দেবদূত
লেখক: তৌফিক সরকার
শিল্পী: সুমন দাস
প্রারম্ভিকা
বিশাল কালো প্রান্তরের মধ্যে অবস্থিত শহরটি। সেটাকে ঘিরে আছে বিশাল ধূসর দেয়াল। এক রাস্তা যোগ হয়েছে মূল ফটকের সঙ্গে। ফটকের দুই পাশে দুটো বেদি, এবং সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে দুই মূর্তি। একটা সাদা শ্বেত পাথরের, আরেকটা কালো কষ্টি পাথর। একটা দেবদূতের, আরেকটা কালদূত। দুটো প্রকাশ করে শহরের সাম্যতা, সঙ্গে অস্তিত্ব।
কথিত আছে, যদি শহরের একটা মূর্তি হারিয়ে যায় ফটকের সামনে থেকে, সেই শহরের অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে কালো প্রান্তরে। কেউ মনে রাখবে না শহরটার অস্তিত্ব কোনওকালে ছিল।
আর, এই শহরের ফটকে শুধু দাঁড়িয়ে আছে কালদূতের মূর্তি।
দেবদূত, সে চলে গেছে এই শহর ছেড়ে।
(১)
হয়তো বৃষ্টি হয়েছিল। যদিও আকাশ পরিষ্কার, অর্ধেক হয়ে থাকা চাঁদের আলো ফুটে উঠেছে মেঘের ফাঁক দিয়ে। পাশার জামা পুরোপুরি ভিজে গেছে, কিন্তু তার সহকর্মীদের জামা শুকনো। তবে পাশার ভিজে জামা দেখে কেউ তাকাল বা ভ্রু কুঁচকাল না। হয়তো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। তবে সেটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও হবে।
মাথার পেছনে ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কীভাবে ব্যাথাটা পেয়েছে বলতে পারবে না। নিজেকে আবিষ্কার করে এক অন্ধকার গলিতে। ভেজা কংক্রিটের উপর শুয়েছিল। সেখান থেকে ওঠার সময় টের পায় মাথার পেছনে ব্যাথা। কীভাবে ব্যাথা পেয়েছে সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছে না।
ভেজা ওভারকোট খুলল পাশা, মুখ কুঁচকে গেল ব্যাথায়। বাড়িতে বিশ্রাম নিতে পারত, কিন্তু কী মনে করে অফিসে না-এসে পারল না।
“ঠিক সময়ে এসেছেন, বস আপনাকে খুঁজছে।” পাশ থেকে একজন বলে উঠল। বাড়িয়ে দিল একটা শুকনো তোয়ালে। ভালো করে মনে করার চেষ্টা করল সে, কিন্তু তোয়ালের মালিকের নাম মনে করতে পারল না, চেহারা তো পুরোই ঝাপসা। তাদের বিভাগে সদস্য অল্প কয়েকজন, সেখানে সবার চেহারা মনে থাকার কথা।
হয়েছে কী তার! সব স্মৃতি ঘোলা ঘোলা লাগছে।
বসের কথা মনে হতেই, মনটা তিক্ত হয়ে গেল। কেন সেটা বলতে পারবে না। মাত্র কয়েক ফুট দূরে বসের ঘর। দরজার সামনে এসে দাঁড়াল পাশা। মেহগনির দরজার সঙ্গে তামাটে বলের মতো হাতল। সেটা ধরে মোচড় দিল।
ঘরে ঢুকতেই দেখল, এক মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছে বিশাল সুইভেল চেয়ারে। তার সামনে পোড়া তামাকের কুয়াশা। দুই আঙুলের মধ্যে এক মোটা চুরুট, যেটার টকটকে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে পুরো ঘরে।
“বসো,” ডানপাশের চেয়ারে ইঙ্গিত করলেন বস। বামপাশের চেয়ারে বসা আছে একজন। পাশা তাকাল সেই ব্যক্তির দিকে, এক মহিলা। প্রথমেই চোখে পড়ল কালো চুল, সেটা যেন রাতের অন্ধকারের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। পরনে কালো চামড়ার জ্যাকেট, প্যান্ট ও সুতির শার্ট। পাশার সন্দেহ ভেতর অন্তর্বাসও কালো হবে। সেটা ভেবে মনে মনে হাসল।
পাশা বসে পড়ল। তাকাল বসের দিকে। বেশ ভারিক্কি চেহারা, ঘন ব্রাশের মতো চুলের দুই পাশ পেকে গেছে। বাকি অংশ কাঁচা-পাকা চুলের সংমিশ্রণ। মুখে মোটা এক চুরুট। চুরুটে বিশাল এক টান দিয়ে, ধোঁয়া ছাড়লেন বস, “কথা প্যাঁচাব না। তোমাকে একটা দায়িত্ব দিচ্ছি, এবং সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো কাল-পরশু সেটা গণ-মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে, তোলপাড় হয়ে যাবে সব।”
“মানে?” পাশার ভ্রু কুঁচকে গেল।
“শহরের দেবদূত চলে গেছে।”
বিশাল এক বিস্ফোরণের পর এক নিস্তব্ধতা চেপে বসে, সেটাই চেপে বসেছে এখন এই ঘরে, এবং আরও প্রকট হয়ে। পাশার চোখে অবিশ্বাস। সুইভেল চেয়ারে লোকটা কোনও ঠাট্টা-তামাশা করে না। পাশা এবার খেয়াল করল তার বসের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে আছে।
পরিস্থিতি সঙ্গিন, পাশা ভাবল। শহরের দেবদূত চলে যাওয়া মানে, সেই শহর ধ্বংসের মুখোমুখি। কয়েক মাসের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে শহর।
“আর তোমাকে এই দায়িত্ব দিচ্ছি আমি,” বস বলে উঠলেন। এমনভাবে বলেছেন যেন তেতো কিছু গিলেছেন, “একমাত্র তুমিই ফাঁকা আছ।”
পাশা কিছু বলল না। তার মুখটাও তেতো হয়ে গেছে।
“তোমার সঙ্গে থাকবে আরুণি,” বস বললেন।
অদ্ভুত নাম, মনে মনে বলে উঠে সে। তাকাল পাশে বসা কালো জামা পরা মেয়েটার দিকে। তার ধারালো চেহারা মোমের মতো ফর্সা। নির্বিকার হয়ে বসে ছিল এতক্ষণ, সে পাশার দিকে ঘুরে মাথা দোলাল, তারপর ফিরে গেল আগের নির্বিকার রূপে।
মেয়েটাকে খেলনা পুতুল বলে মনে হল পাশার। বসের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কোনও সূত্র ছাড়া কীভাবে খুঁজে পাব দেবদূতকে?”
“সেটা তোমার দায়িত্ব,” বস বললেন, “এ ব্যাপারে আরুণি সাহায্য করবে তোমাকে।”
“খুঁজে পাওয়া যাবে,” এবার মেয়েটা বলল, “দেবদূত নিজের শহর সহজে ছাড়তে পারে না। সে এক মৃত মানুষের দেহে ভর করে শহরে ঘুরতে থাকে। এখন কোনও মৃত মানুষকে খুঁজতে হবে যে এখন শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
পাশা একটা তিক্ত হাসি দিয়ে বলল, “এত সোজা করে বলছেন, যেন এই রুম থেকে বের হলেই আমরা ঘুরতে থাকা জিন্দা-লাশ খুঁজে পাব, আর বলব তুমিই দেবদূত। এই শহরে অন্তত হাজারখানেক মানুষ আছে মৃত, কাগজে-কলমে, কিন্তু ঘুরছে-ফিরছে বেশ আরামের সঙ্গে। সেখানে আপনি এই কয়েক দিনে কীভাবে কাঙ্খিত মৃত মানুষ খুঁজে বের করবেন?”
“পাপহীন এক মানুষের দেহে ভর করবে দেবদূত।” মেয়েটা বলল।
“যাক একটু সহজ হল এবার। এই শহরে পাপ করেনি এমন মানুষ আঙুল দিয়েও গোনা লাগবে না। সহজ কথা, গোনাই লাগবে না।”
“বাচ্চারা তো নিষ্পাপ,” আরুণি বলল, “তাদের ওপর দেবদূত ভর করতে পারে।”
“এতক্ষণ কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, এখন পেলাম। এখন আমাদের বের করতে হবে এমন এক বাচ্চাকে যে কিনা সম্প্রতি মারা গেছে এবং ঘুরে বেড়াচ্ছে এই শহরে।”
অনুসন্ধানের পরিধি কিছুটা কমলে, তার বিশালত্ব কমেনি। শহরে মৃতের হার অনেক, সেখানে শিশুমৃত্যুর পরিমাণও কম না। সেখান থেকে দেবদূত খুঁজে বের করা কঠিন এক কাজ। তবে একটা মাধ্যমে হয়তো অনুসন্ধনের পরিধি কমতে পারে। সেটাই আগে দেখবে সে।
কিন্তু দেবদূত, এক অজানা জিনিস পাশার কাছে। হ্যাঁ, সে ফটকের সামনে দেবদূত ও কালদূতের মূর্তি দেখেছে। তার কাছে মনে হয়েছে এটা প্রতীকী চিহ্ন ছাড়া আর কিছু না। ঠিক বহু বছর আগে ধর্মের মতো। এক প্রতীক নিয়ে অন্ধ থাকত, চেষ্টা করত নিজেদের সেরা প্রমাণ করার। তাদের হানাহানিতে এই পর্যন্ত যত মানুষ মারা গেছে, রোগে শোকেও মনে হয়নি মারা গেছে এত মানুষ। এখনও তারা টিঁকে আছে। এক কাল্ট হয়ে লুকিয়ে আছে সমাজের গভীরে। আড়ালে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে সমাজ নামের এক পুতুলের সুতো।
“তাকে খুঁজে পেলে কী করব,” পাশা বলল, “এক জ্বীহনকে আটকে রাখতে পারব আমি, কিন্তু দেবদূত…”
“সেটার ব্যবস্থা আরুণি করবে,” বস তাকে থামিয়ে বললেন, “সে এই বিষয়ে দক্ষ।”
বসের দিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল পাশা, দুই চোয়াল শক্ত করে বসে থাকল শুধু।
বস হাতের ইশারা দিয়ে বললেন চলে যেতে। পাশা একবার মাথা ঝাঁকিয়ে চেয়ার থেকে উঠে, সোজা দরজার দিকে গেল।
“পাশা,” পেছন থেকে বস বলে উঠলেন, “আমাদের হাতে সময় কম। এই সময়ের মাঝে দেবদূতকে খুঁজে বের করো।”
(২)
মেজাজ গরম হয়ে গেছে পাশার। কাজটা যেন এক প্রকারে গছিয়ে দেয়া হয়েছে তার ঘাড়ে। অতিপ্রাকৃত বা জ্বীহন হলে তাদের সামাল দেয়া যায়, কিন্তু কীভাবে এক দেবদূতকে খুঁজে বের করবে? যার অস্তিত্ব সে বিশ্বাস করে না।
আরুণি নামের মেয়েটা তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“অবি-তে স্বাগতম,” পাশা কিছুটা নাটকীয়ভাবে বলার চেষ্টা করল, কিন্ত মাথা ব্যাথার কারণে পারল না। সে বলতে থাকল, “অবি মানে হচ্ছে অতিপ্রাকৃত বিভাগ। এখানে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ে তদন্ত করা হয়। গোয়েন্দা বিভাগের একটা অংশ, ওপর তলায় অপরাধ দমন বিভাগ আছে। যদিও সেটার কথা আলাদা। আমরা জাদুবিদ্যা হারিয়ে ফেললেও, তার রেশ কিছু রয়ে গেছে। সেগুলোর সমধানের জন্যই আমাদের বিভাগ, এছাড়া জ্বীহনদের সামলানোর কাজও আমাদের।”
মেয়েটার মুখ তাচ্ছিল্যের এক হাসি দেখা দিল, যেটা পাশার ভালো লাগেনি। কিন্তু সে চুপ করে থাকল। মানুষেরা অনেক বিদ্যাই হারিয়ে ফেলেছে, তাদের মধ্যে জাদুবিদ্যাও ছিল। প্রাচীন বই পড়ে জানা যায় মানুষ জাতি জাদুবিদ্যা ব্যবহার করে নিজেদের অন্য এক পর্যায়ের নিয়ে যায়, তারপর আসে প্রযুক্তিবিদ্যা। দুটোর মধ্যে প্রথমে ছিল বিভেদ, তারপর তারা বুঝতে পারে, এ দুটো অপরের পরিপূরক। দুটোর সমন্বয় মানবজাতিকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়। কিন্তু বেশিদিন সেই সমন্বয় থাকেনি। ধীরে ধীরে জাদুবিদ্যার পরিধি কমে যেতে থাকে, বাড়তে থাকে প্রযুক্তিবিদ্যার আধিপত্য। মানুষদের সঙ্গে ছিল জ্বীহন জাতি। জাদুবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে তারাও কালের গর্ভে হারিয়ে যায়, অল্প কিছু জ্বীহন টিকে আছে। সেগুলো অবশ্য উল্লেখযোগ্য কিছু না, কিন্তু মাঝে মাঝে অবি সদস্যদের মাথার ঘাম পর্যন্ত ছুটিয়ে দেয়।
আরুণিকে নিয়ে পাশা সোজা চলে গেল নিজের ডেস্কে। ঘরের এক কোণায় সেটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে আছে। আশপাশে অন্য কোনও টেবিল নেই। ছোট ঘরের মধ্যে, ছোট এক নির্জন জায়গা। সেখানে কয়েকটা ফাইল ও টুকটাক অফিসের জিনিস ছাড়া এর কিছুই নেই। দেখে মনে হবে কোনও গোয়েন্দার না, বরং এক কেরানির টেবিল।
একটা লোহার চেয়ার টেনে এনে, “বসুন।” তারপর পাশা বসে পড়ল নিজের চেয়ারে। কোনও ভূমিকার মধ্যে গেল না। “আপনি বলেছিলেন এক বাচ্চার দেহে ভর করতে পারে দেবদূত।” প্রসঙ্গ টানার মতো করে বললেও, সেখানে প্রশ্নের ছাপ ছিল স্পষ্ট।
“আমি বলেছি দেবদূত নিষ্পাপ মানুষের দেহে ভর করে। মানুষ যদি ছোট একটু পাপও করে থাকে, দেবদূত তার শরীরে ভর করবে না।”
“করবে না, নাকি করতে পারবে না?”
