স্তানিসোয়াভ লেম শার্ঘ সংবাদপত্রে একটি সাক্ষাৎকার
লেখক: পেম্যান ইসমাইলি, অনুবাদ: টিম কল্পবিশ্ব
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
পেম্যান ইসমাইলি: আপনি কি একজন উত্তর-আধুনিক লেখক? উত্তর-আধুনিকতার সঙ্গে আপনার উপন্যাসের সম্পর্ক কী? উত্তর-আধুনিক তত্ত্ব (ডিকনস্ট্রাকশন) সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
স্তানিসোয়াভ লেম: আমার লেখাকে “মডেল পোস্টমডার্নিজম” হিসাবে উপস্থাপন করা সাহিত্য বিশ্লেষণ ও গবেষণাপত্র গুলির সঙ্গে আমি একমত নই। ব্যাপারটা বেশ মজার, কারণ আমি যখন আমার বইগুলি লিখছিলাম তখন কোনও “উত্তর আধুনিকতা” ছিল না। একজন বুদ্ধিমান এবং যুক্তিবাদী কম্পিউটার কী বলতে পারে তা খুঁজে বের করার জন্য যখন আমি আগ্রহী ছিলাম, স্বভাবতই আমাকে “নিজেকে একটিতে পরিণত করতে” হয়েছিল। যাইহোক, এই সমস্ত শ্রেণীবিভাগে আমার বিশেষ আগ্রহ নেই৷ দেরিদা এবং লাকানা ঘরানার কাজগুলি আমার কাছে বিশেষ পরিষ্কার নয়: আমার মতে ওগুলো তালমুদিয় পন্থায় আদর্শের চুলচেরা তাত্বিক বর্ননা।
একটি জার্মান এনসাইক্লোপিডিয়া আপনাকে “একজন দার্শনিক” বলে অভিহিত করছে। আপনি কি একজন দার্শনিক? আপনার উপন্যাসে দর্শনের উপস্থিতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
যা গোপনে অন্তর্নিহিত আমি তার প্রকাশে বিশ্বাসী। অতীসরলীকরন, ভ্রান্তি বা কখনো কখনো অপ্রাসঙ্গিকতার ঝুঁকি এতে যথেষ্ট বেশী ও হয়ত তা অনিবার্যও।
আমার অনেক দুশ্চিন্তা, হতাশা এবং বিভ্রান্তির কারণ, যা এখনও বর্তমান, এই সত্য যে অনেকেই দর্শনকে বিরক্তিকর এবং নিষ্ফলা চর্চা বলে মনে করেন। দর্শনে বিমুগ্ধ হতে হবে এবং ব্যক্তিজীবনে দর্শন ব্যবহার করতে হবে: দর্শন একটি শক্তিশালী আবেগের বিষয় হওয়া উচিত। যারা এই আবেগ অনুভব করেন না তারা অবশ্যই আমার কিছু কাজ দেখে হতাশ হবেন।
আপনার জন্য বিজ্ঞান কথাসাহিত্য মানে কি? কল্পবিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত কী? আপনি বলেছেন যে আপনি “বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে আরও বাস্তববাদ” দেখতে চান। এই মন্তব্যের মানে কি? মাইক্রোওয়ার্ল্ডস-এ আপনি বলেছেন যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী তুচ্ছ সাহিত্যের (যেমন ওয়েস্টার্ন, ডিটেক্টিভ গল্প বা রোমান্টিক কথাসাহিত্য) ধারার অন্তর্গত – যদিও তারা এর বিপরীত দাবি করে থাকে। কেন আপনার এটা মনে হয়? অনেকের মতে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন্ত বিজ্ঞান কথাসাহিত্যিক। এই ধারণা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
আমি সাধারণভাবে বিজ্ঞান কল্পকাহিনী পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম, কারণ আমি ওগুলো “হজম” করতে পারিনি – কারণ ওগুলোর বেশিরভাগেরই এর কোনও বোদ্ধিক মুল্য নেই। লেখকরা তা নিয়ে আগ্রহী বলে মনে হয় না, কারণ তারা কেবল তাদের উপন্যাস বিক্রি করতে চায়। আমি মূর্খ যে আমি লিখতে এবং ব্যাখ্যা করতে অনেক সময় নষ্ট করেছি – বিশেষ করে আমেরিকাতে – আর তার জন্য আমার ভাগ্যে গালাগাল ছাড়া আর কিছু জোটে নি। আমি একবার বেশ ন্যায্যভাবেই আমার একজন অস্ট্রেলিয়ান সান্ত্বনাদাতাকে লিখেছিলাম যে “আমাকে চলে আসতে হয়েছে” – কয়েক বছর ধরে একটি পতিতালয়ে একজন ধর্ম যাজকের ভূমিকা পালন করে এবং “পতিতা মহিলাদের সংশোধন করার চেষ্টা করার পরে”। আমি কখনো মনে করি নি যে পৃথিবীতে আমার অস্তিত্বর উদ্দেশ্য মানবজাতিকে উদ্ধার করা। আমার কিছু বই – এমনকি “সাইবেরিয়াড” এবং “মরটাল ইঞ্জিন” – যে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর শ্রেনীভুক্ত হয়েছে তা ভাবনাচিন্তার দীনতা আর শ্রেনীভুক্তি নিয়ে গোঁড়ামিরই প্রমাণ। কেন “সাইবেরিয়াড” একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী? যদিও বা কেউ ওটা নিয়ে দূর্বল যুক্তি দিতে পারে যে এটি “দ্য চেইন অফ চান্স” এর ক্ষেত্রে, যেহেতু পরেরটি (সাইবেরিয়াড) একটি গোয়েন্দা গল্পের সাথে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মিশ্রণ, যেখানে চান্সই অপরাধী প্রমাণিত হয়। কিন্তু কেন “মরটাল ইঞ্জিন”? এটা খুবই অলীক! যদি ভেবে দেখেন, যখন কেলারম্যান তার “টানেল” লিখেছিলেন – ইউরোপ এবং আমেরিকার মধ্যে একটি টানেল নির্মাণের বিষয়ে – কেউ এটিকে কল্পবিজ্ঞান বলে নি, কারণ লেখক ভাগ্যবান যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সময়ে কল্পবিজ্ঞান ধারাটারই প্রবর্তন হয় নি। ক্যাপেক, সুইফট এবং ভলতেয়ারের দার্শনিক গল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমি মনে করি আমার “সাইবেরিয়াড” এবং “মরটাল ইঞ্জিন” এর কিছু অংশ অন্য কোনও কিছুর চেয়ে ভলতেয়ারের অনেক কাছাকাছি; ওটাকে এনলাইটেনমেন্ট-পরবর্তী যুগের এক অবতার বলব। একজন আমেরিকান লেখক ওগুলোকে “সাইবারনেটিক যুগের রূপকথার গল্প” বলেছেন। কিন্তু তাদের উপর একটি বড় “সায়েন্স ফিকশন” লেবেল লাগানো সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। “পারফেক্ট ভ্যাকুয়াম” সম্পর্কে কি বলবেন? এই বইটি কি কোনও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ? এটি নুভেউ রোমান গোত্রীয় কাজের উপহাস প্রেরিত। যারা এই ধরনের ধারনা পোষন করেন, তাদের কাছে ত যা কিছু ক্রাকো বা ম্যানহাটনে সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তাইই কল্পবিজ্ঞান। আমি মনে করি এটি একটি বড় ভ্রান্ত ধারনা। আমি আমার যৌবনে কয়েকটি রদ্দি সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস লিখেছিলাম। এই সত্যটি উপলব্ধি করার পরে আমি অন্যান্য ধারার লেখা শুরু করি, কিন্তু সমস্ত সমালোচক আমাকে সেই “এসএফ পিট” এর দিকেই ঠেলে দেয়। কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া পরাগের সঙ্গে আমার শরীরের বিক্রিয়ার মত (আমি হে ফিভারের রুগি)। মানুষ কেন সায়েন্স ফিকশন পড়ে? আমি ধারনা করতে পারি যে তারা “দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস” বা “ইট ইজ ডিফিকাল্ট টু বি গড”, পড়ে কি পায় যা অন্যান্য ধারার লেখায় পায় না। যদি একজন লেখকের কাজ শুধু “চমত্কার গল্প” দেওয়াই হয়, তবে আমি আমার নিজে এখুনি এক ডজন দিতে পারি। আমি কখনই সময় কাটানোর জন্য পড়ি না। সময়কে কাটানো কারো স্ত্রী বা সন্তানের গলা কাটার সঙ্গে তুলনীয়। সময়ের চেয়ে মূল্যবান আমার কাছে আর কিছু নেই। আমি আমার নিজের এক ডজন নিয়ে আসতে সক্ষম। আমি কখনই সময় মারার জন্য পড়ি না। সময়কে হত্যা করা কারো স্ত্রী বা সন্তানকে হত্যা করার মতো। সময়ের চেয়ে মূল্যবান আমার কাছে আর কিছু নেই।
আপনার রচনায় ভাষার স্থান কী? আপনার সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস সৃষ্টীতে ভাষার গুরুত্ব কতটা? ভাষা সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন বিষয়, আপনার উপন্যাস সৃষ্টিতে সাহায্য করে?
আমি ভাষার প্রতি বেশ সংবেদনশীল, তাই আমি সবসময় আমার গুরুগম্ভীর কাজগুলিতে অনিচ্ছাকৃত হাস্যরস এড়াতে চেষ্টা করেছি। “রিটার্ন ফ্রম দ্য স্টারস”-এ আমি একটি নিরপেক্ষ ভাবাপন্ন শব্দ “বেট্রাইজেশন” (আগ্রাসনকে আটকানোর একটি পদ্ধতি) প্রবর্তন করেছি। অন্যদিকে “সাইবেরিয়াড” এ ভাষা নিয়ে খেলার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। “ইন্সপেকশোন এট দ্যি সিন অফ ক্রাইম” এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে, যেখানে আমি একটি অভিধানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি নিওলজিজমও অন্তর্ভুক্ত করেছি – এসব কারনে আমাকে কখনও কখনও মাত্রাতিরিক্ত নিওলজিজম তৈরি করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এটা ঘটনা যে আমি আমার বইগুলিকে নতুন শব্দ দিয়ে ভর্তি করে হয়ত অনুবাদকদের জীবনকে বেশ দুর্বিষহ করে তুলছি, বিশেষত যেহেতু পোলিশ ভাষা এই নতুন শব্দগঠনের জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত। কিন্তু এই বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে এটি অনিবার্য ঠিক যেমন নৌচালনা সম্পর্কে লেখার সময় নটিক্যাল শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা অসম্ভব। নতুন শব্দের উদ্ভাবন সাধারণত বর্ননার প্রয়োজনীয়তার জন্য হয়। আমি কখনই “জোর করে” এসব করিনি, এবং ইলেকট্রনাইটস, পেলফেসেস এবং ডায়োডাস, ট্রাইউডস এবং হেপ্টোডিয়াসের মতো ধারণাগুলিকে প্রায় স্বয়ম্ভুই বলব। আমি নিওলজিজমের ব্যবহার নিতান্ত প্রয়োজনীয় ন্যূনতমতেই সীমিত করার চেষ্টা করে থাকি, যেহেতু আমি যদি অন্য কোনো যুগের ভাষা উদ্ভাবন করতে চাই, আমি তার জন্য আমার জীবনের অর্ধেকই ব্যবহার করে ফেলব ও তার ফসল হবে এমন একটি একটি বই যা কেউ পড়তে বা বুঝতে পারবে না – যদি না আমি একটি অভিধান এবং একটি বিশ্বকোষ অন্তর্ভুক্ত করি (সেগুলোও স্বভাবতই আমাকেই লিখতে হবে)। কেউ হয় উদ্ভটরস ব্যবহার করতে পারে বা সভ্যতার মধ্যে ব্যাবধানের দিকে নির্দেশ করতে পারে, যা আমি আমার “ইডেন” উপন্যাসে দেখানোর চেষ্টা করেছি। একটি বাস্তববাদী উপন্যাসে কেউ দাবি করতে পারে না যে প্রধান চরিত্রটি ফোনে মহিলাদের নিষিক্ত করতে সক্ষম বা মাছিরা হল অধঃপতিত ক্যাঙ্গারু। তবে যদি একটি উপন্যাস “একটি ভিন্ন বিশ্ব” বা “একটি ভিন্ন গ্লোব” উপস্থাপন করে, তবে একজন গড় পাঠক বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ড থেকে বঞ্চিত হন। লেখক তাকে যা ইচ্ছে বিশ্বাস করতে পারেন। এই দ্বিতীয়টি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখকদের নিরানব্বই শতাংশ অপব্যবহার করে থাকেন। এই লেখকরা গোষ্টিবদ্ধ হয়ে রেফারেন্সের কৃত্রিম ফ্রেম তৈরি করেছেন, যার ফলে তাঁদের কল্পবিজ্ঞানে সমগ্র মহাজাগতিকতাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্র এবং বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানকে পদদলিত করেছেন। এটি ননসেন্স-এর এক ভান্ডারের জন্ম দিয়েছে যা একজন গড়পরতা বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী লেখক মাত্রেই ব্যবহার করেন। যে এই ছক ভাঙ্গে সেই পাঠকদের অসম্মতির শিকার হন, যা ঐ ট্রেজার হাউসের সঙ্গে তাদের স্বাচ্ছন্দের সরাসরি সমানুপাতিক।
আপনি ধর্ম সম্পর্কে কি মনে করেন? আমি মনে করি আপনার উপন্যাসে ধর্ম ও দর্শনের একটি পরিশীলিত ব্যবহার রয়েছে। আপনি কি মনে করেন যে ধর্ম এবং দর্শন পৃথিবীর বিক্ষিপ্ত অংশগুলিকে একত্রিত রাখার সিমেন্ট? আপনার বেশিরভাগ কাজ যেমন “রিটার্ন ফ্রম দ্য স্টার”, “সোলারিস” এবং “হিজ মাস্টার ভয়েস” বিজ্ঞান ও তার সঙ্গে নৈতিক সমস্যার সম্পর্ক বিষয়ে। আপনার কাজের মধ্যে নৈতিকতা সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন? আপনি বিজ্ঞান এবং নৈতিকতার দ্বন্দের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে কি মনে করেন?
মূল্যবোধ কোথাও থেকে হঠাত পেয়ে যাওয়া যায় না, সুতরাং শুধু জ্ঞান আমাদের কোনও সাহায্য করতে পারে না। আধুনিক ধারণা অনুসারে, যা আমি “অর্ডার অফ এম্পিরিসিস্ট” এর সদস্য হিসাবে অনুসরণ করি, অন্যান্য সকলের প্রবৃত্তির সঙ্গে মানুষের মহৎ কাজগুলিও জেনেটিক্যালি প্রোগ্রাম করা রয়েছে। বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট আমাদের জৈবিক কোকুন থেকেই প্রয়োজনীয় মুল্যবোধ পাওয়া যেতে পারে; এটা গাণিতিকভাবেও প্রমাণ করা সম্ভব। আমি এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলব: যদি সামাজিক প্রাণীর দুটি প্রজাতি থাকে এবং তাদের একটিতে অহংবোধ প্রাধান্য পায়, যখন অন্যটিতে পরার্থপর সংবেদনশীলতা দেখায়, প্রবাবিলিটি দেখায় যে দ্বিতীয় প্রজাতির সম্মিলিতভাবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই আদর্শটি বিভিন্ন নৈতিক কোডে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং তা বিভিন্ন ধরণের পরোপকারী আচরণকে প্রত্যাশিত আচরণ বলে স্বিকৃতি দিয়েছে। পরবর্তীতে এই কোডটি অনিচ্ছাকৃতভাবে এর বিবর্তনীয় শিকড় থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং ধর্মীয় উপদেশে পরিণত হয়েছে। তবে বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি কেবলমাত্র কয়েকশ মিলিয়ন বছর ধরে সক্রিয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার ফলাফল। আমি দাবি করি না যে নীতিশাস্ত্রের শুধুমাত্র এই একটিই উৎস আছে, তবে নিঃসন্দেহে কেউ এটি সুদূর অতীতে সৃষ্ট। যার ইচ্ছা প্রাচীন, জৈবিক এবং বিশুদ্ধভাবে ডারউইনীয় বিষয়গুলিকে এড়িয়ে অন্য উৎস গুলিও অনুসন্ধান করতে পারে। যারা – মানবতাবাদী হিসাবে – মানুষের প্রাকৃতিক কর্তব্য এবং আইন বিশ্লেষণ করে, তাদের চোখ অনিচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ; তারা এই সত্যটি সম্পর্কে অবগত নয় যে তারা মানুষের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে যে মতবাদ গুলি সৃষ্টি করেছে তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, কারণ নৈতিকতার শিকড়গুলি যে সময়ের মধ্যে নিহিত, তখনও প্রানীরা কার্য-কারনের পারস্পরিকতাকেই বুঝতে শেখে নি । এটা সম্পর্কে আমাদের কিছুই করার নেই। আমি স্পষ্টতই সচেতন যে মানবসমাজ এই সত্য মেনে নিতে একেবারেই স্বচ্ছন্দ নয়। ব্যক্তিগতভাবে, যদিও আমি একজন অবিশ্বাসী, আমি সেটা না হলেই বেশি স্বস্তি পেতাম, যদিও আমার এই মনোভাবের কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত আমি খুঁজে পাই নি। যাইহোক, আমার মহৎ উদ্দেশ্য এবং অন্যদের এবং নিজের প্রতি আমার শ্রদ্ধার সাথে সহমত নয় বলে আমি একটি নির্দিষ্ট ফ্যাক্টগ্রাফি প্রত্যাখ্যান করা সমর্থন করি না । এটা সত্যি বেশ দুঃখজনক। যেরকম মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও আমি অস্বিকার করতে পারি না যে বিশাল পর্নোগ্রাফিক শিল্প এই সত্যটি থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে যে আমরা যৌনভাবে প্রি-প্রোগ্রামড হয়েছি। ।
আপনি কি ভাবে “সোলারিস” সৃষ্টি করলেন? সোলারিসকে আমরা আধুনিক বিশ্বের মিথ-বিরোধী বলতে পারি। নিঃসন্দেহে মহাবিশ্ব জয় ছিল বিংশ শতাব্দীর মানব পৌরাণিক কাহিনীগুলির মধ্যে একটি। সোলারিস এই মিথকে ধ্বংস করে। “সোলারিস” এ কিছুই অধিকার করা যায় না। সোলারিস কেন এই মানব মিথের “বিপরীত প্রান্তে” দাঁড়িয়ে? সোলারিসে আমরা রহস্যবাদের লক্ষণ দেখতে পাই। এই বই লেখার সময়কার পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে সোলারিসের এই বিশেষ রহস্যবাদের কি সম্পর্ক ?
আমি সাধারনত আমার লেখার প্রক্রিয়া সম্পর্কে খুব কম বিবরণ দিতে পারি। আমার মনে হয় যে প্রতিটি বই নিজেই তার সৃষ্টির ইতিহাসকে আমার মন থেকে মুছে দিয়েছে। উপলব্ধি কাজের স্ফটিকীকরণ প্রক্রিয়াকে আচ্ছন্ন করেছে। একটি বই আমার স্মৃতিতে বহু উপনদীর সম্মেলনের সৃষ্ট কোনও প্রধান প্রবাহ হিসেবে লিপিবদ্ধ। যখনই আমি কোথাও আটকাই এবং পরে সেই পথ প্রত্যাখ্যান করি, “আগে” যা ছিল তা সম্পূর্ণরূপে মন থেকে মুছে যায়। এমনকি আমি আমার সমস্ত বাতিল ম্যানুস্ক্রিপ্ট অবধি ধ্বংস করে ফেলি। আমি যদি ওই লেখাগুলো দেখতে পেতাম, তাহলে হয়তো আমি নিজেই অবাক হয়ে ভাবতাম যে, সম্পুর্ন হওয়া বইটির প্রকৃতি আমার প্রাথমিক বা উত্তর-প্রাথমিক ভাবনা চিন্তার থেকে কতটা আলাদা। এর কারন আমি “ট্রায়াল এন্ড এরর” পদ্ধতি ব্যবহার করি। “সোলারিস” এর শেষ অধ্যায়টি এক বছর বিরতির পরে লেখা হয়েছিল। আমাকে বইটি অতদিন ফেলে রাখতে হয়েছিল কারণ আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না যে আমার চরিত্রটিকে নিয়ে কী করব। কিন্তু আজ আমি ঐ “সীম” খুঁজে পাচ্ছি না – যেখানে বইটির সঙ্গে শেষ অধ্যায়টি জুড়েছিল। তাছাড়া অতদিন ধরে কেন বইটা শেষ করতে পারছিলাম না তাও আজ ব্যাখ্যা করতে পারব না। শুধু মনে আছে যে প্রথম অংশটি এক দৌড়ে এবং বেশ দ্রুত লেখা হয়েছিল, বাকিটা কিছু সময় পরে শেষ হয়েছিল। আমি যখন লিখতে শুরু করি আমার কাছে গল্পের সম্পূর্ণ রূপরেখা থাকে না, যা আমি ভুলে যাওয়ার আগেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লিখে ফেললাম। আমি কেবল লিখতে থাকি, এবং “ঘটনা নিজেই ঘটে”। আমি যখন কেলভিনকে সোলারিস স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিলাম এবং তাকে ভীত, মাতাল স্নাটকে দেখিয়েছিলাম, তখন আমি নিজেই জানতাম না যে কি তাকে এত উদ্বিগ্ন করেছিল। আমি ভাবিই নি কেন স্নাট একজন সম্পূর্ণ নিরীহ অপরিচিত ব্যক্তিকে এত ভয় পাবে। তখন আমি জানতাম না – কিন্তু শীঘ্রই আমি ঠিক খুঁজে বের করলাম, কারণ আমি লিখতে থাকলাম। এই বই সম্পর্কে মন্তব্য করা তাই বেশ কঠিন। আমার মনে হয় আমার যা ইচ্ছে ছিল তা আমি লেখায় প্রকাশ করতে পেরেছি। হারির ফিরে আসা আশ্চর্য একটি নির্দিষ্ট ধারণার উদাহরণ ছিল যা সম্ভবত কান্ট থেকে উদ্বুদ্ধ, যেহেতু এটি ডিং অ্যান সিচ – এমন এক “অন্য দিক” যেখানে আমরা পৌঁছাতে পারি না। আমি কেবল বলতে পারি যে সোলারিস সমালোচকদের কাছে একটি বেশ রসালো খাদ্য হয়ে উঠেছে। আমি এমন সব সমালোচনা পড়েছি যার বিন্দুবিসর্গ আমি বুঝতে পারি নি, এবং প্রত্যাশিতভাবেই বহু সমালোচকই সেগুলো শুরু করেছেন ফ্রয়েডিয়ান ব্যাখ্যা থেকে। একজন আমেরিকান পর্যালোচক একটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন; তিনি জানতেন না যে পোলিশ মূলের ইডিয়মগুলি ইংরেজী থেকে আলাদা – তাই তারা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর অনুমতি দেয় না। “সোলারিস” এর পর্যালোচনাগুলি একটি বিশাল, বেশ মজার ভলিউম তৈরি করতে পারে, যেহেতু পর্যালোচকরা বইয়ের তথাকথিত “মুল ভাবনা” এত রকম বিবিধ আঙ্গিকে দেখেছেন। একজন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট-বিরোধী ইংরেজ ঘোষণা করেছিলেন যে মহাসাগরটি নিশ্চিত ইউএসএসআর, আর স্টেশনের লোকেরা ছোট, প্রতিবেশী দেশগুলির প্রতীক। প্রত্যাশিত অভিক্ষেপের উদাহরণ, উপন্যাসের বস্তুতে সমালোচকের নিজের হৃদয় ও আত্মাকে দেখার সাধারণ ঘটনা, কিন্তু এটা সাহিত্য সমালোচনার বৈষম্যময় চরিত্রকেই উন্মোচিত করে।
কল্পবিজ্ঞানের জগতে কি এমন কোন নির্দিষ্ট লেখক আছেন যার কাজ আপনাকে আকর্ষন করে?
মৌলিক এবং আকর্ষণীয় মনন ছিল ফিলিপ ডিক-এর, তবে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে তারও কিছু সমস্যা হয়েছিল। প্রথমদিকে তিনি ফ্রান্সে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন এবং পরে তার খ্যাতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও, তার সব কাজের মান সমান ছিল না। আমি একবার কিছু মার্কিন ম্যাগাজিনের জন্য একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, যেটি এই শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছিল: “সায়েন্স ফিকশন ব্যতিক্রম সহ আবর্জনা এবং ডিক সেই ব্যতিক্রমের একজন।” এই ক্ষেত্রে আমি খুব বেশি “মননের টাইটান” দেখি নি। কিছু অসামান্য বিজ্ঞানী থাকতে পারেন, যারা মাঝে মাঝে কল্পবিজ্ঞান লেখেন, আমি এমন একজনকে চিনি যিনি সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন… আমি তার নাম উল্লেখ করিনি, তাই আমি বলতে পারি: তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন পদার্থবিদ এবং তৃতীয় শ্রেনীর লেখক। এমন কিছু ঘটনাও ঘটেছে যখন প্রথম শ্রেনীর লেখকরা, যেমন ওয়েলস, কল্পবিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করেছেন। স্ট্রাগাটস্কি ভাইদের আমার যথেষ্ট পছন্দ, যদিও “পিকনিক এট দ্য রোডসাইডের” এর সমাপ্তিটা আমার খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় নি। এই বইটি আমাকে এক অর্থে কিছুটা ঈর্ষান্বিত করে কারন আমার মনে হয়েছে যে “আমারই এটি লেখা উচিত ছিল”। বর্ণনার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, যদিও লেখকরা এই নিয়ে কিছুটা বাড়াবাড়ি করেছেন। এই কাজটি ভালো কারণ এটি একটি ক্লাসিক বিষয়কে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছে, যা আগে ওয়েলস তার “ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস”-এ বিকশিত করেছিলেন – পৃথিবীর আক্রমণের থিম। ক্লার্কও বেশ মননশীল, তবে তিনি বিমূর্ত-তত্ত্বের পরিবর্তে ইঞ্জিনিয়ারিং ডোমেনের দিকে বেশি আকৃষ্ট। তার কিছু দুর্দান্ত কল্পনাও ছিল, বিশেষ করে একটি: উপগ্রহগুলি ভূ-স্থির কক্ষপথে ঘুরছে এবং রেডিও এবং টিভি ট্রান্সমিটার হিসাবে কাজ করছে। তিনি একবার বলেছিলেন যে এই আইডিয়াটা পেটেন্ট না করা নিয়ে তার আফসোস হয়। করলে এতদিনে তিনি বিশাল সম্পদশালী হয়ে উঠতেন।
আন্দ্রেই টারকোভস্কি “সোলারিস” চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করার সময় কি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন? আন্দ্রেই তারকোভস্কি এবং স্টিভেন সোডারবার্গের চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনার কি মত? আপনার গল্পে পরিচালকরা যে পরিবর্তনগুলি করেছেন তার সাথে আপনি কি একমত?
তারকোভস্কি “সোলারিস” ছবির চিত্রায়নের জন্য পাগল ছিলেন… সেই সময়ে তাকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপদস্থ সদস্যরা বলে পাঠিয়েছিল যে এই বইটির ছবি তৈরি করা উচিত নয়, কারণ এই কাজটি আদর্শগতভাবে ত্রুটিযুক্ত: আদর্শবাদী, বিষয়গত এবং আধিভৌতিক। যাইহোক, তিনি তাদের কথা শুনবেন না কারণ তারকোভস্কি একটি বিশুদ্ধ “রাশিয়ান আত্মা” আর তার সঙ্গে মিশেছে এক আদর্শবাদী-আধিভৌতিক মনন – তাই এই ধরনের সতর্কবার্তা গ্রাহ্য করা তার ধাতে ছিল না। তবে তার চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমার গুরুতর আপত্তি আছে। প্রথমত আমি ছবিতে সোলারিস গ্রহ দেখতে চাই। দ্বিতীয়ত, আমাদের একটি তর্কের সময় আমি তারকোভস্কিকে বলেছিলাম যে তিনি কখনই “সোলারিস” করেননি – বরং “ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট” করেছেন। এই ফিল্মটি থেকে আমরা জানতে পারি যে এই ভয়ঙ্কর কেলভিন-লোকটি দরিদ্র হারেকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায় এবং পরে এটি সম্পর্কে কিছুটা অনুশোচনা অনুভব করে, যা পরবর্তী কালে অদ্ভুত এবং ব্যাখ্যাতিত পরিস্থিতিতে তার পুনরাবির্ভাবের মধ্য দিয়ে আরো জোড়ালো হয়েছিল। কিন্তু সব চেয়ে জঘন্য ছিল ছবিতে কেলভিনের বাবা-মা এবং একটি পিসির চরিত্র ঢোকানো, তার মা-এর চরিত্রটি জোর করে ঢোকানো সবচেয়ে খারাপ ছিল, কারণ ওটা ছিল রাশিয়ান মাট, অর্থাৎ রোডিনা – মাদার আর্থ। এতে সত্যিই আমি রেগেচগিলা,। সেই সময়ে আমরা এমন দুটি ঘোড়ার মতো ছিলাম যারা একই গাড়িকে বিপরিত দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল। জনগণের জীবন, আমরা পথে ঘাটে যা দেখতে পারি, তা কোন অস্তিত্ববাদী উপাখ্যান নয়, আমার কাছে তা বরং কসমস-এ মানুষের স্থান নিয়ে বড় প্রশ্ন! আমার কেলভিন কোন প্রত্যাশা ছাড়াই গ্রহে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আর তারকোভস্কি কিছু দ্বীপ এবং একটি কুঁড়েঘর নিয়ে একটি চালচিত্র তৈরি করে। আমি এই ছবিটি দেখে বেশ বিরক্ত… আমি সহ্য করতে পারছি না ” তারকোভস্কি আমার নায়কদের ইমোশনের রসে ডুবিয়ে মেরেছে আর তার ওপর গ্রহের বৈজ্ঞানিক ল্যান্ডস্কেপ সম্পুর্ণ বাদ দিয়ে নানারকম বালখিল্যতা আমদানি করেছে। সোডারবার্গের রিমেকটা আমি দেখি নি। বিভিন্ন সমালোচনায় পড়েছি যে সেটাও তারকোভস্কিকেই অনুসরন করেছে। তবে ব্যাবসায়িক দিক থেকে এই ছবিটা যে বিশেষরকমের সাফল্য লাভ করেছে তা বলতেই হবে।
এটা কি সত্যি যে আপনি উপন্যাস লেখা ছেড়ে দিয়েছেন? এর কারণ কী?
আমি প্রায় বিশ বছর আগে উপন্যাস লেখা বন্ধ করেছি। আমার আর ভালো লাগে না। আমি গদ্যের চল্লিশটিরও বেশি খণ্ড প্রকাশ করেছি, তাই এই কাজগুলির – বিশেষ করে সারা বিশ্ব জুড়ে – পরিচালনা আমার সাধ্যের অতীত হয়ে গেছে। বিভিন্ন ভাষায় (ফিনিশ বা বাস্ক সংস্করণ সহ) প্রকাশনার সংখ্যায় কখনও কখনও খেই হারিয়ে ফেলি। তার ওপরে রয়েছে আরো বৃহত্তর চুক্তি, যেমন ক্যামেরনের সঙ্গে একটা হয়েছে। “আপনার উপন্যাসের 20th Century Fox প্রোডাকশন সম্পর্কে আপনি কি বলতে চান?” এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন। কিন্তু আমি এমন কিছু সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারি না যা নিয়ে আমি কিছু জানি না। আমার কাজ থেকে অনুপ্রাণিত ছবি দেখতেও আমার ভালো লাগে না, তাই আমি নতুন কিছু সৃষ্টি করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। আমি কথাসাহিত্যে নিয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। লেখার প্রতি আমার বর্তমান অনীহার কারনও তাই; আমি লিখি না, আর একটি বই লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। আমার প্রকাশকরা এর বিপরীতে, যারা বইটি কীসের জন্য ব্যবহার করা হবে (টেবিল এর অসমান পায়া ব্যালেন্স করার জন্য?) তা নির্বিশেষে ব্যবসায়িক পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়টি বিচার করেন। কিন্তু আমি সত্যিই আমার পাঠকদের নিয়ে ভাবি।
ইন্টারনেট সম্পর্কে আপনার মতামত কি? ইন্টারনেট কি মানুষের জীবনে নতুন বিপ্লব?
প্রতিটি নতুন প্রযুক্তির সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে। এবং প্রতিটি মানুষের পক্ষে বা বিপক্ষে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ নিয়ে আমি কিছুটা ভয় পাচ্ছি। হ্যানসেল এবং গ্রেটেলের গল্পে কিছু ভুল নেই, জাদুকরী এবং মিষ্টি দিয়ে তৈরি তার কুঁড়েঘর – যতক্ষণ এটি কল্পনার ডোমেনে থাকে। তবে মিষ্টি দিয়ে তৈরি আসল খাওয়ার যোগ্য কুঁড়েঘরের পুরো ছাদ খেলে অবশ্যই বদহজম হবে। লোভনীয় সবকিছু সর্বদা প্রসারিত হাত এবং ফলের মধ্যে থাকে। একবার হাতে নিলেই ফলটি পচা হয়ে যায় এবং এটি আমাদের আর পছন্দ হয় না। তথ্যের সহজলভ্যতার ক্ষেত্রেও তাই। ইন্টারনেট ভাইরাস দ্বারা সমস্ত নেটওয়ার্ক পঙ্গু হয়ে গেলে তথ্য প্রক্রিয়া করার দুর্দান্ত সম্ভাবনার সুবিধা কি? প্রযুক্তি ভুল কাজের জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে। আমি একজন নিষ্ঠুর ব্যক্তি, তাই আমি এমন লোকদের ঘৃণা করি যারা “আই লাভ ইউ” ধরনের ভাইরাস বানায়। আমি খুব খুশি হব যদি তাঁদের ধরে চাবকানো হয় ও তাদের কপালে “মানবতার এক নম্বর শত্রু” লিখে দেওয়া হয়। আমি মন্দ এবং নির্বোধতায় সমান বিরক্ত। মূর্খতার থেকে মন্দ জন্মায়, যখন মন্দ মুর্খতাকে পোষন করে। টেলিভিশনের পরিপূর্ণ হিংস্রতা আমাদের কে অসংবেদনশীল করে তোলে। ইন্টারনেট আমাদের প্রতিবেশীদের ক্ষতি করা সহজ করে তোলে। আমি সম্প্রতি একজন যুবক সম্পর্কে একটি নিবন্ধ পড়েছি যে (প্রায় সফলভাবে) একটি বড় আমেরিকান বিমানবাহী রণতরীর কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ অর্জনের চেষ্টা করেছিল। আমি যদি প্রায় ত্রিশ বছর আগে এমন একটি গল্প লিখতাম, তাহলে সবাই আমাকে পাগল মনে করতো। তবে বর্তমানে এ ধরনের প্যারাডক্স সম্ভব। মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস ভূতাত্ত্বিক ঘড়িতে মাত্র এক সেকেন্ড। আমরা একটি অবিশ্বাস্য ত্বরণের সময়ের মধ্যে বাস করছি। আমরা এমন একজন মানুষের মতো, যে একটি পঞ্চাশতলা ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ত্রিশতম তলায় পৌঁছেছে। কেউ একজন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে: “কেমন আছো?” এবং পড়তে থাকা লোকটি উত্তর দেয়: “এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিক আছে”। যে গতি আমাদের বন্দী করেছে সে সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ। প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ খুবই দুর্বল।
আপনি দেখিয়েছেন কিভাবে লেখা এবং এমনকি চিন্তাও ব্যর্থ হতে পারে। সোলারিস বা ফিয়াস্কোতে, লেখা এবং চিন্তার কোথাও পরিণতি নেই। “সোলারিস” কি মানুষের ভাষার মিথিকাল অক্ষমতা ব্যাখ্যা করে – একটি শব্দকে তার নিজস্ব অর্থে নিষিক্ত করার অক্ষমতা?
আমাদের সমগ্র ভাষা এবং চিন্তার প্রক্রিয়া একটি বরং সংকীর্ণ ফাঁকে পড়ে রয়েছে। একদিকে ভাষাটি খুব “কঠিন” হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, অন্যদিকে – এটি খুব “নরম” হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। অত্যধিক “কোমলতা” এর ফলে মানসিক বিকার দেখা দেয়, যেমন সিজোফ্রেনিয়া। শব্দের প্রয়োগের ফ্রিকোয়েন্সি ঘেঁটে যায় – একই কথা একজন কবির ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। তবে যেখানে কোমলতা এটা অনিয়ন্ত্রিত এবং অনিয়মিত ভাবে করে, কবিতা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে আমাদের কাছে “খুব শক্ত” ভাষা রয়েছে যা যৌক্তিক শুষ্কতার ফলে ধনুষ্টঙ্কার সৃষ্টি করে। ত্রিশটিরও বেশি বইয়ের একজন লেখক জানবেন যে একটি সমস্যার দিকে বিভিন্ন দিক থেকে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে, আলাদা আলাদা বর্ণনামূলক কৌশল ব্যবহার করে। একটি ভাষা খুব পরিশীলিত ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় নয় যার ফলে শত শত বিস্ময়কর, যদিও বেমানান বাক্য সৃষ্টি হয়। একই ভাবে খুব শুষ্ক এমন ভাষা ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় নয়, যা যৌক্তিক মূল থেকে বিছিন্ন। লেখককে সেই ভারসাম্য খুঁজে বের করতেই হবে, যা এর মাঝামাঝি কোথাও রয়েছে।
আপনি কিভাবে সমালোচকদের সাথে মোকাবিলা করেন? সমসাময়িক উপন্যাসের জন্য আপনি কি ধরনের সমালোচক পছন্দ করেন?
পশ্চিমা সমালোচকদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা অনেক ভুল বোঝাবুঝি এবং ভুল ধারণার কারণে খারাপ। ভাল সমালোচকরা আমার কাজগুলি (এই ক্ষেত্রের সর্বোচ্চ ডোমেনে) নিয়ে কাজ শুরু করার পরেই এটা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। প্রথম দিকে সমালোচকরা আমার বইগুলি এমন ভাবে পড়ত যেন তারা টেলিফোন বইতে ডোনাটের রেসিপি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিল – তাই তারা অসন্তুষ্ট হয়েছিল এবং আমার বইগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিল। আমি জানতাম যে তা নিয়ে বিতর্ক এবং আলোচনা নিরর্থক। কেমন লাগবে যদি আমি বলি ? ” যেমনটি সমালোচক X বলেছেন, আমার বইটি Y বিষয়ের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে তা সত্য নয়, । এটি Z বিষয়টিকে উৎসর্গ করা হয়েছে।” এগুলি কেবল বড় আকারের ভুল বোঝাবুঝি ছিল। বর্তমানে একই অবস্থা বিপরীতভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। বেশির ভাগ পর্যালোচনায়, ঠিক যেমন একটি লেজ একটি ধূমকেতুকে অনুসরণ করে, আমার প্রতিটি বইকে অনুসরণ করে গতে বাঁধা প্রশংসা; যার অর্থ হল সংশ্লিষ্ট সমালোচক নিশ্চিত যে তাকে একটি “ভাল এবং প্রশংসনীয় পণ্য” দেওয়া হয়েছে, তবে তিনি আসলে নিশ্চিত নন যে বইটি আসলে কী বিষয়ে। সমগ্র বিশ্বে প্রায় এক ডজন সমালোচক আছেনস যারা সমালোচনা এবং আধুনিক বিজ্ঞান উভয় ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ। বিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া কেউ আমার কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারবে না। উপস্থাপিত ধারণাটি আমার কল্পনা, একটি এক্সট্রাপোলেশন, না বাস্তব, বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত তথ্য থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তা একজন বিজ্ঞান অজ্ঞ সমালোচক বুঝবে কীভাবে? যদি কেউ পাঠকদের জন্যও লেখেন, তিনি তার সমালোচক হিসেবে এমন একজন প্রতিভাবানকে চাইবেন, যিনি তার থার্মোমিটারকে একটি প্রদত্ত পাঠে রেখে তার সঠিক তাপমাত্রা নির্ধারন করতে পারবেন। যাইহোক, আমার ক্ষেত্রে সেসব ছিল না। পশ্চিমে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়বস্তু সহ একটি উপন্যাসের চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছু নেই। শয়তান পবিত্র জলে কম, চিন্তাশীল মানুষে বেশি ভীত হয়! প্রকাশকরা হলেন এমন ব্যক্তিবর্গ যাদের সাধারণত সাহিত্য সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণাও থাকে না। তাই তারা মনে করে এই ধরনের বিষয়বস্তু অপ্রয়োজনীয়। তারা উদ্ঘাটনের জন্য অপেক্ষা করে এবং একটি বেস্টসেলারের কল্পিত কাহিনীতে বিশ্বাস করে। আরও মজার বিষয় হল যে তারা সম্ভাব্য বেস্টসেলার এবং বই যা বিক্রি হবে না তার মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম। তারা সেই তুলো ব্যবসায়ীদের অনুরূপ যারা পালক আর তুলোর তফাত করতে পারে না। আমি বলছি না যে এটি সর্বদা হয়ে থাকে, তবে এটি অবশ্যই বেশ কিছু প্রকাশকের ক্ষেত্রে সত্যি। আমার বাণিজ্যিক সাফল্য একটা ব্যাপার ঘটিয়েছে। প্রথম দিকে আমি খারাপ বই লিখতাম, যেগুলো বেশ “পাঠযোগ্য” ছিল; পরে তারা কম “পঠনযোগ্য” হয়ে ওঠে তবে অবশ্যই বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে আরও ভাল হয়েছে। এই কারণেই আমার রচনাগুলি ব্যাপক হারে পঠিত হয়েছে। আমি যদি “ইম্যাজিনারি ম্যাগনিটিউড” এর মতো বই দিয়ে শুরু করতাম, তবে কোনও মিলিয়ন-কপি সংস্করণ সম্ভব হত না, কারণ আমি খুব ছোট বৃত্তের কাছে পরিচিত হতাম। প্রথম বই, যেমন “দ্য এস্ট্রোনটস” এবং “রিটার্ন ফ্রম দ্য স্টারস” আমার প্রচারের কারন হয়ে ওঠে। যাইহোক, আমার প্রথম দিকের সমস্ত বই খারাপ নয়, কারণ “সোলারিস” এবং “দ্য স্টার ডায়েরিজ” সম্পর্কে কেউ এসব বলতে পারে না, ওগুলোর অনেকগুলি সংস্করণ হয়েছিল।
প্রাচ্যের সাহিত্যের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন? আপনি কি কখনও ফার্সি সাহিত্য বা গল্প লেখা থেকে কিছু শুনেছেন? আপনি অনুবাদ সম্পর্কে কি মনে করেন? আপনার গল্পে কি এমন কিছু আছে যা অনুবাদ করা যায়নি?
দুর্ভাগ্যবশত আমি ফার্সি সাহিত্য জানি না, তাই আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। প্রকাশকরা মনে করেন যে যদি একজন অনুবাদককে ভাল অর্থ প্রদান করা হয় তবে তা অনুবাদের শৈল্পিক মূল্যকে বাড়িয়ে তুলবে। তবে একজন প্রকৃতপক্ষে যা প্রয়োজন তা হল লেখক এবং অনুবাদকের মধ্যে আধ্যাত্মিক সখ্যতা। যদি তাদের প্রিয় বই এবং জীবনের কিছু মিল থাকে, তবে এটি তাদের ভাবনা, শব্দ, শৈলী এবং বাগধারার শব্দার্থিক ফ্রেমের ক্ষেত্রেও মিল থাকার সম্ভবনা প্রবল। এই ভিত্তি একটি প্রয়োজনীয়, যদিও অপর্যাপ্ত শর্ত। এছাড়াও যা প্রয়োজন তা হ’ল প্রতিভা – যা কোনও অর্থ কিনতে পারে না। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আমার রচনার অধিকাংশ অনুবাদের ফলাফল মূলের চেয়ে খারাপ। সবচেয়ে খারাপ হল “সোলারিস” এর ইংরেজি অনুবাদ, যেটি একটি খুব দুর্বল ফরাসি অনুবাদ থেকে অনুবাদ করা হয়েছে! কয়েকবার আমার সহজাত অনুবাদকদের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমার প্রিয় ছিল ইর্মট্রাউড জিমারম্যান-গোলহেইম, একজন জার্মান অনুবাদক, যিনি দুর্ভাগ্যবশত খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। তিনি একটি বিরল ভাষাগত জ্যোতিষ্ক ছিলেন, কারণ তিনি অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত পোলিশ শিখেছিলেন। তিনি “মর্টাল ইঞ্জিনস”, “দ্য ফিউচারোলজিক্যাল কংগ্রেস” এবং “সোলারিস” অনুবাদ করেছেন যা মূলের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সাযুজ্য বজায় রেখেছিল। সেই সময়ে আমি শিখেছিলাম যে একটি ভাল অনুবাদের জন্য অনেকগুলি রেসিপি আছে, যেহেতু আমার আমেরিকান অনুবাদক মাইকেল ক্যান্ডেল, যিনি “দ্য সাইবেরিয়াড” অনুবাদ করেছেন, অনেক প্যারাফ্রেজ করেছেন, ট্রান্সপোজিশন ভেঙেছেন এবং কখনও কখনও মূল ট্র্যাক থেকে সরে এসেছেন – কিন্তু তাতে মূল গল্পের আত্মা হারায় নি। এই কাজটি খুব কঠিন ছিল। আমার “সুম্মা টেকনলজিয়া”-এর প্রথম রাশিয়ান অনুবাদটি বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ প্যানোভকিন সহ গ্রোমোভার দশজন মস্তিষ্ক করেছিলেন। পরে রাশিয়ায় আমার সেরা অনুবাদক হয়ে ওঠেন গণিতবিদ শিরোকভ, যিনি ব্যতিক্রমীভাবে বিশ্বাসযোগ্য ভাষার সমতুল্য খুঁজে বের করে আমার অদ্ভুত-রসাত্মক রচনাগুলি অনুবাদ করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক পাঠ্যের একজন মহান অনুবাদকে পরিণত হয়েছিল ফ্রেডরিখ গ্রিসে – এটি “সুম্মা টেকনোলজিয়া” এর ক্ষেত্রে হয়েছিল – তবে প্রকাশকের সঙ্গে তার কিছু বিরোধ ঘটেছিল। গ্রিসের কিছু বিশেষ রয়্যালটির প্রয়োজন ছিল, কারণ তিনি একা কাজ করেছিলেন, রাশিয়ানদের মত দল নিয়ে করেন নি। দুর্ভাগ্যবশত, আমার অন্যান্য অনুবাদের অধিকাংশই প্রচণ্ড খারাপ। আমি তার কারণ ব্যাখ্যা করতে যাব না; অনুবাদকদের সমস্যাগুলি বোঝার জন্য “সাইবেরিয়াড” থেকে কয়েকটি পৃষ্ঠা দেখাই যথেষ্ট। আমার পরিস্থিতি কিছুটা ফকনারের মতো, যাকে ফরাসিরা আমেরিকানদের “অর্পণ” করেছিল, যেহেতু তিনি তার সবচেয়ে উর্বর সময়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না।
Tags: kalpabiswa y7n1, Stanislaw Lem, পেম্যান ইসমাইলি, সুপ্রিয় দাস, স্তানিসোয়াভ লেম
লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ ও তথ্যসমৃদ্ধ। কিন্তু অনুবাদের ভাষা আমার পছন্দ হয়নি। একটু ভালো করে দেখা দরকার ছিল।