রিভিউ: “The Gollancz Book of South Asian Science Fiction Volume 2”
লেখক: দেবরাজ মৌলিক
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
গোলাঞ্জের প্রথম সাইন্স ফিকশন সংকলনের সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে প্রকাশিত দ্বিতীয় খণ্ডটি শুধু প্রথম খণ্ডের ভুলত্রুটিগুলির কেবল সংশোধনই করেনি, বিস্তৃত করেছে তার লেখা ও লেখকের ব্যপ্তিও। এই সঙ্কলন প্রকৃত অর্থেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রকাশিত সাইন্স ফিকশনের সঙ্কলন, যার পাতায় স্থান পেয়েছে শ্রীলঙ্কা, তিব্বত থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশের তিন দেশের লেখকদের লেখা।
মঞ্জুলা পদ্মনাভনের চিত্র সম্বলিত ভূমিকা সবার আগে নজর কেড়েছে আমার। পোস্টমর্ডান গ্রাফিতি, নজরকাড়া প্রচ্ছদ, এবং শেষের উড়ন্ত মন্দিরসম রকেট, যার উদ্গারি ধূম রকেটের পুচ্ছ – সবকিছু পাঠকদের অবশ্যই রোমাঞ্চিত করবে। তরুণ সেন্টের প্রাককথন, এবং বইয়ের শেষের লেখক পরিচিতি না পড়লে আপনার পাঠ অসম্পূর্ণ।
কিন্তু শুরু করবেনই বা কেন? কারণ এই সঙ্কলনের বিচিত্র এবং বিবিধ গল্পসম্ভার। আপনারা নাৎসি জার্মানির কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বীভৎসতা সম্পর্কে তো জানেন, কিন্তু মনে রেখেছেন আপনাদেরই রাজ্যের সেই যুদ্ধকালীন মন্বন্তরের কথা? His Lordship Is Laughing নামক ফ্যান্টাসি গল্পে শিভ রামদাস তুলে ধরেছেন ব্রিটিশদের সেই নারকীয়তার কথা। নমিনেশন পাওয়া, ডার্ক ফ্যান্টাসির এই গল্প যে কারুরই অবশ্যপাঠ্য।
তাশান মেহেতার তাঁর The Traveler গল্পের প্রতিটি ছত্রে বুনেছেন কথার মায়াজাল, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আর এক অন্য দুনিয়ার শব্দবন্ধে গাঁথা ভূভাগ।
মহম্মদ জাফর ইকবালের The Zoo এইচ.জি. ওইয়েলসের The Island of Doctor Moreau মতই কিভাবে প্রকৃতির উপরে খবরদারি বিকৃতির সূত্রপাত করে নিয়ে লেখা। জেনেটিক্স, আন্থ্রেপলজির সঙ্গে যথাযথ থ্রিলের পাঞ্চ এই গল্প পাঠককে ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য।
ব্জ্র চন্দ্রশেখরের Maker of Memorials গল্প এক অদ্ভুত পেশার মানুষকে নিয়ে, যে স্মৃতিসৌধ তৈরি করে মুছে যাওয়া সভ্যতা এবং রীতির জন্য। এইরকম গল্প সাম্প্রতিককালে আমি আর পড়িনি। গল্পের বিষয়বস্তু ইর্ষনীয়।
জয়প্রকাশ সত্যমূর্তির Dimensions Of Life Under Fascism এক ওরওয়েলিয়ান গল্প যেখানে একুশে আইনের দেশের মত সেই দেশের জনগণও তাদের ডিজিটাল মিডিয়ায় ফুটে ওঠা মন্ত্র উচ্চারণ করতে বাধ্য। কিন্তু একুশে আইনের মত এই গল্প আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে না, ভীতি সঞ্চার করে।
সিনা আহমেদের অলৌকিক শক্তির অধিকারী মেয়েরা এক ধূসর দুনিয়ায় একমাত্র আলো সন্ধানী। এই গল্প নিঃসন্দেহে ফেমিনিস্ট এবং একই সঙ্গে ভীতিসঞ্চার করে পাঠকের মনে।
মঞ্জুলা পদ্মনাভনের লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর Sharing Air (1984) গল্পে, যেখানে মানুষের নেশার অন্যতম উপায় ছিল দূষিত বাতাসে ফুসফুস ভরে তোলা। এই সংকলনে তাঁর The Pain Merchant গল্পটি আমাদের জিজ্ঞেস করতে বাধ্য করে, আমাদের ব্যাথাবেদনা বাদ দিয়ে আমাদের মনুষ্যত্ব কতটুকু? তাঁর যন্ত্রণাহীন দুনিয়ায় যন্ত্রণা আজ সওদার বস্তু।
কলকাতার মত ঘামে ভেজা শহরে কি কখন বরফ পরতে পারে?
সোহম গুহর লেখা শৈত্যের গান (প্রথম প্রকাশিত কল্পবিশ্বের পাতায়) এখানে স্থান পেয়েছে অরুনাভ সিনহার অনুবাদে The Song of Ice হয়ে। গল্পটি কেবল এক বরফের মাঝে ডুবে থাকা আমাদের ‘ভালবাসার শহর’-এর কথা বলে থেমে থাকেনি। বলেছে বাঁচতে চাওয়া কিছু মানুষের কথা, তাদের প্রাত্যহিক কর্ম থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা। সোহম কেবল গল্পে কিছু মানবিক দিক তুলেই থামেনি, জিজ্ঞেস করেছে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বর্তমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে, যেখানে আমাদের সংবিধানের বাক্য আর এক মহাকাব্য মিলেমিশে একাকার।
“Hindus and Muslims could be brothers, but the battle of Kurukshetra was fought among brothers too” – (pg 92, The Gollancz Book of South Asian Science Fiction)
লাবণ্যা লক্ষ্মীনারায়ণ এবং বন্দনা সিং উভয়েই নারীত্বের কথা তুলে ধরেছেন তাঁদের গল্পে। একজন বেছে নিয়েছেন ফেলে আসা অতীতকে, আর একজন এক ভিনগ্রহীর কণ্ঠকে।
সামি আহমেদ খান আর বন্দনা সিং-য়ের গল্প এর আগে আমি গোলাঞ্জের প্রথম সঙ্কলনেও পাঠের সুযোগ পেয়েছিলাম। খানের প্রথম সঙ্কলনের গল্পটি ছিল উত্তরপ্রদেশে ভিনগ্রহীর আগমন নিয়ে এক দ্রুতগতির বিবরণী। এই সংকলনে তিনি উপস্থাপিত করেছেন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সেরা রসনাতৃপ্তির উপাদান – বিরিয়ানি। এই খাবারের মোড়কে খান বহু রাজনৈতিক রূপক ব্যবহার করেছেন। এবং, তাঁর বাকি লেখাগুলির মত এটিতেও এসেছে এক ‘এলিয়েন-নেশন’-এর প্রছন্ন উপস্থিতি। খানের এই গল্পটি সম্ভবত তাঁর সেরা কাজ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক ওঠানামার সঙ্গে আপনি পরিচিত থাকলে এই গল্পে আপনি বহু বিষয়ের উপস্থিতি অনুভব করবেন।
রাজনীতির কথাই যখন উঠলো, তখন সুকন্যা দত্তের গল্পটির কথা বলা জরুরি। তাঁর The Midas Touch বায়োইঞ্জিনিয়ারড কিছু আণুবীক্ষণিক জীব, এক অত্যন্ত ঘরোয়া চরিত্র গলু মামা এবং তাঁর এল ডোরাডোর সন্ধান নিয়ে এক অনবদ্য অ্যাডভেঞ্চার গল্প।
Looney Ka Tabadla আরেকটি রাজনৈতিক স্যাটায়ার যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুএন্সারদের পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। এবং এক সাংবাদিকের বক্তব্য গল্পটিতে এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
স্টার ট্রেক আমাদের শিখিয়েছে মহাকাশই হল ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার। গৌতম ভাটিয়ার লেখা স্পেস অপেরায় তুলে ধরা ধরা হয়েছে মহাবিশ্বের অসীম পটভূমিতে একত্ববাদ আর বহুত্ববাদের দ্বন্দ্ব। শ্রীরামকৃষ্ণের এক উক্তি মনে পড়ছিল এই গল্পটি পড়তে পড়তে।
যদি আপনি কল্পবিজ্ঞান ভালবাসেন, স্যাটায়ার পরে মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি, বা হরর পড়ে শিউরে ওঠেন, তবে পাঠক, এই সঙ্কলন আপনার জন্য। এর হার্ডকভার মলাটের মধ্যে স্থান পেয়েছে ডিস্টোপিয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন, বা এবসারডিস্ট দুনিয়া। তবে, আমার ব্যক্তিগত মতামত, সম্পাদককে অনুরোধ করবো আর আঞ্চলিক লেখাকে তুলে আনুন অনুবাদের মাধ্যমে। এই সংকলনটি আগের সঙ্কলনের ‘পারটিশান হ্যাংওভার’ মুক্ত, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্যে সমৃদ্ধ, এবং প্রোপ্যাগান্ডা থেকে মুক্ত। সাদা বাংলায়, এই ভলিউমটি আগেরটির যাবতীয় খামতি পূরণে সক্ষম। কিন্তু পাঠক, আগেই বলে রাখি, এটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার বই না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বই নামিয়ে রাখতে হয় বিষয়বস্তুর গভীরতা ও বিষণ্ণতার জন্য। কিন্তু ফিরতেই হয় এর লেখাদের মাঝে, তার রসোস্বাদন করতে।
কারণ মঞ্জুলা পদ্মনাভন ঠিকই বলেছেন, আমরা সবাই যন্ত্রণার দালাল।
Tags: kalpabiswa y7n1, দেবরাজ মৌলিক, প্রমিত নন্দী