বর্ণচোরা
লেখক: দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: জটায়ু
“বুতু! অ বুতু! ওট বাবা, ওট!” কপালের ওপর কে যেন আলতো আঙুল বোলাচ্ছে। নরম, ঠান্ডা আঙুল। কার আঙুল এটা? এ ছোঁয়া তো আমার বড্ড চেনা! আহ্, কী আরাম! ইচ্ছে করছে আর-একটু শুয়ে থাকি… কিন্তু সে আর হল না। নরম হাতটা এবার ঠাঁই-ঠাঁই করে দুটো চাঁটি বাজিয়ে দিল কপালে, সঙ্গে বিষম জোর ধাক্কা! “ও মাগো!” বলে কঁকিয়ে উঠতেই কানের কাছে চাপা গলার ধমক বেজে উঠল, “আ মোলো যা! এই রাতবিরেতে চেঁচিয়ে সক্কলের ঘুম না ভাঙালে চলছেনি বাপু?”
“ঝুরিদিদা!” চমকে উঠে বসলাম, “তুমি কখন এলে?”
“সে এইচি বাপু হল কিছুক্ষণ, তার জন্যি অমন গোল করতি আছে? চল চল শিগ্গির নীচে চল! সূয্যি ফোটার আগেই যা করার করতি হবে!” তাড়া লাগাল ঝুরিদিদা। কেন নীচে যাব, সেখানে গেলে কী হবে সেসব জিজ্ঞাসা করা বৃথা… ঝুরিদিদা যখন কোনও কাজ করবে ঠিক করেছে তখন করেই ছাড়বে। তা ছাড়া এমনিতেও ওর কথার কোনও সরল-সোজা মানে সব সময় পাওয়া যায় না। শুধু গাঁয়ের লোক কেন, এই বাড়িশুদ্ধ লোকও মনে করে ঝুরিদিদা পাগল। বাবা, রাঙাজেঠু ওরা অবশ্য বলে ঝুরিদিদা অনেক কিছু দেখতে পায়, শুনতে পায়, যা আমরা আমাদের সাধারণ চোখ-কান দিয়ে বুঝতে পারি না। বাতাসের গায়ে আঁকিবুকি কেটে বিড়বিড় করে কথা বলা, হঠাৎ-হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া— এসব তো তার রোজকার ব্যাপার। জিজ্ঞেস করলে একগাল হেসে উত্তর আসবে, “আরে কত্ত কী দেখার আছে, শুদু আমাদের পিথিবিটাই দেখলে হবে?” যত রকম অদেখা অজানা জিনিস আর ‘অন্য পিথিবির’ হদিশ থাকত তার কাছে। তবে আমার আপন দিদা না হলেও আমি তার দু-চোখের মণি, এবং নানারকম আজগুবি গল্প শোনার একমাত্র শ্রোতাও বটে। যা-ই হোক, তাড়া খেয়ে খাট থেকে নামতে গিয়ে মাথাটা কেমন বাঁই করে ঘুরে গেল। প্রায় দৌড়ে এল ঝুরি দিদা, “আহা গো… শরীলটা বড় দুব্বল তো বুতু বাবুর… দাঁড়া, আচিম-কে ডাকি!”
“কাছিম! কাছিম কে ডাকবে! মানে কচ্ছপ পুষেছ নাকি?”
“আ মোলো যা! কাছিম নয় রে বাপু, আচিম! তুই চুপটি করে বোস দিকিনি!” এই বলে পেছনে অন্ধকারের দিকে ঘুরে অদ্ভুত একটা সুরে ই-ই-ই করে আওয়াজ করে উঠল ঝুরিদিদা। আর ওমনি যেন প্রায় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল খেটো ধুতি পরা একটা গাঁট্টাগোট্টা লোক। এসেই বিনা বাক্যব্যয়ে আমাকে দু-হাতে পাঁজাকোলা করে নিয়ে দোতলার শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল। লোকটা যেন কেমন কেমন। দেখতে অমন শক্তপোক্ত, অথচ হাত-পাগুলো যেন পাঁকাল মাছের মতো ল্যাগবেগে। যেন মোটে হাড়ই নেই শরীরে। মাথাটা কেমন ছোট্ট এতটুকুনি, তার মধ্যে বিশাল বড়-বড় দুটো নাকের ফুটো, চোখ-মুখ আর বিশেষ দেখাই যায় না। তবে সব থেকে সন্দেহজনক জিনিস হচ্ছে ওর মাথার ফেট্টিটা। আমার মাথার থেকেও ছোট্ট পুঁচকে মাথাটা, তাকে জড়িয়ে শক্ত করে বাঁধা আছে একটা লাল গামছা। আমার স্পষ্ট মনে হল সেই গামছার আড়ালে মাথার চারদিক থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে চারটে চোখ! ভয়ে গুটিসুটি মেরে রইলাম। ঝুরিদিদার অবশ্য কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, আমাদের সামনে ঝোলা কাঁধে লেংচে-লেংচে বেতো পায়ে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে। গতকাল সন্ধে থেকেই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছিল ঝুরিদিদা। প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলেও এখন বাড়ির লোকেরা তেমন আর কেউ গা করে না, প্রত্যেকবারেই ক-টা দিন পর দিদা নিজেই ফিরে আসে। তবে তার আগে সকালবেলা একটা শোরগোল বাধিয়েছিল বটে! দু-দিন হল আমার একটা অদ্ভুত অসুখ হয়েছে। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে রক্তবমি আর গোটা শরীরে লাল-লাল দগদগে ঘা। শহর থেকে ডাক্তার এসেও কিছু করতে পারলো না। যন্ত্রণায় কাটা ছাগলের মতো ছটফট করছিলাম আমি। চিন্তায় চিন্তায় বাবা-জ্যাঠাদের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ, মা-জেঠিমা-দিদারা সারাদিন অনর্গল কেঁদে চলেছে। আমি প্রায় আধমরা হয়ে পড়েছিলাম বিছানায়, এমন সময় শুনতে পেলাম বাইরের উঠোনে তাণ্ডব জুড়েছে ঝুরিদিদা। জানালা দিয়ে দেখেছিলাম গোটা উঠোন জুড়ে মাটির মধ্যে মুখ গুঁজে কী যেন শুঁকে চলেছে আর দু-হাতে মুঠো-মুঠো মাটি তুলে এদিক-ওদিক ছুঁড়তে-ছুঁড়তে চিৎকার করছে, “মাটির দোষ গো, মাটির দোষ! মাটির দোষ লেগেছে বুতুর! নষ্ট হয়ে গেছে এ মাটি! শুদ্দু না করলি রোগ ছাড়বেনি গো!” যথারীতি কেউ তার কথায় পাত্তা দেয়নি। দুপুর বেলা মা দুধ-সাবু খাওয়ানোর সময় বলছিল ঝুরিদিদা নাকি আবার গায়েব হয়েছে। তারপর আজ মাঝরাতে এই আচিম না কাছিম কাকে যেন নিয়ে আগমন।
দেখতে-দেখতে কখন উঠোনে এসে পৌঁছেছি। সারা বাড়ি ঝুম হয়ে ঘুমোচ্ছে, শুধু সদরের কাছে বসানো একটা হ্যারিকেনের আলোয় দেখতে পেলাম কাঁচা মাটির ওপরে জ্বলজ্বলে কিছু দিয়ে অদ্ভুত একটা ছবি আঁকা।
এরকম ছবি কোনওদিন দেখিনি। উঠোনে জুড়ে একটা বিশাল বড় বৃত্ত, তার ভেতরে বৃত্তের পরিধিকে ছুঁয়ে একটা ত্রিভুজ। ত্রিভুজের ভেতরের আবার একটা বর্গক্ষেত্র, তার ভেতরে আবার একটা বৃত্ত। অঙ্কে আমি বরাবরই কাঁচা। সবেমাত্র ভয়ে-ভয়ে ভাবছি এখন আবার ঝুরিদিদা এই বিদঘুটে জিনিসটার ক্ষেত্রফল কষতে বলবে কি না, এমন সময় আচিম আমাকে নিয়ে গিয়ে সোজা ওই ভেতরের গোল্লাটার ঠিক মাঝখানে শুইয়ে দিল। কী হচ্ছে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কানে এল ঝুরিদিদার চাপা গলার হুঁশিয়ারি, “খবরদার বুতু! একদম নড়বিনি বলে দিলুম! থির হয়ে শুয়ে থাক!” একেই ওই মাঝরাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর হ্যারিকেনের ছেঁড়া-ছেঁড়া আলো, সামনে দাঁড়িয়ে আজব ধরনের লোকটা, তার ওপর ঝুরিদিদার ওই ফিসফিসানি! ভয়ে মড়ার মতো পড়ে রইলাম। পিঠের ঠিক নীচে কী যেন উঁচু হয়ে ছিল, শুতে একটু কষ্টই হচ্ছিল। তাও চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেলাম ওই অদ্ভুত জ্যামিতিক নকশার বিভিন্ন জায়গায় নানারকম জিনিস মাটিতে আদ্দেক পোঁতা অবস্থায় আছে। তার মধ্যে শামুকের খোল, ডিমের খোসা এসব চেনা যাচ্ছে। আমাকে শোয়ানোর পর আচিম সরু-সরু চুলের মতো কীসব জিনিস এদিক থেকে ওদিক বরাবর টান-টান করে বাঁধতে লাগল। ঝুরিদিদাও একটু দূরে ঝোলা থেকে কীসব বেরটের করে সাজিয়ে বসল। তারপর নরম গলায় “বাবা আচিম, এইবার তোমার গানখানি ধর দিকিনি বাবা,” বলে আবার ই-ই-ই করে উঠল। আচিম কী বুঝল কী জানি, এক বিকট ভাষায় ইনিয়েবিনিয়ে গান জুড়ে দিল। এমন অদ্ভুত ভাষা আমি জীবনে শুনিনি! ওদিকে ঝুরিদিদাও একটা লম্বা কাঠির আগায় ঘাসের মতো কী একটা বেঁধে সেই গানের তালে-তালে মাথা দুলিয়ে আমার গায়ে বোলাতে লাগল। ওই আলো-আঁধারি পরিবেশে ঘড়ঘড়ে গলার করুণ সুর শুনে আমার গায়ে যেন কাঁটা দিচ্ছিল। এসব কী অশৈলী কাণ্ডকারখানা শুরু করেছে ঝুরিদিদা! একটু পরেই মাটির তলায় থেকে একটা গরম ভাপ উঠতে শুরু করল, আর সেই সঙ্গে ভেজা-ভেজা ঝাঁঝালো বুনো গন্ধ। এমনিতেই শরীরটা খুব দুর্বল ছিল, তার ওপর ওই তীব্র গন্ধে আমার স্নায়ু যেন কেমন অবশ হয়ে আসতে শুরু করল। মাটির গরম ভাপটাও আস্তে-আস্তে বেড়ে কেমন একটা সবুজ ধোঁয়ার মতো হয়ে গেছে। সেই সবজে ধোঁয়া যেন ঘন কুয়াশার চাদর পেতে দিল আমার গায়ের ওপর। আমি নেশাচ্ছন্নের মতো কোন অতল ঘুমে যে তলিয়ে গেলাম সে আর মনে করতে পারি না…
ঠক্!
মাথা তুললাম। চায়ের কাপ রেখে দিয়ে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রাণুর মা। জানালার বাইরে এক টুকরো ছাই রঙের মেঘলা আকাশ বেজার মুখে ঝুলে আছে। আজ সকাল থেকে রোদ-বাবাজি একবারও মুখ দেখানোর সুযোগ পাননি, পাবেন বলে মনেও হচ্ছে না। বরং পশ্চিম দিকটাতে এক দলা ঘন কালো মেঘ দলবল জুটিয়ে এগিয়ে আসছে। এমন ছায়া-ছায়া দিনগুলো বেশ লাগে। পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো সাদা-কালো ছবি হয়ে কোলাজ সাজাতে থাকে আমার দেওয়ালে দেওয়ালে। সকাল-সকাল উঠেই তাই আমার খসড়া খাতাটা খুলে বসেছি। নাহ, ডায়েরি নয়, খসড়াটাই ভালো। বরাবরের উড়নচন্ডী আমি। আদতে মুখচোরা হলেও নিজের খেয়ালে নিজস্ব তাড়নায় টইটই করে ঘুরে বেড়িয়েছি জীবনভর, তাই সাল-তারিখের গণ্ডিতে বাঁধা আভিজাত্য কোনওকালেই ছিল না আমার। বরং একদম নিজের এই একফালি পৃথিবীটায় এখন একমাত্র বন্ধু, একমাত্র সঙ্গী হয়ে উঠেছে আমার এই খসড়া খাতাই। ইদানীং যেন বুকের ভেতরটা কেমন ভার ভার ঠেকে। এই দুই কামরার ফ্ল্যাটের নিঃসঙ্গ অবসরে স্মৃতির বোঝা যেন অসহনীয় হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে, মনের কোন অতল থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে আগলহীন অনুভূতিগুলো। সেই ভাবনায় কবে থেকে যেন খাতার পাতায় ধরে রাখতে শুরু করেছি সে-সব অবিশ্বাস্য ঘটনার বর্ণনা। হয়তো কোনওদিনই কেউ জানবে না সে-সব, তবুও। আনমনে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। আর সঙ্গে-সঙ্গেই…
ইস্স্! এ কী দিয়ে গেছে রাণুর মা! বিকৃত মুখে কোনওমতে মুখে তোলা চা-টুকু জানালা দিয়ে ফেলে ঢকঢক করে জল খেলাম। সত্যিই তো, আজ চা দিতে এসে একটাও কথা না বলে দুমদাম করে চলে গেল রাণুর মা! অন্যান্য দিন আমাকে চায়ের সঙ্গে গোটা রাজ্যের ভুলভাল গল্প গিলিয়ে, আমার “হাবিজাবি” লেখার ব্যাপারে দু-চারটে কথা শুনিয়ে এবং বকর-বকর করে অন্তত দশটা মিনিট না কাটিয়ে এই ঘর থেকে নড়ে না সে। সেখানে এমন অভাবনীয় মৌনতা চিন্তার বিষয় বটে! কার কোন অপরাধের শাস্তি আজ চায়ের সঙ্গে মেশাল কে জানে! গুটি-গুটি পায়ে বারান্দার দরজায় এসে গলা খাঁকারি দিলাম, “কী ব্যাপার পুষ্পরানি দেবী? আজ আপনার গল্পের কারখানায় স্ট্রাইক হয়েছে নাকি?”
মেঝের ওপর থেবড়ে বসে পুরোনো খবরের কাগজগুলো ঝেড়েঝুড়ে ডাঁই করছিল রাণুর মা। আজ আবহাওয়া খানিক গম্ভীর মনে হচ্ছে। সকাল থেকে তো মুখে কুলুপ আঁটাই, এখন দেখে বুঝলাম মুখের ওপর যেন প্রথম বর্ষার ঘন কালো মেঘ ঝুলে আছে। আমার কথায় থমথমে মুখ তুলে তাকাল। তারপরেই বিকট মুখভঙ্গী করে হাউমাউ করে উঠল, “ফস্সা না বইলে কি আমার রাণুটার বিয়া হবেনি? এ কেমনধারা বিচার দাদাবাবু! অ্যাঁ!”
রাণুকে অনেক ছোট থেকে দেখছি। প্রায় বছর পনেরো হয়ে গেল, ছোট্ট রাণুকে কোলে নিয়ে প্রথম কাজে এসেছিল পুষ্পরানি কামিল্যা অর্থাৎ রাণুর মা। এরপর রাণুর বাবা গত হলে একার হাতেই মেয়েটাকে মানুষ করেছে সে। সেই মেয়ে দেখতে-দেখতে বড় হয়ে গেল, তার বিয়ের তোড়জোড়ও শুরু হয়েছে সদ্য। বিয়ে-থা করিনি, রাণু প্রায় আমার নিজের মেয়ের মতোই। তাই রাণুর মায়ের এই কথা শুনে একটু উদ্বিগ্নই হলাম, “সে কী! এমন কথা কে বলেছে!”
আহত বাঘিনীর গর্জন বেরিয়ে এল রাণুর মা-র গলা থেকে, “গেল শুক্কুরবারে দক্কিনপাড়া থিকে এয়েচিল মেয়ে দেকতে। কত হেসে-হেসে চপ-মিষ্টি খেল… তাপ্পর বাড়ি ফিরে বলে দেল মেয়ে আমার কালো বলে নাকি তাকে তাদের চাঁদপানা ছেইলের বউ করে ঘরে তোলা যাবেনি! এটা কি ঠিক হল দাদাবাবু! ভগমান জম্ম দেইচে, এই চোক-নাক, গায়ের রং সবই তো তার দেওয়া। মানুষে কি এসব বদলাতে পারে? অ্যাঁ? তার জন্যি চাট্টিখানি কতা শুনাবে?”
মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে গেল। নরম গলায় বললাম, “অত চিন্তা কোরো না। সবে তো মেয়েটা কলেজে উঠল, আরও একটু পড়াশোনা করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। ওর জন্য অনেক ভালো ছেলে পাওয়া যাবে পরে। ওসব ছাড়ো। যাও, এখন আর-এক কাপ চা খাওয়াও দেখি! রাগের চোটে তো সকালের চা-টা নিমপাতার রস বানিয়ে দিয়েছিলে!”
আমার কথায় কতটা প্রলেপ পড়ল জানি না। রাগী গলায় গজগজ করতে থাকল রাণুর মা, “রূপ কি কারও চিরদিন থাকে? হুঁহ্! শরীল পড়ে গেলে সবই যাবে! চুল পাকবে, দাঁত পড়বে, চামড়া কুঁচকাবে। তখন কী করবে অত দেমাক নিয়ে?” বলতে বলতে হঠাৎ ডাঁইয়ের ভেতর থেকে একটা কাগজ টেনে বের করে মেলে ধরল, “এই যে… এই চৈতালী সেন, উব্বোশির মতন রূপ, পুরুষ মানুষগুলা সব চোখ দিয়ে গিলে-গিলে খেত এর ছবি। কী হল শেষপজ্জন্ত? ভগমান কারে কখন কী করবে কিছু কি বলা যায় গো দাদাবাবু? যে দিয়েছে, সে আবার লিয়েও লিতে পারে। হুঁহ, অত রূপের গব্বো ভালো নয়… ”
সামনে মেঝের ওপর পড়ে আছে পুরোনো ধুলো-পড়া খবরের কাগজটা। অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকালাম। রাণুর মায়ের কথাগুলো কেমন দূর থেকে ভেসে আসা ভোঁতা শব্দের মতো আমার মাথার ভেতর ধাক্কা খেতে খেতে হারিয়ে যাচ্ছে। ওপরের পাতাটায় জ্বলজ্বল করছে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা হালকা গোলাপী রঙের শিফন শাড়ি পরা এক অপরূপ সুন্দরী নারী। যার রূপের ছটায় চোখ যেন ঝলসে যায়! পাশে বড়-বড় মোটা হরফে লেখা, “হীরক জয়ন্তীতে চৈতালী সেন”, আর তার নীচে ছোট-ছোট করে লেখা, “অকালে চলে যাওয়া এক রহস্যময়ী নায়িকা!” লেখার আশপাশে আরও অনেকগুলো চিত্রবিন্যাস। কোথাও লতানে শরীরকে জড়িয়ে রেখেছে বেলবটম প্যান্ট-খাটো ব্লাউজ, কোথাও দুঃসাহসী যৌবন প্রকাশ পেয়েছে আঁটোসাঁটো স্বল্প পোশাকে। কিন্তু আমি যেন দেখেও দেখছিলাম না। ওই গ্ল্যামারাস রূপের পেছন থেকে আস্তে-আস্তে উঠে আসছিল একটা অন্ধকার কালো ছায়া, যেন কেউ একটা কালো কালির দোয়াত উপুড় করে দিয়েছে ওই মোহময়ীর ওপর। দেখতে-দেখতে সেই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যকে গ্রাস করতে লাগল ঘন কৃষ্ণবর্ণ এক প্রেতকায় মূর্তি, এক ধূসর মৃত্যু উপত্যকা, চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে থাকল ঝিঁঝির দল, আর সর্বগ্রাসী আগুনের ঝলকানির মাঝে কানফাটানো আর্তনাদ করে উঠল এক অতিকায় দানব!
জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। আজকেই এই প্রসঙ্গ উঠতে হল! বকবকানির ফাঁকেই কখন যেন আবার চা রেখে গেছে রাণুর মা, জলখাবারটাও। জানালার পাশেই টেবিলের ওপর এখনও পড়ে আছে আমার খসড়া খাতাটা। চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে বসলাম টেবিলের সামনে। বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ভেতর থেকে উঠে আসছে কিছু স্মৃতি, কিছু করাল আতঙ্ক, কিছু বীভৎস চিৎকার। কী আশ্চর্য সমাপতন! ঝুরিদিদার স্মৃতি মাখা সেই রাতটা, যে রাতটা বদলে দিয়েছিল আমার বাকি জীবনটাকে, আজ তো তার কথাই লিখছিলাম! আর বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে এই মুহূর্তে যে ঘটনাগুলো ছুটে বেড়াচ্ছে সেই সমস্ত বিভীষিকা কাটিয়েও যে আজ বেঁচে আছি, তার পেছনেও অবদান সেই দশ বছর বয়সের রাতটারই!
সবাই জানে আগুনে ঝলসে গিয়েছিল এককালের বাংলা সিনেমার জনপ্রিয়তম নায়িকা চৈতালী সেন। কিন্তু সত্যিই কি আগুনে পুড়েই মারা গিয়েছিল চৈতি? হ্যাঁ, গোটা পৃথিবীর সামনে সেটাই একমাত্র সত্যি। এমনকী গত মাসে ওর জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখা এই প্রতিবেদনটাও শেষ হয়েছে সেই একই বক্তব্য দিয়ে— যা গত তিরিশ বছর ধরে আপামর বাঙালি বিশ্বাস করে এসেছে… . “হুগলির এক প্রত্যন্ত গ্রামের জমিদার বাড়িতে একটি সিনেমার শুটিং চলাকালীন হঠাৎ-ই নিখোঁজ হয়ে যান চৈতালি সেন। সম্ভবত সেটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ কাজ। কারণ এর কিছুদিন পরেই তাঁরই একটি বাগানবাড়ি থেকে উদ্ধার হয় তাঁর অগ্নিদগ্ধ গলিত দেহ। শোকের ছায়া নেমে আসে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে। পুলিশি তদন্তের পর জানা যায় আত্মহত্যা করেছেন নায়িকা। কিন্তু কেরিয়ারের মধ্যগগনে থেকে যখন একের-পর-এক হিট সিনেমা দিয়ে যাচ্ছিলেন মিস সেন, সর্বকালের অন্যতম সেরা নায়িকার তকমা বসতে শুরু করেছিল তাঁর নামের পাশে, তখন এইরকম চরম একটা সিদ্ধান্ত কেন নিলেন তিনি?”
বাস্তব বড়ই অদ্ভুত। খবরের সন্ধানে একটা সময় জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। আর সেই সূত্রে সাক্ষী থেকেছি এমন অনেক ব্যাখ্যাতীত ঘটনার যা হয়তো সর্বসমক্ষে প্রকাশ পেলে বিশ্বাস করা তো দূরে থাক, আমার মানসিক অবস্থা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। চৈতির ঘটনাটাও ঠিক তা-ই। ওর মৃত্যুর পেছনের আসল সত্যিটা আজ বেঁচে আছে একমাত্র এই বিতংস খাসনবীশের বুকের মধ্যেই! আর আমি নিজে? মৃত্যুর নিষ্ঠুর চাবুক কি আমাকে ছুঁয়েও বেরিয়ে যায়নি? নাকি…
আবারও নতুন করে শিহরণ খেলে গেল শরীরে। আনমনে মুঠো করলাম আঙুলগুলো। প্রতি বারই এমনটা হয়। কোনও ঘুম-ভাঙা রাতে কিংবা একলা বসে দেখা কোনও মায়াবী সূর্যাস্তের মুহূর্তে ছবির মতো ফুটে ওঠে সেই ভয়ংকর দৃশ্যগুলো, বহুবছর আগে ঘটে যাওয়া সেই বীভৎস অভিজ্ঞতা প্রতি মুহূর্তে এখনো আমার অস্তিত্বকে দাঁড় করিয়ে দেয় প্রশ্ন চিহ্নের সামনে। আমার দেখা অন্যান্য অমীমাংসিত কাহিনীগুলোর মতোই এটাও এতদিন থেকে গেছে শুধুমাত্র আমার নিজস্ব গোপন উপলব্ধি হয়ে। সেরকমভাবেই আজ মনে পড়ছে বছর তিরিশেক আগের সেই দিনটার কথা। আজকের মতোই মেঘলা ছিল দিনটা, বিকেলের দিকে দপ্তরে পৌঁছে জুত করে বসেছি চায়ের গ্লাস নিয়ে। সবে একটা আর্টিকল লিখতে শুরু করব, এমন সময় ধপাস করে সামনের চেয়ারটায় এসে বসল তুহিন, “বিতংসদা, কেস জন্ডিস!”
মুখ তুলে বললাম, “কেন, কী কেস ভাই?”
যেন জীবনের সর্বস্ব হারিয়ে গেছে এমন এক গভীর শোকের সমুদ্র থেকে উঠে তুহিন গড়গড় করে বলে গেল, “খুব ভয়ংকর ব্যাপার গো! অমন জ্বালাময়ী রূপ… ওরম ইয়ে, মানে ফিগার… একা একটা মেয়েকে পেয়ে… উফফ, যদি কিছু হয়ে যায়! তুমিই বলো, নিজে-নিজেই বা ওরকম কাউকে না জানিয়ে চলে যাবে কেন? অবশ্য যদি কারো সঙ্গে… ইয়ে, মানে ভেগে গিয়ে থাকে… ইস্স্, আমরা ব্যাচেলর ছেলেরা পুরো ইয়ে হয়ে গেলাম… ”
তুহিন নতুন ইন্টার্ন ঢুকেছে। ছেলেটার সব ভালো, শুধু এই ইয়ে ইয়ে করতে-করতে যে কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যায় ধরা মুশকিল। বিরক্ত হয়ে বললাম, “ধানাইপানাই ছেড়ে আসল কথাটা বলবি? কে কোথায় চলে গেল?”
এবার একটু নিজেকে সামলে আবেগ মাখা গলায় তুহিন বলল, “চৈতালি সেনকে পাওয়া যাচ্ছে না গো! পুরো হাওয়া!”
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল! এত বড় একটা খবর! প্রায় দিন দশেক অবশ্য দিল্লি গেছিলাম রঞ্জি ট্রফি কভার করতে। তারপর আবার সেখান থেকে দৌড়তে হয়েছিল আসাম, বিশাল জঙ্গি হামলা হয়েছে সেখানে। ওখানে গিয়ে আবার আর-এক বিপদ, পাহাড়ি মশার কামড় খেয়ে আমার ক্যামেরাম্যানকে ধরল ডেঙ্গুতে! তাকে নিয়ে ডাক্তার-হসপিটাল দৌড়োদৌড়ি করে অবশেষে সুস্থ করে তুলে প্রায় হপ্তা তিনেক বাদে গত সন্ধ্যায়ই ফিরেছি শহরে। এর মধ্যে এত কান্ড হয়ে গেছে! উতলা স্বরে বললাম, “কী বলছিস! কবে থেকে? কোথা থেকে নিখোঁজ হল?”
“আরে সেটাই তো রহস্যজনক ব্যাপার! কেউ কিডন্যাপ করেছে, নাকি নিজেই কোথাও চলে গেছে, কে জানে! তা প্রায় দিন পনেরো-কুড়ি হবে… ওই তো, মাসের শুরুর দিকে স্বপন দাশগুপ্তের একটা পিরিয়ড ফিল্মের শুটিং চলছিল হুগলির কোন এক জমিদারবাড়িতে। লিড রোলে চৈতালি সেন আর সঞ্জয় চ্যাটার্জি। তো লাস্ট দিনের শুটিং শেষে নাকি মহারানির ইচ্ছে হল রাতটা ওখানে কাটিয়ে ফিরবেন। ওরকম একটা ভাঙাচোরা পুরোনো বাড়ি, সাপখোপ তো থাকতেই পারে, বলো! তার ওপর ওই গ্রামে নাকি জমিদার বাড়িটার দুর্নাম আছে, প্রতি মাসে নাকি ওখানে ইয়ে… মানে ভূতটুত দেখতে পাওয়া যায়! সেই শুনেই নাকি নেচে উঠলেন চৈতালি সেন, তিনি ওখানে থাকতে চান। ভাবো কীরকম ইয়ে! অবশ্য ওরকম গোলাপের মতো নরম-নরম দেখতে হলে কী হবে, মহিলা তো বরাবরই একটু বেশ ইয়ে গোছের, জানোই তো। সে আউটডোর শুটিং-এ গিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করার জন্য পাবলিককে চড় মারাই হোক, বা হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো ওই… বিকিনি পরে জলে নেমে… ইয়ে করা, মানে ফোটোশুট করাই হোক! অগত্যা ইউনিটের বাকিরা হোটেলে ফিরে গেল, তিনি আর তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে গেলেন। তারপরে যে ঠিক কী হল কেউ জানে না! পরের দিন সকালে ড্রাইভার যেতে তাকে বলে দিলেন যে তাঁর একটু দরকার আছে, নিজেই ড্রাইভ করে কলকাতা ফিরবেন। ড্রাইভার যেন ইউনিটের সঙ্গে ফেরে। ব্যাস! তারপরেই পাখি ফুড়ুৎ! সেই যে গাড়ি নিয়ে বেরোলেন, তারপর থেকে আর কোনও পাত্তাই নেই! বাড়ি তো ফেরেনইনি, এমনকী কোনও চেনা-পরিচিত কারোও বাড়িই যাননি। পুলিশ তো লোক লাগিয়ে দিয়েছে, কোথাও কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে কি না, বা কোনও ইয়ে, মানে বেওয়ারিশ লাশটাশ… ইস, ভাবতেই কেমন ইয়ে লাগছে। আর এদিকে স্বপনবাবুরও মাথায় হাত। প্রজেক্টটা তো বিশ বাঁও জলে চলে গেল! কী অবস্থা ভাবো?”
“আর ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটা?”
“ওই মেয়েটা? সেও তো বেরিয়ে ছিল সেই চৈতালি সেনের গাড়িতেই, তারও কোনও খোঁজ নেই।”
আর বসে থাকা সম্ভব নয়। প্রায় দিন কুড়ি কেটে গেছে মেয়েটার কোনও খোঁজ নেই। কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে কে জানে! ভালো-মন্দ যদি কিছু হয়ে যায়… নাহ্, জোর করে মন থেকে বাজে চিন্তাটা সরালাম। এখনই অতখানি নেগেটিভ হয়ে পড়লে চলবে না। মনটা ভীষণ অস্থির-অস্থির লাগছে, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে। পেনটা বুকপকেটে ঢুকিয়ে উঠে পড়তেই খপ করে হাতটা চেপে ধরল তুহিন, “আরে চললে কোথায়? চৈতালি সেন কে খুঁজতে নাকি? কোথায় খুঁজবে? ওর ভবানীপুরের বাড়ি তো ছাড়ো, যেখানে যত আত্মীয়ের বাড়ি, গ্রামের বাড়ি— সব তন্নতন্ন করে চষে ফেলেছে পুলিশ… বাট নো ট্রেস,” বুড়ো আঙুল নাড়াল।
একটু হেসে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা জায়গায় পুলিশ এখনো যায়নি জানি। যাওয়ার কথাও নয়। পেলে হয়তো আমিই খুঁজে পাব চৈতিকে।
চৈতিকে দেখছি সেই ইজের-পরা বয়স থেকে। কাপাসদায় আমাদের দেশের বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল ওদের মামাবাড়ি। গরমের ছুটি, বড়দিনের ছুটি পড়লেই হল, বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে কাকলি মাসি সোজা চৈতি আর ওর দাদা চয়ন মানে চানা-কে বগলদাবা করে হাজির হতেন বাপের বাড়িতে। আর পুজো তো ছিলই। দুই বাড়ির কচিকাঁচা মিলে কী হুল্লোড়টাই না করতাম! দেখলে কে বলবে যে আমরা এক মায়ের পেটের ভাইবোন নই? বড় হওয়ার পরেও যোগাযোগটা ছেঁড়েনি, বরং আরও জোরদার হয়েছে। চৈতি যখন গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখার কথা বলল, তখন কাকলি মাসিকে আমিই বুঝিয়েছিলাম। প্রথম দিকে কিছু-কিছু ডিরেক্টর-প্রোডিউসরের সঙ্গে আলাপ-পরিচিতি করিয়ে দিলেও ধীরে-ধীরে নিজের অসামান্য অভিনয় দক্ষতার জোরেই আজ বাংলা সিনেমার এক নম্বর নায়িকার তকমাটা পেয়েছে ও। আমি ছিলাম ওর সবরকমের মুশকিল আসান, নিজের দাদার চেয়েও বেশি। রাতবিরেতে কতবার ঘুম ভেঙে ফোন ধরেছি, “বুতুদা অমুকটা কী করব… তমুককে কী বলব বলো না? আমি কিছু ডিসাইড করতে পারছি না।” এবারে কেন একটি বার ফোন করলি না চৈতি? বাড়িতে অন্তত একবার ফোন করলেই তো আমি মায়ের থেকে খবরটা পেয়ে যেতাম…
“এরপর কোন দিকে দাদা?” ড্রাইভারের গলায় চিন্তার সুতোগুলো ছিঁড়ে গেল। একটা বটগাছকে ঘিরে বিশাল চারমাথার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে ট্যাক্সি। টাকা মিটিয়ে গাড়িটা ছেড়ে দিলাম। এখান থেকে বামদিকের রাস্তা ধরে প্রায় মিনিট সাতেক যেতে হবে। ট্যাক্সি নিয়ে একেবারে বাড়ির সামনে অব্দি যাওয়া যেতেই পারত, কিন্তু চৈতি যদি সত্যিই এখানে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, তখন আর-একজন তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি সে মোটেই ভালোভাবে নেবে না।
জায়গাটার নাম আমতলা। বেহালা ছাড়িয়ে ডায়মন্ড হারবারের দিকে যেতে পড়ে। এদিকে কলকাতার ভিড়ভাট্টা নেই, সবুজে সবুজ-ঘেরা ছড়ানো মফস্বল এলাকা। মাস দুয়েক আগে দুম করে এখানে নিয়ে এসেছিল চৈতি। খুশিতে ডগমগ হয়ে সেই ছোট্টবেলার মতো চোখ দুটো গোল্লা গোল্লা করে বলছিল, “ফার্মহাউসটা কিনেই ফেললাম বুতুদা! যখন মনখারাপ করবে, কিচ্ছু ভালো লাগবে না… তখন এইখানে পালিয়ে আসব। কেউ জানে না এটার কথা… দাদাও না। দাদাকে বললেই তো জ্ঞান দিতে শুরু করবে, আবার বাড়ি কেনার কী দরকার… আমাদের ভবানীপুরের বাড়িটা তো আছেই। ওকে কী করে বোঝাই বলো, ওই বাড়িতে থাকলে আজকাল কী যেন একটা ভারী পাথর বুকের ওপর চেপে আসে। মা-র গান, বাপির হাসি ঘুরে বেড়ায় বাড়ি জুড়ে। তার চেয়ে এই ভালো, মাঝে-মাঝে আসব এখানে,” বলতে-বলতে চোখ মুছেছিল। আর তারপর বলেছিল, “এটার কথা শুধু তুমি জানলে, আর মাধুদা। আর কেউ না!” মাধুদা চৈতির জন্মের সময় থেকে আছে। বছর দুয়েক আগে মুসৌরিতে বেড়াতে গিয়ে পাহাড়ে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে মাসি-মেসো মারা যাওয়ার পর এখন ওই-ই তো আগলে-আগলে রেখেছে মেয়েটাকে। চানা মেয়ে-বৌ নিয়ে স্টেটসে সেটলড, দু-বছরে হয়তো একবার আসে। মাসি-মেসোর পর তাই বড্ড একা হয়ে গেছিল মেয়েটা। পাগলের মতো কাজে ডুবিয়ে দিয়েছিল নিজেকে। কিন্তু হঠাৎ কী এমন হল…
কখন যেন হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছে গেছি। আকাশ জুড়ে ময়লা ন্যাকড়ার মতো মেঘ ঝুলে আছে। তার নীচে গাছপালার ফাঁক দিয়ে সাদা-ধূসর মেশানো পুরোনো আমলের বাংলো বাড়িটা যেন গম্ভীর রাগী বৃদ্ধের মতো ভুরু কুঁচকে দেখছে। আশপাশে আর বাড়িঘর তেমন নেই। এই বাড়ির গা-লাগোয়া কিছুটা আগাছা ঘেরা পরিত্যক্ত জমি, তার পর থেকে শুরু হয়েছে ধান খেত। লোহার গেটটা ঠেলে ঢুকলাম। সামনে ছোট্ট নুড়ি বিছানো পায়ে চলা পথ, তার দু-পাশে নানারকম মরশুমি ফুলের গাছ। এছাড়াও বড়-বড় আম-নিম-পেয়ারা-আকাশমণি গাছ যেন দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে বাড়িটাকে। কেমন এক গুমোট নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে চারপাশে। গাছের পাতার সরসরানি, পাখিদের ডাক… কোথাও কিচ্ছু নেই। একদম সামনে গিয়ে বাড়িটাকে ভালো করে দেখলাম। দরজা-জানালা সব বন্ধ, কাচের শার্সির ওপর দিয়ে পর্দা টানা। দেখে মনে হচ্ছে না কেউ ভেতরে আছে। তবুও পুরোপুরি নিঃসন্দেহ না হয়ে এখান থেকে কোনওমতেই যাব না আমি। পালিশ-করা ভারী কাঠের দরজা, তবে তালা লাগানো নেই। মানে ভেতরে কেউ আছে! পরপর দু-বার কলিং বেল বাজিয়ে হাঁক পাড়লাম, “চৈতি? অ্যাই চৈতি! মাধুদা? কে আছ? দরজা খোলো!” কোনও সাড়া শব্দ নেই। বেলটা বাজাতেই থাকলাম। ধীরে-ধীরে কেমন যেন একটা জেদ চেপে গেল। দু-পা পিছিয়ে গিয়ে ওপর দিকে মুখ তুলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “চৈতি! দরজা খোল! আরে আমি এসেছি! কী হয়েছে তোর? আমি জানি তুই এখানেই আছিস! দরজা খোল বলছি!”
কিছুক্ষণ দরজাটায় ধাক্কাধাক্কি করে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে হাঁপিয়ে গেলাম। বড় অপমানিত লাগছে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, অথচ চৈতি বা মাধুদা কেউ দরজা খুলল না? কী এমন হল যে চৈতি আমার মুখোমুখিও হতে চায় না? দোতলার দিকে একবার তাকিয়ে ঘুরতে যাব, এমন সময়…
একটা পরদা সামান্য নড়ে উঠল না? একটা ছায়ামূর্তি সরে গেল কি?
দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিছু কি হবে এবার? খুলে যাবে দরজা? মিনিট দুই কাটল। সেই একই রকম পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি। নাহ্, আমার মনের ভুলই হবে। আর অপেক্ষা করার মানে হয় না। বিষণ্ণ মনে সবে ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছি, এমন সময়…
ঠক্।
খুব সাবধানে কেউ যেন খুলে দিল দরজাটা। অবশেষে! “কী ব্যাপার তোর, অ্যাঁ!” বলতে-বলতে কাঠের পাল্লাটা সরিয়ে ভেতরে পা রেখেই চমকে গেলাম। কেউ কোত্থাও নেই! যেন মন্ত্রবলে খুলে গেছে দরজাটা! আর নাহলে যে দরজাটা খুলল সে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ গুম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো বাড়িটাতে একটাও আলো নেই। বেশির ভাগ জানালার কাচের শার্সি যেন ভারি-ভারি পর্দা দিয়ে একপ্রকার মুড়েই রাখা আছে। সেই একবারই এসেছিলাম এ বাড়িতে, তার ওপর তখন সাজানোও হয়নি। এখন এই অন্ধকারে এই অচেনা বাড়ির ভেতরে কি হাঁটাচলা করা সম্ভব? প্রথমেই একটা ছোট টুলে হোঁচট খেয়ে আছাড় খেতে-খেতে কোনও রকমে বাঁচলাম। কিন্তু পরেরটা বাঁচানো গেল না, গুঁতো খেলাম আলমারি জাতীয় কোনও একটা জিনিসের সঙ্গে। “চৈতি!” আপনাআপনি গলা চড়ে গেল আমার… হাতড়াতে-হাতড়াতে বাম হাতটা কীসের ওপর পড়তেই “ঝ্যাং!” করে বিকট আওয়াজে চমকে থেমে গেলাম! একটা পিয়ানো। আর সেই ঝঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে থেকে শুনতে পেলাম গুমগুম করে মেঘের প্রবল গর্জন! কখন যেন চাপ-চাপ মেঘ আরও ঘন হয়ে ঘিরে ধরেছে চারদিক থেকে, ছাই-রঙা আলো কমতে-কমতে ঠেকেছে তলানিতে। দেখতে-দেখতে শনশন করে প্রচণ্ড বেগে ঝোড়ো বাতাস চাবুক আছড়াতে শুরু করল কাচের জানালাগুলোর ওপর, সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি! দরজা-জানালা বন্ধ থাকলেও বিকট শব্দে কান পাতা দায়। সেই ভয়ংকর তাণ্ডব-সঙ্গীতের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার মৃত্যুপুরীর মতো অচেনা বাড়িটায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল আমার! কোথাও একটা জানালা বোধহয় ঝড়ে খুলে গেল দমাস করে, হাওয়ার তোড়ে আমার ডানদিকে ফরফর করে দুলে উঠল একটা সাদা পরদা। সম্ভবত কোনও ঘর আছে ওখানে। পরদাটা উড়লেও ভেতরটায় বিশেষ কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কারণ সেখানেটাও জমাট বাঁধা অন্ধকার। শুকনো গলায় ওদিকেই এগোনো উচিত কি না ভাবতে-ভাবতে ঠাহর করে পা ফেলতেই কিছু একটা ভারী জিনিসে ধাক্কা খেলাম। ঠং! কোনও ধাতব জিনিস গড়িয়ে পড়েছে, ফুলদানিটানি হবে। বেশ জোরেই লেগেছিল, কিন্তু সে ব্যাথাটা অনুভব করার আগেই আরও একটা অপ্রত্যাশিত শব্দে আমার পিঠের ভেতর দিয়ে কনকনে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল!
ধাতব শব্দটা একটা রিনরিনে রেশ ছড়িয়ে থামতেই তোলপাড় করা বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে ঘরের সম্পূর্ণ উল্টোদিকের চাপ-চাপ অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে এল একটা অস্বাভাবিক রকমের খসখসে করাত-টানা গোঙানি, “কেন এসেছ তুমি বুতুদা? চলে যাও! চলে যাও বলছি!”
***
“দাদা! ও দাদা! ঘুমিয়ে গেলেন নাকি? আরে উঠুন উঠুন! পলাশডাঙা তো এসে গেল!” ড্রাইভারের বাজখাঁই ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। কাল রাতে খুব একটা ঘুম হয়নি। গত দিন পাঁচেক ধরেই বিশেষ হচ্ছে না। চোখটা অস্বাভাবিক লাল হয়ে আছে, সামনের মিরর ভিউতে দেখলাম। তার পাশেই দেখা যাচ্ছে ড্রাইভারের সন্দেহগ্রস্ত মুখ, ভুরু কুঁচকে জরিপ করছে আমাকে। ব্যাটা নেশাখোরটোর ভাবছে নাকি! ভালো করে চোখ কচলে গা ঝেড়ে গলায় যতদূর সম্ভব গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললাম, “এখানে তারাসুন্দরী স্কুল কোথায় আছে আশপাশে একটু জিজ্ঞেস করো তো!” পথচলতি লোকেদের জিজ্ঞাসা করে আবার গাড়ি চলল। তারাসুন্দরী স্কুলের পাশেই গগনবাবুর দোকান। দেমুন্ডা যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক করতেই প্রথম মাথায় এসেছিল ধ্রুব-র নাম। কলেজে আমরা এক্কেবারে বুজুম ফ্রেন্ড ছিলাম যাকে বলে। কলেজের পরেও যোগাযোগটা ছেঁড়েনি। মনে আছে, ওর দেশের বাড়ি ছিল হুগলিরই কোনও একটা গ্রামে। কপাল ভালো, ফোন করতেই ধ্রুব-র সহর্ষ গলা ভেসে এসেছিল, “আরে দেমুন্ডা তো চিনি! আমাদের পলাশডাঙা থেকে চোদ্দো-পনেরো কিলোমিটার হবে। একেবারে ধ্যাদ্ধেড়ে অজ পাড়া-গাঁ যাকে বলে। তা সেখানে কী মতলবে ওস্তাদ?” তবে এটা-ওটা গুলগাপ্পি দিয়ে আসল কারণটা চাপা দিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে আমাকে। মায়ের কোন পূর্বপুরুষের জমি আছে দেমুন্ডা তে, সেটার ব্যবস্থা করতে যেতে হবে, এইসব বলে কোনওমতে কাটিয়েছি। যা-ই হোক, ধ্রুবও আর বিশেষ না খুঁচিয়ে পলাশডাঙায় থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। “এই যে ইস্কুল,” গাড়ি থামিয়েছে ড্রাইভার। রাস্তায় আসতে-আসতে দেখে বুঝছিলাম পলাশডাঙাকে মোটামুটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম বলা চলে। “কালিকা ভাণ্ডার”-এ গিয়ে পরিচয় দিতেই বিশাল বপু সামলে চেয়ার থেকে উঠে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ধ্রুব-র জ্যাঠামশাই গগনবাবু। নানারকম রোগে কাবু, এখন শুধু দোকানে এসে বসেন, ছেলেরাই সব দেখে, এইসব গল্প করতে করতে বাড়িতে নিয়ে যেতেই আপ্যায়নের ধুম পড়ে গেল। কোনওমতে শুকনো হাসি দিয়ে ম্যানেজ দিচ্ছিলাম, আদর-আহ্লাদ নেওয়ার মতো মানসিকতা ছিল না। আমার মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা কোষ তখন দপদপ করছিল এক অদ্ভুত অনুভূতিতে। কী ছিল সেই অনুভূতি? কষ্ট? যন্ত্রণা? নাকি মজ্জার গভীরতম অংশে প্রোথিত এক আদিম আতঙ্ক?
***
“চৈতি!” একটা ফ্যাঁসফেসে আওয়াজ কোনওরকমে বেরোল আমার গলা দিয়ে। হ্যাঁ, এ তো চৈতিরই গলা! মনে হচ্ছে কেঁদে-কেঁদে একদম ভেঙে গেছে গলাটা… তাও এ গলা চিনতে আমার ভুল হবে না! অন্ধকারে কিছুটা চোখ সয়ে এসেছে। বিশাল হল-ঘরটার একদিকে সোফা জাতীয় কিছুর ওপর বসে আছে একটা ছায়ামূর্তি। ডানদিকে একটা জানালার কাচের ফাঁক দিয়ে দূরের আকাশ দেখা যাচ্ছে, সেই আবছায়াতে মনে হল তার মাথায় কাপড় জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া, বা জ্যাকেটের হুডের মতো কিছু একটা ঢাকা দেওয়া। “উফ! কী পাগলামি এগুলো?” এতক্ষণে ধড়ে প্রাণ এলো আমার, “যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি না! এরকম আলো নিভিয়ে অন্ধকারে বসে আছিস কেন?”
“আলো?” একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা ঝরে পড়ল ওই ঘড়ঘড়ে গলা দিয়ে। তারপর একটু থেমে কাটা-কাটা শব্দ ভেসে এলো, “চলে যাও বুতুদা। পালাও এখান থেকে। সব শেষ হয়ে গেছে।”
এমন একটা বুকচাপা হাহাকার ছিল ওই কথাগুলোর মধ্যে যে আমার মনের ভেতরটা আকুল হয়ে উঠল। এরকম কেন বলছে চৈতি? খুব খারাপ কিছু কী হয়ে গেছে ওর সঙ্গে? আবছা আলোয় হাতড়ে-হাতড়ে সামনে একটা নিচুমতো মোড়া পেয়ে তাতে বসে পড়ে বললাম, “কী বলছিস! পালাব কেন? কী হয়েছে আমাকে খুলে বল তো! আমি শহরে ছিলাম না, কালই ফিরেছি… শুনলাম কোথায় শুটিং করতে গিয়ে নাকি নিজেই ড্রাইভ করে ফিরে এসেছিস? তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে এখানে লুকিয়ে বসে আছিস! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
“শুটিং! ওই শুটিং… ওই রাতটা… ছারখার করে দিল সবকিছু! মরে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও রাস্তা নেই বুতুদা!” বলতে-বলতে চিৎকার করে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ল চৈতি। আমার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। তা হলে কি আমি যা আশঙ্কা করছি তেমনি কিছু? যার জন্য এভাবে ভেঙে পড়েছে চৈতির মতো শক্ত মনের মেয়েও? “কেন এরকম করছিস? কী হয়েছিল… ওই রাতে?” অস্ফূটে বিড়বিড় করলাম আমি।
ঘোমটা দেওয়া মাথাটা অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে। বাইরে ঝড়ের প্রাবল্য কমলেও আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি চলছেই। সেই আকাশের মতো বৃষ্টি ভেজা গলায় ফুঁপিয়ে উঠল চৈতি, “অ্যাডভেঞ্চারের নেশাটা শেষ পর্যন্ত আমাকে এমন অবস্থায় ফেলবে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি কোনওদিন! তোমার মনে আছে বুতুদা, তুমি আমি আর দাদা মিলে মামাবাড়ির পাশে জঙ্গলের মধ্যে ভাঙা নীলকুঠিটায় কতবার লুকিয়ে-লুকিয়ে রাতের বেলা গেছি ভূত দেখার জন্য?”
হ্যাঁ, ডাকাবুকো ছিলাম বটে আমরা তিনজন। আমগাছের মগডালে উঠে আম পেড়ে আনা, এক নিঃশ্বাসে ডুব সাঁতারে বিশাল কাজলা দিঘি এপার-ওপার, এসব দস্যিপনা ছাড়াও আর যে বিষয়টায় আমাদের তিনজনের অসম্ভব আকর্ষণ ছিল সেটা হল ভূত। শুধু নীলকুঠিতে রাত কাটানোই নয়, গ্রামের একমাত্র লাইব্রেরিটা থেকে বিলিতি বই জোগাড় করে প্ল্যানচেটও করেছি কত! বলাই বাহুল্য সেসবে বিশেষ কোনও লাভ হয়নি… “এবারেও তাই যখন ওই দেমুন্ডা রাজবাড়িতে গেলাম, জায়গাটা আমাকে খুব টানছিল জানো,” বিষাদ-মাখানো গলায় আবার বলতে শুরু করেছে চৈতি, “রেকি করে ফিরে গিয়ে আমাদের এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার তপনদা বলেছিল, দিনকয়েক আগে নাকি হঠাৎ করে ওই ভাঙা রাজবাড়ির ওপর বেশ কয়েকবার বাজ পড়েছে। একই জায়গায় মুহুর্মুহু বাজ পড়া! এ তো ওয়ান’স ইন আ মিলিয়ন কেস! শুনেই আমার বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল ব্যাপারটা। যা-ই হোক, সদলবলে সবাই গিয়ে পৌঁছলাম স্পটে। রাজবাড়ি মানে আসলে জমিদার বাড়ি। কতদিনের পুরোনো হবে জানি না, তবে একটা অদ্ভুত কালচে-ধূসর ছমছমে পরিবেশ ছিল ওখানে। আমাদের শুটিং-এর জন্য একদম পারফেক্ট। বেশ নির্বিঘ্নেই হল শুটিং। তারপর কাজ যেদিন শেষ হল, সবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে, একটা চওড়া দালানে বসে ইউনিটের সবাই মিলে চা খাচ্ছিলাম। দেখতে-দেখতে গোল থালার মতো চাঁদ উঠল। পাশেই পুকুর, তার ওপর দিয়ে বয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাস কোন নাম-না-জানা ফুলের সুবাস নিয়ে। আমার মনটা কেমন করে উঠল। এমন সুন্দর একটা পূর্ণিমা রাতে এরকম একটা ভাঙাচোরা পুরোনো বাড়িতে রাত কাটানোর মজাই আলাদা। আর কপালজোরে যদি তেনাদের সঙ্গে দেখা হয়েই যায় তা হলে তো একদম কেল্লাফতে! এমনিতে ফাঁকাই পড়ে থাকে বাড়িটা। আশপাশের লোকজনের মধ্যে অলরেডি ভয় ঢুকে গেছে ওই বাজ পড়ার ব্যাপারটায়, তারওপর শুনলাম রিসেন্টলি একটা বাচ্চা মেয়ে এখানে খেলতে এসে নাকি পাগল হয়ে গেছে! তা ছাড়া কেউই তেমন কিছু বলতে পারল না। বাজ পড়ার জায়গাটাও দেখলাম। একটা পাথরের পরি, বাগানের ফোয়ারার ওপর বসানো আছে, তাতেই কিছুটা ফাটল ধরেছে। তার সঙ্গে সাদা শ্বেতপাথরটা কালো হয়ে গেছে। আদৌ ওটা বজ্রপাতে নাকি নেহাতই সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে ক্ষয় ধরেছে কে জানে! ভাবলাম এই কথা ধরে নিয়ে অমন ইন্টারেস্টিং বাড়িতে থাকাটা মিস করা যায় নাকি! শটের জন্য একটা রুমে পালঙ্ক, ডিজাইন করা বড় আয়না, তেপায়া টেবিল, আরাম কেদারা এসব দিয়ে সেট রেডি করাই ছিল, আমি আর আমার মেক-আপ আর্টিস্ট জুঁই থেকে গেলাম রাত্রে। জুঁইয়েরও বিশেষ ভয়-ডর নেই, আমার মতোই। তাড়াতাড়ি ডিনার করে সবাই চলে গেলে চাঁদের আলোয় দু-জনে ঘরের লাগোয়া খোলা ঝুল বারান্দাটায় বসলাম,” আস্তে আস্তে যেন ক্ষীণ হয়ে দূরে হারিয়ে যেতে থাকল চৈতির গলাটা।
আবার সেই অসহ্য দমবন্ধ করা নিস্তব্ধতা।
ছটফটিয়ে উঠলাম, “তারপর? তারপর কী হল? কিছু দেখলি রাতে?”
থেমে-থেমে চৈতির ক্লান্ত স্বর ভেসে আসল, “কী যে হল ঠিক মনে নেই। আমরা বসে গল্প করছিলাম, সারারাত জাগার প্ল্যান ছিল। কিন্তু মাঝরাতের দিকে এমন সুন্দর একটা হাওয়া আসতে লাগল, শরীর জুড়ানো ঠান্ডা পরশ, সঙ্গে একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ। আমাদের ঘুম পেয়ে গেল।”
“ঘুম!”
“হ্যাঁ, ঘুম। ওই ঘুমই কাল হল আমাদের!” এক ভয়াল আতঙ্কে থরথর করে যেন কাঁপতে শুরু করল চৈতি, “পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষণে সূর্য অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। ইজিচেয়ারের ওপরেই মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। মাথার ভেতরটা ভীষণ ঝরঝরে, শরীর-মন একদম তরতাজা… যেন পুনর্জন্ম হয়েছে আমার। আড়মোড়া ভেঙে সবে উঠতে যাব, কিন্তু সামনে শুয়ে থাকা জুঁই কে দেখে… ওঃ!” ভীষণ চিৎকার করে যেন দু-হাতে মুখ ঢাকল চৈতি!
“কী? কী হয়েছিল জুঁইয়ের?” আমার গলার কাছটাও কোনও এক অজানা কারণে শুকিয়ে আসছে বুঝতে পারছিলাম। ততক্ষণে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে চৈতি, একটানা কেঁদেই চলেছে। কী মর্মান্তিক হাহাকার সেই কান্নায়! বাইরের বৃষ্টির শব্দ আর ভেতরের এই বুকফাটা করুণ কাতরানি, সব মিলেমিশে আমার ভেতরেও কেমন একটা শূন্যতার সৃষ্টি করছিল। কোনওক্রমে হাতড়ে-হাতড়ে এগিয়ে গিয়ে চৈতির পাশের সোফাটায় বসলাম। পরম মমতায় আলতো গলায় বললাম, “কী হয়েছিল চৈতি? খুলে বল আমাকে, দেখবি অনেক হালকা লাগবে…”
“কী হয়েছিল! হা হা হা!” আমাকে ভীষণ চমকে দিয়ে হঠাৎ পাগলের মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল চৈতি! হাসতে হাসতেই চিৎকার করতে থাকল, “কী হয়েছিল জানতে চাও? সহ্য করতে পারবে না বুতুদা! আমি নিজেও যে সেই অভিশাপে অভিশপ্ত! সহ্য করতে পারছি না নিজেকে! মুখে কাপড় বেঁধে, সানগ্লাস-হ্যান্ডগ্লাভস পরে কোনওমতে লোকজনের চোখের আড়াল হয়ে পালিয়ে এসেছি এখানে… কিন্তু কতদিন? কতদিন এইভাবে ইঁদুরের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকব! জুঁইয়ের মতোই নিজেকে শেষ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই আমার! ‘একটা জলের বোতল কিনব’ বলে গাড়ি থামাতেই ব্রিজের ওপর থেকে ঝাঁপ দিল মেয়েটা। পচে ঢোল হয়ে যাবে ওর বডি, কেউ বুঝতেও পারবে না কী হয়েছিল ওর! হা হা হা! কেমন মজা!”
এ যেন বদ্ধ উন্মাদের প্রলাপ! শিউরে উঠলাম আমি। জুঁই বলে মেয়েটা কি সুইসাইড করেছে? আর সেই শকেই কি চৈতি এমন করছে? কিন্তু কী এমন হয়েছিল জুঁইয়ের যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল সে? চৈতিই বা নিজেকে অভিশপ্ত বলছে কেন? মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। সামনে বসে উন্মত্তের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকিয়ে খনখনে গলায় হাসতে থাকা ছায়ামূর্তি, মাকড়সার জালের মতো অন্ধকার, একটা জমাট-বাঁধা বরফ যেন আমার শিরদাঁড়া বরাবর আস্তে-আস্তে চেপে বসছিল। আর সহ্য হচ্ছিল না আমার! অন্তত একটু আলো যদি থাকত, ঠিক সেই সময়ে…
“আঁ-আঁ-আঁ!” বিকট স্বরে গোঙাতে গোঙাতে উঠে বসলাম খাটের ওপর। গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে জবজব করছে, বুকের ভেতরে যেন পাথর ভাঙার শব্দ! ধ্রুব-র জেঠিমা-বৌদির রান্না খেয়ে দোতলার এই দক্ষিণের ঘরে শুয়ে-শুয়ে যে কখন চোখ লেগে গেছিল বুঝতেই পারিনি। কিন্তু ঠিক আগের কয়েকটা রাতের মতোই দু-চোখের পাতা এক হতেই স্বপ্নের ভেতর থেকে টুপ করে ভেসে উঠেছিল সেই বৃষ্টি ভেজা ভয়াল সন্ধেটা। বাইরে তাকালাম। জানালার ফাঁক গলে অস্তগামী সূর্যের আলো এসে ফুলকাটা নকশা আঁকছে দেওয়ালের গায়ে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে গা-টা শিরশির করে উঠল। আলো! আলো যে মনের মধ্যে এতখানি আতঙ্কের জন্ম দিতে পারে, মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করেছিলাম সেই দুর্যোগের সন্ধেটায়। সেই নিকষ-কালো ঘরের মধ্যে চৈতির অস্বাভাবিক বিকৃত অট্টহাসি যখন দেওয়াল থেকে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন যেন আমার মনের কথা শুনে ফেলল স্বয়ং প্রকৃতি।
হাওয়ার তোড়ে চৈতির ঠিক ডানদিকে ঘরের একপ্রান্তের একটা জানালা খুলে গেছিল বহুক্ষণ আগেই। বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিচ্ছিল ঘরের একাংশ। চৈতির সেই অপ্রকৃতিস্থ হাসি আর বিড়বিড়ানির শব্দকে ছাপিয়ে প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি নিয়ে কানফাটানো শব্দে বাজ পড়ল খুব কাছেই কোথাও! দিনের আলোর মতো চারদিক সাদা হয়ে যাওয়া সেই প্রবল ছটায় যে বীভৎস দৃশ্য দেখতে পেলাম… মনে হল বাজটা আমার মাথাতেই পড়ল!
বিশাল এক আর্তনাদ করে উঠে পালাতে গিয়ে মেঝের ওপর ছিটকে পড়লাম। আমার সামনে সোফায় বসে যেন এক প্রেতমূর্তি। হাসির দমকে খসে পড়েছে তার মাথায় জড়ানো চাদর, জামা-কাপড়ও বিস্রস্ত। আর তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার হাত-পা-মুখ, যার রং ঘন অন্ধকারের মতো! আলোর ঝলকানিতে মুখ ফেরালো সে, তখনি দেখলাম তার চোখ। সে চোখ যেন কোনও মানুষের নয়, এক কালো অন্ধকার অতল খাদ… চোখের সাদা অংশেও কেউ যেন ঢেলে দিয়েছে ঘন আলকাতরা! নাক-মুখ সবই যেন গ্রাস করেছে কোনও কৃষ্ণবর্ণ শয়তানের ছায়া!
উফ! দু-হাতে খামচে ধরলাম চুলগুলো। সেই কদর্য অন্ধকার দুই কোটর সেই থেকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আমাকে! সেদিন সেই সাক্ষাত ডাকিনীমূর্তি দর্শন করে আমার মাথার ভেতরটা দুলে উঠেছিল, চোখের সামনে যেন তৈরি হচ্ছিল একটা অস্পষ্ট কুয়াশার বলয়। কীভাবে যে হোঁচট খেতে-খেতে নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করেছিলাম ওই বাড়ি থেকে তা আজও জানি না। শুধু এখনও কানের কাছে বাজতে থাকে পেছন থেকে চৈতির সেই আকুল চিৎকার, “তুমিও সহ্য করতে পারলে না বুতুদা! জানতাম, আমি জানতাম কেউ পারবে না! কেউ না! হা হা হা! আমার শরীরের সব রঙ শুষে নিয়েছে কেউ। ওই বাড়িটায়, বিশ্বাস করো, ওই রাজবাড়িতে কিছু একটা আছে! ওই একটা রাতের পর আমার চামড়া, চোখের মণি এমনকী রক্তটা পর্যন্ত কালো হয়ে গেছে, জানো বুতুদা! জুঁই তো নিজেকে শেষ করে দিল, আর আমি? আমি কী করব বলো? আর যে সহ্য করতে পারছি না নিজের এই ডাইনি রূপ। আমার কেরিয়ার, জীবন, খ্যাতি, গ্ল্যামার সব শেষ! মরে যেতে চাই আমি! এমনভাবে মরে যেতে চাই যাতে কেউ কোনওদিন দেখতেও না পায় চৈতালি সেনের এই কদাকার চেহারা! হা হা হা!”
নিজের কথা রেখেছিল চৈতি। এর ঠিক তিনদিন বাদে আমতলায় সেই বাগানবাড়ি থেকে উদ্ধার হয় বিখ্যাত অভিনেত্রী চৈতালি সেনের অগ্নিদগ্ধ পচা-গলা দেহ। বাড়িটা থেকে উৎকট দুর্গন্ধ বেরোতে থাকায় পুলিশে খবর দেয় এলাকাবাসী। কিন্তু উদ্ধার হওয়া সেই বিকৃত লাশ এমন পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল যে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই অবস্থায় ঘটনার মোড় ঘুরে যায় যখন ছুটি কাটিয়ে গ্রাম থেকে ফিরে আসে সেনবাড়ির অত্যন্ত বিশ্বস্ত পুরোনো কাজের লোক মাধব দাস এবং জানায় যে মাসকয়েক আগে এই বাগানবাড়িটি কিনেছিলেন চৈতালি সেন। এরপর তাঁর হাতের আংটি দেখে অভিনেত্রীকে শনাক্ত করে সেনবাড়ির অন্যান্য কাজের লোক ও চেনা-পরিচিতরা।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুক উজাড় করে। দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটু-একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে সূর্যটা। কালচে বেগুনি রঙের মেঘ জমাট বাঁধছে আকাশ জুড়ে। চৈতিও এইভাবে তলিয়ে গেছে এক অন্ধকার জগতে। আর আমার জন্য রেখে গেছে আজীবনের গ্লানিবোধ। সেদিন আমতলা থেকে ফিরে এসে প্রবল জ্বরে পড়েছিলাম। যতটা না বৃষ্টিতে ভিজে, তার থেকেও বেশি মনের মধ্যে জেঁকে বসা প্রবল আতঙ্কের জন্য। ক-দিন ধরে জ্বরের বিকারে এন্তার প্রলাপ বকেছি, কতবার যে ঘুমের মধ্যে চমকে-চমকে উঠে বসেছি তার ইয়ত্তা নেই! সুস্থ হওয়ার পর প্রথমেই সকালের কাগজে বড়-বড় হেডলাইন চোখে পড়েছে… “বিখ্যাত অভিনেত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু!” আর তার পর থেকেই আমার ভেতরটা কুরে-কুরে খাচ্ছে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। কী আছে ওই পরিত্যক্ত জমিদারবাড়িতে? যা দু-জন জলজ্যান্ত মানুষের পুরো শরীরের শুধু রঙটুকু শুষে নিল, অথচ আর কোনও ক্ষতি করল না? ভূত-প্রেত জাতীয় গল্পকথার প্রমাণ আজ অব্দি কোনওদিন পাইনি, কিন্তু কিছু-কিছু ব্যাখ্যাহীন আতঙ্কও যে মানুষের কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে বাস্তবের মাটিতে নেমে আসতে পারে, তার ছিটেফোঁটা ধারণা ততদিনে হয়েছে আমার। তাই শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া পর্যন্তও ধৈর্য্য ছিল না, পরের দিনই কী এক অমোঘ টানে রওনা দিয়ে ছিলাম দেমুন্ডা।
***
“এই যে… এটাই দাদা!” একটা মস্ত বড় হাঁ করে খোলা লোহার জং ধরা গেটের সামনে গাড়িটা দাঁড় করালো পিন্টু। ধ্রুবকে গাড়ির কথা বলে রেখেছিলাম, ওই-ই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পিন্টু ওদের পাড়ারই ছেলে। আজ সকাল-সকাল বেরিয়ে দেমুন্ডা পৌঁছে মোড়ের মাথায় দোকানে চা খেতে-খেতে লোকাল লোকজনের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিলাম, আর তারপরেই সোজা এই বাড়ি। গ্রামবাসীর মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক আছে বাড়িটাকে নিয়ে, তবে কেউ পরিষ্কার করে তেমন কিছু বলতে পারল না। বরং তাদের সিনেমার শুটিং নিয়েই বেশি উৎসাহ! আমরা কোনও শুটিং পার্টি কি না, আমাদের সিনেমার নাম কী, হিরো হিরোইন কে, কিছু দিন আগে চৈতালি সেন এসে শুটিং করে গেছে ইত্যাদি কচকচানির ফাঁকে নতুন তথ্য তেমন পাওয়া গেল না। শুধু একজন বলল যে ওই বাজ পড়ার পর জমিদারবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে সব গাছপালা নাকি পুড়ে গেছে।
এখানে পা রেখে দেখছি কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। ঢোকার মুখেই কয়েকটা মরা আম, নিম গাছ চোখে পড়ল… পাতাবিহীন ডালপালা মেলে কালো পোড়া কাঠের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কুচকুচে কালো পাতাগুলো ঝরে গিয়ে নীচে গালিচা বিছিয়ে আছে। এখানে-ওখানে ঝোপঝাড় গজিয়ে ছোটখাটো জঙ্গল তৈরি হয়েছে, সেগুলোর পোড়া কালো রঙের গুল্মের ফাঁকে ফাঁকে কিছু সবুজ পাতাও দেখা যাচ্ছে। সদ্য গজিয়েছে হয়তো। তবে আসল দেখার মতো জিনিস হল বাড়িটা! বিশাল দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িকে জায়গায়-জায়গায় জড়িয়ে রয়েছে বট-অশ্বত্থের শেকড়। শেকড় থেকে পাতা অব্দি পুরোটাই কালো! ঠিক যেন একটা কুচকুচে কালো অজগর সাপ পাকে-পাকে বেঁধে ফেলেছে তার শিকারকে। দিনদুপুরে ফটফটে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়েও আমার হাড়ের ভেতর দিয়ে যেন একটা কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল। মাথার ভেতর বেজে উঠল চৈতির গলা, “ওই বাড়িটায় কিছু একটা আছে!” কথাটা মনে হওয়া মাত্র হঠাৎ করে যেন চোখ খুলে গেল আমার। এই সমস্ত গাছপালার পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া আসলে কি সত্যিই বাজ পড়ার জন্য? নাকি এও ঠিক চৈতির মতো ঘটনা? সাধারণ মানুষের কল্পনায় যা পুড়ে যাওয়া তা আসলে… বুকের ভেতরের ধুকপুকটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। কোনও অশুভ শক্তির প্রভাবে রঙ হারিয়ে যাচ্ছে এই চত্বরের সব জীবন্ত প্রাণীর? চৈতি আর জুঁই তো শুধুমাত্র রূপ হারিয়েছিল, কিন্তু এই সবুজ উদ্ভিদেরা নিজেদের রঙ হারিয়ে সালোকসংশ্লেষ এর অভাবে মারাই গেছে! একটা অজানা আশঙ্কায় মনটা কেঁপে উঠল। পায়ে-পায়ে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। কেমন অস্বাভাবিক যেন এখানকার পুরো পরিবেশটা। শুধু ওই কালো হয়ে যাওয়া গাছপালা নয়, আরও একটা কিছু অপ্রাকৃত ব্যাপার আছে এখানে… কিন্তু সেটা কী? টিপিক্যাল পুরোনো দিনের জমিদার বাড়ি, সামনে উঁচু বাঁধানো গোল ফোয়ারা, তার মাঝখানে সেই বিশাল ডানা-মেলা পরি। ভালো করে দেখলাম কালচে রঙের পরিটাকে। কপালের বাম দিক থেকে শুরু হয়ে এক বিরাট ফাটল বাম চোখ, নাক আর ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে শরীরের ডান দিকে চলে গেছে ঠিক কোনাকুনিভাবে। উফ! যেন এক গভীর দগদগে ঘা! ফোয়ারায় জল নেই বলাই বাহুল্য। চারদিক থেকে ঝোপঝাড় গজিয়ে গোড়ার দিকের লোহার রেলিং প্রায় ঢেকে ফেলেছে। পরিটাকে দেখতে-দেখতে হঠাৎ কালো-সবুজ পাতার মধ্যে একটা জিনিস চোখে পড়ল।
একটা লাল-সাদা ফুল আঁকা কাপড়ের অংশ।
কেউ কি আছে ওখানে? কার কাপড় ওটা? পরির গোড়ার কাছটায় ঘন দুর্ভেদ্য ঝোপ, একজন মানুষ উবু হয়ে বসে থাকলে তাকে বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। ভেতরের কৌতূহলী মনটা আনচান করে উঠল। কে থাকতে পারে ওখানে? কী মতলবই বা তার? আমাকে দেখেই কি ওই ঝোপের পেছনে লুকিয়ে পড়েছে? নাহ্, দেখতেই হচ্ছে একবার। ফোয়ারার সিমেন্ট-বাঁধানো গোড়াটায় উঠে সাবধানে লোহার রেলিং পেরোলাম। আশ্চর্য! এখানে এরকম ছোট-ছোট হাড়গোড়… এগুলো কীসের হাড় পড়ে আছে? ঝোপ বেশ ঘন, একটু পা এদিক-ওদিক হলেই ব্যালেন্স সরে গিয়ে পড়ব। পরিটাতে বাম হাতে ভর দিয়ে শরীর বাঁকিয়ে কোনওমতে শুকনো ডাল আর কাঁটা ঝোপের ভেতর দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গাটায় পৌঁছে অবশ্য হতাশই হলাম। শুধু একটা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোই, আর কিছু না।
কোনও মানে হয়! শুধু শুধু এতটা কসরত করা! কাপড়টা পকেটে ঢুকিয়ে অন্য দিকটায় ঘুরে এসে প্যান্ট ঝেড়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম উঁচু সিমেন্টের বেদিটা থেকে। বুকটা হঠাৎ কেমন ধড়ফড় করে উঠল। এটুকুতেই কাহিল হয়ে গেলাম! প্রেশারটেশার বাড়ল নাকি?
না। সাধারণ প্রেশার বাড়া নয়। হয়তো অন্য কিছু। হয়তো অন্য কোনও জালে জড়িয়ে পড়েছি আমি। হয়তো আমিই সেই অদৃশ্য শয়তানের পরবর্তী শিকার। কারণ ততক্ষণে আমার সারা শরীর জুড়ে রক্তের মধ্যে যেন খেলে যাচ্ছে হাজার-হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ! কোষে-কোষে ছড়িয়ে পড়ছে লক্ষ বিষফোঁড়ার যন্ত্রণা! থরথরিয়ে কাঁপতে-কাঁপতে কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেলাম মাটিতে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আমার। কালঘুম।
***
“দাদা! ও দাদা! শরীর খারাপ লাগছে নাকি? ও দাদা! শুনতে পাচ্ছেন?” বহু দূর থেকে ভেসে আসছে একটানা শব্দটা। ঘুরেফিরে, থেমে-থেমে, একই কথা বারবার। কিন্তু খুব চেনা-চেনা লাগছে আওয়াজটা, কোথায় যেন শুনেছি? শরীরটা দুলতে শুরু করেছে, কে যেন আস্তে-আস্তে ঠেলছে আমাকে। বড় দুর্বল লাগছে, যতটা সম্ভব শক্তি জড়ো করে চোখের পাতাগুলো কোনওমতে খোলার চেষ্টা করলাম। সামনে একটা আবছা অবয়ব তৈরি হচ্ছে। চারদিকে যেন ঝিঁঝিঁ পোকারা ডেকে চলেছে মনে হচ্ছে। মাথার ভেতরের ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা খানিক হালকা হল শেষমেশ, অনেক চেষ্টায় ঘোলাটে চোখ খুলে তাকালাম। পিন্টু। উদ্বিগ্ন মুখে ঝুঁকে পড়ে আমাকে অল্প-অল্প ঝাঁকাচ্ছে। কী হয়েছে? এরকম করছে কেন? উঠে বসার চেষ্টা করতেই ওপরের দিকে চোখ গেল। সেই পরি! আর সঙ্গে-সঙ্গে সব কিছু মনে পড়ে গেল আমার! একটা চিৎকার করে এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসলাম। আমিও কি তবে চৈতির মতো…? হাত-পা ঘুরিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব জরিপ করার চেষ্টা করলাম। কই, সব তো স্বাভাবিক! নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছি না, তবে পিন্টুর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না ভয় পাওয়ার মতো কিছু ঘটেছে। বরং শুনতে পেলাম আমার এই ছিটকে ওঠা দেখে অবাক হয়ে বলছে, “কী দাদা? ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন নাকি?” ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? হ্যাঁ, ঠিকই তো! সেই কাপড়ের টুকরোটা কুড়িয়ে নিয়ে নীচে নামতেই শক্তিশালী সম্মোহনের মতো ঘুম নেমে এল চোখে। কীসের প্রভাবে? ফের শিউরে উঠে ছটফটিয়ে বললাম, “চলো চলো। এক্ষুনি বেরোতে হবে এখান থেকে।” ঘাবড়ে গিয়ে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে আমাকে তুলল পিন্টু, চিন্তিত স্বরে বলেই চলেছে, “শরীরটা কি খারাপ লাগছে দাদা? আজকের মতো কি ফিরে যাবেন? অল্প জ্বর ছিল বলছিলেন, শরীর বোধহয় ধকল নিতে পারছে না।” গাড়ির দরজা খুলে ধরে-ধরে বসিয়ে দিল। বাইরে বেরিয়ে যেন হাঁফ ছাড়লাম। সামনের আয়নায় নিজেকে এক ঝলক দেখে নিয়ে অপ্রস্তুত গলায় বললাম, “নাহ, সেরকম কিছু না, ওই একটু টায়ার্ড লাগছিল বলে রেস্ট নিচ্ছিলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বলো তো?”
“আরে আপনি তো ওই ভূতের বাড়িতে ঢুকে গেলেন। আমি আর কী করি, বসে-বসে আজকের পেপারটা পড়ছিলাম। তারপর প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল, আপনার সাড়াশব্দ নেই। কী হল দেখতে এসে দেখি, ও হরি! আপনি এই রেলিঙে হেলান দিয়ে দিব্বি ঘুম দিচ্ছেন! ভাবলাম শরীরটরির খারাপ হল নাকি… তা গাড়ি কি ঘোরাব দাদা?” ড্রাইভারের সিটে গুছিয়ে বসে এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে বলে গেল পিন্টু।
আধঘণ্টা? আমার তো মনে হচ্ছিল এক জন্ম ঘুমিয়ে উঠলাম! যা-ই হোক, ওকে এসব বলবার মানে হয় না। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “না না, শরীর একদম ঠিক আছে! তুমি বরং মন্ডলপাড়া চলো। দিনু মন্ডলের বাড়ি কোনটা একটু খোঁজ করো তো! হাতে সময় বেশি নেই।” সময় সত্যিই বেশি নেই। আপিসে সবাই জানে জ্বর নিয়ে বাড়িতে শুয়ে আছি। তাও সে আর কদ্দিন? এর মধ্যে দুটো দিন কেটে গেল। বেশি বাড়াবাড়ি হলে এডিটর অমিতদা নিজেই হয়তো বাড়িতে গিয়ে হাজির হবে কেমন আছি দেখার জন্য। পিন্টু ইতিমধ্যে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা ধরে গাড়ি এগোল। হেলান দিয়ে জানালার বাইরে চোখ রাখলাম। এখনও হাড়ের মধ্যে চিড়িক-চিড়িক করে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে, শরীরের সব মাংসপেশীতে ভীষণ ব্যাথা। যেন অনেক দূর দৌড়ে এসেছি। চৈতির কালো চোখটা মনে পড়তেই গায়ে কাঁটা দিল। আমি কি নেহাতই ভাগ্যবান? বাইরের প্রকৃতির দিকে মন দিলাম। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ, ঢিকিয়ে-ঢিকিয়ে চলছে গাড়ি। দু-পাশে আস্তে-আস্তে পেরোচ্ছে দিগন্ত-বিস্তৃত ধানক্ষেত, ঘন সবুজ গাছ-গাছালি, পুকুর, মাটির বাড়ি। দেমুন্ডা জায়গাটা সত্যিই গণ্ডগ্রাম। নাহলে দিনদুপুরে এরকম ঝিঁঝিঁ ডাকে? এক জায়গায় রাস্তার ওপর খেলা করছিল খালি গা হাফপ্যান্ট পরা কিছু বাচ্চা ছেলের দল, গাড়ি দেখে হইহই করে সদলবলে পিছু নিল। মিনিট পাঁচেক এইভাবে আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে গড়িয়ে-গড়িয়ে যাওয়ার পর একটা সরু গলির মুখে এসে দাঁড়াল গাড়ি। এবার পায়ে হেঁটেই এগোতে হবে। পিন্টুকে নিয়ে নামলাম। এখনও মাথাটা টলমল করছে, তবে হাঁটতে পারব। দিনু মন্ডলের বাড়ি খুঁজে পেতে অবশ্য বিশেষ বেগ পেতে হল না। নামটা শোনামাত্রই একটা ভয়ের ছাপ পড়ল লোকজনের চোখেমুখে। কলকাতা থেকে এসেছি শুনে আশপাশের কাঁচা বাড়ির দরজায় কয়েকটা মুখও দেখা গেল। শেষমেশ খানাখন্দ পেরিয়ে গোটাকতক কলা গাছ আর একটা পানাপুকুর সমেত দিনু মন্ডলের মেঠো বাড়িখানা আবিষ্কার করা গেল। দাওয়ায় বসে তরকারি কাটছিলেন মাঝবয়সী একজন মহিলা, আমাদের দেখে হাত থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। ভদ্রমহিলার চোখেমুখে শোকের ছাপ স্পষ্ট। চুল উশকোখুশকো, চোখের নীচে গভীর কালি। ইনি সম্ভবত দিনু মন্ডলের স্ত্রী। পিন্টু পরিচয় দিতেই কাপড়ে হাত মুছে তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে একটা ছোট মোড়া এনে দিলেন। মাথাটা ভার হয়ে আছে, পিন্টুকে জোর করে মোড়ায় বসিয়ে দাওয়ায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসলাম। খানিক আরাম হল। পারুলের ঘটনাটা জানার অদম্য ইচ্ছে আমাকে এত দূর টেনে এনেছে বটে, কিন্তু বুঝতে পারছি শরীর হয়তো শেষ পর্যন্ত ধকল নিতে পারবে না। তেমন হলে কালই কলকাতায় ফিরব, একটা ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার।
এখানেও ঝিঁঝিঁর ডাকে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। তার মধ্যেই কথা শুরু করলাম, “আচ্ছা পারুলের ঠিক কী হয়েছিল? ও হঠাৎ ওই ভাঙাচোরা বাড়িটায় গেল কেন?”
“সবই আমাদের পোড়া কপাল গো বাবু,” বলতে-বলতে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন পারুলের মা। নাক টানতে-টানতে জড়ানো গলায় বললেন, “মেয়েটা আমার ছোট থেকেই বারমুখো। সারাদিন এখানে-সেখানে টো-টো করে ঘুরে, গাছের ফলপাকুড় পেড়ে খাবে, কুত্তা-বিল্লির সঙ্গে গড়াগড়ি করবে! কতবার মানা করেছি, মেরেছি। তাও শোনে না। বাকি ছোট মেয়ে দুটো কিন্তু এমন হয়নি। ওই আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরতে গিয়েই যে কে বাণ মারল…” আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন মহিলা।
এই কথার কী-ই বা সান্ত্বনা হয়? অস্বস্তি নিয়ে চুপ করে থাকলাম। পিন্টু নরম গলায় বলল, “আরে কাঁদলে কি সমস্যার সমাধান হবে? তুমি দাদাকে সব খুলে বলো কী হয়েছিল। দাদা কলকাতার বড় কাগজের রিপোর্টার, বুঝলে! অনেক চেনা-জানা! পারুলকে বড় ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দেবেন। ভালো হয়ে যাবে তোমার মেয়ে।”
পিন্টুর কথায় কাজ হল বোধহয়। নিজেকে সামলালেন পারুলের মা। মুখটুখ মুছে খানিক চুপ করে থেকে তারপর বিষণ্ণ গলায় বলতে শুরু করলেন, “ডাক্তার-বদ্যিতে কি কাজ হবে গো বাবু? কী ব্যামোতে যে ধরল মেয়েটাকে ভগমানই জানে! হারু ওঝা, এখানে পাঁচটা গেরাম মিলে সবচেয়ে বড় ওঝা। সেও এসে ঝাড়ফুঁক করে গেল, কোনও কাজ হল না! তবে আপনারা পড়ালিখা জানা মানুষ, আপনারা যদি কোনও ব্যবস্থা করতে পারেন বড় উবগার হয় গো বাবু। বড় মেয়েটার এমনিতেই পাগল বলে বদনাম হয়ে গেছে, বাকি দুটো মেয়েকে যে কীভাবে পার করব…” বলতে বলতে আবার চোখ ভিজে উঠল তাঁর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করলেন, “বেশি না গো বাবু, ওই গেল মাসে যেদিন খুব বাজ পড়ল তার দিন দুয়েক পরের কথা। পরিষ্কার মনে আছে ওই অলুক্ষুণে দিনটা! সকালে আমি মুড়ি ভাজছিলাম উনুনে, বড় আর মেজো বই খুলে বসেছিল। ছোটটা শুয়ে-শুয়ে খেলা করছিল। যেই-না রোদ্দুর আকাশমণি গাছটার মাথা ছুঁয়েছে, অমনি বড়টা ফুড়ুৎ! ইশকুল বন্ধ থাকলে রোজই ওই সময়টায় পাড়া বেড়াতে বেরোয় বলে আমিও তেমন চোখ দিইনি। কিন্তু দুপুর হল, ভাত খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেল, তবুও মেয়েটা ফিরল না। আমাদের তো ভাত খাওয়া মাথায় উঠল! বাচ্চা দুটোকে দু-মুঠো খাওয়ালাম, উনি বেরালেন পারুলকে খুঁজতে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর সন্ধ্যাও গড়িয়ে গেল। পাড়ার কারও বাড়ি, কোনও বাগানের কোনা, কোনও পুকুর ঘাট উনি বাকি রাখেননি খুঁজতে। কিন্তু কোত্থাও নেই পারুল! পুলিশ ফাঁড়িতে যে একটা খবর দেব, তা সে তো পলাশডাঙা পেরিয়ে আরও কতদূর! সাইকেলে শুধু যেতেই এক ঘণ্টা লাগবে। কী আর করব, শেষে দল বেঁধে আশপাশের সবাই বেরালাম গোটা গ্রামে খোঁজ নিতে। শেষমেশ ওই রাজবাড়িতে গিয়ে কী দেখলাম জানেন? ওখানে গেলে দেখবেন এত্তো বড় পাখনা মেলে একটা পরি দাঁড়িয়ে আছে, তার পায়ের কাছটায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আমার পারুল!”
পরি! চমকে উঠলাম। তার মানে ওই লাল-সাদা ফুল-ফুল কাপড়টা কি পারুলের ফ্রকের টুকরো? “তারপর?” তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “তারপর কী হল?”
“তারপর তো মেয়ে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসলাম। মুখে জল ছিটাতে উঠে বসল বটে, কিন্তু তখন তার চোখ জবা ফুলের মতো লাল। কেমন পাগল-পাগল সে চোখ! ভোম মেরে বসে আছে, খালি মাঝে-মাঝে বলছে, ‘মা, শরীলে খুব বেদনা, হাড়ের মধ্যে কী যেন ফুটছে।’ কিন্তু তার পরের দিন থেকে কেমন যেন হয়ে গেল মেয়েটা আমার,” কান্নায় গলা বুজে এল পারুলের মা-র। “কত রকম অদ্ভুত আওয়াজ করে, কী সব বলে আপন মনে, কোনও দিন শুনিনি সে ভাষা। আর শরীরটা কেমন যেন… ক-দিন থেকে তো…” বলতে-বলতে প্রবল আতঙ্কের ছায়া পড়ল তাঁর মুখে, কথা শেষ করতে পারলেন না।
“ক-দিন থেকে কী? কী হয়েছে পারুলের?” আমি বলার আগেই উৎসুক গলায় বলে উঠেছে পিন্টু। কিন্তু ততক্ষণে একটা আশঙ্কার চোরা স্রোত ধীরে-ধীরে যেন জমিয়ে দিচ্ছিল আমার শরীরের সব রক্তকে। শরীরে ভীষণ বেদনা, হাড়ের ভিতর কী যেন ফুটছে… এসব কীসের লক্ষণ? একটু আগেই তো… আর ভাবতে পারলাম না, বাকি দু-জনকে চমকে দিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “পারুলকে একবার দেখা যায়?”
পলকে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল পারুলের মায়ের মুখ। খসখসে নিচু গলায় খুব গোপন কথা জানানোর মতো করে বলে উঠলেন, “যাননি গো বাবু! ক-দিন থেকে কেমন যেন করছে মেয়েটা! মেয়েটা আর মানুষ নাই গো! জিনে পেয়েছে! ওকে দেখে বাচ্চা দুটো তো ভয়েই সারা। পেছনের ঘরটায় বন্ধ করে রেখেছি। হপ্তা খানেক হয়ে গেল কোনও খাবার-জল কিচ্ছু খাচ্ছে না, খাবার পড়ে থেকে-থেকে পচে যাচ্ছে! তা সত্ত্বেও কেমন যেন দানোর মতো হয়ে উঠছে মেয়েটা, সেই থেকে ভয়ে আর ও-দরজা খুলিনি!”
“পারুলকে তো একবার দেখা দরকার! নাহলে ও সুস্থ হবে কেমন করে?” চমকে উঠলাম! এ যেন আমি নয়, আমার ভেতর থেকে অন্য কেউ বিকৃত লালা জড়ানো গলায় বলে উঠল। একটু দূরেই কলাপাতার ফাঁক দিয়ে একটা ছোট্ট খড়ের চালা দেখা যাচ্ছে, ওখানেই আছে পারুল। যে করেই হোক যেতে হবে ওখানে। মাথার চুলগুলো খামচে ধরলাম। এরকম পাগলামি কেন করছি আমি! কেন চলে যাচ্ছি নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে! পারুলের মা কী বুঝল কে জানে, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পেছন দিকে ইশারা করে ভয়ার্ত স্বরে বললেন, “ওর বাঁধন খুলবেন না গো বাবু!” ভীষণ উৎসাহে ততক্ষণে বাড়ির পেছন দিকে এগিয়ে গেছে পিন্টু, আমিও পা বাড়ালাম পেছন পেছন। খালি গায়ে ইজের পরা একটা বছর সাত আটেকের মেয়ে কোলে আর-এক খুদেকে নিয়ে এতক্ষণ ড্যাবড্যাব করে আমাদের দেখছিল, পেছন ঘরের দিকে এগোতেই ভীত-সন্ত্রস্ত মুখে মায়ের আড়ালে লুকোল।
মাটির ছোট্ট চালা ঘর। আগে ধান কেটে এনে রাখা হত বোধহয়, সামনেটায় খড়ের আঁটি ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। কাঠের দরজায় বাইরে থেকে খিল তোলা। আমার শরীরটা কেমন টলমল করছিল, চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক যেন কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছে। পিন্টু কি শুনতে পাচ্ছে না ঝিঁঝির ডাকটা? কোনওমতে অবশ শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলাম। পিন্টু আমার আগে-আগে বীরবিক্রমে এগিয়ে গিয়ে হুড়কোটা খুলল।
আর ঠিক সেই সময়ে ঘটল ঘটনাটা।
আঁ-আঁ-আঁ করে মর্মান্তিক আর্তনাদ করতে-করতে ছিটকে বেরিয়ে এল পিন্টু! তার চোখগুলো প্রায় উলটে এসেছে, সারা শরীরের রক্ত জমেছে মুখে! বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে-কাঁপতে ধপাস করে পড়ে গেল খড়ের গাদার ওপরে। কান প্রায় বুজে আসছিল ঝিঁঝির ডাকে, তার বিড়বিড়ানির শব্দ আমি ঠিক করে শুনতে পেলাম না। শুধু সব কিছু উপেক্ষা করে চুম্বকের মতো টলতে-টলতে এগিয়ে গেলাম খোলা দরজার সামনে। আর আমাকে দেখে আধ শোয়া অবস্থা থেকে দুই থাবা মেলে সোজা হয়ে বসল শেকলে বাঁধা একটা বীভৎস জন্তু।
জন্তুই বটে! হয়তো সে কোনওকালে ছিল পারুল নামে বছর বারোর এক নিষ্পাপ মেয়ে, কিন্তু আমার সামনে বসে থাকা সেই কদর্য জীব যেন এ জগতের নয়! যেন নরকের অতল গহ্বর থেকে জন্ম নেওয়া মূর্তিমান শয়তান! একটা মানব শরীরের পিঠের ওপর বসিয়ে দেওয়া মস্তবড় কুঁজ, উপুড় হয়ে থাকায় তার নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে সরু লিকলিকে দুটো হাত আর তার সঙ্গে বিশাল পাঞ্জা সহ মোটা-মোটা আঙুল! সাপের মতো কালচে খসখসে চামড়ায় ঢাকা শরীরটায় বিশাল বড় হাঁড়ির মতো একটা মাথা। সে মাথা মানুষের বলে বোঝা গেলেও প্রায় ঝুলে পড়া মোটা ঠোঁট, উঁচু হয়ে থাকা মাড়ির ভেতর প্রায় ঢুকে যাওয়া দাঁত আর পাতা বিহীন গোল-গোল রক্তজবার মতো দু-খানা চোখ যেন ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে দেখা কোনও কুৎসিত প্রাণীর মনে হয়! সেই ভীষণ মূর্তির সামনে আতঙ্কে আমার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না। শুধু পা দুটো যেন আস্তে-আস্তে গেঁথে যাচ্ছিল মাটিতে, মারাত্মক যন্ত্রণা ফালা-ফালা করে দিচ্ছিল তলপেট। তার মধ্যেই শুনতে পেলাম ওই ঝিঁঝিঁর ডাকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কাটা-কাটা ঝিনঝিনে সুরে আওয়াজ করতে শুরু করেছে ওই অদ্ভুত প্রাণীটা। উহ্! মাথার রক্ত ছলকে উঠল, দু-হাতে খামচে ধরলাম চুলগুলো। এতক্ষণে বুঝতে পারছি কেন ওই ঝিঁঝির ডাক শুনতে পাচ্ছে না আর কেউ। কারণ আশপাশে নয়, ঝিঁঝির ডাকটা আসছে স্বয়ং আমার মস্তিষ্ক থেকে। আকাশ পাতাল চিরে যেন নেমে আসছে শুধু ওই শব্দের স্রোত! একটানা ওই সুর ঘোলাটে করে দিচ্ছিল সব কিছু। আচ্ছন্ন চোখে দেখলাম চার পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে অতি সন্তর্পণে আমার দিকেই এগোনোর চেষ্টা করছে জন্তুটা। তার লালা-ঝরা থলথলে মুখগহ্বর থেকে ছিটকে আসা অর্থহীন চিঁ-চিঁ শব্দের মধ্যে হঠাৎ যেন তৈরি হতে শুরু করল একটা বিন্যাস। যেন আমার চেনা! খুব চেনা!
হ্যাঁ, পরিষ্কার শুনতে পেলাম সেই শব্দ।
“ব্রিখট্ এতেৎ
সোঙ্গ্ এতেৎ
লিট ব্রিখট্
ক্রেইস ব্রিখট্
ওডিয়াস ব্রিখট্!”
***
পায়ের নীচে এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমি। কোনওরকমে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। ভীষণ হালকা হয়ে গেছে শরীরটা, যেন ভেসে যাবে সামনের ওই অন্ধকার সমুদ্রে। কোথায় আমার হাত-পা-মাথা? শরীরটা যেন একটা আবছা ধোঁয়ার কুণ্ডলী, যার নেই কোনও আকার, আয়তন, বর্ণ। না, ঠিক ধোঁয়া নয়, ছায়া। আমার শরীরটা যেন হারিয়ে গেছে কোন অতল কালোয়, পড়ে আছে এই ছায়াটুকু! একটা জান্তব চিৎকার ছিটকে বেরোতে চাইছে ভেতর থেকে, কিন্তু বোবায় ধরেছে আমায়। সামনের ওই অনন্ত কালো মহাসাগর থেকে কারা যেন উঠে আসছে। ওরা কারা? রুক্ষ ধূসর এই পাথুরে উপত্যকায় দলবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসছে ওরা। ওরা না-কোনও জীব, না-জড়, না-প্রাণী, না-উদ্ভিদ। ওরা শুধু আকার-আয়তন-রূপ-রস-রঙ-গন্ধ বিহীন এক ছায়া। যেন অন্ধকার জগতের কৃষ্ণগহ্বর থেকে জন্ম ওদের। আমি কি ওদেরই একজন? অনন্ত মহাশূন্য থেকে সার বেঁধে ওরা যেন এগিয়ে আসছে আমারই দিকে। আর ওদের সঙ্গে সঙ্গেই একটু-একটু করে এগিয়ে আসছে বোবা মাইক্রোফোন-এর মতো একটানা তীক্ষ্ণ আওয়াজ। একটু-একটু করে আরও কাছে এগিয়ে আসছে ওরা, শব্দটাও বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। উফ! কী ভীষণ যন্ত্রণা! মাথার সব শিরাগুলো যেন ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে এবার। যেন সৃষ্টির আদি থেকে এভাবেই এগিয়ে চলেছে ওরা। এর কোনও শুরু নেই, শেষ নেই। শুধু আমার অস্তিত্বের ভেতর যেন কেটে বসে যাচ্ছে ওই ঝিমঝিমে আওয়াজটা, “ব্রিখট্ এতেৎ… সোঙ্গ্ এতেৎ… লিট ব্রিখট্… ক্রেইস ব্রিখট্… ওডিয়াস ব্রিখট্!”
উফ! ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে উঠে বসলাম। গা পুড়ে যাচ্ছে। বিছানার চাদরে হাত পড়তেই চমকে উঠলাম। গনগনে আগুনের মতো গরম! জ্বরটা আবার এল নাকি? কিছুক্ষণ ভোম্বল হয়ে বসে রইলাম। কোথায় আমি? এ কি আমার গড়িয়ার বাড়ি? আমার শোবার ঘর? না তো! খাটের পাশে টেবিলের ওপর রাখা ট্র্যাভেল ব্যাগটা দেখে এক ঝটকায় সব মনে পড়ে গেল। এ তো ধ্রুব-র জেঠুর বাড়ি, পলাশডাঙায়। কিন্তু ওই কালো সমুদ্র, ওই অন্ধকার জগত? নিজেকে ভালো করে দেখলাম। আশ্চর্য! হাত-পা তো সব ঠিকই আছে! কিন্তু একটু আগেই তো মনে হচ্ছিল আমার শরীরটাই নেই! তবে কি স্বপ্ন দেখছিলাম? কিন্তু এত পরিষ্কার স্বপ্ন? মনে হচ্ছে আমি নিজে ছিলাম সেখানে। সেই অবয়বহীন ছায়াদের ভীড়ে একজন হয়ে আমিও যেন মহাশূন্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সেই পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে। ওহ্! এসব কী ভাবছি আমি! মাথাটা বারকয়েক ঝাঁকালাম। ওই শব্দগুলো অচেনা, অথচ কী ভয়ংকর শক্তিশালী প্রভাব তার। যেন মাথার মধ্যে খোদাই হয়ে গেছে! পারুলদের বাড়ির পিছনের ওই চালা ঘরের দৃশ্যটা মনে পড়তে চারদিক থেকে যেন রাশি-রাশি প্রশ্ন ঘিরে ধরল আমাকে। ওই নারকীয় মূর্তিটা কি পারুলের? কিন্তু কীসের প্রভাবে এমন বীভৎসভাবে বিকৃত হয়ে গেছে ও? আমিই-বা কেন পারুলের কাছে যাওয়ার জন্য অত উতলা হচ্ছিলাম? ওকে তো আমি আগে কোনওদিন দেখিওনি। তা ছাড়া ওই শব্দটা, ওই অদ্ভুত অচেনা লাইনগুলোই-বা কেন আমার চেনা লাগছিল? ও অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ওই পরির পায়ের কাছে, আমিও পরিটার কাছে যাওয়ার পর থেকেই সব বিদঘুটে ব্যাপারগুলো শুরু হয়ে গেল… তবে কি ওই পরির ভেতরেই কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে? চৈতির ব্যাপারটাও কি এর সঙ্গে জড়িয়ে?
মাথার ভেতর সব তালগোল পাকিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কটকট করে ফিরে আসছে মাথার যন্ত্রণাটা। বুকের ওপর যেন পাথর হয়ে চেপে বসছে প্রশ্নগুলো। এই সমস্ত রহস্যময় তালার চাবি আছে একমাত্র একজনের কাছেই। আর সে হল পারুল। আমার ষষ্ঠেন্দ্রীয় বলছে প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর আমি তার কাছেই পাব। আবার আমাকে মুখোমুখি হতে হবে পারুলের। কিন্তু কীভাবে? জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। যত দূর চোখ যায়, নানা শেডের শুধু সবুজ আর সবুজ! আকাশ ছোঁয়া ধানক্ষেত, দূরের গাঢ় সবুজ জঙ্গল, কচি কলাপাতার নরম সবুজ রং যেন চোখ ধুইয়ে দিচ্ছে। আহ্! কী আরাম! মাথার মধ্যে জমাট বাঁধতে থাকা গুমোট অন্ধকার থেকে রেহাই পাওয়ার এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে? সমস্ত প্রশ্নের ভীড় সরিয়ে রেখে মন দিলাম বাইরের প্রকৃতির দিকে। বুকের ভেতরটা শান্ত হয়ে আসছে ধীরে-ধীরে, সবুজ পরিবেশটা যেন শরীরের ভেতর অব্দি জুড়িয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে এক ছুটে চলে যাই ওই সবুজ মাঠের কোলে। কিন্তু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হঠাৎ শরীরের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি হতে শুরু করল। এরকম তো আগে কোনওদিন হয়নি! ওই বাইরের প্রকৃতি, ওই গাঢ় সবুজ রঙ যেন টানছে আমাকে! না, এ যেন শুধুমাত্র প্রকৃতির শোভা নয়, আরও অন্য কিছু আছে, একদম অন্য রকম কিছু। অনেকক্ষণ থেকে একটা ঝিনঝিনে ভাব অনুভূত হচ্ছিল, এবার ধীরে-ধীরে সেটা বাড়তে বাড়তে পুরো মাথায় জুড়ে বসল। আবার সেই ঝিঁঝির ডাক! আমার রক্তের মধ্যে দিয়ে যেন হাইভোল্টেজ কারেন্ট খেলে গেল। চারদিকের এত রঙ পাগল করে দিচ্ছে আমায়। আমিও কি পারুলের মতো পাগল হয়ে যাচ্ছি? বুভুক্ষুর মতো দুর্বল শরীরে কোনওমতে টলতে-টলতে গিয়ে জানালার শিক ধরে দাঁড়ালাম, লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম সবুজ পরিবেশের দিকে। আমার মাথার ভেতরে ঝিঁঝিগুলো কী যেন বলার চেষ্টা করছে। শুনতে হবে ওদের কথাগুলো।
“ও, তুমি উঠে পড়েছো?” একটা গলা খাঁকরানির সঙ্গে কথাটা ভেসে এল। চমকে পেছনে ঘুরলাম। আনন্দদা, ধ্রুব-র জেঠতুতো দাদা এসে দাঁড়িয়েছেন দরজায়। মৃদু হেসে ঘরে ঢুকলেন, “বাব্বাহ্, যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! দেমুন্ডা থেকে যখন ওরা তোমাকে আর পিন্টুকে দিয়ে গেল, তখন তো দু-জনেই অজ্ঞান। তোমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল, মাঝে একবার জ্ঞান ফিরলেও আবার বেহুঁশের মতো ঘুমিয়ে পড়লে। পিন্টুকেও ওর ঘরে দিয়ে এলাম। ওই দিনু মন্ডল লোকটাও কেমন যেন কিছু না বলে একরকম পালিয়েই গেল। কী ব্যাপার বলো তো? কী হয়েছিল?”
প্রমাদ গনলাম। পারুলকে ওই অবস্থায় দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছিল পিন্টু। যত দূর আবছা মনে পড়ে কোনওমতে ওই ঘরের শিকল তুলে দিয়েছিলাম আমি, কিন্তু আর ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে। জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। এরপর যখন মুখে জলের ঝাপটা পড়ায় জ্ঞান হয়, তখন আমি একটা মাটির ঘরে, মাথার ওপর টালির চাল। তারপর আর কিছু মনে নেই। জানি না পিন্টু কেমন আছে, নিজেকে সামলাতে পেরেছে কি না। কিন্তু এখন আনন্দদা-র কাছে সত্যিটা কোনওভাবেই ফাঁস করা যাবে না। আচ্ছা, পারুলের মা-বাবা কি দেখেছে ওর ওই অবস্থা? “এখানে তোমাকে শুইয়ে তো ডাক্তারবাবুকে একটা কল দিলাম,” আবার বলতে শুরু করেছেন আনন্দদা, “ডাক্তারবাবু এসে জ্বরের ওষুধ দিলেন বটে, কিন্তু তখনও তুমি ঘুমের মধ্যে ‘দরজা খুলো না! খেয়ে ফেলবে, সব খেয়ে ফেলবে! অন্ধকার ছায়া…’ এইসব বিড়বিড় করছিলে।”
“না না তেমন কিছু নয়,” নিজের বুকের ভেতর ধড়াস-ধড়াস শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম, তাও জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, “আরে ওগুলো সিরিয়াসলি নেবেন না। আসার আগে থেকেই জ্বর ছিল বলেছিলাম না? তারপর দিন কয়েক আগে একটা বিদেশী ভূতের সিনেমা দেখেছিলাম, জ্বরের ঘোরে ওটাই হয়তো প্রলাপ বলছিলাম আরকী! চিন্তা করবেন না দাদা, আমি একদম ঠিক আছি। পিন্টুরও একটু শরীরটা খারাপ হয়েছিল ওখানে গিয়ে, তবে মনে হয় তেমন কিছু নয়।”
আনন্দদা কী বুঝলেন কে জানে, চিন্তিত মুখে বললেন, “হুমম্।” আর তারপরেই একটু কাঁচুমাচু হয়ে গেল তাঁর মুখ। হাত কচলাতে-কচলাতে ইতস্তত করে বললেন, “ভাই বিতংস, তুমি কি তা হলে এখন কিছুটা সুস্থ? আসলে তোমাকে একটা কথা বলার জন্যই আসা। বড় বিপদ হয়েছে ভাই! বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু পরিস্থিতিটা এমনই…”
“আরে বলুন না! কী হয়েছে?” অভয় দিলাম।
“আমাদের এক ঠাকুরদা, বাবার জেঠুর হন, অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। অনেক দিন ধরেই ভুগছেন, পুরোপুরি বিছানা শয্যায়। গতকাল একটা ছোটখাটো স্ট্রোক হয়ে গেছে। অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে, ডাক্তার বলছেন হাতে সময় বিশেষ নেই। এখন অন্তিম মুহূর্তে আমাদের সবাইকে দেখতে চেয়েছেন, বারবার নাম করছেন। তো আমাদের সবাইকে আজই কৃষ্ণনগর যেতে হবে… তোমাকে এভাবে একা ফেলে, আমার যে কী খারাপ লাগছে…” মাথা নিচু করে অস্বস্তি ভরা গলায় বললেন আনন্দদা।
“ও এই ব্যাপার!” অল্প হেসে আশ্বাস দিলাম, “আপনি এত দ্বিধা করছেন কেন আনন্দদা? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পড়ুন! আমাকে নিয়ে ভাববেন না, আমি দিব্যি ম্যানেজ করে নেব।”
“না না, তোমাকে একেবারে একা ফাঁকা বাড়িতে ফেলে চলে যাব নাকি!” তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন আনন্দদা, “লক্ষ্মীদি থাকবে, তোমার খাওয়াদাওয়ার সব ব্যবস্থা ওই-ই করবে। এছাড়া বিশুকাকাও থাকছে, তোমার যে কোনও দরকার হলে বলবে। কেমন?”
“আমি একাও থেকে যেতে পারতাম, আপনি শুধু শুধু ব্যস্ত হলেন। যা-ই হোক, আপনারা দেরি করবেন না, বেরিয়ে পড়ুন… চিন্তার কোনও কারণ নেই।”
এতক্ষণে সামান্য হাসি ফুটল আনন্দদা-র মুখে। স্মিত মুখে বললেন, “তোমার যতদিন-না কাজ শেষ হয় নিশ্চিন্তে থেকো এখানে। কী খেতে চাও লক্ষ্মীদিকে বলে দিও, ও বিশু কাকাকে দিয়ে আনিয়ে নেবে বাজার থেকে। ওষুধগুলো ঠিকঠাক খেয়ো ভাই, সাবধানে থেকো। আমি টেলিফোন করে খোঁজ নেব।”
ডাক্তারের ওষুধে কি আর আমি ভালো হব? কী ভয়ংকর রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে জানি না। আচ্ছা, আমিও কি ধীরে-ধীরে পারুলের মতো ওইরকম একটা কদাকার জন্তু হয়ে যাব? বুকের ভেতর গলতে থাকা আতঙ্কের চোরাস্রোতটা চাপা দিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানালাম আনন্দদা-কে। শরীর আর টানছে না, বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে-থেকে কোমর থেকে নীচের দিকটা যেন ভারী হয়ে উঠছে। জানালা ছেড়ে ধীরে-ধীরে খাটে এসে বসলাম। আর-একটু ঘুমের দরকার, চোখের পাতাগুলো যেন জুড়ে আসছে। অনেকক্ষণ থেকে বাম হাতের চেটোটায় কী যেন সুড়সুড় করছিল। হাতের পাতাটা চোখের সামনে মেলতেই কয়েক হাজার ভোল্টের কারেন্ট যেন এক ঝটকায় আমাকে ছুড়ে ফেলে দিল খাট থেকে!
এ কীসের হাত? আমার চোখ দু-খানা যেন ঠিকরে আসতে চাইছিল! থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকলাম নিজের বাম হাতের দিকে! আশঙ্কাটা তা হলে সত্যি হল?
***
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি হবে। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, এখন অবশ্য আবার চাঁদ উঁকি মেরেছে মেঘের পেছন থেকে। ঠান্ডা ভেজা-হাওয়া পাক খাচ্ছে গ্রাম জুড়ে। তারই আমেজে গভীর ঘুমে ডুবে মন্ডলপাড়া। পাড়ার কুকুরগুলোও চালাঘরের আশ্রয়ে ঘুমিয়ে কাদা, তাই তারা দেখতে পেল না চাঁদের আলোতে কালো চাদরে শরীর ঢেকে পা টেনে-টেনে কোনওমতে পোড়ো জমিটা পার হচ্ছে একটা ছায়ামূর্তি। সেই সন্ধে থেকে দেমুন্ডা পৌঁছেছি, তারপর কিছুক্ষণ চা দোকানে, কিছুক্ষণ গাড়িতে শুয়ে কাটল। এক ঘণ্টার পথ প্রায় তিন ঘণ্টায় পৌঁছেছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পা দুটো যেন অসাড় হয়ে আসছে, ঘোলাটে লাগছে সব কিছু। হাতের যন্ত্রণা তো আছেই। এই শরীর নিয়ে এর থেকে বেশি জোরে গাড়ি চালানো যায় না। আজ আমি একেবারে একা। পিন্টুর যে সর্বনাশ করেছি, তারপরে অন্য কাউকে সঙ্গে নেওয়ার মতো ভুল কি আর দ্বিতীয়বার করি?
জীবনটা যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। জানি না, কী সেই নারকীয় অসুখ, কিন্তু তার ফল ফলতে শুরু করে দিয়েছে শরীরে। যদিও খুবই ধীরে-ধীরে হচ্ছে পরিবর্তনটা, তবুও বুঝতে পারছি আমি। আর নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবার মতো চিন্তাশক্তি নেই আমার। যে আদিম আতঙ্ক গেড়ে বসেছে বুকের মধ্যে, তার সঙ্গে যুঝতে যাওয়ার ক্ষমতাও নেই। হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও পরিণত হব কোনও কদাকার বিকৃত জীবে, কিন্তু একটু-একটু করে অন্ধকার জগতে তলিয়ে যাওয়ার আগে আমার ভেতর অবশিষ্ট থাকা মানুষটা যেন শেষবারের মতো প্রাণপনে চেষ্টা করছে মাথা তোলার। চিৎকার করে বলছে, “এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না! কিছু একটা করতে হবে! বাঁচতে হবে!” সেই তাড়না থেকেই আজ সকালে দুর্বল শরীর সত্ত্বেও গিয়েছিলাম পিন্টুদের বাড়ি। গতকাল ফেরার পর থেকেই নাকি নাওয়াখাওয়া-কথা বলা একদম বন্ধ করে দিয়েছিল, আজ সকাল থেকে শুরু হয়েছে ভুল বকা, কখনও খলখল করে হেসে গড়াগড়ি খাওয়া, কখনও-বা আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে খাটের নীচে লুকোনো। পিন্টুর চোখে যে বদ্ধ উন্মাদের ছায়া দেখেছি তা সারা জীবন তার পেছন ছাড়বে কি না কে জানে! কোনওমতে পালিয়ে এসেছি কাঁদতে থাকা ওর মায়ের সামনে থেকে। আর তার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেমুন্ডা আসার। চৈতি চলে গেছে, হয়তো আমি আর পারুলও থাকব না… কিন্তু এই বীভৎস ব্যাধির শিকার যাতে আর কেউ না হয় তার ব্যবস্থা করতেই হবে আমাকে! আর তার জন্য পৌঁছতে হবে পারুলের কাছে। লক্ষ্মীদি আর বিশুকাকাকে দু-দিনের জন্য ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম, কাজের জন্য দেমুন্ডা যেতে হবে এই বলে। এত বড় সুযোগটা ছাড়া যাবে না। আর তারপর মনের জোরে নিজেই বেরিয়ে পড়েছি পিন্টুর গাড়িটা নিয়ে। পুরো রাস্তায় আসতে-আসতে ভেবেছি পারুলকে কি আর কেউ দেখেছে? ওর মা-বাবা? পিন্টুর মতো হতভাগ্য অবস্থা কি তাদেরও হয়েছে? তবে বিকেলে মন্ডলপাড়ায় ঢুকে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। চাদরমুড়ি দিয়ে এক কোণে বসে চা খাচ্ছিলাম, কিছু টুকরোটাকরা কথা ভেসে এল কানে। কলকাতার বাবুরা অমন অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে ভয়ে পারুলের মা-বাবা আর ওই দরজা খোলার সাহস পায়নি, মন্দিরের পুরোহিতমশাইকে ডেকে পুজো করিয়ে বাঁধন দিয়েছে দরজায়। গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছে দু-চার দিনের মধ্যেই ওকে নদী পেরিয়ে ওই গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসা হবে। পারুলের মা খুব কান্নাকাটি করছে, তাই নেহাত প্রাণে মারা হবে না, নাহলে আপদের শেষ রাখত না গ্রামবাসীরা। মনে-মনে শিউরে উঠেছিলাম! তখনই বুঝেছিলাম হাতে সময় বলতে আজকের রাতটাই, তাতেই যা করার করতে হবে। কারণ আমি জানি না আমার নিজের হাতেও আর কতটুকু সময় আছে।
পায়ে-পায়ে এসে দাঁড়ালাম সেই কুঁড়েঘরের পিছনে। পূর্ণিমা কাছেই, চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। মাঝরাতের নিস্তব্ধতা যেন ঘন কুয়াশার মতো চেপে বসে আছে গোটা এলাকার ওপর। সেই শব্দহীনতার মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে ভেসে আসছে ঝিঁঝির ডাক। অবশ্য তা আমারই মাথার ভেতর থেকে হয়তো। আগের দিনই দেখেছিলাম দিনু মন্ডলের বাড়ির পেছন দিকে একটা ছোট মাঠ, তারপরই পাকা রাস্তা। রাত গভীর হতে গাড়িটা এনে দাঁড় করিয়েছি ওই রাস্তার ওপরে। চালাঘরটার ভেতর থেকেও কোনও আওয়াজ নেই, সব চুপচাপ। আচ্ছা, পারুল কি বুঝতে পারবে যে আমি ওকে নিতে এসেছি? সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে ঘুরে বাড়ির সামনের দিকটায় চলে এলাম। দরজায় তেল-সিঁদুর লেপে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা, কড়া দুটো নানারকম মাদুলি ও জবা ফুল সহ দড়ি দিয়ে বাঁধা। পারুলের ছবিটা মনে আসতেই পেটটা কেমন গুলিয়ে উঠল। আবার দাঁড়াতে হবে ওর সামনে! কিন্তু যদি আক্রমণ করে ও? অদ্ভুত এক দোটানা কাজ করছে আমার ভেতরে। মস্তিষ্কের এক অংশ বলছে এক্ষুনি এই জায়গা ছেড়ে পালিয়ে যেতে, অন্যদিকে অন্য অংশ যেন এক অসীম আকর্ষণে টেনে নিয়ে চলেছে ওই দরজার দিকে! মোহগ্রস্ত মানুষের মতো শেষমেশ দড়িদড়া ছিঁড়ে খুলে ফেললাম দরজাটা।
যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিল সে। মাথা তুলে উঠে বসল সেই মূর্তি। আশ্চর্য! এমনিতে ঝাপসা দেখলেও এই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আরও বীভৎস হয়েছে পারুল। শুধু মাথায় নয়, সারা শরীর জুড়ে বেড়েছে লোমের আধিক্য। মাথার ভেতরটা যেন ঝমঝম করে উঠল। এই কদাকার প্রাণী কি সত্যিই আমাকে কোনও সাহায্য করতে পারবে? নাকি নিজের শত্রু বলে ভাববে? ঝিঁঝিগুলো যেন গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করেছে, অবশ হয়ে আসছে আমার একের পর এক ইন্দ্রিয়। দরজা খোলা অবস্থাতেই কয়েক পা পিছিয়ে এলাম। এ দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। সামনের দুই হাতে ভর করে আগুনের ডেলার মতো চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক বীভৎস জন্তু, চাপা ফোঁসফোসানির তালে-তালে যেন মেপে নিতে চাইছে আমার মতলবখানা। কী অনন্ত সেই অপেক্ষা! বুকের ভেতরের হাতুড়িটা যেন স্পষ্ট অনুভব করছিলাম। এক প্রবল আতঙ্ক পেছন থেকে টানছিল আমাকে। সম্মোহিতের মতোই ওই জ্বলন্ত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে পেছোতে-পেছোতে নেমে এসেছি রাস্তায়, এমন সময় একটা ভোঁতা ধাতব শব্দে যেন আমার চটকা ভাঙল।
ঘরর ঘরর…
যেন কোনও ভারী শাবল কেউ টেনে নিয়ে চলেছে মাটির ওপর দিয়ে। ঘুম-ভাঙা মানুষের মতো চমকে দেখলাম, ঘর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে-আস্তে বেরিয়ে আসছে সেই চতুষ্পদ। তার শরীরে বাঁধা লোহার শেকল ঝঙ্কার তুলতে-তুলতে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে রাতের জমাট-বাঁধা নিস্তব্ধতায়।
কিছু পরে চাঁদের আলোয় মাঠ পেরিয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলল এক মনুষ্য অবয়ব, আর তার পেছন-পেছন চলল এক দু-পেয়ে অথবা চারপেয়ে জীব।
***
“ওডিয়াসের সন্তানদের দেশে স্বাগত! অন্ধকার জগতে স্বাগত!”
চমকে উঠলাম। গাড়ি সবে দেমুন্ডা ছাড়িয়েছে। পারুল আমার পেছন-পেছন প্রায় বুকে হেঁটে বড় রাস্তা অব্দি আসতেই চট করে গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে দিয়েছিলাম। তাতে কী বুঝেছে কে জানে, গুঁড়ি মেরে পেছনের সিটে চড়ে বসল। তার ওই বিশাল বপুর পক্ষে গাড়ির ভেতরের জায়গা নিতান্তই কম, কোনওমতে ঘাড়ে-গর্দানে অবস্থায় বসেছে বুঝতে পারছিলাম। লুকিং গ্লাস দিয়ে তার ভাঁটার মতো দুই চোখে সন্দেহের ছায়া দেখতে পেলেও এও বুঝতে পারছিলাম, আমাকে আক্রমণ করবে না সে। হয়তো এখনও তার মধ্যে স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব বোধের কিছু অংশ বাকি রয়ে গেছে, আমার মতো সেও পরিত্রাণ খুঁজছে এই অবস্থা থেকে। কিন্তু হঠাৎ করে এই কথাগুলো বলল কে? গাড়ির গতি সামান্য কমিয়ে লুকিং গ্লাস দিয়ে পারুলের দিকে তাকালাম। গম্ভীর মুখে বসে আছে। ওইই কি বলল কথাটা? দু-তিন সেকেন্ডের ব্যবধান, আর তারপরেই…
“ওডিয়াসের সন্তানদের দেশে স্বাগত! অন্ধকার জগতে স্বাগত!”
আবার! কোথা থেকে যেন তীক্ষ্ণ স্বরে একসঙ্গে ডেকে উঠল কয়েক লক্ষ-কোটি ঝিঁঝিপোকা! একটা বড় বাঁকের মুখে এসে কোনওমতে ব্রেক কষে সামলালাম গাড়িটা। ওডিয়াসের সন্তান! কে ওডিয়াসের সন্তান? এ কার গলা? এ কি সত্যিই কারও গলা, নাকি আমার মনের ভুল? সত্যিই কি লাখো-লাখো ঝিঁঝিপোকা ডাকছে আমাকে ঘিরে ধরে? বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষের মতো বসে রইলাম গাড়ির ভেতর। কোনও অদৃশ্য শক্তি যেন চটচটে আঠালো সুতোয় পরতে-পরতে জড়িয়ে ফেলছিল আমার হাত-পা। একটা ভোঁতা অনুভূতিতে আস্তে-আস্তে ফাঁকা হয়ে আসছিল মাথার ভেতরটা। এই রাস্তা, রাস্তার দু-পাশে গাছপালা, পেছনের কুঁজওলা প্রাণীটি, ওই খানিক দূরের ধানক্ষেত… সব নরম মোমের মতো গলে গিয়ে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। মুছে যাচ্ছিল যত পুরোনো স্মৃতি, এতদিনের অর্জিত জ্ঞান, আমার পুরো অস্তিত্বটাই। তার জায়গায় যেন ঠিক স্লেটের ওপর খড়ি দিয়ে লেখা হচ্ছিল কিছু কথা।
অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। না, বোধহয় খুব বেশি গাঢ় নয়। কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি যেন মহাশূন্যে ভাসমান অবস্থায় আমার দিকে এগিয়ে আসছে একটা ছায়াময় অবয়ব, যা এই অন্ধকারের চেয়েও নিকষ কালো। এ যে সেই স্বপ্নে দেখা মৃতপ্রায় ঊষর প্রান্তর… সেই কায়াহীন বস্তুদের ভীড়! ধীরে-ধীরে আমার একদম কাছে এসে দাঁড়াল সেই ছায়া। না, চোখ-নাক-মুখ বলতে যা বোঝায় তা কিছুই নেই তার, কিন্তু আমার সামনে এসে দাঁড়ানোমাত্র কোনও এক অদৃশ্য শয়তানের নির্দেশে অজস্র ঝিঁঝিঁ পোকা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল… “ব্রিখট্ এতেৎ… সোঙ্গ্ এতেৎ… লিট ব্রিখট্… ক্রেইস ব্রিখট্… ওডিয়াস ব্রিখট্!” উফ! মাথার ভেতরটা টাটিয়ে উঠল! কী এই মন্ত্র যা আমার মাথার ভেতর ঢুকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে সবকিছু? সামনের এই আবছা ধোঁয়াটে বস্তুটিই বা কী? চারদিকের ছায়াগুলো আরও ঘন হয়ে আসছে, যেন মাকড়সার একটা কালো জাল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে আমায়। একটু দূরের কালো মরণকুয়ার মতো গর্তগুলো থেকে কিলবিল করে উঠে আসছে আরও অগুনতি ছায়া। তাদের মুখে ধ্বনিত হচ্ছে সেই অদ্ভুত মন্ত্রটা। একদম কাছে এসে ছায়াগুলো হঠাৎ একে-একে গলে যেতে লাগল, আর গলে যাওয়া সেই থকথকে কালো আলকাতরার মতো তরল যেন গলগল করে ঢুকে যেতে লাগল আমার চোখ-কান-নাক-মুখ দিয়ে! আতঙ্কের শেষ সীমায় পৌঁছে একটা আর্তনাদ উঠে আসতে চাইছিল বুকের ভেতর থেকে, কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বিকল হয়ে গেল আমার স্বরযন্ত্র। শুধু এক বোবা আতঙ্কে গোঙাতে লাগলাম! আর একই সঙ্গে অনুভব করলাম এখন যেন একটু-একটু করে আমি বুঝতে পারছি তাদের সেই সুর করে গাওয়া ছড়াটার মানে…
“সকল রঙ মুছে যাক
সকল অস্তিত্ব মুছে যাক
জেগে উঠুক অন্ধকার জগৎ
জেগে উঠুক ছায়াদের জগৎ
জেগে উঠুক ওডিয়াসের জগৎ!”
এই প্রত্যেকটা শব্দ ধীরে-ধীরে এক অসীম খিদের জন্ম দিচ্ছিল আমার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। এই মরণ সঙ্গীতই আমাকে শেখাচ্ছিল জীবনের মূলমন্ত্র। রাতের ঘন কালো প্রেক্ষাপটে ছড়িয়ে থাকা গ্রাম্য প্রকৃতি এতক্ষণে যেন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছিল আমার কাছে। আজন্ম উপোসী আমি শরীরের ভেতরে লুকোনো আর-এক জোড়া চোখ দিয়ে লোভী রাক্ষসের মতো দেখতে থাকলাম রঙ ঝলমলে সেই সৌন্দর্য। গাঢ় সবুজ রঙের ঝাঁকড়া গাছ, কচি কলাপাতার নরম রঙ, লালচে খয়েরি টালির চাল, একটু দূরেই চোখ-জুড়ানো নীল অপরাজিতার লতা, ঘন কমলা রঙ মেখে ক্ষেতে শুয়ে থাকা কুমড়ো… এই রঙের উৎসব যেন উন্মত্ত করে দিচ্ছিল আমাকে, জাগিয়ে তুলছিল এক অদ্ভুত প্রাণরস শোষণের ইচ্ছে! লুকিং গ্লাসে দেখতে পাচ্ছিলাম ঘন কালো রঙের মণি ধীরে-ধীরে জুড়ে বসছে আমার সমগ্র চোখ, কালশিটে ফুটে উঠছে পাতলা রক্তহীন চামড়ার তলা দিয়ে।
আর জেগে উঠছে আমার হাত।
হ্যাঁ।
পরিকে ছোঁওয়ার মুহূর্ত থেকে বাম হাতের পাতায় তৈরি হওয়া সেই দগদগে কালো ক্ষত, লতানে সাপের মতো পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া কালো আঙুলগুলো… যা দেখে সকালবেলায় চমকে উঠেছিলাম, সেগুলোই জীবন্ত হয়ে উঠেছে যেন খুব স্বাভাবিকভাবে। সরু হিলহিলে আঙুলগুলো যেন আগ্রাসী সরীসৃপের মতো জানালায় রাখা আমার হাত ছাড়িয়ে মিশে যেতে চাইছিল বাইরের রঙিন জগতে। শুষে নিতে হবে! এ জগতের সমস্ত উজ্জ্বল বর্ণ শুষে নিয়ে পরিপূর্ণ করতে হবে নিজেকে! এক বিকৃত লালাঝরানো হাসি ফুটে উঠছিল আমার কুচকুচে কালো ঠোঁটে। কারণ আমি বুঝতে পারছি আমার পেছনের সিটে নড়াচড়া করতে শুরু করেছে জানোয়ারটা। ও-ও অনুভব করছে, ঠিক আমার মতোই! লাল-নীল-হলুদের এই ধ্যাবড়ানো জলছবি তখন আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে, তার মধ্যেই বুঝতে পারলাম ধীরে-ধীরে খুলে যাচ্ছে গাড়ির পেছনের দরজা… সড়সড় করে নেমে যাচ্ছে একটা কালো অন্ধকারময় জীব।
কড়-কড়-কড়াৎ!
প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ল দূরে কোথাও। জলে ডুবে যাওয়া মানুষের মতো যেন ভুস করে ভেসে উঠলাম কোনও এক অতল জগত থেকে। কোথায় ছিলাম আমি! বেভুল চোখে চারদিকে তাকালাম। নিঝুম গ্রাম ঘুমিয়ে আছে আগের মতোই, কোত্থাও কিচ্ছু নেই। শুধু কুচকুচে কালো মেঘের দল ঘিরে ফেলেছে আকাশটা, তাদের বুক চিরে উঁকি দিচ্ছে রুপোলি ঝলকানি। একটা কনকনে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। একটু আগে যা দেখলাম তা কি স্বপ্ন ছিল? গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? আর সেই অনুভূতি? যেন আমি নয়, অন্য কেউ চালনা করছিল আমার সত্ত্বাকে! বাম হাতের ক্ষতটার দিকে তাকালাম। আঙুলগুলো ঝলসানো হাড়বিহীন কিছু সরু-সরু মাংসখন্ড লেপটে আছে তালুর সঙ্গে। শুধু তা-ই নয়, লম্বায় যেন বড়ও হয়েছে খানিকটা। চাপা আর্তনাদ ছিটকে এল আমার মুখ দিয়ে। তা হলে আমিও কি পারুলের মতো হয়ে যাচ্ছি? একে-একে এইভাবে দুমড়ে মুচড়ে যাবে আমার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ? এমন জীবনের থেকে তো মরে যাওয়া ভালো! আর পারুল? ও কোথায় গেল? পেছনের সিটটা ফাঁকা। ডান হাতে টর্চ নিয়ে অতিকষ্টে নামলাম গাড়ি থেকে। একটা বড় মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছি, ডানদিক দিয়ে একটা পায়ে চলা মেঠো পথ চলে গেছে দেমুন্ডার দিকে। আশপাশে তাকালাম। কোথাও পারুলের অত বড় শরীরটার কোনও চিহ্ন নেই। এই রাস্তা দিয়েই কি গেছে পারুল? টর্চের আলো ফেললাম কাঁচা রাস্তাটার ওপরে। জলকাদায় মাখামাখি হয়ে আছে, তবে তার মধ্যেও যেন বোঝা যায় ভারী থাবার ছাপ। ওই তো দেখা যাচ্ছে চারটে দাগ! খানিকটা এগোলাম। এই রাস্তাতেই চার হাতে-পায়ে ভর করে এগিয়ে গেছে পারুল, বহু দূর পর্যন্ত তার চলার ছাপ। কিন্তু কিছুটা গিয়ে যেন আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল!
দাগের সংখ্যা বেড়েছে। চারটে নয়, আটটা দাগ এগিয়েছে এক সঙ্গে। আর তারও কিছুটা দূরে…
থরথর করে কাঁপতে থাকা হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল ঝোপের ওপর।
***
ওই তো দেখা যাচ্ছে! রাতের নিকষ অন্ধকার যেন চুঁইয়ে পড়ছে তার বিশাল বপু থেকে, পূর্ণিমার স্নিগ্ধ ছটাও যেন পুরোপুরি আলোকিত করতে পারেনি তাকে। ধীরে-ধীরে গাড়িটা এনে দাঁড় করালাম সেই অভিশপ্ত রাজপ্রাসাদের সামনে। কোনও বীভৎস দানবের কুচকুচে কালো লোমশ হাতের মতো দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ছোঁয়া গাছগুলো, আর চাঁদের জোছনায় তার ফাঁক দিয়ে অল্পস্বল্প ফুটে উঠছে সেই মৃত্যুপুরীর অবয়ব। ঠিক যেন কোনও মানুষখেকো কালো আলখাল্লার ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে তার শিকারের দিকে! আমি অবশ্য মন্ত্রপূত পুতুলের মতো টলতে-টলতে এগোচ্ছিলাম আমার শেষ ঠিকানার দিকে। মাথায় বাসা বাঁধা নরকের পোকারা প্রতি মুহূর্তে আমাকে আবার এগিয়ে নিয়ে চলেছে সেই স্টিয়ারিং ধরার পর থেকেই। কাঁচা মাটির ছাপ বলছে পারুলও এসেছে এখানেই। কিন্তু ওর কোনওরকম উপস্থিতি টের পাচ্ছি না। শুধু একটাই আকর্ষণ অনুভব করতে পারছি। ওই পরি। এক অমোঘ নিয়তি আমাকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে চলেছে ওই পাথুরে বস্তুটার দিকে, যেন ওখানেই আছে আমার মুক্তির দ্বার। আমার সঙ্গ দিচ্ছে এই মুহূর্তে জ্যান্ত হয়ে ওঠা আঙুলগুলো, ধমনীর মধ্যে নাচতে থাকা কালো রক্তকণার দল। আর আমার মাথার মধ্যে হয়ে চলেছে একের-পর-এক সশব্দ বিস্ফোরণ, “ব্রিখট্ এতেৎ… সোঙ্গ্ এতেৎ…” লক্ষ লক্ষ ঝিঁঝিপোকা বিরামহীনভাবে পড়ে চলেছে সেই অপার্থিব মন্ত্র, আর পরির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাদের উপস্থিতি! আমি এগিয়ে চলেছি অনন্ত কাল… শুধু সেই প্রবল কলরবের মধ্যে থেকে খুব অস্পষ্টভাবে যেন ভেসে আসছে একটা গলা। একটা চেনা গলা। কিন্তু প্রবল মন্ত্রোচ্চারণের তোড়ে তলিয়ে যাচ্ছে সে গলা, আর আমি এগিয়ে চলেছি আমার লক্ষ্যের দিকে। এমন সময় একটা উঁচু পাথরে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ল আমার দুর্বল শরীরটা। আর সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ করে যেন সামনে থেকে সরে গেল একটা পর্দা। একটা খুব চেনা, খুব আদরের দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের পাতায়।
“তুমি সেদিন ওটা কী করে দিলে গো ঝুরিদিদা?”
“ওই একটা দস্যি মতো ভয় তোর কচি শরীল দেখে ঢুকে পড়েছিল, ওটাকেই তাড়ালুম আরকী!”
“ভয়! ভয় কী করে ঢুকে পড়েছিল? কই আমি ভয় পেলাম না তো!”
“ও মা, কী বলে গো ছেলে! তুই তারে দেখলি কই, বুজলি কই যে ভয় পাবি? আসলে তুই এই ছোট্টটি কিনা! তবে আর কিছু দিন থাকলে তোরে বশ করি নিত।”
“বশ করে নিত! ধুস। যে ভয়কে দেখা যায় না, বোঝা যায় না, সে আমাকে বশ করে নেবে তাও আবার হয় নাকি!”
“হয় লো হয়! শোন বুতু, আসলে ‘হয় না’ বলে কিছু হয় না!” মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঝুরিদিদা বলেছিল, “এই মনের জানলাখানা সবসময় খুলে রাকবি, কক্ষনো আগল দিবিনেকো। বুজলি? মনে রাকবি, আমাদের এই চেনাজানা পিথিবিটার বাইরেও আরও অনেক পিথিবি আচে। সাধারণ মনিষ্যির দেখা ভয়ের থেকেও অনেক বড়-বড় ভয় থাকে সেখেনে। আমরা ভয়ের কতটুকুই বা জানি, বল? সেসব দেকার চোক সবার থাকেনিকো। তাদের অবিশ্যি না দেকাই ভালো। কিন্তু যদি কোনওদিন তাদের দেখা পাস, তারা আসে তোর অনিষ্টি করতে, তখন কিন্তু ভয় পাসনি একফোঁটাও! ভয়কে জয় করার মন্তর আমি ভরে দিয়েছি তোর মদ্যে, তোর বুকের ভিতরটা এখন একদম ধুইয়ে-নিকিয়ে শুদ্দ হই গ্যাছে। কেউ কিচ্ছু করতে পারবেনি তোর! আমি জানি, তেমন ভয় সামনে এলে নিজের সাহস আর বুদ্ধি ছুঁইয়ে তুই সমস্ত বাধাবিপত্তিকে ফেলে দিবি মা গঙ্গার গব্বে! শুদু বুকে বল রাকবি… দেকবি, তখন সব ‘হয় না’-কে ‘হয়’ বলে মনে হচ্চে! বুজলি? পারবি বুতু! তুইই পারবি! পারবি… তুইই পারবি…”
শেষের কথা ক-টা মৌমাছির মতো গুনগুন করতে থাকল আমাকে ঘিরে, বারবার কড়া নাড়তে লাগল আমার ভেতরে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। কখন যেন ঢুকে পড়েছি রাজবাড়ির চৌহদ্দিতে। সামনেই সেই ডানা মেলা পরি। আশপাশের পাতাবিহীন কুচকুচে কালো গাছেদের কঙ্কালগুলো প্রহরীর মতো ঘিরে রেখেছে বাড়িটাকে। তাদের সরু ডালগুলো যেন ডাইনির নখরের মতোই অপেক্ষা করে আছে শিকারের শরীরটাকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য! সমস্ত চরাচর জুড়ে যেন আর একটিও জীবিত প্রাণী নেই, নেই কোনওরকমের শব্দও। শুধু এক খনখনে গলা বলছে “পারবি বুতু! তুইই পারবি! জিততেই হবে তোকে!”
