অনুভূতিদের শীর্ষবিন্দু
লেখক: ইমন চৌধুরী
শিল্পী: রনিন
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় শান্তনুর, প্রায় অন্ধকার কম্পার্টমেন্ট, শীতের রাত, সকলেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে, শুধু একটানা ট্রেনের শব্দ আর ঝাঁকুনি, বাথরুমের কাছে হলুদ আলোটা জ্বলছে, ঘুম চোখে সেই আবছা আলোয় সবকিছু কেমন মায়াবী লাগে শান্তনুর।
সর্বোচ্চ গতিতে ট্রেনটা ছুটছে, শান্তনুর মনে পরে সে যখন ঘুমিয়েছিল তখন ট্রেনটা দাঁড়িয়েছিল। কটা বাজছে এখন? পকেটে হাতড়ে মোবাইল বের করে সে, এগারোটা। আহ্ সবে এগারোটা, এতক্ষণ ঘুমের ঘোরে সে ভেবেছে কতই না রাত বুঝি। শিয়ালদা থেকেই ট্রেনটা লেট, এতক্ষণে হয়তো সবে বর্ধমান ছেড়েছে। নিজের মনেই হেসে ওঠে শান্তনু। জল তেষ্টা পেয়েছে বেড থেকে ঘাড় ঝুঁকিয়ে শান্তনু মিডল বার্থে বিদিশাকে ডাকে। “এই শুনছো! জলের বোতলটা দাও না একটু!”
কই বিদিশা তো নেই বার্থে। নিশ্চয় বাথরুমে গেছে, আসুক। কাঁথাটা মাথা অবধি টেনে নিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে শান্তনু। এবারে কিন্তু আর ঘুম আসে না। একটু পরেই আবার সে নিচে তাকায়, বিদিশা এখনও ফেরেনি, এমন করেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। শান্তনু আবার পকেট থেকে মোবাইল বের করে, সারে এগারোটা, মানে বিদিশা আধ-ঘণ্টা ধরে নেই। মনের মধ্যে হঠাৎ কু-ডেকে ওঠে, ধড়মড় করে উঠে বসে শান্তনু। গলা বাড়িয়ে একবার দু-দিকেই তাকায়, সারিবদ্ধ শয্যার মধ্যে দিয়ে অন্ধকার গলিপথ এগিয়ে গেছে, কেউ কোথাও নেই। এবারে আর অপেক্ষা না করে বেড থেকে নেমে পরে শান্তনু। ডানদিকের বাথরুমটাই কাছে, জুতোয় পা গলিয়ে শান্তনু সেদিকেই হাঁটতে থাকে, চলার পথে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে শান্তনু হেলে পড়ছিল একবার বাঁ দিকে একবার ডানদিকে।
বাথরুম অবধি যেতে হয় না দরজার কাছে পৌঁছাতেই বাঁদিক থেকে শান্তনুর গায়ে ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগে, বাঁদিকের দরজা খোলা, খোলা দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বিদিশা। এই রাত্রে এমন করে চুপ করে দরজার সামনে বিদিশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন ভয় পেয়ে যায় শান্তনু। “বিদিশা… এখানে কি করছো?”
বিদিশা শুনতে পায়নি, সে তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে শান্তনু, দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে এবারে সে একটু জোরেই ডাকে, “বিদিশা দরজাটা বন্ধ কর, ঠান্ডা লাগবে।”
এবারে বিদিশা ফিরে তাকায়, ওর ঠোঁটে অল্প একটু হাসি ফুটে ওঠে, এই হাসি দেখে অজানা আতঙ্কে শান্তনু শিউরে ওঠে, আর বিদিশা ঠিক তখনই খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ট্রেন তখন অজয় নদের ব্রিজের উপর উঠেছে, ঝমঝম ঝমঝম শব্দ হচ্ছে, জল নেই, নদী জুড়ে শুধু বালি আর বালি।
তীক্ষ্ন চিৎকার করে লাফিয়ে বিদিশাকে ধরতে গেছিল শান্তনু, পারেনি। এখন সে ট্রেনের দরজার সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
একটু পরেই ট্রেনের গতি কমে আসে। একবার হুইসলের আওয়াজ হয়। বোলপুর স্টেশনে ঢুকছে আপ শিয়ালদা-আলিপুরদুয়ার কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস।
প্রেমিক-প্রেমিকা এত রাতে এই ট্রেনটার জন্যেই নিঃসঙ্গ বোলপুর স্টেশনে অপেক্ষা করছিল, ওদের একটা টিকিট কনফার্ম হয়েছে অন্যটা আরএসি। স্টেশনে ট্রেন থামতেই ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে উঠতে গিয়ে দরজার সামনে পরে থাকা শান্তনুর গায়ে পা দিয়ে ফেলে ওরা, মানুষটার তবু কোন সাড়া নেই, হইচই শুরু হয়, পাশের কামরা থেকে হিন্দিভাষী আরপিএফ জওয়ান আসে।
শান্তনুর চোখেমুখে জল দেওয়া হয়, ওর জ্ঞান ফিরে আসে। ততক্ষণে সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেছে, হেলতে দুলতে ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে, শান্তনু হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে ছুটে যায় দরজার দিকে, “দাঁড়াও… দাঁড়াও…” ওর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে আরপিএফ নিজেই চেন টেনে ট্রেন দাঁড় করায়, হ্যাঁচকা টানে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ট্রেন দাঁড়িয়ে যায়।
স্টেশনে হুড়োহুড়ি পরে যায়, স্টেশন মাস্টার স্ট্যান্ড বাই আরপিএফ বাহিনীর সঙ্গে কামরায় ছুটে আসেন।
শান্তনুর কাহিনি সংক্ষেপে শোনার পর ওকে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনা হয়, প্রেমিক প্রেমিকার টিকিট কনফার্ম হয়ে যায়।
মধ্যে রাতে শান্তনুকে গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় সেই জায়গায়, যেখানে অজয় নদের ব্রিজ শুরু হয়েছে, পরবর্তী ট্রেনের চালককে সতর্ক করা হয়। লম্বা লম্বা আলোর রেখা এসে পরে অজয় নদের সাদা বালির উপর, তবু কুয়াশায় বেশিদূর দৃষ্টি যায় না।
শান্তনু বালির উপর হাঁটু মুড়ে বসে চিৎকার করে কাঁদছিল, “বিদিশা…।” ব্রিজের উপর দিয়ে একটা ডাউন কয়লা বোঝায় মালগাড়ি হেলতে দুলতে ঝমঝম শব্দে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
(২)
শুধু সেই রাতেই নয় পরেরদিন সকাল থেকে হন্যে হয়ে খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না বিদিশাকে, কোন চিহ্নই নেই। মানুষটা সম্পূর্ণ উবে গেছে। যন্ত্রণায় কাতর শান্তনুকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল, অপ্রীতিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল।
পুলিশের খাতায় বিদিশা ঘোষের নামের পাশে লেখা হল ‘নিখোঁজ’।
কিছুদিন পরের ঘটনা।
অনিমেষ মজুমদার, বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার উচুপদের কর্মচারী, ডিভোর্সি। সল্টলেকে ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। অফিসপার্টিতে প্রচণ্ড ড্রিংক করেছিলেন ভদ্রলোক, নিজে গাড়ি চালিয়ে ফিরতে পারেননি, মধ্যেরাতে সহকর্মীরা ওকে বাড়িতে ড্রপ করে যায়, ‘অনিমেষদা ঠিক আছো তো?’ অনিমেষ হাত তোলে, ‘“রফেক্ট… সি ইউ ইন অফিস টুমরো…।” মদ খেলে অনিমেষের মুখ দিয়ে ইংরাজি ছাড়া কিছু বেরোয় না। অফিসের লোকজন জানে, ভদ্রলোক কাল সকালে ঠিক নটার মধ্যে অফিসে পৌঁছে যাবে। তখন আর ওকে দেখে বোঝাই যাবে না যে আগের রাতে সে নেশায় বেহুঁশ হয়ে বারের টেবিলে পরেছিল।
কিন্তু এমনটা হল না। অনিমেষ মজুমদার পরের দিন অফিস গেলেন না। অফিসের সহকর্মীরা ওকে ফোন করেছিল অনেকবার, কেউ ধরেনি ফোন। পরের দিন বিকালে অফিসের লোকজনই ওর ফ্ল্যাটে আসে, দরজা বন্ধ। দারোয়ান জানায় ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরোন নি। গ্যারাজে ওর গাড়িও দেখা যায়। অনেকবার দরজা ধাক্কা দিয়েও কোন লাভ হল না। পুলিশকে খবর দেওয়া হল।
দরজা ভাঙার পর ভিতরে ঢুকে দেখা যায়। সবকিছু সাজানো আছে, টেবিলে পরে আছে মোবাইল, মানিব্যাগ, বিছানার একপাশে ল্যাপটপ, দরজা জানালা বন্ধ, এসি চলছে, ঘরের তাপমাত্রা বাইশ। সবই আছে শুধু মানুষটা নেই। কোন চিহ্নই নেই। বাথরুমের কল থেকে টপ্টপ্ শব্দে একটানা জল পড়ছে, বালতি উপচে পড়ছে।
নাহ্ ঘরের কোথাও অনিমেষ মজুমদার নেই। সাতদিন কেটে গেল ওর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। পুলিশের খাতায় অনিমেষ মজুমদারও নিখোঁজ হলেন।
আরও কিছুদিন পরে তৃতীয় ঘটনাটা ঘটল রামপুরহাটে।
কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী দীপান্বিতা। সন্ধ্যাবেলা মোবাইল হাতে ছাদে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিল। কিছুক্ষণ পরে মা ওকে চা খাওয়ার জন্যে নিচে ডাকতে এসে দেখে ফাঁকা ছাদ কেউ কোথাও নেই, “দিপা… কোথায় গেলি রে…।” কেউ উত্তর দেয় না। সন্ধে পেরিয়ে রাত হয়। বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু হয়।
দীপান্বিতারও আর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। মেয়েটা ছাদ থেকে কর্পূরের মতো উবে গেল, নেই মানে কোথাও নেই। যে বন্ধুর সঙ্গে সে শেষ কথা বলেছে, সেই বন্ধু বলেছে রনবীর কাপুরের নতুন সিনেমা নিয়ে কথা হচ্ছিল ওদের মধ্যে, দীপান্বিতা রনবীরের ফ্যান ছিল।
(৩)
