বঙ্গদেশের যন্ত্রমানব
লেখক: দীপ ঘোষ ও সোহম গুহ
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
রোবট, যন্ত্র মানুষ বা কলের গোলাম— যে নামেই তাকে ডাকো না কেন, টিভি আর সিনেমার পর্দায় উপস্থিতির জন্যে তারা আজ কারো কাছেই অপরিচিত নয়। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা যদিও রোবট তৈরির ব্যাপারে লেখকের কল্পনা এবং কলমকে টেক্কা দিতে পারেনি এখনও, তবু স্বনিয়ন্ত্রিত কলকারখানায় আর গবেষণাগারে তাদের ব্যবহার দেখে মনে হয়, সেই দিন আর আসতে তেমন দেরি নেই। আধুনিক রোবটের ধারণা আসার অনেক আগে থেকেই মানুষ ভেবেছে কলের যন্ত্র বা অটোমাটার কথা। কখনও বা কল্পনা করেছে জাদুবিদ্যার সাহায্যে অজৈব পদার্থের মধ্যে কৃত্রিম প্রাণের সঞ্চার করে তৈরি গোলেমের কথা। এছাড়াও ছিল অ্যান্ড্রয়েড বা মনুষ্যকৃতি যন্ত্রমানবের গল্প।
রোবট শব্দটি ইংরাজি শব্দভাণ্ডারে খুব একটা পুরোনো নয়। এই শব্দের প্রথম আবির্ভাব ১৯২০ সালের চেক লেখক ও সাংবাদিক কারেল চাপেকের আর.ইউ.আর বা রোসামস ইউনিভার্সাল রোবটস নাটকে। চাপেক তার কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক নাটকে তুলে ধরেছিলেন একধরনের কৃত্রিম মানব বা অ্যান্ড্রয়েডের কথা, যারা মানুষের দাসরূপে কাজ করে চলে সমাজের সর্বত্র। কিন্তু অচিরেই তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করল মানুষের বিরুদ্ধে, হত্যা করল তাদের প্রভুদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বুঝতে পারল মানুষ ছাড়া নতুন রোবট সৃষ্টির রহস্য কেউ জানে না, তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখাও জরুরি। ততক্ষণে মানুষেরা রোবট তৈরির রহস্য নষ্ট করে ফেলেছে, তাই মরিয়া রোবটরা মানুষকে অনুমতি দিল তাদের উপর পরীক্ষা চালিয়ে নতুন রোবট তৈরির উপায় আবার পুনরাবিষ্কার করতে। শেষে দেখা যায় সেই ‘প্রজাতির’ শেষ দুটি রোবটের মধ্যেই আবার মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলির উন্মেষ ঘটেছে। একই সঙ্গে, মানুষ বুঝতে পারে এক নতুন যুগের আদম আর ইভের আবির্ভাব ঘটেছে পৃথিবীতে। বুদ্ধিমান পাঠক নাটকটির পিছনে রূপকের আকারে দাসপ্রথার সমালোচনা, শ্রেণিবৈষম্য এবং শ্রমজীবী অভ্যুত্থানের মতো বিষয়গুলি সহজেই খুঁজে পাবেন।
ছবি ১: আর ইউ আর নাটকের একটি দৃশ্যে তিনটি রোবট
হোমারের ইলিয়াড ও অন্যান্য গ্রিক সাহিত্যে বুদ্ধিমান যন্ত্রজীবের উল্লেখ থাকলেও চেক শব্দ ‘রোবটা’ বা দাস শব্দটি থেকে আগত রোবট শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয় পাশ্চাত্যে। ইংরাজি কল্পবিজ্ঞানে রোবট নিয়ে অসংখ্য গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে এবং বর্তমান কালেও লেখা চলছে। সেগুলির মধ্যে বিশদে না গিয়েও আসিমভের তিনটি রোবটের নিয়মের কথা উল্লেখ না করলে কল্পবিজ্ঞানে রোবটের উপরে যে কোনও প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
ক) রোবট কোনও মানুষের ক্ষতিসাধন করতে পারবে না অথবা নিষ্ক্রিয় থেকে কোনও মানুষের ক্ষতির কারণ হতে পারবে না।
খ) রোবট সবসময় মানুষের কথা শুনে চলবে, যদি না সেই নির্দেশের জন্যে প্রথম নিয়ম ভঙ্গ হবার কোনও সম্ভাবনা তৈরি হয়।
গ) রোবট সর্বদা নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করবে, যদি না সেই চেষ্টার জন্যে প্রথম ও দ্বিতীয় নিয়ম ভঙ্গ হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এছাড়াও পরে আসিমভ শূন্য নিয়ম এই তিনটি নিয়মের সঙ্গে যোগ করেন— রোবট কখনও মানবতার ক্ষতিসাধন করতে পারবে না অথবা নিষ্ক্রিয় থেকে কখনও মানবতার ক্ষতির কারণ হতে পারবে না।
এই নিয়মগুলির উপর নির্ভর করে পাশ্চাত্যে আসিমভ এবং এরপরে আরও অনেকেই অনেক চমৎকার গল্প লিখেছেন রোবট নিয়ে।
বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের জয়যাত্রা ইংরাজি সাহিত্যের মতো পুরোনো না হলেও তার প্রায় দেড়শো বছরের ইতিহাসে রোবট বা যন্ত্রমানবের প্রথম আবির্ভাব বোধহয় হেমেন্দ্রকুমার রায়ের হাতেই হয়েছিল। পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে সুপরিচিত ও বাংলা শিশু-কিশোর পাঠ্য অ্যাডভেঞ্চার ও ডিটেকটিভ কাহিনির জনক হেমেন্দ্র খুব সহজেই জয়ন্ত-মানিকের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি ‘নবযুগের মহাদানব’ গল্পে, এক ডাকাত রোবটকে নিয়ে আসেন কলকাতার বুকে। আমেরিকা ফেরত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মোহনেন্দু বানিয়েছিল সেই রোবট, কাপেকের আর ইউ আর নাটকটি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই। মোহনেন্দু চেয়েছিল ডাকাতির টাকায় সে গড়বে আরও অনেক রোবট, যারা মানুষের সব কাজে সাহায্য করে সমাজকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে নষ্ট হয়ে যায় সেই কলের মানুষটি। এক্ষেত্রে রোবটটিকে একটি রিমোটের সাহায্যে চালাত মোহনেন্দু, তার নিজের চিন্তা করার কোনও ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়নি। বাংলার প্রথম এই কলগোলামের গল্পে যন্ত্রটি আদপেই ছিল গোলাম। সত্ত্বার অনুপস্থিতিতে সে ছিল মোহনেন্দুর আজ্ঞাবহ দাস মাত্র। যন্ত্রের নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তি, অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তখনও অর্ধশতাব্দী ভবিষ্যতের বাস্তবে। লক্ষণীয় যে হেমেন্দ্রকুমারের অধিকাংশ সৃষ্টির ন্যায় ‘নবযুগের মহাদানব’ও কিশোর সাহিত্য। কিন্তু কিশোরোপযোগী হলেও এই উপন্যাসে প্রচ্ছন্নভাবে লেখক কি তৎকালীন ভারতীয় সমাজের উপনিবেশ মনোভাবের এক প্রচ্ছন্ন চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন নি? কোথাও যেন সাদা চামড়ার প্রতি তৎকালীন কিছু ভারতীয়দের অজ্ঞান আজ্ঞাবহ মনোভাব এবং সেই কলগোলামের যান্ত্রিক নিয়মানুবর্তিতার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
বাংলা কল্পবিজ্ঞানে পরবর্তী রোবটের আবির্ভাব প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ময়দানবের দ্বীপ’-এ। চরিত্রের দিক থেকে উপন্যাসটি হেমেন্দ্রকুমারের গল্পের সঙ্গে অনেকটাই তুলনীয়। দুই বাঙালি যুবক অসীম ও বিজয় ঝড়ের রাতে গঙ্গাবক্ষে বন্দি হয় এক অজানা জাহাজে। বিজয় পালাতে পারলেও অসীম ধরা পড়ে একদল প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর তৈরি মনুষ্যাকৃতি রোবটদের হাতে। এখানেও বিজ্ঞানীরা তাদের অবিষ্কার কাজে লাগিয়েছিলেন যুদ্ধ ও ডাকাতির কাজে, যদিও তাদের বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছিল এক নতুন সমাজ গড়ে তোলা। কল্পবিজ্ঞানের এই সার্থক কাহিনিকারের এই উপন্যাসটি ওরিয়েন্ট লংম্যানের ১৯৭৪ সালের ছোটদের অমনিবাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। কাহিনির প্রারম্ভে যন্ত্রমানবদের প্রথম উল্লেখে লেখক বলেছেন, ‘সবথেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার এই যে, সে মুণ্ডগুলি যেন দেহ থেকে এইমাত্র আলাদা করা হয়েছে। এখনও সেগুলি তাজা, ঠিক জীবন্ত মুখের মতো উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়েই চেয়ে আছে।’ কোথাও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের এক সূক্ষ্ম সূত্র রেখে গেছেন, যেন সেই প্রায়মানুষ এবং এই নামানুষের মধ্যে সত্বার উৎপত্তি এবং আবেগের বহিঃপ্রকাশের অভাবকে একসুত্রে গাঁথার চেষ্টা করেছেন লেখক। হেমেন্দ্রকুমারের সৃষ্টির মতো এখানেও রোবট চলেফিরে বেড়ানো নিয়ন্ত্রণাধীন যন্ত্রমাত্র। ঠান্ডাযুগের শিখরকালে, যখন গোটা পৃথিবী তটস্থ দুই প্রবল শক্তির পারমাণবিক আস্ফালনে, তখনই প্রেমেন্দ্র মিত্রের কলমে ফুটে উঠল এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার অভিলাষে জেগে ওঠা বিপথগামী ধীমত্তার কল্পইতিহাস। ফরাসি লেখক অগাস্ট ভিলিয়ারস্ ড্ ইস্লে অ্যাডামের টুমরোস ইভ (১৮৮৬) উপন্যাসের হ্যাডলির মতো প্রেমেন্দ্র মিত্রের রোবটরাও সার্থক অ্যান্ড্রয়েড, আর পাঁচটা মানুষের থেকে তাদের আলাদা করা কঠিন। কাহিনির চরিত্র লোকেশবাবু এবং বিজয়ও পারত না, যদি না তাদের আশ্রয়স্থলে— জাহাজের ভাঁড়ারঘর— খাবারের সন্ধান করত না জাহাজদস্যুর দল। প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ‘সাতাত্তর সাধক’— পৃথিবীর তৎকালীন অবস্থা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ কিছু বিজ্ঞানী খাড়া করেছিল অ্যান্ড্রয়েড তৈরির কারখানা। কাঁচামালের জোগান দিতে লুঠ হচ্ছিল জাহাজের লোহা, তলানিতে ঠেকছিল প্রতিবেশী দেশেদের মধ্যের সম্পর্ক। কাহিনিতে রোবটের আবির্ভাব হলেও প্রেমেন্দ্র মিত্র সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন রোবটের সৃষ্টিরহস্য, বলেননি কীভাবে এই আজ্ঞাবহ সেনাদের নিয়ন্ত্রণ করেন সাতাত্তর সাধকেরা, কী তাঁদের ‘মন্ত্রগুপ্তি’ / প্রোগ্রামিং। তাই জন্যই এই সৃষ্টিকে ধ্বংসের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রাকৃতিক প্রলয়কে। হয়তো মানুষের ঈশ্বর হতে চাওয়ার এই কাহিনিতে ঈশ্বরের (প্রকৃতি) প্রচ্ছন্ন উপস্থিতিকে তিনি এইভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন অগ্ন্যূৎপাতকে রূপক বানিয়ে।
ছবি ২: প্রফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা-এর মলাটে রোবু
ষাটের দশকে বাংলার কল্পবিজ্ঞান জগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয় সত্যজিৎ রায় ও অদ্রীশ বর্ধনের হাত ধরে। কল্পবিজ্ঞানের পত্রিকা ‘আশ্চর্য’ ও সাইফি সিনে ক্লাবের দৌলতে উঠে আসেন একদল নতুন লেখক। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জনপ্রিয়তম চরিত্র প্রফেসর শঙ্কু-র স্রষ্ঠা সত্যজিৎ রায় রোবটের প্রসঙ্গ এনেছেন প্রচুর গল্পে। ব্যোমযাত্রীর ডায়েরিতে রোবট বিধুশেখর ছিল শঙ্কুর সহকারী। কলের মানুষ বিধুশেখরের কোনওরকম নিজস্ব চিন্তা করার ক্ষমতা না থাকলেও বেশ কিছু সময় সে শঙ্কুকে অবাক করে নিজের বিচারবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। তবে মজার সুরে লেখা এই গল্পটি থেকে শঙ্কুর পরবর্তী প্রজন্মের রোবটরা অনেক আলাদা।
‘প্রফেসর শঙ্কু ও রোবু’ গল্পে রোবটটি তৈরি করতে মাত্র তিনশো তেত্রিশ টাকা সাড়ে সাত আনা খরচ হয়ে শঙ্কুর। রোবু মানুষের মতো দেখতে না হলেও প্রায় সমস্ত কাজই সে করতে পারে, মানুষের ভাষা শিখতে ও বুঝতে পারে এবং খুব তাড়াতাড়ি অঙ্ক কষতে পারে। অন্যদিকে বোগের্ল্টের রোবট পুরোপুরি মানুষের মতো দেখতে এবং মানুষের মতো রাগ-ভয়-হিংসা ইত্যাদি অন্ধকার প্রবৃত্তিগুলি তার মধ্যেও আছে। গল্পের শেষে শঙ্কুর বন্ধু পামারের তৈরি যন্ত্রের মাধ্যমে রোবুর ও শঙ্কুর মধ্যেও টেলিপ্যাথিক যোগ তৈরি হয় এবং রোবু তার স্রষ্টাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে।
