দীপেন ভট্টাচার্যের কল্পজগতের সফর
লেখক: অনুলিখন: সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: জটায়ু
সাক্ষাৎকারে কল্পবিশ্বের পক্ষে দীপ ঘোষ, সুদীপ দেব এবং সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
নাসা এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া রিভারসাইড ক্যাম্পাসে গামা রশ্মি জ্যোতির্বিদ্যার গবেষক ও বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্য অসামান্য কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসিধর্মী গল্পও লেখেন। পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যায় অধ্যাপনার পাশাপাশি তাঁর সুদৃঢ় লেখনী স্পেকুলেটিভ ফিকশানের আড়ালে এক দার্শনিক অবয়বের মায়াঘোর রচনা করেছে অনেক গল্প এবং উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। আদতে বাংলাদেশের নাগরিক এই সদালাপী, সুভদ্র মানুষটির সঙ্গে এক সন্ধ্যায় অন্তরঙ্গ আড্ডায় জড়ো হয়েছিল কল্পবিশ্ব। সেখানে ঘণ্টাকয়েকের কথাবার্তার অবসরে দেশকালের ঘেরাটোপ পেরিয়ে সমাজ-সাহিত্য-রাজনীতির এক উন্মুক্ত প্রান্তরে পৌঁছে গেছিলাম আমরা। কল্পবিশ্বের পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারের বয়ান উঠে এল তেমনই সহজিয়া ভার্বেটিমের প্রকাশে।
কল্পবিশ্ব: প্রথমেই যে প্রশ্নটা করব সেটা এখনও আমাদের ভাবায়। সায়েন্স ফিকশনের সীমানা কীভাবে নির্ধারিত করা যাবে? সেখানে কতটা বিজ্ঞান অথবা কতটাই বা গল্প বলার মুন্সিয়ানা থাকবে, এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলে। কোন গল্পকে সায়েন্স ফিকশনের আওতায় আনতে পারি সেটা নিয়ে আপনার কী মত?
দী ভ: প্রথমেই বলে রাখি যেহেতু আপনারা এই নিয়ে চর্চা করার ফলে অনেক রকম গল্প পড়েছেন, তাই এই বিষয়ে আপনাদের ধারণা হয়তো আমার থেকে ভালো হবে। আমি খালি এইটুকু বলতে পারি যে একটা জগৎ আছে ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজম নিয়ে আর একটা জগৎ আছে সায়েন্স ফিকশনের। এখন সায়েন্স ফিকশনের মধ্যে নানারকম জনরা আছে অবশ্যই যেটা আপনারা জানেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজম, এই ব্যাপারটা এখন পৃথিবীর সমস্ত বড় লেখকরাই ফুটিয়ে তুলেছেন নানা আঙ্গিকে। মার্কেজের ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ এর একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ক্লাসিক্যাল বলতে আমরা যেমন জুল ভের্ণের কথা বলি, যেখানে একটা নির্দিষ্ট ধারা আছে। আমি বলি যে জুল ভের্ণের লেখায় যত না সায়েন্স তার চেয়েও বেশি অ্যাডভেঞ্চার আছে। কিছু সায়েন্স এর উপাদান ছিল, যেমন আমার মনে পড়ছে এক জায়গায় সাব-ক্রিটিক্যাল টেম্পারেচারে ঢিল ছোঁড়ায় জল বরফ হয়ে গেল… এটা যেন কোন গল্পে ছিল?
কল্পবিশ্ব: ‘অফ অন এ কমেট’ যেটা ফরাসিতে মনে হয় ‘হেক্টর সারভাদক’ নামে বেরিয়েছিল। অদ্রীশ বর্ধনের চমৎকার অনুবাদে প্রথমবার পড়া।
দী ভ: হ্যাঁ, তাই হবে হয়তো, আমার মনে হচ্ছিল বোধহয় ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ’। তা যাইহোক, যেমন লাভক্র্যাফট কি সায়েন্স ফিকশনের মধ্যে ফেলা যাবে কিনা সেটা নিয়ে অনেকের মধ্যে ধন্দ আছে। আমি নিজে যেমন ফেলব না সেই অর্থে। এডগার অ্যালেন পো’র কিছু গল্পে এর উপাদান আছে, মানে মিস্ট্রি গল্পের আবহে সায়েন্স ফিকশনের ছোঁয়া আছে। তবে মোদ্দা ব্যাপারটা হল এর বেশির ভাগটাই হয়তো ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজম এর মধ্যে পড়ে, সায়েন্স ফিকশনের মধ্যে পড়ে না।
কল্পবিশ্ব: মিস্ট্রি বা রহস্য গল্পের ক্ষেত্রে তো উনি অগ্রগণ্য একজন লেখক, দ্যু পঁ চরিত্রকে নিয়ে গোয়েন্দা গল্পের আদলে লেখাগুলোও চমৎকার।
দী ভ: ঠিক। আবার ক্লাসিক ভৌতিক গল্পের একটা অন্য ধারা আছে, যেটাও এর মধ্যে পড়বে না। ভৌতিক গল্পকে যদি আমি সায়েন্সের আবহে কোনও ব্যাখ্যা না দিতে পারি তাহলে সেটা ভৌতিক গল্পই হয়ে থাকবে। ‘নক্ষত্রের ঝড়’ নামে আমার একটা বই আছে, তাতে মানুষেরা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এমন ঘটনা উল্লেখ করা আছে। এটাকে ভৌতিকভাবে দেখানো যেতে পারে কিন্তু শেষ অবধি এটার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। কিছুটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রতিপাদ্য অনুসরণে একটা ব্যাখ্যা। শেষ পর্যন্ত ওই ব্যাখ্যাটাই আমাকে নিয়ে আসতে হবে এবং এ ব্যাপারে যিনি লিখছেন তিনি যেন খুব সচেতন থাকেন। সেই ঘটনাক্রমকে অলৌকিক পর্যায়ে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় না। লেখকের নিজের কাছে এই জায়গাটা খুব পরিষ্কার থাকতে হবে যে তিনি কি আদৌ সায়েন্স ফিকশন লিখতে চাইছেন, না ম্যাজিক রিয়্যালিজম। আমি যদি ‘নিস্তার মোল্লার মহাভারত’ এর কথা ভাবি…
কল্পবিশ্ব: আমরা এই গল্পের অনুষঙ্গটাই ভাবছিলাম।
