটাকে সে হারিয়ে ফেলবে এই তমসায় মোড়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে। সে চুপ করে চেয়েছিল আকাশের দিকে। মিটিমিটি জ্বলতে থাকা নিঝুম তারাগুলোর কাছে হয়তো ক্ষমা চাইছিল সে।
“একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল, তোমার নামটা, ওটাও কি মিথ্যে?” দিমিত্রিয়া অবশেষে মুখ খুলল। স্বরে কান্নার ওঠানামা।
“আমার সমস্ত পরিচয়ই মিথ্যে। কাজটাই এমন—”
“তোমার আসল নাম কি?”
“হেরন—”
মেয়েটি সোজা হয়ে বসল। চাঁদের আলোয় তার উজ্জ্বল চোখদুটোকে বর্ষাস্নাত দীঘির মতন দেখতে লাগছে যেন।
“ত-তু-মি- আলেক্সান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বিজ্ঞানী, স্থপতি হেরন!”
ছেলেটি চমকে উঠল। সে যে আসল নামেই যথেষ্ট বিখ্যাত, এই ধারনাটাই তার ছিল না এতদিন। সে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দিমিত্রিয়াকে চুপ করার ইঙ্গিত দিল।
“আমার খুব একটা খ্যাতি নেই তো, তাই—” যুবক মাথা নীচু করে ফিসফিসিয়ে ব্যাখ্যা করল। তার কারিগরি যে আরও অনেকে খারাপ কাজে ব্যবহার করেছে সেটা বুঝতে দেরি হল না দিমিত্রিয়ার।
“কেন করতে ওসব?”
“প্রথমে আনন্দে, অপরের অনুরোধে, তারপর ভয়ে এবং এখন করি লোভে। সোনার লোভে। স্বপ্ন দেখি, এক সময় ঘর বাঁধবো মনের মানুষের সঙ্গে। দিন রাত গণিত নিয়ে মগ্ন থাকব, বিজ্ঞানের নানা পথে হেঁটে বেড়াব স্বচ্ছন্দ্যে। তাই—”
“কিন্তু এখন—”
“না, আর নয় দিমিত্রিয়া। সব পিছনে ফেলে নতুন পরিচয়ে বাঁচতে চাই। অর্থের অভাব নেই। তাই বাকি জীবনটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই—”
দিমিত্রিয়া এগিয়ে এল একটু। হেরন-এর আরেকটা হাত নিল নিজের হাতে।
“কি করবে বলে ভেবেছ?”
“মানুষকে গল্প শোনাব!”
“পারবে?”
“আমি না পারি, আমার যন্ত্ররা পারবে দিমিত্রিয়া। বিজ্ঞানের কিছু সহজ সরল সূত্র, একটা তার, দুটো চাকা, কয়েকটা চরিত্র- ওভাবেই তো এতদিন দেবতা বানিয়েছি। এতদিন তো ওরাই গল্প শুনিয়ে এসেছে, ভয়ের গল্প, ভগবানের গল্প। এবার থেকে ওরা শোনাবে ইথাকার গল্প। মহাযুদ্ধের মহানায়কের গল্প। সমুদ্রের গল্প। পাহাড়ের গল্প। এ পৃথিবীর গল্প। শিশুরা হাসবে, বড়রা অবাক হবে। ওদের মুখে হাসি ফুটবে। কি বল দিমিত্রিয়া, পারব না?”
অন্ধকারে মেয়েটা আরও কাছে ঘেঁষে বসল হেরণের। কাঁধে মাথা রাখল।
“পারতেই হবে—” ফিসফিসিয়ে বলল বাসিল কন্যা দিমিত্রিয়া। তারপরেই অবশ্য উঠে বসল।
“কিন্তু আমার বাবার ঘোড়াটা চুরি করেছ, তার জন্য কিন্তু তোমায় ক্ষমা করছি না—”
“ওরে বাবা, কতবার বলব। ওটা ইচ্ছাকৃত নয়। বুড়োর ঘোড়াটা পালিয়ে গেসল। আমি যখন দীঘির ধারে পথ খুঁজে মরছি, তখন দেখলাম প্রাণীটা আমার দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। অবলা জন্তুটাকে একলা ফেলে পালিয়ে আসবো? তাই ওকে নিয়ে ফিরলুম গ্রামে। তারপর তো আর বুড়োকে খুঁজেই পাই না আর—”
“তোমার কথা বিশ্বাস করলাম না!” দিমিত্রিয়া ঠাট্টা করে মুখ ঝামটা দিল। আত্মরক্ষায় ছদ্ম তর্কে নামল হেরণ। শিশুদের মতন কলকলিয়ে উঠল ওরা দুজনায়। ওদের গুনগুনানি আর ফিসফিসানি সমুদ্রের হাওয়ায় ভেসে গেল এক নতুন সূচনার বার্তা নিয়ে।
পুনশ্চ:
‘হেরন অব আলেক্সান্দ্রিয়া’ নামের তুমুল বিখ্যাত স্থপতি, গণিতজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীর জীবন নিয়ে গল্পটি লেখার সাধ অনেকদিন ধরেই ছিল। কিন্তু ভদ্রলোকের জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্য নয়, আমায় আকর্ষণ করেছিল তাঁর জীবনের পথ। যে মানুষটির একটি আবিষ্কার অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায় আমাদের সভ্যতা প্রায় দেড় হাজার বছর পিছিয়ে গিয়েছিল তিনি তো অসাধারণ মেধা আর ব্যুৎপত্তির আকর তো হবেনই। অথচ দেখুন তাঁর হাত দিয়েই তৈরি হয়েছিল এমন অনেক কারিগরি যেগুলোকে একদা বিখ্যাত রোমান মন্দিরে ব্যবহার করা হত লোক-ঠকানো জাদু-যন্ত্র হিসাবে। মানুষের ভাগ্য আর নিয়তিকে নিয়ে কি নির্মম খেলা শুরু হয়েছিল ধর্মের আড়ালে রেখে সেটা ভাবলেও চমকে উঠতে হয়। সেই মানুষটি একদিন সব কিছু ছেড়ে বানালেন ‘স্টেটন’ নামের স্বয়ংক্রিয় থিয়েটার। ভাবা যায়? তাই, শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবেই এই মনগড়া গল্পে ধরতে চাইলাম তাঁর পরিবর্তনের ধারাপথ। শুভমস্তু।
Tags: পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পৌরাণিক, বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, রনিন
প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার আবহে বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান, ধর্ম, রাজনীতির সূক্ষ্ম গ্রন্থিগুলো জাল বুনেছে আখ্যানের শরীরে। নির্মেদ গদ্যে এই গল্প এমন কিছু দ্বন্দ্বের উপস্থাপনা করেছে যা এই আবছায়া সময়েও খুব গুরুত্বপূর্ণ। লেখকের কাছ থেকে এমন আরো গল্প পড়তে চাই। চরৈবেতি …