দিলবাহাদুরের বাড়ি ফেরা
লেখক: ডিলমন ডিলা; বঙ্গানুবাদ: প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
(ডিলমন ডিলা উগান্ডার একজন কল্পবিজ্ঞান লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। Braveheart’s Homecoming নামে তাঁর এই গল্পটি মিথিলা রিভিউতে প্রকাশিত হয়েছিল)
বনের উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে মনের মধ্যে হাজারো স্মৃতি ভিড় করে এলো। সে ভেবেছিল এতদিনে সব বোধ হয় ভুলে গেছে। কিন্তু একে একে ছবির মতো তার শৈশবের নানা স্মৃতি মনের মধ্যে জেগে উঠল। সব স্মৃতি সুখের নয়। মরে যাওয়া ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই তার বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে এলো। সে অন্যমনষ্ক হয়ে একটা ভুল গিয়ার টেনে ফেলল আর সঙ্গে সঙ্গে তার অ্যারো রিকশা একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করল। সে তাড়াতাড়ি একটা হোভার লিভার টেনে সেটাকে দাঁড় করিয়ে দিল। বনের মাথায় সেটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। যদিও এর কোনো ডানা নেই, কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এর ভিতর থেকে যে শব্দ আসছিল তা অনেকটা পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো। রিকশার ছায়া বনের আন্দোলিত গাছের মাথায় ঢেউয়ের মতো দুলছিল।
সে চোখের জল মুছল। কেন যে তার কান্না পেল বা চোখে জল এলো সে বুঝে পেল না। ইস এখন যদি তার বউ এখানে থাকত আর তার এই কান্না ভেজা মুখ দেখতে পেত। ইস যদি কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটত, যদি তার বউ তাদের মেয়েটা মারা যাওয়ার পর আর একটা শিশুর জন্ম দিত। মেয়েটা মরে গেল একটা রহস্যময় জ্বরে। হাসপাতালে মৃত মেয়ের সামনে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে এক ফোঁটাও জল ছিল না। সঙ্গীতার সেটা ভালো লাগেনি। “তোমার মেয়ের জন্য তোমার চোখে এক ফোঁটাও জল এলো না?” সঙ্গীতা তার হাত ধরে বলেছিল, “তুমি ওকে ভালোবাসতে না?”
সঙ্গীতার পুরুষদের সম্বন্ধে ধারণা অনেকটা বলিউডের থেকে পাওয়া। সে মনে করে পুরুষরা এমনকি সুপারহিরোরাও খুব তুচ্ছ কারণেই কেঁদে ফেলতে পারে। “তোমার মনটা পাথরের মতো, এই জন্য তোমার বাবা-মা তোমার নাম দিলবাহাদুর রেখেছিলেন।” কথার থেকেও কথা বলার তীর্যক ভঙ্গী তাকে অনেক বেশি আহত করেছিল।
এক সপ্তাহ পরে তার গর্ভপাত হয়। দিলবাহাদুরের সন্দেহ সে এটা ইচ্ছে করে করেছে। গর্ভপাত করানোর জন্য সে প্রচুর পেইন কিলার খেয়ে ফেলেছিল। এই কারণে সে বউকে ডিভোর্স দিতে পারত কিন্তু দেয়নি। এক বছর পার হয়ে গেছে। সে জানে তার বউ তার স্বভাবের জন্য তাকে ঘৃণা করে। সে নিজে শুধরানো না পর্যন্ত তার সন্তান সে গর্ভে ধারণ করবে না। এর পর তারা নয়াদিল্লি ছেড়ে কেরালায় চলে গিয়েছিল। সেখানে একটা মিষ্টির দোকানের মালিক হিসেবে সে নতুন জীবন শুরু করেছিল। যদিও বলার মতো আয় হত না, কিন্তু দিন চলে যেত।
সঙ্গীতা তার স্বভাব জানত। তাই সব সময় সন্দেহ করত। একবার পরপর আট রাত ধরে সে দেরি করে বাড়ি আসে, তার বউ সন্দেহ করেছিল সে কোনো খারাপ কাজ করে গা ঢাকা দিয়েছে। সে তিজ পরব উপলক্ষে একটা এয়ারকন শাড়ি কিনে এনেছিল, কিন্তু সঙ্গীতা সেটা পরেনি। তার মনে হয়েছিল দিলবাহাদুরের এই উপার্জন সোজা রাস্তায় হচ্ছে না। রাতে এক বিছানায় ঘুমালেও তাদের মধ্যে কোনো প্রেম ছিল না। দিলবাহাদুরের ধারণা হল তার মা আর বাবা যদি কেরালায় এসে তার কাছে থাকে তবে তারা হয়তো সঙ্গীতার মন থেকে সব সন্দেহ দূর করতে পারবে, হয়তো তাদের প্রেম আবার ফিরে আসবে।
বনে কোনো কুয়াশা নেই, কিন্তু মোটা মোটা গাছের ক্যানোপির জন্য সে নীচে বাচ্চাদের খেলা দেখতে পাচ্ছিল না। শুধু তাদের কলস্বর আর হাসি তার কানে আসছিল। বাচ্চারা রং আর জলভরা বেলুনের বোমা নিয়ে খেলছে। আজ হোলি। তার মনে পড়ল তার ভাইয়ের একটা লাল রঙের জলপিস্তল ছিল। ছোটোবেলায় ইউনিসেফের ক্যাম্পে থাকাকালীন সেটা নিয়ে সে যখন দিলবাহাদুরের পিছনে ধাওয়া করত, তখন ভাইয়ের মুখে একটা দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে পড়ত। সে জোর করে পিস্তল থেকে জল ছুড়ে দিলবাহাদুরকে ভিজিয়ে দিত। তার ভাই যখন মারা যায় দিলবাহাদুরের বয়স তখন তিন।
বনের উপর থেকে দূরে দিগন্তের দিকে সমতলভূমিতে ধানের খেত দেখা যাচ্ছে। এখন সেখানে তার পরিবার বাস করে, বাবা, মা আর বোন। সে হোভার গিয়ার রিলিজ করে সেই দিকে এগিয়ে গেল। রিকশার গতি এতটাই বাড়িয়ে দিল যে শহর হলে ঠিক পুলিশে ধরত।
দিলবাহাদুর তার আইসনিক চালু করে ভয়েস প্রম্পট ব্যবহার করে নেপালি গানের সাইটগুলি সার্চ করতে থাকল। একটু পরেই কুন্তি মোক্তানের কন্ঠে “খুত্তা তান্দৈ গর” গানটির সুরে তার কেবিন ভরে উঠল। মনে পড়ল, ছোটোবেলায় তাদের কোনো মিউজিক সিস্টেম ছিল না। সে আর তার বোন প্রজ্ঞা রান্না ঘরে বসে বাসন মাজার সময় মালিকের শোবার ঘর থেকে ভেসে আসা সঙ্গীত শুনত। এই গানটা সে প্রথম যখন শোনে তখন তার বয়স বারো বছর। হাকিমের মেয়ে এই গানটার সঙ্গে নাচ প্র্যাকটিস করছিল, প্রজ্ঞাও লুকিয়ে তার সঙ্গে নাচতে শুরু করেছিল। হাকিমের মেয়ে এটা দেখে ফেলার পর দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
এই সুন্দর স্মৃতি মনে পড়তেই দিলবাহাদুর একটু বিষ্মিত হল। তার মনে হল, সত্যিই তো তার ছোটোবেলার সব স্মৃতি তো দুঃখের নয়। দাইয়ের জলপিস্তল নিয়ে তাকে ধাওয়া করা, হাকিমের মেয়ের সঙ্গে প্রজ্ঞার নাচ মনে পড়তে তার মুখে হাসি খেলে গেল। এই সব স্মৃতি তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। সে অন্য একটা মিউজিক পোর্টাল চালিয়ে দিল।
মালিকের খামারের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় সে দেখতে পেল একটা মোষে টানা গাড়ি ভেঙে পড়ে আছে। উপরে সোনার পাহাড়ের মতো ফসলের স্তূপ। তার নীচে গাড়ির চালককে সামান্যই দেখা যাচ্ছে। এই দৃশ্য তিন শতাব্দী আগেকার। এখনও এরা হাইটেক চাষ শুরু করেনি, সেই পুরোনো যুগেই পড়ে আছে। কিন্তু কেন? নতুন এই শিল্পবিপ্লব দশ বছর আগে শুরু হলেও এখন এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে এই সস্তার প্রযুক্তি যায়নি। সে বুঝতেই পারছে না কেন এই ফার্মটা সেই পুরোনো দিনের কাঠের চাকাওলা গাড়ির উপর নির্ভর করে আছে। সে নিজের রিকশার পিছনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সেখানে একটা বাক্সে ছ’টা যন্ত্রমানব রাখা আছে। সে এগুলির বিনিময়ে তার পরিবারের মুক্তি কিনবে বলে নিয়ে এসেছে। এই রোবটগুলি মাত্র চার ফুট লম্বা, কিন্তু একটা কৃষি খামারের সব রকম কাজ করতে পারে আর মানুষের থেকে দশগুণ ক্ষমতা রাখে। আকাশে বসে এসব দেখে সে বুঝতে পারল না সত্যিই এগুলির বিনিময়ে সে তার পরিবারের মুক্তি কিনতে পারবে কিনা।
দিলবাহাদুর এক মাস আগে হাকিমের কাছে তার মা বাবা আর বোনের মুক্তির জন্য এক লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিল। কিন্তু তার কোনো জবাব পায়নি। কেন লোকটা টাকা গ্রহণ করার কথা স্বীকার করল না তা সে বুঝে পেল না।
দিলবাহাদুর জানে তার পরিবার এখনও সেই একই হাকিমের দাস হিসাবে বহাল রয়েছে, যদিও দেশের আভ্যন্তরীন রাজস্ব ডাটাবেসে তাদের নাম কর্মচারী হিসাবে নথিবদ্ধ আছে। আইনত বন্ডেড লেবার সিস্টেম উঠে গিয়েছে, কিন্তু যা আছে তার এরই একটা পরিবর্তিত রূপ। বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর অনেক কামাইয়াই তাদের প্রাক্তন প্রভুর খামারে কাজ করতে ফিরে এসেছে। নতুন সরকার এবং আন্তর্জাতিক চাপের জন্য এখনকার মালিকরা একটা নতুন কর্মসংস্থান চুক্তি বানিয়েছে।
হলুদ রঙের একটা দোতলা বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় তার চোখে পড়ল এক মাইল লম্বা রাস্তার শেষ প্রান্তে একটা গোল চত্তরে গণেশের একটা প্রমাণ মাপের মূর্তি। একটা গাছের নীচে বসে চারজন মানুষ দরদর করে ঘামছে, তাদের খোলা বুক বেয়ে ঘাম ঝরছে। তার রিকশার উপস্থিতিতে লোকগুলির তাস খেলায় ব্যাঘাত হল বলে মনে হল। তারা ভুরু কুঁচকে তার রিকশার দিকে তাকালো। সে এদেরকে চিনতে পেরেছে, এরা সবাই এই ফার্মের সুপারভাইজার।
দিলবাহাদুর সোজা উড়ে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে সে একটা আয়তকার জায়গার উপরে চলে এলো যেখানে অনেকগুলি বাড়ি রয়েছে। এখানেই সে এক সময় বড়ো হয়েছে। জায়গাটা একটুও বদলায়নি। সে খুব ধীরে ধীরে তার অ্যারো রিকশা নীচে একটা শুকনো গাছের পাশে এনে দাঁড় করালো। এই শুকনো গাছটা তার ছোটোবেলাতেও ঠিক এইরকম ছিল। একটা বাড়ির কাদা লেপা দেয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে আঁকা একটা ছবি, মনে হয় যেন সদ্য আঁকা হয়েছে। বারান্দায় ফুলের টব বসানো।
প্রথমে তার মনে হল বাড়িতে কেউ নেই। কিন্তু একটু পরে দেখতে পেল তার বাবার বসার ঘরে একটা ছোটোখাটো ভিড়। তার বাবা খুব জোরে টিভি চালিয়ে টিভি দেখছে। টিভিতে ঘোড়া দৌড়াচ্ছে, অস্ত্রের ঝংকার শোনা যাচ্ছে। ঘরের থেকে মাথা বের করে একজন বাইরে তাকিয়ে তার রিকশা দেখতে পেল। তার মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো। তাই শুনে অনেকগুলি মুখ দরজা দিয়ে উঁকি মারল। কিন্তু রঙিন কাচের একটা ডোমের ভিতরে থাকায় তাকে কেউ দেখতে পেল না। ডোমের ভিতর থেকে দিলবাহাদুর সবাইকে দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু তার বাবা, মা বা বোনের মুখ চোখে পড়ল না। কোথায় গেল সবাই?
দিলবাহাদুর নিজের পোশাকটা একটু খুঁটিয়ে দেখে নিল। কাঁধে, টুপিতে, জুতোতে কয়েকটা এলইডি বাতি ছাড়া পোষাকটা সাধারণ পোশাকের মতোই— একটি চওড়া ঝলমলে টুপি, জিন্সের ট্রাউজার্স, চামড়ার জ্যাকেট, কুমিরের চামড়ার বুট। দিল্লীর এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের বাড়ি থেকে সে এগুলি চুরি করেছে। পোশাকটা এয়ার কন্ডিশনড, তার হাতার ভিতরে লুকোনো একটা বন্দুক রয়েছে। কব্জির ঘড়িতে তাপমাত্রা একুশ ডিগ্রিতে সেট করে সে ডোম থেকে বেরিয়ে এলো।
হালকা সুতির প্যান্ট পরা তিনজন লোক তার বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তাদের মুখে রং মাখা, খালি গা বলে কাউকেই সে চিনতে পারল না। রং আর ঘাম মিলে মিশে তাদের মুখের উপর চকচক করছে। তাদের পাশ দিয়ে একজন খুব বুড়ো লোক এগিয়ে এলো। মাথার সমস্ত চুল সাদা, মুখে পাঁচ রকমের রং, তার মধ্যে সবুজের প্রাধান্য বেশি। মুখের বলিরেখা বেয়ে ঘাম ঝরছে। “দিলবাহাদুর?” লোকটার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো।
“বাবা?’ দিলবাহাদুরের দু-চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সে কোনোরকমে কান্না চেপে রাখল। হঠাৎ কোথা থেকে একটি মেয়ে ছুটে এসে এমনভাবে তাকে জড়িয়ে ধরল যে তার দম বন্ধ হয়ে এল। সে এর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। প্রজ্ঞার মুখেও রং এবং ঘাম। দিলবাহাদুর তার বোনকে জড়িয়ে ধরল। তার কাঁধের উপর প্রজ্ঞার চোখের জল ও তার গায়ের ঘ্রাণ তার মনে অনেক দিন আগে হারিয়ে যাওয়া এক সুবাসের অনুভূতি এনে দিল।
ঘরের ভিতর থেকে টিভির শব্দ কানে আসছিল। বিষণ্ণ এক মেলোড্রামাটিক সুর বাজছে। কোনো একটা ঐতিহাসিক সিনেমা বা সিরিয়াল চলছে। ঘোড়া দৌড়াচ্ছে, অস্ত্রের ঝংকার শোনা যাচ্ছে। এই সব শব্দের মধ্যে হঠাৎ সে একটা অ্যারো রিকশার গুনগুন শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে তার মনে হল টিভির ভিতর থেকে আসছে শব্দটা, কিন্তু টিভিতে তো একটা ঐতিহাসিক দৃশ্য চলছে, তার সঙ্গে এই শব্দ একেবারেই বেমানান। একটু পরেই তার চোখে পড়ল আকাশে তার রিকশার মতোই একটা অ্যারো রিকশা। নীচটা চৌকো বাক্সের মতো, মাথার উপর একটা গোল কাচের গম্বুজ। নামার সময় একটা বাড়ির আড়ালে চলে গেল ওটা।
একটা শক্ত হাত এসে প্রজ্ঞাকে তার কাছ থেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতেই প্রজ্ঞা চিৎকার করে কেঁদে উঠল, “আমাকে আমার ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে দাও।”
বারান্দা থেকে বাবা দেখছিল, তার কুঁচকে যাওয়া মুখের চামড়া বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে নামছিল। অনেকগুলি রং করা মুখ অন্য বাড়িগুলির থেকে বেরিয়ে এসে তার বাবাকে ঘিরে রইল।
“ও এখানে এসেছে কেন?” একজন মহিলা চিৎকার করে উঠল, “তুমি তো জানো এখানে ওর কোনো জায়গা নেই।”
“বুয়া,” দিলবাহাদুর বুড়ির সামনে গিয়ে ডাকল।
“তুমি এখান থেকে চলে যাও, দয়া করে” তার বাবা শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, মনে হল তার গলায় কিছু একটা আটকে আছে।
দিলবাহাদুর বলল, “আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি, বাবা। আমি আগেই টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি।”
“ও তো চোরাই টাকা?” কেউ একজন বলে উঠল।
“তুমি চলে যাও, এখানে থাকলে আমাদের ঝামেলা হবে,” আর একজন বলল।
উঠানের দিকে গেট দিয়ে তিনজন লোককে ঢুকতে দেখা গেল। দুজনের হাতে বৈদ্যুতিক রাইফেল। দিলবাহাদুর দেখে খুব অবাক হল। হাকিম এখনও তার খামারে হাই টেক ব্যবস্থা চালু করেনি, অথচ অ্যারো রিকশা আর ইলেকট্রিক বন্দুক ব্যবহার করছে। বন্দুকগুলিতে অনেকগুলি মোড আছে, যেমন, চাবুক মোড থেকে শুরু করে মারাত্মক লেজার মোড পর্যন্ত। লেজার মোড ব্যবহার করা হয় মেরে ফেলার জন্য। বন্দুকগুলিতে লাল আলো জ্বলছে, তার মানে এরা তাকে মেরে ফেলবার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে।
দিলবাহাদুর তার স্যুটের বুলেটপ্রুফ ফিচারটা চালু করতে কব্জির একটা বোতামে চাপ দিল।
“এ সেই পালিয়ে যাওয়া ছেলেটা না?” হাকিম বলল। হাকিমের বয়স ষাটের উপরে, মাথা থেকে লম্বা চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। সময় এবং এখানকার প্রখর সূর্য তার মুখের থেকে সব রকমের কোমলতা হরণ করে নিয়েছে। “বাঃ একেবারে হিরো হয়ে ফিরে এসেছে!”
সবাই হেসে উঠল।
দিলবাহাদুর বলল, “আমি আপনার সব ঋণ শোধ করার জন্য টাকা পাঠিয়েছি।”
“কীসের টাকা? কীসের ঋণ?”
রিকশা থেকে একটা বড়ো বাক্স টেনে আনল দিলবাহাদুর। হাকিমের দিকে ফিরে বলল, “এর মধ্যে চারটে রোবট আছে। আপনি এগুলি নিয়ে আমার পরিবারকে ছেড়ে দিন।” সে বাক্সটার ঢাকনা খুলতেই রোবটের রূপালী শরীরে সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করে উঠল।
“তুমি ভুল করছ,” হাকিম বলল, “তোমার পরিবারের আমার কাছে কোনো ঋণ নেই। সবাই মুক্ত, কেউ আমার দাস নয়, কেউ আর কামাইয়া নয়।” দিলবাহাদুর খেয়াল করল, তার মায়ের কথা কেউ বলছে না, বা তাকে দেখাও যাচ্ছে না। হাকিম তার বাবার দিকে ফিরে বলল, “তুমি কি দাস?”
দিলবাহাদুরের বাবা উত্তর দিল না। সে হাকিমের দিকে না তাকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুঠো করা হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। হাকিম তার আরো কাছে এগিয়ে গেল।
“আমাকে স্পষ্ট করে বলো, তুমি কি দাস?”
দিলবাহাদুর তার মুখের দিকে তাকালো। বৃদ্ধ যেন নিশ্বাস বন্ধ করে এই প্রশ্নের জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে। তার দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, মুখের সব রং ধুয়ে, ঘামের সঙ্গে মিশে সেই জল নামছে। অবশেষে তার মাথা ঝাঁকিয়ে সে উত্তর দিল।
“দেখলে তো?” হাকিম দিলবাহাদুরের দিকে ফিরে মুচকি হাসি হেসে হাত বাড়িয়ে দিল। “এখানে কোনো কামাইয়া নেই। প্রত্যেকেই একজন কর্মচারী। প্রত্যেকেরই একটি চুক্তি আছে এবং বেতন পায়। তোমার বাবা ইচ্ছে করলেই তোমার সঙ্গে যেতে পারবে, কিন্তু অবশ্যই তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করতে হবে, আমাদের এক মাসের নোটিশ দিয়ে।”
হাকিম দিলবাহাদুরের বাবার দিকে ফিরে বলল, “যাও। তোমার ছেলের সঙ্গে চলে যাও।”
দিলবাহাদুর খুব দ্রুত একবার তার বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রজ্ঞার দিকে ফিরে তাকাল। প্রজ্ঞাকে একজন লোক ধরে রেখেছিল যাতে সে দিলবাহাদুরের দিকে এগিয়ে যেতে না পারে।
“সবই কর্মফল,” তার বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কী করে যাব? আমাদের ভাগ্যে এটাই লেখা আছে, কিছুই করার নেই।”
“না!” দিলবাহাদুর চিৎকার করে উঠল।
দিলবাহাদুর সত্যিকারের ভাগ্যের খেলা দেখেছিল তার ভাই মারা যাওয়ার পর। দীর্ঘদিন ধরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলেছিল। তাদের বাড়ি ঘর ছেড়ে, হাকিমের আশ্রয় ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। দীর্ঘ বিপ্লবের সময় একটা সরকারি ক্যাম্পে তারা কিছুটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল। তারপর একসময় সেই ক্যাম্প উঠে যায়। বনের মধ্যে তারা আশ্রয় নিয়েছিল। গরমকালে গাছের ছায়ায় তাদের দিন একরকম কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু শীত পড়তেই তাদের মনে হতে লাগল তাদের মালিকের দেওয়া বাসস্থানের উষ্ণতার কথা। তারা তখন সেটার অভাব অনুভব করতে শুরু করল।
সেই শীতে একদিন সকালে দিলবাহাদুর তার ভাইকে কম্বলে মোড়া অবস্থায় দেখতে পায়। শরীরটা ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে গেছে। এর জন্য তার বাবা, সরকারকে দায়ী করেনি, বিপ্লবকে দায়ী করেনি, শীতকে দায়ী করেনি। দায়ী করেছিল নিজের ভাগ্যকে, নিজের কর্মফলকে। এর তিন দিন পরে আবার তারা মালিকের অধীনে কাজ করার জন্য ফিরে যায়।
তার বাবা মুখ খুলল, “তুমি যেদিন পালিয়ে যাও সেদিন তোমার মা’র স্ট্রোক হয়। প্যারালিসিস হয়ে গিয়েছিল, হাঁটতে, বা কথা বলতে পারত না। তোমার জন্যই সে মরে গিয়েছে।”
দিলবাহাদুর প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। তার মায়ের হার্ট অ্যাটাকের কারণ যে সে নিজেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মাত্র পনেরো বছর বয়েসে যখন সে কাছাকাছি কোনো শহর পর্যন্ত দেখেনি, সে বয়সে সে সবাইকে ছেড়ে দিল্লী পালিয়ে যায়। সবাই বলে এটাই তার মায়ের স্ট্রোক হওয়ার কারণ। কিন্তু তার মায়ের মৃত্যুর আসল কারণ, সে জানে, ঠিকমতো চিকিৎসা না হওয়া। সে বলতে চাইল, ভাগ্য বা, নিয়তির অভিশাপ বা তার পালিয়ে যাওয়া কোনোটাই তার মায়ের মৃত্যুর আসল কারণ নয়। কিন্তু তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না। নিজেকে সামলে রাখতে সে প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
দিলবাহাদুর নিজের হাতের দিকে তাকালো। যদিও সে মেয়ে নয়, কিন্তু ছোটোবেলায় তার মা তার হাতে মেহেদি দিয়ে ফুল এঁকে দিত। তারপর মাঝখানে তার নাম লিখে দিত, দিলবাহাদুর। মা বলত, “তুই তো একজন সাহসী যোদ্ধা, পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী মানুষ।”
দিলবাহাদুর চিৎকার করে বলে উঠল, “মা মারা গেছে, তুমি আমাকে জানাওনি কেন?”
“তুমি কোথায় ছিলে আমরা জানতাম?”
“ঠিক আছে, তোমরা আমার সঙ্গে চল,” সে বলল, “আমি তোমাদের এবং সঙ্গীতার দেখাশোনা করব। তোমাদের খুব ভালোভাবে রাখব।”
তার বাবা মাথা নাড়ালো, “তা হয় না, এটাই আমাদের বাড়ি।”
“তুমি তো জানো,” হাকিম বলল, “কাজের চুক্তি পালন না করে পালিয়ে যাওয়া অপরাধ।”
দিলবাহাদুর দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “আমি তো কোনো চুক্তি করিনি।”
“তখন তুমি নাবালক ছিলে। তোমার হয়ে তোমার বাবা সই করেছিল। তোমার বাবার সামর্থ্য ছিল না। কথা ছিল আমরা তোমাকে লেখাপড়া শেখাবো এবং পড়াশোনার শেষে তুমি কাজ করে আমার ঋণ শোধ করবে। ঋণ শোধ হয়ে গেলে তুমি মুক্ত হবে। কিন্তু তুমি পালিয়ে গেলে। কর্মসংস্থান আইনে এটা অপরাধ। আইনে বলা আছে যে একজন কর্মচারী যে তার নিয়োগকর্তার টাকা নেয় এবং তার কাজ শেষ করার আগে চুক্তি ভঙ্গ করে তাকে গ্রেফতার ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।”
“আমি আপনাকে যে টাকা দিয়েছি তা শোধ করার জন্য যথেষ্ট—”
“আমরা সেই টাকা নিইনি,” হাকিম তাকে থামিয়ে দেয়, “যদি তুমি সেই টাকা ফেরত চাও, তাহলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগে যাও এবং তোমার আয়ের উৎস ঘোষণা কর।”
“ঠিক আছে,” দিলবাহাদুর বলল।
“তোমার আয়ের উৎস যদি ঠিকও হয় তাহলেও তুমি ঋণমুক্ত হবে না। তোমার পালিয়ে যাওয়ার জন্য তোমার জরিমানা আছে। তার উপর তোমার বোন নার্সিং পড়ছে, তার পড়াশোনার খরচ এবং সব টাকার উপর সুদ যোগ করতে হবে।”
দিলবাহাদুর তার বোনের দিকে ফিরে তাকালো। তার ঠোঁটদুটো তখনও কাঁপছে।
হাকিম রোবোটের বিরাট বাক্সটার গায়ে বুট দিয়ে একটা লাথি মেরে বলল, “এগুলোও তো চোরাই মাল, তাই না?”
দিলবাহাদুর এগুলিকে চুরি করেই এনেছে। রোবোট প্রস্তুতকারি সংস্থা সুষমা টেকের গুদাম থেকে চুরি করে আনার পর এর সিরিয়াল নম্বর আর মেটাডেটা বদলে দিয়েছে যাতে কেউ আর এগুলিকে ট্রেস করতে না পারে। এগুলি চুরি করার সময় দিলবাহাদুর প্রতিজ্ঞা করেছিল এটাই তার শেষ অপরাধ। এর পর থেকে সে একেবারে সৎভাবে জীবন কাটাবে। মা বাবাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখবে। সঙ্গীতাকে বোঝাবে যে সে ভালো হয়ে গিয়েছে। তার মা বাবা সঙ্গে থাকলে হয়তো সঙ্গীতার মন বদলে যেতেও পারে।
সে যে টাকা পাঠিয়েছে তা যদি যথেষ্ট না হয় এই ভেবে সে এই যন্ত্রমানবদের নিয়ে এসেছে, যদি এর বিনিময়ে হাকিম তার পরিবারকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়।
“আমি চোর নই,” দিলবাহাদুর বলল, “কেরালায় আমার একটা মিষ্টির দোকান আছে।”
“হুম”, হাকিম বলল, “তুমি কী ভেবেছ? মিষ্টির দোকান থেকে তোমার এত লাভ হয় যে তুমি ছয়টা রোবট কিনতে পারো?” শুনে হাকিমের পাশে দাঁড়ানো বন্দুক হাতে লোকগুলো হেসে উঠল। “তার মানে তুমি বলছ মিষ্টি বিক্রি করে তুমি রাতারাতি বিলিওনেয়ার হয়ে গেছ। তোমার মিষ্টির দোকান ডিজিটাল মিষ্টি বিক্রি করে নাকি? যেমন টেকনোপুরি বা সাইবার রসগোল্লা।” লোকগুলো আবার হেসে উঠল।
“যাই হোক তোমার যন্ত্রমানব আমি নিতে পারব না। কারণ তারা মানুষের কাজ কেড়ে নিয়েছে। এদের যদি আমি কাজে লাগাই তাহলে এখানকার মানুষগুলি কোথায় যাবে? আমি তাদের ক্ষতি করতে পারব না। এরাই এখন আমার পরিবার।”
দিলবাহাদুর মনে মনে হাসল। হাকিমের মিষ্টি কথার পিছনে আসল উদ্দেশ্য সে বুঝতে পারল। এখানে শ্রম সস্তা তার উপর মানুষ মানুষের জন্ম দিতে পারে, শ্রমিক উৎপাদন করতে পারে। এই শ্রমিকদের সে বংশপরম্পরায় কাজে লাগাতে পারে। যন্ত্রমানবদের ক্ষেত্রে তা হবে না।
হাকিম আবার বলল, “তোমার বিরুদ্ধে এখনও কেস রয়েছে, প্রতারণার মামলা। তার দায়ভার তোমার বাবা বইছে। আমার উপদেশ হল তুমি পুলিশের কাছে সারেন্ডার কর। তুমি যদি আবার এই ফার্মে কাজে যোগ দাও তাহলে আমি সব অভিযোগ তুলে নেব।”
হাকিমের দেহরক্ষীরা দিলবাহাদুরের দিকে এগিয়ে এসে তার বুক লক্ষ্য করে বন্দুক তুলে ধরল।
দিলবাহাদুর তার কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির একটা বোতামে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার জামার হাতার ভিতর থেকে একটা লাল রঙের বন্দুক বেরিয়ে এলো। হাকিমের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আমার কাছে এটা আছে।”
“ভালো কথা, এবার প্রমাণ হল তুমি সত্যিই একজন পলাতক আসামী।”
দিলবাহাদুর বলল, “তোমার লোকদের বন্দুক নামিয়ে বলো। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি আমি একটা বুলেটপ্রুফ স্যুট পরে আছি।”
দিলবাহাদুরের পোষাকে কাঁধের উপর কয়েকটা আলো জ্বলছিল। সেদিকে চোখ পড়তেই হাকিমের মুখের থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। তার একজন বন্ডেড লেবারের ছেলের উদ্ধত এই চেহারার দিকে তাকিয়ে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কথা বলার জন্য তার ঠোঁট কাঁপতে লাগল। তারপর তার দেহরক্ষীর দিকে ফিরে তাদের বন্দুক নামিয়ে রাখতে আদেশ করল।
দিলবাহাদুরের বোন এই সব গোলমালের মধ্যে কখন যেন অ্যারো রিকশায় উঠে বসেছে। প্রজ্ঞাকে পিছনের সিটে উঠে বসতে দেখে সে তার বাবাকে রিকশয় উঠে বসতে বলল।
দিলবাহাদুরের বাবা মাথা নেড়ে রিকশায় উঠতে অস্বীকার করায় দিলবাহাদুর প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “বাবা আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি।”
বাবা তখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না দেখে দিলবাহাদুর আবার বলল, “যদি এই কামাইয়া হয়ে সারা জীবন কাটানো আমার ভাগ্যে লেখা থাকত আমি মেনে নিতাম। কিন্তু আমার একটা সংসার আছে, সেটা ভেঙে যেতে বসেছে। তোমরা আমার সঙ্গে চল। আমার ঘর ভেঙে যেতে বসেছে। তোমরা গেলে তা আবার জোড়া লাগবে। আমার আবার সন্তান হবে, তারা তাদের দাদুর কোলে মানুষ হবে। বাবা প্লিজ আমার সঙ্গে চল।”
তার বাবা তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে রিকশায় উঠে বসল।
ওদের অ্যারো রিকশা ধীরে ধীরে উপরে উঠে গতি বাড়িয়ে দিল। তারপর জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। একবার যদি তারা ভারতের সীমানার ভিতরে ঢুকে পড়তে পারে তাহলে নেপালী পুলিশ তাদের কিছুই করতে পারবে না। তারা অবশ্য ভারতীয় পুলিশকে জানাবে। কিন্তু হাজার হাজার উড়ন্ত অ্যারো রিকশার ভীড়ের মধ্যে ভারতীয় পুলিশ তাদের খুঁজে বের করার আগেই তারা গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। সে যত দ্রুত সম্ভব চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
“ওরা আম্মাকে মেরে ফেলেছে,” প্রজ্ঞা বলল।
দিলবাহাদুর স্টিয়ারিং এ হাত রেখে রিকশা চালানোয় ব্যস্ত ছিল। ভালো করে কথাটা শুনতে পায়নি।
“এ সব কী বলছ তুমি?” তার বাবা বলল।
“আমি সব দেখেছি। মার স্ট্রোক হয়নি, প্যারালিসিসও হয়নি। হাকিমের লোকরা মাকে একটা একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছিল। বলেছিল এটা ভাইয়ের পালানোর শাস্তি।”
“সবই কর্মফল,” দিলবাহাদুরের বাবার মুখ থেকে শুধু এইটুকু কথা বেরিয়ে এল।
দিলবাহাদুর কিছু বলার আগেই তার পিছনে বিকট শব্দ করে পুলিশের সাইরেন বেজে উঠল। সে ড্যাশবোর্ডের পর্দায় পিছনের বিমানটাকে দেখতে পেল। প্লেনে বারো জন অফিসার রয়েছে এবং মাথার উপরে মেশিনগান রয়েছে। দিলবাহাদুর একটা লিভারে টান দিয়ে তার অ্যারো রিকশা জঙ্গলের ভিতরে নামিয়ে নিল। গাছের ফাঁক দিয়ে সে রিকশাটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকল। মাথার উপরে ঘন পাতার বেষ্টনির ভিতর দিয়ে পুলিশরা তাকে আর দেখতে পাবে না। আর এই ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পুলিশের এই বড়ো বিমান চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তার ছোটো রিকশা সহজেই বনের গাছপালার ভিতর দিয়ে উড়ে যেতে থাকল। সে খুঁজতে থাকল জঙ্গলের একটা ক্লিয়ারিং যার ভিতর দিয়ে সে আবার ফাঁকা আকাশে উঠে যেতে পারে।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার রিকশা একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেল এবং একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল।
প্রজ্ঞা আর তার বাবা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু দিলবাহাদুর রিকশাটাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারল না। বিশাল গাছের ভিতর দিয়ে রিকশাটা নীচে পড়তে থাকল।
রিকশার বাবল শিল্ডটাকে সে চালু করে দিল যাতে কারো গায়ে আঘাত না লাগে। তা সত্ত্বেও বনের ডালপালা ভেঙে রিকশাটা ক্রমেই নীচে পড়তে থাকল এবং একটু পরে মাটিতে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা কয়েক টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। বাবল শিল্ড না থাকলে তারা মরেই যেত।
“দিদি তুমি ঠিক আছ তো?” বোনকে সে প্রশ্ন করল।
“আমি ভালো আছি!” প্রজ্ঞা উত্তর দিল “আমি ঠিক আছি।”
দিলবাহাদুর দেখতে পেল তার বাবার গলার ভিতরে একটা রড ঢুকে গেছে। “বাবা” বলে চিৎকার করে প্রজ্ঞা তার বাবার বুকের উপর পড়ে গেল। বাবার গলা থেকে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। প্রজ্ঞা হাত দিয়ে চেপে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকল।
“দৌড়াও,” দিলবাহাদুর তার বোনকে বলল, এখান থেকে শিগগির পালাও।”
“আর বাবা?”
“বাবা বেঁচে নেই, তুমি পালাও তাড়াতাড়ি।”
প্রজ্ঞা বাবার বুকের থেকে হাত সরিয়ে নিল। বাবার গলা দিয়ে একটা রক্তের ধারা নেমে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে কী করতে হবে সে বুঝে পেলো না।
“দৌড়োও দিদি দৌড়োও, পুলিশ আমাদের ধরে ফেলার আগে পালাও এখান থেকে।”
বাবল শিল্ড থেকে প্রজ্ঞা বেরিয়ে যেতে পারলেও দিলবাহাদুর এখনও ভিতরেই আটকে আছে। তাকে বের হতে হলে শিল্ডের কিছুটা কেটে ফেলতে হবে। প্রায় দশ মিনিট লাগবে। সে তার আইসনিক বের করে আনল। এটা অক্ষত আছে দেখে সে খুশি হল।
“প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা ব্যবহার করতে জানো?”
“আমি একা যেতে পারব না”, প্রজ্ঞা কাঁদতে লাগল।
“তুমি পালাও দিদি, আমি তোমাকে ঠিক খুঁজে নেব। তুমি কি এটা ব্যবহার করতে জানো?” ইসনিকটা তার হাতে দিয়ে দিলবাহাদুর আবার বলল।
“হ্যাঁ,” সে বলল।
“আমার পাসওয়ার্ড হল তোমার নাম আর আমার নামের সংমিশ্রণ। নিউ গৌরীফন্তে আমার জন্য অপেক্ষা কোরো। যদি আমি সন্ধ্যার মধ্যে না আসি তাহলে কেরালায় ট্রেন ধরবে। আইসনিকের সাহায্যে সঙ্গীতাকে ডাকো। সে আমার স্ত্রী। সে তোমাকে সাহায্য করবে। এখন যাও, দৌড়াও!”
পুলিশের এয়ারক্র্যাফট ঠিক মাথার উপরে গর্জন করছে। প্রজ্ঞা বাবলশিল্ডের একটা রিবন ধরে টান দিতেই শিল্ডটা কিছুটা ফাঁক হয়ে গেল। সে আইসনিক হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। মাথার উপরে পুলিশের জেটপ্যাকের গর্জন শোনা যাচ্ছে। দিলবাহাদুর শুনতে পেলো পুলিশদের একজন বলছে, “ওদের কাছে আর্মস আছে, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আছে, সাবধান।” দিলবাহাদুর অনুমান করল পুলিশদের নামতে এখনও কিছুটা সময় লাগবে। ততক্ষণে প্রজ্ঞা বর্ডার পার হয়ে যাবে।
“আমার ভয় করছে,”প্রজ্ঞা বলল।
“তুমি পালাও, আমি ঠিক বের হতে পারব। আমার পা আটকে গেছে, একটা রড কেটে ফেলতে হবে।”
জঙ্গলের ভিতরে অদৃশ্য হওয়ার আগে প্রজ্ঞা শেষবারের মত দিলবাহাদুরের দিকে ফিরে তাকালো।
দিলবাহাদুর শুনতে পেলো বনের আন্ডারগ্রোথের মধ্য দিয়ে ডালপালা ভাঙার শব্দ হচ্ছে। পুলিশ আসছে, খুব দ্রুত দৌড়ে আসছে। সে তার স্যুটের বুলেটপ্রুফ মোড চালু করল। এখান ভাঙা রিকশা থেকে বের হতে গেলে তাকে এটা কাটতে হবে। ততক্ষণ ধরে তাকে পুলিশদেরকে আটকে রাখতে হবে। পুলিশের হাতে ধরা না পড়লে সে হয়তো সঙ্গীতা আর প্রজ্ঞাকে আবার দেখতে পাবে।
সে এক হাতে লেজার করাত চালু করে বাবলশিল্ড কাটতে শুরু করল। অন্য হাতে বন্দুক নিয়ে সে পুলিশদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
Tags: kalpabiswa y7n1, কল্পবিজ্ঞান, প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, প্রমিত নন্দী