থামিনের কান্না
লেখক: অনিন্দ্য পাল
শিল্পী: সৌরভ ঘোষ
মরিয়ম দুপুরের খাবারের মেনু কী হবে জানার জন্য দেবুকে অনেকক্ষণ ধরেই মোবাইলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু নট রিচেবল আর নট রিচেবল ছাড়া অন্য কোন সাড়া নেই। কি যে হয় নেটওয়ার্কের? বেশ বিরক্ত হয়েই টিভিটা ছেড়ে বসলো সোফায়। কিন্তু সেখানেও সমস্যা। কেবল নেই। অদ্ভুত তো! বিরক্ত মরিয়মের এবার হাসি পেয়ে গেল। কি অদ্ভুত পরিস্থিতি রে বাবা! এবার কি… ঠিক তখনি ডোরবেলটা বেজে উঠলো। এখন কে হতে পারে? কাগজ–দুধ তো দিয়ে গেছে। তোলা কাজের রোহিণী চলে গেছে আজকের কাজ সেরে। শৌভিক, তার ভাইয়ের ও আজ আসার কথা নেই। পরীও হোস্টেলে। মাত্র দু–দিন আগে গেল। এবছর উচ্চমাধ্যমিক, তাই এখনি আর আসবে না। তাহলে কে হতে পারে? সাত–পাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজার আইহোলে চোখ রাখলো মরিয়ম। দরজার বাইরের মানুষটাকে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গেল সে। আরে এই মহিলার সঙ্গে তো সেদিন মলে কথা হয়েছিল। হ্যাঁ মরিয়মের মনে পড়লো, পরিষ্কার ভেসে উঠলো চোখে সেদিনের ঘটনা।
সেদিন বিকেলে হঠাৎ দেবুর ফোন। একটা জমির ব্রোকারির টাকা পেয়েছে। বেশ অনেকটা টাকা। মরিয়মকে তক্ষুণি একটা অটো ধরে যেতে হল। কেনাকাটা করতে দেবুর জুড়ি নেই। সদ্য তৈরি বাড়িটাকে সাজানোর জন্য সেদিন তারা এক ধাক্কায় লাখখানেক টাকার ফার্নিচার আর প্রচুর জামাকাপড় কিনলো। মলে টাকা পেমেন্ট করে বেরোবার ঠিক আগে তাদের সঙ্গে যেচে কথা বলেন এই মহিলা। কিছু একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিলেন, কিন্তু দেবুর একটু তাড়া ছিল তাই সে কথা শোনা হয়নি। তবে সেই তাড়াহুড়োতে দেবু ওই মহিলাকে নিজের একটা কার্ড দিয়েছিল। হয়তো সেই কার্ডের সূত্র ধরেই …
ইতস্তত করতে করতে দরজাটা খুললো মরিয়ম।
—নমস্কার। সেদিন মলে আপনার স্বামী কার্ডটা দিয়েছিলেন। ভাবলাম চলে আসি একবার।
একটু মৃদু হাসি লেগে আছে সেই মহিলার মুখে। সে দিন তাড়াহুড়ো তে খুব একটা ভালো করে লক্ষ্য করা হয়নি, আজ দেখলো মরিয়ম। ষাটের কাছাকাছি বয়স হবে, কিন্তু দেখে বোঝা যায় এক সময় অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। হলদেটে ফর্সা চামড়ায় এখনও বয়সের ছাপ খুব একটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। মাথার চুলেও তেমন পাক ধরেনি। শুধু একটা জিনিস বেশ অদ্ভুত লাগলো মরিয়মের। মহিলার সমস্ত দেহের তুলনায় কনুই থেকে হাতের কব্জি পর্যন্ত অংশ যেন বেশ কালো। শুধু কালো নয়, কেমন একটা পোড়া পোড়া মতো যেন।
—আমি কি ভিতরে আসতে পারি?
প্রশ্ন শুনে সম্বিৎ ফেরে মরিয়মের। একটু অপ্রস্তুত হয়ে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ায়,
—আরে আসুন, ভিতরে আসুন
—ধন্যবাদ।
—আমি কেইবুল লামজা। ভদ্রমহিলা সোফায় বসতে বসতে বললেন।
মরিয়ম নাম শুনে বুঝলো ভদ্রমহিলা বাঙালি নন। কিন্তু ঠিক কোথাকার তাও ধরতে পারলো না। তবে মরিয়মের মনে হল, এই নামটা কোথাও শুনেছে সে। একটু যেন চেনা চেনা লাগছে। যাইহোক কৌতুহল চেপে রেখে মরিয়ম নমস্কার জানিয়ে বলল,
—আমি…
—আরে জানি তো, তুমি মরিয়ম সরকার। তোমার হাজব্যান্ড দেবব্রত সরকার, নিকনেম দেবু আর তোমাদের মেয়ে পরী। হায়ার সেকেন্ডারি দেবে। হোস্টেলে থাকে। তোমার বাড়ি বার্ডওয়ান শহরে।
মরিয়ম ততক্ষণে হাঁ হয়ে গেছে। তাদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ জানেন ইনি! কিন্তু কেমন করে?
ভদ্রমহিলা যেন তার মনের কথা বুঝতে পারলেন। একটু থেমে অল্প হেসে বললেন,
—কি করে এসব জানি তা কিন্তু জিজ্ঞাসা করো না। ওটা তুমি ভাবতে ভাবতে পেয়ে যাবে।
লামজার মুখে একটা রহস্যের হাসি ছড়িয়ে পড়লো।
কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল মরিয়মের। সে এমনিতে কথা বলতে বা গল্প করতে খুব ভালোবাসে। পাড়া প্রতিবেশী কেউ আসলে খুশিই হয়। এই তো সেদিন, রুমিদির সঙ্গে গল্প করতে করতে ভুলেই দুধ বসিয়ে এসেছে। পোড়া গন্ধে পরী ছুটে গিয়ে গ্যাসটা অফ করে, নাহলে কি যে হত! ভাগ্যিস পরী তখন বাড়িতে ছিল।
কিন্তু কেন যেন আজ মরিয়মের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না একটাও। একটা অদৃশ্য আঠা দিয়ে কেউ যেন তার ঠোঁট দুটো আটকে দিয়েছে।
—এক গ্লাস জল হবে মরিয়ম?
লামজার গলা শুনে আবার যেন নড়েচড়ে উঠলো মরিয়ম। একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
—হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। একটু চা করি।
—চা! আচ্ছা ঠিক আছে। চা খাই না আমি, তুমি বলছো যখন এই মেঘলা দিনে খাই তখন। তবে শুধুই চা। অন্য কিছু নয়।
কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে যখন বসার ঘরে ঢুকল মরিয়ম, যা দেখলো, তাতে সে খুবই অবাক হয়ে গেল। তার অগোছালো বসার ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে কেউ। এইটুকু সময়ে এত জিনিসপত্র সব সরিয়ে এত সুন্দর করে সাজানো কি করে সম্ভব— মাথায় এল না মরিয়মের। নতুন কেনা ফার্নিচারগুলো এমনভাবে রেখেছে কেউ, যেন ওইখানে রাখার জন্যই সেগুলোকে আনা হয়েছিল। এমনকি বুকসেল্ফের অগোছালো বইগুলোও কে যেন একটা একটা করে পেড়ে সাজিয়ে দিয়েছে। নিজের বসার ঘরটাকে নিজেই চিনতে পারছিল না মরিয়ম।
—কি, কেমন লাগছে? এবার বেশ সুন্দর হয়েছে ঘরটা। শুধু ওই দিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
লামজা ঘরের উত্তর–পূর্ব দিকটা আঙুল দিয়ে দেখালেন।
মরিয়মের বিস্ময় কাটছে না দেখে লামজা বললেন,
—আমি ইন্টিরিয়র ডেকরেশনের কাজ করি। সেদিন তোমাদেরকে সেটাই বলতে চাইছিলাম। তোমরা ফার্নিচারের অর্ডার করলে তাই ভাবলাম, যদি …
একটু থেমে চা– এর কাপটা শেষ করে মরিয়মের হাতে দিয়ে বললেন লামজা,
—আজ আমি আসি। কয়েকদিন পর আসবো আবার।
তারপর সেই রহস্যময় হাসি মুখে মাখিয়ে যেমন হঠাৎ এসেছিলেন তেমনি হঠাৎ করেই চলে গেলেন।
(২)
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে এরপর। লামজার ঘটনাটা প্রায় ভুলেই গেছে মরিয়ম। দেবু তো এমনিতেই অপ্রয়োজনীয় কোন কিছু মনে রাখতে চায় না। এই ঘটনাটাও তাই তার স্মৃতিতে কোন ছাপ ফেলতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
গত কয়েকদিন ধরে মরিয়মের শরীরটা ভালো লাগছিল না। খিদে নেই তেমন, রাতে ঘুমও হচ্ছে না ভালো। দেবু আর মরিয়ম আজ বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য ডাক্তার দত্তকে একবার দেখানো, আর তারপর একটু শপিং। কিন্তু ডাক্তার দত্ত আজ হঠাৎ করেই আটকে পড়েছেন। ওঁর কম্পাউন্ডার বলে দিলেন সবাইকে, ডাক্তারবাবু আজ বসতে পারবেন না। ফলে ঘণ্টাখানেক আপেক্ষার ফল সেখানে শূন্য। আবার আকাশটা খুব চমকাচ্ছিল, এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের রেখা সাবধান করে দিচ্ছিল যেন পৃথিবীকে। এই সব ভজকট ঘটনায় মরিয়ম কেমন একটা নিরুৎসাহ হয়ে দেবুকে একরকম জোর করেই বাড়ি নিয়ে চলে এল।
বাড়ি ঢোকার মুখেই তেড়ে ফুঁড়ে নামলো বৃষ্টি। সঙ্গে অনবরত বজ্রপাত। আর মফস্বলের যা রীতি, লোডশেডিং। মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে গেট খুলে বাড়ি ঢুকে ওরা একটু অবাক হয়ে গেল। সেই আলো–অন্ধকারে ওরা দেখলো, কেউ একজন ওদের দরজার সামনে বসে আছে। তার সামনে কয়েকটা মোড়ক। মোড়কগুলো বেশ বড়।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে, মরিয়মের হাতটা শক্তকরে ধরলো দেবু। তারপর টানটান পা ফেলে এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। কে হতে পারে এখন?
দরজার সামনে এসে মোবাইলের টর্চের আলোটা সেই মানুষটার মুখের উপর ফেলতেই বেশ অবাক হয়ে গেল মরিয়ম। এত সেই কেইবুল লামজা! দেবুর তেমন মনে ছিল না, ফলে দেবু তাকে অন্য বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
—আপনি কে? কাকে চাই এখানে? ওগুলো কী?
দেবু সেই প্যাকেটগুলোর দিকে আঙুল দেখালো।
—আমি! আমি…
বলতে গিয়েও থেমে গেলেন লামজা। নিজের হাতদুটো বাড়িয়ে মরিয়মের হাতদুটো চেপে ধরে বললেন,
—আমার আর সময় নেই, মরিয়ম। এবার যেতে হবে। তুমি ওকে বলে দিও। আর এগুলো তোমাদের জন্য আমার উপহার। ইচ্ছা ছিল নিজে হাতে সাজিয়ে দেব, কিন্তু… যাকগে। আমি আসি হ্যাঁ।
কথাগুলো বলে নিমেষের মধ্যে সেই ভয়ঙ্কর বজ্রপাত আর বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেলেন লামজা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মিলিয়ে গেলেন যেন অন্ধকারে। কিছুটা সময় দেবু আর মরিয়ম হতবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছু বুঝতে পারছিলো না ওরা কেউই।
ঘরে ঢুকে চার্জার আলোটা জ্বেলে লামজার দেওয়া সেই বড় প্যাকেটদুটো দেখছিল মরিয়ম। দেবু তাড়া দিল, তার খিদে পেয়েছে। তখনকার মতো জিনিসগুলো কী সেটা না দেখেই মরিয়ম রান্না ঘরে ঢুকে পড়লো।
এরপর আবার দিন দুই কেটে গেছে। একাজ ওকাজে মরিয়মের আর সেই প্যাকেটগুলোর কথা মনে ছিল না। হঠাৎ সেদিন রোহিণীর নজর গিয়ে পড়লো প্যাকেট দুটোর উপরে। অবশ্য রোহিণীর নজর আগের দিনও ছিল। তার লক্ষ্য ছিল প্যাকেট দুটোর উপরের কালো পলিথিন। এই রকম একটা পলিথিন তার খুব দরকার। বর্ষায় এবার তার টালির চালের একধার থেকে জল পড়ছে।
—বৌদি, ওই কালো পলিথিন মোড়া প্যাকেট দুটোয় কী আছে গো? যদি তোমরা পলিথিনগুলো ফেলে দাও, তবে আমাকে দিও। চালে দেব।
রোহিণী থাকায় সুবিধা হল মরিয়মের। প্যাকিংটা কেটে পলিথিন দু‘টো দিয়ে ওকে বিদায় করে বসার ঘরের দরজা দিয়ে খুলতে বসলো মরিয়ম। দু‘টো বাক্সই পিচবোর্ড দিয়ে মোড়ক করা। একটা একটু বেশি ভারী। অন্যটা বেশ হালকা। কোনটা আগে খুলবে সেটা নিয়ে একটু দোনামোনা করলেও হঠাৎ কি মনে হতে হালকা প্যাকেটটাই আগে খুলে ফেললো। বেশ বড় একটা বাঁধানো অয়েলপেন্টিং। একটা হরিণ আর একটা ছোট্ট মেয়ে তার পিঠের উপর বসে কেমন যেন একটা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি সরাসরি এসে পড়ছে মরিয়মের উপর। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে মরিয়মের গা টা কেমন যেন ছমছম করে উঠলো। অস্বস্তি হচ্ছিল মরিয়মের। তাই ছবিটাকে পিছন করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রেখে দিল।
দ্বিতীয় বাক্সটা বেশ ভারী। মরিয়ম সেটা টেনে নিয়ে এল ঘরের মাঝামাঝি, ফাঁকা জায়গাটায়। খুলতে যাবে, ঠিক তখনই কিচেনে একটা কিছু পড়ার শব্দ হল। শব্দটা শুনে মরিয়মের মনে হল, বাসন পড়ার আওয়াজ। দুধের সসপ্যানটা বসানো রয়েছে গ্যাসের উপর, যদিও গ্যাসটা অফ করে রেখে এসেছে, তবু কেমন যেন একটা খটকা লাগলো মরিয়মের। প্যাকেটটা ফেলে রেখে উঠে গেল কিচেনের দিকে।
নাহ, তেমন কিছু পড়েনি। কিচেনের সব জায়গাই ঝকঝকে তকতকে করে রাখা মরিয়মের অভ্যাস, এখন তেমনি আছে। তবে একটা ব্যাপার দেখে একটু অবাকই হল মরিয়ম। সিঙ্কের ভিতরে একটা স্টিলের থালা পড়ে আছে। মরিয়ম একটু ভেবে নিল, নাহ আজতো রোহিণী যাবার পর আর কোন বাসন ব্যবহার করেনি সে। রাতের খাবার করার এখনও কিছুটা বাকি আছে। সবে সাতটা বাজে। তাহলে? তাহলে কি রোহিণী তাড়াহুড়োয় এটা না মেজেই চলে গেছে?
বাসনটা ধুয়ে তুলে দেবার জন্য মরিয়ম সিঙ্কের কাছে গিয়ে অবাক হয়ে গেল, থালাটা একেবারে পরিষ্কার। সিঙ্কটাও বেশ শুকনো। তাহলে? আর একটা ব্যাপার ও তাকে অবাক করলো। এই থালাটা পরীর। ও বাড়ি থাকলে তখনি শুধু ব্যবহার হয়। এখন পরী হোস্টেলে, তাই এটা তোলা ছিল। মাথাটা দপদপ করে উঠলো মরিয়মের। কি যে হচ্ছে!
থালাটা তুলে রেখে কিচেন থেকে বের হয়ে আসছিল মরিয়ম। হঠাৎ তার মনে হল, কিছু একটা বারান্দায় চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। একটা হুলো বেড়াল মাঝে মাঝেই আসে, সেটাই বারান্দায় পাক খাচ্ছে ভেবে মরিয়ম আবার বসার ঘরে এসে দ্বিতীয় বাক্সটা খুলতে শুরু করলো। একটা পেননাইফ দিয়ে প্যাকিং এর উপরের শক্ত করে আঁটা টেপ কেটে ফেলতেই একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধে ভরে গেল ঘরটা। এত সুন্দর গন্ধ এর আগে কখনও পেয়েছে বলে মনে করতে পারলো না মরিয়ম। কয়েক মুহূর্ত একটা ঘোরের মধ্যে ছিল মরিয়ম। হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দে তার সেই ঘোরটা কেটে গেল। মরিয়ম কান পেতে শুনলো শব্দটা, বেশ কয়েক বার শব্দটা তার কানে এল, কিন্তু ঠিক কোথা থেকে এলো সেটা ঠিকঠাক বুঝতে পারলো না। একটু ভয় ভয় করতে শুরু করলো তার। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের বোকামির জন্য মনে মনে হেসে উঠলো। আসলে প্যাকেটের মধ্যে থেকে তখন একটা হরিণের মাথা দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই একটা খেলনা হরিণ, পরীর জন্য দিয়েছেন লামজা। ওহ সত্যি! একটু যেন লজ্জা পেয়ে গেল নিজেই মরিয়ম।
ঠিক তখনি বেজে উঠলো ডোরবেলটা। ঘড়ির দিকে তাকালো মরিয়ম, আটটা বাজে। দেবু তো এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে না! তবে?
আই হোলে চোখ দিয়ে দেখলো, কেউ নেই। চোখ সরিয়ে নিতে যাবে ঠিক তখনি দেখলো সেই অদ্ভুত দৃশ্য। তার দরজার বাইরেটা একটা আশ্চর্য হলুদ আলোয় ভরে আছে আর তাদের বাড়িটা ভেসে আছে জলের উপর। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। তারপরেই হঠাৎ কেমন বদলে যেতে লাগলো সব। সেই জলের উপর ভেসে বেড়াতে লাগলো অসংখ্য ছোট বড় স্থল। তাদের কোনটা একটা ফুটবল মাঠের মতো, কোনটা আবার অনেক ছোট। সেই ছোট বড় দ্বীপগুলোর উপরে ছোট ছোট সবুজ ঝোপ, গাছ। হঠাৎ একটা দ্বীপ থেকে একদল ভারী সুন্দর দেখতে হরিণ ছুটতে ছুটতে তার ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। তাদের মাথার বাঁকা শিংগুলো যেন দু–দিক থেকে ব্রাকেটের মতো করে বেড়ে উঠেছে।
হঠাৎ কোথা থেকে একটা আলোর ঝলকানিতে চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো হল মরিয়মের। বেশ কিছুটা দূর থেকে যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সেই আলো, কখনও তার রং নীল, কখনও হলুদ কখনও অদ্ভুত সব রঙের মিশ্রণ যেন বয়ে নিয়ে আসছে কেউ। কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে সেই আলো। প্রায় যখন তার দরজার কাছে এসে পৌঁছালো, তখন মরিয়ম যা দেখলো, তাতে তার সমস্ত শরীর কেমন যেন গুলিয়ে উঠলো। একটা আধা মানুষ, আধা হরিণ শরীর, তার সর্বাঙ্গথেকে মাংস খসে খসে পড়ছে। একটা অসহ্য দুর্গন্ধে ভরে যেতে লাগলো সমস্ত পরিবেশ। মরিয়ম ভয়ে কেঁপে উঠলো, কিন্তু সেই জায়গা ছেড়ে নড়তে পারলো না, যেন কেউ তার পা দুটো আটকে দিয়েছে মেঝের সঙ্গে। এগিয়ে আসা সেই মাংসের উপর কোন চামড়া নেই। সে ভয়ানক এক বীভৎস দৃশ্য। সেই গলা পচা দেহের সামনের দিকে মুখটা মানুষের আর সেই মুখের উপর থেকে হরিণের শিংগুলোর ভিতর থেকে ছিটকে আসছে অতি উজ্জ্বল সেই চোখ ধাঁধানো আলো। হঠাৎ মরিয়মের মনে হল, এই মুখটা তার খুব চেনা। খুব চেনা। হঠাৎ তখনি মরিয়মের চোখের সামনে ঘটে গেল আরও একটা অদ্ভুত ঘটনা।
দরজার বাইরের সমস্ত দৃশ্যপট হঠাৎ যেন কেমন ঘুলিয়ে উঠলো। একটা বিষন্ন অন্ধকারে ছেয়ে যেতে লাগলো সব কিছু। আর হরিণের দল একে একে মিশে যেতে লাগলো সেই আধা মানুষ আধা হরিণের শরীরে।
বীভৎস সেই দৃশ্য আর ভয়ানক গাঢ় হয়ে আসা অন্ধকার চিরে শুরু হল এক অদ্ভুত গোঙানি আর কান্নার আওয়াজ। কে কাঁদছে? কারা কাঁদছে? বুঝতে পারলো না মরিয়ম। তার চারপাশটা হঠাৎ করে একেবারে গাঢ় অন্ধকার হয়ে গেল। চোখ ঝাপসা হয়ে এল তার, শরীরটা যেন ধসে যাওয়া মাটির মতো নেমে এল মেঝের উপর। জ্ঞান হারাতে হারাতে সে শুনতে পেল, অনেক অনেক দূর থেকে একটা মিষ্টি মেয়েলি গলা তাকে ডাকছে, “মরিয়ম, মরিয়ম চলে আয়, চলে আয়…“
গতকাল রাতের পর প্রায় ঘণ্টাদশেক জ্ঞান ছিলো না মরিয়মের। দেবু বাড়ি ফিরে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বহুবার ডাকা ডাকি করেও যখন মরিয়ম দরজা খুললো না, তখন ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে হতবাক হয়ে গেছিল দেবু। মরিয়ম ঠিক দরজার পাশে মেঝেতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি আর বজ্রপাত। তাই অত রাতে ডাক্তার খানায় নিয়ে যাওয়াটাও মুশকিল ছিল। বন্ধু অবনী হাসপাতালের ডাক্তার, তাকে ফোন করে পরামর্শ নিয়ে সেইমতো দেখাশোনা করেছে দেবুই। সকাল হতেই ডাক্তারবাবু নিজে এসে দুটো ইঞ্জেকশন পুশ করে দিয়ে গেছেন। সকাল সাতটা নাগাদ জ্ঞান ফিরলো যখন, মরিয়মের মাথাটা তখনও ধরে আছে একেবারে। চোখের সামনে তখনও গত রাতের সেই ঘটনা ভাসছে। একবার ভাবলো, দেবুকে বলে সে কথা, কিন্তু পরক্ষণেই সে সিদ্ধান্ত বদলালো। দেবু এসব কথা বিশ্বাস তো করবেই না উলটে ডাক্তার বদ্যি তুমুল তালগোল পাকিয়ে দেবে। নাহ, দেবুকে বলা যাবে না। কিন্তু এই ঘটনাটা কাউকে না কাউকে বলতেই হবে, জানতেই হবে সত্যিটা কী? সেই কি ভুল দেখেছে? তাই যদি হয় তবে কেন ওরকম সব ঘটনা দেখলো? হঠাৎ তার মনে পড়লো “ডাইনো”র কথা। ডাইনো তার ক্লাসমেট। আসল নাম বিপুল সরকার। থাকে কল্যাণী। সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে রীতিমতো যোগাযোগ আছে এখনও। কলেজে পড়ায়, তার সঙ্গে প্যারানর্মাল অ্যাকটিভিটি নিয়ে চর্চা করে। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ওর লেখাও বের হয়।
মোবাইলটা নিয়ে ডাইনোর নম্বরটা ডায়াল করলো মরিয়ম।
(৩)
প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। ডাইনো এসেছিল। সমস্ত ঘটনা শুনেছে। তারপর চলে গেছে। যাবার সময় বলে গেছে,
—কয়েকটা দিন সাবধানে থাকিস। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত মনে জোর রাখতে হবে। তোর কোন ক্ষতি হবে না, কিন্তু …
এই ‘কিন্তু’র উত্তর দেয়নি ডাইনো। চলে গেছে।
এদিকে দেবু গেছে ব্যাবসার কাজে। দিন পাঁচেক পরে আসবে। একাই আছে মরিয়ম। রোহিণী রাত নটায় তার সঙ্গে ডিনার করে বাড়ি যায়। বাকি রাতটা একাই কাটায় মরিয়ম। ঘুম আসে না। একটা খুট করে শব্দ হলেও চমকে বিছানায় উঠে বসে। চোখের নিচে কালি, শরীর বেশ দুর্বল হয়ে গেছে মরিয়মের। তার ওপর গত রাতে যা ঘটলো!
মরিয়ম আধো ঘুমে বিছানায়। মাথার মধ্যে অদ্ভুত সব ছবি ভেসে উঠছে। নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছে, ও সব কিছুই নয়, ভুলভাল দেখেছে নিজেই। হ্যালুসিনেসন? আবার পরক্ষণেই বন্ধ চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে সেদিনের সেই দৃশ্য। কানে বেজে উঠছে সেই কান্না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে এভাবেই হয়তো কেটে যেত সমস্ত রাত। কিন্তু…
হঠাৎ একটা ঘড়ঘড়ে শব্দে ছেঁড়াখোঁড়া ঘুমটা ভেঙে গেল মরিয়মের। একটু সজাগ হয়ে বুঝলো শব্দটা বসার ঘর থেকে আসছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। লোডশেডিং হয় নি, তাই সাহস করে উঠে বসার ঘরে গেল মরিয়ম। না, সব ঠিকঠাক আছে। শুধু একটা জায়গায় চোখটা আটকে গেল তার। লামজার দেওয়া ছবিটা রোহিণী দেওয়ালে আটকে দিয়েছিল, কিন্তু যেখানে আটকে ছিল, এখন সেটা সেখানে নেই। ছবিটা এখন রয়েছে, বসার ঘরের উত্তর–পূর্ব দেওয়ালে। পায়ে পায়ে এগিয়ে সেখানে পৌঁছে মরিয়ম অবাক হয়ে দেখলো, ছবিটা ঠিক দেওয়ালে ঝুলছে না, সেটা যেন দেওয়ালের উপরেই রয়েছে। যেন জীবন্ত, এখুনি চলে ফিরে বেড়াবে, এখুনি হরিণের পিঠের উপর বসে থাকা বাচ্চা মেয়েটা কিছু বলে উঠবে তাকে। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল মরিয়মের। আস্তে আস্তে নিজের বাস্তব অস্তিত্বটা হারিয়ে যাচ্ছিল তার। যেন এক অন্য জগতে ঢুকে পড়ছিল মরিয়ম। সেখানে এক পরম শান্তি, নিস্তব্ধ পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণের দল, তাদের বাদামি–হলুদ রঙের উপর স্বচ্ছ আলো পড়ে অদ্ভুত সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। হরিণগুলো ঠিক যেন একদল নৃত্যরত শিল্পী। অদ্ভুত ভঙ্গিতে এরা নেচে চলেছে। সমস্ত কিছু যেন ভেসে আছে একটা বিরাট জলভাগের উপর। হঠাৎ কোথা থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে তার সামনে দিয়ে চলে গেল। যেতে যেতে একবারের জন্য তার দিকে পিছন ফিরে তাকাতে অবাক হয়ে গেল মরিয়ম, এ তো সেই ছবির মেয়েটা। এক মাথা এলোমেলো চুল, সেই পাতার পোষাক, মাথায় নীল হলুদ ফুলের মুকুট, আর চোখের মণি দুটো ঘন কালো। হঠাৎ কি হল মরিয়মের, মেয়েটাকে ধরার জন্য এগিয়ে যেতে গেল, আর ঠিক তখনই চারধার কাঁপিয়ে একটা ভয়ঙ্কর বজ্রপাত সমস্ত দিক দিনের আলোর মতো ঝকঝকে করে দিল। আর ঠিক তার পরেই সব অন্ধকার। মরিয়ম চমকে উঠে বুঝতে পারলো সে বসার ঘরে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ যা কিছু সে দেখলো, অনুভব করলো সে সবের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। শুধু চাপ–চাপ অন্ধকার আর বৃষ্টির শব্দ। ভয় করতে লাগলো মরিয়মের। বুঝতে পারলো, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বুকের ভিতর কেমন যেন একটা শিরশিরানি ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। শোবার ঘরের দিকে এগোতে গিয়ে বুঝলো গা–হাত–পা কাঁপছে তার। শরীরটা যেন অবশ হয়ে আছে। কোন মতে দেওয়াল ধরে ধরে শোবার ঘরে ঢুকে টেবিলের উপর রাখা চার্জার আলোটা জ্বালতে জ্বালতেই শুনতে পেল, অদ্ভুত সেই কান্নার আওয়াজ।
এ কান্না মানুষের না কি অন্য কিছুর? কেমন একটা অসহ্য গা ছমছমে পরিস্থিতি চারদিক থেকে মরিয়মকে যেন ঘিরে ধরতে লাগলো। বিছানায় বসে পড়লো মরিয়ম। তার চোখ আবার ঝাপসা হয়ে এল।
বিছানার এক কোণে ধীরে ধীরে শরীরটা এলিয়ে দিল মরিয়ম।
(৪)
—আপনার নাম?
—বিপুল সরকার। মরিয়ম আমাকে ডাইনো বলে ডাকতো।
—মরিয়ম সরকার আপনার কে হয়?
