বারো নম্বর সড়কে যা ঘটেছিল
লেখক: জেমস এইচ. শ্মিটস; অনুবাদ: অভিষেক রায় বর্মণ
শিল্পী: দীপ ঘোষ
An Incident on Route 12
James H. Schmitz
পর পর কতকগুলো তীক্ষ্ণ ঠুংঠাং আওয়াজে যখন ফিল গার্ফিল্ডের চটকা ভেঙে গেল, তখন সে ছিল ছোট্ট শহর রেডমন থেকে তিরিশ মাইল দক্ষিণে বারো নম্বর সড়কে। আওয়াজগুলো আসছিল প্যাকার্ডের বনেট থেকে।
তখনই গাড়ির গতি কমতে শুরু করেছে। প্রাণপণে অ্যাক্সিলারেটারটা পিষে ধরেও গার্ফিল্ড যখন মোটর ইঞ্জিন থেকে কোনো সাড়াশব্দ টের পেল না, তখন একটা গা-গুলানো অসহায় ভাব গিলে ফেলল ওকে। খানিক দূরে গড়িয়ে গিয়ে চলচ্ছক্তিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল প্যাকার্ডটা।
ফিল গার্ফিল্ড কাঁপা কাঁপা গলায় গাড়িটাকে খিস্তি করল। ঘড়ি দেখল। তারপর হেডলাইট নিভিয়ে নেমে এল অন্ধকার সড়কে। মাত্র আধঘণ্টা দেরি হলেও সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। মাঝরাত ফুরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে, এখনও একশো দশ মাইল পথ পেরিয়ে তাকে পৌঁছতে হবে একটা ছোটো প্রাইভেট এয়ারফিল্ডে, যেখানে ম্যাজ অপেক্ষা করছে তার জন্য, আর প্যাকার্ডের সামনের গদিতে রাখা সুটকেসবন্দি তিরিশ হাজার ডলারের জন্য।
যদি সে দিনের আলো ফোটার আগে পৌঁছতে না পারে…
ব্যাঙ্কের পাহারাদারটার কথা মনে পড়ল। লোকটা অযথা আগ বাড়িয়ে হিরো সাজতে গিয়ে একটা কাঁচা কাজ করল, তার জন্য ওই মাথামোটা মহিলা গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে এসে পড়ল তাদের গুলির ঝাঁকের সামনে। লাশ পড়ল একজনের। হয়তো বা দুজনের। খবরের কাগজের সান্ধ্য সংস্করণ পড়ার জন্য গার্ফিল্ড আর দাঁড়ায়নি।
তবে এটা সে জানত যে তার পিছনে ফেউ লেগেছে।
একঝলকে সে রাস্তার দু-পাশ দেখে নিল। এইমুহূর্তে দ্বিতীয় কোনো হেডলাইট নজরে পড়ছে না, জংলা পাহাড়ের ওপরে দেখা যাচ্ছে না কোনো বাড়ির আলো। গাড়ির কাছে ফিরে গিয়ে সে বের করল সুটকেসটা, সঙ্গে তার বন্দুক, একটা পেল্লাই টর্চ আর কার্তুজে ঠাসা একটা বাক্স যেটা সুটকেসের পাশে দাঁড় করানো ছিল। বাক্সটা ভেঙেচুরে তার ভেতর থেকে বের করে আনল একমুঠো কার্তুজ, সেগুলো পয়েন্ট থ্রি এইট-টার সঙ্গে ঢুকিয়ে নিল কোটপকেটের মধ্যে; তারপর একহাতে সুটকেস ও আরেক হাতে টর্চ নিয়ে চলে এল রাস্তার ডান দিকের কিনারায়, সেখানে সবশুদ্ধ নামিয়ে রাখল।
গাড়ির বনেটে কলকব্জা নাড়িয়ে খুব একটা লাভ হবে না। কলকব্জা সারানোর কারবারে গার্ফিল্ড যে একেবারে ঠুঁটো জগন্নাথ, সেটা তার ভালো করেই জানা। গাড়িটা এখন তার কাছে পয়মাল হয়ে গেছে… কেবল যদি ওটাকে টোপ হিসেবে কাজে লাগানো যায়।
টোপ হিসেবে ওটা বেশ ভালোই কাজে আসতে পারে।
যেখানে দাঁড় করানো আছে সেখানেই ছেড়ে আসবে? উঁহু, গার্ফিল্ড মনে মনে ঠাহর করল। ওর’ম দেখলে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া কোনো গাড়ির ড্রাইভার ভাববে যে সেটা নির্ঘাত একটা লারেলাপ্পা পার্টি, বা বাড়ি পৌঁছনোর আগে খোঁয়ারি কাটানোর মতলবে ঘুমিয়ে পড়া কোনো পাঁড়মাতাল। সে ঘণ্টাখানেক বা তার বেশি কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করতে পারত, কেউ যদি থামে, সেজন্য। কিন্তু হাতে আর সময় নেই। জানলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে সে স্টিয়ারিংটা নিজের দিকে ঘোরালো— আর শরীরের পুরো ওজনটা ঠুসে দিল পিছনের জানলার ফ্রেমে।
রাস্তার উপরে তেরচা কোণ করে প্যাকার্ডটা ধীরে ধীরে পিছু হটতে লাগল। পুরো রাস্তাটায় সে ঘের করল না, তাতে দেখা মাত্রই সন্দেহ জাগতে পারে। বরঞ্চ একটু বেঁকিয়ে রাখল— আলো নেভানো, ভিতরটা ফাঁকা, সামনের দুটো দরজা হাট করে খোলা— কৌতূহলী পথিককে আমন্ত্রণ জানানোর ভঙ্গিতে।
গার্ফিল্ড সুটকেস আর টর্চ হাতে করে রাস্তার ডান দিক ধরে হেঁটে গেল। রাস্তার কিনার পেরিয়ে ঢালু জমি বেয়ে উঠে গেল গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে। সুটকেসটা ঝোপের আড়ালে রেখে বের করে আনল পয়েন্ট থ্রি এইট-টা, খুলে ফেলল সেফটি ক্যাচ। তারপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
মিনিট দশেক পরে, একজোড়া হেডলাইট ধেয়ে আসছিল বারো নম্বর সড়কের ওপর দিয়ে, রেডমনের দিক থেকে। গায়ের ওপর আলো এসে পড়ার আগেই গার্ফিল্ড হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। গাছপালা তাকে আগাগোড়া চোখের আড়াল করে রেখেছে।
গাড়িটা যত এগিয়ে আসছিল ততই তার গতি কমছিল, নিথর প্যাকার্ড-টা থেকে আন্দাজ ষাট ফিট দূরে এসে সেটা ব্রেক কষল। গাড়ির ভেতর অনেকজন লোক। কয়েকটা গলার স্বর শুনতে পেল গার্ফিল্ড, তারপর মেয়েলি গলায় খিলখিল হাসি। গাড়ির ড্রাইভার দুবার একটু জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে হর্ন বাজাল— তারপর ধীরগতিতে এগোতে লাগল গাড়িটা। হেডলাইটটা তাকে ছাড়িয়ে চলে যেতেই গার্ফিল্ড ঝোঁপের মধ্যে উঠে দাঁড়াল। দু-পা বাড়িয়ে এগিয়ে এল রাস্তার দিকে। বন্দুকের নল উঁচিয়ে।
আর ঠিক তখনই তার নজরে পড়ল রেডমনের দিক থেকে আসা আরেকজোড়া হেডলাইটের ক্ষীণ আলো। অগত্যা চাপা গলায় গজগজ করতে করতে সে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। সামনের গাড়িটা প্যাকার্ডের কাছে এসে অতি সন্তর্পণে গা বাঁচিয়ে পাশ কাটাল, তারপর সশব্দে গতি বাড়িয়ে ছুটে চলে গেল সেখান থেকে।
পিছনের গাড়িটা একশো গজ দূর অবধি এসেই দাঁড়িয়ে পড়েছে, তার আলোর পলকহীন দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে প্যাকার্ড-টা। গার্ফিল্ড শুনতে পাচ্ছে জাঁদরেল মোটরের অনবরত গরগর শব্দ।
মিনিটখানেকের জন্য সব যেমন ছিল তেমনই রইল। তারপর গাড়িটা মসৃণগতিতে গড়িয়ে এল, গার্ফিল্ডের বাঁ-হাতায়— মোটে তিরিশ ফিট দূরে এসে— আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। ও এখন ঝোপের পর্দার আড়াল থেকে ওটাকে দেখতে পাচ্ছে— জব্বর গাড়ি— লম্বা নিচু চার-দরজা-ওয়ালা সেডান। মোটরটা ক্রমাগত চাপা গলায় গরগর করছে। একমুহূর্ত পরে, গাড়ির ওপাশে একটা দরজা খুলে গেল, তারপর সশব্দে বন্ধ হল।
একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে এল হেডলাইটের ছড়িয়ে পড়া আলোর মধ্যে, তারপর এগোতে লাগল প্যাকার্ডটার দিকে।
এতক্ষণ ফিল গার্ফিল্ড উবু হয়ে বসেছিল, এবার সে উঠে দাঁড়াল, পয়েন্ট থ্রি এইট-টা তার ডান হাতে। বাঁ-হাতে টর্চ। ড্রাইভারের সঙ্গে যদি কেউ না থাকে, ও যদি একা হয়, তাহলে তো কেল্লা ফতে! কিন্তু যদি অন্য কেউ থাকে গাড়ির মধ্যে, চটপট ঠান্ডা মাথায় কাজ সারতে পারে এমন কেউ, তাহলে পরের দশ সেকেন্ডে একটা সামান্য ভুলের জন্য হাতছাড়া হতে পারে সেডানটা, এবং খুব সম্ভবত তার জীবন আর স্বাধীনতা।
গার্ফিল্ড পয়েন্ট থ্রি এইটটা তাগ করল আগুয়ান লোকটার খুলির ঠিক মাঝখানে। রাস্তা-বরাবর হেঁটে লোকটা তার উচ্চতায় আসতে সে ধীরে একটি শ্বাস ফেলল, সেই সঙ্গে একটি বার বন্দুকের ঘোড়া টিপল।
ত্বরিতে লোকটা পাক খেয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তার ঢাল বেয়ে। গুলিটা তাকে আড়াআড়িভাবে পেভমেন্টের দিকে ছুড়ে ফেলেছে। তার পাশ কাটিয়ে তিরগতিতে বাঁ দিকে ছুটে গেল গার্ফিল্ড। ডিঙিয়ে গেল হেডলাইটের আলো, তারপর আবার রাস্তার ওই কিনারে অন্ধকারের মধ্যে এসে পড়ল। গাড়িটার দিকে ছুটে যেতে যেতে সে খচ করে টর্চের আলো জ্বালালো।
মোটর-ইঞ্জিনটা সমানে মৃদু স্বরে গুনগুনিয়ে চলেছে। টর্চের আলোয় দেখা গেল সামনের আসনগুলো ফাঁকা। গার্ফিল্ড আলো নিভিয়ে দিল। ঠেলা মেরে একে একে খুলে ফেলল দুটো দরজা৷ বন্দুকটা তাগ করা গাড়ির ভিতরে। কিছুক্ষণ চুপচাপ নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে, দুর্বল লাগল তার, হঠাৎ উদ্বেগ কেটে যাওয়ার স্বস্তিতে কেমন ঘোর এসে গেল।
গাড়ির ভিতরে কেউ নেই— সেডানটা এখন তার হাতের মুঠোয়।
যে লোকটাকে গুলি করেছিল, সে এখন রাস্তার ওপর মুখ গুঁজে পড়ে, তার মাথার টুপি ছিটকে গেছে বারো ফিট দূরে। বারো নম্বর সড়ক তখন আঁধারঘন নৈশব্দের মধ্যে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে রয়েছে। অন্য কেউ চলে আসার আগে নিশ্চয়ই হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে কাজটা গুছিয়ে সেরে ফেলার মতো। গার্ফিল্ড সুটকেসটা নামিয়ে এনে রাখল সেডানের সামনের সিটে, তারপর খুন হওয়া লোকটাকে রাস্তা থেকে দূরে সবার চোখের আড়ালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগুয়ান হল৷ তার টুপিখানা ছুড়ে দিল ঝোপের মধ্যে, তারপর নিচু হয়ে গোড়ালি দুটো ধরে, টেনে নিয়ে গেল বাঁ দিকে, যেখানে রাস্তার কিনারা থেকে জমিটা হঠাৎ খাড়া নীচে নেমে গেছে।
এমন সময়ে লাশটা একটা তীক্ষ্ণ কোঁকানির শব্দ করে অস্বাভাবিক জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।
ভয়ে হিম হয়ে গিয়ে গার্ফিল্ড রাস্তার ওপরে ছুড়ে ফেলে দিল ঠ্যাং দুটো, তারপর এক পা পিছিয়ে গিয়ে ঝটপট পকেট থেকে বন্দুকটা বের করে হাতে নিল। কর্কশ কোঁকানোর শব্দটা আরো তীব্র হয়ে উঠছে, তার সঙ্গে গুলি-খাওয়া লোকটা দ্রুত দুবার ঝটকা দিল বঁড়শি-গেলা মাছের মতো, অমানুষিক শক্তিতে হাত পা আছড়াতে লাগল। খচ করে সেফটি খুলে গার্ফিল্ড পরপর তিনবার গুলি করল লোকটার পিঠে।
তৎক্ষণাৎ সেই হাড়-হিম-করা আর্তনাদ থেমে গেল। লাশটা দু-একবার ঝাঁকুনি দিল, তারপর পড়ে রইল নিথর হয়ে।
গার্ফিল্ড আবার বন্দুকটা পকেটে ভরল। বলা-নেই-কওয়া-নেই এরকম একটা ব্যাগড়া এসে পড়ায় সে একটু ভেবলে গেছে, তার হাত দুটো কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেল অজ্ঞাতপরিচয় লোকটার পা লক্ষ করে। পরমুহূর্তেই সে একঝটকায় দু-হাত পিছিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল— ভয়ে তার চোখের পলক পড়ছিল না।
লোকটার বুকের পাশে, ডান হাতের কয়েক ইঞ্চি নিচে থেকে কালো মোটা লাঠির মতো কী একটা জিনিস, প্রায় তিন ফিট লম্বা, কোটের কাপড় ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে।
গাড়ির আলোয় সেটার ভিজে গা-টা চকচক করছে। প্রথমবার দেখে গার্ফিল্ড কিছু ঠাহর করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু সেটার চেহারায় কিছু একটা ছিল, যার জন্য গার্ফিল্ডের গলা অবধি গয়ের উঠে এল। লাঠিটা মাঝখান থেকে বেঁকে একটা সূক্ষ্ম কোণ তৈরি করে নেমে গেছে, তার ডগাটা তিন ভাগ হয়ে গিয়ে তিনটে ভোঁতা নখের আকার নিল; তারপর পেভমেন্টের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে খামচাখামচি করে এগোতে লাগল। খুব ক্ষীণভাবে আবার সেই কোঁকানির শব্দটা চাগাড় দিচ্ছে, শরীরটা বেঁকে যাচ্ছে ধনুকের মতো, যেন তার পিঠ থেকে আরেকটা লাঠি-সদৃশ হাত বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আতঙ্কে বিবশ হয়ে গার্ফিল্ড পরের কাজটা করল৷ প্রায় অচেতনভাবেই পয়েন্ট থ্রি এইটের সবকটা গুলি ঝেড়ে দিল পায়ের কাছে পড়ে থাকা ওটা-কে লক্ষ করে। তারপর, বন্দুকটা ফেলে দিয়ে, গোড়ালিদুটোর একটাকে জাপটে ধরে দৌড়ে পিছিয়ে এল রাস্তার ধারে, লাশটাকে টেনে হিঁচড়ে।
রাস্তার কিনারে জমাট অন্ধকারের মধ্যে সেটাকে ছেড়ে দিল। তারপর ওপাশে হেঁটে গিয়ে খ্যাপার মতো দুটো লাথি কষিয়ে লাশটাকে ফেলে দিল খাদের গভীরে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে শব্দ এল লাশ গড়িয়ে যাওয়ার— তারপর থেমে গেল। পিছু ফিরে সে দৌড় দিল সেডান-টা লক্ষ করে, যেতে যেতে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিল তার বন্দুক। হুড়মুড় করে ড্রাইভারের সিটে বসে গাড়ির দরজাটা কষে লাগিয়ে দিল।
স্টিয়ারিং হুইলের ওপর থরথর করে কাঁপছিল হাতদুটো। অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিতে মোটর ইঞ্জিনটা গর্জন করে প্রাণ ফিরে পেল। অতিকায় গাড়িটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে৷ ভয়াবহ আতঙ্কে গলা ফাটিয়ে শাপশাপান্ত করতে করতে সে প্যাকার্ডটাকে পাশ কাটাল, তারপর অ্যাক্সিলারেটর পিষে ধরে তড়িৎগতিতে ছুটে গেল বারো নম্বর সড়ক ধরে। তার দু-পাশে এবং পিছনে, ধাওয়া করছিল নিকষ অন্ধকার।
কী ছিল ওটা? সাদা চোখে যাকে দেখলে দিব্যি মানুষ বলে মনে হয়— তাকে পরিধেয় বস্ত্রের মতো ব্যবহার করে, হাঁটাচলা করে মানুষের মতোই, গাড়ি চালায়— অথচ যার নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরশোলার মতো!
থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে গার্ফিল্ড দম নিল। একটা মোড়ের মাথায় এসে টার্ন নেবার জন্য যেই গাড়ির গতি কমিয়েছে, অমনি সামনের আয়নায় একটা লাল আলোর ঝলকানি চোখে পড়ল তার।
একমুহূর্তকাল আলোর দিকে চেয়ে থাকার পর সে ব্রেক কষল, তারপর জানলার কাচ নামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখল।
পিছনে অনেক দূরে, বারো নম্বর সড়কের ওপরে এক জায়গায় আগুন ধরেছে। মোটামুটি সেই জায়গাটায়, যেখানে প্যাকার্ড-টা দাঁড় করানো ছিল— যেখানে রাস্তা থেকে কিছু একটা গড়িয়ে পড়েছিল ঝোপঝাড়ের মধ্যে।
কিছু একটা— গার্ফিল্ড দুয়ে দুয়ে চার করল— যা কিনা মৃত্যু উপস্থিত হলে স্বয়ংক্রিয় আত্মাহুতি বেছে নেয়, নিজে-নিজেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যাতে তার সমস্ত রহস্য চিরকাল অনাবৃত থাকে।
যদিও তার কাছে এই আগুন মানে এক দুঃস্বপ্নের অবসান। জানলার কাচ তুলে একটা সিগারেট ধরাল গার্ফিল্ড, তারপর অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিল…
অবিশ্বাস্য আতঙ্কে সে টের পেল যে গাড়ির সামনেটা ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, রাস্তা পেরিয়ে হেডলাইটের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে গাছের গায়। পরক্ষণে আলোগুলো নিভে গেল। উইন্ডশিল্ডের ওপারে, কালো কালো গাছের ডালপালা ভেসে এল তার দিকে— আরো ওপরে, রাতের আকাশ। ক্ষিপ্রগতিতে দরজার হাতলটা লক্ষ করে হাত বাড়াতে গেল সে।
চুপিসারে একটা লৌহ সাঁড়াশি এসে তার দুই বাহু জাপটে ধরল, তারপর দু-দিকে টানটান করে ধরে বন্ধ করে দিল তাদের নড়াচড়া। একবার ঢোঁক গিলে আয়নার দিকে চাইল গার্ফিল্ড, আর দেখল যে গাড়ির পিছন থেকে তার ওপর নজর রাখছে দুটো আধো-উজ্জ্বল লাল চোখ। তারা সংখ্যায় দুটো… দ্বিতীয়টা তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে তাকে ধরে রেখেছে। এতক্ষণ— তারা যেটাকে ট্রাঙ্ক কম্পার্টমেন্ট বলে— সেখানে ঘাপটি মেরে বসেছিল। আর এখন বেরিয়ে এসেছে।
আয়নায় দেখা চোখ দুটো অদৃশ্য হয়ে গেছে। একটা স্যাঁতসেঁতে, কালো আরশোলার মতো ঠ্যাং গার্ফিল্ডের পাশের সিটটা ডিঙিয়ে এসে তার ফেলে দেওয়া সিগারেটখানা কুড়িয়ে নিয়ে যেভাবে নেভাল, সেই কায়দাটা অবিকল মানুষের মতো, এবং বীভৎস। গার্ফিল্ডের বন্দুকটা তুলে নেওয়ার পরে সেটা চোখের আড়ালে চলে গেল।
সে ভেবেছিল গুলি চলবে, কিন্তু চলল না।
কেউ গুলি চালিয়ে নিজের পরণের কাপড় নষ্ট করে না…
এটা মগজে ঢোকা মাত্রই তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করল গার্ফিল্ড। কয়েক সেকেন্ড পরেও সে চেঁচাচ্ছিল, যখন উইন্ডশিল্ডের ওপাশে, আকাশভরা তারার মাঝখানে একটা মহাকাশযান এসে হাজির হল।
মূল গল্পটি নেওয়া হয়েছে The Giant Book of Science Fiction Stories (Martin H. Greenberg, Charles G. Waugh & Jenny-Lynn Waugh eds.), Magpie Books (London: 1992) এই সংকলনগ্রন্থ থেকে (p. 277-281)
Tags: James H. Schmitz, kalpabiswa y7n1, science fiction, অভিষেক রায় বর্মণ, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দীপ ঘোষ