ঢেউ
লেখক: সোহম গুহ
শিল্পী: সৌরভ ঘোষ
আমরা প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখি আকাশ ছোঁয়ার।
ইকারাসের মতো আমার সেই স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। আকাশে এখন আমি— মহাকাশে। পৃথিবী ঘুমন্ত শিশুর মতো শুয়ে আছে আমার নয় হাজার কিলোমিটার নিচে। সূর্যের প্রথম স্বর্ণাভা আমায় স্পর্শ করল। ভিজিয়ে দিল আমার মুখ, মিঠে ওম ছড়িয়ে দিল আমার ত্বকে, ভাইসরের কাচ পেরিয়ে। সেই প্রতিফলিত কিরণে যেন ঘুম ভাঙল আমার পায়ের নিচের বরফের বাগানের। সে যেন আকাশে ঝুলে থাকা এক না কাটা হীরকখণ্ড, যেন প্রাগৈতিহাসিক কালের এক দৈত্যের কেল্লা। বহু নিচের পৃথিবীতে এখনও সূর্যের আলো পৌঁছায়নি, সে গুনছে রাতের শেষ প্রহর। কোনও শহর জেগে নেই তার আলো নিয়ে। থাকা সম্ভব না। পূর্ব দিগন্তে সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে এক পৃথিবীজোড়া সাগরের জল।
রাতের অন্ধকারে দপদপ করে জ্বলছে জোনাকির মতো আলো। আমি গুনলাম সেই আলোক বিন্দুদের; সভ্যতার আটটি জ্যোতি। ওপর থেকে চিনতে পারছি না, কিন্তু জানি এরই মধ্যে একটা আমার শহর, কলকাতা। নিজের অতিকায় দেহকে কলকাতা টেনে নিয়ে চলেছে এই পৃথিবীব্যাপি মহাসাগরের জল কেটে। তার স্টিল আর টাইটেনিয়াম গর্ভে ধ্বনি তুলছে চারটি হাইড্রলিক ইঞ্জিন। বিশাল প্রপেলার ব্লেডেরা মন্থন করছে সমুদ্রের জল, সমুদ্রস্রোত থেকে তৈরি করছে বিদ্যুৎ। এত উপরে থেকেও আমি যেন শুনতে পেলাম সেই গান, তার সূরের উত্থান পতন, যেন ধুকপুক করছে এই ভাসমান ধাতব কূর্ম অবতারের হৃদয়।
আমার হেলমেটের ট্রান্সমিটার জেগে উঠল তখনই, শুনতে পেলাম সেই কণ্ঠস্বর যাকে আমি আলাদা করে নিতে পারি ভিড়ের কোলাহল থেকে।
“মাসিহা ২, মিশন কন্ট্রোল বলছি। অবতরণ সফল?” তুমি জিজ্ঞেস করলে। যদি আমার আজ থাকত সহস্র বাজপাখির সম্মিলিত দৃষ্টিশক্তি, আমি হয়তো এখন দেখতে পেতাম তোমায়।
এক মুহূর্তের জন্য আমি ভুলে গেলাম আমার চারপাশে অভিকর্ষের অনুপস্থিতি, আমার মাথার যন্ত্রণা আর মাথাঘোরা, আমার জিভে তেতো শঙ্কার স্বাদ, আর দেখলাম গর্জনশীল চল্লিশার কাছে সভা করা মেঘেদের বেগুনী বিদ্যুৎপ্রভা। “মিশন কন্ট্রোল, মাসিহা ২ বলছি। অবতরণ সফল। আমি এক্সফ-২র উপরে দাঁড়িয়ে। আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সব ক-টা জায়গায় বিস্ফোরক লাগাতে পারব।”
তোমার গলায়ও কি জমেছে আমার মতনই শঙ্কা? তুমি কথা বাড়ালে না, কেবল বললে, “গডস্পিড।”
যদিও আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে একটা গোটা আবহমণ্ডল, আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি আমার মনের আয়নায়। তুমি সেই প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে একমুখ অস্বস্তি নিয়ে। সামনের মনিটর তোমায় দেখাচ্ছে আমার ভাইটাল, দেখাচ্ছে আমার ট্যাঙ্কের অক্সিজেনের পরিমাণ, আমার ও আমার মহাকাশ শাটলের মধ্যের দূরত্ব, আর হয়তো এই সব গ্রাফ আর তথ্যের ভিড়ে মিনিমাইজ করা আছে আমার একটা ফোটো। হয়তো তুমি শ্বাস গুনছ নিজের, গুনছ আমার, গুনছ প্রত্যেক সেকেন্ডকে, ঠিক করছ নিজের উস্কখুস্ক চুল, কারণ এই অপেক্ষা দীর্ঘতর হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে।
আমার মনে আছে তুমি কীরকম ক্ষেপে গেছিলে যখন আমার এই কাজের ডাক আসে সরকারি ইমেল হয়ে। তুমি নিষ্ফল রাগে দেওয়ালে ছুড়ে মারায় ভেঙে গিয়েছিল একটা কাচের গ্লাস। সেই গ্লাস তুমি কিনে এনেছিলে আমাদের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না, কারণ আমরা দুজনেই জানি আমরা এক দাবার বোর্ডের বোড়ের ঘুঁটি, সভ্যতার ট্রাকের দুই চাকা।
সভ্যতা বলতে মনে পড়ল, কলকাতাকে উপর থেকে একটা জোনাকির মতো দেখতে লাগে। জানো? আমাদের শহরকে দেখে এক উপলব্ধি হয়েছে আমার। আমরা কত ক্ষুদ্র, কত যৎকিঞ্চিত জগৎসংসারের সামনে। তাই না? ইতিহাসের ক্যানভাসে একটা তুলির দাগ পর্যন্ত না।
ইতিহাস বলি বা স্মৃতি, ওই একটা জিনিসই আনতে পেরেছিলাম সঙ্গে করে, পালানোর সময়।
#
তোমার মনে আছে সেই দিনটার কথা, যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল আমাদের?