“করবে না,” আরুণি বলল, “কারণ, পাপী-মানুষের দেহে ভর করে, দেবদূত নিজের আত্মার কথা ভুলে যাবে। তাই সে পাপী-মানুষের দেহ ভর করবে না। তবে কালদূত সব মানবদেহে ভর করতে পারে।”
“দেবদূতের আত্মাও আছে নাকি?” পাশা কিছুটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “আমি তো জানতাম দেবদূত ও কালদূত শুধু শহরের দরজা পাহারা দেয়। আর তারা চলে গেলে সেই শহর ধ্বংস হয়ে যায়।”
“আত্মার উপর দিয়েই তো সবকিছু তৈরি।” আরুণি বলল এক বাঁকা হাসি দিয়ে, “এই দুনিয়ায় অনেক কিছুই আছে যা মানুষেরা ভুলে গেছে, বা জানে না। আগে জানার চেষ্টা থাকলেও, এখন সেটা মরে গেছে।”
এক কাল্ট সদস্যের মতো কথা। হয়তো আরুণি কাল্ট থেকে এসেছে, সাবধানে কথা বলতে হবে তার সঙ্গে।
“দেবদূত যদি কোনও বিন্দুমাত্র পাপ থাকা দেহের মাঝে ভর করে,” আরুণি বলতে থাকল, “সেই ভর করা দেহে ফুটে উঠে কালো ক্ষয়চিহ্ন। ক্ষয় হতে হতে, সেই দেহের সঙ্গে মিলিয়ে যায় দেবদূতের অস্তিত্ব।”
পাশার ভ্রু কুঁচকে গেল, “আপনি দেখছি দেবদূত সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন।”
“আমাকে রাখতে হয়,” রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলল আরুণি।
আরুণি কাল্ট থেকে এসেছে, এই ধারণা পোক্ত হল পাশার কাছে। এই মেয়েটার কাছ থেকে সাবধান থাকতে হবে। আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসার জন্য সে বলে উঠল, “বুঝলাম, এখন আমদের মৃত বাচ্চা খুঁজতে হবে।”
“সেটা সাম্প্রতিক হতে হবে।” পাশার কথার মাঝখানেই আরুণি বলল, “তিন কি চারদিনের মৃত। বয়স দশ থেকে বারোর মধ্যে।”
যাক অনুসন্ধারের পরিধি আরও কিছুটা কমল। কিন্তু এই শহরে প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশটা শিশু মারা যায়। অধিকাংশর বয়স দশের নীচে থাকে। ধরা যাক গড়ে সাতজন বাচ্চা মারা গেল, তা হলে গত চারদিনের হিসেব ধরলে হয় আঠাশ। পাশা মনে মনে হিসেব করল। এখন মৃত বাচ্চা জীবিত হয়ে যাবার খবর নিতে হবে। আশা করা যাক সেটা বেশি সময় লাগবে না।
পাশা ড্রয়ার খুলে চিরকুটের মতো একটা কাগজ বের করল। একটা চিহ্ন আঁকা সেখানে। টেবিলের এক কোণা থেকে ছোট পিন নিয়ে, নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলে ফোটাল। কয়েক ফোঁটা রক্ত কাগজের উপর রেখে অপেক্ষা করতে থাকে। ছোট এক আলোর ঝলক দেয়া যায় সেখানে। তারপর সে ঘড়ির দিকে তাকায়। আনমনে বলে উঠে, “ঠিক আছে।”
তারপর উঠে দাঁড়ায়। আরুণির দিকে তাকিয়ে বলে, “চলুন।”
“কোথায়?” চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করে আরুণি।
“আমার সোর্সের কাছে।”
আরুণি চুপ করে থাকল, পাশা বলতে থাকল, “এই শহরের সব নাড়ি-নক্ষত্র তার জানা। যদিও তার আসল পরিচয় আপনার পছন্দ হবে না।”
চোখ আরও সরু করল আরুণি। প্রশ্ন না করলেও, সেটা তার চোখে লেগে আছে। কে সে?
“এক গুডরোবঙ্গা।” এক বাঁকা হাসি দিয়ে বলল পাশা, “হ্যাঁ, সে এক জ্বীহন।”
(৩)
একসময়, যখন এই দুনিয়াতে জাদুবিদ্যা পৌঁছে গেছিল এক অন্যতম শিখরে, সেই সময়ে মানব জাতিদের পাশাপাশি ছিল জ্বীহন জাতি। তারা ছিল দুইভাগে, অভিজাত জ্বীহন ও নীচু জ্বীহন। এদের মধ্যেও ছিল শাখা-প্রশাখার মতো অনেক ভাগ।
অভিজাত জ্বীহনদের ছিল উচ্চ জাদুক্ষমতা। নীচু-জাত জ্বীহনদের জাদু ক্ষমতা কম ছিল, তারা চলত নিজেদের সহজাত ক্ষমতা দিয়ে। এই ক্ষমতা সাধারণ জন্তু-জানোয়ার থেকেও তীক্ষ্ণ ছিল।
ধীরে ধীরে দূর্বল হতে থাকে জাদুবিদ্যা, অভিজাত জ্বীহনরা দূর্বল হতে থাকে, কারণ জাদুর সঙ্গে তাদের আত্মার এক সম্পর্ক ছিলো। তারা কোনও কারণে প্রযুক্তিবিদ্যা মেনে নেয়নি। তারা চেয়েছিল জাদুবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে তারাও যেন হারিয়ে যায় চিরতরে। টিঁকে থাকে অল্প কিছু নীচু জাতের জ্বীহন, তাদের মধ্যে গুডরোবঙ্গা অন্যতম।
গুডরোবঙ্গাদের কাজ হচ্ছে তথ্য সংগ্রহ করা। খুদে শরীর নিয়ে তারা ঢুকে যেতে পারত যে-কোনও জায়গায়। মিশে যেতে পারত যেকোনও কিছুর সঙ্গে। তাই কোনও শত্রুর আস্তানায় পাঠিয়ে তার সম্পর্কে যে-কোনও তথ্য সংগ্রহ করে নেওয়ায় তাদের কোনও জুড়ি নেই। তাদের পারিশ্রমিক অবশ্য চড়া। তাদের নিজস্ব সোনার মুদ্রায় দিয়ে হয় সেই পারিশ্রমিক। সেই মুদ্রাও সহজে পাওয়া যায় না।
পূর্বপুরুষদের পেশা এখনও ধরে রেখছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায়, বদলে গেছে পারিশ্রমিকের ধরন। এখন আর মুদ্রা না, তাদের মুদ্রার ওজনে সোনা দিলেই সন্তুষ্ট। সৌভাগ্যবশত পাশার কাছে কিছু সোনা আছে, যা দিয়ে সে এক গুডরোবঙ্গার কাছে থেকে আরও দুই-তিনবার তথ্য বের করতে পারবে।
পাশা ও আরুণি দাঁড়িয়ে আছে এক পুরাতন গুদামের পাশে। নদীর পাশে সেটা অবস্থিত। কংক্রিটের পাড়ের পরেই শুরু হয়েছে নদী। কংক্রিটের সঙ্গে নদীর ঢেউয়ের সংঘর্ষের ‘ছলাৎ’ শব্দ ভেঙে দিচ্ছে চারপাশের নীরবতা। ঢেউয়ের সঙ্গে আসা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে তাদের উপর দিয়ে। প্রায় ভেজা ওভারকোট এখনও তার পরনে, শরীর তার ঠান্ডা হয়ে থাকলেও, শীত লাগছে না মোটেও। আর আরুণির চেহারা দেখেও বোঝা যাচ্ছে না, তার শীত লাগছে কি না।
এখানেই গুডরোবঙ্গার সঙ্গে পাশার মিলিত হবার কথা।
ঘড়ির দিকে তাকাল পাশা। গুডরোবঙ্গার এসে পড়ার সময় হয়ে গেছে। সময়ের কোনও হেরফের করে না তারা।
“আপনাকে এই কারণে আমার পছন্দ,” অন্ধকার থেকে খ্যানখেনে গলা শোনা গেল। গুদামঘরের সামনে থাকা মিটমিটে আলোর নীচে এসে দাঁড়াল গলার মালিক।
উচ্চতায় তিন ফুটের বেশি হবে না। ময়লা গায়ের রঙ, পরনে ছোট নেংটি ও কপালের দুই পাশে ছোট দুটি শিং।
“অল্প সময়ে আবার তলব, নিশ্চয়ই জরুরি কিছুর মাঝে আছেন,” গুডরোবঙ্গা এই বলে তাকাল আরুণির দিকে। চোখ বড় বড় হয়ে গেল, “শেষ বিস্ময় তা হলে দেখে ফেললাম। এই অধমের নাম রিঙ্গা।” সে আরুণির দিকে এগিয়ে বলল, “আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।”
ভ্রু কুঁচকে গেল পাশার। এই গুডরোবঙ্গার নাটকীয়তা অনেক পছন্দ। কী বিস্ময় সেটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, তখনই গুডরোবঙ্গা ঘুরল পাশার দিকে, “বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি।”
“একটা বাচ্চাকে খুঁজে দিতে হবে। দশ-বারো বছরের মতো হবে।”
গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকল গুডরোবঙ্গা, “আবার!”
আগেও কোনও বাচ্চাকে খুঁজতে বলেছিল নাকি? মনে নেই পাশার। এখন তার খেয়াল হল, জ্ঞান ফেরার পর, সে আগের কোনও ঘটনা মনে করতে পারছে না। মুখের ভেতর শুকিয়ে গেল তার। শুকনো এক ঢোঁক গিলল, চেহারা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। মনে হল এটা নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত। আগে মৃত বাচ্চার খোঁজ নিতে হবে।
“হারিয়ে যাওয়া মানুষ খুঁজে বের করা তো আপনাদের কাজ।” গুডরোবঙ্গা বলতে থাকল, “গোয়েন্দা বিভাগ খোলাই হয়েছে তো মানুষের ঝামেলা মেটার জন্য।”
“একটা মৃত মেয়ে—” পাশা বলল— গুডরোবঙ্গা তার চিন্তার জাল ছেদ করেছে ফেলেছে, “গত দুই দিনের মধ্যে কোনও মৃত মেয়েকে জীবিত হতে দেখেছ?”
গুডরোবঙ্গা তাকিয়ে আছে গোল গোল চোখে। মনে হচ্ছে পুরো পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। সে তাকাল আরুণির দিকে। যেন মেয়েটার তার প্রশ্নের জবাব দেবে। কী দেখল আরুণির চোখে সেটা গুডরোবঙ্গা ভালো বলতে পারবে।
“কেন সেটা জানতে পারি?” গুডরোবঙ্গা জিজ্ঞেস করল।
গুডরোবঙ্গা সাধারণত কোনও প্রশ্ন করে না। প্রশ্নের জবাব দেয় শুধু। আজকে সে প্রশ্ন করল। পাশা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, “শহরের দেবদূত চলে গেছে, সেটা তো জানো। বাকিটা তো আর বলতে হবে না।”
গুডরোবঙ্গার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তার চোখ পাশার দিকে নয়, যেন পাশার পিছে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই স্বাভাবিক হল সেই দৃষ্টি, বাঁকা হাসি আবার ফিরে আসল। যেন দুনিয়ার সেরা এক পরিহাস দেখে ফেলেছে।
“হুম, এখন বুঝতে পেরেছি। আপনারা দেবদূতের খোঁজে আছেন।”
“বুঝতে পেরেছ বলে খুশি হলাম, এখন আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
“হ্যাঁ, একটা বাচ্চার কথা জানি। এগারো বছরের এক মেয়ে। দেখেছি একজনের সঙ্গে গাড়িতে করে যেতে। আমি তখনই মেয়েটার নিয়তি টের পেয়ে যাই। বাঁচবে না সে। দেবদূত ভর করলে সেই মেয়েটার উপরেই করবে।”
“কোথায় সে?” পাশার গলায় অধৈর্য্যের ছাপ।
“আমার কাছে সেটার জবাব নেই,” গুডরোবঙ্গা মাথা নীচু করে বলল। “আমি যে-কোনও জায়গায় যেতে পারব, সেটা হোক কোনও দুর্ভেদ্য দুর্গ বা মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা কোনও গুহা। কিন্তু মৃত মানুষের উপর ভর হয়ে থাকা দেবদূতের সন্ধান আপনাকে জানাতে পারব না। এর জন্য দরকার আত্মিক যোগ, যেটা করা যাবে একমাত্র জাদুর মাধ্যমে। আর এই অধম অনেক আগেই সেই বিদ্যা ভুলে গেছে।”
“তার মানে তুমি জানাতে পারছ না কীভাবে পাব মেয়েটাকে,” পাশা বলল। দেবদূতের নাম সে মুখে আনছে না।
“একটা পদ্ধতি আছে,” গুডরোবঙ্গা বলল।
“কী সেটা?”
“তান্ত্রিক।” গুডরবোঙ্গা বলল, “এক তান্ত্রিক পারবে মৃত মানুষের সন্ধান দিতে। তারাই একমাত্র জাদুবিদ্যা টিকিয়ে রেখেছে। ঠিক বিশাল নদীতে এক টুকরো খড় আঁকড়ে ধরার মতো।”
সমস্যা হচ্ছে পাশা এমন কোনও তান্ত্রিককে চেনে না, যে মৃত মানুষের সন্ধান দেবে। গুডরোবঙ্গাই সমাধান দিয়ে দিল, “আমি আপনাকে সন্ধান দিতে পারব সেই তান্ত্রিকের।”
ঠিকানা দেওয়ার পর গুডরোবঙ্গা এগিয়ে গেল নদীর দিকে। জলকে মারাত্মক ভয় গুডরোবঙ্গার। সাঁতার জানে না তারা, তাই নদীর কাছে যাওয়া মানে মৃত্যুকে স্বাগত জানানো।
“কী করছ তুমি?” পাশা জিজ্ঞেস করল।
গুডরোবঙ্গা কিছু না বলে ঝাঁপ দিল গভীর নদীতে।
(৪)
ক্লান্তি চেপে বসেছে পাশার মধ্যে। শরীরটা যেন ভারী হয়ে আছে সিসার মতো। গুডরোবঙ্গাকে আত্মহত্যা করতে দেখার পর, সেদিনের জন্য ক্ষান্ত দেয়। শরীর টানতে ইচ্ছে হচ্ছিল না তার।
গুডরোবঙ্গার মৃত্যু নিয়ে রিপোর্ট না লিখলেও চলবে। একটা জ্বীহনের মৃত্যু মাথা ঘামানোর বিষয় না। অনেক জ্বীহনকে রাস্তার মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ সেদিকে বিন্দুমাত্র তাকায় না। এক আবর্জনার টুকরো মনে করে শুধু।
আরুণিকে বলে সে চলে আসে নিজের বাড়িতে। ছোট ঘর। এক বেডরুম, ছোট রান্নাঘর কাম ডাইনিং রুম। আর একটা বাথরুম। তার মতো ব্যাচেলার মানুষের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
নিজের জামা কাপড় খুলে, ছুড়ে মারে বিছানার দিকে। শাওয়ারের নীচে এসে ছেড়ে দেয় গরম জল। উষ্ণতা যেন তার সারা শরীরের ছড়িয়ে দেয়, পেশির জটগুলো যেন খুলে যাচ্ছে, সঙ্গে বেড়ে গেল মাথা ব্যাথা। খেয়াল করল শরীরের বেশ কিছু জায়গায় কালশিটে পড়ে গেছে। হয়তো কোথাও মারামারি করে সে জিততে পারেনি। অবাক করার বিষয় হচ্ছে কালশিটে পড়া জায়গা থেকে কোনও ব্যাথা টের পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু মাথায় ভোঁতা অনুভূতিটা জ্বালাচ্ছে।
শাওয়ার বন্ধ করে, কোমরে তোয়ালে প্যাঁচানো অবস্থায় বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথা ঝিমঝিম করছে। এতটা অসুস্থভাব আগে কোনওদিন লাগেনি পাশার। আর কীসের স্মৃতি যেন তাকে খোঁচাচ্ছে। চেষ্টা করছে মনে করার, কিন্তু পারছে না।
এই অবস্থায় এসে পড়ল ঘুম। স্বপ্ন হল ছাড়া-ছাড়া। দেখল সাদা পোশাক পরা একটা মেয়ে এক গাড়ির ভেতর পড়ে আছে অজ্ঞান হয়েছে। পাশার মনে হল ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা লোকটা সে। কিন্তু একটু পরে সে আবিষ্কার করে গাড়ি বাইরে। ড্রাইভার ও অজ্ঞান মেয়েটা চলে যাচ্ছে তাকে রেখে। গাড়ির নম্বর পরীক্ষার করতে পারত, কিন্তু তার চোখের সামনে এখন সব কিছু ঘোলা। কুয়াশার জাল বিস্তার করে, তারপর নিজেকে আবিষ্কার করে ফটকের সামনে, যেখানে দুই মূর্তি থাকার কথা। দেবদূতের মূর্তি নেই, নেই কালদূতেরও।
হুট করে, এক নির্জন গলির মাথায় আবিষ্কার করে, হঠাৎ বাম মাথায় ব্যাথা, যেন আঘাত করেছে কেউ। সব অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকার হবার আগে তার চোখের সামনে ভেসে থাকে এক সাদা অস্তিত্ব।
পাশা নিজেকে আবিষ্কার করে বিছানায়। কপালে হাত দিল ঘাম মোছার জন্য, কিন্তু সেটা ছিল একদম ঠান্ডা। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে আবার জড়তা আবিষ্কার করে। কী হয়েছে তার শরীরে?
জানালার ফাঁক দিয়ে, দেখা যাচ্ছে ধূসর আকাশ। সকাল না দুপুর সেটা বোঝা যাচ্ছে না। রাতের মতো, এখন দিন ধূসর হয়ে থাকে। হোক সেটা, গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত কিংবা শীত। ধূসর আবহ বয়ে চলে সারা বছর।
পাশা বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করল না। টের পেল চোখ আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এবারের ঘুমে কোনও স্বপ্ন ছিল ছিল না, ছিল শুধু অন্ধকার।
দরজায় জোরে বাড়ি পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল আবার। প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠল পাশা। মাথায় ভোঁতা অনুভূতিটা রয়ে গেছে। লম্বার ঘুম দেয়ার পরেও, শরীরের ভারী-ভাব এখনও কমেনি। দরজায় মনে হচ্ছে কিল-ঘুসি চলছে এখন।
“কে?” চেঁচিয়ে বলল পাশা।
“আরুণি।”
পাশা দরজার দিকে এগোতেই টের পেল, দিগম্বর আছে। কোমরে টাওয়েল পেঁচিয়ে ঘুমিয়েছিল। সেটা এখন বিছানায় পড়ে আছে অনাদরে।
“একটু দাঁড়ান, আমি বের হচ্ছি।”
পাশা হ্যাঙারে ঝোলানো শার্ট-প্যান্ট পরে নিল। ভারী শরীরে কিছুটা সময় লাগল। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চমকে গেল। বেশ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার চেহারা। যেন রক্তশূন্যতায় ভুগছে। চুল কোনওরকমে আঁচড়ে, সে দরজার খুলল।
আরুণি বাইরে দাঁড়ান, গতকালের পোশাক পরনে। চেহারা নির্বিকার থাকলেও, হয়তো মনে মনে বেশ অধৈর্য্য হয়ে আছে।
“দুঃখিত, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।” পাশা দরজা আটকানোর সময় বলল। হালকা হলেও সেখানে ছিল অজুহাতের ছাপ।
“বিকেল পর্যন্ত?”
“প্রচুর ক্লান্ত ছিলাম। কোনও খবর?” পাশা জিজ্ঞেস করল।
“এখনও দেবদূতের সন্ধান পাওয়া যায়নি,” আরুণি বলল। “আর সকাল থেকে তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। তোমার ডেস্কে বসেছিলাম দুপুর পর্যন্ত। তারপর এখানে চলে আসি।”
“ও, আচ্ছা।” মেয়েটার সম্বোধনের ধরনে অস্বস্তি লাগল তার। হুট করেই ‘তুমি’-তে চলে আসা কেমন-জানি লাগছে।
“এখন কোথায় যাবে?”
“তান্ত্রিকের কাছে। গুডরোবঙ্গার দেওয়া ঠিকানা আছে আমার কাছে। চলো যাই।” পাশাও বদলে ফেলল সম্বোধনের ধরন।
তান্ত্রিকের আস্তানা যে রাস্তার পাশে হবে না, সেটা ভালো করে ধারণা ছিল পাশার। বেশ কয়েকটা অন্ধকার মোড়া গলি পার হবার পর, তান্ত্রিকের আস্তানা চোখে পড়ল। পুরোনো ধাঁচের বাড়ির নীচতলায় সেটা। জানালার উপর থাকা ছোট সাইনবোর্ড না থাকলে বোঝা যেত না এটা কোনও তান্ত্রিকের আস্তানা। দরজার হালকা নক করে ঢুকে পড়ল দুজনে। সন্ধ্যা ততক্ষণে নেমে পড়েছে। ঘরের আধো অন্ধকার ঘন হয়েছে আরও। ঘরের চার কোণায় মোমবাতি জ্বালানো, সেখান থেকে টিমটিমে আলো বের হচ্ছে। ঘরের মাঝখানের মোমবাতির আলো আরও উজ্জ্বল, সেখানে বসে আছে এক মহিলা। সে-ই তা হলে তান্ত্রিক।
“কী কারণে আসা হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল মহিলা তান্ত্রিক। বয়স্ক মহিলার গলায় হালকা পুরুষালী ভাব আছে।
“এক জিন্দা-লাশের খোঁজে,” পাশা কোনও ভূমিকা না করেই বলল।
আধো আলোয় মুখে বাঁকা হাসি দেখা গেল বৃদ্ধার, “শহরের দেবদূত চলে যাওয়ার পর, এই শহরটাই তো জিন্দা-লাশ হয়ে গেছে। সেখানে মানুষের জিন্দা-লাশ খোঁজা—”
কথা শেষ না করে মাথা নাড়াতে লাগল বৃদ্ধা।
পাশা তাকাল আরুণির দিকে। সে মাথা নাড়িয়ে বোঝাল, গণ-মাধ্যম এখনও জানে না দেবদূতের অন্তর্ধানের খবর। এই বৃদ্ধা তা হলে জানল কীভাবে?
“দেবদূত ও কালদূত এতদিন ছিল এক বিশ্বাসের প্রতীক,” বৃদ্ধা তান্ত্রিক বলতে থাকে। “শহরের ফটকের সামনে থাকা এক অলংকরণ ছাড়া আর কিছুই না। এখন তারা বিশ্বাস করবে দেবদূত ও কালদূত অবশ্যই ছিল, এবং তাদের ছেড়ে চলে গেছে। শহরের ধ্বংস এখন অনিবার্য।”
“আমরা অবশ্যই খুঁজে বের করব দেবদূতকে,” পাশা জোর দিয়ে বলল।
“তা হলে একজনের দেহে ভর করেছে দেবদূত?” বৃদ্ধার বাঁকা হাসি আরও বড় হল।
“আপনি দেবদূত ও কালদূত সম্পর্কে কী জানেন?” পাশা জিজ্ঞেস করল। এই প্রথম তার মনে হল দেবদূত ও কালদূত সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। এতটুকু জানে, শহরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই মূর্তি হচ্ছে দেবদূত ও কালদূত। তারা সাম্যের প্রতীক। তারা চলে গেলে শহরের ধ্বংস অনিবার্য। প্রথমে পাশা এসবে বিশ্বাস করত না। অবি-তে আসার পর, মোটামুটি অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ে জ্ঞান হয়েছে। এই অতিপ্রাকৃত জিনিস, জ্বীহন, প্রায় হারিয়ে যাওয়া জাদুবিদ্যা তাদের আশপাশেই আছে। তারা এতদিন ধরে দেখছে। কিন্তু এদের সম্পর্কে কিছুই জানে না।
প্রথমে দেবদূত ও কালদূত সম্পর্কে জানা কথাগুলোই বলল বৃদ্ধা তান্ত্রিক— “আগে এই দুনিয়া ছিল অনেক সমৃদ্ধ। ধূসর ছিল না, ছিল হাজারো রঙের ছোঁয়া। জাদু ভেসে বেড়াত সব জায়গায়। মানুষ ও জ্বীহনদের মধ্যে ঐক্য না থাকলেও, এক সমঝোতা ছিল। একে অপরের গণ্ডি মাড়ানোর চেষ্টা করত না। কিন্তু সব কিছু পূর্ণযৌবনা থাকে না। সময়ের স্রোতে যৌবন এগোতে থাকে বার্ধ্যকের পথে। আমাদের দুনিয়াও বার্ধক্যের দিকে এগিয়েছে। প্রথমে হারিয়েছি জাদু, তারপর হারিয়ে গেল অধিকাংশ জ্বীহন জাতি। মানুষ নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য প্রযুক্তির দিকে হাত বাড়ায়। সেটা শুধু বার্ধক্যের গতি হালকা কমিয়েছে মাত্র। একসময় মানুষ ভুলে যায় তাদের দুনিয়ার নাম। হ্যাঁ, আমাদের এই দুনিয়ার নাম ছিল, কিন্তু সবাই ভুলে গেছে সেই নাম।”
বৃদ্ধা থামল। পাশা ও আরুণি চুপ করে আছে। তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা আবার শুরু বলা শুরু করল।
“নিজেদের টিঁকিয়ে রাখার জন্যই, মানুষেরা শহর তৈরি করল। নিজেদের বন্দি রাখল সেখানে। আর শেষ জাদুবিদ্যা, হ্যাঁ, শেষ জাদুবিদ্যা দিয়ে ফটকের সামনে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবদূত ও কালদূতকে। তারাই নিয়ন্ত্রণ করে শহরের সাম্য। যে-কোনও এক দূত চলে গেলে, সে আরেক দূতক আহ্বান জানায় চলে যাবার জন্য। দুই দূত চলে গেলে সেই শহর ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমার জানা-মতে কোনও দেবদূত তার অবস্থান থেকে চলে গেলে ফিরিয়ে আনার কোনও পথ নেই। সেই শহর ধ্বংস হয়ে যাবে।”
“মনে করলাম, দেবদূত চলে গেলে কেন কালদূতও তার পিছু নেবে?” পাশা জিজ্ঞেস করল। “কালদূত একাই পুরো শহরে আধিপত্য চালাতে পারে। এটাও শুনেছি, কালদূতও চলে গেলে নাকি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। সেটা কেন হবে? একা দেবদূত থাকলে তো সেই শহর আরও সমৃদ্ধির দিকে এগোবে।”
এক তাচ্ছিল্যের হাসি দিল বৃদ্ধা তান্ত্রিক, “সবাই মনে করে দেবদূত ও কালদূত একে অপরের শত্রু, কিন্তু তারা শত্রু নয়। একে অপরের পরিপূরক। অনেকের ধারণা দেবদূতের ভালো প্রভাবের বিরুদ্ধে নিজের খারাপ প্রভাব চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সেটা নয়, দেবদূত না চাইলেও তার ভালো প্রভাব ছড়িয়ে দিতে থাকে মানুষের মধ্যে, তেমনি কালদূত নিজের মন্দ প্রভাব ছড়ায়। এক নিয়তির খেলায় তারা বন্দি। একমাত্র মানুষই পারে কোন প্রভাব বিরাজ করবে নিজের মধ্যে। মনে হতে পারে, ভালো প্রভাব ছড়ালে তো মঙ্গল হয় সবার জন্য। কিন্তু একটা প্রবাদ সবাই প্রায় ভুলে যায়, অতিরিক্ত মিষ্টি কিন্তু বিষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের মধ্যে যখন ভালো এসে পড়ে, সে তখন হয়ে যায় উদ্যমহীন। হয়ে যায় নিয়তির এক পুতুল, এক যান্ত্রিক সত্তা। আর হারিয়ে ফেলে মনুষত্ব। সেটা হারিয়ে ফেললে তো তাকে আর মানুষ বলা যায়। তাই দেবদূতের মতো কালদূত চলে গেলে শহরের ধ্বংস অনিবার্য। আর এই শহরের দেবদূত তো চলে গেছে, তাই এর ধ্বংস অনিবার্য।”
“যেভাবেই হোক দেবদূতকে আমি ফটকের বেদিতে বসাবই,” পাশা জোর গলায় বলল, “আমার শুধু দরকার দেবদূতের অবস্থান। আমার ধারণা একটা মৃত মেয়ের উপর ভর করেছে দেবদূত,” পাশা বলল।
“হ্যাঁ, একজনের উপর তো ভর করেছে,” বৃদ্ধা বলল রহস্যের গলায়।
“কী বলতে চান, মেয়েটার উপর তা হলে দেবদূত ভর করেনি?” পাশার গলার স্বর তীক্ষ্ণ হয়ে আসে। এতক্ষণ বৃদ্ধার ঘ্যানঘ্যান শোনার পর, দেবদূতের সন্ধান নিয়ে রহস্য করলে মেজাজ তো খারাপ হবেই।
“সেটা আমি পরিষ্কার বলতে পারব না,” বৃদ্ধা বলল, “তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি। দেবদূতের সন্ধান হয়তো দিতে পারব।”
“নেমে পড়ুন,” পাশার গলায় অধৈর্য্যের ছাপ।
বৃদ্ধা তান্ত্রিক বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। বেশ কিছু শুকনো ঘাস-পাতা, কিছু প্রাণীর চামড়া একটা ষড়ভূজাকার চিহ্নের মধ্যে রাখে সাজিয়ে। সঙ্গে বলতে থাকে, “জাদুবিদ্যার অল্প কিছু জিনিস টিঁকে আছে এখনও। যদিও সেটাও হারিয়ে যাবে শীঘ্রই। অতিপ্রাকৃতের পরিমাণ অনেক কম। তাই এই জাদু কাজ দিবে অনেক। সহজেই আমরা দেবদূতের অবস্থান বের করতে পারব।”
