আমার প্রাণের পরে
লেখক: মোহনা দেবরায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“শরণ্যা! ডায়েরিটা কোথায় গেল আমার? কতবার বলেছি ওটা টেবিল থেকে সরাবে না?”
স্টাডি থেকে অভিজিতের চিৎকার শুনে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরণ্যা। এই চিৎকারগুলো শুনলে বড্ড ব্যর্থ মনে হয় নিজেকে। মনকে বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, এতে তার দোষ নেই, তার ওপর ভুবনের ভার নেই— তবু বোঝাতে পারেনি। ভুবন না হোক, একটা মানুষের ভার তো সে নিয়েছিল, সজ্ঞানেই নিয়েছিল— সেটুকুও কেন পেরে উঠল না?
বিয়ের আগে অভিজিতের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল শরণ্যা। মনোবিদ ড. অভিজিৎ আদকের খ্যাতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। সে যে শুধু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাইই তো নয়, অবচেতনের কাজকর্ম সম্পর্কে তাঁর গবেষণা বিপুল সমাদৃত। শরণ্যার এম ফিল রিসার্চ গাইড ছিল সে। বছর পাঁচেকের বেশি পার্থক্য ছিল না দু-জনের বয়সের। কাজ করাকালীন, কোনোদিন অভিজিৎকে নিজের ঊর্ধ্বতন মনে হয়নি তার। কত অসময়ে ফোন করে জ্বালিয়েছে, আবার কত ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে কাটিয়েছে। অভিজিৎ তখন নিজেও একটা পেপার নিয়ে ব্যস্ত। কত অসময়ে ফোন করে ইনপুট চেয়েছে শরণ্যার কাছে। কতবার দরাজ গলায় বলেছে, “তোমার এই ক্রিয়েটিভ এনার্জিটাকে আমি ভীষণ অ্যাডমায়ার করি, শরণ্যা।”
অভিজিতের পড়াশোনা সংক্রান্ত অনেক কাজে সাহায্য করত শরণ্যা। কর্তব্য মনে করেই করত। যে মানুষটার কাছে ও এতভাবে ঋণী, তার জন্য করতে কখনো ক্লান্তি আসত না। সেভাবেই কবে থেকে যেন, অভিজিতের কাজের খুঁটিনাটির খবর রাখতে শুরু করেছিল ও। লোকটা এমনিতে ভুলোমনের, শরণ্যা সতর্ক দৃষ্টি রাখত যাতে তার জন্য কোনো ক্ষতি না হয় ওর।
এম ফিল কমপ্লিট হয়ে যাওয়ার পর, অভিজিৎই দিয়েছিল প্রস্তাবটা। বলেছিল, “আমি আমার নিজের খবরও ততটা রাখি না যতটা তুমি রাখো। আমার কোথায় কী লেখা আছে, কবে কোন ডেডলাইনটা মিট করতে হবে… এইসব তোমার হাতের গোড়ায় রাখা থাকে। আমার একটা প্রপোজিশন ছিল এই বিষয়ে।”
শিরদাঁড়াটা আচমকাই খুব ঠান্ডা হয়ে গেছে— টের পেয়েছিল শরণ্যা। কীসের প্রস্তাব দিতে চায় লোকটা? সেই প্রথম আভাস পেয়েছিল…। উত্তেজনার গোড়ায় এক বালতি জল ঢেলে অভিজিৎ বলেছিল, “তুমি কাজটা প্রফেশনালি করবে? আমার না… একজন পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট খুব দরকারও এই মুহূর্তে। আর তুমি ছাড়া কেউ…” কথাটা আর শেষ করেনি ও। রাজি হতে কোনো সময় নেয়নি শরণ্যা।
পিএ হিসেবে মাসছয়েক কাজ করেছিল। নেটের প্রিপারেশন চলছিল তখন। নেট লাগল। জেআরএফ-টা লাগল না। সময় কাটানোর জন্য অনলাইন কাস্টম মেড জামাকাপড়ের ব্যাবসা শুরু করল শরণ্যা। ক্লিক করে গেল জিনিসটা। আর তারপরই এলো প্রস্তাবটা, যেটার জন্য একই সঙ্গে ভয় পাচ্ছিল আর প্রার্থনা করছিল শরণ্যা। তবু, না করতে পারেনি। এই লোকটা ছাড়া আর তার জীবনে আছে কী?
কিন্তু বিয়ের এই দেড় বছর, একটা অদ্ভুত পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে ও। কিংবা হয়তো, না-পরিবর্তনের। হয়তো পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের পদ থেকে উত্তরণ আশা করেছিল শরণ্যা। কিন্তু সেটা আসেনি। আগের চেয়ে দায়িত্ব বেড়েছে শুধু। মাঝে মাঝে মনে হয়, বড্ড বেশি সহজলভ্য করে তুলেছে কি নিজেকে? দেড় বছর পর অবশ্য এসব ভেবে আর লাভ নেই।
তবে একটা ব্যাপারে শরণ্যা নিশ্চিত। ভুলো ভাবটা অনেক বেশি বেড়েছে লোকটার এই ক-মাসে। চিৎকারটাও যেন বেড়ে গেছে অনেক গুণ। শরণ্যার একটু পান থেকে চুন খসলেই বড্ড বিরক্তি দেখায়। আরো একটা ব্যাপার হয়েছে। হয়তো শরণ্যা সবে একটা কাজ নিয়ে বসেছে, অমনি কিছুর একটা দরকার পড়ে যায় তার। শরণ্যা কাজের কথা বললেই হাসিমুখে বলে, “ঠিক আছে আমি করে নিচ্ছি।” কখনো বলে না, “আচ্ছা তুমি হাতের কাজ শেষ করে নিয়ে করো,” তাড়া না থাকলেও…। এখনো অভিজিৎকে নিজের বস ছাড়া কিছু মনে হয় না তার।
***
টেবিলটা ওলঢোল করতে করতে খুব বিরক্ত বোধ করছিল অভিজিৎ। এইটুকু দায়বদ্ধতা থাকবে না একটা মানুষের? হ্যাঁ, সে একটু প্রাচীনপন্থী। এখনো খাতা-কলমেই হিসেব রাখে। এই ডায়েরিটা হারালে আক্ষরিক অর্থেই সে অন্ধ। তার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অ্যাপয়েন্টমেন্ট, কাজের ডেডলাইন, গুরুত্বপূর্ণ পাসওয়ার্ড… সব কিছু লেখা থাকে এইখানে। এটা গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব শরণ্যার। অথচ গতকাল রাতে সে নিজের হাতে ডায়েরিটা টেবিলে রেখে আজ এসে দেখে, জিনিসটা বেমালুম হাওয়া! শরণ্যা ছাড়া আর কারো হাতে পড়ারই কথা নয় এই ডায়েরি। সেই যে তখন থেকে অভিজিৎ চেঁচিয়ে যাচ্ছে, উত্তর পর্যন্ত দিচ্ছে না। এই ক-বছরে যেন কী হয়েছে মেয়েটার। আর কাজ করে না আগের মতো মন দিয়ে। তাকে তো জীবনের অর্ধেক দিয়ে দিয়েছে অভিজিৎ, তবু কেন এই অবহেলা? ভাবতে ভাবতে মনটা যেরকম ভারী হয়ে ওঠে, অভিজিৎ বোঝে, সেটা ডায়েরির জন্য নয়। আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার আছে তার, মনে আছে ভাগ্যক্রমে। এখন বেরোতে হবে। পরে না হয় খোঁজা যাবে। বিরক্তভাবে কাঁধে ব্যাগটা তুলে নিয়ে দড়াম করে দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যায় ও। আওয়াজটা পৌঁছয় রান্নাঘর অবধি। রান্নার মেয়েটা আজ আসেনি।
“স্যার! স্যার! শুনছেন?”
আচমকা ডাকে সম্বিত ফেরে অভিজিতের। সেমিনার সবে শেষ হয়েছে, রিফ্রেশমেন্ট চলছে। সামনের দিকের সারির একটা ফোমে মোড়া সোফায় বসে বসে লাইম সোডায় ছোটো ছোটো চুমুক দিচ্ছিল অভিজিৎ। এই সময়ে ডাকটা এসেছে, পাশ থেকে। মাথাটা ঘোরায় ও। একটা মেয়ে। বয়স আন্দাজ তেইশ। পরনে সিগারেট প্যান্টস, আর একটা লম্বা কুর্তা। মাথার ঢেউখেলানো চুল কাটা বয়েজ কাটে। অর্ধেক কপাল জুড়ে রেখেছে। চোখে চশমা। চেহারাটা রোগা নয় মোটেই, আবার মোটাও বলা চলে না। তবে মোটার দিকে। মেকাপহীন মুখ, কেবল কানে দুটো দুল। চোখগুলো বড়ো বড়ো। এরকম মেয়েদের দেখলে ভালোলাগা বা খারাপ লাগা কিছুই জন্মায় না। কেবল একটুখানি হেসে মাথা নেড়ে কাজের কথাটা বলে এগিয়ে যেতে হয়।
“হ্যাঁ বলুন!”
“আপনার আজকের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কয়েকটা বিষয়ে আলোচনা করতে পারলে ভালো হত আপনার সঙ্গে।”
অভিজিৎ আজকে বলেছে ট্রমা আর তার প্রভাবে মানুষের স্মৃতিভ্রংশের ওপর। এই নিয়ে কী বলতে চায় মেয়েটা? অভিজিতের কয়েক সেকেন্ডের বিহ্বল দৃষ্টির সামনে আচমকাই লালচে হয়ে ওঠে মেয়েটার মুখটা, “দেখেছেন! নিজের পরিচয়টা না দিয়েই উৎপাত শুরু করে দিয়েছি। নমস্কার, আমি সুলগ্না দত্ত।”
হাত তুলে প্রতিনমস্কার জানায় অভিজিৎ, তারপর বলে, “বলুন কী বলবেন!”
“আসলে…” একটু ইতস্তত করে মেয়েটা, “একটু গুছিয়ে বলতে হবে। আপনার থেকে যদি আধ ঘণ্টা সময় চেয়ে নিই, খুব কি অসুবিধা হবে?”
এক মুহূর্ত ভাবে অভিজিৎ। আজ কলেজ নেই। এখানে থেকে একজন প্রকাশকের অফিসে যাওয়ার কথা। একটা নন-ফিকশন লিখছে সে। আজকে সইসাবুদ করে আসবে। কিন্তু মাঝে ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে। কী বলতে চায় মেয়েটা, শোনা যাক। হয়তো কোনো ভাবনার রসদ পাওয়া যাবে। কিংবা আর কিছু না হোক, সময়টা ভালো কাটবে। ও বলে, “বেশ তো! কিন্তু এখানে তো একটু মুশকিল। একটু পরেই সেমিনার হল বন্ধ হয়ে যাবে।…”
“এখানে কাছেই একটা ক্যাফে আছে,” তার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে বলে মেয়েটা, যেন এই সুযোগটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। একটু ভাবে অভিজিৎ। অভিজিৎ আদক, বিবাহিত, বছর বারোর ছোটো একটা মেয়ের সঙ্গে একান্তে ক্যাফেতে ঢুকছে— কারো চোখে পড়ে গেলে স্ক্যান্ডাল ছড়াতে পারে কি? নাহ্! সে তো কোনো পাবলিক ফিগার নয়, স্রেফ একজন স্কলার। “ঠিক আছে, চলুন,” মাথা নাড়ে অভিজিৎ।
“বলুন, কী বলবেন বলছিলেন!”
“আমাকে আপনি করে বলবেন না প্লিজ। আমি অনেকটাই ছোটো।”
“বেশ কিন্তু কথাটা কী?”
“আচ্ছা অভিজিৎবাবু, একটা মানুষের পক্ষে, সকলের স্মৃতি থেকে কি মুছে যাওয়া সম্ভব?”
আপসোস হয় অভিজিতের। পাগলের প্রলাপ শুনতে এলো নাকি? মুখটা যতটা সম্ভব কৌতূহলী রেখে বলে, “আরেকটু বুঝিয়ে বলুন।”
“মানে ধরুন ওই লোকটা…” ফাঁকা ক্যাফেটার ওরা ছাড়া আর একমাত্র কাস্টমারের দিকে আঙুল দেখায় মেয়েটা, “লোকটার নিশ্চয়ই একটা বাড়ি আছে। কাছের দুয়েকজন আছে, কেউ নিশ্চয়ই অপেক্ষা করার আছে। অফিস আছে, কলিগরা আছে, বন্ধু আছে… হঠাৎ করে এ যদি একদিন হারিয়ে যায়, ওদের সকলের ওর কথা মনে হবে তো? ওরা ওকে খুঁজবে তো?”
“হ্যাঁ খুঁজবে বৈকি! একটা মানুষ হারিয়ে গেলে তাকে আরেকজন মানুষ খুঁজবে না?”
“ধরুন যদি না খোঁজে? যদি ভুলে যায়?”
“ওভাবে হঠাৎ কাউকে ভুলে যাওয়া তো বাস্তবে অসম্ভব, মিস দত্ত। ভুলে যেতে তো কারণ লাগে।”
“আপনি নিশ্চিত?”
“মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?”
“আমার তো মনে হয়, ভুলে যাওয়ার জন্য নয়, মনে রাখতেই কারণ লাগে। কারণ না থাকলে কেউ কিছু মনে রাখে না।”
“কারণ তো থাকেই! প্রত্যেকের সঙ্গেই আমাদের কিছু না কিছু স্মৃতি থাকে।”
“ধরুন কেউ যদি কারো জীবনে কোনো মিনিংফুল কোনো স্মৃতি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়? ধরুন কেউ যদি… জাস্ট ইন্সিগ্নিফিকেন্ট হয়?”
“এটা সব রকমভাবে অসম্ভব, মিস দত্ত। আমরা যখন কমিউনিকেট করি, আমাদের ব্রেইনে এক ধরনের—”
“সায়েন্টিফিক কচকচি বাদ দিন, ওগুলো আমি জানি।”
“তাহলে! জানেন যখন, নিশ্চয়ই এটাও জানেন যে কোনো স্মৃতিই পুরোপুরি মুছে যাওয়া সম্ভব নয়?”
সামান্য হাসে মেয়েটা, “কেন, আপনি তো আজ নিজেই বললেন, অনেক সময় ট্রমার সঙ্গে কোপ আপ করতে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু স্মৃতিকে চাপা দিয়ে দেয়?”
“তার তো কনটেক্সট সম্পূর্ণ আলাদা। আর সেটা তো ঠিক ভুলে যাওয়াও নয়, সেল্ফ-ডিনায়াল। কিন্তু এখন তো আপনি যে সিনারিওটা বলছেন, সেটা অবাস্তব। হঠাৎ করে একজন মানুষকে সবাই ভুলে গেল— এটা শুধু কল্পবিজ্ঞানের গল্পে হয়।”
হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে আসে মেয়েটা, যেন খুব গোপন কোনো কথা বলছে, এইরকম নীচুস্বরে বলে, “আমি যদি বলি, এরকম হয়েছে? আমি নিজে সাক্ষী?”
এইবার হাসিটা লুকানোর আর চেষ্টা করে না অভিজিৎ। মজার সুরে বলে, “আপনি সাক্ষী মানে আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই? তাহলেই তো ব্যাপারটা আর খাটছে না। আপনারই তো মনে আছে।”
মুখটা অন্ধকার হয়ে যায় মেয়েটার। “তার কারণ…” একটু থেমে বলে সে, “তার কারণ আমিই সেই মানুষ।”
এবার শব্দ করেই হেসে ফেলে অভিজিৎ। “এটা যদি আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন, মিস দত্ত, তাহলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি ডিলিউশিনে ভুগছেন। তবে চিন্তা করবেন না, এটা সম্পূর্ণ কিওরেবল।”
ম্লান হাসে মেয়েটা, “আপনি সত্যিই বিশ্বাস করছেন না, তাই না? অবশ্য প্রথমবার শুনে কারোরই পক্ষেই বিশ্বাস করার কথা নয়।”
“বিশ্বাস করা কি সম্ভব? আপনার কী মনে হয়? এই তো আপনার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে, আমি কি ভুলে যাচ্ছি আপনাকে?”
এইবার চোখদুটো উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মেয়েটার। “আমি যদি প্রমাণ দিতে পারি?”
“কীভাবে?”
“আপনার মনে হচ্ছে, আপনি এই প্রথম আমায় মিট করছেন, তাই না?”
আচমকা একটা নীরবতা নেমে আসে দু-জনের মাঝখানে। ক্যাফের ভেতরটা কি একটু বেশি ঠান্ডা? একটু থেমে অভিজিৎ বলে, “হ্যাঁ, কারণ আমি এই প্রথম আপনাকে মিট করছি।”
আবার ম্লান হাসে মেয়েটা, “অর সো ডু ইয়ু থিঙ্ক। কিন্তু মিস্টার আদক, এর আগে ঠিক এই ক্যাফেতে বসেই, এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করেছি আমরা। না না… ভয় পাবেন না। এটা আপনার সমস্যা নয়। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই সকলেই ভুলে যায় আমার কথা।”
“হয় আপনি ডিলিউশনে ভুগছেন,” শান্ত গলায় বলে অভিজিৎ, “আর না হলে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো প্র্যাঙ্ক করছেন। দ্বিতীয়টা হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।” বলতে বলতে একবার আশপাশে তাকিয়ে নেয় ও, “কোথাও কি ক্যামেরা রয়েছে?”
“একটু দাঁড়ান!” বলে পকেট থেকে ফোন বের করে মেয়েটা। কিছু একটা করে কয়েক সেকেন্ড, আঙুলগুলো খুব দ্রুত চলাফেরা করতে থাকে স্ক্রিনে। তারপর এগিয়ে দেয় ফোনটা, “এটা দেখুন।”
ফোনটা হাতে নিয়ে শরীরটা ঠান্ডা হয়ে যায় অভিজিতের। এই ক্যাফেরই অন্য একটা চেয়ারে বসে আছে সে। পরনে একটা নীল কালো চেক কাটা টি শার্ট। তিন মাস আগে এখানেই আরেকটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে এটা পড়ে এসেছিল সে। একটু দিশেহারা লাগে তার। বুঝতে পারছে ফোটোশপ, কিন্তু তবু চোরা একটা অস্বস্তি।… ফোনটা ফিরিয়ে দিতে দিতে সে বলে, “ছবিটা কোত্থেকে জোগাড় করলেন?”
“এটা এই ফোনের এই ক্যামেরায় আজ থেকে তিন মাস আগে তোলা। ওইদিকের টেবিলটায় বসেছিলাম আমরা। সেদিনও আমি আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম… যথারীতি আপনি বুঝছিলেন না। তখন বাধ্য হয়ে এই ছবিটা তুলি।”
“এক মিনিট এক মিনিট! আপনার সঙ্গে যদি আমার আগে পরিচয় হয়ে থাকবে এবং এরকম কোনো ঘটনা ঘটে থাকবে, তাহলে আপনার নম্বর তো আমার ফোনে সেভ্ড থাকা উচিত।…” বলতে বলতে পকেট থেকে ফোন বের করে অভিজিৎ।
“লাভ নেই,” হতাশ গলায় গড়ে ওঠে মেয়েটা, “সেদিনও আপনি এরকমই বিরক্ত হয়েছিলেন, তাই আর নম্বর নেননি। আজকেও নেবেন না, আমি জানি।”
“আপনি কোথায় থাকেন? বাড়িতে কে কে আছে?”
–”আমার জন্ম কলকাতাতেই। তেঘড়িয়ায়। আর বাড়ির লোক? একসময় মা-বাবা আর দাদা ছিল। হঠাৎ একদিন বাড়ি ফিরে দেখলাম আমাকে আর কেউ চিনতে পারছে না। কোনোদিনই পারল না তারপর। তাই আর বাড়ি যাই না।”
“তাহলে থাকেন কোথায়? কী করেন?”
মেয়েটা আবার হাসে, “কোথাও থাকি না।”
নিজের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে অভিজিতের। বেকার বেকার সময়টা নষ্ট হল। এর থেকে একা একা একটা থিয়েটার দেখে চলে গেলেও ভালো হত। সে বলে, “দেখুন, ভেবেছিলাম সিরিয়াস কোনো কথা বললেন। সেই কারণে এখানে আসতে রাজি হই। কিন্তু ক্ষমা করবেন, এরকম প্র্যাকটিক্যাল জোকের সঙ্গে আমি অভ্যস্ত নই।”
“প্লিজ মিস্টার আদক! যাবেন না! চলে গেলে আর দেখা হবে না আমাদের। কখনো!”
অভিজিৎ বলতে চাইছিল, “না হলেই বেঁচে যাবো।” কিন্তু জিভের ডগায় এসে আটকে যায় কথাটা, মেয়েটার আর্তি কানে এসেছে, “আমার কথাটা শুনুন একটু, প্লিজ!”
কথাটার মধ্যে কিছু একটা ছিল, যেটা অগ্রাহ্য করতে পারে না অভিজিৎ। হাতদুটো টেবিলের ওপর রেখে বলে, “বলুন!”
“আমার ধারণা আমি সাধারণ মানুষ নই।”
অভিজিৎ চুপ করে থাকে। এই পাগলের প্রলাপের উত্তর দেওয়া অর্থহীন। মেয়েটা আবার বলে, “চ্যাটিং অ্যাপগুলোতে যেমন, মেসেজ ডিলিট করে দেওয়া যায়, আমার সঙ্গে মানুষজনের কথোপকথনের ক্ষেত্রে মনে হয় কেউ যেন বাই ডিফল্ট ওই অপশনটা অন করে রেখেছে। এক-একবার কথা হয়, তারপরেই নিজের দিক থেকে সব হিস্ট্রি ডিলিট করে দেয় সবাই। আর দেখা হলেও চিনতে পারে না। কিন্তু আমি তো কখনো কোনো ট্রমা-ইনফ্লিক্টিং আচরণ করি না কারো সঙ্গে! যে লোকজন নিজের থেকে সেই সব মেমোরিকে রিপ্রেস করবে। তাহলে কেন এরকম হয় বলতে পারেন, মিস্টার আদক?”
“আপনিই বলুন!”
“আমার থিয়োরি শুনলে আপনি হাসবেন।”
অভিজিৎ উত্তর দেয় না। মনে মনে বলে, “অলরেডি কাঁদছি আমি ভেতর ভেতর”।
মেয়েটা আবারও বলে, “আমার মনে হয় আদতে আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি আমার।”
“এটা যে স্বীকার করলেন, এতেই কৃতার্থ হয়ে গেলাম।”
“উঁহু! ভুল করবেন না, ড. অভিজিৎ আদকের সঙ্গে এনকাউন্টারটা আমার মিথ্যে নয়, কিন্তু সেটা আপনি নন।”
“মানে!”
“মানে আসলে… কারো সঙ্গেই আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয় না। যখন দেখা হয়, সে অন্য লোক।”
“কী বলতে চাইছেন আপনি?”
“আমার ধারণা এই শহরে আমার বাবা-মা কোথাও আছে। আমি যাদেরকে বাবা-মা বলে চিনতাম, তারা নয়, অন্য কেউ। হয়তো আমার নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন দিয়েছে তারা খবর কাগজে। আমার ধারণা আমি মানুষই। কিন্তু একটু বেশি… অভিযোজিত। অনেকগুলো সত্ত্বা মিশে গেছে আমার মধ্যে।”
“অনেক সত্ত্বা বলতে?”
“অনেক জগৎ, অনেক জীবনের সত্ত্বা।”
চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে একটু হাসে অভিজিৎ, আচ্ছা! এই গল্প তাহলে! “আপনি মাল্টিভার্স থিয়োরি মিন করতে চাইছেন, তাই না? প্রচুর সাইফাই পড়ার আর দেখার ফল।”
“আমি মাল্টিভার্স থিয়োরি মিন করতে চাইছি না বিশ্বাস করুন! বলতে পারেন, মাল্টি-রিয়ালিটি মিন করতে চাইছি।”
“ওই একই হল!”
“না! দুটো আলাদা! আপনি ইচ্ছামতো পোর্টাল ওপেন করে এক রিয়ালিটি থেকে অন্য রিয়ালিটিতে যাতায়াত করতে পারেন না, কারণ সব রিয়ালিটি একই সঙ্গে এক্সিস্ট করে, তাই যাওয়া-আসাটা থ্রু স্পেস নয়, যেরকম সিনেমায় দেখায়।”
“ওটা তো বোঝার সুবিধার জন্য।”
“হলেও! জিনিসটার ইন্টারপ্রিটেশন হয়ে দাঁড়ায় সম্পূর্ণ আলাদা। আসলে… এইসব কনসেপ্টকে আমাদের চতুর্মাত্রিক এক্সিস্টেন্সের মধ্যে কনসিভ করাই সম্ভব নয়।”
“তো আপনি বলতে চাইছেন আপনি এক রিয়ালিটিতে একই মানুষকে দ্বিতীয়বার মিট করেন না?”
“বলতে চাইছি নয়, বলছি!”
“আচ্ছা এই যাতায়াতটা কীভাবে সম্ভব বলে আপনার মনে হয়? মানে আপনি তো বললেন যেরকমভাবে আমরা গল্পে পড়ি বা সিনেমায় দেখি…” অভিজিৎ বেশ মজা পেয়ে গেছে প্রসঙ্গটায়।
“সরাসরি কিছু নয়। এই ধরুন এখন এই ক্যাফে ছেড়ে বেরোবো। একটু পরে ঢুকে দেখব চেয়ারগুলোর রং, ওরিয়েন্টেশন সব পালটে গেছে। আলোগুলো জায়গা বদল করেছে। ধরুন টেবিলের ওপর যদি আমি এখন পেন্সিল দিয়ে একটা আঁচড় কেটে যাই, আর কোনোদিন সেই আঁচড়টা দেখতে পাবো না।” বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসে মেয়েটার। একটু মায়া হয় অভিজিতের। যাই হোক, অল্পবয়সী মেয়ে। বাজে ডিলিউশনে ভুগছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর ট্রিটমেন্ট দরকার। এখন আর একে মিথ্যাবাদী বলে সন্দেহ করছে না অভিজিৎ। বরং নিজের অজান্তেই ভেতরের ডাক্তারটা কখন জেগে উঠেছে যেন। সে প্রশ্ন করে, “কবে থেকে এটা হচ্ছে আপনার?”
“আঠেরো পূর্ণ হওয়ার পর থেকে। আমার কী মনে হয় জানেন?”
“কী?”
“আমি আসলে অসাধারণ কিছু নই। বরং অগ্রদূত বলতে পারেন। আমার ধারণা আগামী একশো বছরের মধ্যে সকলেই এরকম হয়ে যাবে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ! আরো একটা ধারণা আছে আমার।”
“কী?”
“আমার সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর একটা… প্রভাব আছে। আমি অনুভব করতে পারি… কী যেন ঢুকিয়ে দিচ্ছি আমি তাদের মধ্যে।”
“কীরকম?”
হঠাৎ একটু অদ্ভুত চোখে টাকায় মেয়েটা। “এর আগেরবার অনেকক্ষণ সময় কাটিয়েছিলাম আপনার সঙ্গে।”
“হ্যাঁ তো…?”
“আচ্ছা… আপনার সঙ্গে কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার হয়নি তো? মানে যেটা আপনি কোনোভাবেই লজিক দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না…?”
ভ্রু কুঁচকে ভাবে অভিজিৎ। কেন ভাবে, তা সে নিজেও জানে না। আচমকা, টুং করে ফোনে মেসেজ ঢোকে একটা। অন্যমনস্কভাবে সেটা খোলে ও। মেয়েটা টেবিলের ওপার থেকে এখনো তাকিয়ে আছে স্থির চোখে।
শরণ্যা মেসেজ করেছে। একটা ছবি। ওর সবেধন নীলমণি ডায়েরি। ক্যাপশন লেখা, “আলমারিতে তোমার জামাকাপড়ের মধ্যে গোঁজা ছিল। তোমার কী মনে হয়, ওটা আমি রেখেছি ওখানে? স্ক্রিনের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে অভিজিৎ। নীল রঙের ছোট্ট ডায়েরি, ওপরে সোনার জলে লেখা, “Diary”. কোথাও এতটুকু অস্বাভাবিকত্বের চিহ্নমাত্র নেই। অথচ, অভিজিৎ ওদের অনাগত সন্তানের নামে শপথ করে বলতে পারে, ওটা ওখানে ও কোনোভাবেই রাখেনি।
কথাটা মনে হতেই ভীষণভাবে চমকে ওঠে ও। অনাগত সন্তান! এটা হঠাৎ কেন মনে হল ওর? শরণ্যা তো প্রেগনেন্ট নয়! তাহলে? সামনের মেয়েটার মুখের দিকে তাকায় ও। কেমন একটা দেখতে! কী যেন আছে ওই মুখে! ঠিক বুঝতে পারে না অভিজিৎ। টের পায়, এসির হিমের মধ্যেও কপালে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
“কোনো প্রমাণ এলো বুঝি?” ঠোঁটে একটা অবর্ণনীয় হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে মেয়েটা, “আমার অবস্থাটা একবার ভাবুন তাহলে, মিস্টার আদক। প্রতি মুহূর্তে এই জিনিসটার সঙ্গে ডিল করতে হয় আমায়! আপনি তখন জিজ্ঞেস করছিলেন না, আমি কোথায় থাকি? আমি আসলে জানি না এর উত্তর। হঠাৎ হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করি এক এক জায়গায়…। জানেন, প্রথম যখন এটা হল… এখনো মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে বেল বাজিয়েছি, মা এসে দরজায় দাঁড়িয়ে খুব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করছে, “কাকে চাই?” তারপর… থাক সেসব কথা। আমার খিদে ঘুম ঠিক মতো কাজ করে না, শরীর ঠিক মতো কাজ করে না। অনেকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছি, পারিনি। শুধু ভেবে দেখুন একবার… সারাজীবন যেসব মানুষকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নিয়ে এসেছেন, একদিন হঠাৎ তারা আপনার কেউ নয়! সম্পূর্ণ ভুলে গেছে আপনাকে… এমন একটা সিনারিও, যেটা আপনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। কী অবস্থা হয় বলুন মনের! অবশ্য তখনও যদি আদৌ মন বলে কোনো বস্তু আর অবশিষ্ট থাকে।”
এতদূর বলে চুপ করে মেয়েটা। জলের গ্লাসে একটা চুমুক দেয় আলতো। আবার বলতে থাকে, “স্যার, আপনি প্লিজ আমার সঙ্গে আর বেশি সময় কাটাবেন না। আসলে আপনার সঙ্গে দেখা করার আমার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ভাবলাম যদি আপনি বাই চান্স আমার আগের দেখা অভিজিৎ আদক হন! বোঝার চেষ্টা করছিলাম আমি একটু সুস্থ হয়েছি কিনা। হইনি। অবশ্য প্রথমবারেই যখন আপনি আমাকে চিনতে পারেননি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম সেটা। তবু কী মনে হল কে জানে! কিন্তু আপনি প্লিজ এবার বাড়ি যান। ধরে নিন কোনোদিনও দেখা হয়নি আপনার আমার সঙ্গে। যা হয়েছে, আস্তে আস্তে কেটে যাবে। সাহস আনুন।”
শেষ কথাগুলো বোধহয় ভালো করে শুনতে পায় না অভিজিৎ অভিজিৎ। যেন একটা ঘোরের মধ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। টাকা মেটানোর কথা মনেও থাকে না। অসংলগ্ন পায়ে বেরিয়ে আসে ক্যাফে ছেড়ে।
“সারাজীবন যেসব মানুষকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নিয়ে এসেছেন, একদিন হঠাৎ তারা আপনার কেউ নয়…” মনের ভেতর যেন কেউ ভাঙা রেকর্ড চালিয়ে দিয়েছে। ঝাপসা হয়ে আসছে কি চারপাশ? ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখ বন্ধ করে নেয় ও।…
***
অস্থিরভাবে বারান্দায় পায়চারি করছিল শরণ্যা। নখ খাচ্ছিল মাঝেমাঝে। ঘন ঘন তাকাচ্ছিল ফোনের স্ক্রিনের দিকে। আচমকা নিজের থেকে জ্বলে ওঠে সেটা। বাজতেও শুরু করে। প্রবল উৎসাহে ফোনটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরে শরণ্যা।
“কী রে! কী খবর?”
“মিশন সাকসেসফুল, শরণ্যাদি!” ও পাশের নারীকণ্ঠ আনন্দোচ্ছল, “বড়োসড়ো ধাক্কা খেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। বিল না মিটিয়েই উঠে গেলেন।”
“মানুষটা চিরকালই খুব গালিবল। উফফ… আমি স্পষ্ট ইম্যাজিন করতে পারছি জানিস… তোর তুখোর অ্যাক্টিং স্কিল, আর ওর ভেবলে যাওয়া মুখ। আচ্ছা… ওই টেকেন ফর গ্র্যান্টেডের ভয়টা ভালো করে মনে ঢুকেছে, কী মনে হল?”
“মনে তো হল!”
“দেখা যাক…! তবে তোর একটা বিরাট ট্রিট প্রাপ্য রে, তনিশা!”
“সেসব তো একদিন হবেই, দি! তবে আমি অবশ্য প্রথম দিকে একটু ছড়িয়েছি। মানে লজিকগুলো ঠিকঠাক সাজাতে পারছিলাম না। কিন্তু তারপর আর সমস্যা হয়নি।”
“আচ্ছা চল রে! ছাড়ি এখন। একটু বাদেই ফিরবে ও।”
“চলো টাটা!”
***
অভিজিতের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই কলকাতায়। মফঃস্বল কয়েকবার দেখেছে বটে, কিন্তু সেটাও অনেক বড়ো হয়ে। কিন্তু এখন বন্ধ চোখের পাতার তলায় যে হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটাকে ছিপ হাতে পুকুরের পাড় ধরে দৌড়াতে দেখছে সে, সেটা যে অভিজিৎ নিজে ছাড়া আর কেউ নয়, সেটা আর বলে দেওয়ার দরকার নেই। ওটা অভিজিতের ছেলেবেলা, যে ছেলেবেলা কখনো আসেনি।
আরো অসংখ্য দৃশ্য খুব তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে। একসঙ্গে হাজার হাজার ছেলেবেলা, যৌবন, এমনকী বার্ধক্য… আলাদা করা যাচ্ছে না একে অন্যের থেকে। অভিজিৎ আদক আসলে কে?
“সারাজীবন যেসব মানুষকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নিয়ে এসেছেন, একদিন হঠাৎ তারা আপনার কেউ নয়…”
ও নিশ্চিত, যেটাকে নিজের বাড়ি বলে ও জানে সেখানে ফিরলে শরণ্যা ওকে আর চিনতে পারবে না। কোনো প্রকাশক আর ওকে দিয়ে কিছু সই করানোর জন্য অপেক্ষা করছেন। কিংবা হয়তো পারবে, কিন্তু সে কি এই অভিজিৎ? আচ্ছা… শরণ্যাও কি…? হতেও পারে! বিগত কয়েক বছরে যেন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে ওর।
নাহ্! আর বাড়ি ফেরা হবে না। সেই বাচ্চা ছেলেটা পুকুরের পাড়ে শান্ত হয়ে বসেছে ছিপ ফেলে। ফাতনার ওপর কেবল এসে বসছে একটা জলফড়িং। ফাতনা শব্দটা আগে কোনোদিন শোনেনি অভিজিৎ…। পুকুরের পাড়ে মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে সে। তারপর আবার হাঁটা লাগায়।
কোথায় চলেছে অভিজিৎ, কে জানে!
Tags: গল্প, মোহনা দেবরায়, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
ফাটাফাটি লেখা! পড়ে একই সঙ্গে মোহিত আর শিহরিত— দুই-ই হলাম।