স্ত্রীর মৃত্যুর পরে অম্বরিষ হারিয়ে গেছিল, দীর্ঘদিন কারোর কাছে অম্বরিষের কোন খবর ছিল না। ডিপার্টমেন্ট থেকে অম্বরিষকে খোঁজার চেষ্টা করাই যেত, কাজটা তেমন কঠিনও ছিল না। কিন্তু ডিআইজি সাহেব বলেছিলেন, “থাক্ খোঁজার প্রয়োজন নেই। যদি ফেরার হয় ও নিজেই একদিন ফিরে আসবে।”
ডিআইজির কথা সত্যি প্রমাণ করে অম্বরিষ সত্যিই নিজে নিজেই ফিরে এসেছিল। কেউ ওকে ফিরিয়ে আনেনি। ডিআইজির কড়া নির্দেশ ছিল, ওকে যেন কেউ জিগ্যেস না করে যে সে এতদিন কোথায় ছিল, কি করেছে। ফিরে আসার পরে অম্বরিষকে কোন বিড়ম্বনাকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। কেউ ওকে তেমন ঘাঁটাত না, নিজের কেবিনেই প্রায় সারাটা দিন চুপ করে বসে থাকত সে।
এই অম্বরিষের মোবাইলেই এক রবিবার রাত্রে ডিআইজি বিকে শর্মার নাম্বার ফুটে ওঠে। শুয়েই পড়েছিল অম্বরিষ ঘুম চোখেই ফোন ধরে সে।
—ইয়েস স্যার।
—অম্বরিষ, কাল সকাল নটার সময় আমাকে রিপোর্ট করবে।
—ইয়েস স্যার।
ফোন কেটে যায়।
বহুদিন পরে এই ভারী কণ্ঠস্বর শুনে অম্বরিষের হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়। সারারাত আর ঘুমই আসে না।
ন-টা মানে ঠিক ন-টা, দু-মিনিট আগেও নয়, পরেও নয়।
ডিআইজির কেবিনে ঢুকে স্যারের সামনে দাঁড়ায় অম্বরিষ, স্যালুট করে।
—মর্নিং স্যার।
একটা ফাইলে কিছু দেখছিলেন ভদ্রলোক, চশমার ফাঁক দিয়ে অম্বরিষের দিকে তাকান একবার, “সিট-ডাউন মাই বয়।”
অম্বরিষ বসে পড়ে।
মিনিট পাঁচেক পরে ফাইল বন্ধ করে অম্বরিষের দিকে তাকান ডিআইজি।
—তোমার জন্যে একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে। খুব গোপনীয় আর ততটাই ক্রিটিক্যাল।
—স্যার।
ডিআইজি সাহেব অম্বরিষকে বিদিশা থেকে দীপান্বিতা তিনটে নিখোঁজ হওয়ার কেস খুব সংক্ষেপে বলেন, তারপর হাতের ফাইলটা ওর দিকে এগিয়ে দেন।
অম্বরিষ চুপ করে বসে আছে, সে জানে এখনও স্যারের কথা শেষ হয়নি।
টেবিলে চশমাটা খুলে রেখে উনি মাথাটা চেয়ারে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবেন তারপর হঠাৎ একেবারে সোজা হয়ে বসেন।
—অম্বরিষ, মানুষগুলো সত্যিই অদৃশ্য হয়ে যায়নি তো?
চমকে ওঠে অম্বরিষ। টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে রুমালে কাচটা একবার মুছে চশমাটা পরে নেন ভদ্রলোক।
—পিএমও থেকে চিঠি এসেছে, চার সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যকে ইনভেস্টিগেট করে জানাতে হবে, এই ঘটনাগুলোর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আছে কিনা।
অম্বরিষ হতবাক হয়ে যায়, পিএমও থেকে তিনটে নিখোঁজ কেসের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আছে কিনা খোঁজ করতে বলা হয়েছে, এ তো অসম্ভব ঘটনা। “স্যার আমার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে, পিএমও অবধি এই খবর পৌঁছল কী করে?”
ডিআইজির ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
—অবশ্যই স্টেট থেকেই কেউ জানিয়েছে, কোনও অফিশিয়াল গোপনে জানাতে পারে, অথবা এর মধ্যে পলিটিকাল ইন্টারেস্ট থাকাও অস্বাভাবিক নয়। যে তিনটে ঘটনার কথা বললাম তা ছাড়াও গত একমাসে আরও অন্তত দুটো ঘটনা ঘটেছে এই রাজ্যে, যেখানে পুলিশ বুঝতেই পারেনি কোনও চিহ্ন ছাড়াই কীভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল মানুষগুলো। সরকার থেকে স্ট্রিক্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এই ঘটনাগুলো মিডিয়ার হাইলাইটে না আনতে।
অম্বরিষ কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। ডিআইজি অল্প সময়ের বিরতি নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন।
—আগেই বলেছি অ্যাসাইনমেন্টটা সিক্রেট, তোমার কাজ লোকগুলোকে খুঁজে বের করা নয়, তোমার কাজ ওরা নিখোঁজ হয়েছে এইটুকু নিশ্চিত করা।
অম্বরিষ যেন এখনও কথাগুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। বি কে শর্মা বাজে কথা বলার লোক নন, ভদ্রলোক যুক্তি ছাড়া একটা শব্দও উচ্চারণ করেন না, ওর মুখে এমন ভূতুড়ে কথা শুনে অম্বরিষের সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেছে! কী এমন হয়েছে যার ফলে মেনে নিতে হবে যে জলজ্যান্ত মানুষ নিখোঁজ না হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে?
অম্বরিষকে এমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিকে শর্মা যেন বুঝতে পারেন ওর মনের ভাব।
—দেখো অম্বরিষ, আমি কেসগুলো স্টাডি করে যেটুকু বুঝেছি তাতে ঘটনাগুলো একদম সহজ সরল নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার গল্প নয়। তবু এখনও এটাই বিশ্বাস করি যে মানুষগুলো মোটেই অদৃশ্য হয়ে যায়নি। কিন্তু যদি আগামীকাল মিডিয়ার হাতে এই খবর পৌঁছায়, তবে তার ফল হবে ভয়াবহ। ইলেকট্রনিক মিডিয়া জ্যান্ত মানুষকে আজকে ভ্যানিস করে কালকে ফিরিয়ে এনে সাক্ষাৎকার নিয়ে নেবে, সমাজে প্রচণ্ড অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। আমাদের তার আগে যুক্তি তৈরি রাখতে হবে।
অম্বরিষ এবারে যেন একটু একটু করে বুঝতে পারছে তার কর্তব্য।
—কেসগুলোর ইন্ডিভিজুয়াল তদন্ত যেমন চলছে চলবে, তোমার কাজ হবে কেসগুলোর মধ্যে কোনও লিঙ্ক আছে কিনা সেটা খুঁজে বেড় করা। তুমি সরকারি সহায়তা পাবে, কিন্তু সরকারের খুব কম লোকই জানবে তোমার আসল উদ্দেশ্য। একটা কথা মনে রাখবে কেউ যেন এতটুকু আঁচ না পায় যে এমন একটা ইনভেস্টিগেশন শুরু করা হয়েছে। খুব কম সময়ের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ করতে হবে। কেস সম্পর্কিত সমস্ত ফাইল আমি তোমার কেবিনে পাঠিয়ে দেবো। তুমি ডিরেক্টলি আমাকে রিপোর্ট করবে।
—স্যার।
অম্বরিষ উঠে দাঁড়ায়।
—একটা কথা মনে রাখবে অম্বরিষ, আমার অভিজ্ঞতা বলছে ঘটনাগুলো স্বচ্ছ নয়, তোমাকে স্বচ্ছ করতে হবে। কিন্তু যত দেরি হবে, তত সবকিছু আরও অস্বচ্ছ হয়ে যাবে। তখন আর কিছুতেই সত্যি মিথ্যাকে পৃথক করা যাবে না।
(৪)
তিনটে ঘটনার কথা ডিআইজি বলেছেন, বাকি দুটো ঘটনার কথা অম্বরিষ ফাইলে পড়ে জানতে পারে।
দক্ষিণেশ্বরে এক বস্তিতে বরের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল স্ত্রী, ঘণ্টাখানেক পরে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখা যায় কেউ নেই, ঘর শূন্য। দু-দিন পরে থানায় ডায়েরি করা হয়। এই ঘটনা মিডিয়া অবধি পৌঁছায় নি।
আরেকটা ঘটনা চুঁচুড়ার, রাত্রে স্বামী স্ত্রী এক সঙ্গে শুয়েছিল, সকালে উঠে স্ত্রী খেয়াল করে স্বামী নেই বিছানায়, বাড়ির সব দরজা বন্ধ, কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। এক্ষেত্রেও স্ত্রী একদিন পরে থানায় ডাইরি করেছিল, সে বুঝতেই পারেনি তার স্বামী নিখোঁজ হয়ে গেছে, আর কখনও ফিরবে না। এই ঘটনাও এখনও মিডিয়ায় আসেনি।
অম্বরিষ চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে, একমাসের মধ্যে এই পাঁচটা ঘটনা ঘটেছে। খুঁটিয়ে পড়ার পরে অম্বরিষেরও খুব সহজ লাগে না ঘটনাগুলো। কোথা থেকে শুরু করবে সে? ফাইলগুলো সরিয়ে রেখে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাবে অম্বরিষ, একেবারে প্রথম থেকেই শুরু করা উচিৎ।
শান্তনু ঘোষের পাসপোর্ট সাইজ ছবিটা হাতে নিয়ে ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে অম্বরিষ। গায়ের রং ময়লা, কোঁকড়ানো চুল, ঠোঁটের উপর পাতলা একটা গোঁফের রেখা, লোকটার দৃষ্টির মধ্যে একটা দৈনতার ছাপ আছে। দেখেই মনে হয় এই মানুষটা সুখী নয়।
সন্ধের কিছু আগে অম্বরিষ শান্তনু ঘোষের বাড়ি পৌঁছায়। অযত্নে বেড়ে ওঠা একটা একতলা বাড়ি, খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় বহু বছর আগে কোন এক সময় বাড়িটার রং নীল ছিল, এখন বাড়ির দেওয়ালগুলো ধুসর বর্ণ ধারণ করেছে, ছাদের ফাটল থেকে অশ্বত্থ গাছ গজিয়েছে, কোন কোন অংশের প্লাস্টার খসে পড়ে ইট বেড়িয়ে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে অম্বরিষ বাড়িটার দিকে চেয়ে থাকে। বিদিশার বাবা মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার জন্যে শান্তনুকে দায়ী করেছেন, বেশ কিছুদিন হাজতে ছিল শান্তনু। কেস চলছে, এখন সে জামিনে মুক্ত, একটা ওষুধের দোকানে কাজ করত শান্তনু, কাজটা আর নেই।
কলিংবেলে চাপ দেয় অম্বরিষ, কোন শব্দ হয় না। সুইচটা খারাপ হয়ে গেছে। অনেকবার দরজায় ধাক্কা দিলে দরজার ওপারে মানুষের পায়ের শব্দ শোনা যায়।
—কাকে চাই?
—শান্তনু ঘোষ।
কাটা কাটা শব্দে উত্তর দেয় অম্বরিষ। পায়ের শব্দ আবার ভিতর ঘরে মিলিয়ে যায়, আবার দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করে অম্বরিষ, এবারে আরও জোরে। আরও কিছুক্ষণ পরে পায়ের শব্দ ফিরে আসে। অম্বরিষ বুঝতে পারে, লোকটা দরজার অন্যপ্রান্তে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
—দরজা খুলুন, পুলিশ।
খুলে যায় দরজা। একটা কঙ্কালসার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, লোকটাকে ছবির সঙ্গে মেলাতে পারে না অম্বরিষ, ধ্বংসস্তূপ উঠে আসা কোন মানুষ যেন সে।
দুটো কাঠের চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছে অম্বরিষ আর শান্তনু। একটু আগে শান্তনুর বাড়ির ঘরগুলো ঘুরে দেখেছে অম্বরিষ, সারা বাড়ি জুড়ে একটা হাহাকার ছড়িয়ে আছে, ঘরে ঢুকেই বোঝা যায় এই ঘরে কষ্ট জমে আছে, এই কষ্ট চিনে নিতে অসুবিধে হয়না অম্বরিষের, নিলাঞ্জনা চলে যাওয়ার পর থেকে ওর নিজের বাড়িতেও একই রকম কষ্ট জমেছে। নিজের অজান্তেই শান্তনুর চোখের মধ্যে অম্বরিষ নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করে।
—প্রথম কবে বিদিশা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল?
—সঞ্জয় যেদিন মারা গেছিল সেই দিন।
এক সপ্তাহের জ্বরে বিদিশা আর শান্তনুর পাঁচ বছরের সন্তান সঞ্জয় মারা গেছিল। সেই রাতেই বিদিশা বিষ খেয়েছিল।
—শেষ কয়েকদিনে আপনি কি বিদিশার মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছিলেন?
শান্তনু বিরক্ত হয়।
—একই প্রশ্নের একই উত্তর আর কত বার দেব স্যার? কেন এমন আশা করেন আপনারা যে একাধিকবার জিগ্যেস করলে আমি একাধিক উত্তর দেব?
অম্বরিষ চুপ করে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ সে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসে, প্রশ্নটা করে সে নিজেই চমকে যায়।
—বিদিশা এই কয়েকদিন আপনার সঙ্গে কোনভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে?
শান্তনু যেন প্রশ্নটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, কেমন ঘোলাটে চোখে সে চেয়ে থাকে, “মানে?”
—বলতে চাইছি কোনভাবে এই কয়েকদিনে আপনি কি আপনার স্ত্রীর অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরেছেন?
—স্যার আপনি কি মস্করা করছেন আমার সঙ্গে? খুব তীক্ষ্ন স্বরে উত্তর দেয় শান্তনু।
একরাশ ঘৃণা মাখানো দৃষ্টিতে শান্তনু তাকিয়ে আছে, অম্বুরীশ আবারও চুপ করে যায়।
শান্তনু অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছে, যেন অম্বরিষের অস্তিত্বই অস্বীকার করতে চায় সে। আরও একটু পরে খুব শান্ত স্বরে অম্বরিষ বলে, “শান্তনুবাবু, আপনার সঙ্গে যা ঘটেছে তারপর সমবেদনা জানানোর কোন ভাষা নেই, এটুকু বলতে পারি আমি সমব্যাথী, বিচারের পথ খুব সূক্ষ্ম তবে আমি নিশ্চিত আপনি খুব তাড়াতাড়ি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন, কিন্তু তার জন্যে আপনার সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন।”
“নির্দোষ?” হঠাৎ হো হো করে অট্টহাস্য করে ওঠে শান্তনু।
আকস্মিক এই হাসি একটা ধাক্কা দেয় অম্বরিষকে।
“স্যার, আমি নির্দোষ নই, মিথ্যেবাদী। বিদিশাকে আমিই ঠেলে ফেলে দিয়েছি ট্রেন থেকে…” হাসি না থামিয়েই বলে ওঠে শান্তনু। অম্বরিষ উঠে এসে শান্তনুর কাঁধে হাত রাখে, এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দেয় শান্তনু, হাসি থামিয়ে সে চিৎকার করে ওঠে, “হ্যাঁ আমিই খুন করেছি, ঠেলে ফেলে দিয়েছি, অ্যারেস্ট করুন আমাকে, আমি সব স্বীকার করবো।” কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে অম্বরিষ, এই সময়েই মেঝেতে লুটিয়ে পরে শান্তনু, হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সে, “আমাকে অ্যারেস্ট করুন স্যার। আমি এখানে বাঁচতে পারব না। এই যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচা যায় না, এই ঘরে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে স্যার, আমি মরে যাব, সুইসাইড করে বসবো, আমাকে জেলে নিয়ে যান স্যার… নইলে গুলী করে মেরে দিন।”
অম্বরিষ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিলাঞ্জনার মৃত্যুর পরে অম্বরিষ এভাবেই কেঁদেছিল সম্ভবত, পালিয়ে যেতে চেয়েছিল দূরে কোথাও, কি প্রচণ্ড মিল ওর সঙ্গে শান্তনুর। অম্বরিষও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, শান্তনু কি আত্মহত্যা করবে? জীবন কি প্রচণ্ড কঠিন! মনোবিদের সঙ্গে কথা বলবে অম্বরিষ, এই বাড়িতে এই মানুষটা কিছুতেই বাঁচতে পারবে না, ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে, শান্তনুকে ধরে ধরে চেয়ারে বসায়, সে জল এনে দেয়। “শক্ত হতে হবে শান্তনুবাবু, জীবন থেমে থাকে না। আপনি না চাইলেও মরতে আপনাকে হবেই, তার জন্যে তাড়াহুড়ো করে কি লাভ, বেঁচে থাকাটাই আসল। সময় সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে, বিশ্বাস রাখুন।”
শান্তনুর বাড়ি থেকে বেড়তে বেশ রাত হয়ে যায়, পুলিশের লোক হিসেবে শান্তনুকে এত কথা বলার প্রয়োজন ছিল না অম্বরিষের। মানুষের আবেগ নিয়ে এতো অনুভুতিপ্রবণ হয়ে পরলে পুলিশের চাকরি করা যায় না, কি যে হয়ে যায় অম্বরিষের মাঝে মাঝে। এই জন্যেই ও চাকরিক্ষেত্রে তেমন উন্নতি করতে পারেনি।
(৫)
পরেরদিন ভোরবেলায় বেড়িয়ে পরে অম্বরিষ, দীপান্বিতার বাড়ি যাবে, রামপুরহাট লং জার্নি, একই দিনে ব্যাক করবে সে, আগামী কাল সকালে প্রোগ্রেস রিপোর্ট দিতে হবে ডিআইজিকে, পিএমও থেকে চিঠি এসেছে মানে ইট ইজ অলরেডি লেট।
লোকাল থানার ওসিকে নিয়ে দুপুর নাগাদ দ্বীপান্বিতার বাড়ি পৌঁছায় অম্বরিষ। উঁচুতলা থেকে ফোনে ব্যবস্থা করাই ছিল, প্রশ্ন করা বারণ, অতএব এই সাধারণ নিখোঁজ কেসে কলকাতা থেকে সিআইডি অফিসার কেন এসেছে সেই নিয়ে কেউ কোন প্রশ্নই করে না। অম্বরিষকে এসকর্ট করে দীপান্বিতার বাড়ি পৌঁছে দিয়েই কর্তব্য সারেন ওসি। অম্বরিষ ওকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির ভিতরে ঢোকে।
দ্বীপান্বিতার মা বাবা দাদা তিনজনকে একসঙ্গে বসিয়ে কথা শুরু করে অম্বরিষ, কোন রকম ডিপ্রেসনে ছিল কি দ্বীপান্বিতা? বাড়ির লোকের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল? কাছের বন্ধুদের নাম কি? ইত্যাদি রুটিন প্রশ্নের পর অম্বরিষ বলে, “আপনার মেয়ে যে ছেলেটিকে ভালোবাসত, আসিফ, আপনারা কেউ তাকে পছন্দ করতেন না, সম্পর্কটাও মেনে নেননি। আপনার মেয়ের মোবাইলে চ্যাট হিস্টরি দেখে জানা গেছে সে আসিফের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।”
অম্বরিষ থামে বাড়ির লোকগুলোর থমথমে মুখগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে নেয়। “আপনাদের মেয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে, আসিফ কিন্তু কোথাও যায়নি। কিছু বলবেন?”
বেশ কিছুক্ষণের নীরবতার পরে দীপান্বিতার বাবাই কথা বলেন, “আসিফ আমার মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছে স্যার, আপনি ওকে অ্যারেস্ট করুন।”
—এই কথাটা আপনি এতদিন পুলিশকে বলেননি কেন?
ঘর আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
—বলেননি, সম্মান রক্ষার জন্যে, তাই তো? চাননি যে আসিফ বলে কারোর সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক ছিল সেটা জানাজানি হোক।
বাড়ির সবাই এখনও চুপ।
—এই সম্মানরক্ষার জন্যে এখন দেশে কত খুন হচ্ছে জানেন? মেয়েকে খুন করে দেননি তো আপনারা?
চেয়ার থেকে মাথা ঘুরে পড়ে যান দীপান্বিতার মা। বাড়ির অন্যরা জল নিয়ে ছুটে আসে, মায়ের মাথা কোলে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে দীপান্বিতার দাদা, ওর বাবা অম্বরিষের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়, “আপনি এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে।” খুব কঠিন স্বরে কথা বলেন ভদ্রলোক। অম্বরিষের মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা যায় না।
—আপনার মেয়ের ঘরে নিয়ে চলুন আমাকে।
অম্বরিষ উঠে দাঁড়ায়, ততক্ষণে দীপান্বিতার মায়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে, সেদিকে তাকিয়ে অম্বরিষ বলে, “চিন্তা করবেন না, উনি সুস্থ হয়ে যাবেন, আসুন দিপান্বিতার ঘরটা একবার দেখে নি।”
ভদ্রলোক অম্বরিষের চোখে চোখ রেখে এগিয়ে আসেন, পাশের ঘরটাই দীপান্বিতার। ঘরের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছুই নেই, তাকে সাজানো বই, দেওয়ালে ইংরাজি ক্যালেন্ডারের পাশে প্রিন্সেস ডায়ানার একটা পোস্টার। খুব কাছ থেকে পোস্টারটা দেখে অম্বরিষ, টেবিলে রাখা বইগুলো উলটে পালটে দেখে, সবই কলেজের বই। পড়ার বইয়ের পাশে তাকে সাজানো গীতবিতান আর গল্পগুচ্ছ, টেবিলে স্টোনডাস্টের একটা পুতুল রাখা আছে, অম্বরিষ সেটা তুলে নিয়ে উলটে পালটে দেখে একবার। দীপান্বিতার বাবা এখনও দরজাতেই দাঁড়িয়ে আছেন।
আরও কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে কাটিয়ে অম্বরিষ বেরিয়ে যায়। আসিফকে আগেই থানায় তুলে আনা হয়েছিল, এখান থেকে বেড়িয়ে অম্বরিষ সেখানেই যায়।
সুদর্শন বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে আসিফ, পড়াশুনা খুব ব্রাইট, ভালো গান করে, কলেজে আসিফ বেশ জনপ্রিয়। দীপান্বিতার সঙ্গে ওর সম্পর্কটার বয়স এক বছরের কিছু বেশি।
—পুলিশকে তুমি প্রথমে মিথ্যা কথা বলেছিলে, রনবীর কাপুরের নতুন সিনেমা নিয়ে সেদিন তোমার সঙ্গে দীপান্বিতার রনবীর কাপুরকে নিয়ে কোন কথা হয়নি, কেন মিথ্যে বলেছিলে আসিফ?
উত্তর না দিয়ে মাথা নামিয়ে নেয় আসিফ।
—দীপান্বিতার মেসেজ বক্স দেখে তোমার সঙ্গে ওর কি কি কথা হত তার সবটাই আমরা জানতে পেরেছি। দীপান্বিতা তোমাকে জোর করত পালিয়ে বিয়ে করার জন্যে, ঠিক তো?
আসিফ মাথা তোলে, ওর চোখ ছলছল করছে।
—উত্তর দিতে হবে আসিফ, কথা না বললে ফেঁসে যাবে। দীপান্বিতার সঙ্গে ওর বাড়ির সম্পর্ক কেমন ছিল?
“ভালো ছিল না স্যার, ওই জন্যেই ও বাড়ি থেকে পালাতে চাইত।”
খুব মৃদু স্বরে বলে আসিফ।
—তোমার সঙ্গে?
মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় আসিফ।
—তুমি কি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলে? ওকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে উস্কানি দিয়েছিলে আসিফ? সত্যি কথা বলো।
আসিফ হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, “না স্যার আমি ওকে বারণ করেছিলাম, বলেছিলাম অপেক্ষা করতে… ও শুনল না।” গলার স্বর ঝিমিয়ে আসে আসিফের।
—কি মনে হয় তোমার ও পালিয়ে গেছে?
—জানি না স্যার, আমি সত্যি কিছু জানি না।
—এই কয়েকদিনে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি দীপান্বিতা?
বিহ্বল হয়ে দু-দিকে মাথা নাড়ায় আসিফ।
—ওর বাড়ির লোকেদের কেমন লাগতো তোমার?
কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে বসে থাকে আসিফ।
—কিচ্ছু জানো না তুমি?
আসিফ একইভাবে বসে থাকে।
—দেখো আসিফ, দীপান্বিতা পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, এটা আমরা জানি। দীপান্বিতা তোমার সঙ্গে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল সেটাও আমরা জানি। এখন দীপান্বিতা নিখোঁজ, তাই তুমি সন্দেহের তালিকায় সবার উপরে আছো। খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে অ্যারেস্ট করা হবে, উত্তরগুলো তোমাকে খুঁজে রাখতে হবে। প্রয়োজনে আমাকে ফোন করতে পারো।
ফোন নাম্বার লেখা একটা সাদাকাগজ আসিফের দিকে বাড়িয়ে দেয় অম্বরিষ। দরজার বাইরে ওসি দাঁড়িয়ে ছিলেন, অম্বরিষ ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “ডান ফর দা ডে, থ্যাঙ্ক ইউ।”
সময় একেবারেই নেই, লং জার্নি। গাড়িতে যেতে যেতে, কাল সন্ধে থেকে আজকের সারাদিনের ঘটনাগুলো পরপর সাজিয়ে নিতে হবে।
অম্বরিষের ইচ্ছে মতো ঘটনা সাজানো হয়ে ওঠে না। গাড়িতে উঠতেই ফোন বেজে ওঠে। বিকে শর্মা।
(৬)
—গুড ইভিনিং অম্বরিষ।
—ইভিনিং স্যার।
—কখন পৌঁছচ্ছ তুমি?
—সারে নটা দশটা হয়ে যাবে, এনিথিং আর্জেন্ট স্যার?
—লাল নীল বাতি কিছু আছে গাড়ির মাথায় নাকি সব খুলে ফেলেছ?
অপ্রস্তুত হয়ে পরে অম্বরিষ, “আছে স্যার।”
—সাড়ে আটটার মধ্যে আমার কেবিনে রিপোর্ট করবে, আসার পথে খবরের চ্যানেলগুলো দেখে নাও, সি ইউ।
—স্যার।
ফোন কেটে যায়।
অন্ধকার হতে এখনও দেরি আছে, পিছন থেকে ড্রাইভারকে নির্দেশ দেয় অম্বরিষ “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতা ফিরতে হবে, হুটারটা অন করে দাও।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইল বের করে খবরের কাগজ খুলে বসে অম্বরিষ, ফ্ল্যাশ করছে ‘ব্রেকিং নিউজ’। দমবন্ধ হয়ে আসে অম্বরিষের।
অমিতাভ সেন রাজ্যের ক্যাবিনেট মিনিস্টার, তার ছেলে সন্দীপন সেন আজ দুপুরে বাড়িতে ফিরে দরজা বন্ধ করে শুয়েছিল। বিকালে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখা যায় অন্ধকার ঘর শূন্য। কেউ কোথাও নেই। এই খবর চাপা থাকেনি, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া মুহূর্তের মধ্যে ওবিভ্যান নিয়ে পৌঁছে গেছে অমিতাভবাবুর বাড়ির দরজায়।
“দিনদুপুরে বাড়ি থেকে অদৃশ্য সন্দীপন সেন। কি হয়েছিল? কোথায় গেলেন সন্দীপন? আমাদের সঙ্গে সন্দীপনের বাড়ির সামনে থেকে আছে রূপক ব্যানার্জী, রূপক প্রথমেই শুনে নেব…”
মোবাইল লক্ করে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে অম্বরিষ, সে স্পষ্ট বুঝতে পারে, এবারে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে, স্যার এই ভয়টাই পেয়েছিলেন, আর কিছুই নিয়ন্ত্রন করা যাবে না।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মিডিয়ার খবর সমৃদ্ধ হতে থাকে। এতদিন বহু প্রচেষ্টায় যে সব খবর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল তারা একে একে বেরিয়ে আসে, টিভির পর্দায় ফুটে ওঠে বিদিশা ঘোষ অনিমেষ মজুমদারের নাম। সন্ধের আগেই জমে ওঠে বিতর্কসভা।
নিখোঁজ নাকি অদৃশ্য?
অম্বরিষ জানালার বাইরে তাকায়, নিকষ অন্ধকারে মুখ ঢেকেছে পৃথিবী, ওই অন্ধকারের আড়ালে কি সত্যিই ব্যাখ্যাতীত কিছু আছে?
ডিআইজি আজ বড়ই নিষ্প্রভ, অম্বরিষের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ, ঘরে কোন শব্দ নেই।
—অম্বরিষ, কাল থেকে সবকিছুই কঠিন হয়ে যাবে, দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলবো। তদন্ত তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় হবে। তুমি প্রচুর ভুল খবর পাবে, দিক্ভ্রান্ত হয়ে পোড়ো না।
—স্যার।
কথা বলতে বলতেই ডিআইজির ফোনে একের পর এক ফোন আসতে থাকে, ডিআইজির ঘরের লাগোয়া একটা ছোট্ট শব্দনিরোধক ঘর আছে ফোনের গুরুত্ব বুঝে উনি সেই ঘরে উঠে যান। অম্বরিষের সঙ্গে আর কথা বলা হয় না, ফোনে কথা বলতে বলতেই হাতের ইশারায় উনি অম্বরিষকে চলে যেতে বলেন।
ঘর অন্ধকার করে সারারাত চেয়ারে বসে থাকে অম্বরিষ, সত্যিই কি মানুষগুলো উবে যাচ্ছে? যদি তাই হয় তবে অম্বরিষ এই রহস্যের সমাধান কি করে করবে? ছোটবেলা দাদু গল্প করত বারমুডা ট্রাইয়ালের রহস্য সমাধান করতে গিয়ে নাকি আস্ত একটা জাহাজ অদৃশ্য হয়ে গেছিল। অম্বরিষও কি শেষে অদৃশ্য হয়ে যাবে? যারা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তারা কি মারা যাচ্ছে? নাকি বেঁচে আছে অন্য কোথাও? অম্বরিষ অদৃশ্য হয়ে গেলে কি নিলাঞ্জনার সঙ্গে দেখা হবে? কিন্তু নিলাঞ্জনা তো অদৃশ্য হয়নি, মারা গেছিল। অন্ধকার ঘরে একা বসে থাকতে থাকতে আবার নতুন করে মরে যেতে ইচ্ছে হয় হয় অম্বরিষের। এরকম সময়গুলোতে একটা সুতোর ওপার থেকে মৃত্যু ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে যেন, চোখ বন্ধ করে অম্বরিষ, চোখের সামনে শান্তনু ঘোষ ফুটে ওঠে, ওর হাহাকার করা মুখটা ভেসে ওঠে।
উঠে দাঁড়ায় অম্বরিষ আলো জ্বালে, ঢক্ঢক্ করে জল খায়, তারপর কেস হিস্টরিগুলো নতুন করে পড়তে থাকে, যদি মানুষগুলো সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গিয়ে থাকে তবে মানব সভ্যতার সামনে সমুহ বিপদ। কি হতে পারে? কোন বিজ্ঞানীর গবেষণা নাকি এলিয়ন? সংবাদ চ্যানেলগুলো ইতিমধ্যে সবরকম আলোচনা শুরু করে দিয়েছে, যা কিছু অবাস্তব যার মধ্যে চমক আছে, চটক আছে তারই আছে টিআরপি, দৈনন্দিন এক ঘেয়ে খবর আর কাঁহাতক ভালো লাগে মানুষের।
নাহ্ অবাস্তব কল্পনাকে বিশ্বাস করার সময় এখনও আসেনি। হতেই পারে মানুষগুলো নিখোঁজ, হতেই পারে দু-একদিনের মধ্যে তারা ফিরে আসবে, অথবা ফিরে না এলেও খোঁজ পাওয়া যাবে, চিহ্ন পাওয়া যাবে অথবা লাশ পাওয়া যাবে।
(৭)
পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে রাজ্য জুড়ে বহু মানুষ জাস্ট উবে গেল, তীব্র আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করেছে সারা রাজ্য, ইতিমধ্যে প্রতিবেশী রাজ্য থেকেও একটা দুটো কেসের খবর শোনা গেছে। রাজ্য সরকার অনির্দিষ্ট কালের জন্যে কর্মবিরতি ঘোষণা করেছেন, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ আর বাড়ি থেকে বেরোয় না। কিন্তু বাড়িতে থাকলেও তো নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না, বেশির ভাগ মানুষ বাড়ি থেকেই উধাও হয়ে গেছে। সরকার থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ‘যতটা সম্ভব একসঙ্গে থাকুন, কেউ একা থাকবেন না।’
কোনও এক অজানা বিভীষিকায় থরথর করে কাঁপছে মানুষ। এমন আতঙ্কময় পরিস্থিতির সম্মুখীন মানুষ বুঝি বা আগে আগে কখনও আসেনি—
“মর্নিং ওয়াকে গিয়ে উধাও যুবক”, “বাথরুমের দরজা ভেঙে দেখা গেল কেউ নেই”, “টেবিলে বই খোলা পড়ে আছে মানুষটা নেই”, “হাসপাতালে বেড থেকে উধাও যুবতী।”
অম্বরিষ খবরের কাগজটা ছুড়ে ফেলে দেয়। একজন কনস্টেবলকে পাঠিয়েছিল সে শান্তনু ঘোষের খবর নেওয়ার জন্যে, গত দু-দিন ধরে শান্তনুর বাড়ির দরজায় তালা, পাড়া প্রতিবেশী কেউ জানে না ভদ্রলোক কোথায়, চোখের সামনে এখনও মানুষটার কঙ্কালসার মুখটা ভাসে, সেও কি অদৃশ্য হয়ে গেল?
এর দিনকয়েক পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা মেয়ের ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে গেল, সারা দেশে ট্রেন্ড করছে সে, সুদেষ্ণা পাল, দু-দিন আগে নিজের বাড়ি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছিল সে, গভীর রাতে সারা ঘর একটা নীল আলোয় ভরে যায়, একটানা মৃদু একটা শব্দ হচ্ছিল, সেই শব্দতেই ঘুম ভেঙে যায় সুদেষ্ণার। ঘুম চোখে চারিদিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় সে। চিৎকার করতে গিয়ে দেখে গলা দিয়ে স্বর বেরচ্ছে না। অনেকক্ষণ একই চুপ করে শুয়ে থাকার পরে হঠাৎ সে দেওয়ালে একটা হলুদ বিন্দুর মতো আলো দেখতে পায়, অদ্ভুত আকর্ষণ সেই আলোর, যেন টানছিল সুদেষ্ণাকে, সুদেষ্ণা উঠে দাঁড়ায় আলোটার দিকে এগিয়ে যায়, হাত দিয়ে ছুঁয়ে ফেলতেই আর কিছু মনে নেই। এই ঘটনার দু-দিন পরে সে আবার নিজেকে নিজের বিছানায় আবিস্কার করে, ওর জীবন থেকে দুটো দিন মুছে গেছে। বারেবারে সতর্ক করে দেয় সুদেষ্ণা অদৃশ্য হওয়ার আগে একটা হলুদ আলোর বিন্দু দেখতে পাবে, প্রচণ্ড আকর্ষণ সেই আলোক বিন্দুর, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করতে হবে, কিছুতেই ওইদিকে যাওয়া যাবে না, ওদিকে গেলেই শেষ, সুদেষ্ণা ভাগ্যবান সে ফিরতে পেরেছে হয়তো অন্য কেউ পারবে না।
একসময় প্রতিদিন শতশত মানুষ আপডেট দিতে শুরু করল, কেউ অদৃশ্য হয়ে ফিরে এসেছে, কেউ মধ্যেরাতে নিশির ডাক শুনে নিজেকে সংবরণ করেছে, কেউ বা রাত্রির আকাশে দেখতে পেয়েছে উড়ন্ত চাকতি। একজন অদ্ভুত দর্শন এক জীবের ছবিও প্রকাশ করল, কিছু মানুষ অবশ্য প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ করে দিল সে ছবি ফোটোশপ করে তৈরি করা হয়েছে।
সংবাদ চ্যানেলের এক রিপোর্টার একটা অন্ধকার ঘরে মাইক্রোফোন নিয়ে ঢুকে পড়ল একদিন, লাইভ দেখানো হচ্ছে এখনও এক ঘণ্টা হয়নি এক মহিলা অদৃশ্য হয়ে গেছেন এই ঘর থেকে। সাংবাদিকের গলা কেঁপে ওঠে, “আমি জানি না আমি এই ঘর থেকে কখনও বের হতে পারব না। আমি যদি নাও ফিরতে পারি তবু এই ক্লিপিংসগুলো থাকবে, এই রহস্য ভেদ করতে হয়তো একদিন হয়তো এই ক্লিপিংসগুলোয় সাহায্য করবে।”
হঠাৎ রিপোর্টারের গলার স্বরে তীব্র ভীতি ফুটে ওঠে, “একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছি আমি, একটা অলৌকিক অনুভুতি হচ্ছে… বিপ্বিপ্ লাইন কেটে যায়, স্টুডিয়ো থেকে চিৎকার করে সঞ্চালক ‘অনিকেত তুমি শুনতে পাচ্ছ? ঠিক আছো তুমি? অনিকেত… প্রিয় দর্শক বন্ধুরা আমাদের সঙ্গে অনিকেতের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে…” মিনিট পাঁচেক পরেই আবার লাইন ফিরে আসে, ধরে আসা গলায় উত্তর দেয় অনিকেত, “একটা অদ্ভুত গন্ধ…একটু আলো… আলো দেখাও আমাকে কেউ…” এর একটু পরেই অনিকেত সেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। তখনও চ্যানেলের স্ক্রিনে ফ্ল্যাশ করছে ‘এক্সক্লুসিভ।এক্সক্লুসিভ। এক্সক্লুসিভ।’
বিকে শর্মা বলেছেন যে কেসগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছিল অম্বরিষ সেইগুলোতেই আটকে থাকতে, নতুন কেসগুলো নজরে রাখতে হবে, কিন্তু প্রায়োরিটিতে এগুলো আসবে না। এই ঘটনাগুলো বেশির ভাগই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ইতিমধ্যে অন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে, এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা এক সপ্তাহ আগে অদৃশ্য হয়েছিলেন, আজ বাড়ি থেকে একটু দূরে পুকুর থেকে আর বস্তাবন্দি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, একমাত্র ছেলে অ্যারেস্ট হয়েছে। পুলিশের সন্দেহ যতদিন যাবে এইরকম ঘটনা আরও হয়েছে, মানুষ জন্মগতভাবেই সুযোগ সন্ধানী, পুরোনো শত্রুকে এই সুযোগে অদৃশ্য করে দেওয়া হচ্ছে।
এই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা থেকে উদ্ধার পেতে হলে যেমন করেই হোক প্রমাণ করতে হবে মানুষগুলো নিখোঁজ হয়েছে অদৃশ্য হয়নি নিখোঁজ হয়েছে। এর মধ্যে অলৌকিক কিছু নেই। একবার অলৌকিকের স্বাদ পেয়ে গেলে মানুষকে কিছুতেই আর আইনশৃঙ্খলা দিয়ে বাঁধা যাবে না।
(৮)
পরবর্তী একমাস সময়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোর বাঘাবাঘা সাংবাদিকরা রাজ্যে এসে বসে আছেন, বিদেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন, রাজ্য সরকারের উপর আস্থা হারিয়েছে কেন্দ্র, বিকে শর্মার উপর আস্থা হারিয়েছে রাজ্য। সিবিআই এর বিশেষ দল তদন্ত শুরু করেছে, সমস্ত নথী জমা বুঝিয়ে দিয়ে অম্বরিষ এখন এই কেস থেকে মুক্ত। বিকে শর্মাকে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার।
সকালের খবরের কাগজে একটা আর্টিকেল পড়ছিল অম্বরিষ দক্ষিণেশ্বরের এক বৃদ্ধ দম্পতী উধাও, একমাত্র ছেলে বিদেশে, তাদের বাড়ি দখলে নিয়েছে প্রমোটার। একাধিক সংস্থা পোর্টাল খুলেছে যেখানে প্রতিদিন দেখা যায় কোন জেলায় কত মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেছে, কত জন ফিরে এসেছে। এই হিসেব অনুযায়ী গত চব্বিশ ঘণ্টায় রাজ্যজুড়ে বাহান্ন জন মানুষ বেপাত্তা হয়ে গেছে, ফিরে এসেছেন তেইশ জন। কতটা বিশ্বাসযোগ্য এই সংখ্যাগুলো জানে না অম্বরিষ। যারা ফিরে আসে তারা প্রত্যেকে সোশ্যাল সাইটে তাদের অলৌকিক গল্প শোনায়, চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করার আবেদন জানায়, কত রকম গল্প, কেউ ভিন্ন গ্রহে গেছিল, কেউ ভিন্ন ডাইমেনশনে, কেউ মৃত মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছে, কেউ আবার মহাশূন্যে হেঁটে বেড়িয়েছে। সিবিআই-এর অফিসারদের জেরার মুখে পরে এদের মধ্যে কেউ কেউ স্বীকার করে নিয়েছে তারা গল্প বলেছিল, কেউ কেউ এখনও অনড়। অনেক মানুষের বডি উদ্ধার হয়েছে, অনেক খুনি ধরা পড়েছে, অনেকে এখনও নিরুদ্দেশ অথবা অদৃশ্য।
সিবিআই কেস ক্লোজ করে দিতে চায়, অম্বরিষ খবর পেয়েছে বেশ কিছু ভুয়ো ঘটনার বিবরণ নথিভুক্ত করে সিবিআই প্রমাণ করে দিয়েছে সবটাই ধোঁয়া আগুন নেই, ছিল না কখনও।
কিন্তু অম্বরিষ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে আসলে পুরোটাই অন্তঃসার শূন্য গুজব। প্রথম যে পাঁচটা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছিল অম্বরিষ সেগুলোর হিসেব এখনও মেলে নি। সিবিআই হয়তো সেই হিসেব মেলাবেও না, ওদের উপর প্রচণ্ড প্রেশার আছে কেশ ক্লোজ করার জন্যে। একবার ডিআইজির সঙ্গে কথা বললে ভালো হত, কিন্তু ভদ্রলোকের অফিশিয়াল নাম্বারটা গত কয়েকদিন ধরে সুইচড অফ, খুব প্রয়োজন ছাড়া পার্সোনাল নাম্বারে ফোন করা বারণ।
বারান্দায় নিজের নোটের খাতাটা নিয়ে বসে অম্বরিষ। অলসভাবে একটার পর একটা পাতা উল্টাতে থাকে, একেকটা ঘটনা একেকটা গল্প, বিয়োগান্ত গল্প, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষ শুধু গল্পই লিখে যায়। এরকম সময়ে ওর স্ত্রীর কথা মনে পরে, জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার আর কোন তাগিদ অনুভব করে না অম্বরিষ, পৃথিবী ঘুরছে তাই অম্বরিষেরও দিন কাটে, যারা মরেনি তারা সকলেই কি বেঁচে আছে, একা একাই হেসে ওঠে সে।
তারপর হঠাৎই মাথাটা ঝনঝন করে ওঠে অম্বরিষের, কি একটা যেন পেয়ে গেছে সে, কোথায় একটা হিসাব মিলে গেছে হঠাৎ। চোখের সামনেই ছিল এতদিন কিন্তু চোখে পরেনি, এমনও হয়? অথচ সবার আগে এই কথাটাই তো ভাবার ছিল। কেন ভাবেনি?
দ্রুত হাতে পেন নিয়ে বসে অম্বরিষ।
বিদিশা ঘোষ – ছেলের মৃত্যুর পরে মানসিকভাবে অসুস্থ।
অনিমেষ মজুমদার – ডিভোর্সি, অ্যালকোহলিক।
দীপান্বিতা – বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পালাতে চেয়েছিল, বয়ফ্রেন্ড রাজি হয়নি, ডিপ্রেসড।
দক্ষিণেশ্বরের রুপালী – স্বামীর সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া করে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, এমন সে প্রায়ই করত।
চুঁচুড়ার সোমনাথ বাগচী – এঁর সম্পর্কে এখনও কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
সন্দীপন সেন – ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। রিহ্যাব সেন্টার থেকে ফিরেছিল মাসখানেক আগে, একাধিক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
এতদিন কেসগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে অম্বরিষ কীভাবে চোখের আড়ালে থেকে গেল এই যোগসূত্রটা? খাতার পাতায় বড়বড় করে লেখে অম্বরিষ, “এরা সম্ভবত কেউই বাঁচতে চায়নি।”
খাতা পেন সরিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে অম্বরিষ, হয়তো আত্মহত্যা করার পূর্ব মুহূর্তে কিছু মানুষ অদৃশ্য হয়ে যায়! কোন কোন সময় অবুঝ মানসিক অবস্থায় মন যুক্তি মানে না। অম্বরিষের বারেবারে নিলাঞ্জনার কথা মনে হয়, নিলাঞ্জনা আত্মহত্যা করেছিল কিন্তু সে অদৃশ্য হয়ে যায়নি। হয়তো সকলে হয় না কেউ কেউ উধাও হয়ে যায়।
আবার ডিআইজি স্যারকে ফোন করে অম্বরিষ, ফোন বন্ধ।
এইদিন রাত্রেই রহস্যের সমাধান করে ফেলে অম্বরিষ। ওকে কিছুই করতে হয় না, সবই হয়ে যায়।
স্ত্রীর মৃত্যুর পরে অম্বরিষ মরতে চেয়েছিল, চেষ্টাও করেছিল, পারেনি। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে এসে ও হেরে যায় প্রতিবার, দৃঢ় সংকল্প লঘু হয়ে যায়। অফিস জয়েন করার পর থেকে ভালো ছিল সে। কিন্তু আজ সকালে যখন থেকে সে এই উধাও হয়ে যাওয়ার সঙ্গে মানসিক অস্থিরতার যোগসূত্র আবিস্কার করেছে সে তখন থেকেই ওর মনের মধ্যে আবার নতুন করে আত্মহত্যার ইচ্ছে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। নতুন করে সংকল্প করেছে মন। পৃথিবীকে নতুন করে বড় দীন হীন বলে মনে হচ্ছে অম্বরিষের। নীলাঞ্জনার কথা মনে পরে, অনেকদিন পরে কান্না পায় অম্বরিষের।
পথে চলতে চলতে হঠাতই অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায়, আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় থাকে না। তবে অম্বরিষের কি কোন প্রস্তুতিই ছিল না, ছিল নিশ্চয়, সে তো সকাল থেকেই অনুমান করেছিল অবাস্তব ঘটনার কথা। সেই অনুমানই এইদিন ওকে নতুন করে আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত করেছিল। শুধুমাত্র কিছু ডিপ্রেসড মানুষ উধাও হয়ে গেছে বলেই কি এমন অদ্ভুত অলৌকিক একটা ধারণা করে নেওয়া যায়? যায় না। অম্বরিষ করেছিল, কারণ যুক্তিবাদী মনও মুক্তি খোঁজে, যুক্তিরও একটা বাঁধন আছে।
সার্ভিস রিভলভারটা হাতে নিয়ে গভীর রাতে চুপ করে বসেছিল অম্বরিষ রাত্রি একটার সময় মোবাইলে আলার্ম বাজবে, সেই আলার্ম যখনই বাজবে সেই মুহূর্তে কোন কিছু না ভেবে সে নিজেকে মৃত্যুর হাতে সমর্পণ করবে। সময়কে এমনভাবে বেঁধে না রাখলে ও কিছুতেই পারবে না। শেষ মুহূর্তে নতুন চিন্তার জাল এসে ওকে দ্বিধান্বিত করে তোলে, সম্ভবত অম্বরিষ প্রস্তুত নয়, প্রস্তুত হলে ওর ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে গুলী চালানোর প্রয়োজন হত না।
(৯)
অন্ধকারে ঘরে বসে অম্বরিষ কি শুধুই সেই আগে থেকে নির্ধারিত চরম মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করছিল? সম্ভবত না। সম্ভবত সে অপেক্ষা করছিল কোন নীলাভ অথবা হলুদ অলৌকিক আলোর জন্যে, যা কিছু কল্পনার অতীত এমন কিছুর জন্যে। সে মুহূর্ত আসে। আলো নয় শব্দ।
—অম্বরিষ তুমি অদৃশ্য হবে না, মৃত্যুর পর তোমার শরীর এই ঘরেই পড়ে থাকবে। অলৌকিক কিছুই ঘটবে না।
যান্ত্রিক স্বরে কথা বলে ওঠে কোন না-মানুষ। অম্বরিষ শিহরিত হয়। বুকের মধ্যে প্রচণ্ডরকম ভীতি সৃষ্টি হয়। মৃত্যু পথযাত্রীর এত ভয় পাওয়া শোভা দেয় না। কিন্তু অম্বরিষ তবু ভয় পায়, হয়তো সে ভন্ড তপস্যী তাই অথবা হয়তো ভয় পাওয়াটাই দস্তুর।
চিৎকার করে ওঠে অম্বরিষ “কে? কে কথা বলছেন?” সামনে বন্দুক উঁচু করে ধরে সে।
দেওয়াল হাতড়ে ঘরের আলো জ্বালায়।
কাউকে দেখা যায় না। কিন্তু সে কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়। সে এখানেই আছে অম্বরিষের আশপাশে কোথাও।
—তোমার অনুমান ঠিক অম্বরিষ ওরা সকলেই মরতে চেয়েছিল, আমরা সেজন্যেই ওদের সরিয়ে নিয়েছি।
কথা বলতে পারে না অম্বরিষ, না এই বাংলো বাড়িতে আইপিএস অফিসার অম্বরিষ চ্যাটার্জীর সঙ্গে মস্করা কেউ করবে না। হতে পারে মনের ভুল, হতে পারে একই কথা সকাল থেকে ভাবার ফলে অম্বরিষের মধ্যে কোন দ্বৈত স্বত্বা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু না সে সব কিছুই না অম্বরিষ সত্যিই এই রাতে সম্মুখীন হয়েছে অলৌকিকের।
—আমাকে খুঁজো না অম্বরিষ তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু আমি মিথ্যে নই।
—কে আপনি কি চাই আপনার?
মুহূর্তকাল চুপ করে থাকে সেই কণ্ঠস্বর।
—আমাকে তুমি চিনবে না।
—কেন এসেছেন?
—পরীক্ষা করতে, গবেষণা…
অম্বরিষের মাথা ঝিমঝিম করছে, মনে হচ্ছে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে, নিশ্চয় সে স্বপ্ন দেখছে, কটা বাজছে এখন? এক্ষুনি যদি অ্যালার্ম বেজে ওঠে তবে কি এক্ষুনি অম্বরিষ মরে যেতে পারবে?
সে কণ্ঠস্বর অম্বরিষের কথার জন্যে প্রতীক্ষা করে না সে নিজেই বলে যায়।
“অনুভূতিরা মিলিতভাবে ঠিক কোন বিন্দুতে পৌঁছালে আত্মহত্যা করে মানুষ? এই ছিল আমাদের গবেষণার মূল প্রশ্ন।”
—আপনারা কি মানুষ?
—না মানুষ নই, নই বলেই মানুষের উপর এমন নির্দয় ভাবে পরীক্ষা চালাতে পারি।
কেমন অদ্ভুত স্বরে হেসে উঠল যেন সে। যেন সে নিজের ক্রূর মানসিকতার জন্যে অনুতপ্ত।
—কেন? কী লাভ এই পরীক্ষা করে?
—আমারাও আত্মহত্যা করি। আমরা তোমাদের চেয়ে উন্নত জীব অম্বরিষ, তাই আমাদের দুঃখ-কষ্ট তোমাদের চেয়ে বেশি, জানই তো যার মস্তিস্ক যত বেশি উর্বর তার যন্ত্রণা তত বেশি। আমাদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা তোমাদের চেয়ে ঢের বেশি। আত্মহত্যা নিরোধক টীকা আবিস্কার করতে চাই আমরা। বাঁচিয়ে রাখতে চাই নিজের সন্তান সন্ততি বাবা মায়েদের। বিজ্ঞানের জোরে আমরা মৃত্যুকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি অনেক দূরে, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণায় আমরা নিজেরাই স্বেচ্ছায় সেই বহুদূরের মৃত্যুকে কাছে টেনে আনি। প্রযুক্তি শান্তি দেয় না, সুখ দেয় অম্বরিষ।
অম্বরিষ ধীরে ধীরে ধাতস্ত হয়ে পরে, সম্ভবত কোন কিছুই মানুষকে বেশিক্ষণের জন্যে বিচলিত করে রাখতে পারেনা।
—এই কোটি মানুষের পৃথিবীর মধ্যে থেকে কিভাবে বেছে নিলেন এই গুটি কতক মানুষকে?
—কিছুটা ভাগ্য বাকিটা অঙ্ক।
লোকটা আবার হেসে ওঠে, তবে এবারের হাসির মধ্যে সেই অনুতপ্ত ভাবটি নেই। অম্বরিষ প্রশ্ন না করে কৌতূহলী হয়ে চেয়ে থাকে।
—পৃথিবীর এই অংশেই আমরা উপস্থিত হয়েছি, তাই এই অঞ্চলের মানুষদের উপরেই সমীক্ষা করেছি, নির্বাচন করেছি সাবজেক্ট।
—সাবজেক্ট?
অম্বরিষ যেন অনুভব করতে পারে লোকটা নিঃশব্দে হাসছে।
—মন নিয়ে গবেষণা হয় অম্বরিষ, অনুভূতি বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় মানুষের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে চলেছে।
—তবে আমার অনুমান ঠিক, ওই ছয়জন আত্মহত্যা প্রবণ তাই ওরা অদৃশ্য হয়েছে।
—তোমার অনুমান আংশিক সত্য। ছয় জন নয় দশ জন। বাকিদের খোঁজ পাওনি তোমরা। আর শুধুমাত্র ওরা আত্মহত্যাপ্রবণ ছিল বলে ওদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে এমন নয়। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে ওদের বন্দি করা হয়েছে। অনুভুতির সেই চরম মুহূর্ত নিয়েই আমাদের গবেষণা।
—আমার খোঁজ কী করে পেলেন?
কিছুক্ষণ চুপ থাকে কণ্ঠস্বর। তারপর সে বলে “তুমিও আমাদের সম্ভাব্য সাব্জেক্টের তালিকায় ছিলে অম্বরিষ। তোমার উপর অনেকদিন ধরে লক্ষ্য রেখেছি আমরা। কিন্তু তোমার অনুভূতিরা কখনও সেই শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছায়না। তাই তুমি বারে বারে চেষ্টা করেও মরতে পারো না।”
নিজের অজান্তেই কখন অম্বরিষ কারোর গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। নিজের সম্পর্কে এসব কথা অম্বরিষকে খুশি করে না, বরং তার অনুভুতিরা কখনও শীর্ষ বিন্দু স্পর্শ করে না বলে সে যেন ক্ষুন্নই হয়।
—আজ কেন এসেছেন তবে? দেখতে এসেছেন আজ আমার অনুভূতি সেই বিন্দুতে পৌঁছায় কিনা?
—না অম্বরিষ তা নয়, আমাদের গবেষণার কাজ শেষ হয়েছে আমরা চলে যাচ্ছি। তোমাকে নিশ্চিত করে বলে যেতে এসেছি, গত একমাস ধরে এই ক্রমাগত অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে আমরা স্পর্শ করিনি।
—বলে লাভ?
—লাভ নেই, অনুতাপ একটু কম হবে এটুকুই।
—অনুতাপ?
—মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যাদের হরণ করেছি, তারা কেউ হয়তো বেঁচে যেত অম্বরিষ, ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হয়তো মারা যেত না বিদিশা ঘোষ, হাতের শিরা কেটে হয়তো মারা যেতেন না অনিমেষ মজুমদার, হয়তো এরা কেউ কেউ বেঁচে যেতেন। ওদের আমরা আমাদের জন্যে নিজেদের দীর্ঘ জীবনের স্বার্থে মেরে ফেলেছি। যেমন তোমরা গিনিপিগদের মেরে ফেল। নিজের প্রজাতির উপকারের স্বার্থে এই অপরাধ ক্ষমা করা যায়, তবু অনুতাপ হয় না কি হয় নিশ্চয়। আমরা ওই দশটা মৃত্যুর জন্যেই দায়ী অম্বরিষ। বাকি যারা অদৃশ্য হয়েছে তারা হয় নিজের স্বার্থে, অথবা তাদের অদৃশ্য করেছে অন্য কেউ তার নিজের স্বার্থ পূরণের জন্যে, এই বিশৃঙ্খলার একটা পরোক্ষ দায় আমাদের উপরেও বর্তায়, তাই পাপস্খলন করতে এসেছি। মনে রেখো এ মহাবিশ্বে পুরোটাই শুধু নির্লজ্জ স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়।
—সোমনাথ বাগচী কেন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন?
কিছুক্ষণ চুপ থাকে সে কণ্ঠস্বর, অম্বরিষ ভাবে সে চলে গেছে বুঝি। কিন্তু না একটু পরে সে উত্তর দেয়।
—সোমনাথ বাগচি ওর স্ত্রীকে কখনও ভালোবাসেনি অম্বরিষ, ও ভালোবাসত অদিতিকে, অদিতি সিংহ, ভবানীপুরে বাড়ি। খোঁজ করে দেখো, সেও নিখোঁজ অনেকদিন ধরে। তোমরা তার কথা জানতে পারো নি। কেউ অদিতির খোঁজ করেনি। সোমনাথ ছাড়া কেউ ছিল না ওর। সোমনাথ খুঁজেছিল ওকে পায়নি, পায়নি বলেই সে নিজেও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা ওদের দুজনকে এক বিছানায় পাশাপাশী শুইয়ে রেখেছিলাম।
অম্বরিষ আর কোন কথা বলেনা। অন্যপ্রান্ত চুপ করে যায়।
একসময় অম্বরিষ জিগ্যেস করে “কি পেলেন আপনারা গবেষণায়? আত্মহত্যার রোধ করার টীকা আবিষ্কার কি সম্ভব?”
—যে ঋণাত্মক অনুভূতিরা একসঙ্গে শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করলে মানুষ আত্মহত্যা করে, সেই অনুভূতিগুলো চিহ্নিত করে তাদের একটা চরমমান বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা, যাতে কখনওই সেই সকল অনুভূতি আর শীর্ষে পৌঁছাবে না।
—তা কি সম্ভব?
—সম্ভব, কিন্তু শুধু ঋণাত্মক অনুভুতির উপরেই এই নিয়ম প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, আসলে ঋণাত্মক অনুভূতি বলে তো কিছু হয় না, সুখ আর দুঃখ আসলে একই অনুভূতি, শুধু একটা ধনাত্মক অন্যটা ঋণাত্মক। মান নির্দিষ্ট করলে আপার আর লোয়ার দুটো মানই নির্দিষ্ট করতে হবে। যে অনুভূতি সর্বনিম্ন মানে পৌঁছালে তা চরম ঋণাত্মক সেই একই অনুভূতিই সর্বোচ্চ মানে পৌঁছালে প্রচণ্ড রকমভাবে ধনাত্মক। অর্থাৎ মান একবার নির্দিষ্ট করে ফেললে, সমস্ত চরম অনুভূতিরা চিরদীনের মতো হাড়িয়ে যাবে। চরম দুখ্য অথবা প্রবল আনন্দ কোনটাই আর হবে না কারোর। জীবন থেকে বৈচিত্র কমে যাবে, ঢেউ থাকবে কিন্তু ঢেউয়ের উচ্চতা কমে যাবে।
কিছুক্ষণ চুপ থাক সে তারপর বলে “এই টীকা তৈরি হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানীরা নেবে না, নেবে রাষ্ট্র।”
—যদি রাষ্ট্র টীকা তৈরি করতে নির্দেশ দেয় তাহলে তার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ কোথায় করবেন আপনারা।
অন্য প্রান্তের কণ্ঠস্বর হেসে ওঠে। কোন উত্তর দেয় না। অম্বরিষ তার ষষ্টইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারে সে চলে গেছে।
এই সময়েই অম্বরিষের মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। এবারেও অম্বরিষের অনুভুতিরা শীর্ষ বিন্দু স্পর্শ করে না। সে মারা যায় না।
(১০)
বিকে শর্মা নিজেই পরের দিন সকালে তার পার্সোনাল নম্বর থেকে অম্বরিষকে ফোন করেন, সারা রাত ঘুমায়নি অম্বরিষ, সারারাত সে বারান্দায় বসে আছে, ওর সামনেই অন্ধকার পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠেছে।
ডিআইজি খবর পেয়েছেন, সিবিআই আজই ফাইনাল রিপোর্ট সাবমিট করবে। প্রত্যাশিত ভাবেই রিপোর্টে বলা হয়েছে সবটাই গুজব। রিপোর্টে রাজ্যের প্রশাসন এবং গোয়েন্দা বিভাগের দক্ষতার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথম যে পাঁচটা নিখোঁজ নিয়ে কেস শুরু হয়েছিল, সেই সব ক-টা কেসেরই সমাধান করে ফেলেছে সিবিআই।
—হোয়াট?
চেয়ার ছেড়ে উঠে বসে অম্বরিষ।
বিকে শর্মা হেসে ওঠেন। “সরকার থেকে প্রেশার এলে পুলিশ এক নিমেষে সব রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারে। পাঁচটা মৃতদেহ পাওয়া কি এমন কঠিন কাজ অম্বরিষ! বিদিশা ঘোষের পচাগলা প্রায় কঙ্কাল হয়ে যাওয়া মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে অজয়ের চরে বালির স্তূপের মধ্যে থেকে। অনিমেষ মজুমদারকে পাওয়া গেছে সল্টলেকেরই এক পরিত্যক্ত খালের ধারে। সব মৃতদেহ উদ্ধারের ভিডিয়ো আছে, এবং কোন দেহই চেনা যাচ্ছে না।”
—আর সন্দীপন সেন?
—ওকেও পাওয়া গেছে। ওর বাবা ছেলেকে শনাক্ত করেছেন।
অম্বরিষ আবারও চমকে ওঠে। “কি বলছেন স্যার। হাউ ইজ ইট পসিবল?”
ডিআইজি হাসেন, “আমাকে কোট করো না কোথাও, কয়েক দিনের মধ্যেই দেখবে মন্ত্রীমশাই দল বদলে কেন্দ্রীয় দলে যোগ দিয়েছেন।”
গলার কাছে কি একটা আটকে আছে, কথা বলতে পারছে না অম্বরিষ। বিকে শর্মা সম্ভবত অম্বরিষের অবস্থা আন্দাজ করেন।
—চিয়ার আপ ম্যান। আমরা এটাই চেয়েছিলাম। অন্তত মানুষ এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাবে। চারপাশে অলৌকিকের অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। এটা তো কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয় বাস্তবের জীবন।
“জীবন বলেই তো চিন্তা স্যার, যদি সত্যি মানুষগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়, যদি এই গুজবের মধ্যে এতটুকুও সত্যি থাকে?” মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করে অম্বরিষ।
—তার তদন্ত পরে হবে। কিন্তু তার আগে ভোট হবে।
ডিআইজি আর কথা না বলে ফোন কেটে দেন।
অম্বরিষ চেয়ারে বসে ভবানীপুর থানার ওসিকে পবিত্র বিশ্বাসকে ফোন করে, অদিতি সিংহের খোঁজ করতে হবে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খোঁজ পাওয়া যায়। অদিতি সিংহ নামে মানুষের অস্তিত্ব আছে এবং হ্যাঁ সে নিখোঁজ।
অম্বরিষ আর কিছু ভাবতে পারছে না, ওর মাথার মধ্যে অজস্র অদ্ভুত এবং অলৌকিক চিন্তা এসে ভীর জমিয়েছে, এদেরকে সরিয়ে না ফেলতে পারলে সে কিছুতেই বাঁচতে পারবে না।
উঠে পড়ে অম্বরিষ, দু-দিন আগে অম্বরিষ খবর পেয়েছে শান্তনু ঘোষ ফিরে এসেছে। অম্বরিষ ঠিক করে ফেলে আজ এখনি সে শান্তনুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে। কিছু মানুষকে ভোলা যায় না। শান্তনুর ওই অসহায় মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারেনা অম্বরিষ। সিবিআই মারফৎ আজকেই শান্তনু জেনে যাবে, বিদিশার শরীরটা পাওয়া গেছে। কিন্তু তার আগে অম্বরিষ শান্তনুর সঙ্গে দেখা করতে চায়, সে কিছুতেই চায় না যে শান্তনুর অনুভূতিগুলো সেই শীর্ষবিন্দুটাকে স্পর্শ করে ফেলুক।
Tags: ইমন চৌধুরী, কল্পবিজ্ঞান, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, বড় গল্প, রনিন