বৃদ্ধা তান্ত্রিকের গোছানো হল সবকিছু। তারপর শুরু করে এক মন্ত্র পড়া। চারপাশের পরিবেশ ভারী হতে থাকে। পাশার মনে হল চারপাশে বাতাস ঘন হয়ে গেছে, সে যেন আটকে গেছে আঠালো কোনও স্যুপের ভেতর। উজ্জ্বল হয়ে গেল ষড়ভূজের চিহ্ন। বৃদ্ধা তান্ত্রিক এবার তার দিকে তাকাল বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে। তাকে লক্ষ করে আঙুল তুলল, খাবি খাওয়া গলায় বলতে লাগল, “দেবদূত… দেবদূত… ওখানে… ওখানে…” তারপর লুটিয়ে পড়ে গেল মাটিতে, হারিয়ে গেল ষড়ভূজের উজ্জ্বলতা। খুট করে শব্দ হল পাশার পিছে, ঘুরে দেখল, দশ-বারো বছর এক মেয়ের অবয়ব, সরে গেল দরজার সামনে থেকে। পাশে ছুটে গেল, গলির মাথা মেয়েটার সাদা জামা দেখতে পায়। সেদিকে এগিয়ে সে মেয়েটার টিকিও দেখতে পায় না।
সে ফিরে আসে বৃদ্ধার ঘরে। বৃদ্ধা পড়ে আছে মাটিতে। আরুণি বৃদ্ধার গলা থেকে আঙুল সরিয়ে মাথা নাড়াল, “সে মারা গেছে।”
(৫)
কিন্তু ভাগ্য যেন পাশার পক্ষেই ছিল।
বৃদ্ধার মৃতদেহ আরুনির তত্ত্বাবধানে রেখে, পাশা কাছেই ফোন বুথে যায়। গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে নিজের অতিপ্রাকৃত বিভাগকে জানায় সব। আধঘণ্টার মধ্যেই হাজির হয় লোকজন। ততক্ষণে রাত চেপে বসেছে শহরের উপর।
নিজের লোক ও গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের সব খুলে বলে। দেবদূতের ব্যাপার ছাড়া। তাদের জানায় একজনের সন্ধান করতে এসেছিল। ভেবেছিল জাদুবিদ্যার সাহায্য নিলে, তাড়াতাড়ি খুঁজে পাবে লোকটাকে। কিন্তু বৃদ্ধা নিজের জাদুর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, এবং মারা যায়।
তারপর দুজনে ফিরে আসে অবির অফিসে। পাশা নিজের ডেস্কে বসে আছে, তার সামনে আরুণি। পাশা চিন্তা করে যাচ্ছে কীভাবে খুঁজে বের করবে মেয়েটাকে। আর গুডরোবঙ্গার কথাটাও খোঁচাচ্ছিল তাকে। তিন দিন আগে মেয়েটা নাকি একজনের সঙ্গে গাড়িতে উঠে। তখনই তার মনে পড়ে যায় স্বপ্নের কথা। স্বপ্নে মেয়েকে একজনের সঙ্গে উঠে যেতে দেখে। কেন জানি মেয়েটার পাশে বসে থাকা লোকটাকে পরিচিত লাগছিল।
আর বৃদ্ধা কার দিকে আঙুল তাক করেছিল?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে কীভাবে যে বাকী সময় পার হল সেটা বলতে পারবে না পাশা।
সশব্দে খুলে গেল অফিসের দরজা। পাশা সেদিকে তাকাল, শুধু সে না, ঘরে থাকা সবাই তাকাল অফিসে ঢোকা লোকটার দিকে। সে এই বিভাগেরই সদস্য, রিয়েন। বিরক্তির সঙ্গেই সে ওভারকোট খুলে রাখল।
“বাটপারে ভরে গেছে এই শহর। অবিদের না ভোগালে মনে হয় তাদের চলে না।”
“কেন, কী হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল একজন।
“আরে, কে যেন ফোন করে জানাল, দু-দিন আগে কবর দেয়া এক মৃত বাচ্চাকে নাকি দেখা গেছে অরহিনের বাজারে। কাছাকাছি ছিলাম, সেখানে গিয়ে দেখি যে ফোন দিয়েছে সে এক পাঁড় মাতাল। মাতাল হয়ে যাকে-তাকে ফোন করে বিরক্ত করে। মাল খেয়ে কী দেখেছে কী জানি, সে কসম কেটে বলেছে নিজ চোখে মৃত মেয়েটাকে কবর দিতে দেখেছিল, সে-ই নাকি কবর দিয়েছে। আজ তার চোখের সামনে দিয়ে গেল মেয়েটা।”
“হয়তো মাতালের প্রলাপ।”
“হয়তো, কিন্তু তারপরেও পরীক্ষা করে দেখা দরকার। মেয়েটার নাম ও ঠিকানাও দিয়েছে মাতালটা। এখন দেখি সে মারা গেছে কি না, আর গেলেও দেখতে হবে কবর ঠিক আছে কি নেই।”
“ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুব মাথা ঘামাও তুমি, রিয়েন।”
“মাথা ঘামাতে হয়, এই শহর জঞ্জালে ভরে গেছে। আর জঞ্জালের শহরে অনেক কিছুই সম্ভব। পরে দেখব কোনও জ্বীহন হয়তো এই মেয়েটাকে নিয়ে কোনও খেলা খেলছে। তাদের কাছে সেটা খেলা হতে পারে কিন্তু আমাদের কাছে সেটা দুঃস্বপ্ন।”
এই বলে রিয়েন চলে গেল রেকর্ড রুমে। সেখানেই মেয়েটার সম্পর্কে খোঁজ নেবে।
পাশা ও আরুণি তাকাল একে অপরের দিকে। অপ্রত্যাশিতভাবে এক সূত্র তাদের কাছে এসে পড়বে সেটা ভাবতেও পারেনি তারা।
অরহিন বাজারের সামনে এসে দাঁড়াল পাশা ও আরুণি। মধ্যরাত শহরের মধ্যে চেপে বসলেও, এই বাজার দেখে তা মনে হবে না। বাজারে সব পাওয়া যায়, একটা সুচ থেকে শুরু করে মেয়ে মানুষ, দৈনন্দিন সামগ্রী থেকে শুরু করে মানব দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব। মানুষের এমন কোনও চাহিদা নেই যেটা বাজার পরিপূর্ণ করতে পারে না।
তবে বাজারে দুটো রেখা আছে, সাদা রেখা ও কালো রেখা। এই রেখা দুটোর সময় ঠিক করা, ভোর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাদা রেখার, আর কালো রেখার সময় সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত। কোনও রেখা একে অপরকে মাড়ায় না। এটাই অলিখিত নিয়ম। কিন্তু সামনে সেটা থাকবে কি না, সন্দেহ আছে। যেখানে শহরের প্রতীকের সাম্যভাব চলে গেছে, তখন কীভাবে একটা বাজার তার সীমারেখা মেনে চলবে। শহরের সামনে দেবদূত বা কালদূত চলে যাওয়া মানে, শহরের নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যাওয়া। এক দূত চলে গেলে, তার ছায়াও চলে যায়, তখন অপর দূতের ছায়া বিরাজ করতে থাকে শহরে। ভালো-খারাপের সাম্য হারায়, নষ্ট হয়ে যায় সমাজ। আর সমাজ নষ্ট মানে, মানবজাতি অস্তিত্ব বিলীন। মানবজাতি না থাকলে, শহরের অস্তিত্ব নেই।
তাই দেবদূত ও কালদূত, যেই চলে যাক-না কেন, খুঁজে এনে বসাতে হবে তাদের প্রতীকী জায়গায়, না হলে সব বিলীন হয়ে যাবে।
অরহিন বাজারে, এখন ভদ্রলোকের ঘোরা ফেরার সময় না। চারপাশ নিয়ন আলোর রঙে রঙিন। বিভিন্ন দোকানের পসরা এখানে, এসব জিনিস দিনে খুঁজলে জীবনেও পাওয়া যাবে না। এক দোকানে চাউমিন রান্না করা হচ্ছে, সেখানে পানীয় হিসেবে আছে মদ। তার দোকানে এমন সব প্রাণীর মাংস রান্না বা ভাজা আছে যা দিনের বেলায় আসলে কল্পনাও করতে পারবে না।
এক লোক চাউমিনের সঙ্গে, সবুজ রঙের গিরগিটি ভাজা খাচ্ছে। সেটা এতটাই তেলতেলে ছিল যেন মনে হবে গিরগিটি এখনও জ্যান্ত।
“আমার খিদে পেয়েছে,” আরুণি বলল।
কথাটা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল পাশার। দোকানের খাবার দেখে তার রুচি নেই, আসলে তার খিদে ছিল না। কিন্তু আরুণি এই খাবার খেতে চাইছে, যেটা কোনও ভদ্র ঘরের মেয়ে খেতে চাইবে না।
পাশার কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করে, আরুণি বসে পড়ল এক দোকানে। এসব দোকান অস্থায়ী। একটা ভ্যানের উপর সব বসানো, আর মাথার উপর থাকে তেরপল। বহুদিনের পুরোনো এক কাঠের টুলে বসে আরুণি। দোকানদারকে বলে, রুটি আর কাবাব দিতে। হাজির হয় সেটা, সাদা রুটি ও কাবাব। কোন মাংসের কাবাব সেটা ধারণা করা শক্ত।
আরুণি খেতে লাগল নির্দ্বিধায়। একটা ঢোঁক গিলে পাশাও মুখে নিল কাবাব ও রুটি। কোনও স্বাদ পেল না। তারপরেও সে জোর করে খেল পুরোটা।
অল্পক্ষণের মধ্যেই শেষ হল তাদের খাওয়া। আরুণি উঠে দাঁড়িয়ে বিল দিতে গেলে, পাশা থামাল, বলল, “আমি দিচ্ছি।”
দ্বিমত করল না আরুণি। তারা দুজন খুঁজতে লাগল সেই লোককে, যে রিয়েনকে জানিয়েছিল এক মৃত মেয়ে জেগে উঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই শহরে। রিয়েন অবশ্য অবাক হয়েছিল পাশার কৌতূহলে। পাশা জানায়, এক কেসে সঙ্গে হয়তো এই মেয়ের কেসের সম্পর্ক থাকতে পারে। রিয়েন অবশ্য কথা বাড়ায়নি। তার আচরণে মনে হয়েছিল পাশার সঙ্গে কথা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই। এ-ছাড়া মধ্যরাত প্রায় এসে পড়েছে, আর আগামীকাল সকালেও তার এক কাজ আছে। মৃত মেয়ের অনুসন্ধানে কত সময় লাগে কে জানে। পাশা নিজ থেকে দায়িত্ব নিতে চাইলে তার কোনও সমস্যা নেই। পরে সব পাশাকে বুঝিয়ে দিয়ে সে চলে যায় অফিস থেকে।
লোকটা ফোন করেছে সিন্ডিকেটের ডোম থেকে। সেটাই দেখিয়েছে পাশা। বাজারের মাঝখানে অবস্থিত সেটা। বিশাল এক গম্বুজের বিল্ডিং। সোনালি গম্বুজের শেষে সবুজ রঙের বন্ধনী, তার নীচে হলদে-সাদা দেয়াল। একতলার এই বিল্ডিং চওড়ায় অনেক বিশাল। বাজারের সকল পরিস্থিতি এই বিল্ডিং থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সবাই একে ডোম বলে।
ডোমের পাশে একটা বুথ আছে টেলিফোনের। দুজনেই এগিয়ে গেল সেদিকে। মধ্যরাতের বাজারে ভিড় ঠেলে এগোতে হচ্ছে। বেশ কিছু স্বল্পবসনার মেয়ে আকর্ষণ করার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে পাশার দিকে, আরুণিকে লক্ষ করে কিছু পুরুষ তাদের পেশি ফুলিয়ে দেখাচ্ছে। তারা যে দেহ-ব্যবসার লোক সেটা বলে দিতে হয় না। দুজনেই নজর দিল না সেদিকে। আলখাল্লা পরা এক লোক এসে দাঁড়াল তাদের সামনে, জানাল, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে তার কাছে। যদি লাগে নিতে পারে সস্তায়। তার চেয়ে সস্তায় মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর কেউ দিত পারবে না। সাদা অ্যাপ্রন পরা লোক এসে দাঁড়াল আরুণির সামনে, তার ছোট বুকের দিকে ইঙ্গিত করে জানাল, সে এগুলোকে বড় করে দিতে পারবে।
দুজনেই কোনও ভ্রুক্ষেপ না করে এগোতে লাগল ডোমের দিকে।
ফোন বুথের সামনে কাউকে খুঁজে পেল না। অবশ্য পাবে সেটা আশা করেনি। লোকটা যে এখানে তাদের অপেক্ষায় বসে থাকবে সেটা ধারণা করাই বৃথা।
“তোমার সহকর্মী তো ঠিকানা বলেছিল,” আরুণি বলল।
“হ্যাঁ, ডোম থেকে একশো গজ দূরে একটা ঝুপড়িতে থাকে।”
তারা বুথের সামনে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল ঝুপড়ি। কিন্তু সেখানে তিরিশ-চল্লিশখানেকের মতো ঝুপড়ি আছে। নিজেকে গাল দিলো পাশা, তাড়াহুড়ো করে রিয়েনের কাছে থেকে লোকটার বর্ণনা নিতে ভুলে গেছে। অবশ্য ফোন করে জানা যেতে পারে, কিন্তু তার ফোন নম্বর জানে না পাশা। দাঁতে দাঁত চেপে সে এগিয়ে গেল ঝুপড়িগুলোর দিকে। বাজারের এই জায়গাটা একটু নির্জন।
কাছাকাছি আসতেই এক বোঁটকা গন্ধ নাকে বাড়ি মারল। পাশা নাক কুঁচকিয়ে তাকাল আরুণির দিকে। দেখে মনে হল না, সে কোনও দুর্গন্ধময় এলাকায় প্রবেশ করেছে। তাদের সামনে এক মধ্য বয়স্ক লোক বসেছিল, আগুন পোহাচ্ছিল সে। দাড়ি-গোঁফ না কামানোতে মুখে এক জঙ্গল গজিয়েছে, জামাকাপড় কত বছরের পুরোনো সেটা কেউ বলতে পারবে না, বোঁটকা গন্ধ বের হচ্ছে সেখান থেকে। তাকে জিজ্ঞেস করল পাশা।
“আচ্ছা, এখানে একজন ফোন করেছিল গোয়েন্দা বিভাগে, তার খোঁজ নিচ্ছিলাম আমি, সে কি আছে এখানে?”
মধ্যবয়স্ক লোকটা তাকাল তার দিকে, তারপর তার চোখ গেল আরুণির দিকে, বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার ঘুরল পাশার দিকে, “কে?”
রিয়েনের কাছে থেকে নামটাও জানা হয়নি। কী করে সে এই গোয়েন্দা বিভাগে আছে সেটা মনে মনে ভাবল। “না বলেনি, শুধু বলেছে এক মৃত মেয়ের ব্যাপারে তার কিছু বলার আছে।”
“জানি না।” এই বলে মধ্যবয়স্ক লোকটা আবার ঘুরল আগুনের দিকে।
পাশা এভাবে প্রশ্ন করতে লাগল আরও দশ-পনেরোজন ভবঘুরেকে। তাদের প্রশ্নে ছিল প্রথমজনের মতোই, “কে?” নাম না বলাতে তারা আবার মনোযোগ দেয় আগের কাজে।
“আমাকে খুঁজছেন কেন?” এক ভবঘুরে পেছন থেকে বলে উঠে, “আর আগের দারোগা কোথায়?”
“তার কেস এখন আমার হাতে, তুমিই বলেছিলে মেয়েটার কথা?”
“হ্যাঁ। আমি আজ সকালে দেখি মেয়েটাকে। বাজারের একা হেঁটে যাচ্ছিল।” ভবঘুরে লোকটা বলল।
লোকটার পরনে উলের মলিন প্যান্ট, এক ময়লা লাল-কালো চেক শার্ট ও তারপর উপর তালি মারা ধূসর উলের জ্যাকেট। তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে পাশা জিজ্ঞেস করল, “মেয়েটার বয়স কত হবে?”
“দশ কি এগারোর মাঝে হবে।”
“এই বয়সের মেয়ের বাজারে একা ঘোরা অস্বাভাবিক না?”
“হ্যাঁ, অস্বাভাবিক, তার চেয়ে বেশী অস্বাভাবিক হচ্ছে, নিজের চোখে দেখেছি মেয়েটা মারা গেছে, তার কবর দেয়ার সময় ছিলাম আমি। সে কীভাবে এখন আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে?”
“তুমি বলেছ নিজ চোখে তাকে মারা যেতে দেখেছ, সে মারা যায় কীভাবে?” চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে আসে পাশার।
হুট করে বদলে যায় ভবঘুরের চেহারা। যেন বুঝতে পেরেছে, গোয়েন্দা বিভাগে ফোন করে ভুল করেছে।
“আমি জিজ্ঞেস করছি কীভাবে?”
“আমি বলতে পারব না।”
“বলতে হবে।”
“পারব না, পারব না, পারব না,” এই বলে ভবঘুরে ছুটে গেল। এগিয়ে যাচ্ছে বাজারের ভিড়ের দিকে। দোকানদার-কাস্টমার সবাইকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তার পিছনে দৌড় দিল পাশা। নিজের শরীরটাকে কেন জানি ভারী মনে হচ্ছিল। অন্য যে-কোনও সময় হলে ধরে ফেলত ভবঘুরে লোকটাকে, কিন্তু এখন বেড়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে দূরত্ব। তার পাশ দিয়ে ঝড়ের মতো এগিয়ে গেল আরুণি। সেও ভ্রুক্ষেপ করছে না তার সামনে থাকা মানুষগুলোকে। ধাক্কা দিয়ে এগোচ্ছে ভবঘুরের মতো। আর ভবঘুরের নাগাল পেতে সময় লাগল না।
নিজের প্রায় সিসার মতো ভারী শরীর নিয়ে দাঁড়াল দুজনের সামনে। হাঁপাচ্ছে না, আর ঘামের চিহ্ন নেই পাশার শরীরে। সেটা নিয়ে অবশ্য ভ্রুক্ষেপ করার সময় নেই।
“কীভাবে জানলি মেয়েটা মৃত? তুই খুন করেছিস মেয়েটাকে?” সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভবঘুরের উপর।
“না, আমি মারিনি।” ভবঘুরে আর্তনাদের সঙ্গে বলল।
“তা হলে জানলি কীভাবে মেয়েটা মৃত?” এই বলে শক্ত মেঝে জোরে ঠুকে দিল তার মাথা। তাদের চারদিকে মানুষের ভিড় গজিয়েছে। কোমর থেকে পাশা নিজের গোয়েন্দা ব্যাজ বের করল, বুঝিয়ে দিল সে এখন অনুসন্ধানের কাজে আছে।
“বলছিস না কেন?” পাশা এই বলে যখন ভবঘুরের মাথা আরেকবার ঠুকে দিতে যাবে। সে তখনই বলে উঠল, “বলছি, বলছি।”
“বল।”
“বিচারপতি রাওয়ালের বাসার পাশ থেকে পাই। সেখানের ডাস্টবিনে খাবার খুঁজতে গেছিলাম। ঠিক আকাশ থেকে যেন মেয়েটা এসে পড়ে ডাস্টবিনে, তারপর নেমে আসে বিচারপতি রাওয়াল…”
তারপর ভবঘুরের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। পাশা দিকে ঘুরে বললে, “ওই যে মেয়েটা। ওই যে,” এই বলে সে পাশাকে ঝাপটে ধরে, আঙুল তুলে দেখায়। বারবার বলতে থাকে, “ওই যে মেয়েটা!” আঙুলের নির্দেশনা অনুযায়ী খুঁজতে থাকে। মুহূর্তের জন্যে মেয়েটাকে দেখতে পায়। তার পরনে ছিল সাদা জামা, পিছনে পরির মতো পাখা। যেটা বাচ্চা মেয়েরা জন্মদিনের অনুষ্ঠানের সময় পরে থাকে। পাশা মেয়েটাকে খোঁজার জন্য উঠে দাঁড়াতে চায়, কিন্তু ভবঘুরে তাকে ঝাপটে ধরে আছে। বারবার বলে যাচ্ছে একই কথা।
হঠাৎ খিঁচুনি উঠে ভবঘুরের । মাটিতে উঠে খেতে থাকে গড়াগড়ি, তারপর তার মুখ বেয়ে নেমে আসে সাদা ফেনা। একটু পরেই থেমে যায় সে। চোখে নেই প্রাণের চিহ্ন। পাশা ভবঘুরের দিকে একবার তাকিয়ে, তারপর তাকায় জটলার দিকে। খুঁজছে সাদা জামা পরা মেয়েটাকে।
এই ভিড়ে মেয়েটার চিহ্ন নেই কোথাও।
(৬)
ভবঘুরের বোঁটকা গন্ধ যেন লেগে আছে পাশার গায়ে। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে আছে, শরীরে সাবান ঘষে যাচ্ছে অনবরত। প্রথমে লক্ষ্য ছিল শরীরের ক্লান্তি দূর করা, বেশ কিছুক্ষণ ভেজা পানি ঢালার পর, এক গন্ধ পায় সে। মৃতের গন্ধ। ভবঘুরের গায়ের গন্ধ কী লেগে গেছে তার দেহে। এছাড়া পাঁজরের ভোঁতা ব্যাথা তাকে এখনও ভোগাচ্ছে। কালচে বেগুনী হয়ে আছে জায়গাটা।
বাথরুম থেকে বের হয়ে, সোজা চলে গেল বিছানার দিকে। অস্বস্তিকর ঠান্ডা চেপে বসছে শরীরে। কিন্তু সেটার উপর ভ্রুক্ষেপ না করে সে ভাবতে লাগল পুরো ঘটনাগুলো। কেন যেন মনে হল দেবদূত কাছেপিঠে আছে। একটু চেষ্টা করলেই ধরা দেবে হাতে। কিন্তু কিছু একটা তাকে বাধা দিয়ে যাচ্ছে। কী সেটা?
জানে না সে। গুডরোবঙ্গা, জাদুকর, শেষে ভবঘুরে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে যাচ্ছে সে মৃত মেয়েটার খোঁজে। এই মেয়ের উপর ভর করেছে দেবদূত। তাই মনে হলেও, কেন জানি পাশা সেটা মানতে পারছে না। দেবদূত হয়তো শহরে আছে, কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটার উপর ভর করে নেই। ভর করে আছে কোনও মানুষের ভেতর, লুকিয়ে দেখছে পাশার ছোটাছুটি। আর গত কয়েকদিনের স্মৃতি কেন মনে করতে পারছে না। পাঁজরের আঘাতে কি স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গেল নাকি?
বিচারপতি রাওয়ালের বাড়িতে যেতে হবে আগামীকাল। হয়তো তার কাছেই থাকতে পারে চাবিকাঠি।
এসব ভাবতে ভাবতে, পাশার চোখ বন্ধ হয়ে আসল।
বিচারপতি রাওয়ালের বাড়ি পাঁচতলার। সামনে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা। শহরে অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায়র পর, কঠোর হাতে দমন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে মানুষটা। পাশা এই মানুষটাকে আগে থেকে চেনে। বেশ কয়েকটা কেসে পাশাকে সাহায্য করেছিলেন তিনি। কিন্তু কী কেস ছিল সেইগুলো পরিষ্কার মনে করতে পারছে না সে। বাড়ির মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়াল এসে, বরাবরের মতো তার সঙ্গে আরুণি।
প্রহরী আসল, জিজ্ঞেস করল তাদের পরিচয়। নিশ্চিত হবার পর, তারা দুজনে ভেতরে ঢুকল।
বিচারপতি রাওয়ালের স্টাডি একদম সবার ওপরে, পাঁচতলায়। বিশাল বড় স্টাডিতে আইন সহ বিভিন্ন ধরনের বইয়ে তাক ভরতি। ঘরের একপাশ আড়াআড়িভাবে মুখোমুখি করা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে, সেখান থেকে তিনি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে পান। সৌম্য চেহারার মানুষটা বিশাল আরাম চেয়ারে বসে আছেন, মুখে পাইপ। তাঁর পেছনে বিশাল জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মেঘে বিষণ্ণ হয়ে থাকা দিনের শহর।
সে বসে আছে বিচারপতির মুখোমুখি। গতকালের ঘটনা বলল।
“মনে হচ্ছে নিয়তি আমার সঙ্গে বিশাল এক ঠাট্টা করছে,” বিচারপতি রাওয়াল বলে উঠলেন।
চোখ সরু হয়ে গেল পাশার। বিচারপতির কথা বুঝতে পারছে না। বিচারপতি পাইপে জোরে একটা টান দিলেন। দীর্ঘশ্বাসের মতো করে বের করলেন মুখের ধোঁয়া। কী যেন ভাবছেন আনমনে। তারপর পাশার দিকে তাকালেন, না, পাশার দিকে নয়, যেন তাকালেন তার পিছনে। সেখানে কী দেখে যেন চমকে উঠলেন, সেটা মুহূর্তের জন্য। নিজেকে সামলে নিলেন, কিন্তু কপালে ফুটে উঠেছে ঘাম। পাইপে জোরে একটা টান দিলেন।
পাশা পিছনে তাকাতে চাইলেও, তাকাল না। মনে হচ্ছে সেও কোনও অপ্রীতিকর কিছু একটা দেখতে পাবে, যেটা থেকে সেও আনমনে লুকিয়ে থাকছে এই ক-দিন। কিন্তু কী সেগুলো? স্মৃতি ঘোলা হয়ে আছে তার কাছে।
“আমি মেয়েটাকে খুন করিনি,” বিচারপতি বললেন।
কথাটা শুনে সোজা হয়ে বসলো আরুণি, তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রাওয়ালের দিকে। পাশা চুপ করে থাকল। বিচারপতির কথা এখনও শেষ হয়নি।
“তবে মেয়েটা মারা যাওয়াতে আমার হাত ছিল,” বিচারপতি বলতে থাকলেন, “সারা জীবনের অর্জন শুধু একটা ভুলের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। এই কথা আগে শুনেছিলাম, বিশ্বাস করতাম না সেটা। কিন্তু আজ করতে হচ্ছে। তবে নিয়তির ঠাট্টা সইতে পারছি না আমি।”
“আপনি কী করেছেন, যার কারণে মেয়েটা মারা গেল?” জিজ্ঞেস করল পাশা।
পাশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন রাওয়াল। তারপর আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যেন মেনে নিয়েছেন নিয়তির পরিহাস।
“জানি না মেয়েটাকে দেখে… জানি না আমার কী হয়ে যায়। কামনা করতে থাকি আমি,” কথাগুলো বলতে যেন কষ্ট হচ্ছিল, “মেয়েটাকে আমি ডেকে নিয়ে আসি। একজন সাহায্য করে তাকে আনতে। এখানে মেয়েটাকে আনার পর, আমি… আমি তার উপর জোর খাটাতে যাই… আমার উপর যেন এক জানোয়ার চেপে বসেছিল। মেয়েটা আমার কাছে থেকে পালিয়ে যায়, ঠিক ওই জানালা ভেঙে নীচে পড়ে যায়। এক জানোয়ারের হাতে সঁপে দেয়ার চেয়ে, মৃত্যুর হাতে সঁপে দেয়া সে ভালো মনে করেছিল। কিন্তু পাঁচ তলা থেকে পড়েও সে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়নি। তার সামনে ভবঘুরেটা দাঁড়িয়েছিল। তাকে আগেই চিনতাম। বাসার নীচে থাকা ডাস্টবিন থেকে খাবার নিতে আসত। সে মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, আমি বাধা দিই, জানাই মেয়েটাকে মেরে ফেলতে। নাহলে তাকে আমি ফাঁসিয়ে দেব। আমার কথামতো সে মেয়েটাকে গলা টিপে মারে। তারপর কিছু অর্থ দিই দাফন করানোর জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হল না।”
“কে এনেছিল মেয়েটাকে?” প্রশ্নটা খোঁচাচ্ছে তাকে। গুডরোবঙ্গা বলেছিল এই লোকের কথা। তার পরিচয় জানার দরকার। কেন সে মেয়েটাকে নিয়ে গেল করুন পরিণতিতে?
পাশার এই প্রশ্নে যেন অবাক হল বিচারপতি রাওয়াল। তারপর এক হাসি দিয়ে বলল, “দেখতে চাও কীভাবে মেয়েটা লাফ দিয়েছিল।” তারপর তিনি ছুটে গেলেন জানালার দিকে। পাশাও ছুটে গেল বাধা দেয়ার জন্য। “ঠিক এইভাবে।” জানালার কাচ ভেঙে তিনি লাফ দিলেন রাওয়াল। অল্পের জন্য সে ধরতে পারল না বিচারপতিকে। একটু পরেই শোনা গেল কংক্রিটের ওপর মাংসের দলার আছড়ে পড়ার আওয়াজ।
গা রি-রি করে উঠল পাশার। সে নীচে তাকিয়ে দেখল বিচারপতি রাওয়ালের রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। কয়েক কদম পিছিয়ে আসে সে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। হঠাৎ শিরশির করে উঠল তার পিঠ, ধীরে ধীরে সে তাকাল পিছনে। দেখল সাদা পোশাকপরা এক মেয়ে… মুহূর্তের মধ্যে সে হারিয়ে গেল দরজার আড়ালে। তার পিছে ছুটতে যাবে, তখনই কে যেন বাড়ি মারল তার পাঁজরের মধ্যে। ঠিক যে জায়গায় আঘাত পেয়েছিল। দরজার হাতলে ঠুকে গেল তার কপাল।
চোখ অন্ধকার হয়ে যাবার আগে দেখল, আরুণি দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে মোটা একটা লাঠি। সেটা দিয়ে আঘাত করেছে পাশাকে। তারপর সব মনে পড়ে গেল তার। যেন খুলে গেছে স্মৃতির দুয়ার। গত কয়েকদিনের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি সব মনে পড়েছে।
চোখ বন্ধ হয়ে যাবার আগে, একটা কথাই মনে মনে বলতে পারল, তা হলে সে নিয়ে এসেছিল মেয়েটাকে।
(৭)
অবি-তে নিজের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না সে। একবারে সে জানায় নিজের অসন্তুষ্টির কথা। পুরোনো এক সহকর্মী পরামর্শ দেয়, বিচারপতি রাওয়ালের কাছে যেতে, একমাত্র উনিই পারবেন প্রমোশনের ব্যবস্থা করে দিতে।
সে যায় বিচারপতির কাছে, খুলে বলে সবকিছু। পাশাকে আশ্বাস দেন বিচারপতি রাওয়াল, সাহায্য করবেন তিনি। তারপর দুজনের মধ্যে বাড়ে ঘনিষ্ঠতা। একসময় বিচারপতি নিজেই প্রস্তাব দেন— একটা কাজ করে দিতে হবে তার। সেটা করতে পারলেই, পাশার কাঙ্ক্ষিত পুরষ্কার, তার প্রমোশন প্রস্তুত।
কাজটা শুনেই হতভম্ব হয়ে যায় পাশা। সৌম্য চেহারার এই মানুষের মনে, এক নিকষকালো দিক আছে, সেটা বুঝতে পারেনি।
কাজটা ছিল বিচারপতি রাওয়ালের বাড়িয়ে দেয়া ছবির মেয়েটাকে এনে দিতে হবে ওঁর কাছে। বারো বছরের মেয়েটা ছিল তার পরিচিত। তার সঙ্গে এক অদ্ভুত সখ্যতা ছিল মেয়েটার। অপহরণ করা লাগবে না তাকে। বিচারপতির হাতে তুলে দিতে পারবে খুব সহজেই।
পাশার মনে চেপে বসে দ্বিধা। কেন এই নিষ্পাপ মেয়েটাকে তুলে দেবে এক মুখোশধারী নরপশুর হাতে? সে তো এক বিচার ব্যবস্থার অধিপতি, কেন তার এতটা অধঃপতন হল। সেদিন রাতে পাশা আবিষ্কার করে, শুধু বিচারপতির মতো সেও এক মুখোশধারী। তার কাজ ছিল শহর রক্ষা করা, কিন্তু নিজের স্বার্থে, সে নিজের দায়িত্ব থেকে বিমুখ হয়েছে।
সে তুলে দেয় মেয়েটাকে বিচারপতির হাতে। নিজের গাড়িতে করে উঠিয়ে, নিয়ে যায় বিচারপতির কাছে। বিচারপতির হাতে তুলে দিয়ে সে চলে আসে। তখন মেয়েটার চোখে ছিল হতভম্বের ছাপ। যাকে সে এত বিশ্বাস করেছিল, সে কিনা তাকে তুলে দিচ্ছে এক নরপশুর হাতে!
