স্পন্দন সিরিজ – প্রথম প্রাণের স্পন্দন ও আমরা (পর্ব-৪)
লেখক: ড. শুভময় ব্যানার্জী
শিল্পী:
‘আজ কেমন আছেন প্রফেসর?’ পালস মনিটরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ড. গ্লেন্স। হালকা হেসে প্রফেসর সেনগুপ্ত বললেন, ‘আজ অনেকটা ভালো ডক্টর, শুধু উইকনেস আছে।’ ‘দ্যাটস গুড, উই উইশ ইওর স্পিডি রিকভারি প্রফেসর। প্রায় বাহাত্তর ঘণ্টা পরে আপনার হার্টবিট আর পালসকে স্থিতিশীল করা গেছে। আই থিংক, ইউ আউট অব ডেঞ্জার নাও’ অকল্যান্ড গ্রীন সিটি হসপিটালের নিউরোসার্জেন ড. গ্লেন্স এর মুখ উজ্জ্বল হল।
প্রফেসর হঠাৎ চঞ্চল হলেন, ‘ড. উইলমার… জেসন… কেমন আছে ওরা?’
‘অস্থির হবেন না প্রফেসর, ড. উইলমারের অবস্থা কিছুটা গুরুতর হলেও, তিনি বিপদমুক্ত। আর বাকিরা ঠিক আছেন, কিছুদিন পরেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।’ ড. গ্লেন্স উত্তর দিলেন।
প্রফেসর নিশ্বাস ফেলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বড় কাচের জানলার বাইরে সুদৃশ্য ফুলের বাগানের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। পাশেই হসপিটাল কম্পাউন্ডের বিশাল প্রাচীর। নিউরোসার্জারি ডিপার্টমেন্ট হসপিটাল বিল্ডিং এর পাঁচতলায় বলে, প্রফেসর হসপিটালের পাশে গ্রাফটন রোডের ব্যাস্ত ট্রাফিক দেখা যাচ্ছে।
‘গুড মর্নিং প্রফেসর, আপনার ব্রেকফাস্ট আর মেডিসিন নেবার সময় হল,’ হাসিমুখে কেবিনে ট্রলি ঠেলে প্রবেশ করল নার্স সিমন, চারদিন ধরে সে ঘড়ি ধরে সকাল সাড়ে সাতটায় তার ডিউটি পালন করছে। ড. গ্লেন্স সিমনকে সুপ্রভাত জানিয়ে, প্রফেসরের মেডিসিন চার্টে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। এই সময় তাঁর পেজার বেজে উঠল। পেজারে মেসেজটা দেখে ড. গ্লেন্স প্রফেসরের দিকে তাকালেন, ‘প্রফেসর, ইন্ডিয়া থেকে আপনার একজন অতিথি আছেন, আশা করছি আপনি কিছুটা সময় তার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। সরি, প্রফেসর অন্য কেউ হলে আমি পারমিট করতাম না, কিন্তু, এনাকে এড়ানোর উপায় নেই। নিউজিল্যান্ড গভর্নমেন্ট থেকে অর্ডার এসেছে আর আপনার অতিথি ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টের রিপ্রেসেন্টিটিভ।’
‘ওকে, ডক্টর। নো প্রব্লেম, আই অ্যাম ফাইন উইথ দ্যা কনভারসেসান।’ প্রফেসর বিছানায় উঠে বসলেন।
‘থ্যাংকস, আপনি এখন ব্রেকফাস্ট করুন। আমি ওনাকে আধ ঘণ্টা পরে পাঠাচ্ছি।’ ড. গ্লেন্স চলে গেলেন।
প্রফেসর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। অন্যমনস্কতায় তাঁর হাত মাথার ব্যান্ডেজে ছুঁয়ে গেল। চার দিন আগে সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁকে এখানে আনা হয়, সংজ্ঞা আসার পরেও এক অজানা ভয় তাঁকে সবসময় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তন্দ্রাছন্ন অবস্থায়, তাঁর মাঝে মাঝে মনে হত তিনি হসপিটালের বিছানায় নেই, যেন অতল জলে ভাসছেন, কখনও প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যাচ্ছেন জলের নিচে… আরও গভীরে… হিমশীতল অন্ধকারে…
ঠিক আধ ঘণ্টা পর, সিমন একজন তরুণকে সঙ্গে করে তাঁর কেবিনে ঢুকল। ‘প্রফেসর, আপনার অতিথি ড. শর্মা আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলবেন, কথার মাঝে যদি একটুও শরীরে কষ্ট হয়, আমাকে সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ট করবেন প্লিজ’ সিমনের গলায় চিন্তার ছাপ।
‘ডোন্ট ওরি সিমন, আমি ঠিক আছি।’
তরুণটি প্রফেসরের বিছানার পাশে এসে তাঁকে নমস্কার করে বলল, ‘আমি দুঃখিত প্রফেসর, আপনার এই শারীরিক অবস্থায় একটা ছোট ইন্টারোগেশান করার জন্যে। আসলে ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট আপনার খবর পেয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। জিওলজিক্যাল সার্ভের থেকে একটা এনকোয়ারি কমিটি হয়েছে ঘটনার তদন্তের জন্যে। আর প্রফেসর, আমি ড. দীপেশ শর্মা, চেয়ারম্যান অব স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ, দিল্লী।’
‘ড. শর্মা, আপনি বসুন। আপনাকে দেখে অনেক ইয়ং মনে হয়,’ প্রফেসর স্মিত হাসলেন।
‘ঠিক বলেছেন, স্যার। আসলে এমআইটি থেকে ক্রিমিনোলজিতে গবেষণা শেষ করেই ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ডেপুটি চিফের চাকরিটা পাই আর তার কিছু বছরের মধ্যেই অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টরের পদ… তাই’ ড. দীপেশ শর্মা হাসলেন।
‘ভেরি ইম্প্রেসিভ, আপনি বলুন কী জানতে চান আমার থেকে?’
ড. শর্মা তাঁর ফাইল থেকে একটা কাগজ বার করে বললেন, ‘প্রফেসর আমরা জানি, ভারত সরকারের তরফ থেকে এক বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ এক্সপিডিশনে আপনাকে পাঠানো হয় নিউজিল্যান্ডের এক গোপনীয় স্থানে। কিন্তু কিছুদিন পরেই আপনাদের টিমের সঙ্গে গভর্নমেন্টের মিশন কোঅর্ডিনেটারের সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়… এরপর… আই মিন, বেশ কিছুদিন পর আমরা একটা বড় অ্যাকসিডেন্টের খবর পাই, তাও সেটা নিউজিল্যান্ডের রাউল আইল্যান্ড কোস্টাল পুলিশের তরফ থেকে। রাউল আইল্যান্ডে সেই সময় এক রেডিয়ো অবসারভেটারি টিম ক্যাম্পিং করছিল। তারা পুলিশকে জানায় গত ২৬ মার্চ রাত দুটো নাগাদ আইল্যান্ডে প্রচণ্ড ভূমিকম্প শুরু হয়, স্থায়ী হয় প্রায় আড়াই মিনিট! সমুদ্রের প্রবল জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপের একটা বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ক্যাম্পের তিনজন গুরুতর জখম হন বলে, কোস্টাল পুলিশের হেলিকপ্টার তাদের রেসকিউ করতে আসছিল… সেই সময়…’
‘সেই সময় কি ড. শর্মা?’ প্রফেসর ড. দীপেশ শর্মার মুখের দিকে তাকালেন।
‘দ্বীপের প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে, মহাসমুদ্রে, ভাসমান একটা সাবমেরিন তারা রেডারে লোকেট করে, তার বিপদসঙ্কেত সূচক আলো দেখে তারা সাবমেরিনে নামে, আর আপনাদের সেখান থেকে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করে।’
ঘরে নীরবতা নেমে এল। ড. দীপেশ আস্তে আস্তে বললেন, ‘জিওলজিক্যাল সার্ভের ডিপার্টমেন্ট আমাদের ডিপার্টমেন্টকে এই ব্যাপারটা অনুসন্ধানের জন্যে পাঠিয়েছে প্রফেসর সেনগুপ্ত। এটা কি সত্যি অ্যাকসিডেন্ট না কোনও সাবোটেজ আমাকে তা জানতে হবে।’
‘বুঝলাম।’ গভীর নিশ্বাস ফেলে প্রফেসর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘ড. দীপেশ, আপনি জানেন নিশ্চয়ই আমি জিওলজির নয়, জ্যুলজি বা প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক। কিন্তু, তা সত্ত্বেও জিওলজিক্যাল সার্ভের এক্সপিডিশানে আমাকে বিশেষ কারণে এক্সপার্ট হিসাবে সামিল করা হয়।’
‘প্রফেসর আমি কি জানতে পারি, সেই কারণটা কী?’
‘নিশ্চয়ই পারেন। আসলে এক্সপিডিশানের মূল উদ্দেশ্যটা গোপন রাখা হয়েছিল। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে থেকে। ২০১৫ সালের পর থেকে নিউজিল্যান্ডের রাউল আইল্যান্ডের চারপাশের সমুদ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে বিচিত্র কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল। বেশ কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, দ্রুত কিছু নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হতেও দেখা যায়। সমুদ্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মৃত সামুদ্রিক মাছের ঝাঁক জলে ভাসতে দেখা যায়। পরিচিত তিমির দল মাইগ্রেট করে বহু দূরে চলে যায়। এই বিষয়ে শুনে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ হয়েছিল। পড়াশোনা করে আর নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত প্রাণীবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ উঁকি দেয়। তবে, প্রমাণ না পাওয়ায় তখন তা প্রকাশ করিনি।’
‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, কী সন্দেহ জানতে পারি?
‘সেটা জানতে গেলে, একটা ছোট ঘটনা আপনাকে জানতে হবে ড. দীপেশ।’ প্রফেসর বিছানায় আধশোয়া হলেন। ‘২০১২ সালের জুলাই মাসে, একটা প্লেন সাউথ প্যাসিফিকের উপর দিয়ে যাচ্ছিল। এক ভদ্রমহিলা, প্লেনের জানলা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন! সমুদ্রের উপর এক প্রকাণ্ড বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দেখা যাচ্ছে। প্রায় একটা শহরের সমান। মহিলা তড়িঘড়ি ছবি তুলে তাঁর বন্ধুদের পোস্ট করলেন। প্লেনের পাইলটদের জিজ্ঞাসা করে কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না, যে সমুদ্রের উপর ওই আশ্চর্য, জনমানবহীন শহরটা কী? কোনও ম্যাপে, চার্টে, র্যাডার ডেটাবেসে এর কোনও উল্লেখ নেই।’
‘ভেরি ইন্টারেস্টিং প্রফেসর।’ ড. দীপেশ চোখ বড় করলেন।
‘মজার কথা, সেই সময়ে মহিলার কাছে ছবি থাকা সত্ত্বেও এই বিষয়ে কোনও বিশেষ হইচই হয়নি। কিছু বছর পর স্যাটেলাইট ইমেজে সেটার ছবি আসতেই বিজ্ঞানীরা নড়ে বসলেন। এটা তো কোনও সাধারণ ভূখণ্ডের ছবি নয়! গবেষণা করে দেখা গেল, এটা একটা শহরের সমান বিশাল আকৃতির পিউমাইস র্যাফট! মানেটা নিশ্চয়ই বুঝেছেন ড. দীপেশ’?
‘পিউমাইস র্যাফট!… কী বলছেন প্রফেসর! তার মানে…’ উত্তেজনায় ড. দীপেশের গলা কেঁপে গেল।
‘ঠিকই ধরেছেন, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের চেয়েও অনেক বড় ভাসমান এই অঞ্চল তৈরি হয়েছে, আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভা আর ছাই দিয়ে। ২০১৫ সালে এক এক্সপিডিশান টিম এই ব্যাপারটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, সমুদ্রের প্রায় নশো মিটার নিচে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডুবন্ত সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, যার নাম হ্যাভরে ভলক্যানো।’
‘মাই গড প্রফেসর, বলেন কি!’
‘ইয়েস। তাই, আমার সন্দেহ ছিল এই রকম কোনও সমুদ্রতলবর্তী আগ্নেয়গিরির প্রভাবে নিউজিল্যান্ডের রাউল আইল্যান্ডের চারপাশের সমুদ্রের প্রাণীদের অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়েছে। তবে সেটা আমার মুখ্য আগ্রহের বিষয় ছিল না, আমি শুধু একটা ছোট্ট ব্যাকটেরিয়াকে নিয়ে আগ্রহী ছিলাম।’
‘ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আগ্রহী? মানেটা ঠিক বুঝলাম না প্রফেসর।’
প্রফেসর কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন, কাচের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, ‘এক্সট্রিমোফাইল… এক্সট্রিমোফাইল…’ সামনে বসা ড. দীপেশ ভুরু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করলেন প্রফেসরের কথা।
‘ড. দীপেশ, আমি ইভল্যুশান বা বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করি। সেই ব্যাপারে কাজ করতে গিয়ে আমি এক বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাই। আপনি হয়তো জানেন, সাধারণ ব্যাকটেরিয়া তিরিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার উপর বাঁচে না। কিন্তু, কিছু বিরল প্রজাতির আশ্চর্য ব্যাকটেরিয়া আছে যারা আড়াইশো-তিনশো এমনকী, পাঁচশো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের উপরেও অনায়াসে বেঁচে থাকে পারে।’
‘বলেন কি প্রফেসর, এমন ব্যাকটেরিয়া কোথায় পাওয়া যায়?’ ড. দীপেশের গলায় উত্তেজনার সুর পাওয়া গেল।
‘কিছু বছর আগে আমি নিজে আমেরিকার ইয়েলো স্টোন ন্যাশনাল পার্কের ভিতর একটা হটস্প্রিং থেকে এই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাই। তবে তারা একশো ডিগ্রীর সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে। এদের “হাইপারথার্মোফাইল” বলে। কিন্তু, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, এদের চেয়েও বহুগুনে শক্তিশালী এক ব্যাকটেরিয়া আছে যারা আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভার মধ্যেও অনায়াসে বেঁচে থাকে। তাদের বলে “এক্সট্রিমোফাইল।” আসলে, অনেক বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল, সমুদ্রের নিচে বিশেষ “হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে” মানে আগ্নেয়গিরির মধ্যে।’ আর তাতে বসবাসকারী প্রাণীরা যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’
‘এ তো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। ঠিক সায়েন্স ফিকশানের মতো। তবে, এখন আমি আপনার এক্সপিডিশানের আগ্রহ আর উদ্দেশ্যটা বোধহয় আমি ধরতে পেরেছি প্রফেসর।’ ড. দীপেশ হাসলেন।
‘ঠিকই অনুমান করেছেন, এক্সট্রিমোফাইলের ব্যাপারটা আমি ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগকে জানাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল, কিছুদিন আগেই আবিষ্কার হওয়া হ্যাভরে ভলক্যানোতে বা তার কাছের কোনও হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে এই এক্সট্রিমোফাইলের অনুসন্ধান করা। তার জন্যে নিউজিল্যান্ডের জিওথার্মাল রিসার্চ টিমের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করা হয়। ওই টিম তখন রাউল আইল্যান্ডে গবেষণার জন্যে যাচ্ছিল। প্রথমে তারা রাজি হয়নি। তিন মাস ধরে ক্রমাগত তাদের কনভিন্স করে তবে প্রোজেক্টের অনুমতি পাওয়া যায়। প্রজেক্টের জন্যে নিউজিল্যান্ডের ওশেনোগ্রাফিক ইন্সিটিউট থেকে স্পেশাল সাবমেরিন ডিজাইন করা হয়। দীর্ঘ আট মাস আমাকে নিউজিল্যান্ডের নর্থ কোস্টে থেকে ট্রেনিং নিতে হয়েছিল।’
‘সরি প্রফেসর, একটু ইনটারাপ্ট করছি। আই মিন… একটা ব্যাকটেরিয়ার জন্যে এত প্রিপারেশান আর এত খরচ? ব্যাপারটা আমার কাছে ধোঁয়াটে লাগছে।’ ড. দীপেশ মাথা নাড়লেন।
প্রফেসর সেনগুপ্ত হাসলেন। ‘ব্যাপারটা না জানলে, এরকম মনে হওয়া স্বাভাবিক। নিউজিল্যান্ড গভর্নমেন্টকে বোঝাতেও বেগ পেতে হয়েছিল। আসলে এই ধরনের ছোট্ট ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানের জগতে বিরাট এবং যুগান্তকারী বিপ্লব এনেছে আর ভবিষ্যতেও আনবে বলে বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস।’ প্রফেসর থামলেন। তাঁর কেবিনে এখন সুচ পড়া নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ড. দীপেশ চেয়ে আছেন তাঁর দিকে।
প্রফেসর শুরু করলেন, ‘আপনি পিসিআর বা পলিমারেজ চেন রিঅ্যাকশানের নাম শুনেছেন? এটা এমন এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যার সাহায্যে অতি দ্রুত শরীরে কোনও জীবাণুর সংক্রমণ হয়েছে কিনা তা বার করা যায়। সারা পৃথিবীতে এই পদ্ধতি চিকিৎসার কাজে আর ফরেন্সিক সায়েন্সে বহুল পরিমানে ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তর এনেছে এই পদ্ধতি। আর ব্যাপারটা সম্ভব হয়েছে হটস্প্রিং-এর “থার্মাস একুয়াটিকাস” নামে ব্যাকটেরিয়া থেকে পাওয়া একটি নির্দিষ্ট উৎসেচকের জন্যে। এই উৎসেচক পলিমারেজ চেন রিঅ্যাকশানের জন্যে অপরিহার্য। তাই এই তাপমাত্রাসহিষ্ণু ব্যাকটেরিয়াটির চিকিৎসাবিজ্ঞানে আর জৈব-প্রযুক্তিতে মূল্য অসীম। একেবারে এক্সট্রিমোফাইলের মতো না হলেও তার কাছাকাছি হল এই তাপমাত্রাসহিষ্ণু ব্যাকটেরিয়া। আর আমার গবেষণার বিষয় ছিল এই এক্সট্রিমোফাইলের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ নিয়ে, মানে যে তাপমাত্রায় সাধারণ প্রাণীর দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যাবার কথা, সেখানে কীভাবে এই ছোট্ট ব্যাকটেরিয়া দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকে?’
‘দ্যাটস ইন্টারেস্টিং প্রফেসর, আপনি জানেন কীভাবে এরা এতটা টেম্পারেচার সহ্য করে?’ ড. দীপেশের আগ্রহী প্রশ্ন।
‘এই প্রশ্নের উত্তর শুধু আমি নয়, বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরাও জানতে চান। এই উত্তর আংশিক জানা গেলেও সম্পূর্ণ উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।’ বলে প্রফেসর আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘এই একই প্রশ্ন আমাকে সাবমেরিনে আমার কলিগ ড. উইলমার করেছিল… আসলে এর উত্তর লুকিয়ে আছে অনেক গভীরে, জটিল রহস্যের আবর্তে। ভাবতে পাারেন ড. দীপেশ, মহাসমুদ্রের প্রায় হাজার মিটার নিচে, গভীর অন্ধকারে যেখানে আছে ফুটন্ত আগ্নেয়গিরির লাভা, জল যেখানে তীব্র অ্যাসিডের মতো… জলের চাপ যেখানে ভয়ঙ্কর… সেই পরিবেশে খেলা করছে এক্সট্রিমোফাইলের দল। শুধু খেলা নয়, বংশবিস্তারও করে চলেছে অনায়াসে। তাদের জীবনরহস্য জানতে পারলে জৈব প্রজুক্তির এক নতুন অধ্যায় সূচীত হবে, তার জৈব অণুর সাহায্যে আবিষ্কার হতে পারে এমন অদ্ভুত ড্রাগ যার মাধ্যমে মানুষ হতে পারে অজেয়, অমর।’ প্রফেসর থামলেন। তাঁর কিছুটা দুর্বল লাগছিল। টেবিলের পাশে রাখা জলের গ্লাস নিয়ে অল্প জল খেলেন। ড. উইলমারের সঙ্গে তাঁর আলাপ অনেক আগে থেকেই। জার্মানির গটিংগেনে একটা বায়োমেডিক্যাল কনফারেন্সে উইলমার চেয়ারপার্সন ছিল। যদিও উইলমারের কাজ বায়োফিজিক্স নিয়। অতিরিক্ত জলের চাপ সহ্য করতে পারে এমন এক বিশেষ ডুবুরি পোশাকের ডিজাইন নিয়ে সেই সময় গবেষণা করছিল। প্রফেসর সেনগুপ্তর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে সে নিজেই আলাপ করে। সেই সন্ধ্যার কথা সূর্যশেখরের মাঝে মাঝে মনে পড়ে। কনফারেন্স লাউঞ্জে বসে, ব্ল্যাক কফি খেতে খেতে দুজনের এক্সট্রিমোফাইল নিয়ে অনেক কথা হয়েছিলো। প্রফেসর দেখেছিলেন, উইলমারের অ্যাস্ত্রোবায়োলজি নিয়ে অনেক পড়াশোনা আছে। তার মতে, এক্সট্রিমোফাইলের উৎপত্তি আসলে পৃথিবীতে হয়নি। হয়েছে সৌারমণ্ডলের অন্য কোনও গ্রহে, যেখানে পরিবেশ চরম, ঠিক যেমন হটস্প্রিং বা আগ্নেয়গিরির হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে পাওয়া যায়। প্রফেসর হেসে বলেছিলেন, ‘উইলমার, তোমার কথা শুনে আমার একটি গ্রহের কথাই বার বার মনে পড়ছে, সেটা হল মঙ্গল। ওই লাল গ্রহের চরম তাপমাত্রা, তার শুকনো খাতে জমে থাকা গাঢ় কার্বন ডাই-অক্সাইড সবই যেন এক্সট্রিমোফাইলের জন্যে অনুকূল মনে হচ্ছে।’ উইলমার সায় দিয়ে বলেছিল, ‘সে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না সূর্যশেখর, এখনও সায়েন্টিস্টরা “এক্সট্রা-টেরিসট্রিয়াল লাইফ অরিজিন” থিয়োরিটা একেবারে তাদের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেয়নি।’ প্রফেসরের নিজের এই থিয়োরিতে সদর্থক সায় না থাকায় তর্কটা বেশ জমে ওঠে। কথার মাঝে একবার জীবের ডিএনএ-র গঠন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সেই সময়েই উইলমার তার মোক্ষম যুক্তিটা দেয়। উইলমার বলেছিল, ‘একবার ভেবেছ প্রফেসর, এই পৃথিবীতে সবার ডিএনএ-র গঠন এক, এ ছাড়াও ডিএনএ থেকে আরএনএ এবং আরএনএ থেকে প্রোটিন সংশ্লেষণ পদ্ধতিও এক। কিন্তু, এক্সট্রিমোফাইলের ডিএনএ, আরএনএ এবং প্রোটিনের গঠন অন্য সবার চেয়ে বেশ কিছুটা আলাদা। আমি যদি ধরেও নি, ভয়ঙ্কর প্রতিকূল অবস্থায় অভিযোজনের কারণে তাদের জেনেটিক গঠন আলাদা হয়ে গেছে, তাহলে একটা বিরাট প্রশ্ন ওঠে, ডিএনএ-র এতটা বিবর্তনের জন্যে যে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন ছিল তারা সেই সময় পেয়েছিল কি? প্রফেসর, বিবর্তনের ইতিহাস সে কথা বলে না। এই এক্সট্রিমোফাইলরা পৃথিবীতে এসেছে ইউক্যারিওটিক কোষ তৈরি হবার বহুযুগ আগে, তাহলে এই আধুনিক, আশ্চর্য এবং জটিল জেনেটিক এলিমেন্ট সেই সময়ে তারা পেল কোথায়? আমার গভীর বিশ্বাস, এরা এসেছে পৃথিবীর বাইরে থেকে।’
কথায় যুক্তি আছে। সূর্যশেখরের কাছে এর জুতসই জবাব তখন ছিল না। দুজনের সেই দিন পরিকল্পনাও হয়, অদূর ভবিষ্যতে তাঁরা এক্সট্রিমোফাইলের সন্ধানে একটা বড় এক্সপিডিশান করবেন। কফি আর চীজ স্যান্ডউইচের সদ্ব্যবহার করতে করতে অনেক রাত পর্যন্ত গড়িয়েছিল সেই আলোচনা…
‘এক্সকিউজ মি প্রফেসর!’
সূর্যশেখরের চিন্তাজাল ছিন্ন হল। ড. দীপেশ তাঁকে ঝুঁকে পড়ে কিছু বলছেন। ‘সরি প্রফেসর, আমি জানি আপনার শরীর ঠিক নেই, কিন্তু আমাদের হাতে সময় বেশি নেই, তাই আপনার থেকে বিশেষ কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই।’
‘বেশ, বলুন।’
‘আমাদের ইনফরমেশান অনুযায়ী, আপনাদের পুরো এক্সপিডিশানটা সিক্রেট রাখা হয়েছিল। বাট, দ্যাটস নট ভেরি আনইউজুয়াল, সায়েন্টিফিক এক্সপ্লোরেশানের স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রে এরকম করা হয়। আপনাদের ভয়েজটা কীভাবে শুরু হয়েছিল?’ ড. দীপেশ তাঁর ল্যাপটপ খুলে নোট নিতে শুরু করলেন।
