লম্বগলি
লেখক: ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: রনিন
“এ কোন রাস্তায় নিয়ে এলি?”
“কেন মোড়ের মাথায় ও-ই তো বলল বাঁ দিকের রাস্তায় যেতে।”
“ও বলল আর তুই চলে এলি? এটা তো সেই কুড়গুড্ডা পাহাড়ের রাস্তা মনে হচ্ছে।”
যে মোড়ের মাথায় বাঁ দিকে যেতে বলেছিল সে রুখে উঠল। “কেন কুড়গুড্ডার রাস্তা কি রাস্তা নয়? তোরাই তো বললি চটপট বাড়ি ফিরতে হবে। এ রাস্তাটা অনেক ছোট।”
“ছোট তো বটে, কিন্তু বিপদের কথাটা ভাববি না?”
“কীসের আবার বিপদ? একা তো নই, আমরা চারজন। বাইকে করে যাচ্ছি, অত ভয়ের কি আছে?”
কাঁচা-পাকা রাস্তার উপর দুটো বাইক লাফাতে লাফাতে চলেছে। এই রাস্তায় কোনও এক অতীতে পিচ ফেলা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এখন তার কতখানি টিকে আছে তা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়। রাস্তার দু-পাশেই জঙ্গল। তবে খুব ঘন ঝোপঝাড়ওয়ালা জঙ্গল নয়। বড় বড় গাছ, প্রধানত গামার গাছ, তলাটা মোটামুটি পরিষ্কার। সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে। আকাশে একটা ভাঙা চাঁদের আলোয় চারদিকের জঙ্গল আরও ছমছমে দেখাচ্ছে।
এ রাস্তায় অন্য কোনও যানবাহনের দেখা মেলা কঠিন, বিশেষ করে রাত্রি হলে। রাস্তাটার বেশ বদনাম আছে। বন্য জন্তুর জন্য তো বটেই তা ছাড়া অন্য অপ্রাকৃত কারণও রয়েছে। ছেলে চারটে কাচ্চাবালির মেলা দেখতে এসেছিল। কিন্তু ফেরার সময় পথ ভুল করে উলটোদিকে চলে গিয়েছিল। মাঝখানে দিক চিনতে আরও একটা ছোটখাটো ভুল হয়েছিল। কিন্তু এখন ঘরে ফেরার শর্টকাট রাস্তা পাওয়া গিয়েছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ওরা ওদের গ্রামে ফিরতে চায়।
বাইকের হেডলাইটের আলো কখনও রাস্তার উপর পড়ছে— কখনও বা জঙ্গলের ছোটখাটো ঝোপঝাড়ের উপর পড়ছে। সমস্তটাই একটা ঝাপসা দৃশ্যের মতো লাগছে। রাস্তাটাও সোজা না, কাজেই সামনের দিকেও, বেশির ভাগ সময়েই, গাছের উপরেই আলো পড়ছে! ওরা চারজনেই বেশ ভয়ে ভয়ে আছে। মা পাত্তাখন্দার দয়ায়, কোনও মতে ভালোয় ভালোয় রাস্তাটা পার হতে পারলে হয়। পিছনের বাইকের যে ছেলেটি পিছনে বসেছিল, সে মোবাইল বার করে বেশ কিছুক্ষণ কাকে যেন ফোন করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু টাওয়ার পাচ্ছিল না।
সামনে কুড়গুড্ডা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। অবশ্য কুড়গুড্ডাকে পাহাড় না বলে বড় টিলা বলাই যুক্তিযুক্ত। একটা বড় টিলা আর তার পাশে একটা ছোট টিলা। আকাশের প্রেক্ষাপটে কালো অন্ধকার দুটো দানবের মতো দেখাচ্ছে। এই দুই পাহাড়ের মাঝখানের স্যাডল দিয়ে পথটা চলে গেছে।
রাস্তাটা এবারে ক্রমশ উঁচুর দিকে যাচ্ছে। দুটো বাইকেরই স্পিড কমে আসছে। স্যাডলটার মাঝামাঝি জায়গায় যেখানে দু-পাশ থেকে পাহাড় চেপে আসছে, ঠিক এরকম সময় দেখা গেল সরু রাস্তার উপর আড়াআড়িভাবে একটা বড় কাঠের গুঁড়ি পড়ে আছে। প্রথম বাইকটা গুঁড়িটাকে পাশ কাটিয়ে বার হতে যাবে এমন সময় হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর থেকে একটা লম্বা লাঠি জাতীয় কিছু বেরিয়ে এসে সজোরে বাইকটাকে খোঁচা লাগাল। বাইকটা ছিটকে পড়ে যেতেই জঙ্গলের ভিতর থেকে কয়েকটি অপ্রাকৃত মূর্তি বেরিয়ে এল। অন্ধকার রাত্রের আড়ালে যে সব অশুভ শক্তি ঘুরে বেড়ায় এরা যেন তাদেরই যোগ্য সহচর।
ওদের অসম্ভব রোগা দেখাচ্ছিল, প্রায় ওদের হাতের লম্বা লাঠিটার মতনই। কিন্তু বুদবুদ যেমন বেড়ে ওঠে, ঠিক তেমনভাবেই ওরা আস্তে আস্তে মোটা হতে লাগল। কিন্তু কখনও আবার কোনও কোনও মূর্তির চেহারা মোটা থেকে রোগাও হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক যখন প্রবল গরমে দুপুর রোদে রাস্তার উপরে বাতাস কাঁপতে থাকে, তখন দূরের জিনিসকে কীরকম কাঁপা কাঁপা অপার্থিব দেখায়, ঠিক এই রাতের অন্ধকারে ওই ছায়ার মতো অশুভ মূর্তিগুলোকেও যেন সেই রকম কাঁপা কাঁপা লাগছিল।
সামনের বাইকের পড়ে যাওয়া ছেলেগুলো ওঠার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ততক্ষণে মূর্তিগুলো ছেলে দুটিকে ঘিরে ফেলেছে। ওড়া নিজের পায়ে দাঁড়াবার আগেই ওরা ওদের হাতের বল্লমগুলো একযোগে উঁচিয়ে ধরে প্রচণ্ড জোরে ওই দুটো ছেলেকে আঘাত করল। ছেলে দুটির মরণ চিৎকারে চারপাশের বনজঙ্গল কেঁপে উঠল।
পিছনের বাইকের ছেলে দুটো বাইক থামাতে পেরেছিল মাত্র। কিন্তু তারপরে ভয়ে জমে গিয়েছিল। ওদের থেকে সামনের বাইকটার দূরত্ব প্রায় দেড়শো ফুট মতন হবে। ওই মূর্তিগুলি পিছনের বাইকটা নিয়ে কোনওরকম ব্যস্ততা দেখাচ্ছিল না। ওরা দুজন দুজন করে ছেলে দুটিকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল। পিছনের বাইকের হেডলাইটে ওদের ছ-জনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ছেলেগুলোকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল যারা তারা ছাড়া বাকি দুজন চোখে অমানুষিক জিঘাংসা নিয়ে পিছনের বাইকের আরোহীদের দিকে তাকাল। ওদের চোখ, বন্য পশুদের মতো জ্বলছিল। সে চোখের ভাষা যেন স্পষ্ট বলছিল, ‘তোদের ছেড়ে দিতে বড্ড খারাপ লাগছে, কিন্তু যা, আজ খুব বেঁচে গেলি।’ পিছনের বাইককে আক্রমণ করার কোনও ইচ্ছা ওদের দেখা গেল না। ওরা আস্তে আস্তে জঙ্গলের দিকে চলতে শুরু করল।
পিছনের মোবাইল হাতে ছেলেটি হঠাৎ-ই ওদের দিকে মোবাইল তাগ করে ওদের ছবি তুলে ফেলল। কিন্তু ততক্ষণে ওরা আবার সরু হয়ে যেতে শুরু করেছে। জঙ্গলে ঢোকার আগেই ওরা দু-জোড়া সন্ত্রস্ত চোখের সামনে বিলকুল অদৃশ্য হয়ে গেল।
সেকেন্ড দুয়েক পরেই বাইক চালক ছেলেটির হুঁশ ফিরল। প্রচণ্ড জোরে বাইক ঘুরিয়ে, তার থেকেও জোর গতিতে সে আবার যে রাস্তা দিয়ে আসছিল সেই রাস্তা দিয়ে ফিরে চলল। এই ভয়ানক পিশাচগুলোর থেকে যতদূর যাওয়া যায়! এদের কথা ও আগেও শুনেছে। এরাই মানুষখেকো লম্বগলি পিশাচ। বন্ধু দুজন নিশ্চয়ই এদের পেটে যাবে।
(২)
উড়িষ্যার খন্দমাল জেলার বাল্লিগুড়া মহকুমা। একটু এগোলেই কালাহান্ডির জঙ্গল। তবে বাল্লিগুড়া, কালাহান্ডির চেয়ে পাণ্ডববর্জিত এলাকা হলেও কালাহান্ডির মতো দরিদ্র নয়। এখানকার মুষ্টিমেয় যে ক-জন আদিবাসী আছে, সেই খন্দরা পরিশ্রমী, গর্বিত, অতিথিবৎসল, বীরের জাত। তবে এদের বীরত্ব প্রায়ই অকারণ হিংস্রতায় পরিণত হয়।
জায়গাটা অত্যন্তই জনবিরল। বাল্লিগুড়া মহকুমা শহরের আশপাশেই যেটুকু লোকবসতি। এ ছাড়া দূরে দূরে দু-একটা গ্রাম। পাত্তাখন্দায় মা পাত্তাখন্দার মন্দির ঘিরে কিছু জনবসতি, ব্যাস! এ ছাড়া বিস্তীর্ণ এই মহকুমায় শুধু পাহাড় আর জঙ্গল।
খন্দমাল জেলার বেশির ভাগ লোকই ফুলবনি মহকুমায় থাকে। ফুলবনির দারিংবাড়ি আজকাল খুব পরিচিত টুরিস্ট স্পট। দারিংবাড়িকে উড়িষ্যার কাশ্মীর বলা হয়। কিন্তু দারিংবাড়ির পাহাড় টপকে আরও পশ্চিমে এগিয়ে গেলে আসে বাল্লিগুড়া মহকুমা। লোকবসতির স্বল্পতার কারণে এই মহকুমাটি উড়িষ্যার মধ্যে সর্ববৃহৎ।
সাধারণত আদিবাসী বললে আমাদের চোখে যে ছবিটা ভাসে খন্দরা ঠিক সেরকম নয়। খন্দরা উদ্যোগী, পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান। কাজেই লেখাপড়া, চাষবাস, ব্যাবসাবাণিজ্য, চাকরিবাকরি সব কিছুতেই তারা আছে। বেশির ভাগ খন্দই সম্পন্ন গৃহস্থ। কিন্তু এরা একই সঙ্গে নিজেদের ঐতিহ্য, আচার ব্যবহার, খুব কঠিন ভাবে মেনে চলে। নিজেদের এলাকার বাইরে যাওয়া এরা একদম পছন্দ করে না।
খন্দরা বীর এবং অকুতোভয় হলেও, ভূত-প্রেতে, এদের বিশ্বাস মাত্রা ছাড়া। সন্ধ্যা হলেই যে চার পাশ থেকে নানা অপদেবতা সক্রিয় হয়ে ওঠে তা এরা সবাই জানে এবং মানে। তবে বিশ্বাস করলেও সেই ভয়ে এরা কিন্তু জুজু হয়ে থাকে না। গুনিন ইত্যাদিদের সাহায্যে এই অপদেবতাদের সঙ্গে সাধ্যমতো লড়াই, এরা করে থাকে। তবে বাল্লিগুড়ার মতো পাহাড় জঙ্গলের এলাকায় তেমন গুনিনই বা কোথায় পাওয়া যাবে? সেক্ষেত্রে মা পাত্তাখন্দাই ভরসা। মায়ের পুজোর লাল সুতো হাতে বেঁধেই এরা ভয় কাটানোর চেষ্টা করে থাকে। তবে বাল্লিগুড়ার পাহাড়ে কি আছে, বা থাকতে পারে তা প্রায় অজানা। এমনকি জিওলজিকাল সার্ভের ম্যাপেও ভাসা ভাসা তথ্য দেয়া আছে।
খন্দদের মধ্যে একটা বড় অংশ খ্রিস্টান। এমনিতে খ্রিস্টানরা বাড়তির মধ্যে জিশু পুজো করে, তা ছাড়া অ-খ্রিস্টান খন্দদের সঙ্গে তাদের অন্য তফাত নেই। ইদানীং অবশ্য এই নিয়ে মনোমালিন্য বাড়ছে। এটা প্রশাসনের একটা নতুন মাথা-ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আইপিএস মোহিনী রায়ের প্রথম পোস্টিং এই বাল্লিগুড়ার এসডিপিও হিসাবেই হল। এখানকার সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো। খুন ছাড়া অন্য কোনও অপরাধ বিশেষ হয়ই না। আর সেই সব খুনও খুবই সরল ধরনের। অপরাধী নিজেই থানায় এসে স্বীকার করে, ‘এই কারণে আমি অমুককে মেরে ফেলেছি, যা শাস্তি হয় দিন।’ খন্দদের সমাজ অত্যন্ত সুশাসিত, ফলে ছোটখাটো অপরাধের ফয়সালা সমাজের পাঁচজনে মিলেই করে। কোর্ট-কাছারি, থানা-পুলিশ এদের অত্যন্ত অপছন্দের বিষয়।
কিন্তু সেদিনের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম হল। কাচ্চাবালি থানায় বেশ কিছু খন্দ এসে উপস্থিত। তাদের দুজন ছেলেকে লম্বগলি পিশাচে নিয়ে গেছে। এখন পিশাচে নিয়ে গেলে থানার বিশেষ কিছু করণীয় আছে কি না, আইনে সে কথা লেখা নেই। কিন্তু ছেলে দুটো নিখোঁজ হয়েছে, একথা তো ঠিক? এর আগে আরও অনেক লোকজনই রাস্তা থেকে নিখোঁজ হয়েছে। থানায় কখনও রিপোর্ট হয়েছে, কখনও হয়নি। কিন্তু এবারে এই ঘটনার দুজন প্রত্যক্ষদর্শী আছে। এই প্রত্যক্ষদর্শীর কথাটা উপেক্ষা করার মতো নয়, কারণ সবাই জানে খন্দরা মিথ্যা বলে না।
থানার ওসি গিরিধর মহান্তি ভুবনেশ্বর সিটির লোক। খন্দদের নেহাতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন গেঁয়ো আদিবাসী মনে করেন। কিন্তু এবারের ব্যাপারে গোলমাল আন্দাজ করে তিনি মহকুমা সদরে খবর পাঠালেন। এসডিপিও ম্যাডাম নতুন এসেই কড়া প্রশাসক হিসাবে সুনাম বা বদনাম কিনেছেন। পরে যেন আর ঝামেলার কোনও সুযোগ না থাকে।
বেলা সাড়ে দশটার সময়েই কাচ্চাবালি থানার সামনে ম্যাডামের জিপ এসে থামল। ম্যাডাম খবর পেয়েই জানিয়েছিলেন যে তিনি আসছেন। ওসি বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সমাদর করে মোহিনীকে ভিতরে নিয়ে এলেন। কিন্তু ভিতরে ঢুকে মোহিনীর প্রথম কথাই হল, “আমার জন্য কাজকর্ম ফেলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আমরা দুজনেই একই সরকারের চাকরি করি।”
এবারে একে একে এফআইআর ইত্যাদি দেখা শুরু হল। মোহিনী প্রশ্ন করলেন, “যারা রিপোর্ট লেখাতে এসেছিল তাদের কাউকে পাওয়া যাবে?”
ওসি একটু বাইরে বেরিয়ে খোঁজ নিলেন। জানা গেল আধঘণ্টার মধ্যেই আসতে পারবে।
কাগজ দেখতে দেখতেই আধঘণ্টা কেটে গেল। এমন সময়ে চার-পাঁচজন নানা বয়সের লোক এসে ওসির ঘরে জুটল। মোহিনী সবাইকে সমাদরে বসালেন। তারপরে তাঁর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে যা জানা গেল তা হল এইরকম।
বাল্লিগুড়া টাউন থেকে যে রাস্তাটা কাচ্চাবালি আসে এই রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা পশ্চিমে একটা প্যারালাল রাস্তা আছে। ওই রাস্তাটা শর্টকাট, কিন্তু বিশেষ ব্যবহার হয় না। কারণ ওই রাস্তা থেকে মাঝে মাঝেই লোক হারিয়ে যায়। খন্দদের গাঁওবুড়োরা বলে, ওই রাস্তার আরও পশ্চিমের পাহাড়ে লম্বগলি পিশাচেরা থাকে। ওরা মানুষ খায়। খন্দরা সাধারণত তাই ওই দিকে যায় না, কিন্তু পশ্চিমদিকের গ্রামগুলো থেকে মাঝে মাঝে মানুষ খোয়া যায়।
মোহিনী জিজ্ঞাসা করলেন, “সে তো বন্য জন্তুর কাজও হতে পারে? পারে না কি?”
ওরা সমস্বরে জবাব দিল, “না পারে না, কারণ বন্য জন্তু আক্রমণ করলে ধস্তা-ধস্তির চিহ্ন, রক্তের দাগ, এসব থাকত। এক্ষেত্রে কিচ্ছু পাওয়া যায় না। আর এবারে তো দুজন ওদের দেখেছে পর্যন্ত।”
ওসি মাঝখান থেকে ইংরাজিতে বললেন, “এরা নেহাতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন।” মোহিনী উত্তর দিলেন না। বরং ওদের জিজ্ঞাসা করলেন, “যারা দেখেছে তারা কি একবার এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে?” ওরা বলল, “তারা পালাতে গিয়ে বাইক উলটে পা ভেঙেছে। হেলথ সেন্টার থেকে প্লাস্টার করিয়ে তারা বাড়িতেই আছে।” মোহিনী বললেন, “আমি গিয়ে কি তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারি?”
ওসি হাঁ হাঁ করে উঠলেন। ম্যাডাম ওদের বাড়িতে যাবেন তা হয় না কি? কিন্তু একটি রক্তজমানো চাউনি দিয়ে ম্যাডাম ওসিকে চুপ করিয়ে দিলেন।
খন্দরা সম্মতি জানিয়ে একজন বয়স্ক লোককে গাইড হিসাবে মোহিনীর জিপে তুলে দিল। জিপ চলল বাল্লিগুড়ার রাস্তায়। কিছুদূর গিয়ে কাঁচা রাস্তায় নেমে খানিকক্ষণ পরে একটা খন্দ গ্রামের মধ্যে ঢুকল।
খন্দদের বাড়ি অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। যতটা সম্ভব সাজানো-গোজানোও বটে। মোহিনী বাড়ির ভিতরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
মোহিনীকে দেখে পায়ে প্লাস্টার লাগানো ছেলেটি দাঁড়িয়েই পড়ে আর কি! অনেক কষ্টে তাকে বিছানায় বসিয়ে রাখা হল। উত্তেজনায় তার মুখ জ্বলজ্বল করছে। বাপরে! স্বয়ং পুলিশের বড়কর্তী তার সামনে!
ছেলেটির কাছে নতুন কছুই জানা গেল না, তবে সে যে মানুষের মতো কিছু একটা দেখেছে সেটা স্পষ্ট। কিন্তু যখন সে মোবাইলে তোলা ছবিটা দেখাল, তখন কিন্তু মোহিনীর ভ্রুতে ভাঁজ পড়ল। এ কোন ধরনের মানুষ? এত রোগা আর এত লম্বা? ব্লু টুথ দিয়ে মোবাইলের ছবিটা তিনি নিজের ফোনে নিয়ে এলেন।
জিপে ফিরতে ফিরতে মনস্থির করে ম্যাডাম হোয়াটস-অ্যাপে একটা মেসেজ করলেন।
(৩)
“তোরা এখনও অশিক্ষিতই রয়ে গেলি। আধুনিক কবিতা বলে কি কিছু হয়? পোস্ট-মডার্ন শব্দটাও পুরোনো হয়ে গেছে। কবিতা, হয় ভালো হয়, না হলে বাজে কবিতা হয়।”
“তা তোর মতে ভালো কবিতা কোনগুলো?”
“এতক্ষণ তাহলে কী শোনালাম?”
“ও, মানে তোর লেখা কবিতাগুলো হল ভালো কবিতার উদাহরণ? আর বাজে কবিতা?”
“যে কোনও একটা বাজার চলতি পত্রিকা তুলে নে, সেখানেই পেয়ে যাবি।”
“বুঝলাম, তবে তোর কবিতার মানে বুঝি নি কিন্তু।”
“এই কথা থেকেই তো বোঝা যায় তুই কবিতা সম্বন্ধে কতটা নিরক্ষর। কবিতা কি ফিজিক্সের থিয়োরি যে বুঝবি… আবার ফোন বার করছিস?”
“দাঁড়া, একটা হোয়াটস-অ্যাপ এসেছে, একটু দেখে নিই।”
বেলা দুটো বাজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানথ্রপলজি ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপক ডক্টর ব্রতীন দাসের ঘরে এসেছে তার বন্ধু প্রাংশু সাহা। প্রাংশুর নতুন কবিতার বই বেরিয়েছে। প্রাংশু আসলে পদার্থবিদ, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অব সায়েন্সের বিজ্ঞানী। বয়স বেশি না হলেও স্ট্রিং থিয়োরির উপরে কাজ করে বেশ নাম হচ্ছে। কিন্তু ওর অবসেশান হল কবিতা। নতুন কবিতার বই বেরোলে বন্ধু ব্রতীনকে না দেখিয়ে ওর শান্তি নেই। ব্রতীন যদিও প্রাংশুর কবিতা কিছুই বোঝে না কিন্তু তাহলেও ওরা ছোটবেলার বন্ধু। ওদের ঝগড়া আর ভাবের ইতিহাস অনেকদিনের।
যে হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজটা ব্রতীন দেখছিল সেটা পড়তে পড়তে তার ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল। আর থাকতে না পেরে প্রাংশু প্রশ্ন করল, “কী রে, কার মেসেজ?”
“দাঁড়া, ব্যাপারটা গোলমেলে।”
প্রায় মিনিট তিনেক মেসেজটা পড়ার পর ব্রতীন বলে, “অদ্ভুত কাণ্ড।”
“কী হল রে বাবা?”
ব্রতীন ফোনটা এগিয়ে দিল, ”দ্যাখ।”
লেখা আছে “ব্রতীনদা, জানি না আমাকে আপনার মনে আছে কি না। আমার নাম মোহিনী রায়। বছর আড়াই আগে আপনার কাছে আইপিএস পরীক্ষার জন্য অ্যানথ্রপলজি পড়তাম। যদিও ওটা আমার সাবজেক্ট ছিল না, কিন্তু আপনি খুব ইন্টারেস্টিং করে বুঝিয়ে দিতেন। তাই একটা সমস্যায় পড়ে আপনার কথা মনে হল। আমি এখন ওড়িশার বাল্লিগুড়া সাব ডিভিশনের এসডিপিও। এখানে একটা ক্রাইম রিপোর্টেড হয়েছে। দুজন আদিবাসীকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। যারা নিয়ে গেছে তাদের একটা ছবি পাওয়া গেছে। খুবই অস্বাভাবিক ছবি। ছবিটা পাঠিয়ে দিলাম। আপনি কি ছবি দেখে বলতে পারেন, এই রকম চেহারার কোনও আদিবাসী ট্রাইব ওড়িশায়, বা আর কোথাও আছে কি না? জানতে পারলে আমার খুব উপকার হবে। আমার প্রণাম নেবেন। বউদি ভালো আছেন তো? পিকলু নিশ্চয়ই এখন খুব দুষ্টুমি করছে।”
প্রাংশু মন দিয়ে মেসেজটা দেখছিল। ব্রতীন বলল, “পড়লি?”
প্রাংশু খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “দারুণ দেখতে তো?”
“মানে?”
“তোর মোহিনী রায় তো পুরোপুরি মনমোহিনী রে!”
“তুই হতভাগা মেসেজ না পড়ে ডিপি দেখছিস?”
“মেসেজ পড়েছি, কিন্তু আহা! কি সুন্দর দেখতে রে!”
ব্রতীন ওর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বলে, ”কত করে বলি, একটা বিয়ে করে ফেল। তা তো শুনবি না! বয়স তো দু-কুড়ি হতে চলল…”
“অ্যাই শাটাপ, এখনও চৌত্রিশ পূর্ণ হয়নি। তোর থেকে আমি দেড় বছরের ছোট, মনে নেই?”
ব্রতীন হাসতে হাসতে সিরিয়াস হয়ে পড়ে। বলে, “এই মেয়েটা একচুয়ালি আমার বড় পিসির পরিচিত। ও কেমিস্ট্রিতে এমএসসি পাস করলেও যখন আইপিএস পরীক্ষা দেয়, তখন একটা পেপার অ্যানথ্রপলজি নিয়ে ছিল, অনেকেই নেয়। তখন পিসির অনুরোধে ওকে মাসছয়েক পড়িয়েছিলাম। খুব ভালো ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে। একবারে আইপিএস পাস করে গিয়েছিল।”
“বিয়ে হয়েছে?”
“তা কি করে বলব? আমার সঙ্গে তো আর এতদিন যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু বাজে কথা রাখ। যে ছবিটা ও পাঠিয়েছে সেরকম দেখতে, আদিবাসী তো ছেড়েই দে, মানুষই হয় না কি? এত দড়ির মতো রোগা!”
“ছবিটা ফোটোশপ করা নয় তো?”
“কি করে বলি বল, তবে মোহিনী কি আর শিওর না হয়ে পাঠিয়েছে?”
“তাহলে ফোন করেও তো কথা বলতে পারিস?”
“আইডিয়া নয় কো হে মন্দ। দাঁড়া, মেসেজ করে জেনে নিই কখন ফোন করলে ওর সুবিধা হবে।”
মেসেজের উত্তরে মোহিনী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, যে কোনও সময়েই ব্রতীন তাকে ফোন করতে পারে। ব্রতীন তখনই ফোন করতে উদ্যত হল।
প্রাংশু ব্রতীনকে বাধা দিল। বলল, “এই শোন না, ফোন করে কি বলবি আগে ঠিক করে নিই। ওখানে কোনওভাবে যাওয়া যায় না? মেয়েটার যদি বিয়ে না হয়ে থাকে, তাহলে আমি একটা ডেস্পারেট অ্যাটেম্পট করতে চাই।”
“ওখানে, মানে, ওই, সেই কি না কি জায়গায়, যাব? পাগল হয়েছিস নাকি? ওখানে গিয়ে কী করবি? মোহিনীর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করতে চাস তো বরং পিসির ওখানে গিয়ে ওর বাবা-মার সঙ্গে কথা বলাও এর থেকে ভালো।”
কিন্তু প্রাংশু কোনওমতেই ছাড়ার পাত্র নয়। তার বক্তব্য— ওখানে একটা অজানা নরখাদক ট্রাইব আছে, এটাই কি সেই ট্রাইবকে খুঁজতে যাবার যথেষ্ট কারণ নয়? ব্রতীন কীরকম অ্যানথ্রোপলজিস্ট, যে একটা অজানা জনগোষ্ঠী খুঁজে পাবার ব্যাপারে গা ছাড়া ভাব দেখাচ্ছে? ওখানকার পাহাড়ে জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে সেই অদ্ভুত দর্শন মানুষদের খুঁজে পাওয়ার মতন থ্রিলিং ব্যাপার আর হয়?
ব্রতীন কিছুতেই প্রাংশুকে বোঝাতে পারছিল না যে এটা গল্পের বইয়ের উপন্যাস নয়। এই সো কল্ড অভিযানের খরচ কে দেবে? কোনও আদিবাসীর ছেলে কী বলে গেল, তার ভিত্তিতে একটা অ্যানথ্রোপলজিকাল এক্সপিডিশন হবে— সরকারের অত আগ্রহও নেই, টাকাও নেই। আর একটা অজানা জনজাতি এই একবিংশ শতকে ভারতের বুকে আছে এটাও খুব অসম্ভব একটা ব্যাপার।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাংশুর জেদের কাছে ব্রতীন হার স্বীকার করে নিল। মোহিনীকে ফোন লাগানো হল।
মোহিনীর কাছ থেকে যা জানা গেল তা হল এইরকম।
বাল্লিগুড়ার খন্দদের মধ্যে বহুদিন ধরেই এই লম্বগলি পিশাচের কথা চালু আছে। কোনও এক বিস্মৃত অতীতে নাকি খন্দদের অনাচারে রুষ্ট হয়ে আকাশের দেবতা এই পিশাচদের সৃষ্টি করেন। এই পিশাচরা ইচ্ছামতো চেহারা পালটাতে পারে। এমনকি অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে। এদের হাতে সবসময় একটা বল্লম থাকে, যেটা ওরা মাটিতে ঠক ঠক করে ঠুকতে থাকে।
এসব কিছুই বিশ্বাসের যোগ্য কথা নয়, কিন্তু এইবার দুজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং একটা ছবি পাওয়া গেছে। আর খন্দরা প্রাণ গেলেও মিথ্যা কথা বলবে না। কাজেই একটা কিছু আছে। এখন খন্দরা এই নিয়ে যদি ক্ষেপে ওঠে তাহলে সমূহ বিপদ। সবচেয়ে সমস্যা হল বাল্লিগুড়ায় কিছু খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী খন্দ আছে। যদি কোনও স্বার্থান্বেষী মহল থেকে রটিয়ে দেওয়া হয় যে এর জন্য খৃষ্টানদের অনাচার দায়ী, তাহলে রায়ট অনিবার্য।
ব্রতীন খুব আমতা আমতা করে ওখানে গিয়ে তদন্ত করে দেখার কথা বলতেই মোহিনী কথাটা লুফে নিল। এ তো অতি সু-প্রস্তাব! ও এখনই জেলার পুলিশ অধিকর্তার সঙ্গে কথা বলছে। যদি পিশাচের খোঁজে বাল্লিগুড়ার পাহাড়ে একটা সরকারি অভিযান চালানো হয়, তাহলে খন্দরা খুবই খুশি হবে। গোলমালের সম্ভাবনা কমে যাবে। কাজেই ফলাফল যাই হোক না কেন, এখন এই অভিযানের সূত্রপাত করাটা খুবই সহজ এবং উচিত কাজ। বিশেষজ্ঞ হিসাবে ব্রতীনকে সরকারি আমন্ত্রণ জানান হবে। সঙ্গে এক বন্ধু থাকতে পারবে কি না এ প্রশ্নের উত্তরে মোহিনী বলল সেটাও কোনও সমস্যা নয়। তবে বন্ধুর যাওয়া আসার খরচটা সরকার স্পনসর করতে পারবে কি না সেটা বলা একটু সময় সাপেক্ষ। ব্রতীন বলল তার কোনও দরকার নেই। বন্ধু নিজের খরচেই যাবে, থাকবে, খাবে।
প্রাংশুর জন্য ব্রতীনের কৌশল করা প্রশ্নের উত্তরও সরাসরি পাওয়া গেল। না মোহিনী বিয়ে করেনি। সবে মাসদুয়েক হল ওড়িশা ক্যাডারে আইপিএস হিসাবে সে জয়েন করেছে। আপতত সে নিজের বিয়ের কথা ভাবছে না।
ফোন রেখে প্রাংশুর দিকে তাকিয়ে একটা মুখভঙ্গি করে ব্রতীন, বলে, “হল তো, এবারে উড়িষ্যা যাবার তোড়জোড় শুরু করো। কিন্তু একটা কথা বাছা স্পষ্ট জেনে রাখো। মোহিনীকে বাগাতে গেলে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় বাগাতে হবে। আমি কিন্তু আইপিএসের ঘটকালি করে কেস খেতে রাজি নই।”
প্রাংশু উত্তর দিল না। বিড়বিড় করে কী যেন বলল। হয়তো কোনও স্বরচিত কবিতার লাইনই হবে।
(৪)
কাপ্পো গুহার মতন ফাটলটার সামনে দাঁড়িয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলল। মেদিয়া বলল, “ও বলছে, ওরা এর মধ্যে ঢুকেছে।”
বলরাম বলল, “ম্যাডাম, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আজকে কি এই গুহার মধ্যে ঢোকা উচিত হবে?”
মোহিনী বলল, “আমাদের আলো আছে। ঢুকে দেখা যাক। ঠিক পনেরো মিনিট পরে বার হয়ে আসব।”
বলরাম বাকিদের ভিতরে ঢোকার ইঙ্গিত করল। মোহিনী বলল, “শ্রীধর, তুমি মার্শাল আর্ট জানো। তুমি আর তোমার নাম যেন কী?”
“রাম পণ্ডা, ম্যাডাম।”
“সরি, এবার থেকে মনে থাকবে। তুমি শ্রীধরের সঙ্গে গুহার বাইরে পাহারা থাকবে। বলরাম, তুমি সামনে থাকবে। তোমার পিছনে আমি, আমার পিছনে ব্রতীনদা আর প্রাংশুবাবু। তার পিছনে মানিক আমাদের কভার করবে। রমলা, মেদিয়া আর কাপ্পো সবার পিছনে আসবে।”
বলরামের মুখে একটা সন্তুষ্টির হাসি খেলে গেল। ভাবটা এইরকম যে, ‘এ রকম লিডারের অধীনে কাজ করেই তো আনন্দ’। কিন্তু কাপ্পো তার ভাষায় কিছু একটা অসম্মতি প্রকাশ করল। মেদিয়া ওকে ধমকে চুপ করাতে যাচ্ছিল, কিন্তু সদা সতর্ক মোহিনীর প্রশ্ন, “ও কী বলছিল?”
“ও বলছিল ও আগে যাবে, কারণ পিশাচেরা কোনও ফাঁদ পেতে রাখলে ও নাকি সবার আগে বুঝতে পারবে।”
মোহিনী সঙ্গে সঙ্গে বলল, “ঠিক আছে তাহলে ও আগে যাক, ওর পিছনে তাহলে তুমি থেকো মেদিয়া, আর তোমার সঙ্গে বলরাম।”
বলরাম ম্যাডামের কথা মেনে নিলেও একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছে মনে হল। প্রাংশু ইংরাজিতে প্রশ্ন করল, “আপনি ওর কথা মেনে নিলেন কেন?”
মোহিনী একটু হেসে বলল “কাপ্পো যদিও বনবিভাগের পক্ষ থেকে ট্র্যাকার হিসাবে এখানে আছে, কিন্তু ওর আসল পরিচয় হল গুনিনের। ও সামনে থাকলে হয়তো অন্যরা নিশ্চিন্ত হবে। তা ছাড়া ওর দক্ষতা দেখলেন তো। কীভাবে পথ খুঁজে ওই সো কল্ড পিশাচদের অনুসরণ করে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে বলুন। ওর ছোটখাটো ইচ্ছাকে মান্য করাই ভালো।”
ব্রতীন বলল, “কাপ্পো হল বোন্ড উপজাতির লোক, এরা প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যাবার মুখে। যদি এরা শেষ হয়ে যায়, কত অদ্ভুত গল্প, কত বিচিত্র বিদ্যা, কত তথ্য, সব শেষ হয়ে যাবে। আমাদের রাজমহল পাহাড়ে চেরো বলে একটা উপজাতি থাকে। তাদের একটা আস্ত লিখিত সিস্টেম অব মেডিসিন ছিল জানিস?”
“বলিস কি রে? তা সেটা গেল কোথায়?”
“যেখানে যায়, বিদেশে! এক সাহেব কিনে নিয়ে চলে গেছে।”
মোহিনী মুখ থেকে একটা আক্ষেপের শব্দ করে বলল, “এই ঘটনার কথা আপনি আগেও আমাকে বলেছিলেন ব্রতীনদা। বলেছিলেন এক বুড়ো বদ্যি কি করে একজনের ভাঙা পা একমাসের মধ্যে বেমালুম জুড়ে দিয়েছিল।”
এলইডি ফ্লাডলাইটের আলোয় চলতে চলতে ওদের কথা হচ্ছিল। হঠাৎ কাপ্পো কী একটা বলে উঠল। মেদিয়া বলল, “কাপ্পো বলছে, গুহার অন্য মুখ খোলা, আমরা কি বার হব?”
মোহিনী মেদিয়াকে বলল, “ওকে জিজ্ঞাসা কর, ও কি বলতে পারবে, গুহার বাইরে কেউ ওঁত পেতে আছে কি না?”
কাপ্পো মেদিয়ার কথা শুনে কিছু একটা বলে মাটিতে শুয়ে পড়ল। তারপর একেবারে বুকে হেঁটে এগিয়ে চলল। লাইট হাতে বলরাম সঙ্গে যাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কাপ্পো বেশ জোরে ধমক দিল। মেদিয়া অনুবাদ না করলেও সবাই ধমকটার মানে বুঝতে পারল, “উজবুক কোথাকার, বাইরে কেউ থাকলে সে আলো দেখতে পাবে না? আমি অন্ধকারে একা যাব।” অন্ধকারের মধ্যেই কাপ্পোর শরীরটা হারিয়ে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ সবাইকে টেনশনে রেখে অবশেষে কাপ্পো ফিরল। পায়ে হেঁটেই ফিরল। মুখে বিজয়ীর হাসি। জানা গেল, সব কিছু পরিষ্কার, বাইরে ত্রিসীমানার মধ্যে কেউ নেই।
এবারে মোহিনী এগিয়ে গেল। বলরাম আবারও আলো হাতে সঙ্গ নিতে গেল। কিন্তু মোহিনী বলল, “আলো নিয়ে তুমি এখানেই থাকো। যা দেখার অন্ধকারেই দেখতে হবে।”
মোহিনী পা বাড়াতে প্রাংশুও সঙ্গে চলল। মোহিনী বলল, “আপনি না এলেই পারতেন।” প্রাংশু বলল, “ওই যে ও বলল, কোথাও কেউ নেই।”
মোহিনী মুচকি হেসে বলল, “তাহলে চলুন, কিন্তু অন্ধকার গুহার মধ্যে চলতে গিয়ে হোঁচট খাবেন না তো?”
প্রাংশু সে সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখেনি। কিন্তু এখন তো আর পিছপা হওয়া যায় না, কাজেই বীরের মতো বলল, “না,না। এসব অভ্যাস আছে।”
অন্ধকারে চলতে চলতে মোহিনীর গলা ভেসে এল, “কোথা থেকে অভ্যাস হল?”
প্রাংশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এই মেয়েটা দেখা যাচ্ছে ভয়ানক চালু, একটা লুজ কথা বলার জো নেই। কিন্তু ভগবান ওর মুখে কথা যুগিয়ে দিলেন। বলল, “আমাদের ল্যাবে প্রায়ই লোডশেডিং হয় তখন ঘুটঘুটে অন্ধকারে সমস্ত যন্ত্রপাতি বাঁচিয়ে চলাফেরা করা অভ্যাস আছে।”
অন্ধকারে মোহিনীর কৌতুক তরল হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল, “কেন আপনাদের ফোনে লাইট নেই?”
ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় এই ভয়ানক গুগলির উত্তরও প্রাংশুর মুখে এসে গেল, “আসলে নিরাপত্তার কারণে আমাদের ল্যাবে মোবাইল ঢোকা বারণ।”
মোহিনীর দিক থেকে একটা সম্ভ্রমপূর্ণ “ও” শোনা গেল।
প্রাংশু মনে মনেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিল। কি ভালোভাবেই না গুলতাপ্পিগুলো দিলাম! থিয়োরেটিকাল ফিজিক্সের লোক, ইউনিভার্সিটির বাইরে কোনওদিন ল্যাবরেটরিতে পা দিয়েছি না কি? কিন্তু মেয়েটা কী বুদ্ধিমতী এবং একই সঙ্গে কি ভীষণ ফিচেল! ভাবতে ভাবতেই অন্ধকারে প্রাংশু একটা রাম হোঁচট খেল। তবে পড়ে গেল না। কোনওভাবে গুহার দেয়াল ধরে পদস্খলন রোধ করল।
মোহিনীর আওয়াজ পাওয়া গেল,” পড়ে যাননি তো?”
“না, পাথরে হোঁচট খেলাম।”
“ল্যাবরেটরির মেঝেতে পাথর নেই, না?”
প্রাংশুর মনে হল, ‘ধরণী দ্বিধা হও’। সে উত্তর দিল না। মোহিনী নিজের ফোনের লাইটটা জ্বালিয়ে ফোনটা পিছন দিক করে ধরল, যাতে আলোটা গুহার মাটিতে পড়ে। তারপর বলল, “আপনি এই আলোয় পথ দেখে আসুন।” দুজন আস্তে আস্তে চলতে লাগল। একটু চলার পরেই খুব আবছা একটা আলোর আভাস দেখা গেল। ফোনের আলো নিভিয়ে দেখা গেল সামনে গুহার খোলা মুখ।
ওরা দুজনে খোলা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসে বাইরের দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেল।
ওরা একটা উপত্যকার সামনে অনেকটা উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সামনে দিয়ে খাদের মতো নেমে গেছে উপত্যকার ধার। আজ সম্ভবত ত্রয়োদশী, গোটা উপত্যকাটার উপরই চাঁদের আলো পড়ছে। পাহাড়ের গোল শ্রেণির মধ্যে এই নিচে বসে যাওয়া উপত্যকাটার ব্যাস কিলোমিটার পাঁচেক হবে। উপত্যকার মাঝখানে একটা ছোট হ্রদ মতো আছে। যে দিকটায় গুহার মুখ, সেই দিকটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। কিন্তু লেকের অন্য পাড় গভীর ঘন জঙ্গলে ছাওয়া।
সমস্ত জায়গাটার মধ্যে কি রকম যেন একটা, না বোঝা, আদিম ভাব রয়েছে। ওই লেকের জল থেকে এখনি যদি একটা ডাইনোসর উঠে আসে, একটুও যেন আশ্চর্য লাগবে না। চাঁদের আলোয়, পাহাড়ের কোলে দেখা, একটা উপত্যকা, খুবই সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু তারপরেও যেন পুরো দৃশ্যটার মধ্যে একটা অমানুষিক ভয়ের ব্যাপার, একটা অতিপ্রাকৃত কিছুর আভাস, মিশে আছে। মনে হচ্ছে, এ যেন অনেক আগের পৃথিবী।
প্রাংশু চুপ করে ভাবছিল। হঠাৎ মোহিনীর গলা পাওয়া গেল, “জায়গাটা কিরকম অদ্ভুত, না?”
প্রাংশুর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “অজানা অন্ধকারের অবাক অট্টহাসি।”
মোহিনী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “মানে?”
প্রাংশু সামলে নিতে নিতে বলল, “ওই কবিতার লাইন বেরিয়ে গেল আর কি।”
“কার লেখা? আপনার?”
“না, লেখা হয়নি, মনে মনে ভাবলাম।”
“অবাক অট্টহাসি? মানে কী।”
এই প্রশ্ন আর কারও কাছে শুনলে প্রাংশু ক্ষেপে গিয়ে গালমন্দ করত। কিন্তু মোহিনীকে খুব শান্তভাবেই বলল, “অবাক মানে, নিঃশব্দ অট্টহাসি, সিনেমার ভিলেনদের মুখে মাঝে মাঝে দেখা যায় না?”
কিন্তু মোহিনী হঠাৎ বলে উঠল, “তাই তো! এইবারে বুঝলাম এ জায়গাটা এত অদ্ভুত লাগছিল কেন। এখানে রাতের স্বাভাবিক শব্দ একটাও নেই। কোনও পশুপাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না, এমনকি কোনও পোকামাকড়েরও শব্দ নেই।” তারপরেই তাড়াহুড়ো করে বলল, “চলুন এবারে, সবাই চিন্তা করবে। রাতটা আমরা উপত্যকাটার বাইরেই কাটাব।”
ফেরার সময় মোবাইলের আলো জ্বালিয়েই ফেরা হল। ফিরতে ফিরতে মোহিনী বলল, “কবিরা খুব সেনসিটিভ হয় শুনেছিলাম। আজ নিজের চোখেই দেখলাম। আপনি জায়গাটার সমস্যাটার কথা না বুঝেও অনুভব করেছিলেন দেখা গেল।”
ফিরে গিয়ে মোহিনী ঘোষণা করল ওরা গুহার বাইরেই ক্যাম্প করে থাকবে। আগামীকাল ভোরবেলায় আলো ফোটার সময় ওরা ওই উপত্যকাটায় ঢুকবে।
পাহাড় থেকে সামান্য নেমে একটা বড় চত্বরের মতো জায়গায় ওরা ওদের তাঁবু খাটাতে শুরু করল। দুটো ছোট তাঁবুর একটায় মোহিনী আর ওর ফিমেল অ্যাটেনডেন্ট রমলা। একটায় প্রাংশু আর ব্রতীন। বড় একটা তাঁবুতে ওড়িশা পুলিশের র্যাফের তিনজন আর্মড গার্ড বলরাম দাস, শ্রীধর জলধি, মানিক নায়েক। এ ছাড়া তিন পুলিশ কনস্টেবল রাম পন্ডা, সুখময় মহান্তি আর মেদিয়া। এদের মধ্যে মেদিয়া হল জাতে খন্দ।
তাঁবুর বাইরে অরণ্যের স্বাভাবিক বাসিন্দার মতো রয়ে গেল বনবিভাগের ওস্তাদ ট্র্যাকার কাপ্পো। কাপ্পো জাতে বোন্ড। কাপ্পোর ভাষা একমাত্র মেদিয়া কিছুটা বুঝতে পারে। কিন্তু বুড়ো কাপ্পো একা থাকাই পছন্দ করে।
গতকাল ভোরবেলা ব্রতীন আর প্রাংশু দুজনে ভুবনেশ্বরের বিজু পট্টনায়ক এয়ারপোর্টে যখন পদর্পন করে তখন দুজনেই একটু কাবু হয়ে ছিল। গত রাত্রে বারোটায় দমদম গিয়ে তারপর ভোরে ভুবনেশ্বর পৌঁছানোর ধকলে রাতে একফোঁটা ঘুম হয়নি। ভুবনেশ্বর এসেই দেখে ওদের স্বাগত জানাতে মোহিনী এসে উপস্থিত হয়েছে।
প্রাংশু আর ব্রতীন এই দুই বন্ধুকে একসঙ্গে দেখলে অনেকেই চাচা চৌধুরী আর সাবু বলত। ব্রতীন হাইটে পাঁচ ফুট দু ইঞ্চি প্রস্থেও সেই অনুপাতে কম। ফিটফাট, ক্লিন শেভড, চেহারায় মধ্যবিত্ত বাঙালি অধ্যাপকের ছাপ সুস্পষ্ট। ওদিকে প্রাংশু ফুটছয়েক লম্বা, নিরেট দোহারা চেহারা। এলোমেলো চুল, সিংহের কেশরের মতো অবিন্যস্ত গোঁফ দাড়ি। মোহিনীর চোখে প্রবল কৌতূহল লক্ষ করেছিল ব্রতীন।
কিন্তু মোহিনী ওদের এক মুহূর্ত জিরোতে দেয়নি, এয়ারপোর্টের বাইরেই জিপ দাঁডিয়ে ছিল। প্রায় ঘণ্টাচারেক জিপে ঝিমোতে ঝিমোতে জার্নি করে যখন ওরা বাল্লিগুড়ায় পৌঁছল তখন ওদের যেমন ঘুম পেয়েছে, তেমনই খিদে পেয়েছে। রাস্তায় খুব একটা কথাবার্তা হয়নি। বাল্লিগুড়ার একমাত্র গেস্ট হাউসটিতে ওদের ঘর রাখা ছিল। ওরা খেয়েদেয়ে মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিকেল সাড়ে চারটেয় ওদের ঘুম ভেঙে উঠতে হল। কারণ কলকাতার দুই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করতে স্বয়ং ডিএম সাহেব এসেছেন। তা ছাড়া পুরো টিম তৈরি, তাদের সঙ্গেও পরিচয় হওয়া দরকার।
ওড়িশা পুলিশের স্পেশাল এলিট ফোর্স থেকে যে তিনজনকে পাঠানো হয়েছে তাদের মধ্যে বলরাম দাস হল সাব-ইন্সপেক্টর। এর বিশেষত্ব হল এর পাহাড়ে চড়ায় ডিগ্রি আছে। এএসআই মানিক নায়েক হল শুটিং-এর এক্সপার্ট। ক্র্যাক-শট হিসাবে গোটা ওড়িশা পুলিশে বিখ্যাত। গত বছর ন্যাশনাল-এ থার্ড হয়েছিল। আর শ্রীধর জলধিও এএসআই। সে হল মার্শাল আর্টের ট্রেনিং প্রাপ্ত। ও র্যাফদের মার্শাল আর্টের ট্রেনিং দেয়। রমলা, মোহিনীর জন্য নিযুক্ত ফিমেল অ্যাটেন্ডেন্ট, পুলিশেরই কনস্টেবল।
এ ছাড়া কনস্টেবল রাম পণ্ডা চমৎকার রান্না করতে পারে। আর সুখময় মহান্তি হল পালোয়ান। লম্বায় প্রাংশুর সমান হলেও চওড়ায় এবং ওজনে দেড়গুণ তো হবেই। মেদিয়া হল কাচ্চাবালি থানার একজন খন্দ কনস্টেবল। বাল্লিগুড়ার পথঘাট হাতের তেলোর মতো চেনে। এরা সবাই পুলিশের লোক। বনবিভাগ থেকে একজন অফিসার চাওয়া হয়েছিল। এখনও কেউ এসে পৌঁছননি, কিন্তু বনবিভাগ থেকে কাপ্পোকে পাঠানো হয়েছে। বলা হয়েছে এ যদিও আদিম বোন্ড উপজাতির লোক, কিন্তু জঙ্গলে কোনও কিছু খুঁজে পেতে হলে এর মতো দক্ষ লোক আর নেই। এ ছাড়াও এ খুব নাম করা গুনিন, সঙ্গে থাকলে সবাই ভরসা পাবে।
পরদিন সকাল আটটায় যাত্রা শুরু। কাজেই মোহিনী ওদের বিশ্রামের অবকাশ দিয়ে চলে এসেছিল। তার নিজের কাজের শেষ নেই।
পরদিন সকালে একটা জিপ আর একটা ছোট ভ্যানে করে টিম গিয়ে পৌঁছল সেই কুড়গুড্ডা পাহাড়ে, যেখান থেকে খন্দ ছেলে দুটি অপহৃত হয়েছিল। এইবার দেখা গেল কাপ্পোর কেরামতি। ছোট ছোট চিহ্ন ধরে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে ও এক পাহাড় থেকে ও পাহাড়, এ জঙ্গল থেকে সে জঙ্গল, চলতে লাগল। অবশেষে সন্ধ্যা নাগাদ একটা পাহাড়ে খানিকটা উঠে ঘোষণা করল, এই গুহার ভিতরেই অপহরণকারী ঢুকেছে।
(৫)
এখন রাত্রি সাড়ে সাতটা মতন বাজে। দুপুরে প্যাক করে আনা খাবার দিয়ে কাজ সারতে হয়েছে। তাই রাম পন্ডা গুছিয়ে রাতের খাবার তৈরি করছে। মেনু হল খিচুড়ি, যাতে কিনা নানারকম শীতের সবজি আছে। সেই সঙ্গে মুরগির কষা মাংস। আলু বড়া জাতীয় এক ধরনের ভাজাও রান্না করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটা জ্যান্ত মুরগি রসদ হিসাবে আনা হয়েছে। তবে ওতে আর দিনদুয়েকের মতো চলতে পারে। বাল্লিগুড়ার এই অঞ্চলটা সাহারা মরুভূমির মতো জনহীন। কোথাও কোনও খাবার বা রসদ কিনতে পাওয়া যাবে না।
এখানে এখনও ঠান্ডা আছে। তবে এত বেশি নয় যে বাইরে বসা যাবে না। ব্রতীন, প্রাংশু আর মোহিনী, তাই ওদের তাঁবুর বাইরে একটা শতরঞ্চি পেতে বসে আড্ডা মারছে। দু-চার কথার পরে কথা ঘুরে গেল ক্যানিবলিজম নিয়ে। প্রাংশুই বলল, “আচ্ছা আজকের দিনেও কি পৃথিবীতে কোথাও ক্যানিবল আছে?”
ব্রতীন বলল, “এটা একটা বিরাট বিষয়। এক কথায় এর উত্তর দিতে গেলে বলতে হয়, আছে।”
“কোথায়?”
“কেন দিল্লিতে? নিঠারি মার্ডার কেস নিয়ে তো মিডিয়া তোলপাড় হয়ে গেল।”
“আহা ও তো একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।”
“ঘটনাগুলো তো এরকম বিচ্ছিন্নই ঘটে।”
“না, আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। আমি বলতে চেয়েছি, মানে ক্যানিবল আদিবাসী গ্রুপ, আছে?”
“মানে এরকম কেউ, যারা আর পাঁচটা খাদ্যের মতো রেগুলার নরমাংস খেয়ে থাকে?”
“ঠিক তাই।”
“উত্তর হল, না নেই, এবং কখনই ছিল না।”
“সে কি? এত যে সব নরখাদক ছিল আফ্রিকায়?”