—কেউ না। মানে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। আমরা স্কুল থেকে কলেজে সহপাঠী ছিলাম।
—আপনি জানেন মরিয়ম এর সঙ্গে কী ঘটেছে?
—জানতাম না, এখানে এসে শুনলাম।
—এখানে এলেন কেন? কোন প্রয়োজন ছিল? আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, এর দিন সাতেক আগেও একদিন এসেছিলেন আপনি। ঘণ্টাখানেক ছিলেন। সত্যি?
—হ্যাঁ। এসেছিলাম। মরিয়ম ডেকেছিল। একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছিল ওর সঙ্গে। ও খুব ভয় পেয়ে গেছিল।
এস আই, ঘণ্টারাম মালাকার এবার অবাক হয়ে গেলেন। চোখ কুঁচকে বললেন,
—কী ধরনের অদ্ভুত ঘটনা? আর সেটা যদি ঘটবেই তাহলে তো মরিয়মের হাজব্যান্ড দেবব্রত সরকার ও জানতেন। উনি তো কিছুই জানেন না দেখছি! আর সেই ঘটনা মরিয়ম আপনাকেই বা বলতে গেলেন কেন? কি ডাইনো মশাই? ডাল মে কুছ কালা লাগতা হ্যায়! ঠিকঠাক করে বলুন দেখি ব্যাপারখানা আসলে কী?
দু–হাত দিয়ে নিজের মাথাটা চেপে ধরে কিছুটা সময় বসে রইল বিপুল সরকার ওরফে ডাইনো। একটু ধাতস্থ হয়ে বলল,
—মরিয়মের ফোন পেয়ে আমি সেদিন কলেজ থেকে সরাসরি চলে আসি এখানে। ওর চোখে–মুখে একটা অদ্ভুত ভয়ের ছাপ ছিল। কোন একটা চাপা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় যেন মরিয়ম ছটফট করছিল। বলতে পারছিলো না কাউকে। আমি একটু–আধটু প্যারানরমাল ব্যাপার নিয়ে রিসার্চ করি তাই ও ভেবেছিল বোধহয় আমাকে বললে কোন সুরাহা হতে পারে। তাই…
একটু চুপ করে থেকে, একটা বড় প্রশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলল ডাইনো।
ডাইনো জানত এসব কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, অন্তত পুলিশ অফিসার তো নয়ই। আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওকে অবাক করে ঘণ্টারাম মালাকার বললেন,
—দেখুন বিপুলবাবু, আপনার এই গল্পটা যে কেউ হেসে উড়িয়ে দেবে বা পাগলের প্রলাপ বলে ঠাট্টা তামাসা করবে, এটা নিশ্চয়ই বোঝেন আপনি।
একটু চুপ করে থেকে, নিজের চকচকে টাকে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে আবার বলতে লাগলেন,
—কিন্তু আমি তেমনটা করছি না!
বেশ বড় আর ভাসা–ভাসা চোখ দুটো ডাইনোর মুখের উপর ফেলে বললেন,
—আমি মরিয়মের একটা ডায়রি পেয়েছি। তাতে হুবহু আপনার বলা কথাগুলো লেখা আছে। দিন, তারিখও মিলে যাচ্ছে। কিন্তু এবার বলুন তো, আপনার কি মনে হয়, এই ঘটনার ব্যাখ্যা কী? আর যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তাহলে গতকাল কী এমন হল যে…
—গতকাল কী ঘটেছে সেটা একমাত্র মরিয়মই বলতে পারতো, কিন্তু
একথা বলতে বলতেই হঠাৎ কি মনে হতে ডাইনো উঠে পড়লো চেয়ার থেকে। বসার ঘরেই বসে ছিল তারা। ডাইনো এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছিল। কি একটা দেখতে পেয়ে ঘরের উত্তর–পূর্ব কোণে ছুটে গেল। পরক্ষণেই একটা প্যাকিং বাক্স থেকে নীচু হয়ে কিছু একটা বের করতে যেতেই ঘটে গেল একটা অদ্ভুত ঘটনা। সবাইকে অবাক করে একটা অদ্ভুত সুন্দর হরিণ সেই বাক্সের ভিতর থেকে একলাফে বেরিয়ে যেন হাওয়ার গতিতে ঘরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকারে। এক ঝলকে ঘরের মধ্যেকার সবাই দেখলো হালকা হলুদ–বাদামি রঙের হরিণের সমস্ত শরীর থেকে একটা অদ্ভুত দ্যুতি ছিটকে যেন চারদিকে ছড়িয়ে গেল। চোখ ঝলসে গেল যেন একেবারে সবার।
ডাইনো তখন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে। একটা গা ছমছমে শিহরণে সে কথা বলতে আর চেঁচাতেও ভুলে গেছে। শুধু সেই নয়, ঘরের মধ্যে থাকা জনা তেরো মানুষ এই একইরকম অনুভূতিতে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। সবার চোখ কান খোলা আছে কিন্তু কেউ কিছু ভাবতে বা বুঝতে পারছে না। একটা গুমোট পরিস্থিতি যেন সমস্ত পরিবেশটাকে ভারী করে তুলেছিল।
ঘরময় যখন এরকম পরিস্থিতি, ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর একটা আওয়াজে সবাই চমকে উঠলো। একজন বয়স্ক মহিলা দরজার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এই ভয়ানক কান ফাটানো শব্দে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। ততক্ষণে সমস্ত ঘর গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেছে। পুলিশ অফিসার ঘণ্টারাম মালাকার একটা লাইটার জ্বালানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। আর ঠিক তখনই সবাই দেখলো সেই অদ্ভুত দৃশ্য, শুনলো সেই অত্যন্ত অদ্ভুত কান্না। দেওয়ালের উত্তর–পূর্ব কোণ জুড়ে তখন একটা তীব্র নীল আলোয় ঘটে চলেছে এক ঘটনা। একটা বিশাল জলাভূমির মাঝে কতগুলো ছোট ছোট দ্বীপ। সবুজ গাছ–লতা–গুল্ম ছেয়ে আছে সেখানে। তারা ক্রমাগত ভাসতে ভাসতে চলেছে কোথায় কোনদিকে, কেউ জানে না। হঠাৎ এরকম একটা ছোট্ট দ্বীপের গাছপালার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা বেশ বড়সড় হলুদ–বাদামি রঙের হরিণ। তার পায়ে পায়ে একটা ছোট্ট হরিণ শিশু। হঠাৎ কোথা থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে এসে উঠে বসলো বড় হরিণটার পিঠে। মেয়েটার গায়ে ছেঁড়াখোড়া কাপড়। চুলগুলো মুখটাকে ঢেকে রেখেছে। পিঠের মেয়েটাকে নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এল হরিণটা। ঠিক তখনই সেই ছোট্ট মেয়েটার মুখের উপর থেকে সরে গেল চুলগুলো। সবাই অবাক হয়ে দেখলো সেই মুখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে একটা আর্তি, কেমন যেন করুণ হয়ে উঠছে সেই মেয়ের চোখ। আর তারপরেই হঠাৎ তার চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠলো লাল আগুনের গোলার মতো। আর সেই হরিণের শরীরের সুন্দর রং বদলে যেতে লাগলো লালচে কালো রঙে। ধীরে ধীরে সব কেমন যেন ধূসর হয়ে আসতে থাকলো, হরিণ আর সেই মেয়েটার শরীর যেন মর্গ থেকে বেরোনো মৃতদেহের মতো ফ্যাকাসে হয়ে যেতে লাগলো। ঠিক তখনই একটা গুলির শব্দ, আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু আবার আগের মতো চরম অন্ধকারে ডুবে গেল।
শুধু ভেসে আসতে লাগলো একটা খুব ভয়ানক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া কান্না, সে কান্না মানুষের না অন্য কিছুর তা কেউ বুঝতে পারলো না, যেমন বুঝতে পারলো না এই সব ঘটনার অর্থ।
(৫)
গত প্রায় একমাস যমে মানুষে টানাটানি চলার পর মরিয়ম এখন একটু সুস্থ। তবে হাসপাতালে থাকতে হবে এখনও বেশ কিছু দিন। শরীরে বত্রিশটা ক্ষত নিয়ে ভরতি হয়েছিল যেদিন, তারপর থেকে গতকাল পর্যন্ত সে একটাও কথা বলে নি, বলার মতো অবস্থায় ছিলও না সে। শুধু নল দিয়ে খাওয়া আর নার্সের ওষুধ খাওয়ানো ছাড়া তার সমস্ত কিছুই জড় পদার্থের মতো হয়ে গেছিল। আজ সকালেই প্রথমবার সে দেবব্রতকে ডেকেছে। সে খবর পৌঁছাতেই পুলিশ অফিসার ঘণ্টারাম মালাকার এবং ডাইনো এখন তার ঘরে। গত একমাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুই সে জানে না।
মরিয়ম তার বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে। ডাইনো তাকে কিছু বলার আগেই সে জানতে চাইলো,
—কোথায় দেবু?
মালাকার একটু ইতস্তত করে কিছু বলতে গেলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে ডাইনো বলল,
—তোকে সেই সব বলতেই এসেছি আমরা। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে শুনতে হবে, কোন রকম হাইপার বা উত্তেজনা চলবে না। দেবু ভালোই আছে। চিন্তার কিছু নেই।
একটু থেমে বলল,
—তুই দেবুর ব্যাবসা সম্পর্কে কিছু জানতিস না বোধহয়। বা যেটুকু জানতিস, সেটা খুবই কম। দেবু এই অঞ্চলে রিয়েল এস্টেটের কাজ কর্ম করতো, সেটা সবাই জানে। কিন্তু এর বাইরেও দেবুর একটা বড় ব্যাবসা ছিল, যেটার কথা কেউ জানতো না। বন্য জন্তু পাচার। একটা চক্রের সাহায্যে দেবু আন্তর্জাতিক চোরাচালান বাজারে দিনে দিনে খুব গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে উঠছিল।
তোর যেদিন ওরকম হল, তার ঠিক একমাস আগে এরকম একটা চোরা শিকারির দলের সঙ্গে দেবু গিয়েছিল মণিপুর। সাধারণত দেবু যায় না বা যেত না চোরাশিকারে, সেবার কি ইচ্ছা হয়েছিল কে জানে? আর সেই যাওয়াই কাল হল।
টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে দু‘ঢোক জল খেয়ে আবার বলা শুরু করলো ডাইনো,
—ছ–জনের দলটা সেদিন গেছিল মণিপুরের একটা বিখ্যাত জাতীয় উদ্যানে। বনরক্ষীদের টাকাপয়সা খাইয়ে আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করা ছিল। এই জাতীয় উদ্যানের নামটা তোর জানা মরিয়ম। কেইবুল লামজা।
চমকে উঠল মরিয়ম। এ নাম তো তার পরিচিত। কিন্তু… বেশ বিচলিত হয়ে উঠলো সে
তাকে লক্ষ্য করছিল ডাইনো। একটু গম্ভীর গলায় বলল,
—দেখ, মরিয়ম তুই এরকম টেন্সড হলে হবে না। শোন আগে। যাইহোক, কেইবুল লামজাতে ওরা সেবার টার্গেট করে থামিন শিকার করবে। থামিন হল বিলুপ্ত প্রায় একধরনের হরিণ। খানিকটা সম্বরের মতো হলেও একটু ছোট আর পাগুলো খুব লম্বা। ওরা থাকে লোকতাক হ্রদের উপর ভাসমান ছোট বড় সব দ্বীপের উপর। মাটি, লতা পাতা আর বিভিন্ন জৈব পদার্থ দিয়ে তৈরি এই দ্বীপগুলোকে মণিপুরের ভাষায় ফুমডি বলা হয়। তো সেদিন এরকম একটা বেশ বড় ফুমডির উপর ওরা থামিন মারার জন্য উঠেছিল। থ্রি–নট–থ্রি রাইফেলটা ছিল দেবুর হাতে। সাইলেন্সার রাইফেলটা তাক করে থাকতে থাকতেই সামনে এসেছিল একটা নধর পরিণত থামিন। কিন্তু দেবু তাকে গুলি করতেই কোথা থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে এসে দাঁড়ায় সেই হরিণের সামনে, তার কোলে একটা ছোট্টো বাচ্চা হরিণ। রাইফেলের গুলি সেই বাচ্চা হরিণের শরীর ভেদ করে বাচ্চা মেয়েটার শরীরে গিয়ে লাগে। স্পট ডেড। এই ঘটনায় দেবু প্রচণ্ড রকমের ভয় পায়। কিন্তু কি করবে বুঝতে না পেরে ফুমডির শুকনো গাছপালায় আগুন ধরিয়ে পালিয়ে আসে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, ওরা ফুমডি ছাড়ার পরেই নামে প্রচণ্ড বৃষ্টি। নিভে যায় আগুন। কয়েকদিন পর, স্থানীয় আদিবাসীরা সেই মেয়েটাকে খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যায় সেই অকুস্থলে। সেখানে আধপোড়া, পচতে থাকা তিনটে দেহ তারা খুঁজে পায়। একটা সেই বাচ্চাটার আর অন্য দুটো সেই বাচ্চা হরিণ আর তার মা। ওই মেয়েটা ছোট থেকেই থামিনের সঙ্গে ফুমডিতে খেলতে খেলতে বড় হচ্ছিল। ওর মৃত্যুতে আদিবাসী গ্রামের মানুষ যেমন খুব কষ্ট পেয়েছিল, তেমনি এর প্রতিকার চাইতে ছুটে গেছিল বনদপ্তরের অফিসে। ওরা গুলিটা বের করে দেখালেও সেখানে কোনও সুবিচার পায় নি। আসলে প্রচুর টাকার লেনদেন ততদিনে হয়ে গেছে তো।
এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলার পর হাঁপিয়ে ওঠে ডাইনো। একটু চুপ করে থাকে। ঘরময় তখন নিস্তব্ধতা। মরিয়ম যেন একটা চরম আঘাত প্রাণপণে সয়ে যাচ্ছে। তার চোখের কোণে জল।
নার্স এসে মরিয়মের বাম হাতে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে দিয়ে চলে গেল। একটা ওষুধ ঠিক দশ মিনিট পর খাবার জন্য দিয়ে গেল। নার্স চলে যেতে ডাইনো আবার বললো,
—আদিবাসীদের কান্না বিফলে যায়নি। তাদের আরাধ্য প্রকৃতি এই নৃশংসতার প্রতিশোধ নিতে এসেছিল। যে মহিলা তোকে কেইবুল লামজা নামে পরিচয় দিয়েছে, তিনি ওই আদিবাসীদের এক প্রেতগুরু। যে ছবি আর বাক্সটা তোকে গিফট করেন, সেটা আসলে ওঁর অস্ত্র। ওই বাক্সের মধ্যেই সেই আধপোড়া হরিণের স্টাফড দেহটা উনি রেখে গেছেন। তোর কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে আমি প্রথমে কোন সূত্রই পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ কি মনে হতে “কেইবুল লামজা” সার্চ করি। সেখান থেকেই মনে হয় ওখানে গেলে হয়তো কিছু জানা যাবে। চলে গেলাম। না গেলেই বোধহয় ভালো হত। তাহলে আর…
এতক্ষণ ডাইনোর কথা শুনতে শুনতে দাঁতে নখ কাটছিলেন অফিসার ঘণ্টারাম মালাকার। এবার তিনি শুরু করলেন।
—মিস্টার বিপুল সরকার প্রেতচর্চা না করে যদি আইবি জয়েন করতেন, তবে দেশের ভালো হত। যাইহোক, উনি সমস্ত তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে আমাকে দিয়েছেন, আর তার জন্য একটা বিরাট আন্তর্জাতিক চোরাচালান এবং চোরাশিকারীদের একটা বিরাট গ্যাং আমরা হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছি। খুব শিগগিরই সব কটা ধরা পড়ে যাবে। আপনার স্বামী প্রধান সাক্ষী হয়েছেন। ওঁর শাস্তি যতটা সম্ভব কম করার চেষ্টা করছি আমরা।
এবার একটু মরিয়মের কাছে ঘেঁষে, চোখ দুটো ছোট করে, ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—এবার আপনি বলুন তো, সেদিন আপনার এমন দশা হল কী করে? বত্রিশটা ক্ষত?
মরিয়ম ছটফট করে উঠলো। তার মুখটা তত ক্ষণে ডান দিকে বেঁকে গেছে। শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। ঘণ্টারাম মালাকার ছুটে গেলেন ডাক্তারের কাছে।
ডাইনো নেমে এল হাসপাতালের বারান্দা থেকে, রাস্তায় নেমে হাঁটতে লাগলো।
মরিয়মের শরীরের বত্রিশটা ক্ষত করার সময় একটা অদ্ভুত হিংস্রতা তাকে পেয়ে বসেছিল। আর আজ শেষ হয়ে যাবে সব হিসেব। এই ক–দিনে তেত্রিশটা খুন করেছে দেবু। মেয়েটাকে মারার পরেও চলে আসেনি দেবু। বত্রিশটা থামিন মারার পর আর রাইফেলে গুলি ছিল না। না হলে দেবুর সঙ্গে তার দেখা হবার কথা নয়। নৌকার দাঁড়টা এখনও সেই লোকতাক হ্রদের একটা ফুমডিতে তার শরীরের পাশে পোঁতা আছে। তাকে সেখানে পৌঁছতেই হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ডাইনো উত্তর–পূর্ব দিকে হাঁটতে লাগলো। একটা অদ্ভুত স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল, একটা অদ্ভুত আনন্দে হাওয়ায় ভেসে চললো ডাইনো।
Tags: অনিন্দ্য পাল, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সৌরভ ঘোষ, হরর, হরর গল্প
Last para ta clear bujhte parlam na.