কী যেন হয়ে গেল আমার। চোখের কোল বেয়ে নোনতা জলের স্রোত ভাসিয়ে দিতে লাগল সবকিছু। একই সঙ্গে শরীরের ভেতর যেন জন্ম নিতে লাগল আর-একটা মানুষ। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই রহস্যময় রাতটার কথা, আমার ঝুরিদিদার কথা। আজকের এই মুহূর্তের জন্যই কি সেদিন আমার মধ্যে শক্তি জুগিয়েছিল ঝুরিদিদা? সত্যিই কি পারব এই আতঙ্কের কবল থেকে মুক্তি পেতে? ওই যে বিশাল দুই ডানা মেলা পরিটা! চাঁদের সোনালি আলো পারেনি ওই পাথুরে শরীরের বিরাট ফাটলটাতে ঢুকতে, এই ভরা জ্যোৎস্নাতেও তাই ওটাকে একটা আধখাওয়া খোবলানো মৃতদেহ মনে হচ্ছে। হয়তো ওই ফাটলই খুলে দিয়েছে অন্য কোনও জগতের দরজা, রাস্তা করে দিয়েছে এই কালান্তক শয়তানদের! ওই দরজা আমাকে কোনওভাবে বন্ধ করতেই হবে। জোরে-জোরে নিঃশ্বাস টানলাম। আজকের রাতটাই যদি আমার জীবনের শেষ রাত হয়ও, মরে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো একটা মরণকামড় দিতে চাই আমি। এখনও মাথার ভেতর ক্রমাগত ওই মন্ত্র পড়ে চলেছে শয়তানের দূতগুলো, কিন্তু এত অন্ধকারের মধ্যেও আমার বুকের এক কোণে ফস করে কে যেন একটা আলো জ্বেলেছে। এই আলোকে আমি টিকিয়ে রাখব শেষ পর্যন্ত। জীবনের সবচেয়ে বড় বাজিটা আজ খেলতে হবে। ওই নরকের অতৃপ্ত ছায়াদের নিজের শরীরে ধারণ করে বাকি জীবনটা পোকামাকড়ের মতো বেঁচে থাকার চেয়ে আজকের এই রাতে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করা অনেক ভালো। হোক-না সে অসম লড়াই! কিন্তু জিততেই হবে আমাকে! আমার এই একটা প্রাণের বদলে যদি এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ বাঁচানো যায়, আরও কোটি কোটি চৈতালী, পারুল, বিতংসকে বাঁচানো যায়… তবে সে মৃত্যুতে কোনও আফশোস নেই! ঝুরিদিদার দেখানো সেই পথ শেষ পর্যন্ত আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়, সেটাই এখন সবথেকে বড় পরীক্ষা!
শরীরের সব শিরার ভেতর দিয়ে যেন তরল আগুন ছুটে চলেছে… ফেটে পড়তে চাইছে প্রত্যেকটা স্নায়ুতন্তু… বুকের ভেতরে পাথর ভাঙার শব্দ! একেই কি বলে মৃত্যুভয়? দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করলাম। পা ঘষটে-ঘষটে ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। ডিকিতে একটা পেট্রোলের টিন আছে, আগে দেখেছিলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে সেই টিন নিয়ে এগিয়ে চললাম ওই পরির দিকে। মাথার ভেতরের শয়তানেরা যেন বুঝতে পেরেছে আমার ষড়যন্ত্র, চতুর্গুণ গতিতে আমাকে আবার কবজা করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। কিন্তু সমস্ত মোহ কাটিয়ে পরির ওপরে নিয়ে গিয়ে ঢেলে দিলাম পেট্রোলের টিনটা। এক অমানুষিক খুন তখন চেপে বসেছে আমার মাথায়। এবার শুধু আগুন জ্বালানোর অপেক্ষা! কিন্তু কোথায় পাব আগুন? একটা বিদ্যুৎ ঝিলিক খেলে গেল মনে। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে পিন্টুর লাইটারটা পড়ে আছে। আমার শেষ অস্ত্র!
নড়বড়ে শরীরে কোনওমতে পৌঁছতে পারলাম গাড়ির কাছে। ওই তো লাইটার! এবার আর কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা, তারপরেই ধ্বংস হবে এই শয়তানি ছায়া!
আর ঠিক তখনই খেয়াল করলাম চাঁদের আলোকে ঢেকে আমার আর পরিটার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে এক বিরাট কালো ছায়া।
পেছন দিকে ঘুরতেই দেখলাম আমার বীভৎসতম দুঃস্বপ্নকে।
একটা পাহাড়প্রমাণ লোমশ শরীর, সম্ভবত যার প্রত্যেকটা কোষ থেকে বেরিয়ে এসেছে সরু দাঁড়ার মতো অজস্র পা! যার মাথার ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য জ্যান্ত প্রত্যঙ্গ, আর তার ঠিক নীচে ধকধক করে জ্বলছে সেই দুই চোখ! স্বয়ং মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে অসাড় হয়ে গেল গোটা শরীর। শয়তানের কালো ছায়া পারুলকে আজ কোন নরকের জীবে পরিণত করেছে? এই মুহূর্তে তার সেই জ্বলন্ত চোখ দুটোতে ফেটে বেরোচ্ছে অসীম হিংস্রতা! এক রক্ত জল করা আদিম গর্জনে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই দানব, প্রবল ধাক্কায় পরির দিকে ছিটকে পড়লাম! বিশাল দুই সাঁড়াশির মতো দাঁড়া নেমে আসছে আমাকে লক্ষ করে, ছোট-ছোট সূঁচ যেন ফুটে যাচ্ছে চামড়ায়। এই বোধহয় শেষ!
হঠাৎ আবছা চোখের কোণে ধরা পড়ল একটা ছোট্ট জিনিস। ঘাসের ওপর পড়ে থাকা লাইটারটা। যন্ত্রণায় ভেঙে যাওয়া শরীরটা মুচড়ে কোনওমতে লাইটারটা জ্বেলে ছুঁড়ে দিলাম পরিটার দিকে।
একটা বিকট মরণ আর্তনাদে থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা রাজবাড়ি! দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুন! পেট্রোলের সঙ্গে সঙ্গত দিতে থাকল শুকনো পাতার স্তুপ, লেলিহান শিখা ঘিরে ধরল সেই বিশাল অবয়বকে! তার আর্তনাদের সঙ্গে মিশতে লাগল সেই ঝিঁঝিঁদের প্রবল হাহাকার। আগুনের উন্মত্ত আঁচ প্রবল আশ্লেষে জড়িয়ে ধরতে লাগল ডানা-মেলা পরিকে, আর কালো কুচকুচে ধোঁয়া গলগল করে বেরিয়ে এসে ঢেকে ফেলতে লাগল চারদিক। আগুনের তাপ ছুঁয়েছিল আমাকেও, কোনওমতে ঘাসের ওপর গড়িয়ে এসে উঠে দাঁড়ালাম, আর সর্বশক্তি দিয়ে ছুটতে লাগলাম গাড়ির দিকে।
***
“উফ! তোমার এই খাতাখানার জ্বালায় তো সব মাতায় উঠল দাদাবাবু!” রাণুর মায়ের খনখনে গলায় চমকে তাকালাম। বাস্তবের মাটিতে ফিরতে খানিক সময় লাগল। ততক্ষণে অবশ্য গড়গড় করে নিজের বক্তব্য রাখতে শুরু করে দিয়েছে সে, “কী এত হাবিজাবি লেকো বলো তো? দুপুরের খাবারটা নমো-নমো করে খেলে, ওদিকে বিকেলের চা-ও জুড়িয়ে গেল। অমন সব্বোনেশে খাতার ক্যাঁতায় আগুন! আবার গায়ে চাদর জড়িয়েছ কেন? জ্বরটর এল নাকি? তোমার এই শুদু-শুদু গরমের মদ্যে চাদর জড়ানো বুজি না বাপু! যা-ই হোক, আমি চললুম। রাতে রুটি বেশি করেছি ক-খানা, সারাদিন তো পেটে কিল মেরেই রইলে! সব ঢাকা দেওয়া আছে, ঠিক করে খেয়ে নিও।”
রাণুর মা বেরিয়ে গেল। মৃদু হাসলাম। এই ছন্দে বাঁধা জীবন, আরামের নিশ্চয়তার অবসরে বসে আজ মনে হয়, কী হত যদি সেদিন শেষ মুহূর্তে লাইটারটা জ্বালাতে না পারতাম? সেই ঘটনার পর স্বাভাবিক জীবন আমার কাছে ধরা দিয়েছিল বহু মাসের অপেক্ষায়। কীভাবে যে সেখান থেকে সোজা কলকাতা ফিরেছিলাম তা আজও যেন ধোঁয়া-ধোঁয়া ঠেকে। শুধু মনে পড়ে পুড়ে যাওয়া হাতটা ব্যান্ডেজ করিয়েছিলাম কোনও এক ডাক্তারখানায়। ব্যাস, ওইটুকুই। তবে সহজে কাটেনি সে অন্ধকার। নিজের বাড়ির নিশ্চিন্ত বিছানায়ও আমাকে দিনের-পর-দিন তাড়া করেছে সেই অমীমাংসিত আতঙ্ক। মাসখানেক বিছানায় থাকার পর ধীরে-ধীরে সহজ হতে পারছিলাম সাধারণ রোজনামচার সঙ্গে। এইভাবেই একদিন আবার কর্মব্যস্ত দিনগুলো ফিরে এল। শুধু ওই জায়গার প্রসঙ্গ উঠলে এড়িয়ে যেতাম, সকলের কৌতূহলও কমে এল ধীরে-ধীরে। কিন্তু স্মৃতি? সে তো মোছার নয়! একলা ঘরের কোণাতে মনে ভিড় জমাত সেই সময় উত্তর না-জানা প্রশ্নেরা। তখনও জানতাম না উত্তর একদিন পাব ঠিকই।
তার প্রায় বছর দুয়েক পরের ঘটনা। কী একটা কাজে কলেজ স্ট্রিটে গেছি, হঠাৎ কানে এল পরিচিত গলা, “কী বিতংসদা? বহু দিন দেখা সাক্ষাৎ নেই যে?” ঘাড় ঘোরাতেই দেখি এক গাল হেসে ছোট মোড়াটা এগিয়ে দিয়েছে মাসুদ। প্যারামাউন্টের উলটো দিকটায় ওর পুরোনো বইয়ের দোকান। নানা রকম ফিচার প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে কখনও পুরোনো বইপত্রের রেফারেন্স লাগলে সেসব জোগাড় করে দেয় মাসুদই। শুধু পুরোনো বই নয়, লোকের ফেলে দেওয়া বাতিল খাতাপত্র ডায়েরি চেখে দেখাটাও আমার নিত্য অভ্যাস ছিল। সেদিন গল্পগাছা করে বাড়ি ফিরলাম কিছু পুরোনো ক্রিকেটের বই আর এক সাহেবের ডায়েরি নিয়ে। ইংরেজ আমলে এদেশে ব্যারিস্টার ছিলেন সাহেব। সন্ধেবেলা পাতা উলটোতে-উলটোতে এক জায়গায় কয়েক লাইন পড়ে যেন বাজ পড়ল আমার মাথায়!
সারা রাত জেগে সেই ডায়েরি শেষ করার পর ভোরবেলায় যেন আবার শিরশিরিয়ে ফিরে এল সেই চোরা আতঙ্ক।
ডায়েরির ছত্রে-ছত্রে লেখা আছে সাহেবের দেশের বাড়ি, অর্থাৎ ইংল্যান্ডের এক কাউন্টিতে আঠেরোশো সালের শুরুর দিকে ঘটে যাওয়া এক পরিত্যক্ত খনির অভিজ্ঞতা। আমার দেখা সেই ভয়ংকর ঘটনার সঙ্গে হুবহু মিল! লেখার শেষে সাহেব নিজস্ব অনুসন্ধিৎসা থেকে কিছু গবেষণা করেছিলেন, তার বিবরণ হল… “আমিই একমাত্র ব্যক্তি নয়। সভ্যতার যুগে-যুগে কালের নানা ঢেউয়ের ওঠা-নামায় বারংবার ফিরে এসেছে এদের উল্লেখ। এরা ছিল, এরা এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। হয়তো অন্য কোনও সময়-মাত্রায়। পৃথিবীর কোণে-কোণে আত্মগোপন করে আছে এরা, সেই জগতের দরজা খুলে যাওয়ামাত্র ঢুকে পড়বে মানব পরিচালিত পৃথিবীতে। ধীরে-ধীরে গ্রাস করে নেবে সবকিছু, হারিয়ে যাবে সমস্ত রং, শুরু হবে অন্ধকার দুনিয়ার। বিভিন্ন সভ্যতার প্রাচীন পুঁথিতে এদের উল্লেখ পেয়েছি। তারা কখনও ভয় পেয়েছে, কখনও-বা পুজো করেছে এদের। বহু নামে মানুষ অভিহিত করেছে এদের। তবে প্রায় সব জায়গাতেই এই নামগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে দুটো শব্দ। “অন্ধকার” আর “চাঁদ”। প্রতি আটাশ দিনে এই শক্তির জেগে ওঠার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তবে কি এদের আদি জন্মস্থান চাঁদের কোনও অংশে? আরও ভালো করে বলতে গেলে চাঁদের অন্ধকার অংশে? এও কি সম্ভব?”
খোলা দরজাটা হাওয়ায় দুলছে। আস্তে-আস্তে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে পাতলা সুতির চাদরটা খুললাম। জীবন সবচেয়ে বড় ম্যাজিশিয়ান, সাহেব। এই প্রশ্ন রেখে তুমি হারিয়ে গেছ কালের গর্ভে, জানি না কী পরিণতি হয়েছে তোমার। কিন্তু জীবন প্রতিনিয়ত আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চলেছে এখনও আমাদের জানার কত কিছু বাকি! সম্ভব অসম্ভবের ধারণাটা বোধহয় তোমার সেভাবে তৈরি হয়নি। কিন্তু সেই ছোট্ট বেলাতেই যে আমার চোখ খুলে দিয়ে গেছে এক সদা হাস্যময়ী ফোকলা বৃদ্ধা! পাঞ্জাবির বাম আস্তিনটা গোটালাম। চাঁদের ব্যাপারটা তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলে সাহেব, আর এও ঠিক বলেছিলে যে এরা অবিনশ্বর। এরা আছে, থাকবে। তবে আমার মতো করে বুঝেছিলে কী?
বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আয়নায় ফুটে উঠেছে প্রতিচ্ছবি। সেখানে সাদা পাঞ্জাবির শেষ প্রান্ত থেকে স্পষ্ট উঁকি মারছে কালো জিনিসগুলো। হিলহিলে সাপের মতো কালো মাংসল আঙুল। ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, সেগুলো জীবন্ত। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ধীরে-ধীরে বড় হতে থাকবে এরা, আমার মাথার ভেতরে উচ্চারিত হতে থাকবে সেই জাদুকরী মন্ত্র, আর আবার আমি পরিণত হব এক রঙখেকো দানোয়। এক বর্ণচোরায়। বেসিনের পাশে ঝোলানো ক্যালেন্ডারে লাল রঙে জ্বলজ্বল করছে আজকের দিনটা। প্রতি আটাশতম রাতটায় এভাবেই আমার শরীরে জেগে ওঠে ওরা, বুঝিয়ে দেয় আপাতত দুর্বল হলেও ওরা আছে। থাকবে। থাকবে আমার ভেতরেই।
দাড়ি কাটার সরঞ্জামের ভেতর থেকে তুলে নিলাম ধারালো ছুরিটা। এদিক-ওদিক নড়ছে সরু পিচ্ছিল মাথাগুলো। দেরী না করে সজোরে কোপ বসালাম ওদের গোড়ায়। নুন-পড়া জোঁকের মতো বেসিনে পড়ে ছটফট করতে লাগল কাটা অংশগুলো, থকথকে কালো রক্ত ছিটিয়ে গেল ফিনকি তুলে। ভালো করে ধুয়ে এসে বসলাম ইজিচেয়ারটায়। ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে আঙুলগুলো, আর মিনিট দশেকের মধ্যে বাঁ হাতে জোর ফিরে পাব। আবার সাতাশ দিনের অপেক্ষা। তারপর ফের জন্ম নেবে মহাজাগতিক ছায়াদের আমার শরীরে ফেলে যাওয়া একমাত্র ছাপ। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে শরীর থেকে বিদায় নিয়েছে সমস্ত ক্ষতচিহ্নই, এমনকী হাত থেকে পোড়া দাগটাও। শুধু থেকে গেছে জীবনের প্রতি আটাশতম রাতগুলো, আর আমাকে ভুলতে দেয়নি আতঙ্কময় সেই বীভৎস দিনগুলোর কথা। কোন গোপন রহস্যে ওই নারকীয় জানোয়ারে পরিণত হল পারুলের মতো ফুটফুটে নিষ্পাপ একটা মেয়ে, কেনই বা চরম ডিপ্রেশনের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হল উদীয়মান অভিনেত্রী চৈতালী সেনকে, আর কোন সত্যিকে লুকোতে মাঝেমাঝেই চাদর চাপিয়ে নিজের বাম হাতকে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখল বিতংস খাসনবীশ… তা এখন একমাত্র আমার বুকের মধ্যেই গেঁথে রয়েছে এক যন্ত্রণাময় শূল হয়ে। আর নীলকণ্ঠের মতো এই বিষ আমাকে পান করে যেতে হবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। কারণ বিশ্বের সামনে যেদিন খুলে যাবে এই লুকোনো অধ্যায়ের দরজা, সেদিন সেই ছোট্টবেলার বুতুর মতোই তারাও বলে উঠবে, “ধুস, তাও আবার হয় নাকি!”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হয় রে বুতু হয়। তোর থেকে ভালো আর কে জানে যে…
আসলে ‘হয় না’ বলে কিছু হয় না।
Tags: উপন্যাস, জটায়ু, দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, হরর
সুলিখিত লাভক্র্যাফটিয়ান হরর৷ ভালো লাগল।
অসাধারণ। প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়লাম।
অনেক ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ
ভালো লেগেছে।
প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে গল্পের গতিপ্রকৃতি বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু তারপর যেন সড়সড় করে এগিয়েছে। চাঁদের অন্ধকার অংশে এই মহাজাগতিক ভয়ংকর সত্তার আবির্ভাব হয়ে থাকতে পারে এই ব্যাখ্যাটা দারুন ছিলো।
অনেক শুভকামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ।