জাম্বুবানের সন্ধানে
লেখক: তনুময় দত্ত
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
১
প্রবল বর্ষণের মধ্যে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি আর রবার্ট ঢুকতে পেরেছি একটা গুহায়। দলের বাকি দুই গাইড কোথায় আছে জানি না। পাহাড়ে পা হড়কে পড়ে গিয়েছিলাম। রবার্ট টেনে না ধরলে এখন স্রোতে ভেসে যেতাম হয়তো। গুহায় শুয়ে শুয়ে হাঁপ ফেলছি, রবার্ট দেখলাম উঠে টর্চ বার করে গুহাটাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করা শুরু করেছে। সেটাই বুদ্ধির কাজ। বাঘ-সিংহ নেই, তবে ভাল্লুক তো থাকতেই পারে, সাপ থাকলেও দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আর এখানে যে কোনোদিন মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি সেটা বলাই বাহুল্য। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দেখি রবার্ট গুহার আরো ভেতরে ঢুকছে, তার হাবেভাবে মনে হয় সে কিছু একটা অবিশ্বাস্য খুঁজে পেয়েছে। সে চেঁচিয়ে বলল, “বোস, উঠে এস, দিস ইস ইনক্রেডিবল।”
২
ড. রবার্ট কুপারের সঙ্গে আমার আলাপ শিকাগোয় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রাইমেটোলজি কনফারেন্সে। আমার গবেষণা নীলগিরি পাহাড়ে-জঙ্গলে থাকা লায়ন-টেলড ম্যাকাক নিয়ে। আমার এবং ড. কুপারের টক ছিল একই সেশনে। আমার গবেষণা নিয়ে বাকি শ্রোতারা বিশেষ তাপ-উত্তাপ দেখাননি, দুটো মামুলি জিজ্ঞাসাতেই প্রশ্নোত্তর পর্ব সমাধা হয়। কিন্তু ড. কুপারের ভাষণ শুরু হতেই যেন অনেকে জেগে উঠলেন। বর্নিও দ্বীপে ওরাংওটাংদের আচরণ কীভাবে জঙ্গল ধ্বংসের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে, তাই নিয়েই তার গবেষণা। লোকজনের সর্বাধিক আপত্তি দেখলাম একটি বিষয়ে। যখন ড. কুপার জানালেন কীভাবে ওরাংওটাংদের ব্যবহার বাঁদর কম, মানুষের কাছাকাছি বেশি চলে আসছে। শেষের স্লাইডে লেখা ছিল, যে বিবর্তন হতে হাজার হাজার বছর লেগেছে, তা কি মানুষের কার্যকলাপের চাপে পড়ে কয়েক দশকের মধ্যে হয়ে যাবে? লক্ষ করলাম, অনেক প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক ড. কুপারের গবেষণার সততাকেই প্রশ্ন করছেন। ব্যাপারটা বিতর্কিত সন্দেহ নেই, কিন্তু এত বিরোধিতার কারণ কি অন্য কিছু? তাও ভাগ্যিস রবার্ট কুপার সাদা চামড়া এবং আমেরিকান। আমাদের মতো দেশের কেউ এমন গবেষণা করলে বোধহয় কোনো কনফারেন্সে ডাকই পাবে না। পরের বিরতিতে ওর সঙ্গে আলাপ করলাম। বয়স চল্লিশের ওপর, সুন্দর সুঠাম চেহারা, ইন্দোনেশিয়ার রোদে জলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর ছাপ তার মুখে স্পষ্ট। “গুড আফটারনুন, ড. কুপার” বলে আলাপ করতেই, উনি আমার ট্যাগটা পড়ে বললেন, “ড. বাসু, ইন্ডিয়ান?” বসু শব্দটা ঠিক সুবিধা করতে পারছেন না দেখে বললাম, “সুহাসিনী বোস, বোস অ্যাজ ইন বোসন।” ইঙ্গিতটা পুরো বুঝতে পারলেন কিনা জানি না, হেসে বললেন, “কল মি রবার্ট। হলে বোধহয় একমাত্র তুমিই যে আমাকে কোনো প্রশ্ন করনি। ডু ইউ অলসো থিঙ্ক মাই রিসার্চ ইজ রাবিশ?”
“একেবারেই তাই নয় রবার্ট। আমার গবেষণার মধ্যেও ম্যাকাকদের মধ্যে এমন অনেক আচরণ দেখেছি যেটা সত্যি মানুষের কাছে শেখা। আমার স্টাডি গ্রুপের এক সদস্য মানুষের মতো বুড়ো আঙুল বার করে হাত নাড়িয়ে গাড়ি থামিয়ে খাবার চাইছে, নিজের চোখে দেখা। দুর্ভাগ্যবশত এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটে, ছবি তুলতে পারিনি। তাই তথ্য প্রমাণ নেই।”
“বোস, আমার মনে হয় তুমি আমার গবেষণাটা উপলব্ধি করেছ। ইন্ডিয়ানদের মধ্যে আমি আগেও এটা লক্ষ করেছি, বোধহয় তোমাদের সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে বাঁদরদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে। চলো, আজ সন্ধের অনুষ্ঠানে দেখা হবে।”
সেদিন সন্ধের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বসে রবার্টের সঙ্গে দীর্ঘ গল্প হয় আমার। কাজের-অকাজের। আমাদের গবেষণার ক্ষেত্রে কোলাবোরেশন এবং বন্ধুত্বের সূচনা সেখান থেকেই।
৩
আমার ছাত্র, তোমো রিবা, অরুণাচলের ছেলে। পড়াশুনোয় তুখোড়, আচার-ব্যবহারও অত্যন্ত ভালো। এই অভিযানের গোড়ার কথাটা তার সূত্রেই। একবার ক্রিসমাসের ছুটির সময় বাড়ি থেকে ফিরে এসে সে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আমায় জানাল সে নাকি এক নতুন রকমের এপের সন্ধান পেয়েছে! তোমো বড় হয়েছে ইটানগর শহরে। এই ছুটিতে জীবনে প্রথমবার সে তার প্রত্যন্ত জঙ্গলে অবস্থিত গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। সেখানে তার পিতামহীর এক বাল্যবন্ধু তাকে জঙ্গলের একধরণের অধিবাসী সম্বন্ধে বলেছেন। তারা নাকি দল বেঁধে থাকে, আকৃতিতে একদম মানুষের মতো, অথচ তারা মানুষ নয়। না আদিবাসী নয় তারা— আদিবাসীদের হেন প্রজাতি নেই যাদের ৮০ বছরের এই বৃদ্ধা চেনেন না। বর্ণনা শুনে তোমো নিশ্চিত এরা নতুন কোনো এপ প্রজাতির প্রতিনিধি। গোটা পৃথিবীতে গ্রেট এপ অথবা হোমিনিডের আটটা প্রজাতি। তারা মোট চারটে জিনাসের অন্তর্গত— Pongo (ওরাংওটাং), Gorilla (গরিলা), Pan (শিম্পাঞ্জি, বোনোবো) এবং Homo (মানুষ)। মানুষ বলতে আধুনিক মানুষ অর্থাৎ Homo sapiens বাদে বাকি প্রজাতি বিলুপ্ত। একটা নতুন গ্রেট এপ খুঁজে পাওয়া প্রাইমেটোলজির দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলে দেবে। কিন্তু গবেষণার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক করল। খবরটা তো তোমোর গ্রামের গল্পই। তাকে আবার প্রশ্ন করতে বলল, “বিশ্বাস করছেন না তো ম্যাডাম। আসলে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে জঙ্গলের ধারে থাকতেন, তার মধ্যে অনেকটা জায়গাই অনাবিষ্কৃত। সেই জঙ্গলের ভেতরে কাউকে যেতে দেওয়া হয় না। গ্রামের মানুষও বাইরের জগতের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ রাখে না। এই প্রথম আমাদের প্রজন্মে এসে লোকজন বেরোচ্ছে, শহরে গিয়ে আস্তানা গাড়ছে।” বোধহয় চোখেমুখে আমার অবিশ্বাসটা প্রকট হয়েই উঠেছিল। একটু অনুতপ্ত হলাম। বিজ্ঞানে কোনো কিছুই যুক্তিপ্রমাণ ছাড়া উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়। আর একথাটাও সত্যি যে ভারতবর্ষের কোথাও যদি এমন স্থান থেকে থাকে যেখানে মানুষের পা এখনো পড়েনি, তা এই রাজ্যে। স্বাধীনতার পর থেকে আদিবাসী স্বার্থরক্ষা এবং জঙ্গল বাঁচাবার তাগিদে এই অঞ্চলের বেশ কিছুটা পরিসর কাঠুরের কোদাল আর চোরাশিকারীর গুলি থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু আর কতদিন? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী আক্রমণের সামনে কতদিন আবৃত থাকতে পারবে এই রহস্যঘন অরণ্য? ব্যাপারটাকে তাই উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। কার্যপ্রণালী ঠিক করে ফেললাম।
৪
একমাস পরের কথা। তোমোর আদিগ্রাম মেচুকিং-এ সেখানকার প্রধানদের সামনে বসে আছি। ইটানগর থেকে প্রায় ছশো কিলোমিটার দূরে দিবাং অভয়ারণ্যের পশ্চিমে এই গ্রাম। একমাস কেটেছে এখানে প্রবেশের নানাবিধ পারমিট জোগাড় করতে। কিন্তু এই গ্রামের পূর্বদিকে যে পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চল, সেখানে প্রবেশের অনুমতি এখনও পাইনি। প্রথম অবাক করা ব্যাপার, পাঁচ প্রধানের তিনজন মহিলা। দ্বিতীয়, তোমো আমার সঙ্গে না এলেও পরিবারের লোক মারফত খবর জানিয়ে দেওয়ায় আমার অতিথি আপ্যায়ন অপ্রত্যাশিত রকমের সুখকর। বুঝলাম এরা খাতায় কলমে অশিক্ষিত হলেও শিক্ষক বা গুরুর কদর ভালোই বোঝে। গৌহাটি থেকেই একজন দোভাষী আমার সঙ্গে এসেছে। তার সাহায্যেই কথাবার্তা হচ্ছিল। কুশলবার্তা বিনিময়ের পর একজন বৃদ্ধা প্রধান উঠে সামনে এসে আমার চোখমুখ টিপে দেখতে শুরু করলেন। মিনিট দুয়েক চলার পরে ব্যাপারটা অস্বস্তিকর পর্যায়ে যখন চলে যাচ্ছে, তখন দেখলাম বৃদ্ধা হাতের কিছু একটা ভঙ্গিমা করলেন আর তাতে বাকি প্রধানদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। মনে হল পরীক্ষায় আমি পাশ। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমার পরীক্ষক হলেন তোমোর ঠাকুমার সেই বান্ধবী। এবার প্রধানরা উঠলেন, আমায় ওদের সঙ্গে যেতে বললেন। হাঁটতে হাঁটতে এবার আমরা গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখলাম একটা কাঠের বানানো বাড়ি। কিন্তু তার কাঠামোটা বাকি বাড়িগুলোর মতো নয়। বৃদ্ধা আমার জুতোর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করাতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল— বাড়িটা আসলে দেবালয়। জুতো খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখি এক মানুষপ্রমাণ দেবতা যার সামনে সবাই হাঁটু গেড়ে বসলেন। আমিও ভদ্রতাবশত বসতে বসতে মূর্তিটাকে লক্ষ করলাম। মানুষের সারা গায়ে বনমানুষের মতো লোম। চেনা চেনা লাগছে ছবিটা। হঠাৎ মনে পড়ে গেল স্কুলে ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ করার সময় ক্লাস ফোরের অবিনাশকে জোর করে একটা কস্ট্যুমে ঢোকানো হয়েছিল। মানুষের চোখ-মুখ-শরীর ঢাকা বনমানুষের পোষাক – জাম্বুবান।
৫
এর পরের ছ-মাস কেটেছে গবেষণার জন্য গ্রান্ট আর পারমিট পেতে। ড. রবার্ট কুপারকে রাজি করানোর জন্য আমার প্রাথমিক গবেষণাই যথেষ্ট ছিল। রবার্টের নর্থ ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে ইন্দো-ইউএস কোলাবোরেটিভ গ্রান্ট থেকে আমাদের অভিযান ও পরবর্তী গবেষণার জন্য অনেকটা টাকা অনুদান পাওয়া গেছে। ফলে স্থানীয় ভাষা ও জঙ্গলের সঙ্গে পরিচিত তিনজন গাইড ও দোভাষীকে তিন মাসের জন্য আমরা নিয়োগ করতে পেরেছি। অবিশ্বাস্যভাবে স্থানীয় বনদপ্তরের অনুমতি পেতেও আমায় বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। আমার প্রথম যাত্রায় সেই বৃদ্ধা আমার কপালে হাত বুলিয়ে যে ঠিক কী বুঝেছিলেন আর বাকিদেরই বা কী বলেছিলেন জানি না, কিন্তু তারপর থেকে স্থানীয় মানুষের আমার সঙ্গে অদ্ভুত সখ্যতা হয়ে যায়। এবারে যখন রবার্টকে নিয়ে সেখানে গেলাম, সেই বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি অসুস্থ, কিন্তু তার একটি বার্তা একজন কানে কানে দিয়ে গেল। আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষাজ্ঞানে যতটুকু বুঝলাম তার অর্থ, “সাদা চাঁদ সব খায়, কালা চাঁদ সামলায়”। মানেটা বুঝলাম না কিন্তু সাদা চাঁদের ইঙ্গিত সম্ভবত রবার্টের প্রতি, তাই কথাটা ওকে জানাইনি। সে জাম্বুবানের মূর্তি দেখে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। রামায়ণ তার পড়া, ভারতীয়-ইন্দোনেশীয় দুটো সংস্করণই। সে বলল, “ইস, কেন যে ছবি তুলতে আপত্তিতে রাজি হয়ে গেলে তুমি, আমার ভ্লগের কি দারুণ একটা কভারশট পেতাম, In search of Jambuban, the missing link. নামটা তুমি কিন্তু পারফেক্ট দিয়েছ, জাম্বুবান। আমারও মনে হয় আসলে সে গ্রেট এপ, ভাল্লুক নয়। মানুষ, গ্রেট এপ, লঙ্গুর, ম্যাকাকস সবাই মিলে যুদ্ধ করছে। ফ্যান্টাস্টিক।”
মন্দিরের ভেতরে সম্ভব না হলেও বাইরেই শুরু হল রবার্টের ভ্লগ— আমার সাক্ষাৎকার দিয়ে। আমি প্রথমবার এখানে আসার কাহিনিটা বলব। রবার্ট শুধু আমায় নির্দেশ দিল, তুমি যা শুনেছ সেটাই বলবে, তবে সায়েন্টিফিক পেপার লেখার ঢং-এ নয়, একটু নাটকীয় গল্প বলার ভঙ্গিমায়, যেমন ডিসকভারি ইত্যাদি টিভি চ্যানেলের তথ্যচিত্র হয়। অভিনয় করিনি জীবনে। গল্পটল্পও লিখিনি। কিন্তু গতবার গ্রামের মানুষদের কাছে শোনা লোকগাথা গড়গড় করে মুখে চলে এল, “এই গ্রামের অধিবাসীরা মনে করেন, অরণ্যের মধ্যে বনমানুষ সদৃশ এই প্রাণীরা বাস করছেন আদিকাল থেকে। ভয় ও ভক্তি দুটো কারণেই তারা জঙ্গলের মধ্যে বিশেষ প্রবেশ করেন না। এদেরকে দেবতাসুলভ শ্রদ্ধার কারণ এদের বুদ্ধি নাকি মানুষের চেয়ে প্রখর। তার প্রমাণ এই তির যা জঙ্গলের কাঠচুরি করতে ঢোকা এক যুবকের গায়ে লাগে। গ্রামের প্রধানরা আমায় এটা উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। সাধারণত তাদের দেখা বা শোনা না গেলেও এভাবে কদাচিৎ তাদের অস্তিত্বের পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রামবাসীদের কোনো এক পূর্বপুরুষ নাকি একবার অসমসাহসের পরিচয় দেখিয়ে তাদের গুহায় প্রবেশ করতে পেরেছিলেন এবং খুব কাছ থেকে তাদের দলকে দেখেও ফেলেছিলেন। তিনিই ফিরে এসে এই দেবতার মূর্তি নির্মাণ করেন।”
ক্যামেরা অফ হলে রবার্ট আমায় বলল, “গুড জব, বোস। শুধু পরের বার থেকে চেষ্টা করবে আরেকটু মিস্ট্রি আনতে, অ্যাজ ইফ তুমি এতে বিশ্বাস কর।”
হেসে বললাম, “গোটা ভারতে ঘুরে দেখলে এত রকমের দেবদেবী পাবে যে, সব যদি সত্যি হয় তাহলে জীবনবিজ্ঞানের বই নতুন করে লিখতে হবে।”
“সেই জন্যই তো আমার ইন্ডিয়াকে এত ইন্টারেস্টিং মনে হয়।”
“তুমি একা নও, রবার্ট। ২৩০০ বছর আগে এক ম্যাসিডোনিয় যুবকেরও তাই মনে হয়েছিল।”
ইঙ্গিতটা রবার্ট বুঝল কি না ঝুপ করে নামা সন্ধের মৃদু আলোয় ঠাওর করতে পারলাম না।
৬
দোভাষীর প্রয়োজন নেই, সে ফিরে গেছে। আমাদের দুজন গাইড কাজ চালানোর মতো ইংরিজি জানে। কিন্তু এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমরা যদি অন্ধ হই, তাদের চোখেও চালশে। এই অঞ্চলের অরণ্য প্রথম কয়েকদিন স্বাভাবিকই ছিল, গত দু-দিনে তার চরিত্র বদলাতে শুরু করেছে। অনেক রকম গাছ আমরা দেখেছি যা কোনোভাবেই পার্বত্য অঞ্চলে থাকার কথা নয়, যেমন খেজুর ও নারকেল। ফলের বৈচিত্রও বেড়ে গেছে মনে হয়। ভূপ্রকৃতি সবারই অজ্ঞাত। আমরা পার্বত্য গুহা ও ঝরনার খোঁজ করে চলেছি এবং তার সঙ্গে সন্ধান বুদ্ধিমান জীবের উপস্থিতির কোনোরকম প্রমাণের। কিন্তু গত সাত দিন ভাগ্য অপ্রসন্নই থেকেছে। তার মধ্যেই আজ দুপুর থেকে হঠাৎ শুরু হল আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি। খোলা জায়গা থেকে তাঁবু তুলে আমরা পাহাড়ের মধ্যে ছোটোখাটো গুহা খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়লাম ভিজতে ভিজতেই। পিছল পাথর বেয়ে উঠতে গিয়ে বিপদটা হল। আমার পিছনে আর্তনাদ শুনে বুঝলাম আমাদের অহমিয়া গাইড নিপু পা পিছলে পড়ে গেছে নীচে। আরেক সঙ্গী দোর্জে বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল, “স্যার ম্যাডাম, আপনারা এখানে দাঁড়াবেন না, যেখানে সেখানে ধস নামে এখানে, আস্তে আস্তে এগোতে থাকুন। আমি নিপুকে নিয়ে আসছি।” অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগিয়ে গেলাম আমরা।
৭
তারপর অনেক টানাহেঁচড়া করে কোনোমতে এই গুহাতে ঢুকেছি। নিপু আর দোর্জে এখনো এসে পৌঁছায়নি। আমার বাঁ পায়ের গোড়ালিটা হয়তো মচকে গেছে। কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই এখন কারণ এই গুহার মধ্যেই রবার্ট কিছু একটা জিনিস দেখেছে যাতে ওর চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেছে। পিঠের ব্যাগ থেকে টর্চটা বার করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমিও রবার্টকে যোগ দিলাম গুহার ভেতরে। আমাদের চারিদিকে গোটা দেওয়াল জুড়ে অসংখ্য ছবি এবং লেখা। রবার্ট টর্চ ধরে লাইনগুলোর দিকে দেখছে। আমি বললাম, “পুরোটাই সংস্কৃতে লেখা। আমি পড়তে পারছি, কিন্তু মানে বোঝা আমার কর্ম নয়।”
“ছবিগুলো দেখো শুধু, কী অদ্ভুত।”
সত্যি অবাক করার মতোই সব ছবি। জ্যামিতিক গণনা, ত্রিকোণমিতির হিসেবনিকেশ। কিন্তু এইসব অঙ্ক এখানে কে করেছে? আমার উচ্চমাধ্যমিক অবধি ভালোভাবে অঙ্ক শেখা জ্ঞান দিয়ে বৃত্ত, ত্রিভূজ, চতুর্ভূজের কোলাজের কোনো গূঢ় অর্থ বার করতে পারলাম না। আমাদের ফেলে আসা গ্রামের লোক এই হিসেব করেছে হতেই পারে না। তার উপরে সংস্কৃত! এই গ্রাম, এই রাজ্যে তো নয়ই, গোটা দেশে এখন কতজন দেওয়ালজোড়া কাব্য লিখতে পারবে এই ভাষায়? আমাদের বিস্ময়ের শেষ সেখানেই নয়। আরো দশ পা ভেতরে ঢুকে আরেকটা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে রবার্ট স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। টর্চ ফেলতেই দেওয়াল লিখন জলের মতো স্পষ্ট। আঁকাবাঁকা অচেনা চিহ্ন, কিন্তু তাদের সংখ্যা ও পুনরাবৃত্তি দেখে সেগুলো যে সরগমের এক-একটি সুর তা বুঝতে সময় লাগে না। দেওয়াল জুড়ে স্বরলিপির পর স্বরলিপি লিখে গেছেন কোনো বন্য মোৎসার্ট বা বীঠোফেন। রবার্টকে দেখে মনে হল পুরো কনসার্টটা নিজের মনেই বাজিয়ে ফেলবে। আমি আরো এগিয়ে গেলাম, পায়ের ব্যথা আর বিব্রত করছে না, কারণ যে অরূপরতনের সন্ধান আমরা পেয়েছি, গবেষক জীবনে এর চেয়ে বড় আবিষ্কার করতে পারা সম্ভব নয়। গুহার দেওয়ালের আঁকা দেখতে দেখতে চলেছি, পশুপাখির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি, গাছের ফুল-ফল-শিকড়ের ছবি। বোধহয় এখানে জীবনবিজ্ঞান বা কবিরাজির ক্লাস হত। তারপরে আবার পাহাড় পর্বতের ছবি, এই জায়গার ভৌগোলিক বিবরণ। প্রায় একটা প্রাকৃতিক মানচিত্র বলা যায়। ছবি তুলে রাখতে হবে মনে হতেই খেয়াল করলাম রবার্ট সেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। তাকে ডাকব বলে পিছন ঘুরতেই যে ছবিটা দেখলাম তার জন্য এত বিস্ময়ের জোয়ার সামলেও প্রস্তুত ছিলাম না।
একটা গোটা দেওয়াল জুড়ে মরুপ্রান্তরের ছবি। তার মধ্য থেকে উঠেছে তিনটে ত্রিকোণাকৃতি সৌধ – যাদের বিশ্বখ্যাত নাম গিজার পিরামিড।
৮
পিরামিডের ছবি দেখার পর এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। ওই গুহায় আঁকা ছবি ও বৈজ্ঞানিক হিসেবপত্রের ছবি ও ভিডিয়ো তোলাও হয়েছে অনেকবার। সেদিন বৃষ্টিতে উপর থেকে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙেছে নিপু, তাই দোর্জে তাকে নিয়ে ইটানগরের হাসপাতালে ফেরত গিয়েছে। অভিযানে আমরা দুজনেই টিকে আছি। গুহার ওই অবিশ্বাস্য ছবি দেখার পর আমাদের মধ্যে যে অশেষ আশার সঞ্চার হয়েছিল, গত সপ্তাহে তা মিলিয়ে গিয়েছে। তার কারণ দুটো— প্রথমত ওই গুহার আশপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনো বুদ্ধিমান জীবের সন্ধান পাওয়া যায়নি। চেনা-অচেনা কোনো প্রাইমেট জাতির প্রাণীই চোখে পড়েনি। তবে কি এরা এখান থেকে সরে গেছে আরো দুর্গম অরণ্যের মধ্যে? দ্বিতীয়ত, আমরা বুঝতে পেরেছি এই ছবি দেখিয়ে আমরা কিছুই প্রমাণ করতে পারব না, কারণ এগুলো দেখে মনে হয় মানুষের হাতেই আঁকা আর এগুলো স্পেনের আলতামিরা বা ফ্রান্সের লাসকোর মতো সুপ্রাচীন গুহাচিত্রও নয়। মনে হবে আমরা নিজেরাই ছবি আঁকিয়ে বনমানুষের আঁকা বলে প্রচার করছি। অধুনা এরকম তথ্যবিকৃতি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত গবেষকদের পেপারেও পাওয়া যাচ্ছে প্রায়ই। তাই সাধু সাবধান।
আমরা ঠিক করেছিলাম আরো এক সপ্তাহ অনুসন্ধান চালিয়েও যদি কিছুই না পাই, এই পিরামিড গুহা অবধি আসার মানচিত্রটা বানিয়ে আপাতত ফিরে যাব। পরের বার আরো লোকলস্কর নিয়ে আসা যাবে। কিন্তু ভাগ্যদেবী আবার সুপ্রসন্না হলেন। একসপ্তাহ আমাদের অন্ধের মতো জঙ্গল হাতড়াতে হল না। দ্বিতীয় দিনের শেষেই ঘটল ঘটনাটা। রবার্ট একঘেয়েমি কাটাতে প্রজাপতির ছবি তোলা শুরু করেছিল। ক্যামেরায় চোখ রেখে এগোতে এগোতে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা গর্তের মধ্যে। তাকে আমি হাত ধরে টানতে যাচ্ছি, পিছন থেকে আমাকে কেউ একটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিল গর্তে। তারপর মাথায় একখানা বাড়ি। আর কিছু মনে নেই।
৯
যখন জ্ঞান হল, বুঝলাম চোখ বন্ধ, হাত-পা বাঁধা। আমাদের কাঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাশেই বুঝলাম রবার্টের শরীর, তার মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ বেরোচ্ছে। গলা নামিয়ে ডাকলাম “রবার্ট, রবার্ট।” একটু পরে তার গোঙানি থামল, মনে হয় হুঁশ ফিরেছে, “ইউ আর অ্যালাইভ, বোস, থ্যাঙ্ক হেভেনস।” বললাম, “এরা কারা? কী হচ্ছে বুঝতে পারছ?” রবার্ট ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, “উই আর বিইং কিডন্যাপড।” পরক্ষণেই কথাটার মানে বুঝতে পেরে চরম উল্লসিত হয়ে বলল, “উই আর বিইং কিডন্যাপড!” কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছিল সে কারণ শুনলাম আমাদের অপহরণকারীদের কণ্ঠে গুঞ্জন। আমরা চুপ করে গেলাম। ক্লান্তি আর ব্যথার ঘোরে ঘুম চলে এল।
১০
আবার চেতনা ফিরল যখন বুঝলাম রবার্ট আমার কানের কাছে “বোস, বোস” করে ডাকছে। হাত-পা পিছনে বাঁশের সঙ্গে বাঁধা। চোখ খুলতেই সামনে দেখলাম ভয়াবহ এক মূর্তি— জাম্বুবান। দশাসই মানুষের চেহারায় বনমানুষের গায়ের মতো বড় লোম। আরো চিন্তার বিষয় সে একা নয়, চারিদিকে অজস্র অনাবিষ্কৃত গ্রেট এপ। এদেরই এক বসতির মধ্যে আমাদেরকে এনে আটক করা হয়েছে। এই পার্বত্য অঞ্চলে পাশাপাশি অনেকগুলো গুহা, তাদের সামনে আগুন জ্বলছে। দেখে অজন্তার কথা মনে হয়, এই সব গুহাতেও কি পিরামিড গুহার মতো অত্যাশ্চর্য সব আঁকা আর লেখা? আবিষ্কারের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করার আগেই শুনলাম রবার্ট বলছে, “ওরা নিজেদের মধ্যে কী ভাষায় কথা বলছে শোনো, বোধহয় তুমি চিনতে পারবে।” সামনের জীবটি চেঁচিয়ে ধমকালো, নিতান্তই জান্তব গর্জন। কিন্তু পরক্ষণেই দূর থেকে একটা ডাক ভেসে এলো, জানোয়ারের শব্দ নয়, পরিশীলিত উন্নত মানুষের ভাষা— সংস্কৃত। গুহায় লেখা ছিল সংস্কৃতেই। তার অর্থ এই মৃতপ্রায় ভাষা আদিম অরণ্যের বাসিন্দারা এখনও ব্যবহার করে, কিন্তু তারা শিখল কীভাবে? মানুষের জ্ঞানের গ্রন্থাগারে এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে না।
“বোস, তুমি সংস্কৃত বলতে পারো?”
রবার্টের প্রশ্নের উত্তরে নিজের অজ্ঞতা জাহির করতে হল, “একটু, আধটু, দু-চারটে শব্দ।”
“তাতেই হবে।”
ক্লাস সিক্স থেকে এইট তিনবছর স্কুলে সংস্কৃত পড়েছি, তাও অবহেলা করে। স্কুলের সংস্কৃত ম্যাডাম ইন্দ্রাণীদিকে প্রণাম জানিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, “অহম শান্তিকামী। মুক্তিং দেহি। মুক্তিং দেহি।” সামনের প্রাণীটি আমার মুখে অপ্রত্যাশিত ভাষা শুনে চমকালেও বোধহয় কথাটা বুঝল, কারণ সে তখনই ছুট দিল গুহার দিকে। কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে রবার্ট বলল, “ওয়েল ডান, বোস। লড়াই করে এদের সঙ্গে আমরা দুজনে পারব না, কিন্তু আমাদের এখান থেকে পালাতেই হবে। উই মাস্ট লেট দ্য ওয়ার্ল্ড নো।”
সেই একই কথা আমার মাথাতেও ঘুরছে। কিন্তু কীভাবে? আমরা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। ব্যাগপত্রও যে কোথায় কে জানে? পালাতে পারলেও কি সভ্যসমাজে ফিরতে পারব? ভাবতে ভাবতে দেখি দলে দলে জাম্বুবানরা আমাদের দিকে আসছে। আকৃতি প্রকৃতির ফারাক দেখে মনে হল, দলে বাচ্চাবুড়ো স্ত্রীপুরুষ সবাই আছে। বুড়ো গোছের একজন আমাদের সামনে এগিয়ে এসে খুঁটিয়ে লক্ষ করতে শুরু করল। আমাকে বিশেষভাবে। এতক্ষণে সামনে থেকে আমিও দেখতে পেরে বুঝলাম এদের মুখাকৃতি মানুষের কাছাকাছি, বাকি এপদের থেকেও অনেকটাই বেশি। বয়োবৃদ্ধ হাতের ইশারায় সবাইকে শান্ত হতে বললেন, সবাই সঙ্গে সঙ্গে বসেও পড়ল চুপচাপ। বেশ পরিশীলিত প্রজাতি তো। ইনিই তাহলে দলপতি। আমাকে প্রশ্ন করলেন সংস্কৃতে, শুনে মনে হল বলছেন, “ভবান ভারতবাসী খলু?” উৎসাহের সঙ্গে উত্তর দিলাম, “অহম ভারতবাসী। সঃ আমেরিকান। শান্তিকামী, মুক্তিং দেহি।” আমেরিকান ব্যাপারটা কী সেটা বোধহয় উনি বুঝলেন না, ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে রবার্টকে দেখছেন, তখন বললাম, “সঃ মম বান্ধব।” দলপতি বোধহয় আশ্বস্ত হলেন, তার ইশারায় আমাদের বন্ধনমুক্তি হল। নিয়ে যাওয়া হল গুহার সামনে। গোটা দলের সঙ্গে বসে আগুনে পোড়ানো মাংস ও ফলমূল খেতে মন্দ লাগল না। আমাদের পিঠের ব্যাগগুলো দেখলাম এরা নিয়ে এসেছে, সেগুলো খুলে সন্দেহজনক কিছু আছে কি না খুঁটিয়ে দেখছে একদল উৎসাহী জাম্বুবান। খাওয়া চলাকালীনই ভাঙা ভাঙা সংস্কৃতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমরা বৈজ্ঞানিক। কোনো অসাধু উদ্দেশ্যে আমরা এখানে আসিনি। আপনাদের সম্বন্ধে জানতেই এখানে অভিযান। জানি না ভারতীয় আর মহিলা বলেই কি না আমার উপর এদের একটু আস্থা জন্মেছে মনে হল। দলপতির সঙ্গে দীর্ঘ কথাবার্তা হল এবার অদ্ভুত উপায়ে। বৃদ্ধ কিছু বলেন, আরেক জাম্বুবান নেচেকুঁদে অভিনয় করে দেখায় তার মানে, অনেকটা মূকাভিনয় আর মূক-বধিরের সাংকেতিক ভাষার মাঝামাঝি। রবার্ট মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ছুড়ছিল, আমি সেগুলো এদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম তৎসম সব্দ জুড়ে জুড়ে। কিন্তু সবার আগে আমাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হল, এখানে আমরা যা দেখেছি, শুনেছি তা কখনো কোনোভাবেই প্রকাশ করা চলবে না। ভেবেছিলাম রবার্ট আপত্তি করবে, কিন্তু সেও সম্মত হয়ে গেল।
দলপতি তাঁদের রোমাঞ্চকর ইতিহাসের যে গোপন পাতা খুলে বসলেন তার সারমর্ম এই, “আমাদের সঙ্গে তোমাদের কোনো শারীরিক পার্থক্য ছিল না পাঁচ হাজার বছর আগেও। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাকি মনুষ্যজাতির থেকে শুধু এগিয়ে ছিলেন মানসিক ক্ষমতায়, মস্তিষ্ককোষের ব্যবহারে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবিশ্বাস্য যেসব প্রাচীন কীর্তির নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়, তার পিছনে কৃতিত্ব অনেকটা তাঁদেরই, যেমন মিশরের পিরামিড।” মিশর ও পিরামিড শব্দগুলো যদিও উনি বলেননি, মাটিতে গাছের ডাল দিয়ে ছবি এঁকে দেখানোর ফলে আমাদের সন্দেহের অবকাশ ছিল না। এবার থেকে এঁদের বনমানুষ না বলে অতিমানব বলেই উল্লেখ করব। গিজার পিরামিডের জ্যামিতিক হিসেব, এমনকী তার যে চতুর্ভূজ নয়, অষ্টভূজাকৃতি ভূমিস্থ তল, এবং সেটাও বিশুদ্ধ সংস্কৃতে শুনতে পাবো ভারতবর্ষের কোণে পান্ডববর্জিত এক গহন অরণ্যে বসে, এ অভিজ্ঞতা অকল্পনীয়। রবার্টের চোখমুখেও বাঁধহারা বিস্ময়। সে উন্নত গুহাবাসী বা হোমো ইরেক্টাসের আত্মীয় কাউকে খুঁজতে এসেছিল এখানে, যা পেয়েছে তার মূল্য বিজ্ঞানের জগতে নির্ধারণ করার সামর্থ্য আমাদের কারুরই নেই। দলপতি বলে চললেন, “এই অতিমানবরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করে বিভিন্ন সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে অতি শীঘ্রই সকল বিষয়ে চূড়ান্ত পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ভ্রমণকারী বিজ্ঞজনেরা হয়ে ওঠেন নিজেদের কালেই কিংবদন্তী। কেউ ভাবত ওঁরা ঈশ্বরের সন্তান, বা জাদুকর কিংবা শয়তানসিদ্ধ, কিন্তু ভয় ও শ্রদ্ধা করত সকলেই। বৌদ্ধিক ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশে তারা বিজ্ঞানে-প্রযুক্তিতে সাধারণ মানুষদের থেকে কয়েক হাজার বছর এগিয়ে যান। এই চরম ঔৎকর্ষের কালেই গোষ্ঠীদ্বন্দ শুরু হয়। একদল অতিমানব মনে করেন, তারা যুদ্ধ করে সমস্ত পৃথিবীতে সাম্রাজ্যস্থাপন করবেন, আরেকদল শুধু নিজেদের মানসিক উন্নতি সাধনেই মনোযোগ দিতে চান। বলা বাহুল্য যুদ্ধবাজরাই জয়ী হন প্রথমে, কিন্তু মানুষের উপর আক্রমণ চালিয়ে যত সহজে জয়লাভ করা যাবে ভাবা গিয়েছিল, হয় তার বিপরীত। শক্তিতে খাটো হলেও সংখ্যার বিপুল গরিষ্ঠতায় এবং অকল্পনীয় যূথবদ্ধতা প্রদর্শন করে মানুষের রাজ্য একের পর এক আঘাত প্রতিহত করতে থাকে। লোকগাথায় সুদর্শন দেবতারা হয়ে ওঠেন ভয়ংকর দানব। পরপর যুদ্ধে পরাস্ত হতে হতে অতিমানবের সংখ্যা যখন অনেক কমে এসেছে, তখন শান্তিকামী অতিমানবদের এক দল তাঁদের গোষ্ঠীকে চিরতরে ত্যাগ করে চলে আসেন ভারতবর্ষে। অরণ্যে থেকে জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করে দর্শনচিন্তায় মগ্ন হন। কিছু মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ যোগাযোগ থাকলেও সভ্যতার সঙ্গে তারা আর সেভাবে যুক্ত হননি। কিন্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অরণ্য কেটে নগর বানানো শুরু হয়, তখন তাঁরা হিমালয়ের পূর্বে এই জনমানবহীন পার্বত্য অঞ্চলে চলে আসেন। তারপর দু-হাজারেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। এখানে থাকতে থাকতে সভ্যতার প্রতি বিতৃষ্ণ অতিমানবেরা নিজেদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান প্রকৃতির আরো কাছাকাছি, মানুষের থেকে আরো বেশি দূরে। যান্ত্রিক কোনো বস্তুর ব্যবহার তো নিষিদ্ধ হয়ই, বসন-ভূষণও পরিত্যাগ করা শুরু হয় ধীরে ধীরে, ফলে বনমানুষের মতো পুরু লোম গজাতে শুরু করে সারা দেহে। বিপ্রতীপ বিবর্তনের প্রারম্ভ সেই সময় থেকেই। সংস্কৃত ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজন কমতে কমতে সাবলীলভাবে লিখতে বা বলতে পারা প্রাণীর সংখ্যাও কমে এসেছে। তাই এই জগাখিচুড়ি লম্ফ-ঝম্প ভাষার আবিষ্কার।” শেষ কথাটা বললেন পাশের ভাষান্তররত জাম্বুবানকে দেখিয়ে।
প্রশ্ন করলাম, “কিন্তু গুহার গায়ে যা সব ছবি-লেখা-অঙ্ক দেখেছি সেগুলো তো আপনাদেরই। তার মানে আপনারা এখনও বিজ্ঞান-সাহিত্য-সঙ্গীত চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন।”
“যা দেখেছ, তা ইতিহাসের চিহ্নমাত্র। বহু প্রাচীন জ্ঞান স্মৃতি থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে সংরক্ষণের প্রচেষ্টা। আরো অনেকগুলো গুহা আছে যেগুলো সম্ভবত তোমাদের যাত্রাপথে পড়েনি। কাল সকালে দেখাবো। শুধু যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া চলবে না। আপাতত বিশ্রাম করো। শুভরাত্রি।”
দলপতি বিদায় নিলেন। একটি শিশু জাম্বুবান আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এল একটি গুহার দিকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা। খুশী হয়েই যেন রবার্ট তাকে একটা চকোলেট পকেট থেকে বার করে দিল। কাজটা একেবারেই ঠিক হল না জানি, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করার ইচ্ছে হল না। শুয়ে পড়ে আগামীকালের অভিযানে আরো কী চমক অপেক্ষা করে আছে ভেবে শিহরিত হচ্ছি, দেখলাম রবার্ট আরেকটা চকোলেট মুখের সামনে ধরে ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবছে। বাইরে মশালের আলোর কম্পনে গুহার দেওয়ালে আলোছায়ার চমৎকার পুতুলনাচ দেখতে দেখতে জীবনের এই অপরিসীম সৌভাগ্যপূর্ণ দিনকে বিদায় জানালাম।
১১
রাত্রে ঘুম ভাঙল রবার্টের ধাক্কায়। “ওঠো, আমাদের পালাতে হবে। সূর্যোদয়ের আগেই বেরিয়ে যেতে হবে ওদের রাজত্ব থেকে।” গতরাত্রে ওঁদের আশ্চর্য ইতিহাস শোনার পর মাথার মধ্যে সেসবই ঘুরছিল, স্বপ্নেও বোধহয় ভ্রমণ করছিলাম বৈদিক ভারতের অরণ্যে। রবার্টের কথাগুলো হ্যাঁচকা টানে বাস্তবের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনল। যতই এখন বন্ধনহীন হই না কেন, আসলে আমরা বন্দিই। জাম্বুবানদের গোপন রহস্য জেনে ফেলায় ওঁরা আমাদের আদৌ ফিরতে দেবে কি না সন্দেহ। ফোন আর ক্যামেরা সরিয়ে রেখে আমাদের ব্যাগপত্র আগেই ফেরত দিয়ে গেছিল, সেগুলো কাঁধে নিয়ে গুহা থেকে বেরোলাম। রবার্টের কাঁধে তার ব্যাকপ্যাক ছাড়াও আরেকটা বড় থলি। ইঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলাম, “এটা কী?” সে মুচকি হেসে বলল, “গিফট।” বাইরে প্রহরী ঘুমোচ্ছে। আমরা সন্তর্পণে ধীরপদে হেঁটে গুহাগুলো থেকে বেশ কিছুটা দূরে এসে ছুটতে শুরু করলাম মূলত পশ্চিম দিক লক্ষ করে, মেচুকিং এর দিকে। রাতের আকাশ নক্ষত্রখচিত, উত্তর গোলার্ধের আকাশ সামান্য চেনা থাকলেই দিক ভুল হওয়া সম্ভব নয়। ছুটতে ছুটতে একবার একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে রবার্ট পড়ল আর ওর পিঠের নতুন ব্যাগটা থেকে অদ্ভুত গোঙানির শব্দ পেলাম। “তুমি এর মধ্যে কী নিয়ে যাচ্ছ রবার্ট?” হাত ধরে তাকে টেনে তুলতে তুলতে বললাম।
“দাঁড়াও সাবধানে খুলতে হবে। তোমাকেও দেখানো দরকার।”
ব্যাগ খুলে প্রথমে চমকে গেলেও পরক্ষণেই মন বিষিয়ে গেল। রবার্ট কাল রাতের শিশু জাম্বুবানটিকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। তার হাত-পা-মুখ বাঁধা।
“তুমি এটা কী করেছ, রবার্ট? এরকম তো কথা ছিল না।”
“এছাড়া আমাদের কাছে প্রমাণ কী? কেউ বিশ্বাস করবে তোমার ওই পৌরাণিক গল্প? ইদার দ্যে উইল কল ইউ ক্রেজি অর অ্যা লায়ার।”
“যদি বিশ্বাস না করে না করবে। বৈজ্ঞানিক হয়ে চোরাশিকারীর মতো কাজ আমি করতে পারব না। বাচ্চাটাকে ছেড়ে দাও।”
“ইমপসিবল। ওকে আমি নিয়ে যাবোই। ভুলে যেও না, অভিযানটা আমার টাকাতেই হচ্ছে।”
“তোমার টাকা? রিসার্চ গ্রান্ট দুজনেরই রবার্ট। আর আমি না বললে তুমি জানতে এই জঙ্গলের কথা?”
“ফালতু কথা রাখো। আমিই প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর ভুলে যেও না। যা বলছি শোনো, বাচ্চাটাকে আবার ব্যাগে ভালো করে ঢুকিয়ে দাও। নইলে…”
“নইলে কী করবে তুমি? আমার সঙ্গে লড়াই করবে?”
আমায় এবার সম্পূর্ণ অবাক করে পকেট থেকে রিভলভার বার করলেন রবার্ট কুপার। আগ্নেয়াস্ত্র তার কাছে আছে জানতামই না, চমকে উঠলাম। চেনা ভালো মানুষও বিশেষ মুহূর্তে কীভাবে বদলে যেতে পারে নিজের দিকে তাগ করা বন্দুকের নল দেখে হাড়েহাড়ে টের পেলাম। শত্রু এখন ঘরে-বাইরে।
আমার থেকে বন্দুকটা ব্যাগের দিকে ঘুরিয়ে সে বলল, “ভুলে যেও না। এ ডেড স্প্যাসিমেন ইস অলসো এক্সট্রিমলি ভ্যালেয়েবল টু মি। ভালো চাও তো যা করতে বলছি শোনো।”
যুক্তির সঙ্গে যুক্তি দিয়ে লড়া যায়, অস্ত্রের সঙ্গে নিরস্ত্র ব্যক্তি যুঝবে কীভাবে। হার মানতে হল। বাকি যাত্রায় ওর কথামতো চলব কথা দিলাম। বাচ্চাটাকে ব্যাগে ঢুকিয়ে ভালো করে বেঁধে দিলাম। রবার্ট যখন নিজের পায়ে চোট পেয়েছে কি না দেখছে, সেই ফাঁকে আমার ব্যাগ থেকে একটা বস্তু শিশু জাম্বুবানের ব্যাগে গুঁজে দিলাম। আবার যাত্রা শুরু হল। একটা পাহাড় বেয়ে নীচে নেমে এসেছিলাম, আবার শুরু হল পাহাড়ে চড়া, সামনেরটা বেশি খাড়াই। পিছনে পূর্ব দিগন্তে নবারুণের প্রথম রশ্মি দেখা দিতে শুরু করেছে। আমার মনে যদিও ঘন তমসা।
দু-পা এগোতেই আমার পরিকল্পনা কার্যকর হচ্ছে মনে হল। রবার্টের পিঠের ব্যাগের ভেতরে কম্পনটা খুব বেড়ে যাওয়ায় তার হাঁটতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। সে একবার দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, “শাট আপ।” আমি কিছু না বলে এগিয়ে চলেছি। এবার ব্যাগের মধ্যে আরেকটা ঝাঁকুনি আর রবার্ট ‘আহ’ করে চেঁচিয়ে উঠে সজোরে ব্যাগটা মাটিতে ফেলে দিল। “হোয়াট দ্য হেল?”
ব্যাগের মুখটা খুলতেই বিপদ। ‘মাই গড’ বলে রবার্ট মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম শিশু জাম্বুবান লাফিয়ে বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। জাম্বুবানদের যে তিরটা আমার কাছে ছিল, সেটাই তার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। তিরের সুতীক্ষ্ণ অগ্রভাগের সঙ্গে ঘষে ঘষে মুখ আর হাতের বাঁধন খুলে ফেলতে পেরেছিল সে আর ব্যাগ খুলতেই সেই তির দিয়েই খুঁচিয়েছে তার অপহরণকারীকে। এবার তার পায়ের বাঁধন খুলে দিতে দিতে স্কুলে শোনা কতগুলো কথা মনে পড়ে গেল, “য পলায়তি স জীবতি।” চকোলেটের খালি র্যাপার আমার হাতে ধরিয়ে সে মারল লাফ পাশের গাছে, আর তারপর গাছে গাছে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পালাল পূর্বদিকে নিজেদের গুহার উদ্দেশে। রবার্ট উঠে বসেছে, তার বাঁ-চোখের ঠিক ওপরে ক্ষতচিহ্ন, সেখান থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। সামান্যর জন্য বেঁচে গেছে চোখটা। আমার কাজকর্মে সে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ। “বোস, হাউ কুড ইউ ডু দিস?” বলে সে বন্দুকহাতে দৌড় মারল জাম্বুবানের পিছু পিছু। আমিও ছুটলাম, শিশুটিকে বাঁচাবার রোখ চেপে গিয়েছে আমার মাথায়। এতক্ষণ যে পাহাড় ধরে উঠছিলাম, তার ঢাল ধরে দৌড়ে নামতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলাম। পিঠের ব্যাকপ্যাকটা ধাক্কার সিংহভাগ সামলে নেওয়ায় এতদূর গড়িয়ে পড়েও হাড়গোড় ভাঙল না। শুয়ে শুয়েই নাটকের শেষভাগ দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হল। রবার্টও দ্রুতগতিতে চলে এসেছে দুই পাহাড়ের মাঝের উপত্যকায় এবং এখানে গাছের ঘনত্ব কম থাকায় শিশু জাম্বুবানকে দেখেও ফেলেছে। এবার জান্তব শব্দ শোনা গেল সামনের পাহাড়ের পিছন দিক থেকে। জাম্বুবানরা আসছে। সামনে আকাশ জবাকুসুমের মতো লাল। নতুন সূর্যের আলোকরশ্মি অন্ধকার বিদীর্ণ করে রাঙ্গিয়ে দিয়েছে পূর্বদিক। সেই প্রেক্ষাপটে কালো পাহাড়ের চূড়ায় একে একে উঠে এল বনমানুষের ছায়ামূর্তি নাকি অতিমানবের দেহকায়া। রবার্ট তখনও উদভ্রান্তের মতো শিশুটির পিছনে ধাবমান। তার উদ্ধত আগ্নেয়াস্ত্র জানান দিচ্ছে ধরতে না পারলেও গুলি সে করবেই। জাম্বুবানদের দলের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমেই কমছে। দলপতি হাত তুলে জাম্বুবানদের কিছু একটা নির্দেশ দিলেন। সামনে এগিয়ে এল তিনজন, হাতে তির-ধনুক। এবার রবার্টও লক্ষ করল ওদের। কাছাকাছি চলে এসেছে দেখে সে গুলি চালাল তাদের দিকে, কিন্তু তাড়াহুড়োয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। জাম্বুবানরা এতক্ষণ নিজেদের সংবরণ করেছিলেন, প্রথমে আঘাত হানেননি। কিন্তু আক্রমণের উত্তর দিতে তারাও সক্ষম। সঙ্গে সঙ্গে একটা তির এসে লাগল রবার্টের ডান হাতে। যন্ত্রণায় বন্দুক ফেলে দিতে বাধ্য হল সে। ওদিকে আরো কয়েকজন জাম্বুবান নেমে এসেছে গাছের ডালে ডালে, শিশুটিকে রক্ষা করতে। বাঁ হাত দিয়ে তিরটাকে বার করে আবার বন্দুক তুলে মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করতে গেল রবার্ট। শিশুটির দিকে তাগ করে গুলি করার আগেই আরেকটি তির এসে বিঁধল বাঁ পায়ে। আর্তনাদ করে উঠল রবার্ট। তাকে বাঁচাতে, ফিরিয়ে নিয়ে আসতে আমিও ছুট দিলাম, হাজার হোক সে তো আমারই অতিথি। সামনে তিন তিনজন ধনুর্ধর জ্যায় শরসংযোজন করে প্রস্তুত। মুহূর্তেই শরশয্যা হয়ে যেতে পারে রবার্টের। এতক্ষণে মাতৃস্কন্ধে সুরক্ষিত শিশুটিও। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখে রবার্ট দু-হাত তুলে আত্মসমর্পণ করল। এবার কি ওরা আবার আমাদের বন্দী করবে? নারকীয় অতিথিসৎকারের কথা ভেবে শিউরে উঠতে উঠতেই দেখলাম, দলপতি আবার হাত তুলে নির্দেশ দিলেন, এগিয়ে এল আরেক ধনুর্ধর। তাহলে কি রবার্টের পাপের শাস্তি মৃত্যু? সে চিৎকার করে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আগেই আরেকটি তির এসে লাগল কাঁধে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ড. কুপার।
১২
এরপরে মাস তিনেক কেটে গিয়েছে। ড. রবার্ট কুপার বেঁচে আছে, বিষাক্ত গাছের রস লাগানো তির তাকে মাসখানেকের জন্য কোমায় পাঠিয়ে দিয়েছিল শুধু, প্রাণে মারেনি। জাম্বুবানেরাই রবার্টের দেহ তোমোদের গ্রাম অবধি পৌঁছে দেয়। কিন্তু তার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, জেগে উঠেও বিগতদিনের কোনো ঘটনাই সে মনে করতে পারেনি। বরঞ্চ অরণ্যের বাসিন্দার উপর বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগের চেষ্টায় তার গ্রান্ট, পারমিট সবই বাতিল হয়ে গিয়েছে। আমি রিপোর্টে লিখেছি, আমাদের অভিযান সম্পূর্ণ বিফল। রবার্ট স্থানীয় মানুষদের পবিত্র মন্দিরের নিয়ম উলঙ্ঘন করায় তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হন। তার ফলশ্রুতিতে ভারত সরকারও আদিবাসী সংরক্ষণ আইন প্রয়োগ করে অরুণাচলের উত্তরে ওই জঙ্গলে সকল প্রকারের অভিযানই নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। জাম্বুবান থুড়ি অতিমানবদের অস্তিত্ব এখন তোমোদের গ্রামের লোকগাথায় আর আমার স্মৃতিতে। প্রমাণ শুধু আমার পড়ার ঘরের দেওয়ালে শোভা পাওয়া শিশু জাম্বুবানের স্মৃতিবিজড়িত তিরখানি।
Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তনুময় দত্ত, প্রমিত নন্দী
পড়ে ভালো লাগলো।