সম্পাদকীয়
লেখক: টিম কল্পবিশ্ব
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ছেলেটি জাতে পোলিশ। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সে একটা আশ্চর্য খেলায় মেতে রইত। নকল পাসপোর্ট, সার্টিফিকেট, সরকারি দস্তাবেজ, পরিচয়পত্র— এ সব বানিয়ে ভারী আনন্দ হত তার। এ সব জিনিসপত্র নিয়ে সে এমন দেশে ঘুরতে যাবার কথা ভাবত, যেখানকার ঠিকানা বাস্তবের কোনও ম্যাপে খুঁজে পাওয়া কঠিন। বহু বছর পরে নাজিরা যখন পোল্যান্ডের দখল নিল, পরিবার পরিজনদের সঙ্গে সে ছোকরা দেশ ছেড়ে পালাল। শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে, নিজেদের পরিচয় লুকোতে তখনও তাঁর অস্ত্র ছিল নকল দলিল, দস্তাবেজ আর ভুয়ো পরিচয়পত্র। শিশুর নিষ্পাপ খেলাই যেন ভবিতব্যের হাতে রূপ নিয়েছিল ভয়াল রাজনৈতিক অঘটনে। ছেলেটির নাম স্তানিসোয়াভ লেম (১২ সেপ্টেম্বর ১৯২১ – ২৭ মার্চ ২০০৬)- প্রখ্যাত সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং কল্পবিজ্ঞান শাখার একনিষ্ঠ সাধক ও পথিকৃৎ। বিশ্বে সর্বাধিক পঠিত কল্পবিজ্ঞান লেখকদের তালিকায় একেবারে গোড়ার দিকেই নাম থাকবে তাঁর। ব্যক্তিগত কল্পনা ঘেরা জীবনের সঙ্গে জটিল সামাজিক অভিঘাতের বারে বারে মুখোমুখি হয়ে যাবার এই সত্য আখ্যানই হল তাঁর সাহিত্যের পরিচয়।
কিন্তু আসিমভ, ব্রাডবেরি, ক্লার্কের প্রায় সমকালীন হওয়া সত্ত্বেও বাংলায় লেমের লেখা পড়েছে এমন পাঠকের সংখ্যা হাতে গোনা। এর মূল কারণ হল পোল্যান্ডনিবাসী লেম লিখতেন পোলিশ ভাষায়। বাংলা তো দূরের কথা, লেমের অনেক লেখা ইংরেজিতেও অনুবাদ হয়েছে খুব সম্প্রতি। বাংলাতে লেমের লেখা বললে কারো কারো হয়তো মাথায় আসবে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদকৃত ‘মুখোশ ও মৃগয়া’ বইটির কথা, যা বর্তমানে সহজলভ্য নয়। অথচ লেমের লেখা অনুবাদ করা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ একথা বইমেলায় কল্পবিশ্ব আয়োজিত আলোচনাসভায় বার বার উঠে এসেছে। কল্পবিশ্বের সঙ্গে অনীশ দেবের বহু আলোচনাতেও এই প্রয়োজনীয়তার কথা এসেছে।
২০২১ সালে ছিল লেমের জন্মশতবার্ষিকী। তাই ২০২১ সালেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল এই সংখ্যা প্রকাশের। সেইমতো লেমের লেখাগুলির কপিরাইটের বর্তমান মালিক অর্থাৎ লেম সোসাইটির কাছে অনুমতি চাওয়া হয়। সৌভাগ্যের বিষয় বাংলায় লেমের অনুবাদের বর্তমান অবস্থা জেনে তাঁরা কল্পবিশ্বকে তিনটি গল্প অনুবাদের অনুমতি দেন। এজন্য তাঁদের কাছে আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। দুর্ভাগ্যবশত আবার গোটা দেশ পড়ে মারণরোগ করোনার প্রকোপে, যার থেকে নিস্তার মেলেনি কল্পবিশ্বের সদস্যদেরও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দেখা যায় পুজো আসন্ন। তাই আমরা পুজোর পরবর্তী সংখ্যা হিসেবে ‘স্তানিসোয়াভ লেম শতবার্ষিকী সংখ্যা’টি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। তাই কল্পবিশ্বের এবারের প্রয়াস এই বহুমুখী প্রতিভার কর্মযজ্ঞ নিয়ে আলোচনার পরিসর প্রস্তুত করা। সেই উদ্দেশেই প্রকাশ পেল ‘স্তানিসোয়াভ লেম শতবার্ষিকী সংখ্যা’।
লেমের বিশ্বব্যাপী পাঠকপ্রিয়তার পিছনে অবশ্য ১৯৬১ সালে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘সোলারিস’-এর অবদান অনেকটাই। এই বইয়ের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র আন্দ্রেই টারকোভস্কির ‘সোলারিস’ ১৯৭২ সালে মুক্তির পরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্টিভেন সোডারবার্গের আমেরিকান পুনর্নিমাণটিও সাফল্য পায়। তবে শুধু ‘সোলারিস’ এর সাহায্যে লেমকে বোঝা সম্ভব নয়, লেমের বিদগ্ধ পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবেন তাঁর লেখাগুলি কল্পবিজ্ঞানের সংজ্ঞায়িত সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূর পৌঁছে গেছে।
‘টেকনো ফেয়ারি টেল’ ঘরানার বেশ কিছু কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে তিনি এমন অনেক লেখার জন্ম দিয়েছেন যেখানে মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের সম্পর্ক বিশ্লেষিত হয়েছে পরিবর্তিত জটিল সমাজ, রাজনীতি ও দর্শনের বর্ণালীতে। লেমের সৃষ্ট শহুরে রূপকথাগুলি বর্তমান সভ্যতার সর্বগ্রাসী শাসনের মধ্যে ক্ষয়িষ্ণু মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে ব্যঙ্গের আড়ালে সতর্কীকরণ বলে মনে হয়। Solaris, The Cyberoid, Fiasco, The Invincible, Return from the Stars, Eden, His Master’s Voice, Fable for Robots, Summa Technologiae, Memoirs Found in a Bathtub, The Chain of Chance — তাঁর কয়েকটি প্রখ্যাত সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম। এছাড়া লেম লেখেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবারনেটিক্স, কসমোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, গেম থিওরি, সমাজবিজ্ঞান এবং বিবর্তন নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ, রেডিও নাটক ও চিত্রনাট্য।
লেম মানুষ এবং যন্ত্রের সম্পর্কের উপর রচনা করেছেন মৌলিক দার্শনিক গ্রন্থ ‘Summa Technologiae’, যেখানে তিনি ফ্যান্টোম্যাটিকসের কথা বলেছেন যা বর্তমান পাঠক সহজেই কৃত্রিম বাস্তব বা ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বলে চিনতে পারবে। আজকের দিনে গুগল আর ফেসবুক প্রতিনিয়ত ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করছে আর সেই তথ্যের সাহায্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারকারীকে তার পছন্দমতো জিনিস দেখাচ্ছে— লেমের ‘আরিয়াডনোলজি’ তো এই ভবিষ্যতের কথাই বলে। এছাড়া মেটাভার্সতুল্য কৃত্রিম বিশ্বের সৃষ্টি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের টিওরিং পরীক্ষায় পাস করা— এরকম আরও অনেক কিছুর ধারণা তৈরি করেছিলেন। কাকতালীয়ভাবে এই মাসের গোড়ার দিকেই আমরা খবর পেলাম গুগলের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নাকি সচেতন বা সেন্টিয়েন্ট হয়ে উঠেছে— যদিও গুগল তা অস্বীকার করেছে।
এছাড়া লেম নিয়মিত রীতিমতো ক্ষুরধার ভাষায় যুক্তিযুক্ত সাহিত্য সমালোচনা করতেন— যার ফলে তিনি বহু সমসাময়িক সাহিত্যিকের বিরাগভাজন হয়েছেন, এমনকি এ কারণে ১৯৭৬ সালে সায়েন্স ফিকশন রাইটার্স অফ আমেরিকা তাঁর সাম্মানিক সদস্যপদ বাতিল করে দেয়। আবার লেম অনেকগুলি কাল্পনিক বইয়ের সরস পর্যালোচনা করেছিলেন (যা বলা যেতে পারে জর্জ লুইস বোর্হেস দ্বারা আবিষ্কৃত একটি ধারা) যেখানে তাঁর হাস্যরসবোধের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে। এরকম একটি সাহিত্যকর্ম বর্তমান সংখ্যায় স্থান পেয়েছে, যা সরাসরি পোলিশ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন কামিল সেৎচিন্সকি।
অপরাধ নিয়ে লেমের একটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল, যার ফলস্বরূপ জন্ম নেয় পরীক্ষামূলক গোয়েন্দা উপন্যাস ‘The Chain of Chance’ যেখানে অপরাধীকে খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সমান গুরুত্ব পেয়েছে প্রবাবিলিটি আর ক্যাওস থিওরি।
এই সুবিশাল পরিসরে বিচিত্র সব উপাদান নিয়ে এই বহুমুখী প্রতিভা রেখে গেছেন এক অনন্য সাহিত্যকর্ম, যেখানে বিজ্ঞান ও দর্শন একে অপরের সঙ্গে নিটোলভাবে খাপ খেয়ে গেছে।
এবার বলি এই সংখ্যার লেখাগুলি সম্পর্কে কিছু কথা। আগেই জানিয়েছি রীতিমতো অনুমতি নিয়েই লেমের তিনটি গল্পের অনুবাদ করা হয়েছে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র দেব বর্মন, সায়ক দত্ত চৌধুরী ও কল্পবিশ্বের অন্যতম সম্পাদক সুপ্রিয় দাস। এছাড়া থাকছে লেমের জীবন ও সাহিত্যকীর্তি নিয়ে এক বিশাল রচনা, যা প্রথম প্রকাশ পায় New Yorker পত্রিকায় Paul Grimstad এর লেখনীতে। লেখাটি অনুবাদের সম্মতি দেওয়ার জন্য Paul Grimstad-কে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। ‘অদ্ভুতুড়ে’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘স্তানিসোয়াভ লেম কোনো কমিউনিস্ট সংস্থার নাম নয়’— লেখাটি কিছু সংযোজনের পর এই সংখ্যায় পুনঃপ্রকাশিত হল। পাঠকদের জন্য ইরানের শার্ঘ সংবাদমাধ্যমে দেওয়া লেমের সাক্ষাৎকারটিও অনুবাদ করা হয়েছে।
সবার শেষে ধন্যবাদ জানাবার পালা। এই সংখ্যার মনোরম কভারটি যিনি নিজের হাতে সাজিয়েছেন, সেই উজ্জ্বল ঘোষকে জানাই কল্পবিশ্ব টিমের তরফ থেকে ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা। তা ছাড়াও ধন্যবাদ জানাই তাঁদেরও যাঁদের সাহায্য ছাড়া এতবড় কর্মযজ্ঞ সঠিক সময়ে শেষ করা একেবারেই সম্ভব হত না। সোহম গুহ, বিশ্বদীপ দে, সুদীপ দেব, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, কুণাল কর্মকার ও সৌরভ ঘোষ–— ধন্যবাদ আপনাদেরকেও। অন্যদিকে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, সুমিত বর্ধন, ঋজু গাঙ্গুলি— কল্পবিশ্বের জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের কাছে বটবৃক্ষের মতন আশ্রয় হয়ে উঠেছেন নিজ গুণে। তাঁদের প্রতিও আমরা কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ সে সব পাঠকদের কাছেও যাঁরা আমাদের সমস্ত ঝড়ঝঞ্ঝার মলিন দিনে আশ্বাসের আলো হয়ে দেখা দিয়েছেন ক্ষণে ক্ষণে। আরও অনেক ভালো কাজ করার ক্ষিদেই কল্পবিশ্বকে বাঁচিয়ে রাখবে আগামী দিনে। আপনারা তাই সঙ্গে থাকুন। ভালো থাকুন সবাই মিলে। ধন্যবাদ!
Tags: kalpabiswa y7n1, টিম কল্পবিশ্ব, সম্পাদকীয়