নিদালি আলেয়া
লেখক: পরাগ ভূঞ্যা
শিল্পী: পরাগ ভূঞ্যা
“বউটা পেত্নীর মতন কাঁদতে কাঁদতে হাসে।”
পঞ্চার কথা শুনেই মেজাজ বিগড়ে গেল রজতের। ধমকের সুরে বলল, “চ্যাংড়ামি পেয়েছিস। একে শালা এই রাতদুপুরে তদন্তের উটকো ঝামেলা তার মধ্যে তোর আল বা…
“না স্যার। আমি নয় আশপাশের লোকেরা বলে!” মোলায়েম সুরে কনস্টেবল পঞ্চানন রজতকে থামিয়ে দেয়। সে বিগত বারো বছর ধরে পুলিশের চাকরিতে আছে। তৈল মর্দন শিল্পে সিদ্ধহস্ত।
“কোথায় তোর আশপাশের লোক?”
“স্যার জানেন তো বাবুদের পাড়া। কারুর সাতে-পাঁচে থাকে না। সন্ধ্যা নামলেই এপাড়া নিঝুম হয়ে যায়।”
“ঠিক আছে। আর মাখন লাগাতে হবে না। বড় টর্চটা দে।”
টর্চ হাতে পুলিশের জিপ থেকে নেমে অন্ধকারছন্ন বাড়িটির দিকে এগোয় সাব-ইন্সপেক্টর রজত পাল। তাকে অনুসরণ করে পঞ্চানন।
কলাপসিবল গেটের ফাঁকে টর্চের আলো ফেলে রজত খুঁটিয়ে দেখে। গেটের ওপারে মোজাইক মেঝেতে স্বল্প ধুলোর আবরণ। বোধহয় দু-তিন সপ্তাহ ধরে মানুষের আনাগোনা বন্ধ। ভেতরে গোটাকয়েক খবরের কাগজ পড়ে। দু-তিন দিন খবরের কাগজ দেওয়ার পর আর প্রয়োজন মনে করেনি কাগজওয়ালা।
গেটে কোন তালা নেই।
“লোকাল খবরের কাগজের ছেলেটাকে জেরা করেছিলি― পঞ্চা?” রজত বলে ওঠে।
“হ্যাঁ, স্যার! ওই তো প্ৰথম গন্ডগোলটা ধরে। তারপর প্রতিবেশী উজ্জ্বল সমাদ্দার গেল সোমবার রিপোর্ট করে। বর বউ ঝগড়া করে কিছু একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে এটা তিনি ধরেছেন।”
“হারামজাদা! সবাই সব ধরে নিচ্ছে তাহলে আমাদের আর কোনও কাম নাই। চল কাল থেকে পুলিশ ফাঁড়িতে চপ ভাজা শুরু করি। কী খাবেন পঞ্চুবাবু? বেগুনি না কাটলেট?”
পঞ্চাননের মুখে রা নেই।
রজত এবার গর্জে ওঠে, “আজ বড়বাবু ফোনে উত্তমমধ্যম শুনিয়ে সাপের পাঁচ পা দেখিয়ে ছেড়েছেন। শালা তিনদিন আগে রিপোর্ট হয়েছে। আমার কাছে কোনও খবর নেই। তুই কী এটা জানিস কত বড় ইস্যু হতে চলছে?”
নিরুত্তর পঞ্চানন মাথা নাড়ে।
রজত রাগে গজগজ করতে করতে কলাপসিবল গেট ফাঁক করে ভেতরে ঢোকে। যদিও ইস্যুর গল্পটা ঢপের চপ। নীচের তলার কর্মচারীদের একটু শাসন করা ভালো।
অন্ধকার ভেদ করে মেঝের ওপর টর্চের আলো পড়েছে। গেট পেরিয়ে স্বল্প প্যাসেজ। তারপর একতলার আধখোলা দরজা।
“বাড়িতে কেউ আছে? থানা থেকে আসছি!” বাজখাই স্বরে নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করে রজত। প্রত্যুত্তরে কিছুক্ষণ সব বোবা, তারপর দরজার ওপার থেকে ভেসে আসে পায়ের মৃদু শব্দ। রজত ও পঞ্চানন পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর ধীর পায়ে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে।
“কৃশানুবাবু―অমৃতাদেবী―বাড়িতে কেউ আছেন?”
ঘরে দমবন্ধ করা ভ্যাপসা পরিবেশ। পচা ডিমের গন্ধ ম ম করছে। সম্ভবত রান্নার গ্যাস লিকেজ হয়েছে।
আগে বসার ঘর। বেশ শৌখিন। সেকশানাল সোফা দিয়ে সাজানো। মাঝে অটোম্যান। এলোমেলো টর্চের আলো সোফার ডানদিকের একটা অংশে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ওটা কী― নখ। তা ছাড়া আর কী হতে পারে। রজত কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ। জোর করে উপড়ে ফেলা। তাতে মেরুন নেলপলিশ লেগে উলটো পাশে শুকিয়ে যাওয়া স্বল্প মাংস।
রজতের টনক নড়ে। ডাকাতি, ধর্ষণ, খুন অনেকগুলো সম্ভাবনার মেঘ এসে ভিড় করে। সে ইশারায় পঞ্চাননকে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালতে বলে। তারা কেউই প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। যদিও তার কাছে নাইন এমএমের পিস্তল আছে। যেটার কোনও লাইসেন্স নেই। এনকাউন্টার ছাড়া অন ডিউটি সাব-ইন্সপেক্টরের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার নিয়ম নেই। রজত রাখে নিজের ইগো স্যাটিসফ্যাকশনের জন্য।
ফোনের ফ্ল্যাশলাইটের বাড়তি আলোর সুবাদে রজতের কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়। একটা চাপা উত্তেজনা হাতুড়ি মারতে মারতে শিরদাঁড়া বেয়ে ক্রমশ ওর মাথায় গিয়ে আঘাত হানে। মেঝেতে কিছু দূর অন্তর অন্তর রক্তের ছাপ। কেউ যেন আহত পায়ে অর্বাচীনের মতন হেঁটে বেরিয়ে ঘরময়। তারপর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেছে। হয়তো উলটোটাও হতে পারে। বেশ কিছুর ছাপ শুকিয়ে গেছে আর কিছু টাটকা।
পঞ্চানন রজতের ধন্ধটা বুঝতে পেরেছে। তার অবস্থাও অনুরূপ। মুখ ফুটে বলে, স্যার বলছি কী― আর ঠিক তখনই দোতলা থেকে কেউ করুন সুরে কেঁদে ওঠে। মেয়েলি গলায় কান্না। কান্নার বেগ ক্ষণিকের অন্তরালে তীব্রতর হয়। রজত পিছিয়ে আসে কয়েক পা। তারপর হঠাৎ কান্না থেমে যায়। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে কিছু একটা গড়াতে শুরু করে। গড়তে গড়তে সেটা সিঁড়ির বাঁকে আটকে যায়। আর পেছন পেছন কেউ এলোমেলো পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে… কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার বিরতি। তারপর একটা চেনা শব্দ। কেউ কিছু একটা বেশ আগ্রহ নিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে… তারপর সেই শব্দ ছাপিয়ে আবার শোনা যায় কান্নার আওয়াজ… অসহায়তা আর অপরিসীম যন্ত্রণায় একাকীত্বের সুর মিশেছে…
অন্ধকার সিঁড়িতে ঘটে চলা শব্দের ষড়যন্ত্র রজতের ভয়কে প্রশয় দিচ্ছে। সে আড়চোখে বাইরে বেরোনোর দরজার দিকে তাকায়। কলাপসিবল গেট সে খুলেই ভেতরে এসেছিল। এখান থেকে জিপের দূরত্ব কমবেশি একমিনিটের। গাড়ির চাবিও তার কাছে। উলটোদিকে অঝোরে বয়ে চলা কান্নার স্রোতে পরিবর্তন ঘটেছে। এখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা শুরু হয়েছে…
কিন্তু কৌতূহল বড় সাংঘাতিক বস্তু।
রজত মুখের ইশারায় পঞ্চাননকে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে আলো ফেলতে বলে। পঞ্চানন ধীরে ধীরে ফ্ল্যাশ লাইট মেলে ধরে সিঁড়ির দিকে।
দোতালা থেকে নিম্নগামী সিঁড়ি অর্ধেক রাস্তা এগোনোর পর ডানদিকে বাঁক নিয়ে একতলায় গিয়ে শেষ হয়েছে। যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানকার সিঁড়ির ধাপ অনেক বড়। সেখানে উলটোদিকে উপুড় হয়ে বসেছিল মেয়েটি, আলো গিয়ে পড়তেই ঘুরে মুখ তুলে চায়।
রজতের হৃদ্যন্ত্রটা পাঁজরের দেওয়ালে বাড়ি মারতে শুরু করেছে। আতঙ্কে পঞ্চাননের হাত কাঁপতে থাকে সমানুপাতে ফ্ল্যাশলাইটের স্থিরতা। মেয়েটির পরনের সাদা নাইটির এলোমেলো অবস্থা― স্থানে স্থানে রক্ত লেপা― একটা অংশ ছিঁড়ে বুকের বেশখানিটা দেখা যাচ্ছে। নাইটি শেষ হয়েছে ডান পা-র হাঁটুর কাছে, সেখান রক্তবন্যা বইছে। বাঁ দিকের পা নেই― সেটা এখন দু-হাতে ভর করে মেয়েটির মুখের সামনে ঝুলছে। দুই আগন্তুকের অনাধিকার প্রবেশ তার সান্ধ্যভোজনের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। সে মুখের খাবার ফেলে দিয়ে একপায়ে ভর করে এগোতে চায়। টালসামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে সিঁড়ির ধাপে। তারপর বিকট সুরে কাঁদতে কাঁদতে কনুই ভর করে নেমে আসে নীচে…
কিংকর্তব্যবিমূঢ় রজত স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পঞ্চানন আর সহ্য করতে পারে না। সে রজতের হাত ধরে টান মারে পালানোর জন্য। রজত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। হাতের টর্চ দূরে ছিটকে যায়। সে পঞ্চাননের দিকে তাকায়।
পঞ্চানন ততক্ষণে বাইরের দরজা কাছে পৌঁছে গেছে। রজতের কথা ভাববার সময় নেই। তাকে পালাতে হবে। কলাপসিবল গেটের কাছে গিয়ে তার চাপা উত্তেজনা আর্তস্বরের রূপ নেয়। ক্রমে সেটাও ক্ষীণ হয়ে আসে। শুধু পড়ে থাকে আতঙ্কে উন্মাদ হওয়া রজত, ম্রিয়মান টর্চের আলো, মেঝের বিরুদ্ধে শরীরকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার শব্দ, আর…
।। দুই ।।
दिल चाहता है
हम ना रहें कभी यारों के बिन…
ছুটছে সন্দীপ। কানে ইয়ার ফোন গোঁজা, পরনে জগিং সুট। ভোরের কুয়াশা চিরে ছুটে চলছে।
সন্দীপের মনের আঙ্গিনায় এখন অমৃতা ভাসছে। তার সঙ্গে কথা বলছে, আদর করছে। কৃশাণুর সঙ্গে অমৃতার সম্পর্কের কথা প্ৰথম থেকেই জানত সন্দীপ। তাই বলে একতরফা ভালোবাসা― ধ্যাৎ!― ওই সব ফিল্মি ব্যাপারস্যাপার। অমৃতার শরীরটাকে সে চিরকাল পেতে চেয়েছে তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
সন্দীপের দৌড়োনোর গতিবেগ বাড়ে।
কিন্তু কৃশানুর সঙ্গে বিয়ে হবার পরেই প্রতিনিয়ত ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে সন্দীপ। কৃশানুকে অস্বীকার করা যায় না। তার প্রিয় বন্ধু। স্কুল, কলেজ, পাড়া, খেলার মাঠ― সর্বত্রই তারা ‘মানিকজোড়’। লোকে তো তাদের বন্ধুত্বের মিশাল দেয়। কিন্তু অমৃতা― শুধু কী ওকে দেখতেই রোজ কৃশানুর ফোনে ভিডিয়ো কল― আর ভাবতে পারে না সন্দীপ। অনেকক্ষণ দৌড়ে হাঁপিয়ে পড়েছে। এবার বিশ্রাম চাই। সে পাশের বেঞ্চটায় গিয়ে বসে। এখানটায় বেশি অন্ধকার। কুয়াশা ভেদ করে ভোরের আলো এসে পড়েনি। ইদানিং সন্দীপের অন্ধকারে থাকতে ভালো লাগে। অন্ধকারে বিবেকের মুখোশটা পরতে হয় না। দিব্যি অমৃতাকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করা যায়।
হাত দিয়ে মুখের ঘাম মোছে সন্দীপ।
उसको जाना किधर है
जो वक़्त आए, जाने क्या दिखाए
हो… हो… हो…
কান থেকে ইয়ার প্লাগ খুলে পকেটে রাখার সময় সন্দীপ খেয়াল করল ব্যাপারটা― ওর পাশের অন্ধকার নড়েচড়ে উঠছে। সন্দীপের অবচেতন মন তাকে জানান দেয় এর আগেও যখন কুয়াশার মধ্যে ছুটছিল তখন ঘটেছে ব্যাপারটা, কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়নি। অন্ধকার ভেঙে একটি কৃষ্ণবর্ণ মানুষের অবয়ব এগিয়ে এল তার দিকে। বাড়িয়ে দিল মুঠোবন্দি হাত। সন্দীপ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। ধীরে ধীরে হাতের মুঠি খোলে। সন্দীপের চোখ ঝলসে ওঠে― নীলচে সাদা আগুনের শিখা…
পেছনে কেউ অঝোরে কেঁদে ওঠে।
हो… हो.. हो…
… … …
दिल चाहता है…
রেডিয়োতে গান বাজছে। সন্দীপ চোখ মেলে তাকায়। আশে পাশে লম্বা-লম্বা কাটুনের সারি। তফাতে তফাতে ছাদ থেকে ঝুলন্ত ল্যাম্প নেমেছে। ভ্যাপসা চ্যাটচেটে পরিবেশ। সে একটি রেকলাইনার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। বুকের কাছে হাতদুটো একত্র করে বাঁধা― নীচের পা জোড়াও। মুখে রুমাল গোঁজা।
“আরে আপনার ঘুম ভেঙেছে দেখছি?” সন্দীপ দেখে স্তরে স্তরে সাজানো কাটুন-স্তম্ভের মাঝখান থেকে একটি মাঝবয়সি লোক বেরিয়ে এল। তারপর পাশের টুলে রাখা রেডিয়োটা বন্ধ করে সন্দীপের দিকে এগোয়।
সন্দীপের অস্বস্তি লাগল।
“আপনারে বিভীষণ ভাবতাম আর আপনি মশাই কুম্ভকর্ণ বেরোলেন। এত ঘুমোয় কেউ। যদিও ক্লোরোফর্মের ডোজটা একটু কড়াই ছিল। হি হি”
লোকটা বিকট শব্দে হেসে ওঠে। নিরুপায় সন্দীপ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। গোডাউনের এক কোণ থেকে মেয়েলি কান্নার শব্দ আসে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেও শব্দটা পেয়েছিল সন্দীপ।
“ক্ষমাঘেন্না করে দেবেন। এর চেয়ে ভালো অতিথি আপ্যায়ন হবে না আমার দ্বারা। আশা করি আপনার ভালোই লাগছে। অধমের নাম― ধুস্ একটু শান্তি করে দু-দণ্ড প্রেমালাপ করব সে উপায় নেই। মেয়েটা জ্বালিয়ে খেল। এক মিনিট সময় দেন আমি আসছি―“
লোকটা আবার কাটুনের ভিড়ে হারিয়ে গেল। একটা চিৎকার― আঘাতের শব্দ তারপর সব চুপ। সুবোধ বালকের মতন লোকটা একমুখ হাসি নিয়ে ফিরে এল। হাতে একটা রক্ত মাখা লোহার রড।
“কোথায় ছিলাম আমরা… ও আমার পরিচয় পর্ব নিয়ে। বেশ একটা ইন্টারভিউ-ইন্টারভিউ ফিল হচ্ছে মশাই! কিন্তু তখন থেকে আমিই কথা বলে যাচ্ছি। আপনিও কিছু বলুন― কী? গুঙ্গিয়ে-গুঙ্গিয়ে কী বলছেন? সো সরি। এক্কেবারে খেয়াল নেই―”
লোকটা সন্দীপের মুখ থেকে রুমাল টেনে বের করে আনে। তারপর সেটা দিয়ে মুখের ঘাম, লোহার রডে লেগে থাকা রক্ত মুছে বুকপকেটে চালান করে দেয়। বিপরীতে সন্দীপ মুখ দিয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে থাকে।
“তো যেটা বলছিলাম। কেন আপনারে ঘর জামাই করে রাখছি―”
“আপনি কী চান? কত টাকা? কত টাকার চাই― বলুন?” সন্দীপ আকুতি মিনতি করে।
“আরে ধুস আপনি ওই মেয়েটার মতন ন্যাকামি কেন করেছেন? শুনুন না মন দিয়ে।”
“একটামাত্র ফোন করলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তারপর কিন্তু আমায় ছেড়ে দিতে হবে…”
লোকটার হাতের রডটা গিয়ে পড়ল সন্দীপের ঊরুর ওপর। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সে। লোকটা বুকপকেটের রুমালটা বের করে সন্দীপের মুখে গুঁজে দেয়।
“মানুষের এই এক বড় দোষ বুঝলেন। নিজের এজেন্ডা আগে পুঁতবে। এখানে কী চাঁদে কে আগে পৌঁছবে সেই নিয়ে ডিসকাশন চলছে? সম্মান লোকে নেয়, নেওয়ার গল্প শোনায় কিন্তু দেওয়ার বেলা অরুচি। থাক অপ্রাসঙ্গিক কথা ছেড়ে ইন্টারভিউতে ফেরা যাক। তো যেটা বলছিলাম― তরশুর ঘটনা। আপনার বাল্যবন্ধু ও তার নতুন বিয়ে করা বউয়ের লাশ তাদেরই বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। যদিও অমৃতাদেবীর লাশটা লাশ না বলে লাশের অংশবিশেষ বলা যায়। আশাকরি খবরের কাগজে পড়েছেন। ধুস কী যে বলে ফেলি মাঝেমধ্যে, আমার কমিক টাইমিং একদম ফালতু। ওদের মৃত্যুর খবর পেয়েই আপনি তড়িঘড়ি ইউপি ছেড়ে এখানে এলেন। কিন্তু আমিও ট্যাক্সি ড্রাইভার সেজে আপনাকে পিক-আপ করতে চলে গেলাম এয়ারপোর্ট। তারপর সুযোগ বুঝে ক্লোরোফর্ম শুকিয়ে― বাকিটা আন্দাজ করে নিন আপনি বিচক্ষণ মানুষ…
লোকটা থামল। তারপর দাঁত কেলিয়ে আবার বকতে থাকে―
“কিন্তু আসল গল্পটা কেউ জানে না। সেই রাতে পঞ্চানন আরও ফোর্স নিয়ে ফিরে আসে। বাথটাবে পাওয়া যায় কৃশানু সেনের পোড়া দেহ। শরীরের ভেতর থেকেই তিনি জ্বলে পুড়ে শেষ হয়েছেন। বাথটাব ভরতি জলও তাকে বাঁচাতে পারেনি। খুব স্ট্রেঞ্জ তাই না! রজত পাল আর অমৃতাদেবীকে একসঙ্গে পাওয়া যায় দোতলার বেডরুমে। পুলিশ যখন পৌঁছয় রজত তখন অমৃতাদেবীর মৃতদেহের সঙ্গে ধর্ষণ করছিল। গা গুলিয়ে ওঠা দৃশ্য ছিল মশাই! আমি জানি। আমি ছিলাম সেখানে―
লোকটা মিটি মিটি হাসল। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করল। একবার ডান দিকের কাটুন বাক্সের ভিড়ে মিশে যায় তো একবার বাম দিকের। সন্দীপ কাকু― টুকি! বলে খিলখিলিয়ে হাসে আবার লুকিয়ে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ লুকোচুরি খেলার পর লোকটা ভ্যানিশ হয়ে যায়। সন্দীপের বেশ ভয় করতে থাকে। এরম সাইকো কিলারের কথা শুনেছে। এরা মানসিক বিকারগ্রস্থ জানোয়ার হয়। পারে না এমন কাজ নেই। নৃশংসতায় এরা আনন্দ খুঁজে পায়। মনে হয় না প্রাণ হাতে নিয়ে এই গোডাউন থেকে বেরতে পারবে। উৎসুক দৃষ্টিতে লোকটাকে খুঁজতে থাকে সন্দীপ।
“সন্দীপকাকু― টুকি!” সন্দীপ শিউরে ওঠে। পেছন থেকে এসে লোকটা ওর কানের কাছে চিৎকার করে ওঠে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে―
“আপনি অযথা ভয় পাচ্ছেন। আমি, আপনি, কৃশানুবাবু, অমৃতাদেবী সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছি। তবে কিছু প্রশ্নের উত্তর কেবল আপনি জানেন। সেটা না জানা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। জানেন মেয়েলি কান্না বড় ভালো লাগে আমার। মাঝে মধ্যেই শুনতে মন চায়। ইন্টারনেট ঘেঁটে পেলামও কিছু অডিয়ো ক্লিপ। পোষাল না মশাই। লাইভ শোনার মজাই আলাদা। কী করব বলুন! দুটো মেয়েকে তুলে নিয়ে আসতে হল। একটাকে কাল আর একটাকে একটু আগে খতম করছি। ওদের সুর তালে বড্ড গাফিলতি ছিল। বিশ্বাস করুন নানাভাবে ভয় দেখিয়েছি; লোহার রড দিয়ে পিটিয়েছি লাভ হয়নি। অমৃতাদেবী বড় দরদ দিয়ে কাঁদতেন। ওনার কান্নার সুর আমি ভালোবাসি যেরকম আপনি ভালোবাসেন ওঁর মোহময়ী শরীরকে। তাজ্জব বনে গেছেন তাই না। ভাবছেন কী করে জেনেছি মনের গোপন অভিসন্ধী। আসলে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে শয়তান ঘুমিয়ে থাকে। তাকে জাগানোর জন্য একটু আলোর প্রয়োজন। একটা নীলাভ আগুনের গোলা।
“সে রাতে আমিও ওদের মতন শেষ হয়ে যেতাম যদি না শেষ সাহসটুকু সঞ্চয় করে পিস্তলটা হাতে নিতাম। অমৃতাদেবীর শরীরটা কৃমির মতন বুকে হেঁটে ধরতে চেয়েছিল আমাকে। মাথায় একটা বুলেট ঠুকে ওঁকে শান্ত করাই। তখন যদি জানতাম ওঁর কান্নার সুর আমার এত প্রিয় হয়ে উঠবে― থাক যেটা সম্ভব নয় সে কথা তুলে লাভ নেই। তারপর পিস্তলটা সযত্নে প্যান্টের পকেটে গুছিয়ে রাখলাম। আতঙ্কের পারদ নেমে গিয়ে মাথায় তখন অন্য চিন্তা এসে জুটেছে। বড় সড় ধরনের কেস খাব। পিস্তলটি বেআইনি। দ্বিতীয়ত, অ্যালিবাই কী দেব। যদিও পঞ্চানন সাক্ষী আছে তবুও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থাকবে। এ জন্মের মতন পুলিশের চাকরি করা গেল। টেনশনে ঘরের মধ্যে পায়চারী শুরু করলাম। পুলিশ ফোর্স আসার আগেই অন্য কোনও গল্প ফাঁদতে হবে। সেইমতো এভিডেন্স সাজাতে হবে। দোতলায় হন্য হয়ে কৃশানুবাবুকে খুঁজলাম― নেই। ওর ঘাড়ে দোষ চাপানো যায় আরামসে।
“একতলায় নামলাম সন্তর্পণে। কিচেনের পাশে একতলায় বাথরুমের সামনে গিয়ে আমার নজর আটকে গেল। অন্ধকারের মধ্যে নীলচে আভা। সেটা লক্ষ্য করে বাথরুমে গিয়ে পৌঁছলাম। কৃশানুবাবু ল্যাংটো হয়ে বাথটাব ভরতি জলের মধ্যে শুয়ে শুয়ে কাঁপছিলেন। সারা শরীর জুড়ে নীলচে আলোর রেশনাই। অদ্ভুত ছিল তার মুখের অভিব্যক্তি। কখনও যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছেন, কখনও আবার বিষাদগ্রস্ত। সর্বাঙ্গের চামড়া সঙ্কুচিত-প্রসারিত হয়ে দিকবিদিক শূন্য ঢেউ সৃষ্টি করেছে। বুঝলাম, বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই যে পচা ডিমে গন্ধ পাচ্ছিলাম সেটা বাথটাব থেকেই আসছিল। আমার আগমনেও কৃশানুবাবুর কোনও ভ্রূক্ষেপ ছিল না। হয়তো শেষ কয়েকটা মুহূর্ত গুনতে ব্যস্ত ছিলেন। আমি জানি সেদিন কৃশানুবাবুর অন্তরদহনের কারণ ছিল তার নিজের বিবেক।
“সোনাপাহাড়ির সেই পরিত্যক্ত খনি থেকে ফিরে আসার পর ওঁর মধ্যে পরিবর্তন ঘটে। এক অদ্ভুত প্রতিভার অধিকারী হন। যত দিন যায় আপনার মনের গোপন কথা জানতে শুরু করেন। দুজনের স্মৃতি মিশে যায়। বন্ধুর কষ্ট লাঘব করতে ফোন করে আপনাকে এখানে ডাকে। প্রস্তাব দেয় অমৃতাদেবীকে ভোগ করতে। উলটোদিকে আপনিও অমৃতাকে ঘিরে কৃশানুর স্মৃতি দিয়ে নিজের আকাঙ্খা চরিতার্থ করছিলেন। কিন্তু স্মৃতি আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। আপনি রাজি হয়ে গেলেন। কী তাই না সন্দীপবাবু। সেই জন্যই তো আজকের ফ্লাইটের টিকিট কেটেছিলেন।”
এতক্ষণ মুখে রুমাল গোঁজার দরুন সন্দীপের ভীষণ শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করে। গুঙ্গিয়ে গুঙ্গিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু লোকটির মনযোগ সে পায় না। লোকটা আনমনে নিজের গল্প বলতে ব্যস্ত।
“আপনার বন্ধুর ওই নারকীয় অবস্থা দেখে আমার বড় মায়া হল। আমি ওকে ছুঁতে গেলাম। সেটাই হল আমার কাল। কৃশানুকে ছুঁতেই হাতটা ঝলসে উঠল। ডান হাতটা দিয়ে চেপে রইলাম কিছুক্ষণ। এখনও মাঝে মাঝে হাতটায় ব্যথা হয়। অথচ না পড়েছে ফোস্কা না আছে কোনও ক্ষত। যখন তখন হাতটা চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করে। যদিও খাইনি আজ পর্যন্ত তবে একদিন না একদিন খাবই। দেখবেন নাকি? এই দেখুন। হাতের রেখাবিহীন সুন্দর বলিষ্ঠ হাত। আপনার কাছে এটা নতুন কী। আপনার হাতের অবস্থাও যে একই। আমারা যদি এখন জ্যোতিষকে হাত দেখাতে যাই কী কেলোর কীর্তি হবে মশাই ভেবে দেখুন। রেখাই খুঁজে পাবে না তো ভবিষ্যত কী বলবে। ধুত্তরি ছাই! আপনি তখন থেকে রুমাল মুখে কী বলতে চাইছেন। বড়ই বাজে বকেন আপনি। দাঁড়ান আগে আমি শেষ করি তারপর।
“হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম― হাতের যন্ত্রণা লাঘব হতেই দেখি কৃশানুবাবু মরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তারপর ধীরে ধীরে নিজের মুখটা খোলেন। একটা স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব তার তিনগুণ বড় হাঁ করেন তিনি। আমি মন্ত্রমুখ হয়ে চেয়ে থাকি। ওঁর মুখের ভেতর, জিভে― জলবসন্তের গুটির মতন অজস্র ফোস্কা। আয়তনে ছোট-বড় ফোস্কা দিয়ে স্তরে স্তরে সাজানো মুখগহ্বর থেকে উঠে আসে একটি নীলাভ আগুনের গোলা। গোলাটা বাতাসে ভর করে ক্রমশ ওপরের দিকে ওঠে। আমার মুখের চারিদিকে কিছুক্ষণ ভেসে থাকার পর আমার মুখে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
“ব্যস― তারপরই আপনার ইচ্ছেটা হঠাৎ আমার ইচ্ছে হয়ে উঠল। সে ইচ্ছে এতটাই প্রবল ছিল যে থাকতে পারিনি। অমৃতাদেবীর লাশটা তুলে নিয়ে গেলাম দোতালার বেডরুমে। তারপর ঘপাঘপ শুরু। পুলিশ এসে পুরো মজাটাই নষ্ট করে দেয়। পঞ্চানন তো অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। সে রাতে ওর ওপর দিয়ে অনেক ফাঁড়া গেছে। বে-চা-রা! ওর মুখ দেখে আমার বেজায় হাসি পাচ্ছিল। তারপর সুযোগ বুঝে চলন্ত জিপ থেকে লাফিয়ে ফেরার হয়ে যাই। অপেক্ষা করি কবে আপনি দেখা দেবেন।
“বুঝলেন তো আমার মধ্যের আমিটা আর আমার নেই। কিছুটা আপনি কিছুটা কৃশানু কিছুটা অমৃতা হয়ে থেকে গেছে। ভেতরটা মাঝে মধ্যেই খুব জ্বলে। বিবেকের দংশন কিনা জানি না। এই বিল্ডিংটায় সাত সাতটা তলা আছে সন্দীপবাবু। প্রায় সব তলা থেকেই ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। পারিনি। কিংবা ঝাঁপ দিয়েছি, হয়তো অন্য কেউ হয়ে ফিরে এসেছি। সেটাও সম্ভব। আয়নায় নিজের মুখ দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। থাক আবার অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে আনছি। এমনিতে সন্ধ্যা নামতে যায়। আমায় আবার বেরোতে হবে। আরও একটা কান্না শোনানোর খেলনা জোগাড় করতে হবে। আপনি চাইলে ফষ্টিনষ্টিও করতে পারবেন। কিন্তু তার আগে ফটাফট বলে ফেলুন সোনাপাহাড়ির ওই পরিত্যক্ত খনিতে কৃশানুবাবু আর আপনার সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল। ওটা না জেনে তো শান্তিতে মরতেও পারব না। নিন শুরু করুন… ও সন্দীপবাবু! সন্দীপবাবু― ইস্! স-র্-ব-নাশ করেছে। ও সন্দীপবাবু! পটল তুললেন ক্যান! আমার উত্তরগুলো জানা যে ভীষণ দরকার…”
Tags: পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পরাগ ভূঞ্যা, হরর গল্প