অনন্ত সুতোর গল্প: ব্র্যাডবেরির রহস্য কাহিনি
লেখক: কৌশিক মজুমদার
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“আমার একটা কথাবলা বাক্স আছে। বাক্সটা আমার টাইপরাইটারের ঠিক পাশেই থাকে। যখনই আমার মাথায় কোনো নতুন আইডিয়া আর আসে না, তখন বাক্সটা আমার সঙ্গে কথা বলে। নিত্যনতুন আইডিয়া দেয়” নিজের আত্মজীবনীতে ঠাট্টা করে লিখেছিলেন রে ব্র্যাডবেরি। আজ, একশো বছর পেরিয়ে যখন ব্র্যাডবেরি মানেই ফারেনহাইট ৪৫১ কিংবা মার্সিয়ান ক্রনিকল-এর বহুপঠিত লেখনী, তখন কোথাও যেন আর একজন রে ব্র্যাডবেরি প্রায় অপঠিতই থেকে যাচ্ছেন। এটা সত্যি, জীবনে প্রতিষ্ঠার পরে, যখন তাঁর ভাষা প্রায় কাব্যিক হয়ে উঠেছে, তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন গোয়েন্দা কাহিনি বা ক্রাইম স্টোরি থেকে। কিন্তু সাহিত্য জীবনের প্রথম কুড়ি বছর, সেই নিজেকে গড়ে তোলার দিনে ব্র্যাডবেরি ঝুঁকেছিলেন পাল্প ক্রাইম স্টোরি রচনার দিকে। অ্যা মেমোরি অব মার্ডার-এ নিজেই লিখেছেন “চল্লিশের দশকে ডাইম ডিটেকটিভ, ডাইম মিস্ট্রি ম্যাগাজিন, ডিটেকটিভ টেলস আর ব্ল্যাক মাস্ক ম্যাগাজিনগুলোতে রাজত্ব করতেন হ্যামেট-শ্যান্ডলার কেইন। আমিও হাত মকশো করলাম। কিন্তু করে কিছুদিন বুঝলাম আমি যতই চেষ্টা করি, ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব না। বড়োজোর বাজারে টিঁকে থাকতে পারি।”
জীবনের শুরুর দিকে বিখ্যাত কল্পগল্প রচয়িতা লেই ব্র্যাকেটের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। বিকেলে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যেতেন দুজনে। রে তখন লেই-কে তাঁর লেখা নতুন গল্প শোনাতেন। “লেই ব্র্যাকেট জানতেন যে সমস্ত হৃদয়, আত্মা আর সাহস নিয়ে আমি শুধু একজন লেখক হতে চেয়েছিলাম। আমি চাইতাম আর কেউ না, লেই খুশি হলেই হল। তিনি একবারটি বলুন ‘বেশ হয়েছে’ কিংবা ‘এখনও অবধি এটাই সেরা লেখা’। কিন্তু স্বীকার করতে বাধা নেই আমি তখনও আমার সঠিক কণ্ঠ খুঁজে পাইনি। ধীরে ধীরে অদ্ভুত গল্পের মধ্যে আমি আমার লেখক হবার মতো কিছু সারসত্য খুঁজে পেতে শুরু করলাম। যখন লস অ্যাঞ্জেলেস হাই স্কুল ছাড়লাম, সেই বছর থেকে শুরু করে, সপ্তাহে একটা করে গল্প লেখার নিয়ম চালু করলাম। আমি জানতাম যে প্রচুর পরিমাণ লেখা না লিখলে কোনোদিন কোনো গুণমান বাড়তেই পারে না। সেই সময়ে আমার লেখা গল্পগুলো এতটাই খারাপ ছিল যে শুধুমাত্র দিনরাত অনুশীলনই আমার মাথা থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করতে পারত। তাই প্রতি সোমবার আমি যে কোনো গল্পের প্রথম খসড়া লিখতাম। মঙ্গলবার সেকেন্ড ড্রাফট, তারপর থার্ড, এমন করে শনিবার ফাইনাল ড্রাফট লিখে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতাম রিজেক্ট হবার অপেক্ষায়।”
পাল্প ম্যাগাজিনে টিঁকে থাকার লড়াইতে ব্র্যাডবেরি অদ্ভুত এক অস্ত্র নিলেন। বাকিরা যেখানে একের পর এক নতুন নতুন হার্ড বয়েল্ড ডিটেকটিভ চরিত্র সৃষ্টি করে তাঁদের দিয়ে অ্যাকশানে ভরপুর জমজমাট গোয়েন্দা কাহিনি লিখছেন, ব্র্যাডবেরি সেখানে অনেক বেশি সেরিব্রাল। এতটাই তিনি আলাদা অন্যদের চেয়ে যে ১৯৪৪ সালে উইয়ার্ড স্টোরির এক বছরের প্রতিটা সংখ্যায় তাঁর লেখা ক্রাইম গল্প রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন সম্পাদক। পাল্প ডিটেকটিভ গল্পের কতগুলো বেঞ্চমার্ক ছিল। ছোটো গল্প, অসম্ভব দ্রুত গতি, প্রচুর সাদা-কালো মেশানো ধূসর চরিত্র আর একদম শেষে এক তীব্র মোচড়ে গোটা গল্পের দিক ঘুরিয়ে দেওয়া। সবকিছু মেনেও ব্র্যাডবেরি তার ক্রাইমে অদ্ভুত একটা এলিমেন্ট ঢুকিয়ে দিলেন। ইনঅ্যাকশান। কিচ্ছু না হওয়া। সর্বদা যে কাহিনির একেবারে শেষে ভয়ানক কিছু একটা হচ্ছেই, তা না। অনেক সময় কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু গল্প শেষ হচ্ছে এক অনন্ত সম্ভবনায়। এই সম্ভবনা পাঠককে ভাবায় আর একেবারে ছাই চাপা আগুনের মতো গল্প পড়ার পরেও সেই উত্তেজনা মিলিয়ে যায় না। একটা গল্পের কথা এক্ষুনি মনে পড়ল। ‘দ্য হোল টাউন ইজ স্লিপিং’। লাভিনিয়া নেবস এক প্রত্যন্ত টাউনে থাকে। এক সন্ধ্যায় বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখতে যায় সে। মজা হল শুরুতেই ব্র্যাডবেরি তার ঠাকুমার মুখ দিয়ে বলিয়ে দেন ইদানিং এক অজ্ঞাত আততায়ী মেয়েদের খুন করে চলেছে। পুলিশ তার নাম দিয়েছে দ্য লোনলি ওয়ান। লাভিনিয়া যেন সাবধানে বাড়ি ফেরে। ব্যাস! এরপর থেকে দক্ষ পরিচালকের মতো ব্র্যাডবেরি একের পর এক অতি সাধারণ বর্ণনা দিয়ে চলেন। পাঠক সাসপেন্সের চূড়ান্তে পৌঁছে দাঁতে নখ কাটতে থাকে। ফেরার সময়, গোটা জনপদ যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, ব্র্যাডবেরি সেখানে কাব্যিক ভাষায় দৃশ্য রচনা করে চলেন, আর পাঠক উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করে এই বুঝি কিছু হল। নিজেরাই পড়ে দেখুন কী অপূর্ব সে ভাষা—
The three women moved along the street under the black trees, past suddenly locked houses. How soon the news had spread outward from the ravine, from house to house, porch to porch, telephone to telephone. Now, passing, the three women felt eyes looking out at them from curtained windows as locks rattled into place. How strange the popsicle, the vanilla night, the night of close-packed ice cream, of mosquitolotioned wrists, the night of running children suddenly veered from their games and put away behind glass, behind wood, the popsicles in melting puddles of lime and strawberry where they fell when the children were scooped indoors. Strange the hot rooms with the sweating people pressed tightly back into them behind the bronze knobs and knockers. Baseball bats and balls lay upon the unfootprinted lawns. A half-drawn, white-chalk game of hopscotch lay on the broiled, steamed sidewalk. It was as if someone had predicted freezing weather a moment ago.
শেষটা বলব না। কিন্তু শেষেও এমন একটা মোচড় দেন তিনি, যে মনে হাজারো প্রশ্ন রয়ে যায়। সত্যিই কি লোনলি ওয়ান লাভিনিয়াকে ধরতে পারল? তর্ক চলবে। ঠিক এমনই কিছু হয়েও অনেক কিছু ঘটে যায় ‘দ্য স্মল অ্যাসাসিন’ গল্পে। এমন গল্প বিশ্বসাহিত্যে দুর্লভ। এক মা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন তার সদ্য জন্মানো শিশুপুত্রটি স্বয়ং শয়তানের অবতার ছাড়া কিচ্ছু না। কাহিনির মূল চরিত্র সেই মহিলা আর মহিলার ডাক্তার। এই গল্পে ব্র্যাডবেরি কামাল করেছেন ন্যারেশানে। পাঠকের কাছে স্পষ্ট দুটো পথ আছে। এক, মহিলা বিশ্বাস করা, দুই, তিনি যা ভাবছেন ভুল ভাবছেন ভেবে গল্পটা পড়া। ব্র্যাডবেরির কৃতিত্ব এটাই, আপনি যাই ভাবুন না কেন, শেষে আপনার মনে হবে আপনিই ঠিক। এই ওপেন এন্ডেড ন্যারেটিভে ব্র্যাডবেরি সিদ্ধহস্ত। আবার কিছু কিছু গল্পে তিনি বড্ড বেশি ভয়াবহ, আত্মাকে নাড়িয়ে দেবার মতো। যে সূক্ষ্মতার কথা এতক্ষণ বলছিলাম, তা একেবারেই অনুপস্থিত এই সব গল্পে। তবে এখানেও শেষটা একেবারে স্তব্ধ করে রাখে। আমার ধারণা এই ধরণের গল্পগুলো সম্পাদকের পছন্দে লিখতে হয়েছিল। ফরমায়েসি কাজ। কিন্তু তার পরেও দ্য ট্রাঙ্ক লেডি, আই অ্যাম নট সো ডাম্ব, কিংবা কিলার কাম ব্যাক টু মি-র মতো গল্প, যা মাইক টাইডেনের ডিটেকটিভ টেলস আর রিয়াসরন জনসনের নিউ ডিটেকটিভে ছাপা হত, এক অন্য ব্র্যাডবেরিকে চেনায়। বিশেষ করে ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভে লেখা গল্প দ্য টাউন হোয়ার নো ওয়ান গট অফ। ডিটেকটিভ গল্পের এক পরিচিত ছক হল আনরিলায়েবল ন্যারেটিভ, যা মূলত প্রথম পুরুশে বলা কাহিনিতেই থাকে। আগাথা ক্রিস্টি খুব সম্ভব এই ছকে লেখা সেরা কাহিনির রচয়িতা “মার্ডার অব রজার অ্যাক্রয়েড”। ব্র্যাডবেরি করলেন কি, এই ঘরাণার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন নিজের ওপেন এন্ডেড ন্যারেশন আর ইনঅ্যাকশান। তৈরি হল বিশ্বসেরা এক গল্প। এবং এখানেও ব্র্যাডবেরি শেষে আবার সেই কাব্যিক ভাষায় ফিরে যান—
The train wailed.
Suddenly old myself, I leaned out, squinting. Now the darkness that had brought us together stood between. The old man, the station, the town, the forest were lost in the night. For an hour I stood in the roaring blast staring back at all that darkness.
পঞ্চাশের দশক থেকে ব্র্যাডবেরির ক্রাইম গল্পে একটা স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যায়। এই সময়ই তিনি লিখছেন মার্সিয়ান ক্রনিকলস কিংবা ফারেনহাইট। ফলে সজ্ঞানে কিংবা অজানতে তার ক্রাইম লেখাতেও কল্পবিজ্ঞানের প্রবেশ ঘটল। ম্যারিওনেট ইনকর্পরেশন কিংবা পানিশমেন্ট উইথআউট ক্রাইম আসলে ভবিষ্যতের কাহিনি যেখানে রোবোটিকস প্রবেশ করছে অদ্ভুতভাবে। ব্র্যাডবেরি গবেষকরা অবশ্য অন্য কথা বলেন। তাঁদের মতে যতই ভিনগ্রহের কথা লিখুন না কেন, তাঁর আসল আগ্রহ ছিল মানুষে, মানুষের জটিল মনস্তত্বে। আর ঠিক সেই জন্যেই তিনি ক্রাইম গল্প যখন লেখেন, তাতে মানুষের মনের বিচিত্রভাবই প্রধান হয়ে ওঠে। কল্পবিজ্ঞানেও তাই। গবেষক ড্যামন নাইট জানাচ্ছেন ব্র্যাডবেরির যে কোনো লেখার বিষয় মূলত “the fundamental prerational fears and longings and desires: the rage at being born; the will to be loved; the longing to communicate; the hatred of parents and siblings, the fear of things that are not the self.”
এক অনন্ত সুতো ধরে সময়ের আগুপিছু করে গেছেন তিনি। টাচ অফ পেটুলেন্সের অন্ধকার ভবিষ্যতের পরে তিনিই লিখতে পারেন ধূসর অতীতের আলেখ্য দ্য স্ক্রিমিং উওম্যান। কল্পগল্প আর ক্রাইম গল্পেও অনেকটা তাই। শুরুতে ডাইম ম্যাগাজিন, মাঝে সম্পূর্ণ কল্পবিজ্ঞানের পর আশির দশকে তিনি আবার ফিরে আসেন রহস্য গল্পে। লেখেন ডেথ ইজ অ্যা লোনলি বিজনেস। এখানেও কথকের কোনো নাম নেই। ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভ। ঠিক যেমনটা ছোটো গল্পে করতেন চল্লিশের দশকে। গল্পটাও চল্লিশের দশকে ক্যালিফর্নিয়ার এক লেখকের। ক্যালিফর্নিয়ার পাশেই ভেনিস শহর। কেউ তাঁর খবর রাখে না। সেখানে সমুদ্রের ধারে একের পর এক খুন হয়ে চলেছে। লেখকের সঙ্গে দেখা হয় এক গোয়েন্দার। দুজনে এই রহস্যের সমাধানে নামেন। পরে এর আরও দুই সিকুয়েলও লিখেছিলেন তিনি। এ যেন তাঁর আবার নিজের কাছে ফেরা। ভবিষ্যতের সুতো ধরে অতীতে। আসলে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত— সারাজীবন ধরে এক অফুরন্ত সময়ের কথাই হয়তো বলে যেতে চেয়েছিলেন রে ব্র্যাডবেরি। বলে যেতে চেয়েছিলেন এক অফুরান গল্প। এই বিষয়ে তাঁর জুড়ি আর অন্য কেউ নেই।
Tags: কৌশিক মজুমদার, প্রবন্ধ, সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
অসম্ভব সুন্দর
খুব ভাল লাগল কৌশিক!
হ্যাঁ অই মনস্তত্ত্বকে নিয়েই ওঁ র কারবার নিঃসন্দেহে!!!