পাও নাই পরিচয়
লেখক: সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: দীপ ঘোষ
অন্ধকার হলঘরে নরম গদিওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আমি অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলাম মঞ্চের উপর মেয়েটিকে। উজ্জ্বল স্পটলাইট পড়েছে তার মুখে। মাইক হাতে নিয়ে গান গাইছে সে।
আমার নাকের উপর চশমাটা যন্ত্র দিয়ে আটকানো আছে ভাগ্যিস, নয়তো আমার যা ভুলো স্বভাব, হারিয়েই ফেলতাম হয়তো দরকারি জিনিসটা। একটু নেড়েচেড়ে ফোকাসটা ঠিক করে নিলাম। আর শ্রবণক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকার থেকে এখন যে হিয়ারিং এইডটা বসিয়ে দিয়েছে কানের গোড়ায়, তাতে সুবিধাই হয়েছে। এখন অনেক দূরের ফিসফিসানিও শুনতে কোনো সমস্যা হয় না।
এই মেয়েটির মতো এমন মধুর কণ্ঠস্বর আমি আগে কোনোদিন শুনিনি। ওকে আগেও দেখেছি এই হলে গান গাইতে। সত্যি বলতে কী ওর গান শুনব বলেই আমি আসি এখানে। চুপ করে বসে ওকে দেখতে দেখতে গানটা শুনতে লাগলাম।
একবার কি হাসল ও আমার দিকে তাকিয়ে?
অসম্ভব! ও আছে চড়া স্পটলাইটের মধ্যে, আর আমি আছি প্রায়ান্ধকার দর্শকাসনে। মঞ্চ থেকে আমাকে দেখতে পাওয়া অসম্ভব। আর খামোকা আমাকে দেখে ও হাসতে যাবেই বা কেন? আমি যে রোজ ওকে দেখতেই আসি, ও কী করে জানবে?
মাইকটা মুখের কাছে তুলে ও গাইতে শুরু করল। রবীন্দ্রসংগীত। আমার ভীষণ প্রিয় একটা গান।
“তুমি মোর পাও নাই, পাও নাই পরিচয়।”
কপালে এই বড়ো লাল একটা টিপ ওর, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, পরণে ময়ূরকণ্ঠী রঙের শাড়ি। চোখে ওরও আমার মতোই চশমা। তাতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নেই। সেই দুর্ঘটনার পর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সব মানুষকেই এখন এই ধরণের চশমা আর হিয়ারিং এইড দেওয়া হচ্ছে। ওকে লাগছেও কিন্তু ভারী চমৎকার এই চশমা পরে।
মেয়েটি গাইছে, “মরণ আসুক চুপে / পরম প্রকাশ রূপে, / সব আবরণ হোক লয়।”
হাততালিতে ভরে উঠছে প্রেক্ষাগৃহ। আমার মনে হল, আজ একবার গ্রিনরুমে গিয়ে মুখোমুখি আলাপ করলেই হয়।
যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। সবে উঠে দাঁড়িয়েছি, আর ভূমিকম্প শুরু হল।
টলে উঠল পায়ের তলার মাটি, দুলতে লাগল প্রেক্ষাগৃহ। দর্শকরা ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন।
মঞ্চের উপরের অবস্থাও ভালো নয়। বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গায়িকার পেছনে যারা ছিল, তারা লাফ দিয়ে পালাল ব্যাকস্টেজে। সেখানে ইমার্জেন্সি এক্সিট আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ময়ূরকণ্ঠী শাড়ি আর লালটিপ পরা গায়িকা মেয়েটি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছে মঞ্চের উপরেই। অসহায়ের মতো হাতড়ে হাতড়ে উঠবার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু পারছে না। এদিকে মাটি কাঁপছে থরথর করে।
ছাদ-টাদ ভেঙে পড়বে নাকি রে বাবা?
যা থাকে কপালে, ওকে এইভাবে বিপদের মধ্যে ফেলে আমি পালাতে পারব না।
লোকজন ছুটছে প্রেক্ষাগৃহের বাইরের দরজার দিকে; সেই উল্টোমুখো জনস্রোতকে ঠেলে আমি ছুটলাম মঞ্চের দিকে। দুলন্ত মাটির উপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল বারবার, কিন্তু কোনোক্রমে মঞ্চে উঠে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। “শিগগির হাত ধরো আমার। বাইরে যেতে হবে এক্ষুনি।”
আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল লাল টিপের সুন্দরী; বলল, “স্টেজের পেছনের দিকে বেরনোর দরজা আছে। এইদিকে আসুন। জলদি!”
এবার আমার হাত টেনে নিয়ে চলল ও। বাইরে যেইমাত্র এসে দাঁড়িয়েছি, অমনি আবার তীব্র কম্পনে দুলে উঠল মাটি। ও চেঁচিয়ে উঠল, “সাবধান!”
কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে উপরের দিকে চেয়ে দেখি, ছাদের একটা মাঝারি আকারের পাথরের চাঙড় খসে নেমে আসছে আমার মাথার ঠিক উপরে।
শেষ মুহূর্তে বোধহয় মাথাটা একটু সরিয়ে নিতে পেরেছিলাম, তাই খুলিটা ভেঙে গেল না। কিন্তু তাও আঘাত লাগাটা এড়ানো গেল না। প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়লাম মাটিতে। আর জ্ঞান হারালাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
চোখ বন্ধ করার আগে একবার কেবল দেখতে পেয়েছিলাম ওর সুন্দর মুখে তীব্র আতংকের ছাপ।
***
জ্ঞান ফিরল মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে।
বেশ কিছুক্ষণ পড়ে রইলাম শক্ত মাটির উপর। মুখে হাওয়া লাগছে বুঝতে পারছি। একটা দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগছে, যদিও গন্ধটা যে কীসের, চিনতে পারছি না। কানে আসছে একটা দূরাগত কলরব। এই যন্ত্রণার মধ্যেও আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগল।
চোখ খুলতে পারছি না এখনও, তাই কোথায় আছি বুঝতে পারছি না। কিন্তু এইটুকু অনুভব করতে পারছি, যে জায়গায় আছি, সেটা কোনো খোলা জায়গা। অন্য ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে উঠছে। নাকের উপরে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। হাত দিয়েই চমকে উঠলাম।
যে চশমাটা সরকারের তরফ থেকে বসিয়ে দিয়েছিল ওরা, সেটা আর নেই! সম্ভবত ধাক্কায় ভেঙে গিয়ে ছিটকে পড়েছে কোথাও!
হে ভগবান! এবার আমি দেখব কী করে?
চশমার কথা মনে পড়তেই তার সঙ্গে মনে পড়ে গেল হিয়ারিং এইডটার কথা। কানে হাত দিয়ে দেখি, সেটাও আর নেই – খুলে পড়ে গেছে কোথাও! ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল।
চোখ নেই, কান নেই— আমি বাঁচব কী করে? কে করবে আমাকে সাহায্য? কোথায় আছি আমি এখন?
কপালে ঘাম দিচ্ছে বুঝতে পারছি, বুকের মধ্যে ভয়ে জোরে ধকধক করছে হৃৎপিণ্ড। গলা শুকিয়ে গেছে, বুঝতে পারছি।
পড়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ একটা কথা বুঝতে পারলাম। দূর থেকে একটা কোলাহলের শব্দ আসছিল না? তার মানে হিয়ারিং এইড ছাড়াও আমি শুনতে পাচ্ছি!
তাই তো! এ যে অবাক কাণ্ড!
তাহলে… তাহলে চশমা ছাড়াও কি দেখতে পাব?
মাথার যন্ত্রণাটা একটু যেন কমেছে। আমি ভয়ে ভয়ে চোখ খুললাম।
আর তারপরেই মনে হল, আমি চোখে আর দেখতে না পেলেই বোধহয় ভালো হত।
হে ঈশ্বর! এ কোথায় এসে পড়েছি আমি?
শুয়ে আছি আমি কংক্রিটের রাস্তার উপরে, আর আমার চারপাশে পড়ে আছে সারি সারি মৃতদেহ – নারী, পুরুষ, শিশু। বিশ্রী পচনের গন্ধে ভরে আছে বাতাস।
রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। যেখান থেকে এই একটু আগে বেরিয়ে এলাম আমি, সেই প্রেক্ষাগৃহটা গেল কোথায়? রাস্তার এপাশে ওপাশে ধূসর, ভাঙা বিল্ডিং আছে কেবল গোটাকতক। কোথায় গেল আলো ঝলমল দোকানপাট, বাড়িঘর, ব্যস্ত ট্রাফিক? এ যেন এক মরার দেশে হঠাৎ এসে উদয় হয়েছি আমি। রাস্তার ধারে লাইটপোস্টে মিটমিট করে জ্বলছে হলদেটে আলো। সে আলোয় জ্যোতি কম, ছায়া বেশি।
আমার সঙ্গিনীই বা গেল কোথায়, যাকে আমি উদ্ধার করলাম ভেঙে পড়া প্রেক্ষাগৃহের মধ্য থেকে? আর এই এত লাশ – এরা কারা? আমি এদের মধ্যে এলাম কী করে? একটাও জীবন্ত মানুষ দেখতে পাচ্ছি না কেন চারপাশে?
আমি কি তবে মরে গেছি? এই কি তাহলে নরক?
নিজের হাতে দেখতে পাচ্ছি উল্কি করা আছে অদ্ভুত তিনটে শব্দ— টি এস ৪৫। মানে কী এর? কবে করলাম আমি এমন উল্কি? আমার নিজেরই তো মনে পড়ছে না।
এসব হচ্ছেটা কী আমার সঙ্গে?
একটু দূরে কাদের কণ্ঠস্বর এগিয়ে আসছে। আমি বলতে গেলাম, “বাঁচাও আমাকে!” কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোল না।
যারা আসছে, ওরা কারা? এই ঝাপসা আলোয় বুঝতেও পারছি না ভালো করে। ওরা কি আমাকে সাহায্য করবে?
শক্ত বুটের আওয়াজ হচ্ছে রাস্তায়। বেশ কয়েকজন আসছে এদিকে। আবার ওদের ডাকতে গিয়েও থেমে গেলাম।
এবার একটা গলা পেলাম – পুরুষমানুষের গলা – কর্কশ, নিষ্ঠুর। “খুঁজে দেখ, আর কেউ আছে কিনা। জ্যান্ত কেউ না পালাতে পারে যেন।”
ভয়ে আমার হৃৎপিণ্ড মনে হল গলার কাছে এসে ধুকপুক করছে। আধবোজা চোখে দেখতে পেলাম, লোকগুলোর পরণে সেনাবাহিনীর লোকেদের মতো পোশাক, হাতে অত্যাধুনিক অটোমেটিক রাইফেল।
“কম্যান্ডার, এখানে একটা লোক নড়ছে মনে হচ্ছে!” আওয়াজ দিল একজন। “হ্যাঁ, বেঁচে আছে। তবে সেমি-কনশাস।”
কম্যান্ডারের রুক্ষ্ম কণ্ঠস্বর শোনা গেল আবার। “ভূমিকম্পের ফলে ড্রিমটিউব ভেঙে গেছে নির্ঘাত। চশমাটা আছে চোখে ওর এখনও?”
“না কম্যান্ডার।”
“ব্যাক-আপ ড্রিমিং মার্ক আছে বডিতে?”
“নেই।”
“দেরি না করে খতম করো তাহলে।”
দু’রাউন্ড গুলির শব্দ পেলাম। যে লোকটা মরল, তার তরফ থেকে একটা আর্তনাদও এল না।
খুব পেশাদার এরা। গুলি করলে সোজা মাথায় ফুঁড়ে দেয়।
স্থিরভাবে পড়ে রইলাম আমি। এই মুহূর্তে একটু নড়াচড়া করলেই মৃত্যু নিশ্চিত।
টর্চের আলো ফেলে মৃতের সারি দেখতে দেখতে চলে গেল ওরা। বুটের খটখট আওয়াজ মিলিয়ে গেল দূরে।
আর তারপরেই বুঝতে পারলাম, আমার পাশেই পড়ে থাকা একটা লাশ নড়ছে।
ভয়ংকরভাবে চমকে উঠে আমি দেখলাম, একটি মেয়ে উঠে বসছে সেই মৃতের স্তূপের মধ্য থেকে। মুখটা যেন চেনা চেনা লাগল তার, কিন্তু চিনতে পারলাম না।
“অর্ণব, তুমি ঠিক আছ তো?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ, তোমাকেই তো বলছি। চিনতে পারছ না আমাকে?”
নীরবে মাথা নাড়লাম আমি। পারছি না। আমার নাম যে ‘অর্ণব’, তাই তো মনে করতে পারছি না আমি।
আমি বললাম, “আপনি কে বলুন তো? আর এখানে আমরা কী করছি? এইসব লাশ— এরা কারা?”
ভয়ে ভয়ে একবার এদিক ওদিক দেখে নিল মেয়েটি। তারপর বলল, “আমি ডক্টর নীলিমা সেন। তোমার চিকিৎসা করছি আজ তিন বছর হল।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কী অদ্ভুত পরিবেশ! খোলা রাস্তা, টিমটিমে আলো, সারি সারি মৃতদেহ, আর তার মাঝখানে বসে এই সুন্দরী মেয়েটি আমাকে বলছে, সে নাকি গত তিন বছর ধরে আমার চিকিৎসা করছে। কে পাগল? আমি, না ও?”
আমি বললাম, “আমার চিকিৎসা? হয়েছে কী আমার?”
আবার চারপাশ দেখে নিয়ে ডক্টর নীলিমা সেন (সত্যি যদি এটাই ওর নাম হয়) বলল, “বলব সব। কিন্তু তুমি এসো আমার সঙ্গে। এইভাবে রাস্তায় পড়ে থাকবে কতক্ষণ?”
সে উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টেনে তুলল। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, চোখের চশমা এবং কানের হিয়ারিং এইড ছাড়াও আমি ভালোই দেখতে পাচ্ছি, শুনতেও পাচ্ছি।
রাস্তার ওপারে যে ভাঙা বিল্ডিংটা আছে, সেইদিকে আমাকে নিয়ে চলল সে। আমি বললাম, “এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? এ বাড়ি তো ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে।”
এত চিন্তার মধ্যেও একটু হেসে ডক্টর সেন বলল, “ভাঙাচোরা বাড়ি তো দেখছ সামনে থেকে। ওটা শুধু মুখোশ। ভেতরে যা আছে, দেখলে যে-কোনো বড়োদরের গবেষণাগার লজ্জা পাবে।”
দূর থেকে আবার শোনা যাচ্ছে বুটের শব্দ। লোকগুলো ফিরে আসছে। নীলিমা বলল, “দেরি কোরো না, অর্ণব। এসো আমার সঙ্গে। ওরা জানতে পারলে কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না; তোমাকেও না, আমাকেও না। তোমাকে রক্ষা করার জন্য আমি লাশের পাহাড়ের মধ্যে গিয়ে শুয়েছিলাম, তুমি এখন আর দেরি করে আমাদের দু-জনেরই সর্বনাশ ডেকে এনো না।”
অগত্যা দ্রুতগতিতে নীলিমার পেছনে পেছনে চললাম আমি। ভাঙা বাড়ির পেছনের দেওয়ালে একটা বিশেষ জায়গায় হাত রাখল সে; এক মুহূর্তের মধ্যে একটা দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে। বুঝলাম, অদৃশ্য স্ক্যানার আছে দেওয়ালের গায়ে।
নীলিমা বোধহয় মিথ্যা কথা বলছে না। আমার নিজেরও জায়গাটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল আপনা থেকেই।
ভেতরে ঢুকতে প্রথমে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কী তীব্র, উজ্জ্বল আলো!
তারপর দেখতে পেলাম যন্ত্রগুলোকে।
প্রথম দর্শনে সেগুলোকে মনে হয় বিরাট বিরাট কাচের সব লম্বামতো বাক্স। তাদের মধ্যে শুয়ে আছে সারি সারি নারী-পুরুষ। নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে তারা। শুধু বুকের ওঠানামাটুকু দেখলে বোঝা যায়, তারা বেঁচে আছে, নয়তো জীবনের আর কোনো লক্ষণ নেই তাদের মধ্যে।
“এ কী হচ্ছে এখানে? কারা এরা? এই বাক্সগুলোই বা কী?”
“ড্রিমটিউব,” একটু হাসল নীলিমা। “এরা সেকেন্ড ব্যাচের সাবজেক্ট। স্বপ্ন দেখছে এরা।”
আমি হাঁ করে দেখতে লাগলাম। মানুষগুলো কেমন স্থির হয়ে শুয়ে আছে কাচের বাক্সগুলোর মধ্যে। বাক্সের গায়ে লাগানো আছে নেমপ্লেট; তাতে সাবজেক্ট কোড, বয়স, ওজন এইসব লেখা আছে। বাক্সের মধ্যে অক্সিজেন কানেকশন আছে; আর নলে করে যাচ্ছে তরল খাদ্য। মাথায় লাগানো আছে একগাদা ইলেকট্রোড। অজস্র মনিটর পিঁক পিঁক করে আওয়াজ করে চলেছে। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল এসব দেখে।
“এদিকে এসো, অর্ণব,” নীলিমা ডাকল।
একটা খালি কাচের বাক্সের গায়ে লেখা নেমপ্লেটের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে আমার। সাবজেক্ট কোডটা পড়ে চমকে উঠলাম আমি। “টি এস ৪৫”।
আপনা থেকেই চোখ চলে গেল নিজের বাহুর উল্কিচিহ্নের দিকে।
নীলিমা বলল, “ভূমিকম্পে তোমার ড্রিমটিউবে পাওয়ার সাপ্লাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে তুমিসহ বেশ কয়েক জনের ব্রেনের সার্কিটে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কম্যান্ডারের উপর গভর্নমেন্টের আদেশ আছে, এই ফেসিলিটি থেকে কোনো টেস্ট সাবজেক্ট যেন বাইরে না বেরোতে পারে। বেরোলে কী হয়, স্বচক্ষেই তো দেখলে।”
আমি বিস্ফারিত চোখে দেখছিলাম জায়গাটা। এতদিন তাহলে যা কিছু দেখেছি, সব স্বপ্ন!
আমার বিস্ময়টা আন্দাজ করেই নীলিমা বলল, “ওই চশমার যোগ আছে তোমার ব্রেনের সঙ্গে। তুমি যা দেখতে চাও, তাই তোমাকে দেখানো হত, শোনানো হত ওই অমনিউইশ গ্লাস আর হিয়ারিং এইডের সাহায্যে। নয়তো তোমাকে শান্ত রেখে এক্সপেরিমেন্ট চালানো সম্ভব ছিল কি?”
“কীসের এক্সপেরিমেন্ট? কী ধরণের পরীক্ষার গিনিপিগ ছিলাম আমি? আসলে এতগুলো মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে কী পরীক্ষা চালাচ্ছেন আপনারা?”
অসহায় রাগটা ফুটে বেরোচ্ছিল আমার কণ্ঠস্বরে। নীলিমা আস্তে আস্তে বলল, “এর নাম ‘প্রজেক্ট অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ’। মানবজাতিকে রক্ষা করার শেষ একটা চেষ্টা চালাচ্ছি আমরা। আর তুমি… তোমরা সেই পরীক্ষায় ভাবীকালের মানুষদের …পূর্বপুরুষ।”
আমি হাঁ করে রইলাম। আমি… কী?
“আমাদের মতো ডাক্তারদের উপর আদেশ আছে, কোনো পেশেন্ট বা কোনো টেস্ট সাবজেক্ট যদি পরীক্ষায় ঠিকমতো সাড়া না দেয়, বা এই ফেসিলিটির বাইরে পালাতে সক্ষম হয়, তাহলে তখনই তাকে মেরে ফেলতে। আমরা ব্যর্থ হলে কম্যান্ডার আর তার টহলদার বাহিনী তো আছেই। এই এতদিন ধরে যতজন পালাতে চেয়েছে, ওই রাস্তা থেকে খুব দূরে কেউ যেতেই পারেনি। তাদের তো নিজের চোখেই দেখে এলে এখুনি তুমি।”
সেই মৃতের স্তূপের কথাটা মনে পড়ে যেতেই পেটের মধ্যে কী যেন একটা গুলিয়ে উঠল। আমি বললাম, “কিন্তু আমি এখনও মরিনি কেন তাহলে?”
অদ্ভুতভাবে আমার দিকে চেয়ে রইল নীলিমা। “মরে যাওয়াই উচিত ছিল তোমার। কম্যান্ডার এখান থেকে হিসেব মিলিয়ে গেছে। সে দেখে গেছে, টি এস ৪৫-এর ড্রিমটিউব খালি ছিল। আবার যখন সে ফিরে আসবে, তখন তোমাকে দেখেই সে বুঝতে পারবে, তুমি বাইরে থেকে ফিরে এসেছ। আর তখনই সে অনুমান করে নেবে, এর পেছনে আমার মদত আছে। তখন কী হবে, আশা করি আর বলে দিতে হবে না।”
“কিন্তু তুমি কেনই বা বাঁচালে আমাকে?” নিজেই জানি না কেন ওকে ‘তুমি’ ডেকে ফেললাম।
“প্রজেক্ট অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ আসলে কী জানো, অর্ণব? গোটা বিশ্বের যা জনসংখ্যা ছিল, তার আর মাত্র কতটুকু অবশিষ্ট আছে, ধারণা করতে পারো? মাত্র বারো শতাংশ! কোথায় গেল বাকিরা? শেষ হয়ে গেছে, অর্ণব; একদম মুছে গেছে তারা! যে হারে পৃথিবীকে দূষিত করে গেছে আমাদের পূর্বপুরুষরা, তার মূল্য শোধ করে দিতে হয়েছে আমাদের প্রজন্মকে। একের পর এক মহামারী, তেজস্ক্রিয় যুদ্ধ আর বাতাসের দূষণে রক্ষা পায়নি কেউ। পোলার আইস ক্যাপ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, জানো তুমি? মারাত্মক সুনামিতে ভেসে গেছে অর্ধেক বিশ্ব। এই অবস্থায় যে অল্প ক’জন মানুষ বেঁচে আছে, তারা আছে নালার ইঁদুরের মতো। এই পরিস্থিতিতে মানুষ জাতটা এত ধকল সামলে আর বেশিদিন টিঁকবে, তার আশা কম।
“প্রজেক্ট ‘অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ’ তাই বাছা বাছা কিছু মানুষকে নিয়ে এসেছে এখানে। ভবিষ্যতে মনুষ্যজাতিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে কী চাই? চাই উত্তরাধিকারী, চাই প্রচুর মানুষ। বিগত তেজস্ক্রিয় যুদ্ধের ফলে মানবজাতির একটা বড়ো অংশ হারিয়ে ফেলেছে সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা। তাই তোমাদের মতো হেলদি টেস্ট সাবজেক্ট – যাদের ওই সক্ষমতা এখনও আছে – তাদের এখানে এনে রাখা হয় ড্রিমটিউবের মধ্যে, প্রেম-প্রেম ভাব জাগানোর জন্য দেওয়া হয় অক্সিটোসিন, আর তার সঙ্গে ইনজেক্ট করা হয় ফার্টিলিটি ড্রাগ, আর নিয়মিত বাধ্য করা হয় যৌনমিলনে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চাই, অর্ণব। তুমি, তোমার মতো সাবজেক্টরা আসলে সেই প্রজন্মের অ্যাডাম।”
শুনতে শুনতে রাগে, বিরক্তিতে গায়ে জ্বালা ধরে যাচ্ছিল আমার। আমাকে স্রেফ এদের যৌনদাস বানিয়ে রেখেছে এরা! আমি বললাম, “আর তুমি আসলে কী করো এখানে, নীলিমা?”
মাথা নিচু করল সে; মৃদুকণ্ঠে বলল, “আমি তোমার ইভ, অর্ণব। দু’মাস হল তোমার সন্তান গর্ভে ধারণ করেছি আমি।”
***
“ভালোবাসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এখানে,” নীলিমা বলল। “কিন্তু তাও আমি ভালো না বেসে পারিনি তোমাকে। আমি এই প্রজেক্টের ডাক্তার হলেও টেস্ট সাবজেক্ট হিসেবে ভলান্টিয়ার করেছিলাম একসময়। তুমি কখনও জানতে পারোনি, কিন্তু তোমাকে ভালোবেসেছিলাম আমি, অর্ণব। তাই আজ ওই দুর্ঘটনার পরে বিপদ জেনেও ফেসিলিটির বাইরে তোমাকে আনতে গিয়েছিলাম। অমনিউইশ গ্লাস আর হিয়ারিং এইড না থাকায় তুমি সত্যিটা দেখতে পাচ্ছ। ওই যন্ত্রদুটো তোমাকে বন্দি করে রাখত নিজের ইচ্ছাপূরণের জগতে। এখানে আমরা তোমাকে দিয়ে কী করাচ্ছি, তুমি টেরও পেতে না।”
আমি একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই আমার হাত ধরে টানল নীলিমা।
“কী হল?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“ওই দ্যাখো।”
দেওয়ালে ঝোলানো মনিটরটার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল সে। সেনাবাহিনীর পোষাক পরা ছ-জন লোক হাতে রাইফেল নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে একটা দরজার সামনে। দরজাটা চিনতে ভুল হল না আমার।
এখানে ঢোকার দরজা!
“এই দরজার বাইরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এটা। কম্যান্ডারের কাছে দরজার স্ক্যানারের অ্যাক্সেস আছে। এই পর্যন্ত আসতে ওর এক মিনিটও লাগবে না। এখানে এসে ও যদি তোমাকে দেখতে পায়, আমাদের দু-জনকেই দুটো হেডশটে খতম করে দিতে ওর একটুও হাত কাঁপবে না। এক্ষুণি বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের এখান থেকে। এই ফেসিলিটির কথা সরকার গোপন রেখেছে জনসাধারণের কাছে; তাদের বেশির ভাগই যে ইনফার্টাইল হয়ে গেছে এই সরকারেরই শুরু করা তেজস্ক্রিয় যুদ্ধে, এ তথ্যটা প্রাণপণে গোপন রাখার চেষ্টা হচ্ছে, যদিও আর কতদিন পারা যাবে, আমার সন্দেহ আছে।”
আমাকে ঠেলে ও নিয়ে চলল অন্য একটা দরজা দিয়ে পাশের একটা ঘরে। তারপর এ গলি, ও করিডোর – আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল। উত্তেজিতভাবে নখ কামড়াচ্ছিল নীলিমা।
“কম্যান্ডার একবার জানতে পারলে আর রক্ষা নেই!”
আমি বললাম, “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“বাইরে। তোমাকে আর এখানে রাখার রিস্ক আমি নিতে পারব না। এখান থেকে অনেক দূরে তোমাকে পাঠাবার ব্যবস্থা আমি করব। কিন্তু একটু সময় শুধু চাই আমার।”
অদ্ভুত লাগছিল আমার। এই মেয়েটির গর্ভে আমার সন্তান আসছে, আমাকে বাঁচাবার জন্য নিজের জীবনের পরোয়াও করছে না এ, অথচ একে আমি মনে করতেই পারছি না।
নাই পারি, এই মুহূর্তে মনে হল, আমিও একে ভালোবেসে ফেলেছি।
একটা লম্বাটে, ভারী জিনিস তুলে নিল সে একটা কাবার্ড খুলে। জিনিসটা দেখে চিনতে পারলাম আমি, এবং চমকে উঠলাম।
একটা লাইট মেশিনগান!
“ওদের সঙ্গে আছে, আমাদেরও সঙ্গে অস্ত্র থাকা ভালো।”
“ডক্টর সেন, কোথায় আপনি?” দূর থেকে ভেসে এল কম্যান্ডারের রুক্ষ্ম, নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বর।
আমি চমকে উঠলাম। “আসছে ওরা!”
এই ঘরটার একদিকে একটা দরজা দেখিয়ে রাখল আমাকে নীলিমা। “বিপদ বুঝলে ওই দরজা দিয়ে সোজা বেরিয়ে দৌড় দেবে। একটু এগোলেই নদীর ব্রিজ। দরকার পড়লে নদীতে ঝাঁপ দিও, কিন্তু ওদের হাতে ধরা দিও না।”
আমি মাথা নাড়লাম। কম্যান্ডার যে কী চিজ, জানা হয়ে গেছে। বেঁচে আছি দেখলেই সোজা মাথায় গুলি চালাবে হতভাগা।
আমি বললাম, “কিন্তু তোমার কী হবে, নীলিমা?”
ওর সুন্দর মুখটায় একটা মলিন হাসি ফুটে উঠল। লাইট মেশিনগানটা তুলে ও বলল, “তোমাকে পালানোর সময় কভার দিতে হবে তো। আমাকে নিয়ে ভেবো না, অর্ণব। অনেক পাপ করেছি আমি; আমার প্রায়শ্চিত্ত করার দরকার আছে।”
বুঝতে পারলাম ও কী বলতে চায়। একবার জড়িয়ে ধরলাম ওকে; ওর পেটের উপর হাত রেখে বললাম, “কিন্তু এ তো কোনো দোষ করেনি!”
নীলিমা বলল, “এর না আসাই বোধহয় ভালো, জানো? এই নোংরা পৃথিবী থেকে বিষাক্ত মানুষজাতটা মুছে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়।”
আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আর কিছু বলার আগেই দুম দুম করে ধাক্কা পড়ল দরজায়। কম্যান্ডারের গলা পাওয়া গেল। “দরজা খুলুন, ডক্টর সেন।”
“যাও তুমি এবার!” অধৈর্য স্বরে আমাকে তাড়া দিল ও।
“আমি তোমাকে ফেলে যাব না। তুমিও চলো আমার সঙ্গে, নীলিমা।”
“তর্ক কোরো না। যা বলছি, শোনো।”
“আমি যাব না।”
দাঁড়িয়ে রইলাম আমি গোঁয়ারের মতো। আমি এতটাও নিচ নই যে আমার ভালোবাসার মানুষকে, আমার অনাগত সন্তানকে মৃত্যুর মুখে রেখে আমি পালিয়ে যাব।
দরজা ভেঙে ভেতরে এসে ঢুকল কম্যান্ডার আর তার বাহিনী। এক মুহূর্ত দেরি না করে ফায়ারিং শুরু করল নীলিমা।
“কভার নাও!” চেঁচিয়ে উঠল সে; লুকিয়ে পড়ল একটা ভারী স্টিলের টেবিলকে উলটে দিয়ে।
দু-জন সেনা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। পালটা গুলি চালাতে শুরু করল ওরা।
কানের পাশ দিয়ে শিস দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে গরম বুলেট। নীলিমার এলএমজির গর্জনে ভরে উঠেছে ঘরটা। বারুদের গন্ধে দম যেন আটকে আসছে।
ফায়ারিং-পালটা ফায়ারিং-এর কানফাটা শব্দের মধ্যেই নীলিমা আমাকে আবার বলল, “পালাও, অর্ণব। প্লিজ! আমার গুলি ফুরিয়ে আসছে।”
অসহায়ের মতো আমি তাকালাম দরজাটার দিকে। মনস্থির করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
তারপর ওর হাতের জিনিসটাকে দেখতে পেলাম আমি। পিনটা ততক্ষণে খুলে ফেলেছে ও।
“যাও তুমি! এখানে থাকলে আর কেউই বাঁচবে না!” চিৎকার করে উঠল ও।
অন্ধের মতো আমি ছুটলাম বাইরে যাওয়ার দরজার দিকে। একটা বুলেট আমার কাঁধের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি দরজাটা খুলে ফেললাম, পা বাড়ালাম বাইরের দিকে। আর তারপরেই…
তারপরেই যেন প্রলয় নেমে এল। গ্রেনেডের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল প্রজেক্ট অ্যাডাম অ্যান্ড ইভের ফেসিলিটির দেওয়াল। ঘরের ছাদ ভেঙে পড়ল। শক ওয়েভের ধাক্কায় আমি ছিটকে পড়লাম বেশ কয়েক হাত দূরে। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এল।
জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি আমি। কানের ভেতর চিঁইই করে শব্দ হয়ে চলেছে। নীলিমার গ্রেনেডে ওই ঘরে আর কারও বেঁচে থাকার কথা নয়।
সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা। আমিও বোধহয় মরে গেছি।
না, মরিনি। কাদের কথাবার্তা এখনও শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। আমার চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসছে।
শুনতে পেলাম, একটা রুক্ষ্ম কণ্ঠস্বর বলছে, “সাবজেক্ট আন্ডার কন্ট্রোল তো?”
তারপর একটা চেনা চেনা মেয়েলী গলায় শুনতে পেলাম, “অফ কোর্স। ওর নাকের উপর যে অমনিউইশ গ্লাস আর কানে যে হিয়ারিং এইড লাগানো ছিল, শুধু সেইগুলো ড্যামেজ হয়েছিল ভূমিকম্পের সময়। পাওয়ার সাময়িক ডাউন হয়ে গিয়েছিল আমাদেরও। সেকেন্ডারি পাওয়ার ব্যাকআপ কিক ইন করতে করতে জনা দুয়েক সাবজেক্ট শকের কারণেই দিশাহারা হয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল।”
রুক্ষ্ম কণ্ঠস্বরটা বলল, “হুম, তাদের একটাকে নিয়ে আর রিস্ক নিইনি। বাইরেই তার খেল খতম করে এসেছি আমরা।”
মেয়েলী কণ্ঠটা বলল, “কিন্তু এ তো স্পেশাল কেস। তাই আমিই নিয়ে এলাম একে ভেতরে। ওর চোখের লেন্সের উপরে যে ট্রান্সপারেন্ট স্মার্ট পর্দা লাগানো আছে, তাতে ওর পছন্দমতো দৃশ্য ও আবার দেখা শুরু করেছে। আর কানে ককলিয়ার ভেতরে বসানো স্মার্ট চিপে ওর পছন্দের সাউন্ডওয়েভ দেওয়া হচ্ছে হেয়ার সেলগুলোতে। সেকেন্ড ব্যাচের সাবজেক্টের আর ওইসব পুরোনো অমনিউইশ গ্লাস-টাস দরকার হয় না, কতবার বলেছি ওদের। তা কে শোনে এত টেকনিক্যাল ডিটেলস? ওদের একটাই কথা, সরকারি আদেশ।”
পুরুষকণ্ঠ বলল, “তাহলে চিন্তা করার কিছু নেই বলছেন তো, ডক্টর? এই ন্যাচারাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে সরকারি ব্যর্থতার খবর বাইরে বেরোবে না তো?”
হাসল নারীকণ্ঠ। “না কম্যান্ডার। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এরকম কিছু হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্ণব কখনো আউট অফ কন্ট্রোল হইনি। অল্প কিছুক্ষণের জন্য কেবল রাস্তার দৃশ্যটা দেখে ফেলেছিল। তারপর ওকে এখানে এনেই একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে অচেতন করে ফেলেছি। আর তারপর শুরু হয়েছে পরিমাণ মতো হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ আর অ্যাড্রিনালিন প্রয়োগ। তার ফলে কিছু অদ্ভুত, উত্তেজনাকর দৃশ্য তো ও নিশ্চয়ই দেখেছে, যদিও ও কী দেখেছে, শুধু ও-ই জানে। কিন্তু চিন্তা নেই, আমরা আবার পুরোনো ট্রিটমেন্ট শুরু করব কাল থেকেই। আপনাদের টি এস ৪৫ অ্যাডাম আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই আবার ফুললি ফাংশনাল হয়ে যাবে। এক্ষুণি একটা ইঞ্জেকশন দিচ্ছি ওকে; শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে ও এখনই; ড্রিমটিউবে শুয়ে ডুবে যাবে সুখের স্বপ্নে।”
খট খট বুটের শব্দ দূরে চলে যাচ্ছে। আমার ঘুম পাচ্ছে। চোখ যেন জুড়ে আসছে। মাথার মধ্যে হালকা একটা যন্ত্রণা আছে বটে, কিন্তু কোথা থেকে একটা নিশ্চিন্ত আরাম ঘিরে ধরছে আমাকে। একটা চেনা গলা ফিসফিস করে আমার কানে কানে বলছে, “আমি বেঁচে আছি, অর্ণব; ভেবো না। বেঁচে আছে বাচ্চাটাও।”
তারপর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম আমি।
আবার যখন চোখ খুললাম, সত্যি না স্বপ্ন জানি না, দেখলাম, নীলিমার পরণে ময়ূরকণ্ঠী রঙের শাড়ি, কপালে লাল টিপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। আমার হাত ধরে ও বলল, “ভালোবাসি তোমাকে। তাই বেঁচে আছি এখনও।”
আমি হাসলাম; বললাম, “একটা গান শোনাও না।”
নীলিমাও হাসল; আমার দিকে তাকিয়ে গাইতে লাগল সে।
“তুমি মোর পাও নাই, পাও নাই পরিচয়।
তুমি যারে জানো সে যে কেহ নয়, কেহ নয়।”
Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দীপ ঘোষ, সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়