ভূতগুলো সব বাঁশি বাজায়
লেখক: তৃণময় দাস
শিল্পী: রনিন
“শুনতে পাচ্ছ?” মণির জিজ্ঞাসা।
আমি হাঁটা থামালাম।
আমাদের চারিদিকে গাছ আর গাছ। বাঁশ, ওক, ম্যাপল, ফার। মাঝে মাঝে রক্তাভ রডোডেনড্রন। সভ্যতা এই উপত্যকাকে চেনে না, জানে না। মহাদ্রুমদের শাখা-প্রশাখায় আটকে গিয়েছে সময়ের নিশ্চিত স্রোত। হাওয়ার আদরে পাতাদের শিরশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাখির ডাক। সেই ডাকের সঙ্গে মিশে রয়েছে বাঁশির আওয়াজ।
একটা নয়। বেশ কয়েকটা। মিলিয়ে মিশিয়ে যাওয়া শিষের মতো আওয়াজ। অদ্ভুত লাগছে শুনতে। ভূতেদের অর্কেস্ট্রা। সুরটা চেনা মনে হল। নতুন কোনো সিনেমার গান কি?
“বাবা! কোথাও কোনো উৎসব রয়েছে নাকি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মণি ঠোঁট উলটাল। “লোকাল কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে।” তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল।
আরেকটু এগোতে কুলকুল আওয়াজ শুনতে পেলাম। ট্রেকিং-এর রাস্তা জুড়ে একটা ঝরনা। বাম দিকের জঙ্গলের মধ্য থেকে পাথরের ধাপ বেয়ে বেরিয়ে রাস্তা হয়ে ডান দিকের খাদে পড়ে যাচ্ছে। জল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। জলের মাঝে কয়েকটা ইঁট বসানো। মণি সেগুলোয় তিড়িং তিড়িং করে পা ফেলে ঠিক পার হয়ে গেল।
আমিই পার হতে গিয়ে ঝামেলা বাধালাম। শেষ ইঁটে পা রাখতে গিয়ে হড়কে গিয়ে জলে ঝপাং ঝপ। জিনসের প্যান্টের নীচটুকু ভিজে একাকার। জুতোর ভেতরে বন্যা। কোনোরকমে ঝরনার জল পার হয়ে শুকনো মাটিতে পা রাখলাম।
দেখলাম মণি একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
“জানতাম তোমার দ্বারা ট্রেকিং হবে না।”
“আরে কিছু হবে না। একটু তো ভিজেছে।”
“একটু ভেজা থেকেই সর্দি-জ্বর হয়। একটা গামবুটও নিয়ে আসোনি।”
মণির পায়েও গামবুট নেই৷ কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বাড়ালাম না। বাঘকে জেনেশুনে খোঁচা দিতে নেই। বরং নীচু হয়ে জিনসের প্যান্টটা উপরে গুটিয়ে নিলাম।
পায়ের উন্মুক্ত অংশে পাহাড়ি হাওয়া এসে দাঁত বসিয়ে দিল। ভেজা জুতো দুটো পরে থাকতেও খুব অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু উপায় নেই।
আমাদের যাত্রা পুনরাম্ভ হল। খেয়াল করলাম, বাঁশি বাজানো থেমে গিয়েছে।
***
ট্রেক শেষ হওয়ার একটু আগে কুয়াশায় চারিদিক আবছায়া হয়ে গেল। গাছগুলোর অস্পষ্ট অবয়ব দেখে মনে হল জীবন্ত একটা চৈনিক ইঙ্ক-ওয়াশ পেইন্টিং-এর মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি।
“কী গো! কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না এইবার,” মণিকে ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করলাম। “হাঁটতে গিয়ে যদি কোনো খাদে পড়ে যাই?”
“রাস্তার মাঝামাঝি খেয়াল করে হাঁটো,” মণি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। যতই মনের জোর আর ইচ্ছে থাকুক না কেন, এত কষ্ট করার অভ্যেস ওর নেই৷ দম ফুরিয়ে গেছে।
আমিও ক্লান্ত। তবে আরো আধঘণ্টা ইঞ্জিন চালিয়ে নিতে পারব। সমস্যাটা অন্যদিকে। এতক্ষণ ধরে ভিজে জুতো পরা পা দুটো হাওয়ার দংশনে কেমন অবশ হয়ে এসেছে। এইভাবে খুলে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না।
জিনসের প্যান্টটা নামিয়ে নেব বলে সবে উবু হয়েছি, এমন সময় খুব কাছ থেকে বাঁশির আওয়াজ ভেসে এল।
আমরা দুইজনেই একটু চমকে উঠলাম। সেই আগের মতো, অনেকগুলো বাঁশির আওয়াজ। এইবার চারদিক থেকে আসছে। সুরে একটা নেশালু ভাব।
কিন্তু এই কুয়াশাজড়ানো বনে, হাড় হিম করা শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে, বাঁশি বাজাচ্ছে কারা? আমি এদিক ওদিক ঠাহর করার চেষ্টা করলাম। বাম দিকে পাইন আর ওকের শীর্ণকায় গুঁড়ির মাঝে কাউকে দেখতে পেলাম না। ডান দিকে আগের মতো চড়া খাদ আর নেই, তবে সেইদিকের কুয়াশা আরো গাঢ়। আওয়াজের তীব্রতা শুনে মনে হল কাছ থেকেই আসছে। খুব জোর, বিশ হাত দূরত্বের মধ্যেই। কিন্তু কোন দিক থেকে?
“এই কে আছে?” মণি জোরে হাঁক দিল। “হু ইজ ইট?” একটু ভয় পেয়েছে আমার বউ। ট্রেকিং-এর রাস্তায় আমরা প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে হাঁটছি। এতক্ষণে কারুর টিকি পর্যন্ত দেখিনি। তার উপর এই গাঢ় কুয়াশা ভূতুড়ে একটা পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এখন কেউ যদি সেই ধোঁয়াশার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজায় তো একটু ভয় তো লাগবেই।
মণির প্রশ্নের উত্তর কেউ দিল না। বরং বাঁশির সুরের তীব্রতা যেন আরেকটু বেড়ে গেল। আমি জিনসের পা দুটো নামিয়ে মণির কাছে গিয়ে বললাম, “বাজাচ্ছে বাজাতে দাও না৷ আমরা তো প্রায় চলে এসেছি।”
মণি বলল, “যদি খারাপ লোক হয়?”
“তা হলে বাঁশি বাজিয়ে নিজেদের উপস্থিতি থোড়াই জানান দেবে। দেখ, কোনো দুষ্টু বাচ্চাকাচ্চা হবে। টুরিস্ট দেখে ভয় দেখাতে এসেছে। কাছাকাছি কয়েকটা গ্রাম রয়েছে না? সেখানেই থাকে হয়তো।”
আমার মনে হয় না এগুলো কোনো “বাচ্চাকাচ্চা” বাজাচ্ছে। তবে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভয় না পেয়ে, এগিয়ে যাওয়া উচিৎ৷ যত জল্পনাকল্পনা বাংলোয় ঢুকে করা যাবে।
মণি আমার কথা কতটা বিশ্বাস করল জানি না, তবে জোরে জোরে পা ফেলতে লাগল। আমিও পিছু নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভূতুড়ে অর্কেস্ট্রা পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে এলাম।
কুয়াশার ভারে নুয়ে পড়া বনে এখন হাওয়ার ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে না। একটা পাখির ডাকও নেই। কেউ যেন বনটার টুঁটি চেপে ধরেছে। এই চুপ! একদম চুপ! ভূতেরা বাঁশি বাজাতে এসেছে। সবাইকে তা শুনতে হবে।
আমার মনের কথার আঁচ পেয়েই যেন আবার বাঁশির আওয়াজে বনটা কেঁপে উঠল। এইবার আসছে আমাদের সামনে থেকেই। রাস্তার ঠিক ওপরে দাঁড়িয়ে কারা যেন বাঁশি বাজাচ্ছে!
আমরা দুইজনেই হাঁটা থামিয়ে দিলাম। এখন আমারও বেশ ভয় করছে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। হাতের চেটোয় ঘাম। গলা শুকনো। পা দুটো আবার অবশ হয়ে আসছে, কিন্তু ঠান্ডার জন্য নয়।
আগে যারা বাজাচ্ছিল তারাই তো মনে হয়? সেই একই রকম সুর। আমি মনে মনে গুণে দেখলাম৷ পাঁচটা বাশির আওয়াজ আসছে। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে বাজাচ্ছে। আমাদের আগে কী করে ওরা এগিয়ে গেল? বন থেকে কোনোরকম আওয়াজই তো আমি শুনতে পাইনি! সব তো নিশ্চুপ!
এইবার আমি মণির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দুইজনের হাতেই লাঠি ছিল। আমি আমারটা শক্ত করে ধরে বললাম, “আমার পেছন পেছন হাঁটতে থাকো।”
মণি আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছনে একেবারে লেপটে গেল। তারপর দুইজনে গুটিগুটি পায়ে এগোতে লাগলাম।
এক পা… দুই পা… তিন পা…
কাছে। আরো কাছে।
সারা গায়ে এইবার কাঁপুনি ধরেছে। ভয়ের সঙ্গে ঠান্ডার যুগলবন্দি। কী জানি, জ্বরও এল নাকি?
বাঁশির আওয়াজে কানের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা। এত তীক্ষ্ণ… কিন্তু একই সঙ্গে এত মধুর।
আরেকটু এগোতেই বাঁশির আওয়াজ থেমে গেল। পাঁচ জনের একসঙ্গে। এ কী রকম খেলা রে বাবা? লুকোচুরি খেলছে নাকি আমাদের সঙ্গে? আমরা কিন্তু হাঁটা থামালাম না। একেবারে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম।
মণি আমার কাঁধ থেকে উঁকি মেরে দেখছিল না। পিঠের রাকস্যাকে পুরো মুখ গুঁজে ফেলেছে। অতএব যা দেখার শুধু আমিই দেখলাম।
প্রথমে বুঝতে পারিনি কী দেখছি। রাস্তাটার শেষে কয়েকটা গাছ দেখতে পেয়ে একটু বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম৷ ভুল পথে চলে এলাম নাকি?
কিন্তু না। ট্রেকিং-এর ট্রেইলটা তো এইদিকেই এসেছে৷ তা হলে? রাস্তা শেষ হয়ে গেল কী করে? আমরা কি প্রধান রাস্তার বদলে অন্য একটা ট্রেইল ধরে ফেলেছি? এই বনের মধ্যে হারিয়ে গেলাম নাকি। চিন্তায় মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল…
তখনই গাছের গুঁড়িগুলো নড়ে উঠল।
ঠিক যেন অনেকগুলো শীর্ণ প্রাগৈতিহাসিক পা। আমি উপরের দিকে তাকালাম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। কুয়াশায় সবকিছু মুছে গিয়েছে। কিন্তু নিচের “পা”গুলো উঠছে আর নামছে, উঠছে আর নামছে। দুই সেকেন্ডের মধ্যে সব কটা নিঃশব্দে বাম দিকের বনে ঢুকে পড়ল। খরখর মড়মড় কোনোরকম আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল না।
আমি সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মণি আমার পেছনে হোঁচট খেল।
“কী হল?”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। এক্ষুনি যা দেখলাম সেটা কি সত্যি? রগদুটো দপদপ করছে। জ্বরের ঘোরে ভুলভাল দেখিনি তো?
“ও গো! চুপ করে থেকো না প্লিজ। কী হল?”
গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “কিছু না। হাঁটতে থাকো। সামনে কেউ নেই।”
সত্যিই তো কেউ নেই। গাছগুলো সরে যাওয়ার পর ট্রেইলের আঁকাবাঁকা পথ আবার দেখা যাচ্ছে। ঠিক যেন একটা নেতিয়ে যাওয়া সাপ।
“নেই মানে?” মণি অবাক। সে এতক্ষণে উঁকি মেরে সামনে তাকাল।
“আমরা আসার আগেই লোকগুলো সরে গিয়েছে মনে হয়। অথবা…”
“অথবা কী?”
“কুয়াশার জন্য হয়তো আওয়াজটা ইকো হচ্ছিল। হয়তো আমাদের কাছে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছিলই না। অন্য জায়গার আওয়াজের প্রতিফলন হচ্ছিল। এইসব পাহাড়ি জায়গাতে অনেক সময় তা হয়ে থাকে বলে শুনেছি।”
“যাহ, কী যে বলো! ইকো হলে এত স্পষ্ট শুনতে পেতাম? একেবারে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার আওয়াজ আসছিল।”
“আমি কিন্তু কাউকে দেখিনি।”
মণি কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাস্তার দুইধারের গাছগুলো যেন আমাদের দিকে ঝুঁকে রয়েছে, নিঃশব্দে শুনছে আমাদের কথোপকথন। মণি বলল, “ঠিক আছে। চল হাঁটতে থাকি। ট্রেকিং-এর শখ আমার জন্মের মতো মিটে গিয়েছে।”
যেমন বলা, তেমন কাজ। এবারে দুইজনে প্রায় দৌড়ই লাগালাম। কিছুক্ষণ আগে মণির শরীরে ক্লান্তির ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম, এখন সেটা কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। আমার মাথা ভার হয়ে গিয়েছে। গায়ে কাঁপুনি শুরু হয়েছে। তাও দৌড়চ্ছি। প্রাণের ভয় সর্বসেরা টনিক।
পাঁচ মিনিট নির্দ্বিধায় কেটে গেল। কুয়াশাটাও একটু হালকা হয়েছে। দমবন্ধ করা নিস্তব্ধতা আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। বনের ফিসফাস আবার শুনতে পাচ্ছি। যেন কেউ জাদুকাঠি দিয়ে এই উপত্যকাতে আবার প্রাণসঞ্চার করছে।
এই বাঁকটা পেরোলেই বোধহয় পৌঁছে যাব।
ঠিক তখনই পেছন থেকে মড়মড় করে একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। বড় গাছের গুঁড়ি ভেঙে পড়লে যেইরকম আওয়াজ হয়, সেইরকম।
খেয়াল করলাম মণির চলার গতি স্খলিত হচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে হয়তো দেখতে চায় পেছনে কী হচ্ছে। আমি খপ করে ওর হাত ধরে বললাম, “হাঁটা থামিও না।”
আমার গলাটা বোধহয় কেঁপে উঠেছিল। অথবা আমার চোখেমুখে হয়তো আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট ছিল। কারণ মণি বিনাবাক্যব্যয়ে দৌড় লাগাল। আমিও পিছু নিলাম। ট্রেইলটা আগের মতো আর চড়াই-উতরাই করছে না, অতএব দৌড়তে বেগ পেতে হল না।
দৌড়তে দৌড়তে একটা অদম্য কৌতুহল আমাকে গ্রাস করল।
একবার পেছনে ফিরে দেখি, কেউ আদতে আমাদের অনুসরণ করেছে কিনা। শুধু একবার দেখি। হয়তো মিছিমিছি ভয় পেয়েছি। হয়তো সত্যিই কোন গাছ ভেঙে পড়েছে। হয়তো ওই চলন্ত ‘গাছ’গুলো আমার মনের ভুল ছিল। পেছন ফিরে শুধু ফাঁকা রাস্তা দেখতে পাব।
আমি দৌড়ানো না থামিয়ে ঘাড় ঘোরালাম।
গুঁড়ির মতো অনেকগুলো পা। ছায়াবৎ। নিঃশব্দে উঠছে আর নামছে। কুয়াশা একটু পাতলা হওয়ায় আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম। পা-গুলোকে গাছের কাণ্ডের মতো দেখতে না মোটেই। বরং পা গুলো রোমশ, যেন শীর্ণাকায় গুঁড়িগুলোতে কেউ অসংখ্য সুঁচ গেঁথে দিয়েছে।
পিছু নিয়েছে পা-গুলো। ভাঙাচোরা গতিতে এগিয়ে আসছে।
আমার মনে হল একবার যদি আমি মাথা তুলে উপরের দিকে তাকায় তো আমি যা দেখবো তা সহ্য করতে পারব না। বদ্ধ পাগল হয়ে যাব।
আমি সামনের দিকে তাকালাম। পথ তো শেষই হয় না! মণি হাঁপাচ্ছে। কপাল থেকে দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। আমিও ঘেমে গিয়েছি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
একটা তীক্ষ্ণ বাঁশির আওয়াজে বনটা থরথর করে কেঁপে উঠল। সেই আওয়াজে আমার শরীরের প্রতিটা স্নায়ু যেন জ্বলে উঠল।
“থেমে যেও না,” মণি আর্তনাদ করে বলল। “কিপ মুভিং, কিপ মুভিং!”
খেয়াল করলাম বাঁশির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আমার দৌড়নোর গতি কমে গিয়েছে। মাথায় একটা চিনচিনে যন্ত্রণা। তবু কেমন একটা নেশাতুর আরামে শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। মনে হল আমি বাংলোতে পৌঁছে গিয়েছি। ড্রয়িং রুমে বসে আছি। সামনে ফায়ারপ্লেসের আগুন, হাতে এনামেলের কাপে ধোঁয়া-ওঠা কফি…
দুম করে আমার হাতে কে যেন ঘুষি মারল। স্বপ্নালু ভাবটা বুদবুদের মতো ফেটে গেল।
“কী করছ, নীল?” মণি আমার পাশে দাঁড়িয়ে। “জাস্ট রান।”
মণির মুখটা পুরো সাদা হয়ে গিয়েছে, খালি নাকের ডগাটা লাল। ও বোধহয় এতক্ষণে দেখে ফেলেছে। সেই বিভীষিকাদের। সেই বাঁশিওয়ালাদের।
হাত ধরে মণি আমাকে প্রায় টেনেই নিয়ে গেল। বাঁশির আওয়াজটা এখন চারদিক থেকে শুনতে পাচ্ছি। যেন প্রতিটা গাছ, প্রতিটা পাতা সেই আওয়াজকে প্রতিধ্বনিত করছে। আমাদের মনকে ভেঙে দিতে চাইছে। দেখাতে চাইছে উষ্ণতার মিথ্যে স্বপ্ন।
তারপর হঠাৎ বাঁশির আওয়াজটা থেমে গেল। বনের দমবন্ধকারী পরিবেশটাও উবে গেল। পাখির ডাকে চারদিক মুখরিত। আবার হাওয়া বইছে, কীসের একটা গোপন কথা পাতাদের বলছে।
বুঝলাম আমরা অদৃশ্য কোন একটা গণ্ডি পেরিয়ে এসেছি। এখানে নিঃশব্দতা বারণ, এখানে দুঃস্বপ্নেরা আসে না। এখানে পাখিদের ডানা মুক্ত। আমি ভারাক্রান্ত মনে একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম।
পা-গুলো রাস্তার মাঝে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে, যেন তাদেরও শীত করছে। এরপর কী মনে হল, উপরের দিকে তাকালাম।
কুয়াশা আর প্রায় নেই।
আমি বুঝলাম আমার একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। কোনো গাছের দল আমাদের পিছু নেয়নি।
বাঁশিওয়ালা একজনই ছিল।
আর এক মিনিট পরেই ট্রেইল শেষ হয়ে গেল। বার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারির ছোট্ট বাংলোটা আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
২
নাম ‘গুরাস বাংলো’। কিন্তু দেখেশুনে বাংলো কম, হোম-স্টে বেশি মনে হল। কেয়ারটেকার একজন বুড়ি। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনও চটপটে। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা।
আমাদের চোখমুখ দেখেই বুড়ি বুঝে গিয়েছিল কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কোনোরকম প্রশ্ন করল না। হাঁকডাক করে একটা কর্মচারীকে ডাকল। সেই কর্মচারী আমাদের পিঠ থেকে রাকস্যাক দুটো নিয়ে চলে গেল, আমাদের ঘরে গিয়ে রেখে আসবে।
কেয়ারটেকার আমাদের ড্রয়িং রুমে আদর করে বসাল। তারপর দুইজনের হাতে এক পেগ রাম ধরিয়ে বলল, “দিখ কে লাগতা হ্যাই আপ লোগো কো ইয়ে জরুরত হ্যায়।”
আমরাও চুমুক দিতে শুরু করলাম। গায়ের ঘাম শুকিয়ে ঠান্ডাটা যেন আরো জোরে চেপে ধরেছিল। পেটে রাম পড়তেই সেটাকে কাবু করতে পারলাম। সামনের ফায়ারপ্লেসের উত্তাপ মুখে পড়ছে। ভালো লাগছে।
কেয়ারটেকার এখনও আমাদের কিছু জিজ্ঞেস করল না। রাম শেষ করে আমি প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের জেরক্স ওর হাতে ধরিয়ে খাতায় সই করে দিলাম৷ মণির একজন কাকুর দৌলতে পুরো বাংলোটাই আমাদের নামে বুক করা। সব থেকে লোভনীয় ডাবল বেডের রুমটায় আমরা থাকব। কাকুর মতে কাল ভোরবেলা উঠলেই ওই রুম থেকে আশপাশের বন আর দূরের পর্বতমালার অসাধারণ ভিউ দেখা যাবে। তার সঙ্গে প্রচুর পাখিও রয়েছে এই স্যাংচুয়ারিতে। আশপাশে ঘুরলেই চোখে পড়বে। তাই মণি ওর দামী ক্যামেরাটা অনেক যত্নের সঙ্গে এতটা পথ বয়ে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু এই মুহূর্তে, একটা বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সবকিছুই কেমন অপ্রয়োজনীয় ও হাস্যকর মনে হচ্ছিল। মণি এখনও পাথরের মতো বসে আছে, চোখদুটো ঘোলাটে। আমি পাশে বসে ওর হাতটা চেপে ধরলাম।
“ঠিক আছ?”
মণি আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “হোয়াট দ্য হেল ওয়াজ দ্যাট?”
আমি উত্তর দিলাম না। কিছুক্ষণ শূন্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম, “সত্যি জানি না। বুঝতে পারছি না ঠিক…”
কথা শেষ করতে পারলাম না।
“নীল, তুমিও ওটাকে দেখেছিলে, রাইট?”
“হুমম।”
“কী ‘হুমম’? হাউ আর ইউ নট মোর ফ্রিকড আউট?”
আমি চোখ বুজে একটা জোরে নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপর বললাম, “দ্যাখো। আমরা দুইজনেই কিছু একটা অস্বাভাবিক দেখেছি, তাই তো? কিন্তু ব্যাপারটা একটু যুক্তি দিয়ে ভাবো। তখন চারিদিক কুয়াশাতে ঢাকা ছিল। দুইজনেই অলরেডি খুব ভয় পেয়েছিলাম। মানসিক চাপের জন্য হয়তো… হয়তো চোখের ভুল হয়েছে। আমরা হয়তো যা দেখতে চেয়েছি তাই দেখেছি?”
তারপর একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ঠিক কী দেখেছ?”
মণি উত্তর দিল না। এক চুমুকে বাকি রামটুকু শেষ করে কেয়ারটেকারকে খালি গ্লাসটা ইঙ্গিত করে দেখাল।
“আর কত খাবে?” আমি মৃদু আপত্তি জানালাম। “খালি পেটে এতটা খাওয়া ঠিক হবে না।”
“নীল, জাস্ট, শাট দ্য ফাক আপ।”
বুড়ি কেয়ারটেকার নাক দিয়ে একটা ঘোৎ আওয়াজ করে আমার বউয়ের সঙ্গে সহমত হল। দুই গ্লাসেই আরেক পেগ ঢালা হল। আমি “না, না, আমি খাব না” বলেও খেয়ে নিলাম। মণি অল্প ধাতস্থ হয়ে আমার কপালে হাত রেখে বলল, “তোমার গা কিন্তু বেশ গরম। প্যারাসিটামল খাবে?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “স্ট্রেসের জন্য বোধহয়।” শরীরটা সত্যি ম্যাজমেজে লাগছে। রাম খেয়ে চাঙ্গা হতে পেরেছি, কিন্তু অসুস্থতার ভাবটা কাটেনি। আমার মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগের অনুভুতিটা, যখন আমার শরীর অবশ হয়ে এসেছিল। মনে হয়েছিল একটা ড্রয়িং রুমে বসে আছি। অনেকটা এইরকম দেখতে। ফায়ারপ্লেসটাও একইরকম। শুধু হাতে কাচের গ্লাসের বদলে কফির কাপ ধরেছিলাম।
কেয়ারটেকার হিন্দিতে বলল, “আপনারা নিজের ঘরে চলে যান। গিজার আছে, গরম জলে চান করে নিন। ফ্রেশ হয়ে নিচের ডাইনিং রুমে চলে আসবেন। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
একবার ভাবলাম আমাদের অভিজ্ঞতার কথা একে বলে দেখি। স্থানীয় লোক, কিছু জানলেও জানতে পারে। তারপর সেই চিন্তা বাতিল করে মণির পিছুপিছু উপরে চলে এলাম।
ডাবল-বেডের রুমটা বেশ বড়। টিভিও রয়েছে। জানালাগুলো বিশাল, এখন পর্দা দিয়ে ঢাকা। জানালার পাশে চেয়ার টেবিল। ডাবল বেডটা মখমলের মতো। দেওয়ালে শৌখিন পেন্টিং-এর ফ্রেমবন্দি প্রিন্ট। হঠাৎ দেখে মনে হবে ঘরটা বিলাতি হোটেলের।
আমি ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসলাম। সারা শরীর ভার হয়ে আসছে। আজ বিকালে এদিক ওদিক ঘুরে দেখার কথা ছিল, তবে মনে হয় না সেটা আর হবে। মণি এখন বাথরুমে ঢুকেছে। ও বেরোলে দুইজনে নীচে খেতে যাব। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম সেটা মনে নেই।
ঘুম সেইদিন আর পুরোপুরি ভাঙল না। গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। সারাক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। একবার মনে হল মণি আমাকে উঠিয়ে পরম যত্নে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিচ্ছে। একটা গ্লাস ধরিয়ে বলছে, “টুক করে গিলে নাও।”
আরেকবার মনে হল আমার জন্য কিছুটা স্যুপ বা ব্রথ জাতীয় কিছু নিয়ে আসা হয়েছে। আমি এক দুই চামচ খেয়ে আর খেতে পারিনি। জ্বরের মুখে সব বিস্বাদ ঠেকছিল।
শেষবার যখন হুঁশ ফিরল তখন সন্ধ্যেবেলা। ঘরে কারা যেন হিন্দিতে কথা বলাবলি করছে। খেয়াল করলাম প্যারাসিটামলের দয়ায় আমার সারা শরীর ঘামে ভেজা। কিন্তু আমি উঠে বসলাম না। চুপচাপ শুয়ে থেকে ওদের কথা শুনতে থাকলাম।
“পাশের গ্রামেই ডাক্তার বক্সী থাকেন। আসতে আধঘণ্টা লাগবে। আপনি বললেই ডেকে দিচ্ছি।”
“না। এখন ও অনেকটাই স্টেডি হয়েছে। আজ রাতটা দেখে নিই।”
“সেটাই ঠিক আছে। আমি বললে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু অনেক টুরিস্টই এই ট্রেইল ধরে হাঁটতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যায়।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। প্রধান কারণ হল ট্রেকিং-এর জন্য অপ্রস্তুত হয়ে আসা। গামবুট না পরার দরুন অনেকেরই জুতো ভিজে যায়। অন্যদিকে ঠিকঠাক শীতের জামা কাপড় না পরে এতদূর হেঁটে এলে ঠান্ডাটা শরীরে বসে যায়।”
“ট্রেইলের শুরুতে ফুটহিলে একটা চেকপোস্ট ছিল দেখলাম। সেখান থেকে তো গামবুট বা উলজাতীয় কাপড় ভাড়া দিতে পারেন।”
“ঠিক বলেছেন। আমি এই কথাটাই ওদের বলেছিলাম। কিন্তু এই বুড়ির কথা ওরা শুনবে কেন? বরং চেকপোস্টটায় ওরা কী বিক্রি করতে শুরু করল জানেন?”
“হ্যাঁ দেখলাম। লোকাল ফ্রুট ওয়াইন… আমি কিন্তু এক বোতল কিনেছি।”
“হেঁ হেঁ। ভালো করেছেন। ওয়াইন বিক্রিতে আমার কোন আপত্তি নেই। তার সঙ্গে যদি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোও দেওয়া হত, তো ভালো হত।”
“ঠিক।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ৷ তারপর মণির গলা।
“আসলে আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।”
“হুম।”
“মানে আজ এখানে আসার আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল। তবে এখনও বুঝতে পারছি না ঠিক কীভাবে ব্যাপারটা আপনাকে বলি।”
“আপনি নিশ্চিন্তে আমাকে বলুন।”
“ঘটনাটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। নীল তো বলল চোখের ভুলও হতে পারে…”
“দিদি, শোনেন। আমি এই এলাকায় সারাজীবন কাটিয়েছি। শহর থেকে দূরে, তথাকথিত সভ্যতা থেকে দূরে আমার দিন কাটে। আমার আশি বছরের জীবনে অনেক কিছুই দেখেছি আর শুনেছি, যা অন্যদের কাছে অস্বাভাবিক লাগবে, বুজরুকিও মনে হতে পারে। আপনারা যখন আজকে ওইভাবে বাংলোয় ঢুকলেন তখনই বুঝেছিলাম কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু তখন আপনাদের এতটাই বিহ্বল লাগছিল যে, কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাইনি। হয়তো কী হয়েছে তা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি, তবে আপনি সব কিছু খুলে বললে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। হয়তো এই বুড়ি আপনাদের কিছুটা সাহায্যও করতে পারবে।”
ঘরে নিঃশব্দতা নেমে এল। আমার আবার নিজেকে ঘোরগ্রস্ত মনে হচ্ছে। এক পলকের জন্য মনে হল আমি অন্ধকার একটা বনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। পিঠে ব্যাগ। হাতে মশাল। আলোর গণ্ডির ঠিক বাইরে লম্বা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার অজস্র চোখগুলো তারার মতো চকচক করছে। ছোটোখাটো একটা ব্রহ্মাণ্ড। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সেই তারাদের মাঝের মহাশূন্যতায় আমি হারিয়ে যাব।
হঠাৎ মণির গলা শুনতে পেলাম। প্রথমে খুব ক্ষীণ, যেন গুহার একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অন্যপ্রান্তের কথা শুনতে পাচ্ছি। তারপর গলার জোর বাড়তে লাগল, ঠিক যেন কেউ একটা রেডিয়োর ভলিউম বাড়িয়ে দিচ্ছে। চোখের সামনে অন্ধকার বনটা কেমন দুমড়েমুচড়ে গেল। আর আমিও শূন্যতার মধ্যে সাঁতার কেটে নিজের বিছানায় ফেরত এলাম।
মণি সকালের ঘটনাটা কেয়ারটেকার কে বলছে। বাংলোর এই নিরাপদ গণ্ডির মধ্যে বসেও ওর গলা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। শেষে বাঁশিওয়ালার বিবরণ দিতে গিয়ে সে হোঁচট খেল।
“সত্যি বলতে ওটা জন্তু ছিল না অন্য কিছু, সেটাই বুঝতে পারছি না। হয়তো জন্তু জানোয়ার গণ্য করাটাই ভুল হয়ে যাচ্ছে। হয়তো ওটা এমন কিছু যা আমাদের প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার বাইরে অবস্থিত। একটা অ্যানোমালি।”
বুড়ি চুপ করে রইল। তারপর, “আরেকটু কফি খান।”
ফ্লাস্ক খোলার আওয়াজ। তারপর কফি ঢালার। আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমার আর নড়াচড়া করতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ মনে হল আমি একটা মৃতদেহের মতো পড়ে আছি। পড়ে থাকব। আর কোনোদিন উঠতে পারব না।
বুড়ির গলায় চিন্তার সুতো ছিড়ে গেল।
“সত্যি করে বলুন। আপনার কি মনে হয় আজকে যা দেখলেন সেটা চোখের ভুল ছিল?”
“না৷ যদি সারাক্ষণ কুয়াশার জোর থাকত, তাহলে হয়তো বলতাম চোখের ভুল। কিন্তু শেষের দিকে চারপাশটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। তা ছাড়া নীলও ওটাকে দেখতে পেয়েছে। আমার আগেই দেখেছে। আমি যাতে ভয় না পাই, তাই ব্যাপারটা প্রথমে লুকানোর চেষ্টা করছিল।”
“হুমম। বুঝলাম।”
কেউ একজন কফিতে চুমুক দিল।
“এইসব এলাকায় এখনও পোচিং হয় জানেন,” বুড়ি আবার বলতে শুরু করল। “সরকার আসে, সরকার যায়, কিন্তু পোচারদের উপদ্রব কমে না। এই কয়েক মাস আগেই কয়েকজন সিকিমের অধিবাসী আপনাদের পশ্চিমবঙ্গে ধরা পড়ল। এক কিলো ওজনের হাতির দাঁত নিয়ে বিক্রি করতে যাচ্ছিল। ধরা পড়া দলটার মধ্যে একজন নিজেই আই আর বি-এর সদস্য। রক্ষক নিজেই ভক্ষক হয়ে গেলে আমরা আর কী করব, বলুন! তাই দেদার পশু মরছে। হাতি, গণ্ডার, চিতা – সবার জবাই হচ্ছে। তারপর তাদের শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। পাড়ার ছিঁচকে মস্তান থেকে লোকাল নেতা, সবাই আঙুল ডুবিয়ে রেখেছে। মানুষ কত নৃশংস, তাই না? প্রকৃতির মাঝে থেকে, প্রকৃতিকে সম্মান দিলেই, থাকা পরার অভাব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু লোভ যে লেলিহান আগুনের মতো। যত খাবে, তত বাড়বে।”
বুড়ি উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। এখন দম নেওয়ার জন্য একটু চুপ করল। কোথাও একটা পাখি ডাকছে। সেটা কান্নার মতো শোনাচ্ছে।
“এত কথা বলার কারণ হল এই কয়েক মাস ধরে আশপাশের এলাকা জুড়ে অদ্ভুত কয়েকটা ঘটনা ঘটছে। প্রথম ঘটনাটা ঘটে আড়াই মাস আগে। সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কে কয়েকজন পোচার ঢুকেছিল। জায়গাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, জানেন তো? কিছু রেড পান্ডা ওখানে এখনও দেখতে পাওয়া যায়। তবে, পোচারগুলো পান্ডা মারতেই এসেছিল কিনা সেটা আর জানা যায় নি৷ বরং কিছুদিন পর ওদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। পুরো ছিন্নভিন্ন অবস্থায়। কিন্তু সেই বিভৎসতার মধ্যেও একটা প্যাটার্ন ছিল। কে বা কারা ওদের চামড়াগুলো নিপুণতার সঙ্গে ছাড়িয়ে নিয়েছে, তারপর সেগুলোকে গাছের শাখাপ্রশাখায় শামিয়ানার মতো বিছিয়ে দিয়েছে। সবার দাঁতগুলো উপড়ে ফেলে সারিসারি করে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। আর বেশি বলব না, কিন্তু হত্যাকারীরা কী বোঝাতে চাইছে বুঝতে পারছেন তো?”
“হ্যাঁ।” মণির গলায় আতঙ্কের ছাপ।
“এরপর আরো কয়েকটা খুন হয়েছে। প্রায় প্রতিবারই ভিক্টিম পোচারের দল ছিল। প্রতিবারই সেই নিপুণভাবে তাদের দেহগুলোকে কেটে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। সেই একই ছাল ছাড়িয়ে রাখা, দাঁত মাটিতে পোতা, মেজর অরগানগুলো বিভিন্ন স্তূপে জমিয়ে রাখা, ইত্যাদি। সবার দেহ একইভাবে বিকৃত করা। বনকর্মী, পুলিশ, আই আর বি, কেউ কোন কূল-কিনারা করতে পারেনি। এলোপাথাড়ি কাটাছেঁড়া হলে কোনো বন্য প্রাণীর ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে এরা শান্তিতে ঘুমাতে পারত। কিন্তু ওই যে, একটা প্যাটার্ন রয়েছে। সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হল এত এত মাংস পড়ে থাকা সত্যেও কোন বন্যপ্রাণী সেইসব মৃতদেহে ভাগ বসায়নি। বরং এলাকাটা এড়িয়ে গেছে। অবশেষে এখন ধরে নেওয়া হচ্ছে এগুলো কয়েকজন মানুষের কাজ। নতুন কোনো ইকো-টেরোরিস্টের দল।”
“আপনার তা মনে হয় না?”
“আমার মনে হয় এতদিন মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে যা পাপ করেছে, তার শাস্তি দিতে কিছু একটা জেগে উঠেছে। জানি, কথাটা আজগুবি লাগল। কিন্তু এককালে এইসব এলাকায় পাপের ছায়া প্রায় ছিলই না। তখন এই উপত্যকায় মানুষ ছিল গুটিকয়েক। সেইসব যুগে এইন বনজঙ্গলে রাজত্ব ছিল অন্য কারুর। তাদের দেবতা বলতে পারি না, আবার সাধারণ কোনো জীবও বলতে পারি না। তখন মানুষেরা তাদের সমীহ করতে জানত। প্রকৃতিকে মা হিসাবে দেখত। যা কিছু নিত, তা শুধু প্রয়োজনের খাতিরে। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকায় সভ্যতার রেশ লাগল। মানুষগুলো ধীরে ধীরে বদলে গেল। ভুলে গেল প্রকৃতিকে, ভুলে গেল সেই অতিপ্রাকৃত শাসকদের। এখন জঙ্গল কেটে সাফ হয়েছে, শয়ে শয়ে মানুষ এসেছে, পাহাড়ের গা ক্ষতবিক্ষত করে শহর গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেই সব আদিম অধীশ্বরেরা ঠিক থেকে গিয়েছে। হয়তো এতদিন আমাদের সময়ের গণ্ডির বাইরে কোথাও ঘুমাচ্ছিল। এখন এই অরণ্যের হাহাকার শুনে আবার জেগে উঠেছে।”
রাত হয়ে এসেছে। আমি ঝিঁঝিঁর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
“আপনার মতে এরা আমাদের তাড়া করেছিল?” মণির জিজ্ঞাসা।
“হতে পারে। আবার এটাও হতে পারে দুটো ঘটনার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু দুটো অতিপ্রাকৃত অস্বাভাবিক ঘটনা পাশাপাশি হলে তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে ধরে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
“আমাদের মারার চেষ্টা কেন করল? আমরা তো পোচার নই!”
“আপনাদের বোধহয় মারার চেষ্টা করেনি। একটু ভেবে দেখুন। আগ্নেয়াস্ত্রধারী পোচারদের এরা অনায়াসে মেরে ফেলেছে, অতএব সাধারণ মানুষদের মারতে এদের বেশি বেগ পাওয়ার কথা নয়। আপনার কথা শুনে যা মনে হল, ওরা আপনাদের এমনি ভয় দেখাতে চেয়েছে। তবে নিশ্চিত হয়ে আমি কিছু বলতে পারি না, দিদি। ওই যে অদ্ভুত খুনগুলোর কথা বললাম, শেগুলোর মধ্যে একটা-দুটো ভিক্টিম সাধারণ স্থানীয় মানুষ ছিল, তাদের পোচারদের সঙ্গে কোনো কানেকশন নেই। তবুও তাদের মরতে হয়েছে, সেই একই রকম নৃশংস ভাবে। আপনি ঠিকই বলেছেন, এরা প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার বাইরের কিছু। এদেরকে আমাদের লজিক দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।”
আবার সবকিছু চুপ। এইবার পাখি বা ঝিঁঝি, কোনোটারই ডাক শুনতে পেলাম না। শুধু শূন্যতা।
“আপনাদের বাংলো আসার কিছুটা আগেই ওটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আর এগোয়নি,” মণি বলল
“হুম। কারণ আছে। কাল বলব।”
“আমার ঠিক এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটা দুঃস্বপ্নের মতো ঠেকছে।”
“যুক্তির খাঁচায় আমরা খুব আরামে থাকি, বুঝলেন। খাঁচার মধ্যে সব কিছু আমাদের চেনা আর জানা। সব কিছুর নিয়ম বাঁধা। একটুও এদিকওদিক হওয়ার জো নেই। এখন হঠাৎ সেই খাঁচার চাবি আপনার হাতে চলে এসেছে। খাঁচা খুলে বাইরে পা রাখতে ভয় তো লাগবেই। বাইরের জগতের নিয়মকানুন যে আলাদা। হয়তো মানুষের বোধগম্যের বাইরে।”
ঠুং ঠাং করে আওয়াজ হচ্ছে। কেয়ারটেকার কফির কাপ ইত্যাদি তুলে বোধহয় চলে যাচ্ছে।
দরজার কাছে গিয়ে বলল, “আপনারা চিন্তা করবেন না। কাল আপনাদের সঙ্গে সর্বক্ষণ একজন গাইড থাকবে। আমিও আপনাদের সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করে দেব। বিশ্বাস-অবিশ্বাস পরের কথা৷ কিন্তু এখানে যতক্ষণ আছেন, আমার সুরক্ষার কবচ খানা পরে থাকবেন। কিছু লাভ বই ক্ষতি হবে না। আজ আপাতত বিশ্রাম নিন। বাংলো ছেড়ে কোথাও যাবেন না।”
এরপর খট করে আওয়াজ হল। দরজা বন্ধ করে বুড়ি চলে গিয়েছে।
৩
সেইদিন রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম।
আমাদের রুমের জানালাগুলোর সামনে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। পর্দা সরানো রয়েছে। আকাশে লাল রঙের চাঁদ উঠেছে। বনের মধ্যে সেই রক্তমাখা আলো আর অন্ধকার মিলেমিশে একাকার। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে খেয়াল হল আমি পুরো উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কিন্তু ঠান্ডা লাগছে না মোটেই। বরং সারা গা ঘামে ভেজা। কপাল থেকে ঘামের অজস্র বিন্দু গড়িয়ে গড়িয়ে চোখেমুখে পড়ছে।
হঠাৎ পুরো বনটা কেঁপে উঠল। নাকি বাড়িটাই কাঁপল? বুঝতে পারলাম না। গাছগুলো এইবার বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। সরসর করে আওয়াজ হচ্ছে। যেন ঝড় উঠেছে। আকাশের রক্তমাখা চাঁদটাতে কার যেন মুখ আঁকা।
আমি ভাবলাম গাছগুলো হয়তো জানালার নীচে এসে দাঁড়াবে। রিনরিনে গলায় আমার নাম ধরে ডাকবে। কিন্তু তার বদলে সেগুলো জানালার দুইদিকে সরে গিয়ে আমার দৃষ্টিরেখার বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রথমে একটা দুটো করে। তারপর, গন্ডায় গন্ডায়। শেষে, শয়ে শয়ে। গাছগুলো বাড়ি পার হয়ে চলে যাচ্ছে, নাকি বাড়িটাই এগোচ্ছে? মনে হল বাড়িটার চারপাশে একটা অদৃশ্য বুদবুদ। সেই বুদবুদের জন্য গাছগুলো ওইভাবে সরে সরে যাচ্ছে, কাছে এসে জানালার কাচে আঁচড় দিতে পারছে না।
শূন্যতা। বন পেরিয়ে চলে এসেছি। সামনে শুধু ধূসর উপত্যকা। যতদূর চোখ যায়, খালি ফাঁটল ধরা মাটি। দূরে, বহু দূরে, যেখানে দিগন্তরেখা থাকার কথা, সেখানে ধারালো দাঁতের মতো অসংখ্য পর্বত পৃথিবী ফুঁড়ে উঠে রয়েছে৷
তবে সেইদিকে আমি তাকাচ্ছি না। তাকাচ্ছি বাঁশিওয়ালার দিকে। নেড়া উপত্যকাটার ঠিক মাঝখানে বাঁশিওয়ালা দাঁড়িয়ে। তার কাঁধ থেকে চাঁদের বাতুল হাসি উঁকি মারছে।
সেই হাসিকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমার মুখেও দাঁতাল হাসি। বাড়িটা এগিয়েই চলেছে। আমি বাঁশিওয়ালার পা-গুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আটখানা রোমশ পা। গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে। সেগুলোর উপরে বাঁশিওয়ালার নধরকান্তি দেহ, যেন রক্তভরা একটা বেলুন। সেই দেহের একদম আগায় গলে যাওয়া অন্ধকারের মতো একটা মাথা।
বাড়িটা ভাসতে ভাসতে সেই মাথাটার দিকেই উঠছে। বাইরে হুহু করে বাতাস বইছে, সেটার আওয়াজ আমি শুনতে পাচ্ছি।
বাঁশির আওয়াজ কই?
কী বিভৎস এই শূন্যতা! কী বিপুল এই একাকীত্ব! কী বিদীর্ণ এই উপত্যকা! কত যুগ ধরে এই মৃত্যুপ্রান্তরে সে ঘুরে বেরিয়েছে! রক্তাক্ত চাঁদের দিকে তাকিয়ে বাঁশি বাজিয়েছে।
কিন্তু সেই যুগ এখন শেষ। আবার ডাক এসেছে। যুদ্ধের ডাক এসেছে। সেই হারিয়ে যাওয়া যুগের দিনগুলো আবার ফেরৎ আসবে। আরেকবার মর্ত্যলোকে স্বাধীন হয়ে সে ঘুরবে। আবার নিজের রাজত্ব ফিরে পাবে। ইতিমধ্যেই কয়েকটা পাপীকে সাজা দিয়েছে। কিন্তু, সেটা যথেষ্ট নয়। আরো বলি চায় ওর। আরো যন্ত্রণা দিতে চায়। শুধু একটা ছোট্ট বাঁধা পার করতে হবে।
এখন জানালা জুড়ে বাঁশিওয়ালার মুখ। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রয়েছি, যেন চোখ সরানোর ক্ষমতা কে কেড়ে নিয়েছে। চাঁদের আলোয় ওর অসংখ্য চোখগুলো সুপারনোভার মতো জ্বলজ্বলে। চোখগুলোর আশপাশে ফুটো ফুটো হয়ে রয়েছে, যেন একেকটা ব্ল্যাকহোল। এইবার সেগুলো থেকেই বাঁশির সুর নিঃসৃত হচ্ছে। পাঁচখানা আলাদা আলাদা সুর। মিলেমিশে গিয়ে আমার শরীরটা অবশ করে দিচ্ছে।
মাথা জুড়ে থাকা সেই ফুটোগুলো মাঝে মাঝে বুজছে, আবার খুলছে। সেগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুরগুলোর মাত্রা উঠছে আর নামছে।
মাথার চিনচিনে যন্ত্রণাটা ফেরৎ এসেছে। সেই আগের মতোই আমার শরীরটা হালকা লাগছে। ঘুড়ির মতো হালকা। এইবার পতপত আওয়াজ করে উড়ে যাব। বাঁশিওয়ালাকে ছেড়ে, উপত্যকাকে ছেড়ে চাঁদের অভিমুখে যাত্রা করব…
বাঁশির আওয়াজটা হঠাৎই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। একেক সময় মাত্রাটা যখন উঠছে, তখন মনে হচ্ছে কানে কেউ যেন গরম শিশ ঢালছে, ভেতরে ঢুকে গিয়ে মাথায় কামড় বসাচ্ছে। ওইরকম একটা যন্ত্রণার মুহূর্তে কী যে একটা হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। একটা আমি থেকে পাঁচটা আমরা হয়ে গেলাম। সবাই আমরা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। উলঙ্গ। ঠিক যেমন জন্মকালে ছিলাম।
আমরা এক কিন্তু তবু আলাদা।
প্রথম আমি-এর চোখে জল। সকালে আজ মণি মারা গিয়েছে। দৌড়তে গিয়ে পা হড়কে খাদে পড়ে গিয়েছে।
দ্বিতীয় আমি ইতিমধ্যেই বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু জানালা সে খুলবে না, জানালা সে খুলবে না, জানালা সে খুলবে না, না, না, না…
তৃতীয় আমি-এর বাম হাতটা ভাঙা। সে চোয়াল শক্ত করে বাঁশিওয়ালাকে দেখছে।
চতুর্থ আমি চোখ বুজে রয়েছে। হাত জোর করে প্রণামের ভঙ্গিতে কী একটা বিড়বিড় করে বলছে।
পঞ্চম আমি-এর গায়ে জ্বর। তার মুখে হাসি।
বাঁশিওয়ালা সবাইকে বলছে জানালাটা খুলতে। পুরোপুরি খুলতে হবে না। শুধু ছিটকিনি তুলে দিলেই হবে। শুধু একবার, শুধু একবার…
তীব্র বাঁশির আওয়াজে আমাদের চিন্তাশক্তি লোপ পাচ্ছে। খালি মন জুড়ে একটা ইচ্ছেই প্রতিফলিত হতে থাকছে। জানালাটা যেন খুলে দিই। জানালাটা যেন খুলে দিই। জানালাটা যেন খুলে দিই।
পঞ্চম আমি কাঁপা কাঁপা হাতে জানালার খিলের দিকে হাত বাড়াচ্ছিলাম। তখনই ভেতর থেকে, একদম ভেতর থেকে, কে একজন চিৎকার করে উঠল, “না! না! খুলবে না! একদম খুলবে না! মরে গেলেও খুলবে না!” আমার অন্তরাত্মার এই উন্মত্ত আর্তনাদে হাতটা আর এগোতে পারছে না। জানালা বন্ধ।
ততক্ষণে বাঁশিওয়ালার মুখ একেবারে জানালার কাচের সঙ্গে লেপটে গিয়েছে। এই মহাবিশ্বের থেকেও আদিম চোখগুলো দিয়ে সে আমাকে দেখছে। এইবার আর অনুরোধ না, রীতিমতো আদেশ দিচ্ছে। ওর ক্রুদ্ধ সুর আছড়ে পড়ছে আমার মনের তটে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছি।
খোল!
খোল!
ঢুকতে দে আমাকে!
ঢুকতে দে!
আমি আর দাঁড়াতে না পেরে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পরলাম। উফফ! কী যন্ত্রণা! শরীরের প্রতিটা অঙ্গ, প্রতিটা স্নায়ু, প্রতিটা কোশ জ্বলে পুড়ে খাক যাচ্ছে। আজ আর বাঁচব না। আমার শরীরটা এইবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। সকালবেলায় মণি আমার চামড়া ছাড়ানো রক্তাক্ত দেহটা খুঁজে পাবে…
“নীল, নীল! কী হয়েছে? নীল! “
সেই সন্ধেতে দেখা বনটার মতো এই নেড়া উপত্যকাটা দুমড়ে মুচড়ে গেল, যেন সস্তা কাগজে আঁকা একটা পেইন্টিংকে কেউ দলা পাকিয়ে দিচ্ছে। তারপর শুধু অন্ধকার। শান্তির অন্ধকার। অমানিশার সেই মহাশূন্যে সাঁতার কেটে আমি বিছানায় এসে পড়লাম। চোখ খুলতেই মণির শুকনো মুখ দেখতে পেলাম। চারদিক রডলাইটের আলোতে ভেসে যাচ্ছে।
মণি আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে। মুখে উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট।
“এই এই, উঠেছ? কিছু হয়নি তোমার, কিছু হয়নি।”
“উঠে গিয়েছি। আমি উঠে গিয়েছি।” আমি জড়ানো গলায় বললাম।
“উফফ কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম” মণি আমাকে আঁকড়ে ধরে বলল। “হঠাৎ গোঙাতে শুরু করলে। তারপর শেষের দিকে ইউ ওয়ের স্ক্রিমিং, নীল। পুরো পাগলের মতো আর্তনাদ করছিলে। আমি তো আরেকটু হলেই কেয়ারটেকারকে ফোন লাগাচ্ছিলাম।”
একটু ঝিম মেরে বসে থেকে বললাম, “আমি ঠিক আছি এখন। ঠিক আছি। ওই জাস্ট… একটা বাজে স্বপ্ন।”
মণি কী একটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিল। তারপর, “জল খাবে?”
“দাও তো। গলাটা শুকিয়ে গেছে।”
মণি একটা ফ্লাস্ক থেকে গরম জল ঢেলে, সেটার সঙ্গে জগে রাখা ঠান্ডা জল মেশাতে লাগল। আমি সেই সুযোগে জানালার দিকে একবার তাকালাম। সেটা এখনও পর্দা দিয়ে ঢাকা।
আচ্ছা, পর্দা সরালে কী দেখতে পাব আমি? সেই বাঁশিওয়ালাকে? সেই নির্জীব উপত্যকাকে? আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভাবলাম, উত্তরটা জেনে আমার আর কাজ নেই।
আমাকে জল খাইয়ে মণি আলো নিভিয়ে দিল। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। আমার ঘুম আসতে একটু দেরি হল। মণির বুকে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ শুয়ে রইলাম। আমার কেন জানি কান্না পাচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আমার এই একগুঁয়ে পাগলাটে বউটা আর বেঁচে নেই। তাই বুকে কান পেতে বারবার ওর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি শোনার চেষ্টা করতে থাকলাম।
ঘুম যে কখন আমাকে বিস্মৃতির সমুদ্রে টেনে নিয়ে গেল, তা আর মনে নেই।
৪
পরের দিনটা কাটল ভালোই।
সকালে উঠে খেয়াল করলাম জ্বর আর নেই। শুধু শরীর অল্প দুর্বল।
মণি ইতিমধ্যেই ফ্রেস হয়ে জানালার সামনে বসে। হাতে একটা এনামেল কাপ। আজ কুয়াশা নেই, তাই স্যাংচুয়ারি তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য মেলে ধরেছে আমাদের সামনে। সবুজের মাঝে লালচে ছোপ। রডোডেনড্রন। স্থানীয় ভাষায় তার নাম ‘গুরাস’। সূর্যের সোনালী আলো পাতায় পাতায় হুটোপুটি খাচ্ছে। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।
আজ এই আদুরে রোদে মাখা উপত্যকা দেখে মনে হল গতকাল যা কিছু ঘটেছে তা সব মিথ্যে দুঃস্বপ্ন ছিল। বনের মধ্যে কী না কী দেখে হয়তো আমরা বেকার ভয় পেয়েছিলাম। হয়তো…
তারপরেই গতরাত্রের কথা মনে পড়ল। সেই সত্যিকারের দুঃস্বপ্নটা। আমি শিউরে উঠলাম।
“ঘুম ভাঙল তোমার?” মণির মৃদু জিজ্ঞাসা।
“হুমম।”
“ভোরের দিকে বেরিয়েছিলাম, বুঝলে। আশপাশে ঘুরলাম। ছবি তুললাম। কতরকমের পাখি আসে গো এখানে! না দেখলে বিশ্বাস করবে না। লাফিং-থ্রাস দেখলাম, আর গোল্ডেন রবিন। এই দ্যাখো, এই প্যাঁচাটার নাম ব্রাউন-উড আউল।”
মণি ক্যামেরা হাতে বকেই চলেছে। আমি শুনতে শুনতে ওর উলটোদিকের চেয়ারে বসলাম। টেবিলে রাখা ফ্লাস্ক থেকে একটা কাপে কফি ঢেলে নিলাম। চুমুক দিতে যাওয়ার আগেই মণি ‘রে রে’ করে উঠল।
“বাসি মুখে কফি খাচ্ছ যে বড়। মুখ ধুয়ে আস।”
“মণি। এই পাহাড়ে এসে একদিন সাহেবিয়ানা করতে দাও। দেখিই না কেমন লাগে।”
“যত্তসব আনহেলথি প্র্যাক্টিস,” গজগজ করে বলল আমার বউ। কিন্তু বাধা দিল না।
আমি পরম তৃপ্তির সঙ্গে কফিতে চুমুক দিলাম। মিষ্টতার পরিমাণ একদম পার্ফেক্ট। আবার বেশি তেতোও নয়। বউয়ের বকবক শুনতে শুনতে কফি খাওয়ার সময় আমার মনে হল পৃথিবীটা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কালকের অস্বাভাবিক যা কিছু হয়েছে, তার নিশ্চয় কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। এমন কী রাতের ওই বিভীষিকাময়ী স্বপ্নটাও হয়তো জ্বরে বিকারগ্রস্থ থাকার জন্যেই দেখেছি।
এইসব যখন ভাবছি, তখন টেবিলের উপর রাখা কয়েকটা অদ্ভুত জিনিসের উপর নজর গেল। প্রথমে দেখে জিনিসগুলোর আগাপাশতলা কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু একটা হাতে নিতেই বুঝলাম কী জিনিস।
একধরনের অর্কিডের ফুল। অনেকটা সিলিন্ডারের মতো আকৃতি। পাঁচখানা পাপড়িগুলো একে অপরের সঙ্গে প্যাঁচ খেয়ে লম্বাটে স্পাইরালের সৃষ্টি করেছে। গাঢ় বেগুনি রঙের। নাকের কাছে আনতেই মিষ্টি গন্ধ পেলাম। কেন জানি অর্কিডটা হাতে ধরতেই মনটা অল্প হালকা লাগছিল। এখন গন্ধ শুঁকে মনে হল, আমার মাথার মধ্যে জমে থাকা অনেকটা চাপ ভুরভুর করে বেরিয়ে গেল।
মণি আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। এইবার বলল, “আজকে বাংলোর চারিদিকে ঘোরার সময় অর্কিডটা চোখে পড়ল। এই জাতের ফুল আগে কখনো দেখিনি। আরেকটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার খেয়াল করলাম।”
হাতে ধরা অর্কিডটার জন্য আমার কেমন ঘোর লাগছিল। তবে কালকের মতো অস্বস্তি মাখানো ঘোর না। বরং মনে শান্তি জাগানো ঘোর।
“অর্কিডগুলো একটা বৃত্তের পরিধি বরাবর এই বাংলোর চারিদিকে গজিয়েছে। ঠিক যেন একটা বলয়। প্রাকৃতিকভাবে এইরকম লক্ষণরেখা গজানো সম্ভব নয়। তার মানে…”
“কেউ এই অর্কিডের চারা ইচ্ছে করে বাড়ির চারপাশে লাগিয়েছে,” আমি ফিসফিস করে বললাম।
“ইয়েস।” তারপর একটু ইতস্তত করে, “কালকের যেই জন্তুটা আমাদের পিছু নিয়েছিল, সে হঠাৎ থেমে গেল কেন বুঝতে পারছ তো?”
“হুমম,” আমি ফুলটা মুঠোর মধ্যে রেখে দুমড়েমুচড়ে দিলাম। ভালো লাগা ঘোরটা কেটে গেল।
“তার মানে উই আর রিলেটিভলি সেফ হিয়ার,” মণি বলল।
সেফ। নিরাপদ। বাংলোটা সত্যিই কি নিরাপদ? আবার সেই বিদীর্ণ উপত্যকার কথা মাথায় এল। বাঁশিওয়ালার সেই উন্মত্ত সুর এখনও কানে বাজছে। নরকের কোন নাম-না-জানা গুহাতে এই সুরের জন্ম? কোন পাপীর আর্তনাদ শুনে বনের অধীশ্বরেরা এই সুরের জন্ম দিয়েছে? হয়তো সশরীরে বাঁশিওয়ালা এই বাংলোতে আসতে পারবে না। কিন্তু আমার স্বপ্নজগতে? সেখানে বাধা দেওয়ার জন্য কোন অর্কিড যে আমার কাছে নেই।
“আজ গাইডের সঙ্গে যখন ঘুরছিলাম, সে আমাকে ওই বলয়ের বাইরে নিয়ে গেল না,” মণি বলে চলেছে। “কেয়ারটেকার বলেছে এই এলাকায় ঘোরার জন্য আমাদের সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা সে করে দেবে। তবে আমার ইচ্ছে অত ঘুরে কাজ নেই। তুমি চাইলে আজই ফেরৎ চলে যাব। কী বল?”
আমি কফিতে আরেকটা চুমুক দিলাম। এর মধ্যেই অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বললাম, “এত কাঠখড় পুড়িয়ে আমরা দুইজন ছুটি জোগাড় করলাম। এত দূর এলাম একটু ঘুরব বলে। এখন বলছ ফেরত চলে যেতে?”
নিজের কথা শুনে নিজেই একটু চমকে গেলাম। এইসব কী বলছি? এখান থেকে চলে গেলেই আমাদের মঙ্গল নয় কি? কিন্তু আমার ভেতরটা যেন দ্বিমুখী হয়ে গিয়েছে। এক তরফ বলছে, “থেকে যাও। মিথ্যে অন্ধবিশ্বাসকে এই ভাবে সায় দিও না।” আরেক তরফ, যে আগেরটার থেকে অনেক দুর্বল আর ক্ষীণ, সে বলছে, “না, ফেরৎ চলে যাও। ফেরত চলে যাও। এখানে বিপদ! ঘোর বিপদ!”
মণি যেন সেই ভয়ার্ত আমিকে সায় জানিয়ে বলল, “দেখ, নীল। কালকে যাই হয়ে থাকুক না কেন, সেটা স্বাভাবিক ছিল না। প্লাস আমার মনে হয় না এই জায়গাটা তোমার হেলথের জন্যে ভালো। তোমার জ্বর তো হয়েই ছিল, তার উপর কাল সারারাত তুমি সেই জ্বরের ঘোরে কী সব বকে গেছ। টু বি ফ্র্যাঙ্ক, আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“মানে? আমার মনে আছে তুমি একবার আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছিলে। তারপর তো কোন স্বপ্ন দেখিনি।”
“তোমার হয়তো আর মনে নেই। কিন্তু ভোরের একটু আগে আমার ঘুম ভেঙেছিল। তখন খেয়াল করে দেখি তুমি বিড়বিড় করে কী সব বলে যাচ্ছ। সেটা আসলে কোনো ভাষা ছিল নাকি পুরোপুরি জিবারিশ ছিল, তা বুঝতে পারিনি। আমি তোমাকে ঘুম থেকে তোলার একটু চেষ্টা করেছিলাম। কিছুক্ষণ পর, আই জাস্ট স্টপড অ্যান্ড ট্রায়েড টু লিসন। তাও একটা শব্দ উদ্ধার করতে পারিনি।”
মণির কথা শুনে আমার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। বিড়বিড় করে কী বলছিলাম আমি? আমার সত্যি কিছু মনে নেই৷
দরজায় টোকা। কেয়ারটেকার। মণি “কাম ইন” বলতেই সে ঢুকে পড়ল।
সকালের এই ফুটফুটে আলোতে বুড়ির বয়স যেন দশ বছর কমে গেছে। এখানকার স্থানীয় লোকেদের চেহারায় এক ধরনের জৌলুশ থাকে। ছোটোবেলা থেকে বুড়ো বয়স অব্দি। তাই আমরা সমতলের বাসিন্দারা এদের পাশে দাঁড়ালে মনে হয় আমরা জীর্ণ আর অসুস্থ। যেন কোন এক অসুখে ভুগে আমাদের জীবনীশক্তি মিইয়ে গেছে।
ঘরে ঢুকেই বুড়ি মন দিয়ে কিছুক্ষণ আমাকে জরিপ করল। তারপর একটু মুচকি হেসে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, “আজ ঘুরতে বেরোবেন তো?”
আমি হ্যাঁ বলতে যাওয়ার আগেই মণি বলল, “আসলে আমরা ভাবছিলাম আজকের মধ্যেই ফেরত যাব।”
কেয়ারটেকার গম্ভীরমুখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। “ঠিক আছে৷ আপনারা ব্রেকফাস্টটা করে বেরিয়ে যান। প্রকাশ, যে সকালে গাইড করছিল, সেও আপনাদের সঙ্গে যাবে৷ ফুটহিল অব্দি রেখে…
“এই! না, না,” আমি আপত্তি জানালাম। “মণি তুমি সিকিম আসবে বলে প্রায় দুই মাস ধরে কান্নাকাটি করছিলে। তারপর এখানে এসে কিছু না দেখেই ফেরৎ চলে যাবে?”
“নীল,” মণির স্বর ক্লান্ত।
“লেট মি ফিনিস। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ বোধ করছি। আশেপাশে ঘুরে নিতে অসুবিধে কী? আর, তুমিই তো বললে কেয়ারটেকার দিদি আমাদের সেফ রাখার ব্যবস্থা করে দেবে।”
বুড়ি আবারও আমাকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জরিপ করল। সে বলল, “হ্যাঁ বলেছিলাম বটে। সঙ্গে নিয়েও এসেছি।” এই বলে সে কাপড়ের ভাঁজ থেকে দুটো মাদুলি বার করে আনল।
“আপনারা অলরেডি গুরাসগুলো খুঁজে পেয়েছেন দেখছি,” কেয়ারটেকার টেবিলে রাখা অর্কিডের ফুলগুলো দেখিয়ে বলল। “এগুলোকে আমরা ক্ষিতিজ বলে ডাকি। এখানে অনেক গ্রামে গিয়েই দেখবেন চারদিকে এগুলো গজিয়ে রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি ফুলগুলো আকাশ এবং পৃথিবীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। তাই সমস্ত শুভশক্তির প্রতিকী হল এই গুরাস।”
মাদুলি দুটো মণির হাতে ধরিয়ে বললেন, “মাদুলির ভেতরে অনেক কিছুই রয়েছে। কিন্তু ক্ষিতিজ রয়েছে সব থেকে বেশি পরিমাণে। এখানে আজকে যখন থাকবেন বলে ঠিক করলেন, মাদুলিটা সর্বক্ষণ গলায় ঝুলিয়ে রেখে দিন। নিচে ফুটহিলে নেমে খুলে ফেলবেন খন।”
মণি মাদুলি দুটোর টাকা দিতে চাইলে কেয়ারটেকার এত্তবড় জিব বার করে “না না” করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চলে যাওয়ার আগে বলল তাড়াতাড়ি যেন নীচে আসি। ব্রেকফাস্ট রেডি৷ আমার মনে হল বড়ো বড়ো হোটেল ম্যানেজমেন্টের কলেজে ছেলেমেয়েদের না পাঠিয়ে উত্তরপূর্ব ভারতের পাহাড়ের কোলে থাকা ছোটো ছোটো হোম-স্টে আর হোটেলে পাঠানো উচিৎ। অতিথি আপ্যায়নের একেবারে অ-আ-ক-খ শিখে বাড়ি ফিরবে।
গলায় মাদুলি ঝুলিয়ে ডাইনিং রুমে এলাম। আমাদের গাইড আমাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিল। নাম প্রকাশ। কিন্তু উচ্চারণ করে ‘পরকাশ’। আমি মাদুলিটা পরে তেমন কিছু পরিবর্তন লক্ষ করলাম না। তবে মনে দুঃশ্চিন্তা কম আসছিল। সকালে দুটো পরোটা আর টকটক সয়াবিনের তরকারি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। স্যাংচুয়ারির আশপাশে সাইটসিইং-এর সুযোগ যথেষ্ট কম। তবু মণি আর আমি মিলে যতটা পারি নিংড়ে নিলাম। নানা জাতের অর্কিড আর পাখির ছবি তুলে, পাহাড় দেখে “আহা উহু” করে, নদীর ধারে বসে পা ভিজিয়ে যখন গুরাস বাংলোতে ফিরছি তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে।
পায়ে একটা টনটনে ব্যথা। পেটে খিদে। মনে প্রশান্তি। মুখে খাবার গুঁজে আমি একটু ভাতঘুম দিলাম। শান্তিতে ঘুম হল। নির্বিঘ্নের ঘুম।
ঘুম ভাঙল সন্ধেতে। অন্ধকারে ডুবে রয়েছে ঘরটা। আমি উঠে বসে ডাক দিলাম।
“মণি?”
উত্তর নেই। ঘরের কোনাগুলোয় তাল তাল অন্ধকার জমে রয়েছে। চারদিক চুপচাপ। একটা পোকামাকড়ের আওয়াজ পর্যন্ত নেই।
তখনই আমার মনে হল, বিছানার ঠিক পাশে একটা অস্বাভাবিক লম্বা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার আটখানা পা। চাপা গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না?
আমি ফট করে আলোর সুইচে আঙুল বসালাম। তাল তাল অন্ধকারগুলো যেন সরীসৃপের মতো কিলবিল করে বিছানা আর টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়ল।
কই? কেউ তো ঘরে নেই। শুধুই একটা লম্বাটে ফার্নিচার। অন্ধকারে মানুষের মতো লাগছিল।
কিন্তু মণি কোথায়? আমি বিছানা থেকে নেমে জানালার দিকে গেলাম। এখন পর্দা দিয়ে ঢাকা। জানালার কাছে যেতেই কেন জানি বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। আবার মনে পড়ল সেই বিদীর্ণ উপত্যকা, সেই পৈশাচিক বাঁশিওয়ালা, সেই উন্মাদ চাঁদ।
হুট করে পর্দাটা সরালাম। বাইরে স্যাংচুয়ারি অন্ধকারে ডুবে। অন্ধকার এতই গাঢ় যে আকাশে তারাদেরও খোঁজ নেই। ঘরের যেইটুকু আলো বাইরে ঠিকরে পড়েছে, তাতে বুঝলাম উপত্যকায় ঘন কুয়াশা জমেছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আমার মনে হল বাংলোটা আর চেনাজানা পৃথিবীতে নেই। আমি এখন সম্পূর্ণ একা।
চিন্তাটা মাথায় আসতেই শব্দটা কানে এল। সেই বীভৎস বাঁশির অর্কেস্ট্রা। অত্যন্ত ক্ষীণ। এই বনের মাঝে সেই বাঁশিওয়ালাটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কুয়াশা ছাড়িয়ে খোলা আকাশে তার দেহটা। চাঁদকে গান শোনাচ্ছে। তবে কুয়াশা আর অন্ধকারের জন্য কিচ্ছুটি দেখতে পেলাম না।
খেয়াল করলাম, বুকের উপর ঝুলতে থাকা মাদুলিটা কাঁপছে।
বাঁশির আওয়াজটা এইবার কান্নার মতো শোনাচ্ছে। আমি পর্দা সরিয়ে জানালা ঢেকে দিলাম৷ আজ তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে। কাল আবার ট্রেকিং।
৫
পরদিন সকাল।
কুয়াশা এখনও কাটেনি। আবছায়ায় সব কিছু মায়াময় লাগছে। সেই কুহকের মধ্যে একটা দুটো পাখি ডাকছে।
আমি বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে দেখি মণি গজগজ করছে।
“ইশশ। মেঝেটা এত ধুলো ধুলো কেন? কাল জুতো পরে ঘরময় ঘুরে বেরাচ্ছিলে নাকি?”
আমি “না” বলার আগেই সে আবার খেঁকিয়ে উঠল, “আমার মাদুলিটাই বা গেল কোথায়? সেই কখন থেকে খুঁজছি।”
মাদুলির কথা শুনতেই আমার হাত চলে গেল বুকের উপর। আমার মাদুলি হারায়নি। কিন্তু মাদুলিটা হাতে ধরতে কেমন অদ্ভুত লাগল। কিছু ভাবার আগেই…
“পেয়েছি, থ্যাংক গড,” মণি প্রায় চিৎকার করে উঠল। টেবিলের নীচ থেকে নিজের মাদুলিটা তুলে বলল, “কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে কাল এটা পরে ঘুম দিয়েছিলাম। এখানে এল কী করে?”
আমি উত্তর দিলাম না। আমার না কেমন ভয় করছে! খালি মনে হচ্ছে মণিকে বলি, “আজ বেরিয়ে কাজ নেই। চল আজ থেকে যাই। এখানে চিরকালের জন্য থেকে যাই।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এই চিন্তাটাকে হটিয়ে দিয়ে অন্যান্য চিন্তায় মাথা ভরে গেল। বড়দের যৌক্তিক চিন্তা। সাংসারিক সব ভাবনা। “এখানে চিরকাল থাকা তো সম্ভব নয়, নীল! কী সব উলটোপালটা ভাবছ তুমি! বয়স প্রায় চল্লিশের কোঠায়, আর এখনও ভয় কমলো না তোমার?” ঠিক যেন বাবার গলা।
মণি খুব যত্নের সঙ্গে মাদুলিটা গলায় ঝোলাল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল, “কী দেখছ অমন করে?”
একদলা কান্না আমার গলায় এসে আঁটকে গিয়েছে। আমার আবার মনে হল আমি, মণি দুইজনের কেউই বেঁচে নেই৷ আমার ভেতরটা কেমন ফাঁপা হয়ে গিয়েছে, সেই শূন্যস্থান পূর্ণ হবে না কোনোকালে। অসহায়তার সঙ্গে একদলা বিষাদ মিশে গিয়েছে। নিজেও বুঝলাম না আমার মধ্যে এইরকম রিঅ্যাকশন কেন এল। কান্না চেপে কোনরকমে বললাম, “চল বেরনো যাক।”
আজকেও গাইড যাবে আমাদের সঙ্গে। প্রকাশ ওরফে পরকাশ। ফুটহিলে ছেড়ে আসবে। বেরনোর আগে খরচের হিসেব মিলিয়ে নিলাম। কেয়ারটেকার একটা বিল হাতে ধরাল। দেখলাম তাতে এক বোতল রাম-এর দাম ধরা আছে। নাহ! বুড়ির বিজনেস অ্যাকিউমেন বেশ ভালো।
টাকাপয়সা মিটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আবার সেই দুঃস্বপ্নের ট্রেইলে। আজ কি বাঁশিওয়ালার দেখা পাব?
মণিকে কিন্তু বেশ ফুরফুরে দেখাচ্ছে। মুখে দুঃশ্চিন্তার ছিটেফোঁটা নেই৷ প্রকাশ আমাদের আগে আগে হাঁটছে। হাঁটা না বলে লাফানো বলা ভালো। একেবারে উচ্চিংড়ের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতে আমাদের মতো কোনো ওয়াকিং স্টিক নেই। ওর সেইসব দরকার নেই।
দেখলাম প্রকাশের গলায় কোন এক প্রাণীর দাঁত ঝোলানো রয়েছে, তবে আমাদের মতো কোন মাদুলি নেই। সেই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে একগাল হেসে বলল, “ওইসব ভূতটুত আমাকে কিছু করবে না দাদা। আমি এই বনের ছেলে। তা ছাড়া এইসব মাদুলি ফাদুলিতে আমার বিশ্বাস তেমন নেই।”
ভাবলাম জিজ্ঞেস করে দেখি আমাদের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে ওর অভিমত কী। তারপর ভাবলাম, থাক। এইসব নিয়ে আর ভেবে কাজ নেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ফুটহিলে পৌঁছে যাব। কাল ভোরের মধ্যে হাওড়া স্টেশনে নেমে যাব। এইসব ঝামেলা নিয়ে আর ভাবতে হবে না। তখন খালি অফিস অফিস খেলতে হবে।
আজকের কুয়াশা সেইদিনের মতোই গাঢ়। শুধু একটা ব্যাপার আলাদা। কুয়াশাটা কেমন তৈলাক্ত দেখাচ্ছে। অলস গতিতে পাক খাচ্ছে, পাক খাচ্ছে। গাছ পাতা আর অর্কিডের গায়ে লেপটে রয়েছে।
আমরা বেশ জোরেই হাঁটছি। এতে দম ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কিন্তু ধীরেসুস্থে হাঁটার মতো মানসিকতা মণি বা আমার কারুরই নেই।
হঠাৎ শিস দেওয়ার আওয়াজ। আমি চমকে মণির দিকে দৌড়াতে যাচ্ছিলাম, তখন বুঝতে পারলাম, প্রকাশ শিস দিচ্ছে।
ছেলেটার বয়স বেশি নয়৷ কুড়ি হবে কিনা সন্দেহ। তাই বোধহয় ওর ঠোঁটের কোণে সবসময় একটা অবজ্ঞার হাসি ঝুলে থাকে। এখন সেইরকম হাসি-হাসি মুখ করে সে শিস দিচ্ছে। উপত্যকার গাছগুলো দমবন্ধ করে সেই শিসের আওয়াজই যেন শুনছে।
উফফ, টু বি ইয়াং এগেইন!
প্রকাশের শিস দেওয়া থামল। দম নেওয়ার জন্যে বোধহয়।
ঠিক তখন আমাদের ডান দিক থেকে কে একজন শিস দিয়ে উঠল।
প্রকাশ যে সুরে শিস দিচ্ছিল, হুবুহু এক। আমরা তিনজনেই হাঁটা থামিয়ে দিলাম।
মণির মুখ ফ্যাঁকাশে হয়ে গেছে। ডান হাতে আঁকড়ে রয়েছে মাদুলিটা।
প্রকাশ ডান দিকের আবছায়া জঙ্গলের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল। সেই জঙ্গলের সাদাটে গহ্বর থেকে শিসের আওয়াজ ভেসে আসছে।
“কউন হ্যাঁয় বে?” প্রকাশ জোর গলায় জিজ্ঞেস করল।
উত্তর নেই৷ কিন্তু সুরটা বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। আমার চেনা একটা সুরের মতো হয়ে যাচ্ছে। আকাশে আজ লাল চাঁদ ওঠেনি।
প্রকাশ এইবার স্থানীয় ভাষায় কী একটা জিজ্ঞেস করল।
শিস বাজান থেমে গেল।
প্রকাশ এইবার হিন্দিতে দুই তিনটে গালি দিয়ে বলল, “নিশ্চয় কোনো ছ্যাঁচড়া লোকজন আপনাদের ভয় দেখাচ্ছে। আগের দিনেও দেখিয়েছিল। কোই বাত নেহি। আমার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকুন। কিছু হলে আমি দেখছি।”
প্রকাশ গজগজ করতে করতে হাঁটতে লাগল। আমরা পিছু নিলাম।
“ঠিক আছ?” মণিকে জিজ্ঞেস করলাম।
মণি প্রথমে শুনতেই পেল না। ঘোলাটে চোখদুটো জঙ্গলের দিকে ফেরানো। দ্বিতীয়বার একটু জোরে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাতে চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ। ঠিক আছি। চলো।” দেখলাম এখনো মাদুলিটা আঁকড়ে ধরে রয়েছে।
আমি ওর অন্য হাতটা ধরলাম। তারপর প্রকাশের পিছু নিলাম।
আধঘণ্টা নির্ঝঞ্ঝাটে কাটল। কিন্তু দুইজনেই টেনশনে কুঁকড়ে গিয়েছি। আমাদের সামনে প্রকাশ। মাঝে মাঝেই কুয়াশার আবছায়াতে মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ পর পর ওর পিঠটা দেখা যাচ্ছে। সে আর শিস দিচ্ছে না। ঘাড় শক্ত করে হাঁটছে।
এইবার বাঁশির আওয়াজ। একটাই বাঁশি। ডানদিকের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে। প্রকাশ দাঁড়াল না। বরং হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
একটা আওয়াজ বেড়ে তিনটে হল। আমার মনে হল সারা বন থরথর করে কাঁপছে। গাছের পাতাগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে, “আয়, আয়। এদিকে আয়।”
মণি আমার হাতে চাপ দিল। ও মাটির দিকে তাঁকিয়ে রইছে। হাঁটার গতি থামায়নি। এত জোরে মাদুলিটা ধরে রয়েছে যে ওর আঙুলগুলো সাদা হয়ে গেছে।
আমার বুকের ভেতরটা আতঙ্কে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মনে হচ্ছে এই এক্ষুনি বনের গাছগুলো মড়মড় করে ভেঙে বেরিয়ে আসবে। সেই বাঁশিওয়ালা। সেই নারকীয় ঊর্ণনাভ।
এইবার পাঁচটা বাঁশি। প্রকাশ দেখলাম দাঁড়িয়ে পড়েছে। মুখে সেই মিচকে হাসিটা আর নেই৷ কটমট করে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
“প্রকাশ। চল, হাঁটতে থাকি,” আমি বললাম।
কিন্তু প্রকাশ যেন আমার কথা শুনতেই পেল না। বিড়বিড় করে কী একটা বলছে। বুঝতে পারলাম না।
তারপর, “আপনারা দাঁড়ান এখানে। আমি দেখে আসছি।”
“না! না!” মণি আতঙ্কে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। “প্রকাশ, যেও না! লেটস জাস্ট কিপ মুভিং।”
কোথায় কী! ছোকরা আমাদের কথা পুরো অগ্রাহ্য করে রাস্তা পেরিয়ে বনে মিলিয়ে গেল।
আমি দৌড়ে ওকে আটকাতে যাচ্ছিলাম, তবে মণি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ডোন্ট নীল। জাস্ট ডোন্ট।”
আমরা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের চারদিকে কুয়াশা পাক খাচ্ছে। বাঁশির আওয়াজ থামে নি। আমার সেই আগের বারের মতো ঘোর ভাবটা আসছে। সেই সম্মোহিত অবস্থায় আমার মনে হল, এই শেষ! এই শেষ! এই ক’দিন ধরে যে নাটক হচ্ছিল, তার যবনিকা পতন খুব শীঘ্রই হবে।
বাঁশির আওয়াজ থেমে গেছে। তার সঙ্গে স্যাংচুয়ারিতে নেমে এসেছে অস্বাভাবিক নিঃশব্দতা।
আমি একটু সাহস জুটিয়ে জোরে ডাক দিলাম।
“প্রকাশ? প্রকা-আ-আ-আ-শ! কোথায় তুমি?”
উত্তর নেই। প্রকাশ যেন কুয়াশায় মিলেমিশে গিয়েছে। আর কোনোদিন জীবিতদের দেশে ফেরত আসবে না।
আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মণি বলল, “চল এগোতে থাকি।”
“কিন্তু প্রকাশ?”
“আমি এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, নীল। খুব ভয় করছে। হাত-পা কাঁপছে। আই নিড টু মুভ। উই নিড টু মুভ।”
ভুল বলেনি মণি৷ দাঁড়িয়ে থেকে কিছুই হবে না। আর প্রকাশ যদি ফেরত-ও আসে ও ঠিক লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে যাবে।
“চল,” আমি বললাম।
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।
গত পরশুর বীভৎসতার যেন পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
এক পা…
দুই পা…
তিন…
আমাদের সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। খুব জোর পঁচিশ হাত দূরে। কুয়াশা এতটাই ঘন যে বুঝতে পারছি না কে।
আমরা হাঁটা থামিয়ে দিয়েছি। চোখ ছোটো করে বোঝার চেষ্টা করছি লোকটা কে।
“প্রকাশ?” মণি জিজ্ঞেস করল।
লোকটা আস্তে আস্তে এগিয়ে এল। টলতে টলতে হাঁটছে, যেন মাতাল।
আরেকটু এগোতেই লোকটাকে চিনতে পারলাম।
প্রকাশই বটে। আমাদের সেই ছোকরা গাইড।
শুধু এখন ওর গায়ে একটা সুতোও নেই। এই ঠান্ডায় উলঙ্গ হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে৷ চুল উসকোখুসকো। শূন্যে দৃষ্টি। মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরুচ্ছে। গলা বেয়ে বুকে টপ টপ করে পরছে।
মণি আমার হাতে নখ বসালো। “হিসসস,” করে ওর মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ বেরল। দুইজনে এক এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছি।
প্রকাশ দাঁড়িয়ে গেল। এখনও দৃষ্টি শূন্য, যেন ওর কোনোরকমের বোধ নেই, জ্ঞান নেই।
এরপর মুহূর্তের মধ্যে কী একটা যেন হয়ে গেল, সেটা আমার মস্তিষ্ক আমার মনকে ঠিক করে বোঝাতে পারল না।
প্রথমে প্রকাশের নাকের উপর একটা লম্বা কাটা দাগ দেখা দিল। তারপর সেই কাটা দাগটা উপর নীচে বাড়তে থাকল, যেন কেউ একটা মার্কার দিয়ে ওর দেহটা দুইভাগে ভাগ করে দিচ্ছে।
হঠাৎ সেই দাগ বরাবর প্রকাশের চামড়াটা উপড়ে গেল। দুইদিকে দুই টুকরো৷ চড় চড় করে একটা বীভৎস আওয়াজে স্যাংচুয়ারির নিস্তব্ধতা চুরমার। প্রকাশের শরীর থেকে রক্ত ছিটকে চারিদিকে পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টির মতো। তার থেকে এক দুই ফোঁটা আমার মুখে এসে পড়ল। কী গরম! মানুষের গায়ের রক্ত এত গরম হতে পারে জানতাম না।
দেহটা এইভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরেও প্রকাশের মুখ থেকে একটাও শব্দ বেরোয়নি। সে কোনো এক মায়াজগতে হারিয়ে গিয়েছে। চামড়া দুটো মাটিতে কাপড়ের মতো পড়ে আছে। চামড়াহীন দেহটা থেকে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সেই রক্তে পায়ের নীচের মাটি ভিজে কর্দমাক্ত হয়ে গিয়েছে৷
আমার মুখ থেকে চিৎকারটা বেরনোর আগে মণি হড়হড় করে বমি করে ফেলল।
প্রকাশের দেহটা এইবার গুটিয়ে যাচ্ছে। যেন অদৃশ্য দুটো হাত ওর হাড়গুলো ভেঙে দিচ্ছে। খুলি থেতলে দিচ্ছে। চোখদুটো টিপে টিপে গেলে দিচ্ছে। দাঁত উপড়ে ফেলছে। পেশিগুলোকে ছিঁড়ে দিচ্ছে। নাড়িভুঁড়িগুলো কে সযত্নে টেনে টেনে বার করে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে।
আমি মণির হাত ধরে টান দিলাম।
বাংলোর বাইরে বেরনো আমাদের একদম উচিত হয়নি। একদম হয়নি!
সকালের একটা ছোট্ট ঘটনা আমার মনে পড়ে গেল। মাটিতে ধুলোর মতো মিহি কী একটা পড়ে ছিল। মণি ভেবেছিল আমি জুতো পরে ঘরময় ঘুরে বেরিয়েছি। আমি সেটা করিনি। আচ্ছা মণির মাদুলিটা মাটিতে পড়ে ছিল কেন? আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার কী যেন ছিল?
আমি আমার মাদুলিটা ধরলাম। আগের থেকে হালকা লাগছে না? অনেকটা হালকা। যেন কেউ মাদুলির প্যাঁচ খুলে ভেতরের মালমশলা ফেলে দিয়েছে। মেঝের উপর।
কিন্তু কে? কিন্তু কে?
প্রকাশের দেহটা আর মানুষের বলে গণ্য করা সম্ভব নয়। চামড়া, মাংস আর নাড়িভুঁড়ির স্তূপ। এতক্ষণে রক্তের আঁশটে গন্ধে চারিদিক ভরে গিয়েছে।
আমি মণিকে ধরে উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠলাম, “দৌঁড়ও! আমাদের ফেরত যেতে হবে! মণি, দৌঁড়ও!”
আমরা প্রকাশের মৃতদেহ থেকে মুখ ফিরিয়ে পেছনে তাঁকাতেই আবার থমকে গেলাম।
বাঁশিওয়ালা পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে।
আটখানা পা জড়সড় করে রাখা। কুয়াশায় বাঁশিওয়ালার দেহ অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে। সেই চোখগুলো আমাদের দিকেই ঘোরানো। সেই অজস্র পৈশাচিক চোখ।
মণির গলা থেকে একটা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে এল। একমাত্র আতঙ্কের চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলেই সেইরকম আওয়াজ করা সম্ভব। ও এখন নড়তেও পারছে না। হেডলাইটের আলোতে সম্মোহিত হরিণের মতো তাকিয়ে রয়েছে আটপেয়ে বিভীষিকার দিকে।
আমার নিজেরই চিন্তাভাবনা সব অসংলগ্ন হয়ে যাচ্ছে। হাঁটু দুটো দুর্বল। মনে হল আমি এইবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ব। মিশে যাব পৃথিবীর সঙ্গে।
একটা অশুভ রক্তমাখা পূতিগন্ধে চারিদিক ভরে যাচ্ছে। গা গুলিয়ে উঠল। কিন্তু বমি করার মতো পেটে কিছু নেই।
সন্ধিক্ষণ এসে গিয়েছে। বাঁশিওয়ালার আমাকে খুব দরকার। অনেকক্ষণ ধরে আমার জানালা খোলার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। কিছুটা সফলও হয়েছে।
হ্যাঁ হয়েছে।
কে বারবার সব অদ্ভুত ব্যাপারগুলোকে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে?
আমি।
কে অনেক কিছু হওয়ার পরও গতকাল ফেরত আসতে চায়নি?
আমি।
গতকাল গভীর রাত্রে কে মাদুলিগুলো খুলে ভেতরের সব কিছু ঘরের মেঝেতে ছড়িয়েছে?
আমি।
আমি, আমি, আমি। সেই প্রথমদিন থেকে এই বাঁশিওয়ালা আমাকে নাচিয়েছে। আমার মনের বর্মে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চালিয়েছে। আজ এসেছে নিজের শিকারে ভাগ বসাতে।
আমাকে খুব দরকার ওর।
কিছু বোঝার আগেই সেই বিভীষিকার একটা পা উঠে আমাদের দিকে নেমে এল। আমার চোখের সামনে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল মণির দেহ। ও একবার চিৎকার করারও সুযোগ পেল না।
বাঁশির আওয়াজ আসছে। কানে তালা লাগা তীক্ষ্ণতা।
আমার চোখের সামনে মণির দেহটা ঝুলিয়ে রেখেছে পিশাচটা। ছলকে ছলকে রক্ত পড়ছে মাটিতে।
আমি আর পারছি না নিতে। জানালা আর খোলার প্রয়োজন হবে না। দেখতে পাচ্ছি সেই জানালার কাচে ফাটল ধরেছে। এক্ষুনি সব ভেঙেচুরে যাবে। বাঁশিওয়ালা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে, আমাকে মাটিতে চেপে ধরবে। তারপর…
নিজের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নেমে যাবে এই পর্বতশ্রেণী থেকে, এই উপত্যকা থেকে।
আমার সাহায্যে শুরু হবে এক পরিসরহীন মারণ উৎসব।
শুধু আর কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার।
আমার ভেতরটা হঠাৎ জ্বলে উঠল। ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ আর্তনাদ ভেসে এল।
“না, এটা হতে দেওয়া যাবে না। যে করেই হোক থামাতে হবে। নইলে সর্বনাশ। সবার সর্বনাশ।”
আমি তখনই বুঝে গেলাম আমাকে ঠিক কী করতে হবে। নরকের মাকড়সাটা কিছু বোঝার আগেই বামদিকের খাদের দিকে দৌড় দিলাম। যতক্ষণে ওর ক্রুদ্ধ সুর আমার মনের তটে আছড়ে পড়ল, ততক্ষণে আমি শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
মৃত্যুর ঠিক আগে নাকি জীবনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্তগুলো চোখের সামনে ভেসে আসে। আমার সেইরকম কিছু হল না।
দুই সেকেন্ড পর একটা গাছের ডাল আমার বাম চোখে ঢুকে সবকিছু অন্ধকার করে দিল।
উপসংহার
“শুনতে পাচ্ছ?” মণির জিজ্ঞাসা।
আমি হাঁটা থামালাম।
আমাদের চারিদিকে গাছ আর গাছ। বাশ, ওক, ম্যাপল, ফার। মাঝে মাঝে রক্তাভ রডোডেনড্রন। এই সুন্দর বনের মাঝে কারা যেন বাঁশি বাজাচ্ছে। খুব মিষ্টি সুর।
বললাম, “বাব্বা। নিশ্চয় লোকাল ফেস্টিভ্যাল কিছু হচ্ছে। ভালোয় হল, এই সুযোগে এখানকার সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানা যাবে। কী বল?”
মণি ঠোঁট উলটে বলল, “বাংলোয় পৌঁছে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে।” তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল।
আমি আরেকটু মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম। সুরটা মিষ্টি, একটু চেনা চেনাও লাগছে। তবুও আমার মন কেমন একটা অস্বস্তিতে ভরে গেল। কারণটা বুঝলাম না। হাঁটা শুরু করার আগে আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম।
ছয়জন বাঁশি বাজাচ্ছে।
Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃণময় দাস, রনিন
একটানে পড়ে নিলাম। দারুণ লাগলো। শেষদিকাটায় এম্পটিম্যান মুভির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। এক কথায় চমৎকার। ❤️
দুর্দান্ত