পরীক্ষা দিল পার্ক্স
লেখক: Stanislaw Lem; অনুবাদ: রুদ্র দেব বর্মন
শিল্পী: দীপ ঘোষ
মূল গল্প: “The Test”, যা “Tales of Prix the Pilot” গ্রন্থের অন্তর্গত।
“ক্যাডেট পার্ক্স!”
বুলপেন-এর চিৎকারের এক ধাক্কায় পার্ক্সের দিবাস্বপ্নটা ভেঙ্গে পুরো চুরমার হয়ে গেল। সবেমাত্র দুই-ক্রাউনের সেই কয়েনটা তখন ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। যেটাকে ও পুরনো একটা হাফ প্যান্টের চোর-পকেটে ঢুকিয়ে লকারের একদম নিচে গুঁজে রেখেছিল। আহা, সেই চকচকে ঝনঝনানো রুপোর কয়েনটা! এতদিনে যেটাকে ও পুরোই ভুলে গিয়েছিল। অবিশ্যি আর একটু আগে জিজ্ঞেস করলেই হয়তো ও দিব্যি গেলে বলে দিতো যে ওখানে কিচ্ছুটি নেই। আর থাকলেও বড়জোর থাকতে পারে কিছু পুরনো চিঠিপত্র। তবে এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে এখন যেন ওর মনে হচ্ছে যে একটা আধটা কিছু ওখানে থাকলেও থাকতে পারে। আর তারপর যতক্ষণে বুলপেন ওর নাম ধরে হেঁকে উঠেছে, ততক্ষণে তো ও পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। কয়েনটা এখন ওর কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার। ঐ তো প্যান্টের পকেটটা ফুলে রয়েছে। এখান থেকেই ও কয়েনটা দেখতে পাচ্ছে – একদম গোল, চকচকে আর নরম। ওটা দিয়ে একটা সিনেমার টিকিট হয়ে গিয়েও হাতে আধ-ক্রাউনের মত বেঁচে থাকবে। আর যদি শুধু কোন তথ্যচিত্র দিয়ে ও ব্যাপারটা সেরে ফেলে, তো ওর হাতে দেড় ক্রাউন বেঁচে থাকবে। তার মধ্যে এক ক্রাউন জমিয়ে রেখে বাকি আধ ক্রাউন না হয় ও স্লট মেশিনে ভাগ্য পরীক্ষা করেই উড়িয়ে দেবে। আহা, আর তখন যদি কোন ভাবে মেশিনটা পাগলে যায় আর গাদাগাদা কয়েন উগড়ে দিতে শুরু করে, তখন ও পারবে তো তাড়াতাড়ি করে সব পকেটে ঢোকাতে . . . ? হুম, কেনই বা নয় – স্মিগার সঙ্গেই তো অমনি হল, হল না ? আর ঠিক এই মোক্ষম মুহূর্তে, যখন এই অপ্রত্যাশিত ছপ্পর-ফার সৌভাগ্যে ও পুরো ডুবে যাচ্ছে, ঠিক তখনই বুলপেনের বিখ্যাত ধামাকা ওকে মারল এক ধাক্কা।
ঠিক ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন ইনস্ট্রাক্টর বুলপেন। গোটা শরীরের ওজন এক পায়ে আর হাত দুটো ভাঁজ করে পেছনে রাখা। জিজ্ঞেস করলেন: “ক্যাডেট পার্ক্স, ধরো তুমি মহাকাশে টহল দিতে বেরিয়েছ। আর সেই সময় কোনও অ্যালিয়েন মহাকাশযানের মুখোমুখি হলে। তখন কি করবে তুমি?”
পার্ক্সের মুখটা হাঁ হয়ে গেল। ইয়াব্বরো এক হাঁ। যেন উত্তরটা ঐখানেই কোথাও আছে আর ওকে শুধু ওখান থেকে জোর করে টেনে বের করে আনতে হবে। এখন ওকে দেখে মনে হচ্ছে যে ও হচ্ছে পৃথিবীর সেই শেষ একমাত্র মানুষটা যে জানে ভিনগ্রহী মহাকাশযানের দেখা পেলে কি করতে হবে।
“আমি আরও কাছে এগিয়ে যাবো,” প্রায় বুজে আসা ঘড়ঘড়ে আওয়াজে উত্তর দেয় পার্ক্স।
একটা মজাদার হাসির নাটক যে মঞ্চস্থ হতে চলেছে সেটা বোধহয় সবাই এতক্ষণে আন্দাজ পেয়ে গিয়েছে। গোটা ক্লাস এখন নিঃশব্দে নট নড়নচড়ন অপেক্ষা করছে কখন সেই হেসে ওঠার মুহূর্তটা আসবে।
“বেশ, বেশ,” গুরুজন সুলভ ভারিক্কী গলায় বুলপেন বললেন, “তো তারপর তুমি কি করবে?”
“আমি থেমে যাবো,” এইটুকু বলেই পার্ক্স থমকে যায়। ভালোই বুঝতে পারছে ও এবার মোটামুটি ওর জ্ঞানের চৌহদ্দির বাইরের কোনও সমুদ্রের মধ্যে ডুবতে বসেছে। স্পেস ম্যানুয়ালের দরকারি অনুচ্ছেদগুলো খুঁজে বের করতে ও মাথার ভেতরে পাগলের মত খোঁড়াখুঁড়ি করে। কিন্তু মাথা পুরোপুরি খালি, যেন ও কোনও দিন ওগুলো চোখেও দেখেনি। লজ্জায় ও মাথা নিচু করতে গিয়ে দেখতে পায় স্মিগা নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে ওকে কিছু বলবার চেষ্টা করছে। স্মিগার ঠোঁট নাড়িয়ে বলা প্রত্যেকটা শব্দ ও একটা একটা করে পাঠোদ্ধার করতে থাকে আর বেশ জোরের সাথে বলতে থাকে। কি বলছে সেটা আর ভালো করে পার্ক্স খেয়াল করে না।
“আমি – ওদের – আমার – পরিচয় – জানিয়ে – দেব।”
একটা হো হো আওয়াজে গোটা ক্লাস যেন পুরো ফেটে পড়লো। বুলপেন থামাবার একটা চেষ্টা একটুক্ষণ করলেন বটে বলে মনে হল, তবে তারপরেই, নিজেও হাসিতে ফেটে পড়লেন। যদিও পরের মুহূর্তেই নিজেকে আবার সামলে নিয়েই মুখের ওপর একটা গুরুগম্ভীর ভাব ফিরিয়ে আনলেন।
“ক্যাডেট পার্ক্স, কাল তুমি ন্যাভিগেশনের বইটা নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবে। ঠিক আছে? আর এই যে ক্যাডেট বোর্স!”
পার্ক্স ওর নিজের ডেস্কে ফিরে গিয়ে এমন ভাবে বসলো যেন ওটা কাঁচের তৈরি একটা ভঙ্গুর ডেস্ক। স্মিগার ওপরে ওর রাগ হওয়া উচিত, কিন্তু হচ্ছে না। স্মিগা ঠিক ঐ রকমই। কাউকে নিয়ে মজা করতে পারলে ও আর কিছুই চায় না। ওদিকে বোর্স এখন বুলপেন-এর কোনও একটা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। যদিও একটা কথাও পার্ক্সের মগজে ঢুকছে না। তবে আড়চোখে ও দেখতে পাচ্ছে বোর্স কম্পিউটারে একটা গ্রাফ বানানোর চেষ্টা করছে। আর এই মোক্ষম সময়ে বুলপেন সাধারণত যা করে থাকেন ঠিক সেই পুরনো কায়দা মাফিক দিলেন ইলেকট্রনিক কম্পিউটারটা বন্ধ করে। পুরনো অভ্যাস। যাতে ক্যাডেটরা উত্তর দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে। কম্পিউটার ব্যবহারের অনুমতি স্কুল কর্তৃপক্ষ যদিও দিয়ে রেখেছে, কিন্তু বুলপেনের চিন্তা ভাবনা অন্যরকম। ওনার মতে কম্পিউটার-ও ঠিক মানুষের মতই। ব্রেক-ডাউন হয়েই থাকে। দরকারের সময় তেমন হলে ক্যাডেটরা কি করবে সেটা নাকি দেখে নেওয়া দরকার। পার্ক্সের অবশ্য বুলপেনের উপরেও রাগ হচ্ছে না। ঘটনা হচ্ছে ও কারো উপরেই রাগ করতে পারে না। রাগ ওর কদাচিৎ হয়। ও তাই চুপ করে বসে থাকে। অবশ্য মাত্র পাঁচ মিনিট। তার মধ্যেই ও এখন দাঁড়িয়ে আছে ডায়ারহফ স্ট্রিটের একটা দোকানের সামনে। কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে সাজানো একটা গ্যাস পিস্তল খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ফাঁকা বা কার্তুজ ভরে – সব রকমের ফায়ারিং-এর জন্যেই পিস্তলটা বেশ ভালো। একশোটা কার্তুজ সহ একত্রে ওটার দাম লেখা আছে ছয় ক্রাউন মাত্র। যদিও না বললেও বোধহয় চলবে যে ডায়ারহফ স্ট্রিটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পুরো ঘটনাটাই ঘটছে ওর কল্পনায়।
বেলটা বেজে উঠার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ক্লাসঘর খালি হয়ে গেলো। নিচু ক্লাসের মত কোনও রকম হৈ হৈ বা দাপাদাপি ছাড়াই। না মহাশয়, এরা কেউই আর ছোট নেই। অর্ধেক ক্লাস বেরিয়েই এঁকে বেঁকে সোজা রওনা দিলো ক্যাফেটেরিয়ার উদ্দেশ্যে। যদিও জানে এই সময়ে কোন খাবারই ওখানে পাওয়া যাবে না। তবে ওদিকে ওদের যাওয়ার ভেতরে আলাদা কিছু উদ্দেশ্য আছে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে – নতুন আসা একজন ওয়েট্রেস (শোনা যাচ্ছে পুরো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মত ব্যাপক)।
পার্ক্সের অবশ্য কোন তাড়াহুড়ো নেই। ও ধীরেসুস্থে হাঁটছিলো নক্ষত্র-গোলক রাখা কাঁচের ক্যাবিনেটটার পাশ দিয়ে। আর প্রত্যেকটা পা ফেলার সাথে সাথে বুঝতে পারছিলো দুই-ক্রাউনের কয়েনটা ঐ পুরনো প্যান্টের পকেটে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশঃ কমে আসছে। আর যতক্ষণে ও সিঁড়ির সবচেয়ে নিচের ধাপটায় পা রাখলো, ততক্ষণে ও পুরোপুরি বুঝতে পেরে গেছে যে কয়েনটা আসলে পুরোপুরিই ওর কল্পনায় তৈরি।
এই সময় ওর চোখে পড়ল বোর্স, স্মিগা আর পায়ার্টজ সামনের বারান্দায় আড্ডাবাজি করছে। কিছুদিন আগে যখন মহাজগত পড়ানো হচ্ছিল সেই সময় একটা সেমিস্টারের জন্য পায়ার্টজ ওর ডেস্কমেট ছিল। ঐ একটা সেমিস্টারের জন্যই অবশ্য। যদিও তাতেই সারা জীবনে পার্ক্স আর ওকে ভুলতে পারবে না। নক্ষত্র-অ্যাটলাসটাতে কালি ঢেলে যা অবস্থা করে দিয়েছিল তা আর কহতব্য নয়!
পার্ক্স এখন কোনও দিকে না তাকিয়ে ওদের পেরিয়ে যেতে চাইছিল। ঠিক যখন ও বারান্দাটা পেরিয়ে গিয়েছে, বোর্স হঠাৎ করে পেছন থেকে ওকে ডাকলো, “এই, পার্ক্স, তৈরি থাকিস। কালকের উড়ান-পরীক্ষার জন্য তোকেই বেছেছে!”
পার্ক্স পাত্তা দেয় না। বারবার ওকে বোকা বানানো যাবে না। উদাস ভাবে উত্তর দেয়, “বাছলে বাছুক গে”
“বিশ্বাস করলি না তো? নিজেই পড়ে দেখ,” বলে নোটিশ বোর্ডের কাঁচের ঢাকনাটাতে আঙ্গুল দিয়ে ঠুকে টক্ টক্ আওয়াজ তোলে।
ও ঠিক করেছিল যে দেখবে না। চলে যাবে। কিন্তু না চাইলেও ওর মাথাটা আপনা আপনিই ঘুরে গেল। নোটিশ বোর্ডে তিনটে নাম দেখা যাচ্ছে। আর ঐ তালিকায় সবার ওপরে ওর নামটাই জ্বলজ্বল করছে – “ক্যাডেট পার্ক্স”।
খানিকক্ষনের জন্য ও পুরো হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
ওর মনে হলো বহু দূর থেকে কেউ যেন ওকে কিছু বলছে। যদিও একটু পরেই বুঝতে পারলো গলাটা ওর নিজেরই।
“বললামই তো, বাছলে বাছুক গে!”
আর দাঁড়ায় না পার্ক্স। ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বারান্দা পেরিয়ে একটা ফুলের বাগান। আর তার মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরোনোর সুঁড়িপথ। পথটা দুপাশে ফুলের গাছের সারি দিয়ে সাজানো। ফরগেট-মি-নট ফুলের গাছ গুলো এমন কায়দায় সাজানো যেন মনে হচ্ছে একটা রকেট নেমে আসছে। আর রকেটটার পেছনের দিকে বাটারকাপ ফুলের সারি গুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন রকেটের পেছনের নিষ্কাশনী থেকে আগুনের শিখা বেরিয়ে আসছে। যদিও বাটারকাপের সিজন এখন শেষ বলে রং কেমন যেন একটু মিইয়ে গেছে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে পার্ক্সের মনোযোগ এদিকে কোথাও নেই। এই ফুলের বাগান, এই রাস্তা, এই ফরগেট-মি-নট, এমনকি বুলপেন, যিনি ঠিক এই মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে ভবন থেকে বেরোচ্ছেন, কোন কিছু বা কারোর দিকেই ওর নজর নেই। ফলে যা হতে পারতো তাই হলো। অন্যমনস্ক পার্ক্স বেরোতে গিয়ে একটুর জন্য বুলপেনের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা খাওয়া থেকে বেঁচে গেল। থতমত খেয়ে পার্ক্স যতক্ষণে নিজেকে সামলাতে পারলো ততক্ষণে বুলপেন আর ওর মধ্যের দূরত্ব বোধহয় মিলিমিটারে মাপা যাবে। কোনও রকমে একটু সরে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় পার্ক্স। মুখে ক্যাবলার মত একটা হাসি।
“আরে, পার্ক্স, তুমি!” বলপেন বলেন, “”তুমিই তো কালকে উড়ছো, তাই না? ঠিক আছে, তোমার প্রথম উড়ান শুভ হোক! আর যদি তোমার ভাগ্য ভালো হয় তো… ইয়ে … ভিন গ্রহের সেই লোকগুলোর দেখাও পেয়ে যেতে পারো।”
পার্কের একদম শেষ প্রান্তে বিস্তৃত এক সারি কাঁদুনে উইলো গাছের দেওয়ালের ওপাশেই ওদের ডর্মিটারিটা। ঠিক মুখোমুখি একটা দিঘী। ডর্মিটারির দুপাশের ডানার মত দুটো অংশ পাথরের স্তম্ভের উপরে ভর দিয়ে নেমে এসেছে জলের মধ্যে। একটা গুজব শোনা যায় যে এই স্তম্ভগুলো না কি চাঁদের থেকে আনা পাথর দিয়ে তৈরি। সত্যি বলতে কি এটা পুরোপুরি একটা মিথ্যা রটনা। সেটা বোধহয় সবাই জানেও। প্রথম বর্ষের ছেলেদের তাতে অবশ্য কখনও আটকানো যায় নি। মোটামুটি ওরা সবাই নিজের নিজের নামের আদ্যক্ষর, ক্লাস আর তারিখ পবিত্র হৃদয়ে স্তম্ভগুলোর দেওয়ালে খোদাই করে রেখেছে। পার্ক্সের নামটাও ওখানে ঐ সব নামাবলীর ভীরে ভালো করে খুঁজলে পাওয়া যাবে। অবশ্য আজ চার বছর হয়ে গেছে যেদিন ও অনেক যত্নে নিজের নামটা ওখানে খোদাই করেছিল।
ডরমিতে ওর ঘরটা খুবই ছোট। এতটাই ছোট যে কোনো রকমে একজন ঘরটার ভেতরে নড়াচড়া করতে পারে। এখন ভেতরে ঢুকেই ও নিজের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে ব্যস্ত হলো। তর্কের বিষয় আর কিছুই না। লকারটা ও খুলবে, না কি খুলবে না। ওর বেশ ভাল করেই মনে আছে পুরনো প্যান্টটা ও ঠিক কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। ওসব জিনিস এখানে রাখার নিয়ম না থাকা সত্ত্বেও ও রেখেছে। কিংবা হয়তো নিয়ম নেই বলেই রেখেছে। যদিও ওগুলো এখন আর ও ব্যাবহারও করে না।
শেষে আর না পেরে চোখদুটো বন্ধ রেখে, হাঁটু গেড়ে উবু হয়ে বসে, লকারের পাল্লা অল্প একটু ফাঁক করে, হাত ঢুকিয়ে নিচের তাকে রাখা প্যান্টের পকেটটা হাতড়ে দেখেই নিল। এবার আর কোনও সন্দেহই রইলো না – পকেটটা পুরো ফাঁকা।
ও এখন দাঁড়িয়ে আছে হ্যাঙ্গারের ছাদের ঠিক নিচের ঝুলন্ত ধাতব ক্যাটওয়াকটার উপরে। পরনে স্পেসস্যুট। হাওয়া এখনও ঢোকান হয় নি বলে যদিও সেটা এখন চুপসে সেঁটে আছে শরীরের সঙ্গে। কোনও হাতই ওর এই মুহূর্তে খালি নেই। তাই কোনওরকমে কনুই দিয়ে মোটা তারের রেলিং-এ ভর রেখে শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখেছে। এক হাতে ও ধরে আছে ওর নেভিগেশনের বইটা, আর অন্য হাতে রয়েছে স্মিগার থেকে ধার করে আনা টুকলিপত্র। লোকে বলে যে গোটা স্কুলের সবাই এই টুকলির ভরসায়ই উড়ে এসেছে। যদিও এটা কি ভাবে যে প্রতিবারই ঠিক ঠাক ফিরে আসে তা এখনো এক রহস্য। আরও রহস্য এই জন্যই যে উড়ান-পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আসার পরেই সেই ক্যাডেটকে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আরও উত্তরের বেস ক্যাম্পে। সেখানে ওরা চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ঠেসে প্রস্তুতি শুরু করে। সে যা হোক, আসল কথা হচ্ছে, এই টুকলি সব সময়ই ঠিক ঠাক ফিরে আসে। অনেকেই দাবি করে যে এটা আসলে প্যারাশুটে করে নেমে আসে। অবশ্যই – তাই তো হওয়ার কথা।
চল্লিশ মিটারেও বেশি ওপরে ঝুলন্ত ক্যাটওয়াকটায় দাঁড়িয়ে পার্ক্স অপেক্ষা করছে বাকিদের জন্য। হঠাৎ ওর মাথায় এল যে ওকে আবার খানা-তল্লাশি করা হবে না তো! ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে যে এটা বেশির ভাগ সময়ই করা হয়ে থাকে। অবশ্য তেমন টা করার যথেষ্ট কারণও আছে। সবাই মোটামুটি এতদিনে জেনে ফেলেছে যে ক্যাডেটরা অদ্ভুত অদ্ভুত সব বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে চড়তে আসে। তার মধ্যে বিশেষ কিছু নিষিদ্ধ জিনিস, যেগুলো বেশির ভাগ সময়ই থাকে, সেগুলো হলো হুইস্কি ভর্তি ফ্লাস্ক, খৈনি আর বান্ধবীদের ছবি। অবশ্য টুকলিপত্র সঙ্গে না নিয়ে কেউই আসে না। পার্ক্স অবশ্য ডজন খানেকের মত চোর-পকেট বানিয়ে নিয়ে এসেছে। জুতোর মধ্যে, মোজার ভেতর, স্পেসস্যুটের ভেতরের পকেটের মধ্যে, যে মিনি-অ্যাটলাসটা ক্যাডেটকে সঙ্গে নিতে দেওয়া হয় তার ভেতরে . . . আর একটা চশমার খাপ . . . এখন মনে হচ্ছে এটাই গোলমাল পাকাবে। ও আবার খুঁটিয়ে ভাবে। প্রথমত এটা বহরে বেশ ভালোই আকারের। দ্বিতীয়ত ও চশমা পড়ে না। ঠিক এক মুহূর্ত পরেই ওর মাথায় আসে যে, তাইতো! চশমা পড়তে হলে তো ও এই ইনস্টিটিউটেই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতো না।
এই সব ভাবতে ভাবতে পার্ক্স ধাতব ক্যাটওয়াকটার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে আর অপেক্ষা করছে কখন সিও-র সঙ্গে ওদের দুজন ইনস্ট্রাক্টর এসে হাজির হবে। ওদের এত দেরি কেন হচ্ছে? ও এবার রীতিমত অবাক হয়ে যাচ্ছে। উড়ানের সময় নির্দিষ্ট হয়েছিল ১৯:৪০-শে। ইতিমধ্যে এখন ১৯:২৭ হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ ওর মাথায় এল যে সেই বেঁটে ইয়ার্কসের মত ও আজ নিজে ভাগ্যিস টুকলিপত্রটা বগলের নীচে সেঁটে রাখেনি। সেবার ইয়ার্কস যেভাবে বেঁচে গিয়ে ছিল সে এক গল্প। যেই না ফ্লাইট ইনস্ট্রাক্টর ওকে তল্লাশি করতে এগিয়েছে অমনি বেঁটে ইয়ার্কস ‘কাতুকুতু লাগছে, সুড়সুড়ি লাগছে!’ বলে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। আর এই সব করেই কোনও রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু পার্ক্স জানে ও এরকম করে পার পাবে না। ওকে কোনও ভাবেই কেউ ‘কাতুকুতুতে কুপোকাত’ ধরনের ছেলে বলে বিশ্বাস করবে না।
সেই জন্যই ও আঠালো টেপ দিয়ে কোনও জিনিসই শরীরে সাঁটিয়ে রাখেনি। তাই, এখন একদম গোবেচারা, যেন কিছুই জানে না, এমন ভাবে ডান হাত দিয়ে টুকলিপত্রটা ধরে চুপচাপ এগোতে লাগলো। অবশেষে যখন ও দেখলো যে এবার ওকে তিন তিন জনের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে তখন ও হাত পাল্টে নিলো। এবার টুকলিপত্রটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে আর নেভিগেশন বইটা বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নিয়ে নিল। আর এই পাল্টাপাল্টিটা যখন ও করছে তখন ওর শরীরের চাপে ঝুলন্ত ক্যাটওয়াকটা একটা ডাইভিং বোর্ডের মত উপর-নিচ করে ঝাঁকিয়ে উঠতে থাকলো। সেই ঝাঁকুনির মধ্যে যেভাবে ও নিজেকে সামলালো সেটাও একটা দেখবার মত ব্যাপার। হঠাৎই ওদিকের প্রান্ত থেকে একটা পায়ের আওয়াজ ওর কানে এল। যেন ওদিকে থেকে কেউ আসছে। কিন্তু হ্যাঙ্গারের ছাদটার জন্য ওদিকে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে। ফলে কে আসছে সেটা ও ঠিক বুঝতে পারলো না।
এদের তিনজনকে ওর বেশ ফ্যাশন-দুরস্ত লাগছিল। এ ধরনের প্রথাগত অনুষ্ঠানে সাধারণত যেরকম হয়ে থাকে ঠিক সেরকমই। এরা তিনজনেই, বিশেষত সি.ও. স্বয়ং নিজেও, পুরো প্রাতিষ্ঠানিক উর্দীর ধরাচূড়ায় সেজে রয়েছেন। অবশ্য পার্ক্সের নিজেরটাও কম কিছু নয়। যদিও ওর স্পেসস্যুটটা এখনও ফোলানো হয় নি তা সত্ত্বেও ওটাকে গোটা কুড়ি ফুটবল ইউনিফর্মের চেয়ে কম কিছু লাগছে না। আর ওর স্পেসস্যুটের গলার ওখান থেকে যে ইন্টারকম আর রেডিওফোনের লম্বা লম্বা লেজ ঝুলে আছে, সেগুলো মিলে তো ওর চেহারা আরও খোলতাই করে দিয়েছে। আর গলার সামনে রেসপিরেটরের হোসপাইপটা যেভাবে দোদুল্যমান সেটার কথা তো বলাই হয় নি এখনও। সবচেয়ে ঝামেলা করছে ওর অতিরিক্ত অক্সিজেনের বোতলটা। যেটা ওর পিঠের দিকে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে। সেটা ইতিমধ্যেই ওর পিঠে যথেষ্ট বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে। তবে তারচেয়েও যন্ত্রনা দিচ্ছে ওর ঘাম শুষে নেওয়া কাপড়ের তৈরি অন্তর্বাস। জায়গায় জায়গায় ঘষা খেয়ে এখনই জ্বালা জ্বালা করছে। সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো এই সব গ্যাজেট গুলো যে ও ঝেড়ে ফেলবে তাও সম্ভব নয়। যে ধরনের একধাপের রকেট এই পরীক্ষামূলক উড়ানের জন্য ব্যবহার করা হয় তাতে এগুলো ছাড়া উড়তে যাওয়ার কথা বিবেচনা করাই যাবে না। সমস্যা আছে তাতে।
আর এই সময়েই ঝুলন্ত ধাতব ক্যাটওয়াকটা এমন ভাবে দুলতে শুরু করলো যেন পেছনের দিক থেকে কেউ আসছে। আর কে হবে! ইনি সেই বোর্স। ওরও পরনে একই রকম ধরাচূড়ো, একই রকমের স্পেসস্যুট। একটা বড়োসড়ো গ্লাভস হাতে ধরে আছে। ওকে দূর থেকেই আড়ষ্ট একটা অভিবাদন জানিয়ে এমন ভাবে এগিয়ে আসতে থাকলো যে মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি এক ধাক্কায় ওকে ছিটকে দেবে।
বাকিরা সবাই এগিয়ে গেলে খানিকটা বিস্মিত ভাবেই পার্ক্স জিজ্ঞেস করলো, “তুই এখানে কি করছিস? তোর নাম ত তালিকায় ছিল না?”
“ব্রেন্ডনের শরীর খারাপ হয়েছে। তাই আমি ওর জায়গায় এলাম।”
পার্ক্স মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। এটা একটা বড়সড় ধাক্কা। ওর কাছে এটাই ছিল একটা সুযোগ—এক এবং একমাত্র সুযোগ —যেখানে ও বোর্সদের ওকে নিয়ে হাসাহাসির একটা মোক্ষম জবাব দিতে পারতো। ওদের থেকে অন্তত এক মিলিমিটার ওপরে হলেও উঠতে পারতো। ও ভালোই জানে যে এই প্রোগ্রামের জন্যে বোর্স ওদের ব্যাচের সবচেয়ে ভালো ক্যাডেট। আর সেই জন্যই ওরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও ও ওদের ক্ষমা করে দিয়ে নিজের মত থাকে। এমনকি বোর্সের অঙ্কের চৌখস মাথার জন্য ওকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাও করে। বিশেষ করে যবে থেকে বোর্সকে দেখেছে কম্পিউটার নিয়ে কেরামতি করতে। একমাত্র চতুর্থ বর্গমূলের অঙ্ক এলেই বোর্স একটু কেতরে যায়, নইলে . . . হবে নাই বা কেন? ওর বাবা-মা এতটাই উঁচু স্তরের মানুষ যে ওকে কখনও একটা দু-ক্রাউনের কয়েন পুরনো ঘরে পরার প্যান্টের পকেটে লুকোনো আছে কি নেই তা নিয়ে স্বপ্ন দেখার দরকার পড়ে না। এছাড়া ও আবার জিমন্যাস্টিকের চ্যাম্পিয়ন, লাফানোতে ওস্তাদ, নাচেও পারদর্শী, আর তোমার ভালো লাগুক বা না লাগুক, চেহারাতেও আপাদমস্তক একজন হ্যান্ডসাম। সত্যিকারের হ্যান্ডসাম। যাকে বলে রুপে গুনে রাজপুত্তুর। যেটা আবার পার্ক্সের সমন্ধে কেউ চাইলেও বলতে পারবে না।
ক্যাটওয়াকটার ওপর দিয়ে ওরা সবাই এবার হাঁটতে শুরু করলো। হ্যাঙ্গারের কড়িকাঠগুলো একটার পর একটা পার করে অবশেষে ক্যাটওয়াকটার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রকেটের সামনে এসে পৌঁছোল। একটা উঁচু লম্বাটে জায়গা। একেক করে ওরা সবাই ভেতরে ঢুকলো। পুরো জায়গাটা দিনের আলোর মত ফটফট করছে। আলোটা আসছে অনেক ওপর থেকে, প্রায় ২০০-মিটারের মত ওপরে, ছাদের একটা স্লাইডিং প্যানেল থেকে। পার্ক্সের মনে হলো পুরো রকেটটা যেন শঙ্কু আকৃতির দুটো দৈত্যাকার অংশ দিয়ে তৈরি। দুটোরই মোটামুটি উচ্চতা ৪৮ মিটার আর ব্যাসের দৈর্ঘ্য ১১ মিটার। প্রথম ভাগে রয়েছে বুস্টার। ওটার নিচের দিকে কংক্রিটের বড়ো বড়ো নিঃসারন প্রতিরোধক গুলো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যেই হ্যাচকভারটা দেখা যাচ্ছে খুলে রাখা হয়েছে। রকেটে চড়বার সিঁড়ি-পথটাও লাগানো হয়ে গিয়েছে। সিঁড়ি-পথের ঠিক মাঝামাঝি জায়গা আটকে একটা মঞ্চ রাখা রয়েছে। তার ওপর আবার একটা লাল পতাকা বেঁধে রাখা আছে। এটা একটা চিরাচরিত প্রথা। এই প্রথাটা পার্ক্স জানে। ওখানে পৌঁছালো ক্যাডেটকে প্রশ্ন করা হবে – “পাইলট, আপনি কি আপনার মিশনের জন্য প্রস্তুত?”
এটাও ও জানে যে ঐ প্রশ্নের উত্তরে ওকে ঠিক কি বলতে হবে – “হ্যাঁ, স্যার, আমি প্রস্তুত।” আর তারপরেই জীবনে প্রথমবারের মত ও উঠে দাঁড়াতে পারবে ঐ রক্ত-লাঞ্ছিত পতাকার মঞ্চে। তারপর প্রথম বারের মত ঢুকে পড়তে পারবে রকেটের মধ্যে। হঠাৎই এই সময়ে ওর ভয় হলো। ও যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে যে ঐ প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই ও একটা হোঁচট খাচ্ছে আর তারপরেই সিঁড়ি-পথটার রেলিং টপকে সোজা নাক বরাবর ধড়াম করে নিচে পড়ে যাচ্ছে। এই ধরনের দূর্ঘটনা মানুষের সঙ্গে কদাচিৎ কখনো ঘটেই থাকে। আর যেহেতু কারো সঙ্গে এরকম একবার হলেও হয়েছিল তো ও মোটামুটি নিশ্চিত হলো ওর সঙ্গে ঠিক এমনটাই ঘটবে। ও স্থির নিশ্চিত। ঘটনা হচ্ছে এরকম ব্যাপার ওর ক্ষেত্রে হরদম হয়েই থাকে। যে জন্য ও নিজেকে মাঝে মধ্যেই বাধ্য হয়ে জন্ম-হেরো বলে গালাগালি করে। যদিও ওর ইনস্ট্রাক্টরদের মতামত অন্য রকম। ওরা বলেন যে ও হচ্ছে এই একটু নির্বোধ আর ভোম্বল ধরনের ছেলে যার মনটা কখনও সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকে না। ঠিক আছে। এটা অবশ্য মানতে ওর অসুবিধা নেই। সব বিষয়েই দেখা গেছে ওর চিন্তা ভাবনা আর কাজের মধ্যে অন্তত কয়েক যোজনের দূরত্ব। বা অতটা যদি নাও হয় তবুও ওর কথা আর কাজের মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য থাকবেই থাকবে। সেটাই ওর জীবনের চলার পথে সবসময় কাঁটা বিছিয়ে দিয়ে থাকে। পার্ক্সের কোন ইনস্ট্রাক্টর বা অন্য কারো মাথায় এটা কখনোই এল না যে ও আসলে নির্বোধ বা ভোম্বল নয়, বরং একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। সবাই যেন ধরেই নিয়েছে যে ওর মাথায় না আছে ঘিলু বা না আছে কোনো সঠিক চিন্তা ভাবনা। পার্ক্স কিন্তু জানে যে সেটা একেবারেই সত্যি নয়।
আড়চোখে ও দেখতে পেল বোর্স এবার মঞ্চের নির্দিষ্ট জায়গায় উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রবেশদ্বার থেকে আর একটু মাত্র দুরে ও। এখন দাঁড়িয়ে আছে অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে। দুটো হাত দিয়ে সমান ভাবে ধরে আছে রাবারের এয়ার-ব্যাগের ওপরের অংশটা।
পার্ক্স এসব দেখছে আর ভাবছে। কপালটা দ্যাখো বোর্সের! এই বিচ্ছিরি সাজ-পোষাকটাও বোর্স এমন ভাবে পড়ে আছে যেন দর্জি দিয়ে ওর জন্যেই মাপে-মাপে বানানো হয়েছে। আর আমার গায়ে দ্যাখো একই জিনিসকে মনে হচ্ছে যেন কয়েক গুচ্ছ ফুটবল একসাথে ঝুলে আছে। কেন বোর্সকে একদম ফিটফাট আর ওকে ফোলা ঢ্যাপসের মত লাগছে? হয়তো এই জন্যই ওর চলতে ফিরতে এতো অসুবিধা হচ্ছে। আর সারাক্ষণ পা দুটো ফাঁক করে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। সবার চোখ এড়িয়ে ও পা দুটোকে টেনে পাশাপাশি নিয়ে আসতে চেষ্টা করে। কিন্তু ওর গোড়ালি কিছুতেই ওকে সাহায্য করতে রাজি হলো না। কেন বোর্সের ক্ষেত্রে ওর গোড়ালি দুটো ওকে সাহায্য করছে আর ওর দুটোই বা কেন ওর সঙ্গে এরকম বেইমানি করছে? তবে এটাও ঠিক যে ওখানে যদি এখন বোর্স না হয়ে অন্য কেউ হতো, ও হয়তো পুরোপুরি ভুলেই মেরে দিত যে ওর আসলেই এখন রকেটের দিকে পেছন ফিরে টানটান হয়ে উর্দীধারী তিনজনের মুখোমুখি অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। তবে ওর কপাল দেখ! বোর্সই প্রথম সুযোগ পেল এগিয়ে যাওয়ার। হতে পারে এটা কাকতালীয়, কিংবা অন্য কিছু। অথবা হয়তো এই জন্যই যে বোর্সের নামের আদ্যাক্ষর ‘বি’ দিয়ে আর ওর ‘পি’ দিয়ে। কিন্তু কাকতালীয় বা অন্য যে কোনো কারনই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত ক্ষতিটা তো হলো ওরই। সবসময় ওকেই অপেক্ষা করতে হয় ওর সুযোগ আসবার জন্য। আর এই জন্যই ও বিচলিত হয়, স্নায়ুর চাপে পড়ে যায়। অপেক্ষা করার মত খারাপ কিছুই আর হয় না। যে কোনও কাজ যতো তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যায় ততই ভালো – এটাই ওর নিজস্ব দর্শন।
এই সব নানারকমের চিন্তা ভাবনার মধ্যে বোর্সকে ওখানে ঠিক কি কি জিজ্ঞেস করা হলো ও তার অল্প একটুই শুনতে পেল। আর তাতেই ওর শরীরটা লোহার রডের মত শক্ত হয়ে গেলো। ওদিকে বোর্স আবার এত তাড়াতাড়ি উত্তরগুলো দিয়ে দিলো যে পার্ক্স ঠিকঠাক ধরতেই পারলো না যে কি কি উত্তর দিল। তারপরেই এল ওর পালা। অথচ যেই মাত্র সিও ওকে প্রশ্ন করা শুরু করেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর মাথায় এল, আরে! ওদের তো আজ তিন জনের উড়ানের কথা ছিল। তৃতীয় জন কোথায় গেল? তবে এরপরেও ওর আজ ভাগ্য ভালো বলতে হবে। কোনক্রমে সিও-র করা প্রশ্নের শেষটুকু ধরতে পেরে গিয়ে ঠিক মোক্ষম সময়ে উত্তরটা ও উগরে দিতে পারলো –
“ক্যাডেট পার্ক্স, এখন উড়ানের জন্য তৈরি।”
“হুম…ঠিক আছে,” সিও সাহেব বললেন। “এবং তুমি নিজেকে শারীরিক আর মানসিক, সব দিক থেকেই সম্পূর্ণ … ইয়ে … তোমার ক্ষমতার মধ্যে যতটা বুঝতে পারছো সেই হিসেবে নিজেকে সুস্থ বলে ঘোষণা করছো, তাই তো?”
সিও ভদ্রলোক খুব সাধারণ প্রশ্নকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেশ কায়দা করে করতে ভালোবাসেন। বোধহয় এতে ওর নিজেকে নিজে সিও সিও ভাবতে বেশ সুবিধা হয়।
যদিও তাতে পার্ক্সের কোন অসুবিধা হলো না। ও নিজেকে সবসময়ই সুস্থ বলে মনে করে। তাই সেটা ঘোষণা করতে ও একটুও দেরি করলো না।
সিও সাহেব বললেন, “আমি তোমাকে আজকের এই উড়ান যাত্রার জন্য পাইলট হিসেবে ঘোষণা করছি।” তারপর একটু থেমে আবার ওনার সেই একান্ত নিজস্ব পছন্দের কায়দা মাফিক শুরু করলেন, “এবার এই উড়ানের উদ্দেশ্য এবং বিধেয়: যাত্রা শুরু হবে বুস্টারের অর্ধ ক্ষমতা ব্যবহার করে সরাসরি উল্লম্ব নির্গমনের মাধ্যমে। প্রথমে কক্ষপথ এলিপ্সিস বি৬৮ পর্যন্ত উঠবে। তারপর কক্ষপথে সুস্থিত হওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনা। ওখানে অবস্থান করবে ঠিক চার ঘন্টা ছাব্বিশ মিনিট। তারপর জেও-টু গোত্রের শাটলক্রাফট দুটোর সঙ্গে পূর্ব-নির্ধারিত স্থানে সাক্ষাৎকারের জন্য রওনা দেবে। রাডার যোগাযোগের সম্ভাব্য স্থান হবে – সেক্টর থ্রি, মাধ্যম স্যাটেলাইট পিএএল, সম্ভাব্য ব্যতিক্রমের মাত্রা থাকবে ছয় আর্ক সেকেন্ড। কৌশলগত সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে রেডিও যোগাযোগ স্থাপন করবে। পরিচালন পদ্ধতি – নির্গমন কক্ষপথ: ষাট ডিগ্রি চব্বিশ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ আর একশো পনেরো ডিগ্রি তিন মিনিট এগারো সেকেন্ড পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। প্রারম্ভিক ত্বরণ: টু পয়েন্ট টু-জি। প্রান্তিক ত্বরণ: শুন্য। রেডিও সংযোগ সর্বদা বজায় রাখবে। জেও-টু জাহাজ দুটোকে নিয়ে ত্রিভুজ ফর্মেশনে চলতে হবে। চন্দ্র সন্নিবেশের জন্য অস্থায়ী নিরক্ষীয় কক্ষপথ অনুসরণ করবে। এই কক্ষপথে চলতে হবে লুনা পাথফাইন্ডারের নির্দেশ অনুসারে। ত্রিভুজ সংগঠনে চালিত উভয় জাহাজের কক্ষপথের অনুগমন যাচাই করবে। সব ঠিকঠাক থাকলে কক্ষপথ থেকে যখন নিস্ক্রমনের সময় হবে তখন ত্বরন আর পথরেখা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে তৎকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবং তোমার হিসেবে। তারপর ফিরে আসবে পিএএল স্যাটেলাইটের কক্ষপথের ব্যাসার্ধের মধ্যে। পরবর্তী নির্দেশ তোমাদের জন্যে ওখানেই রাখা থাকবে।”
ইদানিং একটা গুজব প্রায়শই কানে আসছে যে চিরাচরিত কাগজের টুকলির পরিবর্তে এবার আসছে ইলেকট্রনিক বড়ি। ওটা নাকি একটা কুলের বীজের আকারের মাইক্রোব্রেন, যেটা কানের ভেতরে বা জিভের নিচে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে, আর এমনভাবে ওটার প্রোগ্রামিং করা হবে যে যখন যা দরকার পড়বে সেই সব তথ্য ঐ বড়িটাই তৎক্ষণাৎ সরবরাহ করবে।
কিন্তু পার্ক্সের এ বিষয়ে ততটা ভরসা নেই। তার একটা কারনও ও দেখিয়ে থাকে – আর সেটা একেবারে যে অযৌক্তিক তাও বলা যাবে না। ওর বক্তব্য, ওরকম একটা আবিষ্কার যদি হয়েই যায় তো তাহলে ক্যাডেটদের আর কোনও প্রয়োজন পড়বে না। যাইহোক, আপাতত সেরকম কিছু নেই। আর তাই অনোন্যপায় হয়ে ওকেই যাত্রা পথের প্রতিটা খুঁটিনাটির প্রতিটি অক্ষর আর সংখ্যা মনে মনে মুখস্থ করে নিতে হচ্ছে। বিড়বিড় করে বলে বলে ও সেটা করেও নিলো। শুধু একটা ছোট্ট ভুল যদি ধরা না হয় তো প্রায় পুরোটাই ও বলতে পারলো। যদিও ভুলটা মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণই – সময়ের মিনিট আর সেকেন্ড ও গুলিয়ে ফেললো অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশের সেকেন্ড আর মিনিটের মধ্যে। কাজেই ও আবার দ্বিতীয়বার বলার জন্য প্রস্তুতি নিল। উত্তেজনায় মোটা স্পেসস্যুটের নিচে পরা ঘর্ম-রোধক অন্তর্বাসের ভেতরে বালতি বালতি ঘাম জমা হলো। ওকে অবশ্য দ্বিতীয়বার বলার সুযোগও দেওয়া হলো। ও বলেও গেল। কিন্তু কি যে বললো সেটা নিজেও ঠিকঠাক খেয়াল করতে পারলো না। আবার যখন তৃতীয় বারের জন্য ওকে বলতে হচ্ছে তখন ওর খালি মনে হচ্ছিলো, ওয়াও! এরা তো সত্যি সত্যিই আমাকে থার্ড ডিগ্রি দিয়ে দিলো!
তবে এবার বলার আগে টুকলিটাকে বাঁ হাতে ধরে রেখে ও নেভিগেশন বইটা ওদের ধরতে দিলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো। এমনিতে এই যাত্রাপথের খুঁটিনাটি ক্যাডেটদের দিয়ে মুখস্থ বলানোটা একটা শখের খেলাই বলা যায়। কেননা ওরা সবসময়ই এগুলো লিখিত ভাবেই হাতে পেয়ে যায়। সমস্ত দরকারী চিত্র আর চার্ট সহ যাত্রাপথের সম্পূর্ণ বিবরন। সিও সাহেব ঐ কাগজ-পত্রের খামটা ওর স্পেসস্যুটের ভেতরের ছোটো পকেটটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ওর হাতে নেভিগেশনের বইটা ফেরত দিলেন।
“পাইলট পার্ক্স, ইঞ্জিন চালু করার জন্যে তুমি কি প্রস্তুত?”
“প্রস্তুত!” পার্ক্স সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়। এই মুহুর্তে ওর একটাই ইচ্ছে কতক্ষণে কন্ট্রোল কেবিনে গিয়ে বসবে। আর সেই মুহূর্তটার স্বপ্নে ও এখন বিভোর, যখন ও তারপর ওর স্পেসস্যুটটা খুলে ফেলতে পারবে বা না হলেও অন্তত গলার বকলস রিংটা খুলে ছুড়ে ফেলতে পারবে।
সিও সাহেব কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন।
“এবার তোমরা রকেটে ওঠো!” বেশ বাজখাই গলায় চিৎকার করে ঘোষণা করলেন। আওয়াজটা এই বিশাল গুহার মত হ্যাঙ্গারের ভেতরে গমগম করতে থাকলো। যেন কোনও ক্যাথ্রিডালের ভেতরে ঘন্টা ধ্বনি হচ্ছে।
সিও সাহেবের আদেশ তখনও হ্যাঙ্গারের ভেতরে গমগম করছে, পার্ক্স সাঁ করে ঘুরে গেলো। লাল পতাকাটা হস্তগত করে দৌড় শুরু করতেই প্রথম ধাক্কা খেলো রেলিং-এ। কোনও রকমে মোক্ষম মুহূর্তে নিজের ভারসাম্য সামলে নিল। তারপর কি ভেবে দৌড়ানো বন্ধ করে বাঁ-এ ডা-এ করতে করতে লম্বা লম্বা পা ফেলে সরু সিঁড়ি-পথটা বেয়ে উঠতে শুরু করলো। ওকে এখন ঠিক একটা জম্বির মত মনে হচ্ছে। অর্ধেক রাস্তা তখনও পার্ক্স পার করেনি, তার আগেই বোর্স পেছন থেকে সাঁ করে গুলির মত গতিতে এগিয়ে গিয়ে সোজা ওর নিজের রকেটের ভিতরে ঢুকে পড়লো।
সে যাক গে, ও এবার নিজেও রকেটের ভেতরে পা ঢোকালো। ঢুকেই ধাতব দেওয়ালটা আঁকড়ে ধরলো। তারপর নিচে নামার ঝুলন্ত সিঁড়িটা দিয়ে নামতে শুরু করলো। যতটা সম্ভব চেষ্টা করছিল যাতে সিঁড়ির ধাপ গুলো হাতে ধরতে না হয়। বুলপেন মাঝে মধ্যেই বলে থাকেন যে “অক্ষমেরাই শুধু ধাপ ধরে ধরে নামে।” আর পার্ক্স অক্ষম নয়। নেমেই এবার ও এগোলো ওর স্বপ্নের কেবিনের উদ্বোধন করতে। ট্রেনিং-হ্যাঙ্গারের নকল কেবিনে বা কখনও পুরোনো রকেটের খুলে নেওয়া কেবিনের মধ্যে পুরো ব্যাপারটা ওরা আগে থেকেই রীতিমত অভ্যাস করেছে। তা সে হাজার না হলেও অন্তত শ’খানেক বার তো হবেই। পর পর পুরো ব্যাপারটা একটু জটিল। যে কোনও সাধারণ মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মত। প্রথমে বাঁ দিকের হাতলটা অর্ধেক ঘোরাও, তারপর ডানদিকেরটা অর্ধেক ঘোরাও। এবার গাসকেট লাগাও। এবার আবার দুটো হাতলকেই বাকি অর্ধেকটা ঘোরাও। এবার আটকে দাও। বায়ুরোধক নিয়ন্ত্রণ চালু করো। ম্যানহোলের ঢাকনাটা বন্ধ করো। উল্কা প্রতিরোধক খুলে দাও। এবার বায়ুরোধক থেকে কেবিনে ঢোকো। প্রেশার ভাল্ব খুলে দাও। প্রথম হাতলটা ঘোরাও, তারপর দ্বিতীয়টা। এবার সবশেষে ক্রশবার তোলো – ব্যাস, ওয়াও!
যখন ও ম্যানহোলের ঢাকনাটা বন্ধ করছিল ঠিক তখনই ওর মাথায় চিড়িক মেরে চিন্তাটা ঢুকেছিল। বোর্স বোধহয় এতক্ষণে ওর কাঁচের গর্তে ঢুকে বসে পড়েছে। কিন্তু তাতে কি? ও নিজেই নিজেকে বোঝাতে থাকে। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে? ছ’মিনিটের ফারাক তো দুটো রকেটের ওড়ার মধ্যে সবসময়ই রাখা হয়। যাতে একসাথে উড়তে গিয়ে ঝামেলা না বাধে। তবে এরকম ভাবছে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে ওর মনটা রীতিমত আনচান করতে থাকে। কতক্ষণে ও নিজের কন্ট্রোল রুমে পৌঁছেই রেডিও ফোনটা চালু করবে। বোর্স কি করছে সেটা জানতে না পারলে ওর আর চলছে না। বোর্সের উড়ানের মিশনটা আসলে কি তা জানার জন্য ওর প্রাণটা ছটফট করছে।
যেই মাত্র ও বাইরের দরজাটা বন্ধ করলো, অমনি সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের আলোগুলো নিজে থেকেই জ্বলে উঠলো। কেবিনটার সঙ্গে বাইরের পরিবেশের কোনও সম্পর্ক আর রইলো না এখন। সামনে একটা ছোট সিঁড়ি। কয়েকটা মাত্র ধাপ। সিঁড়ির ধাপ গুলো খসখসে অথচ নরম কিছু জিনিস দিয়ে মোড়া হয়েছে। প্রায় লাফ দিয়ে দিয়ে ও উঠে এল। ধাপগুলো উঠেই কন্ট্রোল কেবিনটা আর তার ভেতরেই পাইলটের আসন।
এখন কথা হলো কার দূর্বুদ্ধিতে যে ওরা অমন ছোট একটা ওলটানো বাটির মত কাঁচের ঘরে পাইলটকে চেপেচুপে আটকে রাখার ব্যবস্থা করেছে তা ভগবানেই জানেন! কাঁচের এই বাটিটা আকারে বড়জোর তিন মিটার ব্যাসের হবে। অথচ এই চালক-মাত্র রকেটের মধ্যে অঢেল জায়গা খালি পড়ে আছে। পার্ক্স কি সেটা দেখতে পাচ্ছে না? পাচ্ছে, তাই ও অবাক হচ্ছে। বাটিটা স্বচ্ছ হলেও ঠিক কাঁচের তৈরি নয়। বরং পেক্সিগ্লাস জাতীয় কোনও পদার্থ যার গঠনটা কাঁচের মত অথচ যা শক্ত রাবারের মত সহনশীল, সেরকমই কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি। তার ভেতরে রাখা পাইলটের চেয়ারটার গঠন একটা বড়ো ক্যাপসুলের মত। ওপরে আবার একটা ঢাকনা দেওয়া আছে। আর চেয়ারটার গড়ন এমন যে ঠিক সাধারণ বসা নয়, আধশোয়া হয়ে থাকতে হবে। পিঠের হেলান দেওয়ার জায়গাটা পেছনের দিকে হেলে রয়েছে। গদী মোড়া বসার জায়গার বাঁক গুলো এমন যে বসলেই, মানে আধশোয়া হলেই কাঁধ-পিঠ-কোমড়-পা সব খাপে খাপে মিলে যাবে। চেয়ারটা রাখা আছে গোলাকার কন্ট্রোল কেবিনের একদম কেন্দ্রবিন্দুতে। শঙ্কু আকৃতির কেবিনটার গঠনশৈলীকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। এটা এমন ভাবে বানানো হয়েছে যে পাইলট তার নিজের চেয়ারে, যেটাকে মহাকাশচারীরা তাদের ভাষায় “ডেন্টিস্টের চেয়ার” বলে, সেটা আবার একটা কেন্দ্রীয় অক্ষের উপর ঘুরতে পারে। পাইলট ওটাতে আধশোয়া হয়ে ওপরের, নিচের আর চারদিকের সমস্ত ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলগুলোই দরকার মত দেখতে পাবে। যত যা কিছু ডায়াল, মিটার, ভিডিও স্ক্রীন (সামনে, পেছনে আর দু পাশের), কম্পিউটার ডিসপ্লে, অ্যাস্ট্রোগ্রাফ, আর এসব কিছুর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেই ট্র্যাজেক্টোমিটার, সবকিছুই ঐ এক চেয়ারে বসে বসেই দেখতে পাবে। ট্র্যাজেক্টোমিটার হচ্ছে একটা ইনস্ট্রুমেন্ট যার আলোক-রেখা যানের উড়ান-পথ একটা নাতি-উজ্বল উত্তল পর্দার বুকে একটা নির্দিষ্ট স্থির নক্ষত্রের পরিপ্রেক্ষিতে রকেটের যা আপেক্ষিক অবস্থান, সেটা হেরেলসবার্গ প্রোজেকশানে দেখাতে থাকে। ধরে নেওয়া হয় যে একজন পাইলট এই প্রোজেকশানের প্রত্যেকটা অংশ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং যে কোন অবস্থাতেই তার অর্থ উদ্ধারে সক্ষম হবে, এমনকি পুরো উল্টে যাওয়া অবস্থাতেও। ঐ চেয়ারে অর্ধশায়িত অবস্থায় পাইলট যখন বসবে, তখন তার ডান আর বাঁ-দিকে থাকবে দুটো করে রিঅ্যাকটর আর অলটিচিউড কন্ট্রোল লিভার, তিনটে এমার্জেন্সি কন্ট্রোল লিভার, ছ’টা ম্যানুয়াল কন্ট্রোল হাতল, ইগনিশন আর আইডলিং স্যুইচ আর এদের সঙ্গে থাকবে পাওয়ার, থ্রাস্ট আর পার্জ কন্ট্রোল। পায়ের তলায় মেঝের ঠিক নিচেই চক্রাকার বিস্তৃত একটা অংশের মধ্যে আছে এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট, অক্সিজেন সরবরাহ কেন্দ্র, অগ্নি–নিরোধক ব্যাবস্থা, ক্যাটাপুল্ট (অনিয়ন্ত্রিত চেইন রিয়্যাকশন হলে কাজে লাগবে) এবং খাবার-দাবার আর থার্মোস সম্বলিত একটা অংশ যেটা একটা দড়ি আর ফাঁসের সাথে জুড়ে রাখা রয়েছে। পাইলটের পায়ের ঠিক নিচে আছে ব্রেকিং প্যাডেল যেটা নরম প্যাড দিয়ে মোড়া আর একটা ফাঁসের মত স্ট্র্যাপ দেওয়া। আর আছে অ্যাবোর্ট হাতল, যেটা চালু করলে (সেটা করতে হলে পা দিয়ে লাথি মেরে কাঁচের ঢাকনা ভেঙ্গে তারপর পা দিয়েই ঠেসে ঠেলে দিতে হয়) পাইলটের চেয়ারটা সহ একটা সুরক্ষা ক্যাপসুল পাইলট জেটের সাহায্যে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে গোলাকার বাটির ধরনের একটা প্যারাসুটের সাহায্যে বাইরে ভেসে থাকবে।
চরম বিপদের মুখে রকেট পরিত্যাগ করার সময়ে পাইলটকে বাঁচানো ছাড়াও এই পেক্সিগ্লাসের বাটিটা বানানো হয়েছে আরও আট-আটটা বিশেষ কারন বা উদ্দেশ্যে। পরিস্থিতি তেমন ভালো থাকলে পার্ক্স এক্ষুনি গুনে গুনে সবকটাই বলে দিতে পারতো, যদিও অবস্থা এখন তেমন নয়। আর, ও বা ওর সহপাঠীরা, কেউই কখনো ওগুলো কোনো কাজের বলেই মনে করেনি।
নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসার পর, এটাকে অবশ্য বসা না বলে আধশোয়া বললেই ঠিক হয়, পার্ক্স এবার আসল ঝামেলাটা টের পেল। স্পেসস্যুটের থেকে ঝুলন্ত সব তার, পাইপ, কেবল – যেগুলো ওকে চেয়ারের এপাশে ওপাশে ঠিকঠাক জায়গায় জুড়তে হবে সেগুলো ও ঐ আধশোয়া অবস্থায় চোখেই দেখতে পাচ্ছে না। আবার কোমড় বেঁকিয়ে একটু উঠে যেই মাত্র সামনে ঝুঁকতে যাচ্ছে, অমনি স্পেসস্যুটটা ওর পেটের সামনে বোঁচকার মত জমা হয়ে যাচ্ছে। তখন তার-টার গুলো হাতে ধরাই একটা মুশকিল কাজ হয়ে যাচ্ছে। সঠিক জায়গায় জুড়ে দেওয়া তো পরের ব্যাপার। কাজেই ও যদি ভুল করে রেডিও কেবল আর হিটিং কেবলের মধ্যে গুলিয়ে গিয়ে এর জায়গায় ওকে লাগানোর চেষ্টা করে তো তাতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে! ভাগ্যিস প্রত্যেকটার থ্রেড সাইজ আলাদা! তাই গোলমাল তেমন কিছু হলো না। যদিও ভুলটা বুঝতে যতক্ষণ সময় লাগলো ততক্ষণে পার্ক্স বেশ কয়েক লিটার ঘাম ঝরিয়ে ফেলেছে।
কমপ্রেসড এয়ারের সংযোগ চালু হতেই একটা ফুস্ শব্দ করে পলকের মধ্যে ওর এতক্ষণ চুপসে থাকা স্পেসস্যুটটা ফুলে উঠলো। শান্তির একটা শ্বাস নিয়ে পার্ক্স এবার ভালো করে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। থাই আর কাঁধের ফিতে গুলো বেঁধে নেওয়া বাকি আছে। ও এবার ওগুলো দু হাত দিয়ে বাঁধতে শুরু করলো। ডানদিকের ফিতেটা তো ঠিকঠাক লেগে গেলো। কিন্তু বাঁ দিকেরটা অবাধ্যতা শুরু করেছে। এদিকে স্পেসস্যুটের কলারটা গলার কাছে এমন বেলুনের মত ফুলে উঠেছে যে ভালো করে ঘাড় ঘোরানোই যাচ্ছে না। উপায়ান্তর পার্ক্স হাত দিয়ে থাবড়ে থাবড়ে ফিতের স্ট্র্যাপটা লাগানোর চেষ্টা করতে লাগল। আর ঠিক এই সময়েই একটা চাপা গলার আওয়াজ ইয়ারফোনের মধ্যে দিয়ে ওর কানে এসে ঢুকলো।
“এএমইউ-১৮, পাইলট বোর্স! স্বয়ংক্রিয় কাউন্টডাউন জিরো হলে উড়ান শুরু করো। অ্যাটেনশন, তুমি তৈরি তো?”
“এএমইউ-১৮ এর পাইলট বোর্স! কাউন্টডাউন জিরো হতেই উড়ান চালু করো!” এবার গলার আওয়াজটা যেন আরেকটু বেড়ে গেলো।
দূর ছাই! স্ট্র্যাপের মাথা আর মুন্ডু! লাগ না ব্যাটা! ক্লীক! যাক, লাগলো শেষ পর্যন্ত। পার্ক্স এবার ওর নরম গদির চেয়ারে টানটান হয়ে হেলান দিল। ওকে এখন দেখে মনে হচ্ছিল যেন এই মাত্র ও কঠিন এক মহাকাশ ভ্রমণ সেরে ফিরে এসেছে।
“মাইনাস টোয়েন্টি থ্রি, টোয়েন্টি টু, টোয়েন্…” কাউন্টডাউন ওর ইয়ারফোন দিয়ে কানের ভেতরে ভনভন করতে থাকলো।
একবার এমন হয়েছিল যে কাউন্টডাউন জিরো হতেই দু’জন ক্যাডেটই একসাথে উড়ান চালু করে দিয়েছিলো। যদিও পরিকল্পনা মাফিক কথা ছিল একজনের পর আরেকজনের উড়বে। কিন্তু দুটো রকেটই সেবার একসাথে যমজ ভায়ের মত পাশাপাশি আকাশে উঠে পড়েছিল। দুজনের মধ্যে দূরত্ব ছিল মাত্র ২০০ মিটারের মত। ঘটনার যতটা বাইরে বেরিয়েছিল তাতে এইটুকু শুধু জানা যায় যে মাত্র এক আর্ক সেকেন্ডের ফারাকে রকেট দুটো মাঝ আকাশের সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে পেরেছিল। অবশ্য এই গল্পে খানিকটা জল মেশানোও থাকতে পারে। তবে ঘটনা যাই হোক, এটাও শোনা কথা, যে তারপর থেকেই, রকেটের ইগনিশন সংযোগ দেওয়া হয় একদম শেষ মুহূর্তে। তাও সেটা দেওয়া হয় রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে আর দেন স্বয়ং কমান্ডার নিজে তাঁর উড়ান-ক্ষেত্রের কাঁচের দেয়াল ঘেরা কন্ট্রোল স্টেশনের ভেতর থেকে। তবে এই ইগনিশনের রটনা যদি সত্যি হয় তো এই পুরো কাউন্টডাউন ব্যাপারটাই অর্থহীন একটা নাটক।
“জিরো!” আওয়াজটা পার্ক্সের ইয়ারফোনে গাঁক্ করে ওঠে। আর একই সঙ্গে একটা চাপা গুড় গুড় আওয়াজ-ও ওর কানে আসতে থাকে। ওর চেয়ারটা কেঁপে কেঁপে ওঠে, কেবিনের আলো গুলো দপদপ করতে থাকে। সেই দপদপ করে ওঠা আলোর নিচে ওর কেঁপে কেঁপে ওঠা পাইলটের চেয়ারে আধশোয়া পার্ক্স, কেবিনের ছাদে আর আশেপাশের সমস্ত মনিটর আর প্যানেলগুলো দিকে তাকিয়ে থাকে। ওগুলোর মধ্যে ভেসে ওঠা সংখ্যাগুলো একের পর এক পড়তে থাকে। একেকটা মনিটর আর প্যানেল সব আলাদা আলাদা কাজের জন্যে। একটা অ্যাস্ট্রোগ্রাফ, কয়েকটা এয়ার-কুলিং গেজ, তার সঙ্গে মেইন স্টেজ থ্রাস্টার, প্রধান আর ভার্নিয়ার জেট গুলো, এদিকে একটা নিউট্রন ফ্লাক্স ঘনত্ব মাপক, ওদিকে একটা আইসোটপিক দূষণ মাপক। এছাড়া রয়েছে আরও ১৮টা ইনস্ট্রুমেন্ট যেগুলো শুধুমাত্র বুস্টারের কর্মদক্ষতার হিসেব রাখার জন্য নির্দিষ্ট। একটু পরেই অবশ্য কম্পনের রেশ কমতে শুরু করলো। কানের মধ্যে ভেসে আসা ভনভনানি আওয়াজের তেজ-ও কমে এল। আর যে জোরালো গর্জনটা একটু আগেও কানে আসছিল, সেটাও এখন হালকা হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন আওয়াজটা এখন বহু দূর থেকে আসছে। তারপর একটু পরেই সবকিছু একদম নিস্তব্ধ।
আবার একটু পরেই, একটা হিসসসস্ শব্দ আর সেই সঙ্গে একটা গুন গুন আওয়াজ একদম হঠাৎ করে এমন ভাবে শুরু হলো যে পার্ক্স চমকে ওঠার সময় পেল না। ইতিমধ্যে যে মনিটরগুলো এতক্ষণ চুপচাপ ছিল এখন স্বয়ংক্রিয় সিকোয়েন্সার ব্যাবস্থা সেগুলোকে জাগিয়ে তুলেছে। সাধারণত দূরনিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা দিয়ে এগুলোর সংযোগ উড়ান শুরুর আগে পর্যন্ত কেটে রাখা হয়। যাতে আশেপাশের অন্য উড়ানের আনবিক বিস্ফোরণের জন্যে এদের সাথে যুক্ত ক্যামেরার লেন্সগুলো খারাপ না হয়ে যায়।
এই স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থার ব্যাপারটা কিন্তু বেশ দূর্দান্ত জিনিস তা মানতেই হবে। পার্ক্স ভাবতে শুরু করে। ভাবনা তখনও খুব একটা বেশি দূর যায় নি, হঠাৎ ওর মাথার প্রত্যেকটা চুল ওর গোল্লা-মত হেলমেটের নিচে সোজা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
আসলে হঠাৎ করেই কথাটা ওর মনে পড়ে গেছে। হে ভগবান, এবার তো আমিই, এবারতো তো আমারই পালা।
একদম সঙ্গে সঙ্গে পার্ক্স উড়ান শুরুর যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করে দিল। লিফ্ট-অফ্ কন্ট্রোলারটাকে শুরুয়াতি অবস্থানে তুলে দিল। এক এক করে সমস্ত কন্ট্রোলার আর লিভার গুলো গুনে গুনে আঙ্গুল দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে আর নির্দিষ্ট ক্রমে উঠিয়ে নামিয়ে সরিয়ে যেমন যেমন দরকার তেমন তেমন করতে শুরু করলো। “এক… দুই… তিন… আরে! চার নম্বরটা কোথায় গেল? এই তো… ঠিক আছে… এখন গেজ গুলো দেখি … এবার পেডাল… না, না, পেডাল না – হাতল গুলো… প্রথমে লালটা আর তারপর সবুজটা… এবার স্বয়ংক্রিয় সিকোয়েন্সার… ঠিক… না কি উল্টোটা হতো – আগে সবুজ, তারপরে লাল…?!”
পার্ক্সের মুশকিল আসানের জন্যই কিনা কে জানে, ঠিক এই সময়েই ওর কানের কাছে গমগম করে ঘোষণা হলো, “এএমইউ-২৭, পাইলট পার্ক্স! স্বয়ংক্রিয় কাউন্টডাউন জিরো হলে উড়ান শুরু করো। অ্যাটেনশন, তুমি তৈরি তো?
তুতলে উঠে ও বলতেই যাচ্ছিল, “এখনও না!”, কোনও রকমে নিজেকে আটকে তার জায়গায় বলে উঠলো, “পাইলট বোর্… ইয়ে, পাইলট পার্ক্স বলছি, এএমইউ-২৭ থেকে। আমি তৈরি হচ – ইয়ে – কাউন্টডাউন জিরো হলেই উড়ান শুরু করবো।”
পার্ক্স প্রায় আরেকটু হলে “পাইলট বোর্স” বলেই ফেলেছিল কেননা তখন পর্যন্ত ওর মনে বোর্সের কথাই ঘুরঘুর করছিলো। এবার সুনসান হয়ে যাওয়া নিস্তব্ধতার মধ্যে নিজেকে নিজেই একটা ঝাড় লাগলো, “ব্যাটা গাধা কোথাকার!” এদিকে ইতিমধ্যেই কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বয়ংক্রিয় একটা রেকর্ড করা গলায় – আরে রেকর্ড করা আওয়াজ-ই যদি শোনাবে তো সবসময় কেন যে সেটা এনসিও-র গলায় শোনায়! – আওয়াজটা হেড়ে গলায় বলে চলে, “মাইনাস সিক্সটিন, ফিফটিন, ফোর্টিন…”
এদিকে ঠান্ডার মধ্যেই পার্ক্স গলগল করে ঘেমে যাচ্ছে। ও একটা কিছু ভুলে গেছে। এমন কিছু যা ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ, জীবন মরনের ব্যাপার।
“… ছয়, পাঁচ, চার…”
দুটো হাতের তালুই ঘামে জবজব করছে। ঘেমো হাতের আঙ্গুল দিয়ে হাতলটা জোরে চেপে ধরে রাখে। ভাগ্যক্রমে হাতলটা খসখখসে। সবারই কি এই সময়ে এরকম ঘাম হয়? ও ভাবতে থাকে। সম্ভবত… তবে মোক্ষম সময়েই ওর মাথা কাজ করলো। ঠিক যখন ইয়ারফোনটা গর্জন করে বলে উঠলো “জিরো!!!”
আর তার আগেই ওর বাঁ হাতটা নিজে নিজেই এগিয়ে গিয়ে লিভারটা তুলতে শুরু করে দিল। তুলতেই থাকলো যতক্ষণ না ওটা অর্ধেকটা পর্যন্ত উঠে গেল।
একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণ। কোনও রাবারের মত শক্ত অথচ স্থিতিস্থাপক কিছুর চাপে ওর বুক আর মাথা যেন চেপ্টে যাচ্ছে।
বুস্টারটা! ওটা চালু হয়েছে। চোখের সামনে সবকিছু আবছা হয়ে যাওয়ার ঠিক আগে ঐটুকুই ওর মাথায় এসেছিল। যদিও এই অবস্থা বেশিক্ষণ রইলো না। একটু একটু করে ওর দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এল। যদিও সেই চাপটা নাছোরবান্দার মত ওর গোটা শরীরকে এখনও জড়িয়ে রেখেছে। আর দেরি হওয়ার আগেই ও এবার ভিডিও পর্দা গুলোর দিকে নজর দেয়। ওর একদম সামনের তিনটে পর্দাই এই মুহূর্তে সাদাটে একটা আলোর তীব্র স্রোতে ভেসে যাচ্ছে, যেন লক্ষ লক্ষ দুধের বালতি কেউ ওখানে একসঙ্গে উল্টে দিয়েছে।
আমি নিশ্চয়ই এখন মেঘের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, পার্ক্স ভাবলো। ওপরে ওঠবার সময় ওর চিন্তা শক্তি যদিও খানিকটা স্থবির হয়ে পড়েছিল, তবে এখন বেশ সুস্থির হয়ে গিয়েছে। যেমন যেমন সময় পেরোতে লাগলো ক্রমশঃ ওর নিজেকে আরও বেশি করে যেন কোনও এক অদ্ভুতুড়ে নাটকের দর্শকের মত মনে হতে লাগলো। ঐ তো, ওখানে ওর “ডেন্টিস্টের চেয়ার”টায় ও চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছে। হাত-পা অবশ যেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ, এখন আর কোন মেঘ দেখা যাচ্ছে না, অদ্ভুত একটা নীল আকাশ চারদিকে ঘিরে রয়েছে… আরে ওগুলো সব নক্ষত্র নাকি ওখানে, নাকি অন্য কিছু?
উঁহু। ওগুলো সবই নক্ষত্র।
ইতিমধ্যে সবকটা গেজ ঠিক ঠাক কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে – ছাদের দিকের গুলো, পাশের দেওয়ালের গুলো – প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কাজ, আলাদা আলাদা প্রয়োজন – এখন সবাই যে যার মত কাজ করে চলেছে। আর ওর কাজ হচ্ছে ওগুলোর প্রত্যেকটাকে সারাক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা। এর মধ্যে কোনও খামতি রাখলে চলবে না। ইয়ারফোনে টিং করে একটা শব্দ হলো। এটা একটা সংকেত। সঙ্গে সঙ্গে ওর বাঁ হাতটা এবারও নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়ে বুস্টার সেপারেসন চালু করে দিল। অমনি কেবিনের ভেতরের মারাত্মক চাপটা কমে গেল। রকেট এখন নির্ধারিত পথেই উড়ে চলেছে। গতিবেগ ৭.১ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে, উচ্চতা ২০১ কিলোমিটার, ত্বরণ ১.৯। হিসেব মাফিক সব ঠিক আছে। কাজেই ও এখন খানিক আরাম করে নিতে পারে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ হবে না। কেননা খুব তাড়াতাড়িই ওকে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে। কেন? দেখা যাক!
পার্ক্স এবার একটু আরাম করার সুযোগ পেয়েছে। চেয়ারের পেছনের হেলানটা একটু উঁচু করে নিতে সবে হাতলের জায়গা মত চাপ দিতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে কথাটা ওর মনে পড়লো। আর সঙ্গে সঙ্গে ও থমকে গেল।
“টুকলিপত্র! কোথায় গেল টুকলিপত্রটা?”
মুশকিল হচ্ছে দরকারী জিনিস দরকারের সময় কিছুতেই ওর মনে পড়ে না। পাগলের মত ও চারদিকে তাকিয়ে টুকলিপত্রটা খুঁজতে থাকে। সামনের গেজ-গুলো এখন ঝড়ের মত চলছে অথচ ওদের দিকে তাকানোর কথা এখন ও পুরো ভুলে গেলো। সব ভুলে ও এখন টুকলিপত্রটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কে জানে কখন সেটা ওর হাত ফসকে পড়ে গিয়েছে। এই দ্যাখো, ওটা তো দেখা যাচ্ছে ওরই চেয়ারে নিচে পড়ে আছে। শরীরটা বেঁকিয়ে নিচু হয়ে ওটা তুলে আনতে চেষ্টা করলো পার্ক্স। হচ্ছে না। এক গাদা স্ট্র্যাপ ওকে আটকে দিচ্ছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর সময় নষ্ট করা যাবে না। ওর যেন মনে হচ্ছে ওর পায়ের তলা থেকে মাটি ক্রমশঃ সরে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে নেভিগেশন বইটা বার করে। এতক্ষণ ওটা ওর থাই-পকেটের ভেতরেই রাখা ছিল। বইটা হাতে নিয়ে বের করে ফ্লাইট প্ল্যানের সেই খামটা। পুরো মাথাটা যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। বি৬৮ কক্ষপথটা যেন কোন চুলোর দিকে? পার্ক্স ট্র্যাজেক্টোমিটারটার দিকে তাকায়। ভালো করে দেখে নিয়ে একটা বড়ো করে হাঁফ ছাড়ে। যাক্, এটা তাহলে কাজ করছে।
রকেট এখন উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ধরে নিয়েছে। কম্পিউটার দয়াময়। তথ্য সংগ্রহ করছে, সংশ্লেষণ করছে। পার্ক্স সংশ্লেষিত তথ্য নিয়ে রকেট পরিচালনা শুরু করলো। একবার তো কক্ষপথ ছেড়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ঘ্যাচ করে ব্রেক করলো। এতটাই হঠাৎ করে করলো যে অভিকর্ষ নেগেটিভ হয়ে রইলো দশ সেকেন্ড ধরে। মিটারের ডায়াল দেখালো অভিকর্ষ -3g হয়ে গেছে। অসম্ভব শারীরিক সক্ষমতার জন্য খুব একটা অসুবিধা হলো না ওর । (বুলপেন একবার ওকে বলেছিলেন যে তোমার বুদ্ধির জোর যদি তোমার পেশী-শক্তির অর্ধেক-ও হতো তাহলেই তুমি একজন অসাধারণ মানুষ হয়ে যেতে।)। সংশ্লেষিত তথ্যের হিসেবে কষে ও রকেটটাকে আবার সুস্থিত কক্ষপথে ফিরিয়ে আনলো। কম্পিউটারে সেই সংশোধিত তথ্য ঢোকালো। কিন্তু ফলাফল এল শুধুমাত্র দোদূল্যমান সারি সারি তরঙ্গের ঢেউ। পার্ক্স সংখ্যাগুলো আরেকবার পড়ে দেখলো। বেশ জোরে জোরেই পড়লো আর তারপর বুঝলো যে ও আসলে স্যুইচ-ওভার করতে ভুলে গিয়েছিল। ভুলটা ঠিক করে নিলো পার্ক্স। সিআরটি-র পর্দায় উল্লম্ব রেখাটা এবার সোজা হয়ে দপদপ করতে লাগল। কম্পিউটারের মনিটরের একটার পর একটা উইন্ডো খুলে গেলো। “আহা! এবার আমি নিজের কক্ষপথে ঢুকে পড়েছি।” পার্ক্স এবার আনন্দে প্রায় নেচে ওঠে। তবে এই আনন্দ বেশিক্ষণের জন্য রইলো না। অবাক হয়ে দেখলো কম্পিউটারের হিসেবে কক্ষপথে ওকে থাকতে হবে চার ঘন্টা উনত্রিশ মিনিট। অথচ পরিকল্পনা মাফিক ওর লাগা উচিত চার ঘন্টা ছাব্বিশ মিনিট। তিন মিনিট বেড়ে গেছে। এইটুকু পার্থক্য কি চলতে পারে? উত্তর খুঁজতে মাথা ঘামায় পার্ক্স। জব্বর চেষ্টা করে। উঁহু। টুকলিপত্রটা চাই। ওটা এখনও চেয়ারের নিচে পড়ে আছে। তুলতে হলে ওকে স্পেসস্যুটের স্ট্র্যাপ খুলতে হবে। যদিও এটাও ও জানে যে উত্তরটা যদি টুকলিপত্রে না থাকে তো এতকিছু করেও কোন লাভ হবে না। স্ট্র্যাপ খোলার জন্য হাত ওঠাতে না ওঠাতে ওর প্রফেসর কাহল্-এর কথা মনে পড়ে গেল। “সমস্ত কক্ষপথ প্রোগ্রামিং-এর মধ্যেই কম-বেশি পয়েন্ট থ্রি পারসেন্টের মত ভুল থাকতে পারে।” কথাটা কতটা সত্যি ও জানেনা। তবে এটা জানে যে ঝামেলা রাখার কোন মানে হয় না। সমস্ত তথ্য ও কম্পিউটারে ঢোকালো। কম্পিউটারের দেখাচ্ছে অসুবিধা নেই। গড়বড় যা আছে তা খুই সামান্য। “ঠিক আছে। তাই সই!” হাঁফ ছেড়ে পার্ক্স এবার প্রথম বারের জন্য শান্তিতে নিজের চারপাশটায় তদারকি শুরু করলো।
চেয়ারে সঙ্গে বাঁধা থাকার জন্য একটু হালকা হালকা লাগা ছাড়া অভিকর্ষ কমে যাওয়াটা ও তেমন করে টের পাচ্ছে না। সামনের সমস্ত মনিটরের পর্দা জুড়ে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য নক্ষত্র। সব কটা পর্দার নীচের দিকে শুধু ঝকমক করছে একটা উজ্জ্বল সাদাটে রেখা। দুপাশের মনিটর গুলোতেও একই রকম দৃশ্য। শুধুই অন্ধকার শুন্যতা আর তার ওপরে নক্ষত্ররাজির বর্ণমালা। কিন্তু নিচের ডেকের পর্দায়, আহা! পৃথিবী। কি বিশাল! গোটা পর্দা জুড়ে ভেসে আছে পৃথিবী। দু-চোখ ভরে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে রইলো পার্ক্স। হিসেবমত ওর কক্ষপথে পৃথিবী থেকে সব চেয়ে কম দূরত্বে ওর বর্তমান অবস্থান, উচ্চতা সাতশো কিলোমিটার। সব চেয়ে দূরের অবস্থানে যখন পৌঁছবে তখন উচ্চতা হবে চব্বিশশো কিলোমিটার। আরে! ঐ তো ওখানে গ্রীনল্যান্ড, তাই না? কিন্তু সেটা ঠিক মত যাচাই করার আগেই ও পৌঁছে গেল উত্তর কানাডার ওপরে। চোখে পড়লো উত্তর মেরু ঢেকে রয়েছে রং-বেরং-এর তুষার। মহাসাগর গুলো মনে হচ্ছে পুরো গোল আর পেলব – রং যেন কালচে-বেগুনি, যেন ঢালাই লোহা। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মেঘ তেমন দেখাই যাচ্ছে না। খুবই কম। যাওবা অল্প কিছু চোখে পড়লো সেগুলো কে দেখে ওর মনে হলো যেন পৃথিবীর ওপরে, সবচেয়ে উঁচু কিছু বিন্দুতে জল ভরা পোটলার মত কিছু জিনিস রাখা রয়েছে।
ঘড়ির দিকে তাকায় পার্ক্স। ঠিক সতেরো মিনিট হয়েছে ও মহাকাশে ভাসছে।
এবার সময় হয়েছে পিএএল (ফেজ অলটারনেটিং লাইন)–এর সঙ্গে রেডিও যোগাযোগ করার। ও এতক্ষণে স্যাটেলাইটের আওতায় পৌঁছে গিয়েছে। এবার রাডারের পর্দায় নজর রাখতে হবে। এইজ্জা… কি যেন নাম ছিল ওটার? ‘আরও’? না, না – ‘জেও’। তারপরে কি একটা নাম্বার ছিল যেন… দুরছাই-
পার্ক্স ফ্লাইট প্ল্যান খুলে একবার দেখে নিয়ে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। নেভিগেশনের বইটাও ঢুকিয়ে দেয়। এবার বুকের কাছের একটা বোতামে চাপ দিয়ে ইন্টারকমটা চালু করে। প্রথমে খানিকক্ষন ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ – মহাজাগতিক ব্যতিচার। পিএএল যেন কোন সিস্টেম ব্যবহার করে? ও, হ্যাঁ – মর্স। মন দিয়ে শুনতে থাকে পার্ক্স। চোখ দুটো সাঁটিয়ে রাখে ভিডিওর পর্দায়। ওর ঠিক নিচে ধীর গতিতে আবর্তিত হয়ে চলে পৃথিবী আর চারদিকে ছড়িয়ে থাকে নক্ষত্রেরা – কিন্তু পিএএল কোথাও নেই।
অনেকক্ষণ পর একটা গুনগুন শব্দ ওর কানে এসে পৌঁছোলো।
এটাই কি? পার্ক্স আশ্চর্য হয়ে গেল। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেল যে এটা নয়। হতে পারে না। স্যাটেলাইট কখনো গুনগুন করে না। কিন্তু সেক্ষেত্রে এটা তাহলে কি? সম্ভবত কিছুই না। নাকি একটা অন্য কিছু?
কোনো বড়সড় গড়বড়?
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পার্ক্সের মধ্যে একটুও ঘাবড়ানোর চিহ্ন দেখা গেল না। কি করে তেমন কোন বড়সড় গড়বড় হতে পারে যেখানে ও এখন ইঞ্জিন বন্ধ করে রেখে উড়ে চলেছে?
সম্ভবত কোনও পুরোনো বাক্স-টাক্স পড়ে গিয়ে ভেঙ্গেছে-টেঙ্গেছে। নাকি কোন শর্ট-সার্কিট হলো? হে ভগবান, শর্ট-সার্কিট! ফায়ার প্রিভেনশন কোড, সেকশন থ্রি (এ): “কক্ষপথে অবস্থিত মহাকাশযানে আগুন”, অনুচ্ছেদ… ওঃ, কি ঝামেলা হলো রে বাবা! গুনগুন শব্দটা এখন বাড়তে বাড়তে ভনভন করছে। এতটাই জোরদার হয়ে গেছে যে অন্য আর সব সিগন্যালগুলোর ব্লিপ-ব্লাপ শব্দ ঐ ভনভনানির মধ্যে ডুবে গেছে।
আওয়াজটা ঠিক কেমন যেন … একটা মাছি যেন কোন বোতলে আটকা পড়েছে, পার্ক্স ভাবছিলো, ওকে কেমন যেন বিহ্বল লাগলো। ও এবার চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকটা ডায়াল আর মিটার গুলো নজর করতে শুরু করলো।
এবার ও দেখতে পেয়েছে।
দৈত্যাকার একটা মাছি। ঐ সেই জঘন্য কালচে-সবুজ শয়তান – যেগুলোর জন্মই হয়েছে ওর জীবনটা শোচনীয় করার জন্য – একটা জ্বালানে, বিরক্তিকর, আহাম্মক, আর, আর… একই সঙ্গে ধূর্ত আর ফন্দিবাজ একটা মাছি। ব্যাটাচ্ছেলে এখানে ঢুকলো কি করে? নিশ্চয়ই কোনও অলৌকিক ভাবে – আর তাছাড়া আর অন্য কিইবা হতে পারে? – এই কন্ট্রোল কেবিনে ঢুকে এখন কাঁচের বাটিটার বাইরে বোঁ বোঁ করে এদিকে ওদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে আর মাঝে মধ্যেই আলোকিত ডায়াল গুলোর উপরে গুলির মত গতিতে গিয়ে ধাই করে ঠোক্কর মেরে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ছে।
উড়তে উড়তে একেকবার যখন ওটা কম্পিউটারটার পাশে পৌঁছোচ্ছে, একটা চার-ইঞ্জিনের প্রপেলার প্লেনের মত আওয়াজ ওর ইয়ারফোনে ভনভনিয়ে উঠছে। আসলে কম্পিউটারের মাথায় একটা ব্যাকআপ মাইক্রোফোন রাখা রয়েছে। ওটা ওখানে রাখাই আছে যাতে পাইলট তাঁর ঢাকনা দেওয়া বদ্ধ চেয়ারে আধশোয়া অবস্থাতেও কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। এমনিতে দরকার পড়ে না। তবে কোনও কারনে যদি ভেতরের ফোন কাজ না করে বা তাঁর কাছে যদি ল্যারিঙ্গোফোন না থাকে তখন ওটাই একমাত্র ভরসা। এটা মহাকাশযানের অন্যান্য অসংখ্য ব্যাকআপ ব্যাবস্থার অন্যতম একটা।
মাছিটার মুন্ডপাত করতে করতে পার্ক্স মাইক্রোফোনটার দিকে নীল রশ্মি তাগ করে। ভয় পাচ্ছিলো যে অচলতড়িৎ-এর ধাক্কায় পিএএল-এর সংকেত ধরতে ভুল না হয়ে যায়। কম্পিউটারটার অবস্থা খুব ভালো কিছু নয়। তবে দেখা গেল একটু পরেই মাছিটা কেবিনের অন্যদিকে গিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। সন্মোহিতের মত পার্ক্সের নজর অনেকক্ষণ মাছিটার পেছন পেছন ঘুরতে থাকলো। তারপর একসময় হতাশ হয়ে গিয়ে “মরুকগে যাক” বলে ছেড়ে দিলো।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো যে এই মহাকাশযানে ওর হাতের কাছে কোন ডিডিটি স্প্রে গান নেই।
মরুকগে যাক।
বিজজজজজ… পার্ক্স চমকে ওঠে। মাছিটা। এখন কম্পিউটারটার মাথার ওপরে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। তাও আবার ঠিক ঐ মাইক্রোফোনটার কাছে। আবার তারপর খানিকক্ষন কোনও আওয়াজ নেই। নিশ্চুপ। নিঃশব্দ। মাছিটা যেন আর ডানা-ও ঝাপটাচ্ছেনা। ব্যাটা, শয়তানের বাচ্চা!
একটু পরেই একটা মৃদু অথচ স্থির ছন্দময় শব্দ ওর ইয়ারফোনে এসে পৌঁছোলো। ডট-ডট-ড্যাস-ডট-ডট-ড্যাস-ড্যাস-ডট-ডট-ডট-ড্যাস। পিএএল-এর সিগন্যাল আসতে শুরু করেছে।
পার্ক্স নিজেই নিজেকে বলে, ““এইবার পার্ক্স চোখ খুলে বসো!” চেয়ারটা একটু উঁচু করে উঠিয়ে নেয় যাতে তিন-তিনটে ভিডিও পর্দাতে একসাথে নজর রাখা যায়। পর্দার ওপরে যদিও এখন শুধুই রাডারের ফসফোরেসেন্ট আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। ও অপেক্ষা করতে থাকে। তবে রাডারের পর্দায় কিছু দেখা না গেলেও একটু পরেই ও শুনতে পেল একটা স্পষ্ট আওয়াজে কেউ কিছু বলছে।
“এ-সেভেন টেরালুনা, এ-সেভেন টেরালুনা, সেক্টর থ্রি, কোর্স ওয়ান হান্ড্রেড থার্টি, পিএএল পাথফাইন্ডার বলছি। অনুগ্রহ করে সাড়া দিন। ওভার।”
“যা-চ্চলে! এ আবার কে? আমার দুটো জেও-র সাড়াশব্দ কখন শুনতে পাবো?”
ইয়ারফোনের আওয়াজ আবার হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল। এক সেকেন্ড পরে একটা ছায়া ওর মুখের উপর এসে পড়লো। ছায়াটা পড়লো সরাসরি ওপর থেকে। যেন একটা বাদুর সোজা এসে ওপরের কোনো ঝুলন্ত আলোর উপর নেমেছে। না। এটা সেই মাছিটা। এখন ওর কেবিনের ওপরের ছাদে হামাগুড়ি দিচ্ছে। বোধহয় ভেতরে কি আছে তাই দেখার চেষ্টা করছে।
এদিকে এখন আরও বেশি করে ব্লিপ গুলো আসছে। খানিকক্ষন পরেই পার্ক্সের চোখে পড়ল ওর থেকে প্রায় চারশো বা তার চেয়ে কিছু বেশি ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে একটা পর্যবেক্ষণ গোলক। গোলোকটার সঙ্গে জোড়া আছে আশি মিটারের মত একটা লম্বা অ্যালুমিনিয়ামের সিলিন্ডার। অল্প সময়ের মধ্যেই ওটা ওকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল।
“পিএএল পাথফাইন্ডার থেকে এ-সেভেন টেরালুনা, ওয়ান-হান্ড্রেড-এইট্টি-পয়েন্ট-ফোর্টিন, ওয়ান-হান্ড্রেড-সিক্স-পয়েন্ট-সিক্স। রৈখিক বিচ্যুতি বেড়ে যাচ্ছে। আউট।”
“পিএএল সেন্ট্রাল, পিএএল সেন্ট্রাল। অ্যালবাট্রস-ফোর আরেসটেরা বলছি। রিফুয়েলিং-এর জন্য নেমে আসছি, সেক্টর টু। আমি রিফুয়েলিং-এর জন্য নেমে আসছি, সেক্টর টু। রিজার্ভ সরবরাহ চলছে। ওভার।”
এ-সেভেন টেরালুনা পিএএল পাথফাইন্ডার-কে ডাকছি…”
বাকিটা আর শোনা গেলো না। আবার সেই ভনভনানি শুরু হয়েছে। তবে খুব বেশিক্ষণ হলো না। একটু পরেই আবার সবকিছু নিস্তব্ধ।
“সেন্ট্রাল থেকে অ্যালবাট্রস-ফোর আরেসটেরা, সাত নম্বর চতুর্ভূজে রিফুয়েল হবে। ওমেগা সেন্ট্রাল, সাত নম্বর চতুর্ভূজে রিফুয়েল হবে। আউট।”
বোঁওওওওও… বোঁওওওওও… বোঁওওওওও…
ওরা নিজেদের রাঁদেভ্যুর জায়গা ঠিক খুঁজে নেবে। কিন্তু এই মাছিটা! পার্ক্স উত্তেজনায় এখন প্রচন্ড ঘামছে। স্পেসস্যুটের ভেতরে অন্তর্বাস পর্যন্ত ঘেমে চপচপ করছে। এ যা চলছে আমি তো কিছুই ঠিক করে শুনতে পাবো না।
বোঁওওওওও…বোঁওওওওও… বোঁওওওওও.
মাছিটা কম্পিউটারের চারদিকে পাগলের মত বোঁ বোঁ করে চক্কর কাটছে এমন যেন নাছোরবান্দার মত নিজেরই ছায়া কে নিজে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
“অ্যালবাট্রস-ফোর আরেসটেরা, অ্যালবাট্রস-ফোর আরেসটেরা বলছি পিএএল সেন্টাল শুনতে পাচ্ছো? সাত নম্বর চতুর্ভূজে নামছি। রেডিও সাহায্য চাই। অনুরোধ। আউট।”
বোঁওওওওও…বোঁওওওওও…বোঁওওওওও… বোঁওওওওও…বোঁওওওওও… বোঁওওওওও.
ভনভনানি এবার এতো জোরে হচ্ছে যে রেডিওর আওয়াজ ক্রমশঃ চাপা পড়ে যাচ্ছে। একদম চাপা পড়ে যাওয়ার আগে পার্ক্স যে খবরটা শেষ শুনতে পেল সেটা এইরকম –
“জেও-টু টেরালুনা। জেও-টু টেরালুনা ডাকছে এএমইউ-২৭ কে। ওভার।”
কেউ ডাকছে আমাকে। কে? পার্ক্স চমকে ওঠে। চমকটা একটু বাড়াবাড়ি রকম বেশি হওয়ায় ও স্ট্র্যাপের ফিতে টিতে ছিঁড়ে প্রায় লাফিয়েই উঠেছিল।
ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় ও কোনও রকমে শুধু বলে উঠতে পারলো, “এএমইউ – ”, ব্যাস তারপরেই ওর গলা বুজে এল। ইয়ারফোনে মাছিটার বোঁওওও ভনভনানি বেজে চলেছে। ওঃ! চোখ বন্ধ করে ফেললো পার্ক্স।
“এএমইউ-২৭ থেকে জেও-টু টেরালুনাকে বলছি, অবস্থান চার নম্বর চতুর্ভূজ, সেক্টর পিএএল। আমি নেভিগেশন লাইট অন করছি। ওভার।” শেষ পর্যন্ত কথাগুলো বলতে পারলো পার্ক্স। নেভিগেশনের লাইট গুলো ঝটপট অন করলো। দুপাশের দুটো লাল, নাকের ডগায় দুটো সবুজ আর পেছনে একটা নীল। এবার অপেক্ষা। মাছিটার আওয়াজ ছাড়া এখন আবার আর কোনও আওয়াজ নেই।
“জেও-টু দ্বিতীয় টেরালুনা, জেও-টু টেরালুনা, বলছি…” ভোঁওওও… বিজজজজ… ভোঁওওওও…
আমাকে বলছে কিছু? ঠিক শোনা যাচ্ছে না। পার্ক্স হতাশ। চোখ বুঁজে একমনে শোনার চেষ্টা করে।
না কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। জেও-টু দুটো থেকে কেউ কিছু একটা বলছিলো।
“এএমইউ-২৭ থেকে জেও-টু দ্বিতীয় টেরালুনা-কে বলছি। অবস্থান চতুর্ভূজ চার, সেক্টর পিএএল। আমি সমস্ত নেভিগেশন লাইট অন করেছি। ওভার।”
ও নিজে থেকেই বললো এবার। যখন ও বলতে শুরু করেছে ঠিক তখন দুটো জেও জাহাজই একসাথে বলতে শুরু করছে। কারও কথাই স্পষ্ট হচ্ছে না। পার্ক্স এবার সিকোয়েন্স সিলেক্টর সুইচ অন করলো। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। মারাত্মক ব্যতিচার। সব শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে মাছিটার ভনভনানি তো রয়েইছে।
“ওঃ মনে হচ্ছে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ি!” পার্ক্স ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু ওর মাথায় এল না যে এই ওজনহীন অবস্থায় সেটা অন্তত কিছুতেই সম্ভব নয়।
ঠিক এই সময়ে ওর চোখ পড়ল রাডারের পর্দায়। দুটো জাহাজকেই এখন দেখা যাচ্ছে। দুটোই এখন পিছন থেকে পাশাপাশি অনুসরণ করছে ওকে। দুটোর মধ্যেকার দূরত্ব বড়জোর ন’কিলোমিটার। কেন? এমন তো হওয়ার কথা নয়। এতো পাশাপাশি এতো কাছাকাছি চলতে তো মানা করা আছে। পাইলট জাহাজ হিসেবে এটা ঠিক করা এখন ওর দায়িত্ব। কমপক্ষে চোদ্দো কিলোমিটারের নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে চলার নিয়ম ওদেরকে দিয়ে পালন করাতে হবে।
জাহাজ দুটোর ব্লিপ পোজিসন রাডারের পর্দায় দেখতেই যাবে, ঠিক সেই সময়ে ওর পুরোনো দোস্ত, সেই মাছিটা, উড়ে এসে বসে পড়লো ওদেরই একটার ওপরে। হাতের কাছে নেভিগেশন বইটাই ছিল। পার্ক্স রাগের চোটে ওটাই ছুড়ে মারলো তাক করে। কিন্তু খেয়াল করে নি ফুসকুরির পেক্সিগ্লাসের দেয়ালটা রয়েছে মাঝখানে। ওটাতে ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে গেল নেভিগেশন বইটা। কিন্তু নিচে না গড়িয়ে পড়ে উল্টে লাফিয়ে উঠলো। উঠে গিয়ে ধাক্কা খেলো ফুসকুরিটার ছাদে। ধাক্কা খেয়ে আর নিচে পড়লো না কিন্তু। শুন্য অভিকর্ষের জন্যে ওখানেই ভেসে রইলো। আর ঐ অবস্থাতেই পাতাগুলো খুলে গিয়ে ফড়ফড় করে উড়তে লাগল। এদিকে মাছিটা এখনও যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে মহানন্দে রাডারের পর্দার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে।
“এএমইউ-২৭ টেরালুনা থেকে জেও-টু আর জেও-টু দ্বিতীয়। আমি তোমাদের দেখতে পাচ্ছি। তোমরা খুব কাছাকাছি উড়ছো। উড়ান পথের শূন্য-পয়েন্ট-শূন্য এক সংশোধন করে সমান্তরাল পথে স্যুইচ করো। সংশোধন শেষ হলে অপেক্ষা করো। আউট।”
ধীরে ধীরে রাডারের পর্দায় দুটো জাহাজের দুটো ব্লিপের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে লাগলো। সমস্ত যোগাযোগ অবশ্য এই মুহূর্তে বন্ধ। মাছিটা আবার গান গাইতে গাইতে কম্পিউটারের মাইক্রোফোনটার চারপাশে বেড়ানো শুরু করেছে। ছুড়ে মারার জন্য পার্ক্সের হাতের কাছে আর কিছু এখন আর নেই। নেভিগেশন বইটা এখনও ফুসকুরির আকাশে ভেসে আছে। পাতা গুলো ফরফর করে উড়ছে।
“পিএএল সেন্ট্রাল থেকে এএমইউ-২৭ টেরালুনা। বাইরের চতুর্ভুজ পরিত্যাগ করো। বাইরের চতুর্ভুজ পরিত্যাগ করো। আমি ট্রান্সসোলার কোর্স ধরে এগোচ্ছি। ওভার।”
আরে এ তো দেখছি পুরো বরবাদ করে দেবে। পার্ক্স ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠলো। তুমি কে হে আমাকে ট্রান্সসোলার দেখাবার? সবাই জানে মহাকাশযান যখন দল বেঁধে একসাথে ওড়ে তখন তাদেরকেই প্রাধান্য দিতে হবে। উত্তর দেওয়ার সময় রাগের চোটে ও প্রায় চীৎকার করে ওঠে। মাছিটাকে এতক্ষণেও কিছুই করতে না পারার বিরক্তিটাও একই সঙ্গে বেরিয়ে এল।
“এএমইউ-২৭ টেরালুনা থেকে পিএএল সেন্ট্রাল কে বলছি। না। আমি বাইরের চতুর্ভুজ পরিত্যাগ করছি না। তোমার ট্রান্সসোলার যাক মায়ের ভোগে। আমরা এখন ত্রিভুজ ফর্মেশনে উড়ছি। এএমইউ-২৭, জেও-টু আর জেও-টু দ্বিতীয়। স্কোয়াড্রন লীডার এএমইউ-২৭ টেরালুনা। ওভার।”
উগরে দিতে পেরে ওর রাগটা একটু কমে এল। এবার অন্য একটা চিন্তা মাথায় ঢুকলো। আমার ঐ “ট্রান্সসোলার যাক মায়ের ভোগে” বলাটা বোধহয় উচিত হলো না। পার্ক্স ভাবছিল। এর জন্য আমার বেশ কিছু পয়েন্ট ওরা নিশ্চই কেটে নেবে। ওঃ, ওরা যা পারে করে নিক। ওরাও সব যাক মায়ের ভোগে। হয়তো আর আমাকে উড়তেও দেবে না। না দিক।
এরকম সব বিচ্ছিরি ঘটনা শুধু ওর সঙ্গেই ঘটে। একটা মাছি! ওঃ, যেন কি বিশাল একটা জিনিস। যদি একবার ওরা এই বদমাশ মাছিটার কান্ড-কারখানার ব্যাপারে জানতে পারে তো আর দেখতে হবে না। ও যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে স্মিগা আর বোর্স হেসে হেসে পেট ফাটিয়ে ফেলছে। হঠাৎ ওর খেয়াল হলো যে আকাশে ওঠার পর এই প্রথমবার বোর্সের কথা ওর মনে পড়লো। কিন্তু এখন ওর নষ্ট করার মত একটুও সময় হাতে নেই। পিএএল সিগন্যাল ক্রমশঃ পিছিয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। অথচ অন্তত গত পাঁচ মিনিট ধরে ওরা একই সাথে উড়ছে।
“এএমইউ-২৭ থেকে জেও-টু আর জেও-টু দ্বিতীয় টেরালুনাকে। এখন টোয়েন্টি জিরো সেভেন আওয়ার্স। টেরালুনা অধিবৃত্ত কক্ষপথে ঢোকার সময় শুরু হবে ঠিক টোয়েন্টি টেন আওয়ার্সে। পথ একশো এগারো…”। সরাসরি ফ্লাইট শীট দেখে দেখে ও পথের নির্দেশ দিয়ে গেল। যদিও ব্যাপারটা সহজ ছিল না। মাথার ওপরের প্যানেলটা থেকে দেখে দেখে পড়ার জন্য ওকে বেশ খানিকটা জিমন্যাস্টিকের কসরত করতে হলো। দুটো জেও জাহাজেরই উত্তর অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওর মধ্যে দিয়ে চলে এল। পিএএল এখন আরও একটু কমে গেছে। প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। সিগন্যালের আওয়াজ কিন্তু এখনও হালকা হলেও পাচ্ছে। নাকি সিগন্যাল নয়, ও যেটা শুনতে পাচ্ছে সেটা ঐ মাছিটার গুনগুনানি?
ঠিক এই সময়ে এক মুহূর্তের জন্য হলেও ওর হঠাৎ মনে হলো মাছিটা যেন সংখ্যায় বেড়ে গিয়েছে। একই সময়ে যেন দু জায়গা থেকে আওয়াজ এল। পার্ক্স চোখ কচলে নিয়ে আবার তাকিয়ে দেখে। ঠিক, যা ও ভেবেছে। মাছি আসলে একটা নয়, দু-দুটো। এই দু নম্বরটা আবার কোথা থেকে এসে হাজির হল?!
এবার তবে আমি পুরোপুরি ডুবলাম। পার্ক্সকে কিন্তু আশ্চর্য রকমের শান্ত দেখাচ্ছে। আবেগের লেশ মাত্র চিহ্ন এখন ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। উল্টে ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এবার এতক্ষণে ও স্বস্তি পেয়েছে। আর কিছুতেই কিছু এসে যায় না। একটা হোক কি দুটো। সব দিক থেকেই ও এবার ডুবেছে। যদিও ঘড়ির দিকে চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর চিন্তা ভাবনা আবার ঘুরে গেল। ঘড়িতে এখন ২০১০ আওয়ার্স। ও নিজেই এই সময়টা নির্দিষ্ট করেছিল পথ পরিবর্তনের – অথচ ও নিজেই এখনও পর্যন্ত তৈরি নয়। এমনকি হাতটাও এখনও পর্যন্ত কন্ট্রোলের উপরে তোলে নি।
রোজকার ট্রেনিং-এ যেভাবে ওদের নিংড়ে দেওয়া হতো, তার একটা ভালো দিক-ও আছে। যেটা পার্ক্সকে এখন দেখে বোঝা গেল। এক মুহূর্ত সময় আর নষ্ট না করে দুটো কন্ট্রোল হাতল-ই ও একসঙ্গে পাকড়ে ধরলো। প্রথমে বাঁ দিকেরটা টানলো, তারপর ডান দিকেরটা। সারাক্ষণ ওর চোখ সেঁটে রইলো ট্রাজেক্টোমিটারের উপর। প্রথমে একটা ফাঁকা গর্জন করে ইঞ্জিনটা সাড়া দিলো। তারপর ধীরে ধীরে গর্জনটা ধীরে ধীরে ঢিমে হতে হতে শেষে ফিসফিসে হয়ে গেল। আউচ! কিছু একটা পড়েছে ওর কপালের ওপরে। ঠিক ওর ভাইজারটার নীচে। নড়ছে না ওটা। স্থির হয়ে আছে কপালের ওপর। সেই নেভিগেশন বইটা! কিছুই এখন দেখতে পাচ্ছে না ও। বইটা না সরালে দেখতেও পাবে না। কিন্তু কন্ট্রোল থেকে হাত না উঠিয়ে বইটা ও সরাতেও পারবে না। এদিকে ওর ইয়ারফোন আবার জেগে উঠে অস্থির হয়ে পড়েছে। মাছি দুটো এবার একসাথে কম্পিউটারের ওখানে গান গাইতে গাইতে প্রেম পর্ব শুরু করেছে। উফ, যদি একটা বন্দুক আমার কাছে থাকতো। ভাবতে ভাবতে টের পায় বইটা ওর নাকটাকে চেপ্টে দিচ্ছে। নিশ্চয়ই ত্বরণ এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে। প্রচন্ড হতাশায় ও মাথাটা পাগলের মত এদিক ওদিক ঝাঁকাতে থাকে। ওকে ট্রাজেক্টোমিটারটা যে ভাবে হোক দেখতেই হবে। না হলে কি দেখে ও পথ নির্দেশ দেবে! হঠাৎ করেই বইটা নিচে পড়লো আর সঙ্গে সঙ্গে ধড়াম করে একটা জোরালো আওয়াজ হলো। হবেই, ফোর-জি ত্বরণে ওটার ওজন কমপক্ষে তিন কিলোর মত হয়ে গিয়েছে। তবে এর ভালো দিকটা হলো যে এখন ও দেখতে পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ও পথ পরিবর্তনের জন্য দরকারী নির্দেশ গুলো চীৎকার করে দিতে শুরু করলো। ত্বরন টু-জি’তে নেমে আসতেই হাতল দুটোকে ও ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিয়েই নজর দিলো প্রেমে মত্ত মাছি দুটোর দিকে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে না যে ঋণাত্মক ত্বরণে ওদের বিন্দুমাত্র কোনো অসুবিধা হচ্ছে। উল্টে মনে হচ্ছে যেন সুখের সপ্তম স্বর্গে রয়েছে। হুম, আরও তিরাশি মিনিট সময় লাগবে এখনও। এবার রাডারস্কোপটা একবার দেখে নেয়। দুটো জেও জাহাজই এখন অনেকটা পিছিয়ে গেছে। ৭০ কিলোমিটার পেছন থেকে এখন ওকে অনুসরণ করছে। ত্বরণ যখন ফোর-জি’তে উঠেছিল তখনই সম্ভবত আমি লাফিয়ে এগিয়ে এসেছি। তবে ঠিক আছে। এতে চিন্তার তেমন কিছু নেই।
ত্বরান্বিত এই গতিতে এখন যতক্ষণ ওড়া চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত হাতে একটু আরাম করার মত সময় আছে। টু-জি বেশ সহ্য করে নেওয়া যায়। তা সে ওর ওজন সব ধড়াচূড়ো মিলিয়ে যতই ১৪২ কিলো হোক না কেন। কতবারই তো সেন্ট্রিফিউজের ভেতরে আধ ঘণ্টা বা তারও বেশিক্ষণ ধরে সময় ও ফোর-জি’তে কাটিয়েছে!
কিন্তু তাহলেও এটা কোনও চড়ুইভাতির জায়গা নয়। উল্টে এখানে তোমার হাত-পা মনে হবে লোহার মত ভারী, তোমার মাথা পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দেবে অন্ধ করে দেওয়ার মত তীব্র আলোর মধ্যে…
বাকি দুটো জাহাজের অবস্থান এখন আরেকবার দেখে নেয়। তারপর আবার বোর্সের কথা ভাবতে শুরু করে। ওকে তো আজকে পুরো একজন মুভি স্টারের মত লাগছিল। চোয়ালটাতো ওর এমনিতেই দেখবার মত। আর দীর্ঘ উন্নত নাক নিয়ে তো কিছু বলারই নেই। আর ঐ ইস্পাত ধূসর চোখ দুটো!… বাজি রাখতে পারো যে ওর টুকলিপত্রের কোন দরকারই পড়তে পারে না। কিন্তু এটা ভাববার বিষয় যে, এখনও পর্যন্ত ও…
ইয়ারফোনে এখন আর কোনও আওয়াজ হচ্ছে না – একদম নিস্তব্ধ।
মাছি দুটো এখন ফুসকুরির ওপরে এমন ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে যে ওদের ছায়া এসে পড়ছে পার্ক্সের মুখের ওপরে। আর এই প্রথমবার এত কাছের থেকে ওদের চেহারা দেখে ও একটু হলেও ঘাবড়ে গেল। নিচের থেকে ওদের ছোট ছোট কালো থাবার চোষক-চাকতি গুলো বীভৎস বড়ো বড়ো লাগছে, ওপর থেকে নেমে আসা আলোয় ওদের শরীর থেকে যেন ধাতব ঝলকানি ছিটকে আসছে…
“দাসের-এইট আরেসটেরা থেকে ত্রিভুজ টেরালুনা, চতুর্ভূজ সিক্সটিন, পথ ওয়ান-হান্ড্রেড-ইলেভেন-পয়েন্ট-সিক্স। তোমরা এগারো মিনিট থার্টি টু সেকেন্ড অভিসারী পথে আছো। পথ পরিবর্তনের উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। ওভার।”
অহো ভাগ্য আমার! পার্ক্স নিজের মনে বিড়বিড় করে ওঠে। সবসময় কোনও না কোনও চতুর-বান্দা এসে আমার সব কাজকর্ম বিগড়ে দেবে… ব্যাটা কি দেখতে পাচ্ছে না আমরা ত্রিভুজ ফর্মেশনে আছি?
“এএমইউ-২৭ স্কোয়াড্রন লীডার ত্রিভুজ টেরালুনা জেও-টু জেও-টু দ্বিতীয় থেকে দাসের-এইট আরেসটেরা। নেগেটিভ, আমরা সংগঠিত ভাবে উড়ছি। তোমার উড়ান পথ পরিবর্তনের পদ্ধতি শুরু করো। আউট।”
বলতে বলত পার্ক্স চেষ্টা করে অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশকারী জাহাজটাকে রাডারে খুঁজে বের করতে। ঐ তো ওটা – আরে, ১৫০০ মিটারেরও কম দূরত্বে!
“দাসের-এইট থেকে এএমইউ-২৭ টেরালুনা। গ্র্যাভিমিটার সিস্টেমের সমস্যা। দাসের-এইট পথ পরিবর্তন করতে পারবে না। ত্রিভুজ সংগঠন তাৎক্ষণিক পথ পরিবর্তন চালু করো। পরিবর্তন প্রতিচ্ছেদ বিন্দু ফর্টি-ফোর-জিরো-এইট। স্থানাঙ্ক লুনা ফোর, পরিসীমা অঞ্চল। ওভার।”
“এএমইউ-২৭ থেকে দাসের-এইট আরেসটেরা, জেও-টু জেও-টু দ্বিতীয়। পথ পরিবর্তন বিচ্যুতি শুরু ২০৩৯ আওয়ার্স। বিচ্যুতি শুরু হবে স্কোয়াড্রেন লীডারের সাথে একসঙ্গে একই সময়ে দৃষ্টি সহায়ক পরিসীমার মধ্যে। উত্তর দিকের বিচ্যুতি লুনা সেক্টর ওয়ান জিরো পয়েন্ট সিক্স। আমি স্বল্প-পরিসরের থ্রাস্টার গুলো চালু করছি। ওভার।”
বলা শেষ করেই পার্ক্স স্বল্প ক্ষমতার দুটো জেটই একসাথে চালু করে দেয়। দুটো জেও জাহাজ-ও একই সঙ্গে ওকে অনুসরণ করে। আর একটু পরে তিনটে জাহাজই একসাথে নির্দেশিত পথে মোড় ঘোরায়। ভিডিওর পর্দায় নক্ষত্রের দল সরে সরে যেতে থাকে।
দাসের ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে লুনা সেন্ট্রালের দিকে এগিয়ে যায়। পার্ক্সের আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। ও দাসের-কে নিরাপদ অবতরণের শুভেচ্ছা জানায়। ওর নিজেকে বেশ হীরো হীরো লাগছিল। বিপদগ্রস্থ কোন জাহাজকে সাহায্য করা কি চাট্টিখানি ব্যাপার! আরো হাজার কিলোমিটারের মত এই পথেই পার্ক্স এগিয়ে চললো। লক্ষ্য রাখলো পেছনের জেও জাহাজ দুটো ঠিকঠাক অনুসরণ করছে কি না। এবার আবার পূর্ব নির্ধারিত কক্ষপথে ফেরার পালা। ও জেও জাহাজ দুটোকে ফেরার পথ নির্দেশ দেওয়া শুরু করলো। এটা বলা যত সহজ, করা ততটাই কঠিন। রাস্তা হারানো কোন ব্যাপারই না। কিন্তু খুঁজে পেতে সঠিক পথে প্রত্যাবর্তন কঠিন কাজ। আর পথটা যদি উপবৃত্তাকার হয় তো সেটা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। একে তো আলাদা আলাদা ত্বরণে চালাতে হচ্ছে, তার উপর কম্পিউটারটাও এতো জলদি জলদি বিভিন্ন ফলাফল দিয়ে যাচ্ছে যে স্থানাঙ্ক গুলো ঠিক ঠাক পড়ে উঠতে পারছে না। তার উপর ঐ মাছি দুটোতো আছেই ওর ঝামেলা বাড়িয়ে তোলার জন্য। এই এক্ষুনি ওরা কম্পিউটারের পর্দার ওপরে হামাগুড়ি কাটছে তো আবার একটু পরেই রাডারের পর্দার ওপরে গিয়ে কুমীর-ডাঙ্গা খেলছে। কোথ্থেকে ওরা এত এনার্জি পায়? পার্ক্সের অবাক লাগে। মোটামুটি কুড়ি মিনিটের মত সময় লেগে গেল ওদের পূর্ব নির্ধারিত কক্ষপথে ফিরে আসতে। ফিরেই ওর আবার মনে পড়ে গেল বোর্সের কথা। ও নিশ্চিত একদম নির্ঝঞ্ঝাট চালিয়ে চলেছে। ঝঞ্ঝাট? তাও আবার বোর্সের সামনে? উঁহু। কপাল করে আসা ছেলে ও।
ঠিক তিরাশি মিনিটের মাথায়, শুন্য ত্বরণে পৌঁছোবার জন্যে, যেমন শেখানো হয়েছিল, পার্ক্স স্বয়ংক্রিয় থ্রাস্ট কন্ট্রোলারটা অন্তিম মাত্রায় ঠেলে দিলো। আর তারপরেই ও দেখতে পেল। দেখেই ওর ঘর্ম-শোষক অন্তর্বাসের ভেতরটা পর্যন্ত জমে বরফ হয়ে গেল।
সামনের ড্যাসবোর্ডের একটা সাদা রঙের প্যানেল খুলে বেরিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, বেরিয়ে এসে গড়িয়ে নামতে শুরু করেছে। একেক বারে একেক মিলিমিটার করে নেমে আসছে। সম্ভবত এটা শুরু থেকেই ঢিলে ছিল। অন্তত পার্ক্সের তো তাই মনে হচ্ছে। তারপর এই কক্ষপথ থেকে ঐ কক্ষপথ করার সময় যা সমস্ত ঝাঁকুনি হয়েছে, অবশ্য পার্ক্স যে সব সময় মসৃন ভাবে জাহাজ চালিয়েছে সেটা ও নিজেও দাবি করছে না, তাতেই ওটা আরও ঢিলে হয়ে গিয়ে এখন পুরো খুলে বেরিয়ে এসেছে। আর এখনকার এই ত্বরান্বিত গতিতে, এখনও ওয়ান পয়েন্ট সেভেন জি-তে জাহাজ চলছে, প্যানেলটা ধীরে ধীরে জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। যেন কোনও অদৃশ্য সুতো দিয়ে কেউ ওটাকে টেনে নামিয়ে আনছে। কাঁচের দেয়ালের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে গড়াতে গড়াতে ডেকের উপর স্থির হয়ে পড়ে আছে। ফলে খোলা জায়গাটা হাঁ হয়ে গিয়ে চার-চারটে হাই ভোল্টেজের তামার তার আর একটা ফিউজ দেখা যাচ্ছে।
এতে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? পার্ক্স নিজেকে বোঝায়। একটা ইলেকট্রিক প্যানেল খুলে গেছে। এমন কি বিশাল ব্যাপার। একটা প্যানেল খোলা থাকলেও জাহাজ আরামসে চলতে পারবে। পারবে না?
পারতেই পারে। তবে পারলেও এসব মোটেও হেলাফেলা করার মত ব্যাপার নয়। পার্ক্স উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এমন ঘটনা কিন্তু ঘটার কথা নয়। আর যদি এভাবে একটা ফিউজ প্যানেল খুলে চলে আসতে পারে তো জাহাজের লেজ ভেঙ্গে খুলে পড়াটা কে আটকাবে?
এই ত্বরান্বিত গতিতে এখন আরও সাতাশ মিনিটের উড়ান বাকি রয়েছে। এটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা চিন্তা ওর মাথায় ধাক্কা মারলো। সাতাশ মিনিট পরে ইঞ্জিন বন্ধ হলেই তো এই প্যানেলটা ওজনহীন হয়ে যাবে। তাতে কি কোন বিপদ বাধাবে? উঁহু, মাথা নাড়ে পার্ক্স। তেমন কিছু হওয়ার কথা নয়। প্যানেলটা সেই হিসেবে অনেক হালকা। এমনকি কাঁচ-টাচ ভাঙ্গার পক্ষেও অনেকটাই হালকা। নাঃ, সেরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই…
কিন্তু মাছি জোড়া এতক্ষণ কি করছে? নজর ঘোরাতেই পার্ক্সের চোখ ওদের ওপরে গিয়ে পড়ে। দুটোতে সাঁ সাঁ করে উড়ছে, ভনভন করে গুনগুনাচ্ছে, ফুসকুরিটার বাইরের চারদিকে গোল গোল চক্কর কাটছে, এ ওকে তাড়া করছে। আর এই করতে করতেই মাছি দুটো ওর চোখের সামনেই উড়তে উড়তে গিয়ে নামলো সেই ফিউজ প্যানেলটার পেছনে। তারপরে দুটোই পার্ক্সের নজরের বাইরে।
পার্ক্স এবার রাডারস্কোপে জেও জাহাজ দুটো খুঁজে বার করলো। দুজনেই এখনও ঠিক পথেই আছে। সামনের ভিডিও পর্দায় চাঁদের গোলকটা এখন বিশালাকায় হয়ে উঠেছে। পর্দার অর্ধেক জুড়ে এখন শুধুই চাঁদের মুখটা দেখা যাচ্ছে। ওর মনে পড়লো সেই সেবার টায়কো ক্রেটারে এসে একের পর এক গাদাগুচ্ছের সেলেনোগ্রাফিক অনুশীলনের সময় বোর্স কিভাবে একটা ছোট্ট থিয়োডোলাইট দিয়ে… ধ্যাততেরিকা, কেন যে ছেলেটা সব কিছুতেই এতটা চৌকস হলো! যাকগে। পার্ক্স নজর দেয় ভিডিও পর্দায় চাঁদের উপর। মেয়ার ইমব্রিয়ামের পূব দিকে আর্কিমিডিস ক্রেটারের বাইরের ঢালের দিকটা এখন দেখা যাচ্ছে। ঢালের উপরের দিকেই চন্দ্র ঘাঁটিটা থাকার কথা। পার্ক্স খুঁজতে থাকে। ক্রেটারের ঢালের বিশাল বিশাল পাথরের মধ্যে এমন ভাবে ক্যামোফ্লেজ করে ঘাঁটিটা তৈরি যে ওপর থেকে প্রায় অদৃশ্য। শুধু অবতরনের জন্য এক ফালি মসৃন জমি আর নির্দেশক আলোগুলো ছাড়া কিছুই এমনিতে দেখা যায় না – তাও যখন এধারটা চাঁদের রাত্রির দিকে থাকে। এখন তো দিনের দিকে। সূর্যের আলো এখন ঝকঝক করছে। যদিও এই মুহূর্তে চন্দ্র-ঘাঁটিটা ক্রেটারের চওড়া ছায়ার মধ্যে ঢুকে আসছে। চাঁদের বুকের দিনের তীব্র ঝকঝকে আলোর বিপরীতে অবতরণের নির্দেশক আলোগুলো এখন দূর্বল ম্যাড়মেড়ে হয়ে আছে।
চাঁদকে দেখে এই মুহূর্তে পার্ক্সের মনে হচ্ছিল যেন মানুষের পা কোনদিনও ওখানে পড়ে নি। এখন বিস্তৃত ছায়া একদিকে চান্দ্রেয় আল্পস থেকে শুরু করে অন্য দিকে সী অফ রেইনস বা মেয়ার ইমব্রিয়াম পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। ওর এখনও মনে আছে, প্রথমবার যখন এখানে এসেছিল – অবশ্য এসেছিল শুধুমাত্র যাত্রী হিসেবে, পাইলট নয় – তখন কিভাবে ওকে মুর্গি করা হয়েছিল। বুলপেন ওকে ডেকে চাঁদের বুক থেকে সপ্তম উজ্জ্বলতার কোনও নক্ষত্র দেখা যায় কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখতে বলেছিল। আর ও এতটাই বোকা যে প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে সেটা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মোদ্দা কথাটা ও ভুলেই গিয়েছিল যে প্রতিফলিত সূর্যালোকের প্রচন্ডতায় চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে কোনও নক্ষত্রই দিনের আলোয় দেখা যায় না। সপ্তম উজ্জ্বলতার নক্ষত্রের দেখা পাওয়া তো দূরের কথা। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর তবে বুলপেন ওকে ঐ নক্ষত্র খোঁজার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
পর্দায় চন্দ্র গোলোকটা ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ভিডিও পর্দার বাকি অন্ধকার জায়গা গুলো ক্রমশঃ ঢেকে দিতে লাগলো।
“বাঃ, এতক্ষণে একটাই ভালো ব্যাপার —ঐ ভনভনানি গুঞ্জনটা আর এখন কানে আসছে না।” পার্ক্স এদিকে ওদিকে তাকিয়ে মাছি দুটোকে খোঁজার চেষ্টা করতে থাকে। আর একটু পরেই চমকে ও প্রায় সোজা হয়ে ওঠে।
দুটোর মধ্যে কোনও একটা মাছি এখন ওই খোলা প্যানেলটার ভেতরে গিয়ে ডানা পরিষ্কার করতে বসেছে আর জোড়ার অন্যটাকে দেখা যাচ্ছে তার চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে। মনে হয় প্রেম নিবেদন করার চেষ্টা করছে। বসে থাকা মাছিটার থেকে কয়েক মিলিমিটার দূরেই তামার একটা তারের খোলা মুখ। ইনসুলেসন নেই বলেই বোধহয় তারের ওখানটা ঝকঝক করছে। এটা হচ্ছে সবচেয়ে কাছের তারটা। পাশেই আরো তিনটে তারের শেষ প্রান্ত। চারটে তার-ই প্যানেলটা খোলা থাকায় এখন উদোম হয়ে গেছে। তার গুলো এক একটা পেন্সিলের মত মোটা আর প্রত্যেকটাতেই ভোল্টেজ রেঞ্জ হবে হাজার ভোল্টের মত। প্রত্যেকটা তারের মধ্যে সাত মিলিমিটারের মত ফাঁকা জায়গা। ফাঁকটা যে ঠিক সাত মিলিমিটারেরই, বেশি-ও নয় বা কম-ও নয়, সেটা হঠাৎ করেই পার্ক্স একদিন একটা দূর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে জানতে পেরেছিল। সেবার একদিন অনুশীলন করার সময় ওরা হঠাৎ একটা গোটা সার্কিট নষ্ট করে ফেলেছিল। সেটা ঠিক করতে গিয়ে যখন ও কিছুতেই তার-গুলোকে ঠিকঠাক জায়গা মত বসাতে পারছিল না, সেই তখন ইনস্ট্রাক্টরের কাছে ও এই সমস্ত কায়দা কানুন শিখেছিলো।
এরই মধ্যে, যে মাছিটা এতক্ষণ প্রেম নিবেদন করছিল, সেটা প্রেম করার থেকে একটু বিরতি নিয়ে এখন দেখতে পাচ্ছে দুনিয়াদারি করতে বেরিয়েছে। তাও কোনদিকে, না, লাইভ টার্মিনালের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছে। বেড়াতে যাওয়া এমনিতে খারাপ কোনো কাজ নয়। যদি না, কেউ হঠাৎ করে গান গাইতে গাইতে একটা খোলা ইলেকট্রিক্যাল প্যানেলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে খোলা তারের উপর বসে পড়ে। বসেই যদি আবার পাশেরটায় তারটায় পা রাখার চিন্তা ভাবনা করে তো সেটা আরও খারাপ ব্যাপার হয়ে যায়। মাছিটা মনে হয় ঠিক এটাই করতে চেয়েছিল। যেন গোটা কেবিনে আর যথেষ্ট বেড়াবার মত জায়গা ছিল না। সে না থাকুক, পার্ক্স তখন ভাবছে অন্য কথা। ও ভাবছিল মাছিটা যদি এখন ওর সামনের থাবাটা একটা তারে এগিয়ে দিয়ে পেছনের পা-টা অন্য একটা তারের উপরে রাখে তাহলেই মহা সমস্যা। ঠিক আছে, যদি তেমন করেই ফেলে তবে কি কি হতে পারে? খুব খারাপ হলে, বড়জোর একটা সর্ট সার্কিট হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে – একটা মাছি?! একটা সামান্য মাছি কি তেমন বড় কিছু করার মত ততটা বড়? আর যদি তেমনটা ধরেও নেওয়া যায় তাহলেও খুব বেশি কিছু হওয়ার তো কথা নয়। বড়জোর ক্ষণিকের জন্য একটা ব্লোআউট হবে, সার্কিট ব্রেকার বিদ্যুতের চলাচল বন্ধ করে দেবে, মাছিটা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবে, জ্বলে ছাই হয়ে যাবে। ব্যাস, আর তারপর আবার বিদ্যুৎ চলাচল শুরু হয়ে যাবে – মাঝখান থেকে শুধু, বিদায় হে প্রেমিক মাছি!
পার্ক্স যেন একটা ঘোরের মধ্যে সন্মোহিতের মত হাই-টেনশন বক্সটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। গোপনে হলেও মনে মনে আশা করেছিল যে মাছিটা এ বিষয়ে আরেকটু চিন্তা ভাবনা করবে। একটা শর্ট সার্কিট এমন গুরুতর কোনও ব্যাপার না, একটি ছোট ঝামেলা, কিন্তু কেউ তো জানে না ঠিক কি কি ঘটতে পারে…
আর মাত্র আট মিনিটের মত বাকি। উড়ানের ঋণাত্মক ত্বরণ এখন ধীরে ধীরে শুন্যের কাছে গিয়ে পৌঁছোচ্ছে। আট মিনিটের মাথায় অবতরণ। পার্ক্স তখনও ডায়ালটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল যখন কেবিনের সব আলোগুলো একবার ঝলসে উঠেই নিভে গেল। ক্ষনিকের জন্য পুরো অন্ধকার। তবে ঐ মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্যেই। কিন্তু মাছিটা! পার্ক্স দম বন্ধ করে অপেক্ষা করে কখন সার্কিট ব্রেকারটা আবার কখন কাজ শুরু করবে আর তারপর আলো জ্বলে উঠবে। আলো জ্বললো।
জ্বললো ঠিকই, কিন্তু কেমন যেন ম্লান একটা ভাব। আর আলোটা সাদা নয়। কেমন যেন কমলা-বাদামি হয়ে রইলো। তারপর আবার দ্বিতীয়বারের জন্য চলে গেলো। আবার সম্পূর্ণ অন্ধকার। তারপর আবার এল। চলেও গেল আবার। আবার এল। আবার চলে গেল। আর তারপর এই আসা আর যাওয়া চলতেই লাগলো – শুধু যখন আসছে আর আলো জ্বলে উঠছে তখন সেটা সাধারণত যেমন উজ্জ্বলতা ছড়ায় তেমন নয়। আলোটা যেন অর্ধেক অ্যাম্পিয়ারেজে জ্বলছে।
গড়বড়টা কোথায় হচ্ছে? বারবার আলো আসা আর যাওয়ার ফাঁকে যতটুকু সময় আলো পাওয়া যাচ্ছে ততটুকুর সদ্ব্যবহার করে, যতটা সম্ভব কখনো চোখ কুঁচকে তো কখনো চোখ বড় বড় করে, পার্ক্স সমস্যাটার মূল কারণ একটু পরেই বের করে ফেললো। মাছিটা দুটো তারের মধ্যে ঝুলে আছে। ঠিক মাছিটা না। ওটার ছাই হয়ে যাওয়া মৃতদেহটা। একটা ছিলকার মত দুটো তারের মধ্যে ঝুলে আছে। দুলছে। আর ঐ ভাবে থেকে বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
পার্ক্স এখন ভয় পাওয়ার মত জায়গা থেকে অনেক দূরে এসে গেছে। এটা ঠিক যে ওর স্নায়ুতন্ত্রের অবস্থা এখন বাজে রকমের ঢিলে। কিন্তু উড়ান শুরুর পর থেকে ধরলে কখনোই বা ও নিশ্চিন্তে ছিল? কেবিনের ঘড়িটা খুব আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে। ভাগ্য ভালো যে রাডারস্কোপটার মতই বাকি ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেল গুলোর-ও নিজস্ব আলাদা আলোর ব্যবস্থা আছে। কেবিনের সব আলো জ্বালানোর মত দম আর না থাকলেও ব্যাকআপ সার্কিটে এখনও যত টুকু দম বেঁচে আছে তাই দিয়েই ওগুলো এখনও চলছে।
এদিকে আর মাত্র চার মিনিট বাকি ইঞ্জিন বন্ধ হতে। এটা একটা ভালো কথা, ওর মাথা থেকে অন্তত একটা ভার তো নামলো। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইঞ্জিন বন্ধ করার জন্য থ্রাস্ট টার্মিনেটর-কে প্রোগ্রাম করাই আছে। হঠাৎ ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিম শীতল বরফ জলের স্রোত নেমে গেল। আরে, সার্কিটটাই তো সর্ট হয়ে রয়েছে! কিল-স্যুইচটা কাজ করবে কিভাবে?
প্রথমে কিছুক্ষণ তো ও মনেই করতে পারলো না ওগুলো একটাই সার্কিটে চলে না ওগুলো পুরো রকেটটার বিদ্যুৎ সরবরাহের মেন ফিউজের সঙ্গে জোড়া রয়েছে। অবশ্যই মেন ফিউজের সঙ্গে। ওটাই হতে হবে। কিন্তু রিঅ্যাক্টরটা? ওটার ব্যবস্থা কি রকম? নিশ্চয়ই রিঅ্যাক্টরটার নিজস্ব আলাদা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে…
হ্যাঁ, রয়েছে। রিঅ্যাক্টরটার আলাদা ব্যবস্থা আছে। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় স্যুইচ-টার তো নেই। ও সেটা ভালোই জানে। কারন ও নিজেই ওটা লাগিয়েছে। ঠিক আছে, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই রকম যে, ওকে এখন একবার গোটা পাওয়ার সিস্টেম শাটডাউন করতে হবে। নাকি ওর এখন চুপচাপ বসে থাকাই উচিত, যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাবে সবকিছু নিজে থেকে ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ পায়।
ইঞ্জিনিয়াররা সবরকম অবস্থার কথাই ভেবেছে – শুধু ভাবেনি কি করতে হবে যখন কেবিনে একটা মাছি ঢুকে পড়বে, বা একটা ফিউজ প্যানেল খুলে যাবে, কিংবা যখন তুমি এই রকম একটা গোলমেলে সর্ট-সার্কিটের পাল্লায় পড়বে।
ইতিমধ্যে আলো গুলো আবার নিভে আসতে শুরু করেছে। একটা কিছু এ ব্যাপারে করতেই হবে। কিন্তু কি করবে পার্ক্স?
একদম সোজা। বেশি কিছু না। শুধু ওর চেয়ারের নিচের মেঝেতে যে মাস্টার স্যুইচটা আছে সেটাকে ঠেলে দিতে হবে। ওটা তখন মেইন পাওয়ার সার্কিট বন্ধ করে দিয়ে এমারজেন্সি সিস্টেমটাকেও ট্রিপ করিয়ে দেবে। তাহলেই ওর সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে। পার্ক্স ভাবে, হুম, খুব একটা খারাপ ভাবে এই বালতি গুলো বানানো হয় না।
হঠাৎ পার্ক্সের মাথায় আসে যে ওর জায়গায় বোর্স থাকলে হয়তো ওর চেয়ে আরো আগে এইসব বুঝে ফেলতো। সম্ভবত, আরো তাড়াতাড়ি… একি! আর যে মাত্র দু মিনিট বেঁচে আছে! পথ পরিবর্তন করার মত যথেষ্ট সময় আর নেই! এবার তড়াক করে ও উঠে বসে – আরে, বাকিদের কথা তো ও একদম ভুলেই মেরে দিয়েছে।
এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে ও। চোখ বুঁজে পরপর কি কি করতে হবে একবার ভেবে নেয়।
“এএমইউ-২৭ স্কোয়াড্রন লীডার টেরালুনা, ডাকছি জেও-টু আর জেও-টু দ্বিতীয় কে। কন্ট্রোল রুমে শর্ট-সার্কিট। আমাকে চন্দ্রাবতরন স্থগিত রাখতে হচ্ছে। পথ পরিবর্তন অস্থায়ী নিরক্ষীয় কক্ষপথে-ইয়ে – অনির্দিষ্টকালের জন্য। আগের ঠিক করা সময় মাফিক পথ পরিবর্তন শুরু করছি। ওভার।”
“জেও-টু দ্বিতীয় থেকে স্কোয়াড্রন লীডার টেরালুনা-কে। আমরা একসাথে পথ পরিবর্তন শুরু করবো চন্দ্রের অস্থায়ী নিরক্ষীয় কক্ষপথের ঢোকার জন্য। চন্দ্রাবতরনের থেকে আর উনিশ মিনিট দূরত্বে আছো তুমি। পথ পরিবর্তন শুভ হোক। শুভ যাত্রা। আউট।”
পার্ক্স এতো কথার প্রায় কিছুই শুনতে পেলো না। এর মধ্যেই ও খুলে ফেলেছে ওর রেডিও ফোনের কেবল। এয়ার হোস, আরো কিসের একটা ছোট কেবল, এমনকি স্পেসস্যুটের স্ট্র্যাপ গুলোও ওর ইতিমধ্যে খোলা হয়ে গেছে। তাতেও ওর পা যতক্ষনে এগোলো তার আগেই কিল স্যুইচ-টা জ্বলে গিয়েছে। আলোটা এখন রুবির মত লাল টকটক করছে। সঙ্গে সঙ্গে গোটা কেবিনটা প্রথমে পুরো অন্ধকারে ডুবে গেল। তারপর আবার কমলা-বাদামী আবছা একটা আলো ফুটে উঠলো। ইঞ্জিন বন্ধ করার সুযোগ ব্যার্থ হয়ে গিয়েছে। লাল আলোর সংকেতটা জ্বলে উঠে সেই আবছা অন্ধকারে যেন ওর দিকে তাকিয়ে রইল। সতর্কতামূলক সংকেতটাও এবার আওয়াজ করতে শুরু করেছে। স্বয়ংক্রিয় টার্মিনেটরটা-ও শেষ পর্যন্ত কাজ করলো না। কোনও রকমে নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে পার্ক্স পাইলটের চেয়ারটার পেছনে ঝাঁপ দিলো।
মাস্টার স্যুইচটা ওখানে মেঝেতে একটা ক্যাসেটের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা রয়েছে। ক্যাসেটটা আবার তালা বন্ধ। পার্ক্স টেনে ডালাটা খোলার চেষ্টা করে। নাঃ। খুলছে না। চাবিটা চাই। কোথায় আছে চাবিটা?
চাবিটা কোন চুলোয় কে জানে! ও আবার টান মারে। এবার আরও জোরে। না। কপাল খারাপ।
উঠে দাঁড়ায় পার্ক্স। অন্ধের মত সোজা একদম সামনে তাকায়। সামনেই একটা ভিডিওর পর্দা। পর্দাটা আর আগের মত রুপোলী ঝকঝকে নেই। বরং আলপাইন-তুষারের মত সাদা। ওখানে এখন দেখা যাচ্ছে দৈত্যাকার চাঁদকে। ক্রেটার গুলোকে একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন। ওগুলোর বিস্তৃত ছায়া আঁকাবাঁকা নিস্তব্ধ পড়ে আছে চাঁদের বুকে। রাডার অল্টিমিটারের ক্লিক ক্লিক আওয়াজ কানে আসছে। পার্ক্স অবাক হয়। এটা কখন থেকে কাজ করা শুরু করলো? ছোট ছোট সবুজ সংখ্যাগুলো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। সংখ্যাগুলো দেখে বুঝলো এই মুহূর্তে ও ২১০০০ কিলোমিটার ওপরে আছে।
আলো এখনও পুরো নিভে যায় নি। সার্কিট ব্রেকারটা ক্রমাগত চালু-বন্ধ হয়েই চলেছে। কিন্ত এখন যখন বন্ধ হচ্ছে তখন আর চারপাশ ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে না। চাঁদের আলো ঢুকে এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে কেবিনটা। একটা অদ্ভুত, উজ্জ্বল আলো কেবিনের মধ্যে সারাক্ষণ ছড়িয়ে থাকছে। শুধু কেবিনের ভেতরের আলো গুলো যখন ম্লান ভাবে জ্বলে উঠছে তখন বরং সেই চাঁদের আলো খানিকটা যেন মিইয়ে যাচ্ছে।
একদম নিখুঁত একটা সরলরৈখিক পথ ধরে জাহাজটা এখন উড়ে চলেছে। গতিবেগ ক্রমশঃ বাড়ছে। রকেটের নিজস্ব অবশিষ্ট ত্বরণ এখন পয়েন্ট টু-জি হলেও যতই ও চাঁদের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে ততই চন্দ্রের অভিকর্ষের টান বেড়ে চলেছে। এখন কি করতে হবে? ও দৌড়ে ফিরে আসে ক্যাসেটটার কাছে। পা দিয়ে লাথি মারতে থাকে ডালাটার ওপরে। কিন্তু ধাতব ঢাকনা তাতে বিন্দুমাত্র টসকায় না।
আরে! দাঁড়াও দাঁড়াও। তাইতো! হে ভগবান, কি ভাবে ও এতটা বোকামো করতে পারে! ওর তো শুধু দরকার ছিল ফুসকুরিটার ওপাশে যাওয়ার একটা রাস্তা। আর এর একটা সহজ উপায় তো দেখাই যাচ্ছে। ঐ যে, বাইরে বেরোবার রাস্তার দিকে, যেখানে ফুসকুরিটা একটা কুপির মত সরু হয়ে এয়ার লকের কাছে পৌঁছেছে, ঐখানেই তো সেই হাতলটা আছে। উজ্জ্বল লাল রং-এর হাতলটার নিচে একটা চওড়া পাতের উপর বড় বড় করে লেখা রয়েছে – “আপৎকালীন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা”। লিভারটা শুধু টেনে তোলার যা ওয়াস্তা, সঙ্গে সঙ্গে ওর কাঁচের খোলটা মেঝের মিটার খানেক উপরে উঠে যাবে। তাহলেই তলা দিয়ে গলে যাওয়ার মত ফাঁকা জায়গা হয়ে যাবে। একবার শুধু ওপাশে পৌঁছনো, ব্যাস, তারপর ওকে শুধু লাইন পরিষ্কার করতে হবে আর একটা ইনসুলেশান দিয়ে…
আর একটুও দেরি না করে ও হাতলটার কাছে পৌঁছে গেল।
গাধা কোথাকার! নিজেকেই গালাগালি করে পার্ক্স। তারপর ধাতব হাতলটা দু হাতে পাকড়ে ধরে “হেইয়ো” বলে মারলো একটা হ্যাচকা টান। টানের চোটে কাঁধের হাড়ে চিঁড় ধরে গেল নাকি কে জানে, তবে তেল চুকচুকে ধাতব হাতলটা ঐ একটানেই পুরোটা উঠে এল। তবে হাতলটা উঠলে কি হবে, ফুসকুরিটা জায়গা ছেড়ে এক ইঞ্চিও নড়লো না। পার্ক্স হতবম্ব হয়ে গেল। ড্যাবড্যাব করে কাঁচের বুদবুদটার দিকে তাকিয়ে ও দাঁড়িয়ে থাকলো। এদিকে তখন ভিডিও পর্দাগুলো চাঁদের আলোয় ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। মাথার ওপরে আলো গুলো দপদপ করেই চলেছে। পার্ক্স আরেকবার চেষ্টা করে। হাতলটা যতদূর ওঠার ততদূর উঠেই ছিল। তাও আরও যতজোর সম্ভব ঠেলে দেয়। ঠেলাই সার, ফুসকুরিটার মধ্যে নড়াচড়ার কোন লক্ষন দেখা গেল না।
চাবিটা চাই। ক্যাসেটের চাবিটা! ওটাই চাই। মেঝেতে উবু হয়ে প্রায় শুয়েই পরে পার্ক্স। ঠিক ওর চেয়ারটার নিচে। খোঁজো, পার্ক্স খোঁজো। কিন্তু কোথায় কি! টুকলিপত্রটা পড়ে গিয়েছিল, পাওয়া গেল। আর কিছুই নেই।
ওদিকে আলোগুলো এখনও দপদপ করেই যাচ্ছে। সার্কিট ব্রেকারটা এখনও কাটছে আর জুড়ছে। যেই সার্কিট ব্রেকারটা কেটে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে আলো নিভে যাচ্ছে আর অমনি চাঁদের আলোয় চারদিকটা কঙ্কালের হাড়ের মত সাদা ফটফটে হয়ে উঠছে।
সব শেষ। ওর মাথা আর ঠিক মত কাজ করছে না। তাও ভাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ও কি এবার ইজেকশান রকেট চালু করে ওর ঢাকামুখো চেয়ার সহ বাইরে বেরিয়ে যাবে? নাঃ, তাতেও কোনও লাভ নেই। কোন প্যারাস্যুটই বাতাসের টান না থাকলে কাজ করে না। এই মুহুর্তে ওর খুব ইচ্ছে করছিল “বাঁচাও বাঁচাও” বলে চিৎকার করে উঠতে। কিন্তু তাতেই বা কি লাভ? এখানে কেউ কোথাও নেই ওকে বাঁচানোর জন্য। এখানে একদম একা ও। কি করবে এবার? একটা কিছু উপায় নিশ্চয়ই আছে।
ও আবার এমার্জেন্সি হাতলটার ঝাঁপিয়ে পড়লো। আরও আরও টেনে ওঠাতে চাইলো। এতোটাই জোরে টানছিল যে আরেকটু হলেই বোধহয় কাঁধের থেকে হাতটা খুলে বেরিয়ে আসতো। কিছুই হচ্ছে না। হতাশায় ও চীৎকার করে উঠতে চাইলো। সব, সব কিছু গড়বড় হয়ে গিয়েছে… চাবিটা কোথায় গেছে? কেনই বা এমার্জেন্সি হাতলটা কাজ করছে না? অলটিমিটার! চট করে এক নজরে দেখে নেয় অলটিমিটারটা। ৯৫০০ কিলোমিটার দেখাচ্ছে ওটা এখন।
উদ্ভাসিত চন্দ্রালোকের পটভূমিতে টিমোচারিস পর্বতের উঁচু নিচু শৃঙ্গগুলো এখন আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পিউমিসে ঢাকা ঐ পাথুরে চন্দ্রপৃষ্ঠের ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে ওর জাহাজটা মুখ থুবড়ে পড়বে সেটাও যেন এখন ও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। প্রথমে একটা ভয়ংকর সংঘর্ষের আওয়াজ হবে আর তারপরেই সেই চোখ ধাঁধানো বিস্ফোরণের ঝলক… ব্যাস…
হঠাৎ ওর চোখ গিয়ে পড়লো সেই চারটে তামার তারের উপর। দুটো তারের মধ্যে এত দূর থেকেও ঝলসে যাওয়া মাছিটার ছাই হয়ে লটকে থাকা মৃত শরীরটা একটা ছোট্ট কালো ফুটকির মত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া! পার্ক্স ওখান থেকেই লাফটা মারলো। যেভাবে গোলকিপার দু-হাত বাড়িয়ে লাফ মারে গোল বাঁচাতে ঠিক সেভাবেই। মাঝখানে ছিল ফুসকুরিটার কাঁচের দেয়াল। ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেল পার্ক্স। মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো যেন রাবারের ফোলানো একটা টিউব। কাঁচের দেয়াল ভ্রুক্ষেপহীন। যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেল। পার্ক্স কিন্তু তেমন রইলো না। রক্তাক্ত মুখে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনও রকমে উঠে দাঁড়িয়ে আবার একবার লাফিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হলো।
লাফ মারার ঠিক আগেই ওর চোখ গেল নিচের দিকে।
ঐ তো ম্যানুয়াল ওভাররাইড-টা। এটা বানানো হয়েছে এমন ভাবে যাতে খুব কম সময়ের মধ্যে টেন-জি’র মত ত্বরণ তৈরি হয়ে যায়। এটা চালানো যায় শুধুমাত্র যান্ত্রিক শক্তি দিয়ে আর এক সেকেন্ডের কম সময়েই প্রয়োজনীয় এমার্জেন্সি থ্রাস্ট যোগাতে পারে।
পারে তো বটে, কিন্তু ত্বরণ বৃদ্ধির হার বাড়লে চন্দ্রপৃষ্ঠের দিকে ওর পতনটাও তো আরো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে! পার্ক্সের মাথা গুলিয়ে যায়। তাই তো হওয়ার কথা, না কি? উঁহু, বরং উল্টোটাই হবে। এটা অল্প সময়ের জন্যে একটা ব্রেকের মত কাজ করবে। কিন্তু ঐটুকু সময়ের জন্য ব্রেক হলেও সেটা কি কোন কাজে লাগবে? পতন রুখতে করতে হলে তো একটানা ব্রেক করে যেতে হবে। তাই না কি?
ও এবার ঝাঁপিয়ে পড়ে ওভাররাইডের নিয়ন্ত্রণ-টার ওপরে। পড়েই হাতলটাকে আঁকড়ে ধরে আর গায়ের জোরে মারে এক টান। চেয়ারটা ভাগ্যিস মাঝখানে কুশনের কাজ করে ধাক্কার চোটটা কমিয়ে দিল। নইলে যেভাবে ও ডেকটার ওপর গিয়ে পড়েছিল তাতেই ওর সব হাড়গোড় ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেত। আবার আরেকটা টান। আরেকবার হুমড়ি খেয়ে পড়া। এবার লাগলো মাথায়। এবারও ফোম-রাবারের আস্তরণ দেওয়া হেলমেটটা না থাকলে মাথাটা ফেটে চুরচুর হয়ে যেতো।
ফিউজ প্যানেলটা চড়চড় শব্দে আওয়াজ করে উঠলো। এতক্ষণ পরে এবার হঠাৎ দপদপানো বন্ধ হয়ে গিয়ে কেবিনের ভেতরটা একটা নরম অথচ স্থির বৈদ্যুতিক আলোয় ভরে উঠলো।
ম্যানুয়াল কন্ট্রোলের একটার পর একটা, পরপর দুটো ধাক্কা, দু-বার থ্রাস্টারের বিস্ফোরণ, দু-ধাপে হঠাৎ করে ত্বরণ বেড়ে যাওয়া, এই সবকিছু মিলিয়ে তামার তার দুটোর মধ্যে থেকে মাছিটার ঝলসানো শরীরের ছোট্ট ফুটকির মত ছাইটূকু খসে পড়লো। ওটা খসে পড়তেই শর্ট-সার্কিটের সমস্যাটা-ও নির্মূল হয়ে গেল। ম্যানুয়াল ওভাররাইডের ওখান থেকে পার্ক্স যখন রক্তাক্ত মুখে উঠলো তখন রক্তের স্বাদে ওর মুখের ভেতরটা কেমন যেন নোনতা নোনতা লাগছে। ঐ অবস্থাতেই ও ওর চেয়ারটার উদ্দেশ্যে আরেকটা লাফ মারলো। সোজা চেয়ারে গিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে লাফ দিলেও ও কিন্তু চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছালো না। তার বদলে ও ভেসে গেল। সোজা ভাসতে ভাসতে উঠে ফুসকুরিটার ছাদে গিয়ে মাথাটা ঠোক্কর খেল। ঠোকাটা ছাদের সঙ্গে যত জোরে লাগলো চোটটা হেলমেটের জন্যই মাথায় ততটা লাগলো না। খুব হালকার ওপর দিয়ে গেল। এবার ঠিক যখন ও আরেকটা লাফ মেরে ছাদের ওখান থেকে নিজের চেয়ার পৌঁছাতে চাইছে, ইতিমধ্যে জেগে ওঠা কিল-স্যুইচটা সেই সময়েই রকেটের ইঞ্জিনটা দিল বন্ধ করে। ফলে অল্প স্বল্প যেটুকু আভিকর্ষ তখনও পর্যন্ত বেঁচে ছিল সেটুকুও তৎক্ষণাৎ শেষ। এদিকে ওর মহাকাশযানটা তখন নিজের ভরবেগে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে টিমোচেরিসের পাথুরে উপত্যকার বুকের ওপরে।
ছাদের ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে পার্ক্স তখনও শুন্যে ভাসছে। মুখের ভেতরে বিচ্ছিরি নোনতা একটা ভাব। থু থু করে বাইরে ফেলতেই রক্ত মাখা থুথু ছোট ছোট বুদবুদের মত ওর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাসতে শুরু করলো। লাল-সাদা বুদবুদের নতুন এক গ্যালাক্সি যেন ওর চারপাশে তৈরি হয়েছে।
পাগলের মত শরীর মুচড়ে, হাত-পা ছুড়ে পার্ক্স হাত বাড়িয়ে চেয়ারটা ধরার চেষ্টা করে। হচ্ছে না। আরও একটু নিচে নামতে হবে। পকেটের মধ্যে যা কিছু পেল সব বের করে ও পেছনের দিকে ছুড়ে মারে। যদি একটু বাড়তি ভরবেগ পাওয়া যায়। পেল। ঐ বাড়তি জোরটুকু ওকে ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে নিচের দিকে নিয়ে এল। এবার চেয়ারটা একবার ধরতে পারলেই হয়। হাতের আঙ্গুল গুলোয় প্রচন্ড ব্যাথা করছে। ভাঁজ করাই যাচ্ছে না প্রায়। করতে গেলেই মনে হচ্ছে টেন্ডন টিস্যু ছিঁড়ে যাবে। প্রথম বারের চেষ্টায় নিকেলের প্রলেপ দেওয়া পাইপের কাঠামোর উপর সোজা হয়ে থাকা আঙ্গুল গুলো অল্প আঁচড় কেটেই পিছলে গেল। তবে চেষ্টা ছাড়লে হবে না। পার্ক্স ছাড়লো না। অ্যাক্রোব্যাট যেভাবে প্যারালাল বারের উপর হাতের ভর দিয়ে দাঁড়ায়, ঐ ভাবেই মাথাটা নিচের দিকে করে শরীরটা কে উল্টে নিল। যেন এবার শীর্ষাসন করবে। কোনও ভাবে ও এবার চেয়ারের একটা স্ট্র্যাপ ধরতে পারলো। ওটাকেই টেনে টেনে নিজেকে এবার চেয়ারের আরও কাছে নিয়ে এল। তারপর স্ট্র্যাপটা শরীরে জড়িয়ে ওটার খোলা দিকটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরলো। হ্যাঁ, হাত দুটো এবার খালি হয়েছে। এবার কন্ট্রোল লিভার আর ব্রেক প্যাডেল।
অলটিমিটার এখন দেখাচ্ছে চন্দ্রপৃষ্ঠ আর মাত্র ১৮০০ কিলোমিটার। ও কি ঠিক সময়ে ব্রেক করে উঠতে পারবে? অসম্ভব – এই ৪৫ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে তো কিছুতেই পারবে না। এখন তবে আর একটাই মাত্র উপায়। কোনও রকমে যদি তাতে নাক বরাবর গোত্তা খাওয়া থেকে বাঁচা যায়! যেভাবে হোক মুখ ঘোরাতে হবে রকেটের। তবে তাতেও বাঁচবে কিনা কে জানে! তবে এছাড়া অন্য কিছু করার মত সময় আর হাতে নেই।
তবে শুধু ঘোরালেই হবে না। রকেটের মুখ অনেকটাই বাঁকাতে হবে। হাতে সময় খুব কম। পার্ক্স তাড়াতাড়ি পিচ-রকেট গুলো চালু করে। ত্বরণ বাড়তে শুরু করেছে। টু-জি, থ্রি-জি, ফোর-জি… যাক, বাড়াতে পেরেছে। তবে এটুকু তে হবে না। এ যথেষ্ট নয়। আরো চাই।
এবার পুরো শক্তিতে থ্রাস্ট ইঞ্জিন চালু করলো। যদি কোনও ভাবে বেরিয়ে যাওয়া যায়। ভিডিওর পর্দায় চাঁদ এখনও পারদের মত চকচক করছে। তবে একটু আগেও পর্দার বুকে ছবিটা যতটা স্থির ছিল এখন আর তা নেই। ক্রমশঃ পর্দার কাঁপুনি বাড়ছে আর ছবিটা অস্পষ্ট হয়ে আসছে। এদিকে ওর শরীরের চাপে চেয়ারটা এখন ক্যাঁচকোঁচ করে আওয়াজ শুরু করেছে। শরীরের ভার এখন অনেক বেড়ে গেছে। মহাকাশযানটাকে এবার ধনুকের মতে বেঁকে একটা গভীর বৃত্ত চাপ তৈরি করে চন্দ্রপৃষ্ঠের কাছ থেকে ঘুরে গিয়ে ওপরের দিকে উঠে আসতে হবে। বৃত্ত চাপের ব্যাসার্ধটা-ও অনেক বেশি হবে এই প্রচন্ড গতির জন্যে। কন্ট্রোল হাতলটা যতদূর সম্ভব ততদূরেই ঠেলে রাখা আছে। এখন ওর শরীর স্পঞ্জের গদি দেওয়া চেয়ারের ব্যাকরেস্টে প্রায় সেঁটে গেছে। স্পেসস্যুটের সঙ্গে এখনও এয়ারকম্প্রেসরের পাইপ জোড়া হয়ে ওঠেনি। পার্ক্সের মনে হচ্ছে ওর ফুসফুস থেকে যেন হাওয়া নিংড়ে বের করে নেওয়া হচ্ছে। আর বুকের পাঁজর-টাজর সব যেন ভেতরের সেই শুন্য স্থানে ঢুকে যাচ্ছে। চোখের সামনে সব কিছু ধূসর হয়ে আসছে। আরেকটু পরেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। তবে এই অবস্থাতেও ও তাকিয়ে আছে অলটিমিটার রাডারটার দিকে। একটার পর একটা সংখ্যা ওখানে ভেসে উঠছে আর মুছে যাচ্ছে। ৯৯০ … ৯০০ … ৮৪০ … ৭৬০…
ও জানে থ্রাস্ট যত বেশি হওয়া সম্ভব ও এখন ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। ও কন্ট্রোল হাতলের মুঠোটা তাও চেপে ধরে ঠেলে রাখছে। ওর পক্ষে এই মুহূর্তে যতদূর যা কিছু করা সম্ভব সব কিছু করে ফেলেছে। তা সত্ত্বেও অলটিমিটারের সংখ্যা গুলো এখনও কমছে তো কমছেই। তবে এটাও ঠিক যে উচ্চতা কমে আসার হার এখন অনেকটাই কমেছে। তার মানে এখনও ও বৃত্তচাপের নামার দিকের ঢালেই আছে। ওর মাথা আর চোখ এবার অসাড় হয়ে আসছে। তাও এক দৃষ্টে ও ট্র্যাজেক্টোমিটারটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ট্র্যাজেক্টোমিটারের নিয়ম হচ্ছে যখন কোনও মহাকাশযান কোনও মহাজাগতিক বস্তুর বিপদজনক ভাবে কাছে চলে আসে, তখন ট্র্যাজেক্টোমিটার আর শুধু মহাকাশযানের উড়ানপথ দেখায় না। ওটা ছাড়াও আরও দুটো জিনিস দেখাতে থাকে। একটা হচ্ছে মহাকাশযানের বর্তমান অবস্থার গণনালব্ধ সম্ভাব্য গতিপথ যেটা একটা আবছা স্পন্দিত রেখা দিয়ে দেখায়। আরেকটা হচ্ছে মহাজাগতিক বস্তুটার পৃষ্ঠরেখা – যার বিপদজনক এলাকায় মহাকাশযান এসে পড়েছে। ট্র্যাজেক্টোমিটারের ঐ তৃতীয় রেখাটা এখন চন্দ্রের উত্তল পৃষ্ঠরেখা দেখাচ্ছে – যার সাপেক্ষে পার্ক্স উড়ান পথ পাল্টাতে চাইছে।
পার্ক্স দেখতে পাচ্ছে যে একটা বিন্দুতে মহাকাশযানের উড়ান পথ আর চন্দ্রের পৃষ্ঠরেখা প্রায় মিশে গিয়েছে। কিন্তু রেখা দুটো কি একে অন্যকে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে না কি পরষ্পরকে ছেদ করেছে? মূল প্রশ্ন এখন সেটাই।
না, ছেদ অবশ্যই করেনি। যা দেখা যাচ্ছে দুটো বক্ররেখাই শেষ বিন্দুতে একে অন্যকে ছুঁয়ে আছে। তবে একটাই সাধারণ স্পর্ষক আছে বলে মনে হচ্ছে। তাই আপাতত ভবিষ্যৎবাণী করার কোনও উপায় নেই যে ও কি চন্দ্রপৃষ্ঠে শুধুই আঁচর কেটে বেরিয়ে যেতে পারবে নাকি ওখানেই দড়াম করে মুখ থুবড়ে পড়বে।
ট্র্যাজেক্টোমিটার যেভাবে মাপজোক করে তাতে ৭ থেকে ৮ কিলোমিটারের মত ভুলের সম্ভাবনা থেকেই থাকে। কাজেই এই মুহূর্তে পার্ক্স শুধু এইটুকুই আন্দাজ করতে পারছে যে ওর সম্ভাব্য উড়ানপথ হয় চাঁদের পাহাড়ের ৩ কিলোমিটার ওপর দিয়ে কিংবা নিচ দিয়ে পার হয়েছে।
পার্ক্সের দৃষ্টিশক্তি এবার পুরোপুরি নিভে আসতে শুরু করেছে – ফাইভ-জি’র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জ্ঞান ওর এখনও টনটনে। ঐখানে ওর চেয়ারটায় ও শুয়ে রইলো। দৃষ্টিশক্তি আংশিক অন্ধ। হাতের আঙ্গুল এখনও শক্ত করে চেপে ধরে আছে কন্ট্রোলের হাতল। বুঝতে পারছে শরীরের নিচে চেয়ারের ফোমের গদি অভিকর্ষের চাপে প্রায় চেপ্টে গেছে। কিন্তু কিছুতেই ও নিজেকে বিশ্বাস করাতে পাড়ছে না যে ও শেষ পর্যন্ত পেরেছে। অন্তত যা কিছু করা সম্ভব ছিল ততটুকু ও করতে পেরেছে।
এখন আর কিছুই দেখতে পারছে না। অন্য আর কিছু করারও নেই। ঠোঁট নাড়াতেও পারছেনা বলে ঐ অন্ধকারেই ও মনে মনে গুনতে শুরু করলো। জেনেশুনেই আস্তে ধীরে গুনতে থাকে – একুশ … বাইশ…. তেইশ … চব্বিশ…
গুনতি পঞ্চাশ হতেই ওর মাথায় এল যে সংঘর্ষ যদি হওয়ার থাকে তো ওটা এক্ষুনিই হবে। হলে হোক। তবে কন্ট্রোল হাতলটার ওপর থেকে হাতটা ও সরালো না। যদিও বুঝতে পারছে আর পারছে না ও। বুকের মধ্যে দম আটকে আসছে। কানের মধ্যে একটা ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। গলার মধ্যে যেন রক্তের ডেলা জমাট বেঁধে গেছে। চোখ ফেটে যেন রক্ত বেরিয়ে আসছে…
একটু পরেই ওর হাত এলিয়ে পড়লো। কন্ট্রোলের হাতল থেকে মুঠো আলগা হয়ে হাতটা নিজে থেকেই ঝুলে পড়লো। এখন আর ও কিছুই দেখছে না। এখন আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। দেখতে পাক বা না পাক, আরেকটু পরে নিজে থেকেই অন্ধকারের মাত্রা কেবিনের ভেতরে কমতে শুরু করলো। ক্রমশঃ ঘন কৃষ্ণ অন্ধকার থেকে ধূসর হয়ে উঠলো চারপাশ। শ্বাস-প্রশ্বাস এখন অনেক সহজে নেওয়া যাচ্ছে। ও চেষ্টা করলো চোখ খুলতে। কিন্তু তার দরকার পড়লো না। ও বুঝতে পারলো চোখ ওর এতক্ষণ খোলাই ছিল। সারাক্ষণ ধরেই খোলা ছিল। চোখের পাতা-ই শুধু শুকিয়ে গিয়েছে।
ও উঠে বসলো।
গ্র্যাভিমিটারে এখন অভিকর্ষ দেখাচ্ছে টু-জি। সামনের পর্দায় চাঁদ-টাদ আর কিছু নেই – শুধু নক্ষত্রময় শুন্যতা। চাঁদের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। চাঁদের আবার কি হলো?
কিছুই না। ঐ তো ওটা আছে – একদম যেমনটা ছিল, তেমনি। ওর নিচে। ওয়াও! নাক বরাবর মরন ঝাঁপ থেকে ও মুক্তি পেয়েছে। এখন ক্রমহ্রাসমান মুক্তিবেগে ভাসতে ভাসতে উঠে যাচ্ছে উপরে। সংঘর্ষের কতটা কাছ থেকে ও বেঁচে ফিরলো? পার্ক্স আশ্চর্য হয়ে ভাবার চেষ্টা করে। অল্টিমিটারটা নিশ্চিত ঠিকঠাক দূরত্বটা মেপে রেকর্ড করে রেখেছে। কিন্তু এখন আর ওর সেটা দেখার ইচ্ছে করলো না।
হঠাৎ এবার অ্যালার্ম সিগন্যালটার আওয়াজ বন্ধ হলো। হে ভগবান! এটা এতক্ষণ ধরে বেজেই যাচ্ছিল! বাঃ, বেশ ভালো ব্যাপার তো! তবে ওখানে একটা চার্চের ঘন্টা লাগিয়ে রাখলে আরও ভালো হতো!
যদি তুমি কবরখানায় শেষ-যাত্রায় যাওয়ার পথেই যাচ্ছো তো তোমাকে অন্তত বেশ পরিপাটি কায়দা মাফিক যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত নয় কি!
আবার একটা গুন গুন আওয়াজ। তবে এবারের আওয়াজটা খুব হালকা। সেই অন্য মাছিটা! এই শয়তানের বাচ্চাটা তো দেখা যাচ্ছে বেঁচেই আছে। শুধু বেঁচে থাকা না, রীতিমত গুন গুন করে আবার গান গাইছে ফুসকুরির ছাদে বসে!
হঠাৎ ও মুখের ভেতর একটা বিচ্ছিরি স্বাদ টের পায়। স্বাদটা ঠিক যেন একটা মোটা ক্যানভাসের মত… ওঃ, সেই সেফটি বেল্টের স্ট্র্যাপটা। অন্যমনস্ক ভাবে এতক্ষণ ধরে ও ওটাকে মুখের মধ্যে চিবিয়েই চলেছে।
পার্ক্স এবার সেফটি বেল্টটা ভাল করে বেঁধে নেয়। আবার হাতে তুলে নেয় কন্ট্রোল হাতলটা। ওকে এবার জাহাজটাকে আবার সেই পুরোনো কক্ষপথে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। জেও জাহাজ দুটোকে এখন আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
সে যাই হোক। ওকে এখন ওর মিশন পুরো করতে হবে। তারপরে চন্দ্র ঘাঁটিতে রিপোর্ট করতে হবে। না কি এই গড়বড়ের ব্যাপারটার জন্য ও আগেই চন্দ্র ঘাঁটিতে রিপোর্ট করবে? ধ্যাৎতেরিকা! কোনটা ঠিক হবে সেটা ও কি করে জানবে! না কি ও পুরো চেপে যাবে? উঁহু, লাভ নেই। নামা মাত্র ওরা রক্ত দেখে ফেলবে। যেটা এই মাত্র ও প্রথমবারের জন্য খেয়াল করেছে। ছাদের নিচে চারদিকে রক্তের ছিটে লেগে আছে। এছাড়াও ফ্লাইট রেকর্ডারের টেপে তো বোধহয় পুরো গল্পটাই পেয়ে যাবে। যেভাবে সার্কিট ব্রেকারটা বরবাদ হলো বা এমার্জেন্সি লিভারের গড়বড়… বৎস পার্ক্স, এই যন্ত্রযানে নজরদারির অনেক গ্যাড়াকল রাখা আছে। ওরা আমাদের কোন কফিনে ভরে মহাকাশে পাঠায় নি।
ঠিক আছে, রিপোর্ট না হয় ও করবে। কিন্তু কোথায় এবং কখন? তুমুল চিন্তা ভাবনা শুরু করে পার্ক্স। তারপর সামনে ঝুঁকে কাঁধের স্ট্র্যাপ খুলে চেয়ারের নিচে উঁকি মেরে টুকলিপত্রটা খোঁজে। নেই। ওটা কোথায় গায়েব হলো? একটু আগেই তো দেখেছিল। আর গায়েব হলো তো হলো এমন একটা সময়ে হলো যখন ওটা হাতে পেলে এবার সত্যিই কাজে লাগতো।
আর ঠিক এই সময়ে ওর কানে এল একটা আওয়াজ। ওর পেছন দিকে কোথাও ক্যাঁচ করে একটা কিছু আওয়াজ করলো। ঠিক যেন একটা দরজা খোলা হলো।
একটা দরজা? ওর পেছনে? ও ভালো করেই জানে ওর পেছন দিকে কোন দরজাই নেই। কিন্তু স্ট্র্যাপগুলোর জন্য ও ঘুরে দেখতে চাইলেও দেখতে পারছে না।
একটা সরু আলোর রেখা পেছন থেকে সামনের পর্দায় এসে পড়েছে। এতক্ষণ যে নক্ষত্রের দল ওখানে ছিল এখন তাদের কাউকেই আর দেখা যাচ্ছে না। আর ঠিক তারপরেই আরেকটা পরিচিত আওয়াজ ও শুনতে পেল। এটা সিও সাহেবের সেই নরম আর চাপা গলার আওয়াজ :
“ক্যাডেট পার্ক্স।”
ও তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা করলো। কিন্তু স্ট্র্যাপের বাঁধনের জন্য আটকে গিয়ে আবার চেয়ারের উপরেই পড়ে গেল। ও নিশ্চিত যে ও ভুলভাল শুনছে। এতদূরে, এই মহাকাশে, ওর রকেটের ভেতরে কেউ কিভাবে আসতে পারে! তাও, প্রায় আকাশ থেকে পড়ার মতই, কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ করে কেবিন আর কাঁচের বুদবুদের মধ্যের জায়গাযটায় এসে দাঁড়ালেন সিও। পরনে সেই চিরাচরিত ধূসর উর্দী। আরেকটু এগিয়ে উনি এসে দাঁড়ালেন এবার পার্ক্সের সামনে। ধূসর নরম চোখে পার্ক্সের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসলেন। পার্ক্স এবার পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে গেল।
কাঁচের বুদবুদটার ঢাকনাটা নিজে নিজেই খুলে ওপরে উঠে গেল। কি হচ্ছে পার্ক্স এর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তাড়াতাড়ি সব স্ট্র্যাপ গুলো খুলে উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে সিও সাহেবের পেছনের সবকটা ভিডিওর পর্দাই পুরো ফাঁকা।
“দারুণ পারফরম্যান্স, পার্ক্স,” সিও সাহেব ওকে বললেন “দূর্দান্ত বললেও কম বলা হবে।”
পার্ক্স এখনও হতবম্ব।
তারপর, হতবম্ব পার্ক্স ঐ অবস্থাতেই স্বয়ং সিও-র সামনে আরেকটা ভুল করে বসলো। অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই অবস্থাতেই ও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকালো। গলার অর্ধেক ফুলে থাকা কলারটা ওকে অবশ্য খুব বেশি ঘাড় ঘোরাতে দিল না।
তবে যতটুকু পারলো তাতেই ও আরও অবাক হয়ে গেল। ভেতরে ঢোকার সেই সুড়ঙ্গটা – আর তার ঢাকনা ফাকনা সহ সবকিছু এতক্ষণে খোলা হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন ওর রকেটটাই দু টুকরো হয়ে গিয়েছে।
বাইরে এখন সন্ধ্যা। সেই ক্যাটওয়াকটা এই সন্ধ্যার আলোতেও এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এমনকি ওখানে যে বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে তাও দেখা যাচ্ছে। সেই কেবল রেলিং, ছাদের কড়িকাঠ… সব স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পার্ক্স হাঁ করে সিও সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“চলো এসো পার্ক্স,” সিও সাহেব এগিয়ে এসে পার্ক্সের হাতটাকে শক্ত করে ধরে বেশ কয়েকবার ঝাঁকিয়ে দিলেন, “ফ্লাইট কমান্ডের তরফ থেকে আমি তোমার দূর্দান্ত পারফরম্যান্সের প্রশংসা করছি—আর … তোমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে ক্ষমা প্রার্থনাও করছি। হ্যাঁ, এটা আমার করাই উচিত। এবার এসো আমার সঙ্গে। তুমি আমার অফিসেই পরিষ্কার হয়ে নেবে।”
কথা শেষ করেই উনি বেরোবার জন্য হাঁটা শুরু করলেন। পেছনে পেছনে চললো পার্ক্স। ও এখনও খোঁড়াচ্ছে আর হাঁটছে পা টেনে টেনে। বাইরে এখন প্রচন্ড ঠান্ডা। উপরের খোলা প্যানেলের মধ্যে দিয়ে একটা ঠান্ডা হাওয়া আসছে। রকেট দুটো একদম সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে ও দুটো তখন ছিল। দুটোরই সামনে থেকে কতকগুলো লম্বা লম্বা মোটা কেবল এখন শুন্যে ঝুলে আছে। ওগুলো আগে ওখানে ছিল না।
ক্যাটওকটার ওপরে ভালোই ভীর। ভীরের মধ্যে ওর ইনস্ট্রাক্টর-ও দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছু একটা উনি বললেন, কিন্তু হেলমেটের জন্য পার্ক্স বোধহয় ঠিক ঠাক শুনতে পেল না।
“কি?” সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখ থেকে আওয়াজ বেরোলো।
“আরে, তোমার স্পেসস্যুটের হাওয়া তো বের করো।”
“ও। হাওয়া …”
পার্ক্স একটা ভালভে চাপ দিতেই হিসসস্ আওয়াজ করে হাওয়া বেরিয়ে গেল।
ক্যাটওকটার যেখানে এখন ও দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছে দুজন সাদা রং-এর পোশাক পড়া লোক রেলিং-এর ওপাশে অপেক্ষা করছে। ও ওর রকেটটার দিকে তাকিয়ে ছিল। দেখে মনে হচ্ছিলো যেন ওটার ঠোঁটটা ভেঙ্গে গিয়েছে। রকেটটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর মধ্যে অদ্ভুত একটা উদাসীন ভাব তৈরি হলো। যা একটু পরে প্রথমে বিস্ময়ে, তারপর হতাশায় আর শেষে প্রচন্ড একটা রাগে পরিবর্তিত হয়ে গেল —বিশুদ্ধ আর নিরবচ্ছিন্ন একটা রাগ।
লোকজনেরা এখন ওপাশের রকেটটার ভেতরে ঢোকার দরজাটা খুলছিল। সিও সাহেব ক্যাটওকটার একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা রং-এর পোষাক পরা লোক দুজনের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বোধহয় বলছিলেন।
এই সময় প্রথমে দ্বিতীয় রকেটটার ভিতর থেকে একটা কিছু পড়ে যাওয়ার একটা অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেল।
ঠিক তারপরেই ওটার কেবিনের ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বাদামী ইউনিফর্ম পরা একটা শরীর টলমল করতে করতে বেরিয়ে এল। শরীরটার মালিকের হেলমেটহীন মাথায় চোটের দাগ। যা এখান থেকে অস্পষ্ট হলেও বোঝা যাচ্ছে। কোন কাতরানি শোনা না গেলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাদামী ইউনিফর্ম-ধারীর মুখটা এখন ব্যাথায় পুরো বেঁকে রয়েছে।
পার্ক্সের পায়ের নিচের মাটি হঠাৎ যেন সরে গেল।
আরে, এ তো সেই… বোর্স।
শেষে ও-ই চাঁদের বুকে আছাড় খেলো।
Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, গোপাল কৃষ্ণ বর্মন, দীপ ঘোষ, স্তানিসোয়াভ লেম
বাবারে!! একেবারে রুদ্ধশ্বাস গতি। ধীর লয়ে শুরু করে সুপারসনিক। ধন্যবাদ এমন অনুবাদ পড়তে পেরে।
উৎসাহিত করার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
কিন্তু হেলমেট পরা অবস্থায় দাঁত দিয়ে স্ট্রাপ টা কামড়ে ধরে রেখেছিল!! 🤔🤔 Original গল্প টা পড়িনি, তাই বুঝলাম না এটা ঠিক অনুবাদ কিনা। তবে বাকীটা দুর্দান্ত হয়েছে।