প্রফেসর কিছুটা ভেবে নিয়ে বললেন, ‘মেরিন এক্সপিডিশানের জন্যে স্পেশাল ট্রেনিং লাগে। প্রায় ছয় মাস ধরে নর্থ-ইস্ট নিউজিল্যান্ডের কোস্টে আমাদের ট্রেনিং নিতে হয়েছিল। সাত জনের টিমে আমি একমাত্র ভারতীয় প্রাণীতত্ত্ববিদ হিসাবে যোগ দি। উইলমার ছাড়া আমেরিকান মাইক্রোবায়োলজিস্ট ড. জেসন স্টিভানের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। সৌভাগ্যবশত, আমরা পেয়েছিলাম জাপানের বিখ্যাত ওশেনোলজিস্ট প্রফেসর ওসাকা কিমুরাকে। আর ছিলেন দুজন সাবমেরিন ক্যাপ্টেন ও একজন মেরিন এঞ্জিনিয়ার। আপনাদের নোটে নিশ্চই লেখা আছে, আমরা পনেরোই মার্চ যাত্রা শুরু করি। মার্চ মাসে আবহাওয়া ভালো থাকে, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রাও বেশি কমে না। আমাদের প্ল্যান ছিল, টাউরাঙ্গা হেলপ্যাড গ্রাউন্ড থেকে সোজা কারমাডেক আইল্যান্ডে গিয়ে নামব। জানেন নিশ্চয়ই কারমাডেক বায়োরিসার্ভ ভীষণ রেসট্রিটেড জায়গা। নিউজিল্যান্ডের স্পেশাল পারমিশান লাগে। ভীষণ দুর্গম আর এই অদ্ভুত দ্বীপে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ আর প্রাণীর সমাবেশ। এই দ্বীপ থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের জাহাজে করে কারমাডেক আর্কের দিকে যাত্রা।’
‘আই সি, কিন্তু কারমাডেক আর্ক ব্যাপারটা কী?’ দীপেশের প্রশ্ন।
‘কারমাডেক আর্ক হল সক্রিয় আগ্নেয়গিরির দ্বীপপুঞ্জ, এরা টঙ্গা আর উত্তর-পূর্ব নিউজিল্যান্ডের মাঝে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। আশ্চর্যের কথা কি জানেন, এই কারমাডেক আর্কের আশেপাশে মহাসাগরের নিচে প্রায় তিরিশটা ডুবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে, তার মধ্যে হ্যাভরে ভলক্যানো সবচেয়ে বড়।’
‘আর আপনারা সেই দিকে পাড়ি দিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ, ড. দীপেশ, হ্যাভরের কাছাকাছি সাবমেরিনে পৌঁছে এক্সট্রিমোফাইলের সন্ধান আর গবেষণা করাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল।’
‘ওকে, কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটল কীভাবে, অবশ্য… আপনি যদি একে অ্যাক্সিডেন্ট বলে মনে করেন…’ ড. দীপেশের মুখ কিছুটা চিন্তিত দেখাল।
প্রফেসর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘দেখুন, আপনাদের ইনভেস্টিগেশানে কি পাওয়া যাবে জানি না, কিন্তু, ব্যক্তিগতভাবে আমি ব্যাপারটাকে দুর্ঘটনা বলেই মনে করি। মহাসমুদ্রের নিচে যে অদ্ভুত আর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আমরা হয়েছিলাম তাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করার সাধ্য আমার নেই। সেই ভয়াবহ ঘটনার রেশ এখনও আমার পিছু ছাড়েনি। আপনি শুনতে চাইছেন বলে শোনাচ্ছি…।’
‘বলুন প্রফেসর।’
সূর্যশেখরের মনে ভেসে উঠল সেই সাবমেরিন যাত্রার কথা।
‘কারমাডেক আইল্যান্ড ছবির মতো সুন্দর একটা দ্বীপ। কোনও মানুষের বসবাস এই দ্বীপে নিষিদ্ধ। সবুজ ঘন ট্রপিক্যাল ফরেস্টে ছাওয়া, নির্জন দ্বীপ। কারমাডেকের চারপাশে অনেক ছোট ছোট দীপপুঞ্জ আছে, কিন্তু এখানকার প্রকৃতি ও সৌন্দর্যয়ের তুলনাহীন। প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য আমাকে সব সময়েই মুগ্ধ করে। শুধু কারমাডেক সংলগ্ন সমুদ্রেই প্রায় তিরিশের বেশি ডলফিন আর তিমিমাছ পাওয়া যায়। তার সঙ্গে পৃথিবীর মধ্যে দুষ্প্রাপ্য “সেভেন সি কচ্ছপ” এখানে পাওয়া যায়। কারমাডেক আইল্যান্ডের বেলাভূমি ছোট। কোনও কোনও জায়গায় সমুদ্রের ধার থেকে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। শান্ত সমুদ্রের জল গাঢ় নীল। সোনালি বেলাভূমিতে স্বচ্ছ জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। দু-দিনের জন্যে আমারা কারমাডেকে ক্যাম্প করেছিলাম। কাজের ফাঁকে, আমি উইলমার আর জেসন সবুজ বনভূমির মধ্যে ঘুরতে যেতাম। নাম না জানা বহু প্রাচীন মহীরুহের গা বেয়ে উঠেছে ফার্নের গুচ্ছ, আইভির মতো লতানে গাছ। বনের মধ্যে মনে হয়, সারা পৃথিবীতে কোথাও কোনও শব্দ নেই। শুধু, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর মাঝে মাঝে অচেনা পাখির ডাক। মজার কথা, দ্বীপে কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখলাম না। কিছু অদ্ভুত চেহারার ক্যামেলিওনের মতো সরীসৃপ চোখে পড়ল, আকারে বেশ বড়। আমাদের দেখে তারা পালিয়ে গেল না, বরং ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। মানুষ আসে না বলে, মানুষকে এরা ভয় পায় না।
প্রফেসর কিমুরা আমাদের সবার চেয়ে বড়। এটা ওঁর তেইশতম এক্সপিডিশান। দিনের বেশির ভাগ সময়টা বেলাভূমির ধারে বসে নোটবই খুলে প্রয়োজনীয় নোট নিতেন। উঁচু অরণ্যভূমির থেকে ওঁর সাদা টুপি আর ক্যাম্প চেয়ারটা আমরা দেখতে পেতাম।
১৮ মার্চ আমরা সি-হক এনজি-১৭৫৪ নামে একটা বড় জাহাজে আমাদের প্রয়োজনীয় মালপত্র নিয়ে কারমাডেক আর্কের দিকে যাত্রা শুরু করি। বেরোনোর দিন দেখলাম, উইলমারের মালপত্রের মধ্যে বিরাট বড় একটা কাঠের বাক্স আছে। জিজ্ঞেস করতে সে বলল, তার কিছু পার্সোনাল জিনিস আছে। একটু অবাক হলাম কিন্তু আর কথা বাড়ালাম না।
আমাদের মোট চার দিন মানে, ১৮ থেকে ২২ মার্চ লাগল কারমাডেক আর্কে পৌঁছোতে। সমুদ্রযাত্রার মাঝে একদিন দেখা পেলাম উড়ুক্কু মাছের ঝাঁকের, প্রায় হাজার হাজার মাছ। সমুদ্র থেকে লাফিয়ে উঠছে, বেশ কিছুটা উড়ে আবার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমরা জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দেখতাম এই মজার খেলা…। রাতে, ডেকে বসে জোর আড্ডা হত। জেসন তার মাউথ অরগ্যানের সুর তুলত তার মধ্যে। তারায় ভরা কালো আকাশের নীচে নিকষ কালো মহাসমুদ্রের মাঝে ভেসে চলল আমাদের জাহাজ।
ইলেকট্রনিক সেক্সট্যান্ট মেশিনে ল্যাটিচিউড ও লঙ্গিচিউড ২৪°৪৮’ দক্ষিণ আর ১৭৭°১’ পশ্চিম সেট করে আমাদের জাহাজ গন্তব্যের কাছাকাছি আসতেই সামুদ্রিক আবহাওয়ার একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কুয়াশার মতো মেঘ ছড়িয়ে আছে। হাওয়ার গতিবেগ বেশ কিছুটা কম। প্রফেসর ওসাকা চিন্তিত মুখে বললেন, এই ধরনের আবহাওয়া পাওয়া মহাসমুদ্রের এই অঞ্চলে কিছুটা আশ্চর্যের। এখনও, কারমাডেক আর্কের অবস্থান বেশ কিছুটা দূরে, অন্তত দেড়শো মাইল তো বটেই। সবার সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হল, সমুদ্রের এই জায়গাটা স্টাডি করা যাক। হাই-টেক সাবমেরিন আমাদের জাহাজের লোয়ার চেম্বারে সেট করা ছিল। সেটাকে জলে নামিয়ে, ওয়াটার প্যারামিটার চেক করতেই সারাদিন লাগল। জাহাজে একজন ইঞ্জিনিয়ার আর টেকনিশিয়ানকে রেখে, পরদিন অর্থাৎ ২৩ মার্চ দুপুর ২টো ৪৫ মিনিটে আমরা সাবমেরিনে চেপে ডুব দিলাম প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীর জলে।
সাবমেরিনের ভিতরটা ভীষণ আধুনিক। আগে থেকেই এই সাবমেরিনে আমাদের ট্রেনিং করানো হয়েছিল। আমার অবাক লাগছিল প্রত্যেক বিজ্ঞানীদের জন্যে আলাদা চেম্বার আর মিনি ল্যাবরেটরির সুন্দর ব্যবস্থা দেখে। যাকে একেবারে, “স্টেট-অব-আর্ট ল্যাবরেটরি” বলা চলে। ফোটন এমিসন মাইক্রোস্কোপ, স্ক্যানার, বিওডি ইনকিউবেটার, স্যাম্পেল কালেক্ট করার ক্রায়ো-চেম্বার কী নেই সেখানে, একটা পোর্টেবল কেমিস্ট্রি ল্যাব-কিটও আছে! সাবমেরিনকে খুব ধীরে ধীরে নীচে নামানো হচ্ছিল। সাবমেরিনের ঠিক মাঝের চেম্বারে মিটিং লাউঞ্জ আছে, সেখানে বিশাল স্ক্রিনে সমুদ্রের নীচের ছবি লাইভ দেখা যায়, সঙ্গে কতটা নীচে সাবমেরিন নামছে তা সব সময় ক্যাল্কুলেট করা হচ্ছে। সব কাজ বুঝে নিতে প্রায় ঘণ্টাসাতেক লাগল। ঠিক হল, আজ বিশ্রাম নিয়ে কাল থেকে এক্সপিডিশানের কাজ শুরু হবে। সাবমেরিনের গতিবেগ কমিয়ে দিয়ে তাকে প্রায় স্থির অবস্থায় রাখা হল। টুইইলাইট জোন ছাড়িয়ে, প্রায় তিনশো মিটার নীচে সাবমেরিন নেমেছে। কিছু আগেও জলে হালকা আলোর আভা ছিল, এখন একেবারে অন্ধকার। সাবমেরিনের হাই পাওয়ার এলইডি সার্চলাইট চারপাশে পয়েন্ট করা আছে, তার জোরালো আলোতে মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে মাছের ঝাঁক, কয়েকটা গামি শার্ক আর কক্কাটো স্কুইড চোখে পড়ল। জলের তাপমাত্রা বেশ কমে আসছে দেখলাম, সাত ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। জলের এতটা গভীরে এ যেন এক আলাদা রহস্যময় জগৎ! মানুষ এখানে শুধু দর্শক মাত্র…
নিজের চেম্বারে ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ ইন্টারকম প্যানেলে থাকা ফোন বেজে উঠল। ঘুম চোখে ফোন নিয়ে হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে প্রফেসর ওসাকার উত্তেজিত স্বর ভেসে এল।
‘সেনগুপ্ত! তাড়াতাড়ি লাউঞ্জে একটা ব্যাপার দেখবে এসো, ভেরি ইন্টারেস্টিং।’ লাউঞ্জে ছুটলাম। গিয়ে দেখি সবাই জড়ো হয়ে উত্তেজিত হয়ে কী বলাবলি করছে। মনিটর স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। প্রায় মিডনাইট জোনে সাবমেরিন নেমে এসেছে, চারপাশে নিকষ কালো অন্ধকার থাকার কথা, কিন্তু তার বদলে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র নীল আলো! কিন্তু, কোথা থেকে আসছে এই আলো? প্রথমে মনে হোল এটা হয়তো “বায়োলুমিনেসেন্স” এর ঘটনা, মানে কোনও কোনও সামুদ্রিক প্রাণীর শরীরে বাস করে আলো ছড়ানো বিশেষ মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া, ফলে সেই সামুদ্রিক প্রাণীরা যেখানে থাকে সেই স্থান আলোকিত হয়ে ওঠে। কথাটা জেসনকে বললাম। সে জানাল এই যুক্তি আগেই সবার মনে এসেছিল, কিন্তু সাবমেরিনের রেয়ার, লোয়ার আর ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনও বায়োলুমিনেসেন্স প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়নি, যার থেকে এমন তীব্র আলো বার হতে পারে। লক্ষ করলাম নীলচে আলোর তীব্রতা স্থির নয়, কখনও বাড়ছে আবার কখনও কমে যাচ্ছে। সত্যি, ব্যাপারটা যথেষ্ট রহস্যজনক!
উইলমার, প্রফেসর ওসাকা আর ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলে আমরা স্থির করলাম, এই অদ্ভুত জায়গায় সাবমেরিনকে নীচে নামিয়ে ব্যাপারটা স্টাডি করা হোক। সেই মতো, হিসেব কষে সাবমেরিনকে নামানো হতে লাগল। সবমেরিনের লোয়ার প্যানেল থেকে জোরাল সার্চ লাইট গভীর অন্ধকার ভেদ করে নীচে নেমে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে ইল মাছের ঝাঁক আর স্কুইডের দল আলোকস্তম্ভ ভেদ করে চলে যাচ্ছে। যতটা নামছি, ততই নীল আলো আরও জোরাল হচ্ছে। প্রায় পনেরোশো মিটার নামার পর সাবমেরিনের সেন্সর আমাদের জানিয়ে দিল সামনে মাটি আছে। আমাদের সবার ভ্রু কিছুটা কুঞ্চিত হল। মাত্র পনেরোশো মিটারে সমুদ্রতল আসার কথা নয়, তাহলে ব্যাপারটা কী? আর কিছুটা নামার পর হঠাৎ সেন্সর বিপদ সঙ্কেত দিতে লাগল! আমরা মনিটরকে জুম করে ভালো করে এই অদ্ভুত “সমুদ্রপৃষ্ঠ”কে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। আরও প্রায় বিশ মিটার নামার পরেই মনিটরে আমরা যা দেখলাম তাতে আমাদের সবার মুখ থেকে বিস্ময়সূচক শব্দ বার হয়ে পড়ল। এই সমুদ্রতলের মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য গভীর খাত, আর সেইখান থেকে বার হচ্ছে তীব্র নীলচে আলো আর ধোঁয়া! ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্যে নীচে নামা দরকার, একটা ছোট মিটিং করে স্থির করলাম, আমি জেসন আর উইলমার নামব সমুদ্রতলে, আর প্রফেসর ওসাকা থাকবেন মনিটরে। সেখান থেকে তিনি আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠাবেন।
সাবমেরিনের রবোটিক সিস্টেম অ্যাকটিভেট করা হল। ছয় দিক থেকে নেমে এল অটোম্যাটিক হাইড্রোলিক ম্যানিপুলেটর আর্ম। সজোরে গেঁথে গেল মাটিতে আর সাবমেরিন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল। আমরা ডুবুরির পোশাক পরার চেম্বারে ঢুকলাম। উইলমার আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘প্রফেসর, তোমার সঙ্গে একটা প্রয়োজনীয় কথা আছে।’ আমি তার দিয়ে অবাক হয়ে চাইলাম। উইলমার বলল, ‘শোন, তুমি আমার গবেষণার বিষয় জান। উচ্চ তাপমাত্রা প্রতিরোধ করতে পারে, এমন এক মেটিরিয়াল আমি আবিষ্কার করেছি। সেই মেটিরিয়ালের ডুবুরির পোশাক আমার কাছে আছে। প্রায় সাতশো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা সহ্য করে এই পোশাক। আমার নিজের মন বলছে, এই অদ্ভুত এবং অজানা সমুদ্রতল আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়। আমার অনুরোধ, এই পোশাক পরে জলে নামো সূর্যশেখর। আমি জানি, আমার কথা তোমার কাছে হয়তো অদ্ভুত ঠেকছে, কিন্তু বিশ্বাস করো, অনেক অভিজ্ঞতার ফলে এই কথা তোমায় বলছি।’ সত্যি বলতে কি, উইলমারের প্রস্তাব আমার কাছে আশ্চর্য লাগছিল। তবু কথা না বাড়িয়ে, উইলমারের সঙ্গে আমি আর জেসন সেই বিশেষ পোশাক পরে নিলাম। তার ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই অটোম্যাটিক এলিভেটর আমাদের সাবমেরিন থেকে সমুদ্রতলে নামিয়ে দিল।’ প্রফেসর থামলেন।
‘আপনার বর্ণনার ডিটেলিং খুব ভালো প্রফেসর, যেন ঘটনা… নাকি দুর্ঘটনা বলব, তার সঙ্গে নিজে একাত্ম হয়ে যাচ্ছি।’ ড. দীপেশ নোট নিতে নিতে বললেন। ‘এর পর কী ঘটেছিল প্রফেসর?’
সূর্যশেখর একটু চুপ থেকে বললেন, ‘এর পরের ঘটনা ভয়াবহ ও আকস্মিক। বেঁচে গিয়ে ঈশ্বরকে যে কতবার ধন্যবাদ দিয়েছি… আর সঙ্গে উইলমারকে… বেচারা এখনও হয়তো সংজ্ঞাহীন, কিন্তু তার গবেষণার তুলনা হয় না। যাই হোক, এলিভেটর থেকে আমরা নেমে সমুদ্রতলে পা দিলাম। কিছুটা দূরেই নীলচে আলোর একটা খাত দেখা যাচ্ছে। জেসন ওয়াটার আর সি-ফ্লোরের সয়েল স্যাম্পেল চেক করছিল। আমি একটা ব্যাপার অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলাম, এই অঞ্চল বা তার চারপাশের মাটিতে কোনও প্রাণী বা উদ্ভিদের চিহ্নমাত্র নেই। ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। সাধারণত, প্যাসিফিক সি-ফ্লোরে নানা প্রজাতির কোরাল, সি-অ্যানিমন, সি-আর্চিন, হারমিট ক্র্যাব পাওয়া যায়। এখানে শুধুই কাঁকরের ঢেলার মতো কালচে পাথর বিছিয়ে রয়েছে, জলের তরঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে তারা এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছে। মজার কথা, নুড়ি-পাথরগুলো সবই গোলাকৃতি, গায়ে অসংখ্য ফুটো। ভালো করে দেখার জন্যে কয়েকটা সংগ্রহ করলাম। আমাদের পোশাক বিশেষভাবে তৈরি। অনেকটা স্পেসস্যুটের মতো। এতটা গভীরে জলের প্রেশার অনেক, তা অনায়াসে সহ্য করে এই পোশাক। কানের মাইক্রোফোনে জেসনের আওয়াজ পেলাম। ‘প্রফেসর, মাটিতে প্রচুর সালফার আর এখানকার জল ভীষণ অ্যাসিডিক। শুধু তাই নয়, জলের তাপমাত্রা বেশ বেশি, প্রায় চল্লিশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড!’ শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কয়েকটা শব্দ মাথায় ঘোরাফেরা করতে লাগলো, নীলচে আলোর খাত… গোলাকার পাথর… সালফার… গরম জলের স্রোত… মাথাটা ঘুরে উঠল। নিশ্চিত এক আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। টেলিপ্যাথি কিনা জানি না, ঠিক এই সময়েই প্রফেসর ওসাকার গলা মাইক্রোফোনে পেলাম। রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে, প্রফেসর বললেন, ‘সূর্যশেখর! শিগগিরি জেসন আর উইলমারকে নিয়ে সাবমেরিনে ফিরে এসো, বেশি সময় নেই… আমরা আনআইডেন্টিফাইড হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে চলে এসেছি, তোমার…’ কথা শেষ হতে না হতেই আমাদের পায়ের নীচে মাটি দুলে উঠল, তারপর ক্রমাগত কাঁপতে থাকল! আচমকা কিছুটা দূরেই সামনের মাটি ভেদ করে নিঃশব্দে লাফিয়ে উঠল লালচে আগুনের শিখা, জলের ভিতর যেন ঝড় শুরু হল… সামনে সব ঘোলা, বালি আর পাথরের কুচি ছিটকে পড়তে লাগল আমাদের পোশাকে। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, এলোমেলো স্রোতের অভিঘাতে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। মাটি ভয়ঙ্কর কাঁপছে, শরীরের নীচ দিয়ে উদ্দাম স্রোতের মতো নুড়িপাথর চলে যাচ্ছে। শরীরের কোনও ভারসাম্য নেই, অক্সিজেন টিউব বোধহয় ছিঁড়ে গেছে, নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে খুব… আবছায়া ডিজিটাল ক্লকে জলের তাপমাত্রা দেখলাম, ৭৭ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড! নিশ্চিত মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম। বুঝতে পেরেছিলাম আমরা ডুবন্ত আগ্নেয়গিরির খুব কাছে চলে এসেছিলাম… যা এখনও সক্রিয়! সমুদ্রগর্ভে ফুটন্ত লাভার ফোয়ারা ছুটছে মাটির বুক চিরে, তৈরি করছে গিরিখাত, গরম কালচে-নীল ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে চারপাশ… স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে চেতনা… এই সময় একটা শক্ত হাত আমার কাঁধ চেপে ধরল।
অর্ধ-অচেতন অবস্থায় আমাকে উইলমার উদ্ধার করে। জেসন সাবমেরিনের কাছে থাকায় তার বিশেষ ক্ষতি হয়নি। বড় পাথরের ধাক্কায় উইলমারের পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়। সেই অবস্থাতেই গরম, ঝোড়ো স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে সে আমাকে খুঁজে পায়। ভাগ্যক্রমে, আমাদের ট্র্যাক করে সাবমেরিন কিছুটা এগিয়ে আসে। পিউমাইস স্টোনের স্তূপের নীচে আমাদের অচেতন দেহ দুটি তারা উদ্ধার করে।
আমার কপালে বড় চোট ছিল। সাবমেরিনে জ্ঞান হবার পর মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। সমুদ্রতলের সেই অগ্ন্যুৎপাতজনিত বিস্ফোরণে সাবমেরিনের বেশ কিছুটা ক্ষতি হয়। টেম্পারেচার সেন্সার কাজ করছিল না, দুটো বড় অক্সিজেন জেনারেটর বিকল হয়ে যায়। সেই অবস্থাতেই আমরা নর্থ-ইস্ট কোস্টের দিকে প্রায় ঘণ্টায় চল্লিশ কিলোমিটার গতিবেগে সাবমেরিন চালাতে থাকি। পিছনে ফেলে আসি অজানা আগ্নেয়গিরির ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতকে। সঙ্গে মাঝে মাঝেই প্রবল ভূমিকম্পে জলস্তর ভীষণভাবে কেঁপে উঠছিল। বেশ কিছুটা উপরে উঠে এলেও মনিটরে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, সমুদ্রতল থেকে ডুবন্ত আগ্নেয়গিরি ক্রমাগত উগরে চলেছে লাল জ্বলন্ত লাভাস্রোত, জলের সংস্পর্শে আসা মাত্র তীব্র বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে সৃষ্টি করছে ঘন কালচে ধোঁয়ার কুণ্ডলী! এই সক্রিয় আগ্নেয়গিরি থেকে তৈরি হয়েছে বহু খাত-অনেক হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট, তার থেকে বার হয়ে আসছে কালচে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। জলের নীচে মাইলের পর মাইল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেই ঘন ধোঁয়ার মেঘ… সাবমেরিনে থাকা কিছু বিজ্ঞানী এই রহস্যময়, বিরল প্রাকৃতিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল।
সীমিত অক্সিজেনে, ভয়ে আর যন্ত্রণায় প্রায় বারো ঘণ্টা আমাদের সবাইকে কাটাতে হয়েছিল। নিউজিল্যান্ডের ওশেনোগ্রাফি ইন্সিটিউটের সঙ্গে বার বার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। উইলমারকে হাইডোজ পেইনকিলার আর সিডেটিভ দিয়ে রাখা হয়েছিল। আমরা খুবই চিন্তিত ছিলাম। আমাদের লোকেশানের স্যাটেলাইট ইমেজিং আমরা আরও সাতটা কোস্টাল জিওথার্মাল রিসার্চ অর্গানাইজেশানকে পাঠানোর চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। সিসমোগ্রাফের রেখা দেখে বোঝা যাচ্ছিল প্রবল ভূমিকম্প ঘটে যাচ্ছে চারপাশে! সেই চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে, ২৬ মার্চ, আন্দাজ রাত একটা নাগাদ রাউল আইল্যান্ডের প্রায় দশ মাইল দূরে সমুদ্রের উপর আমাদের সাবমেরিন ভেসে ওঠে, বাকিটা আপনার জানা ড. দীপেশ।’ ক্লান্ত গলায় কথা শেষ করলেন প্রফেসর সূর্যশেখর।
বেলা পড়ে আসছে, কেবিনে পিন পড়া স্তব্ধতা। জানলা দিয়ে শহরের জনবহুল রাস্তার দিকে চেয়েছিলেন ড. দীপেশ। বললেন, ‘আশ্চর্য অভিজ্ঞতা আপনার, প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে আপনারা ফিরে এসেছেন। ওকে, আমার রিপোর্ট আমি গভর্নমেন্টকে দেব। একটাই প্রশ্ন, এক্সট্রিমোফাইলের সন্ধান আপনারা শেষ পর্যন্ত কি পেয়েছিলেন? আর ওই নীল আলোর রহস্যটাই বা কী?’
‘জানি না ড. দীপেশ, জলের স্যাম্পেল পরীক্ষা করে পাইনি। ম্যাগমা বা তার চারপাশের পরিবেশে এক্সট্রিমোফাইলের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলে আমার ধারণা। আর, ওই সব হাইড্রোথার্মাল ভেণ্টে অনেক জায়গায় প্রচণ্ড তাপমাত্রায়, লাভায় থাকা খনিজ লবনের বিক্রিয়ায় তৈরি হয় দাহ্য গ্যাস। এক্ষেত্রে হয়তো তা নীল শিখার সৃষ্টি করছিল, তবে গবেষণা ছাড়া তা স্পষ্টভাবে বলা অসম্ভব।’ একটু ভেবে প্রফেসর বললেন, ‘এই প্রোজেক্ট শেষ হয়নি ড. দীপেশ, আমি আবার যাব, এক্সপিডিশান করব মহাসমুদ্রের সেই জায়গায়, দেখব কী রহস্য লুকিয়ে আছে সেখানে।’
(ক্রমশ)
তথ্যসূত্র:
- Coker JA. Recent advances in understanding extremophiles. F1000Res. 2019;8:F1000 Faculty Rev-1917. Published 2019 Nov 13. doi:10.12688/f1000research.20765.1
- Rampelotto PH. Extremophiles and extreme environments. Life (Basel). 2013;3(3):482-485. Published 2013 Aug 7. doi:10.3390/life3030482
- Coker JA. Extremophiles and biotechnology: current uses and prospects. F1000Res. 2016;5:F1000 Faculty Rev-396. Published 2016 Mar 24. doi:10.12688/f1000research.7432.1
- Danovaro R, Canals M, Tangherlini M, Dell’Anno A, Gambi C, Lastras G, Amblas D, Sanchez-Vidal A, Frigola J, Calafat AM, Pedrosa-Pàmies R, Rivera J, Rayo X, Corinaldesi C. A submarine volcanic eruption leads to a novel microbial habitat. Nat Ecol Evol. 2017 Apr 24;1(6):144. doi: 10.1038/s41559-017-0144. Erratum in: Nat Ecol Evol. 2017 May 22;1(6):187. PMID: 28812643.
- Carey R, Soule SA, Manga M, et al. The largest deep-ocean silicic volcanic eruption of the past century. Sci Adv. 2018;4(1):e1701121. Published 2018 Jan 10. doi:10.1126/sciadv.1701121
- Merino N, Aronson HS, Bojanova DP, et al. Living at the Extremes: Extremophiles and the Limits of Life in a Planetary Context [published correction appears in Front Microbiol. 2019 Aug 13;10:1785]. Front Microbiol. 2019;10:780. Published 2019 Apr 15. doi:10.3389/fmicb.2019.00780
- Cavicchioli R. Extremophiles and the search for extraterrestrial life. Astrobiology. 2002 Fall;2(3):281-92. doi: 10.1089/153110702762027862. PMID: 12530238.