অনীশ আর্কাইভ
লেখক: সংকলক: কল্পবিশ্ব
শিল্পী:
অনীশ দেব (১৯৫১ – ২০২১)
বাংলা কল্পবিজ্ঞান জগতের মহীরুহ অনীশ দেব আর নেই। মারণ ভাইরাস কেড়ে নিল বর্ষীয়ান এই সাহিত্যিককে। এই ঘোর কালান্তক সময়ে দাঁড়িয়ে এমন এক আঘাতে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো এই সংবাদে স্তম্ভিত কল্পবিশ্ব পরিবার। আমাদের তরফে অনীশ দেবের পারিবারিক সদস্য ও আপনজনদের প্রতি রইল গভীর সমবেদনা।
সংকল্প সেনগুপ্ত
স্যারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ আলাপ একটা কাজের সূত্রে। আমাদের অফিসের প্রকাশনা বিভাগের তরফ থেকে শিশু-কিশোরদের জন্য একটা কল্পবিজ্ঞান সংকলনগ্রন্থ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এবং তার সম্পাদনার জন্য যোগ্যতম মানুষটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। অদ্রীশ বর্ধন তখনও আমাদের মাথার ওপর ছিলেন ঠিকই, কিন্তু বয়সজনিত কারণে তাঁর পক্ষে হয়তো এই কাজ করা সম্ভব ছিল না। প্রসঙ্গত, বইটির নাম ‘সেরা শিশু-কিশোর কল্পবিজ্ঞান: সেকাল থেকে একাল’, শিশু কিশোর আকাদেমি, সম্পাদনা: অনীশ দেব।
স্যারের সঙ্গে আমার কাজের বাইরে কথা বলার সুযোগ হয়নি ঠিকই। তাই তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয়লাভের সুযোগও আসেনি। যদিও তার ছিটেফোঁটাও আত্মস্থ করার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু একটা বই সম্পাদনা করতে গিয়ে সম্পাদক নিজেকে কতটা সম্পৃক্ত করতে পারেন, তা আমি উপলব্ধি করেছি। সেকাল আর একালের কিছু সেরা শিশু-কিশোর কল্পবিজ্ঞান গল্পের সমাহার করতে গিয়ে তিনি যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়, অদ্রীশ বর্ধনের লেখা ‘তৈরি’ অবস্থায় পেয়েছেন, তেমনই সুচিত্রা ভট্টাচার্যর কিশোর কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস ‘দাবানলের দেশে’ নির্বাচন করেই তিনি থেমে থাকেননি, তাকে শুধুমাত্র শিশু-কিশোর উপযোগী করে তোলার জন্য তাঁকে কলম চালাতে হয়েছে। যদিও তাতে গল্পের স্বাদ আস্বাদনে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটেনি। দুর্ভাগ্যবশত, বইটি প্রকাশের কিছুদিন আগেই লেখিকার আকস্মিক প্রয়াণ ঘটে।
লেখা নির্বাচন করে দিয়েই তিনি হাত গুটিয়ে নেননি। হাজারো ব্যস্ততা সত্ত্বেও বারংবার দফতরে আসা, অলংকরণ ঠিক কোন পাতায় যাবে তা দেখিয়ে দেওয়া, প্রুফ ঠিকঠাক দেখা হল কি না খোঁজ নেওয়া, কীরকম পাতায় ছাপা হবে, তার তদারকি করা—এই সব কিছুর মাধ্যমে তাঁর আদ্যন্ত পেশাদারিত্বের পরিচয় পেয়েছি। এই প্রসঙ্গে তাঁর হাতের লেখার কথা না বললেই নয়। মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে নির্ভুল বানানে গোটা গোটা করে লেখা তাঁর নির্দেশ বুঝে নিতে অসুবিধে হবে না কোনও কম্পোজিটার অথবা প্রুফ-রিডারের। যে কথা না বললেই নয় তা হল তাঁর সময়জ্ঞান। তাঁর বারোটা মানে যে বারোটাই, সেটা তিনি অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাই আমরাও তৈরি ছিলাম সময়মতো যথাস্থানে পৌঁছোনোর জন্য। তাঁর সমকালীন লেখকদের থেকে এগিয়ে থেকেও তিনি তাঁর লেখাটিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সবার শেষে। এই ঘটনা যেন তাঁর সদাহাস্য, অমায়িক, অনহং মুখের সঙ্গেই খাপ খায়।
পুনশ্চ: পরিচিতজনের বিয়োগ ঘটলে একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসে। তাঁর ফোন নম্বরটা কি আর রাখার দরকার নেই? আর তিনি যদি হন অনীশ দেবের মতো বিখ্যাতজন, তাহলে একজন ‘তারকা’ [শব্দটা সচেতনভাবেই ব্যবহার করলাম]-র ফোন নম্বর নিজের কাছে থাকার যে সুখানুভূতি, সেখান থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। প্রশ্নটা করেছিলাম কল্পবিশ্ব টিমের অন্যতম সদস্য বিশ্বদীপ দে-কে। তাঁর চটজলদি উত্তর, ‘থাক-না। আমি তো রেখে দিই।’ একজন সাহিত্যিকের মুখ থেকে এরকম উত্তরই আশা করা যায়। না, তাঁর নম্বর আমি এখনও ফোন থেকে মুছে ফেলিনি। ভবিষ্যতে হয়তো-বা মুছে ফেলব। সেটা তেমন কোনও বিষয় নয়। তবে তাঁর নাম আর কাজকে যেন কোনওমতেই মন থেকে মুছে না ফেলি। কল্পবিশ্ব টিমকে তিনি যে উৎসাহ দান করেছিলেন, তার প্রতি যোগ্য সম্মান আমরা এভাবেই জানাতে পারি। এবং তা সম্ভব কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় নিরন্তর প্রচার এবং প্রসারের মাধ্যমে।
