মোচন
লেখক: শ্রীজিৎ সরকার
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
কখনো “লকউড” গ্রামের নাম শুনেছ? কোন দেশ, কোন মহাদেশ, কোন অঞ্চল, কত অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশে তার অবস্থান— জানো সেসব কিছু?
জানি, জানো না।
পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার গুরুত্বহীন গ্রামগুলোর মধ্যে লকউডও একটা— শুধুমাত্র বাসিন্দারা ছাড়া, আর কেউ যাদের কথা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। তাদের মতো লকউডেও দূরদূরান্ত থেকে দেখতে আসার মতো বিশেষ কোনো দর্শনীয় স্থান নেই, শতমুখে বলে বেড়ানোর মতো বিশিষ্ট কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, রপ্তানি করার মতো দারুণ কোনো কৃষিজ বা খনিজ সম্পদ নেই… অথচ সেখানেও মানুষ, পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গরা পাশাপাশি বাস করে। খামখেয়ালি আবহাওয়া আর পর্যায়ক্রমিক ঋতু পরিবর্তন সেখানকার পরিবেশকেও প্রভাবিত করে।
হয়তো খুব মন দিয়ে খুঁজলে মানচিত্রে লকউডের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে, সেখানে যাওয়ার রাস্তাঘাটেরও হদিশ মিলবে। তবু ওই যে বৈশিষ্ট্যহীনতা— ওই জন্যই সে গুরুত্বহীন থেকে গিয়েছিল… শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেউ তাকে নিয়ে মাথা ঘামাত না, মাথা ঘামানোর প্রয়োজনই বোধ করে না।
অবশ্য এই অজ্ঞানতার পিছনে যতটা দায় ছিল বহির্বিশ্বের বাসিন্দাদের, ততটাই দায় ছিল লকউডের অধিবাসীদের। আজ থেকে শদেড়েক বছর আগে যেমন বাইরের পৃথিবীর কেউ কোনোদিন সেখানে পা রাখার কথা ভাবতে পারত না, তেমন লকউডের বাসিন্দারাও গ্রামের সীমানা পেরোনোর কথা চিন্তা করে দেখত না। পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝখানে, বৈশিষ্ট্যহীন আর নিরুপদ্রব জীবনযাপন নিয়েই তারা খুশি ছিল। খুশি ছিল কেন, আজও খুশি আছে! তাদের ওই ছিয়ানব্বই বর্গকিলোমিটার গ্রামেই যেন এঁটে গেছে গোটা পৃথিবীটা। কবি থাকলে নিশ্চয়ই বলতেন: “দেখিতে যাইনি পর্বতমালা, দেখিতে যাইনি সিন্ধু / দেখা হইয়াছে চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশিরবিন্দু…”
যাইহোক। বলছিলাম পুরোনো কথা; সুতরাং, আপাতত সেটাই বলা যাক।
লকউড তো ছিল লকউডের মতো। তাদের বাঁধাধরা, নির্ঝঞ্ঝাট এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবনযাপন নিয়ে তারা দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছিল বিচ্ছিন্ন একটা জীবন। ঘটনার পাশাপাশি ছোটোখাটো কিছু অঘটন ঘটলেও, উল্লেখযোগ্য কোনো দুর্ঘটনা তাদের জীবনে কোনোদিনই ঘটেনি! ফলত, অবসর সময়ে তারা নিজেদের মধ্যে যেসব গল্পগাছা করত— সেসবের বিষয়ও হত নিতান্ত সাধারণ। কবে কে অসুস্থ হয়েছিল, কবে জঙ্গলে দৈত্য কি অপদেবতার পায়ের ছাপ দেখা গিয়েছিল, কোন বছর আকস্মিকভাবে বেশি ফসল ফলেছিল…
এরপর, আজ থেকে প্রায় একশো কুড়ি বছর আগে, গুপ্তঘাতকের মতো চুপিসাড়ে এসে দাঁড়াল সেই দিন! তার আবির্ভাবটুকু যতটা নিঃশব্দ ছিল, তার পরের ঘটনাটা হল ততটাই সশব্দ; বলা যায়— প্রায় কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো!
নিকটবর্তী যে পাহাড় এতদিন ঘুমিয়ে ছিল ধ্যানমগ্ন সাধকের মতো— যার ঢালে গ্রামবাসীরা ছাগল চরাত আর ধাপ কেটে কেটে চাষ করত আলু-কোয়াশ-ভুট্টা, যার পাদদেশে বানিয়েছিল তারা কমলালেবু-আপেল-খোবানির বাগান আর যার গুহায় তারা পুজো করত তাদের আরাধ্যের— সে হঠাৎ জেগে উঠল তার এতদিনের নিদ্রা ভঙ্গ করে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল শান্ত-স্নিগ্ধ লকউড। লক্ষ আতসবাজির ফুলকি ছিটকে ছিটকে উঠল আকাশ লক্ষ্য করে। হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল সালফারের উগ্র গন্ধ আর প্রচণ্ড উত্তাপ গোটা গ্রাম জুড়ে। তবে উদ্গৃত ম্যাগমার পরিমাণ এতই সামান্য হল যে, পাদদেশ পেরোতে না পেরোতেই ফুরিয়ে গেল তার স্রোতের বেগ।
তবে অদ্ভুত এক ধোঁয়ার আস্তরণ ঢেকে রাখল লকউডকে প্রায় তিন মাসের জন্য!
এরকম সময়ে যা হওয়ার ছিল, হয়েছিলও ঠিক সেটাই। শিউরে উঠে লকউডবাসীরা জপ করেছিল তাদের আরাধ্য ঈশ্বরের নাম। তাদের ধারণা ছিল (যে ধারণায় তারা আজও স্থির হয়ে আছে)— পাহাড়ের দেবতা নিশ্চয়ই কোনো কারণে রুষ্ট হয়েছেন! তাঁকে শান্ত না করতে পারলে আর বাঁচার উপায় নেই… কিন্তু তাঁকে তুষ্ট করার উপায় তাদের জানা ছিল না।
প্রাণভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ লকউডবাসী। জীবজন্তুরাও ছিটকে পড়েছিল এদিক-ওদিক। আর যারা পালাতে পারেনি— বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে তাদের মৃত্যু তো হয়েছিলই, সেইসঙ্গে তাদের রক্ত-মাংসের শরীরগুলো অদ্ভুতভাবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। যেন প্রাচীন কোনো সমাধি খুঁড়ে বের করে আনা হয়েছিল অসংখ্য মমি… অস্থিচর্মসার সেই শরীরগুলো সাঙ্ঘাতিকতম কোনো অভিশাপের মতো ছড়িয়ে ছিল গোটা গ্রাম জুড়ে। এমনকি, এমন সহজলভ্য ভোজের সুযোগ পেয়েও কোনো শকুন পর্যন্ত নেমে আসেনি লকউডের মাটিতে। কিংবা, এসেছিল হয়তো— কিন্তু মারণধোঁয়াকে উপেক্ষা করে ফিরে আর যেতে পারেনি!
তখনই লকউডের নাম জেনে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব! অখ্যাত লকউড, অনামী লকউড রাতারাতি হয়ে উঠেছিল অজস্র সংবাদপত্রের শিরোনাম! হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল বিশেষজ্ঞ মহলে; বহু আড্ডায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল সেই দুর্ঘটনা।
সরকার থেকেও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। ধোঁয়ার কারণে হয়তো লকউডে উদ্ধারকারী দল পাঠানো যায়নি; তবে যারা পালাতে সক্ষম হয়েছিল, তাদের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সহযোগিতার হাত। খুলে দেওয়া হয়েছিল শরনার্থী শিবির; দেওয়া হয়েছিল খাদ্য, পানীয় এবং চিকিৎসাব্যবস্থার পর্যাপ্ত জোগান।
আগ্নেয়গিরি অবশ্য ঠান্ডা হতে সময় নেয়নি। গোটা পৃথিবীর মতো লকউডেও রোদ-বৃষ্টি খেলেছিল নিজেদের নিয়মে, বাতাস বয়েছিল নিজের গতিতে। আর সেই যে দিগন্তবিস্তৃত ধোঁয়ার জাল, সেও ফিকে হয়ে গিয়েছিল একসময়।
ঝোপেঝাড়ে-জঙ্গলে যেমন ফিরে এসেছিল পশুপাখি, কীটপতঙ্গরা, কাণ্ডে-শাখায়-প্রশাখায় যেমন ফিরে এসেছিল ফুল-ফল-পাতারা, ঝরনায়-ঝোরায়-নালায় যেমন ফিরে এসেছিল জলধারা— তেমনই একে একে গ্রামে ফিরে এসেছিল বাসিন্দারাও। ঝলসে যাওয়া ফসলের খেত আর অর্ধদগ্ধ ফলের বাগান, ছাই আর ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, পরিত্যক্ত আর আগাছায় আবৃত পথঘাট— সবকিছুকে তারা আবার সংস্কার করেছিল। খুব ভালো করে তারা পুজো দিয়েছিল গুপ্তগুহায়।
দুর্ঘটনার স্মৃতিকে ভুলে ধীরে ধীরে লকউড আবার হয়ে উঠছিল প্রাণময়, ঠিক আগের মতো।
সমস্ত মৃতদেহগুলোকে যত্ন করে সমাধি দিয়েছিল তারা। খুঁজে খুঁজে তারা বের করেছিল মৃতদের পরিচয়, যত্ন করে বানিয়েছিল সমাধিফলক…
আর তখনই আবিষ্কৃত হয়েছিল এক আশ্চর্য তথ্য!
জিব্রাইল কোথায় গেল? ছাপ্পান্ন বছরের অবিবাহিত, আত্মীয়-স্বজনহীন জিব্রাইল— যে প্রায় সারাবছরই বাতের ব্যথায় শয্যাশায়ী থাকত, ব্যথা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে আফিম জাতীয় কিছু খেয়ে ঘুমোত সর্বক্ষণ এবং প্রতিবেশিরাই দয়াপরবশ হয়ে তার খাবার-দাবারের জোগান দিত— তার শরীরটা তো কোত্থাও দেখা যাচ্ছে না! অথচ সে তো শরণার্থী শিবিরেও ছিল না। তার বাড়িটাও পড়ে আছে ফাঁকা অবস্থায়, জানালা-দরজা হাট করে খোলা, ছাই জমে আছে পুরু হয়ে। তাহলে…
আগেই বলেছি: কুসংস্কারে আপাদমস্তক নিমজ্জিত ছিল লকউডবাসীরা। তাদের ধারণা হয়েছিল, নিশ্চয়ই পাহাড়ের দেবতা এসে তুলে নিয়ে গেছে জিব্রাইলকে! হু হু করে ছড়িয়ে পড়েছিল খবরটা। মৃত্যুর খতিয়ান নিয়ে তাৎক্ষণিক ডেথ সার্টিফিকেট বিতরণ করতে আসা সরকারি কর্মচারীদের মাধ্যমে খবরটা পৌঁছে গিয়েছিল উঁচু মহল পর্যন্ত।
শিক্ষিত মহলে যারা জেনেছিল ঘটনাটার কথা, তারা সবাই-ই যে খুব ভাবিত হয়েছিল— তেমন নয়। অধিকাংশই “ও কোনো ব্যাপার নয়, দূরে কোথাও পালিয়ে-টালিয়ে গেছে” কিংবা “মরে পচে গেছে” বলে ঘটনাটাকে ফেলে দিয়েছিল বিস্মৃতির কোটায়। শোরগোল আর শিরোনামের ঢেউ থিতিয়ে এসেছিল আস্তে আস্তে। আর লকউডও আবার ফিরে গিয়েছিল তার আগের অবস্থানে।
লকউডবাসীরা বলাবলি করেছিল, “বলি নিয়ে গেছে দেবতা। তাইজন্যই না সে এত তাড়াতাড়ি শান্ত হয়ে গেছে! আর আমরাও বেঁচে গেছি!”
বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়েছিল শুধু কয়েকজন। এক অন্যরকম সন্দেহ বুদ্বুদ হয়ে জেগে উঠেছিল তাদের মনের মধ্যে। অন্যদের সহজ-সরল ব্যাখ্যায় তারা সন্তুষ্টও হতে পারেনি; আর অন্যদের তাচ্ছিল্যও তাদেরকে নিরস্ত করতে পারেনি।
আর তারপর…
***
গ্রীষ্মকালের লকউড কেমন হয়, জানো?
উজ্জ্বল এবং আতপ্ত রৌদ্র সারাদিন আলোকিত করে রাখে গ্রামটাকে, পাহাড়ের রং হয় সবুজ, মাটি থাকে শুকনো-তপ্ত, পুরুষ্ট পাতায় ছাওয়া মেপলবনের ফাঁকে ফাঁকে দৌড়ে বেড়ায় হরিণ, খরগোশ, কাঠবিড়ালি, শেয়াল…
আবহাওয়ার মতোই তখন তরতাজা থাকে গ্রামবাসীদের মেজাজ। তারা হাপর চালাতে চালাতে হাতুড়ি পেটায়, গনগনে উনুনে পুড়িয়ে নেয় বাসনকোসন, খটর-খটর তাঁত চালিয়ে বুনতে থাকে থানকাপড়, পূর্ণ উদ্যমে চাষবাস করে, মেয়েরা ব্যস্ত থাকে গৃহস্থালীর কাজে কিংবা স্বামীদের হাতে হাতে সাহায্য করতে। উঠোনে উঠোনে তখন ফসল শুকানো হয়, জ্বালানি কাঠ সঞ্চয় করে রাখা হয় ভাঁড়ারে।
সেইসময় যদি যাও মেপলবনের মাঝখানে, দেখবে— জমাট নিস্তব্ধতার মাঝখানেও বনজ সৌন্দর্য কেমনভাবে মেলে রেখেছে নিজেকে! এই পথ ধরেই তো হেঁটেছিল বেশ কিছু অভিযাত্রী দল। তারা এসেছিল ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিকে আরো নিকট থেকে দেখবে বলে, এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে খুঁটিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে বলে, জঙ্গলের বৈচিত্র্যকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে বলে…
তারা কি সফল হয়েছিল?
কেউ জানে না। জানা যায় না।
যদি তুমি কোনো গ্রামবাসীকে জিজ্ঞাসা করো তাদের কথা, সে নিরাসক্ত মুখে উত্তর দিয়ে দেবে, “ওসব শহুরে লোকেদের কথা আমরা জানব কীভাবে? ওদের মুখে এক, মনে আরেক। হ্যাঁ, জঙ্গলে ওদেরকে ঢুকতে দেখেছিলাম বটে। সঙ্গে বড়ো বড়ো অনেক পোঁটলাপুঁটলিও ছিল। সে ঢুকতেই পারে। জঙ্গলে ঢোকায় তো আর বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু ওই যে ঢুকেছে— ওই পর্যন্তই আমরা দেখেছি। তারপর যে ওরা কী করেছে, কোথায় গেছে— সেসব কিছু জানি না। ওরা তো আমাদের সঙ্গে কোনো কথাও বলেনি।”
কথা শেষ করে সে আবার ফিরে যাবে নিজের নিজের কাজে।
গ্রীষ্মকাল তাদের ভরপুর কাজ করার ঋতু, আগাম কাজ গুছিয়ে রাখার ঋতু। অযথা বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের নেই। কোথায় কোন জটিল-কুটিল শহুরে লোক, কোথায় নিতান্ত অপরিচিত তুমি— তোমাদেরকে অত মনোযোগ দেওয়ার কী দায় পড়েছে ওদের?
তবে মেপল গাছেদের ভাষা যদি বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকে তোমার, তবে শুনবে— দক্ষিণা হাওয়ায় সবুজ পাতা নেড়ে নেড়ে তারা বলছে, “সেই নিখোঁজ অভিযাত্রীরা একজন অতিদীর্ঘ মানুষকে দেখেছিল এই বনের পথে ঘুরে বেড়াতে, সম্পূর্ণ সুস্থ-স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও যার বয়স সে নিজেও জানে না। আড়াল থেকে তারা নজর রেখেছিল তার উপরে। তারপর একদিন তার ঘুমের সুযোগ নিয়ে, অতিকষ্টে তারা সংগ্রহ করেছিল সেই দীর্ঘদেহীর রক্ত। সঙ্গে থাকা উপকরণ দিয়ে, ক্যাম্পে বসেই প্রাথমিক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিল তারা। সেখানে তারা খুঁজে পেয়েছিল FGFR3 এবং HMGA2 জিনের অস্বাভাবিকতা, যা তার গ্রোথ প্লেটকে দিয়েছিল অনির্ণীত বৃদ্ধি— ঠিক সাপের মতো।”
***
বর্ষার লকউড দেখার সৌভাগ্য কি কখনো হয়েছে?
প্রায় সারাবছরই শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাতে অল্পবিস্তর ভিজতে থাকা লকউডে বর্ষা আসে আরো প্রবল হয়ে। গ্রামবাসীদের কাজে ভাঁটা পড়ে যায়, বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় গোটা গ্রাম, ভরে ওঠে ছোটো-বড়ো গর্তগুলো, ব্যাঙ ডাকে গাল ফুলিয়ে, সরিসৃপরা অবাধে ঘুরে বেড়ায় যত্রতত্র…
সেইসময় যদি যাও মেপলবনের মাঝখানে, দেখবে— সদ্য বৃষ্টিস্নাত পাতায় কী আশ্চর্য স্নিগ্ধতার স্পর্শ!
তবে বর্ষাকালে, লকউডের রাস্তায় মানুষজনের দেখা পাওয়া মুশকিল। গোটা বর্ষাটাই তারা কাটিয়ে দেয় ঘরে বসে। অবশ্য চাইলেই যে বাইরে বের হওয়ার প্রচুর উপায় আছে, তেমনটা নয়। বর্ষায় লকউডের জঙ্গলের পথ ধুয়ে যায়, জল-কাদা জমে থাকে সর্বত্র, নির্বিষ সাপাদের সঙ্গে সঙ্গে গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে বিষধর সাপেরাও… এইসময় লকউডের বাসিন্দারা ব্যস্ত থাকে ছাদের ফুটো মেরামত করতে, জমিয়ে রাখা শস্য এবং শুকনো কাঠকুটোকে ভিজে যাওয়ার কবল থেকে রক্ষা করতে।
তখন যদি পাহাড়ের পথে যাও, দেখবে— ছোটো ছোটো ঝোরারাও কেমন সবেগে গর্জে উঠছে ঝরনার মতো। এই পথ ধরেই তো এগিয়ে গিয়েছিল বিশেষ পর্যবেক্ষকদের দল। তারা এসেছিল এখানকার পরিবেশে অগ্ন্যুৎপাতের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখতে, এখানকার আবহাওয়ার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে, আগ্নেয়গিরির পুনরায় জেগে ওঠার সম্ভাবনা বিচার করতে…
পেরেছিল কি তারা সফল হতে?
কে জানে! সেভাবে তো কিছু জানা যায়নি।
তবে যদি সৌভাগ্যক্রমে প্রশ্নটা কোনো গ্রামবাসীকে করেও ফেলতে পারো, নিতান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে সে উত্তর দিয়ে দেবে, “ওসব শিক্ষিত লোকজনদের মতিগতি আমরা আর কীভাবে জানব! সর্বক্ষণ ওদের মাথায় হাজারটা জিনিস একসঙ্গে ঘুরছে। হ্যাঁ, পাহাড়ের দিকে ওদের যেতে দেখেছিলাম বটে। সঙ্গে অনেক বড়ো বড়ো বাক্সপ্যাঁটরাও ছিল। সে যেতেই পারে। পাহাড় তো আর কারোর একার না। ইচ্ছা হয়েছে, গেছে। কিন্তু ও যে ওদিক পানে গেছে— ওই পর্যন্তই আমরা জানি। তারপর যে কী করেছে, কী হয়েছে— সেসব কিছু বলতে পারব না।”
কথা শেষ করে সে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বে নিজের কাজে।
বর্ষাকাল তাদের ঘরবাড়ি এবং সম্পদকে বাঁচিয়ে রাখার ঋতু, বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখার ঋতু। অকারণ কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের নেই। কোনো খামখেয়ালি শহুরে লোক আর অজ্ঞাতকুলশীল তুমি— তোমাদেরকে নিয়ে অত ব্যস্ত হতে ওর বয়েই গেছে!
তবে যদি ফার গাছেদের ভাষা বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকে তোমার, তবে শুনবে— ভিজে বাতাসে সরু দেখা পাতা দুলিয়ে তারা বলছে, “সেই নিরুদ্দেশ পর্যবেক্ষকরা টানটান ত্বকে এবং পাকা চুলের একজন মানুষকে দেখেছিল এই ঝরনায় স্নান করতে, হাজার পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও যে নিজের নাম বলেনি। তারা আড়াল থেকে লক্ষ্য রেখেছিল তার উপর। তারপর, তার ঘুমের সুযোগ নিয়ে, অতিকষ্টে তারা সংগ্রহ করেছিল সেই আশ্চর্য যৌবনের অধিকারী মানুষটার রক্ত। সঙ্গে থাকা সরঞ্জাম দিয়ে, ক্যাম্পে বসেই প্রাথমিক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিল তারা। সেখানে তারা খুঁজে পেয়েছিল ডিনোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার মতো আশ্চর্য জিনগত গঠন— যা আশ্চর্য দ্রুততায় DNA-এর ত্রুটি মেরামত করতে সক্ষম এবং কোষের বয়সকে ঘুরিয়ে দিতে সমর্থ। “
***
শীতের লকউড কেমন হতে পারে, ভাবতে পারবে কি?
হাজার হোক— পাহাড়ি গ্রাম বলে কথা। লকউডে শৈত্য আসে প্রচণ্ড পরাক্রম নিয়ে। শরতের শেষে যেসব গাছের পাতা ঝরে যায়, তাদের নিষ্প্রাণ শরীরে তখন জমে থাকে তুলোর মতো তুষার। সব রং ম্লান হয়ে যায়, সরিসৃপরা গর্তে গর্তে সেরে নেয় তাদের বাৎসরিক শীতঘুম, সবুজ পাহাড়ে লাগে রুক্ষ্ম বিবর্ণতার স্পর্শ…
শীতকালে লকউডের কর্মচক্র শ্লথ হয়ে পড়ে আশ্চর্যজনকভাবে। গ্রামবাসীরা জমিয়ে রাখা শস্য আর শুকিয়ে রাখা ফল-মাংস-পনির ইত্যাদি দিয়েই করে নেয় রোজকার খাবারের ব্যবস্থা, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কুয়াশামাখা পথঘাটে পা দেয় না কেউ, চাষের জমিগুলো ভর্তি হয়ে থাকে আগাছায় আর তাদের ফুটিয়ে রাখা ছোটো ছোটো বুনোফুলে…
সেইসময় যদি যাও মেপলবনের মাঝখানে, দেখবে— কিছুদিন আগেও রক্তলাল শৃঙ্গারে সেজে থাকা জঙ্গলে এসেছে বিষণ্ণ বৈধব্য! এই জঙ্গুলে পথ বেয়েই তো হেঁটে গিয়েছিল বেশ কিছু বৈজ্ঞানিকের দল। তারা এসেছিল গ্রামবাসীদের শরীরে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করবে বলে, এখানকার উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের বৈচিত্র্য সম্পর্কে গবেষণা করবে বলে, পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসা অভিযোজন নিয়ে পর্যালোচনা করবে বলে…
তারা কি সমর্থ হয়েছিল?
