৪৫১ ডিগ্রি ফারেনহাইট
লেখক: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
৪৫১ ডিগ্রি ফারেনহাইট। যে তাপে কাগজ পোড়ে। পুড়ে যায় বই… কাগজে ছেপে বাঁধিয়ে নেয়া অক্ষরমালা, যা কিনা জ্ঞানের সঞ্চয়মাধ্যমের প্রতীক।
আকৈশোর গ্রন্থাগার থেকে আরেক গ্রন্থাগারে তাঁর পদচারণা। কলেজি শিক্ষা পাননি। খবর কাগজ বেচতেন তরুণ বয়সে। আর তারই পাশাপাশি যতটা, সময় পেতেন, কাটাতেন লাইব্রেরির শব্দহীন রিডিংরুমে, তার বইদের সঙ্গে। এই হলেন ব্র্যাডবেরি, রে ব্র্যাডবেরি।
আজ, তাঁর জীবনকাল থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে অনুভব করা যায়, চূড়ান্ত ভোগবাদি একটা সমাজ, আয়ান র্যান্ড এর অবজেকটিভিজমের দর্শন যেখানে জীবনকে একমাত্র বস্তুবাদি ঐহিক সাফল্যের দাঁড়িপাল্লায় মাপে, সেখানে দাঁড়িয়ে, বেঁচে থাকবার একটা অবলম্বন, একটা অন্ধ প্যাশনের প্রয়োজন ছিল সেই বিত্তহীন তরুণের। বই ছিল তাঁর সেই প্যাশন। আর ফলত, বইয়ের নিরাপত্তার মূল্য তাঁর কাছে অস্বাভাবিক বেশি ছিল। উত্তর বিশ্বযুদ্ধ ভোগবাদি সংস্কৃতির সেই উত্থানের যুগে তাঁর তরুণ অথচ দূরদর্শী মনন, জ্ঞানচর্চার অন্ধকার ভবিষ্যতকে অনুভব করেছিল। আর সেই অনুভূতি, খানিক দুঃস্বপ্নের মতোই ফুটে বের হচ্ছিল তাঁর একাধিক গল্পে, যার মূল বক্তব্য হল, বইকে ধ্বংস করবার প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস ও তাকে রক্ষা করবার গেরিলা কৌশলাদি।
কিন্তু, সমাজের বুনোটের একটা কোনো সুতোকে নিয়ে আলাদা করে কাজ করা অসম্ভব। তাতে অন্য সুতোগুলোতেও টান পড়ে। গল্পগুলোর মধ্যে দিয়ে আগামি সমাজের যে কোলাজটা গড়ছিলেন ব্র্যাডবেরি, সেখানেও তাই সেই পরিবর্তিত ভোগসর্বস্ব সমাজের টুকরো টুকরো ছবিও গড়ে উঠছিল। যেমন একটা গল্পে (দ্য পেডেস্ট্রিয়ান) দেখা গেল, রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হাঁটা এক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আর এইভাবেই টুকরো টুকরো ভবিষ্যত বয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সমাজের যে পূর্বাভাষটা গড়ে উঠছিল তা অবশেষে একটা নভেলায় একত্রিত হল। তার নাম ফায়ারম্যান।
এর কিছুকাল বাদে নভেলাটার আয়তন প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে জন্ম হয়ে ফারেনহাইট ৪৫১-এর।
ভবিষ্যৎদর্শী সাহিত্য পৃথিবীর নানান ভাষায় কম জন্মায়নি। তবে সত্যি বলতে কী, ফারেনহাইট ৪৫১-র মতন এত অব্যর্থ ভবিষ্যৎবাণী বোধ হয় তার মধ্যে কোটিতে গুটিকয়েকের বেশি নেই। ধনতন্ত্র ও ভোগবাদ তার নিজের স্বার্থেই একসময় উপভোক্তাদের চিন্তার ক্ষমতাকে শেষ করে দেবে, এবং সে শেষ করে দেবার জন্য তাদের হাতিয়ার হয়ে উঠবে ইলেকট্রনিকস ও সরকারি মেশিনারি— এই হাড়হিম করা ভবিষ্যৎবাণী এ-উপন্যাসের মূল উপজীব্য। এর পাতায় পাতায় সেই শেষ করে দেবার অজস্র খুঁটিনাটি পদক্ষেপের বিবরণ রয়েছে।
লেখক যে-সময়ে বসে এই উপন্যাস লিখেছেন সেই সময়ের প্রেক্ষিতে সেই পদক্ষেপদের অধিকাংশ অবশ্যই কাল্পনিক। কিন্তু সমস্যা হল, পাঠ যতই এগোবে ততই পাঠক আবিষ্কার করবেন, গত তিন-চার দশক ধরে সেই কাল্পনিক খুঁটিনাটিগুলো এবং ফলত সমাজের বিবর্তনের ধারাটা হুবহু বাস্তব হয়ে উঠে চলেছে। যেন কোনো অশুভ আঁতাতে টেকনোলজি, ধনতান্ত্রিক ও ভোগবাদি অর্থনীতি এবং সরকার হাতে হাত মিলিয়ে এই বইটার পাতা ধরে ধরে তাকে বাস্তবে বদলে দিয়ে চলেছে একসঙ্গে। ফলত একসময় একটা গা শিরশিরে ভয় মেরুদণ্ড বেয়ে উঠে আসবে পাঠকের—এ বইতে বলা যে ভবিষ্যৎ এখনও কাল্পনিক, অদূর ভবিষ্যতে তা-ও আবার বাস্তবে বদলে যাবে না তো!
উত্তরটা সম্ভবত হ্যাঁ। এখনও সাবধান না হলে সেটা ঘটবে। ঘটতে বাধ্য। অন্তত যে পথে হাঁটছি আমরা সে পথের অভিমুখ না বদলালে ওই গন্তব্য ছাড়া আর কোথাও পৌঁছোনো সম্ভব নয়।এইখানেই এ-উপন্যাসের সমসাময়িকতা।
বহুস্তর এই উপন্যাসে লেখক ব্র্যাডবেরি পাঠকের বৌদ্ধিক স্তরকে তাচ্ছিল্য করে অনাবশ্যক অতিসরলীকরণের পথে হাঁটেননি। বক্তব্যকে তীক্ষ্ণ করবার তাগিদে গদ্যকে বহুস্তরীয় করে, তাতে অজস্র ইনটার-টেক্সচুয়ালিটি বুনে দিয়ে তিনি পাঠকের পাঠের ব্যপ্তি ও গভীর অভিনিবেশের ওপরে ভরসা রেখেছেন। অনুবাদক হিসেবে সে ভরসা আমিও পাঠকের ওপরে রাখলাম।
শেষ করবার আগে আর একটা কথা।
তথ্যের বৈদ্যুতিণ সংরক্ষণ ও আঙুলের একটা ক্লিকে তার সহজলভ্যতা, ইবুকের নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি, নৈনং দহন্তি পাবকঃ টাইপের স্টেটাস দেখে অনেকেই বলবেন, ফারেনহাইট ৪৫১ অবসোলিট। বইকে আর পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব নয়। আমাদের গুটেনবার্গ আছে, অর্কাইভ অর্গ আছে, লিবজেন, কিন্ডল, ইপাব আছে।
হ্যাঁ। ৪৫১ ডিগ্রি ফারেনহাইট সত্যিই ধীরে ধীরে আউট অব কনটেক্সট হয়ে উঠছে। কারণ, বৈদ্যুতিন মিডিয়ায় প্রতিবাদের ভাষ্যের গলা টিপতে এখন উপযুক্ত কর্তার থেকে একটা ফোনকলই যথেষ্ট। ফায়ারম্যান বিটিকে আর কেরোসিনের হোস ধরতে হয় না। ঠান্ডাঘরে বসে এখন মাউসের একটা ক্লিকেই সে প্রতিবাদের ভাষ্যদের ছাই করে দেয়।
৪৫১ ডিগ্রি ফারেনহাইট সত্যিই ধীরে ধীরে আউট অব কনটেক্সট হয়ে উঠছে, কারণ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্য, যা ছাপা মাধ্যমে ধরা আছে, তার নাটুকে এডিটেড রগরগে অডিয়ো রূপ, সংক্ষেপিত বদলে দেয়া অক্ষম চলচ্চিত্ররূপ এখন সেই ছাপা মাধ্যমকে অপ্রয়োজনীয় করে দিচ্ছে একটু একটু করে। এই ভবিষ্যৎবাণীও ধরা আছে ব্র্যাডবেরির এই উপন্যাসে।
Tags: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, বিশেষ আকর্ষণ, সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা