ডেজা ভ্যু
লেখক: এস. সি. মন্ডল
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
মনে হল প্রচণ্ড ভয়াবহ কোনো এক দুঃস্বপ্ন দেখছি। চিৎকার করে উঠতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না। আর ঠিক তখনি একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলাম। অনুভব করলাম গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দুঃস্বপ্ন হলেও এতটাই বাস্তব ছিল যে ঘুম ভাঙার পরেও আমি কে, কোথায় আছি কিছুই মনে এলো না। তারপরেই চোখ গেল সামনের সিটে বসে থাকা লোকটার দিকে। ফর্সা গোলগাল চেহারার ভদ্রলোকের মাথায় পাতলা হয়ে আসা আধপাকা চুল, দু-চোখে উজ্জ্বল দৃষ্টি, নাকের নীচে প্রফেসর সুলভ চওড়া গোঁফ। হাসিহাসি মুখে আমার দিকে চেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি মশাই, ঘুম ভাঙল?’
প্রশ্নটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাজিকের মতো আমার সব কথা মনে পড়ে গেল। আমার নাম ত্রিশঙ্কু, আমি একজন লেখক। ট্রেনে করে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা যাচ্ছি একটা লেখক সম্মেলনে যোগ দিতে। আর আমার সামনে বসা ভদ্রলোকের নাম ত্রিদিব মজুমদার। ভদ্রলোক পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর। তার সঙ্গে এই ট্রেনে উঠেই আলাপ হয়েছে। তিনিও কলকাতা যাচ্ছেন, কোনো একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে। আমি উত্তর দিচ্ছি না দেখে ত্রিদিববাবু আবার বললেন, ‘কিষণগঞ্জ ষ্টেশন এসেছে।’
আমি এবারে বললাম, ‘ওহ, ক্ষমা করবেন, একদম গভীর ঘুমে চলে গিয়েছিলাম।’
‘তাই তো দেখলাম। তা, চা চলবে নাকি?’
আমার সত্যিই চায়ের তেষ্টা পেয়েছিল। এমন গভীর ঘুম ভাঙ্গার পর চা না হলে শরীর মন চাঙ্গা হয় না। আমি বললাম, ‘তা হলে মন্দ হয় না।’
ভদ্রলোক বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে চা দিতে বললেন। অর্ডার নিয়ে বেয়ারা চলে যাবে ঠিক এমন সময় কামরার দরজা ঠেলে অন্য আরেকজন লোক ভিতরে ঢুকে এলেন। আমরা দুজনেই একযোগে তার দিকে ফিরে চাইলাম। বেটে খাটো একজন ভদ্রলোক, গায়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। হাতে টিকেট দেখে বুঝলাম ভদ্রলোক আমাদের নতুন সহযাত্রী।
সিট নাম্বার মিলিয়ে দেখে ত্রিদিববাবুর পাশে বসলেন ভদ্রলোক। তারপর নিজের কাঁধের ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রেখে আমাদের দিকে চেয়ে মৃদু হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ‘নমস্কার’। উত্তরে আমরাও দুজন তাকে নমস্কার জানালাম। আমার কেন যেন মনে হল ত্রিদিববাবু একটু চুপসে গেছেন। হঠাৎ যেন মুখের স্বাভাবিক হাসিটা মুছে গেছে। অগত্যা আমি নিজেই যেচে পড়ে নতুন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ জমালাম।
ভদ্রলোক নিজের নাম বললেন ভুবন পালাকর। মালদা যাচ্ছেন এক আত্মীয়ের মেয়ের বিয়েতে। এরই মধ্যে আমার আর ত্রিদিববাবুর চা চলে এসেছিল। বেয়ারা চা নামিয়ে রেখে চলে যেতেই ট্রেন ছেড়ে দিল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমাদের কথাবার্তা চলতে লাগল। আসলে এটা আমার একটা অভ্যাস, লিখতে গেলে মানুষ সম্পর্কে জানতে হয়, তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে হয়। আমার অনেক গল্পের প্লট আমি এভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পেয়েছি। ত্রিদিববাবু দেখলাম আমাদের আলোচনায় যোগ না দিয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের উজ্জ্বল ভাবটা কমে গিয়ে কেমন একটা উদাসী ভাব এসেছে। আমি ভদ্রলোককে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ত্রিদিববাবু, কোনো সমস্যা হল কি?’
উত্তরে খানিকক্ষণ কী যেন ভেবে নিয়ে ত্রিদিববাবু একটা ভারী অদ্ভুত কথা বললেন। বললেন, ‘না তেমন কিছু নয়, আসলে মনে কেমন একটা ধাঁধাঁ লাগছে।’
‘সেকি, সে আবার কেমন?’
‘দেখুন হঠাৎ করে কেন যেন মনে হচ্ছে এই যে ট্রেনের কামরায় আপনাদের সঙ্গে বসে যাচ্ছি, একটু আগে কিষণগঞ্জ ষ্টেশনে ট্রেন থামল, সেখানে প্ল্যাটফর্মে একজন লোকের ব্যাগের হাতল ছিঁড়ে গেছে এই সব কিছুই যেন আমার সঙ্গে আগে হয়েছে।’
এ ব্যাপারটা আমার জানা ছিল। আমি হালকা হেসে বললাম, ‘সে আরে নতুন কি, এমনটা সকলেরই হয়। একে বলে ডেজা ভ্যু।’
আমি কথাটা শেষ করতে পারলাম না। তার আগেই ত্রিদিববাবু নিজেই বললেন, ‘জানি ত্রিশঙ্কুবাবু। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে…’
ত্রিদিব বাবু নিজেও কথাটা শেষ করলেন না। তার বদলে আবারো ভাসা ভাসা চোখে জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে লাগলেন। আমি বা ভুবনবাবু কেউই আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। প্রফেসর শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ভাবালুতা কিছুটা থাকে জানতাম, সম্ভবত ওঁর মধ্যেও আছে। কাজের মধ্যে যেটা হল তা হল আমার আর ভুবনবাবুর মধ্যে যে আলোচনাটা চলছিল সেটা খেই হারিয়ে থেমে গেল। আমি ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটা বই পড়ছিলাম, সেটা আবার খুলে বসলাম। আর ভুবনবাবু কিছু না করে চুপচাপ বসে রইলেন।
এভাবে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। তারপর হঠাৎ লক্ষ করলাম ত্রিদিব বাবুর মুখের ভাব পাল্টে গেছে। জানালা ছেড়ে আমার দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা ত্রিশঙ্কুবাবু, আপনি তো লেখালেখি করেন?’
আমি বইটা নামিয়ে রেখে তার দিকে ফিরে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘সে কিছুটা চেষ্টা করি বটে।’
‘আচ্ছা এই জানালা দিয়ে দেখুন দেখি, ওই যে দূরে গ্রাম দেখা যাচ্ছে, কেমন আবছা আবছা হয়ে আছে, আর ওই দেখুন ওই মাঠে কিষানেরা কাজ করছে, দেখতে পাচ্ছেন?’
‘হুম পাচ্ছি তো।’
‘আচ্ছা এসব কিছু কি বাস্তব?’
প্রশ্নটা শুনে আমি কিছু সময় চুপ করে বসে রইলাম। এ আবার কেমন প্রশ্ন কে জানে? মনে মনে ত্রিদিববাবুর মানসিক সুস্থতা ব্যাপারে একটা সূক্ষ্ম প্রশ্ন দেখা দিল। তবু বললাম, ‘বাস্তব নয়তো কী?’
‘ওসব আমাদের কল্পনাও তো হতে পারে। যেমন ধরুন আপনি যখন লেখেন বা আপনার লেখা যখন কেউ পড়ে তখন তার মনেও তো একটা জগত তৈরি হয় তাই না?’
আমি খানিক ভেবে বললাম, ‘তা হয় বটে, কিন্তু সে জগৎ তো কাল্পনিক জগৎ। তার সঙ্গে বাস্তবের কি সংযোগ।’
‘তেমন আমাদের এই জগৎটাও তো কারো কল্পনা হতে পারে। ওই গ্রাম, ওই মাঠ ওসব হয়তো বাস্তব নয়, হয়তো একটু আগেও ছিল না।’
আমি এবারে আর ত্রিদিববাবুর কথার কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। ভুবনবাবুর দিকে চেয়ে বুঝলাম তিনিও আমার মতোই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। এবারে ত্রিদিববাবু নিজেই আবার বললেন, ‘দেখুন আমার কথা শুনে আপনারা দুজনেই হয়তো ভাবছেন আমি প্রলাপ বকছি। কিন্তু কথাগুলো না বলেও পারছি না। আচ্ছা আপনারা কি শ্রোডিঞ্জারের বিড়ালের কথা শুনেছেন?’
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম আর ভুবনবাবু না সূচক। তখন বেশ উৎসাহ নিয়ে ত্রিদিববাবু ভুবন বাবুর দিকে ফিরে বললেন, ‘না শুনলেও সমস্যা নেই। আমি সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরুন একটা বাক্সের মধ্যে একটা বিড়াল রাখা আছে, আর আছে এক পাত্র বিষ। সেই বিষের একটা ফোঁটাও বিড়ালটা চেখে দেখলে মারা যাবে। এখন আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বিড়ালটা কি জীবিত আছে নাকি মৃত তখন আপনি কী বলবেন?’
উত্তরটা আমার জানা ছিল, কিন্তু যেহেতু প্রশ্নটা আমাকে করা হয়নি তাই আমি চুপ করে রইলাম। ভুবনবাবুর মুখ দেখে মনে হল খুব বিপদে পড়েছেন। আত্মীয়ের মেয়ের বিয়েতে যাবার পথে যদি ট্রেনে অপরিচিত লোকের মুখে এমন প্রশ্ন শুনতে হয় তবে সেটাই স্বাভাবিক। তিনি খানিকটা ভেবে অনেকটা নিস্তার পাবার আশাতেই বললেন, ‘জানি না।’
‘একদম ঠিক।’ সোৎসাহে বলে উঠলেন ত্রিদিববাবু। তারপর যোগ করলেন, ‘আসলে জানার কথাও নয়। বিড়ালটা বেঁচেও থাকতে পারে, আবার বিষটা খেলে মরেও যেতে পারে। জানতে হলে আপনাকে বাক্সের ভিতরে উঁকি মেরে দেখতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি বাক্সের ভিতরে না দেখছেন ততক্ষণ পর্যন্ত বাক্সের বিড়াল জীবিত হতে পারে, মৃত হতে পারে, আবার এমনও হতে পারে যে বাক্সে কোনো বিড়ালই নেই। তাই নয় কি?’
ভুবনবাবু মাথা নেড়ে সায় দিলেন। ত্রিদিববাবুর ব্যাখ্যা করার ধরনে আমি চমৎকৃত হলাম। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুব ভালো শিক্ষক, কঠিন একটা বিষয় কি সহজ করেই না বুঝিয়ে বললেন। ভদ্রলোকের উপর আমার খানিকটা আস্থা ফিরে এলো। ত্রিদিববাবু বললেন, ‘এই একই ব্যাপার কিন্তু প্রকৃতির সব ক্ষেত্রেই ঘটে চলেছে। এই যে অনিশ্চয়তা, এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। যেমন ধরুন এই যে আলো সে কি তরঙ্গ নাকি কণা সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো পর্যবেক্ষক যাচাই না করছে ততক্ষণ পর্যন্ত আলো একই সঙ্গে তরঙ্গ আবার কণাও। যেই মাত্র কোনো পর্যবেক্ষক তাকে দেখল, অমনি সে হয় কণা না হয় তরঙ্গ হয়ে যাবে।’
ত্রিদিব বাবুর কথাগুলো আমি কিছুটা বুঝতে পারলাম, কিন্তু ভুবনবাবু যে কিছুই বোঝেননি সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। কাজেই এবারে আলোচনাটা শুধু আমার আর ত্রিদিববাবুর মধ্যে এসে পড়ল। আমি বললাম, ‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন এই যে গ্রাম, মাঠ, খেত এসব আসলে থাকতেও পারে, নাও পারে?’
‘একদম তাই।’ উৎসাহে হাতে চাপড় দিয়ে বলে উঠলেন ত্রিদিববাবু। তারপর আবার বললেন, ‘শুধু তাই কেন, এই যে আপনি বা আমি, আমরাও হয়তো বাস্তব না। কেউ একজন আমাদের দেখছে বলেই আমরা মূর্তিমান হচ্ছি। অথবা এমনও হতে পারে কেউ একজন দেখবে বলেই আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। আবার সে যখন চোখ ফিরিয়ে নেবে তখন আর আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না।’
আমি এবারে গভীর ভাবনায় পড়ে গেলাম। ত্রিদিববাবুর কথাগুলো একেবারে উড়িয়ে দিতে পারলাম না, আবার সম্পূর্ণরূপে মেনে নিতেও পারলাম না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই প্রতি মুহূর্তে নতুন কিছু না কিছু ছুটে আসছে জানালার বাইরে। কখনো গাছপালা, কখনো মানুষ, ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ। আবার পরক্ষণেই তারা মিলিয়ে যাচ্ছে চোখের আড়ালে। তখন কি সত্যিই তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে? নাকি আমার পরে অন্য যারা দেখছে তাদের জন্য মূর্তিমান হয়ে থাকছে?
চিন্তাটা কিন্তু শুধু এখানেই থেমে থাকল না। বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। মনে হল এই যে কলকাতা যাচ্ছি, আসলেই কি কলকাতা বলে কিছু আছে? নাকি আমি যখন গিয়ে পৌঁছব তখনই কলকাতা মূর্তিমান হবে? কলকাতায় আমার যে বন্ধুরা আছেন, পরিচিত লেখকেরা আছেন তারা কি সত্যিই আছেন?
হয়তো আরও কিছু ভাবতাম, তার আগে চোখ গেল ত্রিদিববাবুর দিকে। দেখলাম পকেট থেকে কলম আর নোটবুক বের করে কী যেন লিখছেন ভদ্রলোক। হয়তো নতুন এই ভাবনাগুলোকে নোট ডাউন করছেন। আমি তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার কী মনে হয়? কে দেখছে আমাদের?’
‘সেটা খুব কঠিন প্রশ্ন ত্রিশঙ্কুবাবু।’ ছোট্ট করে উত্তর দিলেন ভদ্রলোক। তারপর মনে মনে কী যেন ভেবে আবার বললেন, ‘এই যে ট্রেনের কামরায় আমরা তিনজন যাচ্ছি, হতেও পারে আমাদের মধ্যে কেউ একজন বাস্তব। আর বাকিরা আছি শুধু তার বাস্তবতাকে রূপদান করার জন্য।’
‘সেটা আবার কী রকম?’
‘মানে ধরুন অনেকটা কম্পিউটার সিমুলেটেড জগতের মতো। আমাদের মধ্যে কোনো একজন হলেন মূল চরিত্র। তিনি যেখানে যাচ্ছেন তার আশেপাশের জগৎ সেইমতো রেন্ডারিং হচ্ছে। সে বাদে আমরা বাকিরা সবাই পার্শ্বচরিত্র।’
‘কিন্তু সেটা কী করে হয়? আমার একটা অতীত আছে, পরিবার আছে, আপনার নিজেরও নিশ্চয়ই আছে? তাহলে কি আমরা দুজনেই মূল চরিত্র?’
ত্রিদিববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘হতে পারে, আবার নাও পারে। যে অতীতের কথা, পরিবারের কথা আপনি বলছেন, হতে পারে সেসব শুধুই আমাদের স্মৃতিতে পুরে দেয়া খানিকটা তথ্য। আমরা যতক্ষণ আছি, সেই তথ্যগুলোও ততক্ষণ আছে।’
‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে আমরা আসলে আছি একটা সিমুলেশানের মধ্যে?’
‘অনেকটা তেমনই বলতে পারেন। আর আমার ধারণা এই ব্যাপারটা এবারেই প্রথম হচ্ছে না। আগেও হয়েছে, হয়তো আবারও হবে।’
এবারে পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে কিছুটা পরিষ্কার হল। তার মানে ভদ্রলোক আসলে ডেজা-ভ্যু’র একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। সেই কারণেই এত সব প্রসঙ্গের অবতারণা। এর চেয়ে ভদ্রলোক সোজাসুজি বললেই পারতেন। আমাদের এসব খাপছাড়া কথা শুনে ভুবনবাবু এরই মধ্যে নির্ঘাত আমাদের উন্মাদ ঠাউরেছেন।
ভুবনবাবুর দিকে চেয়ে দেখলাম তিনি বার বার ঘড়ি দেখছেন, যেন বুঝতে চাইছেন আর কতক্ষণ এসব সহ্য করতে হবে। আমি যখন ভুবনবাবুর দিকে দেখছি ঠিক সেই মুহূর্তে ত্রিদিববাবু একটা কাজ করলেন। নোট বইয়ের একটা পাতায় কীসব লিখে সেটা ছিঁড়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘আসুন একটা পরীক্ষা হয়ে যাক, পড়ে দেখুন।’
আমি কাগজটা নিয়ে চোখের সামনে ধরে দেখলাম তাতে লেখা, ‘ভুবনবাবু এবারে বেয়ারাকে ডেকে চা দিতে বলবেন। চা খেতে গিয়ে চা ছলকে পড়বে তার গায়ে।’
আমার এবার হাসি পেল। ভদ্রলোকের কথায় কিছুটা যুক্তি আছে সেটা ঠিক, কিন্তু এটা এবারে বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। সে কথাই বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই অভাবনীয় ব্যাপারটা ঘটে গেল। ভুবনবাবু কামরার বেল চেপে বেয়ারাকে ডেকে চা দিতে বললেন।
ত্রিদিববাবু এবারে আমার দিকে চেয়ে চোখের একটা ইশারা করলেন, তার মানে অনেকটা এমনকী মিলে গেল তো? আমার অবশ্য মনে হল ব্যাপারটা হয়তো পুরোটাই কাকতালীয় বা ইংরেজিতে যাকে বলে কোইন্সিডেন্স। ভাবলাম দেখা যাক পরেরটুকু মেলে কিনা। দুই মিনিটের ভিতর চা চলে এলো। ত্রিদিববাবু দেখলাম আবার জানালা দিয়ে বাইরে দেখছেন। আমি কিন্তু দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম এর পর কী ঘটে সেটা দেখার জন্য।
আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ শেষ করে আনলেন ভুবনবাবু। এই সময়ে হঠাৎই আমি যে গোপনে তার ব্যাপারে কিছু একটা লক্ষ করছি সেটা বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক, আর সঙ্গে সঙ্গেই অঘটনটা ঘটে গেল। চায়ের কাপ উলটে গিয়ে পড়ল তার সাদা পাঞ্জাবিতে।
কোনো রকমে সামলে নিয়ে এক্সকিউজ মি বলে ওয়াশরুমে যাবার জন্য উঠে পড়লেন ভুবনবাবু। কামরার দরজাটা বন্ধ হতেই সোৎসাহে চিৎকার করে উঠলেন ত্রিদিববাবু, ‘দেখলেন, ঘটনাটা দেখলেন ত্রিশঙ্কুবাবু।’
আমার বিস্ময়ও তখন সীমা ছাড়িয়েছে। এতটা কাকতালীয় ব্যাপার কী করে হয়? তবে কি ত্রিদিববাবুর কথাই ঠিক? এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে ত্রিদিববাবুর কথাটার কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। তারপর একটু ধাতস্থ হতেই চাপা উত্তেজনা মাখা কণ্ঠে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কিছু কী মনে হচ্ছে ত্রিদিববাবু?’
‘আবছা আবছা মনে আসছে, সামনেই মালদা ষ্টেশনে, সেখানে ট্রেন থামবে ঠিক বারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে। তারপর…’
ত্রিদিব বাবুর কথা শেষ হবার আগেই ভুবনবাবু আবার ফিরে এলেন। আমি ঘড়ি দেখলাম, বারোটা সাতাশ বেজেছে। আমি বা ত্রিদিব বাবু কেউই ভুবন বাবুকে ব্যাপারটা জানাতে চাচ্ছিলাম না। তাই থেমে গেলাম। ভদ্রলোক সিটে বসতে বসতে বললেন, ‘মালদা এসে পড়েছে প্রায়। আমি এবার নেমে যাব।’
মুখে আমি আর ত্রিদিববাবু দুজনেই কিছু সৌজন্যসূচক কথা বললাম। কিন্তু আমার মন পড়ে রইল ঘড়ির কাঁটার দিকে। ট্রেনের ইন্টারকমে ঘোষণা হল, মালদা এসে পড়েছে। তারপর সত্যি সত্যি যখন ট্রেনটা থামল তখন আমি ঘড়ি মিলিয়ে দেখলাম, ঠিক বারোটা পঁয়ত্রিশ বেজেছে।
ভুবনবাবু এবারে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। হয়তো আবার দেখা হবে।’ তারপর ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। আমি আর ত্রিদিববাবু বিহ্বল অবস্থায় বসে রইলাম ট্রেনের কামরায়।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ভুবন বাবু প্ল্যাটফর্ম ধরে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছেন, একবার পিছন ফিরে আমাদের দিকে চাইলেন। আমি চাপা গলায় ত্রিদিববাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভুবনবাবুকে যে দেখছি, উনি যদি মূল চরিত্র না হন তবে আমাদের চোখের আড়াল হলেই কি উনি মিলিয়ে যাবেন? আপনার কি মনে হয়?’
ত্রিদিববাবু আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। মালদা ষ্টেশনে ট্রেন থামল মাত্র দু-মিনিট, তারপরেই গতি বাড়িয়ে ষ্টেশনের বাইরে এসে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গেই ত্রিদিববাবু চিৎকার করে উঠলেন, ‘দেখুন ত্রিশঙ্কুবাবু, দেখুন… আমার কথাই ঠিক…’
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ত্রিদিব বাবু, কিন্তু সেটা আর আমার শোনা হল না। প্রচণ্ড আতঙ্ক ভরা চোখে চেয়ে দেখলাম চারপাশের সব কিছু শূন্যে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। আমাদের কামরা, কামরার জানালা, বসার সিট, ত্রিদিববাবু সব একে একে মুছে যেতে শুরু করেছে এই বিশ্বচরাচরের বুক থেকে। সেই সঙ্গে মুছে যেতে শুরু করেছি আমিও। তবে কি ওই ভুবনবাবুই বাস্তব? আমরা শুধুই পার্শ্বচরিত্র? তিনি ছিলেন বলেই কি আমরা ছিলাম?
মুছে আসা ট্রেনের জানালা দিয়ে শেষবারের মতো বাইরে তাকালাম, নেই, ভুবনবাবু কোথাও নেই। শূন্যে মিলিয়ে যাবার আগে শেষবারের মতো হো হো করে হেসে উঠলেন ত্রিদিববাবু। যেন বলতে চাইলেন— পেরেছি, আমি এর সমাধান করতে পেরেছি। আমি তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পারলাম না।
মনে হল প্রচণ্ড ভয়াবহ কোনো এক দুঃস্বপ্ন দেখছি। চিৎকার করে উঠতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না। আর ঠিক তখনি একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলাম। অনুভব করলাম গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দুঃস্বপ্ন হলেও এতটাই বাস্তব ছিল যে ঘুম ভাঙার পরেও আমি কে, কোথায় আছি কিছুই মনে এলো না। তারপরেই চোখ গেল সামনের সিটে বসে থাকা লোকটার দিকে। ফর্সা গোলগাল চেহারার ভদ্রলোকের মাথায় পাতলা হয়ে আসা আধপাকা চুল, দু-চোখে উজ্জ্বল দৃষ্টি, নাকের নীচে প্রফেসর সুলভ চওড়া গোঁফ। হাসিহাসি মুখে আমার দিকে চেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি মশাই, ঘুম ভাঙল?’
Tags: kalpabiswa y7n1, এস. সি. মন্ডল, কল্পবিজ্ঞান, প্রমিত নন্দী
বেশ কমন ও গতানুগতিক প্লট, কিন্তু অভিনব এক্সিকিউশন। আর স্টোরিটেলিং মারাত্মক! এতোই সাবলীল যে একদমে পড়ে ফেললাম। এমন স্টোরিটেলিং ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে যাওয়া যায়, ক্লান্তিহীন। অভিনন্দন লেখককে।
এমন লেখা আরও পড়তে ইচ্ছুক। শুভকামনা রইলো।
আন্তরিক ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার লেখার প্রত্যাশায় রয়েছি কিন্তু।