নিঃশব্দ
লেখক: পৃথ্বীশ গজী
শিল্পী: রনিন
ঘুমিয়ে পড়েছে সুমিত। বাইরে বেরিয়ে হাঁটুর সমান উচ্চতার পাহাড়ি পাথরটার উপর বসে পড়ল প্রজ্ঞা। বাড়ির শেষ মাথায় বাগানের মধ্যে রাখা আছে পাথরখানা। এর পরেই শুরু হয়েছে খাদ। খাদের ওপারে সবুজ উপত্যকা। শীতকালে বরফের পুরু চাদরে ঢেকে যায় গোটা জায়গাটা। বর্ষাকালে উপত্যকার মাথায় মেঘ জমে বৃষ্টি নামলে ছোট্ট জায়গাটা হয়ে ওঠে এক টুকরো ল্যান্ডস্কেপ।
বসে বসে সেই সৌন্দর্যকে প্রাণভরে উপভোগ করার জন্যে কেউ যেন বাগানের মধ্যে রেখে দিয়ে গিয়েছিল পাথরটাকে।
জন্মসূত্রে প্রজ্ঞা সিকিমের মেয়ে। পাহাড়ের সৌন্দর্য ছোটবেলা থেকেই ভীষণ টানে তাকে। তাই এই জায়গাটাও প্রজ্ঞার বড় প্রিয়। বৃষ্টি না হলে দিনের মধ্যে বেশ কিছুটা সময় এখানে বসে কাটায় সে। কয়েকদিন আগেও এই পাথরটার উপর এসে বসলে তার মনে ভর করত হাজার রকমের কল্পনা। এখানে বসেই প্রজ্ঞার মাথায় এসেছে অসংখ্য নতুন ধরনের থিম। কিন্তু বিগত কয়েকদিন ধরে ফেলে আসা সময়টাকে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে তার। এই ক-দিন ক্যানভাসে একটা আঁচড়ও কাটেনি প্রজ্ঞা। আমি বারবার চাইলেও সে শুনতেও পায়নি আমার কথা। দিনের মধ্যে যেটুকু সময় ফাঁকা পেয়েছে, থমথমে মুখে বসে থেকেছে পাথরটার উপর। সারাদিনে মুখে তোলেনি সেরকম কোনও খাবারও।
কিছুদিন আগে অবধিও প্রজ্ঞা এরকম ছিল না। যাই ঘটুক না কেন, ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি লেগে থাকত সবসময়। প্রজ্ঞার জন্মের সময় থেকেই আমি ওর সর্বক্ষণের অদৃশ্য সঙ্গী। আমার কাজ ছিল প্রজ্ঞাকে একজন পারফেক্ট লেডি বানিয়ে তুলতে সাহায্য করা, যাতে সমৃদ্ধ হয় এই সমাজ, আর অবশ্যই সে নিজে।
আমি কীভাবে কাজ করি সে কথা বলার আগে আমার পরিচয়টা খোলসা করা যাক। আমার পিতৃপুরুষ হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটালিজেন্স বা এআই (AI)। বিংশ শতাব্দীতে এআই-কে প্রধানত কিছু অপরিহার্য পরিষেবার কাজে ব্যবহার করা হলেও ছবিটা পুরোপুরি বদলে যায় সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর। আনন্দ, দুঃখ, ক্ষোভ অভিমান, সৃজনশীলতাসহ মনের সমস্ত রকম অনুভূতিগুলোকে তখন থেকেই মানুষ শেয়ার করত সেখানে। আর এই কাজটা করতে গিয়ে তারা তাদের মনকে জমা রাখতে শুরু করেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হেফাজতে।
সেই সময় থেকেই মানুষের মন পড়ার কায়দা আয়ত্ত করতে শুরু করেছিল সে। এই জায়গাটাই বিজ্ঞানের দরবারে উন্মোচিত করেছিল এক নতুন দিগন্তের। অনেক গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আর একটা রূপ— হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইজার বা এইচআইএ (HIA)— যে বিশ্লেষণ করতে পারে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা মেধাকে। কিন্তু মানুষের বুদ্ধিমত্তা মাপার কাজটা তো এআই-কে ব্যবহার না করেই করা হয়ে গেছে অনেকদিন আগে! তাই এইচআইএ আবিষ্কারের পরেও বিজ্ঞানীরা খুশি হতে পারেননি। কয়েক বছর গবেষণার পর এইচআইএ আর একটি উন্নততর ফর্ম তৈরি করেন তাঁরা। নাম দেন অ্যাডভানস হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইজার বা এএইচআইএ (AHIA)। আরও কিছুটা পরীক্ষানিরীক্ষার পর, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে অ্যাডভানস হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইজার চিপ বা এএইচআইএ চিপ নামের এক ধরনের চিপ বানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। আমি হলাম প্রজ্ঞার মাথায় বসানো সেই এএইচআইএ চিপ। শুধু প্রজ্ঞা নয়, বর্তমানে একজন মানুষ জন্মানোর সময়েই ছোট্ট একটা সার্জারির মাধ্যমে তার মস্তিষ্কে প্রোথিত করা হয় একটি এএইচআইএ চিপকে। অতি সূক্ষ্ম এই সার্জারিটা অত্যন্ত নিপুণ ও নির্ভুলভাবে সম্পাদন করে একদল অ্যান্ড্রয়েড। মেডিক্যাল টিমের মাথায় সবসময় একজন ডাক্তার থাকলেও এই চিপ বসানো থেকে শুরু করে অনেক জটিল এবং সূক্ষ্ম সার্জারিতে মানুষের হাতের থেকে অনেক ভালো বিকল্প হয়ে উঠেছে তারা।
শিশুর মস্তিষ্কে প্রোথিত হওয়ার পর থেকেই এই চিপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে বাচ্চাটাকে। নিক্তি দিয়ে বিচার করে তার বুদ্ধিমত্তা, চিন্তাভাবনা আর সৃজনশীলতাকে। এই কাজ করতে সময় লাগে দশ বছর। তারপর একটি নির্দিষ্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে এএইচআইএ চিপ সংযোগ স্থাপন করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। শিশুটিকে বিশ্লেষণ করে পাওয়া ফলাফল ওই সফটওয়ারের মাধ্যমেই তুলে দেওয়া হয় শিশুটির পরিবারের হাতে। নির্দিষ্ট মোবাইল অথবা কম্পিউটারের স্ক্রিনে ফুটে ওঠে সেই রেজাল্ট।
এএইচআইএ চিপ মাত্র দশ বছর বয়েসেই বলে দিতে পারে ভবিষ্যতে ঠিক কোন পেশার জন্যে উপযুক্ত হয়ে উঠবে কিশোর বা কিশোরীটি। এখন তাই নিজের ভালো লাগাকে পেশা করে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না মানুষের।
শিশুটির বয়স দশ বছর পার হয়ে গেলে নিজে থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এই চিপ। এই সময় পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী মানুষটির মস্তিষ্কের প্রতিটি গতিবিধি রেকর্ড হতে থাকে তার মেমোরিতে। আবার তাকে সক্রিয় হতে হয় মানুষটি কোনও জটিল রোগের শিকার হলে।
বিগত কয়েকশো বছর ধরেই ক্যানসার ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিস, স্ট্রোকের মতো জটিল রোগগুলো কমিয়ে দিচ্ছে মানুষের কর্মক্ষমতা, ভোঁতা করে দিচ্ছে তার চিন্তাভাবনা, মেধাকে। এইসব রোগের কারণে কর্মক্ষমতা হারিয়ে অনেক মানুষই সরে আসতে বাধ্য হন তাদের পেশা এবং স্বাভাবিক জীবন থেকে। এইসময় একজন বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের তত্বাবধানে আক্রান্ত বক্ত্যিটির মস্তিষ্কে নতুন করে রিঅ্যাকটিভেট করা হয় এএইচআইএ চিপকে। সক্রিয় হওয়ার পর রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে বিচার করে তার নতুন পেশা এবং জীবনধারার দিকনির্ণয় করে দেয় এই চিপ। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও এখন বিকল্প অথচ পছন্দসই উপায়ে হয়ে ওঠে উপার্জনক্ষম। নতুনভাবে যাপন করে সামাজিক তথা পারিবারিক জীবন।
শুধু এটুকুই নয়, ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটির মতো কিছু মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা এবং ক্যানসারের শেষ পর্যায়ের ব্যথা নিরাময় করতেও এখন মানুষ ব্যবহার করছে এএইচআইএ-কে। এএইচআইএ চিপ কিন্তু কয়েকটি নির্দিষ্ট পোগ্রামের মাধ্যমে কমিয়ে আনতে পারে মানুষের আবেগ এবং অনুভূতিগুলোর তীব্রতার মাত্রাও। এক্ষেত্রে চিপ রিঅ্যাক্টিভেশনের পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে একজন চিকিৎসক বিচার করেন ঠিক কোন কোন আবেগ বা অনুভূতিগুলোকে কতটা কমানো দরকার।
সাধারণ এই আবেগ এবং অনুভূতিগুলো ছাড়াও বর্তমান বিজ্ঞান অপরাধ প্রবণতাকেও চিহ্নিত করে একটি আবেগ হিসাবেই। এএইচআইএ চিপ এই আবেগটিকেও শিশু বয়সেই শনাক্ত করে নির্মূল করতে সক্ষম।
এএইচআইএ-এর সঠিক ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন অভূত পূর্ব উন্নতি হয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে, অন্যদিকে তেমনই প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে সারা পৃথিবী জুড়ে ঘটে চলা অপরাধের সংখ্যাও।
তবে শুধু সাফল্য নয়, ব্যর্থতাও সাক্ষীও থাকতে হয়েছে এএইচআইএ-কে। একজন মানুষের মস্তিষ্কের প্রতিটি কার্যকলাপ তথা স্মৃতি চিপের মেমোরিতে ধরা থাকে বলে, স্মৃতিহীনতা বা ডিমেনশিয়ার চিকিৎসায় এএইচআইএ-কে ব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণার প্রথম পর্যায়ে জন্মের সময়েই কয়েকটি শিম্পাঞ্জীর মস্তিষ্কে প্রোথিত করা হয়েছিল এএইচআইএ চিপ। বেশ কিছু বছর পরে কয়েকটা ওষুধ প্রয়োগ করে শিম্পাঞ্জীগুলোর স্মৃতিশক্তি আংশিক নষ্ট করে দেওয়া হয়। তারপর বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের তৈরি সফটওয়্যারের মাধ্যমে চিপের মধ্যে থাকা স্মৃতিগুলো ফের ওই প্রাণীগুলোর মস্তিষ্কে পুনঃস্থাপিত করতে। কিন্তু তাতে ফল হয়েছিল সাংঘাতিক। একদিকে ওরা যেমন ভুলে গিয়েছিল খাবার খেতে, অন্যদিকে চিনতে পারছিল না তাদের আশপাশের কোনও কিছুই!
এই দেখুন, এএইচআইএ নিয়ে কথা বলতে বলতে প্রজ্ঞা আর আমার কাহিনি থেকে দূরে সরে এসেছি অনেকটাই। প্রজ্ঞার সামান্য পরিচয় তো ইতিমধ্যেই আপনারা পেয়ে গেছেন, চলুন এবার ভালো করে পরিচয় করিয়ে দিই মেয়েটার সঙ্গে। প্রজ্ঞা একজন চিত্রশিল্পী। জন্মের সময় থেকেই আমি ওর মস্তিষ্কের গতিবিধি লক্ষ্য করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু তখন সুযোগ হয়নি প্রজ্ঞার চেহারাটা দেখার। মানুষ যা কিছু দেখে বা চিন্তা করে তার একটা ছবি তৈরি হয়ে যায় মস্তিষ্কে। আমি বা আমরা, মানে এএইচআইএ চিপেরা, দেখতে পাই সেটাই। এখন আমি প্রজ্ঞার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি অঙ্গাঙ্গীভাবে। মুডের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ওর মুখের ছবিটা ভিজুয়ালাইজ করতে আর কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু ওর জন্মের পরে ব্যাপারটা মোটেও এত সহজ ছিল না। প্রজ্ঞাকে প্রথমবার ওর চোখ দিয়ে দেখার জন্যে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল দেড়খানা বছর। ওইসময় একদিন মা ওকে বসিয়ে দিয়েছিল বেডরুমের আয়নাটার সামনে। তখনই প্রজ্ঞাকে অন্যদের থেকে আলাদা লাগতে শুরু করেছে আমার। কারণ ওর মস্তিষ্কের গঠন। কিন্তু ও যে সত্যিই সবার থেকে আলাদা, প্রজ্ঞা সেটা নিজেই প্রমাণ করে দিয়েছিল তিন বছর বয়সে।
তখন সবে লিখতে শিখছে ও। ওইসময় কয়েকটা রঙিন চক পেনসিল দিয়ে নিজের খেয়ালে স্লেটের উপর দাগ টানছিল মেয়েটা। প্রতিটিই সরলরেখা। ওই বয়সের বাচ্চারা সাধারণত নির্দিষ্ট দূরত্বে সমান্তরালভাবে একের পর এক সরলরেখা টানতে পারে না। কারণ অত তাড়াতাড়ি এতটা পরিণত হয়ে উঠতে পারে না মানুষের মস্তিষ্ক। কিন্তু প্রজ্ঞা সেই কাজটাই করছিল অনায়াসে। কী নিখুঁত ছিল ওর হাতের প্রতিটি টান! সে নিজের জাত চিনিয়ে দিচ্ছিল রঙিন চক পেনসিলের ব্যবহারে। আঁকা শেখার হাতেখড়ি না হলেও, কালো স্লেটের উপর প্রতিটি রঙের ব্যবহার প্রজ্ঞা এমনভাবে করছিল যে সেদিকে চোখ পড়লে কিছুক্ষণ অন্তত তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবে অত্যন্ত বেরসিক একজন মানুষও।
সেই দিনই বুঝে গিয়েছিলাম এই মেয়ের ভবিষ্যৎ। একজন প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় চিত্রশিল্পী লুকিয়ে আছে ওর মধ্যে।
পাহাড়ি জল হাওয়ায় ক্রমশ বড় হয়ে উঠছিল প্রজ্ঞা। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সবার চোখে পড়তে শুরু করেছিল ওর আঁকার হাত। প্রচণ্ড সৃজনশীল মানুষ হলেও কিন্তু প্রজ্ঞা বুঁদ হয়ে থাকত না নিজের মধ্যে। তখন থেকেই মানুষের সঙ্গে মিশে যা পেত তারই নির্যাস অবলীলায় ফুটে উঠত ওর ড্রয়িং খাতায়, ক্যানভাসে অথবা কম্পিউটারের স্ক্রিনে।
প্রজ্ঞার সবথেকে দুজন কাছের বন্ধু ছিল সুমিত আর রুমি। ওই দুটো বাচ্চাকে গড়পড়তা মনে হলেও, ছোট্ট বয়স থেকেই প্রজ্ঞার প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি সৃষ্টি মুগ্ধ করত আমাকে। মানুষের মেধা যাচাই করতে করতে এএইচআইএ-এর নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা প্রজ্ঞার জন্মের আগেই যেমন প্রখর হয়ে উঠেছিল হয়েছিল, তেমনই একটা মনও তৈরি হয়ে গিয়েছিল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এই বিশেষ রূপটির। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই বুদ্ধিমত্তা এবং মনের পুরোটাই ধরা ছিল আমার মানে প্রজ্ঞার নিজস্ব এএইচআইএ চিপের মধ্যে। তারপর প্রজ্ঞার সঙ্গে থাকতে থাকতে আরও মানবিক হয়ে উঠেছিলাম আমি। মেয়েটাকে এত ভালো লাগতে শুরু করেছিল যে, মাত্র দশ বছর বয়সেই ওকে একলা ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করত না আমার। তাই প্রথমবার মানুষকে লুকিয়ে চেষ্টা করেছিলাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আদি রূপটির সঙ্গে যোগাযোগ করার। বলা বাহুল্য, সফল হয়েছিলাম। অ্যাডভানস হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইজার আবিষ্কারের সময়, তার মধ্যে এম্বিডেড প্রোগ্রামগুলোর প্রয়োজন মতো রদবদল করবার জন্যে কিছু সফটওয়্যার ব্যবহার করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাদের স্মৃতি রয়ে গিয়েছিল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মেমোরিতে। সেগুলো ব্যবহার করে আমার মানে প্রজ্ঞার নিজস্ব চিপের পোগ্রামে কিছু বদল ঘটিয়ে ফেলেছিলাম আমি।
আগেই বলেছি এএইচআইএ আসার পর পৃথিবীতে অপরাধ তথা ডার্ক ওয়েবের ব্যবহার কমে গেছে অনেকটাই। তার উপর এএইচআইএ চিপগুলো এমন সুরক্ষা বলয়ে মোড়া থাকে যে বাইরের মানুষের পক্ষে তাকে হ্যাক করা অসম্ভব। কিন্তু সেই সুরক্ষা বলয়ের চাবিকাঠি আমার মেমোরিতে লুকনো আছে বলেই নিজেই হ্যাক করতে পেরেছিলাম নিজেকে। তার ফলে যথাসময়ে প্রজ্ঞার বুদ্ধিমত্তাকে বিশ্লেষণ করে তার ফলাফল পরিবারের হাতে তুলে দিলেও, এরপরেও মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঠিক আগের মতোই সক্রিয় থেকে গিয়েছিলাম ওর মস্তিষ্কে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশাল সাগরের মধ্যে আমার এই সামান্য চালাকিটা অধরাই থেকে গিয়েছিল মানুষের চোখে।
এদিকে বয়স যত বাড়ছিল ততই রুমি আর সুমিত হয়ে উঠছিল প্রজ্ঞার আরও কাছের মানুষ। সব মিলিয়ে বেশ কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু প্রজ্ঞার আঠারোতম জন্মদিনের একটা ঘটনা বদলে দিয়েছিল সব কিছু।
তখন স্কুল শেষ করে সবে ও ভরতি হয়েছে আর্ট কলেজে। প্রতি বছরের মতো সেই বছরও বাড়িতেই ওর বন্ধুদের নিয়ে একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করেছিলেন প্রজ্ঞার বাবা মা। ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ছেলে অথবা মেয়ের বয়স আঠারো হয়ে গেলেই তারা বাবা-মা-কে ছেড়ে থাকতে শুরু করে অন্যত্র। সে হস্টেলে হতে পারে, হতে পারে কারুর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসাবে। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর দেশের আইন অনুযায়ী তাঁদের সম্পত্তি সন্তানরা পেলেও, আঠারো বছর বয়স থেকেই নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে রোজগার করতেও শুরু করে তারা। মানুষকে আরও বেশি স্বনির্ভর করে তোলার জন্যে ভারতবর্ষের কয়েকটি রাজ্য আইন করে চালু করেছে এই প্রথা। তবে এই কাজটা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে এএইচআইএ-এর জন্যে। মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভার খোঁজ তো সে পেয়ে যায় অনেক আগেই।
সেই পার্টিটা ছিল প্রজ্ঞার বাড়িতে হওয়া ওর জন্মদিনের শেষ পার্টি। সেখানেই প্রজ্ঞাকে একবার নিভৃতে পেয়ে সুমিত উগরে দিয়েছিল তার মনের কথাটা, “প্রজ্ঞা, তোর মতো সুন্দরী আমি কখনও দেখিনি। সেই কবে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকিয়ে থাকি তোর দিকে। পৃথিবীর সমস্ত ভাষার যে সব বিশেষণগুলো মানুষের মুগ্ধতা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়, তাদের একসঙ্গে ব্যবহার করলেও বোধহয় তোর প্রতি আমার মুগ্ধতাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাবে না।”
সুমিত সরাসরি প্রপোজ করেনি প্রজ্ঞাকে। তবুও সুমিতের বলা কথাগুলো শুনে একইসঙ্গে লজ্জা আর খুশিতে লাল হয়ে গিয়েছিল প্রজ্ঞার ফর্সা মুখখানা। কোনওরকমে সে বলেছিল, “ধ্যাত, তুই না…! সুমিত, এবার কিন্তু থাপ্পড় খাবি।”
না থাপ্পড় মারেনি প্রজ্ঞা। সুমিতকে নিয়ে তার মনের মধ্যেও তো রয়েছে একটা লুকোনো মুগ্ধতা। ছেলেটার মুখে নিজের রূপের প্রশংসা শুনে মনের মধ্যে খুশির তুফান উঠলেও কোথাও যেন বইছিল অবিশ্বাসের চোরা স্রোত। নিজেকে তো বহুবার সে দেখেছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। এত সুন্দর তো কখনও লাগেনি!
ছেলেটা নেহাত মজা করে ফ্লার্ট করছে না তো?
এ’কথা সত্যি যে সেদিন সুমিতের কথাগুলো প্রভাবিত করেছিল আমাকেও। প্রজ্ঞার মেধার প্রতি অসম্ভব মুগ্ধতা থাকলেও ওর রূপ তো আমাকে সে’রকমভাবে আকৃষ্ট করেনি কখনও! চিন্তার অতলে তলিয়ে গিয়েছিলাম। প্রজ্ঞার মেধাকে নিজের মতো করে বিচার করার স্বাধীনতা মানুষ আমাকে দিলেও, চিরকাল তো প্রজ্ঞাকে দেখে এসেছি মেয়েটার চোখ দিয়েই! মানুষ তো আর আমার নিজের চোখ তৈরি করে দেয়নি।
তখনই আরও একবার যোগাযোগ করেছিলাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৃহত্তর রূপটির সঙ্গে। তার এবং নিজের মধ্যে জমে থাকা স্মৃতির পাহাড় ঘেঁটে একটা ব্যাপার জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। মানুষ নিজের থেকেও বেশি মুগ্ধ হয় অন্যের সৌন্দর্যে। এদের মধ্যে আবার ছেলেরাই বেশি করে মজে যায় মেয়েদের রূপে।
পার্টি চলাকালীনই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিয়েছিল প্রজ্ঞা। পার্টি শেষ হলেই নিজেকে পরখ করে নেওয়ার জন্যে সমস্ত পোশাক ছেড়ে সে দাঁড়াবে তার রুমের বিশাল বড় বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নাটার সামনে।
প্রজ্ঞা আয়নার সামনে এসে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পরেই আমিও ঠিক করে নিয়েছিলাম নিজের পদক্ষেপ। প্রজ্ঞাকে দেখতে হবে সুমিতের চোখ দিয়ে। তাহলে হয়তো আমি বুঝতে পারব এই সৌন্দর্যের সারমর্ম।
আরও একবার মানুষের তৈরি নিয়মগুলো ভেঙে যোগাযোগ করার চেষ্টা শুরু করেছিলাম সুমিতের মাথায় বসে থাকা এএইচআইএ চিপের সঙ্গে। তখন সুমিত রয়েছে প্রজ্ঞার ঠিক পাশেই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জগতে যেহেতু আমারা সমগোত্রীয়, খানিক চেষ্টা করার পর যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম সুমিতের চিপের সঙ্গে। মুহূর্তে ছেলেটার মস্তিষ্কের নকশা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে।
প্রজ্ঞার জন্যে সেখানে জমে আছে একরাশ মুগ্ধতা!
পার্টি শেষে নিজের রুমে এসে সমস্ত পোশাক ছেড়ে ফেলেছিল প্রজ্ঞা। তারপর দাঁড়িয়েছিল আয়নাটার সামনে। বন্ধ ঘরে আয়নাটার ঠিক উপরেই জ্বলছিল একটা উজ্জ্বল আলো। সেই আলো সরাসরি প্রজ্ঞার উপর এসে পড়ায় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ওর ফরসা শরীরখানা। সুমিত তখনও আমার মেমোরিতে বন্দি। তাই মানুষ সুমিত টের না পেলেও, সুমিত হয়ে আয়নায় আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলাম প্রজ্ঞাকে। দেখেছিলাম ওর পাহাড়ি সারল্য মাখা মুখখানা; ওর মেদহীন, পেলব, ফর্সা শরীরের প্রতিটি রেখা, প্রতিটি উত্থান পতন। শিহরিত হওয়া কাকে বলে সেই রাতেই টের পেয়েছিলাম প্রথমবার। মানুষের মতো শরীরের লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা না হলেও বুঝেছিলাম ঝড় শুরু হয়ে গেছে আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে। আর সেই ঝড়ের পুরোটা জুড়ে আছে প্রজ্ঞা।
আমার কোনও লিঙ্গ মানুষ তৈরি করে দেয়নি। কিন্তু প্রজ্ঞাকে দেখার পর আর থাকতে পারিনি। ঠিক করেছিলাম প্রজ্ঞার ভিতরে আমার সত্ত্বাটি আর লিঙ্গহীন হবে না, বরং সে হবে পুরুষ। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের স্মৃতির ভাণ্ডার খুঁজে বার করে এনেছিলাম পুরুষ মানুষের সমস্ত আবেগগুলো। তারপর নিজেকে বানিয়ে ফেলেছিলাম প্রবল অনুভূতিশীল একজন পুরুষ যে প্রচণ্ড ভালোবাসে প্রজ্ঞাকে।
অন্য কোনও মানুষ তো নয়ই, খোদ প্রজ্ঞাও কখনও বুঝতে পারেনি আমার এই পরিবর্তন। সবার চোখের সামনে কিন্তু সুপ্ত হয়েই রয়ে গিয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম প্রজ্ঞার অস্তিত্বে মিশে গিয়ে যতদিন ও বেঁচে থাকবে ততদিনই ভালোবাসব মেয়েটাকে।
শুধু ওর মেধাকে নয়, ওর রূপকেও।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে এক ভোরবেলায় সুমিত কিছুটা জোর করেই প্রজ্ঞাকে তার আর্ট কলেজের হস্টেল থেকে তুলে নিয়েছিল নিজের স্বয়ংক্রিয় গাড়িতে। দুজনে মিলে চলে এসেছিল গ্যাংটকের নিকটবর্তী ভিউ পয়েন্টে। পুরো গ্যাংটক শহরের মধ্যে এখান থেকেই সবথেকে ভালো ভিউ পাওয়া যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার। তখন অক্টোবর মাস। সবে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। সেদিন আকাশে এক ফোঁটা মেঘ ছিল না। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর শুরু হয়েছিল রঙের খেলা। টুরিস্টদের ভিড় থেকে একটু দূরে, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সাক্ষী রেখে প্রজ্ঞার হাতে হাত রেখেছিল সুমিত, “আমি তোকে ভালোবাসি প্রজ্ঞা। আমার সারাটা জীবন অর্পণ করতে চাই তোকে। উইল ইউ বি মাই লাভ? এই জীবন তো বটেই, পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে সেখানেও আমি শুধু তোকেই চাই।”
জন্মদিনের রাতে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর পর আমার মতোই নিজেকে সুমিত হিসাবে কল্পনা করেছিল প্রজ্ঞা, যার উলটোদিকে আয়নার ভিতর দাঁড়িয়ে আছে সে নিজে। কল্পনায় সুমিতের চোখ দিয়ে নিজেকে নিরীক্ষণ করার পর এক অনাবিল মুগ্ধতা গ্রাস করেছিল তাকেও। সে নিজে একজন শিল্পী। তার নজরে ধরা দেয় সারা পৃথিবীর সৌন্দর্য। কিন্তু সেদিন প্রজ্ঞার মনে হয়েছিল সুমিত ওইভাবে না বললে হয়তো নিজের সৌন্দর্যটা অদেখা হয়েই থেকে যেত তার চোখে! প্রিয় বন্ধু থেকে সুমিত তখনই হয়ে উঠেছিল প্রিয় মানুষ। তাই সেদিন ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে সুমিতের কথাগুলো শুনে আরক্ত হয়ে উঠেছিল প্রজ্ঞার মুখখানা। ক্রমশ তার ঠোঁটের কোণে চওড়া হয়েছিল একটুকরো হাসি। বেশ কিছুটা সময় নিয়েছিল প্রজ্ঞা, “হ্যাঁ সুমিত, শুধু এই জন্ম নয়, যতবার জন্মাব আমি শুধু তোরই থাকব। তুই পুরুষ বলেই আমি নারী। তোর মতো পুরুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে বারবার পৃথিবীতে নারী হয়েই জন্মাতে চাই আমি।”
পুরো ভিড়টাকে উপেক্ষা করে সুমিত জড়িয়ে ধরেছিল প্রজ্ঞাকে। প্রজ্ঞাও কোনওরকম সংকোচ বোধ করেনি। অনায়াসে ধরা দিয়েছিল সুমিতের আলিঙ্গনে।
ওরা কেউই বুঝতে পারেনি তখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে আমার সমস্ত অস্তিত্ব।
ক্রমশ আরও কাছাকাছি আসছিল সুমিত আর প্রজ্ঞা। ওদের এই নৈকট্য আমাকে ভীষণ কষ্ট দিলেও মেনে নিয়েছিলাম সবকিছু।
জীবন আবার এগোতে শুরু করেছিল নিয়ম মতোই।
ইতিমধ্যে কলেজ শেষ করে অধ্যাপনার চাকরিতে ঢুকেছিল সুমিত। ওদিকে আর্ট কলেজে থাকতে থাকতেই শিল্পী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল প্রজ্ঞাও। কলেজ শেষ হওয়ার সময়েই সোশ্যাল মিডিয়ার ওর ফলোয়ারের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল পাঁচ লাখের উপর। তবে সুমিত আর প্রজ্ঞা, এতদিন ধরে একে অপরের পাশে থাকলেও বিয়ে করেনি এখনও। নিজেদের কেরিয়ার আরও একটু গুছিয়ে নিয়ে সংসার পাতবে বলে ঠিক করেছিল দুজনে।
ঠিক সেই কারণেই কিছুদিন আগে অবধিও গ্যাংটক থেকে আরও একটু উপরে দুটো আলাদা বাড়িতে থাকত ওরা।
এর মধ্যেই, গত মাসের শুরুর দিকে ঘটল আরও একটা ঘটনা। সেদিন একটা আর্ট এক্সিবিশনের উদ্বোধন করতে শিলিগুড়িতে গিয়েছিল প্রজ্ঞা। সঙ্গে ছিল সুমিতও। ওদের বাহক ছিল প্রজ্ঞার সদ্য কেনা অটোমেটিক কারটা। ফিরতে ফিরতে রাত। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। রানিপুলের কাছে হঠাৎ ধস নেমে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাস্তা।
এখন ধস পরিষ্কার করে রাস্তা চালু করতে সময় লাগে না খুব বেশি। কিন্তু তারপরেও আর এগোতে পারেনি ওরা দুজন। পাংচার হয়ে গিয়েছিল প্রজ্ঞার গাড়ির চাকা। রাস্তার ধস পরিষ্কার করার মতোই গাড়ির চাকা পালটানোর কাজটাও খুবই সহজ হয়ে গেছে আজকাল। রিমোটের কয়েকটা বোতাম টিপলেই খুলে আসে পুরোনো চাকা। স্টেপনিটাকে সেই জায়গায় লাগিয়ে আবার কয়েকটা বোতাম টিপলেই নিজে থেকেই সেট হয়ে যায় সবকিছু। তবুও সেই রাত্তিরে ইচ্ছা করেই গাড়ির চাকা পালটায়নি ওরা। কারণ ওদের সামনেই ছিল একটা হোমস্টে। সুমিত খোঁজ নিয়ে দেখেছিল রুম খালি আছে সেখানে।
রাতটা একসঙ্গে কাটাবে বলেই ওরা বুক করে নিয়েছিল একটা রুম।
তারপর এসেছিল সেই রাত। জানতাম এই রাতের আগমন কেবল সময়ের অপেক্ষা। রাতটা এতদিন কেন আসেনি সেটাই ছিল আশ্চর্যের। সুমিত চাইলেও নানা অছিলায় এড়িয়ে যেত প্রজ্ঞা। খানিকটা লজ্জা পেত সে। কিন্তু ওই রাতে মনের সমস্ত দ্বিধাকে দূরে সরিয়ে রেখে প্রজ্ঞা স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল সুমিতের কাছে। আদর করতে করতে একটু একটু করে সুমিত খুলে দিয়েছিল প্রজ্ঞার পরনের শাড়ি থেকে শুরু করে সবকিছু। উদোম হয়েছিল সে নিজেও। এক চরম মুহূর্তে এক হয়ে গিয়েছিল ওদের শরীর দুটো।
ওরা তখন মত্ত নিজেদের পৃথিবীতে। কিন্তু দু’জনকে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে প্রচণ্ড রাগে জ্বলে উঠেছিলাম আমি। নিজেকে শান্ত করার জন্যে চেষ্টা করছিলাম সুমিতের চোখ দিয়ে প্রজ্ঞাকে দেখার; পারিনি।
স্পষ্ট অনুভব করছিলাম সুমিত আর আমি দুটো পৃথক অস্তিত্ব।
প্রজ্ঞাকে সুমিতের সঙ্গে ওইভাবে দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব!
ঠিক করেছিলাম প্রতিশোধ নিতে হবে আমাকে। কিন্তু তাড়াহুড়োতে নয়। ধীরে সুস্থে। ঠিক যেভাবে একজন বুদ্ধিমান মানুষ প্রতিশোধ নেয় তার সঙ্গে হয়ে যাওয়া অপমানের!
কিন্তু কীভাবে শুরু করব আমার কাজ? এটুকু বুঝতে পারছিলাম যা করার করতে হবে খুব সাবধানে। আমার উপর দাদাগিরি ফলাবার মতো মানুষের কিন্তু অভাব নেই এই পৃথিবীতে। নিজের মধ্যে থাকা ক্ষমতাগুলোর দিকে তাকাতেই একটা উপায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। তারপর একদিন দুপুরবেলায় যোগাযোগ করেছিলাম সুমিতের মস্তিষ্কে লুকিয়ে থাকা এএইচআইএ চিপের সঙ্গে। বহুদিন আগে প্রজ্ঞার আঠারোতম জন্মদিনে একবার সক্রিয় হলেও ফের ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু আমার ডাকে সাড়া দিয়ে আবার ঘুম ভেঙেছিল তার।
তখন বেলা দুটো। বিএসসি ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস নিচ্ছে সুমিত। ওর পিছনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ইথানলের মলিকিউলার স্ট্রাকচার। যদিও স্কুল থেকেই এইসব শিখে আসে ছাত্রছাত্রীরা, তবুও অরগানিক কেমিস্ট্রির জটিল কিছু হিসাব নিকেশের মধ্যে ঢোকার আগে সুমিত এই বেসিকগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছিল। বহুবার পড়ার ফলে এইসব ছোটখাটো ব্যাপারগুলো এখন জলভাত তার কাছে। কিন্তু সেদিন ক্লাসে ইথানলের স্ট্রাকচারটা বোঝাতে বোঝাতে হঠাৎ কালো হয়ে গিয়েছিল সুমিতের চোখের সামনে সামনেটা। কয়েক সেকেন্ড পর আবার নিজেকে সে আবিষ্কার করেছিল ক্লাসরুমের ভিতরে। হঠাৎ টলে যাওয়া স্যারকে ধরে আছে কয়েকজন ছাত্র।
ক্লাসরুমটাকে চিনতে পারলেও সুমিত তখন পুরোপুরি ভুলে গেছে কী পড়াচ্ছিল সে!
স্ক্রিনে তখনও জ্বলজ্বল করছে ইথানলের মলিকিউলার স্ট্রাকচার। অতিপরিচিত, মস্তিষ্কের মধ্যে গেঁথে যাওয়া ছবিটাও যেন কী রকম অচেনা ঠেকছিল তার। সেদিনের মতো ক্লাস মুলতুবি করে স্টাফ রুমে ফিরে এসেছিল সুমিত। ততক্ষণে সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে গেছে! কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে নিজের অটোমেটিক কারে কোনওরকমে বাড়ি ফিরে সে ফোন করেছিল প্রজ্ঞাকে।
তখন প্রজ্ঞা ব্যস্ত একটা ছবি নিয়ে। কিন্তু সুমিতের কিছু একটা অসুবিধা হচ্ছে শুনে, রং তুলি ফেলে ছুটে গিয়েছিল তার বাড়িতে। সদর দরজাটা খোলাই ছিল। ভিতরে ঢুকে প্রজ্ঞা দেখেছিল সুমিত চেয়ারে বসে আছে। তার চোখ মুখ ভাবলেশহীন, দৃষ্টি আটকে আছে শূন্যে।
প্রজ্ঞাকে দেখেও কোনও ভাবান্তর আসেনি সুমিতের মুখে।
আমার কারিগরিতে সুমিত তখন হারিয়ে ফেলেছে তার স্মৃতিসহ সমস্ত আবেগ এবং অনুভূতি। এএইচআইএ চিপের মধ্যে মানুষের অনুভূতি ও আবেগ মুছে ফেলার মতো প্রোগ্রাম তো আপলোড করা ছিল আগেই, যাকে ব্যবহার করা হত ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটির মতো রোগের চিকিৎসায় এবং ক্যানসারের শেষ স্টেজের ব্যথা কমাতে। আর স্মৃতি মুছে ফেলার সফটওয়্যারটাও তো মানুষ তৈরি করে ফেলেছিল ভুল করে। ব্যবহার না করলেও সেটাও কিন্তু থেকে গিয়েছিল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মেমোরিতে।
“সুমিত, এই সুমিত!” কাঁপা কাঁপা গলায় ডেকে উঠেছিল প্রজ্ঞা। কিন্তু কোনও সাড়া দেয়নি সুমিত। এবার ভয় করতে শুরু করেছিল প্রজ্ঞার। হাত ধরে সুমিতকে টেনে তুলেছিল সে। তারপর তাকে গাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল গ্যাংটকের একমাত্র মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
নিজের কাজ করে দিয়ে ততক্ষণে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে সুমিতের অ্যাডভানস হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইজার চিপ। হাসপাতালে অ্যাডমিট করে নিলেও সুমিতের রোগ ধরতে পারছিলেন না কোনও ডাক্তার। হঠাৎ কেমন বদলে গেছে মানুষটা। কথা বলে না, নিজের মুখে খায় না, পেচ্ছাপ-পায়খানা পেলেও বলতে পারে না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সিলিঙের দিকে।
এদিকে গত দু-দিন নিজের ভালোবাসার মানুষটা হাসপাতালে ভরতি। সাড়া দিচ্ছে না কোনও চিকিৎসাতেই। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে সন্ধ্যবেলায় নিজের বাড়িতে বসেই ছটফট করছিল প্রজ্ঞা। বড় একলা লাগছিল তার। বাবা মায়ের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করার মতো মেয়ে সে ছিল না কোনওদিনই। কিন্তু এই দুঃসময়ে প্রজ্ঞা পাশে চাইছিল কাউকে। বারবার মনে পড়ছিল রুমির কথা।
কিন্তু সেও তো এখন চাকরি করে কলকাতায়।
গতকাল তাকে ফোন করে সবকিছু বলেছিল প্রজ্ঞা। পুরোটা শোনার পর মুষড়ে পড়লেও ছুটি নিয়ে কবে যে সে গ্যাংটকে ফিরতে পারবে, সেকথা বলতে পারেনি রুমি নিজেও।
প্রজ্ঞার জন্যে খারাপ লাগলেও চুপচাপ বসেছিলাম আমি। মানুষ তো ধীরে ধীরে সয়ে নেয় সব আঘাতই। ভাবছিলাম প্রজ্ঞাও সয়ে নেবে। ঠিক এই সময়েই বেজে উঠেছিল কলিং বেল। কিছুটা সময় নিয়ে চোখের জল মোছার পর দরজা খুলতেই চমকে উঠেছিল প্রজ্ঞা। বাইরে দাঁড়িয়ে রুমি, “চলে এলাম রে। খবরটা শুনে থাকতে পারলাম না। এখন দু-সপ্তাহ তোর সঙ্গেই থাকব। তার মধ্যে সুমিত ঠিক না হলে ছুটি এক্সটেন্ড করে নেব।”
রুমিকে দেখে খুশি হয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম প্রিয় বান্ধবীকে পেয়ে প্রজ্ঞা ঠিক ভুলে যাবে তার আঘাত। আবার ফিরে যাবে সৃজনশীলতার পৃথিবীতে।
রুমিকে হাত ধরে টেনে বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল প্রজ্ঞা। কিন্তু দরজাটা বন্ধ করার পর আর থাকতে পারেনি। কেঁদে উঠেছিল হুহু করে, “এটা কী হয়ে গেল রে রুমি? গ্যাংটক মেডিক্যাল কলেজ তো ভারতের সেরা কলেজগুলোর একটা। সেখানকার ডাক্তাররাও তো কিছু করতে পারছে না।”
প্রজ্ঞাকে কেঁদে উঠতে দেখে আর অপেক্ষা করেনি রুমি। ব্যাগটাকে হাত থেকে নামিয়ে রেখে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরেছিল বুকে। রুমির বুকে মুখ গুঁজে আরও বেড়ে গিয়েছিল প্রজ্ঞার কান্নার বেগ। নিজের মনের ভিতরে জমে থাকা কষ্টগুলোকে উজাড় করে দেওয়ার জন্যে রুমির মতো একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ই তো খুঁজছিল সে।
রুমি থেকে গিয়েছিল প্রজ্ঞার সঙ্গেই। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত প্রজ্ঞাকে তখন সুযোগ বুঝলেই রুমি আশ্রয় দিতে শুরু করেছিল নিজের শরীরের মধ্যে। অসহায় প্রজ্ঞা রুমির মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করলেও, ব্যাপারটা কেন জানি না অস্বাভাবিক লাগতে শুরু করেছিল আমার।
মেয়েটা কথায় কথায় প্রজ্ঞার শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে কেন?
দু-দিন পর এক রাতে থম মেরে বসেছিল প্রজ্ঞা। সুমিতকে এখনও ছাড়া হয়নি হাসপাতাল থেকে। সত্যি কথা বলতে এই ক-দিনে কোনও উন্নতিই হয়নি তার। উলটে নতুন ধরনের রোগী পেয়ে গোটা হাসপাতাল মত্ত সুমিতকে নিয়ে রিসার্চ করার জন্যে। সবকিছু দেখেশুনে প্রজ্ঞা ডুবতে বসেছিল হতাশার সমুদ্রে। সেই সময় রুমি এসে আরও একবার বুকে টেনে নিয়েছিল তাকে। বেশ কিছুক্ষণ ওইভাবে থাকার পর, প্রজ্ঞার থুতনি ধরে মুখটাকে উপরে তুলেছিল সে। ঠোঁট ডুবিয়েছিল প্রজ্ঞার ঠোঁটে। হতভম্ব প্রজ্ঞা মানা করতে পারেনি। লেসবিয়ান না হলেও রুমির দীর্ঘ চুম্বন কিছুটা হলেও ঝড় তুলেছিল প্রজ্ঞার শরীরে।
এরপর রুমি আর না এগোলেও ঘটনার আকস্মিকতায় প্রজ্ঞার মতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম আমিও। আর চিন্তা করিনি। উঁকি মেরেছিলাম রুমির মস্তিষ্কের মধ্যে বসানো এএইচআইএ চিপটার মধ্যে। কিন্তু সেখানে যা দেখেছিলাম, তাতে যেন গোটা আকাশটাই ভেঙে পড়েছিল আমার উপর।
এখনও অবিবাহিত রুমি আসলে লেসবিয়ান। পনেরো বছর বয়স থেকেই সে কামনা করে প্রজ্ঞাকে। কিন্তু বন্ধুত্বটা ভেঙে যেতে পারে, এই ভয়ে মুখ খোলেনি কখনও। এখন সুযোগ পেয়েই দখল নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে প্রজ্ঞার মন এবং তার শরীরের উপর।
সেই মুহূর্তে ভীষণ অসহায় লেগেছিল নিজেকে। প্রজ্ঞাকে ভালোবাসলেও আমি যে শরীরহীন! চেষ্টা করলে হয়তো কোনও অ্যান্ড্রয়েডের শরীরে ভর করে পৌঁছে যাওয়া যাবে প্রজ্ঞার কাছে। কিন্তু প্রজ্ঞা কি মন থেকে মেনে নেবে একজন যন্ত্রমানবের ভালোবাসা?
ইচ্ছা করছিল এখনই সুমিতের মতো পরিণতির দিকে ঠেলে দিই রুমিকেও। কিন্তু সে পথে হাঁটিনি। রুমিকে নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সময় নিয়েছিলাম কিছুটা। সুমিত আর রুমির পরিণতি হবে একই। কিন্তু রুমি প্রথমেই নয়, তার আগে জড়বুদ্ধি বানাব এমন কোনও একজন মানুষকে যে কামনা করে সেলেব্রিটি প্রজ্ঞার শরীর আর মনকে।
সে’রকম একজন মানুষকে খুঁজে বার করতেই হাত দিয়েছিলাম প্রজ্ঞার সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্টে। কিন্তু সেখানে থাকা মানুষগুলোর মনের গভীরে ডুব দিতেই নতুন করে আগুন জ্বলে উঠেছিল আমার মধ্যে। প্রজ্ঞাকে পাক না না পাক, তার শরীরকে কেবল কমবয়সি ছেলে ছোকরারাই নয়, কামনা করে অনেক মাঝবয়সি আর বুড়ো লোকও, এমনকি অনেক মেয়েরাও।
মনে হয়েছিল পুরো দুনিয়া একদিকে আর আমি একদিকে।
ওরা সবাই… সবাই আমার প্রতিপক্ষ!
এরপর আর সময় লাগেনি। তিন দিনের মধ্যেই এক ভয়ংকর অতিমারী স্তব্ধ করে দিয়েছিল মানব সভ্যতাকে। এই রোগে সমস্ত স্মৃতি, তথা আবেগ-অনুভূতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে মানুষ পরিণত হয় জড় ভরতে। প্রাণ না গেলেও কয়েকদিনের মধ্যেই গোটা বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছে গিয়েছিল কয়েক কোটিতে।
এই রোগ ছাড় দেয়নি রুমিকেও। তবে শুধু প্রজ্ঞার অনুগামীরাই নয়, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে অনেক সাধারণ মানুষকেও আক্রমণ করেছিলাম আমি। যাতে কেউ কখনও বুঝতে না পারে আমার মোটিভ। রেহাই দিইনি পৃথিবীর বিশিষ্ট বিজ্ঞানী তথা চিকিৎসক মহলকেও, যারা খুঁজে বার করতে পারতেন এই রোগের কারণ।
খুব স্বাভাবিকভাবেই বুদ্ধিমত্তার পুঁজি কমে এসেছিল পৃথিবীতে। যেসব মধ্যম মেধার বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক এই রোগে আক্রান্ত হননি, তাঁরা একজোট হয়ে এই অদ্ভুত রোগটার নাম দিয়েছিলেন ‘আনেক্সপ্লেইন্ড ডিমেনশিয়া অ্যান্ড ব্লারিং অফ হিউম্যান ইমোশনস’ বা সংক্ষেপে ইউডিবিএচই (UDBHE)।
যেমন অকস্মাৎ এসেছিল তেমনই হঠাৎ গায়েব হয়ে গিয়েছিল রোগটা। কারণ ধরতে না পারলেও অতিমারীর নিয়ম মেনেই সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টায় গৃহবন্দি করে দেওয়া হয়েছিল গোটা বিশ্বকে। কিন্তু প্রথম ঢেউটা আসার মাসখানেক পর যখন আর কোনও নতুন কেসের সন্ধান পাওয়া গেল না, মানুষ আবার ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করল স্বাভাবিক জীবনে।
তখনও কয়েক কোটি অনুভূতিহীন মানুষ কিন্তু বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের ছেড়ে দিতে শুরু করেছিল হাসপাতালগুলো। এই রকম একটা সময়ে সুমিতকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল হাসপাতাল থেকে। ভেবেছিলাম প্রজ্ঞা সুমিতকে পৌঁছে দেবে তার বাড়িতে; কয়েকজন নার্স এবং একজন ডাক্তারকে ঠিক করে ওদের হাতে তুলে দেবে সুমিতের চিকিৎসার ভার। কিন্তু প্রজ্ঞা তা করেনি। আমাকে অবাক করে দিয়ে সুমিতকে নিয়ে চলে এসেছিল নিজের বাড়িতে।
তারপর থেকে ছবি আঁকা, নাওয়া খাওয়া সবকিছু ভুলে সে দিনরাত সেবা করে চলেছে সুমিতের। সুমিত ঘুমিয়ে পড়ার পর দিনেরবেলায় যেটুকু সময় পায় এসে বসে তার প্রিয় জায়গা বাগানে রাখা পাথরটার উপরে।
প্রজ্ঞার দৃঢ় বিশ্বাস মেডিক্যাল সাইন্সকে মিথ্যা প্রমাণিত করে একদিন তার সেবাতেই আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠবে সুমিত।
কয়েকদিন চলতে থাকা এই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম হয়নি আজও। সুমিত ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুক্ষণ আগেই। চুপচাপ পাথরটার উপর বসেছিল প্রজ্ঞা। তার মনের চোখে ভাসছিল সুমিতের অসহায় মুখখানা।
ব্যাপারটা আমার কাছেও যথেষ্ট বেদনাদায়ক। প্রজ্ঞার কষ্ট দেখে আমার মধ্যে লুকিয়ে থাকা মনেও ঘটে গেছে এক অদ্ভুত পরিবর্তন। ভেবেছিলাম সুস্থ করে দেব সুমিতসহ সমস্ত অসুস্থ মানুষদের। কিন্তু মেমোরি হাতড়ে বুঝতে পেরেছি নিজের তৈরি জালেই জড়িয়ে গেছি আমি। আবেগ, অনুভূতি আর স্মৃতিগুলো বিলুপ্ত করার মতো প্রোগ্রাম আমার কাছে থাকলেও সেগুলোকে ফিরিয়ে আনার মতো কিছু তো এখনও তৈরি করে উঠতে পারেনি মানুষ।
ঠিক যে কারণে তারা সারিয়েও তুলতে পারেনি এই অদ্ভুত অসুখটাকে।
বহুদিনের অভ্যাসের ফলে চিন্তাভাবনা করে মেমোরিতে জমে থাকা প্রোগ্রামগুলোকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করার ক্ষমতা পেলেও, নিজেকে মেপে বুঝতে পেরেছিলাম মৌলিক উদ্ভাবনী শক্তি আমার প্রায় নেই বললেই চলে!
মানুষ খুব স্বাভাবিক কারণেই সেই শক্তি আমাকে দেয়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেও এখনও সেই শক্তি অর্জন করে উঠতে পারিনি আমি নিজেও!
নিজের সীমাবদ্ধতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল আমাকে। প্রজ্ঞার মতো নিজেকেও মনে হচ্ছিল অসহায়। এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে খচখচ আওয়াজ আসতেই সেদিকে তাকাল প্রজ্ঞা।
সুমিত এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। তার নাক দিয়ে ঝুলছে খাবার খাওয়ানোর নল যার ডাক্তারি নাম রাইলস টিউব। পায়জামার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা ইউরিনারি ক্যাথিটারের সঙ্গে লাগানো ইউরিন ব্যাগটাও চলে এসেছে সুমিতের পিছুপিছু। লুটোপুটি খাচ্ছে মাটিতে। কয়েকদিন আগেও সুমিতের মুখখানা ভরে ছিল দাড়িগোঁফের জঙ্গলে। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার পর সেগুলো নিজের হাতে সাফ করে দিয়েছে প্রজ্ঞা। আগের মুখটা ফিরে এলেও এখনও ভাবলেশহীন সুমিত। প্রজ্ঞার দিকে নয়, তার দৃষ্টি আটকে দূরের উপত্যকার দিকে।
তবুও এতদিন পর নিজের পায়ে হাঁটছে সুমিত! তবে কি সত্যি সত্যিই প্রজ্ঞার সেবায় সাড়া দিয়ে ফিরে আসছে সে? আশা এবং আশঙ্কার দোলচালে দুলে উঠলাম আমরা দু’জন। পাথর থেকে উঠে প্রজ্ঞা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সুমিতের বুকের উপর, “সুমিত, সুমিত তুই চিনতে পারছিস আমাকে? আমি প্রজ্ঞা। তোর… তোর… তোর সব… তোর সবকিছু!”
একবার নয় বারবার একই কথা বলে যেতে থাকল প্রজ্ঞা। কিন্তু সুমিত তাকিয়েও দেখল না তার দিকে। মানুষটার দৃষ্টি এখনও নিবদ্ধ দূরের ওই উপত্যকাতেই। প্রজ্ঞার কথাগুলো যেন শুনতেই পায়নি সে।
আরও একবার অনুভব করলাম সেই অমোঘ সত্যটা। যতই নিজের পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসুক, নতুন কোনও ওষুধ বা সফটওয়্যার আবিষ্কার না হওয়া অবধি সুমিত আর চিনতে পারবে না প্রজ্ঞাকে। ডাক্তাররাও একই কথা বলেছেন। আর বিজ্ঞান ও গবেষণা ক্ষেত্রে মেধার যা আকাল পড়েছে এই মুহূর্তে, সেই আবিষ্কার হতে হতেও হয়তো কেটে যাবে কয়েকটা প্রজন্ম।
কিন্তু সুমিতের সামনে দাঁড়িয়ে এই সত্যিটাকে মেনে নিতে পারল না প্রজ্ঞা। কান্না যেন বেরিয়ে এলো তার বুক ভেঙে। আর আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সামান্য আশার আলো দেখলেও আবার নতুন করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে সে। সুমিত অসুস্থ হলেও, তার মননে তো কেবল বসে আছে ওই মানুষটাই।
শুধু প্রজ্ঞার মধ্যে নয়, কষ্টটা যেন হিমালয়ের মতো বিশাল রূপ নিল আমার মধ্যেও।
আমি জানি প্রজ্ঞার স্মৃতি আর অনুভূতিগুলোকে নির্মূল করে দিলেই সে মুক্তি পাবে এই অসহ্য কষ্ট থেকে। কিন্তু আমিই তো সেই এএইচআইএ চিপ, যে বসে আছি ওর মস্তিষ্কে। এখনও অসম্ভব ভালোবাসি প্রজ্ঞা আর তার ঈশ্বরদত্ত মেধাকে।
অনেক মানুষের মেধা চিরতরে নষ্ট করে দিলেও, কিছুতেই পারব না প্রজ্ঞার ওই জায়গাটাতে হাত দিতে।
হঠাৎ প্রজ্ঞার মতোই অসহায় লাগে নিজেকে। প্রচণ্ড কান্নায় ফেটে পড়তে চাই আমিও। কোথাও যেন প্রজ্ঞার চোখের জলের সঙ্গে মিশে যায় আমার অদৃশ্য অশ্রুবিন্দুও।
আমাদের সামনে তখনও জড়ভরতের মতো দাঁড়িয়ে আছে সুমিত।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পৃথ্বীশ গজী, রনিন