নীলাঞ্জন এবং লিনা
লেখক: নয়ন বসু
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
আজ নিয়ে পরপর তিনদিন মেয়েটাকে লক্ষ করল নীলাঞ্জন। সে যখন কলেজের জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে তখন মেয়েটাও দাঁড়িয়ে থাকে। তিনদিনই নীলাঞ্জন দেখেছে মেয়েটার চোখে কালো চশমা আর মাথায় ছাতা। অথচ কোনোদিন বৃষ্টি পড়েনি। তাও ছাতার লজিকটা না হয় বোঝা যায়, বৃষ্টি না পড়লেও এখন আষাঢ় মাস চলছে। সুতরাং বৃষ্টির জন্য ছাতা নিয়ে চলাটা স্বাভাবিক। তার কলেজের ব্যাগেও একটা ফোল্ডিং ছাতা গোঁজা আছে।
কিন্তু কালো চশমার লজিকটা কিছুতে মাথায় ঢুকছে না নীলাঞ্জনের। আকাশে কোনো কালো মেঘ নেই, কিন্তু রোদও নেই। রোদচশমার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। তাও মেয়েটা কালো কুচকুচে একটা চশমা পরে ততোধিক কালো একটা ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে থাকবে। নীলাঞ্জন লক্ষ করেছে রাস্তার আর কেউ তাকায় না মেয়েটার দিকে। যেন পরমা সুন্দরী একটা মেয়ে জেন্টস ছাতা মাথায় দিয়ে কালো চশমা পরে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
হ্যাঁ, মেয়েটা দেখতে সুন্দর। শুধু সুন্দর বললে কম বলা হবে। এর জন্য বাংলা ভাষার যে শব্দটা ঠিক হয় সেটা হল অপরূপ। অপরূপ বলেই হয়তো নীলাঞ্জননের নজরে পড়েছে। অথচ সুন্দর দেখতে মেয়ে রাস্তায় আরো দেখা যায়। কিন্তু এই মেয়েটার মধ্যে একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে। যেটা নীলাঞ্জনকে চুম্বকের মতো টানছে।
নীলাঞ্জন প্রথমে ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো অন্ধ। কিন্তু অন্ধ লোকেরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চেয়ে চেয়ে দেখে না। অন্ধ লোকেরা খুব ফোকাসড হয়। এই মেয়েটা দিব্যি এদিক ওদিক চায়। নাঃ, অন্ধ হবে না। এমন হতে পারে মেয়েটার চোখের মণি অস্বাভাবিক নীল। যেই দেখবে সেই প্রেমে পড়ে যাবে, সেজন্য ঢেকে রাখে মেয়েটা। অথবা একটা চোখ পাথরেরও হতে পারে।
মেয়েটার মাথা ভরতি চুল, পিঠের মাঝামাঝি অবধি। একটা বেগুনি রঙের সালোয়ার পরেছিল প্রথম দিন। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনও তাই। এই ধরণের মেয়েরা পরপর তিনদিন এক ড্রেস পরবে এটাও অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু নীলাঞ্জন ভালো করে লক্ষ করেছে পরপর তিনদিন অবিকল সেম ড্রেস। কালো ছাতার তলায় বেগুনি সালোয়ার আরো অদ্ভুত লাগে। অবশ্য দুধে আলতা গায়ের রঙের সঙ্গে বেগুনি রংটা খুব ভালো খোলে।
পরপর তিনদিন লক্ষ করার পর চতুর্থ দিন নীলাঞ্জন আশা নিয়েই গিয়েছিল আজও দেখতে পাবে। যথারীতি দেখতেও পেল। আজও সেই আগের দিনের ড্রেস। একদিকে দেখতে পেয়ে একটু আস্বস্ত হল নীলাঞ্জন, কেন সে জানে না। আরেকদিকে এটাও ভেবে অবাক লাগল সে কি একাই যে এই পরমা সুন্দরী মেয়েটাকে লক্ষ করে! মেয়েটা এখানকার নয়। এখানকার হলে সে আশা করি চিনতে পারত।
এসব ভাবতে ভাবতেই নীলাঞ্জনের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। দিনের বেলা না হলে সে হয়তো ভূত ভূত বলে চেঁচিয়ে মেচিয়ে একশা করত। কিন্তু সকাল দশটার সময় ভরতি বাসস্টান্ডে দাঁড়িয়ে ভূত ভূত বলে চেঁচানো যায় না! নীলাঞ্জন দেখল মেয়েটা মাটিতে দাঁড়িয়ে নেই, মাটি থেকে অন্তত তিন ইঞ্চি উঁচুতে শূন্যে দাঁড়িয়ে আছে! নীলাঞ্জন চোখ কচলে আবার তাকাল। নাঃ, সে ভুল কিছু দেখেনি। মেয়েটা মাটি থেকে ইঞ্চি তিনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে আছে বলাটা ভুল হবে। বলা ভালো শূন্যে ভাসছে!
নীলাঞ্জন চারপাশের লোকেদের দিকে তাকাল। অবাক ব্যাপার কেউ এটা লক্ষ করছে না। বেশির ভাগ লোক মোবাইলে চোখ ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাদবাকি লোকেরা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছে যেন যুদ্ধ লেগেছে। এক্ষুণি বোমা পড়বে মাথার ওপর তিন সেকেন্ড দাঁড়িয়ে গেলে।
মেয়েটারও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন শূন্যে ভেসে থাকাটা তার কাছে খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। যেন প্রত্যেকদিন তিন ঘণ্টা সে এমনি করেই দাঁড়িয়ে থাকে। নীলাঞ্জনের মনে হল সে যদি এখন গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থাকত, মেয়েটা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে টুকটুক করে হেঁটে হেঁটে গঙ্গা পেরিয়ে যেত! ওপারে গিয়ে রাগী রাগী গলায় চেঁচিয়ে বলত, কি হলটা কি, ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন, চলে এসো!
আজও মেয়েটার চোখে কালো কুচকুচে চশমা, মাথায় কালো ছাতা, বেগুনি সালোয়ার। সেই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, একঝলক নীলাঞ্জনের দিকেও তাকাল। নীলাঞ্জনের মনে হল সামনে ম্যানহোল থাকলে সে তার ভেতরেই সেঁধিয়ে যেত!
এমন সময় ত্রাতার ভূমিকায় একটা বাস দেখতে পেল নীলাঞ্জন। নীলাঞ্জন ভিড় বাসটার হাতল ধরে উঠে পড়ল। হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারল সে দরদর করে ঘামছে আর তার নিজের বুকের ধুকপুক সে নিজে শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে টগবগ টগবগ করে একটা ঘোড়া দৌড়োচ্ছে। নীলাঞ্জন একবার হাতে চিমটি কেটেও দেখে নিলো টুক করে, নাঃ সে জেগেই আছে।
সারাটা দিন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কাটলো তার। কিন্তু শরীরের স্বাভাবিক নিয়মেই খুব গভীর কোনো অনুভূতি খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না। তা সে শোক, দুঃখ, ভয়, ভালোবাসা যাই হোক না কেন। কলেজে গিয়ে দুটো ক্লাস করার পর নীলাঞ্জনের মনে হল সে নিশ্চয়ই ভুল দেখেছে। আর কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না এর। দিনদুপুরে একজন মহিলা শূন্যে ভাসতে পারেন না। সে নিশ্চয়ই মেয়েটাকে নিয়ে বেশি ভেবেছে, তাই এসব দেখেছে। কাল রাতেই সে ভাবছিল সুন্দরী মেয়েরা খুব অহংকারী হয়। তাদের মাটিতে পা পড়ে না। সেজন্যই আজ তার ব্রেন তাকে দেখিয়েছে মেয়েটা শূন্যে ভাসছে।
নীলাঞ্জন যখন বাড়ি এলো তখন সে পুরোপুরি স্বাভাবিক। মোবাইলে কয়েক দান লুডো খেলল। হোয়াটসআপে নোংরা জোকস পড়ে খুকখুক করে হাসল। রাতে ফেসবুকে নোটিফিকেশন চেক করল এবং এসি চালিয়ে দেখল খানিকক্ষণের ভেতর টুপ টুপ করে জল পড়ার আওয়াজ আসছে।
সকালবেলা মাকে বলতেই মা বলেদিল, লোকটাকে আগে ফোন কর। বাবা অফিস বেরিয়ে গেছে, তোর কাছে লোকটার নম্বর আছে। তুই ফোন করে আসতে বলে দে। তুই ওইভাবেই চালাবি আর একগাদা ইলেকট্রিক বিল আসবে নয় শর্ট সার্কিট হবে নয় এসিটা বার্স্ট করে যাবে।
এসি বার্স্ট হলে কী হতে পারে নীলাঞ্জনের ধারণা নেই। মনে মনে একবার ভাবল তার ঘরের স্প্লিট এসিটা আর নেই, সেই জায়গার দেয়ালটাও আর নেই। দেয়ালের ওই জায়গাটায় একটা চৌকো ফুটো, সেখান দিয়ে পাশের বাড়ির সবুজ জানলা দেখা যাচ্ছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই নীলাঞ্জন ফোন করল লোকটাকে। মোবাইলে সেভ করা আছে এরশাদ মালিক এসি বলে। এই প্রথম সে নিজে থেকে ফোন করছে। নইলে মা যেমন তিড়িং বিড়িং করছে, নীলাঞ্জনের মনে হচ্ছে এসি থেকে জল নয়, এসিড পড়েছে। ছেলের মুখে পড়ে পুড়ে যাবে আর তার বিয়ে হবে না। মুখপোড়া ছেলেকে কোনো মেয়ে বিয়ে করবে না বলাই বাহুল্য। যদি না ছেলেটি কোটিপতি হয়। নীলাঞ্জন কোটিপতি নয়, কোনোদিন হবে বলেও আশা নেই।
এরশাদ মালিককে ফোন করে নীলাঞ্জন মুগ্ধ হল। কোনো মানুষের আত্মবিশ্বাস লেভেল এই পর্যায়ের হতে পারে এঁর সঙ্গে কথা না বললে সে জানতে পারত না।
এরশাদ প্রথমেই অবাক গলায় বলল, এসি থেকে জল পড়বে এটা তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার! জল পড়া বন্ধ হয়ে গেলে আবার চালিয়ে নেবেন! সোজা ব্যাপারকে আপনারা কেন এতো জটিল করেন কে জানে!
নীলাঞ্জন বিনীত গলায় বলল, আসলে মা খুব চিন্তা করছে তো দাদা, আমি তো ওইভাবেই সারারাত এসি চালিয়ে শুয়েছিলাম, আজ যদি শর্ট সার্কিট হয়ে যায় কী হবে বলুন! আমার এখনো বিয়ে হয়নি!
এরশাদ নীলাঞ্জনকে আরো চমৎকৃত করে বলল, ভাই আপনি একটা কাজ করুন, এসির কাছে গিয়ে বলুন, জল পড়া থামা নইলে এরশাদ এসে যাবে! এতে করে কাজ হয়ে যাওয়ার কথা। না কমলে বলবেন, চলে আসব। তবে পাঁচশো টাকার কমে এরশাদের হাতের কাজ পাবেন না। আসলে সবই যন্ত্র, বুঝলেন ভাই, এই যে আপনি আমি মোবাইলে কথা বলছি, যন্ত্র, আপনার এসি যন্ত্র, আপনি আমি সবাই যন্ত্র। কিন্তু আপনার কিছু হোক, ডাক্তারের কাছে যাবেন, সম্মান কতো তার! এদিকে আমরাও যে অন্যান্য যন্ত্রের ডাক্তার কেউ বোঝেই না!
নীলাঞ্জন ভেবে দেখল কথাটা এরশাদ খুব ভুল বলেনি। লোকটার সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু কলেজের দেরি হয়ে যাবে। মাকে বলল, লোকটা বলেছে একদিন দেখে ফোন করতে।
মা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ভাত বেড়ে গেল। বলে গেল, একটা কাজ যদি তোকে দিয়ে হয়! এত বড়ো হয়েছিস, একটা এসির মিস্ত্রি বুক করতে পারিস না!
নীলাঞ্জন গম্ভীর গলায় বললো, মিস্ত্রি নয় মা, ডাক্তার বলো! সবই তো যন্ত্র, আমাদের শরীরও একটা যন্ত্র। ডাক্তারবাবুকে তুমি মিস্ত্রি বলো? তাহলে এসির যন্ত্র যে ঠিক করবে তাকে কেন মিস্ত্রি বলছ?
এটা বাড়ি না পাগলাগারদ কে জানে! এই কথা বলে মা গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
এই পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। নীলাঞ্জনের মেজাজ ফুরফুরে ছিল। সে জানে সে মেয়েটাকে আজও দেখতে পাবে। বেগুনি সালোয়ার, কালো চশমা, কালো ছাতা। সে দেখবে পরির মতো মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার পা মাটিতে লেগে আছে।
কিন্তু রাস্তায় পা দিয়েই তার টেনশন আরম্ভ হল। ভয়ানক টেনশন। পেটের মধ্যে গুড়গুড়, বুকের তলায় ঘোড়দৌড় সব কিছু একসঙ্গে। একটা পর্যায়ে গিয়ে নীলাঞ্জন আবিষ্কার করল সে দরদর করে ঘামছে। নীলাঞ্জন নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, টেনশন নেওয়ার কিছু নেই। টেনশন নেওয়ার একেবারেই কিছু নেই, দিনের বেলা, সে কলকাতা শহরে দু হাজার উনিশ সালে সকাল দশটার সময় হাতিবাগান বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছে। তার ভয় পাওয়ার মতো কিছু থাকতে পারে না। হয়তো দেখবে কালো চশমা আজ আর নেই।
কিন্তু বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে সে দেখল কালো চশমা আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেই কালো চশমা, কালো ছাতা, বেগুনি সালোয়ার। পায়ের দিকে দুরুদুরু বুকে তাকিয়ে দেখলো মাটিতেই পা আছে। নীলাঞ্জন ঢোঁক গিলল। থুতুটা কোনো অজানা কারণে তেঁতো লাগল। কিন্তু বুঝতে পারল ঘোড়ার গতিবেগ আস্তে আস্তে কমছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে সে কপালের ঘাম মুছল। একবার আড়চোখে তাকাল।
এমনিতে মেয়েদের বয়স নিয়ে নীলাঞ্জন কোনোদিনই নিশ্চিত হতে পারে না। একবার কলেজে একটা মেয়েকে কাকিমা বলে ফেলায় খুব লজ্জিত হয়েছিল। দোষটা নীলাঞ্জনের ছিল না। সেদিন কলেজে ফিজ জমা দেওয়ার দিন। তার কাছে পাঁচশো টাকার খুচরো ছিলো না। কলেজে অনেকের গার্জেন এসেছিল। সে মেয়েটাকে আগে কোনোদিন দেখেনি। মেয়েটা এমন হাবভাব করছিল, যেন সে সব জানে। এক্ষুণি কোনো ছেলে কি মেয়েকে ডেকে বলবে, চলে আয়, বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
নীলাঞ্জন খুব কিন্তু কিন্তু করে মিউ মিউ করে বলেছিল, কাকিমা একটা পাঁচশো টাকার খুচরো হবে?
মেয়েটা তার দিকে ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলো, আমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি!
তারপর আর মেয়েটা দাঁড়ায়নি। সেকেন্ড ইয়ার মানে তার চেয়েও এক বছরের জুনিয়র। কি লজ্জা কি লজ্জা! এরপর থেকে মেয়েদের বয়স নিয়ে চিন্তা করতেও ভয় হয় নীলাঞ্জনের। ওই ঘটনার পর কোনো অজানা কারণে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ট্যালা। ট্যালারা মেয়েদের বয়স নির্ধারণ করতে অসম্ভবভাবে অক্ষম।
কিন্তু তাও নিলাঞ্জনের দৃঢ় ধারণা এই মেয়েটির বয়স কুড়ির একদিন কম নয়, তিরিশের একদিন বেশি নয়। ভাগ্গিস তাকে জিজ্ঞেস করতে যেতে হবে না!
এসব ভাবতে ভাবতেই আরেকবার আড়চোখে সে মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটি আবার শূন্যে ভাসছে! মাটি থেকে অন্তত তিন থেকে চার ইঞ্চি উঁচুতে ভাসছে মেয়েটি। আশপাশের কারুর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। নীলাঞ্জনের মন শান্ত হয়ে গেল। ভয় এলো না। মনে হল, তার ওপর এরশাদ মালিকের আত্মা ভর করেছে।
নীলাঞ্জন খুব স্বাভাবিক ছন্দে মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আপনি শূন্যে ভাসছেন। আমাকে শিখিয়ে দেবেন কী করে? হইচই পড়ে যাবে তাহলে আমাকে নিয়ে। আমায় কেউ পাত্তা দেয় না। কলেজে আমায় সবাই ট্যালা বলে ডাকে। আমি আকাশে উড়তে পারলে কেউ আমায় আর ট্যালা বলতে পারবে না!
মেয়েটি চোখ থেকে কালো চশমাটা খুলল। নীলাঞ্জন মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। সে যা ভেবেছিল তাই। এত সুন্দর চোখ মানুষের হয় না। টানা টানা বিশাল চোখ মেয়েটার। একবার দেখলে চোখ সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করলেও পারা যায় না। চোখ তো নয়, যেন গভীর দিঘি। কাকচক্ষু জল টলটল করছে। নীলাঞ্জন ভুলেই গেলো চোখ সরিয়ে নেওয়ার কথা। মেয়েটার চোখের মণি নীল। কোথায় যেন পড়েছিল স্বর্গের অপ্সরাদের চোখের মণি নীল হয়। হ্যাঁ, তাই তো, এই মেয়ে স্বর্গের অপ্সরা হলে সব কিছু মিলে যায়। হয়তো বেড়াতে এসেছে পৃথিবীতে। পৃথিবীতে বড়োলোক আর স্বর্গে দেবতাদের এরকম অনেক খেয়াল চাপে মাথায়।
মেয়েটা যেন একটু লজ্জা পেল। বলল, কী দেখছেন?
নীলাঞ্জন ট্যালার মতো বলল, আপনার চোখদুটো কী সুন্দর!
মেয়েটি হাসল। নীলাঞ্জন এই প্রথম হাসতে দেখল মেয়েটাকে। নীলাঞ্জন সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল এই মেয়ে মানুষ হোক কি পরি, একে সে ভালোবাসবে। এছাড়া তার কাছে আর কোনো উপায় নেই। অপ্সরা হলে হিমালয়ে গিয়ে হাজার বছর ধ্যান করবে, শিব তুষ্ট হয়ে বর দেবে। সে বলবে, আমি এই মেয়ের সঙ্গে থাকতে চাই, এই সৃষ্টি যতদিন আছে ততদিন অবধি। মহাদেব হাত তুলে বলবেন, তথাস্তু!
এ যদি মানুষ হয়, নীলাঞ্জন সব ছেড়ে দিয়ে নয় পড়াশোনা করবে, সিএ হবে নয় পলিটিক্সে নাম লেখাবে। জান প্রাণ লড়িয়ে দেবে। নীলাঞ্জন শুনেছে সিএ আর পলিটিশিয়ান দুজনেরই প্রচুর পয়সা হয়। সে সিএ কিংবা নেতা হতে পারলে মেয়েটির বাবা আর না করতে পারবে না।
ঠিক তক্ষুণি এই গোটা দৃশ্যটাকে আরো অপরূপ করার জন্য বৃষ্টি নামল। মেয়েটি লাজুক লাজুক গলায় বলল, সরে এসে দাঁড়ান, ভিজে যাবেন নইলে।
নীলাঞ্জনের মনে হল তার কানে কেউ মধু ঢেলে দিল। মনে হল কোকিল ডাকছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সে একটা কালো সাড়ে পাঁচ ফুট কোকিলের সঙ্গে এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে ভিজছে। ভাবতে একটুও ভালো লাগল না। সে কোকিলের কথা মাথা থেকে বের করে দিল।
বেশ খানিকক্ষণ বৃষ্টি হল। কলেজের বাস একটা এলো, দুটো এলো, তিনটে এলো। নীলাঞ্জন একটা বাস ছাড়ল, দুটো বাস ছাড়ল, তিনটে বাস ছাড়ল। তার মনেই হল না কলেজ বলে কিছু আছে। তার মনে এলো না বাড়ি গিয়ে এসির কাছে গিয়ে বলতে হবে, সো যা, ওয়ারনা এরশাদ আ যায়েগা। নীলাঞ্জনের মনে হল এই বৃষ্টি না থামলেই ভালো। তাহলে সারাজীবন সে আর এই মেয়ে এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে।
মেয়েটা আলতো স্বরে বলল, তাহলে আপনার ভালো লাগবে না। আপনারা মানুষেরা খুব অদ্ভুত, আসলে চান একটা সময় পরে সব শেষ হয়ে যাক, কিন্তু মনকে বোঝান আপনারা অসীমকে ভালোবাসেন। মিষ্টি মিথ্যে বিশ্বাস করতে আপনারা কেন এত ভালোবাসেন কে জানে!
নীলাঞ্জন চমকে উঠল। বলে কী মেয়েটা! এ কি মনের কথাও বুঝতে পারে নাকি! সে তো কিছুই বলেনি। তাহলে মেয়েটা এসব কী বলছে!
নীলাঞ্জন একটু নার্ভাস হয়েই জিজ্ঞেস করে, আপনি আমার মনের কথা বুঝতে পারছেন?
মেয়েটা মাথা নামিয়ে লাজুক লাজুক মুখ করে বলে, হ্যাঁ! আমাদের গ্রহে অন্যের মনের কথা বোঝার কৌশল কয়েক লক্ষ বছর আগে আবিষ্কার হয়ে গেছে।
মেয়েটা আরেকটু থেমে বলল, এই যে বৃষ্টিটা হচ্ছে, এটাও আমি চাইছি বলে হচ্ছে। আপনি চাইলেই বন্ধ হয়ে যাবে।
নীলাঞ্জন আবার নিজের হাতে চিমটি কাটল। গতকাল বাসের মতো। নিজেই উঃ করে উঠল।
মেয়েটা একটু দুঃখ দুঃখ গলায় বলল, আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না?
নীলাঞ্জন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, খুব বিশ্বাস হচ্ছে! আসলে আপনার চোখদুটো… না না, মানে আপনার ছাতাটা… আঃ, আসলে আপনি, মানে, আকাশে উড়তে পারেন?
মেয়েটি ঘাড় নাড়ল। পারে।
– আপনি আকাশে উড়তে পারেন?
– যেকোনো সভ্যতার প্রথম স্তরে প্রাণীরা যখন ইচ্ছাশক্তিকে জড়জগতে প্রথম প্রয়োগ করতে পারে, একদম প্রথম কাজ তারা এটাই করে। এটা আপনাদের ভাষায় ভীষণ প্রিমিটিভ একটা ব্যাপার।
– আপনি কে?
মেয়েটা একটু লাজুক হেসে বলল, আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি আমায় নিয়ে খারাপ খারাপ চিন্তা করছেন!
– আপনি কি দয়া করে আমার মনের ভেতর দেখা থামাতে পারেন?
– পারি, কিন্ত আমার দেখতে ভালো লাগছে।
– আপনি প্লিজ থামান, আমার ভালো লাগছে না।
– আচ্ছা, আপনি বলছেন যখন থামলাম। আর দেখব না।
– আপনি কে?
– আমি লিনা।
– লিনা, আপনি কী করে এসব করছেন?
লিনা একবার এদিক ওদিক তাকাল, তারপর বলল, আপনি একটু আগে একটা ঘরের কথা চিন্তা করছিলেন। আমরা সেখানে গিয়ে বসে কথা বলি?
– এই না, বাড়িতে মা আছে। তুমি, ইয়ে মানে আপনি কি এখনো আমার মনের ভেতর দেখছেন?
– না।
– তাহলে চলুন কোনো ক্যাফেতে গিয়ে বসা যাক?
– আপনি চাইলে আমরা পৃথিবী কি পৃথিবীর বাইরে যেকোনো জায়গায় গিয়ে বসতে পারি।
– তাহলে গড়ের মাঠ যাবেন?
নীলাঞ্জন চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে দেখল তারা গড়ের মাঠে বসে আছে। যা যা হচ্ছে, তারপর সে খুব অবাক হল না। অথবা অবাক হওয়ার লিমিট সে ক্রস করে গেছে। একবার লিমিট ক্রস করে গেলে কোনো কিছুতেই মানুষ অবাক হতে পারে না। এই মুহূর্তে সে যদি দেখে তার দুটো ডানা গজিয়েছে তাও আর নীলাঞ্জন অবাক হবে না।
– আপনার ভালো লাগবে ডানা গজালে?
নীলাঞ্জন দাঁতে দাঁত চিপে বলে, আপনি আমার মনের ভেতর দেখা বন্ধ করবেন?
লিনা দুঃখিত গলায় বললো, ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না।
গড়ের মাঠে কয়েকটা ছেলে দূরে ক্রিকেট খেলছে। আকাশ দেখে বোঝার উপায় নেই একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে। নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, আপনি কে একটু বলবেন?
মেয়েটি জানাল সে অ্যামিডা বলে একটা গ্রহ থেকে পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছে। নীলাঞ্জন যেমন ছুটিতে দিঘা পুরী দার্জিলিং যায় তেমনি ওদের গ্রহের লোকজন ইচ্ছেমতো নানা গ্রহে বেড়াতে যায়। নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করেছে, এলিয়েনরা তো মানুষের মতো দেখতে হয় না। তাদের লিকলিকে হাত পা, বড়ো বড়ো চোখ হয়। লিনা বলেছে তাদের দেখতে মানুষের মতো নয়ও। পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছে বলে এইরকম সেজে এসেছে। যেমন কলকাতায় নীলাঞ্জন সুতির জামা পরে, কিন্তু দার্জিলিং গেলে সোয়েটার সেইরকম।
– কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে সকলের সামনে শূন্যে ভেসে থাকলে তো সবাই চিনে যাবে, বিরক্ত করবে।
– তখন আমাদের চারপাশে যারা ছিল তাদের একাত্তর পার্সেন্ট লোক মোবাইল দেখছিল, উনিশ পার্সেন্ট লোক এত জোরে হাঁটছিল যে চারদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে তাদের লক্ষ করার উপায় ছিল না। আমি দেখছিলাম কে কে নোটিস করে।
তারপর লিনা যে কথা বলল, শুনে নীলাঞ্জনের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাওয়ার জোগাড়। লিনা বলল, আমি চাইছিলাম আপনি আমাকে দেখুন।
– কেন?
লিনা লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, আমার আপনাকে খুব ভালো লেগেছে!
নীলাঞ্জন একবার ঢোঁক গিলল। একবার মাথা চুলকালো। একবার ফোঁস করে জোরে একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর শূন্য চোখে চেয়ে রইলো লিনার দিকে। লিনাও হাসাহাসি মুখ করে চেয়ে রইল। দুজনের কেউ চোখ সরিয়ে নিল না। ঠিক তক্ষুণি বৃষ্টি নামল। জোরে হয়, খুব হালকা, ইলিশেগুঁড়ি। নীলাঞ্জন দেখল তাদের গায়ে জল পড়ছে না। তাদের বসার জায়গাটা ছাড়া বাকি মাঠ ভিজতে থাকল।
নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, এই বৃষ্টিটাও কি আপনি করছেন?
লিনা দুদিকে ঘাড় নেড়ে জানাল, না। এটা সে করছে না।
সন্ধেবেলা ঝুপ করে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে নীলাঞ্জন হাজির হল হাতিবাগান বাসস্ট্যান্ডে। লিনা বলেছিল বাড়ির সামনে ল্যান্ড করাবে। সেই বারণ করেছে। এখানে অনেক লোক, কেউ কারুর দিকে চায় না। বাড়ির সামনে লোকজন তুলনায় কম। কেউ হুট করে যদি দেখে শূন্য থেকে একটা ছেলে উদয় হল, বেচারা ঘাবড়ে যাবে। বয়স্ক লোক হলে হার্ট ফেল জাতীয় কিছু হয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। কলকাতা শহরটা যতটা যুক্তিবাদী বাইরে থেকে লাগে, ভেতর থেকে ততটা নয়।
প্রচণ্ড উত্তেজনার পর একরকমের অবসন্নতা আসে। নীলাঞ্জন বাড়ি গিয়ে দেখল তার অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। পারলে এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়ে। সে চান করল। চা খেলো। মুড়ি বাদাম খেলো। তারপর নিজের ঘরের বিছানায় এসে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। মনে হল খুব সম্ভবত তার জ্বর আসছে।
সন্ধ্যেবেলা ঘর অন্ধকার দেখে মা একবার ঘরে এলো। কিরে সন্ধেবেলা ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস কেন? আমার এখনো শাঁখ বাজানো হয়নি। শরীর খারাপ নাকি।
তারপর নিজেই এসে কপালে হাত দিয়ে বললেন, না জ্বরজারি আসেনি তো। কিরে?
নীলাঞ্জন তেঁতো মুখে জানাল তার মাথা ধরেছে। মা চলে গেল। ঘরের দরজাটা বন্ধ করে নীলাঞ্জন এসির কাছে গিয়ে বলল, সো যা ওয়ারনা এরশাদ আ যায়েগা।
তারপর হালকা করে এসিটা চালিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল। কোনো অজানা কারণে এসি থেকে জল পড়ছে না আর।
রাত্তির দশটার সময় মায়ের ডাকাডাকিতে নীলাঞ্জনের ঘুম ভাঙল। বাবা বলল একটা স্যারিডন খেয়ে নিতে। নীলাঞ্জন বিনা বাক্যব্যয়ে কোৎ করে একটা স্যারিডন গিলে নিল। গিলে নিয়ে ভাবল না খেলেই ভালো হত। তার মাথা ব্যথা করছে না আর।
রাতে ভাত-মাছ খেয়ে সে ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়ল। কিছু চিন্তা করতে ভালো লাগছে না। তার ভালো খারাপ কিছুই লাগছে না। রাতে ঘরে আলো জ্বললে তার ঘুম হয় না। কাচের জানলার সামনে পুরু পর্দা। পর্দার এদিক ওদিক দিয়ে রাস্তার যতটুকু আলো আসে ততটুকুই আলো। আর এসি চালালে এসির আলো। এটা নীলাঞ্জনের একটা বদঅভ্যেস। ডিসেম্বর জানুয়ারি ছাড়া সারাবছর তার এসি চাই। স্লিপ মোডে চব্বিশ করে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে শোয় সে। আজও তাই করল। এবং কম্বলটা টেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে অতল ঘুমে তলিয়ে গেল।
মাঝরাত্তিরে উশখুশ করতে করতে নিলাঞ্জনের ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হল ঘরে আলো আসছে। যা ভেবেছে ঠিক তাই। জানলার পর্দাগুলো টেনে সরিয়ে দেওয়া। সেখান থেকে আলো আসছে। সেই আলোয় নীলাঞ্জন দেখতে পেলো খাটে লিনা বাবু হয়ে বসে নোখ খুঁটছে। এলিয়েনরা নোখ খোঁটে নিলাঞ্জন জানত না। হলিউডের কোনো সিনেমায় এলিয়েনদের নোখ খুঁটতে দেখা যায় না।
ভূত দেখার মতো চমকে উঠল নীলাঞ্জন। তুমি আমার বাড়ি চিনলে কী করে?
– তুমি আমার কথা ভাবছিলে, তাই চলে এলাম। এসে দেখি তুমি ঘুমোচ্ছ, তাই অপেক্ষা করছিলাম তোমার ঘুম ভাঙার।
– আমি তো ঘুমচ্ছিলাম।
– তাতে কি, মানুষের ভাবনার রং থাকে, শেপ থাকে। তোমাদের চোখ এখনো দেখতে পায়না ভাবনা চিন্তার রং, আমি দেখতে পাই। আমি দূর থেকে দেখতে পেলাম তুমি কষ্ট পাচ্ছ। তোমার কষ্টটা অনেকটা আমার মতো দেখতে। তাই চলে এলাম।
নীলাঞ্জন সত্যি সত্যি লিনাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখছিল। কী দেখছিল এখন আর আনন্দের চোটে মনে পড়ছে না। কিন্তু গভীর বেদনার কিছু দেখছিল। এখনো তার মনটা ভারী হয়ে আছে। আবার একই সঙ্গে লিনাকে দেখে ভীষণ আনন্দও হচ্ছে।
– তুমি কি আমার মা বাবা যাতে জেগে না যায় তার ব্যবস্থা করতে পারো? একবার ওরা উঠে পরে যদি দেখে মাঝরাতে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি, আমায় বাড়ি থেকে বের করে দেবে। ভিক্ষে করে খেতে হবে তখন আমায়।
লিনা মুচকি হেসে বলল, ওরা উঠবে না। গভীর ঘুমোচ্ছে ওরা। তোমার চিন্তা নেই।
নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, তোমাদের আসলে দেখতে কীরকম?
– তোমাদের চোখ আমাদের দেখতে পাবে না।
– কেন, তোমরা কি হাওয়ার মতো নাকি?
– ঠিক তা নয়, সময় যেমন সব জায়গায় সমান নয়, স্পেসও সব জায়গায় সমান নয়। আমাদের গ্রহের স্পেসের প্রকৃতি অন্যরকম। সেখানে তোমাদের চোখ কাজ করবে না।
– এখানে তো দেখাতে পারবে!
– এখানে আমি চাইলেও নিজের আসল চেহারায় পৌঁছতে পারব না। সেই ক্ষমতা এখনো প্রকৃতি আমাদের দেয়নি।
– তাহলে আমাকে তোমাদের গ্রহে নিয়ে যাবে?
– আমার খুব ইচ্ছে তোমায় নিয়ে যাই আমাদের গ্রহে। কিন্তু আমাদের গ্রহে তোমায় ঢুকতে দেবে না। এলিয়েন আইন খুব কড়া ওখানে। আর আমার কাছে একটাই ছাতা আছে। একটা ছাতা একজনকেই ফেরত নিয়ে যেতে পারবে।
– তার মানে ওই ছাতাটা তোমার বাহন?
লিনা মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, বাহন।
নীলাঞ্জন একবার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার বয়স কত?
জিজ্ঞেস করেই জিভ কাটল। মেয়েদের, বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই এটা একটা প্রাথমিক ব্যাপার। কিন্তু এলিয়েন মেয়েও কি রাগ করবে? হোক এলিয়েন, মেয়ে তো!
লিনা রাগ করল না। কিন্তু সোজাসুজি উত্তরও দিল না। জানালো তাদের ওখানে বয়সের হিসেব পৃথিবীর মতো নয়। তাদের সূর্য, সময়ের স্রোত সবই আলাদা। নীলাঞ্জন আর খোঁচাখুঁচি করল না।
নীলাঞ্জন একটু আলহাদী গলায় জিজ্ঞেস করল, আমাকে তোমার কেন পছন্দ?
লিনা এককথায় বলল, এমনি।
নীলাঞ্জন একটু দুঃখ পেল। নীলাঞ্জনের মুখ দেখে খুব সম্ভবত লিনারও খারাপ লাগছিল। তাই আবার বলল, কোনো কারণে পছন্দ হওয়ার চেয়ে এমনি এমনি পছন্দ হওয়া অনেক ভালো নীলাঞ্জন।
প্রথমবার লিনার মুখে নিজের নাম শুনে নীলাঞ্জনের গাটা শিউরে উঠল একবার। বললো, বাবা মা উঠে পড়বে না তো?
লিনা মুখ নামিয়ে বলল, না।
নীলাঞ্জন আলতো করে লিনার হাতে হাত রাখল। লিনা বারণ করল না। নীলাঞ্জনের মনে হল লিনা একবার কেঁপে উঠল যেন। সে আরো একটু কাছে গিয়ে বসল। লিনার গা থেকে খুব সুন্দর একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। এই গন্ধটা আজ সকালবেলা ছিল না। কিন্তু এখন পাচ্ছে নিলাঞ্জন। কোনো একটা ফুলের গন্ধ। কোন ফুলের গন্ধ সে জানে না। এই ফুল পৃথিবী না অন্য কোনো গ্রহের তাও সে জানে না। নীলাঞ্জনের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নীলাঞ্জন দেখল লিনা নেই। মনটা একটু খারাপ হল তার। জানলা দিয়ে সকালের আলো এসে পড়েছে। ওই জায়গাটায় কয়েক ঘণ্টা আগে পৃথিবীর, হয়তো গোটা মহাবিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর মানুষটা বসেছিল।
প্রেমে পড়লে খুব সম্ভবত পুরোনো কথা মনে পড়ে। নীলাঞ্জনের হঠাৎ মনে পড়ল মা ছোটোবেলায় সুর করে করে গাইত, পদ্মদিঘির কালো জলে হরেক রকম ফুল, হাঁটুর নীচে দুলছে খুকুর গোছা ভরা চুল। লিনার চুল হাঁটুর নীচ অবধি নয়। কিন্তু তাও তার মনে হল মহাকাশের কোনো স্পেস স্টেশনে একটা সুইমিং পুল। লিনা সেখানে চান করতে নামছে। চারদিকে অজানা অচেনা গ্রহ নক্ষত্র। কোনটা সূর্য কোনটা চাঁদ কোনটা পৃথিবী বোঝার উপায় নেই। লিনা বুক থেকে সাদা তোয়ালেটা খুলে নীল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে নীলাঞ্জন দেখল লিনা যথারীতি দাঁড়িয়ে আছে। চোখে কালো চশমা, মাথায় কালো জেন্টস ছাতা, বেগুনি সালোয়ার। একগাল হেসে সে লিনার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। লিনা খুব স্বাভাবিকভাবে নীলাঞ্জনের হাত ধরল আলতো করে। নীলাঞ্জনের মনে হল সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
পরপর কয়েকটা দিন স্বপ্নের মতো কেটে গেল। সেদিন ওরা গিয়ে বসল গঙ্গার ধারে। নীলাঞ্জন মজা করে জিজ্ঞেস করল, তুমি জলের ওপর হাঁটতে পারো?
লিনা মুচকি হেসে বলল, তুমিও পারবে আমার হাত ধরে থাকলে। যাবে?
– না, লোকে ভয় পাবে।
লিনা এমনিতে বেশ কম কথা বলে। বেশির ভাগ সময় সে নীলাঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের গ্রহের মেয়েরা কীরকম হয় নীলাঞ্জন জানে না। কিন্তু লিনার চুপ থাকা ওর ভালো লাগে। কথা বললেও ভালো লাগে। এককথায় বলতে গেলে লিনার সবটুকুই ওর ভালো লাগে। সব কিছু নিখুঁত।
একদিন লিনা বলল, পৃথিবীর বাইরে থেকে পৃথিবীকে কেমন দেখতে লাগে দেখবে?
নীলাঞ্জন একটু ভেবে বলল, মহাকাশে নিশ্বাস নেবো কেমন করে?
– সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।
– চলো।
নীলাঞ্জন তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তটা সেদিন কাটাল। মুহূর্তের মধ্যে তারা চলে এলো পৃথিবীর বাইরে। গোল নীল বলটা অপরূপ লাগছে। এই উচ্চতা থেকেও সাদা সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে। একদম ওপরে নর্থ পোলটা ধবধবে সাদা। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে সাউথ পোল দেখা যাচ্ছিল না। সূর্য দেখা যাচ্ছে। চাঁদটা আরো বড়ো লাগছে। কালো নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে নীল একটা আলোর বল ভাসছে। ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে কোথায় চলে যাচ্ছে! নীলাঞ্জনের মনে হল তার কান্না পাচ্ছে। পৃথিবী এত সুন্দর! খুব বেশি সুন্দর কিছু একটানা দেখা যায় না।
নীলাঞ্জন বুঝতে পারল সে তিরতির করে কাঁপছে। লিনা তার একটা হাত ধরল। সে শক্ত করে প্রাণপনে হাতটা চেপে ধরল। তারপর জলভরা চোখে লিনার দিকে তাকাল। লিনা কোনো কথা বলছে না।
নীলাঞ্জন তার দুটো হাত দিয়ে লিনার দুটো গাল ধরে তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। তারপর অস্ফুট গলায় লিনার কানে কানে বলল, তুমি পৃথিবীর চেয়েও সুন্দর! তারপর লিনাকে জড়িয়ে ধরে সে চোখ বন্ধ করে নিল। এত সুন্দর একসঙ্গে সে নিতে পারছে না। তার ভয় লাগছে।
লিনা কথাটা শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না। মহাকাশে বাতাস নেই। তাই শব্দ চলাচল করতে পারে না। এই সময় যে কেন লিনা তার মন পড়ছে না কে জানে! মেয়েরা কিচ্ছু বোঝে না। তা সে পৃথিবী হোক কি অ্যামিডা।
এখন আর কলেজে কেউ ট্যালা বলে ডাকলে নীলাঞ্জনের মন খারাপ হয় না। তারপরই তার খেয়াল হয় সে অনেকদিন কলেজ যায়নি। অনেকদিন মানে হপ্তাখানেক তো হবেই। লিনার সঙ্গে থাকতে থাকতে দিন হপ্তা মাস বছর সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
নীলাঞ্জন একদিন লিনাকে জিজ্ঞেস করেছিল, পৃথিবীতে তোমার এই রূপ তুমি কী করে ঠিক করলে? তোমাদের ওখানে কোনো অসাধারণ শিল্পী এই রূপ তৈরি করেছে?
লিনা শুনে খিলখিল করে বাচ্ছা মেয়ের মতো হেসে উঠেছে। বলেছে, আমরা যখন অন্য গ্রহে যাই, সেখানকার কোনো প্রাণীর মতো রূপ ধারণ করি। আমার মতো দেখতে একজন লিনা পৃথিবীতে আছে। সেটা আমাদের সিস্টেম ঠিক করেছে।
– বলো কি? এই পৃথিবীতে অবিকল তোমার মতো দেখতে কেউ আছে?
– উলটো হবে কথাটা। অবিকল তার মতো দেখতে একজন ভিনগ্রহী এই পৃথিবীতে আছে। খুব সম্ভবত তার নামও লিনা। তোমার তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে?
নীলাঞ্জন ঘাড় নাড়ে। না, তার কোনো আগ্রহ নেই।
কয়েকদিন পর অবধারিতভাবেই প্রশ্নটা সামনে আসে। লিনার বেড়াতে আসার মেয়াদ কতদিন? নীলাঞ্জন লিনাকে বলে সে যদি পৃথিবীতে পাকাপাকিভাবে থেকে যায় তাহলে কী সমস্যা!
লিনা জানায় সমস্যা তার নয়, সমস্যা পৃথিবীর। প্রথম সমস্যা পৃথিবীতে থাকলে তার বয়স পৃথিবীর মানুষের অনুপাতে বাড়বে না। একটা হিসেব দিয়েছিল লিনা। নীলাঞ্জনের তিন প্রজন্ম পরের কেউ হয়তো দেখবে লিনার মাথায় একটা পাকাচুল গজিয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ হল পৃথিবীর নীলাঞ্জনের সঙ্গে অ্যামিডা গ্রহের লিনার মিলন হলে সেটা প্রকৃতিকে অতিক্রম করা হয়ে যায়। লিনার ধারণা প্রকৃতি যেভাবে হোক এটাকে আটকাবার চেষ্টা করবে। তার ফল ভালো হবে না। মহাবিশ্বের যে কোনো প্রাণীর প্রথম প্রবৃত্তি হল পরের প্রজন্মকে রক্ষা করা।
তবে তার চেয়েও বড়ো কারণ হল লিনার থাকার ইচ্ছে নেই।
নীলাঞ্জন আহত হয়। গভীরভাবে আহত হয়। তার মানে কি লিনা তাকে ভালোবাসে না? লিনা জানায় সে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসে নীলাঞ্জনকে। কিন্তু ভালোবাসে মানেই তাদের সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে হবে এটার কোনো মানে নেই লিনার কাছে। কথোপকথনটা হয় অনেকটা এইরকম।
– তুমি কি আমায় ভালোবাসো না?
– খুব ভালোবাসি, নিজের চাইতে ঢের বেশি ভালোবাসি।
– তাহলে চলে যাচ্ছ কেন?
– প্রথম দুটো কারণই চলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আরো বড়ো কারণ হল আমাদের মিলন কোনোদিনই হওয়ার ছিল না। তাহলে আমি মানুষ হয়ে এখানে জন্মাতাম না হয় তুমি অ্যামিডা গ্রহে জন্মাতে।
– তাহলে তুমি এগোলে কেন?
– ওমা, তোমায় ভালোবাসি বলে! এবং এই ভালোবাসার কোনো কারণ নেই বলে।
– ভালোবাসলে তো একসঙ্গে থাকতে হয়।
– তোমার তো পাহাড় পছন্দ। বেড়াতে গিয়ে ফিরে আসো কেন তাহলে?
– কী কথার কী উত্তর!
– সব ভালোবাসাই বেড়াতে যাওয়া। বেড়িয়ে আবার নিজের কাছে ফিরে আসতে হয়। নাহলে ভালোবাসা মরে যায়।
– তাহলে তো কাউকে ভালোবাসাই উচিত নয়।
– একদম উচিত। কিন্তু যে যেরকম তাকে সেরকম করেই ভালোবাসা উচিত। তুমি তো আমায় চেনোই না। মানুষের মতো দেখতে বলে ভালোবাসো।
– মানুষ হয়ে মানুষকে ভালোবাসতে পারব না?
– আমি মানুষ নই।
– আচ্ছা তুমি আমায় পৃথিবীর চোখে দেখো না তোমার গ্রহের চোখ দিয়ে?
– দুটো দিয়েই।
– কোনটা বেশি সুন্দর?
– আমার গ্রহের চোখ দিয়ে দেখলে তোমায় একটা রামধনুর মতো দেখতে লাগে। একটা প্রজাপতির মতো, তার চারদিক থেকে রামধনুর ছটা বেরোচ্ছে। আমাদের গ্রহে রামধনু নেই। তোমায় যে কত সুন্দর লাগে তোমার কোনো ধারণা নেই। সেজন্য তোমাকে এই এত্তখানি ভালোবাসি।
– আমায় ছেড়ে থাকতে তোমার মন খারাপ করবে না?
– আমি কাল হিসেব করে দেখছিলাম। তোমাদের গ্রহে সময় যে গতিতে বয় সেই হিসবে আমি হাজার বছর বাঁচতে পারি। আমি হাজার বছর পর্যন্ত তোমায় ভালোবাসবো।
– আমিও ভালোবাসবো তোমায়।
– আমার হিসেব বলছে আমরা একসঙ্গে থাকলে তুমি তিন বছরের পর থেকে আমায় আর এভাবে ভালোবাসবে না। এখন আলাদা থাকলে আরো এগারো বছর তুমি আমায় মনে রাখবে। আমি চাই তুমি আমার কথা মনে রেখে রাত্তিরে কাঁদো। আমার জন্য কেউ কাঁদছে এই ব্যাপারটায় আমার অসম্ভব লোভ লাগে।
– তোমার হিসেব ভুল।
– হিসেব ভুল হয় না। তোমার মাথার স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা আমার থেকে ঢের কম। তোমরা একসঙ্গে বেশি অনুভূতি প্রসেস করতে পারো না। আমরা পারি। তাই তোমার সঙ্গে যখন থাকি, চুপ করে থাকি। ভালো লাগায় কাঁপতে থাকি। কথা বলতে পারি না। তাই চুপটি করে রামধনু দেখি।
– তাও চলে যাবে!
– তোমরা পৃথিবীর মানুষ সময় দিয়ে ভালোবাসা মাপতে খুব ভালোবাসো। আমি রামধনু দিয়ে ভালোবাসা মাপি।
– তুমি খুবই বাজে একটি মেয়ে। অহংকারী, জেদী এবং স্বার্থপর। তুমি কি জানো সেটা?
নীলাঞ্জন দেখে লিনা চুপ করে আছে। খুব সম্ভবতঃওদের গ্রহে কেউ কাঁদে না। নাহলে হয়তো লিনা এই মুহূর্তে কাঁদত। কিন্তু প্রকৃতি ভারসাম্য ভালোবাসে। নীলাঞ্জন লিনাকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। লিনা শুনতে পেল নীলাঞ্জন বারবার বলছে, সরি সরি।
লিনা পরম মমতায় নীলাঞ্জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
লিনা আগামীকাল চলে যাবে। গতকাল রাতে নীলাঞ্জন একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে। অদ্ভুত স্বপ্নের থেকেও বড়ো কথা হল স্বপ্নটা তার মনে আছে। কোনো স্বপ্নই তার মনে থাকে না। ঘুম থেকে উঠেই মাথা চুলকে তাকে ভাবতে হয় কেন এতো আনন্দ হচ্ছে অথবা কেন এত বেদনা হচ্ছে। কিন্তু কালকে রাতের স্বপ্নটা দিনের আলোর মতো সে দেখতে পাচ্ছে। এখনও। যেন স্বপ্ন নয়, সত্যি ঘটনা।
নীলাঞ্জন দেখেছে লিনা একটা উঁচু ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিজের অনেক তলা দিয়ে একটা নদী চলে যাচ্ছে। চারদিকে পাহাড়। পেছন দিকে ট্রেকারে করে লোকজন যাচ্ছে। কম, কিন্তু যাচ্ছে। লিনা ব্রিজের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। একা একা। খুব সম্ভবত সকাল এগারোটা নাগাদ হবে। কিন্তু কোনো রোদ নেই। আকাশে মেঘ করে আছে। পাহাড়ে বৃষ্টি দেখতে তার খুব ভালো লাগে। মনে হয় সারাদিন বসে বসে বৃষ্টি দেখি। ভাগ্গিস লিনা আর তার মনের ভেতর ঢোকে না, নইলে কিছু একটা ভুলভাল কথা বলত আর তার মন খারাপ হয়ে যেত।
স্বপ্নে নীলাঞ্জনও আছে। লিনা ব্রিজের একটা দিকে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঠিক উলটোদিকে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছে লিনাকে। মজার ব্যাপার লিনার গায়ে সেই সিগনেচার বেগুনি সালোয়ার আর নেই। একটা খয়েরি জ্যাকেট পরে আছে লিনা। স্বপ্নের মধ্যে নীলাঞ্জন বুঝতে পারছে যে সে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু এত বাস্তব স্বপ্ন সে কোনোদিন দেখেনি। যেন সে কোনোভাবে হাতিবাগানের বাড়ি থেকে উড়ে গিয়ে লিনার মুখোমুখি পড়ে গেছে।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নীলাঞ্জন রাস্তা পেরোল। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। পাহাড় জঙ্গলের দিকে মাঝে মাঝে এসির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন হঠাৎ হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া লাগে সেরকম হাওয়া দিচ্ছে। নীলাঞ্জন দেখল সে কলকাতার পোশাকই পরে আছে। হাড় পর্যন্ত ঠান্ডায় কেঁপে যাচ্ছে তার।
রাস্তা পেরিয়ে নীলাঞ্জন অপেক্ষা করছে। লিনা এখনো পেছন ফেরেনি। সে অপেক্ষা করছে কখন লিনা পেছন ফিরে তাকে দেখবে আর অবাক হয়ে যাবে। লিনাকে এমন ভাবে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য সে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। লিনার সামনে অনেকদূর পর্যন্ত নদী চলে গেছে। দুদিকে পাহাড়, আকাশে কালো মেঘ। এসবের কেন্দ্রবিন্দুতে পৃথিবীর এবং খুব সম্ভবত গোটা ইউনিভার্সের সবচেয়ে সুন্দর দেখতে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। গোটা দৃশ্যটার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যেটা নীলাঞ্জন ঠিক বুঝতে পারছে না। যেটা আছে সেটা পার্থিব কিছু নয়।
একটা সময় লিনা পেছন ফিরল। ফিরেই নীলাঞ্জনকে দেখতে পেলো। নীলাঞ্জন হাসল। লিনা হাসল না। নীলাঞ্জন বলল, বৃষ্টি পড়লে ভিজবে?
লিনা অবাক হয়ে বলল, আমি কি আপনাকে চিনি?
তারপরেই লিনা দুটো হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল। নীলাঞ্জন শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে ধরতে গেল। লিনা হাত বাড়িয়ে মানা করল। একটু বাদে ধাতস্ত হয়ে বলল, আপনি গায়ে কিছু পরেননি কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো!
নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার লিনা?
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, আমি আপনাকে স্বপ্নে দেখেছি। আপনি আর আমি একটা বিশাল মাঠের মধ্যে বসে আছি। কিন্তু আপনি আমাকে লিনা কেন বলছেন? আমার নাম নীলাঞ্জনা।
ঠিক সেই মুহূর্তেই নীলাঞ্জনের ঘুমটা ভেঙে গেল। এবং নীলাঞ্জন বুঝতে পারল তার মাথায় তীক্ষ্ণ ছুঁচের মতো ব্যথা হচ্ছে। এবং মনে হল তার জ্বর আসছে। তুমুল ধুম জ্বর। আয়নায় গিয়ে দেখল তার দুটো চোখ জবাফুলের মতো লাল। তারপর ঘড়ির দিকে তাকাতেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল সে। নটা বেজে গেছে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে! মা অন্যদিন তাকে ডেকে দেয় আজ কেন ডাকেনি!
আজ লিনার সঙ্গে তার শেষ দেখা। আজ তার একশো সাত জ্বর উঠে গেলেও যেতে হবে। সে কী বলবে সে জানে না। কিন্তু এটুকু জানে তাকে যেতে হবে। যে কোনো মূল্যে।
দশটার সময় সে যখন বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াল তখন তার পা টলছে। লিনা তাকে দেখেই আতঁকে উঠেছে। নীলাঞ্জনের হাতটা ধরেই লিনা করুণ গলায় বলল, তোমায় গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কী হয়েছে তোমার? আজকের দিনে আমার সঙ্গে এরকম করো না প্লিজ!
লিনার বলার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কাঁদছে। কিন্তু তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে না। নীলাঞ্জন ফিসফিস করে বলল, এমন একটা কোথাও নিয়ে চলো যেখানে কেউ আমাদের চেনে না।
মুহূর্তের মধ্যে তারা পৌঁছে গেল একটা সবুজ গালচের মতো মাঠে। চারদিকে গাছপালা। দূরে দূরে উঁচু উঁচু বাড়ি দেখা যাচ্ছে। গড়ের মাঠের মতোই। কিন্তু গড়ের মাঠের থেকে অনেকটা বেশি সবুজ। বাড়িগুলোও কলকাতার মতো নয়। আরো উঁচু উঁচু।
নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করল না কোথায় তারা। লিনা বলল, এখানে আমাদের কেউ বিরক্ত করবে না। কী হয়েছে নীলাঞ্জন? প্লিজ বলো আমায়, তোমায় এভাবে ছেড়ে আমি কিকরে ফিরে যাই বলো তো!
নীলাঞ্জন লিনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। তারপর লিনার একটা হাত চেপে রেখে বলল, তাহলে যেও না।
লিনা হাসলো, পাগল একটা। কী হয়েছে আগে বলো।
নীলাঞ্জন সংক্ষেপে কাল রাতের স্বপ্নটা বলল। শুনে লিনার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। বলল, এমন কিছু একটা হতে পারে আমি আশঙ্কা করেছিলাম, কিন্তু এর সম্ভাবনা শতকরা তিন শতাংশের কম বলে গুরুত্ব দিইনি।
– কি হয়েছে, তুমি এরকম করছ কেন লিনা?
– দেখো আমি জানি না তুমি বুঝবে কিনা, কিন্তু আমার আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা উচিত নয়।
– কেন?
– তুমি যেটা দেখেছ সেটা স্বপ্ন নয় নীলাঞ্জন।
– কী বলছ?
– তুমি সত্যি সত্যিই ওখানে গিয়েছিলে এবং নীলাঞ্জনার সঙ্গে কথা বলেছ। তবে মেয়েটির নাম যে নীলাঞ্জনা সেটা আমি জানতাম না। আমি লিনাই জানতাম। কিন্তু আমাদের ভাষায় উচ্চারণ এরকম করে হয় না। সুতরাং নীলাঞ্জনাকে আমি লিনা ভেবে ভুল করতেই পারি।
– কী হয়েছে একটু স্পষ্ট করে বলবে?
– তুমি বুঝতে পারবে না।
– চেষ্টা তো করো।
লিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলতে শুরু করলো।
– দেখো যেকোনো সভ্যতা যতই উন্নতি করুক না কেন, প্রকৃতির থেকে বড়ো কোনো সভ্যতাই নয়। তোমরা সেই দিক দিয়ে সভ্যতার ভীষণই প্রিমিটিভ স্তরে আছো। আমরা অনেকটা এগিয়ে, কিন্তু আমরাও প্রকৃতিকে ভয় করি। তার নিয়ম মেনে চলি।
যে মেয়েটির আদলে আমায় তৈরি করা হয়েছে আমার আর তার ডিএনএ এক। তার শরীরের সবকটা কোশ আমার শরীরের সব ক-টা কোশ এক। অন্তত আমি যখন প্রথম তোমাদের পৃথিবীতে পা রেখেছিলাম তখন তাই ছিল। সুতরাং যে প্রকৃতিতে একটা লিনা থাকার কথা সেখানে এখন দুজন লিনা অথবা নীলাঞ্জনা আছে। এটা প্রকৃতি পছন্দ করছে না।
– পছন্দ করছে না মানেটা কি?
– পছন্দ করছে না মানে আমরা একটা বেসিক রুল ভেঙেই এই যাত্রাগুলো করি। যে গ্রহে যাচ্ছি, সেখানকার কারুর ডিএনএ নিয়ে সেই গ্রহের উপযোগী একটা শরীর বানিয়ে তার ভেতর নিজেদের চেতনা প্রতিস্থাপিত করি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছু হয় না। কারণ এই মহাবিশ্ব যত বড়ো, তাতে নিয়মের এইটুকুনি বিচ্যুতি অসম্ভব রকমের ছোটো একটা ঘটনা। এতে প্রকৃতির গ্র্যান্ড প্ল্যানের কিছু এসে যায় না। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে প্রকৃতি এই বিচ্যুতি ধরে ফেলে এবং তখন সেটা ঠিক করতে চেষ্টা করে।
– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি এমন করে কথা বলছ প্রকৃতি যেন একটা প্রাণী! তুমি কি ঈশ্বরের কথা বলছো?
লিনা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললো, ঈশ্বর বলতে তোমরা কী বোঝ আমি জানি না। কারণ তোমরা পৃথিবীর একেক প্রান্তে ঈশ্বরের একেক রকম সংজ্ঞা দাও। আমি একবার বোঝার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তোমরা ভীষণই কনফিউসড ঈশ্বরকে নিয়ে। প্রকৃতিতে একটা ভারসাম্য আছে। আমি সেটার কথা বলছি। সেই ভারসাম্যের চূড়ান্ত রূপ কোনো সভ্যতা আজও বের করতে পারেনি। কিন্তু সে মাঝে মাঝে জানান দেয়, সে আছে। তুমি যদি তাকে ঈশ্বর বলতে চাও, বলো।
– কিন্তু আমি তো দিনের বেলা গেছিলাম।
লিনা হাসল। কটা বাজে এখন বলত? নীলাঞ্জন হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, সাড়ে এগারোটা।
লিনা আলতো করে নীলাঞ্জনের একটা হাত ছুঁয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে তারা দুজন কালকের স্বপ্নে দেখা ব্রিজটার কাছে চলে এলো। তারা এখন ব্রিজটা শুরুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। লিনা আঙুল তুলে দেখাল নীলাঞ্জনকে।
নীলাঞ্জন আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়ে দেখল ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গার একদিকে সে দাঁড়িয়ে আছে, তার ঠিক উলটোদিকে দাঁড়িয়ে আছে লিনা অথবা নীলাঞ্জনা। একটা সময় পর কাল স্বপ্নের মতোই সে নীলাঞ্জনার কাছে গেল। দাঁড়িয়ে রইল। নীলাঞ্জনা একটু পরে পেছন ফিরল। অবাক হল। নীলাঞ্জন এত দূর থেকে ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিল না। কিন্তু বুঝতে পারছিল কালকের স্বপ্নের ঘটনার অবিকল পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। একটা সময় পর সে দেখল ভোজবাজির মতো সে মিলিয়ে গেল গোটা দৃশ্যটা থেকে। নীলাঞ্জনা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে এতো অবাক সে জীবনে কোনোদিন হয়নি।
লিনা ফিসফিস করে বলল, তোমার ঘুম এইসময় ভেঙেছিল।
আবার তারা ফিরে এল আগের পার্কটায়। নীলাঞ্জন বলল, তাহলে এবার কী হবে?
লিনা ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, এবার আমায় যেতে হবে নীলাঞ্জন। আমি যত তোমাদের মধ্যে থাকব তোমাদের তত বিপদ বাড়বে। আমার জন্য তোমাদের কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না।
– কিন্তু কিছু তো একটা উপায় বের করাই যায়।
– প্রকৃতির ওপর কারুর কোনো কথা চলে না।
– কিন্তু এরপর হবেটা কি?
– আমি জানি না। কিন্তু একবার যখন প্রকৃতি সংশোধন শুরু করেছে, তখন অনেক কিছুই হতে পারে।
– যেমন?
– আমি জানি না। প্রকৃতি কি করবে এটা ইউনিভার্সের কোনো কম্পিউটার অঙ্ক কষে বের করতে পারবে না। তোমাদের বিপদ হতে পারে, নাও পারে। তোমাদের গ্রহের বিপদ হতে পারে, নাও পারে।
– আমাদের জন্য গোটা গ্রহের বিপদ!
– কেন তোমাদের সামগ্রিক দূষণের জন্য তোমাদের গ্রহের বিপদ হয়নি? অবশ্য এতে প্রকৃতির কিছু এসে যায় না। সে নিজেকে রক্ষা করতে জানে। বিপদ তোমাদের।
– সামান্য আমার জন্য গোটা গ্রহের বিপদ!
– তুমি সামান্য নয় প্রথম কথা। তোমরা সবাই, সত্যি বলতে এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবাই সবার সঙ্গে কানেক্টেড। সবকিছুই একটা ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে। একটা ছোট্ট পিঁপড়েও কি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার এই স্তরে তোমরা চিন্তাও করতে পারো না। সুতরাং একটা সুতোয় টান পড়লে গোটা সৃষ্টিতে টান পড়তে পারে।
– কিন্তু উপায়?
– উপায় আমার এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাওয়া। আমার ধারণা এটা একটা ওয়ার্নিং। এরপরও আমি থাকলে আরো বড়ো বিপদ আসবে। এবং সেটা এলে আমরা কেউ সেটা সামলাতে পারব না।
নীলাঞ্জনের মাথা ঘুরছিল। অর্ধেক অথবা কোনো কথাই সে বুঝতে পারেনি। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছে লিনার আর এখানে থাকা উচিত নয়। লিনারও ক্ষতি হতে পারে এতে।
লিনা মিষ্টি হেসে বলল, প্রকৃতি কি চাইছে জানো?
– কী?
– তোমার আর নীলাঞ্জনার মিলন। নাহলে নিজের স্বাভাবিক নিয়ম এতখানি বেঁকিয়ে তোমাদের মুখোমুখি দাঁড় করাতো না প্রকৃতি।
নীলাঞ্জন মুখ গম্ভীর করে থাকল। কোনো কথা বলল না। লিনা সেই দেখে আবার বলল, ব্যাপারটা কিন্তু খুব একটা খারাপ নয় নীলাঞ্জন। বরং সব দিক থেকে ভালো। সবার জন্য। সত্যি কথা বলো, তোমার নীলাঞ্জনাকে ভালো লাগেনি?
নীলাঞ্জন মনে করার চেষ্টা করে। একটা কথা হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায়। ব্রিজটা করোনেশন ব্রিজ। তিস্তার ওপর। যতবার নর্থ বেঙ্গল গেছে ততবার সে ব্রিজটা দেখেছে। তার মানে নীলাঞ্জনা নর্থ বেঙ্গল থাকে। এর বেশি কিছু তার মাথায় এলো না।
লিনার কথায় তার হুঁশ এলো, আমি যাই নীলাঞ্জন?
নীলাঞ্জন দেখল তারা হাতিবাগান বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই তার মনে একটা প্রশ্ন এলো। সে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি এতদিন রইলে, ততদিন কিছু হল না কেন? তুমি তো চলেই যাচ্ছিলে। যে আমায় স্বপ্ন দেখিয়েছে, সে যদি সব জানে, সে এটুকু জানবে না?
লিনা ততক্ষণে ছাতার বোতাম টেপাটিপি শুরু করে দিয়েছে। একটা সময় তার ছাতার কাজ শেষ হল। লিনা নীলাঞ্জনের একটা হাত ধরল। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, কাল রাতে আমি ভেবেছিলাম আমি আর ফিরে যেতে চাই না।
নীলাঞ্জন শিউরে ওঠে লিনার হাতদুটো ধরতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। লিনা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের অ্যামিডা গ্রহে। নীলাঞ্জন দেখল তার পায়ের কাছে একটা কালো চশমা গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে নীচু হয়ে চশমাটা তুলে নিল। এলিয়েনের সব কিছু তাহলে ভিনগ্রহের ছিল না।
ঠিক এই সময়েই বৃষ্টি নামল। ইলশেগুঁড়ি নয়, মুষলধারে বৃষ্টি। নীলাঞ্জন আকাশের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বললো, প্রকৃতি, তুমি লিনাকে ভালো রেখো, তুমি লিনাকে খুশি কোরো।
বাড়ি ফিরে নীলাঞ্জন তুমুল জ্বরে পড়ল। তিনদিন রইল সেই জ্বর। দিনের প্রায় পুরোটা সময়ই সে বিছানায় শুয়ে কাটাল। অর্ধেক সময় ঘুমিয়ে। কিন্তু একটাও স্বপ্ন দেখল না সে।
তিনদিন বাদে নীলাঞ্জন অনেকটা ঝরঝরে হয়ে গেল। জ্বর আর নেই। অনেকদিন কলেজ কামাই হয়েছে। থার্ড ইয়ারে এমনিতেই কম ক্লাস হয়, তার ওপর এত কামাই করলে খবর আছে। এবার আবার কলেজে ফিরতে হবে।
পড়ার টেবিলের ওপর কালো সানগ্লাসটা পড়ে আছে। নীলাঞ্জন নিজের মনেই একবার হাসল। তারপর আলগোছে একবার চোখে লাগাল কালো চশমাটা। খাটে বসে না থাকলে সে খুব সম্ভবত উলটে পড়ে মাথা ফাটিয়ে একশা কাণ্ড করত।
নীলাঞ্জন দিনের আলোর মতো দেখতে পাচ্ছে পরির মতো একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চারদিকে ভরতি লোকজন। একটা হোটেল দেখা যাচ্ছে। হোটেলটার নাম নিউ শিলিগুড়ি হোটেল। মেয়েটা হাতের ঘড়ির দিকে একবার তাকাল। একটু মনোযোগ দিতেই ঘড়ির ডায়ালটা পর্যন্ত সে স্পষ্ট দেখতে পেল। এগারোটা কুড়ি। এক মুহূর্তের জন্য নীলাঞ্জন চোখ থেকে চশমাটা খুলে দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকাল। এগারোটা কুড়ি। আবার চশমাটা পরে নিল সে। মেয়েটা কারুর জন্য অপেক্ষা করছে। একটু পরেই আরেকটা মেয়ে এলো। বললো, ভেরি সরি নীলা, হাকিমপাড়ার ওখানে খুব জ্যাম, একটু দেরি হয়ে গেল।
নীলাঞ্জন চোখ থেকে চশমাটা খুলে রাখল। সারাদিন সারাসন্ধে চশমাটা তার পড়ার টেবিলে ওপর পড়ে রইল। রাত্তিরবেলা একটা নাগাদ তার ঘুম ভাঙল। নীলাঞ্জন শান্ত মাথায় চশমাটা নিল। মটাস করে মাঝখান থেকে ভাঙল। তারপর বারান্দায় বেরিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিল।
আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল প্রকৃতি আসলে একজন নারী। কিন্তু সে পুরুষ। কোনো নারীই পুরুষকে ঠিকমতো চেনে না।
বিছানায় এসে পরম শান্তিতে নীলাঞ্জন ঘুমিয়ে পড়ল। সে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল।
নীলাঞ্জন দেখল একটা রঙিন প্রজাপতি। তার শরীরটা এই এত্তটুকু। কিন্তু তার শরীর থেকে রামধনুর মতো অসংখ্য রং বেরোচ্ছে। এতো রং সে জীবনে কোনোদিন দেখেনি। এই রং এই মর্ত্যের নয়। এই রঙের উৎস অমর্ত্য। নীলাঞ্জনের মনে হল সে নিজেও একটা প্রজাপতি হয়ে গেছে। তার শরীর অথবা অশরীর থেকেও রং বের হচ্ছে। দুটো রং মিলেমিশে মহাকাশ ছেয়ে ফেলছে। সময় স্থান সব দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে সেই রঙের ঝলসানিতে।
মহাবিশ্বে ভালোবাসার চেয়ে অধিক রহস্যময় আর কিছুই নেই।
Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, নয়ন বসু, প্রমিত নন্দী
গল্পটা সুন্দর হয়েছে। তবে হুমায়ূন আহমেদকে নকল করার একটা ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছে। যেটা পড়ে বোঝা যাচ্ছে যে এই স্টাইল লেখকের স্বাভাবিক লেখা না। তাই খুব কৃত্রিম লাগছে। আমার পরামর্শ হল আপনি নিজের মতোই লিখুন। হুমায়ূন আহমেদ একজনই হয়। প্রত্যেকেই নিজের স্টাইলে ইউনিক। সেটাই ফলো করা উচিত।
অনেক ধন্যবাদ।
কল্প বিজ্ঞান হলেও, খুব সুন্দর মন ছুঁয়ে যাওয়া একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প। ভীষণ ভীষণ সুন্দর গল্পটা।
খুব ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ!
হুমায়ূন আহমেদকে নকল করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে, এই কথাটা বলার আগে নিজে কিছু করার চেষ্টা করুন। পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে সমালোচনা করা। আপনি তো free-তে জ্ঞানের ভান্ডার খুলে বসেছেন….
সৌভিক, হুমায়ূন আহমেদকে নকল করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে, এই কথাটা বলার আগে নিজে কিছু করার চেষ্টা করুন। পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে সমালোচনা করা। আপনি তো free-তে জ্ঞানের ভান্ডার খুলে বসেছেন….
Khub Sundar