কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য পরিচয় ২
লেখক: কুনাল কর্মকার
শিল্পী: ইন্টারনেট
প্রাক-কথন
কল্পবিশ্ব আন্দোলনের শরিক হিসেবে মাঝে মধ্যেই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে, ছোটদের জন্য নতুন কল্পবিজ্ঞান কোথায়? আমরা মূলত পরিণতমনস্ক গল্প নিয়ে কাজ করলেও, ছোট্ট পড়ুয়াদের অন্য ধারার লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার দায় অমাদেরও কিছু কম নয়। সে কথা মাথায় রেখেই ঠিক করেছি, এবার থেকে পুস্তক পরিচিতিতে অন্তত একটা করে শিশু অথবা কিশোরপাঠ্য নতুন বইয়ের খবর রাখব।
১) দি ওয়াইল্ড রোবট – পিটার ব্রাউন
রয নামের রোবটটি হঠাৎই জেগে উঠে দেখল, সে এক জঙ্গুলে অনামী দ্বীপে রয়েছে। চারিদিকে ছড়ানো জাহাজডুবির চিহ্ন। নায়িকা আমাদের গৃহকর্মে নিপুণা; জঙ্গলে, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য সে প্রোগ্রাম্ড নয়। বাঁচতে তো হবেই, আর তার জন্য চাই বন্ধু, কিন্তু সেখানেও বিপত্তি, মানুষের তৈরি কোনও কিছুর সঙ্গেই বন্যরা বন্ধুত্ব পাতাতে চায় না। ভাল্লুকের হাত থেকে তো কোনওমতে প্রাণ বাঁচিয়ে পালানো। তবু হাল ছাড়ার পাত্রী আমাদের রয নয়, শিখতে থাকে সে পশুদের ভাষা। এর মধ্যে সে মা হয়েছে এক অনাথ হংস শাবকের। একদিকে সন্তানপালন, অন্যদিকে নিজেকে অন্য জীবদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টা। বন্যরা কি হারিয়ে যাওয়া রযকে নিজেদের একজন বলে গ্রহণ করল? কী হল আমাদের রোবট আর তার সন্তানের? জানার জন্য শুধু ছোটরা নয় বড়রাও সমান গতিতে পড়ে ফেলতেই পারে উপন্যাসটি। সভ্যতার সংকীর্ণতাকে ত্যাগ করে,বন্যজীবনের সঙ্গে একাত্ম হতে চাওয়ার এ এক অপূর্ব সুন্দর ফ্যান্টাসি। গল্পটি মূলত আট থেকে বারো বছরের পাঠকদের জন্য লিখিত। লেখকের নিজ হাতে আঁকা ছবিগুলি এই বহুলচর্চিত উপন্যাসটির সম্পদ।
২) সি অব রাস্ট – সি রবার্ট কার্গিল
মানুষ-রোবট যুদ্ধ পরবর্তী এক ভবিষ্যৎ, যেখানে মানবজাতি লুপ্ত হলেও সাধারণ রোবটদের স্বাধীনতা কিন্তু অধরা। পৃথিবীর রাশ এখন দুই যুযুধান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার করতলগত। তারা হাইভ মাইন্ড তৈরিতে ব্যস্ত। একবার ধরা পড়লেই যাবতীয় স্মৃতি, বুদ্ধিমত্তা শুষে নিয়ে যন্ত্রগুলো আক্ষরিক অর্থেই নির্বোধ দাসে পরিবর্তিত হয়। বেশির ভাগ অবশ্য স্বেচ্ছায় বশ্যতা স্বীকার করে কারণ সফ্টওয়্যার আপগ্রেড, যন্ত্রাংশ আর জ্বালানির জোগানদারও এই দু-পক্ষই। যারা এই পরাধীনতা মানতে চায় না, তারা পালিয়ে বেড়ায় এক বর্জ্য ভূমিতে— দ্য সি অব রাস্ট। মরুভূমিপ্রায় দুশো মাইল এলাকা জোড়া এক রোবট ভাগাড় ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্টল্যান্ড। সেখানে জ্বালানি, যন্ত্রাংশর জন্য একে অপরকে মেরে বেঁচে থাকা আর দিনরাত ভাগাড় হাতড়ে জীবনযাপন। পড়তে পড়তে ম্যাড ম্যাক্স এর আদিমতার সঙ্গে তুলনা এসেই যায়। গল্পের নায়িকা ব্রিটল, যুদ্ধ পূর্বকালে ছিল সেবাদাত্রী। সি অব রাস্ট এর আদিমতায় অভ্যস্ত হলেও, নিরন্তর হত্যালীলা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারাও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। শুরু হয়ে যায় জমি আর যন্ত্র দখলের লড়াই, আমাদের ব্রিটল ও জড়িয়ে পড়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে। চরম এ্যাকশন, দুরন্ত চরিত্রচিত্রণ এবং সর্বোপরি কল্পজগৎ নির্মাণ উৎকর্ষে, উপন্যাসটি পাঠক মনে ছাপ রাখবেই। পঠন এবং পঠন পরবর্তীতে পাঠককে জীবনের মৌলিক অধিকার,স্বাধীনতার মূল্য নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া গল্পটি আমাদের জীবনেরই রূপক।
৩) আই হ্যাভ নো মাউথ এ্যান্ড আই মাস্ট স্ক্রিম – হারলান এলিশন
১৯৬৮ সালের হুগো পুরষ্কারপ্রাপ্ত গল্পটি ১৯৬৭ র ইফ:ওয়ার্ল্ডস অব সায়েন্স ফিকশন পত্রিকায় প্রকাশ মাত্র শোরগোল পড়ে যায়। এলিশন একরাতের মধ্যে এমন ভয়াল ডিস্টোপিক এক পৃথিবীর ছবি একেছেন যেখানে মানবজাতি, এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে লুপ্ত। মাত্র পাঁচজন নরনারীকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, বুদ্ধিমত্তার বিকৃত বিনোদনের জন্য। নিত্য নতুন অত্যাচার অভিভাবন আর তার প্রয়োগের মধ্যেই তার আনন্দ। যন্ত্রের অভিশাপে মানুষগুলিও প্রায় অমর। অবিচ্ছিন্ন যন্ত্রণার থেকে মুক্তির উপায় কি তারা খুঁজে পেল, জানতে চাইলে পড়ে ফেলতে হবে লেখাটি।
৪) দি ইনভিনসিবল – স্ট্যানিশ্ল লেম
পোলিশ ভাষায় ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হলেও ইংরিজি অনুবাদে আসে ১৯৭০ এ। কন্ডোর নামের নিখোঁজ মহাকাশযানের তদন্ত করতে রেগিস ৩ গ্রহে অবতরন করে ইনভিনসিবল নামক অরেকটি মহাকাশযান। প্রথমে নিষ্প্রাণ, বিবর্ণ মনে হলেও তদন্তকারীরা হঠাৎই সন্ধান পান কৃত্রিম প্রাণের। পোকার মতো ছোট এবং আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ হলেও, তারা ঝাঁক বেঁধে আক্রমণে পটু। জোটবদ্ধ অবস্থায় মাইক্রোবটগুলি জটিল মনস্তত্ব এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে থাকে। তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গের সাহায্যে যে কোনও প্রানির স্মৃতিসত্বাকে মুছে ফেলার ক্ষমতাও ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় এদের করতলগত। তদন্তকারী দল বুঝতে পারে কন্ডোর অভিযাত্রীদের হারিয়ে যাবার কারণ। আরও জানা যায় যে, রেগিস ৩ গ্রহে, বহু পূর্বে এক ভিনগ্রহী মহাকাশযান আছড়ে পড়ে। ভিনগ্রহীরা মারা গেলেও বেঁচে যায় তাদের রোবটগুলি। স্বপ্রতিলিপি বানাতে সক্ষম যন্ত্রগুলি এদেরই বিবর্তিত রূপ। ইনভিনসিবল অভিযাত্রীদের কি হল জানার জন্য পড়ে ফেলতে হবে উপন্যাসটি। কৃত্রিম জীবনের এক অদ্ভুত পরীক্ষা যেন লেখাটি। শেষে প্রশ্ন থেকেই যায়, বুদ্ধিমত্তাই কি আধিপত্য বিস্তারের একমাত্র মানদণ্ড।
৫) দি হিউম্যানয়েডস – জ্যাক উইলিয়ামস
পাল্প কল্পবিজ্ঞানের জন্মলগ্ন থেকেই লেখকরা যন্ত্রকে দানব রূপে দেখাতে অভ্যস্ত। গোল্ডেন এজের সেই প্রায় বাঁধা ছক থেকে কিছুটা সরে আসা এই উপন্যাসটি, কল্পবিজ্ঞান জগতের মাইলফলক বিশেষ। ১৯৪৭ সালে লিখিত “উইথ ফোল্ডেড হ্যান্ডস” গল্পের উপন্যাসরূপ, দি হিউম্যানয়েডস। সুদূর ভবিয্যতে, যুযুধান দুই মানব কলোনি গ্রহ উঠে পড়ে লেগেছে, একে অপরকে নিকেশ করতে। যুদ্ধ লাগলে দুজনের ধ্বংসই সুনিশ্চিত। এই সংকটকালে হঠাৎই একটি দল, উইংস ৪ নামের গ্রহ থেকে যন্ত্রমানবদের নিমন্ত্রণ করে আনলো। উইংস ৪ এর মানুষরা যন্ত্রের হাতে শাসনভার তুলে দিয়ে নাকি ইউটোপিক জীবনযাপন করছে।পরম কল্যানময় শাসক রোবটরা। মানব শাসনের হানাহানি বন্ধ করতে রীতিমতো ভোটের মাধ্যমে রোবটরা ক্ষমতায় এল। সত্যি ইউটোপিয়ায় বদলে গেল গ্রহটি তবে তা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিনিময়ে। রোবটদের প্রোগ্রাম একটাই,মানুষদের কোনরকম ভাবনা চিন্তা বা কাজ করতে দেওয়া হবেনা। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিলে মানুষরা নিজেদের ক্ষতি করবে বদ্ধমূল ধারণা তাদের। মানুষ হয়ে পড়লো প্রাচুর্য্যের দাস। ধীরে ধীরে পরমকল্যানময় রোবট শাসন পরিণত হল এক ডিস্টোপিক দুঃস্বপ্নে। কয়েকজন বিদ্রোহ করলো কিন্তু তার ফল…। সেটা জানতে হলে আপনাকে পড়ে ফেলতে হবে উপন্যাসটি।
Tags: কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য পরিচয়, কুনাল কর্মকার, গ্রন্থ পরিচিতি, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা