লেটারবক্স
লেখক: কৃষ্ণাশীষ জানা
শিল্পী: জটায়ু
দুপুর দুটোর ট্রেনটা ধরে ভালোই করেছিল মৃদুল। একটা সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় দিনের আলো থাকতে থাকতে পৌঁছানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। গ্রামের নাম শিউরিয়া। ভারী অদ্ভুত নাম। শুনলেই কেমন যেন শিউলি ফুলের কথা মনে পড়ে। মৃদুল অবশ্য নামটা প্রথম শুনেছিল একজন পোস্টম্যান-এর কাছে।
দিনটা ছিল মঙ্গলবার। অফিস থেকে ফেরার পথে মানিকতলা মোড়ে একটা বিশ্রী জ্যাম-এ আটকে পড়েছিল মৃদুল। একেই ফাইনাল রিপোর্টের দুটো কলাম-এ সামান্য ভুল ধরা পড়ায় বস-এর কেবিনে গিয়ে কথা শুনতে হয়েছিল তাকে। কাজেই মেজাজ আগে থেকেই বিগড়ে ছিল তার। তার মধ্যে এই ভ্যাপসা গরমে কলকাতার জ্যাম। কার মুখ দেখে সকালে উঠেছিল সেটা আর মৃদুল মনে করার কোনও চেষ্টাই করল না, কারণ ফ্ল্যাটে সে একাই থাকে।
গেট খুলে মৃদুল যেই ঢুকতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডাক দিল, “ও মৃদুলবাবু! দাঁড়ান দাঁড়ান!”
এখন আবার কে এল রে বাবা? এইভাবে বসের খোঁচা খেয়ে জ্যাম-এ গলদঘর্ম হয়ে বাড়ি ফিরে কি আর ‘গেস্ট’ এর ঠ্যালা সামলানো যায়? মৃদুল অনিচ্ছা সহকারে ঘুরে তাকাল। আরে, এ তো পোস্টম্যান! বাঁচা গেল!
“কী ব্যাপার?”
“আপনার নামে চিঠি আছে যে। এই নিন। আর এইখানে একটা সই।”
চিঠিটা মৃদুলের দিদির। আগের মাসে ওর দিদির ছেলে হয়েছে। কাজের চাপে মৃদুল যেতেই পারেনি। “আমি কিন্তু খুব রাগ করব সোনাই! এবার কোনও রকম অজুহাত শুনব না এই বলে দিলাম। তুই কেমন ভাই রে? তোর পা ধরে বাড়িতে ডাকতে বাধ্য করবি? একবার আসতেও ইচ্ছে করে না, বল? কী এত কাজ করিস সারাদিন? শুনিসনি, অল ওয়ার্ক অ্যান্ড নো প্লে, মেকস জ্যাক আ ডাল বয়?” দিদি ফোন করে বলত মৃদুলকে। কিন্তু ওর যে সত্যিই অফিসে খুব চাপ, সেটা শুধু দিদি কেন, কাউকে যেন ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারত না। মনে মনে মৃদুল একটা ছোট্ট হিসেব করে নিল। সে লিখবে এই মাসে হবে না, কিন্তু সামনের মাসে সে নিশ্চয়ই যাবে।
“আর কোনও চিঠি আসেনি? ঠিক জানো তো?”
“হ্যাঁ মৃদুলবাবু। আপনি তো চেনা লোক। আপনার নাম চোখে পড়বে না? কেন, আরও কিছু আসার কথা ছিল?”
“হ্যাঁ… একটা বিল আসার কথা…” অন্যমনস্কভাবে বলল মৃদুল, “ঠিক আছে। যখন আসার আসবে।”
“চিন্তা করবেন না বাবু। আমাদের এখানে কোনও রকম গোলমাল হয় না। যখন যা আসবে ঠিক টাইম-এ পেয়ে যাবেন। এ তো আর শিউরিয়া নয় যে ভৌতিক কাণ্ড ঘটবে চিঠিপত্তর নিয়ে!”
কথাটা কেমন যেন কানে লাগল মৃদুলের। পোস্টম্যান সাইকেলে বসার আগেই মৃদুল তাকে জিজ্ঞেস করল, “কী বললে? ভৌতিক কাণ্ড? কী রকম ভৌতিক কাণ্ড?”
পোস্টম্যান হেসে বলল, “আপনারা শহুরে মানুষ। আমার কথা শুনে হাসবেন।”
“আহা, শুনি না!”
“আমিও সত্যি-মিথ্যে জানিনে বাবু। তবে এই লাইনে আছি বলেই শুনেছি, শিউরিয়াতে নাকি কোথায় একটা ছোট ভাঙা ঘর আছে, মানে খুবই ছোট। এই আপনার ওই গ্যারাজ-এর চেয়ে সামান্য বড়। ওখানে নাকি এক পাগল বৈজ্ঞানিক থাকত। অনেক বছর আগেই বুড়ো মারা যায়। লোকে বলে, তার পাগল হবার পেছনেও নাকি এক বেদনাদায়ক গল্প আছে। আমার কিন্তু সবই শোনা…”
“বলে যাও-না।”
“লোকে বলে তার নাকি একটি ফুটফুটে মেয়ে ছিল। ওই বৈজ্ঞানিকের স্ত্রী-র অভিযোগ ছিল যে মানুষটা নাকি কাজ ছাড়া আর কিছুই জানত না। সারাদিন শুধু জটিল অঙ্ক আর হাজার হাজার ফরমুলায় নাকি ডুবে থাকত। ব্যাপারটাকে ওই গ্রামের কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু একদিন এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল…”
“কী ঘটেছিল?”