দী ভ: হ্যাঁ, ‘নিস্তার মোল্লার মহাভারত’ আসলে সায়েন্স ফিকশন নয়। এটা সামাজিক গল্পই আদতে। এটার শেষ পর্যন্ত সে দেখতে চেয়েছে ভবিষ্যৎ, কিন্তু তাকে তা দেখতে দেওয়া হল না, লাইক দ্যা কসমস ইজ ইন্টারফেয়ারিং। আবার কুড়ি বছর পরে সে যা যা মনে রচনা করেছিল, তখন নিস্তার মোল্লার মেয়ে এসে বলল তোমার এই ভাবনাগুলো ঠিক নয়। মানে নিস্তার কোনও বিরাট গ্রন্থ রচনা করেনি কিম্বা যা রচনা করেছে তার কোনও অর্থ হয় না। আবার সে বলেছিল যে ঘরে আয়না ছিল এবং সেই আয়না দ্বারা সে খুবই প্রভাবিত হত। এখন এটার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই বা দেওয়া হয়নি। সেই অর্থে এটা ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজম। অপরপক্ষে, আমি যে ভবিষ্যৎ জানতে পারব না, সেটা কিন্তু কিছু কার্যকারণবশত একটা সায়েন্টিফিক ফ্যাক্ট।
কল্পবিশ্ব: মানে সেই কারণেই ওটা মুছে গেছে হয়তো…
দী ভ: একদম তাই। যেমন আমি আলোর গতিতে ভ্রমণ করতে পারব না। যেটা হলে কজাল রিলেশনশিপটা ঠিক থাকবে না মানে এফেক্টটা কজের আগে আসবে।
কল্পবিশ্ব: ইনফ্যাক্ট ওখানে আয়নগুলোর কোনও নির্দিষ্ট প্রপার্টি আছে যার ফলে হিস্ট্রিটা স্টোর হয়ে ছিল এরকম একটা কিছু ভাবা যায়।
দী ভ: হ্যাঁ, সেটা ভাবা যায়।
কল্পবিশ্ব: আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটা সায়েন্স ফিকশন গল্পের কথা। একটা খুনের দৃশ্য সেভ হয়ে থাকবে ওই ঘরে রাখা একটা আয়নায় তারপর বহুদিন পরে আবার সেটা দেখতে পাওয়া যাবে এমন একটা ঘটনাক্রম ছিল সেখানে।
দী ভ: হ্যাঁ, এরকমই একটা গল্পের চলন আসলে। এই গল্পে বীথি চরিত্রটি আসলে অমলকে এই কথাটাই বলছে, যে এই ইতিহাস ওখানে স্টোর হয়ে থাকতে পারত না। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে অমলের কাছেও এর ব্যাখ্যা নেই, তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল একটা এফেক্ট হিসেবে গল্পের শেষে একটা ছায়া আছে। মহাবিশ্ব আসলে ভাগ হয়ে যেতে পারে আর সে একটা ভাগের স্মৃতিকে ধরে রেখেছে আর বীথি আর একটা স্মৃতিকে ধরে রেখেছে। তবু আমিও সেভাবে এটাকে ব্যাখ্যা না দিয়ে ওপেন এন্ডেড রেখেছি বলে ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজমই বলব। যদি কিছুটাও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারি তাহলে আমি এটাকে সায়েন্স ফিকশন বলব আর ব্যাখ্যা ছাড়া উপস্থাপিত হলে সেটা ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজম, ভূতের গল্প ইত্যাদি। যেমন ‘দিতার ঘড়ি’ কাহিনিকে আমি সায়েন্স ফিকশনের মধ্যেই ফেলব কারণ তার মধ্যে একটা কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ব্যাখ্যা আছে। একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে নেওয়া একটা ডিসিশন, যার ওপর ভিত্তি করে মহাবিশ্ব ভাগ হয়ে গেছে। ওখানে একটা লেকচার আছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে যেটা অনেকে আবার পছন্দ করেন না (মৃদু হেসে)। আমি অনেকসময় বলি ওই জায়গাটা বাদ দিয়ে যাবার জন্য। একইভাবে নক্ষত্রের ঝড়ে একটা ব্যাখ্যা ছিল।
কল্পবিশ্ব: ‘অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো’ উপন্যাসেও ফন নয়ম্যান মেশিন নিয়ে একটা উল্লেখ আছে।
দী ভ: আসলে এটা ১২০ পাতার লেখা হলেও এরপর মোটামুটি পনেরো পাতা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা আছে, তারপর আবার গল্প ফিরে আসে। ওই পনেরো পাতা সলিড বিজ্ঞান মানে কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ওয়েভে মানুষের অদৃশ্য হওয়ার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যেটাকে এলিয়েন ওয়েভ নাম দিয়েছি।
কল্পবিশ্ব: এটা কি এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট এর মতো কিছু?
দী ভ: হ্যাঁ এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট এর মতোই প্রায়, মানে কাহিনির শুরুতে… আমি কি গল্পটা তোমাদের একটু বলব?
কল্পবিশ্ব: হ্যাঁ, অবশ্যই দাদা, আমরাও আগ্রহী শোনার জন্য।
দী ভ: প্রথম কাহিনিটা ছিল যে একটা ট্রেন ১৯৩০ সনে পশ্চিমবঙ্গেই কোনও একটা লাইনে আসছে। তা সেটা আসতে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে স্টেশন মাস্টার বিব্রত। তারপর আধঘণ্টা পরে ট্রেনটা যখন এসে পৌঁছল তখন দেখা গেল যে ট্রেনের একটা কম্পার্টমেন্টে কোনও লোক নেই। কিন্তু তাদের মালপত্র সবই আছে। আবার দ্বিতীয় এবং আরও কিছু কম্পার্টমেন্টে লোকজন আছে। আবার পরের দিকে আর একটা কম্পার্টমেন্টে লোক নেই। এটা একটা রহস্য হয়ে রইল। ডাকাতি, অপহরণ এমন নানা সন্দেহে ট্রেনের ড্রাইভারদের ধরা হল, কিন্তু শেষমেশ এর কোন সমাধান হল না। দ্বিতীয় কাহিনিটা হল একটা প্লেনকে নিয়ে যেটা আফ্রিকা থেকে সাউথ আমেরিকা আসছিল ১৯৫৫ সনে, ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ারওয়েজ কর্পোরেশনের প্লেন। তা ওই একইরকম ঘটনা প্রবাহে পাইলট এসে দেখে পেছনে সব যাত্রী এবং এয়ারহোস্টেজ উধাও। তৃতীয় ঘটনা ২০১৫ সালে ঢাকার। সেখানে একজন ইন্টারভিউয়ার ইন্টারভিউ করতে গিয়ে চায়ের কাপ উলটে ফেলে,তা সেই মহিলা সেটা তুলতে গিয়ে আর ওঠেন না মানে অদৃশ্য হয়ে যান। তারপর থেকে প্রচুর লোকজন অদৃশ্য হয়ে যাওয়া শুরু করল। একটা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ কী করে লোকজন অদৃশ্য হয়ে যাবে সেই ঘটনার সূত্রে ওই অমল চরিত্রের প্রবেশ। এইখানে কাহিনিতে দুজন চোর ঢুকবে এবং তাদের একজন অদৃশ্য হয়ে যাবে। এর মূল আইডিয়া হল, যদি কেউ একে অপরকে খেয়াল করে তা হলে অদৃশ্য হবে না। যদি ঘটনাপ্রবাহের ভিডিয়ো করা হয় তাহলে অদৃশ্য হবে না আর একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকে যায় যে কেউ যদি দৃঢ়ভাবে ভাবতে থাকে যে ‘আই এগজিস্ট’ তাহলেও অদৃশ্য হবে না সে।
