অসুখ
লেখক: শ্রীজিৎ সরকার
শিল্পী: সৌরভ ঘোষ
তারিখ: ১৫ মার্চ, ২৫০০
সময়: দুপুর ৩টে ১০ মিনিট
স্থান: ৬, লিন্ডসে লেহান স্ট্রিট, গ্রেট ব্রিটেন
বাচ্চাটাকে সুন্দর দেখতে। চোখদুটো খুব সরল আর নিষ্পাপ। তবে মুখে একটা দুঃখী-দুঃখী ভাব আছে; দেখলেই মায়া হবে।
এলিজা খুব মিষ্টি করে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার কীসের এত ভয় মাই বয়?”
বাচ্চাটা কোনও উত্তর দিল না। শুধু চোখ বড়-বড় করে এলিজার দিকে তাকিয়ে থাকল।
আজকাল ভয় পাওয়া লোকজন বড় একটা পাওয়া যায় না। যারা এখানে আসে, অধিকাংশই ডিপ্রেশনের রোগী। শিশু-কিশোররা ডিপ্রেশনে ভোগে লেখাপড়া নিয়ে, যুবক-যুবতীরা ডিপ্রেশনে ভোগে কেরিয়ার নিয়ে, মধ্যবয়স্ক-মধ্যবয়স্কারা ডিপ্রেশনে ভোগে টাকা-পয়সা নিয়ে…
জীবন থাকলে তো দুশ্চিন্তা থাকবেই, আর দুশ্চিন্তা থাকলেই আসবে হতাশা। আর সেই হতাশা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আছে বিখ্যাত মনোবিদ ডক্টর এলিজা প্যাটিনসন— যার কাছে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ ছুটে আসে। আজকাল সুপারসোনিক ট্যাক্সি বেরিয়ে যে যাতায়াতের এত সুবিধা হয়েছে!
মানুষের হাতে আজকাল সময় কম। তারা ঢুকেই আগে নিজের সমস্যার কথা বলে নেয়। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান নিয়ে কাজে ফিরে যায়।
কিন্তু এই বাচ্চাটা ঢুকে থেকে নিজের নাম-ধাম বলা ছাড়া আর কোনও কথার উত্তর দেয়নি। এর মানে ভয়টা ওর মনের মধ্যে চেপে বসে আছে।
তবে এলিজা অধৈর্য্য হল না। এসব কাজে শান্ত থাকাই নিয়ম। ও আরও নরম গলায় বলল, “বলো মাই বয়, কীসের ভয় তোমার? আমি আছি তো। তোমার সব ভয় ঠিক করে দেব।”
ছেলেটা মনে হয় ও বারবার এলিজার স্নেহমাখা কথাগুলো শুনতে-শুনতে একটু ভরসা পেল। খুব আস্তে-আস্তে বলল, “অ্যাকোয়াম্যানদের ভয়।”
আজকাল এই এক অসুখ এসেছে। কিছু সুস্থ-সবল মানুষ আচমকা গ্যালন-গ্যালন জল খেতে শুরু করে দিয়েছে। খাচ্ছে না, ঘুমোচ্ছে না, কোনও কাজ করছে না; শুধু জল খেয়ে চলেছে। পুকুর, নদী, সমুদ্র— কিচ্ছু বাদ দিচ্ছে না।
ঠিক কীসের থেকে যে রোগটা ছড়াচ্ছে, সেসব কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তাই আপাতত এর পোশাকি নাম রাখা হয়েছে — ‘অ্যাকোয়াম্যান সিনড্রোম’। কয়েকজন আক্রান্তকে ধরে অবশ্য প্রচুর গবেষণা আর পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত তাদের শারীরিক কোনও অস্বাভাবিকতা ধরা যায়নি।
বরং যা দেখেছেন, তাতেই বিজ্ঞানীদের চোখ কপালে উঠে গেছে। তাঁদের চোখের সামনে কয়েকশো লিটার জল খেয়ে নেওয়ার পরেও আক্রান্তদের শরীরে ওয়াটার-লেভেল একদম স্বাভাবিক। অথচ তারা মূত্রত্যাগ বা বমি— কিছুই করেনি। তাহলে এত জল যাচ্ছে কোথায়!
মাম্পস, হারপিস, পোলিও, ইবোলা বা করোনার মতো ভাইরাস ঘটিত অসুখ তো বহু আগেই পৃথিবী থেকে নির্মূল করে ফেলা হয়েছে। এইডস বা অন্যান্য মারণ-অসুখেরও ভ্যাকসিন বেরিয়ে গেছে। নতুন কোনও রোগ পৃথিবীতে হয় না বললেই চলে। হলেও তার ঠিকুজি-কুষ্ঠি জানতে আর প্রতিষেধক বের করতে বড়জোর মাসখানেক…
কিন্তু এই অসুখটা বড়ই অদ্ভুত! এদিকে রোজ অন্তত পঁচিশ-ত্রিশজন করে নতুন আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এলিজা বলল, “অ্যাকোয়াম্যানদের তোমার কীসের ভয়? ওরা তো জলই খায়। মানুষ তো আর খায় না।”
ছেলেটা ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ, জানি। কিন্তু এরকম করতে-করতে ওরা যদি একদিন সব জল খেয়ে ফেলে?”
এলিজার ভুরু-দুটো কুঁচকে গেল। অবশ্য আজকাল বাচ্চাদের আই কিউ খুবই বেশি হয়। তাদের পক্ষে এই আপাত সাধারণ সম্ভাবনার কথাটা বুঝে ফেলা এমনকিছু আশ্চর্যজনক নয়।
তবে খুব বেশিক্ষণ এলিজা ভুরু কুঁচকে রাখল না। তাতে বাচ্চাটা ভয় পেয়ে যাবে। ও মুখ স্বাভাবিক করে, হাসি টেনে বলল, “বাব্বা! এরই মধ্যে তুমি এতকিছু ভেবে ফেলেছ?” তারপর আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, “ভয় পেও না। কিচ্ছু হবে না। দেখো, ঠিক এর ভ্যাকসিন বেরিয়ে যাবে। তা ছাড়া পৃথিবীতে এত জল— খেয়ে শেষ করা মুখের কথা নাকি?”
“কিন্তু তার আগে যদি আমি নিজেই ‘অ্যাকোয়াম্যান’ হয়ে যাই?”
এলিজা জিজ্ঞাসা করল, “কেন? তুমি বাইরে বেরোনোর আগে মাস্ক পরো না? তোমাদের বাড়িতে এয়ার-পিউরিফায়ার চলে না? ইমিউনিটি বুস্টার, মাল্টি-ভিটামিন— এসব খাও না?”
ছেলেটা ঘাড় নাড়ল, যার অর্থ— সবগুলোরই উত্তর ‘হ্যাঁ’। ও বলল, “আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ে মাইকেল, ওর বাবাও তো অ্যাকোয়াম্যান হয়ে গেছে। ওরাও তো এসব করত। রোজ মাস্ক পালটাত।”
এলিজা বুঝল, একে বুঝিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। বরং ছেলেটাকে যত এই প্রসঙ্গ ভুলিয়ে রাখা যায়, ততই ভালো। এবং কয়েকদিন কাউন্সেলিংও করাতে হবে।
ও কিছু ওষুধের নাম আর বেসিক ইন্সট্রাকশন ছেলেটার অভিভাবকদের কাছে মেল করে দিল। যে কোনও অপ্রাপ্তবয়স্কের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার সময়ই গার্জিয়ান ডিটেইলস নেওয়া থাকে। কারণ ব্যস্ততার জন্য অধিকাংশ সময়ই তাঁরা বাচ্চার সঙ্গে আসতে পারেন না।
এলিজা হাসিমুখে বলল, “এবার তোমাকে একটা ইঞ্জেকশন দেব। একটুও লাগবে না।”
প্রযুক্তির কল্যাণে আজকাল ইঞ্জেকশনের সুচ প্রায় অদৃশ্য হওয়ার মতো সরু হয়ে গেছে। তাও অনেক বাচ্চাই ইঞ্জেকশনের নাম শুনেই নার্ভাস হয়ে পড়ে।
কিন্তু এই ছেলেটা তেমন ঘাবড়াল না। জামা গুটিয়ে, হাত এগিয়ে দিল।
এলিজা ইশারা করতেই ওর রোবট-অ্যাসিস্ট্যান্ট এগিয়ে এল। ইঞ্জেকশন দেওয়া, রক্তচাপ মাপা, টেস্টের জন্য স্যাম্পেল নেওয়া, কাউন্সেলিং চলাকালীন কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলে তার শুশ্রূষা করা— এসব কাজ সাধারণত ও-ই করে।
তারিখ: ২ এপ্রিল, ২৫০০
সময়: রাত ১১ টা ৩০ মিনিট
স্থান: ১০, জনপথ রোড, ভারতবর্ষ
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী অজিতেশ পাই ঘরে ঢুকলেন। আজ সারাদিন ভীষণ ব্যস্ততা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং, বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে মিটিং, বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর স্বাস্থ্যসচিবদের সঙ্গে মিটিং…
বিষয় একটাই: ‘অ্যাকোয়াম্যান সিনড্রোম’
পিঁপ-পিঁপ শব্দ হল কম্পিউটারে। তার মানে দিনের শেষ আপডেট ঢুকল।
চোখের ইশারায় অজিতেশ স্ক্রিন অন করলেন।
Total Affected— 189
Newly Affecte— 7
Dead— 0
Healed— 0
আবারও সাতজন! এ কী অদ্ভুত অসুখ এল— কেউ মরছে না, দুর্বল হচ্ছে না, কাউকে আঘাতও করছে না। খালি পাগলের মতো জল খেয়ে যাচ্ছে৷
একশো ঊননব্বই তো সরকারি হিসাব। কে জানে এর বাইরেও কতজন আছে! এর মধ্যে মোটে সত্তরজনকে আইসোলেটেড করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বাইশজন আবার পালিয়েছে।
অবশ্য অসুখটা ছোঁয়াচে কিনা, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি।
কয়েকবছর আগে একটা নতুন ধরনের প্রোটোজোয়া-ঘটিত অসুখ খুব ছড়াচ্ছিল। মূলত আলু থেকে হচ্ছিল সেটা। অজিতেশ আর তাঁর টিম সেবার খুব ভালো কাজ করেছিলেন।
এবার আবার নতুন একটা চ্যালেঞ্জ।
বড় ক্লান্ত লাগছে অজিতেশের। কাল আবার হয়তো লন্ডন ছুটতে হবে; ওখানকার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা আর WHO-এর আধিকারিকদের সঙ্গে গোপন বৈঠক আছে। এই দু-দিন আগেই তিনি ওখান থেকে ফিরলেন হতাশার চিকিৎসা করিয়ে। যত বুদ্ধিমান আর ক্ষমতাধরই হোন, তিনিও তো মানুষ। তাঁরও মনে আশঙ্কা আসে, নিরাপত্তাহীনতা আসে, হতাশাও আসে।
অফিসিয়াল কাজ হয়তো আজকের মতো শেষ। কিন্তু এখনও কিছু মেলের উত্তর দেওয়া বাকি রয়ে গেছে।
আজ আর অজিতেশের কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু আজ থেকে একটা নতুন ওষুধ খাওয়ার আছে। কিছু খাওয়ার পরেই সেটা খেতে হবে। তাই তিনি একটা রুটি একটু মার্মালেড মাখিয়ে খেলেন। তারপর ওষুধ খেয়ে মেলের জবাব লিখতে বসে গেলেন।
অজিতেশ আর তাঁর রোবট-সেক্রেটারিকে ডাকলেন না। যন্ত্রেরও তো একটু বিশ্রাম দরকার। তা ছাড়া চিঠি লিখিতে এমনকিছু কষ্ট নেই। মনে-মনে শুধু বলে গেলেই হল। কম্পিউটারের অটো-সেন্সর আপনা-আপনিই লিখতে থাকবে। বানান, ব্যকরণ, যতিচিহ্ন— সব ঠিকঠাক করা যন্ত্রের দায়িত্ব। শুধু প্রাথমিক বয়ানটুকু অজিতেশকে বলে দিতে হবে।
প্রথম মেলটা গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সচিবের কাছে। আজ সারাদিনের কাজের সারমর্ম লেখা আছে তাতে। আর দ্বিতীয়টা গেল গবেষকদলের প্রধানের কাছে। তাতে তাঁদের কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে খোঁজখবর করা হচ্ছে।
যেমন করে হোক, এই অসুখের প্রকোপ আটকাতেই হবে।
কাজ শেষ করে জল খেলেন অজিতেশ। তারপর আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন। দুশ্চিন্তায় ঘুম হয়তো তেমন হবে না; তবু শরীরকে যতটুকু বিশ্রাম দেওয়া যায় আর কী!
অন্যদিন শোওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একটা তন্দ্রাভাব চলে আসে। কখনও সেটা গাঢ় হয়, আবার কখনও সেটা হালকা হয়ে যায়। কিন্তু আজ আর অজিতেশ বেশিক্ষণ শুতে পারলেন না। প্রবল তৃষ্ণা তাঁকে উঠে বসিয়ে দিল।
একনিমেষে দু-লিটারের ভরতি বোতল শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু তৃষ্ণা কমছে কই? গলা-বুক তো একইভাবে খাঁ-খাঁ করছে!
ফ্রিজের যাবতীয় বোতল আর ডাইনিং-এ রাখা বোতলগুলোর জল ঢুকে গেল অজিতেশের পাকস্থলীতে। সেই সঙ্গে আরও যেখানে যা ছিল…
মন্ত্রী, সামরিক অধিকর্তা— এদের সরকার থেকে বিশেষ ধরনের ‘হাইড্রেটিং পিল’ দেওয়া হয়৷ অনেক জায়গায় প্রতিরক্ষার খাতিরে বাইরের জল খাওয়া যায় না। এমনকি স্নান পর্যন্ত করা যায় না। অত জল তো বহন করা যায় না। তখন এই একেকটা পিল এক-লিটার জলের ঘাটতি পূরণ করে।
অজিতেশ দুটো পিল খেয়ে ফেললেন।
আরও দুটো… আরও দুটো… একে-একে ত্রিশটা পিল খাওয়া হয়ে গেল। এদিকে ঘরের সমস্ত জল শেষ, পিলও শেষ।
তবু অজিতেশের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কে যেন ওঁর বুকের মধ্যে গোটা মরুভূমি বসিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এখনকার সুজলা-সুফলা মরুভূমি না; তিন-চারশো বছর আগেকার রুক্ষ, তপ্ত মরুভূমি।
এদিকে অ্যাকোয়ারিয়ামের জলটা পর্যন্ত শেষ। মাছগুলো ছটফট করতে-করতে নিস্তেজ হয়ে আসছে। এদিকে অজিতেশের শরীরে যেন আগুন ধরে গেছে।
অজিতেশের মন বলছে, ওঁ হয়তো ‘সেই’ রোগে আক্রান্ত। এক্ষুনি ফোন করলেই গোটা মেডিকেল টিম ছুটে আসবে। কিন্তু সেইটুকুও করতে ইচ্ছা করছে না।
অজিতেশ দ্রুত নীচে নেমে এলেন। আগুপিছু কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সুইমিং পুলের নীল জলে। হোক নন-পিউরিফায়েড, হোক নন-ড্রিঙ্কেবল; জল যখন— তৃষ্ণা তো মেটাবে।
পুলের জল কমতে শুরু করল…
তারিখ: ১০ এপ্রিল, ২৫০০
সময়: সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিট
স্থান: ৪/৬, উইলিয়াম ফ্র্যাঙ্কলিং স্ট্রিট, গ্রেট ব্রিটেন
“এফেক্টেড লোকগুলোর মধ্যে কিছু তো একটা যোগসূত্র আছে। আমি জানতে চাই— কী সেটা?”
ডগলাসকে ভীষণ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে যে ‘সিক্রেট ইনভেস্টিগেটিং কমিটি’ তৈরি করা হয়েছে, ও তার চেয়ারপার্সন। সুতরাং বলা যেতেই পারে, গোটা টিমের সাফল্য বা ব্যর্থতার দায় অনেকটাই ওর উপর এসে পড়বে।
বাকিরা মুখ চুন করে বসে আছে। এরা সবাই ডগলাসের বদমেজাজের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত। তারউপর বয়স, পদমর্যাদা, সম্মান— সবদিক থেকেই ও সবার সিনিয়র।
মাইক্রোবায়োলজিস্ট রবার্ট মিনমিন করে বলল, “মিস্টার ডগলাস, আমার ধারণা এই জিনিসটা এর জিন ম্যাপিংটাই বারবার বদলে ফেলছে। বা হয়তো এর জেনেটিক গঠন, ক্যারিওকাইনোসিস— এসব মানুষের খুব কাছাকাছি। যে কারণে আমরা একে লোকেট করতে পারছি না।
ডগলাস টেবিলে একটা জোরদার চাপড় মারল, “কিন্তু কেন? আমাদের টেস্টকিট বা মাইক্রোস্কোপ এত উন্নত! তাও আমরা পারছি না কেন ডিক? এর আগে কি আমরা এইরকম জটিল অণুজীব নিয়ে কাজ করিনি?”
রবার্ট ঢোঁক গিলে সায় দিল। মুখে কিছু বলল না। ডগলাস যে ভিতরে-ভিতরে কত উত্তেজিত, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। প্রকাশ্যে এটিকেট ভুলে সহকর্মীকে ডাকনাম ধরে ডেকে ফেলছে।
এদের মধ্যে ডগলাসের পরই ভাইরোলজিস্ট লিয়াকতের সম্মান সবচেয়ে বেশি। ওর নামে কিছু পেটেন্ট আছে, বেস্টসেলার ই-বুক আছে। ও গম্ভীর হয়ে বলল, “আমরা তো এখনও এটাই বুঝতে পারিনি যে এটা কীসের থেকে আসছে— ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া নাকি প্রোটোজোয়া? ভেক্টরটাই বা কী? রোগটা আদৌ সংক্রামক নাকি নয়? নাকি এটা কোনও জেনেটিক ডিজিজ?”
জেনারেল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ স্যামুয়েল বলল, “যে ক’জন আক্রান্তকে পরীক্ষা করেছি, তাদের মধ্যে মাত্র এক শতাংশের কোনও না কোনও সিরিয়াস অসুখ আছে। বাকিরা একদম ফিট অ্যান্ড ফাইন। ইমিউনিটি পাওয়ারও যথেষ্ট ভালো।”
বায়োকেমিস্ট জেনিফারও স্যামুয়েলের কথায় সায় দিল, “হ্যাঁ। ওদের কোনও স্যাম্পেলে অস্বাভাবিক কিছু তো দেখিনি। আর রোগটা কিন্তু নারী, পুরুষ, শিশু— সবাইকে অ্যাটাক করছে। এবং সমস্ত বয়সের, সমস্ত দেশের মানুষকে…”
ডগলাস খানিকটা আক্ষেপের সুরে বলল, “আর আমরা এতজন এক্সপার্ট সেটা বসে-বসে দেখছি!”
কারোরই কিছু বলার নেই। সবাই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর মাথা নীচু করে নিল। সত্যিই তো ওরা কেউ কোনও নতুন রিপোর্ট দিতে পারছে না। শুধু প্রতিদিন একই বয়ানে সরকারকে জানিয়ে যাচ্ছে, এখনও কিছু পাওয়া যায়নি।
ডগলাস বলল, “যান যে যার কাজে। আরও ভালো করে কেস স্টাডি করুন, স্যাম্পেল অ্যানালিসিস করুন। আমিও দেখি কতদূর কী করা যায়…”
সবাই একে-একে উঠে গেল।
ঘর এখন ফাঁকা। ডগলাস কম্পিউটারে কেস হিস্ট্রি আর স্ট্যাটিস্টিক্স খুলে বসল। আরেকবার সবকিছু খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
সত্যিই কি কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি? তা তো নয়। পাওয়া তো গেছে। আর সত্যি বলতে, সেই মিলটা আপাতত শুধু ডগলাসেরই চোখে পড়েছে। তবে ও সেটা অন্যদের সামনে ফাঁস করেনি। বরং সমানে এমন ভাব দেখিয়ে গেছে, যেন কাজ আদৌ কিছু না এগোনোয় ও বিরক্ত এবং হতাশ।
এর পিছনে দু-দুটো কারণ আছে—
এক: ডগলাস নিজে এখনও পর্যন্ত সূত্রটার ব্যাপারে নিরানব্বই শতাংশ নিশ্চিত। বাকি এক শতাংশে গিয়েও সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সেটুকুও নিঃসন্দেহ না হয়ে কিছু বলা ঠিক না।
দুই: সমস্যা সমাধানের পুরো কৃতিত্বটা ডগলাস একাই নিতে চায়। সুনাম, অর্থ আর পুরস্কারের ব্যাপারে ভাগাভাগি ওর ঘোর অপছন্দ।
মন দিয়ে সবকিছু যাচাই করে খুশি হল ডগলাস। সম্ভাবনা তত্ত্ব তো বলছে এখনও পর্যন্ত ওর সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। সমস্ত তথ্য আর যুক্তি পরস্পর মিলে যাচ্ছে। তিরও একদিকেই ছুটছে। এবার শুধু লক্ষ্যভেদের অপেক্ষা।
টিঁ-টিঁ আওয়াজ ছড়াচ্ছে কলারের স্পিকার। লাল আলো জ্বলছে— তার মানে গুরুত্বপূর্ণ কোনও খবর আছে। ডগলাস চোখের ইশারা করতেই বাতাসে ভেসে উঠল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সচিবের চেহারা।
একটা যান্ত্রিক স্বরে সচিব বলে গেল, “ভারতবর্ষের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পর এবার আফ্রিকার বিদেশমন্ত্রী, কানাডার রাষ্ট্রদূত এবং ব্রাজিলের চ্যান্সেলর অ্যাকোয়াম্যান সিনড্রোমে আক্রান্ত। পৃথিবী জুড়ে গত চব্বিশ ঘণ্টায় আক্রান্ত সাত। ব্রিটেনে আক্রান্ত দুই। মৃত শূন্য। সুস্থ শূন্য।”
চেহারাটা মিলিয়ে গেল।
কে জানে, ক-দিন পরই ডগলাসের নাম ‘নাইটহুড’ পাওয়ার জন্য সুপারিশ করা হবে কিনা! সঙ্গে পুরস্কার, টাকা, খবরের কাগজের শিরোনাম…
কথাগুলো ভেবে ডগলাসের ঠোঁটের কোণায় একচিলতে হাসি ফুটে উঠল।
তারিখ: ১৫ এপ্রিল, ২৫০০
স্থান: ৬, লিন্ডসে লেহান স্ট্রিট, গ্রেট ব্রিটেন
সময়: রাত ৯ টা ৩০ মিনিট
ডগলাস বলল, “আমি গভর্নমেন্টের ‘সিক্রেট ইনভেস্টিগেটিং কমিটি’র চেয়ারপার্সন ডগলাস। পেশায় প্যাথোলজিস্ট।”
ডগলাস কিছুক্ষণ চুপচাপ একটানা তাকিয়ে ছিল এলিজার দিকে। সত্যি বলতে, এলিজার তাতে একটু অস্বস্তি-ই হচ্ছিল। ওকে কথা বলতে দেখে এলিজা মনে-মনে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল।
নিজের কাজ আর সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে ডগলাসের চেহারা এলিজার অপরিচিত নয়। ও বলল, “চিনতে পেরেছি। বলুন।”
এলিজা এমনিতেই আশ্চর্য হয়েছে। ওর সঙ্গে এত কী দরকার থাকতে পারে যে ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন ইমার্জেন্সি’ নিতে হয়েছে? অবশ্য সরকারি কমিটির লোক যখন, তখন সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট-ই ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন ইমার্জেন্সি’৷
ডগলাস বলল, “আপনার সঙ্গে আমার একটা বিশেষ দরকার আছে ডক্টর এলিজা।”
এই যুগে দরকার ছাড়া বাবা-মা পর্যন্ত ছেলে-মেয়ের ঘরে যায় না। সেখানে ইনি যে এখানে গালগল্প করতে আসেননি, সেটা কি আর এলিজা জানে না!
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে — দরকারটা কী? ডগলাসের যেরকম বদমেজাজের কথা ও শুনেছে, তাতে এর মধ্যে কোনও হতাশাবোধ আছে বলে মনে হয় না।
অবশ্য বদমেজাজও একরকম মানসিক অসুখ। ডগলাস সেটার চিকিৎসা করানোর জন্যও এলিজার কাছে আসতে পারে।
এলিজা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, “দরকারটা একটু তাড়াতাড়ি বললে ভালো হয় ডক্টর ডগলাস। কারণ কাল আমার একটা কলেজে সেমিনারে যাওয়ার আছে৷ এদিকে এখনও লেকচার রেডি হয়নি।”
গলা খাঁকারি দিল ডগলাস, “হ্যাঁ-হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।” তারপর আবার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল এলিজার মুখের দিকে। বোধহয় ওর মানসিক অবস্থাটাও বুঝে নিল; নিজের কথাগুলোও সাজিয়ে নিল।
ডগলাস কেটে-কেটে বলল, “‘অ্যাকোয়াম্যান সিনড্রোম’ নিয়ে পৃথিবী জুড়ে কাজ হচ্ছে— এই তথ্যটা আপনি নিশ্চয়ই জানেন?”
এলিজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “হ্যাঁ। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, ব্যাপারটা নিয়ে কেউই এখনও পর্যন্ত খুব বেশি এগোতে পারেনি।”
ডগলাস ঘাড় নাড়ল, “হুমম্। সেরকমই সবাই জানে। তবে আসল ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। সেটা হল, আমি কিন্তু এই কাজে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছি। কাজ করতে-করতে আমি গোটা কেসটায় একটা অদ্ভুত সমাপতন খুঁজে পেয়েছি।”
এলিজা অবাক হল, “কী সমাপতন বলুন তো?”
ডগলাস এলিজার চোখে চোখ রেখে বলল, “আক্রান্তরা সবাই আপনারই পেশেন্ট ডক্টর এলিজা।”
ঠিক এক মিনিট এলিজা ডগলাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর থতমত ভাবটা খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, “আপনার কথাটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ডক্টর ডগলাস। মানলাম— আপনারা যাদের ধরেছেন, তারা সবাই আমার পেশেন্ট। এর থেকে বাকি সবার ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?”
ডগলাস বেস আত্মতৃপ্তির সুরে বুঝিয়ে বলল, “যাদের আমরা পরীক্ষা করেছি, তাদের প্রত্যেকের শরীরে একটা সূচের চিহ্ন পাওয়া গেছে। সেই সূচের নাম্বার আপনার নামে রেজিস্টার্ড ডক্টর এলিজা। প্রত্যেকের বাড়িতে একটা বিশেষ পিল পাওয়া গেছে।
এতগুলো রোগীকে একই ওষুধ দিয়েছেন, আবার প্রত্যেককেই ইঞ্জেকশন দিতে হয়েছে। এরকম তো নয়, যে আপনি এই একরকম ছাড়া চিকিৎসা জানেন না। এগুলো কি সব নেহাতই কাকতালীয়? এর থেকেই তো দুইয়ে-দুইয়ে চার করে নেওয়া যায়।”
রাগে এলিজার সুন্দর মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। আঙুল তুলে ও কড়া গলায় বলল, “আপনার হিসাব আপনার কাছে রাখুন, আর বেরিয়ে যান এখান থেকে। পোক্ত প্রমাণ নিয়ে তারপর কথা বলতে আসবেন। আমি… আমি আপনার বিরুদ্ধে হিউমিলিয়েশনের চার্জ আনব।”
ডগলাস কোনও কথা বলল না। পকেট থেকে নিউক্লিয়ার গানটা বের করে এলিজার দিকে তাক করল। তারপর খুব শান্ত গলায় বলল, “আর তার আগেই যদি এই জিনিসটা চার্জ করে ওঠে?”
মুহূর্তে এলিজার মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেল।
একটামাত্র বাটন টেপার অপেক্ষা, নিউক্লিয়ার গানের তীব্র তেজস্ক্রিয় রশ্মি ছুটে এসে বিপক্ষের শরীরটা বাতাসে মিলিয়ে দেবে। আর ডগলাস রেগে গেলে কী না করতে পারে! তার উপর ও এখন রাষ্ট্রের সুরক্ষায় নিযুক্ত। এখন কী আর ওর উপর হত্যার কেস টিঁকবে?
এলিজা শক্ত হয়ে বলল, “আপনি ঠিক কী চাইছেন?”
ডগলাস হাসল, “কী আর চাইব ডক্টর এলিজা? আমি শুধু অ্যাকোয়াম্যান সিনড্রোমের রহস্যটা জানতে চাইছি।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলিজা। মাথা নীচু করে কিচ্ছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলতে শুরু করল, “এটা মাসখানেক আগের ঘটনা হবে। সেদিনও আমি পেশেন্ট দেখে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেছি। বেশ রাত হয়েছে তখন। হঠাৎ দেখি একটা মেল ঢুকেছে। কিন্তু সেন্ডারের অ্যাড্রেস দেখাচ্ছে না। আমি খুব আশ্চর্য হয়ে মেলটা খুললাম। ইংরেজিতেই লেখা একটা বড় মেল। কিন্তু যা লেখা ছিল, পড়ে আমি ভীষণ ভয় পেলাম।
তাতে লেখা ছিল, মেলটা এসেছে দুশো আলোকবর্ষ দূরের একটা গ্রহ থেকে। সেখানে জল নেই, গাছ নেই। শুধু সেখানকার বাসিন্দা, যন্ত্র আর মরুভূমি। অত্যন্ত উন্নত সেই গ্রহের সভ্যতা। কিন্তু বছরকয়েক হল সেখানে জনবিস্ফোরণ হয়েছে— মানে জায়গার তুলনায় বাসিন্দার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তাই তারা একটা বিকল্প গ্রহ খুঁজছিল। আর খুঁজতে-খুঁজতে পৃথিবীকে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আর পৃথিবীর বাতাসে এখন প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড আছে। আর বেঁচে থাকতে গেলে তাদের ওটাই প্রয়োজন। কিন্তু একটা সমস্যাও আছে। আর সেটা হচ্ছে, পৃথিবীতে প্রচুর জল রয়েছে। তারা এই জল সরিয়ে তাদের উপযোগী পরিবেশ, অর্থাৎ মরুভূমি সৃষ্টি করতে চায়৷ আর সেই ব্যাপারেই তারা আমার সাহায্য চায়।
আমি ভেবেছিলাম, কেউ হয়তো আমার সঙ্গে মজা করছে। কিন্তু সেটা যে কতটা সাঙ্ঘাতিক একটা বাস্তব সেটা আমি দু-দিন পরে টের পেলাম।”
ডগলাস এলিজার কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না। কারণ এত উন্নত গবেষণা চলার পরেও, ভিনগ্রহী আজও শুধু সাই-ফাই গল্পেই আছে। তবু পুরোটা শোনার দরকার।
ও বলল, “কীভাবে টের পেলেন?”
একবার ঢোঁক গিলে বলল এলিজা, “দু-দিন পরে গভীর রাতে তাদের কয়েকজন সত্যি-সত্যিই আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে হাজির হল।”
এলিজার চোখে একটা অদ্ভুত ভয়। বানানো গল্প বলার সময় কোনও মানুষের চোখে এইরকম ভয় থাকে না। তা ছাড়া ওর ঠোঁট কাঁপছে, গোটা শরীরে একটা অস্থির ভাব।
ডগলাসের চোখদুটো বড়-বড় হয়ে গেল, “সত্যিই? আই মিন রিয়েলি আপনি তাদের— মানে এলিয়েনদের দেখেছেন? কেমন দেখতে?”
“অবিকল একটা কেউটে সাপের মতো।”
ডগলাস উত্তেজনায় ঢোঁক গিলল, “আশ্চর্য! তারপর কী হল? আপনি রাজি হলেন তাদের প্রস্তাবে?”
এলিজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “না হয়ে উপায় ছিল না ডক্টর ডগলাস। আগেই তো বলেছি, ওরা সাঙ্ঘাতিক উন্নত জীব। পৃথিবীর সমস্ত ভাষা জানে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে আমাদের থেকে অন্তত পাঁচশো বছর এগিয়ে। আমি রাজি না হলে তখনই আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিত৷
তারা ইংরেজিতেই বলল, আমার যেহেতু সমাজে একটা সম্মানযোগ্য জায়গা আছে, মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে— তাই তারা আমাকে বেছে নিয়েছে।”
ডগলাসের যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এত বড় একটা কেস সমাধানের সঙ্গে-সঙ্গে এলিয়েনদের হদিশ দেওয়া… আইনস্টাইন বা নিউটনের থেকে খুব নীচু পদ কি ও পাবে?
ও কোনওরকমে বলল, “তারপর?”
“তারপর তারা আমাকে পুরো পদ্ধতিটা বুঝিয়ে দিল। রোগী এলেই আমাকে প্রথমে তার শরীরে একটা জিনিস ইনজেক্ট করে দিতে হবে। সেটা হচ্ছে একটা তীব্র জলাকর্ষী এনজাইম। সেটা ওরাই সরবরাহ করবে। তারপর রোগীকে একটা বিশেষ সিডেটিভ প্রেসক্রাইব করতে হবে।
এমনিতে সেটা খুবই কমন একটা ওষুধ। কিন্তু সেটা ওই এনজাইমের সঙ্গে বিক্রিয়া করলেই এনজাইম সক্রিয় হয়ে উঠবে। তারপর ওই এনজাইম শরীরের সমস্ত জল শোষণ করে নিতে থাকবে, আর নিজেই নিজেকে ক্রমাগত রি-প্রোডিউস করতে থাকবে।
তেষ্টায় পাগল হয়ে মানুষ জল খেয়েই যেতে থাকবে, আর পৃথিবীও আস্তে-আস্তে জলশূন্য হতে থাকবে। জলের অভাবে এখানকার সমস্ত ফ্লোরা আর ফনা শেষ হয়ে যাবে। তারপর পৃথিবী সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে ওরা এখানে বসতি গড়ে তুলবে।
আমাদের কোনও টেস্টেই ওই এনজাইম ধরা পড়বে না। আর কোনও ওষুধও কাজ করবে না।”
ডগলাস সন্দেহ প্রকাশ করল, “কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হলে তো সরকার আক্রান্তদের সরাসরি শুট-আউট করতে থাকবে। তখন?”
এলিজা মুখ নীচু করে বলল, “এটা একটা প্রারম্ভিক পদ্ধতি। এরপর আরও আছে৷ আসলে ওরা আসলে একটু ধন্ধে ছিল, ওদের এই পদ্ধতি মানুষের উপর আদৌ কাজ করবে কিনা! পরীক্ষা তো এখন সফল। তাই ওদের স্পেসশিপও রওনা হয়ে গেছে। তার থেকে ওরা গোটা পৃথিবীতে ওই এনজাইম ছড়িয়ে দেবে। সেগুলো আরও অ্যাক্টিভ। মানুষের চামড়ায় লাগলেই হল! কোনও পিউরিফায়ার সেটাকে বাতাস আলাদা করতে পারবে না। সরকার আর কত মানুষকে…”
কথা অসম্পূর্ণ রেখে এলিজা থেমে গেল।
ডগলাস শিউরে উঠছে ভিতরে-ভিতরে। কী সাঙ্ঘাতিক পরিকল্পনা!
এলিজার চোখ-মুখ করুণ হয়ে উঠেছে। ও কাতর গলায় বলল, “আমি এটা করতে চাইনি। বিশ্বাস করুন ডক্টর ডগলাস… কিন্তু আমাকে করতেই হল।”
নিজের ভয়টা সামলে নিল ডগলাস। এখন শক্ত হওয়া প্রয়োজন। ও ভুরু কুঁচকে বলল, “এর অ্যান্টিবডির ব্যাপারে ওরা কিছু বলেনি?”
দু’পাশে মাথা নাড়ল এলিজা, “না। কিন্তু আপাতত একটা কাজ করা যেতে পারে।”
“কী?”
এলিজা গলার আওয়াজ খাদে নামিয়ে বলল, “ওই যে আমার রোবট-সেক্রেটারিকে দেখছেন— ওর খোলসের মধ্যেই ওদের একজন লুকিয়ে আছে। ও সবসময় আমার উপর নজর রাখে, এখানকার খবরাখবর ওদের গ্রহে পাঠায়, রোগীর শরীরে ইঞ্জেকশন পুশ করে। ওকে যদি মেরে ফেলেন, ওদের এখানে পৌঁছাতে খানিকটা হলেও দেরি হয়ে যাবে। তারপর বাকিটা নাহয়…”
“সেটা নাহয় সবাই মিলে আলোচনা করে দেখা যাবে। কিন্তু ওর মধ্যে যে আছে, সে আবার আমাদের কথা শুনে ফেলেনি তো?”
“না এখন ওদের বিশ্রামের সময়। এই সময়টা ওরা গভীর ঘুমে থাকে।”
ডগলাস বলল, “তাহলে আপনি এতদিন এই সময়টায় কিছু করেননি কেন?”
“কারণ আমার তো নিউক্লিয়ার গান নেই। ওদেরকে আমি বলতে শুনেছি— “মানুষের আর কী ক্ষমতা! শুধু ওদের ওই তেজস্ক্রিয় যন্ত্রগুলোকেই ভয়।” তার মানে ওরা এই বন্দুককে ভয় পায়।”
“আমাদেরকে একটা মেল তো করলে পারতেন।”
“ডাটা ইউজেস ধরে-ধরে ওরা রোজ আমার প্রত্যেকটা মেল চেক করে। ডিলিট করে ফেললেও ঠিক ডিটেক্ট করতে পারে।”
ডগলাস বুঝল, ওরা সত্যিই অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। পৃথিবীতে পা দিতে পারেনি, এখানকার সব প্রযুক্তি এবং তার ফাঁকফোঁকর বুঝতে শুরু করে দিয়েছে। এদের সঙ্গে এঁটে ওঠা সহজ হবে না।
তবে কাজটা আর ওর একার থাকল না। এখনই টিমকে জানাতে হবে, তারপর প্রতিরক্ষামন্ত্রক, স্বরাষ্ট্র দপ্তর, প্রধানমন্ত্রীর সচিব… তবে ও খুশি; কারণ তদন্তের এত বড় মোড়টা তো ওর হাত ধরেই এল। নিশ্চয়ই ‘হল অফ ফেম’-এ ওর নাম লেখা থাকবে।
আপাতত এতসব ভাবার আর সময় নেই। বিশ্রামের সময় পার হয়ে গেলেই মুশকিল।
ডগলাস নিউক্লিয়ার গানটা শক্ত করে ধরে বলল, “সে কোথায়?”
এলিজা ঘরের কোণা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ওই যে।”
সত্যিই তাই। ঘরের কোণায় একটা মেডিকেল-রোবট চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কপালের রেড ক্রস লাল আলো ছড়াচ্ছে না। তার মানে, এখন ও বিশ্রাম নিচ্ছে।
ডগলাস অস্ত্র তাক করল।
তিন… দুই… এক…
একটা শীতল প্রবাহ বয়ে গেল, আর সঙ্গে-সঙ্গে ডগলাসের শরীরটা বেঁকেচুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাত থেকে খসে গেল নিউক্লিয়ার গান।
এলিজা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। উহ্! নিউক্লিয়ার গান দেখেই তো ওর বুক শুকিয়ে গিয়েছিল। খুব বুদ্ধি করে বেঁচেছে। ডগলাস লোকটা মেধাবী হলে কী হবে, আসলে একটা বোকার ডিম। কেমন ওর বানানো কথায় বিশ্বাস করে নিল!
কোথাও একটা অদৃশ্য সংকেত বাজছে।
ওই তো স্পেসশিপ দেখা যাচ্ছে৷ মেঘের মতো দেখতে বলে কেউ বুঝতে পারছে না। অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি বলে কোনও রাডারেও ধরতে পারছে না। এক্ষুনি পরাণুবীক্ষণিক কণায় এনজাইম ছড়ানো শুরু হবে। আর তারপর কেউ ভালো করে কিছু টের পাওয়ার আগেই…
সাপের মতো চেরা জিভ বের করে ঠোঁটদুটো চেটে নিল ও। এটাই ওদের আনন্দের ভাষা।
হ্যাঁ। মেঘের মতো দেখতে হলেও ওগুলো যেমন মেঘ নয়; এলিজার মতো দেখতে হলেও তো ও আসলে এলিজা নয়। আসল ডক্টর এলিজাও তো ওর বিষে নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছিল, যেমন নিস্পন্দ হয়ে গেল ডক্টর ডগলাস। তার শরীর এখন মাটির দশহাত নীচে পার্থিব অণুজীবদের খাদ্য হচ্ছে। ডক্টর ডগলাসের শরীরের পরিণতিও ওই একই।
নিত্যনতুন আবিষ্কারের মতো ছদ্মবেশ নিতেও তো ওরা বরাবরই ওস্তাদ। স্বার্থক বহুরূপী।
ও খুশি হয়ে দেখল রাস্তায় মানুষগুলো হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করেছে। তাদের মুখে একটাই কথা: “জল চাই… জল…”
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, শ্রীজিৎ সরকার, সৌরভ ঘোষ