“আমার কিন্তু সব শোনা, বাবু। সত্যি-মিথ্যে…”
“আহা! আবার শুরু করলে তুমি! আরে বলো-না কী হয়েছিল?”
পোস্টম্যান-এর মুখ দেখে বেশ বোঝা যাছিল যে ঘটনার বর্ণনা সে করতে চলেছে তা যথেষ্ট অপ্রীতিকর।
“একদিন সকালে ওর স্ত্রী কিছু কাজে বাইরে যাবার আগে স্বামীকে বলে গিয়েছিলেন মেয়েকে দেখতে, উনি অল্পক্ষণের মধ্যেই ফিরবেন। কিন্তু স্বামীর মন তো পড়ে আছে বিশ্বের অকল্পনীয় সব রহস্যে। তিনি তো অঙ্ক কষতেই ব্যস্ত। মেয়ে যে কখন ঘর থেকে খেলতে খেলতে বেরিয়ে চলে গেছে তিনি টেরও পাননি। যখন স্ত্রী ঘরে ফেরেন তখন বৈজ্ঞানিক বুঝতে পারেন যে মেয়ে ঘরে নেই। তন্ন তন্ন করে চারপাশ খোঁজা হল। কোত্থাও পাওয়া গেল না মেয়েটিকে। এদিকে কেঁদে কেঁদে মায়ের অবস্থা শোচনীয়। অবশেষে সন্ধের দিকে গ্রামের একটা ছেলে এসে খবর দিল পাশেই একটা ছোট পুকুরে নাকি সে দুটো পুতুল ভাসতে দেখেছে।”
“মাই গড…”
“ভাবুন তো। আমার নিজের একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। রক্ত জল হয়ে যায় এসব ভাবলে…। যা-ই হোক, তার পর ওর স্ত্রী-ও এক কঠিন অসুখের মধ্যে পড়েন এবং কয়েক মাসের মধ্যেই দেহ ত্যাগ করেন। বৈজ্ঞানিক নাকি তার পর থেকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। ঘর থেকে বেরোত না, কারও সঙ্গে কথা বলত না। সারাদিন ওই ছোট্ট ঘর, মানে যেটাকে ‘গবেষণাগার’ বলা চলে, তার মধ্যেই বসে বসে না-জানি কী করত। মাঝে মাঝে নাকি মাঝরাতে বৈজ্ঞানিকের কান্নার আওয়াজ ও ভেসে আসত। অনেকে পাগলের মতো হাসির শব্দও শুনতে পেত। লোকে বুঝে গেল মানুষটা পাগল হয়ে গিয়েছে। ওই পরিস্থিতিতে পাগল হওয়াটা কিছুই আশ্চর্যের না।”
“তা তো বটেই। কিন্তু ভুতুড়ে ব্যাপার কী যেন বলছিলে?”
“শেষ কিছুদিন বৈজ্ঞানিক কাকে যেন চিঠি লিখত। তার ঘরের বাইরেই একটা ছোট লেটারবক্স তৈরি করল সে। লেটারবক্সটা আমি দেখেছিলাম অনেক বছর আগে। একটু অদ্ভুত দেখতে। মানে আমাদের এখানকার মতোই, কিন্তু তবু যেন কেমন একটা অন্যরকম মনে হয়। ঠিক বলে বোঝানো যাবে না বাবু।”
“সে যা-ই হোক, সেইখানে নাকি বুড়ো চিঠি ফেলত প্রায় রোজ। গ্রামের কিছু লোকের চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। চিঠি ফেলছে, অথচ কোনও পোস্টম্যান তো নিতে আসছে না সেই চিঠি। বুড়ো কি তবে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেল? তখনকার দু-একজন পোস্টম্যান নাকি বলত বুড়োকে, বাবু, আপনার চিঠি কিছু থাকলে রেখে দেবেন আপনার ওই লেটারবক্সে, আমি না-হয় এসে নিয়ে যাব। তখন নাকি বুড়ো রেগে গিয়ে বলত, তুমি নিয়ে যাবে? আমার চিঠি? তুমি পারবে পৌঁছে দিতে সে-সমস্ত চিঠি? বলেই নাকি হা-হা করে গর্জন করে হেসে উঠতেন। একটা পোস্টম্যান একবার সকালে দেখেছিল বুড়ো বাইরে বেরিয়ে এসে তার বানানো লেটারবক্সে একটা চিঠি ফেলে আবার নিজের গর্তে প্রবেশ করল। পোস্টম্যান ভাবল যাই, চিঠিটা নিয়ে নিই। না-জানি বুড়ো কাকে লেখে। চিঠি দেখলেই বুঝতে পারব আদৌ সেটা কাউকে পাঠানো যাবে কি না। সে এগিয়ে গিয়ে লেটারবক্সটা ভালো করে পরীক্ষা করল। কেমন যেন একটা লাগল ওর। নীচের ডালাতে তালা নেই। কোনও ল্যাচও নেই। একটা হালকা টান দিলেই খুলে যায়। সে টেনে খুলল ডালাটা। ভেতরটা ফাঁকা। আশ্চর্য! চিঠি ফেলে দেবার মাত্র দু-মিনিটের মধ্যেই উধাও হয়ে গেল নাকি সে চিঠি? সে যে স্পষ্ট দেখল বুড়োকে চিঠিটা ফেলতে।”
“এর পর আরও অনেক ঘটনা এরম ঘটেছে বাবু। গ্রামের দুষ্টু ছেলেরাও অনেক রকম ফন্দিফিকির করেছে, কিন্তু কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি চিঠিগুলো যেত কোথায়। ব্যাপারটা হল কয়েক মাস পর।”
“শিউরিয়া ছোট গ্রাম। রাত ন-টার মধ্যেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। একবার নাকি অনেক রাতে গ্রামেরই একজন বাড়ি ফিরছিল। হয়তো শহরে গিয়েছিল কোনও কাজে, ট্রেন লেট… যা-ই হোক। তা সে দেখেছিল এক অদ্ভুত কাণ্ড। তখন রাত দেড়টা। তাড়াহুড়ো করে বাড়ির দিকে ফিরছিল সেই লোক। হঠাৎ সে দেখে রাতের ওই অন্ধকারে নাকি বুড়ো চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে লেটারবক্সের ডালা খুলে একটা চিঠি হাতে নিয়ে আবার ঘরে ঢুকে গেল। বুড়োকে আবার কেউ উত্তরও দেয় নাকি? আর কোত্থেকেই-বা আসে সে উত্তর? পোস্টম্যানকে পরে অনেকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে বুড়োর নামে কোনও চিঠিই আসে না। এ এক ভারী আশ্চর্য ব্যাপার, মৃদুলবাবু। যা-ই হোক, কয়েক বছরের মধ্যেই বুড়ো মারা গেল। অনেকদিন বেরোচ্ছে না দেখে গ্রামের ছেলেরা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে বুড়ো বিছানায় শুয়ে। ঘুমের মধ্যেই মারা গেছে। গ্রামের লোকেরাই বুড়োর দেহ পোড়াবার সব ব্যবস্থা করে। তার পর থেকে আর ওই ছোট্ট গবেষণাগার আর ওই লেটারবক্সে কারও কোনও রকমের কৌতূহল রইল না। সবাই একটু দূরেই থাকত। ‘না জানি কী করে রেখেছে পাগল বৈজ্ঞানিক… কোনও দরকার নেই ওদিকে যাবার।’ এই ধরনের কথাই ছিল সবার মুখে। অনেকদিন ওদিকে যাইনি… কে জানে এখন কী অবস্থায় আছে সেই গবেষণাগার।”
এরকম একটা গল্প শুনবে মৃদুল ভাবেনি। সে যে ক্লান্ত সেটা যেন কিছুক্ষণের জন্যে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। সেদিন রাতে খেতে বসেও তার মাথার মধ্যে শুধু একটাই নাম বার বার ঘুরছিল। শিউরিয়া… শিউরিয়া…। গল্পটা কিছুতেই যেন ভুলতে পারছিল না মৃদুল। শুধু যে চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে গল্পটার ভেতর তা নয়, আছে একটা অজানা, অচেনা গন্ধও। কীসের গন্ধ সেটা? বুড়ো কাকে চিঠি লিখত? কে-ই বা তার উত্তর দিত? হঠাৎ নিজের একটা আলাদা লেটারবক্স-ই বা বানানোর প্রয়োজন কী? তবে কি সেটা সাধারণ কোনও লেটারবক্স নয়? সেটা কি তার একটা ‘প্রজেক্ট’?
পরের দু-দিন যখন মৃদুল দেখল ভাবনাটা মাথা থেকে বেরোচ্ছে না, তখন ও বুঝল ব্যাপারটা আসলে কী। ওর লোভ হয়েছে। সেই লেটারবক্সটা দেখার লোভ। অবশেষে ঠিক করেই ফেলল সে, একবার যাবে শিউরিয়া। ব্যাপারটা দারুণ ইন্টারেস্টিং বলাই বাহুল্য। এইভাবে একটা গল্প যে কাউকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসতে পারে সেই ধারণা মৃদুলের ছিল না। মা-কে জানানোর প্রয়োজন নেই। অফিসে ছুটি চাইলে পাবে না তো বটেই, উলটে আরও চারটে বাঁকা কথাও শুনতে হতে পারে। তাই সবার চেয়ে ভালো উপায় ‘হঠাৎ শরীর খারাপ, স্যার। ফুড পয়জনিং।’
ট্রেন থেকে মিরিশাল-এ নেমে বাস ধরে সোজা শিউরিয়া। জায়গাটা দেখে মৃদুলের প্রথম যেটা মনে হয়েছিল সেটা হল— এত আধুনিক প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু গ্রাম কেমন যেন একই রকম থেকে গিয়েছে। হঠাৎ এই গ্রামে এসে মৃদুলের মনে হল সে যেন টাইম-ট্র্যাভেল করে এক লাফেই অনেকখানি অতীতে ফিরে গেছে। হাজারটা গাড়ির হাড়-জ্বালানো আওয়াজ নেই, রক্ত বিষিয়ে দেওয়া কালো ধোঁয়ার মেঘ নেই, দম বন্ধ করে দেওয়া বাতাস নেই। সত্যি, এরম জায়গায় যদি মাসে একবার করে দু-দিনের জন্যে হলেও আসা যায়, তা হলে সারা বছর কাঁড়ি-কাঁড়ি অ্যালোপ্যাথি ওষুধ আর গিলতে হয় না।
রাস্তা ঘাটে লোক খুব কম। দোকানপাটও তেমন নেই। মৃদুল বুঝল গ্রামটা নিতান্তই ছোট, আর জনসংখ্যাও কম। মৃদুল যেটা আশা করে এসেছিল, সেটাই হল। খুব কাঠ-খড় পোড়াতে আর হল না তাকে। একটা দোকানে ‘বুড়ো বৈজ্ঞানিক’-এর বাড়িটা কোথায় জিজ্ঞেস করতেই মোটাসোটা লোকটা মৃদুলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “বৈজ্ঞানিক? পাগল বুড়ো?”
“হ্যাঁ গো।”
“সে তো অনেক বছর হল মারা গেছে ভাই।”
“সে খবর আমি পেয়েছি। ওই ঘরটা কোথায় একটু যদি বলে দেন।”
লোকটা মুচকি হেসে বলল, “বেঁচে থাকতে কেউ লোকটার খোঁজ নিতে এল না। আর এখন… যা-ই হোক, শোনো ভাই। এই রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে যাবে। প্রথম ডান দিকের গলিটা ছেড়ে দেবে। পরের ডান দিকের গলিতে ঢুকে আবার মিনিট পাঁচেক হাঁটা। তারপরই দেখতে পাবে একটা ফাঁকা জায়গায় একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি, আর তার পেছনে একটা ছোট ভাঙা ঘর। ওইখানেই বুড়ো বসত। বাড়িটায় তালা দেওয়া বোধহয়… কে জানে… কেউ তো আর যায় না… সাপখোপ থাকতে পারে কিন্তু, সাবধান!”
মৃদুল বাড়িটার সামনে যখন পৌঁছল, তার চোখ সোজা চলে গিয়েছিল সেই লেটারবক্সটার দিকে। ছোট ভাঙা গবেষণাগার, চারিদিকে ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা। সেই ঘরের দরজার বাইরেই একটা আম গাছের নীচে একটা ছোট্ট লেটারবক্স। উচ্চতায় খুব বেশি হলে সাড়ে চার ফুট। গায়ের রং লাল, যদিও একসময় সেটা টকটকে লাল ছিল বোঝাই যায়। ওপরে ঢাকনাটা কালো। রঙের ব্যাপারে সাধারণ লেটারবক্সের সঙ্গে বেশ মিল। কিন্তু খটকা অন্য জায়গায়। মৃদুল লক্ষ করল, লেটারবক্সটার নীচে একটা ছোট্ট ফাঁক, আর সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটো সবুজ রঙের তার। এর ভেতরে কি এরকম আরও তার আছে? মৃদুল মনে মনে ভাবল। তবে কি এটা আসলে একটা যন্ত্র? যেটা বাইরে থেকে দেখতে একটা লেটারবক্সের মতো?
গবেষণাগারের দরজা ঠেলতেই খুলে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে নাকে রুমাল চাপা দিতে হল মৃদুলকে। ভ্যাপসা দম-বন্ধ করে দেওয়া গরম হাওয়া ঠেলে বেরিয়ে এল ঘরটা থেকে। ঘরের একটি মাত্র জানালা এক ধাক্কায় ঠেলে খুলে দিল মৃদুল। এইটুকু একটা ঘরে বৈজ্ঞানিক সারাদিন থাকতেন কী করে? নিজের শেষ জীবনটা এইখানে কাটিয়েছিলেন। শেষ জীবন বললে কম বলা হয়… তার স্ত্রী-র মারা যাবার পর থেকেই তো আর তিনি বাড়িতে ঢোকেননি। তখন এই গবেষণাগারই তার পৃথিবী। ভেবেও কষ্ট হল মৃদুলের। সায়েন্স-পাগল মানুষ, একটু খামখেয়ালী। তাই বলে এত বড় শাস্তি তাকে পেতে হল?
ইমারজেন্সি লাইট, দুটো টর্চ, একটা বড় আর একটা পকেট সাইজ, এক্সট্রা ব্যাটারি, মোমবাতি, সবই ব্যাগে করে এনেছে মৃদুল। সে মনে মনে ঠিক করেই এসেছিল একটা রাত অন্তত সে এখানে থাকবেই। ওই লেটারবক্সটা ওর কাছে একটা সাংঘাতিক আকর্ষণ। কিছু একটা লজিক তো থাকবেই। ভুতুড়ে বলে তো আর সব কিছু মেনে নেওয়া যায় না এত সহজে।
রাত তখন প্রায় ন-টা। কাছেই দোকান থেকে কিনে আনা পাউরুটি আর ডিমভাজা খেয়ে ঘরে ইমারজেন্সি ল্যাম্প জালিয়ে মেঝেতে বসল মৃদুল। একটা গা-ছমছমে ব্যাপার যে নেই, সেটা বললে ডাহা মিথ্যে বলা হবে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। এইরকম আবহাওয়া কি আগে কোনওদিন মৃদুল অনুভব করেছে? না, করেনি। কত দুঃখ, কত কষ্ট, কত আক্ষেপ, আর কত বুক চাপড়ে-চাপড়ে কান্নার আওয়াজ যে মিশে আছে এই ছোট্ট ঘরে রাখা এত খাতা এত অঙ্ক এত ফরমুলার মধ্যে, কে জানে।
বৈজ্ঞানিকের ধুলোমাখা আলমারি আর টেবিলের ড্রয়ারে অনেক কাগজপত্র রয়েছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। মৃদুল কাগজগুলো উলটে-পালটে দেখতে লাগল। মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল প্রায় সবকিছুই। জটিল ফিজিক্স। রিলেটিভিটি, টাইম-স্পেস কন্টিনিউয়াম, আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ প্যারাডক্স… কত রকম বিষয়ে যে কত রকমের লেখা, গবেষণা, পাতার পর পাতা অঙ্ক…। টেবিলে মাকড়সার উপদ্রবে কাহিল হয়ে পড়া কিছু বই মৃদুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটার নাম ‘দ্য আইনস্টাইন-রোসেন ব্রিজ’। মৃদুলের মনে পড়ল একটা বিদেশি সিনেমা দেখে এই বিষয়টার ব্যাপারে সে প্রথম জেনেছিল। ‘টাইম ট্রাভেল’ আর ‘ওয়ার্মহোল’ নিয়েও বেশ কিছু বই ওর চোখে পড়ল। কিন্তু সব শেষে যেটা চোখে পড়ল সেটা ইন্টারেস্টিং। বইটার নাম ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য সুপারন্যাচারাল’। মৃদুল নিজেও ঠিক জানে না কেন, কিন্তু ওর মনে হল ও যেন ঠিক এই বইটাই খুঁজছিল। বইটা নিজের ব্যাগের পাশে রাখল সে।
বাইরে একটা কুকুর ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। হাতে-পায়ে আর গলায় ওডোমস মেখে ড্রয়ার খুলল মৃদুল। একটা ডায়েরি গোছের কিছু পেলে মন্দ হত না। কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে একটা ছোট কাগজ নীচে পড়ল। সাদা কাগজ। বেশ পাতলা। ওপরে দু-কোনায় দুটো গোল ফুটো। ঠিক যেমন একটা পাঞ্চার দিয়ে ফুটো করা হয়। এরকম কাগজ আরও অনেক ছিল। এতেই হয়তো চিঠি লিখতেন বৈজ্ঞানিক, মৃদুল ভাবল। সে আবার ডায়েরি জাতীয় কিছু খুঁজতে শুরু করলে, এবং ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেল।
ডায়েরি নিয়ে নীচে বসল মৃদুল। মলাটে নামটা চোখে পড়ল, পরিতোষ ঘোষদস্তিদার। শুরুর বেশ কিছু পাতায় অঙ্ক ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। অল্পবিস্তর লেখা শুরু হয়েছে মাঝখান থেকে। খুবই এলোমেলোভাবে এন্ট্রিগুলো করা। ভালোভাবে গুছিয়ে কিছুই লেখা নেই। কিছু কিছু এন্ট্রি-তে শুধুমাত্র ভাঙা ভাঙা শব্দ ছাড়া কিছুই নেই। ঠিক ঠিক সাজিয়ে রাখলে এন্ট্রিগুলো এইরকম:
২ এপ্রিল, ৯০: অন্য ডাইমেনশন? যোগাযোগের উপায়?
৯ এপ্রিল, ৯০: টাইম-এর ফ্যাক্টরটা থেকেই যাছে। টাইম কি বেন্ড করা একেবারেই অসম্ভব? ডক্টর হাওয়ার্ড-এর লেখা ওয়ার্মহোল-এর ওপর বইটা কিনতে হবে। দরকার পড়লে ওঁকে একটা চিঠি লিখব।
২১ মে, ৯০: বৃষ্টির জন্মদিন। ওকে একটা ছোট্ট পেরিস্কোপ বানিয়ে দিয়েছি। ও খুব খুশি। সারাক্ষণ চোখে লাগিয়ে বসে আছে। বৃষ্টির মধ্যে একটা কৌতূহল লক্ষ করছি। যা দেখছে তা-ই অন্ধের মতো মেনে নিচ্ছে না। ব্যাখ্যা খুঁজছে। কাল আকাশে রামধনু দেখে কত কিছুই-না জিজ্ঞেস করল আমাকে। এই কৌতূহলটার খুব প্রয়োজন।
১৫ জুন, ৯০: হচ্ছে না, হচ্ছে না। কিছুতেই মিলছে না। গামার এক্সপোনেন্টটা নিয়ে যত সমস্যা। শহর থেকে নতুন সরঞ্জাম কিনে আনতে হবে।
২ জুলাই, ৯০: আজ পদ্মা আমাদের বিয়ের ছবি দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিল। আমায় দেখে ভেতরে চলে গেল। কেন? ও কি আমায় কিছু বলতে চায়?
১১ জুলাই, ৯০: এই ঝামেলাটা মিটে গেলে এক মাস কোনও কাজ করব না। আই নিড আ ব্রেক। পদ্মা আর বৃষ্টিকে নিয়ে কোথাও ঘুরে এলে হয়।
১ আগস্ট, ৯০: এ আমি কী করলাম?
৫ আগস্ট, ৯০: বৃষ্টি, আমায় ক্ষমা কর, মা। তোর বাবাকে ক্ষমা কর… আমি আর পারছি না… ফিরে আয় মা…
২৪ অক্টোবর, ৯০: বৃষ্টি চলে গেছে প্রায় দু-মাস হল। পদ্মা এখন একটা কাঠের পুতুল। আমার আর ভালো লাগছে না। আমার জন্যে আমার মেয়েটাও গেল, আর এবার আমার স্ত্রী-ও যাবে। ভগবান, তুমি আমায় কেন নিলে না সেইদিন?
১৩ নভেম্বর, ৯০: পদ্মার অবস্থা খুবই খারাপ। সারা রাত বৃষ্টির মধ্যে বসেছিল। সেদিন মাঝ রাতে আবার পুকুরে একা একা চলে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘আরে মেয়েটা পুকুরে স্নান করতে গিয়েছিল তো। তাই ওকে আনতে গেলাম। তুমি তো সব ভুলে যাও।’ সাইনস অফ ডেলিরিয়াম। এখন ওর সাংঘাতিক নিউমোনিয়া।
৩ ডিসেম্বর, ৯০: আমি একাই রয়ে গেলাম। একা। সবাই ছেড়ে চলে গেল।
এর পর বেশ কিছু পাতা ভুলভালো লেখা। মানে যাকে বলে হিজিবিজি। অঙ্ক করে করে কেটে দেওয়া, ফরমুলার ডেরিভেশান একশোবার একশোটা পদ্ধতিতে করা এবং বেশির ভাগই কেটে দেওয়া। কিন্তু সে-সবের পরে যে লেখাগুলো ছিল সেগুলো পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল মৃদুলের।
৫ জুন, ৯১: এও কি সম্ভব? জানি না… জানি না… কিন্তু একটা চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।
৯ জুলাই, ৯১: মিলছে না। অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। এই পথে বার বার গণ্ডগোল হবে। তা ছাড়া যোগাযোগটা ঠিক কীভাবে সম্ভব?
১৮ নভেম্বর, ৯১: আবার ব্যর্থ। হচ্ছে না কিছুতেই। আমার ঘরের আশপাশেই কি কোনও পোর্টাল আছে? একটা যোগাযোগের রাস্তা? ব্রিজ? সামনের আম গাছের নীচে ওরম অদ্ভুত এনার্জি সিগনেচার-এর মানে কী?
১ ডিসেম্বর, ৯১: আমার বিশাস হচ্ছে না। এতে যদি সফল হই তবে… তবে…
৯ এপ্রিল, ৯২: এই সামান্য ভুলের জন্য এতদিন হচ্ছিল না কাজটা! ছিঃ! একটা সোজা অঙ্কের ভুল! এইবার হবে! হতেই হবে!
২৯ মে, ৯২: ট্রান্সমিশন হযেছে। মাস ট্রান্সফার সাক্সেসফুল। কিন্তু রিসিভ করতে পারব কি? সত্যি, আমরা কীসের বৈজ্ঞানিক? কত রহস্য যে লুকিয়ে আছে আমাদের চারপাশে, যাদের সম্পর্কে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারনাই নেই। কত রহস্যের আবার একাধিক সমাধান!
৩০ মে, ৯২: আমার বিশাস হচ্ছে না। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম একটা সম্পূর্ণ নতুন ডাইমেনশন খুঁজে বার করেছি আমি, আর শুধু তা-ই নয়, সেই ডাইমেনশনের সঙ্গে একটা যোগাযোগ করার প্রচেষ্টায় সফল হয়েছি! সেটা অবশ্য আমার আম গাছের নীচে পোর্টালটা আবিষ্কার করতে না পারলে সম্ভব হত না!
৩১ মায়, ৯২: আর ডায়রির প্রয়োজন নেই। আজ বড় হালকা লাগছে। অনেক দিন পর মনে হছে আমি একা নই। আমি কোনওদিনই একা ছিলাম না। ওরা আমায় ক্ষমা করেছে। ওরা আমায় এখনও মনে রেখেছে, এখনও ভালোবাসে। সাইনিং অফ।
এর পর যে কটা পাতা রয়েছে তাতে কলমের একটা আঁচড়ও নেই।
মৃদুল কিছুক্ষণ হাঁ করে বসে রইল। যে ক্ষুদ্র সন্দেহটা তার মনের গভীরে দানা বেঁধেছিল, সেটা তা হলে সত্যি? বুড়ো বৈজ্ঞানিক কি সত্যি ওই গাছের নীচে ‘অন্য ডাইমেনশন’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্রিজ খুঁজে পেয়েছেন, এবং সেখানেই লেটারবক্সটা বানিয়েছেন? লেটারবক্সটা কি তা হলে একটা বৈজ্ঞানিক যন্ত্র, যার সাহায্যে স্পিরিট-ডাইমেনশন এর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়?
গায়ের জামাটা ঘামে ভিজে গেছে মৃদুলের। এ যে এক ছোট্ট গ্রামের বুকে বিদেশি সায়েন্স-ফিকশন! এও কি সম্ভব? মৃদুল দেখল ওর হাত ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ও আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেল। পাল্লাটা খুলে নীচের দিকেই চোখ গেল প্রথমে। চল্লিশ-পঞ্চাশটা চিঠি।
কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিগুলো তুলল মৃদুল। একই রকম কাগজ। সাদা, পাতলা, ওপরে দুটো ফুটো। প্রথম চিঠিটা খুলতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল মৃদুলের। কিন্তু সেই ভয়ের মধ্যে ‘আতঙ্ক’ ব্যাপারটা যত-না ছিল, তার থেকেও যেন অনেক বেশি ছিল একটা অদ্ভুত ‘ভালো লাগা’। চিঠিতে শুধু একটা লাইন লেখা:
‘আমি ভালো আছি, বাবা।’
মৃদুল বুঝল এটাই প্রথম উত্তর যা বুড়ো বৈজ্ঞানিক পেয়েছিল।
ওপার থেকে আসা উত্তর।
আর-একটা চিঠি খুলল মৃদুল। তাতে লেখা:
‘না, আমরা যেতে পারব না। দেখা দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই, সম্ভবও নয়। এখানে সবই খুব শান্ত। খুব হালকা লাগে। আর যেন কোনও কিছুর ভয় নেই, চিন্তা নেই, ভাবনা নেই। দুঃখও নেই, আবার আনন্দও নেই। তবু… মাঝে মাঝে কেমন একটা যেন মনে হয়। একটা হালকা… অসোয়াস্তি। জানি না সেই অনুভূতির কী নাম।’
পরের চিঠি:
‘আমাদের কানে এল লোকে নাকি তোমায় পাগল বলে? ঘর থেকে বেরোতে হবে তো। অন্ধকারে কেন বসে থাকো? বাইরে কত আলো দেখো। এখানেও খুব আলো। আজ বৃষ্টি বলছিল পেরিস্কোপটা থাকলে ভালো হত। সব মায়া ত্যাগ করেছে, কিন্তু বাবার দেওয়া পেরিস্কোপের মায়া এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি তোমার মেয়ে।’
এরম আরও অনেক চিঠি, আরও অনেক গল্প। পড়তে পড়তে কখন যে মৃদুলের চোখ ভিজে এসেছে সে নিজেও টের পায়নি। যাক, লোকে জানল না ঠিকই, কিন্তু বৈজ্ঞানিকের শেষ ক-টা দিন খারাপ কাটেনি। নিজের স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গেই কেটেছে। মৃদুলের বিশ্বাস তার চেয়ে বেশি কিছু পরিতোষ ঘোষদস্তিদার চাননি। শেষ চিঠিটা এইরকম:
‘তোমার ডাক পড়বে।
কোনও রকম কষ্ট না পেয়েই তুমি আসবে এইদিকে।
আমরা অপেক্ষায় থাকব।
কতদিন পর তোমায় দেখব। সেই দেহত্যাগ করার পর থেকে আজ এই প্রথম বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। অথচ মজার ব্যাপার হল বুকের ভেতর তো এখন ফাঁকা, কিছুই নেই।
সাবধানে এসো।’
চোখ মুছল মৃদুল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল ডায়েরিটা পড়ে, কিন্তু এখন মনটা আবার ভালো হয়ে গেল। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন বুড়ো বৈজ্ঞানিক। হয়তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে আজ তাকে ধরা হত, যদি এই আবিষ্কারের কথা গোটা পৃথিবী জানত। কিন্তু এই আবিষ্কারের গল্প শুধুমাত্র বিজ্ঞানের গল্প নেই, ভালোবাসার গল্পও। হয়তো তাই এই গল্প এক নাম না-জানা গ্রামের এক ছোট্ট ভাঙা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখা কিছু চিঠির মধ্যেই থেকে খুশি।
মৃদুল আবার ডায়েরিটা নিয়ে শেষ পাতাতে গেল। তাতে এক-দুই-তিন করে কিছু পয়েন্টস লেখা:
১. সাদা পাতা, ৬০-৭০ জি.এস.এম.-এর মধ্যে। এটা অত্যন্ত জরুরি। মোটা কাগজ চলবে না।
২. ওপরে দুটো ফুটো। স্ট্যান্ডার্ড পাঞ্চার।
৩. লেখকের পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবে কিছু লিখতে হবে প্রথম চিঠিতে। পরের চিঠিতে তার আর কোনও প্রয়োজন হবে না। এটা খুবই জরুরি। পরিচয় গোপন করলে বা ঠিক ঠিক প্রমাণ না করতে পারলে উত্তর আসবে না।
৪. চিঠি যখন খুশি রাখা যায় লেটারবক্সে। চিঠি ফেলার পর ওপরের কালো কভার এর ঠিক নীচে যে বোতামটি রয়েছে, সেটি একবার টিপতে হবে। চিঠি ফেলা আর বোতাম টেপার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ৭ সেকেন্ডের বেশি যেন না হয়।
৫. উত্তর আসার উইন্ডো হল রাত ১:০০ থেকে ২:০০। কারণ জানি না।
৬. সব চিঠির উত্তর নাও আসতে পারে।
নাঃ, আর কি লোভ সামলানো যায়?
টেবিল থেকে একটা সাদা কাগজ টেনে এনে কোলের ওপর নিয়ে বসল মৃদুল। মনে মনে ভেবে নিল কী লিখবে। শরীরের মধ্যে উত্তেজনার স্রোত ভালোই অনুভব করছে সে। করবে না-ই বা কেন? সে যেটা করতে চলেছে সেটা তো রীতিমতো ঈশ্বরের নিয়মের বিরুদ্ধে!
মৃদুল লেখা শুরু করল:
‘বাবা,
আমার প্রণাম নিও।
তুমি কেমন আছ বাবা? আমরা সবাই ভালো আছি। মায়ের পায়ের সমস্যাটা আর নেই। কমপ্লিটলি কিওর্ড। দিদির বিয়ে যেখানে ঠিক করেছিলে সেইখানেই হয়েছে। সুমনদা আর দিদি একসঙ্গে খুব সুখেই আছে। দিদির ছেলে হয়েছে। ওর নাম রেখেছে ‘অর্ক’।
আমি সেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি বাবা। এখন অন্য জায়গায় অফিস আমার। কাজের চাপ প্রচুর, তবে মাইনেটা ভালোই।
তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম বাবা। এ এক ভারী অদ্ভুত জায়গা। এই বাড়ি, এই চিঠি-বাক্সের খোঁজ না পেলে তোমার সঙ্গে আর আমার কথা হত না। জানি না এই চিঠি ওপারে তোমার হাতে পৌঁছবে কি না, কিন্তু মন বলছে হতাশ হব না।
সোনাই।’
চিঠিটা নিয়ে লেটারবক্সটার সামনে এসে দাঁড়াল মৃদুল। তার হাত-পা এবার সত্যিই ঠান্ডা হয়ে আসছে। ভয়, উত্তেজনা, আনন্দ, সব মিলিয়ে যেন এক কালবৈশাখীর ঝড় উঠেছে তার মনের ভেতর। চিঠিটা সরু ফাঁকের মধ্যে গলিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বোতামটা টিপে দিল মৃদুল। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক দু-সেকেন্ডের জন্য সেই ফাঁক থেকে একটা ক্ষীণ সবুজ আলো বেরিয়ে এল। ভেতরে অল্প খুট-খুট শব্দও হল, তারপর আবার সব চুপ। মৃদুল ঘরে এসে ঘড়ি দেখল। ঘণ্টা দুয়েকের অপেক্ষা। জানালার পাশে বসে রইল মৃদুল। ঘুম পাচ্ছে না ওর আজ। পাওয়ার কথাও না। অবাক হয়ে পুরো ঘরটা আরেকবার ভালো করে দেখল মৃদুল। কী সাংঘাতিক একটা কাজ-ই না করে ফেলেছেন এই বাঙালি বৈজ্ঞানিক এই ছোট গ্রামের এই ছোট গবেষণাগারে! সাকসেসফুল কন্টাক্ট উইথ দ্য স্পিরিট ডাইমেনশন! মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়, সেখানে গিয়েও যে আমাদের কথা তারা ভাবে, এসবের অকাট্য প্রমাণ!
একটা বাজার পর মৃদুল বাইরে গিয়ে বসল। তার চোখ সেঁটে আছে লেটারবক্সের ওপর। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হল না। কিছুক্ষণ পরেই আবার সেই খুট-খুট শব্দ, আবার সেই কয়েক সেকেন্ডের ক্ষীণ সবুজ আলো। মৃদুল ঝাঁপিয়ে গেল লেটারবক্সের দিকে। ডালা খুলতেই দেখতে পেল চিঠিটা। ঘরে নিয়ে এসে আলোর সামনে রেখে ভাঁজ করা সাদা কাগজটা খুলল সে। কাগজটা গরম হয়ে গিয়েছে। চিঠি পড়ার আগেই মৃদুলের কান্না পেয়ে গেল। বাবার শেষ মুহূর্তে সে পাশে ছিল না। ট্রেন লেট ছিল। শেষ বারের মতো দেখতে পায়নি সে তার বাবাকে।
‘সোনাই,
আজ হঠাৎ খুব আনন্দ হচ্ছে। মন ভালো হলে কেমন লাগে ভুলতেই বসেছিলাম। তুই মনে করিয়ে দিলি।
আমি ভালো আছি। এখানে সবই ভালো, অভিযোগের কোনও কারণ নেই। কোনও রকম টান অনুভব করি না, কিন্তু আজ তোর চিঠিটা পেয়ে খুব খুশি হলাম।
সেদিন ভাগ্যিস তোর গাড়ি লেট ছিল। আমি চাইনি তুই আমায় ওই অবস্থায় দেখিস।
দীপাকে বলিস ‘অর্ক’ নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আর তোর মা-কে বলিস আমায় যেন ক্ষমা করে। সিগারেটের নেশাটাই আমায়… যাক গে। আরেকটা কথা মা-কে বলিস— রোজ যেন হাঁটে। বয়স হচ্ছে।
মাঝে মাঝে এই বাড়িতে আসিস সোনাই। এখানে কথা বলার লোক নেই রে।
আর শোন। খুব মন দিয়ে শোন। কাল দুপুরে ফিরবি ঠিক করেছিস তো? দুপুরে না গিয়ে সকালে চলে যাস। সকাল আটটায় বাস। মনে রাখিস। সকাল আটটা।
সুখে থাক, সুস্থ থাক।
বাবা।’
চিঠিটা যে কতবার মৃদুল পড়েছিল সেটা আর তার গোনা হয়নি। মনে মনে পরিতোষবাবু কে প্রণাম করল মৃদুল। বাংলার এই ছোট গ্রাম শিউরিয়া… সেই গ্রাম কী সম্পদটাই না লুকিয়ে রেখেছে নিজের বুকে! মনে মনে মৃদুল ভাবল, এর ব্যাপারে সবার না জানাটাই বোধহয় বাঞ্ছনীয়। এই আবিষ্কারের সঠিক মূল্যায়ন শুধুমাত্র বিজ্ঞানের ভিত্তিতে করা সম্ভব নিয়ে, উচিতও নয়। তা ছাড়া গোটা দুনিয়া জেনে গেলেই স্পিরিট ডাইমেনশনও ভরে যাবে জটিল অঙ্কে আর ভয়ংকর সব ফর্মুলায়, আর তাদের ভারে চাপা পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে একটা ছোট্ট মেয়ের পেরিস্কোপে আর একটিবার চোখ রাখার ইচ্ছে।
কলকাতায় ফিরে আসি পরের দিন সকালে। কলকাতা এসে খবর পেয়েছিলাম মিরিশাল থেকে দুপুরের ট্রেনটা, যেটায় আমার আসার কথা ছিল, ডিরেল করে সাংঘাতিক এক অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলেছে।
Tags: কৃষ্ণাশীষ জানা, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি গল্প
ভীষণ সুন্দর.. 😍