কল্পবিশ্ব: এটা কি কিছুটা রেফারেন্স ফ্রেম, অবসার্ভেশন এইসব নিয়ে।
দী ভ: ঠিক, এটাই আন্দাজ করে এরা ব্যাপারটা ভিডিয়ো করতে শুরু করে। এরমধ্যে ভিনগ্রহী একজন এসে জানাবে অনেক আলোকবর্ষ দূরের এক সভ্যতার কথা। যারা অমরত্বের আশায় তাদের দেহকেই ইলেকট্রনিক সার্কিটে পরিণত করার চেষ্টা করেছে হাজার হাজার বছর ধরে। মানে মস্তিষ্ক হল গিয়ে বিভিন্ন লজিক গেটের এক জটিল বিন্যাস ইত্যাদি। কিন্তু এর ফলে তারা দেখবে যে তাদের মৌলিক সৃজনীশক্তি শেষ হয়ে গেছে। দেন দে ওয়ান্টেড টু গো ব্যাক টু দেয়ার অর্গানিক সেলফ। তখন তারা এমন একটা ওয়েভ পাঠাতে লাগল গ্যালাক্সিতে যেটা কনশাস ব্রেনের সঙ্গে ইন্ট্যার্যাক্ট করে তাদের একটা সিগন্যাল পাঠাবে। মানে ব্রেনের হায়ার লেভেল অব কনশাসনেস বুঝতে পারবে তারা। এই আবহেই গল্পের প্লট এগিয়েছে। এখানে আমার থিয়োরি হলে এই যে যদি আমি দেহের সব পার্টিকল আলাদা করে দিই তাহলে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই পার্টিকল এবং ওয়েভ এই দ্বৈত সত্তার একটা ডুয়ালিটি থাকবে। মানে আমি অবসার্ভ করলে এটা একটা পার্টিকল। আবার সেটাই এর মাঝখানে একটা ওয়েভ আকারে অবস্থান করবে যতক্ষণ না অন্য পার্টিকলের সংস্পর্শে আসে। তেমনিভাবে আমাদের শরীরেও একই ব্যাপার চলছে মানে প্রতি মুহূর্তে একটা রিকনস্ট্র্যাকশন হয়ে চলেছে এর মধ্যে। বৌদ্ধ দর্শনেও এমন একটা তত্ত্ব আছে। এক্ষেত্রে কোয়ান্টাম থিয়োরির একটা প্রসঙ্গ চলেই আসে। মহাবিশ্ব ভাগ হয়ে যাওয়ার অনুষঙ্গে সেই এভারেটের গবেষণায় মেনি ওয়ার্ল্ড ইন্টারপ্রিটেশন। তো আমরা হয়তো একটা নির্দিষ্ট অবস্থানে গিয়ে উপস্থিত হচ্ছি। এর আগে কী কী ঘটনা ঘটছে তার পারম্পর্যে আমাদের সেই পৌঁছনোর কিছু কার্য কারণ আছে। একইভাবে আমার পার্টিক্যালে রিকনস্ট্র্যাক্ট হবার সময় সেই ব্রেন ওয়েভটা এসে হয়তো বাধা দিচ্ছে, যার ফলে আমি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি। মানে কোনও দেশকালেই আমার অস্তিত্ব থাকছে না, সম্ভাবনাও থাকছে না ফিরে আসার। এটা মৃত্যুই একপ্রকার। আর একে অপরকে দেখলে যেটা হচ্ছে, যে তরঙ্গটা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ব্যস্ত হয়ে থাকছে। একে পদার্থবিদ্যায় ‘জিনো এফেক্ট’ বলে। আমি যদি একটা জিনিসকে দেখতে চাই তাহলে তার ওপরে আলো ফেলতে হবে। তা আলো ফেলার পরে যে আলোর সঙ্গে সে ইন্টার্যাক্ট করছে তার জন্য আরেকটা আলো যদি আমি ফেলি তাহলে সে সেটা ইগনোর করবে। যাইহোক এই ছিল মূল আইডিয়া। ওই ভিনগ্রহের তরঙ্গের সঙ্গে ইন্ট্রার্যাক্ট করে কোটি কোটি মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর ভিনগ্রহীরা জানাবে যে ঠিক এমন কনশাসনেস তারা খুঁজছিল না, ফলে তারা চলে যাবে। কিন্তু এই পুরো ঘটনাক্রম শেষ হতে আরও চোদ্দো বছর সময় লেগে যাবে। এখানে ব্ল্যাক হোলের প্রসঙ্গ আসবে। শেষ দৃশ্যে তিনজন সার্ভাইভার— একজন চোর, একজন আশি বছর বয়স্ক সার্জেন এবং অমল, এরা তিনজনে ভিডিয়ো ক্যামেরার দোকানে গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে আসবে। তখন শহরে আর সারা দুনিয়ায় পুরো ডিস্টোপিক আবহ। সৈন্যবাহিনী ট্যাঙ্ক নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে ইত্যাদি। এমন অবস্থায় ফিরে আসার পর তারা বাচ্চার কান্না শুনতে পাবে। তখন তারা বুঝবে যে এই তরঙ্গ হয়তো বাচ্চাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করেনি সেটা সুগঠিত না হবার জন্য। তারা আবার নতুন উদ্যমে বাচ্চাদের খুঁজতে বেরোবে ওই শহরে। আমি এত কথা বললাম কারণ এর মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু মূলগত সূত্র ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমি কি সফল হয়েছি এটা লেখার ক্ষেত্রে? বিভিন্ন লোকেরা হয়তো নানা কথা বলবে। ‘অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো’ বইতে যেমন পপুলার সায়েন্সের উপদান বেশি, মানে মহাবিশ্বের প্রসারণ ইত্যাদি। অনেকের ভালো লেগেছে। কিন্তু ‘নক্ষত্রের ঝড়’ বইতে সায়েন্সটা একটু ডেন্স বা হার্ডকোর ছিল যেটা সবাইকে সমানভাবে আলোড়িত নাও করতে পারে। এই ব্যাখ্যার পরেও কিন্তু ইন্টারেস্টিং নানা ঘটনার মোড় ছিল। যাইহোক, এখানে আমাদের সমস্যা হচ্ছে যে আমরা কতটুকু সায়েন্স রাখব? ‘অদিতার আঁধার’ বইতে যেমন আমি এই গুঢ় বিজ্ঞানের তত্ত্বে যাইনি। সেখানে গভীর দর্শনের একটা ন্যারেটিভ লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ‘নক্ষত্রের ঝড়’ এর পরবর্তী পর্ব লেখার ইচ্ছে আছে আমার যেখানে ওই তিনজন সার্ভাইভার শহরে বেরিয়ে পড়বে যে শহরে একটা অ্যাপোক্যালিপ্টিক আবহ তৈরি হয়েছে। ওই বাচ্চাটার একটা ভূমিকা থাকবে ওই চোদ্দো বছর টাইম ফ্রেমের পরে।
কল্পবিশ্ব: এর সূত্রেই আর একটা প্রশ্ন আসে যে আপনি লেখার সময় কি পাঠকের কথা ভেবে লেখেন না নিজের আনন্দেই গল্পের কাহিনি বিন্যাসে যা আসে সেইভাবেই লিখে যান?
দী ভ: আসলে দুটো ব্যাপার থাকে। আমি একটা লেখাকে কেন্দ্র করে বলার চেষ্টা করছি। ‘সিনেস্থেসিয়া’ গল্পের মধ্যে কালার অব সাউন্ড নিয়ে একটা ব্যাপার থাকলেও তার মূলগত আখ্যান ১৯৭১ সালের পাকিস্থানি আর্মির অত্যাচারের কাহিনি। গল্পটার শেষ আমি ভেবেই রেখেছিলাম এর আদলটা রূপ দেবার সময়। আবার অনেকে বলে যে গল্পের ফ্লোতে ন্যারেশনটা যায়।
কল্পবিশ্ব: আমি আসলে বলতে চাইছিলাম যে এই যে বিজ্ঞানের এতটা ব্যাখ্যা সেটা কতদূর পর্যন্ত যায়? মানে যেমন ‘অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো’ পড়ে আমার বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি কিন্তু আমার পরিচিত একজন বলেছেন যে এর মধ্যে যে আধুনিক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, ফন নয়ম্যান মেশিন ইত্যাদি সেটা অনেক সময় দুরূহ হয়ে যেতে পারে। এবার আমরা বইমেলায় একটা ফোরাম করেছিলাম যেখানে কলকাতার প্রথিতযশা কল্পবিজ্ঞান লেখকেদের অনেকেই এসে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে একজন বলেই ফেললেন যে ‘আমরা যেগুলো লিখছি তার পাঠক যদি হন একজন মানুষ যাকে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন ধরুন ট্রেনে, বাসে অনেকটা যাতায়াত করতে হচ্ছে। তার সাপেক্ষে বলি যদি হার্ডকোর দুরূহ সায়েন্স থেকে যায় গল্পে তাহলে সে তো বুঝতে পারবে না।’ এখানেই একটা প্রশ্ন আসে যে কে পড়বে সেটা ভেবে আমি কি লিখব নাকি গল্প বলার জন্য নির্লিপ্ত হয়ে লিখে যাব। গল্পের আখ্যানভাগের মধ্যে হার্ড সায়েন্স কতটা থাকবে মানে গল্পের প্লটের মধ্যে সেটা সম্পৃক্ত হয়ে থাকবে যেখানে আলাদা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে না, নাকি কিছুটা সায়েন্টিফিক ন্যারেশন থাকবে? আমরা যারা কল্পবিজ্ঞান লেখার চেষ্টা করছি এই প্রশ্নগুলো আমাদের কাছে বারবার ফিরে আসে। তাই আপনার মতামত জানতে আগ্রহী এই ব্যাপারে।
দী ভ: আমি সবাইকে বলি যে আমি ঠিক সাহিত্যিক বা গল্পকার নই। কিছুটা বাইরে থেকে দেখে যাই আমি। আর আমার মনে হয় না গল্পকারের দায়িত্ব সমাজকে উন্নত করা, তার নিজেরই কি সবটুকু ধারণা আছে সমাজ কীভাবে চলবে তা নিয়ে? পাঠক তার চেয়ে হয়তো অনেক বেশি জানে এই ব্যাপারে। এইজন্য দু-ধরনের গল্পের কথা ভাবি। এক ধরনের গল্পে বহিরঙ্গে বিজ্ঞান তেমনভাবে নেই কিন্তু পাঠককে আখ্যানের সঙ্গে নিবিষ্ট করার মতো করে লেখা। যেমন ‘মাউন্ট শাস্তা’ গল্পটা, সেখানে একটা দার্শনিক বিন্যাসে গল্পটা এগিয়েছে। সময় যে পিছু হটছে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা নেই। এই ধরনের গল্প যখন আমি লিখি তখন আমি এই ব্যাপারেই জোর দিই যাতে গল্পের নির্মান পাঠককে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু যেখানে হার্ডকোর সায়েন্স ফিকশন এর প্রশ্ন সেখানে আমার একটা দায়িত্ব থাকে যাতে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাটা ঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়। এই যে ‘নক্ষত্রের ঝড়’ গল্পে আমাকে ভাবতে হয়েছে যে এই যে মানুষগুলোকে অদৃশ্য করে দিলাম সেখানে বিজ্ঞানের সূত্রের আবহে কীভাবে আমি ব্যাপারটা ধরতে পারব। প্রায় ছ-মাস ধরে আমি গল্পটাকে সাজিয়ে ছিলাম। যাইহোক, মনে হয় ইট ওয়ার্কড। আমার এই এক্সপেরিমেন্ট ফেইলিওর হতে পারে কিন্তু আমার মনে হয়েছে আমার এই দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যেতে পারি না। যেমন ‘মনোনকে এক্সপেরিমেন্ট’ গল্পটাও পিওর সায়েন্স ফিকশন। সেখানেও অদৃশ্য মানুষের কথা আছে কিন্তু সেখানে ব্যাখ্যাটা ‘মোর মানডেন’ যেটা পৃথিবীতেই সম্ভব। তবে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে যায়, তা হল পাঠক তৈরি করা।
কল্পবিশ্ব: ঠিক, এটা আমরাও বিশ্বাস করি।
দী ভ: যেমন, ‘দিতার ঘড়ি’ মতো লেখায় আমি জানি না আমি সফলতা পেয়েছি কি না! কিন্তু এটা যখন লিখছিলাম তখন ‘লস্ট’ নামে একটা সিরিজ চলছিল। তার প্রথম তিনটে সিজন বেশ ইন্টারস্টিং কিন্তু তারপরে সেভাবে মেলাতে পারেনি। ওটা দেখে আমার মনে হয়েছিল যে যখন আমরা গল্প লিখি তখন খুব সহজে একটা সিকোয়েন্স দিয়ে স্যাটিসফ্যায়েড হয়ে যাই কিন্তু আসলে ইউ শ্যুড বিল্ড-আপ আপন দিস। আর তারপরে আস্তে আস্তে জটটা ছাড়াতে হবে। পাঠককে হয়তো কিছুটা পেন্সিল নিয়েও বসে থাকতে হবে এই নানা সিকোয়েন্সগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক ধরার জন্য। অনেকগুলো মিস্ট্রি লেয়ার থাকতে পারে কিন্তু আমার কাজ শেষে জটটা ছাড়ানো। তাও একটা ইনহেরেন্ট প্যারাডক্স আছে সেটার নাগাল হয়তো সবাই পায়নি। আমি যে কারণে বলছি তা হল পাঠককেও কিছু বৌদ্ধিক চ্যালেঞ্জ দেওয়া, এটাও আমাদের দায়ের মধ্যে পড়ে। মাউন্ট শাস্তা গল্পে যেমন একটা ইমেল দিয়েছিলাম, সেখানে অনেকজন মেল করেছিল। আবার আমি বলেও দিয়েছিলাম যে যদি আপনি এখানে মেল করেন, তাহলে আপনিও এক ধরনের এন্ট্যাঙ্গলমেন্টে জড়িয়ে পড়বেন, অতীতে যাত্রা করবেন সুতরাং সাবধান! নিস্তার মোল্লা গল্পে যেমন আমি প্রথমের দিকেই বলেছিলাম যে আপনার নামটা একবার উচ্চারণ করবেন আবার শেষেও আবার সেটা করতে বলা। এটা পড়ে অনেকে আবার অনেকে বলেছেন ব্রেখটিয়ান অভিঘাত, এলিয়েনেশন ইত্যাদি, মানে দর্শককেও নাটকের অংশ করে তোলা। জানি না এতটা সজ্ঞানে করেছি কিনা কিন্তু এই ধরনের গল্পের ন্যারেটিভের সঙ্গে পাঠককেও অঙ্গীভূত করা বা তাকে গল্পের চলনে অংশগ্রহণ করানোর একটা উদ্দেশ্য অবশ্যই থেকেছে আমার। এখানে আমার একটা দুর্বলতার কথা বলব। দেশে থাকলে হয়তো সমাজ-রাজনীতির প্রেক্ষাপট আরও ভালো করে আমি প্রতিফলিত করতে পারতাম সাহিত্যিকদের মতো। তবে এতদিন বাইরে থাকার ফলে হয়তো আমার কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। এর খারাপ ভালো দুটো দিকই আছে। আমার দেশের প্রেক্ষিতে তার সমাজ-রাজনীতির সবটুকু কার্য কারণ সম্পর্ক হয়তো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না সবসময়। আবার এর বিপ্রতীপে ঘটনাক্রমকে একটা বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করতে পারি এখন। হয়তো লেখাতে সেই বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে।
কল্পবিশ্ব: আপনার প্রথম দিকের জীবন সম্পর্কে যদি কিছু বলেন। মানে অধ্যাপনার সঙ্গে লেখালেখির সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে পড়লেন? কল্পবিজ্ঞান লেখার কথাই বা কীভাবে ভাবলেন।
দী ভ: আমার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন ঢাকাতে তারপর আঠেরো বছর বয়সে রাশিয়ার চলে যাই। সেখানে প্রথমে এক বছর ভাষাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান এইসব বিষয়ে পরবর্তী পাঁচ বছর পড়াশুনা করি মাস্টার্স অবধি। শেষের তিন বছর আমি মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করি। আপনারা গুগল করে দেখতে পাবেন তার বিশাল বিল্ডিং, যেটা স্ট্যালিনের আমলে নির্মিত। তার অসংখ্য কক্ষ, কোনদিক দিয়ে ঢুকে কোনদিক থেকে বেরোব তা গুলিয়ে যায়। সেই সময় আমি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পড়েছি রুশ ভাষায়। আসলে রুশ ভাষাতে আমি সেই সময় বিশ্ব সাহিত্যের অনেক কিছুর স্বাদ পেয়েছিলাম যার মধ্যে রুশ সাহিত্যের নিজস্ব বিরাট ক্যানভাস তো আছেই। তা ওই বিল্ডিং, তার বিশালত্ব আমাকে প্রভাবিত করেছিল। আমি সেই সময় মানে আমার তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সে একটা গল্প লিখেছিলাম এই নিয়ে, যার নাম ‘প্রাসাদ’। প্রাসাদের কাহিনিতে ছিল বহু বছর ধরে হয়ে চলা বৃষ্টিতে পৃথিবী জুড়ে বন্যা। শুধু প্রাসাদটাই বেঁচেছে। বন্যার জল কমে যাওয়ার পর একজন লোক ওই প্রাসাদে এসে নানা কক্ষ ঘুরে একটা ডায়েরি পায়। এই ভদ্রলোক কোথা থেকে এসেছে তা আমরা জানি না। ওই ডায়েরি পড়ে সে অতীতের তিনজন মানুষের নানা অলৌকিক কাহিনি জানতে পারে। এই কাহিনির মধ্যে অ্যাবস্ট্রাক্ট একটা ব্যাপার ছিল এবং সেই সময় আমি মার্কেজের রচনার দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম বলে এর মধ্যে ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজম এসেছে। পরে ‘নিওলিথ স্বপ্ন’ বইতে এটা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই লেখার পরে অনেককাল আমি কিছু লিখিনি। তখন আমি আমেরিকায় চলে গেছি পিএইচডি করার জন্য। সেখানে গ্যামা রে অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে আমি গবেষণা করি। পরে নাসায় যোগ দিই এবং তিন বছর কাজ করি সেখানে। তারপরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইডে যোগ দিই। এরপর ২০০২ সালে ‘নিওলিথ স্বপ্ন’ প্রকাশিত হয়। সেটা এখন পড়তে গিয়ে ভাবি বড়ই অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ছিল গল্পগুলো। তারপর ২০০৬ সালে ঢাকা থেকে বেরোয় ‘অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো’। তাহলে ভাবুন, আমি মস্কো ছেড়েছি ১৯৮৪ সালে আর ২০০২ সালে ‘নিওলিথ স্বপ্ন’ বেরিয়েছে। এটা প্রকাশিত হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিজেন শর্মার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। উনি না বললে বেরোত না। ওঁকেই উৎসর্গ করেছিলাম বইটা। আসলে এখন বুঝি সাহিত্যিক বলয়ের ওই আবহ না থাকলে লেখালেখি হয় না আমার মতো মানুষের। একক উদ্যোগে তো কিছুই হয়নি প্রায়। এই ফেসবুক আসার আগে তো আমার সঙ্গে সাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল না। আর দীর্ঘদিন বাইরে থাকার পর মোটামুটি ২০০০ এর পর থেকে আমি বাংলাদেশে আসা শুরু করি। সেই সময় বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের অনেকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়, কিন্তু সাহিত্য জগতের লোকেদের সঙ্গে তেমন পরিচিতি হয়নি। সেই সময় থেকেই আমার মনে হচ্ছিল পাঠক তৈরি করতে হবে বিশেষত বাংলা ভাষায় তুলনামূলক ধারার আরও পরিচিতি এবং উৎকর্ষের জন্য। যেটা আপনারাও বললেন। আমার অন্যতম একজন প্রিয় লেখক উরসুলা কে লে গুইন একটা কথা বলেছিলেন, “ক্যান সায়েন্স ফিকশন রাইটার্স রাইট?” উনি ভেবেছিলেন যে এই ধারার মধ্যে নানা নিরীক্ষামূলক লেখালেখির সুযোগ রয়েছে, আমাদের ভাষায় হয়তো ওই মাপে আমরা এখনও করতে পারিনি। সায়েন্স ফিকশনের আয়নায় আসলে সমাজটাকেই ভেঙে গড়ে দেখা উচিত। আর একটা রাজনৈতিক সমস্যা রয়ে যায়, যার ফলে অনেক প্রসঙ্গ আমরা সেলফ সেন্সর করি। নক্ষত্রের ঝড়ে যেমন একটাই এমন লাইন ছিল। যখন সবকিছু উধাও হয়ে যাচ্ছে তখন সাংবাদিক ফোন করে বলে যে সরকার বিরোধীপক্ষের লোকজনদের জেলে ঢোকাচ্ছে এই কারণে যে জেলে যদি অদৃশ্য হয়ে যায় তার কোনও দায়িত্ব বর্তাবে না। তা আমার প্রকাশক বলে যে সরকার শব্দটা যদি বদলে দেওয়া যায়। ‘শাত্যোয়ান্ত’ গল্পটা তো আসলে আমাদের দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেই নিয়েই। ধরো যদি অভিজিৎ রায়কে নিয়ে কিছু লিখি তাহলে তো এখনও বিপদের আশঙ্কা।
কল্পবিশ্ব: পাঠক তৈরির এই প্রসঙ্গটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন বিশ্বসাহিত্যের ক্ষেত্রে অনেক বিখ্যাত লেখা একটা ওপেন এন্ডেড জায়গায় শেষ হয়ে গেছে। তাকে পাঠকের মননে ধরা পড়া বা ইন্টারপ্রিট করার জন্য কিছুটা বৌদ্ধিক পরিশ্রম পাঠককেও করতে হবে। কিছু কিছু রস গ্রহণ হয়তো একোয়ার্ড টেস্টের মতন। এটা আমাদেরও মনে হয়েছে কিছু কিছু সহজপাচ্য লেখা (বা এই শব্দটা না বলে বলা যায় যে যাদের অভিঘাত নতুন আর কোনও দিশা দেখায় না সেইসব লেখাও) যেমন থাকবে তেমনই কিছু লেখা আবার ওপেন এন্ডেড লেখা হয়তো পাঠকের মনের মধ্যে জারিত হয়ে একটা রূপ বা আদল পাবে। আমার মনে হয় যে কোনও শিল্পী যখন সৃষ্টি করেন তিনি হয়তো একটা বিমূর্ত ছবি ভেবে নেন। অন্যপ্রান্তে রসিকজনের রসগ্রহণের আধারের মধ্যে হয়তো সেই সৃষ্টির নবজন্ম হয়।
দী ভ: আমি এটাকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আধারেই দেখি যে অবসার্ভ না করলে বিষয়টা মূর্ত হবে না। কাজেই পাঠক যতক্ষণ না গল্পটা পড়ছে ততক্ষণ এটার আখ্যান বাস্তবতার আধার পাবে না। এক এক জিনিস অবশ্যই এক একজন একেক ভাবে দেখবে বা ইন্টারপ্রিট করবে। ব্যাপারটা একটা পাজল বা ধাঁধার মতো। বাইরে অনেকেই এই পরীক্ষাটা করেন। ইটালো ক্যালভিনো আমার খুব প্রিয় একজন লেখক। ওঁর লেখায় যেমন দেখি একটা স্তর থেকে আরেকটা স্তরে এই ইন্টারপ্রিটেশন চলেছে। পড়তে গেলে অনেক সময়ই বেশ কিছু পাতা আগুপিছু করতে হয়।
কল্পবিশ্ব: বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডিফাইনিং ফ্যাক্টরগুলো কী হওয়া উচিত? মানে দেশকাল পরিবেশের সাপেক্ষে কোনও একটা সাহিত্যের যে মূলগত একটা ধাঁচ থাকা উচিত সেটা নিয়ে বলছি। ধরুন এই যে চাইনিজ সায়েন্স ফিকশন এতটা এগিয়ে আসছে যার মধ্যে তাঁদের নিজস্ব একটা পরিমণ্ডলের প্রতিফলন হয়েছে। ওয়েস্টার্ন সাইফি ক্যানন থেকে যেটা অনেকটা আলাদা। আমাদের এখানে মানে মূলত কলকাতা কেন্দ্রিক কল্পবিজ্ঞান লেখকেরা মূলত দুই ধরনের। এক, যারা সত্যজিৎ রায় এবং শঙ্কু দ্বারা প্রভাবিত এবং দুই, যারা অনেকটা বাইরের লেখালেখি পড়ার ফলে অনেকটা সেই ধরনের প্রভাব মুক্ত। এঁরা মূলত পাশ্চাত্য গোল্ডেন এজ সায়েন্স ফিকশনের ধারা মেনে লেখেন। কিন্তু আপনার লেখায় আমরা বাংলার সমাজ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা ছবি পেয়েছি বারবার। যেটা কখনই আরোপিত বলে মনে হয় না।
দী ভ: কয়েকটা ব্যাপার আছে। বাংলাদেশি হওয়ার ফলে ১৯৭১ সালের সামগ্রিক প্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধ কিছুটা দেশভাগের স্মৃতি মেদুরতা এসব প্রচ্ছন্ন বা কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবেই এসেছে আমার লেখায়। অনেকে বলেছেন যে আপনার লেখায় একটা হাহাকার থাকে শেষে। একটা কারণ হল ‘এক্সিস্টেন্সিয়াল অ্যাঙ্গস্ট’ অর্থাৎ এই অস্তিত্বের একটা বড় অর্থ খোঁজা। আমার সঙ্গে প্রকৃতির সামগ্রিক সম্পর্ক এবং তা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব আমি অনুভব করি তার একটা ছায়া থাকে আমার লেখায়। ওই হাহাকার হয়তো তারই দ্যোতক। এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ এবং আবার দেশ ছেড়ে চলে আসার অনুভূতিগুলো মিশে যায়।
কল্পবিশ্ব: দেশ ছেড়ে চলে আসার বিষয়টা বেশ কিছু লেখায় দেখেছি উঠে এসেছে।
দী ভ: অভিজিৎ নক্ষত্রের আলোতেও এই বিষয়টা এসেছে। এই ইতিহাসটা থেকে বেরোন যায় না। আবার সবাই কিন্তু ওই অনুভূতিটা ধরতে পারেন না। ‘অসিতোপল কিংবদন্তি’ বলে একটা লেখায় রং একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। তার ভাগটা যুদ্ধ পূর্ববর্তী আর যুদ্ধ পরবর্তী এই দুই অধ্যায়ে বিভক্ত। আমি এই গল্পটা যখন এক জায়গায় পড়লাম যেখানে শ্রোতারা মূলত বাংলাদেশি কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের। তাদের কাছে এই অভিজ্ঞতাটা নেই। তাঁদের কয়েকজন জানতে চায় যে কোন যুদ্ধের কথা আমি বলছি সেখানে। এই যে যুদ্ধের পর টালমাটাল পরিস্থিতি, লুঠপাঠ হচ্ছে এটা তারা বুঝতে পারে না। আর গল্পটার মধ্যে যেহেতু একটা ইউরোপীয় আঙ্গিক আছে তাই তারা ভাবছে যে এটা হয়তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশি লেখকদের লেখার মধ্যে এই মুক্তিযুদ্ধের একটা ছবি থাকেই। শঙ্কুর গল্পের যে আদল সেটা আসলে আমাকে আমার শিকড়ের সঙ্গে প্রোথিত করে না। আমার স্ত্রী গল্প লেখার প্রক্রিয়ায় আমায় অনেকটা সাহায্য করেন মানে যখন এই ভাবনা বা জারণটা চলতে থাকে ভেতরে ভেতরে। আমি একেবারে নতুন একটা গল্পের শেষটা আমার স্ত্রী লিসার সঙ্গে বারবার চিন্তাভাবনা করে সাজিয়েছি। এটা ওই ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজমের আঙ্গিকে লেখা কিন্তু আদলটা আমার লেখার চেয়ে অনেকটা আলাদা। একটা স্ট্রাকচার থাকে যদিও। কিন্তু এটা গল্পের ক্ষেত্রে বলা চলে। উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমি সত্যি জানি না এই চলনটা কোন পথে যাবে। ‘অদিতার আঁধার’ বা ‘দিতার ঘড়ির’ ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে, আমি জানতাম না ন্যারেটিভ কোন পথে যাবে। তবে আমার মতে এর আখ্যানগুলোর ক্ষেত্রে সুবিচার করা গেছে। তবে ছোটগল্প লেখার ক্ষেত্রে আমার মনে হয় পাঠকের সময়ের মূল্য অপরিসীম এটা অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত। হয় সে আমার গল্পের কাহিনি অংশে এনগেজ হবে অথবা ভাষা তাকে টানবে। জোর করে গল্প লিখতে পারি না আমি। যাইহোক, সত্যজিৎবাবুর ক্ষেত্রে আমার একটা অভিযোগ আছে যে তাঁর লেখা নারী চরিত্র বর্জিত। কেন উনি এই গ্যাপ রেখে দিয়েছেন সেটা নিয়ে আমার বিস্ময় জাগে। আমি সজ্ঞানে চেষ্টা করি আমার লেখার মধ্যে নারী চরিত্র রাখার জন্য বা অনেকক্ষেত্রে মুখ্য চরিত্রই নারী। ‘অদিতার আঁধার’ যেমন অদিতারই কাহিনি।
কল্পবিশ্ব: বাংলায় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের মধ্যে কাদের লেখা পড়ে আপনার ভালো লেগেছে?
দী ভ: আমি ছোটবেলায় প্রেমেন্দ্র মিত্র বা সত্যজিৎ রায় এঁদের লেখা পড়েছি। পরে তেমনভাবে আর এই ধরনের লেখা পড়া হয়নি বাংলায়। যেমন জগদীশচন্দ্র বসু বা হেমেন্দ্রকুমার রায় এঁদের লেখা। বা পড়লেও হয়তো প্যারাফ্রেজে পড়েছি। বরং বলা যায় বিভূতিভূষণ এবং রবীন্দ্রনাথ আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছেন।
কল্পবিশ্ব: বিদেশি লেখকদের ক্ষেত্রে যদি এই তালিকাটা বলেন যেমন উরসুলা কে লে গুইনের কথা বললেন।
দী ভ: বিদেশি লেখকদের ক্ষেত্রে এই চয়েসটা খুব স্পেসিফিক। মার্কেজ এবং বোর্হেস— এঁদের দুজনের রচনার প্রভাব অনেকটা আমার ক্ষেত্রে। উরসুলা কে লে গুইন আমার খুব প্রিয়। এ ছাড়া স্ট্রুগাটস্কি ব্রাদার্স, স্তানিসোয়াভ লেম, ইটালো ক্যালভিনো আমায় নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। ছোটবেলা ব্র্যাডবেরিও পড়েছি অনেক। বড় হয়ে অবশ্য আর পড়া হয়নি।
কল্পবিশ্ব: আপনার গল্পের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে গল্পের প্লটের চেয়েও চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক বা মিথোস্ক্রিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওই যে গল্পে এলিয়েনরাই পাশের বাড়ির ভাড়াটে হয়ে ছিল…
দী ভ: ‘পৃথিবীর ছায়া’।
কল্পবিশ্ব: হ্যাঁ, ওখানে গল্পের চরিত্রের জীবনগুলো জ্যান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে এলিয়েনের অনুষঙ্গের চেয়েও। যেটাকে হিউম্যান টাচ বলা যায়।
দী ভ: ধন্যবাদ। আমি নিজে তো একটা ঘোরে লিখেছি। এটা ময়মনসিংহের গল্প, আমি তো সেখানে থাকিনি কখনও। কিন্তু ওই পাড়ায় আমি গেছি। এই গল্পের শুরুতেও দেশভাগের একটা অনুষঙ্গ আছে। আমাদের পারিবারিক একটা ইতিহাসের ছায়াও আছে। যেমন আমার বাবাও ময়মনসিংহে ওকালতি করতেন, মা ওখানে স্কুলে পড়িয়েছেন আর আমরাও তিন ভাইবোন। মানে আত্মজীবনী না হলেও নিজের জীবনের উপাদান আছে ওই গল্পে।
কল্পবিশ্ব: আপনি প্রেমেন্দ্র মিত্র বা সত্যজিৎ রায়ের কথা বললেন। তাঁদের সময় থেকে এখন বাংলায় কল্পবিজ্ঞান লেখার ধারা কতটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আপনার মনে হয় মানে সেই পরিবর্তনটা কোন দিকে?
দী ভ: এই প্রশ্নের উত্তরেও আমি আমার অজ্ঞতা স্বীকার করে নেব প্রথমে। তবে যা খবর পাচ্ছি তাতে মনে হয় সামাজিক দৃষ্টিকোণটাও আস্তে আস্তে প্রাধান্য পাচ্ছে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির বর্ণনা ছাড়াও। তবে ভাষার একটা দিক আছে গল্পের স্ট্রাকচার ছাড়াও। আমার কাছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
কল্পবিশ্ব: আপনার গল্পে ভাষার একটা বড় দিক আছে সত্যি। নিছক বর্ণনাও লেখার মুন্সিয়ানায় একটা অপূর্ব রূপ নিচ্ছে।
দী ভ: শুধু গল্পের আদলটা থেকে হয়তো ন্যারেটিভ বা ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট একটা জায়গায় এল, কিন্তু তাকে সুসংহত রূপ দেওয়ার উপযোগী ভাষা চাই। একইভাবে একটা নতুন আঙ্গিকে পুরোটা বুনতে পারলে পাঠককে নিবিষ্ট করে রাখা যাবে, যেটা আমি চেষ্টা করি সবসময়। আমি একটা গল্পে তো চরিত্রকে সুড়ঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়েছি, তারপর একটা বড় বর্ণনা ছিল। যেখানে সে যে আসলে বেরোতে পারছে না, সেই অসহায়তাকেই আমাকে প্রকাশ করতে হবে। তার জন্য কিছুটা বড় বয়ানের প্রয়োজন, সেই আটকে পড়া সময়টাকে আমাকে বোঝাতে হবে। আসলে তাকে একটা মিলিটারি ক্যাম্পে পৌঁছতে হবে যেখানে একজন ঘড়ি নির্মাতা আছে। তা সে যদি সহজেই পৌঁছে যায় সেখানে তাতে গল্পের পারম্পর্য্য থাকলেও সেই গভীর অভিঘাত তৈরি করে না। খেয়াল আছে আমি লেখার সময় আমি নানাভাবে চিন্তা করে একটা দরজার ভাবনায় পৌঁছে যাই। সেই দরজা দিয়ে সে বেরিয়ে আসতে গিয়ে আসলে দশ বছর পেরিয়ে যায়। ঘড়িটা নিয়ে সুড়ঙ্গ দিয়ে যাওয়াটাই ছিল মেকানিজম, যা বিজয় আনবে। কিন্তু এই কাজটা তাকে বলা যাবে না। এই ভাবনায় পৌঁছনোর জন্য পরিশ্রম করতে হবে। এই আইডিয়াগুলো এক একটা বৌদ্ধিক এক্সারসাইজ। এখানে এই আইডিয়াটা কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ডবল স্লিট ইন্টারফেরেন্স, কিন্তু যদি ডিটেক্টর বসাই তাহলে আলো জেনে যাবে সেইকথা, আর পরীক্ষাটা সফল হবে না। এইভাবে বিষয়টা নির্মানের জন্য আমাকে একটা ভাবনার স্তরের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এখানে চরিত্র একজন মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তাকে বলা হয়নি যে এইভাবে তোমার জীবন থেকে দশটা বছর বলি দিতে হবে।
কল্পবিশ্ব: একটা কথা মনে এল, সায়েন্স ফিকশনে সমকালীন রাজনীতি কতটা আসতে পারে? মানে ধরুন কিছুটা নিয়ার ফিউচার এক্সট্রাপোলেশন করলাম কিন্তু তাতেও এই সময়ের রাজনীতির অনুষঙ্গটাও রয়েই গেল এমন লেখা। যেখানে চরিত্রের বহিরঙ্গের আড়ালে মানুষ ঠিকই বুঝবে কী বলতে চাইছি! অবশ্যই লেখনীর মুন্সিয়ানাতেই ব্যাপারটা করতে হবে।
দী ভ: এমন লেখা কিন্তু হচ্ছে। বিশ্বসাহিত্যে তো হচ্ছেই। বাংলা সায়েন্স ফিকশনের কথা অতটা বলতে পারব না। তবে এখানেও পাঠক সৃষ্টির প্রসঙ্গটা চলে আসে। আমার নিজের আত্মীয়স্বজনদের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই তো বাংলা পড়ার ভাগটা খুবই কম। আর লেখকদেরও দূরদৃষ্টি থাকতে হবে এই ব্যাপারে যে আমার সমাজকে আমি কীভাবে এবং কতটা দেখাতে চাইব। আর প্রেজুডিস মুক্ত হয়ে সমাজকে বিশ্লেষণ করতে হবে। বাইরে থাকার একটা প্রভাব হচ্ছে নিজের সমাজকে অনেকটা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। এখন তো পলিটিক্যাল কারেক্টনেস একটা বড় ব্যাপার। সম্প্রদায়গতভাবে নানা স্টিরিওটিপিক্যাল ধারণা বিমুক্ত হয়ে লেখার চল বাড়ছে। এখানেও একটা রাজনীতির প্রকাশ। সিক্সিন লিউ এর লেখা তো বেশ বিখ্যাত, তার মধ্যেও দেখবে একটা প্রচ্ছন্ন জাতীয়তাবাদের প্রভাব আছে।
কল্পবিশ্ব: হ্যাঁ অবশ্যই। আমি নিউরোম্যান্সারের লেখক উইলিয়াম গিবসনের একটা লেখা পড়েছিলাম যেখানে উনি চীন ভ্রমণের সময় একজন চাইনিজ অফিসারের সঙ্গে কথাবার্তার প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে আটের দশক থেকেই তারা অনুধাবন করতে শুরু করে যে টেকনোলজিতে হয়তো আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো ইম্যাজিনেশন পাওয়াটা আরও বাড়াতে হবে। যেটার একটা ক্ষেত্র হিসেবে স্টেট স্পনসর্ড সায়েন্স ফিকশনের কথাও ভাবেন তারা। যাইহোক, আজ আপনার সঙ্গে কথা বলে একটা বিস্তৃত ক্যানভাস উন্মুক্ত হল। অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
দী ভ: আমারও খুব ভালো লাগল। কল্পবিশ্বের সঙ্গে এই যোগাযোগটা আমার জন্যও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ফোটোগ্রাফ: টিম কল্পবিশ্ব
Tags: ইন্টারভিউ, জটায়ু, দীপ ঘোষ, দীপেন ভট্টাচার্য, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়, সাক্ষাৎকার
খুবই জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। অনেক কিছু জানা হলো। কল্পবিজ্ঞান ও আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের উপর লেখক দীপেন ভট্টাচার্যের দখল রীতিমতো ঈর্ষনীয়! লেখকের সর্বমঙ্গল কামনা করছি।
বিজ্ঞানী, লেখক দীপেন ভট্টাচার্যের জ্ঞানের পরিধি এতোটাই বিস্তৃত যে তাঁর চিন্তন পরিক্রমা এক অভাবিত উন্নতস্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে স্তরটিতে তাঁর সাহিত্য নির্মাণ উপকরণ এতো প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ যেখানে তিনি কোনোকিছু নির্মাণে কোনো অভাবই বোধ করেন না। কোথাও তিনি পাঠকের কথা মাথায় রেখে কোনো শূন্যতায় আটকে গেলে বায়ুর সুরঙ্গ, আলোর সুরঙ্গ, তরঙ্গ বা কণা অথবা ম্যাজিক রিয়েলিজম বা ওপেন এন্ডেড জাতীয় যে সব অবস্থাগুলোর প্রসঙ্গ আলোচনায় আনলেন সেগুলো উতরে যাবার অসংখ্য জুতসই যন্ত্রের সহায়তা নিতে পারেন যেগুলো তাঁর মূল বিষয় অধ্যয়নের পথেই সংগ্রহ করতে করতে চলেছেন। এতে তাঁর যন্ত্রভাণ্ডার অবিশ্বাস্যমাত্রায় বিপুল। তাঁর জন্যে ঈর্ষা নয় আর, তাঁর প্রতিভা ভয়ঙ্কর, জটিল। তাঁর লেখা পাঠ করে বুঝি না বুঝি পাগলের মতো আরেকটি লেখা খুঁজি।
ওঁর লেখা গল্প পড়তে উজ্জীবিত বোলার, কেউ পড়াবেন?
দীপেনবাবুর বেশ কিছু লেখা আমাকে মুগ্ধ করেছে। অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো, নক্ষত্রের ঝড়, নিস্তার মোল্লার মহাভারত। তার সঙ্গে আট দিন কাটিয়েছিলাম রিভারসাইড, মোরেনো ভ্যালিতে। তার বাসস্থানটিই তাঁর লেখার পটভূমি যেন। অপূর্। আমার বাড়ি কয়েকবার এসেছেন। সায়েন্স ফিকশন আমার প্রিয় পাঠ। এই সাক্ষাৎকার খুব ভালো লাগল। লেখককে পাঠ করে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাই উচিত।
দীপেন ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকারটি পড়ে চমৎকৃত হলাম। তাঁর প্রজ্ঞার যে বিচ্ছুরণ পেলাম তা তাঁর বইগুলি পড়তে আগ্রহী করে তুলল। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি গল্প পড়েছিলাম আগে, ভীষণ ভাল লেগেছিল, কিন্তু এখন ওঁর সব বইগুলি পড়ার ইচ্ছাটা বেড়ে গেল। দীপেনবাবুর সুস্বাস্থ্য ও সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি।
দীপেন ভট্টাচার্য এর এই দীর্ঘ সাক্ষাতকার টা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম | তাঁর লেখা সব সময় এক অন্য মাত্রা এনে দেয় যা পরবর্তী তে পড়তে উতসাহিত করে |অনেক ধন্যবাদ |
ভাষাতাত্ত্বিক রাজীব চক্রবর্তী দাদার সৌজন্যে বছর দুয়েক আগে দীপেনদার কথাসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওঁর মায়াঘোর অক্ষর পাঠে একটা গভীর বীক্ষণের আবেশ পেয়েছি। কল্পবিজ্ঞানের বহিরঙ্গের অবয়ব ছাড়িয়ে তা প্রজ্ঞার অভীপ্সায় আমাদের অস্তিত্বের এক টেস্টামেন্ট রচনা করে চলেছে বলেই আমার বিশ্বাস। সেদিনের ওই কথোপকথনের প্রেক্ষিতে যে ভালো মানুষটার সন্ধান পেয়েছি তা আমাদের কাছে এক অমলিন স্মৃতির সম্পদ!!