এর পরের দৃশ্যতে সে নেই। কিন্তু দেখতে পেল, বিচারপরি লালসা মাখা চোখে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটার দিকে। মেয়েটার চোখ ছিল সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো, যার সামনে এক শিকারী নেকড়ে এগিয়ে আসছে।
মেয়েটা তার পবিত্রতা হারাতে চায়নি। সে ছুটে যায় জানালার দিকে, লাফ দেয় নির্দ্বিধায়।
পাঁচতলা থেকে পড়েও তখনও মেয়েটা মারা যায়নি, মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে কোঁকাচ্ছিল সে। আর কাছেই ছিল বাজারের সেই ভবঘুরে। সে মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায়, মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করার পরিবর্তে সে মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায়। নিজের হারিয়ে যাওয়া লালসা ফিরিয়ে আসে।
ভবঘুরে মেয়েটার গায়ে হাত দেয়ার আগে মারা যায় মেয়েটা। সেটা দমাতে পারেনি ভবঘুরের লালসা। সেটা চরিতার্থ করার সময়, নীচে বিচারপতি রাওয়াল, সঙ্গে তার দেহরক্ষী। ভবঘুরেকে থামানোর বদলে তার কাজ সম্পন্ন করতে দেয়।
কাজ শেষ করে ভবঘুরে যখন চলতে যাবে, তাকে থামায় বিচারপতি, হুমকি দেয় মৃত মেয়েকে ধর্ষণ করার অভিযোগে আটক করবে। ভবঘুরে অনুনয় শুরু করলে, বিচারপতি বলে মেয়েটাকে কোথাও মাটি চাপা দিতে। যাতে কেউ জানতে না পারে মেয়েটার কথা।
কেন আমি এগুলো দেখছি?
কারণ তোমার থেকেই সব শুরু।
নিজের মাথার ভেতর থেকে ভেসে আসে কথাটা।
কে তুমি, জিজ্ঞস করল পাশা।
আমি দেবদূত।
(৮)
পাশা নিজেকে আবিষ্কার করে এক পুরাতন অট্টালিকার এক ঘরে। ঘরটাতে বিশেষ কিছু নেই, একদম খালি। দেয়ালের রঙ উঠে গেছে অনেক আগেই। সময়ের ছোঁয়ায় সেখানে এখন পড়েছে কালো ছোপ। তবে একরঙা এই শহরে সেই কালো ছোপ কোনও প্রভাব বিস্তার করে পারেনি। তার গালের পাশটা আঠালো লাগছে, স্পর্শ না করেই বুঝতে পারলো নিজেরই রক্ত। কপালের একপাশ কেটে সেখানে ধারা বেয়ে নীচে নেমেছে।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুটো অবয়ব। চোখের ঘোলাভাবে পরিষ্কার হতেই দেখতে পেল দুজনকে। একজনকে দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। কারণ চোখে সামনে নিজেকে দেখতে পারছে। তবে অনেক আলাদা, তার প্রতিমূর্তির চেহারা একদম নিষ্কলুষ। পাপের একটা ফোঁটা নেই সেখানে। পরনে দুধ-সাদা জামার মধ্যেও নেই বিন্দুমাত্র কালো দাগ। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরুণি। তার পরনে এমন এক কালো জামা, সেটা যেন দুনিয়ার সকল রং শুষে নিয়েছে।
“কে তুমি?” পাশা জিজ্ঞেস করল দাঁড়িয়ে থাকা তার মতো দেখতে অবয়বকে।
“আমি দেবদূত।” সাদা জামা পরা অবয়ব বলল।
পাশার চোখে অবিশ্বাসের ছাপ।
“আমাদের নিজস্ব কোনও রূপ নেই, যদিও ফটকে আমার এক মূর্তি আছে, সেটার মাঝে আমি শুধু ধারণ করে থাকি। তোমার কারণে আমি এই শহর ছাড়ছি, তাই তোমার রূপ ধারণ করেছি। আমরা যে-কোনও মানুষের রূপ ধারণ করতে পারি। হোক সে পাপী, কিন্তু আমি দেবদূত, পাপী মানুষের ওপর ভর করতে পারি না।”
পাশা আরুণির দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ,” দেবদূত বলল, “সে কালদূত। আমার উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্যই সে তোমাদের কাছে এসেছে।”
কিন্তু সেটা অসম্ভব! সেটা ভাবতেই পাশার মাথায় ভেসে উঠল বৃদ্ধা তান্ত্রিকের খ্যানখেনে গলা, সবাই মনে করে দেবদূত ও কালদূত একে অপরের শত্রু, কিন্তু তারা শত্রু নয়। একে অপরের পরিপূরক।
“মেয়েটা ছিল এই শহরের একমাত্র নিষ্পাপ বাসিন্দা। নিজেকে কলুষিত করতে চায়নি। আমার কাছে সে ছিল এক নোঙর, যার কারণে আমি এই কলুষিত শহরের ফটকের মূর্তির মাঝে ছিলাম।”
“কিন্তু কেন আমি।”
“আগেই বলেছি, তোমার থেকে শুরু হয়েছে সব। তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিচারপতির মনে থাকা লুকিয়ে থাকা কামনাটা জাগিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। তোমার কারণে শহরের শেষ নিষ্পাপ বাসিন্দা মারা গেছে। তোমার কারণে এক ভবঘুরে করেছে দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ। তুমি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছিলে এর মাঝে। তাই কালদূতের সাহায্যে আমি তোমার মাথায় আঘাত করেছি। যাতে পুরোনো স্মৃতি ভুলে যাও, তারপর আমি ত্যাগ করি আমার অবস্থান। কালদূতকে পাঠাই যেন আমাকে খোঁজার জন্য তোমাকে বাছাই করা হয়, আর আমি ভর করি সেই নিষ্পাপ মেয়েটার মাঝে। আমি চেয়েছিলাম তোমাদের পাপের সাজা দিতে। নিজেদের ভুল বুঝতে পারো যেন। আর তোমার কারণে আরও দুজনের প্রাণ চলে যায়। যাদের কিনা পাপের মাঝে কোনও ভূমিকাই ছিল না।”
পাশা বুঝতে পারল গুডরোবঙ্গা ও বৃদ্ধা তান্ত্রিকের কথা বলছে দেবদূত।
“গুডরোবঙ্গা বুঝে যায় আরুণি হচ্ছে কালদূত। আর বৃদ্ধা বুঝতে পারে আমি কাছেই আছি, এবং কিছু একটা উদ্দেশ্যে আছি। কালদূত সেটা বুঝতে পারে, তাই বাধ্য হয় দুজনকে মারতে।”
“এখন কী চাও আমার কাছে?” পাশা জিজ্ঞেস করল।
“সেটা তুমি ভালো করে জানো।” দেবদূত বলল, “এবং তার জন্য একটু সাহায্যের ব্যবস্থা করেছি।”
তখনই দরজার সামনে থেকে এক শব্দ হল। তাকাল সে, দেখল সেই মেয়েটা ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। অনুতাপে ছেয়ে গেল পাশার মন। বুঝতে পারে সামান্য লোভে সে কত বড় একটা পাপ করে ফেলেছে। সে শুধু একটা প্রমোশন চেয়েছিল। তার এই লোভে, নিষ্পাপ মেয়েটা নৃশংসভাবে মারা গেল।
বুঝতে পারল দেবদূতের উদ্দেশ্য।
তার চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়তে থাকে।
“তোমার হাতে সময় অল্প।” দেবদূত বলল, “তোমার মাথার পেছনের আঘাত খুবই মারাত্মক। নিজের ক্ষমতা দিয়ে তোমার মৃত্যুর গতি ধীর করেছি। মৃত্যু ঠেকানোর অধিকার আমার নেই। তোমার অনুতাপই দরকার ছিল আমার।”
দেবদূতের কথা যেন কানে ঢুকল না পাশার। সে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার কাছে মাফ চেয়ে হয়তো পার পাব না। তারপরেও আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার সামান্য লোভে তোমাকে এত ভুগতে হল। যদি পুনর্জন্ম বলে কিছু থাকে, তা হলে তুমি এমন কোনও দুনিয়ায় জন্ম নেবে যেখানে পাপীর হাত পৌঁছতে পারবে না তোমার কাছে।”
মেয়েটা কিছু বলল না, মাথা দোলালো শুধু।
“এখন আমার প্রায়শ্চিত্তের পালা,” পাশার শরীরে তখন যেন অসুরের শক্তি ভর করল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। তারপর ছুটে গেল কাচহীন খোলা জানালার দিকে। লাফ দিল গভীর অন্ধকারে। নীচে পড়ার আগে পর্যন্ত পাশার মুখে লেগে থাকল হাসির ছাপ । তারপর অন্ধকার হয়ে গেল সব।
উপসংহার
আরুণি কিংবা কালদূত আসল দেবদূতের পাশে। তারা দুজন ঘুরে তাকাল, দেখল মেয়েটার আত্মা মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। যাবার আগে হাত নাড়াল। দুজনেই মাথা দোলালো শুধু।
“কী করবে এখন?” জিজ্ঞেস করল কালদূত।
“প্রথমে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেটাই,” বলল দেবদূত। “চলে যাব এই শহর ছেড়ে। কারণ এখানে আমার আর অধিকার নেই।”
“তা হলে ধ্বংস হয়ে যাবে সব।”
“ধ্বংসের পরেই তো সবকিছুর শুরু।” বলল দেবদূত, “এই শহর পাপে ভরে গেছে। এখানে আমার কোনও জায়গা নেই। শেষ নিষ্পাপ আত্মা, যেটা ছিল এই শহরে নোঙর, সেও চলে গেছে। আমার যে এখানে থাকা চলে না।”
“তা হলে কেন এই তিনজনের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমার সাহায্য নিলে। চলে গেলেই তো পারতে।”
“বলতে পারো প্রতিশোধ,” দেবদূত মলিন হাসল, “শেষ নিষ্পাপ বাসিন্দাকে হত্যা করার প্রতিশোধ বলতে পারো।”
“কিন্তু কেন?”
“শহরের বাসিন্দা, তোমাকে বাছাই করে, এতে বেড়ে গেছে তোমার প্রভাব। তোমার সেই প্রভাব হয়তো আমাকে স্পর্শ করেছিল।”
কালদূত চুপ করে থাকল। তারপর সে বলে উঠল, “তুমি না থাকলে আমিও থাকতে পারব না।”
“তা হলে চলে যাই একসঙ্গে।”
“কোথায়।”
“হয়তো এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে সবকিছু নতুন করে শুরু হয়েছে। সেখানে ভালো যেমন আছে, আছে খারাপও। সেখানেই যাব আমরা। কিন্তু আলাদা হয়ে নয়। আমাদের দুজনের আত্মা একত্র হয়ে যাবে সেখানে।”
“চলো, যাই তা হলে।”
দেবদূত পরিণত হল সাদা আলো, আর কালদূত কালো। তারপর তারা দুজনে একত্রিত হয়ে মিলিয়ে গেল সেই শহর ছেড়ে।
শহরটা পড়ে থাকল একা। তার ফটকের সামনে দুই বেদি এখন পড়ে আছে খালি হয়ে।
Tags: তৌফিক সরকার, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি গল্প, বড় গল্প, সুমন দাস
এক কথায় দুর্দান্ত একটা গল্প পড়লাম। মারাত্মক গল্প। টানটান উত্তেজনায় ভরপুর। গল্পের মেসেজটাও দারুন। আসলেই সাদা কালোর সমন্বয়েই টিকে থাকে মানুষ, সভ্যতা। টুপি খোলা অভিবাদন।