সৃষ্টি ও স্রষ্টা
লেখক: সম্পদ বারিক
শিল্পী: দীপ ঘোষ
খাতার সাদা কাগজটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পুলক। তার মাথায় আজ গল্পের কোনো প্লটই আসছে না। ফ্যালফ্যাল করে পুলক শুধু কাগজটাকে দেখে যাচ্ছে। ধবধবে সাদা কাগজটা দেখতে দেখতে তার কীরকম ঘোরের মতন লাগছে… তাও সে তাকিয়েই আছে। নতুন টেবিল ল্যাম্পের আলোটা বেশ জোরালো। টানা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কীরকম চোখ ধাঁধাচ্ছে। তাও পুলককে তাকিয়ে থাকতেই হবে… কারণ পূর্বে এইভাবেই সে বহু গল্পের প্লট পেয়েছে। কাগজের শুভ্রতায় তার চিন্তাশক্তি ডালপালা মেলে ধরে। টেবিলের উপরে ঘড়ির কাঁটাটা অত্যন্ত মৃদুভাবে চলছে ‘খচ… খচ… খচ…’।
কিন্তু আজ যে কিছুই মাথায় আসছে না। বড়ো অস্বস্তি হচ্ছে আজ পুলকের। চোখদুটো একবার বন্ধ করে মাথাটা পিছনদিকে এলিয়ে দেয়। এখন একটু চোখে শান্তি লাগছে; কিন্তু মাথার মধ্যে চিন্তার জাল ক্রমাগত গরল দংশন করছে… সেটার কী হবে? প্রতিষ্ঠিত লেখক পুলক চক্রবর্তী আজ সম্মানের খেলায় নেমেছে। এই খেলায় সে হেরে যেতে পারে না। তাকে জিততেই হবে…
পুলকের মাথায় বিগত কয়েকদিনের ঘটনা যেন বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো বয়ে যায়। সুকমল… হ্যাঁ… সুকমল পোদ্দার, এই নামটাই। বিগত কয়েকদিন এই নামটাই পুলকের মস্তিষ্কে কাঁটার মতন বিঁধে আছে। ঘটনার সূত্রপাত এক গল্প লেখার প্রতিযোগিতা থেকে। আজকাল এরকম প্রতিযোগিতা প্রায়ই হয়, কিন্তু এই প্রতিযোগিতাটা ব্যতিক্রমীমূলক ছিল। কারণ প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিল এক বিখ্যাত প্রকাশক, এবং প্রতিযোগিতা যে জিতবে তাকে নগদ টাকা ছাড়াও নিজের বই প্রকাশ করার সুযোগ দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রকাশকেরা। নতুন লেখকদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। সেই প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে চারজন নামকরা লেখকের মধ্যে একজন ছিল পুলক।
প্রতিযোগিতায় প্রচুর গল্প জমা পড়ে; প্রায় শ’খানেক, এবং প্রতিটা গল্পকেই চারজন বিচারককে পড়তে দেওয়া হয়। শুধুমাত্র সারবস্তু ছাড়াও লেখনশৈলী, নতুনত্ব এবং গল্প বলার ক্ষমতার উপরে বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল। দশদিন ধরে সমস্ত গল্প পড়ে দশটা শ্রেষ্ঠ গল্প বাছাই করা হয়। তারই মধ্যে একটি গল্প ছিল সুকমল পোদ্দারের। গল্পটার শুরুটা সুন্দর ছিল; প্রচুর রহস্য ও চমকের মাঝে দিয়ে সুচতুরভাবে তথ্যের ব্যবহার করে বেশ বুনোট গল্প লেখা হয়েছিল। কিন্তু শেষে গিয়ে কীরকম যেন ছড়িয়ে গেল। সেই কথাটা পুলক অন্য তিনজন বিচারককে জানায়। খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক নির্মাল্যবাবু বলেন, “পুলক, এই গল্পটা ওপেন এন্ড গল্প… সব গল্পের শেষ হয় না। এরকম গল্পে পাঠককে ভাবার সুযোগ দেওয়া হয়। কত কত পসিবিলিটি ওপেন হয়ে যায় বলতো? তর্ক করার একটা স্কোপ…”
“সেটা মানছি…” পুলক বলে, “কিন্তু এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শেষ?”
“কোথায় শেষ?” আরেক বিচারক স্বাতী মিত্র বলেন, “শেষ তো হয়নি… সেখানেই তো মজা… সেখানেই তো এই গল্প অন্যদের থেকে আলাদা…”
“গল্প শেষ না হলে আর গল্প কি?” পুলক বলে, “একটা খুন হল, তার ভূত এত ভয় দেখিয়ে বেড়ালো, বেছে বেছে খুনীদের খোঁজ করল, তারপরে তাদের বাড়ির লোকজনদের এরকম ইনোভেটিভভাবে মারল, কিন্তু খুনীদের ছেড়ে দিল? শেষে গিয়ে খুনীদের মেরে প্রতিশোধ নেবে না?”
“হয়তো ভূতের মাধ্যমে গল্পের লেখক প্রতিহিংসার এক অন্য মাত্রা দেখাতে চেয়েছে…” তৃতীয় বিচারক বিমল ডোম বলেন, “হয়তো এটাই প্রতিশোধ। খুনীরা নিজেদের আত্মীয় স্বজন হারিয়ে সারাজীবন অনুশোচনায় ভুগবে… এটাও একরকমের প্রতিহিংসা বইকি…”
“না গো বিমলদা…” পুলক বলে, “তাহলেও একটা সমাপ্তি দরকার… একটা প্রপার ক্লোজার দরকার। কোথাও একটা ভূতটা এসে খুনীদের বোঝাবে এবং সেই মাধ্যমে পাঠকদেরও বোঝাবে, তবেই তো গল্পের পূর্ণতা। একজন পাঠক গল্পের মাঝখান থেকে সমানে আশা করছে যে ভূত এসে খুনীদের মেরে প্রতিশোধ নেবে, কিন্তু এরকম হঠাৎ শেষ…? বৃত্ত যে সম্পূর্ণ হচ্ছে না…”
“বাস্তবে যা ঘটে সেটায় কি বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়?” নির্মাল্যবাবু বলেন, “গল্পটা ভূতের হলেও এর মধ্যে বাস্তিবকতার ছোঁয়া রয়েছে।”
“আমার ভালো লাগেনি…” পুলক অকপট স্বীকার করে।
“তার মানে তুমি কম নম্বর দেবে তাই তো?” স্বাতীদি বলেন, “মনে রেখো পুলক, তোমার কম নম্বরের জন্য গড় নম্বর কমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এরকম প্রতিভাবান লেখক শুধু হেরে যাবে তাই নয়, সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে হতাশও হয়ে যেতে পারে।”
“সবাইকেই স্ট্রাগল করতে হয় দিদি…,” পুলক বলে, “লেখার ক্ষেত্রেও তাই। হেরে গেলে আবার চেষ্টা করবে। ওর প্যাশন ওকে আরো ভালো লিখতে প্রভাবিত করবে…।”
এই বলে পুলক সুকমল পোদ্দারের লেখাকে সর্বনিম্ন নম্বর দেয়। হয়তো একটু বেশিই দিত, কিন্তু বাকি বিচারকদের সঙ্গে তর্ক করে মাথাটা গরম হয়ে গেছিল। তাই সর্বনিম্ন নম্বর। সুকমল হেরে যায়, অন্য একজন জিতে যায়। সব সুষ্ঠুভাবেই মিটে যায়। কিন্তু গড়বড় শুরু হয় কয়েকদিন পরে। সেই হেরে যাওয়া লেখক, সুকমল পোদ্দার হঠাৎ একদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। কোথাও থেকে সুকমল জেনে যায় যে পুলকের কম নম্বরের জন্যই তার গল্পটি জিততে পারেনি। ভিতরের কেউ নিশ্চয় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
পুরো গল্পটা ফেসবুকে প্রকাশ করে জনগণের কাছে সোজাসাপটা মতামত চায় সুকমল। সেই মতামত থেকে মানুষের কথার তোড়ে নেট দুনিয়া তোলপাড় হয়ে যায়। পুলকের পক্ষে ও বিপক্ষে বহু কথা উঠতে শুরু করে। পুলক এতদিন ভাবত তার অনুরাগীর সংখ্যা প্রচুর, কিন্তু তাকে এত মানুষ যে ঘৃণাও করে সে ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। আর সেই মানুষদের কত রকমের ভাষা। ভদ্র ভাষায় অপমান থেকে সরাসরি মাতৃ-পিতৃ-স্বসাকূল উদ্ধৃত করে গালি, কোনোটাই বাদ যায়নি। পুলকের ভক্তরাও প্রচুর লড়াই করেছে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই পুলক বুঝতে পারে যে খ্যাতির পাহাড়ে ওঠা যতটা কঠিন, ঠিক ততটাই সহজ সেখান থেকে পা হড়কে পড়ে যাওয়া। সুকমলের দিকে পাল্লা ভারী হয়, লোকে তার গল্পের জয়গান করে পুলককে দুষতে থাকে।
ঠিক এই সময়ে সুকমল সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যেই মোক্ষম চালটা দেয়। সরাসরি পুলককে আহ্বান করে তার গল্পের টক্করে একখানা গল্প লিখে দেখাতে। তারপরে মানুষে পড়ে যদি বিচার করে পুলক সত্যিই সুকমলের থেকে ভালো লিখেছে তাহলে সুকমল লেখা ছেড়ে দেবে। সুকমল জিতলে অবশ্য সে শুধুমাত্র একটি বই ছাপাবার আশা করেছে। যে প্রকাশককে পুলক গত বছর গল্প দেয়নি, তারা সুযোগ বুঝে সুকমলের জেতার আশায় বইয়ের অফারও দিয়ে রেখেছে। সবাই মিলে পুলককে অপমানিত করে টেনে নামাতে চাইছে। প্রচুর মানুষ আছে যারা তাকে টেনে নামাতে চায়। অনেকদিন পরে পুলককে আবার নিজেকে প্রমাণ করতে মাঠে নামতে হয়েছে।
কিন্তু দুটো দিন কেটে গেল, কোনো গল্পের প্লটই মাথায় আসছে না। টেনশনে হোক বা লোকলজ্জার ভয়ে হোক, যে-কোনো একটা কারণে পুলকের মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। একবার খসখস করে কাগজে একটা প্ল্যান ছকে ফেলল, দিব্যি গল্প… কিন্তু একটু পরেই খেয়াল হল, এই গল্পটা তো আগে লিখেছে পুলক। বছরখানেক আগে কোনো একটা পূজোবার্ষিকিতে। বিরক্তিতে কাগজটা দলা পাকিয়ে ফেলে দিল টেবিলের পাশে। তারপর থেকে শুধু ভেবেই যাচ্ছে। বাড়িতে কেউ নেই। কোথায় যেন গেছে, কোনো অনুষ্ঠানে, আজ ফিরবে না। পুলক রাতে খাওয়াদাওয়া করেনি, সমানে সেই বিকেল থেকে টেবিলে বসে ভেবেই যাচ্ছে। এই সবে চোখদুটোকে একটু বিশ্রাম দিল।
ক্রমে রাত একটা বাজে। ‘ঢং’ শব্দ করে দেওয়াল ঘড়িটা সময় জানান দিল। পুলক চোখ খুলে একবার ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে। নাহ… আজ আর লেখা হবে না, টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করে দেয় পুলক। চেয়ার ছেড়ে উঠে অন্ধকারেই বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায় সে, কিন্তু থমকে দাঁড়ায়।
কিছু একটা ঠিক নেই ঘরে… পুলক বুঝতে পারছে কোনো কিছু একটা ব্যাপার নিয়মের বাইরে আছে। কিন্তু কী যে বেঠিক সেটা পুলক বুঝতে পারছে না। ঘরের আলো জ্বালিয়ে পুলক এদিক ওদিক দেখে। অস্বস্তি হচ্ছে, কী যেন একটা ধরা উচিৎ কিন্তু ধরতে পারছে না পুলক… কে যেন একটা…
হঠাৎ পুলক আবিষ্কার করে তার টেবিলের পাশে দুটো কাগজের দলা পড়ে আছে। দুটো কেন? পুলক তো একটাই ফেলেছিল। আরেকটা এলো কী করে? নাকি ভাবনার বশে নিজেই দু-বার কাগজ ছিঁড়েছে? সেটাই হবে… ভাবতে ভাবতে কখন করে ফেলেছে। পুলক বাথরুমে গিয়ে মুখে ঘাড়ে জলের ছিটে দিয়ে বেরিয়ে আসে। আর বেরিয়ে এসেই অবাক হয়ে যায়। টেবিলের পাশে এখন তিনটে কাগজের দলা পড়ে আছে। পুলকের ভ্রুযুগল কুঁচকে ওঠে। এতটা ভুল করল সে? ঘুমের ঘোরে তিনটে কাগজকে দুটো দেখে ফেলল?
হয়তো তাই…
পুলক মাথা ঘামায় না। তার বিশ্রামের প্রয়োজন। ক্রমাগত ভেবে ভেবে তার স্বাভাবিক ভাবনাচিন্তা গুলিয়ে যাচ্ছে। খাটে শুয়ে বেডসুইচ বন্ধ করে দিল পুলক। এবার শান্তি… আহ্। আজকে বিশ্রাম নিয়ে কালকে কোমর বেঁধে লেখা লিখতে হবে। পুলক চোখ বোজে, কিন্তু পরক্ষণেই খুলে ফেলে।
“যাহ, ওষুধটা খেতে ভুলে গেছি…” পুলক নিজের মনেই বলে, তারপরে আবার আলো জ্বালায়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার দৃষ্টি টেবিলের পাশে গিয়ে পড়ে। সেখানে এখন ছ-সাতটা কাগজের দলা পড়ে আছে। এবার পুলকের ভাবনা হয়। এতগুলো কাগজ সে ফেলেনি। পুলক খাট থেকে উঠে সটান টেবিলের পাশে গিয়ে বসে পড়ে। সব মিলিয়ে ন-টা কাগজের দলা। পুলক সেগুলোকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে খাটে বসে, তারপরে একটা একটা করে দলা খুলে দেখতে থাকে কী লিখেছিল সে?
প্রথম দলাটা খুলে তার লেখা গল্পের ছকটা পায়। দ্বিতীয়টা খুলতেই পুলক অবাক হয়। এক পাতা জুড়ে লেখা। হাতের লেখাটাও পুলকের নয়। এই কাগজটা কী করে এলো এখানে? পুলক আগ্রহভরে কিছুটা পড়তে শুরু করে দেয়। এ যে দারুণ লেখা… কী ভূমিকা, কী চরিত্র উপস্থাপন, এক পাতাতেই এত ইন্টারেস্ট লাগল পড়তে। পুলক পাতা উলটে দেখে, পিছনে কিছু লেখা নেই। কিন্তু গল্পটা চেনা চেনা লাগল কেন? আগে কোথায় যেন পড়েছে?
কৌতুহলবশে পুলক আরেকটা কাগজের দলা তুলে নেয়। সেটায় অন্য হাতের লেখায় আরো অন্য গল্প।
“অদ্ভূত… অদ্ভূত…” অস্ফুট স্বরে পুলক বলে।
সেই গল্পটাতেও সুন্দর উত্তেজনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ নেই। পুলক সব ক-টা কাগজ খুলে দেখে। এই লেখাগুলো তার টেবিলের পাশে কোথা থেকে এলো? প্রত্যেকটাতেই লেখা। গল্প আর কবিতা পাঁচটা, বাকিগুলো পড়লে মনে হয় বড়ো উপন্যাসের শুরুর পর্ব। পুলক কাগজগুলো নিয়ে চিন্তায় পড়ে। টেবিলের পাশে এগুলোর হঠাৎ আগমনের কী কারণ থাকতে পারে? অনেক ভেবে ভেবে পুলক একটা সিদ্ধান্তে আসে। নিশ্চয় তার টেবিলের পাশে খাঁজে কোথাও এগুলো আটকে ছিল। এগুলো সব উঠতি লেখকদের লেখা। মাঝেমাঝেই পুলকের কাছে আসে এরকম। যেমন এই প্রতিযোগিতার লেখাগুলো এসেছিল। সেগুলোই কোনোভাবে দলা পাকিয়ে পুলক ফেলে দিয়েছিল। হয়তো তখন পড়ে ভালো লাগেনি, এখন ভালো লাগছে। মানুষের চিন্তা এবং পছন্দ-অপছন্দ দিনের একেক সময় একেক রকম হয়। যে জিনিসটা রাত দুটোয় পড়ে দুর্দান্ত লাগে সেটাই দুপুর দুটোয় পড়ে অন্যরকম লাগে। এগুলো সেই বাতিল লেখাই।
পুলক মনে মনে খুশি হয়। এই কটা লেখা পড়ে তার মাথায় অনেক আইডিয়া এসেছে। কাগজগুলো সোজা করে নিয়ে সে উঠে টেবিলের দিকে যায়। কিন্তু টেবিলের কাছে এসেই পুলক অবাক হয়ে কয়েক পা পিছনে সরে আসে। টেবিলের পাশে আরো দলা পাকানো কাগজ পড়ে আছে। পনেরো কুড়িটা হবে। পুলক হাতের কাগজগুলো টেবিলে রেখে নীচের কাগজগুলো দেখে। এগুলো আসছে কোথা থেকে? কাগজগুলো না খুলেও সে জানে ওগুলো সব বাতিল করা লেখা। অন্য লেখকদের লেখা। পুলক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবে, তারপরে কী মনে করে টেবিলটা ধরে টান মারে, আর সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের পিছনে টেবিল আর দেওয়ালের মাঝে ফাঁক থেকে হুড়হুড় করে শ’খানেক কাগজের দলা বেরিয়ে চলে আসে।
“এত?” পুলক নিজের মনেই চেঁচিয়ে বলে। আরেকটু শক্তি লাগিয়ে আরো টান মারে টেবিলে। আরো কাগজের দলা বেরিয়ে একটা ঢিপির মতো হয়ে যায়। পুলক চিন্তায় পড়ে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না আর। পুলক এবার টেবিলের ড্রয়ারগুলো খুলে ফেলে। সবকটা ড্রয়ারে ঠেঁসে ঠেঁসে কাগজের দলা ভরা। খুলতেই দলাগুলো বাইরে ঝরঝর করে পড়তে লাগল। চমকে গিয়ে পুলক পিছিয়ে এলো।
এ কী?
তার পায়ের নীচেও কাগজের দলা ভরতি… পুলক লাফিয়ে খাটের দিকে যায়। সেখানেও কাগজের দলা ভরে আছে… গোটা ঘরে কাগজের দলাইয় ছেয়ে গেছে। পুলক ঘর থেকে বেরিয়ে পালাতে যায়। দরজা খুলতেই একগাদা কাগজের দলা যেন পুলককে ভাসিয়ে দিল। জানালা দরজা সব দিক দিয়ে কাগজের দলা ঘরের ভিতরে ভরে ভরে পড়ছে। পুলক হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওর মুখ, চোখ শরীর ঢেকে দিচ্ছে কাগজের দলাগুলো…
“বাঁচাওওওও…”
পুলক চেঁচিয়ে ধড়ফড় করে জেগে ওঠে। পাশ থেকে কার যেন কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, “কীরে কী হল?”
হঠাৎ জেগে উঠে পুলক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। একটা আধা অন্ধকার বিশাল ঘরে বসে আছে পুলক। চারিদিকে খোপ খোপ করে মাঝারি হাইটের বাহারী কিউবিকল বানানো। পুলক নিজেও একটা কিউবিকলের ভিতরে একটা চেয়ারে বসে আছে। তার সামনে কম্পিউটার চলছে, আশপাশে প্রচুর জিনিসপত্র ছড়ানো। পেন, পেন্সিল, নোটবুক, ব্যাগ।
“কীরে ভয় পেয়েছিস নাকি?”
চমকে উঠে পুলক উপরে তাকায়। কিউবিকলের দেওয়ালে হেলান দিয়ে একটা বছর ছাব্বিশের লোক তাকিয়ে হাসছে আর জিজ্ঞেস করছে।
“আমি… মানে… এখানে…?” পুলক আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে।
“আর কোথায় থাকবে চাঁদ?” লোকটা বলে, “তোর আর আমার তো এখানেই থাকার কথা। জামতলায় এস টি এসের তেরোতলায় নাইট শীফটে ছাড়া আর কোথায় তোর এখন থাকার কথা শুনি?”
“আমি এখানে কী করে এলাম?” পুলক জিজ্ঞেস করে।
“তোর কী হয়েছে বলত পুলক?” লোকটা বলে, “তুই কি ভয়ের স্বপ্ন দেখে সব ভুল মেরে দিলি?”
পুলক চট করে লোকটার গলায় ঝোলানো ব্যাচটা দেখে ফেলে। ‘সোমদেব দাস’… লোকটার নাম। নামটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলকের স্মৃতিতে যেন বন্যার মতো কত কিছু ভেসে আসে। সোমদেবকে চিনতে পারছিল না পুলক? সোমদেব যে ওর কলেজ থেকে বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে কলেজ পাশ করে এই ‘এস টি এস’ আইটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিল। আজ চার বছর ধরে তারা চাকরি করছে একসঙ্গে। এই তো পুলকের কিউবিকল। দুটো কিউবিকল পেরিয়ে বাঁ দিকের কিউবিকলটা সোমদেবের। সে নিজে আইটি কর্মী পুলক সেন… তিনমাস পরে তার বিয়ে। চিত্রার সঙ্গে। হনিমুনে মালদ্বীপ যাবে, বিস্তর খরচ। তাই ওভারটাইম করে পুলক কাজ এগিয়ে রাখছে।
“সোম… জানিস ভাই, একটা ভীষণ স্বপ্ন দেখছিলাম…” পুলক বলে, “আমি একটা বিখ্যাত লেখক হয়ে গেছি। অহংকারে একজনের লেখা বাতিল করে দিয়েছি। তারপর আমি কাগজের বান্ডিলে ডুবে মরে যাচ্ছি…”
“স্বপ্ন ওরকমই হয়…” সোমদেব বলে, “ছিল রুমাল হল বেড়াল টাইপের হয়। চাপ নিস না…”
“আরে, এত সত্যি মনে হচ্ছিল স্বপ্নটা…” পুলক বলে, “যেন আমি চরিত্রটা হয়ে গেছি। যেন কত বছরের লেখালেখির অভিজ্ঞতা আমার। এমনকী একটা প্রতিযোগিতায় আমি বিচারক, আর বাকি বিচারকগুলোকেও আমি যেন অনেকদিন চিনি…”
“টেনশন করিস না…” সোমদেব বলে, “ক্রমাগত কাজের প্রেশার নিচ্ছিস বলে তোর উপরে চাপ পড়ছে। কফি খাবি?”
“ক্যান্টিনে যাচ্ছিস? নিয়ে আয় তাহলে আমার জন্য একটা…” পুলক বলে।
সোমদেব শিস দিতে দিতে চলে যায়। পুলক একটু আরমোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। সত্যি… বিশ্বাস করা যায় না… এরকম স্বপ্ন? এতটা বাস্তব মনে হচ্ছিল। উফ… এখনও একটা ঘোরের মতো লাগছে পুলকের। পুলক কিউবিকলের মাঝে প্যাসেজে একটু হাঁটাচলা করে। আজকে তাদের বিদেশের ক্লায়েন্টদের কী একটা ছুটি আছে, তাই অফিসে চাপ নেই। নাইট শিফটে চাপ না থাকলে পুলকের মতো অফিসাররা একটু ঘুমিয়ে নেয়। সেই ঘুম ঘুমোতেই গিয়ে এসব ভুলভালো স্বপ্ন দেখছিল পুলক। হাঁটতে হাঁটতে সোমদেবের কিউবিকলের পাশে চলে এলো পুলক।
“ভঁ… ভঁ…”
পুলক সোমদেবের টেবিলের দিকে তাকায়। সোম ওর ফোনটা চার্জে রেখে গেছে। সাউন্ড অফ করা, তাই ভাইব্রেট করে ‘ভঁ… ভঁ’ করে আওয়াজ করছে। কেউ ফোন করেছে। এত রাতে সোমদেবের ফোন? ব্যাটা তো প্রেমও করে না। পুলক মজাচ্ছলে ফোনটার দিকে উঁকি দেয়। কিন্তু নম্বরটা দেখেই পুলকের ভুরু কুঁচকে ওঠে।
প্রিয়ার নম্বর…
পুলক একবার উঁকি দিয়ে করিডরের দিকে দেখে নেয়। সোমদেবের দেখা নেই। পুলক ফোনটা তুলে নিয়ে কানে লাগিয়ে বলে, “হ্যাঁ…”
পুলকের কথা শেষ হয় না, তার আগেই ফোনের উলটোদিকে প্রিয়ার ক্রদনরত স্বর শোনা যায়, “আমি আর বাঁচতে চাই না রে সোম… তোকে ছাড়া আর ভালো লাগে না। তুই ওই হারামী পুলকটাকে সব বলে দিসনি কেন? আমার আর ভালো লাগছে না। তুই আজকে একটা ডিশিসন নে। আমি কিন্তু সত্যিই সুইসাইড করব সোম। তোর সঙ্গে থাকতে না পারলে আমি বাঁচতে পারব না। পুলকটার সঙ্গে বাবা মা বিয়ে ফিক্স করে দিল। তুই কীরকম ছেলে অ্যাঁ? একবারও বলতে পারলি না পুলককে? কীসের ভয় তোর? বন্ধুবিচ্ছেদ? আজকে তোকে ডিশিসন নিতেই হবে সোম। হয় পাঁচ মিনিটের মধ্যে তুই আমাকে ফোন করে জানাবি যে তুই পুলককে সব বলে দিয়েছিস, নয়ত এই আমি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না জড়িয়ে গলায় বেঁধে রেখেছি… আই অ্যাম সিরিয়াস সোমদেব দাস…”
প্রিয়া ফোনটা কেটে দেয়। পুলক আস্তে করে ফোনটা নামিয়ে রাখে। স্বপ্নের কথা কোন অতলে চলে গিয়ে এখন পুলকের ভাবনায় নানারকম চিন্তা ভীড় করে আসছে। সোম আর প্রিয়া? দুজনের মধ্যে গোপন সম্পর্ক আছে? আর তার মাঝে পুলক ফেঁসেছে? সোম জানায়নি কেন? পুলকের বাবা একটা সময়ে সোমের পরিবারকে অনেক সাহায্য করেছে তাই? প্রিয়া জানায়নি কেন? পুলক রাগ করবে তাই?
রাগ তো হচ্ছে পুলকের। অদম্য, অপ্রতিরোধ্য রাগের একটা গরম স্রোত পুলকের শরীরের মধ্যভাগ থেকে যেন মাথায় উঠে আসছে। পুলকের প্রেমিকার দিকে সোমের নজর পড়েছে? এত বড়ো সাহস? পুলকদের খেয়ে পরে বড়ো হল, এখন পুলকের সমান চাকরি করে পুলকের সব কেড়ে নিতে চাইছে? আর প্রিয়া? দিনের পর দিন নাটক করে পুলকের পয়সা ধ্বংস করে আজ সোমের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কয়েকটা অশ্লীল গালি পুলকের ঠোঁটের ডগায় এসে ফিসফিস করে হাওয়ায় ভেসে গেল। হতচ্ছাড়া সোম, বন্ধুর পিছনে ছুরি মারে। আজ ওকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। না… শুধু সোমকে কেন? প্রিয়ারও শাস্তি পাওয়া উচিৎ।
“কী শাস্তি দেওয়া যায়? কী শাস্তি দেওয়া যায়?” বিড়বিড় করে পুলক। নানারকম চিন্তা খেলতে থাকে পুলকের মাথায়। বাড়িতে জানিয়ে একটা সিন ক্রিয়েট করবে? অথবা দুজনের সম্পর্কের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি করানো? ধুর… সেসব সময় সাপেক্ষ। দুজনেই পুলককে ঠকিয়েছে, পুলকের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। এত সহজে তো দুজনকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। পুলকের ইচ্ছে করছে নিজের হাতে সোম আর প্রিয়াকে গলা টিপে খুন করে।
খুন?
হ্যাঁ… দুজনের মৃত্যুদণ্ডই সঠিক শাস্তি হবে। পুলকের জীবনটাকে ছারখার করে দিয়েছে ওরা, ওদের তো মৃত্যুই হওয়া উচিৎ। পলকের মধ্যে পুলকের মাথায় বুদ্ধি আসে। করিডরের দিকে আরেকবার তাকিয়ে সোমদেবের ফোনটা ঝট করে তুলে নেয়। পাসওয়ার্ড জানা আছে। দ্রুত আঙুল চালিয়ে একটা মেসেজ লিখে ফেলে পুলক,
“আমায় ক্ষমা কর প্রিয়া, এই সম্পর্ক আর রাখতে পারব না। তুই বড়ো বাজে মেয়ে, পুলক আর আমাকে দুজনকেই ঠকিয়েছিস। তোর সঙ্গে থাকলে আমি সুখী হতে পারব না। রোজ মনে হবে তুই পুলকের স্ত্রী হতে যাচ্ছিলিস, নিজেকে মনে হবে এঁটো খাচ্ছি। তোর মতো দুশ্চরিত্রা কুলটা আদেখলা মেয়ের আমার জীবন থেকে চলে যাওয়াই ভালো। আমাদের মধ্যে যা হওয়ার হয়ে গেছে, এবার আমাকে রেহাই দে। কল করিসনা। আমি তোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না কোনোভাবেই…”
লিখেই প্রিয়াকে পাঠিয়ে দিল পুলক।
“এবার মজা বুঝবে…” পুলক মনে মনে হাসে। কয়েক সেকেন্ড পরেই প্রিয়ার মেসেজ আসে, “ভিডিও কল করছি, প্লীজ শেষবারের মতন একবার তোল…”
বলার পরেই ভিডিও কল এলো। পুলক মুখ লুকিয়ে রিসিভ করল কলটা। প্রিয়ার দুটো পা দেখা যাচ্ছে। গোড়ালি পর্যন্ত গেরুয়া পাজামা। খাটের উপরে প্লাস্টিকের টুল তার উপরে প্রিয়ার পা। পরক্ষণেই সেই পা লাথি মেরে টুলটা ফেলে দিল। তারপরে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে প্রিয়ার পা দুটো অসম্ভব ছটফট করতে থাকে। পুলকের মুখে শয়তানী হাসি ফুটে ওঠে। সঠিক শাস্তি দিয়েছে ধোকাবাজ মেয়েটাকে।
“মর… মর… শালী…” উল্লাসে চাপা গর্জন করে পুলক। যা দেখার দেখা হয়ে গেছে পুলকের। পা দুটোর নড়াচড়া কমে আসছে। থেকে থেকে একবার ঝটকা দিচ্ছে। পুলক কলটা বন্ধ করে সোমদেবের ফোন থেকে সব রেকর্ড উড়িয়ে দিয়ে ফোনটা যথাস্থানে রেখে দেয়। তার ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরেই সোমদেব হাতে দুটো কফির কাপ নিয়ে করিডর দিয়ে ঢোকে।
“কিরে এত দেরি?”- স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করে পুলক।
“আরে বলিস না…” সোমদেব একগাল হেসে বলে, “রমাদাকে নিয়ে আর পারা যায় না। নাইট শিফটের জন্য কিছু রেডি রাখে না। পুরো কফি মেশিন খাঁ-খাঁ করছে। শেষে সিকিউরিটির কাছ থেকে চাবি নিয়ে স্টোর খুলিয়ে কফি, দুধ চিনি এনে একেবারে বানিয়ে আনলাম।”
“বাবা কী খাটনি…” পুলক বলে, “এত খাটনি দিয়ে যদি প্রেম করতিস যে কোনো মেয়ে তোকে বিয়ে করার জন্য ঝুলে পড়ত…”
“ধুস কী যে বলিস…” সোমদেব হেসে বলে। পুলকের কথার পিছনে লুক্কায়িত বিদ্বেষটা সোমদেব ধরতে পারেনি।
“আরে না রে… সত্যি কেউ এসবে পটে না…” সোমদেব বলে।
পুলক সোমদেবের হাত থেকে কফির মগ নিয়ে বড়ো জানালাটার দিকে এগিয়ে যায়। সোমদেবও এগিয়ে আসে। জানালা নামেই। অফিসকে বাহারী করতে একটা ইঁটের দেওয়াল না তুলে সেখানে কাচের দেওয়াল করা। বাইরে শহর ঝিমিয়ে আছে। দূরে ফ্লাইওভারটা দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা গাড়ি হুহু করে ছুটে চলে যাচ্ছে।
“তুই একটা ভালো দেখে মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করছিস না কেন?” সোমদেবের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করে পুলক।
“কাউকে পাচ্ছি না তাই…” সোমদেবের উত্তর আসে।
“হুমম…” পুলক বলে একটা চুমুক দেয়, “কেমন মেয়ে খুঁজছিস তুই?”
“শান্ত, নম্র, ভদ্র, শিক্ষিতা…” সোমদেব বলে, “সুন্দরী অতটা না হলেও হবে। কাস্ট আর গায়ের রং ডাজ নট ম্যাটার…”
“প্রিয়ার মতো?” ঝটিতে বলে পুলক।
সোমদেব কফি কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিল, এক সেকেন্ডের জন্য আটকে যায় তার হাত, তারপর স্বাভাবিকভাবে চুমুক দিয়েই বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে, “প্রিয়া ভালো মেয়ে। ওর মতো মেয়ে পাওয়া মুশকিল। ইউ আর লাকি টু হ্যাভ হার…”
“হুঁ…” বলে পুলক কাপটা নামিয়ে রাখে, তারপর বলে, “প্রিয়া আর আমার নেই…”
“মানে?’, সোমদেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“শি ইজ নট মাইন, শি ইজ নট এনিওয়ানস ইদার…” পুলক গলা চড়িয়ে বলে, “কারণ তোর জন্য শি ইজ ডেড…”
বলেই পুলক সোমদেবকে আচমকা একটা জব্বর ধাক্কা মারে। ঘটনার আকস্মিকতায় সোমদেব নিজের ওজন সামলাতে পারে না। পুলক এত জোরে ঠেলা মেরেই যাচ্ছে, সোমদেব কাচ ভেঙে নিমেষে বাইরে পড়ে গেল।
“পাপ বিদেয় হল…” হাঁপাতে হাঁপাতে বলে পুলক, “শালা আমাকে ঠকানো…”
পুলক জানালা থেকে পিছিয়ে এসে ট্যিসু পেপার দিয়ে নিজের দাঁড়ানোর প্রমাণগুলো মুছে ফেলল। তারপর পুলিশ স্টেশনে ফোন করে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “হ্যালো…হ্যালো স্যার… স্যার একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেছে… আমার কলিগ জানালা থেকে নীচে ঝাঁপ মেরেছে স্যার। তেরোতলা স্যার…। স্যার প্লীজ কিছু করুন…”
বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে পুলক। পুলিশের পরে সে অফিসের বস আর এইচ আরকে ফোন করে একইরকম কুম্ভীরাশ্রু বইয়ে সব কিছু জানায়।
ফোন রেখে পুলক মনে মনে বলে, “এবার শুধু অপেক্ষা… পারফেক্ট প্ল্যান…”
ততক্ষণে বিল্ডিঙ্গের সিকিউরিটি, কেয়ারটেকার, নাইটের সুপারভাইজার সবাই ছুটে এসেছে। পুলক কান্নাকাটি করে একবার উঁকি দিয়ে নীচে সোমদেবের লাশটা দেখে। এত উঁচু থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু সোমদেব কীরকম হাত পা অদ্ভুতভাবে বেঁকিয়ে পড়ে আছে, আর রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে। পুলক দু-বার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ভান করে ভীষণ অভিনয় করে। সবার ব্যস্ততা তুঙ্গে ওঠে। নীচে পড়ে থাকা মরা ছেলেটাকে দেখবে নাকি অসুস্থ হয়ে যাওয়া পুলককে সামলাবে? কয়েকজন পুলককে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে মেডিকেল রুমে একটা বেডের উপর শুয়ে দিল। পুলক নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকে। নাইট শিফটের মেডিকাল অ্যাটেন্ডান্ট এসে কী একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে গেল। পুলকের ঘুম ঘুম পায়। চোখ বুঝে পুলক ঘুমিয়ে পড়ল।
ঠুং করে একটা শব্দে পুলকের ঘুম ভাঙে। কয়েকটা যন্ত্রপাতি সাজিয়ে একজন নার্স বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পুলক চোখ খুলে দেখে ঘরে একটা জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে। এখনও পুলকের ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিছুক্ষণ সে কিছুই মনে করতে পারে না। কড়া সেডাটিভ দিয়েছে বোধহয়। কিন্তু তারপরেই পুলকের সব মনে পড়ে। দুটো মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে সে। ঘুমের মধ্যে মানুষ বোধহয় দূর্বল বোধ করে। এখন পুলকের একটু একটু ভয় করতে শুরু করে। সে কি কোনো সূত্র ছেড়ে এসেছে? পুলিশ যদি প্রশ্ন করে? সোমদেবের মার্ডারের সময়… না… না… মার্ডার না… পুলক যদি নিজে ভাবে সোমদেবের খুন হয়েছে তাহলে মুখ ফস্কে বলে দিতে পারে।
পুলক বিড়বিড় করে, ‘খুন নয়… সুইসাইড… সোমদেব আত্মহত্যা করেছে… আত্মহত্যা, আত্মহত্যা’।
পুলিশের কোন প্রশ্নে কী উত্তর দেবে ঠিক করে ফেলে পুলক। পুলিশ দেখে ভয় পাওয়ার ছেলে পুলক নয়। তার মামারবাড়ির লোকেরা পুলিশের বড়ো বড়ো কর্তা। ছোটো থেকে পুলিশ দেখে আর তাদের সঙ্গে মিশে ভয়টাই চলে গেছে। তাও একটা শঙ্কা উঁকি দেয় পুলকের মনে। যদি ওর উত্তরের মধ্যে অসংগতির ফাঁক থাকে তাহলে সহজেই ধরা পরে যাবে।
পুলক মনে মনে হিসেব করতে থাকে। তার ভীষণ জলতেষ্টা পেয়েছে। হাতের কাছে জলও রাখেনি কেউ। পুলক জানে কোথায় জল থাকে। জানালার পাশে একটা ছোট্ট টেবিলের উপরে। কিন্তু উঠলেই যদি তাকে সুস্থ মনে করে পুলিশের সামনে নিয়ে যায়? ঘুমের ঘোরে পুলিশের সামনে যাওয়া ঠিক হবে না, আরো কিছুক্ষণ ঘুমের অভিনয় করতে হবে, যতক্ষণ না পুলকের মাথাটা পরিষ্কার হচ্ছে। পুলক একবার দরজার দিকে দেখে নেয়।
কেউ নেই…
ঝট করে পুলক উঠে টেবিলের দিকে যায়। একটা জলের বোতল খুলে ঢক ঢক করে অনেকটা জল খেয়ে নেয়।
“আহ…” তৃপ্তির শব্দ বেরিয়ে আসে পুলকের মুখ দিয়ে। এই তৃপ্তি শুধু জলের তৃপ্তি নয় যেন; এই তৃপ্তি দুই শত্রুকে শেষ করারও তৃপ্তি। পুলক আগ্রহ বশে একবার জানালা দিয়ে তাকায়। নীচে পুলিশের গাড়ি আর মিডিয়ার গাড়ির সঙ্গে প্রচুর মানুষের ভীড়। তাদের কলরব এই বারো তলাতে শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু একটা চাপা গুঞ্জন আসছে। পুলকের মজা লাগে। জানালা খুলে একবার বাইরে দেখে।
পুলিশের গাড়িগুলোর নীল লাল বাতি জ্বলছে-নিভছে। পুলক সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনে হয় নীচে বিল্ডিংয়ের গায়ের কাছে কী একটা নড়ে উঠল। ভীড় থেকে দূরে। বাগানের হালকা আলোয় সরসর করে কী একটা দেওয়ালের কাছে চলে এলো। পুলক একটু ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করল। কি ওটা?
তারপরেই পুলক আবিষ্কার করে, ওটা একটা মানুষ। আর মানুষটা দেওয়াল ধরে চড়ছে। একেবারে পুলকের জানালার নীচেই। কোনো পাইপ ছাড়াই সরাসরি চার হাত পায়ে দেওয়াল ধরে চড়ছে। পুলক চমকে ওঠে। মেডিক্যাল রুমে কোথায় একটা টর্চ থাকেনা? হ্যাঁ ওই তো, টেবিলের তলায়। পুলক টর্চটা নিয়ে দেওয়াল চড়া মানুষটার উপরে ফেলে। ততক্ষণে সেটা তিন-চার তলায় উঠে এসেছে। পুলক আলো ফেলে, আর সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে পিছিয়ে আসে ঘরের মধ্যে।
সোমদেব…
মাথাটা একদিকে ফেটে গিয়ে রক্ত আর চোখ বেরিয়ে গেছে। সেভাবেই মুখে একটা হাসি নিয়ে দেওয়ালে চড়ছে। পুলক শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
“না… না… সব হ্যালুশিনেশন…” পুলক নিজেকে বলে, “ওষুধের সাইড এফেক্ট… হ্যাঁ… ঠিক…”
ঠনাৎ করে একটা শব্দ হয়। নার্স ফিরে এলো বোধহয়। পুলক দরজার দিকে তাকায়। না… কেউ আসেনি। পুলক দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
“পুলক শোন…”
সহসা কোথা থেকে প্রিয়ার কণ্ঠস্বর পাচ্ছে পুলক?
“না… না… তোরা সব শুধু আমার কল্পনা…” পুলক চেঁচিয়ে ওঠে।
“এদিকে দেখ একবার…”
প্রিয়ার কণ্ঠে পুলক এদিক ওদিক তাকায়। কোনদিকে? কোনদিকে?
হঠাৎ পুলক চমকে উঠে ধড়াস করে পড়ে যায় মেঝেতে। দরজার পাশের বেডটার ঠিক উপরে একটা দড়িতে ঝুলছে প্রিয়া। ঘাড়টা অদ্ভুতভাবে বেঁকে রয়েছে, ভেঙে গেছে বোধহয়। চোখের মণিগুলো ডিমের মতো কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে আর জিবটা বেরিয়ে প্রায় বুক পর্যন্ত ঝুলছে।
“না তুই মিথ্যে…” পুলক চোখ বুজে চেঁচায়।
“মিথ্যে তো তুই বলেছিস…” প্রিয়ার স্বর বলে, “আমাকে আর সোমকে… তুই খুনী… তুই খুনী…”
জানালার কাছে একটা ঝটাপট শব্দ। পুলক চোখ ফাঁক করে দেখে জানালার কাচ টপকে আসছে সোমদেব। সেই ফাটা রক্তাক্ত মাথা, ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ আর মুখে ক্রুর হাসি।
“তুই খুনী…” সোম বলে, আর প্রিয়ার কণ্ঠ যেন সেটারই প্রতিধ্বনি করতে থাকে, “তুই খুনী… তুই খুনী…”
“নাআআআআ…” পুলক চীৎকার করে ওঠে। কিন্তু কানের কাছে সমানে মন্ত্রের মতো একটাই কথা দুটো কণ্ঠস্বর আউড়ে যাচ্ছে, “তুই খুনী… তুই খুনী… তুই খুনী… তুই খুনী…”
পুলক সটান উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে দৌড়য়। এই ঘরে থাকলেই সে পাগল হয়ে যাবে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে পা রাখতে গিয়ে পুলক চমকে ওথে। দরজা খুলে জানালা হয়ে গেল কী করে? পুলক টেবিলের উপরে দাঁড়িয়ে জানালা খুলে বাইরে পা বাড়িয়ে আছে। সব তার অবচেতন মনের দূর্বলতা। ভয়ে পুলক পিছিয়ে আসে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার দুই কানের কাছে সোম আর প্রিয়ার কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে, “তুই খুনী…”
টাল সামলাতে না পেরে পুলক জানালা থেকে পড়ে যায়।
“নাআআআআআআ…”
ধড়ফড় করে জেগে ওঠে পুলক।
“কী হয়েছে? কী হয়েছে?” পাশ থেকে নারী কণ্ঠস্বর শোনা যায়। মহিলাটি পুলকের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অন্ধকারে পুলক ভীষণ ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। সে কোথায়? বেঁচে আছে? কি হয়েছে তার?
“খোকা… খোকা…”
কে যেন দরজা ধাকাচ্ছে। পুলকের পাশের মহিলাটি গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
“কী হয়েছে খোকা?” এক বয়স্কা মহিলা বলতে বলতে ঘরে ঢোকেন।
“ভয়ের স্বপ্ন দেখেছে বোধহয়…” পাশের গৃহবধূ মহিলাটি বলেন।
“আমি কোথায়?” পুলক ঢোঁক গিলে জিজ্ঞেস করে।
“জলটা খেয়ে নাও একটু…” মহিলা বলেন। বয়স্কা মহিলাটি মাথায় বুকে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। দুজনকেই ভারী চেনা চেনা লাগে পুলকের। কোথায় দেখেছে? শুধু দেখা নয়, যেন এদের সঙ্গে বহুদিন কাটিয়েছে। খুব আপন কেউ। কিন্তু পুলক তো আইটি অফিসার ছিল। তাহলে এরা কে? আর খুনের পরে এখানে এই বেডরুমে কী করে এলো পুলক?
জল খেতে খেতেই পুলকের ধীরে ধীরে মনে পড়ে, সে তো আসলে পুলক চ্যাটার্জি। রেন্টিল কোম্পানীর উচ্চপদস্থ অফিসার। সে তো সাংসারিক। এই তো তার বউ আর মা দাঁড়িয়ে আছে সামনে। সামনের ঘড়িটায় সোয়া দুটো বাজে। পরশুর মিটিংয়ের জন্য কাজ করে করে এই একটু আগে শুয়েছিল পুলক। তার মধ্যেই ওই ভয়ানক স্বপ্ন…
“মা আমি ভীষণ বাজে স্বপ্ন দেখেছি…” পুলক বলে। পুলকের মা গিয়ে ঠাকুরঘর থেকে প্রদীপ জ্বালিয়ে এনে গায়ে মাথায় আঁচ দিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, “এত খাটলে মাথাটা এমনিই খারাপ হবে। তার মধ্যে উন্নতি করছিস, লোকে নজর দিচ্ছে।”
পুলকের মা চলে যান। পুলক ঢকঢক করে গ্লাসের বাকি জলটা খেয়ে নেয়।
“কী স্বপ্ন দেখছিলে গো?” পুলকের স্ত্রী সোনালী জিজ্ঞেস করে।
“আমি খুনী হয়ে গেছি…” পুলক বলে, “আমার বয়স কমে গেছে, একটা অফিসে কাজ করি। আমার প্রেমিকা আর বন্ধু গোপনে প্রেম করে বলে দুজনকেই খুন করে দিয়েছি…”
“হাহাহাহা… হাসালে…” সোনালী বলে, “তুমি একটা মশাও মারতে চারবার ভাবো, আর তুমি কিনা খুন করছ?”
“আরে শোনো পুরোটা…” পুলক বলে, “তারপর ওই খুন হওয়া ছেলেটা-মেয়েটা ভূত হয়ে আমাকে তেড়ে এসে মার্ডার করছে…”
“তুমি এক্ষুনি লিখে রাখো গল্পটা…” সোনালী এখনও হাসছে, “পরে কোনো ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে দিও…”
“রক্ষে করো…” পুলক বলে, “লেখালেখি আমার দ্বারা হবে না। বরং তুমি লিখে রাখো। কিন্তু জানো তার আগেও কী যেন একটা ভীষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। মনে পড়ছে না ঠিক, যেন আরেকটা কিছুতে ডুবে যাচ্ছি…”
“তুমি ছুটিটা অ্যাপ্লাই করে দাও…” সোনালী বলে, “মাথায় চাপ পড়ছে…”
“হুমমম…” পুলক সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে।
পরেরদিন রবিবার। সকালে উঠে পুলক নোংরার বালতিটা নিয়ে নীচে নেমে আসে। কর্পোরেশনের সাফাইকর্মী ছোটু গাড়ি আনতে পুলক বালটি উলটে নোংরা ফেলে দিল।
“দাদাবাবু…” ছোটু বলে।
“কীরে?”
“ছোটোমুখে একটা বড়ো কথা বলব?”
“বল…”
“আজ কয়েকদিন থেকে আপনি এত খাবার ফেলে দিচ্ছেন…”
“তোর কি তাতে?” পুলক ঈষৎ রাগ দেখায়।
“কিছু না… ক্ষমা করবেন…” ছোটু বলে চলে যায়। পুলক কিছুক্ষণ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক খাবার ফেলা যাচ্ছে কি? সত্যি? সোনালী আর মাকে বলতে হবে পরে, বাজার সেরে এসে বলবে। এই ভেবে পুলক বড়ো গেট খুলে ঘরে ঢোকে। বিরক্তমুখে ব্যাগ নিয়ে বাজারে চলে যায়। মেজাজ ভালো করার একমাত্র দাওয়াই হল প্রাণভরে বাজার করা। এটা পুলকের বিশ্বাস। পুলক দামদর করে ভালো মাছ নিল। সবজির দোকানে গিয়ে প্রাণভরে বাজার করার পর পয়সা দিচ্ছে, এমন সময়ে সবজি বিক্রেতা বাদল বলল, “দাদা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“বল…” পুলক বলে।
“আপনি কালকেই এত বাজার করলেন…সব খাওয়া শেষ?”
“হ্যাঁ চারটে মানুষ খেলে হবে না?”
“মা ঠাকরুণ বুঝি ফিরে এসেছেন?” সবজি বিক্রেতা বলে।
“মা?” পুলক অবাক হয়, “মা তো ঘরেই আছে। বাবাও। কেন কোথাও গেছিল?”
“আপনি যে সেদিন বললেন, মাসখানেক ধরে মা ঠাকরুণ আর বড়ো দাদাবাবু নেই বাড়িতে?”
পুলক ভুরু কুঁচকে তাকায়। তারপর সোজা বাড়ির দিকে রওনা দেয়। সে কবে এসব বলল? তা ছাড়া একটু আগে ছোটু প্রশ্ন করেছে, এখন সবজি বিক্রেতা প্রশ্ন করল। পুলকের পার্সোনাল ব্যাপারে সবার এত কৌতুহল কেন? আর পুলক কালকে বাজার করেইনি, বাদল ওরকম মিথ্যে বলল কেন?
“কিরে আজ আবার বাজার?”
চায়ের দোকান থেকে শঙ্কর বলে। শঙ্কর পুলকের পাড়ার বন্ধু। পুলক আনমনা হয়ে হাঁটছিল, বন্ধুর কথা শুনে দাঁড়ায়।
“হেব্বি খাওয়াদাওয়া চলছে মনে হচ্ছে…” শঙ্কর বলে।
“এই চারদিন পরে বাজার করলাম…” পুলক বলে।
“চারদিন?” শঙ্কর বলে, “কালকেই তো ব্যাগ বোঝাই করে বাজার করলি…”
“আমি?”
“তুই নয়তো কে? তোর ভূত?”
পুলক বাজারের থলি নিয়ে বসে পড়ে, তারপর কী একটা ভেবে মিথ্যে বলে, “আসলে কালকে দিদি জামাইবাবু এসেছিল তো…”
“কাকিমা চলে এসেছে?” শঙ্কর জিজ্ঞেস করে, “কাকু কাকিমা না থাকলে তো মিষ্টিদি আসে না…”
পুলক প্রমাদ গোণে। শঙ্করও মা-বাবার না থাকার কথা বলছে। অথচ পুলক জানে তার মা বাবা বিগত কয়েকমাস কোথাও যায়নি।
“হ্যাঁ এসে গেছে…” পুলক বলে, “পরশু…”
“বাহ বউদি বাপের বাড়ি গেল, আর কাকু কাকিমাও এলেন… তোর আর অসুবিধে রইল না…” শঙ্কর বলে।
বউদি বাপের বাড়ি গেছে? মানে সোনালী? বাপের বাড়ি? ঘরে দেখে এলো যে পুলক…
“না যায়নি…” পুলক চায়ে চুমুক দিয়ে বলে।
“যায়নি বললেই হল?” শঙ্কর বলে, “তুই নিজে গত সোমবার বউদিকে স্টেশনে ছেড়ে এলি। যাওয়ার মুখে কত কথা হল বউদির সঙ্গে।”
পুলকের মাথাটা কেমন চক্কর দেয়। এসব কী বলছে শঙ্কর? শঙ্কর তো মশকরা করার লোক নয়। উপরন্তু শঙ্করের কথা সবজি বিক্রেতার কথাকেও সমর্থন করছে।
“এই দেখ পেপারে কি লিখেছে…” শঙ্কর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে, “কুলতলি থানায় একটা লোক তার বাবাকে এত ভালোবাসে যে বাবার মৃত্যুর পরে বড়ো ফ্রীজারে লাশটা ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে। তিন বছর ধরে কেউ জানতেও পারেনি। শেষে ধরা পড়ে গিয়ে বলছে ওর বাবা নাকি মরেনি। এদিকে লাশ শুকিয়ে কাঠ… মমি হয়ে গেছে…”
“হুমম…” পুলক উত্তর দেয়।
“যতসব পাগলের কারবার…” শঙ্কর বলে।
“আজ আমি উঠি রে…” বলে পুলক উঠে পড়ে। তার মাথায় চিন্তার জাল জড়িয়ে যাচ্ছে।
পুলক কালকেও বাজার করেছে, কিন্তু সেটা তার মনে নেই। অথচ মা বা সোনালী কিছু বলল না তো? ঘরে বাজার থাকলে আবার বাজার করল কেন? তাহলে কি রাতে সব রান্না করে সকালে ফেলে দিল? ছোটু তো সেটাই বলল। খাবার ফেলে দেওয়া মা দু-চক্ষে দেখতে পারে না, এদিকে এত খাবার কয়েকদিন ধরে ফেলা হচ্ছে? খাচ্ছে না কেন? খেতে বসে তো পুলকের মনে হয়নি যে চারজনের থেকেও অনেক বেশি খাবার হয়ে যাচ্ছে। তাহলে এত খাবার নষ্ট হচ্ছে কেন? আর মা-বাবা ঘরে ছিল না, সোনালী বাপের বাড়ি গেছিল… এসব তার কিছুই মনে পড়ছে না কেন? গেলেও ওরা কবে এলো? পুলকের স্মৃতিশক্তি তো এত খারাপ নয়। তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
ফোনটা বেজে ওঠে। পুলক রিসিভ করে, উলটোদিক থেকে পুলকের দিদি বলে, “ভাই কালকে যা খাওয়ালী, ঊফফফ পেট আঁইঢাঁই করছে এখনও। অতটা খাবার অর্ডার না করলেও পারতিস…”
গতকাল দিদিরা এসেছিল? সত্যি এসেছিল? পুলক শঙ্করকে মিথ্যে বলেছিল, কিন্তু দিদিরা এসেছিল সেটাও মনে পড়ছে না তো।
“কাল? কাল তোরা এসেছিলিস?”
“হ্যাঁ তো…” দিদি বলে, “তুই কি রাতে বেশি মাল খেলি নাকি? কাল যে পিকুর জন্মদিন সেলিব্রেট করলাম। তুই খাবার অর্ডার করলি। মা বাবাকে ধানবাদে ভিডিয়ো কল করলি আর সোনালী জলপাইগুড়ি থেকে কত আফশোস করল সব ভুল মেরে দিলি নাকি…?”
“না না… ভুলব কেন?” অপ্রস্তুত হয়ে পুলক বলে, তারপর আরো কয়েকটা কথা বলে ফোন রেখে দেয়।
এবার পুলকের মনে ভয় করতে শুরু করে। সবাই বলছে বাড়িতে মা-বাবা আর সোনালী নেই, অথচ পুলক দেখে এসেছে ওরা আছে। এতগুলো মানুষ একসঙ্গে মিথ্যে কথা বলছে কেন? আর পুলকের কিছুই মনে পড়ছে না কেন? হঠাৎ পুলকের মাথায় একটা চিন্তা আসে…
তার মানে কি পুলকের বাড়িতে আসলে কেউই নেই? একটা মায়ার বাঁধনে সে ভুলভালো দেখছে আর সেটাই তার সত্যি মনে হচ্ছে? আসলে কেউ নেই, কিন্তু পুলক হ্যালুসিনেট করছে? কেন? কিসের জন্য? মা, বাবা আর সোনালী তো পুলকের খুব কাছের মানুষ। কী কারণে তাদের যাওয়া মনে পড়ছে না? ঘরের মধ্যে তিনজনকেই দেখেছে পুলক, অথচ দিদি আর শঙ্কর জানাল ওরা নেই। বাড়ির ভিতরে ওরা তাহলে কারা? ভূত? পুলকের দেখার ভুল? মাথার গন্ডগোল?
পুলক বাড়ির কাছে চলে এসেছে। বাড়ির ছাদে মাকে দেখা যাচ্ছে। পাশে সোনালী। পুলক ঘরে ঢুকেই বাজারের থলি দুটো রেখে ছাদে চলে গেল।
“মা তোমরা ধানবাদ গেছিলে মাসখানেকের মধ্যে? আর সোনালী তুমি জলপাইগুড়ি গেছিলে গত সপ্তাহে?” সটান প্রশ্ন করে পুলক।
“আমরা?” মা বলে, “এক বছর হয়ে গেল ধানবাদ যাইনি…”
“আর আমারও ছ-মাস হয়ে গেল জলপাইগুড়ি যাইনি…” সোনালী বলে, “তুমি কি সত্যিই গল্প লিখছ নাকি?”
পুলক ছাদ ছেড়ে নীচে চলে আসে। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসতেই সোনালী থালায় করে পরোটা আর তরকারি দিয়ে যায়। পুলক পরোটা তুলে দেখতে থাকে। এটা তো সত্যি পরোটা। তার মানে সোনালীও সত্যি। তাহলে শঙ্কর আর দিদি মিথ্যে বলল কেন?
“মা…” পুলক ডাকে। মা এসে দাঁড়ালে পুলক বলে, “এই দেখলাম ছাদে, এর মধ্যে পরোটা হয়েও গেল?”
“ছাদে কোথায় দেখলি? মা অবাক হয়ে বলেন, “সকাল থেকে তো রান্নাঘরেই। মাসখানেক তোকে রান্না করে খাওয়াতে পারিনি, আজ জমিয়ে রান্না করব।”
“কেন রান্না করোনি?” পুলক জিজ্ঞেস করে।
“ওমা… ধানবাদে ছিলাম যে…” মা বলেন, “কালকেই তো এলাম। আমরাও এলাম, আর সোনালীও জলপাইগুড়ি থেকে ফিরল…”
“আর তুমি আজ আবার এত বাজার আনলে? কালকেই অত ফেলা গেল…” সোনালী বলে।
পুলকের হাতে খাবার ওঠে না। সে ফ্যালফ্যাল করে থালার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার সমস্ত হিসেব উলটোপালটা হয়ে যাচ্ছে। কে সত্যি কথা বলছে? কে মিথ্যে বলছে? কেনই বা মিথ্যে বলছে? কোনটা বাস্তব? কোনটা স্বপ্ন? কোনটা স্মৃতি? অনেক কিছু পরস্পরবিরোধী কথা চলে আসছে কেন? পুলকের সামনে যে মা আর বউ দাঁড়িয়ে তারা কি সত্যি নাকি তারাও পুলকের কল্পনা?
পুলক উঠে পড়ে রান্নাঘরের দিকে ধাবমান হয়। এই রহস্যের সমাধান তাকে করতেই হবে। রান্নাঘরে ঢুকতেই পুলক আরো আশ্চর্য হয়। একটা বিশাল দুই পাল্লার ফ্রিজ। এটা কবে এলো? পুলক ফ্রিজটা খুলতেই তার মধ্যে থেকে সোনালীর মৃতদেহ বাইরে গড়িয়ে পড়ল। আঁৎকে উঠে পুলক দৌড়ে উপরের ঘরে চলে আসে। সেখানে আরেকটা বড়ো ফ্রিজ। সেটা খুলতেই পুলক দেখে তারা বাবা মায়ের মৃতদেহ শুকিয়ে জড়োসড়ো করে গুঁজে রাখা আছে ফ্রিজের মধ্যে।
পুলক কি তার মানে সেই রোগে আক্রান্ত? শঙ্কর যাদের ‘পাগল’ বলছিল? পুলক ফ্রিজের সামনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
জ্ঞান যখন ফেরে তখন পুলক দেখে সে সোফায় বসে। সোনালী জলের ছিটে দিচ্ছে, আর মা-বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। পুলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর রান্নাঘরের দিকে তাকায়। ওই তো বড়ো ফ্রিজটা। তার মানে পুলক ভুল দেখেনি। সোনালী আর মা-বাবা বেঁচে নেই। এরা ভূত।
“তুই লাশ টাশ কিসব বলছিলিস…” মা বলেন তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলেন, “হ্যাঁ গো, ছেলেটার রোগ আবার ফিরে এলো নাকি?”
পুলক ঝট করে ফোন করার চেষ্টা করে। দিদিকে ডাকতে হবে। কল লিস্ট ঘেঁটে দেখে দিদি তো ফোন করেনি। কিন্তু দিদির সঙ্গে যে কথা হল একটু আগেই? সব ভুতুড়ে ব্যাপার হচ্ছে। পুলক আর নিতে পারছে না। এইসব দুঃস্বপ্ন… নাইটমেয়ার…
পুলক উঠে দাঁড়ায় তারপরে উপরের ঘরের দিকে দৌড় দেয়।
“পুলক… শোন বাবা…” পিছন পিছন বাবা দৌড়য়। তাদেরও পিছনে মা আর সোনালী।
“পুলক… তোর একটা রোগ ছিল ছোটোবেলায়…” বাবা চেঁচাচ্ছে, “তুই ভুলে যেতিস আর নিজের মতো ঘটনা বানিয়ে নিতিস… যাস না বাবা… ওই ঘরে… শোন…”
কিন্তু পুলক আর কিছু শুনছে না। ততক্ষণে সে দোতলা পেরিয়ে তিনতলার ঘরে চলে এসেছে। দোতলায় বড়ো ফ্রিজটা দেখেছে পুলক, সে ভুল হতে পারে না। ঝট করে আলমারিটা খুলে লকার থেকে বন্দুকটা বের করে। এই দুঃস্বপ্ন থেকে তাকে জাগতেই হবে। এই মায়ার জালে পাগল হওয়ার থেকে মৃত্যুই শ্রেয়। বাবা আর মা চীৎকার করে উঠল, “না পুলু… নাআআ…” সোনালী পাগলের মতন চেঁচাচ্ছে।
পুলক কপালে বন্দুকটা ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দিয়ে দিল।
“গুড়ুম…”
ঝটিতে পুলক জেগে উঠল। সে টেবিলে বসে। সামনে টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। সাদা পাতাটা খোলা আছে। লেখক পুলক জেগে উঠেছে। সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল? কি বীভৎস বীভৎস স্বপ্ন দেখছিল… বাপরে। পুলক নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখে। হ্যাঁ এবার সত্যিই সে জেগেছে। কিছুক্ষণ থম মেরে পুলক ভাবার চেষ্টা করল… এতক্ষণ সে কি স্বপ্নই দেখল? এরকম ভয়ংকর সব স্বপ্ন? অতঃপর পুলক ভেবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। লেখার জন্য লেখকদের কখনও কখনও চরিত্রদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে হয়। পুলক ভাবতে ভাবতে সেরকমই চরিত্রদের মধ্যে নিশ্চয় ঢুকে পড়েছিল, তাই অমন স্বপ্ন দেখল। কিন্তু লাভের লাভ হল পুলক দুটো গল্পের আইডিয়া পেয়ে গেল। ঘড়িতে বাজে পৌনে তিনটে।
পুলক উঠে বাথরুমের দিকে যায়। টেবিলের পাশে একটাই কাগজের দলা দেখে নিশ্চিন্ত হয়। লাইট জ্বালিয়ে বাথরুমে ঢুকতেই পুলক চমকে ওঠে। এটা তো তার বাথরুম নয়। এটা এস টি এস কোম্পানীর মেডিকেল রুম। সে এখন পুলক সেন। নিজেকে লেখক ভাবল কী করে? একটু আগে তো লেখক ছিল। বাথরুমের কোণায় সোম আর প্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আঙুল তুলে বলছে, “তুই খুনী…তুই খুনী…”। পুলক ভয়ে দ্রুত পিছিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতেই আবার লেখকের রুমে চলে আসে। পুলক এখন নিজেকে লেখক মনে করছে। পুলক ভয় পেয়ে শোওয়ার ঘরের দিকে দৌড়য়। সেখানে দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখে সামনে সোনালী আর মা-বাবা দাঁড়িয়ে। সে এখন নিজেকে পুলক চ্যাটার্জি বলে বোধ করছে। এসব কী হচ্ছে? লেখকের ঘরে ফিরতেই দেখে ঘরের সর্বত্র কাগজের দলা ভরে যাচ্ছে।
“নাআআআআআআ…” বলে চীৎকার করে এই ঘর ওই ঘর দৌড়তে থাকে পুলক। যে ঘরেই যায় সেই ঘরেই সে নিজেকে একেকরকম পুলক বোধ করছে নিজেকে। কোনো পুলকেরই বাঁচার আশা নেই। এর থেকে কি বেঁচে ফেরার উপায় নেই…?
“ভগবান…” বলে পুলক দরজার চৌকাঠের উপরে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে।
***
“পড়লেন লেখাগুলো?” সুকমল বলে, “এবার যেটা খুশি ছাপুন…”
“হ্যাঁ, তিনটেই পড়লাম…” প্রকাশক কৌশিক সামন্ত বলেন, “পুলক চক্রবর্তী, পুলক সেন আর পুলক চ্যাটার্জি… তিনজনকেই যে শেষে মেরে ফেললে…”
“সেরকমই তো গল্প হলে মজা…” সুকমল হাসতে হাসতে বলে, “আমার সৃষ্ট চরিত্র, আমি যেমন ইচ্ছে মারলাম…”
“আচ্ছা, ভেবে দেখো…” কৌশিক বলেন, “এই যে একটাই মানুষের তিনটে আলাদা পরিচয় দিয়ে লিখছ, ধরো… মানে কিছুই তো ইমপসিবল নয়। ধরো তোমার লেখার সঙ্গে সঙ্গে একেকটা গল্পের যদি একেকটা রিয়েলিটি, একেকেটা বাস্তবতা তৈরি হয় তাহলে কী হবে? তুমিও তো স্রষ্টা, এক প্রকারের ভগবান। সেই সব ইউনিভার্সে পুলক যদি জানতে পারে যে তুমি তাকে নিয়ে এরকমভাবে খেলছ তার কীরকম লাগবে?”
“বাবাহ আপনি তো সায়েন্স ফিকশন শোনালেন…” সুকমল বলে, “আইডিয়াটা ঝেঁপে দেব?”
“হাহাহা…” কৌশিক বলেন, “না… আমার মনে হল। প্রত্যেকটা সৃষ্টি, তুমি তো এই তিন পুলককে প্রায় জীবন দিচ্ছ, তারপরে কেড়েও নিচ্ছ… কিন্তু পুলকের কাছে এগুলো একেকটা নাইটমেয়ার…”
“আমিই পুলকের ভগবান… কী বলেন?” সুকমল হাসে, “যাইহোক, যে গল্পটা ইচ্ছে ছাপবেন আপনাদের পুজোবার্ষিকিতে, আর বাকি দুটো জানাবেন, অন্য কাউকে দিয়ে দেব…”
“বাই দ্য ওয়ে… পুলক বলে কি সত্যি কারোর উপর রাগ পুষে রেখেছ নাকি?” কৌশিক জিজ্ঞেস করেন।
“পুলক পাতিদার…” সুকমল বলে, “আজ থেকে কুড়ি বছর আগে লিখতেন। অনেক নাম করেছিলেন। আপনি তো চিনতেন। গত বছর মারা গেলেন। রাগ বলব না, কিন্তু একটা অভিমান ছিল। বহুদিন আগে তিনি আমার গল্প বাতিল করেছিলেন, অথচ সেই গল্পেই আমার আত্মপ্রকাশ… প্রাত্যহিক কাগজ লুফে নিয়েছিল…”
“সৃষ্টি ও স্রষ্টা…?” কৌশিক জিজ্ঞেস করেন, “ঈশ্বর যে মানুষের সৃষ্টি আর ঈশ্বরও যে খেলাচ্ছলে মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন সেটা বোধহয় গোঁড়া বৈষ্ণব পুলকবাবু নিতে পারেননি…”
সুকমল হাসে, তারপরে উঠে চলে যায়। কৌশিক গল্পগুলো আরেকবার পড়তে বসে।
Tags: kalpabiswa y7n1, দীপ ঘোষ, সম্পদ বারিক