“কোন কালেও ছিল না।”
“সে আবার কি? হেঁয়ালি না করে খুলে বল।”
“আসলে ক্যানিবলিজম ইজ দি বিগেস্ট ট্যাবু ইন হিউম্যান রেস। কোনওকালেই মানুষ স্বাভাবিক খাদ্য হিসাবে অন্য মানুষকে খায় না। খাবার আলাদা কারণ থাকে। ধর্মীয় কারণ, মেডিক্যাল কারণ— সে যত ভুলভালই হক না কেন, তা ছাড়া প্রবল খাদ্যাভাব। এ ছাড়া মানুষ কোনও কালে মানুষ খায়নি।”
“তাহলে আফ্রিকার যে সমস্ত অ্যাডভেঞ্চার…”
“সব গল্প কথা। কলোনিয়াল যুগের প্রারম্ভে, যখন কলম্বাস আমেরিকা গিয়েছিলেন, তখন ক্যারিবিয়ান দ্বীপের উপজাতির লোকরা তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করেছিল। সেকথা কলম্বাসের কাছে শোনার পর কলম্বাসের অভিযানের স্পন্সরর স্পেনের রানী ইসাবেলা পরবর্তী অভিযানের কর্তাদের বলেছিলেন এই সব আদিবাসীর সঙ্গে যেন খ্রিস্টান-সুলভ ব্যবহার করা হয়। তবে যদি এইসব আদিবাসী নরখাদক হয় তাহলে তাদের সঙ্গে যে কোনওরকম খারাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। রোমের পোপও এ ব্যাপারে সায় দিলেন। কিন্তু পরের অভিযানের নায়করা দেখলেন আমেরিকায় বিশেষ সোনা পাওয়া যাচ্ছে না (পরে অবশ্য সোনা, বিশেষ করে রুপো অনেকই পাওয়া গেছিল)। তখন তাঁরা দাস ব্যাবসাটাকেই লাভজনক একটা ব্যাপার বলে ধরলেন। তখনই রটানো হল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বা মহাদেশীয় আমেরিকার লোকজন নরখাদক। এবারে তাদের সঙ্গে যে কোনও বর্বর ব্যবহার করা চলতে পারে। সেই একই লজিকে পরে আফ্রিকার লোকজনকে নরখাদক বলা হত, যা একেবারেই মিথ্যা। ধর্মীয় কারণে ক্যানিবলিজম যেখানে চালু ছিল, সেই পাপুয়া নিউগিনি, ফিজি বা কয়েকটি মেলানেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কথা চাপাই পড়ে গেল। কারণ সেখানকার লোকেরা তথাকথিত সভ্যতা থেকে এতই দূরে ছিল, যে তাদের দাস বানিয়ে কাজ করানো, কার্যত অসম্ভব ছিল।”
প্রাংশু হাঁ হয়ে গিয়ে বলল “বোঝ কাণ্ড!”
মোহিনী বলল, “কিন্তু ধর্মীয় কারণে ক্যানিবলিজম, ব্যাপারটা কি রকম?”
“এটা এক ধরনের সংস্কার, সেটা হল কোনও শ্রদ্ধেয় লোক মারা গেলে, তার দেহটাকে যদি সবাই খেয়ে ফেলে তবে তার গুণগুলো সবাই পাবে। আবার শত্রুদের বন্দি করে তাদের যদি খেয়ে ফেলা যায় তাহলে তাদের শক্তিগুলো সব আমাদের ভিতরে চলে আসবে। এই ছিল মেলানেশিয়দের মধ্যে কোনও কোনও উপজাতির বিশ্বাস।”
“এখনও কি তার এই প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছে?”
“আর কোথাও সেভাবে শোনা যায় না। তবে পাপুয়া-নিউগিনিতে নাকি এখনও, ‘আসমেত’ আর ‘কোরোওয়াই’ এই দুটো ট্রাইবে ব্যাপারটা চলে। আসলে পাপুয়া নিউগিনি একটা বিরাট দ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া বাদ দিলে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। ওই দ্বীপটা দু ভাগে বিভক্ত, পুবের অংশটার নাম পাপুয়া-নিউগিনি আর পশ্চিমদিকে-রটার নাম ইরিয়ান জ্বারা, এটা ইন্দোনেশিয়ার অংশ। আসমেতরা থাকে পুবের দিকে। ‘কুরু’ রোগের প্রকোপে, এখন তারা প্রায় নরমাংস খাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিম দিকটা এতই দুর্গম আর বন্য যে সেখানকার কোরোওয়াইরা ঠিক কি অবস্থায় আছে আমাদের ভালোভাবে জানা নেই।”
“কুরু আবার কি রোগ?”
“খুবই রহস্যময় একটা রোগ। যা কেবলমাত্র নরখাদকদেরই হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্তরা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে প্রচণ্ডভাবে মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে থাকে। কিন্তু তাদের ঘুম সহজে ভাঙে না। এরা ঘুমাতে ভীষণ ভয় পেতে থাকে। এইরকমভাবে তারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে মারা যায়। আগে তো এটাকে সভ্য মানুষেরা পাপের শাস্তি বলত। কিছুকাল আগে আবিষ্কার হয়েছে মানুষের মাথার কোষে প্রায়ন বলে একটা প্রোটিন আছে। সেই প্রোটিন থেকে এই রোগ হয়। কিন্তু সবার হয় না। এটা জানার পর পাপুয়া-নিউগিনির আসমেটরা ভয়ে নরমাংস খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে।”
“বাবা রে! কত রকম রোগ আছে! তবে অবশ্য রোগের জন্য যদি ক্যানিবলিজম কমে সেটা ভালো কথা।”
ব্রতীন আপত্তি জানাল, “এটা হল টিপিক্যাল তথাকথিত সভ্য মানুষের কথা। আত্মীয়ের দেহ সৎকার না করে যদি আসমেতরা সেটা খেয়েই ফেলে, তাতে অন্যায় কোথায়?”
“ভারতে আশা করি এরকম কিছু কি নেই?”
“না। কিন্তু ভারতে এক শ্রেণির সাধু, যারা নিজেদের অঘোরী বা অঘোরপন্থি বলে দাবি করে, তারা শ্মশানে মৃত মানুষের মাংস, ঘিলু, এসব খেয়ে থাকে। যদিও এটা নাকি তারা ঘৃণা থেকে মুক্তি পাবার জন্য করে থাকে। তাদের নাকি বিষ্ঠা চন্দন সমজ্ঞান।”
প্রাংশু জ্ঞানীর মতো বলল, “তান্ত্রিকরা তো নরবলি দিয়েই থাকে। ওরা তো মানুষ খাবেই।”
ব্রতীন হাঁ হাঁ করে প্রতিবাদ করল, “নরবলি দেওয়া আর নরখাদক হওয়া দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। বলি দিয়ে সেই মানুষের মাংস খাবার চল কোথাও নেই। এই খন্দরাই তো আগে নরবলি দিত।”
“সে কি রে?”
“খুব ব্যাপকভাবেই দিত। এরা তো বছরে একবার চাষ করত, সেই চাষের মরসুমের আগে অন্য জায়গা থেকে একজন মানুষকে গায়ের জোরে বন্দি করে বা পয়সা দিয়ে কিনে নিয়ে আসত। তারপর বেশ কিছুদিন খাইয়ে দাইয়ে মোটা করত। তারপর খুব বিশ্রী নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ সারা জমিতে ছড়িয়ে দিত। ওদের ধারণা ছিল এতে জমির উর্বরতা বাড়বে। এই বলির লোকটাকে বলা হত, ‘মেরিয়া’।
মোহিনী বলল, “আমার ধারণা ছিল খন্দদের ভাষায় মেরিয়া একটা খুব খারাপ গালাগালি। মাসদুয়েক আগে, এখানে একজন লোককে, আর কয়েকজন মেরিয়া বলে বিদ্রূপ করেছিল বলে লোকটা তাদের দুজনকে সাংঘাতিকভাবে আহত করেছিল। লোকটির বিরুদ্ধে চার্জ ফ্রেম করার সময় খন্দদের পঞ্চায়েত এসে উপস্থিত হয়। তাদের বক্তব্য মেরিয়া বলে গাল দেওয়ার পর খুন করলেও কোনও অন্যায় হয় না। পঞ্চায়েতের লোকেরা সটান হসপিটালে গিয়ে সেই আহত লোক দুজনের থেকে লিখিত স্টেটমেন্ট এনে দেয়, যে তাদের কে আঘাত করেছে তারা জানে না। ফলে লোকটিকে বেকসুর খালাস দিতে হয়। সে যাবার সময় আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি খুব ভয়ে ছিলাম যে গ্রেপ্তার করার জন্য সে আবার আমার উপর প্রতিশোধ না নেয়। কিন্তু সে আমাকে জেলে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধন্যবাদ দিয়ে যায়। জেলে কেউ তাকে গালি দেয়নি। এটাই নাকি ভালো ব্যবহারের চূড়ান্ত।”
ব্রতীন বলল, “বিভিন্ন আদিবাসীদের মূল্যবোধ বিভিন্ন রকমের হয়। তবে বেশির ভাগ আদিবাসীরাই মিথ্যা বলে না, চুরি করে না এবং রেপ তাদের কাছে অজানা জিনিস। সভ্য হওয়া ইস্তক আদিবাসীদের এই সব গুণগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।”
মোহিনী বলল, “কিন্তু ব্রতীনদা, এই লম্বগলিদের ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলেন? এখানে একটা নরখাদক ট্রাইব এল কোথা থেকে?”
“প্রথমে দেখতে হবে এরা আদৌ নরখাদক কি না? এরা নরবলি দেবার জন্যও তো লোক নিয়ে আসতে পারে? এরা হয়তো খন্দদেরই কোনও হারিয়ে যাওয়া উপজাতি।”
“আর এদের চেহারা?”
“যদি ফোটোগুলি অরিজিনাল হয়, তাহলে এরকম চেহারার কোনও মানুষের প্রজাতি আছে বলে জানা নেই। আফ্রিকার মাসাইরা সবচেয়ে লম্বা ছিপছিপে চেহারার হয়। কিন্তু দৈর্ঘ্য প্রস্থের এত বেশি অনুপাত তাদেরও নেই। দেখা যাক, কাপ্পো যদি সঠিক জায়গায় এনে থাকে তো কালই দেখা যাবে।”
“মাসাইরা কি নরখাদক?”
“একেবারেই না। কি বললাম এতক্ষণ? আফ্রিকাতে সেভাবে কোনও নরখাদক উপজাতিই নেই।”
এমন সময় রাম পণ্ডা এসে খবর দিল খাবার রেডি। ম্যাডাম অনুমতি দিলেই আসন পাতা হবে। সবাই সভা ভঙ্গ করে উঠে পড়ল।
(৬)
“শ্রীধর, এত আস্তে আস্তে তো চলাই যাচ্ছে না। এখন তো দিনের বেলা। ওই বুনো বোন্ডটা রাস্তায় কি শুঁকছে বল তো?”
“জানি না বলরাম দাদা, কিন্তু ওর কথা ম্যাডাম খুব শোনেন।”
“এত লেখাপড়া শেখার পর যদি ম্যাডামের গুনিনের উপরে এত বিশ্বাস হয়!”
“আমার এমনিতে কিন্তু ম্যাডামকে খুবই ওস্তাদ কম্যান্ডারের মতোই লাগছে বলরাম দাদা।”
“আরে সে তো প্রথম প্রথম আমারও লাগছিল। কিন্তু ওই জংলিটার মধ্যে উনি কি যে দেখেছেন? ভোর থেকে দুপুর হয়ে গেল, এখনও আমরা পাঁচ কিলোমিটার চলেছি কি না সন্দেহ।”
কথাটা সত্যি। ভোর চারটের সময় উঠে, স্ট্রাইক দি টেন্ট করে, পাঁচটার মধ্যে উপত্যকায় ঢুকে পড়া হয়েছে। তখন সবে সকালের আলো ফুটছে। এই সময় উপত্যকায় ঢোকার দুটো কারণ আছে। প্রথমত, উপত্যকায় সদলবলে ঢোকার মুহূর্তে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম, শত্রুপক্ষ, যদি থাকে, তারা তখন ঘুমবে। দ্বিতীয়ত, আলো জ্বালাতে হবে না। আলো অনেক দূর থেকেও চোখে পড়ে।
বলরাম বলেছিল লটবহর পাহাড়ের বাইরে ক্যাম্পে রেখে, ঝাড়া হাত-পা হয়ে উপত্যকায় ঢুকতে। কিন্তু মোহিনী রাজি হয়নি। কেন হয় নি সেটার যে কারণটা ও দেখাল, সেটা অনেকের কাছেই বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। মোহিনীর বক্তব্য হল, ফাঁকা টেন্ট রাখা যাবে না। ওখানে পাহারায় অন্তত দুজন লোক লাগবে। দল থেকে দুজন লোক কমিয়ে দেয়া উচিত হবে না। বলরাম তর্ক করার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল রাম পণ্ডা আর রমলা যদি ওখানে থাকে, তাহলে কম লোকের জন্য খুব একটা অসুবিধাও হবে না, আবার ওরা ওদিকে নিশ্চিন্তে রান্নাবান্না করে রাখতে পারত। কথাটা প্রাংশুর অন্তত খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। মোহিনী তাতে রাজি হয়নি। কিন্তু সেই সময়ে ওর মুখের ভাব দেখে প্রাংশুর মনে হয়েছে যে মোহিনী খুব চিন্তার মধ্যে আছে।
ওরা পাহাড় থেকে নেমে যখন উপত্যকার সমভূমিতে এল, তখন উপত্যকার হালচাল স্বাভাবিকই লাগছি। কাল রাতের মতো নিথর নিস্তব্ধ ব্যাপারটা নেই, তবে এই উপত্যকায় জীবজন্তু, পাখপাখালির সংখ্যা অনেকটাই কম। স্বাভাবিক গতিতে লেক পর্যন্ত পৌঁছানো হল।
বলরামের ব্যাক প্যাকে জল টেস্ট করার কিট রয়েছে। লেকের জল টেস্ট করে দেখা গেল, জল স্বাভাবিক এবং নিশ্চিন্তে খাওয়া যেতে পারে। একটা বড় সমস্যার সমাধান হল। একটা অভিযাত্রী দল খাবার ছাড়াও দিনতিনেক পর্যন্ত চালাতে পারে, কিন্তু জল ছাড়া একদিনও নয়। জল আবার বয়ে নিয়ে যাবার পক্ষেও ভীষণ ভারী।
গুহার মুখ থেকে, লেকের ও পারে ঘন জঙ্গল আছে বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু এপাশে এসে দেখা গেল, বড় গাছ থাকলেও ঝোপঝাড় তত নেই। সহজেই এগিয়ে চলা যাবে। কিন্তু কাপ্পো হঠাৎ ভীষণই চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারপর সে প্রায় প্রত্যেক পায়ে, মাটি, গাছ, শুঁকতে শুঁকতে চলছে। এত আস্তে চলার দরুন সবারই বিরক্তি লাগছে। কিন্তু মোহিনী কাপ্পোর কথা মতোই দল পরিচালনা করছে।
এই মুহূর্তে কাপ্পো একেবারেই দাঁড়িয়ে গেছে। একটা গাছের বাকলের গা থেকে কিছু একটা, খুটে খুটে তোলার চেষ্টা করছে। প্রাংশু মোহিনীকে ইংরাজিতে প্রশ্ন করল, “ও বড় সময় নিচ্ছে, তাই না?”
মোহিনী বলল, “ওরা যে কীভাবে পথ খুঁজে পায় আমাদের বোঝা অসাধ্য।”
“আরও একটা প্রশ্ন আছে। আপনি বলরামের কথামতো বাইরের টেন্টে মালপত্র রেখে এলেন না কেন?”
মোহিনী হেসে ফেলল। বলল, “ওকে তখন যে কথাটা বলেছিলাম সেটা আপনার পছন্দ হয়নি?”
“একেবারেই না।”
“আসলে আমি রাত্রে এই ভ্যালিটার ভিতরে ক্যাম্প করতে চাই। শত্রুরা যদি থাকে, তাহলে অন্তত ধারে কাছে আসবে। একটা ক্লোজ এনকাউন্টার হতেও পারে। কিন্তু এ কথাটা আমাদের টিমের লোকজনকে আমি বলতে চাই না, ওরা ভাবতে পারে আমি ওদের টোপ হিসাবে ব্যবহার করছি।”
প্রাংশু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সহসা কাপ্পো আবার চলতে শুরু করল। ব্রতীন খুব মনোযোগ দিয়ে কাপ্পোকে লক্ষ করছিল। বলল, “মনে হচ্ছে ও কোনও একটা হদিস পেয়ে গেছে। ইস ওর ভাষাটা যদি জানতাম, তাহলে ওদের এই ট্র্যাকিং এর কৌশলগুলো নোট করে নিতাম।”
কাপ্পো এবারে কিন্তু সোজা হয়ে হন হন করে হেঁটে চলেছে। পিছন পিছন সিঙ্গেল ফাইলে গোটা দল। সবার পিছনে রয়েছে পালোয়ান সুখময় মহান্তি। একটু চলার পরেই দেখা গেল একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা। রাস্তায় পৌঁছে কাপ্পো দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছু বলল। মেদিয়া অনুবাদ করে বলল, “ও বলছে, এই পায়ে হাঁটা পথ ধরে বাঁ দিকে কিছুটা গেলেই পিশাচদের ডেরা পাওয়া যাবে।”
মোহিনী কয়েক সেকেন্ড ভাবল। তারপর বলরামকে ডাকল, বলল, “আমরা ওদের অ্যাটাক করতে চাই না। তাহলে কীভাবে এগোন বুদ্ধিমানের কাজ হবে?”
বলরাম মাথা চুলকাতে লাগল, বলল, “ম্যাডাম ওদের উপর চুপচাপ হামলা করাই তো ভালো।” মোহিনী একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “জানা নেই, শোনা নেই, আমরা ওড়িশা পুলিশের এলিট ফোর্স, একটা আদিবাসী ট্রাইবকে আক্রমণ করে বসব?”
মানিক নায়েক বলল, “একটা কাজ করা যেতে পারে, কাপ্পো আর মেদিয়া এগিয়ে চলুক। পিছন থেকে আমি আর বলরামদা ওদের কভার করি। আপনারা শখানেক ফুট পিছনে আসুন।”
মোহিনী চিন্তিতভাবে বলল, “এই মতলবটাও আমার পছন্দ হচ্ছে না। ওরা দুজন দেখে যদি মেদিয়া আর কাপ্পোকে অ্যাটাক করে, তখন তোমরা তো গুলি ছুঁড়বে, তাই না? সেটাই আমি চাইছি না।”
মানিক বলল, “তাহলে আমরা দুজনই এগিয়ে যাই। ওরা বন্দুক দেখলে অ্যাটাক করতে ভয় পাবে।”
“কিন্তু সেক্ষেত্রে ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে পারে। সেটাও তো ভালো হবে না। কী যে ঝামেলায় পড়লাম।”
এমন সময় একটু দূরে জঙ্গল কাঁপিয়ে একটা কুচিলা-খাঁই পাখি ডেকে উঠল। ‘কু হাঁক্কু হাঁক্কু’। ওড়িশার জঙ্গলের সঙ্গে জানাশোনা না থাকলে এই আওয়াজে পিলে চমকে যাবার কথা। প্রাংশু আর ব্রতীনের ঠিক তাই হল। বাকিরা প্রথমটা চমকে উঠলেও তারপর পাত্তা দিল না। তিনবার ডেকে পাখিটি নিরস্ত হল। প্রাংশু আঁতকে উঠে বলল, “ও কী?”
মোহিনী হেসে ফেলে বলল, “পিশাচ নয়, ওটা ধনেশ পাখি। ইংরাজিতে বলে লেসার ইন্ডিয়ান হর্নবিল।”
“বাবা, লেসার হর্নবিলেরই এই আওয়াজ! তাহলে গ্রেটার-টার আওয়াজ কীরকম হবে?”
“গ্রেটারের আওয়াজ একেবারেই নিরীহ। কিন্তু কাপ্পো কী বলছে?”
মেদিয়া বলল, “কাপ্পো বলছে কুচিলা খাঁই নয়। পিশাচদের আওয়াজ।”
“মানে?”
কাপ্পো গড়গড় করে নিজের ভাষায় কিছু বলে গেল। মেদিয়া তার অনুবাদ করল, “ওটা কুচিলা খাঁই নয়। পিশাচরা জানতে পেরে গেছে আমরা এসে গেছি। ওরা নিজের দলকে কুচিলা খাঁইয়ের আওয়াজ করে সতর্ক করল।”
মোহিনী উত্তেজিত হয়ে বলল, “তাহলে তাড়াতাড়ি চল। ওরা পালাবার আগেই সবাই মিলে গিয়ে পড়তে পারলে হয়তো কিছু কথা বলা যেতে পারে।”
পুরো দলটাই বাঁ দিকের রাস্তায় দৌড় মারল। প্রায় দুশো মিটার যাবার পর দেখা গেল বেশ খানিকটা জায়গায় জঙ্গল পরিষ্কার করে মাঠের মতো করা আছে। আর তার একপাশে একটা ছোট ঝোপড়ার মতো ঘর। কাপ্পো সামান্য এদিক ওদিক দেখেই সটান ঘরটার মধ্যে ঢুকে গেল। ওর পিছন পিছন সবাই ঘরটার দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু তার মধ্যেই কাপ্পো বেরিয়ে এল। মুখে নিখাদ আতঙ্ক।
ওরা কাপ্পোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল কাপ্পো কিছু বলতে পারছে না, ভয়ে ওর কথা আটকে গেছে। এবারে মোহিনী দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেই, ‘আঁক’ করে একটা আওয়াজ করল। প্রাংশু মোহিনীর পিছন পিছন ঘরে ঢুকে পড়ল। এক এক করে সবাই ঢুকল, প্রত্যেকের মুখ দিয়েই কিছু না কিছু আওয়াজ বেরিয়ে এল।
ঘরের একপাশে স্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে নরকঙ্কালের টুকরো! শরীরের বিভিন্ন জায়গার হাড়, খুলির টুকরো। অন্তত দশ বারোজন মানুষের হাড় তো হবেই, বেশিও হতে পারে।
(৭)
এখন রাত্রি সাড়ে ন-টার মতো হবে। ওরা লেকের পাড়ে ক্যাম্প করেছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা সবাইয়েরই শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। যথারীতি প্রাংশু, ব্রতীন আর মোহিনী তাঁবুর বাইরে বসে আছে। কিন্তু কথাবার্তা প্রায় বন্ধ। সকালের ধাক্কাটা এখনও সবাই সামলে উঠতে পারেনি।
সকালে ওই ঝোপড়ার মধ্যে প্রথম কাণ্ডজ্ঞান ফিরে আসে ব্রতীনের। ও বলরামকে বলে, “তুমি কি এই হাড়গুলো দেখে বলতে পারবে যে এগুলো ভুক্তাবশেষ না এমনি ডেড বডির থেকে হয়েছে? বলরাম কিছু বলতে পারল না। কিন্তু পালোয়ান সুখময় মহান্তি এগিয়ে এল। প্রথম জীবনে সে মর্গে কিছুদিন ডিউটি করেছে। সে একটু খুঁটিয়ে দেখে বলল, “না, এই হাড়গুলো কারুর চেটেপুটে খাওয়া। কিছু কিছু হাড় চিবানোও হয়েছে।”
ব্রতীন খুব চিন্তিতভাবে বলল, “তাহলে এরা সত্যিই ক্যানিবল, আশ্চর্য!”
ইতিমধ্যে কাপ্পো কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। সে মেদিয়ার মারফৎ জানাল, “এই ঘরেই দুটো খন্দ ছেলেকে আটকে রাখা হয়েছিল। তার বেঁচে আছে। আধঘণ্টা আগে তাদের বাঁধা অবস্থায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি স্পষ্ট তাদের গন্ধ পাচ্ছি।”
এই এক কথায় টিম আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠল। ওরা যখন বেঁচে আছে তখন ওদের খুঁজে বার করাটা তো প্রথম কাজ। কিন্তু ব্রতীন ততক্ষণে ঘরের কোনে থাকা মূর্তিটার দিকে মন দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা লম্বগলিদের দেবতার মূর্তি। একখণ্ড নরম বেলে পাথরে খোদাই করা রিলিফ টাইপের জিনিস। ব্রতীন ওতে হাত দিল না, শুধু ওর মোবাইলে একগাদা ছবি তুলল। তারপর অন্যদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল।
কিন্তু সারাদিন উপত্যকার বিভিন্ন কোনে ঘোরাঘুরি করেও কোনও লম্বগলির টিকির দেখা পাওয়া গেল না। কাপ্পোকেও খুব বিভ্রান্ত লাগছিল। সে বিড়বিড় করে কী সব বলছিল। মেদিয়াকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল কাপ্পোর বেশির ভাগ কথাই সে বুঝতে পারেনি। তবে কাপ্পো বার বার একটা কথা বলছিল, ‘এখান থেকে কোথায় চলে গেল?’
দিনের শেষে মোটামুটি জানা গেল যে এই উপত্যকাটায় আর কোনও জায়গায় কোনও ঘর বা ঝোপড়া নেই। তবে যে গুহা দিয়ে ওরা ঢুকেছিল, তার উলটো দিকের পাহাড়ের গায়ে অনেক উঁচুতে কিছু কিছু গুহার মতন জায়গা আছে। তাতে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু পাহাড়ের ওই দিকটা অনেকটা বেশি খাড়া। ওঠানামা করা প্রায় দুঃসাধ্য। ওখানে কারো পক্ষে পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়া অসম্ভব।
মোহিনী যেটা করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল সেটা হল উপত্যকার সর্বত্র ওয়াই ফাই সিসিটিভি বসিয়ে দেওয়া। প্রায় চল্লিশটি নাইট ভিশন ক্যামেরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। আর একটা প্রবল শক্তিশালী ওয়াই ফাই রাউটার, আর সেই সঙ্গে একগাদা রিপিটার বিভিন্ন দূরত্বে ছড়ানো আছে। সব ক-টা ক্যামেরার তোলা ছবি দুটো ল্যাপটপে দেখা যাচ্ছে। তবে বেশির ভাগ ক্যামেরাই মোশন সেন্সর মোডে আছে। ক্যামেরার সামনে নড়াচড়া ধরা পড়লে তবেই ভিডিয়ো উঠবে।
ব্রতীন খুব মন দিয়ে নিজের ফোন দেখছে। প্রাংশু প্রশ্ন করল, “এত কী দেখছিস?”
“ওদের দেবতার ছবি। অনেক আদিবাসী দেবতার ছবি দেখেছি কিন্তু এরকম দেখিনি।”
“এরা না হয় একটা নতুন দেবতারই পুজো করল। ট্রাইবটাও তো নতুন।”
ব্রতীন হাসল। বলল, “ব্যাপারটা অত সোজা নয়। আদিবাসীদের দেবতা খুব একটা জটিল কিছু হতে পারে না। সাধারণত এরা গাছ বা কোনও পাথরকে পুজো করে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক শক্তি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দেবতাকে পুজো করে। এই দেবতারা কখনও কোন পুরুষ দেবতা বা কখনও কোন নারী দেবতা। মজা হচ্ছে, পুরুষ বা নারী যাইই হোক তার লিঙ্গ পরিচয়টা খুব পরিষ্কার থাকবে, এ ছাড়া দেবতার মূর্তিতে খুব একটা ডিটেল থাকবে না। এবারে আর একটা কাণ্ড হতে পারে। ওই আদিবাসী সেক্ট যদি মূল ধারার কাছাকাছি থাকে তাহলে অনেক সময়ে মূল ধারার দেবদেবীর পূজাও করে…”
“মূল ধারা মানে?”
“মানে শিব, দুর্গা, রাম ইত্যাদি। বর্তমানে উত্তর ভারতের আদিবাসীদের মধ্যে হনুমানজির পুজো খুব ছড়িয়েছে। এ ছাড়া কিছু কিছু আদিম আদিবাসীরা কোনও কোনও জন্তু, যেমন ষাঁড়, বাঘ, মাছ, কচ্ছপ ইত্যাদির পুজো করে। কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“এই ছবিটা দ্যাখ। কীসের মূর্তি বলতে পারবি? এটা কোনও মূর্তিই নয়। বরং একটা দৃশ্যের রিলিফ খোদাই করা আছে। কত কিছু আছে বল তো এই ছবিটায়? প্রথমত এটা কোনও মানুষের মূর্তি না। কোনও চেনা জন্তুর মূর্তিও না। খানিকটা জ্যামিতির ফিগার, খানিকটা অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু, সবচেয়ে আশ্চর্য হল কাঁচা হাতে অজস্র ডিটেল খোদাই করা আছে, যেটা কোনও আদিবাসী আর্টে থাকে না। মজা হল এটা এত কাঁচা হাতে করা, যে এটা অন্য কোনও জায়গা থেকে চুরি করে আনা, তাও বলা যাচ্ছে না।”
প্রাংশু ছবিটা দেখতে দেখতে বলল, “এই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, গাছের তলায় নিউটন বসে আছে, একটা আপেল পড়ছে। টাইকো-ব্রাহে দূরবীন দিয়ে তারা দেখছে। ওদিকে কেপলার খাতায় আঁক কেটে তার ল-গুলো বোঝাচ্ছে, এই তো উপবৃত্ত, তার ফোকাসে সূর্য। কারা সব হেলমেট পরে…”
মোহিনী খিলখিল করে হেসে, “সত্যি প্রাংশুবাবু, আপনি পারেন বটে! সুকুমার রায়ের ‘কালাচাঁদের ছবি’ বলে একটা গল্প আছে। আপনার কথা শুনে আমার সেই গল্পটা মনে পড়ে গেল।”
প্রাংশু হেসে ফেলল, বলল, “আপনি বেশ গল্পের বই পড়েন মনে হচ্ছে। ও গল্পটা আমার খুব ফেভারিট।”
ব্রতীন প্রাংশুর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল, “সিরিয়াস ব্যাপারে ইয়ার্কি মারবি না।”
মোহিনী হাসতে হাসতেই বলল, “সত্যি প্রাংশু-দা, ঠাট্টার সময় ইয়ার্কি একদম ভালো লাগে না!”
প্রাংশু বলল, “লীলা মজুমদারের কোটেশন, ‘লঙ্কাদহন পালা’ থেকে।”
মোহিনী আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখনি একটা ল্যাপটপ থেকে পিঁক করে একটা আওয়াজ হল, মানে মোশন সেন্সরে কিছু একটা ধরা পড়েছে। ওরা তিনজনেই লাফ মেরে ল্যাপটপের চলন্ত ছবিটার দিকে তাকাল। মোহিনী ওটার উপর ক্লিক করে ওটাকে বড় করে দিল। এটা সবচেয়ে দূরের ক্যামেরাটা।
কয়েকটা দড়ির মতো ফিগার দেখা যাচ্ছে। সেগুলো ক্রমশ চেহারা বদলাচ্ছে আর চওড়া হচ্ছে। অদ্ভুত ট্যারাব্যাঁকাভাবে এক-একটা মানুষের চেহারা ফুটে উঠছে আবার চলে যাচ্ছে। অবশেষে সেগুলো তিনটে মানুষের চেহারায় এসে পৌঁছল।
ওরা রোগা এবং লম্বা। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে লাঠি। ওরা আস্তে আস্তে লাঠিগুলো মাটিতে ঠুকছে। ধীরে ধীরে ওরা প্রথম ক্যামেরার আওতা থেকে বেরিয়ে গেল।
মোহিনী বিমূঢ়ের মতো বলল, “এটা কী হল ব্রতীনদা? ওরা কি অন্ধকার থেকে জন্ম নিল?”
ব্রতীনও ঠিক একই রকমভাবে বলল, “জানি না, বুঝলাম না।”
মোহিনী ততক্ষণে সবাইকে ডাক দিয়েছে। নীচু গলায় বলল, “ওরা আসছে। রেডি হও।”
ক্যাম্পের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। মোহিনী ল্যাপটপ দেখতে দেখতে শান্ত গলায় বলল, “সবাই কানে ব্লুটুথ হেডসেট লাগিয়ে নাও। আমাদের প্রথম চেষ্টা হবে অন্তত একজনকে জ্যান্ত পাকড়াও করা। গুলি চালানোটা শেষ চয়েস। মারামারি হলে লাঠি, বন্দুকের বাঁট, সবচেয়ে ভালো হল খালি হাত ব্যবহার করতে পারলে। ব্রতীনদা, প্রাংশুদা, আপনারা কানে হেডসেট লাগিয়ে টেন্টে ঢুকে যান। এটা আমার অর্ডার, কুইক।”
মোহিনীর ব্যক্তিত্বের এই দিকটা প্রাংশু বা ব্রতীনের দেখা ছিল না। ওরা সুড়সুড় করে টেন্টে ঢুকে গেল।
ইতিমধ্যে যে ক্যামেরা দুটো ওদের ঝোপড়ার দিকে রাখা ছিল সেটা থেকে সিগন্যাল আসতে শুরু করেছে। দেখা গেল এখন ওরা সংখ্যায় বেড়ে আটজন হয়েছে। তাহলে বাকি পাঁচজন কোথা থেকে এল?
এরপর বিভিন্ন ক্যামেরায় দেখা গেল এই আটজনের দলটা ক্রমে ক্রমে ওদের টেন্টের দিকে এগিয়ে আসছে। এখন কিন্তু ওদের স্বাভাবিক মানুষের মতোই দেখাচ্ছে। ওদের চলাফেরার মধ্যেও কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে না।
মোহিনী তার দলবলকে টেন্ট থেকে কিছু দূরে, ওরা যে দিক থেকে আসছে তার উলটোদিকে, ছড়িয়ে দিল। বিশেষভাবে বলে দিল বন্দুক ব্যবহার না করতে।
ল্যাপটপে দেখা যাচ্ছে, ওরা ঠেঁটের থেকে আর দেড়শো মিটার মতন দূরে জঙ্গলের মধ্যে আছে। ওরা এবারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে লাঠি ঠুকতে শুরু করল। পরমুহূর্তেই ওরা আবার সরু হয়ে যেতে লাগল। ক্রমে ক্রমে কাঁপতে কাঁপতে কয়েকটা অশুভ ছায়ার মতো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
মোহিনী সজোরে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল। চালে ভুল হয়ে গেছে। ওরা এখন কোন জায়গা দিয়ে যে এসে উপস্থিত হবে কে জানে! চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখলে ওর লোকেরা নার্ভ ফেল করবে কি না তাই বা কে বলতে পারে? ওদিকে ব্রতীন আর প্রাংশু টেন্টের মধ্যে রয়েছে। ওরা যদি সরাসরি টেন্টের ভিতরে উদয় হয় তাহলে? বাইরে থেকে ওরা তো কিছু বুঝতেও পারবে না। কিন্তু এখন আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লে লম্বগলিরা সমস্ত দেখতে পাবে। তখন সমস্ত ছকটাই বিফলে যাবে।
হেডসেটে মোহিনীর শান্ত গলার নির্দেশ ছড়িয়ে গেল, “ওদের হাতে ওই বল্লমটা ছাড়া আর অস্ত্র নেই। তোমাদের প্রথম কাজ হবে বল্লমটা কেড়ে নেওয়া। এক একজন এক একজনকে অ্যাটাক করবে। আমি এক্সট্রিম ডান-দিকেরটাকে অ্যাটাক করব। শুধু রমলা যেখানে আছ সেখানেই থাকবে। ব্রতীনদা, প্রাংশুদা, আপনারা যদি দেখেন ওরা টেন্টের ভিতরে ঢুকেছে তো তখনি চিৎকার করে আমাদের জানাবেন।”
মোহিনী নিজের সার্ভিস রিভলভারটা খাপ থেকে বার করে হাতে নিল। এটার বাঁট দিয়ে মাথায় মারলে অনেক আচ্ছা আচ্ছা পালোয়ানও ঘায়েল হয়ে যাবে। কিন্তু ওরা গেল কোথায়? মাটিতে রাখা ল্যাপটপের দিকে তাকাল মোহিনী। পরমুহূর্তেই চিৎকার করে উঠল, “ওরা আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। অ্যাটাক।” তখনিই রমলার চিৎকার শোনা গেল। ওরা সবচেয়ে দুর্বল টার্গেটকেই আক্রমণ করেছে। মোহিনী রণ হুঙ্কার দিয়ে রমলার দিকে তেড়ে গেল, “জয় বাবা জগন্নাথো।” টিমের সব কজনই তেড়ে যেতে যেতে এক সঙ্গে উত্তর দিল, “কিরপা কর অনাথো।”
লম্বগলিরা এই দুঃসাহসী আক্রমণে একটু ঘাবড়ে গেল মনে হয়। একজন লম্বগলি রমলাকে পিছন থেকে বাঁ হাতের কনুয়ের ভাঁজে গলা লক করে ধরেছিল। মোহিনীকে তেড়ে আসতে দেখে সে রমলাকে ছেড়ে বল্লমটা বাগিয়ে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু যেটুকু দেরি হয়েছিল তার মধ্যেই মোহিনীর রিভলভারের বাঁট লোকটার বাঁ কানের উপর এসে পড়ল। লোকটা ছিটকে মাটিতে পড়ল বটে কিন্তু তখনও বল্লম ছাড়ল না।
ইতিমধ্যে তাঁবু থেকে প্রাংশু মুণ্ডু বার করে ফেলেছে। প্রথমেই সে দেখল মোহিনীর পিছন দিক থেকে দুটো লম্বগলি বল্লম হাতে এগিয়ে আসছে। মোহিনী তাদের দেখতে পাচ্ছে না। ওদিকে টিমের অন্যরা বাকিদের তাড়া করেছে, তাদেরও এদিকে নজর নেই। প্রাংশু পাশে হাতড়ে হাতে পেল স্লিপিং ব্যাগটা। এক টানে ওটা হাতে নিয়ে সে-ও লম্বগলিদের দিকে তেড়ে গেল। মুখে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে শেখা বিকট রণহুংকার, “ছাতেঃ ফেলে দেব, suকিয়েঃ মরে যাবি, soকুনেঃ লিয়ে যাবে।”
প্রচণ্ড চমকে ঘাড় ফিরিয়ে মোহিনী দেখল দুটো উদ্যত বল্লমের সামনে প্রাংশু তেড়ে আসছে, হাতে স্লিপিং ব্যাগ। ওদিকে যাকে সে মাটিতে ফেলেছিল সেও ওঠার চেষ্টা করছে। খণ্ড মুহূর্তে মোহিনী সিদ্ধান্ত নিল গুলি করার। কিন্তু তার আগেই প্রাংশু লম্বগলিদের সামনে এসে পড়ল। দুটো বল্লম একসঙ্গে প্রাংশুর উপর নেমে এল বটে, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল স্লিপিং ব্যাগটা। দুটো বল্লমই স্লিপিং ব্যাগটা ভেদ করতে পারল না, বরং ব্যাগের ভিতরের নানা জটিলতায় জড়িয়ে গেল। প্রাংশু ঠিক ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো ব্যাগ সমেত দুটো লম্বগলির মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে এল। হাতে তার স্লিপিং ব্যাগ আর তাতে জড়ানো দুটো বল্লম। মোহিনীর সামনে যে লোকটা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, সবসুদ্ধ তাকে রামধাক্কা দিয়ে ফেলে, মাড়িয়ে, পার হয়ে গেল।
মোহিনী অবাক হয়ে দেখল, তিন তিনটে সশস্ত্র লম্বগলি, একজন নিরস্ত্র কবি-কাম-পদার্থবিজ্ঞানীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল। অবশ্য প্রাংশুর গায়ের জোরটাও তাকে সাহায্য করেছিল বটে।
প্রাংশু ঘুরে দাঁড়াল। ওখান থেকে আবার বিকট চিৎকারে জয়সূচক সিংহ নাদ ছাড়ল, “চালাও পান্সি বেলঘরিয়া।”
তিন লম্বগলি হঠাৎ প্রাংশুর দিকে হাত জোড়া করে একটা করুণ চিৎকার করে উঠল। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগিয়ে জঙ্গলের ভিতরে হারিয়ে গেল।
একটু সামলে নিয়ে মোহিনী প্রাংশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে না টেন্টে থাকতে বলেছিলাম?”
প্রাংশু প্রায় মুখ ভেংচিয়ে জবাব দিল, “আমি তেড়ে না এলে এতক্ষণে তোমাকে ঈশ্বরের বাগানে বসে হাওয়া খেতে হত সুন্দরী।”
মোহিনী একটা কড়া জবাব দিতে গিয়েও থমকে গেল। প্রাংশু যা বলেছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। ইতিমধ্যে ব্রতীনও টেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে প্রাংশুকে বলল, “কিন্তু ওরা তোকে অত ভয় পেল কেন?” প্রাংশু হেসে বলল “বোধহয় ‘চালাও পান্সি বেলঘরিয়া’ ওদের কোনও সিদ্ধ মন্ত্র। আমার মুখে শুনে ঘাবড়ে গেছে।”
ইতিমধ্যে বাকিরাও এক-দুই করে ফিরে আসছে। লম্বগলিরা আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে বুঝতে পেরে পালিয়ে গেছে। রমলা মুখ নীচু করে মোহিনীকে বলল, “আমার জন্য আপনার জীবন চলে যাচ্ছিল ম্যাডাম।” মোহিনী বিশেষ কিছু না বলে পুরো টিমকে নিয়ে এক জায়গায় বসল। তারপর রাতের পাহারা কীভাবে হবে তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হল।
(৮)
সকালবেলা পাখির ডাকে ব্রতীনের ঘুম ভাঙল। প্রাংশু বিছানায় নেই। ব্রতীনের ঘুম না ভাঙিয়ে সকালের কাজ সারতে গেছে হয়তো।
কাল রাতে ওরা অনেকক্ষণ জেগেছিল। মোহিনী মিটিং সেরে ওদের তাঁবুর সামনে এসে বসেছিল বটে কিন্তু কথা বলার মুডে ছিল না। ব্রতীন খুব মন দিয়ে ওদের কাছ থেকে পাওয়া বল্লম দুটো দেখছিল। বল্লমের ফলাটা খুব ক্রুড তামার তৈরি। মানে লম্বগলিরা সবে নতুন প্রস্তর যুগ পার হয়েছে। ফলা দুটো বড়সড় এবং শক্ত হলেও তাতে ধার বলে কিছু নেই। ওই জন্যই বল্লমের ফলা দুটো প্রাংশুর স্লিপিং ব্যাগ ফুটো করতে পারেনি। ফলা দুটো একটা বড় লাঠির সামনে শুকনো নাড়িভুঁড়ি দিয়ে জড়ানো। প্রাংশু ফলা দুটো ধরে দেখতে গেছিল, কিন্তু ব্রতীন বারণ করল, বলল “ফলায় বিষ থাকতে পারে। সব কিছুতে এরকম দুমদাম হাত দেওয়া ঠিক নয়।” প্রাংশু একটু থতমত খেয়ে গেল। বল্লমে যে বিষ থাকতে পারে সেটা তার মাথায় আসা উচিত ছিল।
মোহিনী বলল, “আপনি ভীষণ কেয়ার-লেস প্রাংশুদা। আজ আপনার যদি কিছু হত আমি মুখ দেখাতে পারতাম না।” প্রাংশু বলল, “কিন্তু ওরা তোমার পিছন থেকে বল্লম নিয়ে অ্যাটাক করছিল। সেটা দেখেও চুপ করে থাকব কী করে?” মোহিনী বলল, “আমরা পুলিস। এসবে আমাদের অভ্যাস আছে। আমার হাতে রিভলভার ছিল। প্রাণসংশয় হলে সেটাই ব্যবহার করতাম। কিন্তু আপনারা অধ্যাপক মানুষ। এইসব মারদাঙ্গার বাইরে থাকুন প্লিজ।”
প্রাংশু কথাটা খুব নিমরাজি হয়ে মেনে নিল। এরপর মোহিনী ব্রতীনকে প্রশ্ন করল, “আপনার কি মনে হচ্ছে ব্রতীনদা? এরা কি সত্যিই কোনও অজানা ট্রাইব?”
“ভিডিয়োয় চেহারা দেখে কি আর কিছু আন্দাজ করা যায়? কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি কঠিন প্রশ্ন হল ওরা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কীভাবে?”
প্রাংশু বলল “ভিডিয়োতে ওদের অদৃশ্য হতে দেখে, কীসের সঙ্গে যেন একটা সিমিলারিটির কথা মনে হচ্ছিল।”
“কীসের?”
“আরে তখনই তো সব গুলিয়ে গেল। আচ্ছা, ওরা পালানোর সময় অদৃশ্য হয়ে পালাল না কেন?”
“বোঝা গেল না।”
মোহিনী বলল, “একটা জিনিস অন্তত কনফার্মড। সেটা হল ওরা বিদেহী নয়। ওদের দস্তুরমতো শরীর আছে। আমরা ছুরি ব্যবহার করলে বুঝতে পারতাম শরীর থেকে রক্ত পড়ে কি না। এই তথ্যগুলো আমার দলবলের কাছে ইম্পর্ট্যান্ট। তারা যদি এদের সত্যিকারের ভূতপ্রেত জাতীয় কিছু ভাবে, তাহলে আমার পক্ষে এই অভিযান চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।”
প্রাংশু বলল, “আচ্ছা ওই কাপ্পো না কি ওর নাম, বলছিল না, খন্দ ছেলেগুলো বেঁচে আছে। সেটা কি করে সম্ভব? এ ক-দিনে ওদের খেয়ে ফেলাই তো স্বাভাবিক ছিল।”
ব্রতীন বলল, “তুই কিন্তু গতকাল আমার কথা একেবারেই মন দিয়ে শুনিস নি। ক্যানিবলরা কি ইচ্ছামতো মানুষ খায় না কী? এরাও নিশ্চয়ই কোনও একটা ধর্মীয় কারণে এদের খাবে বলে ধরে এনেছে। যখন তখন খাবার জন্য নয়।”
এরপর আর রাতে বিশেষ কথা বার্তা হয়নি।
ব্রতীন প্রাতঃকৃত্য সেরে এসে দেখল প্রাংশু ফেরেনি। কিন্তু বিছানাটা তো টানটান হয়েই আছে। রাতে শোয়ার তো কোনও চিহ্ন নেই। তবে কি প্রাংশু বিছানা গুছিয়ে রেখে সকালের কাজ সারতে গেল? এ তো একেবারেই প্রাংশুর স্বভাবের বাইরে। ব্রতীন প্রথমে এটা নিয়ে বিশেষ ভাবেনি। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেও যখন প্রাংশুকে কোথাও দেখা গেল না, তখন ব্রতীন মোহিনীকে রিপোর্ট করল। মোহিনী ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে কাপ্পোকে খবর দিল। কাপ্পো কিন্তু এসে ভীষণ কনফিউজড হয়ে পড়ল। সে পরিষ্কার বলল, প্রাংশু কোথাও যায়নি, এখান থেকেই হাওয়া হয়ে গেছে। তাকে প্রশ্ন করা হল, সেটা কীভাবে সম্ভব? তাহলে প্রাংশুকে কি পিশাচেরা ধরে নিয়ে গেছে? কাপ্পো সজোরে মাথা নাড়ল, না, এখানকার ত্রিসীমানার মধ্যে কোনও লম্বগলির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না।
ব্রতীন ভয়ানক নার্ভাস হয়ে পড়ল। কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশি আপসেট হয়ে পড়ল মোহিনী। কিন্তু কী করবে তাও তার মাথায় আসছিল না। অবশেষে সবাই মিলেই প্রাংশুকে খুঁজতে বের হওয়া হল।
কিন্তু একটা পঁচাত্তর বর্গকিলোমিটার উপত্যকা খুঁজে একজন লোককে পাবার থেকে খড়ের গাদার মধ্যে সুচ খুঁজে পাওয়াও সহজ। কোথায় খোঁজা হবে? দেখা গেল সবাই পায়ে পায়ে কালকের সেই ঝোপড়া ঘরটার দিকেই যাচ্ছে। ওখানে যে কেউ নেই, সেটা যদিও সিসি ক্যামেরায় দেখাই যাচ্ছিল কিন্তু তা ও সবাই ওই ঘরটার কাছেই এসে দাঁড়াল। ব্রতীন ভিতরে ঢুকে ওদের দেবতার মূর্তিটার দিকে তাকাল। না, মূর্তিটাকে কেউ নাড়ায়নি বা নিয়ে যাবার চেষ্টা করেনি। ব্রতীন দেবতার মূর্তিটার আরও কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল।
বাইরে অল্পবিস্তর গোলমাল শোনা যাচ্ছিল। ব্রতীন বাইরে বেরিয়ে দেখল মেদিয়া আর সুখময় দুজনে কিছু একটা বলছে। আর রমলা তার প্রতিবাদ করছে। অবাক কাণ্ড হল, মোহিনী তার টিম থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার দিয়ে জঙ্গলের পিছনের পাহাড়ের দিকে দেখছে। উপত্যকার যে দিক দিয়ে ওরা ঢুকেছে এ তার উলটোদিকের পাহাড়। মোহিনী এতই মন দিয়ে নজর করছে এদিকের কোনও কথা তার কানে যাচ্ছে না।
সুখময় বলছিল, “যাই বল না কেন, ওগুলো পিশাচ। আমরা ওদের সঙ্গে কী করে পারব? কাল দাড়িওয়ালা সাহেব ওদের বল্লম কেড়ে নিয়েছিলেন, সেই রাগে, দেখ না আজ ওঁকেই গায়েব করে দিয়েছে।”
মেদিয়া সায় দিয়ে বলল, “একেবারে আকাশ থেকে এসে আমাদের পিছনে দাঁড়িয়েছিল। ক্যামেরায় ওদের ধরাই যায়নি।”
রমলা বলল, “কিন্তু যখন আমার গলা টিপে ধরেছিল তখন কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ওরা আমাদের মতোই রক্ত মাংসের মানুষ। তা ছাড়া ম্যাডাম যখন ওটার রগে রিভলভারের বাড়ি মারলেন তখন ওটা সাধারণ মানুষের মতো পড়েও গিয়েছিল। ভূতপ্রেত হলে কি আর ওইভাবে মার খেত না পালাত?”
“কিন্তু, তাহলে ওরা ভ্যানিশ করে যাচ্ছে কীভাবে? আর দাড়িওয়ালা সাহেবকেই বা গায়েব করল কীভাবে? আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। নয়তো পিশাচরা আমাদের সবাইকেই খেয়ে ফেলবে।”
“কিন্তু কথাটা ম্যাডামকে কে বলবে?”
মোহিনী এতক্ষণ মন দিয়ে বাইনোকুলারে দূরের পাহাড়ের গায়ে কিছু দেখছিল। এবারে বলরামকে ডাকল। তার হাতে বাইনোকুলারটা দিয়ে বলল, “পাহাড়ের গায়ে ওই উঁচুতে একটা গুহার মতন দেখতে পাচ্ছ? ওখানে একটা মুভমেন্ট দেখা যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না? একটু অপেক্ষা কর, তারপরই মনে হচ্ছে একটা ছায়ার মতো কি গুহার মুখটায়…”
বলরাম উত্তেজিত গলায় বলল, “দেখুচি ম্যাডাম।”
“ওখানে ওঠা সম্ভব?”
“আমি উঠতেই পারি, তবে সবাই পারবে বলে মনে হয় না।”
“কিন্তু তোমাকে তো আর এক যেতে দিতে পারি না!”
“আমি যদি ওই পাশের চত্বরটায় উঠি, আর তারপর দড়ির মই ফেলে দি তাহলে সবাই উঠে আসতে পারবে। ওখান থেকে যদি সবাই মিলে গুহাটায় ঢুকি?”
“কিন্তু তুমি যখন একা ওখানে উঠবে, তখনই যদি তোমায় অ্যাটাক করে?”
এবার মানিক নায়েক বলল, “আমি তলা থেকে ওকে কভার করব। ওর ধারে কাছে কাউকে আসতেই দেব না।”
“তাহলে চল।”
এমন সময়ে ব্রতীন বলল, “একটু অপেক্ষা কর। এক নম্বর পয়েন্ট হল ওখানে যদি লম্বগলিরা থাকে, তাহলে তারা কীভাবে ওঠানামা করে?” দু-নম্বর পয়েন্ট হল যদি ওরা ওখানে থাকেও, ওদের উপর গোলাগুলি চালানো কি ঠিক হবে?”
মোহিনী বলল, “ব্রতীনদা, দু-নম্বর কথাটা আমি আগে ভাবছিলাম। কিন্তু এখন প্রাংশুদা কে উদ্ধার করাটা টপ প্রায়োরিটি। এক নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল ওরা ওখান থেকে দড়ির মই ব্যবহার করে নামতেই পারে। পরে উপর থেকে মই গুটিয়ে নিলেই হল।”
“তুই আবার ভেবে দ্যাখ কিন্তু, একটা অজানা আদিবাসী ট্রাইবের কয়েকজন মাত্র অবশিষ্ট আছে। তাদের উপর গুলি চালাবি?”
“না পারতে চালাব না, তবে প্রাংশুদাকে এখানে ফেলেও যাব না। তার জন্য যা করতে হয় রাজি আছি। কিন্তু আর কথা নয়, এবারে অ্যাকশন।”
সবাই এগিয়ে চলল। আধঘণ্টার মধ্যেই পুরো টিম উদ্দিষ্ট টিলাটার নিচে চলে এল। বলরাম ঠিকই বলেছিল। মসৃণ রকফেস বেয়ে প্রায় একশো মিটার উঠলে তবে পাহাড়ের গায়ের চত্বরটা পাওয়া যাবে। সেখান থেকে ফুটপঞ্চাশেক দূরেই একটা গুহার মুখ দেখা যাচ্ছে।
বলরাম, ব্রতীন আর কাপ্পো ছাড়া সবাই রাইফেল হাতে ধারের একটা ছোট্ট টিলার মাথায় উঠে গেল। মানিক সবাইকে জায়গামতো বসিয়ে নিজে আরও উপরের একটা ঝোপের পাশে দাঁড়াল। বলরাম যখন উঠবে, তখন যদি গুহা থেকে কেউ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে, তার উদ্দেশ্যে পুরো টিম চ্যাঁচাবে আর এলোপাথাড়ি গুলি চালাবে। তাতেও যদি ভয় না পেয়ে আক্রমণকারী বলরামের আরও কাছে যাবার চেষ্টা করে তখন মানিকের টেলিস্কোপিক রাইফেল তাকে ওপারে পাঠিয়ে দেবে। ব্রতীন আর কাপ্পো যেহেতু রাইফেল চালাতে জানে না তাই শুধু চেঁচাবে।
পুরো ব্যাপারটা ব্রতীনের ঘোরতর অপছন্দ হচ্ছিল। এতো পুরো কলোনিয়াল ওয়ার! তথাকথিত অসভ্যতার উপর সভ্যতার নির্লজ্জ আক্রমণ। কিন্তু মোহিনীর চোখ জ্বলছে। সে কোনও কথা শুনতে রাজি নয়।
কয়েক মিনিট বাদেই বলরামের কেরামতি দেখে সবার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। পিঠে একটা বোঝা নিয়ে ঠিক বাঁদরের মতো ওই মসৃণ রকফেসের সূক্ষ্ম খোঁচ খাঁচ আঁকড়ে টপাটপ চত্বরে পৌঁছে গেল সে। ব্রতীন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক, গুহায় যেই থাক তার সুবুদ্ধি হয়েছে।
বলরাম উপর থেকে সিল্কের দড়ির মই নিচে ফেলে দিল। মোহিনী ব্রতীনকে প্রশ্ন করল, “ব্রতীনদা, এই মই বেয়ে উঠতে পারবেন তো?”
ব্রতীন একটু রেগে গিয়েই বলল, “এত অপদার্থ ভাবিস না। তা ছাড়া উপরে তোরা কী করিস দেখতে হবে না?”
“তাহলে আপনি সবার শেষে উঠবেন। আর মানিক, তুমি যেখানে আছ সেখানেই থাকবে। আমাদের কভার করবে।”
প্রথমেই দড়ির মই বেয়ে মোহিনী উপরে উঠল। এতটাই সহজ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে উঠল যে ব্রতীনের মনে হল ও একটা বন্য কাঠবেড়ালি। তারপরে উঠল শ্রীধর, তারপরে এক এক করে টিমের বাকিরা। ব্রতীনের উঠতে বেশ ভয় লাগলেও শেষ পর্যন্ত অসুবিধা হয়নি।
এবারে সবার আগে কাপ্পো আর মেদিয়া। তাদের পিছনেই রিভলভার হাতে মোহিনী। ব্রতীন অবাক হয়ে লক্ষ করল আজ মোহিনীর বডি ল্যাংগুয়েজ-ই পালটে গেছে। চোখ জ্বলছে, যে কোনও ছোট্ট প্ররোচনাতেই রক্তগঙ্গা বয়ে যেতে পারে। ব্রতীন সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মোহিনীকে বলল, “ওদের একবার সাবধান করে দেওয়া উচিত হবে না?”
“কেন?”
“আমরা এতজন আছি জানলে ওরা আক্রমণ নাও করতে পারে।”
“প্রাংশুদা কে নিয়ে পালিয়েও যেতে পারে। ব্রতীনদা, আপনি আর কথা বলবেন না।”
কাপ্পোর মুখ উত্তেজনায় টানটান। ও গুহার মুখের কাছে এসে মন দিয়ে মাটির গন্ধ শুঁকল। তারপর ওর ভাষায় কিছু বলল। মেদিয়া অনুবাদ করে বলল, “লম্বগলিরা এখানেই আছে। আর দুজন বন্দি খন্দ ছেলেও।”
মোহিনী ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলল, “আর দাড়িওয়ালা সাহেব?”
কাপ্পো মাথা নাড়ল, না, নেই।
গুহার মধ্যে অন্ধকার থাকতে পারে। তাই প্রথমেই টর্চ জ্বালান হল। এক হাতে টর্চ অন্য হাতে রিভলভার নিয়ে মোহিনী সুট করে গুহায় ঢুকে পড়ল। পিছনে পিছনে অন্যরা।
গুহার মুখটা খুব একটা চওড়া নয়। সোজাও নয়। যদি এই সরু রাস্তায় একজনও বল্লম হাতে রুখে দাঁড়ায় তাহলে বিরাট বিপদ হতে পারে। কিন্তু মোহিনী সব সতর্কতা বিসর্জন দিয়ে সোজা ভিতরের দিকে এগিয়ে গেল। এবারে গুহাটা চওড়া হতে শুরু করেছে। হঠাৎ ডান দিক থেকে একটা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ পাওয়া গেল।
একটা পাথরের উপরে খানিকটা লফটের মতো জায়গা। সেখান থেকে আওয়াজ আসছে। মেদিয়া টক করে পাথরের উপর উঠে পড়ল। তারপরেই তার গলা থেকে বেরল “জয় মা পাত্তাখন্দা।”
“কী হল?”
“ওই খন্দ ছেলে দুটোকে এখানে বেঁধে রেখেছে।”
“নামাও।”
নির্দেশ পাবার আগেই কাপ্পো পাথরের উপরে উঠে পড়ল। তারপর মেদিয়া আর সে এক এক করে দুটো ছেলেকে নিচে নামাল।
ছেলে দুটির জামাকাপড় শতচ্ছিন্ন কিন্তু চেহারা মোটেও খারাপ হয়নি। যাদের খাওয়া হবে তাদের স্বাস্থ্যহানি যাতে না হয় সে ব্যাপারে লম্বগলিরা কঠোর নজর রেখেছিল। ওদের কোনও সিডিটিভ জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। ফলে ওরা কীরকম ঝিমিয়ে আছে। কিছু বুঝতে বা বলতে পারছে না। কাপ্পো আর মেদিয়া ওদের গুহার বাইরে নিয়ে গেল।
মোহিনী বলল, “কিন্তু আসল লোক কই?”
ওরা আরও ভিতরে ঢুকতে লাগল। গুহাটা এবারে বেশ চওড়া হয়ে উঠছে। একটা ক্ষীণ আলোর রেশ আসছে। গুহার ওদিকের মুখটা কি খোলা? তাহলে তো লম্বগলিরা প্রাংশুকে নিয়ে ওদিক দিয়েই পালাবে।
সহসা দেখা গেল সামনে গুহাটা মোড় নিয়েছে। আর মোড়ের ওদিক থেকে আলো আসছে।
ইতিমধ্যে কাপ্পো ফিরে এসেছে। সে মোহিনীর কাঁধে টোকা মেরে এগোতে বারণ করল। ওর ভাষায় যা বলল তা বোঝা না গেলেও বোঝা গেল লম্বগলিরা একদম সামনেই আছে। কাপ্পো হঠাৎ ওর বোন্ড ভাষায় জোরে কিছু একটা বলতে লাগল। মনে হয় এর মানে “তোমরা পারবে না। আমাদের আক্রমণ করলে বিপদে পড়বে। ভালো চাইলে চুপচাপ থাক।”
ওপাশ থেকে একটা গরগরে গর্জন ভেসে এল। ব্রতীনের অবাক লাগল, কেউ কারো ভাষা জানে না কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ওরা বলছে, “আমরা ধরা দেব না। আমরা লড়ব।”
মোহিনী রিভলভার বাগিয়ে মোড়ের ওপাশে গেল, সঙ্গে কাপ্পো, সুখময়, শ্রীধর। ব্রতীনও ওদের পিছন থেকে উঁকি দিল।
গুহার পিছনটা খোলা নয়। কিন্তু সেখানে পাথর সরিয়ে আলো আসার মতো একটা জানালা করা হয়েছে। তার আসে পাশে ছড়িয়ে আছে জনাচোদ্দো লম্বগলি। আট জন পুরুষ। তাদের মধ্যে ছ-জনের হাতে বল্লম, দুজনের হাতে মুগুর। ছ-জন নারী। তাদের হাতে কয়েকটা লাঠি। দুজনের কোলে ছোট সন্তান।
পুরো মানব গোষ্ঠীটাই রুখে দাঁড়িয়েছে। মোহিনী কড়া গলায় বলল, “আমাদের যাকে ধরে এনেছ সে কোথায়?”
লম্বগলিরা মোহিনীর কথা বুঝতে পারল বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে মেদিয়া এসে খন্দ ভাষায় একই কথা জিজ্ঞাসা করল। লম্বগলিরা মাথা নেড়ে কিছু একটা বলল। ওরা অল্প অল্প খন্দ ভাষা জানে মনে হয়। মেদিয়া বলল, “ওরা জানে না বলছে।”
মোহিনী ওদের একজনকে আঙুল নেড়ে কাছে আসতে বলল। কিন্তু ওরা যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। ব্রতীনের অবাক লাগল, ওরা ভ্যানিশ করে যাবার চেষ্টা করছে না কেন?
মেদিয়া খন্দ ভাষায় ওদের একজনকে এগিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করতে বলল। কিন্তু লম্বগলিদের দিক থেকে একটা সমবেত গর্জন শোনা গেল। ওরা কাউকে দেবে না।
মোহিনী শ্রীধর আর সুখময়কে বলল, “ওদের একজনকে ধরে আন।” শ্রীধর এগোচ্ছিল। কিন্তু নাটকীয়ভাবে ব্রতীন ওদের সামনে রুখে দাঁড়াল। মোহিনী কঠোর গলায় বলল, “সরে যান ব্রতীনদা।”
“প্রাণ থাকতে নয়। এটা তুই করতে পারিস না মোহিনী।”
“খুব ভালোই পারি। আপনি সরে যান।”
ব্রতীন আচমকা লম্বগলিদের দিকে চলে গিয়ে ওদের পাশে দাঁড়াল। বলল, “আমায় না মেরে ফেলা পর্যন্ত আমি ওদের ধরতে দেব না।”
মোহিনী চিৎকার করে বলল, “সরে আসুন! ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে।”
“কক্ষনো মারবে না। মারলে তোমরা মারতে পারো।”
সহসা ব্রতীন লক্ষ করল এক লম্বগলি মেঝে থেকে একটা মুগুর তুলছে। অথচ তার হাতেই একটা মুগুর আছে। মুগুরটা তুলে ও ব্রতীনের দিকে বাড়িয়ে দিল। মানে ওরা ব্রতীনকে সহযোদ্ধা বলে স্বীকার করে নিয়েছে!
ব্রতীন চিৎকার করে উঠল, “দ্যাখ মোহিনী দ্যাখ! ওরা আমাদের মতো বিনা কারণে মারে না। ভেবে দ্যাখ প্রাংশু এখানে আসেনি। প্রাংশু আসলে, ওরা মিথ্যা বলত না। তা ছাড়া যাবেই বা কোথায়?”
মোহিনী থমকে গেল। এতক্ষণে ওর বিচারবোধ ফিরে এল মনে হয়। বলল, “তাহলে এদের নিয়ে কী করা হবে?”
“এরা যেমন আছে তেমন থাকতে দিতে হবে, আবার কী? এবারে তোরা বাইরে যা। মেদিয়া থাক। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলব।”
মোহিনী কয়েক সেকেন্ড ভাবল। তারপর বলল, “ঠিক আছে। আমরা ঠিক মোড়ের ওপারেই রইলাম।”
সবাই চলে গেলে লম্বগলিরা যেন নিশ্বাস ফেলে বাঁচল। মেদিয়ার মাধ্যমে তাদের প্রথম কথা হল, “তুমি বন্ধু বটে, তবে তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমরা উৎসাহী নই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়।”
ব্রতীন বলল, “আমরা চলে যাব। শুধু বল, তোমরা কি জান তোমাদের বল্লম যে কেড়ে নিয়েছিল, সে কোথায় আছে?”
“না, জানি না।”
“তোমরা অদৃশ্য হয়ে যাও কী করে?” লম্বগলিরা কলকল করে কি বলল। মেদিয়া ভুরু কুঁচকে দু-একবার সওয়াল জবাব করে বলল, “ওরা কী বলছে বুঝতে পারছি না। দেবতাটেবতা কী সব বলছে।”
“জিজ্ঞাসা কর ওদের দেবতা কে? কোথা থেকে এল।”
“বলছে আকাশ থেকে, ওরা বার বার আমাদের চলে যেতে বলছে। বলছে তোমরা রোগ ছড়াও। তোমাদের ছড়ানো রোগেই আমরা মরে মরে এই কয় জনায় ঠেকেছি। তোমরা এখান থেকে চলে যাও।”
“শেষ প্রশ্ন, তোমরা মানুষ খাও কেন?”
“দেবতা বলেছে, তোমাদের খেলে, তোমাদের ছড়ানো রোগ আমাদের লাগবে না।”
ব্রতীন নিজের পকেট থেকে একটা সুন্দর কৃস্টাল বসানো চাবির রিং বার করে চাবি-কটা খুলে নিল। তারপর চাবির রিংটা ওদের দিয়ে বলল “বন্ধুর উপহার।”
ওদের একজন রিংটা তুলে নিয়ে বলল, “তোমাদের দেবার মতো আমাদের কাছে কিছু নেই। যদি পারো আমাদের খোয়া যাওয়া বল্লম দুটো দিয়ে যেও। ওগুলো দেবতা আমাদের দিয়েছিলেন, খুবই দরকারি জিনিস।”
ব্রতীন আর মেদিয়া ওদের ছেড়ে চলে এল। মোহিনীকে বলল “চল। এরা সত্যিই জানে না প্রাংশু কোথায়।”
ওরা গুহার মুখের দিকে ফিরে চলল।
(৯)
সন্ধ্যা নেমেছে। ব্রতীনের তাঁবুর সামনে মোহিনী আর ব্রতীন বসে। মোহিনী উদাস গলায় বলল, “আমায় মাপ করে দেবেন ব্রতীনদা। আমার মাথার ঠিক ছিল না।”
ব্রতীন হাসল, বলল, “তোর জায়গায় আমি থাকলে, তুই যা করেছিস ঠিক তাই করতাম।”
“আচ্ছা ওরা আমাদের ভীষণ ঘেন্না করে, না? বার বার বলছিল তোমরা রোগ ছড়াও। এই কুসংস্কারটা ওদের এল কোথা থেকে?”
“এটা আদৌ কুসংস্কার নয়। আমরা যারা মেইনস্ট্রিম সভ্য মানুষ। আমাদের বহু ভাইরাস ঘটিত রোগের ইমিউনিটি আছে। যুগ যুগ ধরে মনুষ্যজাতির মূলধারা এই সব রোগের সঙ্গে লড়ে এসেছে। আমাদের শরীরে তাই এমন বহু ভাইরাস থাকে যারা আমাদের ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু যে সব আদিবাসী সমাজ মূলধারার বাইরে, তাদের আদৌ এসব ভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কোনও ইমিউনিটি নেই। আমাদের সংস্পর্শে এসে তারা ওই সব সাধারণ রোগের আক্রমণে মারা যায়। ইতিহাসে এরকম বহু বার হয়েছে। স্প্যানিশদের সঙ্গে মিশে রেড ইন্ডিয়ানরা সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার আক্রমণে উজাড় হয়ে গেছিল। তারপর এস্কিমোরা, অ্যালুসিয়ান দ্বীপের আদিবাসীরা, কত নাম করব?”
“কী কাণ্ড। তাহলে এইসব জনগোষ্ঠীর ধ্বংসের জন্য আমরাই দায়ী?”
“হ্যাঁ, আর সেই কারণেই কিন্তু অনেক আদিবাসী ট্রাইব আমাদের ভয় পায়, দূরে থাকে।”
“কিন্তু মানুষ খেলে ইমিউনিটি হবে এটা নিশ্চয়ই কুসংস্কার?”
“আমি জানি না। আমি এ-ও জানি না কে ওদের দেবতা যিনি ওদের অদৃশ্য হতে শিখিয়েছেন, মানুষ খেতে বলেছেন”
“ওরা কি এরপর আর আমাদের আক্রমণ করবে?”
“আমার মনে হয় না।”
“আমারও তাই মনে হয়। তবে ক্যামেরাগুলো চালিয়েই রেখেছি। সতর্ক থাকা ভালো।”
ব্রতীন সায় দেয়, তারপর চুপ করে থাকে। মোহিনী একটু উসখুস করে, তারপর বলে, “আচ্ছা প্রাংশুদার সত্যিই কী হল?”
ব্রতীন বলল। “এই প্রশ্নটা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। একটা বড় রহস্য বাকি আছে। তবে লম্বগলিরা মিথ্যে বলছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ওদের দেবতা…”
সহসা একটা ল্যাপটপ পিঁক পিঁক করে উঠল। মানে কোনও ক্যামেরায় নড়াচড়া ধরা পড়েছে। মোহিনী লাফ মেরে ল্যাপটপের সামনে ঝুঁকে পড়ল, বলল, “ওরা আবার আসছে। সবচেয়ে কাছের ক্যামেরায় দেখছি।”
ঠিক আগের দিনের মতোই খুব সরু একটা ফিগার বাতাসে কেঁপে কেঁপে আকার নিচ্ছে। মোহিনী চিৎকার করে ওঠে, “সবাই সাবধান!”
ফিগারটা আরও মোটা হয়। হাতের বল্লমটা চিনতে পারা যাচ্ছে। ক্রমে আরও মোটা হতে হতে অবশেষে দেখা যায় একটা বিরাট লম্বা চওড়া, সিংহের মতো দাড়ি-গোঁফওয়ালা চেহারা। মোহিনী চেঁচিয়ে ওঠে, “প্রাংশুদা!!”
হ্যাঁ, প্রাংশুই বটে, হাতে বল্লম। হঠাৎ প্রাংশু উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে, “ইয়েসস!”
মোহিনী ততক্ষণে দৌড় মেরেছে। ক্যামেরার লোকেশন তার জানা আছে।
আধঘণ্টা পরে। ওরা আবার তাঁবুর বাইরে গুছিয়ে বসে আছে। প্রাংশু এসে প্রথমেই বলেছিল, “আগে খেতে দাও, সারাদিন খাওয়া জোটেনি।” গোগ্রাসে গেলার পর এখন সে কথা বলার মতো অবস্থায় এসেছে।
ব্রতীন বলল, “আগে বল তুই ছিলি কোথায়?”
প্রাংশু বলল, “শোন। রাত্রে শোবার আগে আমি ওদের বল্লমটা নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। তারপর মনে হল ওরা কী অদ্ভুতভাবে বল্লমের গোঁড়াটা মাটিতে ঠোকে, আমিও ঠুকে দেখি। এদিক ওদিক নানা প্যাটার্নে ঠুকে দেখতে দেখতে বেশ নেশার মতো ধরে গেল। হঠাৎ…” বলে প্রাংশু একটা নাটকীয় পজ দিল।
“কী হল?”
“যা হল, তা বললে কেউই বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার চারপাশটা একদম অন্যরকম হয়ে গেল। আমি দেখলাম, আমি একটা জঙ্গলঘেরা মাঠে দাঁড়িয়ে আছি”
ব্রতীন আর মোহিনী একযোগে বলল, “অ্যাঁ!!”
“এবারে আমার অবস্থা বোঝ। একটু ভেবে দেখলাম। যেহেতু লাঠিটা ঠুকেই এই কাণ্ডটা হয়েছে, তখন আবার লাঠি ঠুকে দেখি। কোথায় কী! আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেলাম। এবারে কি করি? রাতের অন্ধকারে কি না কি বিপদ হবে ভেবে, আমি একটা গাছের গোড়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।”
মোহিনী হাঁ হয়ে বলল, “এরকম অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লেন?”
“করার তো আর কিছু ছিল না। চিন্তা করেই বা লাভ কি!”
“তারপর?”
“সকাল হতেই আমি আবার লাঠি ঠোকার চেষ্টা শুরু করলাম। কোনও লাভ হল না। আমি জায়গাটা এক্সপ্লোর করতে বেরলাম। যদি জল বা ফলমূল পাওয়া যায়। তা জলের সোর্স একটা পেলাম। এই লেকটার মতোই। তবে খাবারদাবার পেলাম না। কিন্তু ততক্ষণে আমার মাথায় একটা থিয়োরি এসে গেছে। আমি পেটভরে জল খেয়ে ঘুম লাগালাম। সন্ধ্যাবেলা উঠে আবার লাঠি ঠক ঠক করতে শুরু করলাম। হঠাৎ দেখি দূরে আমাদের টেন্টটা দেখা যাচ্ছে। তারপর কি হল তো জানিসই।”
“কিন্তু এসব হল কীভাবে? তোর থিয়োরিটাই বা কি?”
“বলছি, তার আগে বল তোরা স্ট্রিং থিয়োরি কাকে বলে জানিস?”
ব্রতীন মোহিনী সমস্বরে বলল “না।” ব্রতীন আরও যোগ করে “শুনেছি সে তোর কবিতার থেকেও দুর্বোধ্য।”
প্রাংশু চটে না। বলল, “বুঝিস না বুঝিস, শোন। উপকার হতে পারে।”
“আমাদের এই জগতে আছে তিনটে ডাইমেনশন। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ। রিলেটিভিটি বলে সময়কেও একটা ডাইমেনশন ধরে অংক কসলে অনেক কিছু সরল হয়ে যায়। কিন্তু স্ট্রিং থিয়োরি বলে সময় ছাড়াও দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার মতোই আরও সাতটা ডাইমেনশন আছে। আমরা সেটা বুঝতে পারি না কেন? না ওই সাতটা ডাইমেনশন ভয়ানক রকম ফোল্ডেড। মানে ওই সব ডাইমেনশনে এক্কেবারে জায়গা নেই। বুঝলি?”
“না।”
“কী করে বোঝাই! আচ্ছা স্লাইডিং জানালা দেখেছিস তো? একটা অ্যালুমিনিয়ামের চ্যানেলের মধ্যে জানালার কাচটা স্লাইড করে। ওটা খালি এগোতে পিছতে পারে। মানে ওটার মোশন ওয়ান ডাইমেনশনাল। কেন না অন্য দুটো ডাইমেনশনে নড়ার জায়গা নেই। এবারে বুঝলি?”
ব্রতীন আর মোহিনীর মাথা খুব সন্দেহজনকভাবে হ্যাঁ-এর দিকে নড়ে।
“কিন্তু বর্তমান স্ট্রিং থিয়োরিতে বলছে যে চতুর্থ ডাইমেনশনটা অতটা ফোল্ডেড নয়। মানে সে দিকে নড়াচড়ার জন্য খানিকটা জায়গা থাকতেও পারে। অবশ্য কতটা কী আছে এখনও কেউ বলতে পারছে না।”
“এখন ধরা যাক চার নম্বর ডাইমেনশনে একটু নড়াচড়ার জায়গা আছে। কিন্তু আমরা তো তিন ডাইমেনশনের প্রাণী। ফলে আমাদের কাছে তো চতুর্থ ডাইমেনশন অজানা জিনিস। ফলে কী দাঁড়াল? ওই যে এক্সট্রা জায়গাটা আমাদের অজানা রয়ে গেল। যেন দুটো পাশাপাশি চ্যানেল, আমরা একটা চ্যানেলের মধ্যে চলাফেরা করছি আর একটা চ্যানেল ফাঁকা পড়ে আছে।”
প্রাংশু দম নেবার জন্য থামল। মোহিনী বলল, “তাহলে কি ওই বল্লমগুলো মাটিতে ঠুকলে অন্য চ্যানেলটায় চলে যাওয়া যায়?”
প্রাংশু ব্রতীনের দিকে তাকিয়ে একটু চোখের ভঙ্গি করে বলল, “দেখলি? বুদ্ধি হ্যাজ। কিন্তু ঠোকার প্যাটার্ন আছে। সেই প্যাটার্ন মতো ঠোকা হচ্ছিল না বলে আমাদের চ্যানেলে ফিরে আসতে পারছিলাম না। আরও একটা ব্যাপার আছে। এই চ্যানেল পালটানোটা খুব সম্ভব দিনেরবেলায় কাজ করে না। কারণ আমি দিনেরবেলা সবরকম প্যাটার্ন চেষ্টা করে দেখেছি, কাজ করেনি।”
মোহিনী বলল, “ঠিক কথা, ওইজন্যই আমরা যখন গুহার মধ্যে ওদের আক্রমণ করেছিলাম, ওরা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেনি।”
ব্রতীন বলল, “তা ওদের ওই প্রস্তর যুগের বল্লমে এত কায়দা কোথা থেকে এল?”
“এইখানেই আমার থিয়োরি। ওই যে ওদের দেবতা, যতই অবিশ্বাস্য শোনাক না কেন, সে আসলে এলিয়েন। অন্য কোনও জগৎ থেকে আসা প্রাণী। ওদের দেবতার ছবির মধ্যে একটা হেলমেটের মতো জিনিস ছিল দেখেছিলি? কিছু জটিল যন্ত্রের সরলীকৃত ছবিও আছে মনে হয়। সে ওদের এই বল্লমগুলো বানিয়ে দিয়েছিল, যার ফলার উলটোদিকে কোনও গ্যাজেট লাগানো আছে। যাতে ওরা বিপদে পড়লে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। সেই হয়তো ওদের শিখিয়েছিল সভ্য মানুষ খেলে ওরা সভ্য মানুষের ছড়ানো রোগ থেকে ইমিউনিটি পাবে।”
“ওদের এত সরু দেখাত কেন?”
“কখন দেখাত? যখন ওরা পাশের চ্যানেল থেকে আমাদের চ্যানেলে এসে ঢুকত। যখন ওরা দুই চ্যানেলের মাঝখানে তখন আসলে ওদের থ্রি ডাইমেনশনাল প্রজেকশন আমরা দেখতে পেতাম। ওদের দেখে তখন হঠাৎ আমার মাথায় টেসের্যাক্ট-এর কথা এসেছিল?”
“সেটা আবার কি বস্তু।”
“দুই ডাইমেনশনে যাকে বলে বর্গক্ষেত্র, তিন ডাইমেনশানে তাকেই বলে ঘনক। চার ডাইমেনশনে তার নাম হল টেসের্যাক্ট (Tesseract)। একটা টেসের্যাক্ট যদি আমার এই তিন ডাইমেনশনের স্পেসে ঢোকার চেষ্টা করে তবে সেটাকে নানা শেপের একটা কিম্ভূতের মতো দেখতে হবে। বরং নেটে দেখে নিস কীরকম দেখায়। খুব ভালো ভিডিয়ো আছে। যা হোক ওদেরও সেইজন্য আমাদের চ্যানেলে ঢোকা বা বার হবার সময় ওরকম কিম্ভূত লাগত।”
ব্রতীন বলল, “কিছুই বোধগম্য হল না। যাকগে। এখন কি কর্তব্য?”
মোহিনী বলল, “আপতত শুয়ে পড়া। কাল সকালে বল্লম দুটো ওদের দেবতার ঝুপড়িতে রেখে আমরা কেটে পড়ব।”
(১০)
বিরাট আওয়াজে গুহার মুখটা ভেঙে পড়ল। মোহিনী বলল, “যাক আপদ বিদায় হল।”
ব্রতীন বলল, “কিন্তু তোকে তো রিপোর্ট দিতে হবে?”
“যখন হারিয়ে যাওয়া ছেলে দুটোকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি তখন আর কেউ রিপোর্ট নিয়ে মাথা ঘামাবে না। বলা হবে ওখানে একটা আদিম আদিবাসীর দল আছে। তারা কোনও অজ্ঞাত কারণে দুটো খন্দ ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা তাদের ফিরিয়ে এনেছি। বলা হয় বটে ওই আদিবাসীগুলি ক্যানিবল, কিন্তু আমরা প্রমাণ পাইনি। খন্দদের প্রতিহিংসা থেকে ওদের বাঁচানোর জন্য ওদের উপত্যকায় ঢোকার প্রধান পথটা ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে সাময়িকভাবে দুর্গম করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাস রিপোর্ট খতম, পয়সা হজম।”
প্রাংশু প্রশংসার চোখে তাকিয়ে বলল, “এক্কেবারে অ্যাকিউরেট অ্যান্ড প্রিসাইজ যাকে বলে।”
“এ ছাড়া আমরা আর কিই বা করতে পারতাম। এসব ফোর্থ ডাইমেনশন, নরখাদক এসব জানাজানি হলে সারা পৃথিবী ওদের উপর গবেষণা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে ওরা সব ক-জন পটল তুলত। এই ভালো হল। ওদের হাত থেকে খন্দরা নিরাপদ, সারা সভ্যতার হাত থেকে ওরাও নিরাপদ।”
চলতে চলতে মোহিনী ব্রতীনকে প্রশ্ন করল, “আপনারা এখন কদিন এখানে থাকবেন তো? এই খন্দমাল জেলায় কিন্তু অনেক কিছু দেখার আছে।”
ব্রতীন বলল, “না, কলকাতায় আমার অনেক কাজ। আমি সম্ভব হলে রাতের ফ্লাইটেই কলকাতা ফিরে যাব।”
প্রাংশু প্রচণ্ড চটে গেল, “তুই কীসের অ্যানথ্রোপলজিস্ট রে? চারদিকে এত এত আদিবাসী ট্রাইব, আর তুই তাদের স্টাডি না করে কলকাতা চলে যাবি?”
“ট্রাইব থাকলেই তো হল না, তাদের কাছে পৌঁছান অত সহজ নয়।”
“তা ছাড়া মোহিনী যে বলছে অনেক কিছু দেখার আছে?”
“তোর কাজ না থাকলে তুই থেকে যা।”
প্রাংশু গোঁয়ারের মতো ঘাড় গুঁজে গজগজ করতে লাগল। মোহিনীকেও একটু অপ্রসন্ন মনে হল। এমন সময় মেদিয়া এসে ব্রতীনকে বলল, “কাপ্পো আপনাকে কিছু বলতে চায়।”
ব্রতীন চমকে উঠে বলল, “কাপ্পো? আমাকে? কি বলবে?”
কাপ্পো একটু হাসি মুখে ব্রতীনের হাতটা ছুঁলো। তারপর মেদিয়া মারফত কথা শুরু হল।
“তুমি আমাদের বন্ধু, তুমি লম্বগলিদের যেভাবে রক্ষা করলে, কাপ্পো তোমার প্রশংসা করছে। কাপ্পো তোমার বন্ধু হতে চায়।”
“আমি ভীষণ খুশি। কাপ্পো কি আমাকে তাদের সব দেবতাদের কথা, তাদের গ্রামের সব গল্প বলবে?”
“নিশ্চয়ই। বন্ধুর যদি অসুবিধা না হয় তাহলে কাপ্পো বন্ধুকে নিজের গ্রামে নিজের বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারে।”
“কাপ্পোর ভাষা শিখতে কতদিন লাগবে মনে হয়?”
কাপ্পোর ভাঙাচোরা মুখ নির্মল হাসিতে ভরে গেল। বলল, “ছোট ছোট ছেলেরা যে ভাষা সহজেই শিখে ফেলছে, তোমার আর কদিন লাগবে?”
“কাপ্পো কি এখনই বন্ধুকে সঙ্গে নেবে?”
“বন্ধু চাইলে নিশ্চয়ই।”
ব্রতীন শাম্মি কাপুরের মতো আনন্দে ইয়া হু করে উঠল। বন্ধুর ছেলেমানুষি দেখে কাপ্পো আবার হাসল। কথা হল, বাল্লিগুড়া ফিরেই ব্রতীন কাপ্পোর গ্রামে যাবে।
প্রাংশু বলল, “তোর কলকাতার কাজ?”
“গোলি মারো কাজে! এই সুযোগ কোনও অ্যানথ্রোপলজিস্টের জীবনে একবারও আসে না।” প্রাংশু বাঁকা চোখে ব্রতীনের দিকে তাকিয়ে বলল, “একসঙ্গে এলাম, একসঙ্গে ফিরব না?”
“তোকে নিয়ে ভাবার সময় এখন আমার নেই। প্রাচীন, অবলুপ্তপ্রায়, রহস্যময় বোন্ডদের নিয়ে লেখা আমার বইটার মলাট চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। তা ছাড়া একসঙ্গে ফেরার কথা তো ছিল না। বাল্লিগুড়ায় কত কী দেখার আছে। মোহিনী তোকে যত্ন করে সব দেখাবে, তাই না মোহিনী?”
মোহিনী লজ্জা পেয়ে বলল, “যাঃ!”
Tags: কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, রনিন
অসাধারণ একটা গল্প পড়লাম।
বাহ বাহ। তোহফা গল্প। হাল্কাচ্ছলে বলা এই ধরনের ধারালো লেখা আজকাল তেমন দেখা যায় না। সব কিছু পরিমিত। অসাধারণ লাগলো।
আহা! বিজ্ঞান, রোমাঞ্চ, মায় রোমান্স মেশানো কী চমৎকার একখান গল্প পড়তে পেলাম।
ওয়াও! শ্বাসরুদ্ধকর একটা অভিযানের ভেতর দিয়ে গেলাম। খুবই চমৎকার গল্প। শেষে এসে দারুনভাবে সব রহস্যের জট খুলেছেন। সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যাটাও যুতসই মতো হয়েছে। এমন লেখা আরও চাই। শুভেচ্ছা রইল।
চমৎকার লেখা!! অসাধারণ উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ! আর কত কী যে শিখলাম। শুরু করে আর থামতে পারি নি। মনের ভিতরে এই গল্পের রেশ রয়ে যাবে দীর্ঘদিন!!! লেখক কে হাজারো সেলাম।
গল্পটা রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম। আদিবাসীদের জীবনযাত্রার সাথে কল্পবিজ্ঞান আর পদার্থবিদ্যার সাম্প্রতিকতম স্ট্রিং থিওরী মিশিয়ে বেশ বিশ্বাসযোগ্য ভাবে গল্পটি লেখা হয়েছে। আনন্দ পেলাম।
কল্পবিজ্ঞানের গল্প -একদম বিশ্বাসযোগ্য করে লেখা -ডিটেলিং অপূর্ব , থিওরি ক্লান্ত করে না
বেশ উপভোগ্য গল্প। অভিযানের অংশটা দারুণ। anthropology-র অংশটাও বেশ তথ্যসমৃদ্ধ। তবে স্ট্রিং থিওরির সঙ্গে এলিয়েনের যোগাযোগের অংশটা আরেকটু বড় হলে আরও জমত। অন্তত আরেকটা চ্যাপ্টার যোগ হলে ভাল হত, কারণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার অংশটা যেন একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। ওখানে এলিয়েন অংশটা রেখেই মিস্টিসিজমের অংশটা একটু বড় হলে যেন মনের চাহিদাটা পুরোপুরি মিটত।
বহুদিন বাদে এমন এক তোড়ে একটা গল্প শেষ করে মনে হল বলি – চালাও পান্সি বেলঘড়িয়া। খুব ভাল লিখেছেন ত্রিদিববাবু। আপনার লেখা আরও চাই।
যাঃ মানেই হ্যাঁ… 😆
Enjoyed the story very much. Specially twists in different parts and then moving into a series of mysterious events and finally introducing string theory. I think it is first of its kind. Congratulations to the author.
এবারের সেরা গল্প
দারুণ গল্প। রহস্যময় উপজাতি, অজানা উপত্যকা, বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পনা, রোমাঞ্চ এবং সাসপেন্স…সব মিলিয়ে দুর্দান্ত ভালো লাগল পড়তে। আর একটা হালকা মজার রেশ আছে বলে গল্পের গতি বড় সাবলীল। তবে শেষে অ্যালিয়েন দেবতা, অদ্ভুত দেবমূর্তি, স্ট্রিং থিয়োরীর অ্যাপ্লিকেশন, এই বিষয়গুলো একটু ডিটেলে থাকলে আরো ভালো হত। একটা খুব কৌতূহল রয়ে গেল।
কল্পবিশ্বর পুজোসংখ্যার মূল আকর্ষণ ত্রিবিদেন্দ্রবাবুর লেখা৷ এবারো প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়নি৷ অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য, বিজ্ঞান আর হালকা প্রেমের জাদু মিশেলে এবারেও বাজিমাৎ করল “লম্বগলি”৷
ত্রিদিবেন্দ্রবাবু৷ সরি৷