চুক্তি
লেখক: সুমন মিশ্র
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মিউনিখ শহরের প্রাণকেন্দ্র মারিয়েনপ্লাটজ স্কোয়ার সেজে উঠেছে মায়াময় আলোর সাজে। যেদিকেই চোখ যায় সবকিছু যেন আলোর রোশনাইতে ভেসে যাচ্ছে। বাড়িঘর, দোকানপাটের গায়ে ছোটো ছোটো জোনাকি আলো দিয়ে অপরূপ সাজসজ্জা করা হয়েছে। নিউহাউসার স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে গেলে পথের ধারে চোখে পড়ছে আলো দিয়ে তৈরি নানান আকারের তারার প্রতিরূপ। রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে ঝোলান হয়েছে নানান রঙের অসংখ্য আলোক শৃঙ্খল। মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে আলোর বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়িগুলোর জানলা থেকে ঝুলছে আলোর সাজ, তার মাঝে শোভা পাচ্ছে দেবদূতের প্রতিমূর্তি। বাতিস্তম্ভগুলির নরম হলদে আলো এই উৎসব মুখর পরিবেশের সঙ্গে যেন যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা পথে বিছিয়ে দিচ্ছে নরম হলুদ আলোর চাদর। পথের পাশে দোকানগুলোর বাইরে ঝুলছে বিশেষ ছাড়ের বিজ্ঞাপন। আর হবে নাই বা কেন, ক্রিসমাসের যে আর বেশি দেরি নেই।
মানুষের ভিড় নিউহাউসার স্ট্রিট ধরে অলস গতিতে এগিয়ে চলেছে মারিয়েনপ্লাটজের মূল চত্বরের দিকে। প্রায় নয়শত বছরের প্রাচীন এই জায়গাটি কত ইতিহাসেরই না সাক্ষী থেকেছে। পুরাতন সময় এই জায়গাটাই ছিল শহরের সবচেয়ে বড়ো বাজার। আর এখন তা মিউনিখের ক্রীড়া, শিল্প, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র।
দেবদত্ত অবাক হয়ে দেখছিল চারদিকে। কলকাতায় ক্রিসমাস উদযাপন সে দেখেছে। পার্ক স্ট্রিটের হুজুগে জনসমুদ্র এড়িয়ে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের ঘণ্টাধ্বনিতে সে বরাবর খুঁজে পেয়েছে প্রকৃত বড়োদিনকে। কিন্তু প্রায় ছয় মাস আগে যখন চাকরি সূত্রে তাকে মিউনিখে আসতে হল তখন থেকেই সে অপেক্ষা করছে ইউরোপের ক্রিসমাস দেখার জন্যে। ছোটোবেলা থেকেই সে শুনে এসেছে ইউরোপের দেশগুলিতে ক্রিসমাস উদযাপন হয় রূপকথার মতো। সে মানসচক্ষে না জানি কতবার দেখেছ, বরফে বরফে রাস্তাঘাট ঢেকে গেছে, পথের ধারের সোনালি আলো চুঁইয়ে পড়ছে সেই বরফের উপর। চার্চে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে। বাচ্চারা লাল পোশাক পরে রাস্তায় বরফ নিয়ে খেলা করছে, আর সান্টাক্লজ তাদের খেলনা বিতরণ করছে। সে বরাবর চেয়েছে অন্তত একবার যদি সে সেই অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে।
না, মিউনিখে আজ বরফ পড়েনি। তবে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা রয়েছে। শনশন করে হাওয়া বইছে। কান ঢাকা টুপি, গরম পোশাকের উপর মোটা জ্যাকেট, হাতে গ্লাভস, পায়ে বুট পরেও ঠান্ডাকে বশে আনতে পারছিল না সে। কিন্তু আজ যে ঠান্ডার কাছে হেরে যাওয়ার দিন নয়। সে যেদিকেই তাকাচ্ছে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বড়োদিনের উৎসবকে জাদুময় করে তুলতে চেষ্টার একটুও খামতি রাখা হয়নি।
নিউ টাউন হলের সামনে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়েছে। তার সমস্ত ডালপালায় অসংখ্য ছোটো ছোটো আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। হাওয়ায় গাছটা দুলছে, তার সঙ্গে আলোগুলো যখন একসঙ্গে ঝিকমিক করে উঠছে তখন মনে হচ্ছে যেন হাজার হাজার জোনাকির দল একসঙ্গে খেলা করছে। হরেক রকমের দোকান রয়েছে সারা চত্বর জুড়ে। সেগুলিও নানা রঙের আলো, লাল রিবন, ছোটো ছোটো ঘণ্টা দিয়ে ক্রিসমাসের সাজে সেজে উঠেছে। কোথাও বিক্রি হচ্ছে ছোটো ছোটো পুতুল, কাঠের তৈরি ছোটো ছোটো খেলনা বাড়ির মডেল। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে ক্রিসমাসের সময় ঘর সাজানোর বিভিন্ন সামগ্রি, আবার কোথাও নানান রকম চকলেট। এছাড়া শীতের পোশাক, নানান রকম খাবারের দোকান তো আছেই।
দেবদত্তও আজ জমিয়ে কেনাকাটা করেছে। ছোটো ছোটো কাঠের পুতুল, ঘর সাজানোর অনেক জিনিস সে কিনে ফেলেছে। ঘুরতে ঘুরতে খিদেও পেয়েছিল খুব। তার সহকর্মী বাল্ডুইন তাকে বলেছিল ক্রিসমাস মার্কেটে গেলে অবশ্যই কারিওয়ারস্ট খেয়ে দেখতে। এটা বারবিকিউ সসের মধ্যে সসেজ দিয়ে বানানো হয়। সত্যি বলতে দেবদত্তর দারুন লেগেছে সেটা খেয়ে। এমনকি সে আলাদা করে পার্সেলও করে নিয়েছে রাতে খাবার জন্যে। এছাড়াও কিছুটা নউগাট, মারোনি আর পমফ্রিটজ খেয়ে তার পেট এতটাই ভর্তি হয়ে গিয়েছিল যে ইচ্ছে থাকলেও মারজিপান নামের মিষ্টিটা সে খেতে পারল না। অগত্যা সেটাও রাতের জন্যে পার্সেল করতে হল।
ঘণ্টাখানেক ঘোরার পর ক্লান্ত হয়ে যখন সে ক্রিসমাস পিরামিডের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেই সময়ে দোকানটা তার নজরে পড়ল।
দুই
ক্রিসমাস মার্কেটের প্রায় শেষ প্রান্তে, ওল্ড টাউন হলের কাছাকাছি একটা ছিমছাম দোকান। আশপাশের আর পাঁচটা দোকানের সঙ্গে সেটার কোনো মিলই নেই। ক্রিসমাস মার্কেটের মধ্যে সেটা যেন ভুলবশত চলে এসেছে। না আছে তাতে কোনো আলোর সাজ, না আছে কোনো হোর্ডিং। কাঠের তৈরি, খড় দিয়ে ছাওয়া দোকানটাকে দেখে মনে হয় যেন মধ্যযুগ থেকে সময়ের কারসাজিতে এখানে এসে হাজির হয়েছে। এমনকি দোকানটিতে বৈদ্যুতিক আলোও নেই, তার বদলে অনেকগুলো বিশাল আকারের মোমবাতি জ্বলছে, যা সেটিকে আরো রহস্যাবৃত করেছে। এই জাঁকজমকের যুগে জৌলুশহীন দোকানটার যা হওয়ার তাই হয়েছে। আশপাশে ক্রেতাদের ভিড় থাকলেও ওই দোকানটি একদমই ফাঁকা।
দেবদত্তর বেশ কৌতূহল হল, সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেই অদ্ভুত দোকানটার দিকে। সামনে পৌঁছে সে বুঝতে পারল যে দোকানটা শুধু বহিরঙ্গে নয় ভিতর থেকেও বড্ড বেমানান। একজন বৃদ্ধা মহিলা একটি কাঠের টুলের উপর বসেছিলেন। অনেকক্ষণ ক্রেতা না আসায় তার চোখদুটো ঘুমে প্রায় বুজে এসেছে। বৃদ্ধার পরনের পোশাক, চুল বাঁধার কায়দা সবই যেন ভীষণ বেমানান। আধুনিকতার লেশমাত্র নেই, বরং দেবদত্ত মধ্যযুগের উপর যে সব হলিউডের সিনেমা দেখেছে সেইখানে এইরকম বেশভূষা দেখা যায়। এটা কি এই দোকানের থিম, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার কৌশল? কৌশল হলেও সেটা যে ঠিকমতো কাজ করেনি সে তো চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে।
দেবদত্ত একবার দোকানটায় বিক্রির জন্যে রাখা সামগ্রির দিকে চোখ বোলালো। এখানেও তাকে নিরাশ হতে হল। দোকানটায় অদ্ভুত অদ্ভুত যে সব জিনিসে ভর্তি তার সঙ্গে অন্তত ক্রিসমাসের কোনো যোগসূত্র নেই। অনেকগুলো বয়ামে রাখা নাম না জানা অসংখ্য লতাপাতা।
অনেকগুলো পুরোনো মূর্তি রাখা আছে কিন্তু সব ক-টাই ভয়ঙ্কর দর্শন, মাথায় শিং, লকলকে জিভ, ভয়ঙ্কর চোখ। শয়তানের মূর্তি এমন পরিবেশে বিক্রি হতে দেখাটা সত্যি আশ্চর্যের। যে সব পুতুল বিক্রির জন্যে রাখা আছে সেগুলোও ক্রিসমাসের সঙ্গে নয়, হ্যালোউইনের সঙ্গেই বেশি মানানসই। এছাড়াও আছে বিভিন্ন প্রাচীন সামগ্রি, আর অসংখ্য ছোটো, বড়ো সাইজের ঘণ্টা।
আর একটা অদ্ভুত জিনিস রাখা আছে বৃদ্ধার ঠিক পিছনের তাকে। একটা কাচের জারে অসংখ্য জোনাকি ঝিকমিক করছে। জোনাকিই তো? পতঙ্গগুলো যেন বিভিন্ন রঙের, লাল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি। আকারেও কি জোনাকির তুলনায় সামান্য বড়ো নয়? তারা কাচের পাত্রের মধ্যে এলোমেলো উড়ছে না। এক জায়গায় জড়ো হয়ে তারা উড়ছে। বলা যায় কাচের পাত্রের যেদিকে দেবদত্ত দাঁড়িয়ে সেদিকেই তারা জড়ো হয়েছে। তারা যেন পাত্রের গায়ে ধাক্কাও দিচ্ছে,পাত্রটা থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে।
“শুনছেন?” দেবদত্ত বৃদ্ধাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু বৃদ্ধার ঘুম ভাঙল না। বাধ্য হয়েই সে সামনে রাখা একটা লতা পাতার বয়ামে আঙুলের আংটি দিয়ে টোকা মারল। তিন নম্বর টোকার পরে বৃদ্ধা ধরপরিয়ে উঠে বসল। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তারপর একগাল হেসে দেবদত্তকে কোনো এক দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু কথা বলল।
দুর্বোধ্য কারণ দেবদত্ত ইংলিশ আর জার্মান ভাষাটা বেশ ভালোই জানে, কিন্তু এই ভাষাটা তার জানা নেই। অথচ সে এতক্ষণ একটাও দোকান দেখেনি যেখানে এই দুটো ভাষা জানে না এমন বিক্রেতা ছিল।
সে জার্মান ভাষায় বলল, “এই লতাপাতা গুলো দিয়ে কী হয়?”
বৃদ্ধা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল, তারপর আরো কীসব বলল সেই অজানা ভাষায়।
দেবদত্ত দেখল এ তো মহা মুশকিল। ক্রেতা বিক্রেতা কেউ কারোর কথা না বুঝলে কী করে চলবে। তবে সে আঙুল দিয়ে বৃদ্ধার পিছনের তাকে রাখা কাচের পাত্রের দিকে দেখিয়ে বলল, “ওগুলো কী পতঙ্গ? ওগুলো কি বিক্রির জন্যে রাখা আছে?”
বৃদ্ধাকে দেখে মনে হল দেবদত্তর কথার কিছুই বোঝেনি, কিন্তু আঙুলের নির্দিষ্ট দিকে তাকাতেই তার মুখ রাগে বিকৃত হয়ে গেল, যদিও মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক “উফ” ছাড়া কিছুই বেরল না। সে পাত্রটাকে তাকের আরো ভিতরের দিকে ঠেলে দিয়ে আবার দেবদত্তর দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল।
ভাষা সমস্যার কারণেই দেবদত্ত একবার ভাবল যে এই দোকান থেকে সে চলে যাবে, অথচ বৃদ্ধার প্রতি তার মনে কেমন যেন এক মায়া জন্মাচ্ছে। বৃদ্ধার মুখটা বড্ড মমতা মাখা। হয়তো এই ভাষা সমস্যার জন্যই তার তেমন বিক্রিবাট্টাও নেই। হয়তো সে কিছু কিনলে তবেই বৃদ্ধা আজ রাতে কিছু খেতে পারবে। এইসব সাত-পাঁচ সে যখন ভাবছে তখনই বৃদ্ধা একটা ছোটো ঘণ্টা দেবদত্তর দিকে এগিয়ে দিল।
বিক্রির জন্যে রাখা ঘণ্টাগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে ছোটো আকৃতির। ঘণ্টাটা দেখে অত্যন্ত পুরোনো মনে হচ্ছে। দেবদত্তর অ্যান্টিক সম্পর্কে জ্ঞান খুব কম, তবে যদি নকলও হয় তবুও ঘণ্টাটার গায়ের কারুকার্য খুবই চমকপ্রদ। যদিও সামনের প্রতিকৃতিটা নিয়ে মনে একটু খচখচানি ছিল, তবে স্মৃতি স্মারক হিসাবে সত্যিই সংগ্রহযোগ্য।
সে এবার বলল, “আমার এটা পছন্দ হয়েছে। এটার জন্যে কত দিতে হবে?”
বৃদ্ধা কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, “মানি?”
“ইয়েস, মানি। কত দেব?” দেবদত্ত হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, যাক অন্তত কাজে লাগার মতো আসল শব্দগুলো বৃদ্ধা জানে।
বৃদ্ধার মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে গেল, সে বারবার বলতে লাগল, “নো মানি, নো মানি।”
দেবদত্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে বৃদ্ধা ভাঙা ভাঙা ইংলিশে বলল, “নো মানি… অনলি সাইন।” বলেই সে একটা পুরোনো কাগজ দেবদত্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে সই করার জায়গাটা দেখিয়ে দিল।
দেবদত্ত কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। একটা সই দিয়ে জিনিস কেনাবেচা চলছে! কী লেখা আছে কাগজে? দেখে তো কিছুই বুঝতে পারছে না। ইংলিশ নয়, জার্মানও নয় তাহলে কি বৃদ্ধা যে ভাষায় কথা বলছিল সেই ভাষা? এইসব সন্দেহজনক ব্যাপারে যদিও না জড়ানোই ভালো, কিন্তু হাতে ধরে থাকা ঘণ্টাটার মধ্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। এটাকে রেখে চলে যেতেও মন চাইছে না। আর যদি সে নাও বুঝতে পারে যে কি লেখা আছে, তাতে কি এসে গেল। একবার এই দোকান থেকে সে চলে গেলে তার সঙ্গে বৃদ্ধার আর কোনোদিন দেখাও হবে না। সে কাগজের নীচে সই করে দিল।
বৃদ্ধা একগাল হেসে একটা ছোটো কাঠের বাক্সের মধ্যে খড়ের মোটা আস্তরণ দিয়ে তার মধ্যে ঘণ্টাটাকে রেখে দেবদত্তর দিকে এগিয়ে দিল। দেবদত্ত মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে জিনিসটা হাতে নিল। একটা ধাতব ঘণ্টার জন্যে এত যত্ন নিয়ে প্যাক করার কী প্রয়োজন।
সে সবে দোকান থেকে বেরতে যাবে এমন সময় বৃদ্ধা বলে উঠলেন, “রিং অনলি থ্রি টাইম্স।”
দেবদত্ত হলফ করে বলতে পারে বৃদ্ধার হাসিটা যেন আগের মত মমতা মাখা নেই, চোখদুটোও যেন শিকার বাগে পাওয়া বাঘের মতো জ্বলজ্বল করছে।
তিন
ইউ-বান লাইনে দুইবার ট্রেন পালটে সেন্ডলিং পৌঁছে, তারপর দশ মিনিট হেঁটে নিজের ভাড়া বাড়ি অবধি পৌঁছতে দেবদত্তর বেশ রাত হয়ে গেল। ক্লান্ত শরীরে কোনোমতে রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুতেই গভীর নিদ্রা তার দু-চোখে নেমে এল। ঘুম যখন ভাঙল তখন পরের দিন সকাল আটটা বাজে।
মাত্র কয়েকমাস হল সে এখানে এসেছে তবুও আশপাশের অনেকের সঙ্গেই তার বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। এই যেমন গডফ্রে, দুটো বাড়ি পরেই থাকে, এখানে আসার পরের দিনই দেবদত্তকে নিজে নিয়ে গিয়ে আশপাশের বাজারটা চিনিয়ে দিয়েছিল। জারভিস, গত মাসেই নিজের জন্মদিনে দেবদত্তকে নিমন্ত্রণ করেছিল। পাশের বাড়ির মিলার দম্পতি গত সপ্তাহে নিজেদের বিবাহবার্ষিকীতে দেবদত্তকে ডেকেছিলেন। তাই সেও ঠিক করেছে নতুন দেশের এই নতুন বন্ধুদের ক্রিসমাসের সময় নিমন্ত্রণ করে ভারতীয় খাবার খাওয়াবে।
সকাল থেকেই সে ক্রিসমাসের জন্য ঘর সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। নানা রকমের বৈদ্যুতিক আলো তো আগেই কেনা হয়েছিল, কাল ক্রিসমাস মার্কেট থেকে কেনা হরেক রকম ঘর সাজানোর জিনিস দিয়ে সারাদিন ধরে মনের মতো ঘর সাজালো। সামনের সুপারমার্কেট থেকে একটা ছোটো ক্রিসমাস ট্রিও কিনে এনেছিল সে, সেটাকেও যত্ন সহকারে সাজালো। এত সবের মাঝে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এসে পড়েছে খেয়ালই করেনি সে। সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করতে সে সামনের একটা পার্ক থেকে হেঁটে আসবে ভাবল।
আজ আকাশের মুখ ভার। সকাল থেকে মাঝে মধ্যেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি হলেও বিকেলের দিকে সেটা কমে গেছে। বৃষ্টিভেজা পথ ধরে হাঁটছিল দেবদত্ত। ছিমছাম এই শহরতলি নিজের সাধ্যমত ক্রিসমাস পালন করছে। পথঘাট আলোয় সেজে উঠেছে। চার্চের গায়ে সোনালি আলোর সাজ। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা দূরে একটা পার্কে এসে সে পৌঁছল। নিরিবিলিতে একটা বেঞ্চে বসে সামনের একটা পুকুরের দিকে তাকিয়ে ছিল। এমন সময় একজন ভবঘুরে তার পাশে এসে বসল। গায়ে পুরোনো একটা জ্যাকেট মাথায় নোংরা চিটচিটে একটা টুপি, জট পরা মাথার চুল, একমুখ দাড়ি। দেবদত্ত সেখান থেকে উঠেই যেত, এমন সময় লোকটা হাত বাড়িয়ে খসখসে গলায় বলল, “একটা সিগারেট হবে?”
“আমি খাই না।”
“খাস না, নাকি দিবি না?” তার গলাটা আরো কর্কশ হয়ে উঠল।
“বললাম তো খাই না, আর সিগারেট খাওয়া তো আইনত নিষিদ্ধ।”
“আমাকে আইন শেখাচ্ছিস!” বলেই কিছু বোঝার আগে সে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি মারল দেবদত্তকে। ঘুসির জোর এতটাই ছিল যে দেবদত্ত অনেকক্ষণ এক জায়গায় পড়ে থাকল। তারপর একটু সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখল লোকটা পালিয়েছে।
চার
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল সেদিন। ভয়ে দেবদত্তর হাত পা কাঁপছিল। রাত যত বাড়ল সেই ভয় ক্রমশ রাগে পরিণত হল। পুলিশের কাছে না গেলেও একটা প্রতিহিংসা বোধ তাকে ঘিরে ধরছিল। খাওয়ার ইচ্ছাও ছিল না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে যখন রাগে গজগজ করছিল তখনই বিছানার পাশের টেবিলে সে আগের দিনের কেনা ঘণ্টাটা দেখতে পেল।
সারাদিনের কাজের মাঝে এটার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। তার মনে আছে ঘণ্টার বাক্সটা সে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রেখেছিল। তাহলে ঘণ্টাটা এখানে এল কী করে? নাকি সেই কোনো এক সময়ে ঘণ্টাটাকে এখানে রেখেছিল তারপর কাজের মধ্যে ভুলে গিয়েছিল?
ঘণ্টাটা সে হাতে তুলে নিল। অদ্ভুত কারুকার্য ঘণ্টাটার চারদিকে। বিশেষত সামনের দিকে, যেখানে শয়তানের প্রতিরূপ খোদাই করা আছে। শয়তান একটা শূল দিয়ে একজন দেবদূতকে বিদ্ধ করছে। শয়তানের মুখে অদ্ভুত হাসি, আর চোখদুটোর দৃষ্টি যেন তার মনের ভিতরটা পুড়িয়ে দেবে।
দেবদত্তর মনটা যেন আরো অস্থির হয়ে উঠছে। মনের মধ্যে প্রতিহিংসার মেঘ আরো ঘনীভূত হচ্ছে। একটা ভবঘুরে তার গায়ে হাত তুলল! ইচ্ছা করছে লোকটার মাথাটা সেই বেঞ্চেই জোরে ঠুকে দিতে। এইসব ভাবতে ভাবতেই সে ঘণ্টাটা একবার বাজিয়ে ফেলল। আহ্ কী সুন্দর শব্দ। ঘণ্টার আওয়াজটা মিলিয়ে যেতেই বাড়ির বাইরে যেন আরো হাজার হাজার ছোটো ছোটো ঘণ্টা একসঙ্গে বাজতে থাকল। টুংটাং শব্দের অপরূপ হিল্লোল উঠছে যেন চরাচর জুড়ে। দেবদত্ত দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে এই বাড়তি ঘণ্টাধ্বনির উৎস খোঁজার চেষ্টা করল। বাইরের তরল অন্ধকারের মধ্যে ঘণ্টাধ্বনিগুলির উৎস দেখা না গেলেও, সে রাস্তায় একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। পরনে তার একটা সাদা আলখাল্লা। আলো আধারির মধ্যে তার মুখটা বোঝা যাচ্ছে না, তবে সে দেবদত্তর বাড়ির দিকেই মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। পরমুহূর্তেই কোথা থেকে একরাশ ঘন কুয়াশা এসে লোকটাকে ঘিরে ধরল। সঙ্গে সঙ্গেই এক মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরে গেল। দেবদত্তর এত ঘুম পাচ্ছে কেন? চোখদুটো এত ভারী হয়ে আসছে কেন?
দেবদত্তর ঘুম যখন ভাঙল তখন প্রায় দুপুর বারোটা। এত দেরি তার কখনো হয় না। হঠাৎ কী মনে হল সে চারপাশটা দেখল। না, ঘণ্টাটা তো নেই। সে ধরফরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড়ল আলমারির দিকে। কাঠের বাক্সটা সেখানেই রেখেছিল। সেটা খুলতেই দেখল ঘণ্টাটা সেখানে সযত্নে রাখা আছে। তাহলে কালকের ঘণ্টার ব্যাপারটা কি পুরোটাই স্বপ্ন?
সেইদিনই সুপার মার্কেট যাওয়ার সময় দেখা হল জারভিসের সঙ্গে। সে নিজেই এগিয়ে এসে বলল, “কী দিনকাল পড়ল দেখ তো। কাল চার্চের পাশের পার্কে একটা খুন হয়ে গেছে।”
“সেকি, কখন?” দেবদত্তর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। তাহলে কি ভবঘুরেটা কারও কে খুন করেছে। ইস কালই যদি পুলিশের কাছে যেত সে।
“ওই রাত্রিবেলা। পুলিশের অনুমান মাঝরাতে। একটা ভবঘুরে, তার মাথাটা কেউ এমনভাবে বেঞ্চের কোনায় ঠুকে দিয়েছে যে মাথার খুলি পর্যন্ত ভেঙে গেছে।”
দেবদত্ত কিছুই বলতে পারল না। হ্যাঁ এটাই তো সে চেয়েছিল। কিন্তু তা এত ভয়ানকভাবে সত্যি হল! এই ঠান্ডার মধ্যেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল।
“তুমি তো যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াও। একটু সাবধানে চলাফেরা কোরো। কোনো বিপদ হলে কে বাঁচাবে?” জারভিস বলল।
জারভিসের কোনো কথাই আর দেবদত্তর কানে ঢুকছে না। কানটা যেন বোঁবোঁ করছে। এই ঘটনার সঙ্গে কি ঘণ্টাটার যোগসূত্র আছে? সে কি সত্যিই ঘণ্টাটা বাজিয়েছিল?
সুপার মার্কেট যাওয়া আর হল না। মাথায় হাজার চিন্তা নিয়ে সে বাড়ি ফিরল। কিন্তু বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই তার মাথাটা আবার গরম হয়ে গেল। ক্রিসমাসের জন্যে সারা বাগানে সে আলো দিয়ে সাজিয়েছিল,এছাড়া তার বাগানের শখও আছে তাই বাড়িওয়ালার অনুমতি নিয়ে বাগানে বিভিন্ন গাছ লাগিয়েছিল। কিন্তু এখন সারা বাগান লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। গাছ উপড়ানো, মাটি খাবলা খাবলা করে খোঁড়া, আলোর তারগুলো ছিড়ে মাটিতে লুটোচ্ছে। দেবদত্ত ঘুরে তাকালো রাস্তার উলটো দিকে রোলান্ডের বাড়ির দিকে। ছেলেটা বাংলায় যাকে বলে লোফার। মদ্যপ, অসভ্য। তার দেবদত্তর উপর যে কী রাগ কে জানে? মাঝে মাঝেই রাস্তায় নিজের পোষা কুকুরটাকে দেবদত্তর দিকে লেলিয়ে দেয়। আর আজ কুকুরটাকে বাগানে ঢুকিয়ে এই সর্বনাশ করেছে।
দেবদত্ত রোলান্ডের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ছেলেটা তখন বাড়ির লনে দাঁড়িয়ে শয়তানি হাসি হাসছিল আর কুকুরটাকে আদর করছিল।
“এটা কী হল?”
“মজা হল।” রোলান্ড ফিক করে হাসল।
“আমি কিন্তু পুলিশে অভিযোগ করব।”
“তাই? কীসের জন্যে? বাগান নষ্ট হওয়ার জন্যে, নাকি রকি তোমায় কামড়েছে বলে?” বলেই সে কুকুরটাকে ছেড়ে দিল। দেবদত্ত কোনোমতে দৌড়ে এসে নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়ে বাঁচল।
নিজের ঘরে ঢুকতেই দেবদত্তর নজরে পড়ল খাওয়ার টেবিলের উপর ঘণ্টাটা রাখা। কিন্তু তার পরিষ্কার মনে আছে শেষবার সে ঘণ্টাটা আলমারির মধ্যেই দেখেছিল। তাহলে ঘণ্টাটা নিজের থেকে আলমারির বাইরে এল কী করে? এখন সে অনুভব করতে পারছে ঘণ্টার সঙ্গে সত্যিই অলৌকিক কিছু জড়িত আছে। তবে সে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে চায় ঘণ্টার শক্তির ব্যাপারে। সে ঘণ্টাটা হাতে নিয়ে বাজাতে বাজাতে বলল রোলান্ড আর রকি দুটোই উপযুক্ত সাজা পাক।
সঙ্গে সঙ্গেই সেই অপার্থিব হাজার ঘণ্টাধ্বনিতে চারপাশ ভেসে গেল।সঙ্গে সঙ্গেই সে ছুটে গেল জানলার ধারে। দিনের আলোয় সে পরিষ্কার দেখল সেই লোকটা আজও দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজ তার পরনে ধূসর পোশাক। তার দৃষ্টি দেবদত্তর জানলার দিকে স্থির হয়ে আছে। দূরত্ব সত্ত্বেও দেবদত্ত লোকটার মুখের শয়তানি হাসি স্পষ্ট দেখতে পেল। লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ওইপারে। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা আইসক্রিম ভ্যান রাস্তা দিয়ে চলে গেল এবং কয়েক সেকেন্ডের জন্যে লোকটা দেবদত্তর দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। কিন্তু ভ্যানটা চলে যেতেই দেবদত্ত অবাক হয়ে গেল। লোকটা কোথাও নেই। এত তাড়াতাড়ি সে গেল কোথায়! সঙ্গে সঙ্গেই এক অপরূপ সুগন্ধে ঘর ভরে উঠল। আগেরদিনের মতোই ঘুমে তার চোখ বুজে আসতে শুরু করল। সে টলতে টলতে কোনোমতে গিয়ে বিছানার উপর শুয়ে পড়ল। তার দু-চোখে নেমে এল ঘুমের চাদর।
পাঁচ
ঘুম ভাঙল পরেরদিন সকালে। সঙ্গে সঙ্গেই কানে এল বাড়ির সামনে হট্টগোলের আওয়াজ। দেবদত্ত নীচে নেমে এল। বাড়ির সামনেই একটা জটলা হয়েছে। মি. মিলারও ছিলেন সেখানে, তিনিই এগিয়ে এসে খবরটা দিলেন। কাল রাতে নাকি রকি খুব আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল। এমনকি যে রোলান্ডের পায়ে পায়ে সে ঘুরত তাকেও সে আক্রমণ করেছিল। রোলান্ড রোজকার মতো যেই রকিকে খাবার দিতে গিয়েছিল, অমনি সে রোলান্ডের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আঁচড়ে কামড়ে রোলান্ডকে সে এতটাই ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে যে প্রাণে বাঁচার সম্ভবনা কম। আর রকিকেও কে যেন গলা টিপে মাঝ রাস্তায় মেরে ফেলে রেখে গেছে।
দেবদত্তর ঠোঁটের কোনায় শয়তানি হাসি খেলে গেল, চোখ চকচক করে উঠল। এ কী ঐশ্বরিক ক্ষমতা তার হাতে এসে পড়েছে। সে এখন চাইলেই তার যে কোনো শত্রুকে পথের থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে পারে।
ঘণ্টাটা কি শুধুই জার্মানির মধ্যে কাজ করবে নাকি দেশ, মহাদেশ, কোনো দূরত্বই এর কাছে বাধা নয়? সেটার পরীক্ষাও হয়ে গেল কাল। সে জার্মানি আসার পরপরই তার ছোটোকাকা বোলপুরের জমিটা নিয়ে দেবদত্তর বাবার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। বয়স্ক মানুষটাকে এই কয়েক মাসে কম নাকানিচোবানি খাওয়ায়নি। আজ সকালে বাবা ফোনে জানালো যে গতকাল রাত্রে ছোটোকাকা হার্টঅ্যাটাকে মারা গেছেন। কিছু একটা দেখে প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন, তারপর সব শেষ। খবরটা শুনে দেবদত্তর ঠোঁটে একটা পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠল, “ভালোই তো হল। যা জ্বালাচ্ছিল তোমায়।”
“কী বলছিস তুই? তোর মাথা ঠিক আছে তো? ও আমার ছোটো ভাই। সে মারা যাওয়ায় তুই বলছিস ভালোই হল?” ওদিক থেকে বাবার হতভম্ব গলা ভেসে এল।
দেবদত্ত কথা বাড়াল না। এইসব ঠুনকো ইমোশনের আজকালকার দিনে কোনো দাম নেই।
কাল রাতেও ঘণ্টা বাজানোর পর একই ধরনের ঘটনাপ্রবাহ হয়েছিল। শুধু একটাই পার্থক্য ছিল, লোকটার পরনে কাল কালো রঙের পোশাক ছিল। এই পোশাকের রং পরিবর্তনের কারণ দেবদত্ত জানে না, জানতেও চায় না।
ক্রিসমাসটা ভালোই কেটেছিল। প্রতিবেশিদের ভারতীয় খাবার খাইয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল দেবদত্ত। সবাই কত সুখ্যাতি করল। এছাড়া মিউনিখের জাদুমাখা ক্রিসমাস দেখে তার ছোটোবেলার স্বপ্নও খানিকটা পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু সেই ভালো লাগার রেশে এক লহমায় কেটে গেল ক্রিসমাসের দু-দিন পরে বাল্ডুইনের একটা ফোনে।
খবরটা এই রকম, দেবদত্ত প্রায় ছয়মাস ধরে বাল্ডুইনের সঙ্গে একই অফিসে চাকরি করছে। তবে দেবদত্ত এখনো কন্ট্রাক্টে রয়েছে, যদিও এই বছরই তার পার্মানেন্ট হয়ে যাওয়ার কথা চলছিল। এখন উপরতলা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে কন্ট্রাক্টে থাকা বেশির ভাগ কর্মীদের ছেড়ে দেওয়া হবে। শুধু হেনরি নামের একটা ছেলেকে পার্মানেন্ট করা হবে। হয়তো দেবদত্তকেই ওরা রেখে দিত, কিন্তু হেনরির জার্মান ভাষার উপর দক্ষতার জন্যেই কর্তৃপক্ষ তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
খবরটা শোনার পর থেকে সারাটা দিন দেবদত্তর এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছিল। কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না, পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে কিছু মাথায় আসছে না। শেষে রাতে শুতে যাওয়ার সময় তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। যদি হেনরিই আর না থাকে তাহলে? তখন কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তাকেই রেখে দেবে। সে কাঁপা হাতে ঘণ্টাটা তুলে নিল।
ঘণ্টা বাজানোর পর যে গভীর ঘুম আসে তার মধ্যে সে আগে কোনোদিন স্বপ্ন দেখেনি। তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে তখন থাকত শুধুই মসিকৃষ্ণ অন্ধকার। কিন্তু আজ সে স্বপ্ন দেখল। সে দেখল সেই বৃদ্ধা মহিলা তার খাটের পাশে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে এক শয়তানি হাসি খেলা করছে ,চোখটা তার মানুষের নয়, নিশাচর প্রাণীদের মতো হয়ে গেছে। সে পরিষ্কার ইংলিশে দেবদত্তকে বলছে— তুমি চতুর্থবার ঘণ্টাটা বাজিয়ে চুক্তিভঙ্গ করেছ। তোমায় এবার সাজা পেতেই হবে।
দেবদত্ত চিৎকার করে বলল— কোন চুক্তি? আমি কোনো চুক্তির কথা জানি না।
বৃদ্ধা একটা কাগজ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল— এটা তবে কার সই।
দেবদত্ত চমকে উঠল, এটা তো সেই কাগজ যেখানে সে সই করেছিল। কিন্তু এই কাগজের লেখাগুলো এখন আর অজানা নয়। পরিষ্কার ইংলিশে লেখা আছে, ঘণ্টার মালিক ঘণ্টাটা তিনবার পর্যন্ত বাজাতে পারবে। এই তিনবার অবধি তার যে কোনো শত্রু দমনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমাদের। তার অধিক ঘণ্টা বাজালে চুক্তিভঙ্গ হবে এবং ঘণ্টার মালিক আমাদের গোলাম হয়ে থাকবে।
দেবদত্ত বৃদ্ধার দিকে সভয়ে তাকাল। বৃদ্ধা ততক্ষণে তার দুটো হাত উপরে তুলে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে, তারপরেই চারপাশ এক অদ্ভুত আলোয় ঢেকে গেল।
দেবদত্ত চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে বসল। এই শীতের সময়ও তার দরদর করে ঘাম হচ্ছে।তার হৃৎস্পন্দন তীব্র হয়ে গেছে। চারপাশে এত আলো কেন? সে তো নিজের ঘরে নেই। চারপাশে দেওয়ালগুলো কাচের কেন?
সে উপরের দিকে তাকাতেই চমকে গেল। অসংখ্য মানুষের মতো দেখতে পতঙ্গ উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের রং লাল, সবুজ, গোলাপি, নীল। সে নিজের হাতের দিকে তাকাল তার গায়ের রং কেমন সবজে নীল হয়ে গেছে, গায়ে ছোটো ছোটো আঁশ ভর্তি। তার পিঠে এটা কী? ডানা? সেও কী তবে পতঙ্গ হয়ে গেছে?
হঠাৎ সে দেখল সব পতঙ্গরূপি মানুষগুলো উড়তে উড়তে এক জায়গায় জড়ো হয়ে কাচের দেওয়ালে ধাক্কা দিতে শুরু করল। তারা চিৎকার করছে, “চলে যাও, চলে যাও।” কাচের ঘরটা কাঁপছে।
ডান পাশে চোখ ঘোরাতেই সে দেখল সেই বৃদ্ধা দোকানের মধ্যে বসে আছে। আর একটা লোক বিস্মিত চোখে চারপাশটা দেখছে। বৃদ্ধা দেবদত্তর দিকে পিছন ফিরে থাকলেও বোঝা যাচ্ছে সে কিছু একটা লোকটার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। জিনিসটা লোকটার হাতে যেতেই দেবদত্ত চমকে উঠল, সেই ঘণ্টাটা। সঙ্গে সঙ্গে সে উড়ে গেল সেই পতঙ্গরূপি মানুষগুলোর মাঝে। সে উড়তে শিখল কবে?
সে চিৎকার করল, “ওটা রেখে দাও, ফিরে যাও, ফিরে যাও।”
লোকটা একবার জোনাকি ভর্তি কাচের পাত্রর দিকে তাকাল, তারপর বৃদ্ধাকে হেসে বলল, “আমার এটা পছন্দ হয়েছে। এটার জন্যে কত দিতে হবে?”
Tags: গল্প, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সুমন মিশ্র