রিভিউ: Chosen Spirits/The City Inside
লেখক: সোহম গুহ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
শহর কি?
শহরের সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে অনেকগুলো কথা মাথায় আসে। কারুর কাছে শহর ইঁট কাঠ, পাথর, আর কংক্রিটের জঙ্গল, কারুর কাছে গাড়িঘোড়ার চিৎকার সর্বস্ব এক বিভীষিকা, যেখানে রাস্তা পেরনোর জন্য আলোর রং বদলের অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু শহর আসলে তা নয়, শহরের পরিচয় তার রেওয়াজের আত্মপ্রত্যয়ে, তার সংস্কৃতির অবভাসে, তার মানুষের মাঝে। শহরের পরিচয় তার অপ্রতিহত আত্মনিবেদনে, তার মাঝের মানুষের শহরে। সেই কারণেই, এই বইয়ের উভয় নাম Chosen Spirits, আর The City Inside সার্থক।
শমিত বসুর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় প্রাইমারিতে পড়ার সময়। হাতে এসেছিল একটা রাশভারী নামের ইংরাজি বই, উপরি পাওনা ছিল ভেতরে লেখকের সাক্ষর। The Simoqin Prophecies পড়ে বুঝে উঠতে যদিও আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও বছর পাঁচেক। কিন্তু ভারতীয় ঘরানার ফ্যান্টাসির সঙ্গে আমার সেটাই মনে হয় প্রথম পরিচয়। তাই যখন কলেজ স্ট্রিটের এক দোকানে ওনার নতুন বইটি সাজানো দেখি, কেনার লোভ সামলাতে পারিনি। চোজেন স্পিরিট, এককথায় বললে, দিল্লির গল্প, দিল্লিবাসির গল্প। সেই দিল্লির সঙ্গে আমাদের বর্তমান দিল্লির ভীষণ মিল, আবার ভীষণ অমিলও। কে জানে, হয়তো সেটা সায়েন্স ফিকশনের ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতার জন্যই।
গল্পের শুরু যে চরিত্রকে দিয়ে তার সঙ্গে নাম বাদে অ্যামেরিকান সিটকম ফ্রেন্ডসের এক চরিত্রের আর কোনো মিল নেই। থাকার কথাও নয়, কেন নয় সেটা কাহিনির শেষেই পরিস্ফুট। চোজেন স্পিরিটসের দিল্লি ধোঁয়াশায় ঢাকা, তার জলের সমস্যা বর্তমানের থেকেও প্রকট, তার মানুষজন স্বার্থপর, চোখ থাকা সত্ত্বেও চক্ষুষ্মান, তার অলিগলি, আনাচকানাচে অন্ধকার বলে কিছু নেই। সারভেলেন্সের রক্তচক্ষু প্রকট সর্বত্র। কিন্তু তাও মানুষ সেখানে আছে। তারা আছে কারণ তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তারা দিল্লির অধিবাসী কারণ তাদের কাছে দিল্লি কেবল একটা শহর না, এক ভালোবাসার স্থান।
জয়ীর ক্ষেত্রে সেই ভালোবাসা আর সম্মানের উত্থান যখন সে শাহিনবাগের প্রতিবাদী মহিলাদের প্রত্যক্ষ করে। সে দেখে তাদের অনড় অটল অবস্থান সরকারি অচলায়তনে বিরুদ্ধে। তাদের মেরুদণ্ড তখন ঋজু। তাদের পদানত করতে পারেনি এক বিপথগামী সরকার বা দিল্লীর নৃশংস ঠান্ডাও। জয়ী সেইদিনেই ঠিক করেছিল, এখানেই সে থাকবে। এই দেশ, এই শহর তার।
কিন্তু আন্দোলনদের পদদলিত করেছিল আইনের ঠান্ডা ব্যাটোন আর চামড়ার বুট। ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের বিঁধেছিল তাদেরই করের বিনিময়ে কেনা সিসার প্রজ্বলন্ত বুলেট। দিল্লি ভয় পেয়েছিল, গুটিয়ে গেছিল। ভেঙে পড়েনি। তাদের প্রচার আর সবার সামনে হয় না, হয় হয় আড়ালে আবডালে। তাই, জয়ী তার প্রাত্যহিক শরীরচর্চার সময় যতক্ষণ না এক কলামের পুষ্পশোভিত কারুকার্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিরুদ্ধাচারী হ্যাশট্যাগগুলিকে লক্ষ করল, আর ডিকোডার প্রোগ্রামের মাধ্যমে জানল সেটা এক সরকার বিরোধী প্রচারের আমন্ত্রণপত্র, ততক্ষণ সে অবগত ছিল না এই ব্যাপারে।
কাহিনিতে জয়ীর বাবা-মা সেই প্রজন্মের মানুষ যারা প্রত্যক্ষদর্শী ইন্দিরা গান্ধীর সময়কার এমার্জেন্সির, যারা দেখেছেন বা শুনেছেন নকশাল আন্দোলনের কথা। যারা এখনো ভুলে যাননি, অথবা ভুলতে পারেননি ভারতবর্ষের প্রকৃত অর্থ— জন্মভূমি স্বর্গদপী গরীয়সী। তাই হয়তো তারা যখনই পারেন, বলেন তাদের মেয়েকে, “আমাদের মত ভুল করো না। আমাদেরকে আমাদের দেশ মিথ্যা প্ররোচনা দিয়েছিল। বলেছিল আমরা জগৎ-সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠব। হয়ে উঠিনি আমরা।”
কথাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে এক প্রজন্মের জমে থাকা যন্ত্রণা। যন্ত্রণা পালটে যাওয়া দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে না মানতে পারা, নিত্যনতুন প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী সর্বদর্শী ক্ষমতাকে বুঝতে না পারার। তার থেকেও বেশি অজান্তে নিজেদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেওয়ার।
জয়ীর সর্বক্ষণের ভার্চুয়াল সঙ্গী নারদ সেই প্রযুক্তিরই এক অঙ্গ। পৌরাণিক মুনির মতো সেও সর্ববিজ্ঞ। এবং ক্ষেত্রবিশেষে গোপনতথ্য সম্প্রচারক।
কিন্তু কাহিনি তো কেবল জয়ীর না, এই কাহিনি ইন্দির, এই কাহিনি রুদ্ররও। প্রত্যেকে তাদের জায়গায় সঠিক, কেউ নিজের জীবনের সব ঘটনা খোলা চিঠির মতো সম্প্রচার করে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত ফ্লোস্টার হয়ে, কেউ বা পরিবার আর আত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে বিচার করতে। কিন্তু কেউই সম্পূর্ণ না, না ইন্দি, না রুদ্র, না তারা, না জিন, না জারিয়া। না জয়ী, কিংবা তার বাড়িতে কাজ করা লক্ষ্মী।
তাহলে সম্পূর্ণ কে? সম্পূর্ণ একমাত্র শহর দিল্লী। সেই জন্যই রুদ্র ফিরে গেল তার পরিবারের কাছে কারণ পরিবার, তা সে যতই ক্ষতবিক্ষত, বিপর্যস্ত হোক না কেন, অগ্রাহ্য করা অসাধ্য একজন ভারতীয়র কাছে। কাহিনি শেষ করার পর, বিশেষ করে সাইবার বাজারের ঘটনা পড়ার পরে প্রশ্ন জাগে। জয়ী কি সত্যিই বিজয়িনী নায়িকা এই কাহিনির, যা সে বিশ্বাস করে, নাকি অজ্ঞাতে সে-ও হয়ে উঠেছে সেই সুবিশাল চাকার এক নিবেদিত অংশ যা চালিত করছে এই কাল্পনিক অদূর ভবিষ্যতের ভারতবর্ষকে।
শমিত বসু তাঁর কাহিনিতে আমার চেনা তিনটে বিষয়ের প্রয়োগ করেছেন। অরওয়েলের মতো তিনি বলেছেন ভয় দিয়ে মানুষের বাস্তব থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া। আবার তিনি হাক্সলির মতো দেখিয়েছেন কীভাবে ভোগ দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় মনোযোগ। লুন্ডঅয়ালের ২০১৮ বইটির মতো তাঁর দিল্লীর মানুষের মনোযোগ সরিয়ে দেয় বাস্তব থেকে ব্যানার। দিল্লীর এখানে ‘মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে’। বইটা পড়ে একটা কথাই মনে হয়েছে আমার, ডিস্টোপিয়া আর ইউটোপিয়ার ধারণা আসলে ভীষণভাবে ব্যক্তিবিশেষে পরিবর্তনশীল।
এই কাহিনি অবিশ্বাস্য, ভীতিপ্রদক, এবং ক্ষেত্রবিশেষে সম্মোহনী। কিন্তু চোজেন স্পিরিট, বা তার আন্তর্জাতিক সংস্করণ দ্য সিটি ইন্সাইড, অকল্পনীয় না। এই কাহিনি আমাদের ভারতবর্ষের গল্প, আমাদের শহরের গল্প। আমাদের গল্প। কাহিনির শুরুর সেই মীর তাকি মীরের কবিতা তাই রেখে যায় এক রিনরিনে সুর।
Tags: গ্রন্থ পরিচিতি, সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সোহম গুহ