বিশ্বদীপ দে
‘লোকাল ট্রেনের মতো বেশ ঘনঘন আসছে যাচ্ছে মৃত্যু আজকাল’। সেই কবে লিখেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। সময়, পরিপ্রেক্ষিত বদলে অতিমারীর এই দ্বিতীয় ঢেউ নতুন করে ফের সেই পঙক্তির সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। গত সপ্তাহে চলে গেলেন শঙ্খ ঘোষ। আর আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবর এল অনীশ দেব আর নেই। প্রথমটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল মাথাটা। উচ্চারণ করে পড়লাম ফেসবুকের পোস্ট। আর নেই! কাল শুনেছিলাম বটে করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভরতি, কিন্তু সত্যিই সব শেষ? আর কখনও দেখা হবে না? অদ্রীশ বর্ধন চলে যাওয়ার পরে তিনিই তো ছিলেন বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জন্য। মহীরুহ সকলে হতে পারেন না। অনীশ পেরেছিলেন। কেবল লেখাই নয়, সামগ্রিক ভাবে ওঁর উপস্থিতির মধ্যেই একটা লিডারশিপ ছিল। হয়তো আলাদা করে পরে আর কোনও কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা করেননি, তবু নতুনদের উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন আজীবন। তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা বছর ছয়েক আগে। বইমেলায়। ততদিনে ডানা মেলেছে আমাদের ‘কল্পবিশ্ব’। অদ্ভুত উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিলেন। কল্পবিজ্ঞান নিয়ে যে আলাদা করে আমরা ভাবছি, সেটাকে চিয়ার আপ করতেই সম্ভবত দীর্ঘ এক আড্ডার প্রস্তাব মেনেও নিলেন। সেই আড্ডা ছাপা হয়ে আছে কল্পবিশ্বের পাতায়। ছিলেন সৈকত মুখোপাধ্যায়ের মতো এই সময়ের আরও এক খ্যাতনামা সাহিত্যিকও। আর ছিলাম আমরা তিনজন। আমি, দীপ, সুপ্রিয়। কিন্তু আলোচনায় সিংহভাগ কথা বলেছিলেন অনীশবাবুই। অবাক হয়েছিলাম ব্র্যাডবেরির ‘দ্য মার্শিয়ান ক্রনিকলস’ থেকে শুরু করে প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি কল্পবিজ্ঞান গল্প (নাম ভুলে গেছি) থেকে উদাহরণ টেনে, কোথাও লাইন মুখস্তের মতো বলে দিয়ে অনায়াসে তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন কেমন করে কল্পবিজ্ঞান লিখতে হবে। বুঝতে পারছিলাম কথাগুলো মনের ভিতরে গেঁথে আছে। সেই শুরু। পরবর্তী সময়ে আরও বহুবার দেখা হয়েছে। ফোনেও কথা হয়েছে। অদ্রীশ বর্ধনের মৃত্যুর পরে শুনেছিলাম তাঁর ব্যথাতুর কণ্ঠস্বর। তারপরেও কল্পবিশ্বের স্টলে এসেছেন। কথা হয়েছে। আরেকবার পত্রভারতীর ‘বইমেলা’ পত্রিকার এক আড্ডায় তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিতে পেরেছিলাম। সেই আড্ডাতেও অনে্কে ছিলেন। কিন্তু অনীশ দেবের একটা গুণ ছিল, তিনি সকলের কথা মন দিয়ে শুনতেন। তারপর যখন বলতেন, বাকিরাও কার্যত চুপ করে শুনত। এভাবেই বারবার তাঁর সামনে গিয়ে পড়া। একটা অদ্ভুত চার্ম ছিল মানুষটার। যাকে বলে পজিটিভ ভাইব। সামনে এলে নিজেরও ভিতরটা চনমন করত। আর দেখা হবে না। তবে লেখক-কবিদের একটা ব্যাপার আছে। তাঁরা চলে গেলেও লেখা থেকে যায়। সেই লেখার মৃত্যু হয় না। অনীশ দেবের লেখাগুলিও থাকল। তাঁর কল্পবিজ্ঞান কেবল নয়, হরর আনক্যানি জাতীয় অনেক লেখাও আমার ভালো লাগে। সেসব পড়ব। আর রইল স্মৃতি। যা থেকে যায়। স্মৃতি পোড়ে না।
অনিঃশেষ অনীশ
ঋজু গাঙ্গুলী
স্পেকুলেটিভ ফিকশন বলতে ঠিক কী বোঝায়? অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী সেটি হল a genre of fiction that encompasses works in which the setting is other than the real world, involving supernatural, futuristic, or other imagined elements.
বাংলা সাহিত্যে যেক’জন সাহিত্যিক এই ‘আদার দ্যান রিয়্যাল ওয়ার্ল্ড’-কে আমাদের সামনে সজীব ও রঙিন করে তুলতে আমরণ সচেষ্ট থেকেছেন, তাঁদের মধ্যে অনীশ দেব অন্যতম।
ঠিক কী-কী লিখেছেন তিনি? তাঁর সম্পূর্ণ সাহিত্যকীর্তির পরিমাপ করার জন্য ডক্টরাল থিসিসও পর্যাপ্ত নয়। আমার পক্ষে তেমন কিছুর চেষ্টাও বাতুলতা। তাই তাঁর যে কাজগুলো আমার অপরিণত, কাঁচা মন ও দুর্বল লেখাকে দুর্গম প্রান্তরের মধ্য দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে, তাদের কথাই শুধু লিখি আজ।
আমাদের ছোটোবেলায় ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ পত্রিকার মহিমাই ছিল আলাদা। সেখানেই আমি প্রথমবার এমন একটা লেখা পড়েছিলাম যা পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-র শঙ্কু কাহিনির আরামপ্রদ রোমাঞ্চের বদলে আমাকে ভীষণ, ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। গল্পটার নাম ছিল “টিরা গ্রহের ভয়ংকর।” অভিযান সেরে পৃথিবীর উদ্দেশে রওয়া এক অভিযাত্রী দলের জাহাজে সওয়ার হয়েছিল সাক্ষাৎ শমন— যাকে চেনা যায় না। সে পৃথিবীতে পৌঁছোলে শ্মশান হয়ে যাবে এই গ্রহ! কিন্তু তাকে কীভাবে ঠেকানো যাবে? কোয়ারেন্টাইন আর মুখোশের আড়ালে ঠকঠক করে কাঁপা এই পৃথিবীতে নতুন করে ভয় ধরিয়ে দেয় গল্পটা।
তখন স্কুলে একটা বিশাল ঘরে একটাই কম্পিউটার রাখা থাকত। দরজার বাইরে জুতো খুলে, একজন স্যারের তত্ত্বাবধানে এক-ক্লাস ছেলে ঘরে ঢুকে দেখতাম সেই আশ্চর্য যন্ত্রটিকে। স্যার হাত নেড়ে দেখাতেন, স্ক্রিনের ডানপাশে দাঁড়ানো সি.পি.ইউ আর তাতে ফ্লপি ড্রাইভ। আমরা চিনতাম ফ্লপি— যা দিয়ে কম্পিউটারের মধ্যে লুকোনো নানা ব্যাপারকে জাগিয়ে তোলা যায়, রেখে দেওয়া যায় নানা তথ্য। তারপর ‘আনন্দমেলা’-তে পড়তাম এক হাড়-হিম করে দেওয়া গল্প “খেলতে খেলতে।” ফ্লপির মাধ্যমে ‘ওয়ান্ডার’ নামক একটি নতুন ধরনের খেলায় মজে গিয়ে এক কিশোরের কী হল— সে-কথা ভেবে এখনও শিউরে উঠি।
মাধ্যমিক পেরোলাম। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে বুঝলাম, ফর্মুলা বা অংক না শিখে বরং এলোমেলো ভাবনায় ডুবে থাকতে অনেক বেশি ভালো লাগে। কিন্তু সেই ভাবনাদেরও তো একটা মাধ্যম চাই। তখনই উপহার পেলাম ঝকঝকে প্রচ্ছদ আর অলংকরণে সাজানো একটা হৃষ্টপুষ্ট হার্ডকভার— ‘সেরা কিশোর কল্পবিজ্ঞান।’ স্রেফ গিললাম লেখাগুলো। তাদের মধ্যে অনেকগুলো লেখাই হয়তো সায়েন্স ফ্যান্টাসির গা-ঘেঁসে যাবে। কিন্তু কল্পনার উড়ানকে একেবারে বাধাবন্ধহীন করে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম তাদের ছুঁয়েই। তারপর যাদবপুরে পড়ার সময় হাতে এল ‘সেরা কল্পবিজ্ঞান’— যার মধ্যে ছিল সিদ্ধার্থ ঘোষের অবিস্মরণীয় ডিস্টোপিয়ান লেখা “‘মহাশূন্যের মণিমুক্তো”, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের “অপালা”, এমন আরও কত সম্পদ। বিশ্বাস করুন, ওই গল্পগুলো পড়ার দিন থেকে স্বপ্ন দেখেছি, কোনো একদিন আমিও ওইরকম কোনো গল্প লিখব! অনেক পরে গার্ডনার দোজঁ, এলেন ডাটলো, জন জোসেফ অ্যাডামস, পলা গুরান, নিল ক্লার্ক বা অন্যদের সম্পাদনায় নানা আন্তর্জাতিক সংকলন পড়েছি। তখন বুঝেছি, কিউরেটেড সম্পাদনার ক্ষেত্রে অনীশ দেব-এর ওই দুটি বই বিশ্বমানেরই ছিল।
আনন্দমেলা-রই একটা সংখ্যায় আসিমভ ও অন্য ক’জনের অনূদিত লেখা পড়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, তাহলে ফিজিক্সের প্রফেসররা গম্ভীর মুখে ইকুয়েশন লেখার পাশাপাশি রহস্য সমাধান করতেও পারেন! তাহলে বাংলায় কেউ করেন না কেন? বিশ্বাস করুন, “পাখি ধরা”-র মধ্য দিয়ে যখন এসিজি আমাদের সামনে গোয়েন্দা হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন তখন আমার দুরন্ত লেগেছিল দুটো কারণে। প্রথমত, একজন ভদ্র এবং আত্মমগ্ন অপেশাদারের ওই রহস্যভেদ আমার ফেলুদা-পড়া মগজকে মোক্ষম ঝাঁকুনি দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর যুক্তিক্রম দিয়ে কীভাবে লকড-রুম মিস্ট্রি সলভ্ করা যায়— সেও আমি সেই প্রথম দেখেছিলাম।
মেসে-হোস্টেলে থাকা মানেই রাত জাগা। পড়ার পাশাপাশি তখন আড্ডাও জমত, আর তাতে অবধারিতভাবেই উঠে আসত ভূতের বা ভয়ের গল্প। গল্পের বইয়ের বুভুক্ষু পাঠক হিসেবে আমার ততদিনে ভালোই কুখ্যাতি হয়েছে। কিন্তু বাংলা বইপত্রের পুঁজি দিয়ে শহুরে জনতাকে ভয় পাওয়ানো মুশকিল। এদিকে যাবতীয় খরচা মিটিয়ে ইংরেজি অ্যান্থলজি কেনার মতো পুঁজি তখনও হয়নি। সেই সময় বিশ্বজোড়া ভয়ের ফাঁদ পেতে রাখা আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটল “বিশ্বের সেরা ভয়ংকর ভূতের গল্প”-র মাধ্যমে। একেবারে সেরার সেরা কিছু গল্প ওই বইয়ে যে স্বাচ্ছন্দ্য, মিতকথন এবং সরসতা ও তীব্র-তীক্ষ্ণ অভিঘাতের সঙ্গে অনূদিত হয়েছিল, তার কোনো তুলনা নেই। সেই গল্পগুলো বলে চ্যান্সেলর হার্ভার্ড লাক্সারি আর বৃদ্ধ সাধু-র বহু কৃপা পেয়েছি। তার থেকেও বড়ো কথা, সে-সবের দু’দশকেরও বেশি পরে যখন আমি অনুবাদের কাজে হাত দিই, তখন অদৃশ্য দ্রোণাচার্য হিসেবে ওই বইয়ের রচয়িতাই আমার কাছে আদর্শ হয়ে থেকেছেন।
গা থেকে ‘ছাত্র’ তকমাটা মুছে গেল একসময়। তবু বই পড়া থামাতে পারলাম না। প্রাইভেট টিউশনের পুঁজি থেকে সিভিল সার্ভিসের বইপত্র আর সিগারেট কেনা বাদ দিয়ে যা পড়ে থাকত, তার সবটাই যেত বইয়ের পেছনে। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার কী জানেন? ইংরেজি বইপত্রে ভেসে যাওয়া সেই সময়েও আদ্যন্ত ইংরেজি গন্ধ গায়ে মাখা লেখাগুলো আমাকে ছাড়ল না।
ওয়্যারউলফ নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে হলমার্ক ছিল “ক্ষুরধার খেলা”-ই।
ভ্যাম্পায়ার নিয়ে হাজারো বই আর গল্পের ভিড়েও কোথায় যেন আলাদা জায়গা নিত “ছায়ার মতো মানুষ” আর “আমি পিশাচ।”
অভিশাপ আর স্যাডিজমের কথা বলতে গেলেই মনে পড়ত “পিশাচ প্রহর।”
পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সর্বনাশা অ্যাপোক্যালিপটিক লেখা বললেই ভেসে উঠত “ঘাসের শিষ নেই”।
ঝাঁ চকচকে কমপ্লেক্স আর সিসিটিভি দেখলেই “সাক্ষী কেউ নেই”-এর কথা ভাবতাম।
সিরিয়াল কিলারের কথা ভাবলেই মনে পড়ত “এক বিন্দু সন্দেহ” আর “সাপের চোখ।”
জাল নোট নিয়ে কথা হলেই মনের মধ্যে কে যেন বলত “কিরাত আসছে!”
এমনকি শেষ সিগারেটটা অ্যাশট্রে-তে দুমড়ে দেওয়ার সময়েও ‘কুইটার্স ইঙ্ক’-এর বদলে আমার মাথায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল “অস্থির কলঙ্করেখা।”
এটাই অনীশ দেবের ম্যাজিক। এই ম্যাজিকের অজস্র নিদর্শন থেকে গেছে আমার চারপাশে।
রাতের খাওয়া সেরে বউ উঠে গেলে আমার আর মেয়ে’র গল্পের সেশন হয়। সেখানে সে ক্রিপি-পাস্তার গল্প শুনিয়ে আমাকে চমকে দিতে চায়। উত্তরে আমি মনে-মনে খুলে বসি ‘অশরীরী অলৌকিক’; সেখান থেকে একে-একে উঠে আসে “সাবধান, সাপ আছে!”, “বাক্সের ভেতরে কী আছে?”, “শুনছেন, আপনাকে বলছি!”
অকাল্ট ডিটেকটিভ নিয়ে লেখাপড়া করতে বসে ডক্টর হেসেলিয়াস, ফ্ল্যাক্সম্যান লো, কারনাকি, জন থানস্টোন হয়ে দেশে ঢুকি। তারানাথ তান্ত্রিক, আগমবাগীশ পেরিয়ে প্রফেসর সোম অবধি চলে সেই লম্বা সফর। কিন্তু সেই লম্বা-চওড়া ব্যক্তিত্বের ভিড়ে শান্ত, অনপনেয়, অনমনীয় উপস্থিতি হয়ে থেকে যান প্রিয়নাথ জোয়ারদার। আমারও হাতের একেবারে নাগালেই থাকে ‘ভূতনাথের ডায়েরি’ নামের সেই বইটা, আর তার অবিশ্বাস্য চিত্ররূপময় গদ্য।
হাসিখুশি, একমাথা সাদা চুল আর মিঠে গলার ব্যক্তিত্বময় মানুষটা এগিয়ে যান আমাদের পেছনে ফেলে কোনো দূর নীহারিকার দিকে।
পেছনে থাকি আমরা, আমাদের দুঃখ, হতাশা— আরও কী পেতাম, কী পেলাম না, কেন পেলাম না…-র সারি।
আর থাকে তাঁর লেখারা— অন্ধকারে, হাতে হাত রেখে।
“দিও তোমার মালাখানি…”
সুকন্যা গোস্বামী
স্মরণে : শ্রী অনীশ দেব (১৯৫১ – ২০২১)
সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
ভূদেব মুখোপাধ্যায়, জগদানন্দ রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে শুরু করে বেগম রোকেয়া, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, সত্যজিৎ রায়, রণেন ঘোষ, অমিতানন্দ দাস। অক্ষরকণাকে ভালোবেসে একটা রিলে রেস চলছিল কোন মহাজাগতিক স্কেলের তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট পেরিয়ে অনন্তের সীমানায়। লক্ষ্য ছিল সাহিত্যের একটা বিশেষ ঘরানা বা ধারাকে এই আমরি ভাষার জল, মাটি অথবা আলো, হাওয়ার সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া। এই পূর্বোল্লিখিত নামগুলোরই ব্যাটন হাতে নিয়েছিলেন শ্রী অনীশ দেব। সেই ষাটের দশকের একেবারে শেষ মানে তাঁর প্রাক-যৌবন কাল থেকেই কল্পবিজ্ঞান – ফ্যান্টাসি বা এখন যাকে স্পেক্যুলেটিভ ফিকশন বলা হয় সেই ধারায় নিবেদিত হয়ে ছিলেন পেশায় পদার্থবিদ এই মানুষটা। মৌলিক, অনুবাদ নানা লেখার পাশাপাশি সম্পাদনার গুরুভার দায়িত্ব সামলেছেন অধ্যাপনার ব্যস্ততার মধ্যেও। আমাদের মত অনেক কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী, যাদের কিশোরবেলা কেটেছে নয়ের দশকের অলিন্দ নিলয়ের মাঝখানে, তারা ওই সময় আনন্দমেলা, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান প্রভৃতি নানা পত্রিকায় ওঁর লেখা গোগ্রাসে গিলেছি। ‘সবুজ পাথর’, ‘টিরা গ্রহের ভয়ঙ্কর’, ‘ভয়ঙ্কর ভাইরাস’ এই কিশোরপাঠ্য কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসগুলো তখন কল্পনার একটা উড়ন্ত গালিচা চাপিয়ে আমাদের সওয়ার করিয়েছে ওঁর গল্পমালার মায়াপ্রাসাদে। পরে শারদীয়া শুকতারায় প্রকাশিত ‘পিশাচের রাত’ এর মত হাড় হিম করা ভয়ের গল্পে ভয়াল রসেরও এক জাদুকর হিসেবে তাঁকে পেয়েছি। কল্পবিজ্ঞানের অতি বিখ্যাত সংকলনগুলো ছাড়াও একসময় ‘রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা পত্রিকার সেরা ১০০ গল্প’ আর তিন খণ্ডে ‘শতবর্ষের সেরা রহস্য উপন্যাস’ সংকলনের দায়িত্ব নিয়ে এক দক্ষ সম্পাদক হিসেবে জাত চেনালেন অনীশ বাবু। জহুরীর চোখে সেরা লেখাগুলো পরখ করে নিয়েছেন রহস্য সাহিত্যের পরকলায়। আমাদের প্রিয় কল্পবিশ্বের প্রতি ওঁর সপ্রশংস স্নেহ ছিল প্রথম দিন থেকেই। সেই কারণে বইমেলায় কল্পবিশ্ব আয়োজিত আলোচনাসভায় ওঁর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখা থেকে শুরু করে কল্পবিশ্বের প্রাথমিক উদ্যোগে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ওপর যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে সেখানেও পরিচালক অরুণাভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নানা প্রশ্নের সামনে তিনি খুলে দিয়েছেন করেছেন তাঁর অন্তর্লীন বোধের দোরগুলো।
এই অতিমারীর সময় সার্বিক অর্থেই আমরা রিক্ত, নিঃস্ব হয়েছি বাঙালী সংস্কৃতির আক্ষরিক মেন্টরদের হারিয়ে ফেলে। সেই অর্থেই গত ২৮ শে এপ্রিল আরেকটা নিকষ কালো দিন গেল আমাদের জন্য। অদ্রীশ বাবু প্রমুখের যে ব্যাটন যোগ্যতার সঙ্গে সামলেছিলেন অনীশবাবু, অনন্তের কাছে আমাদের অপেক্ষা রয়ে যাবে সাহিত্যের সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তেমনই কোন যোগ্য কলম বা দুঁদে সম্পাদকের। পাশ্চাত্য সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান এবং স্পেক্যুলেটিভ ফিকশনের যে গুরুত্ব রয়েছে সমাজ বীক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ দর্পণ হিসেবে, এই বাংলায় যদি তেমন জোয়ার আমরা নিয়ে আসতে পারি সেটাই হবে অনীশ দেবের প্রতি তাঁর মুগ্ধ পাঠকদের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
অঙ্কিতা
“Spell my name with an A”
দীপ ঘোষ
A-তে অদ্রীশ, A-তে অনীশ। অ-এ অদ্রীশ, অ-এ অনীশ। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের শুরু, দুই স্তম্ভ। মৌলিক রচনা, অনুবাদ, সম্পাদনা – সব কটি বিষয়েই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন দুজনে। শুধু তাই নয়, সাংগঠনিক দিক থেকেও চূড়ান্ত সফল ছিলেন দুজনে। অদ্রীশের তৈরি আশ্চর্য্য আর ফ্যান্টাসটিকের মধ্যে দিয়ে এক ঝাঁক তরুণ লেখকের মধ্যে উঠে এসেছিলেন অনীশ। পরবর্তীকালে তাঁর হাতেই ছিল বাংলা কল্পবিজ্ঞান-হরর-রহস্য জগতের চাবিকাঠি। যেমন চ্যাপেকের রোবটকে নাটকের জনপ্রিয় চরিত্র থেকে কল্পবিজ্ঞানের মাধ্যমে বিশ্ব জোড়া যন্ত্র-সাংস্কৃতিক প্রতীক করে তুলেছিলেন অ্যাসিমভ। তেমনই অদ্রীশের দেখানো পথে হেঁটেও নিজের স্বতন্ত্র কলম শুধু খুঁজেই নেননি অনীশ, পথ দেখিয়েছেন একাধিক প্রজন্মকে, পালটে দিয়েছেন বাংলা কল্পবিজ্ঞানের হাল হকিকত। লিখে গেছেন ম্যাগনাম ওপাস ২৩ ঘন্টা ৬০ মিনিট। আমার সৌভাগ্য কল্পবিশ্বের সম্পাদক হিসেবে পরিচয় হয়েছে দুজনের সাথেই, স্নেহ আর ভালোবাসা পেয়েছি তাঁদের। যেটুকু পেরেছি শিখেছি দুজনের কাছে বসে। গত দুবছরের মধ্যে চলে গেলেন দুজনেই। তবে অনীশ বাবুর অকালে যাওয়াটা বড্ড কষ্টের, এখনো তো কত কিছু জানার-শেখার-বলার ছিল। কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী ও সম্পাদক হিসেবে যেন আপনাদের দেখানো পথেই চলতে পারি, এইটুকুই আশীর্বাদ চাই।
শুধু সমাপন
মোহনা দেবরায়
“ওরা আমার বুকের ভেতরে খুঁজে যাক অনন্তকাল। আমার বুকের গভীরতা ওরা জানে না। সেই অতল গভীর থেকে কখনওই ওরা খুঁজে বের করতে পারবে না ভবিষ্যতের মানবসভ্যতার ঠিকানা।”
‘বুকের ভিতরে’ গল্পটা শেষ হয়েছিল এই লাইনগুলো দিয়েই। ঠিক কথকের মতোই, সেই গল্পের লেখক তথা এমন একজন মানুষকে নিয়ে আজ লিখতে বসেছি, যাঁর মননের গভীরতা বুঝি আমরা কেউই মেপে উঠতে পারিনি। আফসোস একটিই থেকে যাবে, মানুষটিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হল না কোনওদিন।
অনীশ দেবের সঙ্গে আমার পরিচয় শুকতারায় তাঁর লেখার মাধ্যমে। ২০০৮ সালের শারদীয়া শুকতারায় তাঁর ‘না যেন করি ভয়’ উপন্যাসটি আমার পড়া প্রথম সমসাময়িক ডার্ক ফ্যান্টাসি। শুধুমাত্র মুগ্ধতা নয়, একটা অদ্ভুত পরিপূর্ণতার অনুভূতি পেয়েছিলাম উপন্যাসটা পড়ে, মনে আছে। ২০০৯ সালের বইমেলায় ‘সাসপেন্স ডট কম’ বইটিতে তাঁর হস্তাক্ষর পাওয়ার সৌভাগ্য হয়।
‘তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট’ উপন্যাসটি আমার পড়া প্রথম ফিউচারিস্টিক থ্রিলার। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর যে সুদীর্ঘ অপেক্ষার পরে দ্বিতীয় খণ্ড হাতে পেয়েছিলাম, তা মনে পড়লে, আজও যেন অস্থির অনুভব করি।
লেখকের সাহিত্যকীর্তি এতই বিস্তৃত, যে তা নিয়ে একবার আলোচনা শুরু করলে অদূর ভবিষ্যকালে শেষ হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাই লেখকের কয়েকটি সৃষ্টির কথা বলব, সেগুলি আমাকে চিরকালের জন্য একটা মন্ত্রমুগ্ধতার নাগপাশে বেঁধে ফেলেছে তাঁর লেখনীর সঙ্গে।
‘সময়েরে দিতে ফাঁকি’ গল্পটা পড়ে নিজের অস্তিত্বকে অর্থহীন মনে হয়েছিল। ‘সময়’ জিনিসটা যে আসলে কতটা মন-নির্ভর আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এই গল্পের মাধ্যমে লেখক সেটা করিয়েছিলেন।
‘ঘাসের শিস নেই’ একটি ডিস্টোপিয়ান নভলেট। যে সমাজের কথা সেখানে লেখক বলেছেন, তার দিকে যে সত্যিই আমরা এগিয়ে চলেছি, পাঠক যদি পড়েন তাহলে বুঝতে পারবেন। এই গল্প শুনিয়ে যায় সেই শাশ্বত সত্যের বাণী: আইনস্টাইন কিংবা নিউটনের চেয়ে ফ্রয়েডের আকর্ষণ অনেক বেশি শক্তিশালী।
উদ্ধৃতিটা যথাযথ মনে এল না, তাই কোটেশন মার্ক দিতে পারলাম না।
‘হারিয়ে যাওয়া’ এই গল্পটা সম্পর্কে শুধু এই গল্পের একটি উদ্ধৃতিই যথেষ্ট। মানুষটির দৃষ্ঠিভঙ্গি, চিন্তাভাবনার স্তরটা যে ঠিক কীরকম ছিল, তা অনুভব করা যায় এই কয়েকটি ছত্রেই: “…তোমার কি মনে হয় না শহরের একশোটা জীবনের চেয়ে এইখানে এইভাবে মারা যাওয়াটা অনেক বেশি দামি?”
আরেকটা গল্প। ‘মাদারি যখন খেলা দেখায়’। যে এই গল্পটা পড়েনি তার কাছে কীভাবে এই গল্পটার সম্পর্কে বলা উচিত? আমি সত্যিই জানি না। শুধু এইটুকু বিশ্বাস করি, পত্রভারতী প্রকাশিত ‘সেরা সায়েন্স ফিকশন সমগ্র’ বইটির অন্তর্গত এই গল্পটি প্রত্যেকের অন্তত একবার পড়া উচিত। বিশেষ করে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। প্রতিটি মানুষের উচিত। হদিশ দেওয়ার জন্য সংকলনের নামটা উল্লেখ করলাম। এবং, যাঁরা বলেন স্পেকুলেটিভ ফিকশন ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর সাহিত্য’, এই কাহিনিটিই তাঁদের জবাব।
পরিশেষে এটুকুই বলি, সেই মানুষ, যিনি হঠাৎ যেন খেলা ফেলে উঠে গেছেন, যাঁর অর্ধ-নিঃশেষিত চায়ের কাপটি এখনও পড়ে আছে পাশে— তাঁকে নিয়ে লিখতে কষ্ট বড় বেশি। যাঁকে এত তাড়াতাড়ি হারানোর সম্ভাবনা মনের কোণাতেও উঁকি দেয়নি কখনও, হঠাৎ যদি একদিন সকালে উঠে শুনি তিনি নেই— যে শূন্যতার অনুভবটা হয়, সেটা ব্যক্ত করা যায় না। শুধু গুমরে মরা যায়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, অনীশ স্যার। যদি মরণোত্তর জীবন বলে কিছু থেকে থাকে, তবে সেখানে বসেই ধন্যবাদ গ্রহণ করুন এই ক্ষুদ্র কলমচির, তাকে কলম তুলে নিতে সাহস দেওয়ার জন্য। শুধু এইটুকু বলেই ইতি টানবো:
“নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ৷
ন চৈনং ক্লেদযন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ৷৷”
মনের মণিকোঠায় চিরঞ্জীবী হয়ে থাকুন, প্রিয় স্রষ্টা।
অনীশ দা, আমার মেন্টর
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
তখন ক্লাস এইট আমার। স্কুলের লাইব্রেরিতে একটি কিশোর কল্পবিজ্ঞান সংকলন আমার বিশেষ পছন্দের ছিল। বেশ কয়েকবার ওইটিই ইস্যু করেছিলাম বারবার পড়ব বলে। বইটির সম্পাদক ছিলেন শ্রী অনীশ দেব। তাঁর একটি অসামান্য গল্পও ছিল এতে। তার কিছুদিন পর পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কিনে আনা একটি মাসিক রহস্য পত্রিকার হলদেটে পাতায় আবার অনীশ দেবের লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এবার হাড়হিম করা অলৌকিক কাহিনি। অচিরেই তাঁর ভক্ত হয়ে উঠলাম। আরেকটু বড় হয়ে যখন শুনলাম তিনি রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, আমি নিজেও তখন ফিজিক্স অনার্স পাঠরত। পরে আমার এক বন্ধু ওখানে ভর্তি হয়ে তাঁর ক্লাস করার সুযোগ পায়। প্রিয় লেখকের কথা শুনতাম তার কাছে। সমীহ জাগত মানুষটির প্রতি। কখনও ভাবিনি তাঁর সান্নিধ্যে আসতে পারব।
আশ্চর্য! সেটাই ঘটে গেল। আমার প্রথম লেখা ছোটগল্পটি যখন কিশোর ভারতী পত্রিকায় মনোনীত ও প্রকাশিত হল, শুনলাম সেটি নির্বাচন করেছেন আকৈশোরের প্রিয় সাহিত্যিক অনীশ দেব স্বয়ং! তারপর মাসখানেক বাদেই পয়লা বৈশাখে পত্রভারতীর কলেজ স্ট্রিট শো রুমে আমন্ত্রিত হয়ে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হল তাঁর সঙ্গে। একটি স্কেচ করে নিয়ে গেছিলাম, ছবিতে তাঁর স্বাক্ষর নিয়ে যত্ন করে রাখব বলে। খুশি হলেন, তারপর একান্তে পাশে বসিয়ে কিছু কথা বললেন। আমার লেখাটির সম্বন্ধে। অন্তত গোটা ছয়েক ভুল পরপর বলে গেলেন। প্রায় দু-মাস আগে পড়া একজন আনকোরা লেখকের একটা গল্প কতটা মন দিয়ে পড়লে এভাবে সেগুলো চিহ্নিত করা যায়, এটা ভেবেই আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম। আর অবাক হয়েছিলাম আমার মতো একজন ‘কেউ-না’কে এতটা গুরুত্ব সহকারে লেখার প্রাথমিক পাঠটুকুর শিক্ষা দিতে দেখে। সেই শুরু। তারপর যখনই দেখা হয়েছে, লেখালিখির খোঁজ নিয়েছেন। আর সস্নেহে ত্রুটি সংশোধন করতে করতে এগিয়ে দিয়েছেন প্রশ্রয়ের হাত ধরে।
২০১৭ সাল, হঠাৎ তাঁর ফোন এল একদিন, “সপ্তর্ষি, একটা অলৌকিক গল্প সংকলন সম্পাদনা করছি। মোট ১০১ জন লেখক থাকবেন। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ, শরদিন্দুর মতো আগের লেখকদের লেখাও থাকবে, আর অল্প কয়েকজন নবীন লেখকের একদম অপ্রকাশিত লেখা চাইছি। তোমাকে একটা গল্প দিতে হবে। শব্দসংখ্যা নিয়ে ভেবো না। শুধু গল্পটা যেন ভালো হয়…” প্রথমে আমার বিশ্বাস হয়নি। তারপর লেখা হল। আবার তিনি ফোন করলেন। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন! বললেন, “তোমার গল্পটা বইয়ের একদম শেষে রেখেছি। ১০১তম গল্প ওটাই। ‘সন্ধ্যাবিল’। দারুণ লিখেছ। তোমাকে বলি, কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত নামি লেখকের লেখাও আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম আবার এডিট করে লেখার জন্য, কিন্তু তোমার গল্পে সেটার প্রয়োজন নেই, পেনম্যানশিপ খুব ভালো তোমার।” আমার সেরা প্রাপ্তি। ২০১৮ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হল সেরা ১০১ ভৌতিক অলৌকিক। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তাঁর মতো সম্পাদক বিরল। শুধু লেখা নির্বাচনের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা নয়, সামগ্রিকভাবে একটি ত্রুটিহীন গ্রন্থ নির্মাণের প্রায় প্রতিটি ধাপে তিনি নিজের গভীর বিচক্ষণতার ছাপ রাখতেন। প্রচ্ছদ কেমন হবে, প্রয়োজনে প্রচ্ছদের ক্যালিগ্রাফি বা লেটারিং নিজে হাতে করে দেওয়া, প্রকাশনার খুঁটিনাটিও ছিল তাঁর নখদর্পণে।
একবার দুর্গাপূজার আগে ফোন করলেন। ফেসবুকে একটি কবিতা পোস্ট করেছিলাম, তিনি সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব কমই আসতেন, তবু ওটা কোনওভাবে খেয়াল করেছিলেন। ফোনে বললেন “কবিতাটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। এটা নেব। আমার পাড়ার দুর্গাপুজো, গৌরীবেড়িয়া সার্বজনীন এবার বেশ বড় করে হচ্ছে। একটা স্মরণিকা বেরবে, কিন্তু গেট আপ একেবারে বইয়ের মতোই হবে। আমি ওটার সম্পাদনা করছি। শ্রীজাত, ত্রিদিববাবু, সৈকত (মুখোপাধ্যায়) লেখা দিচ্ছেন, তোমার এই কবিতাটা রাখতে চাই। অন্য কোথাও দিও না।” কবিতার বড় সমঝদার ছিলেন তিনি। একবার সহাস্যে বলেছিলেন, “এখন শুধু গদ্যই লেখা হয় বটে, তবে এককালে আমি কবিতাও লিখতাম। আমার কয়েকটা কবিতা কিন্তু ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, বুঝলে?” এরকম আরও কত স্মৃতি ভিড় করে আসছে। জনপ্রিয় গায়ক নচিকেতা চক্রবর্তীর গীতিকার থেকে গল্পকার হয়ে ওঠার যাত্রাপথে নেপথ্য-কাণ্ডারি ছিলেন অনীশ দেব, এ কথা স্বয়ং গায়ক বারবার অকপটে স্বীকার করেছেন। লেখক ‘তৈরি’ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর।
কিছুদিন আগে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ ছাড়া প্রায় অন্য কোনও সরকারি স্বীকৃতি পাননি বাংলা কল্পবিজ্ঞানের এই মহীরুহ। কিন্তু অনীশদার এসবে কিছু যেত আসত না। এই অসীম প্রাজ্ঞ, কিংবিদন্তিতুল্য মানুষটি কী অমায়িক আর মাটির কাছাকাছি থাকা একজন ছিলেন! যখনই তাঁকে দেখেছি, সাধারণ শার্ট-প্যান্ট আর কাঁধে ঝোলানো একটা কালো ব্যাগ। শীতের দিনে তার উপর একটা সোয়েটার, ব্যাস। নিশ্চুপে কাজ করে যাওয়া একজন। অবসর নেওয়ার পর বজবজের একটি বেসরকারি কারিগরি শিক্ষার কলেজে কিছুদিন গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন। বলতেন “লেখালিখির সময়ের অভাব হয়ে যাচ্ছে খুব। তবে পড়ার সময়টা বের করে নিই ওর মধ্যে। সকালের বজবজ লোকালটা ধরি শিয়ালদা থেকে। একটু আগেরটাই ধরি। তাতে সুবিধা হয়, গাড়ি একটু ফাঁকা থাকে। আমি ব্যাগ থেকে নতুন কোনও বই বের করে জানলার ধারে বসে পড়তে পড়তে চলে যাই।” এমনই পড়ুয়া ছিলেন অনীশদা। নতুন-পুরোনো, বাংলা-ইংরেজি কত যে লেখা পড়তেন। আর তেমনই ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি। বিদেশি ছায়ায় লেখা কোনও নতুন বাংলা গল্প পড়েই তৎক্ষণাৎ বলে দিতে পারতেন কোন লেখকের কোন গল্পের আদলে লেখা হয়েছে সে গল্প। অবিশ্বাস্য ক্ষমতা!
তারপর বজবজের কলেজ ছেড়ে দিয়ে বারাসাতের কাছে আরেকটি বেসরকারি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন তিনি। গতবছর লকডাউন পিরিয়ডে একবার ফোন করেছিলাম ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই। ফোন বেজে থেমে যাওয়ার কিছু পরেই তিনি রিংব্যাক করলেন। এটা সবসময়েই করতেন তিনি। বললেন, “এখন লকডাউন বটে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে, তবে কাজের চাপে কিছু কমতি নেই। এই তোমার সঙ্গে কথা বলছি যে, সামনে টেবিলে ফাইলপত্তর, কাগজ সব স্তূপাকৃতি হয়ে আছে। তার মধ্যেই দুটো মোবাইল কোনওক্রমে উঁকি মারছে।”
“এত কাজের চাপ কেন নিচ্ছেন অনীশদা?” তিনি হাসতেন। কাজ ছেড়ে থাকতে পারতেন না। তার মধ্যেই লিখেছেন টানটান ধারাবাহিক উপন্যাস, বিভিন্ন শারদীয়া সংখ্যার জন্য গল্প, সম্পাদনা করেছেন চমকপ্রদ সব বই। কোনও অনুষ্ঠানে দেখা হলেই প্রথম প্রশ্ন করতেন, “লেখালিখির খবর কী? নিয়মিত লিখছ তো? লেখার অভ্যাস কিন্তু ছেড়ো না, আর পড়াটাও চালিয়ে যাবে সমানতালে। মনে রাখবে ১০০ পাতা পড়লে এক পাতা লেখার সামর্থ্য আসতে পারে।” নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, আজ যেটুকু লেখালিখি করার সাহস দেখাতে পারছি, তার পিছনে অনীশদার অবদান অপরিসীম।
এমন একজন মেন্টরকে, স্নেহশীল অভিভাবককে আর পাব না, প্রয়োজনে তাঁর পরামর্শ নিতে পারব না, ভাবতে পারছি না। জানি, এই ব্যক্তিগত আক্ষেপ স্বার্থপরের মতো শোনাচ্ছে। কিন্তু মানুষটাই যে এমন ছিলেন! নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমার মতো বহু নবীন লিখিয়ের মাথার উপর থেকে বিরাট একটা ছাদ সরে গেল। বাংলা সাহিত্যজগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল। তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।
কল্পবিশ্বে প্রকাশিত অনীশ দেবের সাক্ষাৎকার
কল্পবিশ্বের আড্ডায় অনীশ দেব এবং সৈকত মুখোপাধ্যায়
কল্পবিশ্বে প্রকাশিত অনীশ দেবের লেখা
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও প্রতিবেদন সংকলন
আনন্দবাজার পত্রিকা: পড়ুন
এবিপি আনন্দ: পড়ুন
Aajkaal: পড়ুন
Aaj Tak: পড়ুন
Tv9 Bangla: পড়ুন
Zee 24 Ghonta: পড়ুন
Indian Express: পড়ুন
Ei samay: পড়ুন
Times of India: পড়ুন
Khabor Online: পড়ুন
Sangbad Ekalavya: পড়ুন
News18 Bengali: পড়ুন
india Blooms: পড়ুন
Locus Magazine: পড়ুন
Newstracklive: পড়ুন
Deccan Herald: পড়ুন
Yahoo News: পড়ুন
Tribune India: পড়ুন
Bollyinside: পড়ুন
Devdiscource: পড়ুন
Outlook India: পড়ুন
Bangladesh Journal: পড়ুন
The Kharagpur Post: পড়ুন
Newg24: পড়ুন
Bongnews24x7: পড়ুন
Epar Opar Bnagla: পড়ুন
Bangla News 24: পড়ুন
Priyo.com: পড়ুন
S Newz: পড়ুন
Dainik Yuvakantha: পড়ুন
SportsnScreen: পড়ুন
Kolkata 24×7: পড়ুন
Mahanagar 24×7: পড়ুন
Asianet News: পড়ুন
DW: পড়ুন
Kolkata Times 24: পড়ুন
Desh Rupantor: পড়ুন
The Wall: পড়ুন
Priyo Bandhu: পড়ুন
Latest Ly: পড়ুন
Bangla Hunt: পড়ুন
ntv: পড়ুন
Poridorshok: পড়ুন
Key Khabor: পড়ুন
MBharat: পড়ুন
Barta Samprotik: পড়ুন
Dainik Sangbad Pratidin: পড়ুন
Bangladesh Journal: পড়ুন
Khas Khobor: পড়ুন
News 24: পড়ুন
বাংলালাইভ: পড়ুন
গণশক্তি: পড়ুন
Tags: অনীশ দেব, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, স্মৃতিচারণ