সেইদিন কীসের যেন একটা ইন্টারডিপার্টমেন্টাল কন্ডাক্টেড ট্যুরের ব্যবস্থা হয়েছিল, ওই কৃত্রিম জলাভূমিগুলো দেখানোর জন্য। কলকাতার চার কিলোমিটার ব্যাসের ধাতব রিংকে বেষ্টন করে এই জলাভূমিতেই তো সোনা ফলাচ্ছে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা, জেনেটিকালি এনহ্যান্সড সবজির চাষ করে।
ভাগ্যিস সেইদিন আমাদের গাইড ছিল এক্কেবারে আনাড়ি। আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম কী করে সমুদ্রের জল ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ট্রিট করা হয়, কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন বর্জ্য ব্যবহৃত হয় সার হিসেবে, অথবা কেন ওই বেগুনগুলো আমাদের মাথার সমান বড়, সে বেচারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাথা চুলকাতে শুরু করল।
তুমি তখন আমার পাশ থেকে ফুট কাটলে, “ওকে এভাবে বেইজ্জত না করলেই পারতে!”
আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে তুমি ছুড়ে দিয়েছিলে নিজের পরিচয়। “অরুণ রায়। যদি প্রশ্নের উত্তর চাও, আমার কিছু কিছু জানা। তোমায় একটা বিয়ারও খাওয়াতে পারি কথা বলতে বলতে।”
আমি জানতাম উত্তরগুলো। কেবল গাইডের লেগপুলিংয়ের জন্যই প্রশ্নগুলো করেছিলাম আমি।
আমায় তুমি সেই বারে নিয়ে যাওয়ার আগে তোমার শরীরী ভাষা, তোমার চোখের কথা, তোমার ঠোঁটের ডগায় জমা হওয়া শব্দ একটা জিনিসই বলেছিল আমায়। তুমি আমার মতো। কিন্তু প্রশ্ন করতে সাহস পাইনি আমি।
যে বারে নিয়ে গেছিলে আমায়, সেখানে স্বচ্ছ কাচের বাইরে খেলা করছিল একটা শঙ্কর মাছের ঝাঁক। মেনুতে লেখা দাম ছিল আমার সাধ আর সাধ্যের বাইরে। তুমি সেখানে পরিচিত মুখ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি দেখছিলাম সেই মাছের ঝাঁককে, তখন তুমি হাত রাখলে আমায় পায়ে, জিজ্ঞেস করলে আমার নাম। সন্ত্রস্ত হয়ে আমি সরিয়ে দিয়েছিলাম তোমার হাত। খুঁজছিলাম দেওয়ালে ঝোলানো অতিপরিচিত সিকিউরিটি ক্যামেরাগুলোকে। যদি কেউ দেখে ফেলে? যদি কেউ রিপোর্ট করে। তাহলে?
শহরের সংবিধান তৈরির পর সরকার আর সমলিঙ্গের সম্পর্কদের স্বীকার করে না। কলকাতার জনসংখ্যা আর জন্মনিয়ন্ত্রণে এ এক একুশে আইন। যারা মানেনি, তাদের দেহ আজ হাঙরের খাদ্য।
কিন্তু তুমি সেইসবের তোয়াক্কা করোনি, না সেই মুহূর্তে, না কোনওকালে। কেন করবে? এক পালটে যাওয়া দুনিয়ায় তুমি খুঁজেছ নিজের মতো কাউকে। আমিও খুঁজতে চেয়েছিলাম। পারিনি, সাহস হয়নি। আমরা সেই দুই ক্ষ্যাপা যারা খুঁজে ফিরেছে সম্পর্কের অস্বীকৃত পরশপাথর।
আমার মনে আছে সেইরাতে, হালকা মদ্যপ অবস্থায় আমি টেনে এনেছিলাম তোমায় আমার ফ্ল্যাটে। রক্তে মিশে যাওয়া অ্যালকোহল সরিয়ে দিয়েছিল আমার সব বিধিনিষেধের ঠুনকো পর্দা। আমায় ভালোবেসেছিলে তুমি সেই রাতে, অবাক হয়ে দেখেছিলে আমার লিঙ্গাগ্রচর্মছেদিত পৌরুষ। খিতান যে আমাদের ধর্মেই কেবল আছে, তোমাদের না। সেই রাত ছিল আমার প্রথম রাত, তোমার সঙ্গে, কোনও পুরুষের সঙ্গে, কারুর সঙ্গে।
তোমার বানানো কফির গন্ধে পরের দিন ঘুম ভেঙেছিল আমার। বিছানার চাদর জুড়ে ছিল আমাদের সোহাগের ওম। টেলিভিশনে তখন চলছিল সরকারের ‘ভোরের বার্তা’র সম্প্রচার। খবরের মাঝে মাঝে ছিল প্রোপাগান্ডার বিজ্ঞাপন, এই সম্পর্কগুলির বিরুদ্ধে।
#
যেদিন ইমেল পেলাম আমি, সেইদিন তোমার শান্ত হতে সময় লেগেছিল। যখন হলে, তখন আমায় অবাক করে জড়িয়ে ধরলে তুমি। তোমার গলায় তখনই পেয়েছিলাম আমি শঙ্কার পূর্বাভাস। জিজ্ঞেস করেছিলে, “তুমি কি জানো কেন তোমায় উপরে পাঠাচ্ছে ওরা?”
আমার একটা খাপছাড়া, উত্তর পেয়ে তুমি বললে, “না। কিচ্ছু জানো না; তার মানে ভুলে গেছ আমাদের স্কুলে কি পড়ানো হয়েছিল।” আমি বলতে পারিনি যে উচ্চবিত্তের আর মধ্যবিত্তের স্কুলগুলোর সিলেবাস এক নয়। তুমি ধরতে পারোনি আমার মনের কথা। আমায় ধরে বসিয়ে তুমি শুরু করলে আমাদের ইতিহাসের গল্প। “পঞ্চাশ বছর আগে, হেলির ধুমকেতুর আছাড় খায় চন্দ্রপৃষ্ঠে। শতধাবিভক্ত হয়ে যায় সেটা সংঘর্ষের ফলে। নির্দিষ্ট সময়ের দেড় বছর বাদে সেটা ফিরেছিল কুইপার বেল্টের অন্ধকার ঘরে, স্বাভাবিকের থেকে ছয় গুণ বড় হয়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন সেটা জুড়ে গিয়েছিল অন্য কোনও বরফের খণ্ডের সঙ্গে। মহাকাশের রাস্তায় ছুটে চলা এই জ্যোতিষ্কদের কথা কে অত খেয়াল রাখে।”
নিজের গরজে এই ঘটনাটি সম্পর্কে পড়াশুনো করেছিলাম আমি। চাঁদের গায়ে ধাক্কা মারার পরে সেই টুকরোগুলোকে নিজের দিকে টানে আমাদের গ্রহ, তারা জমতে থাকে দুইয়ের মাঝের ল্যারেঞ্জ পয়েন্টে, তৈরি হয় এক বরফের টুকরোর কসমিক আংটি। সেই এক এক দশকের জন্য পৃথিবীকে দূর থেকে দেখলে মনে হত শনির সৎ ভাই। কিন্তু সেই রিং ছিল অস্থায়ী। কেস্লার সিন্ড্রোমে বশে সেই এক্রেশন ডিস্কের ছোট টুকরোগুলো ঝরে পড়ে পৃথিবীর আবহমণ্ডলে। ঘর্ষণজনিত তাপের প্রভাবে তারা প্রায় চার বিলিয়ান বছর পরে আবার তরল। সেই টুকরোরা ঝরে পড়ে বৃষ্টিরূপে। অকাল বর্ষা। অসীম বর্ষা।
সেই বৃষ্টিকে অর্ধশতবার্ষিক বর্ষা এমনি এমনি বলা হয়নি। বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় ভারতীয় উপমহাদেশ, গোটা পৃথিবী। রোদের দেখা মেলেনি পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ বছর। সেই রোদ প্রলিফলিত হয় এক জগৎজোড়া সমুদ্রের পৃষ্ঠে, পূর্বের থেকে আরও চোদ্দো হাজার ফুট উপরে উঠে গেছে জলস্তর।
সেই অবিরাম বৃষ্টির মাঝে আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম করে গেছে নিজেদের কাজ। থামতে পারেনি সন্তানদের মুখ চেয়ে। আগ্রাসী ঢেউ, জলস্তর আর হাতের ফুরিয়ে আসা সময়কে তারা কাজে লাগিয়েছিলেন পৃথিবীর ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে, ভূগর্ভকে শূন্য করে তুলে এনেছিলেন আকরিক, বসুন্ধরার জঠরস্থিত সম্পদ দিয়ে তৈরি করেছিলেন এই শহরদের।
কলকাতা আর তার বত্রিশ বোন ভেসেছিল এই মহাসমুদ্রের বুকে, পেছনে ফেলে এসেছিল লাসা শহরের অর্ধনিমজ্জিত চুড়োগুলোকে। কথায় বলে প্রত্যেক প্রজন্ম তাঁদের সন্তানদের কাছ থেকে সময় কেনে বাঁচার জন্য, আমরাই বোধহয় প্রথম যাদের অস্তিত্ব বাস্তব হয়েছে তাদের বাপ-ঠাকুরদার আত্মত্যাগের জন্য। এই শেষ বিলিয়ান আজকে সূর্যকে দেখতে পাচ্ছে সেই এগারো বিলিয়ানের বলিদানের জন্য।
“এখনও হেলির তেরোটি দেহাংশ আবর্তন করছে পৃথিবীকে,” তুমি বলেছিলে, “একবার ভাবো, যখন সেই অতিকায় টুকরোগুলো নেমে আসবে একে একে, কী হবে।”
অনুভব করেছিলাম, আমাদের পালানোর রাস্তা বন্ধ করেছে অনাবিল জলরাশি।
“সেই জন্যই,” তুমি বলেছিলে, “তোমার যাওয়াটা এত জরুরি। তোমার কাজের উপরে নির্ভর করছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ।”
জানি আমি অরুণ। সবই জানি। যা জানতাম না, জেনেছি ব্রিফিংয়ের সময়ে। মহাকাশযানের সঙ্গে আমার একমাত্র যোগসূত্র, এই কার্বন ন্যানোফাইবারের কেবল ছিন্ন করলাম আমি। এই ভাসমান হিমশৈলের গায়ে গেঁথেছি হুক, সেই হুকের সঙ্গে আমার নতুন কেবল লাগিয়ে দিলাম। নতুন ওঠা সূর্যের আলোয় বরফ যেন কাচের আয়না। এখানকার মতো নিচের পৃথিবীতেও ভোর এসেছে। মানুষ উঠছে আড়মোড়া ভেঙে, তাদের মধ্যে খুব কমজনই জানে উপরে বসে থাকা এই টাইম বম্বের সম্পর্কে। না দলিল ঘাঁটলে জানতে পারবেও না তারা। আমিও এককালে ছিলাম তাদেরই একজন, খুশি ছিলাম অজ্ঞানতার ককুনে বন্দি থেকে। আর তারপর তুমি এলে। জুলিয়াস সিজার হলে বলতে, ‘ভেনি, ভিডি, ভিকি।’ পালটে দিলে আমার ভাবনার ধারাকে।
অরুণ, তুমি আশার আগে আমি জানতাম না ভালোবাসা কাকে বলে, ভালোবাসতে কীভাবে হয়। তুমি জানো না শূন্য ঘর কী অর্থ বহন করে আমার কাছে, অথবা এক মিনিমাম ব্যালেন্সের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। কী করে জানবে? তোমার বাবা তো শহরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, তোমার হাতের মুঠোয় দুনিয়া আর পায়ের তলায় সর্ষে। পৃথিবীর জল কেটে যাওয়ার জন্য বন্দরে তোমার দ্রুতগামী প্রমোদতরণী সর্বদা তৈরি। এখন আমি যদি বলি তোমায় এই কথাগুলো, তুমি বলবে হয়তো, এইরকম এক বাবার সংস্পর্শে থেকে তুমি সরকারের সমস্ত কলকবজার সঙ্গে পরিচিত, আর সেই চিনেছ বলেই এই ঐশ্বর্য নিয়ে বিরক্ত তুমি। এই টাকা যে তোমার রোজগার নয়। কিন্তু, অরুণ, এক ভিখারিই সবথেকে বেশি চেনে রাতের আকাশকে।
আমাদের মধ্যে এই নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হত, একদিনের কথা আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।
সেইদিন ছিল পৌষসংক্রান্তি। তুমি আমাদের জন্য মহার্ঘ মৌরলা মাছ নিয়ে এসেছিলে বিত্তশালীদের সুপারমার্কেট থেকে। আমি সেই মাছের টক আর গরম ভাত পরিবেশন করেছিলাম। জাঁকিয়ে কৃত্রিম শীত ফেলায় ফ্ল্যাটের ছাদ সেইদিন ছিল জনশূন্য। মাথার উপরে, শহরকে মোড়া প্লেক্সিগ্লাসের আবরণ ভেদ করে ছুঁইয়ে নামছিল খণ্ডবিখণ্ডিত চাঁদের মৃত জ্যোৎস্না। নিচের চলমান ফুটপাথে মানুষের ঢলের দিকে দৃষ্টি ছিল না তোমার। তোমার দৃষ্টি ছিল মোমবাতির আলোয় আলকিত আমার সাজানো টেবিলের দিকে।
মাছ দিয়ে ভাত মেখে প্রথম গ্রাস মুখে নিয়ে তুমি বলেছিলে, “একে বাঁচা বলে না।”
আমি তখনও খাইনি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হঠাৎ? কিছু হয়েছে আজকে?”
সেইদিন দুপুরে তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল তোমার। সেইখানেই কি কোন মতান্তর হয়েছে তোমাদের মধ্যে? তোমার মায়ের মৃত্যুর পর সম্পর্কের যে আঠা তোমাদের ধরে রেখেছিল একসঙ্গে, সেটা যেন আস্তে আস্তে ধুয়ে যাচ্ছিল কালের স্রোতে।
তুমি আমায় সেইদিন বলেছিলে সমুদ্র আর দুঃখের স্বাদ এক।
“দিল্লীর সঙ্গে একটা সামরিক চুক্তি করছে বাবা। মানে, দেখ, যদি শহরেরা পরস্পরের সঙ্গে এইসব চুক্তি না করে, তাহলে আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমাদের এই টাকাটা দরকার। ভুলে গেলে চলবে না যে হিমালয়ের উর্বর মাটি দিল্লী আর বেইজিঙের নটিক্যাল সীমার অন্তর্গত।”
আমি একগ্রাস গিলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি সবসময় এত বেশি বেশি ভাব কেন বলত? এসব তোমার বাবা আর তাঁর সহকর্মীদের মাথাব্যাথার জিনিস। তুমি ভুলে যাচ্ছ, তুমি এক সরকারি অফিসার, মন্ত্রী নও। তোমায় মাইনে দেওয়া হয় আকাশ দেখার জন্য, পৃথিবীর উপরে নজরদারি চালাতে না।”
“হেঃ, সব যদি এতটাই সোজা হত,” তুমি হাত তুলে দেখিয়েছিলে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের দেওয়ালকে, “যদি ওইগুলোর উপস্থিতি ভুলতে পারতাম…”
পাশের ফ্ল্যাটের দেওয়ালে বসানো একটা সিসিটিভি ক্যামেরা, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ নিচের পথচারীদের দিকে। গোটা শহরকে এই ক্যামেরার নেটওয়ার্ক মুড়ে রেখেছে এক অদৃশ্য শ্যেন নজরে। “আমরা কী করছি, কোথায় যাচ্ছি, সব জানে ওরা।”
এই শহর মহাসাগরের বুকে ভাসমান এক কৃত্রিম দ্বীপ, তার সরবরাহের পরিমাণ সর্বদা মানবসম্পদের নিক্তিতে মাপা। আমরা শান্তি চাই, কিন্তু ভুলে যাই শান্তি কিনতে হয়, সেই বিনিময়ের মূল্য আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা।
এই শহর আমাদের ঘর, মহাসাগরের নীলিমায় আমাদের আশার বাতিঘর, এবং একই সঙ্গে আমাদের পিঞ্জর। যে সহকামীদের ছুড়ে ফেলা হয়েছিল সমুদ্রে, তাদের মতো আমরা বোকা না। ফ্ল্যাটের বাইরে পরস্পরের হাত পর্যন্ত ধরি না আমরা। অনেক লেন্স যে দেখছে আমাদের। আমরা সেই ময়নার দল যাদের ঠাঁই হয়েছে খাঁচায় জঙ্গলের বিলুপ্তির পরে। আমরা সেই গ্রন্থকীট যারা বইয়ের পাতা গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করি নিস্ফল রাগে, কারণ আমাদের নিজেদের কথা আজ অবগুণ্ঠিত।
আমি বলেছিলাম, “তুমি যদি সরকারের এতই বিরুদ্ধে হও তাহলে এই চাকরি করছ কেন?”
নিজের পেটকে দেখিয়েছিলে তুমি, “খিদের পেটে কোন বিপ্লব সফল হয়েছে আজ অবধি?”
সেই মুহূর্তে নড়ে উঠেছিল আমাদের টেবিল, নড়ে উঠেছিল গোটা শহর। যেন এই দানবের অস্থিতে জং ফেলেছে নোনা জল। শহরে ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে, তার দেওয়াল আর প্রশাসনিক ক্ষমতার।
গণতন্ত্র বলে এক শাসন নীতির কথা বলেছিলে আমায়। সেখানে নাকি জনগণ মন্ত্রীদের নির্বাচিত করত, এইরকম একটা দলের পার্টি মেম্বাররা নয়। তারা নাকি গণতন্ত্রের অবলুপ্তি ঘটিয়েছিল রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা লাভ আর ভোটের খরচ কমাতে। আমি তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী বলতে চাইছ তুমি?”
“শুনতে পাওনি? শহর বুড়োচ্ছে দ্রুত। তার ইঞ্জিন, তার গর্ভগৃহ, তার মাটির নিচের কারাগার, সবই একটা ব্যালাস্টের মতো কাজ করে, বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের মাঝে সোজা রাখে এই অতিকায় নৌকাকে। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, নিয়মিত মেরামত করা সত্ত্বেও শহরের শরীরে ঘুণ ধরছে। সরকার জানে, কিন্তু তার নজর অন্য দিকে। যেন কালিদাস আবার গাছের ডালে বসে সেই গাছই কাটছে।”
“তুমি কি সব শহরের কথাই বলছ?”
“যদি কলকাতার ক্ষেত্রে এটা সত্যি হয়, তাহলে দুইয়ে দুইয়ে চার কি করতে পারি না? আমরা ভুলে যাই, সমুদ্র এক পাষাণ হৃদয় কাবুলিওয়ালা, আর আমাদের ধারদেনা মেটানো বাকি অনেক দিন ধরে।”
আমি বাটিতে চুমুক দিয়ে খেলাম বাকি ঝোলটুকু। যখনই এইরকম মিষ্টি জলে চাষ করা মাছ খাওয়ার সৌভাগ্য হয়, আমার শিকড় টানে আমায়। আমার বাঙালি জিভ, আমার জেনেটিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এই ঝোলের প্রতি অণুতে মিশে। যখন ফিরে দেখি ইতিহাসের পাতাগুলো, পড়ি আমাদের দেশভাগ আর দাঙ্গার বছরগুলোর কথা, আমার একটাই কথা মনে হয়। আমাদের জিভে একই মাতৃভাষা, একই মানুষের লেখা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, প্রায় একই খাদ্যাভ্যাস, তাহলে কেন কেবল ধর্মের ভিত্তিতে ভাগকরা হল একটা জাতকে? এবং, এখনও কেন সেই ভেদাভেদ এত প্রকট? দেশভাগের দেড়শো বছর পরেও? সরকারের পরোক্ষ ইন্ধনের জন্যই কি?
আমি অরুণকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই, তুমি মিথ্যে বলছ না তো?”
হয়তো আমার মুখে অবিশ্বাস লেখা ছিল খোলা পাতার মতো। তুমি বললে, “কারণ আমাদের ঘরের আজকে কোনও দেওয়াল নেই, নেই মানুষের ব্যক্তিগত জীবন। এই সরকার, তার আগের মাটির দুনিয়ার সরকার, বা তারও আগের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশেরা, সবাই বিশ্বাস করে বিভেদনীতির শাসনে। স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য তাদের এই একটাই পথ জানা। হ্যাঁ, যদি তুমি কথাগুলো একসঙ্গে উচ্চারণ করো, মনে হবে হিপক্রেসি, পরস্পরবিরোধী। যদি এই শহরের ভিত্তিই হয় এইরকম দুর্বল, তাহলে তুমি কি জোর গলায় বলতে পারবে তোমার ঘাড়ে জোর করে চাপানো এই কাজ কলকাতাকে রক্ষা করতে যথেষ্ট?” তুমি হেসে ফেললে, আমিও হাসলাম, যদিও সেই হাসির মধ্যে আমাদের কারুরই আনন্দ লুকিয়ে ছিল না।
#
সেই ইমেলে কেবল লেখা ছিল এক মহাকাশের মিশনের জন্য আমায় নির্বাচিত করা হয়েছে। সেই মিশনের জন্য ট্রেনিং নিতে আমি যেন সত্বর নির্দিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করি। ট্রেনিংয়ের শেষে আমি দেখা পেয়েছিলাম কলকাতার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর। আমার ‘শ্বশুর’ আমাদের এখানে পাঠানোর আগে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে ছেলের চোখ বাদে আর কোনও মিল খুঁজে পাইনি আমি।
তিনি বললেন, “তোমাদের এখানে ডাকা হয়েছে তোমাদের শহর-রাষ্ট্রদের রক্ষা করার জন্য। কেন জান? এই কারণে।” তাঁর পেছনের স্ক্রিনে ফুটে উঠলো ছবির পর ছবি। “যেমন দেখতে পাচ্ছ, আমাদের মাথার উপরে, লো আর্থ অরবিটে তেরোটা হিমশৈল ঝুলছে, দম শেষ হওয়া ঘড়ির পেন্ডুলামদের মতো। খুব ধীরগতিতে এগুলো তাদের স্থিতিশীল কক্ষ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। আর যখন হবে,” বলার দরকার ছিল না তাঁর। স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে এক অতিকায় সুনামির চিহ্ন। স্বর্গ থেকে মিসাইলের প্রভাবে তৈরি করে দুই কিলোমিটার উঁচু ঢেউ। এই তেরোটি ঢেউ মিশে যাবে একে অপরের সঙ্গে, তাদের শক্তি বৃদ্ধি হবে। সাগরের জলে মোছা স্লেটে চিহ্নমাত্র থাকবে না মানব সভ্যতার শেষ তেত্রিশটি আঁকের।
বাকিদেরকে তাদের শহরের থেকে আসা প্রতিনিধিরা ব্রিফ করছিল। তিনি তাদের ছেড়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। বুকে যেন দামামা বাজতে লাগলো আমার।
“ইমরান মণ্ডল,” গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, একটা ট্যাবলেট স্ক্রিন হাতে ধরে, “এটা তোমার গন্তব্য। আমরা এটার নাম দিইয়েছিলাম এক্সএফ২, বা যেঁনোফ্রস্ট ২। এটা কলকাতার প্রায় উপরে ঝুলে আছে। বাকি এক্সএফের মতো এরও কক্ষপথ বিচ্যুতি ঘটছে। তোমায় আমরা পাঠাচ্ছি উপরে, যাতে আকাশ না ভেঙে পড়ে আমাদের প্রিয় শহরের বুকে। তুমিই আমাদের শেষ ভরসা। মানুষের ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে আছে তোমাদের কাজের উপরে। বাকিটা ট্যাবলেটে আছে, একটু পড়ে নিয়ো মন দিয়ে।“ আমায় জিনিসটা ধরিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন।
স্ক্রিনে খোলা পাতাগুলো একে একে উলটে গেলাম আমি। একটা বাড়তি কথা বলেননি তিনি। আমি যদি কাজটা না করি, বা যদি সময়ে শেষ করতে না পারি… কী হবে ভেবে কপালে ঘাম দেখা দিল আমার। কলকাতা তো আর অ্যাটল্যাসের সার্ফবোর্ড নয় যে ঢেউয়ে ভেসে থাকবে। এটা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়, মানুষের তৈরি শেষ মেগাস্ট্রাকচার।
আমরা তেরো জন মহাকাশে যাচ্ছি জঙ্গি হয়ে। মানুষকে বাঁচাতে শূন্যে বিস্ফোরণ ঘটাতে।
#
এই বিশাল, প্রায় নয়শো মিটার ব্যাসের হিমশৈলকে ধীরে ধীরে প্রদক্ষিণ করছি আমি। পোশাকের জন্য আমার নড়াচড়া সীমাবদ্ধ। ব্রিফিঙে যা বলা ছিল, সেই অনুযায়ী আমি এই বরফের কেল্লার জায়গায় জায়গায় ড্রিল করে বিস্ফোরকগুলিকে পুঁতছি। আর মাঝে মাঝে দেখছি আমাদের বিদুষী গ্রহকে।
এখান থেকে এখন পরিষ্কার দেখা যায় হিমালয়। জেগে থাকা সবুজ, ঘন অরণ্যে মোড়া চুড়োগুলো এখন এক ছড়িয়ে থাকা দ্বীপপুঞ্জ। মাউন্ট এভারেস্ট এখন এক আন্তর্জাতিক উদ্যান। এখানেই কোথাও লুকিয়ে লাসা, অতল জলের নিচে। সেই শহরকে দেখতে পাচ্ছি না আমি, আমার জল ভরা চোখের সামনে ভাসছে আমার আলামারির এক কোণায় রাখা সেই মাটিভরতি বায়ুনিরুদ্ধ জার। যদি দেখাতে পারতাম তাকে এই দৃশ্য!
আমার মা, তোমায় বলেছিলাম হয়তো, ছিল কলকাতা হাসপাতালের নার্স। লাসা ছেড়ে সবাই যখন পালাচ্ছে, তখন আমি মায়ের পেটে। বাবা আসতে পারেনি। নিজের জীবন দিয়ে আমার জীবনের টিকিট কিনেছিলেন তিনি। মা-ও বেশি কিছু আনতে পারেনি সঙ্গে। সেই নিমিত্ত প্যাঁটরার মাঝেই ছিল একটা জার।
মাতৃহারা হই আমি আমার বিশতম গ্রীষ্মে।
আমি কোনওদিন ভুলতে পারব সেই দিনের কথা যেইদিন ওরা আমায় মায়ের সম্পত্তি হস্তান্তর করেছিল। বেশি কিছুই ছিল না ভদ্রমহিলার। যা ছিল, সবই ঢুকে গেছিল একটা সুটকেসে। এক সরকারি কেরানি এসে দিয়ে গেছিল আমায় সেই সুটকেস। আমার কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে যাওয়া নির্ঘুম চোখ দেখে বেশি কথা না বাড়িয়ে চলেও গেছিল সে। সারারাত ধরে কেঁদে তখন আমার অশ্রুগ্রন্থিরা মরুভূমি। গালে দাগ কেটেছে শুকিয়ে যাওয়া জলের নদীখাত। মাঝে মাঝে হেঁচকি উঠছিল আমার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন চারদিকের দেওয়াল এগিয়ে এসেছে কাছে, সেই দেওয়ালের মাঝে চিরকালের জন্য বন্দি আমি। সেই দেওয়ালের ইটগুলো তৈরি আমার স্মৃতি দিয়ে। সেই কারাগারই হয়েছিল আমার মনের ঘর।
মায়ের শেষ বার পড়া ম্যাক্সিটা হাতে নিয়ে কতক্ষণ বসেছিলাম আমি জানি না। মনে আছে পূর্বদিকের দেওয়ালে বাড়িদের ছায়াদের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে শেষে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে দেখেছিলাম সেইদিন। রাস্তার আলো এসে পৌঁছায়নি আমার ঘরে, কেবল ছড়িয়ে দিয়েছিল এক আলো আঁধারির খেলা।
সেই প্রায় অন্ধকারে, আমি হাতড়ে হাতড়ে স্পর্শ করছিলাম সুটকেসের বাকি জিনিসদের। যখন একটা কাচের জার আমার হাতে এসে ঠেকল, ঝাঁকাতে নড়ে উঠলো ভেতরের কিছু, আমি উঠে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালালাম। জার ভরতি ছিল কেবল মাটি দিয়ে।
তখন আমি ছিলাম মনের দিক দিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক। আমি বুঝতে পারিনি সেই মাটির অর্থ। আমার জন্ম হয়েছে সমুদ্রের বুকে, আমি জানি না পৃথিবীর বুকে একদা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা, বর্তমানে নিমজ্জিত শহরের কথা। আমি গোটা জীবনে কেবল চিনেছি এই নতুন প্যানথেলাসা মহাসাগরকে, তার বুকে ভাসা শহরদেরকে— তার মাছের ভেড়ি, কৃত্রিম জলাভূমির খেত, সুপেয় জলের অস্মসিস সেন্টার— আর, পৃথিবীর মুষ্টিমেয় কিছু ভূভাগের একটি— জলের উপরে মাথা উঁচু করে থাকা হিমালয়ের সবুজে মোড়া শিখরদের। আর আমি চিনি দিকচক্রবালে জমা হওয়া কিউমুলোনিম্বাসদের।
কিন্তু এখন, যখন গোটা বিশ্ব আমার পায়ের নিচে বিছিয়ে কার্পেটের মতো, আমি বুঝতে পারলাম সেই জারের অর্থ। বুকের ডানদিক অযথাই চিনচিন করে উঠল আমার। ট্রান্সমিটারে তুমি বললে, “মাসিহা ২, তোমার হৃদস্পন্দন হঠাৎ দ্রুত কেন?”
“মিশন কন্ট্রোল, আপনাকে বললেও আপনি বুঝবেন না।” সত্যিই বুঝবে না তুমি। এই দৃশ্য না দেখলে আমিও বুঝতে পারতাম না। আমি এখন বুঝেছি কেন মা ওই মাটিকে আগলে রেখেছিল নিজের কাছে, কেন সেই মাটি ছিল তার কাছে প্রাণের থেকেও দামি। সেই মাটি কলকাতার মাটি, তার হারিয়ে যাওয়া ঘরের শেষ স্মৃতিচিহ্ন। তার পৈতৃক ভিটের বাগানের শেষ নিদর্শন এই রূপান্তরিত, সমুদ্রের দুনিয়ায়। সেই দুনিয়ার সব গল্প শুনেছি আমি তার কাছে, ঘুম পাড়ানি গান হিসেবে। কোনও ফোটো আনতে পারেনি মা তার সঙ্গে। তার মৃত্যুর সঙ্গে ইলেকট্রিক চুল্লিতে সেদিন পুড়েছিল সেই জায়গার সমস্ত স্মৃতি। মৃতেরা কথা বলে না।
সাগরের পানি এখন ভাসছে আমার হেলমেটের মধ্যে, চোখের বাঁধ ভেঙে। সেই জলকণা প্রত্যেকে একটি হীরের কুচি, দূরের প্রাণবন্ত সূর্যের প্রেক্ষাপটে।
#
আমি তোমাকে একবার বলেছিলাম আমার স্বপ্ন সম্পর্কে— আকাশে যাওয়া বাদে কি স্বপ্ন থাকতে নেই মানুষের?— সেই স্বপ্নে আমি বারবার ফিরে গেছি মায়ের গল্পে জীবন্ত কলকাতার পথেঘাটে। তুমি উত্তর দাওনি, মাথা নেড়েছিলে কেবল। আমি একবার দেখতে চেয়েছিলাম সেই শহরকে। তার রাস্তায় এখন এঙ্গলার মাছ সাঁতরে বেড়ালেও সেই স্থানের প্রতি আমার নাড়ির টান, আমার পিতৃপুরুষের ঋণকে ভুলি কি করে?
এই কলকাতার সঙ্গে সেই শহরের নাম বাদে আর কোনও মিল নেই। সেই শহরের প্রাণবন্ত জীবন দেখে দমিনিক লাপিয়ের তার নাম দিয়েছিলেন সিটি অব জয়। এই শহর আমার কাছে খাঁচা বাদে আর কিছু না। সূর্যের আলো এখন প্রতিফলিত হচ্ছে তার ধাতব ত্বকে। নিচে যেন ফুটে আছে এক হীরের ফুল।
“জন্নত থেকে পৃথিবীকে কেমন লাগছে জনাব ইমরান?” সবার সামনে, ওপেন চ্যানেলে প্রথমবার আমার নাম ধরে ডাকলে তুমি।
আমিও তোমার মতো ব্যবহার করলাম জন্নতের প্রতিশব্দ। “সত্যিই এটা স্বর্গ, রায়বাবু। যেন কোনও বেগমের দামি কালো বোরখায় সেলাই করে আল্লা বসিয়েছে অজস্র রত্নকুচি।”
সময় যত এগিয়ে আসতে লাগল, তত শান্ত হয়ে গেল আমার মন। মহাকাশে বিস্ফোরণের শব্দ হয় না, কিন্তু আমার ভাইসর দিয়ে আমি দেখলাম মাসিহা প্রজেক্টের বাকিরা তাদের কাজ শেষ করে একে একে ফিরে যাচ্ছে। পেছনে ফেলে যাচ্ছে অপূর্ব তারাবাজির রংদের। আমার চারপাশের এক্সোস্ফিয়ারে নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটছে। জ্বলন্ত ডিপিক্রামাইড আর হেক্সানাইট্রোসিলবেনের উজ্জ্বল নীল, হলুদ, কমলা, আর সবুজ আগুন এক্সএফগুলিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে সেই টুকরোরা। পিছিয়ে পড়েছি বলে সেই আলোর খেলা দেখার সময় ছিল না আমার।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে যখনি দৃষ্টি যায় আলোয় ভরা পৃথিবীর দিকে, এক ভ্রান্তি মনের মধ্যে বুদবুদ কাটতে থাকে আমার। আমার গোটা জীবন কলকাতার বাকিদের মতোই কাটিয়েছি খাঁচার পাখি হয়ে। মনে পড়ল প্রাচীন চিনের সেই পা-বন্ধনের বর্বর প্রথার কথা। এতদিন অবধি আমিও কি ছিলাম না সেই অভাগিদের মতোই শৃঙ্খলে বন্দি? অরুণ, যখন কেউ তোমার পায়ে পড়ায় বেড়ি, জিভে দেয় গলন্ত লোহার ছ্যাঁকা, কেড়ে নেয় তোমার ভালোবাসার অধিকার, তখন নিজেকে জীবিত কি বলতে পারো তুমি জোর গলায়? আমরা এখন চিড়িয়াখানার জীব। কিন্তু এই মুহূর্তে, আমি মুক্ত সেই অচলায়তনের সব একুশে আইন থেকে, চিন্তার উপরে কর বসাতে পারবে না এখানে আমায় সরকার। মহাশূন্যে ফ্যাসিজমের বজ্রমুষ্টিও ফস্কা গেরো।
শেষ ফ্লেক্সিবল লাইনার শেপড চার্জ (FLSC) জায়গায় বসিয়ে আমি বললাম তোমায়। তুমি উত্তর দিলে, “বাহ! এবার তোমার স্যুটের বাঁ-দিকের পাউচটা একবার খোলো তো…”
আমি চেন খুললাম তোমার কথা মেনে। সেই পাউচে ভাসছে একটা চৌকো উজ্জ্বল বস্তু। যেন আমার কানে কানে তুমি বললে ট্রান্সমিটার দিয়ে, “তোমার জন্য একটা গিফট, ইমরান। শুভ জন্মদিন। প্রকৃতির দেওয়া এই দৃশ্যকে জয় করতে পারবে না আমার এই উপহার, তবুও…”
চৌকো জিনিসটা একটা হলোগ্রাফিক প্রজেক্টর। গোটা দুনিয়াকে আমার সামনে সাক্ষী রেখে সেই প্রোজেক্টরের গায়ে লাগানো একমাত্র বোতামটা টিপলাম। ভোরের শিউলির ফুটতে থাকা পাপড়িদের মতো একে একে খুলে গেল তার আবরণ, উন্মুক্ত হল লেন্সগুলি, আর আমার সামনে উদ্ভাসিত হল এক ত্রিমাত্রিক চিত্র। একটা ম্যাপ। সেই ম্যাপে যত্ন করে আঁকা রাস্তাঘাট, তাদের ফুটপাথ, ফ্লাইওভার, ব্রিটিশ আমলের লাল বাড়িরা বা পরবর্তীকালের আকাশচুম্বী ইমারতেরা। চিনতে পারলাম ময়দান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, পার্ক স্ট্রীটের কবরখানা, শিয়ালদা স্টেশন, এমনকি নন্দনও। প্রাচীন কলকাতা তার নগ্নরূপে ধরা দিল আমার সামনে।
আমার ভাইসর ঝাপসা হয়ে গেল আমার নিঃশ্বাসের উষ্ণতায়। তুমি মনে রেখেছিলে!
আমায় বললে তুমি, “একদিন, তোমার মনে আছে কিনা জানি না, তুমি বলেছিলে কলকাতা, তোমার ঠাকুরদার শহর, ভালোবাসার শহর দেখার সাধ। তোমার এই মানুষের মহাপ্রস্থানের পথে যাওয়ার আগের শেষ রাজত্বের নিদর্শন দেখার ইচ্ছা পূরণ করেছি আমি।” সেইদিন আমি উষ্মা উগড়ে দিয়েছিলাম তোমার কাছে, শহরের প্রতি। মনে পড়ল আমার।
ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা ছিল না আমার, গলার কাছে একটা জমাট পাকান খুশি ওঠানামা করছিল। তখনি দেখলাম একটা উল্কাপাত। আমায় এখানে আনা শাটল ফিরে যাচ্ছে পৃথিবীতে। আমায় না নিয়েই।
যারা আমায় এখানে পাঠিয়েছে তারা এই ধরনের ভুল করে না।
ট্রান্সমিটারে চিৎকার করে উঠলাম আমি। ব্যাখ্যা চাইলাম, প্রাণভিক্ষাও করলাম। ওইদিকে তুমি হঠাৎ নিরুত্তর, শুনতে পেলাম কারুর সঙ্গে এই নিয়েই কথা কাটাকাটি করছ। সঙ্গের গলাটাও চেনা আমার। তোমার বাবাই তার মানে দায়ী এই ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার জন্য।
অবশেষে, তুমি ফিরে এলে আমার কাছে। তোমার গলায় পাতাঝরার মরসুমের শব্দ। “তোমার কাছে যে রিমোট ডিটোনেটর আছে, ওটা আসল না।” আমার হাতেরটা যে প্লাস্টিকের বুঝতে পারলাম আমি।
তোমার কণ্ঠনালীতে কেউ যেন পা দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি রাগে ছুড়ে ফেললাম প্রজেক্টরটা, মহাকর্ষের নিয়মে এক প্রভুভুক্ত কুকুরের মতো সে ভেসে বেড়াতে লাগল আমার চারপাশে। তুমি বলে চললে, “আমায় এইমাত্র বাবা অরিজিনালটা দিল। ওরা… ওরা জানত, ইমরান। আমরা ভেবেছিলাম ক্যামেরাকে ফাঁকি দিলেই ওদের হাত থেকে বাঁচতে পারব। কিন্তু না, যে শহর নজরদারির ছাতার নিচে, সেখানে আমাদের প্রেমকে গলা টিপেই মারা হয়। মনুষ্যজাতির টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাকে অগ্রাহ্য করাই দস্তুর। বাবা পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। বলছেন তিনি যদি না থাকতেন, আমার দশাও হত তোমার মতো। কিন্তু… কিন্তু আমি যে চাইনি এটা ইমরান। আমার বোঝা উচিত ছিল এটা ঘটতে চলেছে, সেইদিনই যেদিন তোমার ইমেল এল। আমি কি এই প্রশাসনিক নাটকের খেলনা মাত্র?”
কিচ্ছু না তুমি। তুমি একটা জিনিস ভুলে যাও, অরুণ। আমি জানি তুমি মিথ্যে গুছিয়ে বলতে পারো না। ট্রান্সমিটারের যান্ত্রিকতাও আড়াল করতে পারেনি তোমায়। আমার স্যুটের দায়িত্বে তুমি ছিলে। এই রিমোট তুমি ছাড়া আর কে পারতো পালটে দিতে? বা কে পারত তোমার অজান্তে? দ্বিতীয়টা সত্যি হলে তোমার থেকে নির্বোধ আর কেউ নেই। প্রথমটা হলে তোমার থেকে বড় অভিনেতা কেউ নেই। যাইই হোক না কেন, ক্ষমা তোমায় করতে পারলাম না আমি।
ক্ষমা করার শক্তি নেই আমার। আর নেই।
তাও, চোখ তুলে চাইলাম পৃথিবীর দিকে, তোমার দিকে, গলার স্বর আমার অস্বাভাবিক শান্ত। বললাম, “ঠিক আছে, সব ঠিক আছে, প্রিয়ে, তুমি কি জান আজকের সূর্যোদয়কে আমার স্মৃতিকোঠা থেকে কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা নেই কারুর? আমাদের গ্রহকে এখান থেকে দেখতে লাগছে যেন ঈশ্বরের অ্যাকোরিয়াম। এক নিমজ্জিত বাগান। মহাবিশ্বের পথে চলা এক পোখরাজ মণি। হিমালয় দ্বীপপুঞ্জ তার সবুজ শিরা, শহরেরা তার মুকুটের রত্ন।
অরুণ, মা চলে যাওয়ার পর এই একলা মানুষটাকে তুমি নতুন করে সব চেনাতে শিখিয়েছিলে। পরিবারের অর্থ বুঝিয়েছিলে আবার। আমার ভয়কে জয় করতে শিখিয়েছিলে। আমায় অন্ধকার থেকে টেনে বের করে সূর্যের সামনে দাঁড় করিয়েছিলে। আমার মনের গরলকে দূর করেছিলে সম্পর্কের চারাগাছে জল সিঞ্চন করে। আমি ছিলাম নিজের মনেই বন্দি, তুমি এসে মুক্তি দিয়েছিলে আমায়।
“তুমি জানো তোমায় কী করতে হবে, অরুণ। তোমার বোতাম চাপার উপরে নির্ভর করছে গোটা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।” আমি মাইক বন্ধ করে তাকালাম সূর্যের দিকে। অন্ধ হয়ে যাব, কিন্তু তাতে আমার আর কিছু যায় আসে না। এই অগ্নিগোলক জেনে যাবে আমার কথা, মূক দর্শক হয়ে।
মাগো, যদি জানতাম, তাহলে সেই জার সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম এখানে। তোমার জন্য উপহারের কাগজে মুড়ে।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সোহম গুহ, সৌরভ ঘোষ
এই অদ্ভুত সুন্দর গল্প পড়ার পর নির্বাক হয়ে যেতে হয়। লেখকের উদ্দেশে রইল অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।
ধন্যবাদ দাদা!
অসাধারণ! জাস্ট অসাধারণ! কল্পবিশ্ব প্রথম থেকেই পড়ি, এই গল্পটাকে একেবারে প্রথম সারিতে রাখলাম। লেখকের আগের গল্প বলে মুগ্ধ হয়েছিলাম, এইবার সেই মুগ্ধতা শতগুণ বাড়ল। চুপ করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। এই মুহূর্তে মনের ভাব ব্যক্ত করার ক্ষমতা আমার নেই। অনেক শুভেচ্ছা, অফুরান ভালবাসা রইল।
ধন্যবাদ দাদা!
সোহম বাবু – খুবই ভাল লাগল আপনার এই গল্পটা পড়ে। আরও এরকম অনেক মণিমুক্তো আশা করছি ভবিষ্যতে।
ধন্যবাদ অমিতাভ বাবু
খুব সুন্দর গল্প। হ্যালির ধূমকেতুর কাইপার বেল্টে তুষারযুক্ত হয়ে ভর বৃদ্ধির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা খুব ভাল। এই গল্পে ভাষার সৌন্দর্য এবং তার প্রয়োগ গল্পটিকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। লেখককে শুভেচ্ছা জানাই।
ধন্যবাদ দাদা।
লেখা নির্বাচনের সময় পড়েই খুব ভালো লেগেছিল। তোমার লেখনী এই ধারার লেখালেখিতে ক্রমশঃ এক পূর্ণতর অবয়ব নিচ্ছে। চরৈবেতি, চরৈবেতি …