এছাড়াও ‘শঙ্কুর শনির দশা’ গল্পে শঙ্কুর প্রতিদ্বন্দ্বী বিজ্ঞানী গ্রোপিয়াস হুবহু একরকম দেখতে একটি অ্যান্ড্রয়েডের সাহায্যে শঙ্কুকে বদনাম করার চেষ্টা করেছেন। ‘কম্পু’ গল্পে তৈরি যন্ত্রগণকটি একটি বলের আকারের, মানুষের মস্তিষ্কের পাঁচগুণ হল কম্পুর ইলেকট্রনিক মস্তিষ্কের আয়তন। সেদিক থেকে কম্পুকে রোবট না বলে বুদ্ধিমান কৃত্রিম মস্তিষ্ক বলাই উচিৎ হয়তো। গল্পের শেষের দিকে আমরা দেখি কম্পু তার স্রষ্ঠার শেখানো সমস্ত জ্ঞান আত্মসাৎ করে খুঁজে চলেছে নতুন নতুন প্রশ্নের উত্তর। অন্য যে কোনও জৈব প্রাণীর মতোই বয়স বাড়ছে তার, অবশেষে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সে পায় সেই শেষ জিজ্ঞাসার জবাব— ‘মৃত্যুর পরের অবস্থা আমি জানি।’ শঙ্কুর রোবটদের পরে অনুকূলের কথা না বললে সত্যজিতের রোবটদের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। নিকুঞ্জবাবুর রোবট অনুকূল বাকিদের থেকে একেবারেই আলাদা। একদিকে তার যেমন নিজস্ব চিন্তার ক্ষমতা আছে, তেমনি যথেষ্ট সম্মান জ্ঞান এবং দরকার পড়লে নিজেকে রক্ষা করার জন্যে হত্যা করার ক্ষমতাও আছে তার। আসিমভের নিয়মগুলি থেকে সচেতনভাবে মুক্ত এক বুদ্ধিমান রোবট সে। অনুকূলই বাংলা কল্পবিজ্ঞানে প্রথম রোবট যে সচেতনভাবে কাউকে খুন করে তার মালিককে অর্থনৈতিক বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে।
প্রকাশের কাল অনুসরণ করে যদি এই গল্পগুলোকে সাজানো হয়, তাহলে এক আভ্যন্তরীণ স্রোত ফুটে ওঠে পাঠকের কাছে। ব্যোমযাত্রীর ডাইরিতে উপস্থিত বিধুশেখর সত্যজিতের তৈরি প্রথম রোবট চরিত্র। নবজাতকের মতো তার বক্তব্য পরিষ্কার নয়, তার চরিত্রের বিকাশও সম্পূর্ণ হয়নি কাহিনি শেষের আগে। তাই ‘টাফা’ এবং ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’-এর এক যান্ত্রিক সুরকার ছাড়া তার চরিত্রের রূপ পরিষ্কার হয় না পাঠকের কাছে। দ্বিতীয় গল্প ‘প্রফেসর শঙ্কু এবং রোবু’ গল্পের রোবটটি এই অনুপাতে অনেক বেশি প্রাগ্রসর। হয়তো তার বাহ্যিক রূপ মানুষের সমান নয়, কিন্তু তার পজিট্রনিক মস্তিষ্কের যে বিকাশ হচ্ছে, নবজাতক সে সত্যজিতের রোবট যে শৈশবে পদার্পণ করছে, তা দেখতে পাই আমরা। সত্যজিতের রোবটে মানবিক গুণের বিকাশ হতে থাকে, এবং এই জন্যই শঙ্কুর প্রাণরক্ষা হয়। শঙ্কুর শনির দশায় রোবট চরিত্রটি সম্পূর্ণ রূপে প্রাপ্তবয়স্ক, ফলে তার নিষ্পাপ চরিত্রে মিশেছে ক্রূরতা, ধূর্ততা, শঠতা এবং প্রাণহরণের ক্ষমতা। সূক্ষ্মরূপে সিজোফ্রেনিয়ার রূপক হিসেবে এক ডক্টর জেকিল মিস্টার হাইড খেলার শিকার হয়েছেন শঙ্কু, তাঁরই যান্ত্রিক যমজের হাতে। শেষ গল্প ‘কম্পু’ আসলে এই সবকিছুর উপসংহার। সেই যন্ত্র হয়ে উঠেছে মানব-উত্তীর্ণ। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাঁর এই চার রোবট গল্পের মাধ্যমে সত্যজিৎ রায় আসলে মানবজাতির বিবর্তনের কথা বলতে চেয়েছেন, যেখানে চালক হল সময়ের স্রোত, চালিকাশক্তি আমাদের উদ্ভাবনী উদ্বর্তন শক্তি এবং তীব্র অনুসন্ধিৎসা। মানুষের তৈরি হওয়ায় তাঁর রোবটরাও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। সেই জন্যই কম্পুর শেষ প্রশ্ন ছিল মৃত্যু উত্তর অবস্থা নিয়ে, যে অবস্থা নিয়ে আদিকাল থেকে মানুষের প্রশ্নের শেষ নেই। যদিও, কম্পুর প্রশ্ন ছিল ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে না— কালের প্রেক্ষাপটে সে অতি নগণ্য— তার প্রশ্ন ছিল প্রজাতির মৃত্যু নিয়ে। মানবজাতির মৃত্যুর পরে পৃথিবীর অধীশ্বর কারা হবে? পোস্ট হিউম্যান রোবটরা? শঙ্কু সিরিজের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও অনুকুল তাই রোবটের প্রাপ্তবয়স্কতার এক উদাহরণ।
সবমিলিয়ে দেখা যায় সত্যজিতের রোবটরা কিন্তু শুধুই বুদ্ধিহীন যন্ত্রমানব বা তার স্রষ্ঠার হাতের পুতুল নয়। বিভিন্নভাবে তারা চেষ্টা করেছে মানুষের সীমিত জ্ঞান ও বুদ্ধি অতিক্রম করে নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে।
এর পরের ধাপে আমরা দেখতে পাই ‘আশ্চর্য!’, ‘বিস্ময়’ ও ‘ফ্যান্টাস্টিক’ এর মতো কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা এবং কিশোর ভারতী, শুকতারা ও আনন্দমেলার মতো কিশোর পত্রিকায় এক ঝাঁক কল্পবিজ্ঞান লেখকের গল্পে রোবটের আগমন। অদ্রীশ বর্ধন, রণেন ঘোষ, নিরঞ্জন সিংহ, এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, নবকুমার ঘোষ, অরূপরতন ভট্টাচার্য, দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অনীশ দেব প্রমুখ লিখে গেছেন একের পর এক রোবটের গল্প। এই সময়েই অনুবাদ হয়েছে ফিলিপ কে ডিকের সেকেন্ড ভ্যারাইটি বা আসিমভের বাইসেন্টিনিয়াল ম্যানের মতো কালজয়ী গল্পগুলি বাংলায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ের গল্পগুলির উপর পাশ্চাত্য কল্পবিজ্ঞানের প্রভাব পড়েছে খুব বেশিমাত্রায়। তার মধ্যেও উল্লেখযোগ্য কিছু গল্প হল— অদ্রীশের ‘অ্যান্ড্রয়েড আতঙ্ক’, ‘বৈজ্ঞানিক কুমারটুলি’ ও ‘খুনে রোবটদের খপ্পরে’; রণেন ঘোষের ‘পিপে’, ‘কার্বন মির্যাকেল’, ‘হ্যাঁ স্বীকার করছি আমি অ্যান্ড্রয়েড’; এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের ‘অর্ধেক মানবী তুমি’; অরূপরতন ভট্টাচার্যের ‘লৌহমানুষ’, দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রোবনুষ’ ও ‘রোবটের প্রেম’; নিরঞ্জন সিংহের ‘পি আর রোবট’ ও ‘উত্তরণ’ উল্লেখযোগ্য। এই গল্পগুলির আলাদা করে আলোচনা করতে গেলে সেটিই একটি সম্পূর্ণ প্রবন্ধের আকার নেবে, তাই সংক্ষেপে বলা যায় এই গল্পগুলিতে লেখকেরা যন্ত্রমানব ও মানুষের মধ্যের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন— কখনও যন্ত্র পড়েছে মানুষের প্রেমে, খুঁজতে চেয়েছে জীবনের অর্থ, কখনও বা সে অবাক হয়েছে ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনের শত বাধার মাঝেও উত্তরণের প্রচেষ্টায়।
সাতের দশকে নারায়ণ স্যান্যালের দুটি গল্পের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। ‘নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা’ গল্পে আর্থার সি ক্লার্কের ‘২০০১ আ স্পেস ওডিসি’র কম্পিউটার হ্যালের অবলম্বনে তৈরি কম্পিউটার ব্রেন যন্ত্রমানব-৯০০। লেখক যন্ত্রমানব-৯০০ কে সংক্ষেপে নাম দিয়েছিলেন যন্ত্র-না। এই যন্ত্র-না ছিল মহাকাশযান অভিযাত্রিকের তৃতীয় কৃত্রিম যাত্রী। দুজন মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে যন্ত্র-নার মধ্যে অভিমান, ভয়, রাগ, ভালোবাসা ইত্যাদি সমস্ত অভিব্যক্তির জন্ম হয়। শেষে ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে তার হাতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় যন্ত্র-না। আগের গল্পটিতে বিদেশি কল্পবিজ্ঞানের ছাপ থাকলেও ‘অবাক পৃথিবী’ নারায়ণবাবুর নিজের সৃষ্টি। মহাকাশ অভিযান সেরে দুই নভশ্চর পৃথিবীতে ফিরে দেখে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে, পৃথিবীতে রাজত্ব করছে পাঁচ শ্রেণির রোবট। তারা ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী নিজেদের মধ্যে শ্রেণি আর সমাজ গড়ে তুলেছে। কেউ রাজা, কেউ সেনাপতি আবার কেউ শিল্পী বা বৈজ্ঞানিক। কিন্তু তারা আসিমভের রোবটের তিনটি নিয়ম মেনে চলে। মানুষকে ভয় দেখালে বা মিথ্যে বললেও তাদের ক্ষতি করার কোনও ক্ষমতা তাদের নেই। এই শ্রেণিবিভাগ, কাহিনির মূল সূত্রের মতো আসলে জাতপাত/ রেসিজমের উপরে বিন্যস্ত। লেখক দেখাতে চেষ্টা করেছেন পুরাণের এক কথা— যে কোনও সৃষ্টি নির্মিত হয় তার স্বত্বার ছায়াতে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ‘বনি’ গল্পে আমরা দেখা পাই রোবট চিচেং বা মিস্টার পাঞ্চোর, যে মাদার কম্পিউটারকে ধ্বংস করতে গিয়ে আত্মবলিদান করে নিজেকে। বনি গল্পে কোথাও যেন মানুষ এবং রোবটের বিভাজন মিলিয়ে যেতে শুরু করে, সেই মিলিয়ে যাওয়া লক্ষ্মণরেখা কি ভবিষ্যতের বায়োরোবটদের দিকে আঙুল তুলেছে, প্রশ্ন করছে প্রযুক্তির কাছে আমাদের দাসখত লেখা নিয়ে?
এছাড়া প্রচুর ছোটগল্পে মজার ছলে শীর্ষেন্দু রোবটদের এনেছেন। এর মধ্যে ‘অম্বুজবাবুর ফ্যাসাদ’ গল্পটির কথা বিশেষভাবে করতে হয়। রোবট মোক্ষদা অম্বুজবাবুর বাড়িতে ঝিগিরি করতে আর রাজি নয়, তার জায়গায় সে হতে চায় পরমাণু বিজ্ঞানী! তিন বার নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানী অম্বুজবাবুর বাড়িতে সব কাজই যন্ত্র করে দেয়— এমনকী যন্ত্র ভাত বেড়ে খাইয়েও দেয়! অফিসের কম্পিউটার যখন কাজ করতে অস্বীকার করে দাবা খেলতে চায় অম্বুজবাবুর সঙ্গে, তিনি অবাক হয়ে আপনমনে বলতে থাকেন— “যন্ত্র মানুষ হয়ে যাচ্ছে? অ্যাঁ? এ যে আজব কাণ্ড! যন্ত্র শেষে মানুষ হয়ে যাবে!” আর তখনই কম্পিউটারটি অম্বুজবাবুর মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে বলে— “মানুষ কি শেষে যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে? অ্যাঁ? এ যে আজব কাণ্ড! মানুষ শেষে যন্ত্র হয়ে যাবে!” কল্পবিজ্ঞান আর রোবট নিয়ে আধুনিক যন্ত্রনির্ভর সমাজকে এইভাবে ব্যঙ্গ আর কোনও লেখক বোধহয় করে যাননি।
ছবি ৩: সাত্যকি সোম ও তার রোবট নরোত্তম
বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জগতে দুই রোবট চরিত্র হল রেবন্ত গোস্বামীর নরোত্তম ও সিদ্ধার্থ ঘোষের যুধিষ্ঠির। বিজ্ঞানী সাত্যকি সোমের তৈরি রোবট নরোত্তম। নরোত্তমের মাথায় বসানো আছে বিভিন্ন রকম ক্যাপসুল— অভিমান, ভদ্রতা, দুঃখ ইত্যাদি। এগুলির সাহায্যে সে প্রায় মানুষের মতোই ব্যাবহার করতে পারে। ‘সাত্যকি সোমের সত্যান্বেষ’, ‘সুমন’, ‘নরোত্তম-সংবাদ’ প্রভৃতি গল্পে নরোত্তমের উল্লেখ পাওয়া যায়। সিদ্ধার্থ ঘোষের যুধিষ্ঠির, যার ডাকনাম যুধো, এদের সবার থেকে অন্যরকম এক যন্ত্রমানুষ (‘জাল বানাল যুধিষ্ঠির’, ‘যুধিষ্ঠির উধাও’ ইত্যাদি)। বিজ্ঞানী লেখককে সে বাবা বলে ডাকে, বয়স তার সবে সতেরো আর টিনএজারদের সমস্ত দোষ-গুণ তার মধ্যে বর্তমান! যখন তখন তার আদরের বাবিকে সে বকুনি দেয় আর পিছনে লাগে, আবার পৃথিবীর বাকি মানুষদের থেকে নিজের পরিচয় গোপন রেখেও সে সবসময় চেষ্টা করে মানবজাতির কল্যাণের জন্যে। শেষে ‘টাইম মেশিনে যুধিষ্ঠির’ গল্পে সে নিজেকে উন্মত্ত জনতার হাতে ধ্বংস হতে দেয়, পৃথিবী থেকে ধর্মের ভেদাভেদ মুছে দেবার জন্যে। মানব কল্যাণে রোবটের এমন নিঃস্বার্থ আত্মবলির উদাহরণ বাংলা কল্পবিজ্ঞানে বিরল।
উপরোক্ত গল্পগুলি ছাড়াও ময়ূখ চৌধুরীর ‘যাত্রী’ কমিকসের শক্তিশালী রোবট ভোম্বল, যে সমুখ সমরে হারকিউলিসকে পর্যন্ত অজ্ঞান করে ফেলে অতি সহজেই আর শিবরাম চক্রবর্তীর ‘কল-স্বর’ গল্পের ওজন মাপক রোবটের উল্লেখ না করলেই নয়।
এরপর আমাদের এসে পড়তে হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞানের যুগে। দাপটের সঙ্গে এখন কল্পবিজ্ঞান লিখে চলেছেন অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, সৈকত মুখোপাধ্যায় এবং অবশ্যই অনীশ দেব। তাদেরই একটি করে গল্পের উল্লেখ করছি। অভিজ্ঞানের চাণক্যকে তৈরি করা হয়েছিল গুপ্তচর অ্যান্ড্রয়েড হিসেবে, তার ভিতরে পুরে দেওয়া হয়েছিল দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর প্রচুর তথ্য। চাণক্যের আবিষ্কারক যখন তাকে বিক্রি করে দিতে চায় অন্য দেশের কাছে, চাণক্য তাকে হত্যা করে তার জায়গা নেয়। কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে বোধহয় চাণক্যই প্রথম রোবট যে দেশপ্রেমের মতো একটি বিমূর্ত ধারণার জন্যেও হত্যা করতে পিছপা হয় না। সৈকতের ‘চুমুতে চমক’ গল্পে রোবো টেকনোলজিস্ট জীবক নিজেই একজন অ্যান্ড্রয়েড। বন্ধু মানুষ শীলাপন্থের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে তার বাধে না। চিন্তাবীদ ও কবি অজীন যখন সরাসরি শরীরে ক্যান্সারের ওষুধ নিতে অস্বীকার করেন, জীবক আর শীলাপন্থ খুঁজে বের করে এক অভিনব উপায় অজীনকে সারিয়ে তোলার। অনীশ দেব ছাড়া রোবট নিয়ে এমন পরিণতমনষ্ক গল্প কল্পবিজ্ঞানে কমই লেখা হয়েছে। দেবজ্যোতির লেখা ‘বারে বারে আসে’ উপন্যাসে ভীনগ্রহী ধাতুতস্কর জিভা পৃথিবীতে পাঠায় অতি উন্নত দুই যন্ত্রমানব রেনি ও র্যাং-কে। মানবাকৃতি যন্ত্রমানবদুটি শেষ পর্যন্ত বেছে নেয় তাদের পার্থিব পিতাকেই, বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাদের স্রষ্টার প্রতি। অনীশ অ্যান্ড্রয়েড ও মানুষের মধ্যের টানাপড়েন নিয়ে অনেক গল্পই লিখেছেন, তার মধ্যে ‘ভোলাকে ভোলা যাবে না কিছুতেই’ গল্পটি অবশ্যই পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে। ডোমেস্টিক কম্প্যানিয়ন ভোলাকে বহু বছর কাজের পরে পালটে ফেলতে চান তার মালিক, যাকে ভোলা বাবা বলে ডাকে। মানুষের মধ্যে মায়া-স্নেহের এই অভাব মেনে নিতে পারে না সে, ঘোষণা করে ‘তোমরা আসলে মানুষ নও… মানুষের মতো…।’
বাংলা কল্পবিজ্ঞানে যন্ত্রমানব প্রথমে বৈজ্ঞানিকের বুদ্ধিহীন পুতুল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও কালের নিয়ম মেনে সে মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। বাংলার মাটির রসে সিক্ত এই যন্ত্রমানুষরা পাশ্চত্যের আসিমভের নিয়মের বাঁধনে ধরা পড়েনি, তাই তারা সবসময় যুক্তি মেনেও চলে না। তারা হাসে, দুঃখে পাথর হয়ে যায়, ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে আত্মহত্যাও করে। কখনও বা সে হত্যা করে তার মনিব বা দেশকে বাঁচানোর জন্যে, আবার নিজেকে শেষ করে দেয় মানবজাতির স্বার্থে! বাংলার কল্পবিজ্ঞানের মতোই তার যন্ত্রমানুষরাও এক স্বতন্ত্র ধারা গড়ে তুলেছে বাংলা সাহিত্যে। লক্ষণীয় যে কল্পবিজ্ঞানে আবির্ভূত অধিকাংশ রোবটই আসিমভের তিনটে আইনের ধার ধারে না। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কমপ্লেক্স, অর্থাৎ নিয়মবহির্ভূত আত্মবিকাশ এবং পরিস্ফুটন (প্রসঙ্গ – টারমিনেটর ফ্র্যানচাইজ) বাংলায় লেখা রোবটদের একটা বৈশিষ্ট্য। আবার, মানুষের হিতসাধনকারী রোবট, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ রোবটও উপস্থিত বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে। পাশ্চাত্য এসএফ সাহিত্যের থেকে বাংলা কল্পবিজ্ঞান কেন আলাদা যদি প্রশ্ন উঠে আসে, তাহলে তার নিভৃত কারণ খুঁজতে হবে বইয়ের পাতায় নয়, বাংলার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে। পশ্চিমবঙ্গ এক উন্নয়নশীল দেশের এক রাজ্য, তার অধিবাসীদের বিভক্ত করে র্যাডকিলফের রক্তাক্ত লাইন। সেই লাইনের দুই পাশে কল্পবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনতা উত্তর যুগে দুই ভিন্নভাবে। কল্পবিজ্ঞান, যে নামে বাংলা স্পেকুলেটিভ/ সায়েন্স ফিকশনকে ডাকা হয়, সেই নামের উদ্ভব এবং বিকাশ পশ্চিমবঙ্গে, প্রাণপুরুষ অদ্রীশ বর্ধনের হাত ধরে। স্বভাবতই তার একটি ভাগ, রোবট নিয়ে কল্পবিজ্ঞানেও প্রতিভাত পশ্চিম বাংলার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। কালের নিয়মে তাই প্রেমেন্দ্র পরবর্তী সাহিত্যে, বিশেষ করে সত্যজিৎ রায় এবং সিদ্ধার্থ ঘোষের গল্পে রোবট তার যান্ত্রিক নিঃস্পৃহতা কাটিয়ে অধিকারি হয়েছে মানবিক গুণের। আমাদের একান্নবর্তী সংসারের নিয়ম মেনেই হয়তো রোবটরা যেমন চেষ্টা করে নিজের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে, তেমনি চেষ্টা করেছে সমাজের বন্ধনের মধ্যে নিজের উপস্থিতিকে পরিস্ফুটিত করতে। এই বেড়াজাল এবং আত্মউৎকর্ষতার লড়াইয়ের সবথেকে বড় উদাহরণ সম্ভবত সিদ্ধার্থ ঘোষের যুধিষ্ঠির। নরোত্তমও একই পথের পথিক, আসিমভের ‘বাইসেন্টিনেন্টাল ম্যান’-এর মতো। কিশোরগল্প হিসেবে প্রকাশিত হলেও তাই এই কাহিনিগুলিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে জটিল যান্ত্রিক এবং অযান্ত্রিক দ্বন্দ্বের, যা আসলে নতুন এবং পুরাতনের চিরায়ত সংঘর্ষের এক ইলেক্ট্রনিক প্রতিফলন। সৃষ্টি যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্রষ্টাকে ছাপিয়ে যায়, যেমন যায় এক সন্তান তার বাবা-মাকে। বাংলা কল্পবিজ্ঞানে রোবট তাই কেবল কলের গোলাম নয়, মানব সভ্যতার তৈরি এক নতুন সমাজ, প্রজাতি এবং প্রজন্মের প্রতিনিধি।
সব শেষে বলতে হয় প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে প্রায় পঁচাত্তর বছরের কল্পবিজ্ঞানে যন্ত্রমানবের ইতিহাস তুলে ধরা সহজসাধ্য নয়। হয়তো অনেক লেখক এবং অনেক ভালো গল্পের কথা বাদ পড়ে গেল অজ্ঞাতসারে, পাঠক আশা করি ক্ষমা করবেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: প্রবন্ধটির জন্যে তথ্য ও মতামত দিয়ে সাহায্য করেছেন ঋজু গাঙ্গুলী ও সন্তু বাগ।
Tags: দীপ ঘোষ, প্রবন্ধ, প্রমিত নন্দী, বিশেষ আকর্ষণ, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সোহম গুহ
দারুণ একটা কাজ.. লেখা এবং লেখার সঙ্গে জড়িত সকলকে ধন্যবাদ
দুর্দান্ত লেখা।
অনীশ দেবের মৃত্যুতে বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে একটা যুগের অবসান হয়েছে। অনীশোত্তর যুগের কল্পবিজ্ঞান যন্ত্রমানবকে কীভাবে ফুটিয়ে তোলে, আমরা এখন তা দেখার অপেক্ষায় আছি।
তথ্যে ভরপুর অত্যন্ত সুখপাঠ্য লেখনী , সমৃদ্ধ হলাম ।