কেউ জানে না। জানতে পারেনি।
যদি আগুন পোহাতে থাকা কোনো গ্রামবাসীকে প্রশ্নটা করতে পারো, সে উদাস ভঙ্গিতে উত্তর দিয়ে দেবে, “ওসব বড়ো বড়ো মানুষদের ব্যাপারস্যাপার আমরা কীভাবে বলব? হ্যাঁ, এক দলকে জঙ্গলের দিকে যেতে দেখেছিলাম ঠিকই। সঙ্গে ঢাউস ঢাউস সব লটবহরও ছিল। তাতে আর কী? জঙ্গলে ঢুকতে গেলে তো আর হাতিঘোড়া লাগে না। কিন্তু ওই যে তারা গেল— ওই পর্যন্তই দেখেছি। তারপর যে তারা কী করেছে, কোথায় গেছে— সেসব কিছুই জানি না।”
কথা শেষ করে সে আবার ফিরে যাবে নিজের কাজে।
শীতকাল ওদের নির্ভেজাল আলস্য যাপনের ঋতু, সারাবছর জুড়ে জমাতে থাকা গল্পগুলোকে কেঁচেগণ্ডূষ করে নেওয়ার ঋতু। অনর্থক জিনিসপত্র নিয়ে মাথাব্যথা করার অবকাশ ওদের নেই।
তবে যদি বাতাসের ভাষা বোঝার ক্ষমতা তোমার থাকে, তবে শুনবে— উত্তুরে হাওয়া পত্রহীন শাখাপ্রশাখার ফাঁক দিয়ে ছুটতে ছুটতে বলছে, “সেই হারিয়ে যাওয়া বৈজ্ঞানিকরা একজন দীর্ঘদেহী মানুষকে সাপের মতো খোলস ত্যাগ করতে দেখেছিল এই পাতাঝরার জঙ্গলে, যার নতুন ত্বক ছিল যে কোনো যুবকের মতোই তারুণ্যময়। সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রের সাহায্যে তারা দ্রুত পরীক্ষা করেছিল কিছু কিছু। তারা জেনেছিল, মানুষটার পিটুইটারি অতিরিক্ত সক্রিয়। ফলে পিউবার্টির পরও ক্রমাগত বিভাজিত হয়ে চলেছে তার গ্রোথ প্লেটস। গোটা বছর ধরে চলছে তার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির পালা; তাইজন্যই তাকে খোলস ছাড়তে হচ্ছে শীতান্তে এসে।”
***
লকউড যে বসন্তে কেমন রূপ ধারণ করতে পারে, সেই বিষয়ে কোনো ধারণা আছে কি?
বসন্তের বাতাস আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে লকউডে। রিক্ত শাখাপ্রশাখায় গজিয়ে ওঠে লাল কিংবা তামাটে রঙের কচি কচি পাতা, তাদের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দেয় ফুলের কুঁড়ি, পাখিরা গায় খুশির গান…
এইসময় ঘরের সীমাবদ্ধ পরিবেশ ছেড়ে আবার বাইরে বেরিয়ে আসে বাসিন্দারা, শীতে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া শরীরকে জাগিয়ে তোলে তাজা রোদ-বাতাসের স্পর্শে। চাষের জমিকে তারা প্রস্তুত করে নতুন ফসল বোনার জন্য, ফলের বাগানকে করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, যাবতীয় শীতপোশাক আর বালিশ-বিছানা শুকিয়ে নেয় বসন্তের নরম রৌদ্রে…
সেইসময় যদি যাও পাহাড়ের কোলে, দেখবে— রিক্ত হয়ে থাকা পাহাড়ের লেগেছে খুশির ছোঁয়া। সেই গুপ্তগুহায় জড়ো হয়েছে গ্রামের সমস্ত বাসিন্দারা, জ্বালানো হয়েছে বিশাল অগ্নিকুণ্ড, আর সেই লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হচ্ছে সেই মানুষের খোলস। প্রাণভরে পোড়ার গন্ধ বুকে ভরে নিচ্ছে উপস্থিত মানুষেরা, বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে, ব্যক্ত করছে নিজেদের মনোবাসনা।
কী হবে এই গন্ধে? কেন করছে তারা এরকম?
যদি তাদের কাউকে জিজ্ঞাসা করো এই প্রশ্ন, সসম্ভ্রমে উত্তর দেবে সে, “ওই জাদু-খোলসের গন্ধ শুঁকছি। একবার যদি আগ্নেয়গিরির দেবতার আশীর্বাদ পেয়ে যাই, আমরাও জিব্রাইলের মতো অমর হতে পারব। আমরাও শত শত বছর ধরে বেঁচে থাকতে পারব। আমরাও বছর বছর লম্বা হতে পারব।”
কথা শেষ করে আবার নিজের কাজে ফিরে যাবে সে।
বসন্তকাল তাদের কাছে উদযাপনের ঋতু, দেবতাকে আহ্বান করার ঋতু। অহেতুক কিছু কথা বলে খরচ করে ফেলার মতো সময় তাদের নেই।
জিব্রাইলের জিন যে আগ্নেয়গিরির ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা তেজস্ক্রিয় কণাকে প্রতিহত করার জন্য অকস্মাৎ পরিব্যক্ত হয়েছিল এবং তার ফলেই অভিযোজিত হয়েছিল জৈবিক অমরত্ব আর অনিঃশেষ বৃদ্ধির দিকে— সেসব তত্ত্ব তারা বোঝেও না, আর বুঝতে চায়ও না। জিব্রাইল তাদের কাছে ঈশ্বরের বরপ্রাপ্ত মানুষ— মৃত্যু যাকে ছুঁতে পারে না! তারাও স্বপ্ন দেখে একদিন অমর হয়ে ওঠার; তাই তারা এই রহস্যকে সীমাবদ্ধ রেখে দিতে চায় নিজেদের মধ্যে। অমৃতের ভাগ তারা দ্বিতীয় কোনো গোষ্ঠীকে দিতে রাজি নয়।
তোমার যদি পাহাড়ের ভাষা বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকে, তবে শুনবে— বহতা ঝরনার ঝরঝর শব্দের মধ্যে দিয়ে সে বলছে, “যারা এই গ্রামে এসে হারিয়ে গেছে, তারা কেউ-ই আসলে হারিয়ে যায়নি। তাদেরকে গোপনে হত্যা করা হয়েছে— যাতে এই রহস্য তারা কোনোদিন বহির্বিশ্বের কাছে প্রকাশ না করতে পারে। অমরত্বের অভিশাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো জিব্রাইল আসলে নিঃসঙ্গ নয়; অজস্র চোখ, আড়াল থেকে সর্বক্ষণ নজরবন্দি করে রেখেছে তাকে। যতক্ষণ তুমি তাকে না দেখছ, তার ব্যাপারে আগ্রহী না হচ্ছ— ততক্ষণ তুমি নিরাপদ। আর নয়তো…”
Tags: গল্প, শ্রীজিৎ সরকার, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা