ধূসর রঙিন
লেখক: সৌজন্য চক্রবর্তী
শিল্পী: রনিন
অনুরাগের ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল একটা দুঃস্বপ্নে। এই রোজকার অফিসের ইঁদুর-দৌড়, যানজট, ধুলো কাদা আর সবচেয়ে বড় কথা তার নিঃসঙ্গ জীবনের বাকি দিনগুলোর এই একঘেয়েমি সিলেবাস। মৃত্যুও তো একটা পরীক্ষাই, মুক্তি পাওয়ার! চাইলেও সবাই পারে না।
এই এক বছরে যেন তার জীবন থেকে সব রং, মুছে গিয়েছে ধীরে ধীরে, কালকের সেই গোধূলির ম্লান আলোটার মতোই।
কাল বিকেলে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার আগে বেশ কিছুক্ষণ ঘাটের পাশের বেঞ্চিটাতে বসেছিল অনুরাগ। দিনের শেষ আলোটা নিভে যাওয়ার পর কাঠের বেঞ্চিটা ছেড়ে উঠেছিল সে। তার জীবনের দীপশিখাও যেন বড় নিভু নিভু।অফিসের কাজে আর মন বসে না বহুকাল। বসের কাছে তাই গালিগালাজ শুনতে হয় হামেশাই। কোনরকমে স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা শুধু। দুঃখ, হতাশা ভুলে থাকতে এই কিছুদিন হল সে একটা এনজিও তে জয়েন করেছে। মাঝে মাঝেই কিছুটা সময় কাটিয়ে আসে ওখানকার ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর সঙ্গে। ওদের মধ্যেই ছোট্ট মেয়ে অণুর মিষ্টি মুখটা খুঁজে পায় সে।
কিন্তু রাত নামলেই একলা ঘরে বুক চাপা কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় তার।
আর ঠিক তখনই একটুকরো স্বপ্ন হয়ে নেমে আসে তার চোখে ছোট ছোট কিছু ভালোবাসার রঙিন মুহূর্ত, যেগুলো মনে করেই বাকি জীবন টা কাটিয়ে দেবে অনুরাগ। সে জানে এগুলো স্বপ্ন, বাস্তবে কোনওদিনই ফিরে পাবেনা উশ্রী আর তাদের সাত বছরের মিষ্টি মেয়ে অণুশ্রীকে। বছরখানেক আগের সেই অ্যাকসিডেন্টে অনুরাগ বেঁচে গেলেও, স্ত্রী আর মেয়েটা…
আর ভাবতে পারছে না অনুরাগ। ঢক ঢক করে এক-গ্লাস জল খেয়ে বিছানার ওপর বসে রইল কিছুক্ষণ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে তার। তারপর আরেকবার স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করল অনুরাগ।
এই স্বপ্নটা সে বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছে। রাত গভীর হলেই তার নিদ্রাতুর চোখে নেমে আসে এই স্বপ্নটা। মনের গভীরে বসে যেন এক অদৃশ্য চিত্রকর কোনও এক জাদুবলে এঁকে চলেছে অজানা কোনও জগতের কিছু বিচ্ছিন্ন ছবি, আর তার ক্যানভাসেই ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে অনুরাগ…
…একটা গ্রহ। ঠিক পৃথিবীর মতোই, কিন্তু ধূসর তার রং। সৃষ্টিকর্তার কোনও এক অদ্ভুত খেয়ালে এই জগৎটা তৈরির সময় তিনি যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছেন বাকি রংগুলো করতে…
তারপর একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে ভেতরের চিত্র।
একটা শহর…হ্যাঁ, একটা শহরই তো, বেশ চেনা শহর। আর এদিক ওদিক কিছু মানুষের ভিড়। প্রত্যেকেই খুব চেনা… খুব… কিন্তু কোথাও যেন একটা গণ্ডগোল আছে… অথচ গণ্ডগোলটা যে ঠিক কোথায় সেটা বুঝতে পারে না অনুরাগ… হাঁটতে হাঁটতে সে এগিয়ে চলেছে রাস্তাটা ধরে… দূরে একটা দোতলা বাড়ি… বাড়ির সামনে একটা বাগান… দুটোই খুব চেনা লাগছে তার… একটু এগোতেই চোখে পড়ছে অণু কে… ওই তো বাড়ির সামনের উঠোনে খেলা করছে একটা হলুদ বল নিয়ে… হ্যাঁ, এটাই তো কিনে দিয়েছিল সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে। অণু খুব বায়না করছিল। তারপর থেকেই ওই বলটা ওর সর্বক্ষণের খেলার সাথী… বাড়ির কাছে যেতেই অণু এক দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল… একটা চেনা স্বর ভেসে এল বাড়ির ভেতর থেকে, একটা চেনা হালকা ধমকের সুর, “অণু, বাপিকে নিয়ে খেলা নয় এখন। বাপি অফিস থেকে এসেছে, আগে ফ্রেশ হয়ে নিক, তারপর…” উশ্রীর গলা… অণুর গালে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে বাড়িতে ঢুকে এল অনুরাগ… স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তার অফিসের প্রমোশনের সংবাদটা দিল… উশ্রী বেজায় খুশি হল… তার চোখে মুখে উপচে পড়া খুশির ঢেউ অনুরাগের চোখ এড়াল না… খানিকপর হাতটা ছাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল উশ্রী… অনুরাগ শুনতে পেল, “জামা প্যান্টটা ছেড়ে বাথরুমে যাও। আমি ডিনার রেডি করছি।”… তারপর আবার টুকরোটুকরো কিছু ছবি… ফিরে আসতে গিয়ে মনে হল পেছন থেকে কেউ যেন ডাকছে… বাপি…
সে ডাক যেন সহস্র কোটি বছর আগে কেউ ডেকেছিল, যেন কোনও দূরের এক তারা থেকে। লক্ষ যোজন পথ পেরিয়ে আসতে আসতে অনন্ত শূন্যের মাঝে মহাজাগতিক কিছুর ধাক্কায় বারবার প্রতিফলিত হয়ে আসছে শব্দটা তার কানে।
শুধু এইটুকু সময়ই তো তার নিজেকে একলা লাগে না। তার মনে হয়, কয়েক শত আলোকবর্ষ দূরে কোথাও যেন এই ধূসর জগৎ টাতে তার সব সুখ লুকিয়ে রেখেছে কেউ। পুরো ধূসর শহরটাতে ওইটুকুই যেন রঙিন। জীবনের সবটুকু ভালোবাসা, সব আনন্দ যেন ওইটুকু স্বপ্নের মাঝেই খুঁজে পায় সে।
স্বপ্নের জগৎটাই যেন তার কাছে প্রাণ। সেটুকু ছাড়া সব তার অর্থহীন লাগে। বাস্তবের দুনিয়াটা বড্ড প্রাণহীন ও একলা লাগে আজকাল অনুরাগের।
বিয়ের পর ক-টা বছর বেশ হাসিখুশিতে কাটিয়েছিল অনুরাগ। অণু জন্মানোর পর আনন্দের সীমা আরও বেড়ে যায় শতগুণ। কলেজ লাইফের সেই বৃষ্টির দিনে অনুরাগ যে উশ্রীর হাতটা ধরেছিল, আজও অটুট সেই বন্ধন। অণুর আগমন সেই বন্ধন কে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। কিন্তু সব ভালোরই শেষ থাকে একটা। চিরদিন একইরকম থাকে না কিছুই এ পৃথিবীতে। বড্ড নিষ্ঠুর এই পৃথিবী। কালের নিয়মে একদিন হারিয়ে যেতে হয় সব কিছুকেই।
অনুরাগের মনে পড়ে যাচ্ছে সব কথা, পিসিমা তাকে আবার নতুন করে বিয়ে করতে বলেছিল কতবার! কিন্তু অনুরাগ করেনি। সে চেয়েছিল ওদের হারিয়ে যাওয়া ওই স্মৃতিগুলোকে আগলে রেখে জীবনের আর কটা দিন পার করে দিতে।ডিপ্রেশন এ ভুগে কতবার অনুরাগ পালিয়ে যেতে চেয়েছে ঘর ছেড়ে। কিন্তু যাবেই বা কোথায়! এই পৃথিবী ছেড়ে যদি চলে যেতে পারতো সেই স্বপ্নের ধূসর জগৎ টাতে তাহলে মুক্তি পায় সে! কতবার চেয়েছে নিজেকে শেষ করে দিতে… পারেনি শুধু বৃদ্ধা মা, পিসিমার খেয়াল রাখার কেউ নেই বলে। কিন্তু এখন তো আর কোনও বাধা নেই, তারাও এ জগতের মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছে বহুদিন। এখন তার জীবনের শেষ কটা দিন গুনতে গুনতে কাটিয়ে দেওয়া শুধু। তবে এখন আর আগের মতো একলা লাগে না সবসময়।
যেদিন থেকে স্বপ্নটা দেখতে পাচ্ছে অনুরাগ, সেদিন থেকেই একটা অদ্ভুত নেশা পেয়ে বসেছে তাকে। সে চায় এই স্বপ্নের যেন শেষ না হয় কোনদিন। আরও… আরও… আরও কিছুটা সময় থাকুক না স্বপ্নটা! এটুকুই তার জীবন বলে মনে হয়। বাকিটা যেন মৃত্যুরই সামিল। উশ্রী, অণু… রোজ ওদের দেখতে পায় অনুরাগ। কত কথা বলে তার সঙ্গে। এইতো বেশ আছে ওরা। এসব কিন্তু স্বপ্ন বলে মনে হয় না অনুরাগের। এই পৃথিবী তার জীবন থেকে সব রং মুছে দিলেও, ওই যে ধূসর জগৎটা, রোজ রাতে যে এসে ধরা দেয় অনুরাগের চোখে,স্বপ্ন দিয়ে হলেও সে আবার রাঙিয়ে দিয়ে যায় তাকে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও।
একবার যদি যেতে পারতো, যদি হারিয়ে যেতে পারতো চিরদিনের মতো ওই জগৎটাতে!
…আজও স্বপ্নটা দেখছিল কিন্তু হঠাৎ দৃশ্যপট বদলে সেই দিনটার ছবি ভেসে ওঠে। অণুর স্কুলের ফাংশন থেকে ফিরছিল তিনজনে, গাড়ি করে। হাইওয়েটার ওপর দিয়ে যেতে যেতেই একটা মোড়ের মাথায় সজোরে কলিশন হল একটা মালবোঝাই লরির সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গেই স্পট ডেথ দুজনেরই…
কুলকুল করে ঘামছে অনুরাগ। ফ্যানটা যেন শুধুই ঘুরছে, বাতাস লাগছে না যেন একটুও গায়ে। ঘরটা একটা গুমোট ভ্যাঁপসা গরমে ভরে উঠেছে। অনুরাগ উঠে ফ্যানের স্পীড টা ফুল বাড়িয়ে আবার শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলো।
(২)
পরদিন অফিস থেকে ফিরে ডিনার করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্ত শরীরে ঘুম নেমে এল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল মনে নেই। খানিক পরেই সেই স্বপ্নটা আবার ফিরে এল অনুরাগের অবচেতনে…
সেই অদ্ভুত ধূসর পৃথিবীর আকাশ, মাটি সবই যেন কোনও অদৃশ্য মায়াবলে কেউ ধূসর করে রেখেছে। সবটুকু রং যেন ফুরিয়ে গিয়েছে, বা ফেলে এসেছে কোথাও! তবে সে জগতের ডাক কে যেন উপেক্ষা করা যায় না। তার হাতছানি যেন অপ্রতিরোধ্য আর সেখানে যাবার বাসনা দুর্দমনীয়।
কিসের অমোঘ আকর্ষণে আজও অনুরাগ এগিয়ে চলেছে সেই চেনা রাস্তাটা দিয়ে। ধূসর বালির ঢিপির পাশ দিয়ে কিছু আঁকাবাঁকা গলিপথ চলে গেছে শহরের ভেতরের দিকে। একবার সেদিকে তাকিয়েই আবার হাঁটতে থাকে অনুরাগ।
গণ্ডগোলটা এবার বুঝতে পারে সে। চারিদিকে যেসব মানুষ রয়েছে, তাদের বেশ চেনে অনুরাগ। বহুদিনের পরিচিত সব্বাই। গোলমালটা সেখানেই,তাদের কেউই বেঁচে নেই আর পৃথিবীতে। এ যেন এক ধূসর মৃত্যুপুরী। অথচ সকলেরই প্রাণ আছে এখানে। সবাই কথা বলছে, কাজ করছে। যেন সেই আদি অনন্ত কাল ধরে তারা বেঁচে আছে এখানে। মৃত্যু তাদের কাওকে স্পর্শ করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। যেন পৃথিবীতে কাটানো সময়টুকু তাদের নিছক কিছুসময়ের অভিনয় মাত্র। কিংবা কোনও গোপন অভিসন্ধি আছে এর পেছনেও।
আর একটু পরেই এসে পড়বে তার বাড়ি। ওই তো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অনুরাগের একবারও মনে হচ্ছে না এ জগৎ ছেড়ে তার পৃথিবীতেই ফিরতে চায় সে। নাহ, সে চায়না আর ফিরে যেতে…
কিন্তু হায়, এ যে স্বপ্ন, এখানে কিছুটা মুহূর্ত কাটানো যায় শুধু, সারাটা কাল থাকা যায় না। কিন্তু স্বপ্ন কীভাবে এত নিখুঁত হতে পারে! পরিষ্কার বুঝতে পারছে স্বপ্ন দেখছে না সে। সব যেন আশ্চর্য রকমের সত্যি মনে হয় অনুরাগের। উশ্রীর গলার আওয়াজ আর অণুর খিলখিল করে হাসির শব্দ টা পর্যন্ত এত স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে অনুরাগ! তাহলে কি সত্যিই সে এসে পৌঁছেছে এমন এক জগতে যেখানে মৃত্যুর পর সবাইকেই যেতে হয়। নাকি ঘুমের মাঝে এই স্বপ্ন দেখার সময়টুকু, কেউ ঠিক পৃথিবী নামের গ্রহ টা তে থাকেইনা। অনন্ত মহাবিশ্বের কোনও এক অজ্ঞাত নক্ষত্রের কক্ষপথে ঘুরতে থাকে কোনও এক নতুন অবচেতনের জগতে। কিংবা হয়তো সত্যি সত্যিই পৃথিবীর ঠিক সমান্তরালে থাকা কোনও এক অচিন গ্রহে চলে যায় তারই একটা সত্ত্বা।
কলিং বেলের শব্দে ঘুমটা ভাঙল অনুরাগের।
রান্নার মাসি এসে পড়েছে সকালে। অফিসের জন্যে তাকে রেডি হতে হবে এবার।
সে বেশ বুঝতে পারছে স্বপ্ন হলেও সে অনুভূতি বাস্তব অনুভূতির চাইতে কোনও অংশে কম নয়। সত্যি বলতে, অনুরাগের আর একদমই ভালো লাগে না এই পৃথিবীতে, একটু একটু করে সে যেন নেশাগ্রস্তের মতো ধূসর জগৎটার মোহজালে আবিষ্ট হয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে তাকে সেই কল্পনার জগতের স্রষ্টা কোনও অদৃশ্য প্রাণীর মায়াজাল যার আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। হয়তো প্রতিনিয়ত কোনও এক নতুন স্বপ্নের জাল দিয়ে সে বুনে চলেছে গোপন কোনও ষড়যন্ত্র।
আজ বস কে বলে অনুরাগ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি চলে এসেছে, অফিস থেকে। শরীরটা ভালো লাগছে না তার। মাথাটা একটু যেন ধরেছে। কিছু এলোমেলো চিন্তা আজ তাকে আচ্ছন্ন করে রয়েছে।
সোফাতে বসতেই কখন চোখ দুটো লেগে গিয়েছিল তার মনে নেই, চমক ভাঙল একটা কিছুর পড়ে যাওয়ার আওয়াজে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল অনুরাগ। একটা কালো বেড়াল… টেবিলটার ওপর বসে, জ্বলজ্বলে হলুদ চোখদুটো তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অফিসের ফাইলগুলো টেবিল থেকে উলটিয়েছে হতভাগাটা। বেড়ালটাকে বাড়ির আসে পাশে দেখেছে বেশ কয়েকবার অনুরাগ। কিন্তু এত রাতে কোনদিক দিয়ে ঢুকে পড়লো কে জানে! হয়তো খাবারের মতলবেই এসেছে ব্যাটা!
দেওয়ালে ঘড়ির দিকে তাকাল অনুরাগ। এগারোটা বেজে পাঁচ। সেই সন্ধে থেকে এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল সে! ঘুমের মাঝে স্বপ্নগুলো আবার তাকে হাতছানি দিচ্ছিল।
কিন্তু যতবারই স্বপ্নটা সে দেখে, কোনও না কোনও ভাবে কেউ যেন ইচ্ছে করে ভাঙিয়ে দেয় তার ঘুমটা।
কখনও কোনও শব্দ শুনিয়ে, কখনও বা সে স্বপ্নের মাঝে খারাপ কিছু দুঃস্বপ্ন চাপিয়ে, যেভাবেই হোক এই পৃথিবী তাকে যেন টেনে নিয়ে আসতে চায় শত আলোকবর্ষ দূরের সেই আশ্চর্য গ্রহটার থেকে। আজ মাঝরাতে এই বেড়ালটার আকস্মিক উপস্থিতিও অনুরাগের মন হল যেন কারোর চক্রান্ত। কেউ কি চায় না তাহলে, সে পৃথিবী ছেড়ে স্বপ্নের কোনও অচেনা জগতে চলে যাক! নাকি পৃথিবীই চায় না!
কিন্তু অনুরাগ সত্যিই হাঁপিয়ে উঠেছে জংধরা এই পৃথিবীতে। মন খুলে কথা বলার যে কেউ নেই তার এখানে। বেঁচে থাকার সমস্ত যুক্তিই আজ তার বড় অর্থহীন লাগে।
তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে নিল অনুরাগ। তারপর অফিসের খাতা খুলে একটু কাজে মন বসাবার চেষ্টা করল।কাল একটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে। অফিসের কয়েকটা ডাটা চেক করতে করতে একসময় আবার সেই ধূসর জগৎটা ভেসে উঠল তার চোখে শেষবারের মতো।
এবার একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করল অনুরাগ।
একটা বিশাল দানবের মতো কোনও প্রাণী তার একটার পর একটা লম্বা শুঁড়ের মতো কিছু অতিপ্রাকৃত উপাঙ্গ দিয়ে অক্টোপাসের মতোই যেন সেই ধূসর মায়াবী জগৎ টাকে ধীরে ধীরে জড়িয়ে ফেলছে। তারপর কোনও এক অদৃশ্য মায়াবলে শুষে নিচ্ছে তার সবটুকু রং।
….এক টুকরো ভাসা ভাসা আবার কিছু ছবি… সেই চেনা রাস্তা… সেই বাড়ি… উশ্রী, অণু… বাগানের গাছগুলো, হলুদ বলটা… আজ সব কেমন অন্য রকম লাগছে। নাহ, সব কিছু কেমন যেন পালটে গেছে আগের থেকে!
হ্যাঁ, এবার বুঝতে পেরেছে অনুরাগ।
যেটুকু রঙিন ছিল এই জগতে সেটুকুও ধূসর হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একি! তার শরীর, হাত, পা— সব কোনও এক জাদুতে ধূসর হয়ে যাচ্ছে! তবে কি সেও এই জগতের ই একজন হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে!
কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? এ কি তাহলে স্বপ্ন নয়! নাহ, কোনও ভুল নেই। সে সম্পূর্ণ চেতনার মধ্যে রয়েছে।
ভুলটা এবার বুঝতে পারে অনুরাগ। সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে এবার তার কাছে। এতদিন যে পৃথিবীতে সে একাকীত্বের সঙ্গে প্রতিটা প্রহর গুনে এসেছে। হতাশা, বেদনা গ্রাস করেছিল যে পৃথিবীতে। সেই পৃথিবী আজ তার থেকে কত শত আলোকবর্ষ দূরে… কিংবা হয়তো খুব কাছেই, শুধু কোনও এক অদৃশ্য সূক্ষ্ম চাদর সরালেই তার দেখা পাওয়া যাবে। দুঃখ, হতাশা, সব হারানোর বেদনার অনুভূতিগুলো থেকেই যেন জন্মে উঠেছে আরেকটা ধূসর পৃথিবী মনের কোনের কোনও এক অবচেতনের স্তরে। যেখানে হয়তো সব রং ফুরিয়ে গিয়েছে,কিন্তু আরও একবার বেঁচে থাকার, আরও একবার প্রিয়জনদের কাছে পাওয়ার আনন্দ থেকেই শুরু হয়েছে আরেকটা পৃথিবী যেখানে মৃত্যুও এসে থমকে গিয়েছে। বে-রং দুনিয়ার প্রতিটা মুহূর্ত আবার রঙিন লাগে এখানে, হোক না সে যতই রংহীন… ধূসর।
এই মৃতের জগৎটা এই মুহূর্তে হয়তো লুকিয়ে আছে পৃথিবীর কোনও এক প্রান্তে তারই মতো কোনও এক অভাগা অনুরাগের স্বপ্নের অতল গভীরে। তাকেও হয়তো এই জগৎটা কোনও রঙিন মুহূর্তের লোভ দেখিয়ে চলেছে অবিরত। তার সমস্ত সত্ত্বা, সমস্ত শরীর,মন জুড়ে সেই ধূসর জগতের প্রাণীটা তার মায়াজাল ছড়িয়ে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে ক্রমাগত।
একটা সময় তার মনের মধ্যে জমে থাকা পৃথিবীর দেওয়া সমস্ত রং ধীরে ধীরে শুষে নেবে। তারপর টেনে নিয়ে যাবে তার ধূসর জগৎটা তে।
এমনি করে, একদিন তার মতোই আসতে আসতে নীল গ্রহটার সমস্ত মানুষগুলোকে সেখানে বন্দি করবে।
হয়তো পৃথিবী বহুবার বাধা দেবার চেষ্টা করবে তাকে, কিন্তু একটা সময় হার মানতেই হবে এই অদৃষ্টের কাছে।
মানুষের মৃত্যু তাহলে কি আর কিছুই না! কেবল এই বেরং ধূসর জগৎটারই আহ্বান। প্রতিটা জগৎই কি তাহলে সবাইকে তার দাস করে নিতে চায়? শুধু তফাৎ কেবল সত্ত্বায়!
কোনও জগৎ জীবনের সব রং মাখিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চায়। আবার কোনও জগৎ সেই জীবনের সব মায়া, সব রং শুষে নিয়ে তাদের নিজের বাসিন্দা করতে চায়।
এভাবে হয়তো আমাদের পৃথিবীও প্রতিনিয়ত কোনও এক অচেনা জগতের জীব দের রঙিন জীবনের লোভ দেখিয়ে টেনে নিয়ে আসে। হয়তো তুমি, আমিই সেই অন্য কোনও এক গ্রহের বাসিন্দা যারা পৃথিবীর সেই ডাক কে উপেক্ষা করতে না পেরে নিজেদের অজান্তেই চলে এসেছি এই গ্রহে।
এরকম অসংখ্য জগৎ রয়েছে আমাদের আশপাশেই। আমরা খালি চোখে হয়তো দেখতে পাই না, কিন্তু তোমার বাড়ির পোষা বেড়ালটা হয়তো পায়। সেইজন্যই তোমার পেছনের দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কখনও।
যে জগতেরই বাসিন্দা হও তুমি, স্বপ্ন কিন্তু আমরা সবাই দেখি। আর সব স্বপ্ন, কিছু অচেনা জগতের হাতছানি ছাড়া আর কিছুই না। ধূসর জগৎটার মতোই আরও অগুনতি দুনিয়া রয়েছে যারা প্রতিনিয়ত চায় অন্য গ্রহ থেকে সেই গ্রহের বাসিন্দা দের নিজের গ্রহে তুলে নিয়ে যেতে। বাস্তব জগতের আকর্ষণে তা সবসময় সম্ভব হয় না বটে। কিন্তু যারা চলে যেতে চায়… তাদের সবসময় নিরাশ করে না তারা। কখনও যদি চিন্তার সূক্ষ্ম পর্দা দুর্বল হয়ে পড়ে, চেতনার স্তর পাতলা হয়ে যায়, তবে তারা…তারা ঠিক টেনে নেবে তাদের শিকারকে। তখন চাইলেই সেই জগতে চলে যাওয়া যায় অবচেতনের সেই সূক্ষ্মস্তর ভেদ করে যেমন করে আজ অনুরাগ পৌঁছে গিয়েছে মৃত্যুর পরের সেই ধূসর জগৎটাতে।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, রনিন, সৌজন্য চক্রবর্তী
ধূসর রঙিন গল্পটি কল্পবিশ্ব পত্রিকাই এক যথার্থ সাহিত্য সৃষ্টি । প্রত্যেকের কাছে কল্পনার বিশ্বটা তার কাছে বড়ো আনন্দের ,যেমন ছিল অনুরাগের । আমরাও ক্ষনেক সুখ পেতে ছুটে যাই নিজের কল্পনার জগতে ,যেমন ছুটে যেনো অনুরাগ ।বাস্তবতা ও লেখনী মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ।গল্পটি অসাধারণ এবং অনবদ্য ।লেখক মহাশয়কে অনেক ধন্যবাদ। ওনার সাহিত্য সত্তা আরও সমৃদ্ধ হোক।
আমি আগেও লিখেছি যে এই গল্পটা আমি ঠিক গল্প লিখবো বলে বসে লিখিনি। আমার অবচেতনের কিছু অদ্ভুত অনুভুতির প্রকাশ মাত্র। তাই খুব অ্যাবসার্ড লাগে আমার নিজেরই। তবে অবশ্যই এটা একটা ফিকশন হিসেবে পড়া যায়। আমাদের মনের গভীরে এরকম ব্যাপার চলে আমাদের অজান্তেই। যাইহোক, এর চেয়েও আরো যুক্তিনির্ভর লেখা আমি পরে উপহার দেবার চেষ্টা করবো। তবুও এই লেখাটি ভালো লেগেছে শুনে খুব খুশি হলাম। অনেক ধন্যবাদ। কল্পবিশ্ব কেও কৃতজ্ঞতা।
ধূসর রঙিন গল্পটি সত্যি খুবই সুন্দর, ভালো লাগলো পড়ে।
গল্পটির মধ্যে বেশ একটা রোমাঞ্চ আছে। খুব ভালো লাগলো পড়ে। এরকম আরো সুন্দর সুন্দর গল্পের অপেক্ষায় থাকবো!
অন্যরকম… খুব ভালো লেগেছে..
গল্পটিতে বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার যে অদ্ভুত এক সংমিশ্রণ, তা সত্যিই মুগ্ধ করে। এই গল্পে যেমন মূর্ত হয়ে উঠেছে স্বজন হারানোর বেদনা, একাকিত্বের কষ্ট, তেমনই কাছের মানুষের প্রতি অপ্রতিরোধ্য টান ও ভালোবাসার বার্তাটি সমভাবে বিরাজমান। তরুণ লেখক সৌজন্য-র জন্য আমার তরফ থেকে অনেক শুভকামনা রইল, ওনার লেখনীগুণ আরো সমৃদ্ধ হোক এই আশা রাখি।