শিস
লেখক: লুৎফুল কায়সার
শিল্পী: দীপ ঘোষ
১
“এই দুলজোড়া আমার খুবই পছন্দ হয়েছে, থ্যাংক্স কিনে দেওয়ার জন্য,” আহ্লাদি গলায় পাবলোকে বলল পুষ্পিতা।
“আমাদের টাক্সকো তো বিখ্যাতই রূপার জন্য। এই অঞ্চলকে স্প্যানিশরা কী নাম দিয়েছিল জানো? সিলভার সিটি। এখনো ওই নামই বহাল আছে, শুধু মেক্সিকো নয়, গোটা পৃথিবী থেকেই রূপাপ্রেমীরা এই শহরে আসে,” হাসল পাবলো।
“যাক, তোমাকে বিয়ে করে এই একটা লাভ তো হল, রূপার শহরের বউ হলাম।”
“স্প্যানিশ সৈন্যরা যখন এই অঞ্চলটা দখল করে তখন নাকি ওরা বেশ কয়েকটা রূপার খনি পেয়েছিল। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে শুরু করল রূপার ব্যাবসা, এভাবেই শহরটার পত্তন। তারপর ধরো, একটা সময়ে রুপা শেষ হয়ে গেল, স্প্যানিশরাও আজ আর নেই, মেক্সিকো স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সেই ঐতিহ্যটা আমরা ধরে রেখেছি। তুমি এই শহরে যত রুপার গয়নার দোকান পাবে পৃথিবীর কোনো শহরে এত দোকান নেই।”
“আহা, ছেলেটা কত জানে!”
ছয় মাস হল বিয়ে হয়েছে ওদের। ঢাকার একটা স্প্যানিশ লার্নিং সেন্টারে প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করত পাবলো আর ওখানেই স্প্যানিশ শিখতে ভরতি হয়েছিল পুষ্পিতা।
তারপর পরিচয়, প্রণয়… এইতো। শুরুর দিকে পুষ্পিতার মা-বাবা বেশ আপত্তি তুলেছিলেন। বিদেশি কারো সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটা এখনো বাংলাদেশে ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয় না।
কিন্তু পাবলোর সঙ্গে দুয়েকবার কথা বলার পর তারা দুজন রাজি হয়ে যান। মানুষ হিসাবে যথেষ্ট ভালো পাবলো, দীর্ঘকাল বাংলাদেশে থাকার কারণে চমৎকার বাংলাও বলতে পারে।
বিয়ের পর এই প্রথম তারা মেক্সিকোতে এসেছে, সাতদিন হল।
স্বামীর দেশ ভালোই লাগছে পুষ্পিতার। স্প্যানিশটা বেশ বলতে পারে ও, তাই এখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলতেও সমস্যা হচ্ছে না।
মাংসের বাজারের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। রাস্তার ডান পাশে বেশ বড় একটা হরিণের মাংসের দোকান, বেশ গোমড়া মুখের একজন বুড়ো বসে আছে সেখানে। মেক্সিকোতে হরিণের মাংস প্রকাশ্যেই বিক্রি হয়।
“পাবলো হরিণের মাংস নাও না,” বলে উঠল পুষ্পিতা।
“চলো চলো।”
দুই-তিন কেজি হরিণের মাংস প্যাকেট করে দেওয়ার পর দোকানের মালিক বুড়ো কেমন যেন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, “মনে রেখ আজ কিন্ত শুক্রবার… এল সিলবনের দিন… আজকে হরিণের মাংস খেতে হয় না।”
“আরে রাফায়েল চাচা, তোমরা পড়ে আছো এল সিলবন নিয়ে। এই যুগে?” হেসে ফেলল পাবলো।
“এসব নিয়ে মজা করতে হয় না বাবা! পুরো মেক্সিকোই ওকে ভয় পায়।”
“বড় শহরগুলোতে দেখ গিয়ে, ওখানকার লোকেরা ড্রাগলর্ডদের ভয়েই তটস্থ, এমনকী সরকারও ওদের ভয় পায়। এইসব পুরোনো কিংবদন্তীদের ভয় পাওয়ার সময় কেবল আমাদের ছোটো শহরগুলোর মানুষদেরই আছে।”
দোকান থেকে বেরিয়ে এল ওরা।
“উনি কীসের কথা বলছিলেন? এল সিলবন কী?” জিজ্ঞাসা করল পুষ্পিতা।
“আরে মেক্সিকোর একটা পুরোনো কিংবদন্তী, আরবান লেজেন্ড বলতে পার, বাড়ি ফিরে মায়ের কাছ থেকে সব শুনে নিও, আমার এইসব ব্যাপারে জ্ঞান খুব কম।”
রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে একদল ছেলেছোকরা। আড্ডাবাজির ব্যাপারে মেক্সিকানরা খুব চৌকস, এরা আড্ডা দিতে অনেক ভালোবাসে।
কতগুলো ছেলে আড়চোখে তাকাল পুষ্পিতার দিকে। ব্যাপারটা নজর এড়াল না পাবলোর।
“দেখলে তো ছোঁড়াগুলোর চাহনি? তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে দেখেইনি হয়তো জীবনে,” চোখ নাচাল সে।
“যাহ,” হেসে ফেলল পুষ্পিতা।
সুন্দরী কথাটা জীবনে অনেকবারই শুনেছে সে। যদিও আহামরি সুন্দরী বলতে বোঝায় তা নয় সে, তবে চেহারার মধ্যে একটা বেশ ধারাল ভাব আছে, চোখে সর্বদা লেগে থাকা চশমা সেই ভাবে এনে দিয়েছে একটা অনন্য মাত্রা আর তা ছাড়া বেশ লম্বাও সে।
সব মিলিয়ে ভালোই রূপসী বলা যায় তাকে।
২
“তো, তো তুমি এল সিলবনের ব্যাপারে জানতে চাও?” পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বললেন ইসাবেলা। হিস্পানিক চেহারার মানুষগুলোর মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেছে পুষ্পিতা, এরা যেন সহজে বুড়ো হতে চায় না। ওর শাশুড়ি ইসাবেলারও অনেকটা সেই অবস্থা। বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনো যথেষ্ট রূপ-লাবণ্য বিদ্যমান চেহারাতে।
“হ্যাঁ, মা… বাজারে একজন বলছিল আজ নাকি হরিণের মাংস খাওয়া…”
“হরিণের মাংসের ব্যাপারটা হয়তো বেশি বেশি। তবে এল সিলবনের কাহিনি বেশ লম্বা। দাঁড়াও,” পেঁয়াজগুলো একটা বাটিতে তুলে রাখলেন তিনি, “এখনই শুনবে?”
“হ্যাঁ, আমার বেশ আগ্রহ ব্যাপারটাতে। আমাদের দেশেও এমন সব আরবান লেজেন্ড রয়েছে… নিশি, ভুলো, জুজু… এইসবে আমার বেশ আগ্রহ।”
“সব দেশেই থাকে। যাইহোক ঘটনার শুরু ষাটের দশকে। হুট করেই মেক্সিকোর গ্রাম আর ছোটো শহরগুলো থেকে মানুষরা নিখোঁজ হতে থাকে। শুধু তাই নয়, বনে শিকার করতে গিয়ে কিছু শিকারীও নিখোঁজ হয়। অদ্ভুত ব্যাপারটা শুরু হয় এরপর থেকে… এদের মধ্যে অনেকেরই মৃতদেহ পাওয়া যেতে থাকে কোনো নির্জন জায়গাতে বস্তার ভিতর খন্ড-খন্ড অবস্থায়।”
“এখান থেকেই এল সিলবনের লেজেন্ডটা আসে?”
“না না। এল সিলবনের কাহিনি আরো পুরোনো… আসছি, ওদিকে আসছি। যাইহোক নিখোঁজ এবং মৃত একজন শিকারীর সঙ্গী নাকি পুলিশকে বলেছিল যে সে আর ওই শিকারী বনের মধ্যে ক্যাম্পিং করার সময়ে শুনতে পায় বহুদূর থেকে কেউ যেন শিস দিচ্ছে। শিসের উৎস খুঁজতেই সেই শিকারী উঠে চলে যায়। এই ঘটনা খবরের কাগজে ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এল সিলবন বা শিস দেওয়া বালকের প্রেতের সঙ্গে অনেকেই এর সম্পর্ক খুঁজতে থাকে।”
“শিস দেওয়া বালক?”
“চল্লিশের দশকে মেক্সিকোর এক গ্রামে বাস করত খুব জেদি একটা ছেলে। যখন যা জেদ ধরত তাই আদায় করে ছাড়ত। তো একদিন ওর খুব ইচ্ছা হল হরিণের মাংস খাবে। ওর বাবাও বিকালবেলা বেরিয়ে পড়ল হরিণ শিকারে। সন্ধ্যা হয়ে গেল… কিন্তু লোকটা ফিরল না। অবশেষে ছেলেটা একটা কুঠার নিয়ে বাবার খোঁজে বের হয়। বাড়ি থেকে একটু দূরেই বাবার সঙ্গে তার দেখা হয়। লোকটি জানায় যে সে হরিণ খুঁজে পায়নি। প্রচণ্ড রেগে যায় ছেলেটা। নিজের বাবাকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে তার শরীরের অঙ্গগুলোকে আলাদা করে একটা বস্তাতে ভরে বাড়ি ফিরে আসে আর সেই বস্তা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলে যে সে হরিণের মাংস এনেছে। ওর মা বস্তা খুলেই বুঝতে পারে যে এগুলো তার স্বামীর শরীরের কাটা অংশ! রাগের মাথায় মহিলা বাড়ির পোষা কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দেন ছেলেটার ওপর। উপর্যুপুরি কুকুরের কামড়ে মারা যায় ছেলেটা। মৃত্যুর আগে নাকি ওর মা ওকে অভিশাপ দিয়েছিল, ‘তোর আত্মার কোনোদিন মুক্তি হবে না! সারাজীবন এই পৃথিবীতে ঘুরেই মরতে হবে তোকে।’ এরপর থেকেই নাকি অনেকেই ছেলেটার আত্মাকে দেখেছে বিভিন্ন নির্জন জায়গাতে। পরনে থাকে ছেড়া জামা আর প্যান্ট, মাথায় মেক্সিকান হ্যাট আর কাঁধে কুড়াল।
“ছেলেটা নাকি বেঁচে থাকার সময়ে খুব ভালো শিস দিতে পারত। মারা যাওয়ার পরেও সেই অভ্যাস যায়নি তার। এখনো নাকি শোনা যায় ওর শিস। তুমি যদি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খুব কাছ থেকে ওর শিস শুনতে পাও তার অর্থ হল ও তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে আর যদি শুনতে পাও যে শিসের শব্দ অনেক দূর থেকে আসছে… তার মানে তোমার আর রক্ষা নেই। ও তোমাকে মেরেই ফেলবে! এই হল এল সিলবনের কাহিনি। ষাটের দশকের ওই হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্য এই কাহিনি যেন আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে এল। এখন পর্যন্ত মেক্সিকোর গ্রাম আর ছোটো শহরগুলোতে শুক্রবারে হরিণের মাংস খাওয়া হয় না। কারণ এতে করে নাকি এল সিলবন অখুশি হয়। আবার ধরো পরশু হ্যালোইন, টাউন হলে আমরা সবাই হ্যালোইন পার্টিতে যাব। হ্যালোইনে সবাই বিশেষভাবে সাজে, জানো তো?”
“হ্যাঁ, গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশেও পালন করা হচ্ছে অনুষ্ঠানটা।”
“বেশ, মেক্সিকোর কোনো হ্যালোইন পার্টিতেই কেউ এল সিলবন সেজে যায় না। কারণ ওই অভিশপ্ত ছেলেটি নাকি এটা পছন্দ করে না। এই তো…”
“আরে আরে, কী শোনাচ্ছ মা ওকে?” হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল পলা। পাবলোর ছোটোবোন সে। দুই ভাই-বোন আর ওদের মা মিলে ছোট্ট সংসার ওদের। পাবলোর বাবা বহুকাল আগেই মারা গেছেন। এখন নতুন করে এই পরিবারে যোগ হয়েছে পুষ্পিতা।
পাবলো আর পলা দুজনেই যেন ওদের মায়ের চেহারা পেয়েছে। পলাকে দেখলে যে কেউ বলবে যে ও তো পাবলোর একটা ছেলে সংস্করণ, আর কিছু না।
“পুষ্পিতা, এল সিলবনের কাহিনি শুনতে চাচ্ছিল তাই বললাম,” হাসলেন ইসাবেলা।
“সেই শিস দেওয়া প্রেত? এসবও এই যুগে কেউ বিশ্বাস করে?”
ঠিক তখনই তীক্ষ্ণ একটা শিসের শব্দ ভেসে এল রান্নাঘরের জানালা দিয়ে। প্রায় পিলে চমকে গেল পুষ্পিতার।
অবাক হয়ে ওরা চাইল জানালার দিকে।
৩
হেসেই চলেছে মিগুয়েল। ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে ইসাবেলা আর পলা।
ছেলেটাকে চেনে পলা। পাবলোদের প্রতিবেশী। একদম পাশের বাড়িটাতেই মা-বাবার সঙ্গে থাকে ছেলেটা। পলার সঙ্গে একই হাইস্কুলে পড়ে, ক্লাসমেট।
ছেলেটার মোটামুটি রকমের লম্বা আর চেহারাতে একটা দুষ্ট দুষ্ট ভাব।
“মিগুয়েল, এইভাবে এখানে শিস বাজানোর মানে কী?” চেঁচিয়ে উঠলো পলা।
“তোমাদের কথা শুনছিলাম, এসব ভূতের কাহিনি এই যুগে কেউ বিশ্বাস করে?” হাসি থামছেই না যেন মিগুয়েলের।
“বিশ্বাস করি এটা তো বলিনি,” ঠান্ডা গলায় বললেন ইসাবেলা, “আমার ছেলের বউকে শুধু দেশের একটা পুরোনো লেজেন্ড শোনাচ্ছিলাম… এই তো…”
“ওঁকে মেক্সিকোর ভূগোল আর ইতিহাস শোনান, জাতি হিসাবে আমরা কতটা সমৃদ্ধ তা বোঝান, তা না করে….”
“মিগুয়েল…” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল পলা, “আমার মা কী করবেন আর না করবেন তা তোমাকে শেখাতে হবে না।”
“আরে যাও যাও, শোন পরশুর হ্যালোইন পার্টিতে আমি এল সিলবন সাজবো, দেখি আমার কী হয়!”
“কী!” থমকে গেলেন ইসাবেলা, “মেয়র কিন্তু এটা পছন্দ করবেন না!”
“আরে ওই বুড়ো হাবড়াটার কথা কে ভাবে? আর পলা তুমিও এইসব বিশ্বাস কর নাকি?”
“বিশ্বাস করি না, কিন্তু তাই বলে আমার মায়ের সঙ্গে এইভাবে কথা বলার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে…”
“আরে রাখো, চললাম আমি.. মোড়ে ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরকে তো বলতে হবে, শিস দেওয়া বালকের পোশাক জোগাড় করতে হবে না?”
গটগট করে হেঁটে চলে গেল মিগুয়েল।
“এই ছেলেটা, স্কুলেও একে কেউ পছন্দ করে না, মানুষকে নিয়ে শুধু হাসাহাসি করে…” বিরক্ত কণ্ঠে বলল পলা।
“তা করুক, কিন্তু ও আসলেই এল সিলবন সাজবে নাকি? ব্যাপারটা ভালো হবে না কিন্তু…”
“বাদ দাও মা ওর কথার কোনো ঠিক আছে?”
চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল পুষ্পিতা। বোঝাই যাচ্ছে ওর শাশুড়ি এল সিলবনের অস্তিত্বের ব্যাপারটা বেশ ভালোই বিশ্বাস করেন।
৪
পরের দিন।
স্কুলে দুপুরের খাবারের বিরতি চলছে। দূর থেকে মিগুয়েলকে খেয়াল করছে পলা আর ওর বান্ধবী ডোনা। পাঁচ-ছয়জন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাটাকে ঘিরে আর তাদেরকে রসিয়ে রসিয়ে কী যেন বলছে সে।
“বুঝলে পলা, শুনলাম মিগুয়েল কালকের পার্টিতে এল সিলবন সাজতে যাচ্ছে,” ফিসফিসিয়ে বলল ডোনা।
“হুম, কাল থেকেই জানি, এসব আবার স্কুলের ছেলেদেরকেও বলে বেড়াচ্ছে নাকি?”
“আরে হ্যাঁ। সবাই তো ওকে নিয়ে সেই উত্তেজনাতে আছে। তুমি তো জানোই, গোটা মেক্সিকোতে কেউই কখনো হ্যালোইন পার্টিতে এল সিলবন সাজে না। হ্যালোইনের রাতে মানুষ আর প্রেতদের জগতের মাঝখানের পর্দাটা আর থাকে না। সত্যিই যদি…”
“আরে বাদ দাও ডোনা, তুমিও এসব বিশ্বাস কর?”
“আসলে…”
“ধুর, কাল আগে পার্টিতে আসুক তো ও। তোমরা আসবে না? কী সাজছ?”
“হার্লে কুইন, তুমি?”
“আমি ভাবছি ওয়ান্ডার ওম্যান সাজব।”
৫
বিকাল হতে চলেছে। মোড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মিগুয়েন আর আন্টনিও।
“এই নাও, তুমি যা যা বলেছিলে সব আছে,” মিগুয়েলের হাতে বাক্সটা তুলে দিতে দিতে বলল আন্টনিও।
“আহহহহ… কালকের পার্টিতে… সেই মজা হবে।”
“আরেকবার ভেবে দেখো মিগুয়েল।”
“হ্যাঁ, এল সিলবন এসে ধরবে আমাকে…”
“তা না, মেয়র হয়তো ব্যাপারটা পছন্দ করবেন না…”
“ওই বুড়োর কথা কে ভাবে?”
৬
জায়গাটা কেমন যেন জঙ্গলের মতো। একা একা হেঁটে যাচ্ছে পুষ্পিতা।
চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার।
ধীরে ধীরে এগোচ্ছে সে। ঠিক তখন শিসের শব্দটা কানে এলো তার।
অনেক দূর থেকে যেন কেউ শিস দিয়ে যাচ্ছে। দিয়েই যাচ্ছে…
একটানা একঘেয়ে সেই শব্দ, যেন পৃথিবীর সব বিষন্নতা ওই শব্দেই মিশে আছে। পুরো শরীরটা কেমন যেন ছমছম করছে ওর।
আর ঠিক তখনই অন্ধকার চিরে ওর সামনে বেরিয়ে এল একটা অবয়ব। লোকটার মাথায় মেক্সিকান হ্যাট, গায়ে ছেড়া কাপড় আর কাঁধে একটা কুঠার…
এল সিলবন… শিস দেওয়া বালক…
আর্তনাদ করে উঠল পুষ্পিতা।
ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল তার। ওর চিৎকারে ততক্ষণে ধরফরিয়ে উঠে বসে পাবলো।
“কী হল পুষ্পিতা? খারাপ স্বপ্ন?”
“পাবলো… এল সিলবন…” পুষ্পিতার গলা দিয়ে যেন আওয়াজ বের হচ্ছে না।
“স্বপ্নে ওকে দেখেছ?”
“কালকের পার্টিতে আমি যাবো না!”
“আহ… ঘুমাও তো পুষ্পিতা। পার্টিতে যাবে কিনা কাল দেখা যাবে…”
“যদি খারাপ কিছু হয়, ওই ছেলেটা এল সিলবন সাজছে!”
“মিগুয়েল? আমিও শুনেছি। ভালো একটা কাজ করছে সে। দীর্ঘকাল ধরে মানুষের মনের কোণে জমে থাকা কুসংস্কারগুলো দূর করা দরকার। সবার বোঝা দরকার যে এল সিলবন শুধুই একটা কল্পনা। ওর মতো করে সাজলে কিছুই হয় না…”
“আ… আমি…”
“ঘুমাও… ঘুমাও।”
বিছানাতে শুয়ে পড়ল পুষ্পিতা, কিন্তু কেন যেন তার বারবার মনে হতে লাগল যে পরেরদিনের পার্টিতে খুব খারাপ একটা কিছু হবে।
৭
সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে।
মিগুয়েলের মা-বাবা দুজনেই পার্টিতে চলে গেছেন। একা বাড়িতে রয়েছে সে।
সাজতে একটু বেশিই সময় লেগেছে তার। তারপরেও একদম নিখুঁত হয়েছে সাজ। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে বাহবা দিল সে।
এখন সব কিছু গুছিয়ে টাউন হলের দিকে রওনা দিতে হবে।
বুড়ো মেয়র ব্যাটার মুখটা দেখতে কেমন হবে ভাবতেই বেশ হাসি পেল তার।
এল সিলবন সাজবে শুনে প্রথমদিকে ওর মা একটু আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু ওর বাবার সমর্থনে সেই আপত্তি ধোপে টেকেনি। ওর ডাক্তার বাবা এইসবে একদমই বিশ্বাস করেন না।
সবকিছু গুছিয়ে রেখে বাড়ি থেকে বেরোবার জন্য প্রস্তুত হল সে।
আর ঠিক তখনই ওর কানে এল বহু দূর থেকে যেন কেউ শিস দিচ্ছে… বেশ দূর থেকে… অনেক দূর থেকে…
৮
জমে উঠেছে পার্টি।
প্রায় পুরো টাক্সভিল শহরই যেন জমায়েত হয়েছে টাউন হলে। একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পিতা। কিছুই সাজেনি সে। এখানে আসার ইচ্ছাই তার ছিল না, অনেক কষ্ট করে রাজি করিয়েছে পাবলো।
টাউন হলের ডান পাশে একটা বিরাট মাঠ আর ওই মাঠের মাঝখানে ত্রিশ-চল্লিশ ফুট উঁচু একটা স্তম্ভের মাথায় একটা ঘড়ি।
জানালা দিয়ে তাকাল পুষ্পিতা। রাত সাড়ে আটটা বাজে।
বেশ কিছুটা দূরে একটা টেবিলে বসে আছেন ইসাবেলা, তিনিও কিছু সাজেননি। ওঁর ঠিক পাশেই বসে আছেন ডা. মোরালেস আর মিসেস মোরালেস। এঁরা মিগুয়েলের মা-বাবা। মিকি আর মিনি মাউস সেজে এসেছেন তাঁরা দুজন।
পলাকে দেখা যাচ্ছে ওর বান্ধবীদের সঙ্গে। ওয়ান্ডার ওম্যানের সাজে বেশ মানাচ্ছে মেয়েটা।
বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মেয়রের সঙ্গে আলাপ করছে পাবলো। সলোমান গ্রান্ডির সাজে বেশ উদ্ভট দেখাচ্ছে পাবলোকে আর অপর দিকে মোটাসোটা মেয়রকে ফ্ল্যাশ গর্ডনের পোশাকে একদমই বেমানান লাগছে।
ইসাবেলার টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল পুষ্পিতা। যেতেই মিসেস মোরালেসের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল ওর।
“আপনার ছেলে কোথায়?” জিজ্ঞাসা করল পুষ্পিতা।
“সাজছে হয়তো, ওর একটু দেরী হবে।”
ততক্ষণে মেয়রকে নিয়ে সেদিকে চলে এসেছে পাবলো।
“মি. মেয়র, এই আমার স্ত্রী পুষ্পিতা, বাংলাদেশের মেয়ে,” পরিচয় করিয়ে দিল পাবলো।
“হাই,” বলল পুষ্পিতা।
“আমি আলবার্তো, এই শহরের মেয়র, আপনি কিছু সাজেননি কেন?” হাসতে হাসতে ওর সঙ্গে হাত মেলালেন মেয়র।
“আসলে ভালো লাগছিল না.. শরীরটা…”
“আরে… একী!” আঁতকে উঠলেন মেয়র। তাঁর চোখ দরজার দিকে।
অবাক হয়ে সেদিকে তাকাল পুষ্পিতা।
ছেড়া জামা-কাপড়, মাথায় মেক্সিকান হ্যাট আর কাঁধে কুঠার। একদম পুষ্পিতা স্বপ্নে যেমনটা দেখেছিল… এল সিলবোনের সাজে ভালোই মানিয়েছে মিগুয়েলকে। কিন্তু মুখে মুখোশ পরে আছে কেন ছেলেটা?
ততক্ষণে একগাদা ছেলে-মেয়ে ঘিরে ধরেছে ওকে। সবাই সাজের তারিফ করছে। বয়স্করা ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
“পুষ্পিতা, মিগুয়েলকে একটু বেশিই লম্বা লাগছে না?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করল পাবলো।
জিনিসটা পুষ্পিতাও খেয়াল করেছে।
“ফাজলামি? এই সাজ?” রাগে ফুঁসছেন যেন মেয়র। প্রায় লাগিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন এল সিলবনরূপী মিগুয়েলের দিকে।
“অ্যাই ছোঁড়া, এই সাজ কেন? জানো না এটা অভিশপ্ত? মুখে আবার মুখোশ কেন?” মেয়রের চিৎকারে পুরো হল যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। কেউ কোনো কথা বলছে না।
“কী হল! উত্তর দাও!”
কোনো উত্তর না দিয়ে অদ্ভুতভাবে শিস দিতে শুরু করল মিগুয়েল। ধীরে ধীরে বেড়েই যেতে লাগল সেই শব্দ।
সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। কেমন যেন বিষণ্ণ সেই শিসের শব্দ।
“মিগুয়েল বেশি বেশি করছে,” ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল পলা। কখন যে ও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পুষ্পিতা বুঝতেই পারেনি।
“বেরিয়ে যাও, এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও,” চিৎকার করে উঠলেন মেয়র।
সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরে দরজার দিকে হাঁটা দিলো মিগুয়েল। কিন্তু শিস থামাল না, শিস দিতে দিতেই বেরিয়ে গেল।
৯
ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো হলই যেন নীরব হয়ে গেছিল। সবাই চুপচাপ, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না।
“অ্যাই যে মি. মেয়র, আমার ছেলেকে এভাবে কেন বের করে দিলেন?” নীরবতা ভঙ্গ করতেই যেন উঠে এলেন মি. মোরালেস।
“আপনার ছেলে? তা মুখোশ পরেছে কেন? মানা করেননি কেন ওকে এই সাজ নিতে,” অবাক হলেন মেয়র।
“কেন মানা করব?”
“এ তো অভিশপ্ত…”
“বাদ দিন মি. মেয়র… এইসব কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করি না। আমার ছেলেকে এভাবে কেন বের করে দিলেন? এই হল কি আপনার বাবার? নির্বাচনে জিতেছেন তাই ভোগ করছেন!”
“মুখ সামলে কথা বলবেন ডাক্তার সাহেব, আমি এই শহরের মেয়র।”
“এই থামো তো…” মি. মোরালেসকে একদিকে টানতে থাকলেন মিসেস. মোরালেস।
ততক্ষণে প্রায় হাতাহাসি অবস্থা।
ঠিক সে সময়েই মাঝে পড়ে গেল পাবলো।
মি. মোরালেসকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাইরে নিয়ে চলল সে। বরাবরই এইসব ব্যাপার মিমাংসা করতে ওর জুড়ি নেই। ওদের পিছু পিছু বাইরে এল মিসেস মোরালেস আর পুষ্পিতা।
ডান পাশের সেই মাঠটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা।
জিনিসটা প্রথমে পুষ্পিতার চোখেই পড়ল।
সেই বিরাট স্তম্ভটার ওপরে একটা ঘড়িটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে এল সিলবনরূপী মিগুয়েল! মুখে মুখোশটা আছেই।
১০
মাঠ এখন গম গম করছে। টাউন হলের প্রায় সমস্ত মানুষই চলে এসেছে মাঠে।
“অ্যাই মিগুয়েল নিচে নেমে এসো,” চিৎকার করলেন মেয়র।
“মিগুয়েল, ওখানে কী?” অবাক কণ্ঠে বললেন মি. মোরালেস। ওদিকে মিগুয়েলের মা কাঁদতে শুরু করেছেন।
“মিগুয়েল.. আমি বলছি নেমে এসো,” আবার চিৎকার করলেন মেয়র।
“মি. মেয়র… ফায়ার সার্ভিস ঢাকুন, মই আনতে বলুন… যেভাবে হোক আমার ছেলেকে বাঁচান,” মেয়রের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস. মোরালেস।
আর তারপরেই ওপর থেকে ভেসে আসতে শুরু করল শিসের শব্দ! এতই জোরে যে পুরো মাঠের মানুষরাই নীরব হয়ে শুনতে লাগল সেই শব্দ।
একমনে শিস দিয়ে চলেছে মিগুয়েল।
তারপরেই লাফ মারল সে…
“মিগুয়েল…” আর্তনাদ করে উঠলেন ওর মা।
পড়ে যেতে লাগল মিগুয়েল… পড়তেই থাকল… আর সবার চোখের সামনেই অর্ধেকটা রাস্তা আসার পর ওর শরীরটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল…
আর কিছু মনে নেই পুষ্পিতার কারণ সে ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে।
১১
পরের দিন মিগুয়েলের খন্ড-বিখন্ড মৃতদেহটা একটা বস্তাবন্দি অবস্থায় পাওয়া গেল টাউন হলের পিছনের ড্রেনে।
পোস্টমর্টেমে জানা গেল যে সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যেই মৃত্যু ঘটেছে তার। তাহলে এল সিলবন সেজে সাড়ে আটটার সময়ে কে গেছিল টাউনহলে? কে সেই মুখোশধারি?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।
পরিশিষ্ট
ওই ঘটনার এক সপ্তাহ পরেই বাংলাদেশে ফিরে আসে পাবলো আর পুষ্পিতা।
এখনো মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে এল সিলবন কে স্বপ্নে দেখে সে। কেউ তার সামনে শিস দিলে চমকে ওঠে।
কী করে মিগুয়েলের মৃত্যু হয়েছিল, কে বা কারা তাকে হত্যা করেছিল কিংবা সেদিন টাউন হলে কে এল সিলবন সেজে গেছিল, এক মাঠ লোকের সামনে কী করে অদৃশ্য হল সে… সেইসব রহস্যের সমাধান আর হয়নি, হয়তো কোনোদিনই হবে না।
তবে টাক্সকোতে আর কখনোই কোনো হ্যালোইনে পার্টিতে কেউ এল সিলবন সাজেনি।
Tags: fantasy, kalpabiswa y7n1, দীপ ঘোষ, ফ্যান্টাসি, রনিন, লুৎফুল কায়সার